জাল নোট

জাল নোট

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে টুম্পা দেখল তাদের বাসার সামনে একটা সাদা গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়িটার পিছনে একটা পুলিশের ভ্যান, সেখানে অনেক পুলিশ। সাদা গাড়িটা থেকে একজন মানুষ নামল, সে এদিক-সেদিক তাকাল তারপর তাদের বাসার ভিতরে ঢুকে গেল। কয়েক মিনিট পরেই দরজায় টুং-টাং বেল শোনা গেল।

টুম্পা ছোটাচ্চুর ঘরে গিয়ে দেখল ছোটাছু বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের কোম্পানি থেকে নিজের চাকরি যাওয়ার পর থেকে ছোটাচ্চু বেশিরভাগ সময় এইভাবে শুয়ে থাকে।

টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু বাসার সামনে একটা পুলিশের গাড়ি থেমেছে।”

ছোটাচ্চু বলল, “গুড।”

“একজন মানুষ আমাদের বাসায় ঢুকেছে।”

ছোটাচ্চু উপরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “ভেরি গুড।”

“মনে হয় তোমার কাছে এসেছে!”

“ভেরি ভেরি গুড।“

“তুমি যাবে না দেখা করতে?”

ছোটাচ্চু এবারে টুম্পার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “কী বললি?”

“বলেছি তুমি দেখা করতে যাবে না?”

“কার সাথে দেখা করতে যাব না?”

“তুমি আমার কথা শুনোনি?”

ছোটাচ্চু পালটা জিজ্ঞেস করল, “তুই কি আমাকে কিছু বলেছিস?”

“হ্যাঁ, বলেছি, তুমি কিছুই শুনোনি।”

টুম্পা কী বলেছে সেটা আবার বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই শান্ত এসে বলল, “ছোটাছু, তোমার সাথে ডি.এম.পি.র পুলিশ কমিশনার দেখা করতে এসেছেন।”

ছোটাচ্চু বিছানা থেকে উঠে বসে বলল, “আমার কাছে? আমার কাছে কেন?”

শান্ত বলল, “তুমি কোনো ক্রাইম করেছ?”

“আমি কেন ক্রাইম করব?”

“ক্রাইম করে থাকলে বলতাম তোমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। না করলে কেন এসেছে আমি জানি না।”

ছোটাচ্চু আজকাল দাড়ি কাটে না, তাই তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ছোটাচ্চু গালে হাত বুলিয়ে বলল, “এইভাবে যাব?”

শান্ত বলল, “হ্যাঁ। মুখে বিন্দি বিন্দি দাড়ি থাকা হচ্ছে স্টাইল। পুলিশ কমিশনার মনে করবে তুমি স্টাইলিস্ট।”

ছোটাচ্চু তাই সেভাবেই গেল, বাইরের ঘরে পুলিশ অফিসার ছোটাচ্চুকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ছোটাচ্চুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “শাহরিয়ার সাহেব?”

“জি।” বলে ছোটাচ্চু হাত মিলিয়ে সোফায় বসে পড়ল। পুলিশ অফিসার নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “আমরা একটা কাজে আপনার কাছে এসেছি।”

“আমার কাছে?”

“জি। আমরা আসলে প্রথমে আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কাছে গিয়েছিলাম।”

ছোটাচ্চু তখন সোজা হয়ে বসল; বলল, “তাই নাকি?”

“জি। দেখলাম নতুন ম্যানেজমেন্ট, কিন্তু সেখানে আপনি নাই।”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “না, আমি নাই।”

“আপনার নিজের হাতে তৈরি করা কোম্পানি কিন্তু আপনি কেন নাই। বুঝতে পারলাম না।”

ছোটাচ্চুর বলতে লজ্জা লাগল যে তাকে তার নিজের কোম্পানি বের করে দিয়েছে, সেই জন্যে নাই। তাই জোর করে চেষ্টা করে মুখটা হাসি হাসি বানিয়ে বসে রইল। পুলিশ অফিসার বলল, “প্রথমে ভেবেছিলাম আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির সাথেই আলাপ করি কিন্তু পরে মনে হলো যেখানে আপনি নাই সেই কোম্পানির সাথে আলাপ করে লাভ নাই।”

ছোটাচ্চুর চোখে-মুখে এবারে একটু উত্তেজনা দেখা দিল, বলল, “তাই ভাবলেন?”

“জি। সেই জন্যে আমরা খোঁজাখুঁজি করে আপনার কাছে চলে এসেছি।”

ছোটাচ্চু এবারে আরেকটু উত্তেজিত হলো। বলল, “আচ্ছা!”

“আপনার একটু সাহায্য দরকার।”

“আমার?”

“হ্যাঁ, আপনার।”

ছোটাচ্চু তার বিন্দি বিন্দি দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলল, “কিন্তু, আমি ভেবেছিলাম ডিটেকটিভের কাজ ছেড়ে দেব।”

“সে কী!” পুলিশ অফিসার বলল, “আমরা ডিপার্টমেন্ট থেকে অনেক সময় আগাতে পারি না, একটা বৃত্তের মাঝে আটকা পড়ে যাই। তখন আপনাদের মতো ব্রিলিয়ান্ট এনলিটিক্যাল ডেটিকেটেড, থরো আর কমপ্রিহেনসিভ ইনভেস্টিগেশন যারা করে তাদের সাহায্যে যদি না পাই–”

ছোটাচ্চু তার নিজের সম্পর্কে বলা এই পাঁচটা ইংরেজি বিশেষণ মনে রাখার চেষ্টা করল, ব্রিলিয়ান্ট, এনলিটিক্যাল, ডেডিকেটেড, থরো এবং কমপ্রিহেনসিভ। কী অসাধারণ!

পুলিশ অফিসার বলল, “আপনি প্লিজ না করতে পারবেন না। আমাদেরকে হেল্প করেন।”

ছোটাচ্চু একটা ভাব নিয়ে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে, আগে বলেন শুনি। দেখি হেল্প করতে পারি কি না।”

পুলিশ অফিসার এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “ব্যাপারটা খুবই গোপনীয়। এটা এখন শুধু আপনার আর আমার মাঝে থাকবে। আর কেউ যেন জানতে না পারে।”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “জানবে না।”

অবশ্যি ছোটাচ্চু জানত না বসার ঘরে জানালার নিচে বাসার প্রায় সব বাচ্চা মাথা নিচু করে ছোটাচ্চুর সাথে পুলিশ অফিসারের কথাবার্তা শুনছিল। এই অতি গোপনীয় আলাপটা বাচ্চারা সবাই খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনল।

পুলিশ অফিসার ছোটাচ্চুকে যেটা জানাল সেটা সংক্ষেপে এ রকম : দেশে জাল নোটের একটা সমস্যা সবসময়েই ছিল কিন্তু সবসময়েই সেই জাল নোট হতো পাঁচশ’ কিংবা হাজার টাকার। কিন্তু এখন খুবই বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটেছে। দশ টাকার জাল নোটে বাজার ভরে গেছে। পাঁচশ টাকা কিংবা হাজার টাকার জাল নোট একজনকে গছিয়ে দেওয়া খুবই কঠিন, ভালো করে যাচাই-বাছাই না করে এই বড় নোট কেউ নেয় না। দশ টাকার জাল নোটের বেলায় সেটা সত্যি নয়, মানুষ চোখ বন্ধ করে দশ টাকার নোট নিয়ে নেয়, সেটা পরে জাল নোট বের হলেও সেটা নিয়ে কেউ বেশি বিচলিত হয় না। বরং অনেক সময় এই জাল নোট নিয়ে হাসি তামাশা করে। তাই যারা দশ টাকার জাল নোট বের করে তারা মোটেও যত্ন নিয়ে জাল নোট তৈরি করে না, একেবারে ফটোকপি করার মতো করে জাল নোট তৈরি করে-খুবই সস্তায়। পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই দলটাকে ধরতে পারছে না। তাই তারা ছোটাচ্চুর কাছে এসেছে কীভাবে ধরা যায় সেটার একটা বুদ্ধি নেওয়ার জন্যে।

সবকিছু শুনে ছোটাচ্চু বলল যে সে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখবে, তারপর জানাবে। পুলিশ অফিসার খুব খুশি হয়ে ছোটাচ্চুকে কিছু কাগজপত্র দিয়ে চা-নাশতা খেয়ে চলে গেল।

ছোটাচ্চু পুলিশ অফিসারের সাথে কথা শেষ করে যখন বাসার ভিতরে এলো তখন তার মুখ বেশ হাসি হাসি। বাচ্চারা ততক্ষণে দাদির কাছে চলে এসে টেলিভিশন দেখার ভান করছে। ছোটাচ্চুকে দেখে টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু, পুলিশ অফিসার তোমাকে কী বলেছে?”

“একটা কেস নিয়ে এসেছে।”

“তুমি না ডিটেকটিভ কাজ ছেড়ে দিয়েছ?”

“ছেড়েই তো দিয়েছিলাম কিন্তু এমনভাবে ধরেছে, না করতে পারলাম না!”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কী কেস ছোটাচ্চু?”

“সেটা বলা যাবে না। খুবই গোপনীয়।”

“বলো না আমাদেরকে, প্লিজ।”

“উঁহু।” ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “বলা যাবে না।”

সবাই মুখ টিপে হাসল, ছোটাচ্চু সেটা লক্ষ করল না। কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল, মনে হলো পুলিশ অফিসার যে ফাইলটা দিয়ে গেছে সেটা দেখছে। অনেক দিন পর ছোটাচ্চুর ভেতরে একধরনের উৎসাহ ফিরে এসেছে।

.

পরদিন বিকালে সব বাচ্চারা একসাথে বসেছে, টুনি সবাইকে ডেকে এনেছে। যখন সবাই গোল হয়ে বসেছে তখন টুনি বলল, “ছোটাচ্চু এখন বাসায় নাই, তাই আমি তোমাদের সবাইকে ডেকেছি।”

একজন জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“ছোটাচ্চুকে যখন তার কোম্পানি থেকে বরখাস্ত করে দিয়েছে তখন ছোটাচ্চুর খুব মন খারাপ হয়েছে।”

প্রমি বলল, “মন খারাপ হতেই পারে। নিজের কোম্পানি থেকে কখনো কেউ বরখাস্ত হয়?”

শাহানা বলল, “স্টিভ জবস হয়েছিল।”

প্রমি বলল, “কিন্তু ছোটাচ্চু তো স্টিভ জবস না।”

শান্ত বলল, “ছোটাচ্চু হচ্ছে বোকাসোকা মানুষ। সহজ-সরল মানুষ।”

টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, তোমার ভিতরে অনেক প্যাঁচ, সে জন্যে তোমার কাছে সবাইকে মনে হয় বোকাসোকা, সহজ-সরল।”

শান্ত বলল, “শব্দটা প্যাঁচ না, শব্দটা হচ্ছে বুদ্ধিমত্তা। ইন্টেলিজেন্স।”

প্রমি বলল, “খামোখা বাড়তি কথা বলে লাভ নাই। কী জন্যে ডেকেছিস সেইটা বল।”

টুনি বলল, “আমরা সবাই কালকে লুকিয়ে লুকিয়ে পুলিশ অফিসার আর ছোটাচ্চুর কথা শুনেছি।”

মুনিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, “কাজটা ঠিক হয় নাই। কারো গোপন কথা শুনতে হয় না।”

শান্ত বলল, “বড় বড় কথা বলবি না, দিব একটা থাবড়া।”

মুনিয়া তখন চুপ করে গেল।

টুনি বলল, “পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে ছোটাচ্চুর সাথে কথা বলেছে এটা অনেক বড় ব্যাপার। ছোটাচ্চুর খুব মন খারাপ, যদি এই কেসটা সলভ করতে পারে তাহলে ছোটাচ্চুর মনটাও ভালো হয়ে যাবে, ছোটাচ্চু আবার আগের মতো বাসায় বসে বসে কাজ করতে পারবে। একটা ইনকামও হবে।”

শাহানা বলল, “সেইটা তো বুঝলাম, কিন্তু আজকে সবাইকে তুই কেন ডেকেছিস?”

টুনি বলল, “ছোটাচ্চু নিজে নিজে এই কেস সলভ করতে পারবে না। আমাদের ছোটাচ্চুকে সাহায্য করতে হবে।”

“আমাদের? আমরা কীভাবে সাহায্য করব?”

টুনি তখন তার হাতে ধরে রাখা ফাইলটা খুলে বলল, “পুলিশ অফিসার যে ফাইলটা দিয়ে গেছে সেটা নিয়ে এসেছি। পুলিশ যা যা জানে সেটা এখানে লেখা আছে।”

“কী লেখা আছে, দেখি?” বলে সবাই এগিয়ে এলো।

টুনি ফাইলটা দেখাল; বলল, “জাল নোটের নম্বর দেয়া আছে। ছয়টা আলাদা নম্বর। সবসময় ঘুরে-ফিরে এই ছয়টা নম্বরই আসে।”

শাহানা বলল, “ছয়টা?”

টুনি বলল, “হ্যাঁ। আর কয়েকটা জাল নোটও দিয়েছে দেখার জন্যে।”

“দেখি দেখি”, বলে সবাই নোটগুলো দেখার জন্যে ঝুঁকে পড়ে। শাহানা একটা নোট হাতে নিয়ে অনেক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, হাতে ধরে আলোর বিপরীতে রেখে পরীক্ষা করল, তারপর ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “রঙিন লেজার প্রিন্টারে প্রিন্ট করেছে। সাইজটা ভালো করে কাটে নাই পর্যন্ত।”

টুনি বলল, “একটা এ ফোর কাগজে ছয়টার বেশি দশ টাকার নোট প্রিন্ট করা যায় না। সেই জন্যে খালি ছয়টা নম্বর।”

শান্ত বলল, “এত সোজা? তাহলে আমরা জাল নোটের বিজনেস শুরু করি না কেন?”

টুনি বলল, “সেই জন্যে তোমাকে ডেকেছি শান্ত ভাইয়া।”

“সেই জন্যে আমাকে ডেকেছিস মানে?”

“যারা জাল নোট তৈরি করে তারা ব্যবসাটা কীভাবে করে সেটা তোমার কাছ থেকে বোঝার জন্যে।”

শান্ত চোখ পাকিয়ে বলল, “তুই কী বলতে চাইছিস?”

টুনি শান্ত গলায় বলল, “ধরা যাক, তোমার একটা রঙিন লেজার প্রিন্টার আছে, তুমি দশ টাকার জাল নোট তৈরি করো। তৈরি করার পর ধরা না পড়ে বাজারে ছাড়বে কেমন করে?”

শান্ত একটু রেগে বলল, “সেইটা আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন?”

টুম্পা বলল, “শান্ত ভাইয়া, আমাদের মাঝে তুমি সবচেয়ে বেশি দুই নম্বুরি, সেই জন্যে টুনি আপু তোমাকে জিজ্ঞেস করেছে। তাই না টুনি আপু?”

টুনি মাথা নাড়ল, তখন শান্ত বলল, “দেব একটা থাবড়া।”

শাহানা বলল, “এত রাগ হচ্ছিস কেন? একটু চিন্তা করে বল আমাদের। তোকে তো কেউ ক্রিমিনাল বলছে না, বলছে তুই ক্রিমিনালদের মতো চিন্তা করতে পারিস!”

প্রমি বলল, “হ্যাঁ, ক্রিমিনালদের মতো চিন্তা করলে কেউ ক্রিমিনাল হয় না।”

টুনি বলল, “এটাকে ক্রাইম ফ্যান্টাসিও বলতে পারো।”

শান্ত তখন একটু শান্ত হলো। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করল, তারপর বলল, “বড় জাল নোট একটা গছাতে পারলেই অনেক লাভ। দশ টাকার জাল নোটে সেই রকম লাভ নাই। তাই অনেকগুলো জাল নোট একসাথে ব্যবহার করতে হবে। সেই জন্যে মার্কেটিং করার জন্যে অনেক মানুষ দরকার। কিন্তু মানুষ বেশি হলে ধরা পড়ার চান্স বেশি। তাই মার্কেটিং করতে হবে খুব কায়দা করে।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “সেটা কী রকম?”

“টোকাই বাচ্চাদের ব্যবহার করা সহজ, তারা জানবেও না-আমি তাদের জাল নোট দিয়ে বলব সেগুলো দিয়ে কিছু একটা কিনে আনতে! চকোলেট, ক্লিপ, পেন্সিল, কলম, ফিতা, সেফটিপিন! তারপর সেই জিনিসগুলো সস্তায় পাইকারি বিক্রি করব।”

শাহানা বলল, “ওয়ান্ডারফুল, তুই বড় হলে ঘাঘু ক্রিমিনাল হতে পারবি!”

টুম্পাকে জানালার কাছে দাঁড়া করিয়ে রাখা হয়েছিল, সে এ রকম সময়ে ছুটে এসে বলল, “ছোটাচ্চু আসছে! ছোটাচ্চু আসছে!”

সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়াল, টুনি ফাইলটা নিয়ে ছুটে গেল ছোটাচ্চুর ঘরে সেখানে রেখে আসার জন্যে। আজকের মিটিং মোটামুটি এখানেই শেষ।

.

ছোটাচ্চু যখন বাসায় থাকে না তখন বাচ্চারা মিলে আরো কয়েকবার মিটিং করল এবং সবাই মিলে চিন্তা-ভাবনা করে মোটামুটি কীভাবে তদন্ত করা যায় সেটা ঠিকও করে ফেলল। কিন্তু সেটা কীভাবে ছোটাচ্চুকে বলবে তারা বুঝতে পারছিল না, তখন ভেবে-চিন্তে তারা শেষ পর্যন্ত একটা পথ বের করল।

সেদিন রাত্রিবেলা যখন ছোটাচ্চু এসেছে তখন বাচ্চারা ছোটাচ্চুকে শুনিয়ে শুনিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। প্রথমে মুনিয়া বলল, “চল, আমরা চোর পুলিশ খেলি।”

টুম্পা বলল, “নাহ্, এটা খুবই পানসে খেলা। এটা খেলব না।”

“তাহলে কী খেলবে?” শান্ত বলল, “আয়, ক্রিমিনাল ক্রিমিনাল খেলি।” “সেটা কীভাবে খেলে?”

“আমরা একজন একজন করে ক্রিমিনাল হয়ে ক্রাইম করব, অন্যেরা হবে ডিটেকটিভ, তারা ক্রিমিনালকে ধরবে।”

মুনিয়া বলল, “ঠিক আছে। প্রথমে কে ক্রিমিনাল হবে?”

শান্ত বলল, “আমি।”

টুম্পা বলল, “তুমি কী করবে?

“মার্ডার!”

“ঠিক আছে মার্ডার করো।”

শান্ত বলল, “একজনকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছাদে নিয়ে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেব। তার হাড্ডিগুড্ডি গুঁড়া হয়ে যাবে, মাথার ঘিলু বের হয়ে যাবে, পুরা শরীর থেঁতলে যাবে।”

তখন দাদি ধমক দিয়ে বললেন, “কী বলছিস এইসব?”

“খেলছি দাদি।”

“এইটা একটা খেলা হলো? বন্ধ কর এই খেলা।”

টুম্পা বলল, “ঠিক আছে। মার্ডার করার দরকার নাই। অন্য ক্রাইম করো।”

শান্ত বলল, “আসলে আমি মার্ডার করার এক্সপার্ট। অন্য ক্রাইম পানসে লাগে!”

“পানসে লাগলে লাগুক। অন্য ক্রাইম করো।”

শান্ত খানিকক্ষণ চিন্তা করার ভান করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে, তাহলে নোট জাল করব।”

সবাই চোখের কোন দিয়ে দেখল শান্তর কথা শুনে ছোটাচ্চু কেমন জানি সোজা হয়ে বসল।

শান্ত বলল, “আমি নোট জাল করতে শুরু করেছি। সবাই পাঁচশ’ আর এক হাজার টাকার নোট জাল করে, আমি শুরু করেছি দশ টাকার জাল নোট!”

এবারে ছোটাচ্চুর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, বিস্ফারিত চোখে শান্তর দিকে তাকিয়ে রইল।

টুনি বলল, “দশ টাকার নোট জাল করে তোমার পোষাবে না।”

“একশ’বার পোষাবে।” শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “আমি মার্কেটিং করব টোকাইদের দিয়ে। তাদেরকে দশ টাকার জাল নোট দিয়ে বলব কিছু একটা কিনে আনতে।”

টুম্পা বলল, “কিন্তু তুমি জাল নোট বানাবে কেমন করে?”

“খুবই সোজা। রঙিন লেজার প্রিন্টারে জাল নোট ছাপাব। একটা এ ফোর কাগজে ছয়টা এঁটে যাবে।”

“তার মানে শুধু ছয়টা নম্বরের জাল নোট হবে?”

“হ্যাঁ। সমস্যা কী? কেউ কখনো নোটে কী নম্বর আছে দেখে না।”

ছোটাচ্চু তখন মুখ হাঁ করে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, শান্ত বলল, “তোরা কেউ আমাকে ধরতে পারলি না। আমি হচ্ছি ক্রিমিনালদের সেরা। এক নম্বর ক্রিমিনাল!”

টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, তোমাকে ধরা খুবই সোজা।”

“কীভাবে ধরবি?”

“লেজার প্রিন্টারে খুবই সুন্দর রঙিন ছাপা হয় সত্যি-কিন্তু সেই প্রিন্টারের কার্টিজের দাম অনেক বেশি। সব জায়গাতে পাওয়া যায় না।”

“তাতে সমস্যা কী?”

“সমস্যা হচ্ছে, ঢাকা শহরে মাত্র অল্প কিছু দোকানে রঙিন লেজার প্রিন্টারের টোনার পাওয়া যায়। আমি সেই দোকানগুলোতে খোঁজ নিব, দেখব কে মাঝে মাঝেই এত দামি টোনার কিনছে। তাহলেই তুমি ধরা পড়ে যাবে।”

সবাই দেখল ছোটাচ্চু হঠাৎ কেমন জানি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠল, তারপর ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।

বাচ্চারাও তখন ছোটাচ্চুর পিছু পিছু গেল। ছোটাচ্চু নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই ফোনে একজনের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। বাচ্চারা দরজায় কান লাগিয়ে শুনল ছোটাচ্চু বলছে, “কমিশনার সাহেব, জাল নোটওয়ালাদের ধরার খুব সহজ একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এসেছে। রঙিন লেজার প্রিন্টারের টোনার যারা বিক্রি করে তাদের দোকানে যদি চোখ রাখা যায়…”

বাচ্চারা মুখে হাত দিয়ে খিকখিক করে হাসতে হাসতে সরে এলো।

.

দুই দিন পর রাত্রিবেলা দাদির ঘরে সবাই বসে আছে তখন ছোটাচ্চ এসে ঢুকল। হাতে বিশাল একটা কেক। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “কেক! কেক!”

টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কেক কেন এনেছ ছোটাচ্চু!”

ছোটাচ্চু বলল, “মনে আছে পুলিশ কমিশনার কয়দিন আগে একটা কেস নিয়ে এসেছিল?”

“হ্যাঁ ছোটাচ্চু, মনে আছে।”

“সেই কেসটা সলভ করেছি।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। বিশাল একটা গ্রুপকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।”

সবাই তখন আনন্দের মতো শব্দ করল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেসটা কী ছিল ছোটাচ্চু? আমাদের বলবে?”

“না।”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, “বলা যাবে না। এটা খুবই গোপনীয়।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *