জিন-কফিল

জিন-কফিল

জায়গাটার নাম ধুন্দুল নাড়া।

নাম যেমন অদ্ভুত, জায়গাও তেমন জঙ্গুলে। একবার গিয়ে পৌঁছলে মনে হবে সভ্যসমাজের বাইরে চলে এসেছি। সেখানে যাবার ব্যবস্থাটা বলি—প্রথমে যেতে হবে ঠাকরোকোণা। ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ ব্রাঞ্চ-লাইনের ছোট্ট স্টেশন। ঠাকরোকোণা থেকে গয়নার নৌকা যায় হাতির বাজার পর্যন্ত। যেতে হবে হাতির বাজারে। ভাগ্য ভালো হলে হাতির বাজারে কেরায়া নৌকা পাওয়া যাবে। যদি পাওয়া যায় সেই নৌকায় শিয়ালজানি খাল ধরে মাইল দশেক উত্তরে যেতে হবে। বাকি পথ পায়ে হেঁটে পেরুতে হবে মাঠ, ডোবা, জলাভূমি। জুতো খুলে হাতে নিয়ে নিতে হবে। পা কাটবে ভাঙা শামুকে। গোটা বিশেক জোঁক ধরবে। বিশ্রী অবস্থা! কতটা হাঁটতে হবে তারও অনুমান নেই। একেক জন একেক কথা বলবে। একটা সময় আসবে যখন লোকজন হাসিমুখে বলবে—ধুন্দুল নাড়া? ঐ তো দেখা যায়। তখন বুঝতে হবে আরো মাইল সাতেক বাকি।

বছর পাঁচেক আগে এই জঙ্গুলে জায়গায় আমাকে জনৈক সাধুর সন্ধানে যেতে হয়েছিল। সাধুর নাম—কালু খাঁ। মুসলমান নাম হলেও সাধু হিন্দু ব্রাহ্মণ। বাবা-মা তাঁকে শৈশবেই পরিত্যাগ করেন। তিনি মানুষ হন মুসলিম পরিবারে। কালু খাঁ নাম তাঁর মুসলমান পালক বাবার দেওয়া। যৌবনে তিনি সংসারত্যাগী হয়ে শ্মশানে আশ্রয় নেন। তাঁর অসাধারণ ক্ষমতা, বিভূতির কোনো সীমাসংখ্যা নেই। তিনি কোনোরকম খাদ্য গ্রহণ করেন না। তাঁর গা থেকে সবসময় কাঁঠালচাঁপা ফুলের তীব্র গন্ধ বের হয়। পূর্ণিমার সময় সেই গন্ধ এত তীব্র হয় যে, কাছে গেলে বমি এসে যায়। নাকে রুমাল চেপে কাছে যেতে হয়।

সাধু-সন্ন্যাসী, তাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা এইসব নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাই না। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি—ব্যাখ্যার অতীত কোনো ক্ষমতা প্রকৃতি মানুষকে দেয় নি। কোনো সাধু যদি আমার চোখের সামনে শূন্যে ভাসতে থাকেন, আমি চমৎকৃত হব না। ধরে নেব এর পিছনে আছে ম্যাজিকের সহজ কিছু কলাকৌশল, যা এই সাধু আয়ত্ত করেছেন। কাজেই আমার পক্ষে সাধুর খোঁজে ‘ধুন্দুল নাড়া’ নামের অজ পাড়াগাঁয় যাবার প্রশ্নই আসে না। যেতে হয়েছিল সফিকের কারণে।

সফিক আমার বাল্যবন্ধু। সে বিশ্বাস করে না এমন জিনিস নেই। ভূত-প্রেত থেকে সাধু-সন্ন্যাসী সবকিছুতেই তার অসীম বিশ্বাস। বিংশ শতাব্দীর মানুষ হয়েও সে বিশ্বাস করে যে, সাপের মাথায় মণি আছে। কৃষ্ণপক্ষের রাতে এই মণি সে উগরে ফেলে। চারদিক আলো হয়ে যায়। আলোয় আকৃষ্ট হয়ে পোকা-মাকড় আসে। সাপ তাদের ধরে-ধরে খায়। ভোজনপর্ব শেষ হলে মণিটি আবার গিলে ফেলে।

সাধু কালু খাঁর খবর সফিকই নিয়ে এল এবং এমন ভাব করতে লাগল যে, অবতারের সন্ধান পেয়ে গেছে—যে-অবতারের সঙ্গে দেখা না হলে জীবন বৃথা।

আমি সফিকের সঙ্গে রওনা হলাম দু’টি কারণে—এক, সফিককে আমি অত্যন্ত পছন্দ করি। তাকে একা-একা ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না; দুই, সাধু খোঁজা উপলক্ষে গ্রামের দিকে খানিকটা হলেও ঘোরা হবে। মাঝে-মাঝে এ-রকম ঘুরে বেড়াতে মন্দ লাগে না। নিজেকে পরিব্রাজক -পরিব্রাজক মনে হয়। যেন আমি ফা’হিয়েন। বাংলার পথে-পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

খুব আগ্রহ নিয়ে রওনা হলেও আগ্রহ হাতির বাজারে পৌঁছবার আগেই শেষ হয়ে গেল। অমানুষিক পরিশ্রম হল। হাতির বাজার থেকে যে-কেরায়া নৌকা নিলাম সে-নৌকাও এখন ডোবে তখন ডোবে অবস্থা। নৌকার পাটাতনের ফুটো দিয়ে বিজবিজ করে পানি উঠছে। সারাক্ষণ সেই পানি সেঁচতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সফিকের মতো পাগলেরও ধৈর্যচ্যুতি হল। কয়েক বার বলল, ‘বিরাট বোকামি হয়েছে। গ্রেট মিসটেক। এর চেয়ে কঙ্গো নদীর উৎস বের করা সহজ ছিল।’

আমি বললাম, ‘এখনো সময় আছে। ফিরে যাবি কি না বল্।’

‘আরে না। এতদূর এসে ফিরে যাব মানে। ভালো জিনিসের জন্যে কষ্ট করতেই হবে। জাস্ট চিন্তা করে দেখ—একজন মানুষের গা থেকে ভুরভুর করে কাঁঠালচাঁপা ফুলের গন্ধ বেরুচ্ছে। ভাবতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে। হাউ এক্সাইটিং!’

সন্ধ্যার পরপর ধুন্দুল নাড়া গ্রামে উপস্থিত হলাম। কাদায় পানিতে মাখামাখি। তিন বার বৃষ্টিতে ভিজেছি। ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় জীবন বের হবার উপক্রম। বিদেশি মানুষ দেখলেই গ্রামের লোকজন সাধারণত খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে। এইখানে উল্টো নিয়ম দেখলাম। আমাদের ব্যাপারে কারো কোনো আগ্রহ নেই। কোত্থেকে এসেছি? যাবো কোথায়? দায়িত্ব পালন করার ভঙ্গিতে এইটুকু জিজ্ঞেস করেই সবাই চলে যাচ্ছে। এ কী যন্ত্রণা!

সাধু কালু খাঁ-কে দেখেও খুব হতাশ হতে হল। বদ্ধ উন্মাদ একজন মানুষ। শ্মশানে একটা পাকুড় গাছের নিচে ন্যাংটো অবস্থায় বসা। আমাদের দেখেই গালাগালি শুরু করল। গালাগালি যে এত নোংরা হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমাকে এবং সফিককে কালু খাঁ সবচেয়ে ভদ্র কথা যা বলল তা হচ্ছে, ‘বাড়িত্ যা। বাড়িত্ গিয়া খাবলাইয়া-খাবলাইয়া গু খা।’

আমি হতভম্ব। ব্যাটা বলে কী!

সফিকের দিকে তাকালাম। সে ভাব-গদগদ স্বরে বলল, ‘লোকটার ভেতর জিনিস আছে বলে মনে হচ্ছে।’

আমি বললাম, ‘কী করে বুঝলি? আমাদের গু খেতে বলেছে, এই জন্যে?’

‘আরে না। সে আমাদের এড়াতে চাচ্ছে। মানুষের সংসর্গ পছন্দ নয়। মানুষের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার এটা সহজ টেকনিক।’

‘লোকটা যে বদ্ধ উন্মাদ, তা তোর মনে হচ্ছে না?’

‘তাও মনে হচ্ছে। তবে একটা প্রবাবিলিটি আছে যে, সে উন্মাদ না।

গ্রামের কয়েক জন বয়স্ক মানুষ আমাদের সঙ্গে আছেন। সাধুর প্রতি তাঁদের ভক্তিশ্রদ্ধাও সফিকের মতোই। তাঁদের একজন বললেন, ‘বাবার মাথা এখন একটু গরম।’

আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ‘মাথা ঠাণ্ডা হবে কখন?’

‘ঠিক নাই। চাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ।’

‘চাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ মানে?’

‘অমাবস্যা-পূর্ণিমায় মাথা গরম থাকে।’

এই ব্যাপারেও মতভেদ দেখা গেল। একজন বলল, ‘অমাবস্যা-পূর্ণিামাতেই মাথাটা ঠাণ্ডা থাকে। অন্য সময় গরম। বাবার কাছে মাসের পর মাস পড়ে থাকতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় কখন বাবার মাথা ঠাণ্ডা হবে।’

আমি বললাম, ‘সফিক, বাবার গা থেকে ফুলের গন্ধ তো কিছু পাচ্ছি না। আমাদের যে-দ্রব্য খেতে বলছিল তার গন্ধ পাচ্ছি। তুই কি পাচ্ছিস?’

সফিক জবাব দেবার আগেই আমাদের সঙ্গী মানুষের একজন ভীত গলায় বলল, ‘একটু দূরে যান। বাবা অখন ঢিল মারব। আইজ মনে হইতাছে বাবার মিজাজ বেশি খারাপ।’

কথা শেষ হবার আগেই ঢিলবৃষ্টি শুরু হল। দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেলাম। বাবার কাণ্ডকারখানায় সফিকের অবশ্যি মোহভঙ্গ হল না। সে বেশ উৎসাহের সঙ্গেই বলল, ‘দুটো দিন থেকে দেখি। এতদূর থেকে আসা। ভালো-মতো পরীক্ষা না-করে চলে যাওয়াটা ঠিক হবে না।’

‘আর কী পরীক্ষা করবি?’

‘মানে ওনার মাথা যখন ঠাণ্ডা হবে তখন দু’-একটা কথাটথা জিজ্ঞেস করলে…’

আমি হাল ছেড়ে দেওয়া গলায় বললাম, ‘থাকবি কোথায়?’

‘স্কুলঘরে শুয়ে থাকব। খানিকটা কষ্ট হবে। কী আর করা! কষ্ট বিনে কেষ্ট মেলে না।’

জানা গেল এই গ্রামে কোনো স্কুল নেই। পাশের গ্রামে প্রাইমারি স্কুল আছে—এখান থেকে ছ’ মাইলের পথ। তবে গ্রামে পাকা মসজিদ আছে। অতিথি মোসাফির এলে মসজিদে থাকে। মসজিদের পাশেই ইমাম সাহেব আছেন। তিনি অতিথিদের খোঁজখবর করেন। প্রয়োজনে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

আমি খুব একটা উৎসাহ বোধ করলাম না। গ্রামের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইমাম সাহেব লোক কেমন?’

সে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে দার্শনিকের মতো বলল, ‘ভালোয়-মন্দয় মিলাইয়া মানুষ। কিছু ভালো, কিছু মন্দ।’

এই উত্তরও আমার কাছে খুব সন্দেহজনক মনে হল। উপায় নেই। আকাশে আবার মেঘ জমতে শুরু করেছে। রওনা হলাম মসজিদের দিকে। গ্রামের লোকগুলো অভদ্রের চূড়ান্ত। কেউ সঙ্গে এল না। কীভাবে যেতে হবে বলেই ভাবল আমাদের জন্যে অনেক করা হয়েছে।

.

মসজিদ খুঁজে বের করতেও অনেক সময় লাগল।

অন্ধকার রাত। পথঘাট কিছুই চিনি না। সঙ্গে টর্চলাইট ছিল—বৃষ্টিতে ভিজে সেই টর্চলাইটও কাজ করছে না। অন্ধের মতো এগুতে হচ্ছে। যাকেই জিজ্ঞেস করি সে-ই খানিকটা জেরা করে—’জুম্মাঘরে যাইতে চান ক্যান? কার কাছে যাইবেন? আপনের পরিচয়?’

শেষ পর্যন্ত মসজিদ পাওয়া গেল। গ্রামের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা খালের পাশে মসজিদ। মসজিদের বয়স খুব কম হলেও দু’ শ’ বছরের কম হবে না। বিশাল স্তূপের মতো একটা ব্যাপার। সেই স্তূপের সবটাই শ্যাওলায় ঢাকা। গা বেয়ে উঠেছে বটগাছ। সব মিলিয়ে কেমন গা-ছমছমানি ব্যাপার আছে।

আমাদের সাড়াশব্দ পেয়ে হারিকেন হাতে ইমাম সাহেব চলে এলেন। ছোটখাটো মানুষ। খালি গা। কাঁধে গামছা চাদরের মতো জড়ানো। বয়স চল্লিশের মতো হবে। দাড়িতে তাকে খানিকটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো দেখাচ্ছে। আমার ধারণা ছিল মসজিদে রাত্রি যাপন করব শুনে তিনি বিরক্ত হবেন। হল উল্টোটা। তাঁকে আনন্দিত মনে হল। নিজেই বালতি করে পানি এনে দিলেন। গামছা আনলেন। দু’ জোড়া খড়ম নিয়ে এলেন। সফিক বলল, ‘ভাই, আমাদের খাওয়াদাওয়া দরকার। সারাদিন উপোস। টাকাপয়সা নিয়ে যদি খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।’

ইমাম সাহেব বললেন, ‘ব্যবস্থা হবে জনাব। আমার বাড়িতেই গরিবি হালতে ডালভাতের ব্যবস্থা।’

‘নাম কি আপনার?’

‘মুনশি এরতাজউদ্দিন।’

‘থাকেন কোথায়, আশেপাশেই?’

‘মসজিদের পিছনে—ছোট্ট একটা টিনের ঘর আছে।’

‘কে কে থাকেন?’

‘আমার স্ত্রী, আর কেউ না।’

‘ছেলেমেয়ে?’

ছেলেমেয়ে নাই জনাব। আল্লাহ্পাক সন্তান দিয়েছিলেন, তাদের হায়াত দেন নাই। হায়াত-মউত সবই আল্লাহ্পাকের হাতে। আপনারা হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করেন, আমি আসতেছি।’

ভদ্রলোক ছোট-ছোট পা ফেলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সফিক বলল, ‘ইমাম সাহেবকে নিতান্ত ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে। মাই ডিয়ার টাইপ। মনে হচ্ছে আমাদের দেখে খুশি হয়েছেন।’

আমি বললাম, ‘ভদ্রলোক জঙ্গুলে জায়গায় একা পড়ে আছেন—আমাদের দেখে সেই কারণেই খুশি। এই মসজিদে নামাজ পড়তে কেউ আসে বলে আমার মনে হয় না।’

‘বুঝলি কি করে?’

‘লোকজনের যাতায়াত থাকলে পায়ে চলার পথ থাকত। পথ দেখলাম না।’

সফিক হাসতে হাসতে বলল, ‘মিসির আলির সঙ্গে থেকে-থেকে তোর অবজারভেশন পাওয়ার বেড়েছে বলে মনে হয়।’

‘কিছুটা তো বেড়েছেই। ইমাম সাহেব আমাদের বসিয়ে রেখে যে চলে গেলেন, কী নিয়ে ফিরবেন জানিস?’

‘কী নিয়ে?’

‘দু’ হাতে দুটো কাটা ডাব নিয়ে।’

‘এই তোর অনুমান?’

আমি হাসিমুখে বললাম, ‘মিসির আলি থাকলে এই অনুমানই করতেন। অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে গ্রামে প্রচুর ডাব গাছ। অতিথিদের ডাব দেওয়া সনাতন রীতি।’

‘লজিক তো ভালোই মনে হচ্ছে।’

আমার লজিক ভুল প্রমাণ করে মুনশি এরতাজউদ্দিন ট্রে হাতে উপস্থিত হলেন। ট্রেতে দু’ কাপ চা। একবাটি তেল-মরিচ মাথা মুড়ি। এই অতি পাড়াগাঁ জায়গায় অভাবনীয় ব্যাপার তো বটেই। মফস্বলের চা অতিরিক্ত গরম, অতিরিক্ত মিষ্টি এবং অতিরিক্ত কড়া হয়। তবু চা হচ্ছে চা। চব্বিশ ঘন্টা পর প্রথম চায়ে চুমুক দিলাম, মনটা ভালো হয়ে গেল। চমৎকার চা। বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘চা কে বানিয়েছে? আপনার স্ত্রী?’

ইমাম সাহেব লাজুক মুখে বললেন, ‘জ্বি। তার চায়ের অভ্যাস আছে। শহরের মেয়ে। আমার শ্বশুরসাহেব হচ্ছেন নেত্রকোণার বিশিষ্ট মোক্তার মমতাজউদ্দিন। নাম শুনেছেন বোধহয়।’

আমরা এমন ভঙ্গি করলাম যে নামটা আমাদের কাছে অপরিচিতি নয়, আগে অনেক বার শুনেছি।

ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি চা খাই না। আমার স্ত্রীর চায়ের অভ্যাস আছে। শহর থেকে ভালো চায়ের পাতা এনে দিতে হয়। বিরাট খরচান্ত ব্যাপার।

‘আপনি কি ইমামতি ছাড়া আর কিছু করেন?’

‘জ্বি-না। সামান্য জমিজমা আছে। আধি দেই। আমার শ্বশুর সাহেব তাঁর মেয়ের নামে নেত্রকোণা শহরে একটা ফার্মেসি দিয়েছেন—সানরাইজ ফার্মেসি। তার আয় মাসে-মাসে আসে। রিজিকের মালিক আল্লাহ্পাক। তাঁর ইচ্ছায় চলে যায়।’

‘ভালো চলে বলেই তো মনে হচ্ছে।’

‘জ্বি জনাব, ভালোই চলে। সংসার ছোট। ছেলেপুলে নাই।’

এশার নামাজের সময় হয়ে গিয়েছিল। ইমামসাহেব আজান দিয়ে নামাজ পড়তে গেলেন। কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তিকে নামাজে আসতে দেখলাম না। ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করে জানলাম—লোক এমনিতেই হত না। দু’ বছর ধরে একেবারেই হচ্ছে না। শুধু জুমাবারে কিছু মুসুল্লি আসেন।

লোকজন না-হওয়ার কারণও বিচিত্র। মসজিদ সম্পর্কে গুজব রটে গেছে, এখানে জিন থাকে। নাপাক অবস্থায় নামাজ পড়লে জিন তার সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়।। নানান ধরনের যন্ত্রণা করে।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘জিন কি সত্যি-সত্যি আছে?’

‘অবশ্যই আছে। আল্লাহ্পাক কোরান মজিদে বলেছেন। একটা সুরা আছে— সুরায়ে জিন।’

‘সেই কথা জিজ্ঞেস করছি না—জানতে চাচ্ছি জিন গিয়ে বিরক্ত করে এটা সত্যি কিনা?’

‘জ্বি জনাব, সত্য। তবে লোকজন জিনের ভয়ে মসজিদে আসে না—এটা ঠিক না, আসলে সাপের ভয়ে আসে না।’

‘সাপের ভয়ে আসে না! কী বলছেন আপনি?’

‘একবার নামাজের মাঝখানে সাপ বের হয়ে গেল। দাঁড়াস সাপ। অবশ্য কাউকে কামড়ায় নাই। বাস্তুসাপ কামড়ায় না। মাঝেমধ্যে ভয় দেখায়।’

সফিক আঁৎকে উঠে বলল, ‘মাই গড! যখন-তখন সাপ বের হলে এইখানে থাকব কীভাবে?’

‘ভয়ের কিছু নাই। কার্বলিক এসিড ছড়ায়ে দিব।

‘কার্বলিক এসিড আছে?’

‘জ্বি। নেত্রকোণার ফার্মেসি থেকে তিন বোতল নিয়ে আসছি। আমার স্ত্রীরও খুব সাপের ভয়। এই অঞ্চলে সাপখোপ একটু বেশি।

মসজিদের সামনে উঁচু চাতালমতো জায়গায় বসে আছি। সাপের ভয়ে খানিকটা আতঙ্কগ্রস্ত। আকাশে মেঘ ডাকছে। বড় ধরনের বর্ষণ মনে হচ্ছে আসন্ন। ইমাম সাহেব বললেন, ‘খাওয়া দিতে একটু দেরি হবে। আমার স্ত্রী সব একা করছে—লোকজন নাই।’

‘ভাব দেখে মনে হচ্ছে—বিরাট আয়োজন।’

‘জ্বি-না, আয়োজন কিছু না, দরিদ্র মানুষ। আপনারা এসেছেন শুনে আমার স্ত্রী খুব খুশি। কেউ আসে না। আমি বলতে গেলে একা থাকি। সবাই আমাকে ভয় করে।’

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘কেন?’

‘সবার একটা ধারণা হয়েছে আমি জিন পুষি। জিনদের দিয়ে কাজকর্ম করাই…..’

‘বলেন কী!’

‘সত্য না জনাব। তবে মানুষ অসত্যকে সহজে বিশ্বাস করে। অসত্য বিশ্বাস করা সহজ, কারণ শয়তান অসত্য বিশ্বাসে সাহায্য করে।’

ইমাম সাহেব বেশ মন খারাপ করে চুপ হয়ে গেলেন। প্রসঙ্গ পান্টাবার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সাধু কালু খাঁ সম্পর্কে কী জানেন?’

ইমাম সাহেব বললেন, ‘তেমন কিছু জানি না। তবে আপনাদের মতো দূর-দূর থেকে ওনার কাছে লোকজন আসে—এইটা দেখেছি। বিশিষ্ট ভদ্রলোকরাই আসে বেশি। ময়মনসিংহের ডি. সি. সাহেব ওনার পত্নীকে নিয়ে এসেছিলেন।

‘ওনার ক্ষমতাটমতা কিছু আছে?’

‘মনে হয় না। কুৎসিত গালাগালি করেন। কামেল মানুষের এই রকম গালিগালাজ করার কথা না। তা ছাড়া কালু খাঁর কারণে অনেক বেদাতী কাণ্ডকারখানা হয়। এইগুলাও ঠিক না।’

‘কী কাণ্ডকারখানা হয়?’

‘উনি নগ্ন থাকেন। এইজন্য অনেকের ধারণা নগ্ন অবস্থায় তাঁর কাছে গেলে তাঁর মেজাজ ঠিক থাকে। অনেকেই নগ্ন অবস্থায় যান।’

‘সে কী।’

‘উনি পাগলমানুষ। সমস্যার কারণে যাঁরা তাঁর কাছে আসেন তাঁরাও এক অর্থে পাগল। পাগলমানুষের কাজকর্ম তো এই রকমই হয়। সমস্যা হলে তার পরিত্রাণের জন্য আল্লাহ্পাকের দরবারে কান্নাকাটি করতে হয়। মানুষ তা করে না, সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-ফকির খোঁজে।’

ইমাম সাহেবের কথাবার্তায় আমি অবাক হলাম। পরিষ্কার চিন্তা-ভাবনা। গ্রাম্য মসজিদের ইমামের কাছ থেকে এমন যুক্তিনির্ভর কথা আশা করা যায় না। লোকটির প্রতি আমার একধরনের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হল। তা ছাড়া ভদ্রলোকের আচার-আচরণেও সহজ সারল্য আছে, যে-সারল্যের দেখা সচরাচর পাওয়া যায় না।

রাত ন’টার দিকে ইমাম সাহেব বললেন, ‘চলেন যাই, খানা বোধহয় এর মধ্যে তৈরি হয়েছে। ডাল-ভাত-এর বেশি কিছু না। নিজ গুণে ক্ষমা করে চারটা মুখে দিবেন।’

ইমাম সাহেবের বাড়িটা ছোট্ট টিনের দু’-কামরার বাড়ি। একচিলতে উঠোন। বাড়ির চারদিকে দর্মার বেড়া। আমাদের ঘরে নিয়ে বসানো হল। মেঝেতে শতরঞ্জি বিছানো। থালা-বাসন সাজানো। আমরা সঙ্গে-সঙ্গে খেতে বসে গেলাম। খাবারের আয়োজন অল্প হলেও ভালো। সব্জি, ছোটো মাছের তরকারি, ডাল এবং টকজাতীয় একটা খাবার। ইমাম সাহেব আমাদের সঙ্গে বসলেন না। খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন। খাবারের শেষ পর্যায়ে আমাদের অবাক করে দিয়ে ইমাম সাহেবের স্ত্রী ঘরে ঢুকলেন, এবং শিশুর মতো কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ব্যাপারটা এত আচমকা ঘটল যে আমি বেশ হকচকিয়েই গেলাম। অজ পাড়াগাঁয়ে এটা অভাবনীয়। কঠিন পর্দাপ্রথাই আশা করেছিলাম। আমি খানিকটা সংকুচিত হয়েই রইলাম। ইমাম সাহেবকেও দেখলাম খুব অপ্রস্তুত বোধ করছেন।

সফিক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কেমন আছেন?’

ইমাম সাহেবের স্ত্রী সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘ভালো নাই। আমার সঙ্গে একটা জিন থাকে। জ্বিনটার নাম কফিল। কফিল আমারে খুব ত্যক্ত করে।’

সফিক হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আপনি কী বললেন, বুঝলাম না।’

মেয়েটি যন্ত্রের মতো বলল, ‘আমার সঙ্গে একটা জিন থাকে। জ্বিনটার নাম কফিল। কফিল আমারে বড় যন্ত্রণা করে।

সফিক অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। আমি নিজেও বিস্মিত। ব্যাপার কী কিছু বুঝতে পারছি না। ইমাম সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন—’লতিফা, তুমি একটু ভিতরে যাও।’

ভদ্রমহিলা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, ‘ক্যান? ভিতরে ক্যান? থাকলে কী অসুবিধা?’

‘ওনাদের সঙ্গে কিছু কথা বলব। তুমি না থাকলে ভালো হয়। সব কথা মেয়েছেলেদের শোনা উচিত না।’

লতিফা তীব্র চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। খাওয়া বন্ধ করে আমরা হাত গুটিয়ে বসে রইলাম। এ কী সমস্যা!

লতিফা মেয়েটি রূপবতী। শুধু রূপবতী নয়, চোখে পড়ার মতো রূপবতী। হালকা-পাতলা শরীর। ধবধবে ফরসা গায়ের রঙ। লম্বাটে স্নিগ্ধ মুখ। বয়সও খুব কম মনে হচ্ছে। দেখাচ্ছে আঠার-উনিশ বছরের তরুণীর মতো। এত কম বয়স তার নিশ্চয় নয়। যার স্বামীর বয়স চল্লিশের কাছাকাছি তার বয়স আঠার-উনিশ হতে পারে না। আরো একটি লক্ষ করার মতো ব্যাপার হল—মেয়েটি সাজগোজ করেছে। চুল বেঁধেছে, চোখে কাজল দিয়েছে—কপালে লাল রঙের টিপ। গ্রামের মেয়েরা কপালে টিপ দেয় বলে ও জানতাম না।

ইমাম সাহেব আবার বললেন, ‘লতিফা, ভিতরে যাও।’

মেয়েটি উঠে চলে গেল।

ইমাম সাহেব গলার স্বর নিচু করে বললেন, ‘লতিফার মাথা পুরাপুরি ঠিক না। ওর দুটো সন্তান নষ্ট হয়েছে। তারপর থেকে এ-রকম। তার ব্যবহারে আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমি তার হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। কিছু মনে করবেন না।—আল্লাহ্র দোহাই।’

আমি বললাম, ‘কিছুই মনে করি নি। তা ছাড়া মনে করার মতো কিছু তো উনি করেন নি।

ইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘জিনের কারণে এ-রকম করে। জিনটা তার সঙ্গে-সঙ্গে আছে। মাঝে-মাঝে মাসখানিকের জন্য চলে যায়। তখন ভালো থাকে। গত এক মাস ধরে তার সাথে আছে।’

‘আপনি এ-সব বিশ্বাস করেন?

‘বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস না-করার তো কিছু নাই। বাতাস আমরা চোখে দেখি না, কিন্তু বাতাস বিশ্বাস করি। কারণ বাতাসের নানান আলামত দেখি। সেই রকম জিন কফিলেরও নানান আলামত দেখি।’

‘কী দেখেন?’

‘জিন যখন সঙ্গে থাকে, তখন লতিফা খুব সাজগোজ করে। কথায়-কথায় হাসে, কথায়-কথায় কাঁদে।’

‘জিন তাড়াবার ব্যবস্থা করেন নি?’

‘করেছি। লাভ হয় নাই। কফিল খুব শক্ত জিন। দীর্ঘদিন লতিফার সঙ্গে আছে। প্রথম সন্তান যখন গর্ভে আসল তখন থেকেই কফিল আছে।’

‘জিন চায় কী?’

ইমাম সাহেব মাথা নিচু করে রইলেন। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কোনো কারণে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হল—জিন বোধহয় লতিফা মেয়েটিকেই স্ত্রী হিসেবে চায়। বিংশ শতাব্দীতে এই ধরনের চিন্তা মাথায় আসছে দেখে আমি নিজের ওপরও বিরক্ত হলাম। ইমাম সাহেব বললেন, ‘এই জিনটা আমার দুইটা বাচ্চা মেরে ফেলেছে। আবার যদি বাচ্চা হয় তারেও মারবে। বড় মনকষ্টে আছি জনাব। দিন-রাত আল্লাহ্পাকেরে ডাকি। আমি গুনাগার মানুষ, আল্লাহ্পাক আমার কথা শুনেন না।’

‘আপনার স্ত্রীকে কোনো ডাক্তার দেখিয়েছেন?’

‘ডাক্তার কী করবে? ডাক্তারের কোনো বিষয় না। জিনের ওষুধ ডাক্তারের কাছে নাই।।’

‘তবু একবার দেখালে হত না?’

‘আমার শ্বশুরসাহেব দেখিয়েছিলেন। একবার লতিফাকে বাপের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম। শ্বশুরসাহেব তারে ঢাকা নিয়ে গেলেন। চিকিৎসাটিকিৎসা করালেন। লাভ হল না।’

বারান্দা থেকে গুনগুন শব্দ আসছে। উৎকর্ণ হয়ে রইলাম—খুবই মিষ্টি গলায় টেনে টেনে গান হচ্ছে—যার কথাগুলোর বেশির ভাগই অস্পষ্ট। মাঝে-মাঝে দু’-একটা লাইন বোঝা যায়, যার কোনো অর্থ নেই। যেমনঃ

‘এতে না দেহে না দেহে না এতে না।’

ইমাম সাহেব উঁচু গলায় বললেন, ‘লতিফা, চুপ কর। চুপ কর বললাম।’

গান থামিয়ে লতিফা বলল, ‘তুই চুপ কর্। তুই থাম্ শুয়োরের বাচ্চা।’

অবিকল পুরুষের ভারি গলা। আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। সেই পুরুষকণ্ঠ থমথমে স্বরে বলল, ‘চুপ কইরা থাকবি। একটা কথা কইলে টান দিয়া মাথা আলগা করুম। শ‍ইল থাকব একখানে মাথা আরেকখানে। শুয়োরের বাচ্চা আমারে চুপ করতে কয়।’

আমরা হাত ধুয়ে উঠে পড়লাম। এত কাণ্ডের পর খাওয়াদাওয়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এ-জাতীয় যন্ত্রণায় পড়ব, কখনো ভাবি নি।

সফিক নিচু গলায় বলল, ‘বিরাট সমস্যা হয়ে গেল দেখি। ভয়ভয় লাগছে। কী করা যায় বল্ তো?’

মসজিদের ভেতর এর আগে কখনো রাত্রি যাপন করি নি। অস্বস্তি নিয়ে ঘুমুতে গেলাম। কেমন যেন দম-বন্ধ দম-বন্ধ লাগছে। মসজিদের একটামাত্র দরজা—সেটি পেছন দিকে। ভেতরে গুমোট ভাব। ইমাম সাহেব যত্নের চূড়ান্ত করেছেন। স্ত্রীর অস্বাভাবিক আচরণজনিত লজ্জা হয়তো-বা ঢাকার চেষ্টা করেছেন। আমাদের জন্যে দুটো শীতল পাটি, পাটির চারপাশে কার্বলিক এসিড ছড়ানো হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা—দুটো মশারি খাটানো হয়েছে।

ইমাম সাহেব বললেন, ‘ভয়ের কিছু নাই। হারিকেন জ্বালানো থাকবে। আলোতে সাপ আসে না। দরজা বন্ধ। সাপ ঢোকারও পথ নাই।’

আমি খুব, যে ভরসা পাচ্ছি, তা নয়। চৌকি এনে ঘুমুতে পারলে হত। মসজিদের ভেতর চৌকি পেতে শোয়া–ভাবাই যায় না।

সফিকের হচ্ছে ইচ্ছাঘুম। শোয়ামাত্র নাক ডাকতে শুরু করেছে। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। মসজিদের ভেতর আগরবাতির গন্ধ। যে-গন্ধ সবসময় মৃত্যুকে মনে করিয়ে দেয়। সব মিলিয়ে গা ছমছমানো ব্যাপার।

আমি ইমাম সাহেবকে বললাম, ‘আপনি চলে যান, আপনি এখানে বসে আছেন কেন? আপনার স্ত্রী একা। তাঁর শরীরও ভালো না।’

ইমাম সাহেব বললেন, ‘আমি মসজিদেই থাকব। এবাদত-বন্দেগি করব। ফজরের নামাজ শেষ করে বাসায় গিয়ে ঘুমুব।’

‘কেন?’

‘লতিফা এখন আমাকে দেখলে উন্মাদের মতো হয়ে যাবে। মেঝেতে মাথা ঠুকবে।’

‘কেন?’

‘ওর দোষ নাই কিছু। সঙ্গে জিন আছে—কফিল। এই জিনই সবকিছু করায়। বেচারির কোনো দোষ নাই।’

আমি চুপ করে রইলাম। ইমাম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘এমনিতে তেমন উপদ্রব করে না। সন্তানসম্ভবা হলেই কফিল ভয়ংকর যন্ত্রণা করে। বাচ্চাটা মেরে না-ফেলা পর্যন্ত থামে না। দুইটা বাচ্চা মেরেছে—এইটাও মারবে।’

‘আপনার স্ত্রী কি সন্তানসম্ভবা?’

‘জ্বি।’

‘আপনি কি নিশ্চিত যে পুরো ব্যাপারটা জিন করছে, অন্য কিছু না?’

‘জ্বি, নিশ্চিত। জিনের সঙ্গে আমার মাঝেমধ্যে কথা হয়।’

‘অবিশ্বাস্য সব কথাবার্তা বলছেন আপনি।’

‘অবিশ্বাসের কিছু নাই। একদিনের ঘটনা বলি—তাহলে বুঝবেন। ভাদ্র মাস। খুব গরম। একটা ভেজা গামছা শরীরে জড়ায়ে এশার নামাজে দাঁড় হয়েছি। মসজিদে আমি একা। আমি ছাড়া আর কেউ নাই। হঠাৎ দপ করে হারিকেনটা নিভে গেল। চমকে উঠলাম।। তারপর শুনি মসজিদের পিছনের দরজার কাছে ধুপ-ধুপ শব্দ। খুব ভয় লাগল। নামাজ ছেড়ে উঠতে পারি না। নামাজে মনও দিতে পারি না। কিছুক্ষণ পরপর পিছনের দরজায় ধুপধুপ শব্দ। যেন কেউ কিছু একটা এনে ফেলছে। সেজদায় যাবার সময় কফিলের গলা শুনলাম—টেনে-টেনে বলল, ‘তোরে আইজ পুড়াইয়া মারব। তোরে আইজ পুড়াইয়া মারব।’ তারপর ধপ করে আগুন জ্বলে উঠল। দাউদাউ আগুন। নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দেখি দরজার কাছে গাদা করা শুকনা লাকড়ি। আগুন জ্বলছে। আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম—বাঁচাও, বাঁচাও! আমার চিৎকার শুনে লতিফা পানির বালতি হাতে ছুটে আসল। পানি দিয়ে আগুন নিভায়ে আমারে মসজিদ থেকে টেনে বার করল। আমার স্ত্রীর কারণে সেই যাত্রা বেঁচে গেলাম। লতিফা সময়মতো না আসলে মারা পড়তাম।’

‘জিন মসজিদের ভেতরে ঢুকল না কেন?’

‘খারাপ ধরনের জ্বীন। আল্লাহ্র ঘরে এরা ঢুকতে পারে না। আমি এই জন্যই বেশির ভাগ সময় মসজিদে থাকি। মসজিদে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে পারি। ঘরে পারি না।’

‘কফিল আপনাকে খুন করতে চায়?’

‘তাও ঠিক না—একবারই চেয়েছিল। তারপর আর চায় নাই।’

‘খুন করতে চেয়েছিল কেন?’

ইমাম সাহেব চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, ‘আপনার যদি আপত্তি না থাকে পুরো ঘটনাটা বলুন। আপত্তি থাকলে বলার দরকার নেই।’

‘না, আপত্তির কী আছে? আপত্তির কিছু নাই। আমি লতিফার অবস্থা একটু দেখে আসি।’

‘যান, দেখে আসুন।’

ইমাম সাহেব চলে গেলেন। আমি ভয়ে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভূত, প্রেত, জিন, পরী কখনো বিশ্বাস করি নি—এখনো করছি না, তবু আতঙ্কে আধমরা হয়ে গেছি। সফিক জেগে থাকলে খানিকটা ভরসা পাওয়া যেত। সে ঘুমুচ্ছে মড়ার মতো। একেই বলে পরিবেশ। ইমাম সাহেব দশ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন। বিরস গলায় বললেন, ‘ভালোই আছে, তবে ভীষণ চিৎকার করছে।’

‘তালাবন্ধ করে রেখেছেন?’

‘জ্বি-না। তালাবন্ধ করে তাকে রাখা সম্ভব না। কফিল ওর সঙ্গে থাকে কাজেই ওর গায়ের জোর থাকে অসম্ভব। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।’

ইমাম সাহেব মন-খারাপ করে বসে রইলেন। আমি বললাম, ‘গল্পটা শুরু করুন ভাই।’

তিনি নিচু গলায় বললেন, ‘আমার স্ত্রীর ডাকনাম বুড়ি।’

কথা পুরোপরি শেষ করতে পারলেন না। মসজিদে প্রচণ্ড শব্দে ঢিল পড়তে লাগল। ধুপধুপ শব্দ। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে কয়েকজন মানুষ যেন চারদিকে ছোটাছুটি করছে। আমি আতঙ্কিত গলায় বললাম, ‘কী ব্যাপার?

ইমাম সাহেব বললেন, ‘কিছু না। কফিল চায় না আমি কিছু বলি।’

‘থাক ভাই, বাদ দিন। গল্প বলার দরকার নেই।’

‘অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢিল ছোঁড়া বন্ধ হবে। ভয়ের কিছুই নাই।’

সত্যি-সত্যি বন্ধ হল। বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল। ইমাম সাহেব গল্প শুরু করলেন। আমি তাঁর গল্পটাই বলছি। তাঁর ভাষাতে। তবে আঞ্চলিকতাটা সামান্য বাদ দিয়ে।

গল্পের মাঝখানেও একবার তুমুল ঢিল ছোঁড়া হল। ইমাম সাহেব একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লেন। আমার জীবনে সে এক ভয়াবহ রাত।

নেত্রকোণা শহরের বিশিষ্ট মোক্তার মমতাজউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে তখন আমি থাকি। ওনার সঙ্গে আমার কোনো আত্মীয়সম্পর্ক নাই। লোকমুখে শুনেছিলাম — বিশিষ্ট ভদ্রলোক। কেউ কোনো বিপদে পড়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি যথাসাধ্য করেন। আমার তখন মহাবিপদ। এক বেলা খাই তো এক বেলা উপোস দেই। সাহসে ভর করে তাঁর কাছে গেলাম চাকরির জন্য। উনি বললেন, ‘চাকরি যে দিব, পড়াশোনা কী জানো।?’

আমি বললাম, ‘উলা পাস করছি।’

উনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মাদ্রাসা পাস করা লোক, তোমারে আমি কী চাকরি দিব! আই.এ., বি.এ. পাস থাকলে কথা ছিল। চেষ্টাচরিত্র করে দেখতাম। চেষ্টা করারও তো কিছু নাই।

আমি চুপ করে রইলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বড় আশা ছিল কিছু হবে। একটা পয়সা সঙ্গে নাই। উপোস দিচ্ছি। রাতে নেত্রকোণা স্টেশনে ঘুমাই।

মমতাজ সাহেব বললেন, ‘তোমাকে চাকরি দেওয়া সম্ভব না। নেও, এই বিশটা টাকা রাখ। অন্য কারো কাছে যাও। মসজিদে খোঁজটোজ নাও—ইমামতি পাও কি না দেখ।’

আমি টাকাটা নিলাম। তারপর বললাম, ‘ভিক্ষা নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। ঘরের কোনো কাজকর্ম থাকে বলেন, করে দেই।’

তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী কাজ করতে চাও?’

‘যা বলবেন করব। বাগানের ঘাসগুলো তুলে দেই?’

‘আচ্ছা দাও?’

আমি বাগান পরিষ্কার করে দিলাম। গাছগুলোতে পানি দিলাম। দু’-এক জায়গায় মাটি কুপিয়ে দিলাম। সন্ধ্যাবেলা কাজ শেষ করে বললাম, ‘জনাব যাই। আপনার অনেক মেহেরবানী। আল্লাহ্পাকের দরবারে আমি আপনার জন্য দোয়া করি।’

মমতাজ সাহেব বললেন, ‘এখন যাবে কোথায়?’

‘ইস্টিশনে। রাত্রে নেত্রকোণা ইস্টিশনে আমি ঘুমাই।’

‘এক কাজ কর। রাতটা এইখানেই থাক। তারপর দেখি।’

আমি থেকে গেলাম।

এক দিন দুই দিন তিন দিন চলে গেল। উনি কিছু বলেন না। আমিও কিছু বলি না। বাংলাঘরের এক কোণায় থাকি। বাগান দেখাশোনা করি। চাকরির সন্ধান করি। ছোট শহর, আমার কোনো চিনা-পরিচয়ও নাই। কে দেবে চাকরি? ঘুরাঘুরি সার হয়। মোক্তার সাহেবের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হয়। আমি বড়ই শরমিন্দা বোধ করি। উনিও এমন ভাব করেন যেন আমাকে চেনেন না। মাসখানেক এইভাবে চলে গেল। আমি মোটামুটি তাঁদের পরিবারের একজন হয়ে গেলাম। মোক্তার সাহেবের স্ত্রীকে মা ডাকি। ভেতরের বাড়িতে খেতে যাই। তাঁদের কোনো-একটা উপকার করার সুযোগ পেলে প্রাণপণে করার চেষ্টা করি। বাজার করে দেই। কল থেকে পানি তুলে দেই।

মোক্তার সাহেবের তিন মেয়ে। বড় মেয়ে বিধবা হয়ে বাবার সঙ্গে আছে। তার দুই বাচ্চাকে আমি আমপারা পড়াই। বাজার-সদাই করে দেই। টিপকল থেকে রোজ ছয়-সাত বালতি পানি তুলে দেই। মোক্তার সাহেবের কাছে যখন মক্কেলরা আসে, তিনি ঘনঘন তামাক খান। সেই তামাকও আমি সেজে দেই। চাকরবাকরের কাজ। আমি আনন্দের সঙ্গেই করি। মাঝে-মাঝে মনটা খুবই খারাপ হয়। দরজা বন্ধ করে একমনে কোরান শরিফ পড়ি। আল্লাহ্পাকরে ডেকে বলি—হে আল্লাহ্, আমার একটা উপায় করে দাও। কতদিন আর মানুষের বাড়িতে অন্নদাস হয়ে থাকব?

আল্লাহ্পাক মুখ তুলে তাকালেন। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব বলে এক ব্যবসায়ী বলতে গেলে সেধে আমাকে চাকরি দিয়ে দিলেন। চালের আড়তে হিসাবপত্র রাখা। মাসিক বেতন পাঁচ শ’ টাকা।

মোক্তার সাহেবকে সালাম করে খবরটা দিলাম। উনি খুবই খুশি হলেন। বললেন, ‘তোমাকে অনেকদিন ধরে দেখতেছি। তুমি সৎ স্বভাবের মানুষ। ঠিকমতো কাজ কর, তোমার আয়-উন্নতি হবে। আর রাতে তুমি আমার বাড়িতেই থাক। তোমার কোনো অসুবিধা নাই। খাওয়াদাওয়াও এইখানেই করবে। তোমাকে আমি ঘরের ছেলের মতোই দেখি।’

আনন্দে মনটা ভরে গেল। চোখে পানি এসে গেল। আমি মোক্তার সাহেবের কথামতো তাঁর বাড়িতেই থাকতে লাগলাম। ইচ্ছা করলে চালের আড়তে থাকতে পারতাম। মন টানল না। তা ছাড়া মোক্তার সাহেবের বাগানটা নিজের হাতে তৈরি করেছি। দিনের মধ্যে কিছুটা সময় বাগানে না থাকলে খুব অস্থির-অস্থির লাগে।

একমাস চাকরির পর প্রথম বেতন পেলাম। পাঁচ শ’ টাকার বদলে সিদ্দিকুর রহমান সাহেব ছ’ শ’ টাকা দিয়ে বললেন, ‘তোমার কাজকর্ম ভালো। এইভাবে কাজকর্ম করলে বেতন আরো বাড়িয়ে দিব।’

আমার মনে বড় আনন্দ হল। আমি তখন একটা কাজ করলাম। পাগলামিও বলতে পারেন। বেতনের সব টাকা খরচ করে মোক্তার সাহেবের স্ত্রী এবং তাঁর তিন মেয়ের জন্য চারটা শাড়ি কিনে ফেললাম। টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি। মোক্তার সহেবের জন্য একটা খদ্দরের চাদর।

মোক্তার সহেবের স্ত্রী বললেন, ‘তোমার কি মাথাটা খারাপ? এইটা তুমি কী করলা? বেতনের প্রথম টাকা—তুমি তোমার আত্মীয়স্বজনের জন্য জিনিস কিনবা, বাড়িতে টাকা পাঠাইবা।’

আমি বললাম, ‘মা, আমার আত্মীয়স্বজন কেউ নাই। আপনারাই আমার আত্মীয়স্বজন।’

তিনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, ‘কই, কোনোদিন তো কিছু বল নাই!’

‘আপনি জিজ্ঞেস করেন নাই—এই জন্য বলি নাই। আমার বাবা-মা খুব ছোটবেলায় মারা গেছেন। আমি মানুষ হয়েছি এতিমখানায়। এতিমখানা থেকেই উলা পাস করেছি।’

উনি আমার কথায় মনে খুব কষ্ট পেলেন। উনার মনটা ছিল পানির মতো। সবসময় টলটল করে। উনি বললেন, ‘কিছু মনে নিও না। আমার আগেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। তুমি আমারে মা ডাক আর আমি তোমার সম্পর্কে কিছুই জানি না—এইটা খুবই অন্যায় কথা। আমার খুব অন্যায় হইছে।’

তিনি তাঁর তিন মেয়েরে ডেকে বললেন, ‘তোমরা এরে আইজ থাইক্যা নিজের ভাইয়ের মতো দেখবা। মনে করবা তোমরার এক ভাই। তার সামনে পর্দা করার দরকার নাই।’

এর মধ্যে একটা বিশেষ জরুরি কথা বলতে ভুলে গেছি—মোক্তার সাহেবের ছোটো মেয়ে লতিফার কথা। এই মেয়েটা পরীর মতো সুন্দর। একটু পাগল ধরনের। নিজের মনে কথা বলে। নিজের মনে হাসে। যখন-তখন বাংলা-ঘরে চলে আসে। আমার সঙ্গে দুই-একটা টুকটাক কথাও বলে। অদ্ভুত সব কথা। একদিন এসে বলল, ‘এই যে মৌলানা সাব, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে আসছি। আচ্ছা বলেন তো—শয়তান পুরুষ না মেয়েছেলে?’

আমি বললাম, ‘শয়তান পুরুষ।’

লতিফা বলল, ‘আল্লা মেয়ে-শয়তান তৈরি করেন নাই কেন?’

আমি বললাম, ‘তা তো জানি না। আল্লাহ্পাকের ইচ্ছার খবর কেমনে জানব? আমি অতি তুচ্ছ মানুষ।’

‘কিন্তু শয়তান যে পুরুষ তা আপনি জানেন?’

‘জানি।’

‘আপনে ভুল জানেন। শয়তান পুরুষও না স্ত্রীও না। শয়তান আলাদা এক জাত।’ আমি মেয়েটার বুদ্ধি দেখে খুবই অবাক হই। এই রকম সে প্রায়ই করে। একদিনের কথা। ছুটির দিন। দুপুর বেলা। বাংলাঘরে আমি ঘুমাচ্ছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অবাক হয়ে দেখি, লতিফা আমার ঘরে। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। লতিফা বলল, ‘আপনেরে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করতে আসছি। আচ্ছা বলেন তো—

হেন কোন গাছ আছে এ-ধরায়
স্থলে জলে কভু তাহা নাহি জন্মায়।’

আমি ধাঁধার জবাব না-দিয়ে বললাম, ‘তুমি কখন আসছ?’

লতিফা বলল, ‘অনেকক্ষণ হইছে আসছি। আপনে ঘুমাইতেছিলেন, আপনারে জাগাই নাই। এখন বলেন –ধাঁধার উত্তর দেন,

হেন কোন গাছ আছে এ-ধরায়
স্থলে জলে কভু তাহা নাহি জন্মায়।’

আমি বললাম, ‘এইটার উত্তর জানা নাই।‘

‘উত্তর খুব সোজা। উত্তর হইল—পরগাছা। আচ্ছা আরেকটা ধরি বলেন দেখি–

পাকলে খেতে চায় না, কাঁচা খেতে চায়
এ কেমন ফল বল তো আমায়?’

মেয়েটার কাণ্ডকারখানায় আমার ভয়ভয় লাগতে লাগল। কেন সে এই রকম করে? কেন বারবার আমার ঘরে আসে? লোকের চোখে পড়লে নানান কথা রটবে। মেয়ে যত সুন্দর তারে নিয়া রটনাও তত বেশি।

লতিফা আমার বিছানায় বসতে বসতে বলল, ‘কই, বলেন এটার উত্তর কি—

পাকলে খেতে চায় না, কাঁচা খেতে চায়
এ কেমন ফল বল তো আমায়?

বলতে পারলেন না! এটা হল—শশা। পাকা শশা কেউ খায় না। সবাই কাঁচা শশা চায়। আচ্ছা আপনার বুদ্ধি এত কম কেন? একটাও পারেন না। আপনি একটা ধাঁধা ধরেন আমি সঙ্গে-সঙ্গে বলে দেব।’

‘আমি ধাঁধা জানি না লতিফা।’

‘আপনি কী জানেন? শুধু আল্লাহ্-আল্লাহ্ করতে জানেন, আর কিছু জানেন?’

‘লতিফা, তুমি এখন ঘরে যাও।’

‘ঘরেই তো আছি। এইটা ঘর না? এইটা কি বাহির?’

‘যখন-তখন তুমি আমার ঘরে আস—টা ঠিক না।’

‘ঠিক না কেন? আপনি কি বাঘ না ভালুক?’

আমি চুপ করে রইলাম। আধা-পাগল ই মেয়েকে আমি কী বলব? ই মেয়ে কদিন নিজে বিপদে পড়বে, আমাকেও বিপদে ফেলবে। লতিফা বলল, ‘আমি যে মাঝেমধ্যে আপনার খানে আসি—সেইটা আপনার ভালো লাগে না—ঠিক না?’

‘হ্যাঁ, ঠিক।’

‘ভালো লাগে না কেন?’

‘নানান জনে নানান কথা বলতে পারে।’

‘কী কথা বলতে পারে? আপনার সঙ্গে আমার ভালবাসা হয়ে গেছে? চুপ করে আছেন কেন, বলেন।’

‘তুমি খন যাও লতিফা।

‘আচ্ছা যাই। কিন্তু আমি আবার আসব। রাত-দুপুরে আসব। তখন দেখবেন — কী বিপদ!’

‘কেন ই রকম করতেছ লতিফা?’

লতিফা উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলল, ‘যে ভয় পায় তাকে ভয় দেখাতে আমার ভালো লাগে। ইজন্যে -রকম করি। আচ্ছা মৌলানা সাহেব, যাই। আসসালামু আলায়কুম। ওয়া রহমাতুল্লাহে ওয়া বরকাতুহু। হি-হি-হি।’

ভাই, আপনার কাছে সত্য কথা গোপন করব না। সত্য গোপন করা বিরাট অন্যায়। আল্লাহ্পাক সত্য গোপনকারীকে পছন্দ করেন না। চাকরি পাওয়ার পরেও আমি মোক্তার সাহেবের বাড়িতে থেকে গেলাম শুধু লতিফার জন্য। তারে দেখার জন্য মনটা ছটফট করত। মনে-মনে অপেক্ষা করতাম কোন সময় তারে কনজর হলেও দেখব। তার পায়ের শব্দ শুনলেও বুক ধড়ফড় করত। রাত্রে ভালো ঘুম হত না। শুধু লতিফার কথা ভাবতাম। বলতে খুব শরম লাগছে ভাই-সাব, তবু বলি—লতিফার চুলের কটা কাঁটা আমি সবসময় আমার সঙ্গে রাখতাম। আমার কাছে মনে হত–ইটা চুলের কাঁটা না, সাত রাজার ধন। আমি আল্লাহ্পাকের দরবারে কান্নাকাটি করতাম। বলতাম—হে পরোয়ারদিগার, হে গাফুরুর রহিম, তুমি আমাকে -কি বিপদে ফেললা। তুমি আমারে উদ্ধার কর।

আল্লাহ্পাক আমাকে উদ্ধার করলেন। লতিফার বিবাহের প্রস্তাব আসল। ছেলে ম.বি.বি. স. ডাক্তার। বাড়ি গৌরীপুর। ভালো বংশ। খান্দানি পরিবার। ছেলে নিজে সে মেয়ে দেখে গেল। মেয়ে তার খুব পছন্দ হল। পছন্দ না-হওয়ার কোনো কারণ নাই। লতিফার মতো রূপবতী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না। ছেলেও দেখতে শুনতে ভালো। শুধু গায়ের রঙটা কটু ময়লা। কথায়বার্তায়ও ছেলে অতি ভদ্র। বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল। বারই শ্রাবণ। শুক্রবার দিবাগত রাত্রে বিবাহ পড়ানো হবে।

আমার মনটা বড়ই খারাপ হয়ে গেল। আমি জানি, ই মেয়ের সঙ্গে আমার বিবাহের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কোথায় সে আর কোথায় আমি। চাকরশ্রেণীর আশ্রিত কজন মানুষ। জমিজমা নাই, আত্মীয়স্বজন নাই, সহায়-সম্বল নাই। তার জন্য আমি কোনোদিন আফসোস করি নাই। আল্লাহ্পাক যাকে যা দেন তাই নিয়াই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমিও ছিলাম। কিন্তু যে-দিন লতিফার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেল সে-দিন কী যে কষ্ট লাগল বলে আপনাকে বুঝাতে পারব না। সারা রাত শহরের পথে-পথে ঘুরলাম। জীবনে কোনোদিন নামাজ কাজা করি নাই—এই প্রথম এশার নামাজ কাজা করলাম। ফজরের নামাজ কাজা করলাম। এত দিন পরে বলতে লজ্জা লাগছে— আমার প্রায় মাথা খারাপের মতো হয়ে গিয়েছিল। ভোরবেলা মোক্তার সাহেবের বাসায় গেলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এইখানে আর থাকব না। বাজারে চালের আড়তে থাকব। মোক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন, ‘এখন যাবে কেন বাবা? মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কত কাজকর্ম। কাজকর্ম শেষ করে তারপর যাও।’

আমি মিথ্যা কথা বলি না। প্রথম মিথ্যা বললাম। আমি বললাম, ‘মা, সিদ্দিকুর রহমান সাহেব আমাকে আজই দোকানে গিয়ে উঠতে বলেছেন—উনি আমার মনিব-অনুদাতা। ওনার কথা না রাখলে অন্যায় হবে। বিয়ের সময় আমি চলে আসব। কাজকর্মের কোনো অসুবিধা হবে না, মা।’

সবার কাছ থেকেই বিদায় নিলাম। লতিফার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারলাম না। সে যখন সামনে এসে দাঁড়াল তখন চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারলাম না।

লতিফা বলল, ‘চলে যাচ্ছেন?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘কেন, আমরা কি কোনো দোষ করেছি?’

‘ছি ছি—দোষ করবে কেন?’

‘আচ্ছা, যাওয়ার আগে এই ধাঁধাটা ভাঙায়ে দিয়ে যান—বলেন দেখি—’

‘জানি না লতিফা।’

‘ছাই ছাড়া শোয় না;
লাথি ছাড়া ওঠে না। এই জিনিস কি?’

‘এত সহজ জিনিস পারলেন না। এটা হল কুকুর। আচ্ছা যান। দোষঘাট হলে ক্ষমা করে দিয়েন।’

আমি আড়তে চলে আসলাম। রাত আটটার দিকে মোক্তার সাহেব লোক পাঠিয়ে আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি শোবার ঘরে চেয়ারে বসে ছিলেন। আমাকে সেইখানে নিয়ে যাওয়া হল। আমি খুবই অবাক হলাম। একটু ভয়ভয়ও করতে লাগল। তাকিয়ে দেখি মোক্তার সাহেবের স্ত্রী খাটে বসে আছেন। নিঃশব্দে কাঁদছেন। আমি কিছুই বুঝলাম না। বুক ধড়ফড় করতে লাগল। না জানি কী হয়েছে।

মোক্তার সাহেব বললেন, ‘তোমাকে আমি পুত্রের মতো স্নেহ করেছি। তার বদলে তুমি এই করলে? দুধ দিয়ে কালসাপ পোষার কথা শুধু শুনেছি। আজ নিজের চোখে দেখলাম।’

আমি মোক্তার সাহেবের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘মা, আমি কিছুই বুঝতেছি না।’

মোক্তার সাহেব চাপা স্বরে বললেন, ‘বোকা সাজার দরকার নাই। বোকা সাজবা না। তুমি যা করেছ তা তুমি ভালোই জান। তুমি পথের কুকুরেরও অধম।’

আমি বললাম, ‘আমার কী অপরাধ দয়া করে বলেন।’

মোক্তার সাহেব রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, ‘মেথরপট্টিতে যে শুয়োর থাকে তুই তার চেয়েও অধম—তুই নর্দমার ময়লা।’ বলতে-বলতে তিনিও কেঁদে ফেললেন।

মোক্তার সাহেবের স্ত্রী বললেন, ‘লতিফা সবই আমাদের বলেছে—কিছুই লুকায় নাই। এখন এই অপমান এই লজ্জার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় লতিফার সঙ্গে তোমার বিবাহ দেওয়া। তুমি তাতে রাজি আছ, না মেয়ের সর্বনাশ করে পালানোই তোমার ইচ্ছা?’

আমি বললাম, ‘মা, আপনি কী বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না। লতিফা কী বলেছে আমি জানি না। তবে আপনারা যা বলবেন—আমি তা-ই করব। আল্লাহ্পাক উপরে আছেন। তিনি সব জানেন, আমি কোনো অন্যায় করি নাই মা।’

মোক্তার সাহেব চিৎকার করে বললেন, ‘চুপ থাক্, শুয়োরের বাচ্চা। চুপ থাক।’

সেই রাতেই কাজী ডাকিয়ে বিয়ে পড়ানো হল। বাসর রাতে লতিফা বলল, ‘আমি একটা অন্যায় করেছি—আপনার সাথে যেন বিবাহ হয় এই জন্য বাবা-মাকে মিথ্যা করে বলেছি—আমার পেটে সন্তান আছে। বিরাট অপরাধ করেছি, আপনার কাছে ক্ষমা চাই।’

আমি বললাম, ‘লতিফা, আমি তোমার অপরাধ ক্ষমা করলাম। তুমি আল্লাহ্পাকের কাছে ক্ষমা চাও।’

‘আপনি ক্ষমা করলেই আল্লাহ্ ক্ষমা করবেন। তা ছাড়া আমি তেমন বড় অপরাধ তো করি নাই। সামান্য মিথ্যা বলেছি। আপনাকে বিবাহ করার জন্য অনেক বড় অপরাধ করার জন্যও আমি তৈরি ছিলাম। আচ্ছা এখন বলেন এই ধাঁধাটির মানে কি–

আমার একটা পাখি আছে
যা দেই সে খায়।
কিছুতেই মরে না
পাখি জলে মারা যায়।’

বুঝলেন ভাইসাহেব, আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। এই আনন্দের কোনো সীমা নাই! আমার মতো নাদান মানুষের জন্য আল্লাহ্পাক এত আনন্দ রেখে দিয়েছেন আমি কল্পনাও করি নাই। আমি কত বার যে বললাম, আল্লাহ্পাক, আমি তোমার নেয়ামত স্বীকার করি। আমি তোমার নেয়ামত স্বীকার করি।

বিয়ের পর আমি শ্বশুরবাড়িতেই থেকে গেলাম। আমার এবং লতিফার বড় দুঃখের সময় কাটতে লাগল। শ্বশুরবাড়ির কেউ আমাদের দেখতে পারে না। খুবই খারাপ ব্যবহার করে। আমার শাশুড়ি দিন-রাত লতিফাকে অভিশাপ দেন—’মর, মর, তুই মর।’

আমার শ্বশুরসাহেব একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘সকালবেলায় তুমি আমার সামনে আসবা না। সকালবেলায় তোমার মুখ দেখলে আমার দিন খারাপ যায়।’

শ্বশুরবাড়ির কেউ আমার সঙ্গে কথা বলে না। তারা একসঙ্গে খেতে বসে। সেখানে আমার যাওয়া নিষেধ। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ হলে লতিফা থালায় করে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসে। সেই ভাত আমার গলা দিয়ে নামতে চায় না।

লতিফা রোজ বলে, ‘চল, অন্য কোথাও যাই গিয়া।‘

আমি চুপ করে থাকি। কই যাব বলেন? আমার কি যাওয়ার জায়গা আছে? যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। লতিফা খুব কান্নাকাটি করে।

একদিন খুব অপমানের মধ্যে পড়লাম। আমার শ্বশুরসাহেবের পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক হাজার টাকা চুরি গেছে। তিনি আমারে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘এই নে দাড়িওয়ালা, তুমি কি আমার টাকা নিছ?’

আমার চোখে পানি এসে গেল। এ কী অপমানের কথা! আমি দরিদ্র। আমার যাওয়ার জায়গা নাই—সবই সত্য, কিন্তু তাই বলে আমি কি চোর? ছিঃছিঃ।

শ্বশুরসাহেব বললেন, ‘কথা বল না কেন?’

আমি বললাম, ‘আমারে অপমান কইরেন না। যত ছোটই হই, আমি আপনার কন্যার স্বামী।‘

শ্বশুরসাহেব বললেন, ‘চুপ। চোর আবার ধর্মের কথা বলে!’

লতিফা সেইদিন থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিল। সে বলল-এই বাড়ির ভাত সে মুখে দিবে না।

আমার শাশুড়ি বললেন, ‘ঢং করিস না। এই বাড়ির ভাত ছাড়া তুই ভাত পাইবি কই?’

দুই দিন দুই রাত গেল, লতিফা পানি ছাড়া কিছুই মুখে দেয় না। আমারে বলে, ‘তুমি আমারে অন্য কোথাও নিয়া চল। দরকার হইলে গাছতলায় নিয়া চল। এই বাড়ির ভাত আমি মুখে দিব না।’

আমি মহা বিপদে পড়লাম।

সারা রাত আল্লাহরে ডাকলাম। ফজরের নামাজের শেষে আল্লাহ্পাকের দরবারে হাত উঠায়ে বললাম—হে মাবুদ। হে পাক পরোয়ারদিগার—তুমি ছাড়া আমি কার কাছে যাব? আমার দুঃখের কথা কারে বলব? কে আছে আমার? তুমি আমারে বিপদ থাইক্যা বাঁচাও।

আল্লাহ্পাক আমার প্রার্থনা শুনলেন।

ভোরবেলায় চালের আড়তে গিয়েছি। সিদ্দিকুর রহমান সাহেব আমারে ডেকে বললেন, ‘এই যে মৌলানা, আমার একটা উপকার করতে পারবে?’

আমি বললাম, ‘জ্বি জনাব, বলেন।’

‘ময়মনসিংহ শহরে আমি নতুন বাড়ি করেছি। এখন থেকে ঐ বাড়িতে থাকব। সপ্তাহে-সপ্তাহে এইখানে আসব। নেত্রকোণায় আমার যে-বাড়ি আছে—তুমি কি এই বাড়িতে থাকতে পারবে? নেত্রকোণার বাড়ি আমি বিক্রি করতে চাই না। শুনলাম তুমি বিবাহ করেছ—তুমি এবং তোমার স্ত্রী দু’ জন মিলে থাক।’

আমি বললাম, ‘জনাব, আমি অবশ্যই থাকব।’

‘তা হলে তুমি এক কাজ কর, আজকেই চলে আস। একতলার কয়েকটা ঘর নিয়ে তুমি থাক। দোতলার ঘর তালাবন্ধ থাকুক।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

‘বাড়িটা শহর থেকে দূরে। তবে ভয়ের কিছু নেই, একজন দারোয়ান আছে। চব্বিশ ঘন্টা থাকবে। দারোয়ানের নাম বলরাম। ভালো লোক।’

‘জনাব,আমি আজকেই উঠব।’

সেইদিন বিকালেই সিদ্দিক সাহেবের বাড়িতে গিয়া উঠলাম। বিরাট বাড়ি। বাড়ির নাম ‘সরজুবালা হাউস।’ হিন্দু বাড়ি ছিল। সিদ্দিক সাহেবের বাবা কিনে নিয়েছিলেন।

আট ইঞ্চি ইটের দেয়ালে বাড়ির চারদিক ঘেরা। দোতলা পাকা দালান। বিরাট বড় বড় বারান্দা। দেয়ালের ভিতরে নানান জাতের গাছগাছড়া। দিনের বেলায়ও অন্ধকার হয়ে থাকে।

আমি লতিফাকে বললাম, ‘বাড়ি পছন্দ হয়েছে লতিফা?’

লতিফা আনন্দে কেঁদে ফেলল। দুই দিন খাওয়াদাওয়া না-করায় লতিফার শরীর নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। চোখ ছোট-ছোট, ঠোঁট কালচে। মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। এই অবস্থাতেই সে রান্নাবান্না করল। অতি সামান্য আয়োজন। ভাত ডাল পেঁপে ভাজা। খেতে অমৃতের মতো লাগল ভাইসাহেব।

খাওয়াদাওয়ার পর দু’ জনে হাত ধরাধরি করে বাগানে হাঁটলাম। হাসবেন না ভাইসাব, তখন আমাদের বয়স ছিল অল্প। মন ছিল অন্য রকম। হাঁটতে-হাঁটতে আমার মনে হল, এই দুনিয়াতে আল্লাহ্পাক আমার মতো সুখী মানুষ আর তৈরি করেন নাই আনন্দে বারবার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল ভাই সাহেব।

ক্লান্ত হয়ে একসময় একটা লিচুগাছের নিচে আমরা বসলাম। লতিফা বলল, ‘আমি যে মিথ্যা কথা বইলা আপনেরে বিবাহ করছি, এই জন্য কি আমার উপর রাগ করছেন?’

আমি বললাম, ‘না লতিফা। আমার মতো সুখী মানুষ নাই।’

‘যদি সুখী হন তাহলে এই ধাঁধাটা পারেন কি না দেখেন। বলেন দেখি—

কাটলে বাঁচে, না-কাটলে মরে
এমন সুন্দর ফল কোন গাছেতে ধরে?’

পারলাম না লতিফা

‘ভালোমতো চিন্তা কইরা বলেন। এইটা পারা দরকার। খুব দরকার –

কাটলে বাঁচে, না-কাটলে মরে
এমন সুন্দর ফল কোন গাছেতে ধরে?

‘পারব না লতিফা। আমার বুদ্ধি কম।’

‘এইটা হইল সন্তানের নাড়ি-কাটা। সন্তানের জন্মের পর নাড়ি কাটলে সন্তান বাঁচে। না-কাটলে বাঁচে না। আচ্ছা এই ধাঁধাটা আপনেরে কেন জিজ্ঞেস করলাম বলেন তো?’

‘তুমি বল। আমার বিচারবুদ্ধি খুবই কম।‘

‘এইটা আপনেরে বললাম—কারণ আমার সন্তান হবে।’

লতিফা লজ্জায় দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। কী যে আনন্দ আমার হল ভাইসাহেব—কী যে আনন্দ!

সেই রাতে লতিফার জ্বর আসল।

বেশ ভালো জ্বর। আমি জ্বরের খবর রাখি না। ঘুমাচ্ছি। লতিফা আমারে ডেকে তুলল। বলল, ‘আমার খুব ভয় লাগতেছে, একটু উঠেন তো।’

আমি উঠলাম। ঘর অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায় না। হারিকেন জ্বালায়ে শুয়েছিলাম। বাতাসে নিভে গেছে। হারিকেন জ্বালালাম।

তাকিয়ে দেখি লতিফার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। সে ফিসফিস করে বলল, ‘ছাদের কার্নিশে কে যেন হাঁটে।’

আমি শোনার চেষ্টা করলাম। কিছু শুনলাম না।

লতিফা বলল, ‘আমি স্পষ্ট শুনেছি। একবার না, অনেক বার শুনেছি। জুতা পায়ে দিয়া হাঁটে। জুতার শব্দ হয়। হাঁটার শব্দ হয়।’

‘বোধহয় দারোয়ান।’

‘না, দারোয়ান না। অন্য কেউ।’

‘কি করে বুঝলা অন্য কেউ?’

‘বললাম না—জুতার শব্দ। দারোয়ান কি জুতা পরে?’

‘তুমি থাক। আমি খোঁজ নিয়া আসি?’

‘না না। এইখানে একা থাকলে আমি মরে যাব।’

আমি লতিফার হাত ধরে বসে রইলাম। এই প্রথম বুঝলাম লতিফার খুব জ্বর। জ্বর আরো বাড়ল। একসময় জ্বর নিয়ে ঘুমায়ে পড়ল। তখন আমি নিজেই শব্দটা শুনলাম। ঝনঝন শব্দ। জুতার শব্দ না। অন্য রকম শব্দ। ঝনঝনঝনঝন।

একমনে আয়াতুল কুরসি পড়লাম।

তিন বার আয়াতুল কুরসি পড়ে হাততালি দিলে-সেই হাততালির শব্দ যতদূর যায় ততদূর কোনো জিন-ভূত আসে না। হাততালি দেয়ার পর ঝনঝন শব্দ কমে গেল, তবে পুরোপুরি গেল না। আমি সারা রাত জেগে কাটালাম।

ভোরবেলা সব স্বাভাবিক।

রাতে যে এত ভয় পেয়েছিলাম মনেই রইল না। লতিফার গায়েও জ্বর নেই। সে ঘর-দুয়ার গোছাতে শুরু করল। একতলার সর্বদক্ষিণের দুটো ঘর আমরা নিয়েছি। বারান্দা আছে। কাছেই কলঘর। লতিফা নিজের সংসার ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দারোয়ান বলরাম সাহায্য করার জন্য চলে আসল। বলরামের বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। আদি বাড়ি নেপালে। দশ বছর বয়সে বাংলাদেশে এসেছে, আর ফিরে যায় নি। এখন পুরোপুরি বাঙালি। বাঙালি একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিল। সে মেয়ে মরে গেছে। বলরামের এক ছেলে আছে। খুলনার এক ব্যাঙ্কের দারোয়ান। ছেলে বিয়ে-শাদি করেছে। বাবার কোনো খোঁজখবর করে না।

বলরামের সঙ্গে অতি অল্প সময়ে লতিফার ভাব। বলরাম লতিফাকে ‘মা’ ডাকা শুরু করল। আমি নিশ্চিন্ত হয়ে দোকানে চলে গেলাম। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।

বাড়িতে ঢুকে দেখি বারান্দায় পা ছড়িয়ে লতিফা বসে আছে। তার মুখ শুকনা। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে?’

‘ভয় লাগছে।’

‘কিসের ভয়?’

‘বিকেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।’

‘কী স্বপ্ন?’

‘দেখলাম আমি ঘুমাচ্ছি। একটা লম্বা, কালো এবং খুব মোটা লোক ঘরে ঢুকল। লোকটার সারা শরীরে বড়-বড় লোম। কোনো দাঁত নেই। চোখগুলা অসম্ভব ছোট— ছোট। দেখাই যায় না—এ-রকম। হাতের থাবাগুলিও খুব ছোট। বাচ্চা ছেলেদের মতো। আমি লোকটাকে দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। সে বলল, এই, ভয় পাস কেন? আমার নাম কফিল। আমি তো তোর সাথেই থাকি। তুই টের পাস না? তুই বিয়ে করেছিস, আমি কিছু বলি নাই। এখন আবার সন্তান হবে। ভালোমতো শুনে রাখ— তোর সন্তানটারে আমি শেষ করে দিব। এখনি শেষ করতাম। এখন শেষ করলে তোর ক্ষতি হবে। এইজন্য কিছু করছি না। সন্তান জন্মের সাত দিনের ভিতর আমি তারে শেষ করব। এই বলেই সে আমারে ধরতে আসল। আমি চিৎকার করে জেগে উঠলাম। তারপর থেকে এইখানে বসে আছি।’

আমি বললাম, ‘স্বপ্ন হল স্বপ্ন। কত খারাপ খারাপ স্বপ্ন মানুষ দেখে। সবচেয়ে বেশি খারাপ স্বপ্ন দেখে পোয়াতি মেয়েছেলে। তাদের মনে থাকে মৃত্যুভয়।’

কথাবার্তা বলে লতিফাকে মোটামুটি স্বাভাবিক করে তুললাম। সে ঘরের কাজকর্ম করতে লাগল। রান্না করল। আমরা সকাল-সকাল খাওয়াদাওয়া করলাম। তারপর বাগানে হাঁটতে বের হলাম। লতিফা বলল, ‘এই বাড়িতে একটা দোষ আছে, সেইটা কি আপনি জানেন?’

‘কী দোষ?’

‘এই বাড়িতে একটা খারাপ কুয়া আছে। সিদ্দিক সাহেবের চার বছর বয়সের একটা ছোট্ট মেয়ে কুয়ায় পড়ে মারা গিয়েছিল। কুয়াটা দোষী।’

‘কী যে তুমি বল! কুয়া দোষী হবে কেন? বাচ্চা মেয়ে খেলতে খেলতে পড়ে গেছে।’

‘তা না, কুয়াটা আসলেই দোষী।’

‘কে বলেছে?’

‘বলরাম বলেছে। কুয়াটার মুখ সিদ্দিক সাহেব টিন দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। সেই টিনে রাতের বেলা ঝনঝন শব্দ হয়। মনে হয় ছোট কোনো বাচ্চা টিনের উপরে লাফায়। তুমি গত রাতে কোনো ঝনঝন শব্দ শোন নাই?

আমি মিথ্যা করে বললাম, ‘না।’

‘আমি কিন্তু শুনেছি।’

আমি বলরামের উপর খুব বিরক্ত হলাম। এইসব গল্প বলে ভয় দেখানোর কোনো মানে হয়? ঠিক করলাম, ভোরবেলায় তাকে ডেকে শক্তভাবে ধমক দিয়ে দেব।

রাতে ঘুমুতে যাবার সময়ে লক্ষ করলাম, লতিফার জ্বর এসেছে। সে কেমন ঝিম মেরে গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। হারিকেন জ্বালিয়ে রেখে ঘুমুতে গেলাম। গভীর রাতে ঘুম ভাঙল। লতিফা আমাকে ঝাঁকাচ্ছে। ঘর অন্ধকার। লতিফা বলল, ‘হারিকেন আপনা-আপনি নিভে গেছে। আমার বড়ো ভয় লাগতেছে।’

আমি হারিকেন জ্বালালাম, আর তখনি ঝনঝন শব্দ পেলাম। একবার না, বেশ কয়েক বার।

লতিফা ফিসফিস করে বলল, ‘শব্দ শুনলেন?’

আমি জবাব দিলাম না। লতিফা কাঁদতে লাগল।

যতই দিন যেতে লাগল লতিফার অবস্থা ততই খারাপ হতে লাগল। রোজ সে কফিলকে স্বপ্ন দেখে। কফিল তাকে শাসিয়ে যায়। বারবার মনে করিয়ে দেয়—বাচ্চা হওয়ার সাত দিনের মধ্যে সে বাচ্চা নিয়ে নিবে। মনের শান্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল।

আমি লতিফাকে তার বাবার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলাম, সে রাজি হল না। প্রয়োজনে সে এইখানেই মরবে, কিন্তু বাবার বাড়িতে যাবে না। আমি তার জন্য তাবিজ-কবচের ব্যবস্থা করলাম, বাড়ি-বন্ধনের ব্যবস্থা করলাম। আমি দরিদ্র মানুষ, তবু একটা কাজের মেয়ের ব্যবস্থা করলাম, যেন সে সারাক্ষণ লতিফার সঙ্গে থাকে।

কিছুতেই কিছু হল না।

এক সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে দেখি—লতিফা খুব সাজগোজ করেছে। লাল একটা শাড়ি পরেছে। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করেছে। বেণী করে চুল বেঁধেছে। বেণীতে চার-পাঁচটা জবা ফুল। সে পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে আছে। একটু দূরে বলরাম এবং কাজের মেয়েটা। তারা দু’ জন ভীত চোখে তাকিয়ে আছে লতিফার দিকে।

আমাকে দেখেই লতিফা খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে লতিফা?’ লতিফা হাসি থামাল এবং আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে পুরুষের গলায় বলল, ‘মৌলানা আসছে। মৌলানারে অজুর পানি দেও। নামাজের পাটি দেও। কেবলা কোন দিকে দেখাইয়া দেও। টুপি দেও, তসবি দেও।

আমি বললাম, ‘এই রকম করতেছ কেন লতিফা?’

লতিফা আবার হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ে বলল, ‘ওমা, মেয়েছেলের সঙ্গে দেখি মৌলানা কথা বলে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! মৌলানার লজ্জা নাই।’

আমি আয়তুল কুরসি পড়া শুরু করলাম।

আমাকে থামিয়ে দিয়ে লতিফা চিৎকার করে বলল, ‘চুপ কর। আমার নাম কফিল। তোর মতো মৌলানা আমি দশটা হজম কইরা রাখছি। গোটা কোরান শরিফ আমার মুখস্থ। আমার সঙ্গে পাল্লা দিবি? আয়, পাল্লা দিলে আয়। প্রথম থাইকা শুরু করি… হি-হি-হি। ভয় পাইছস? ভয় পাওনেরই কথা। বেশি ভয় পাওনের দরকার নাই। তোরে আমি কিছু বলব না। তোর বাচ্চাটারে শেষ করব। তুই মৌলানা মানুষ, তুই বাচ্চা দিয়া কী করবি? তুই থাকবি মসজিদে। মসজিদে বইস্যা তুই তোর আল্লাহ্রে ডাকবি। পুলাপান না-থাকাই তোর জন্য ভালা। হি-হি-হি—।’

একটা ভয়ংকর রাত পার করলাম ভাইসাব। সকালে দেখি সব ঠিকঠাক। লতিফা ঘরের কাজকর্ম করছে। এইভাবে দিন পার করতে লাগলাম। কখনো ভালো কখনো মন্দ।

লতিফা যখন আট মাসের পোয়াতি, তখন আমি হাতে-পায়ে ধরে আমার শাশুড়িকে এই বাড়িতে নিয়া আসলাম। লতিফা খানিকটা শান্ত হল। তবে আগের মতো সহজ-স্বাভাবিক হল না। চমকে চমকে ওঠে। রাতে ঘুমাতে পারে না। ছটফট করে। মাঝে-মাঝে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে। সেই দুঃস্বপ্নে কফিল এসে উপস্থিত হয়। কফিল চাপা গলায় বলে, ‘দেরি নাই—আর দেরি নাই। পুত্রসন্তান আসতেছে। সাত দিনের মধ্যে নিয়ে যাব। কান্দাকাটি যা করার কইরা নেও।’ ঘুম ভেঙে লতিফা জেগে ওঠে। চিৎকার করে কাঁদে। আমি চোখে দেখি অন্ধকার। কী করব কিছুই বুঝি না।

শ্রাবণ মাসের তিন তারিখে লতিফার একটা পুত্রসন্তান হল। কী সুন্দর যে ছেলেটা হল ভাইসাহেব, না-দেখলে বিশ্বাস করবেন না। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ। টানা-টানা চোখ। আমি এক শ’ রাকাত শোকরানা নামাজ পড়ে আল্লাহ্র কাছে আমার সন্তানের হায়াত চাইলাম। আমার মনের অস্থিরতা কমল না।

আঁতুড়ঘরের বাইরে একটা বেঞ্চ পেতে রাতে শুয়ে থাকি। আমার স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন আমার শাশুড়ি আর আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোন। পালা করে কেউ-না-কেউ সারা রাত জেগে থাকি।

লতিফার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম নাই। সন্তানের মা। সারাক্ষণ বাচ্চা বুকের নিচে আড়াল করে রাখে। এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করে না। আমার শাশুড়ি যখন বাচ্চা কোলে নেন তখনো লতিফা বাচ্চাটার গায়ে হাত দিয়ে রাখে, যেন কেউ নিয়ে যেতে না পারে।

ছয় দিনের দিন কি হল শুনেন।

ঘোর বর্ষা। সারা দিন বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। এ-রকম বর্ষা আমি আমার জীবনে দেখি নাই।

লতিফা আমাকে বললো, ‘আইজ রাইতটা আপনে জাগনা থাকবেন। আমার কেমন জানি লাগতেছে।’

আমি বললাম, ‘কেমন লাগতেছে?’

‘জানি না। একটু পরে-পরে শরীর কাঁপতেছে।’

‘তুমি নিশ্চিন্ত হইয়া থাক। আমি সারা রাইত জাগনা থাকব।’

‘আপনে একটু বলরামরেও খবর দেন। সেও যেন জাগনা থাকে।’

আমি বলরামকে খবর দিলাম। লতিফা বাচ্চাটারে বুকের নিচে নিয়া শুইয়া আছে। আমি একমনে আল্লাহ্পাকেরে ডাকতেছি। জীবন দেওয়ার মালিক তিনি। জীবন নেওয়ার মালিকও তিনি।

রাত তখন কত আমি জানি না ভাইসাহেব। ঘুমায়ে পড়েছিলাম। লতিফার চিৎকারে ঘুম ভাঙল। সে আসমান ফাটাইয়া চিৎকার করতেছে। আমার বাচ্চা কই গেল—আমার বাচ্চা কই। দুইটা হারিকেন জ্বালানো ছিল, দুইটাই নিভানো। পুরা বাড়ি অন্ধকার। কাঁপতে-কাঁপতে হারিকেন জ্বালালাম। দেখি সত্যি বাচ্চা নাই। আমার শাশুড়ি ফিট হয়ে পড়ে গেলেন।

লতিফা ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে দৌড়ায়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ছুটে গেল কুয়ার দিকে।

কুয়ার উপর টিন দিয়া ঢাকা ছিল। তাকায়ে দেখি টিন সরানো। লতিফা চিৎকার করে বলছে—’আমার বাচ্চারে কুয়ার ভিতর ফালাইয়া দিছে। আমার বাচ্চা কুয়ার ভিতরে।’ লতিফা লাফ দিয়া কুয়াতে নামতে চাইল। আমি তাকে জড়ায়ে ধরলাম।

ইমাম সাহের চুপ করে গেলেন। কপালের ঘাম মুছলেন।

আমি বললাম, ‘বাচ্চাটা কি সত্যি কুয়াতে ছিল?’

‘জ্বি।’

‘আর দ্বিতীয় বাচ্চা? সে-ও কি এইভাবে মারা যায়?’

‘জ্বি-না জনাব। আমার দ্বিতীয় বাচ্চা শ্বশুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করে।‘

‘সিদ্দিক সাহেবের ঐ বাড়ি তাহলে আপনি ছেড়ে দেন?’

‘জ্বি। তাতে অবশ্য লাভ হয় না। কফিলের যন্ত্রণা কমে না। দ্বিতীয় সন্তানটাকেও সে মারে। জন্মের চারদিনের দিন—’

আমি আঁৎকে উঠে বললাম, ‘থাক ভাই, আমি শুনতে চাই না। গল্পগুলো আমি সহ্য করতে পারছি না।’

ইমাম সাহেব বললেন, ‘আল্লাহ্পাক আরেকটা সন্তান দিতেছেন। কিন্তু এই সন্তানটাকেও বাঁচাতে পারব না। মনটা বড়ই খারাপ ভাই সাহেব। বড়ই খারাপ। আমি কত বার চিৎকার করে বলেছি—কফিল, তুমি আমারে মেরে ফেল। আমার সন্তানরে মের না। এই সুন্দর দুনিয়া তারে দেখতে দাও।

ইমাম সাহেব কাঁদতে লাগলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হল। ইমাম সাহেব ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন।

সেইদিন ভোরেই আমি সফিককে নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। সফিকের আরো কিছুদিন থেকে কালু খাঁর রহস্য ভেদ করে আসার ইচ্ছা ছিল। আমি তা হতে দিলাম না। ইমাম সাহেবের সঙ্গে আরো কিছু সময় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

সাধারণত আমি আমার জীবনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার গল্প মিসির আলির সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্র বলি। মজার ব্যাপার হচ্ছে—ইমাম সাহেরের এই গল্প তাঁকে বলা হল না।

ঢাকায় ফেরার তিন দিনের মাথায় তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। নানান কথাবার্তা হল—এটা বাদ পড়ে গেল।

দু’ মাস পর মিসির আলি আমার বাসায় এলেন। রাতে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করলাম। তিনি প্রায় দু’ ঘন্টা কাটিয়ে বাড়ি চলে গেলেন—ইমাম সাহেবের গল্প বলা হল না। তিনি চলে যাবার পর মনে হল—ইমাম সাহেবের গল্পটা তো তাঁকে শোনানো হল না।

আমি আমার মেয়েকে বলে রাখলাম যে এর পরে যদি কখনো মিসির আলি সাহেব আমাদের বাসায় আসেন, সে যেন আমার কানের কাছে ‘ইমাম’ বলে একটা চিৎকার দেয়। আমার এই মেয়ের স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। সে যে যথাসময়ে ‘ইমাম’ বলে চিৎকার দেবে, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত।

হলও তাই। অনেকদিন পর মিসির আলি সাহেব এসেছেন। তাঁর সঙ্গে গল্প করছি—আমার মেয়ে কানের কাছে এসে বিকট চিৎকার দিল। এমন চিৎকার যে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মেয়েকে কড়া ধমক দিলাম। মেয়ে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, ‘তুমি তো বলেছিলে মিসির চাচু এলে ‘ইমাম’ বলে চিৎকার করতে।’

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কানের পর্দা ফাটিয়ে দিতে তো বলি নি। যাও, এখন যাও তো!’

মিসির আলি বললেন, ‘ব্যাপারটা কী?’

আমি বললাম, ‘তেমন কিছু না। আপনাকে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে চাচ্ছিলাম। একজন ইমাম সাহেবের গল্প। আপনার সঙ্গে দেখা হয় কিন্তু গল্পটা বলার কথা মনে থাকে না। মেয়েকে মনে করিয়ে দিতে বলেছি। সে এমন চিৎকার দিয়েছে, এখন মনে হচ্ছে বাঁ কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না।’

মিসির আলি বললেন, ‘গল্পটা কী বলুন শুনি।’

‘আজ থাক। আরেক দিন বলব। একটু সময় লাগবে। লম্বা গল্প।’

মিসির আলি বললেন, ‘আরেক কাপ চা দিতে বলুন। চা খেয়ে বিদেয় হই।‘

চায়ের কথা বলে মিসির আলির সামনে এসে বসলাম। মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘ইমাম সাহেবের গল্পটা আপনি আমাকে কখনই বলতে পারবেন না।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন?’

‘আপনার মস্তিষ্কের একটা অংশ আপনাকে গল্পটা বলতে বাধা দিচ্ছে, যে-কারণে অনেক দিন থেকেই আপনি আমাকে গল্পটা বলতে চান অথচ বলা হয় না। আপনার মনে থাকে না। আজ আপনাকে মনে করিয়ে দেয়া হল, এবং মনেও করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনি রেগে গেলেন। তার চেয়ে বড় কথা মনে করিয়ে দেবার পরেও আপনি গল্পটি বলতে চাচ্ছেন না। অজুহাত বের করেছেন—বলছেন, লম্বা গল্প। আমি নিশ্চিত, আপনার অবচেতন মন চাচ্ছে না এই গল্প আপনি আমাকে বলেন। আপনার সাবকনশ্যাস মাইন্ড আপনাকে বাধা দিচ্ছে।’

‘আমার সাবকনশ্যাস মাইন্ড আমাকে বাধা দিচ্ছে কেন?’

‘আমি তা বুঝতে পারছি না। গল্পটা শুনলে বুঝতে পারব। চা আসুক। চা খেতে-খেতে আপনি বলা শুরু করুন। আমার সিগারেটও ফুরিয়েছে। কাউকে দিয়ে কয়েকটা সিগারেট আনিয়ে দিন।’

আমি আর কোনো অজুহাতে গেলাম না। গল্প শেষ করলাম। গল্প শেষ হওয়ামাত্র মিসির আলি বললেন, ‘আবার বলুন।’

‘আবার কেন?’

‘মানুষ যখন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প বলে তখন মূল গল্পটি দ্রুত বলার দিকে ঝোঁক থাকে বেশি। গল্পের ডিটেইলস-এ যেতে চায় না। একই গল্প দ্বিতীয় বার বলার সময় বর্ণনা বেশি থাকে। কারণ মূল কাহিনী বলা হয়ে গেছে। কথক তখন না-বলা অংশ বলতে চেষ্টা করেন। আপনিও তাই করবেন। প্রথম বার শুনে কয়েকটা জিনিস বুঝতে পারি নি। দ্বিতীয় বারে বুঝতে পারব। শুরু করুন।’

আমি শুরু করলাম, বেশ সময় নিয়ে বললাম।

মিসির আলি বললেন, ‘কবে গিয়েছিলেন ধুন্দুল নাড়া? তারিখ মনে আছে?’

‘আছে।’

আমি মিসির আলিকে তারিখ বললাম। তিনি শান্ত গলায় বললেন, ‘আপনার তারিখ অনুযায়ী মেয়েটির বাচ্চা এখন হবে কিংবা হয়ে গেছে। আপনি বলছেন দশ মাস আগের কথা। মেয়েটির বাচ্চা হয়ে গিয়ে থাকলে তাকে যে হত্যা করা হয়েছে সেই সম্ভাবনা নিরানব্বই ভাগেরও বেশি। আর যদি এখনো হয়ে না থাকে তাহলে বাচ্চাটাকে বাঁচানো যেতে পারে। এখন ক’টা বাজে দেখুন তো।’

আমি ঘড়ি দেখলাম, ‘ন’টা বাজে।’

মিসির আলি বললেন, ‘রাত সাড়ে দশটায় ময়মনসিংহে যাওয়ার একটা ট্রেন আছে। চলুন রওনা হই।’

‘সত্যি যেতে চান?’

‘অবশ্যই যেতে চাই। আপনার অসুবিধা থাকলে কীভাবে যেতে হবে আমাকে বলে দিন। আমি ঘুরে আসি।’

‘আমার অসুবিধা আছে। তবু যাব। এখন বলুন তো জিন কফিলের ব্যাপারটা আপনি বিশ্বাস করছেন?’

‘না।’

‘আপনার ধারণা বাচ্চাগুলোকে খুন করা হয়েছে?’

‘তা তো বটেই।’

‘কে খুন করেছে?’

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘কে খুন করেছে তা আপনিও জানেন। আপনার সাবকনশ্যাস মাইন্ড জানে। জানে বলেই সাবকনশ্যাস মাইন্ড গল্পটি বলতে আপনাকে বাধা দিচ্ছিল।’

‘আমি কিছুই জানি না।’

মিসির আলি হাসতে-হাসতে বললেন, ‘আপনার সাবকনশ্যাস মাইন্ড জানে, কিন্তু সে এটি আপনার কনশ্যাস মাইন্ডকে জানায় নি বলেই আপনার মনে হচ্ছে আপনি জানেন না।’

আমি বললাম, ‘কে খুন করেছে?’

‘লতিফা। দু’টি বাচ্চাই সে মেরেছে। তৃতীয়টিও মারবে।’

‘কী বলছেন এ-সব!

‘চলুন, রওনা হয়ে যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ট্রেনে যেতে-যেতে ব্যাখ্যা করব।’

.

মিসির আলি বললেন, ‘লতিফা যে পুরো ঘটনাটা ঘটাচ্ছে তা পরিষ্কার হয়ে যায় শুরুতেই, যখন ইমাম সাহেব আপনাকে বলেন কীভাবে জিন কফিল তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছিল।……

পুরোনো ধরনের মসজিদ—একটামাত্র দরজা। এই ধরনের মসজিদে বসে থাকলে বাইরের চিৎকার শোনা যাবে না, ভেতর থেকে চিৎকার করলেও বাইরের কেউ শুনবে না। কারণ সাউন্ড ওয়েভ চলার জন্যে মাধ্যম লাগে। মসজিদের দেয়াল সেখানে বাধার মতো কাজ করছে।………

আপনি এবং ইমাম সাহেব মসজিদে ছিলেন। ইমাম সাহেব একসময় স্ত্রীর খোঁজ নিতে গেলেন এবং ফিরে এসে বললেন-লতিফা খুব চিৎকার করছে। তাই না?’

‘জ্বি, তাই?’

‘মসজিদের ভেতরে বসে সেই চিৎকার আপনি শুনতে পান নি। তাই না?’

‘জ্বি।’

‘অথচ ইমাম সাহেব যখন আগুন দেখে ভয়ে চেঁচালেন, বাঁচাও বাঁচাও—তখন লতিফা পানির বালতি নিয়ে ছুটে এল। প্রথমত ইমাম সাহেবের চিৎকার লতিফার শোনার কথা নয়। দ্বিতীয়ত শুনে থাকলেও লতিফা কী করে বুঝল আগুন লেগেছে? সে পানির বালতি নিয়ে ছুটে এল কেন? আগুন-আগুন বলে চিৎকার করলেও আমরা চিৎকার শুনে প্রথমে খালি হাতে ছুটে আসি, তারপর পানির বালতি আনি। এটাই স্বাভাবিক। এই মেয়েটি শুরুতেই পানির বালতি নিয়ে ছুটে এসেছে। কারণ পানির বালতি হাতের কাছে রেখেই সে আগুন ধরিয়েছে। আমার এই যুক্তি কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?’

‘হচ্ছে।’

‘প্রথম শিশুটি মারা গেল। শিশুটিকে ফেলা হল কুয়ায়। এই খবর মেয়েটি জানে, কারণ সে পাগলের মতো ছুটে গেছে কুয়ার দিকে—অন্য কোথাও নয়। তার বাচ্চাটিকে কুয়াতে ফেলা হয়েছে, এটা সে জানল কীভাবে? জানল, কারণ সে নিজেই ফেলেছে। এই যুক্তি কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ, হচ্ছে?’

‘আপনাকে কি আরো যুক্তি দিতে হবে? আমার কাছে আরো ছোটখাটো যুক্তি আছে।’

‘আর লাগবে না। শুধু বলুন—কুয়ার ওপরের টিনে ঝনঝন শব্দ হত কেন? যে-শব্দ ইমাম সাহেব নিজেও শুনেছেন?’

‘কুয়ার টিনটা না-দেখে বলতে পারব না। আমার ধারণা বাতাসে টিনটা কাঁপে, ঝনঝন শব্দ হয়। দিনের বেলায় এই শব্দ শোনা যায় না, কারণ আশেপাশে অনেক ধরনের শব্দ হতে থাকে। রাত যতই গভীর হয় চারপাশ নীরব হতে থাকে। সামান্য শব্দই বড় হয়ে কানে আসে।’

’আপনার এই যুক্তিও গ্রহণ করলাম, এখন বলুন, লতিফা এমন ভয়ংকর কাণ্ড কেন করছে?’

‘মেয়েটা অসুস্থ। মনোবিকার ঘটেছে। ইমাম সাহেব লোকটি তাদের আশ্রিত। তাদের পরিবারে চাকরবাকররা যে-কাজ করে, সে তাই করত। মেয়েটি ভাগ্যের পরিহাসে এমন একজন মানুষের প্রেমে পড়ে যায়। প্রচণ্ড মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। পরিবারের সবার কাছে ছোট হয়, অপমানিত হয়। এত প্রচণ্ড চাপ সহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না। তার মনোবিকার ঘটে। পোয়াতি অবস্থায় মেয়েদের হরমোনাল ব্যালান্স এদিক-ওদিক হয়। সেই সময় মনোবিকার তীব্র হয়। মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। মেয়েটি দরিদ্র ইমামকে বিয়ে করে কঠিন মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়েছে। একই সঙ্গে সে লোকটিকে প্রচণ্ড ভালবাসে, আবার প্রচণ্ড ঘৃণাও করে। কী ভয়াবহ অবস্থা!’

‘মেয়েটি ইমামকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে, এটা কেন বলছেন?’

‘ইমামতি পেশা মেয়েটির পছন্দ নয়। পছন্দ নয় বলেই মেয়েটি কফিলের গলায় বলেছে—ইমাম আসছে। অজুর পানি দে, জায়নামাজ দে, কেবলা কোন দিকে বলে দে। একধরনের রসিকতা করার চেষ্টা করছে।’

‘মনোবিকার এমন ভয়াবহ রূপ নিল কেন? সে নিজের বাচ্চাকে হত্যা করছে কেন?’

‘বড়ো ধরনের বিকারে এ-রকম হয়। সে নিজেকে ধ্বংস করতে চাইছে। নিজের সন্তানহত্যার মাধ্যমে সেই ইচ্ছারই অংশবিশেষ পূর্ণ হচ্ছে। আরো কিছু থাকতে পারে। না-দেখে বলতে পারব না।’

ধুন্দুল নাড়া গ্রামে সন্ধ্যার পর পৌঁছলাম। পৌঁছেই খবর পেলাম পাঁচ দিন হয় ইমাম সাহেবের একটি কন্যা হয়েছে। কন্যাটি ভালো আছে। বড় ধরনের স্বস্তি বোধ করলাম।

ইমাম সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম মসজিদে। তিনি আমাদের দেখে বড়ই অবাক হলেন। আমি বললাম, ‘আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?’

ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ‘ভালো না। খুব খারাপ। কফিল তার সঙ্গে— সঙ্গে আছে। কফিল বলেছে, সাতদিনের মাথায় মেয়েটিকে মেরে ফেলবে। খুব কষ্টে আছি ভাইসাহেব। আল্লাহ্পাকের কাছে আমার জন্য খাস দিলে একটু দোয়া করবেন।’ আমি বললাম, ‘আমি আমার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। উনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কিছু কথা বলবেন।

ইমাম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কেন?’

‘যাতে আপনার বাচ্চাটা ভালো থাকে, সুস্থ থাকে। উনি খুব বড় একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। অনেক কিছু বুঝতে পারেন, যা আমরা বুঝতে পারি না। ওনার কথা শুনলে আপনাদের মঙ্গল হবে। এই জন্যেই ওনাকে এনেছি।’

‘অবশ্যই আমি ওনার কথা শুনব। অবশ্যই শুনব।’

ইমাম সাহেব আমাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে অনেক লোকজন ছিল, তাদের সরিয়ে দেওয়া হল।

মিসির আলি বললেন, ‘আমি কিছু কথা বলব যা শুনতে ভালো লাগবে না, তবু দয়া করে শুনুন।’

লতিফা চাপা গলায় বলল, ‘আমার সাথে কী কথা?’

‘আপনার বাচ্চাটির বিষয়ে কথা। বাচ্চাটি যাতে বেঁচে থাকে, ভালো থাকে, সেজন্যেই আমার কথাগুলি আপনাকে শুনতে হবে।’

লতিফা তার স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বলেন, কী বলবেন।’

মিসির আলি খুবই নিরাসক্ত গলায় কথা বলতে শুরু করলেন। কথা বলার সময় একবারও লতিফার দিকে তাকালেন না। লতিফা তার শিশুকে বুকের কাছে নিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার মাথায় লম্বা ঘোমটা। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে মাঝে-মাঝে তার তীব্র চোখের দৃষ্টি নজরে আসছে। ইমাম সাহেব তাঁর স্ত্রীর পাশে বসে আছেন। মিসির আলির ব্যাখ্যা যতই শুনছেন ততই তাঁর চেহারা অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।

মিসির আলি কথা শেষ করে লতিফার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কি আমার ব্যাখ্যা বিশ্বাস করলেন?’

লতিফা জবাব দিল না। মাথার ঘোমটা সরিয়ে দিল। কী সুন্দর শান্ত মুখ! চোখের তীব্রতা এখন আর নেই। মনে হচ্ছে অশ্রু টলমল করছে।

মিসির আলি কঠিন গলায় বললেন, ‘আমার ব্যাখ্যা আপনি বিশ্বাস না-করলেও শিশুটির দিকে তাকিয়ে তার মঙ্গলের জন্যে শিশুটিকে আপনি অন্যের কাছে দিন। সে যেন কিছুতেই আপনার সঙ্গে না থাকে। আমার যা বলবার বললাম, বাকিটা আপনাদের ব্যাপার। আচ্ছা, আজ তাহলে যাই। আমরা রাতেই রওনা হব। নৌকা ঠিক করা আছে।’

আমরা বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, ‘মিসির আলি সাহেব, আপনার কি মনে হয় মেয়েটি আপনার কথা বিশ্বাস করেছে?’

মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ‘হ্যাঁ, করেছে। এবং বিশ্বাস করার কারণেই তার দ্রুত রোগমুক্তি ঘটবে। আমার ধারণা, মেয়েটি নিজেও খানিকটা হলেও এই সন্দেহই করছিল। মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী। চলুন, রওনা দেওয়া যাক। এই গ্রামে রাত কাটাতে চাই না।’

আমি বললাম, ‘ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা বলে যাবেন না?’

‘না। আমার কাজ শেষ, বাকিটা ওরা দেখবে।’

রওনা হবার আগে ইমাম সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। শিশুটি তাঁর কোলে। তিনি বললেন, ‘লতিফা মেয়েটাকে দিয়ে দিয়েছে। সে খুব কাঁদতেছে। আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। মেহেরবানি করে একটু আসেন।’

আমরা আবার ঢুকলাম। বিস্মিত হয়ে দেখলাম, লতিফা ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। মিসির আলি কোমল গলায় বললেন, ‘আপনি কি কিছু বলবেন?’

লতিফা কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘আল্লাহ্ আপনার ভালো করবে। আল্লাহ্ আপনার ভালো করবে।’

‘আপনি কোনো রকম চিন্তা করবেন না। আপনার অসুখ সেরে গেছে। আর কোনো দিন হবে না।’

লতিফা তার স্বামীর কানে-কানে কী যেন বলল।

ইমাম সাহেব বিব্রত গলায় বললেন, ‘জনাব, কিছু মনে করবেন না। লতিফা আপনারে একটু ছুঁইয়া দেখতে চায়।’

মিসির আলি হাত বাড়িয়ে দিলেন। লতিফা দু’ হাতে সেই হাত জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।

নৌকায় উঠছি।

ইমাম সাহেব আমাদের তুলে দিতে এলেন। নৌকা ছাড়ার আগ-মুহূর্তে নিচু গলায় বললেন, ‘ভাইসাহেব, আমি অতি দরিদ্র মানুষ, আপনাদের যে কিছু দিব আল্লাহ্পাক আমাকে সেই ক্ষমতা দেন নাই। এই কোরান শরিফটা আমার দীর্ঘ দিনের সঙ্গী। যখন মন খুব খারাপ হয় তখন পড়ি—মন শান্ত করি। আমি খুব খুশি হব যদি কোরান মজিদটা আপনি নেন। আপনি নিবেন কি না তা অবশ্য জানি না।’

মিসির আলি বললেন, ‘অবশ্যই নেব। খুব আনন্দের সঙ্গে নেব।’

‘ভাইসাহেব, আমার মেয়েটার একটা নাম কি আপনি রাইখা যাইবেন?’

মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, ‘হ্যাঁ, যাব। আপনার মেয়ের নাম রাখলাম লাবণ্য। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় এই নামের একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। মেয়েটা আমাকে একেবারেই পাত্তা দেয় নি। মাঝেমাঝেই মেয়েটার কথা আমার মনে হয়। মনটা খারাপ হয়ে যায়। ভাই, যাই।’

2 Comments
Collapse Comments

ভয় বইয়ে চোখ,জিন কফিল আর সঙ্গিনী এই তিনটা হল্প আছে।সঙ্গিনী নামে আরেকটা গল্প আছে ওইটা আপনাদের এখানে মিসিং।

Bangla Library (Administrator) April 9, 2021 at 7:37 am

ধন্যবাদ। বইটি ‘প্রিয়পদরেখা’ নামে আরেকটা গল্পগ্রন্থ ক্যাটাগরিতে ছিল। এবার ‘ভয়’ ক্যাটাগরিতেও রাখা হলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *