তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৬/২ – জলাভূমির আতঙ্ক – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০
এক
‘খাইছে!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘গাছে লাগল তো!’
ম্যানগ্রোভ গাছের প্রায় পাতা ছুঁয়ে উড়ে গেল হাইড্রোপ্লেন। এক জায়গায় জটলা করে আছে গাছগুলো।
ছোট্ট বিমানের নাকটা টেনে তুলল পাইলট রাস্টি কালাহান। ‘ভয় পেলে?’
‘না!’ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভুরুর ঘাম মুছল মুসা। গলা কাঁপছে। ‘কিন্তু আরেকটু হলেই তো লেগে যেত!’
‘সব সময় রোডেও-মেজাজে থাকে কাজিন রাস্টি,’ রবিন বলল। পিছনের সিটে ঠাসাঠাসি করে বসেছে কিশোরের সঙ্গে।
রাস্টি কালাহান ওর দূর সম্পর্কের ভাই, মায়ের পক্ষের। উইকএন্ডে সোয়াম্পল্যান্ড রোডেও দেখতে তিন গোয়েন্দাকে দাওয়াত করেছে। রকি বিচ থেকে ফ্লোরিডার মায়ামি, সেখান থেকে এই গেইটর সোয়াম্পে উড়ে এসেছে ওরা। সোয়াম্পল্যান্ড গুডস-এ নেমে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে চলে যাবে রাস্টির ফিশিং ক্যাম্পে। নিরালা ওই ক্যাম্পটাতেই থাকবে কটা দিন।
একটা ‘কী’র কাছাকাছি এল প্লেন। স্থানীয় লোকেরা দ্বীপকে ‘কী’ বলে। দক্ষিণ ফ্লোরিডার এই এভারগ্লেডে এ রকম হাজার হাজার দ্বীপ ছড়িয়ে আছে।
এক ঝাঁক সাদা পাখি উড়ে গেল। রকি বিচ থেকে কিনে আনা ট্র্যাভেল বুকে ছাপা একটা পাখির ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে রবিন বলল, ‘ইগ্রেট!’
‘খিদে পেয়েছে কারও?’ পাখি নিয়ে এখন মাথাব্যথা নেই মুসার। এক মুঠো চিপস মুখে পুরল। ‘বহুক্ষণের জন্যে এটাই হয়তো শেষ খাওয়া।’
‘বহুক্ষণ না, মাত্র কয়েক মিনিট,’ রাস্টি বলল। ‘সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে পৌঁছে গেছি। খাবার কিনে নেব।’ করাত-ঘাসে ছাওয়া দিগন্ত বিস্তৃত জলাভূমির মাঝখানে বিশাল এক প্রাকৃতিক দীঘির দিকে এগিয়ে চলেছে প্লেন। নীচে নামছে ক্রমশ।
‘স্কি করে ল্যান্ড করাবেন?’ নীচে পানির দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর।
‘হ্যাঁ,’ রাস্টি জবাব দিল। ‘চাকার বদলে রানার লাগানো থাকে হাইড্রোপ্লেনের তলায়। পন্টুনের মতই কাজ করে রানার। এর সাহায্যে পানিতে ভেসে থাকে প্লেন।’
পানি ছুঁলো রানার। তারপর হাঁসের মত ভেসে সোয়াম্পল্যাস্ত গুডসের দিকে এগিয়ে গেল বিমান। কিনারে কাঠের জেটি। সেটায় প্লেন ভিড়াল রাস্টি। ওর সঙ্গে ডাঙায় নামল তিন গোয়েন্দা।
পানির কিনারে মস্ত একটা কাঠের ছাউনি। এটাই সোয়াম্পল্যান্ড গুডস। জেনারেল স্টোর। গেইটর সোয়াম্পের একমাত্র বাণিজ্যিক এলাকা। সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায় এখানে। নৌকা এমনকী ঘোড়াও ভাড়া পাওয়া যায়।
মাটিতে পা দিয়েই ডাফেল ব্যাগ থেকে একটা ল্যাসো টেনে বের করল মুসা-লম্বা দড়ির মাথায় ফাঁস পরানো—এর সাহায্যে গরু ধরে কাউবয়রা।
একটা ডক পোস্ট লক্ষ্য করে ল্যাসো ছুঁড়ল ও। ‘রকি বিচে পার্কিং মিটারগুলোর ওপর প্রচুর প্র্যাকটিস করেছি। একটাও মিস করিনি। গরু ধরার জন্যে আমি এখন রেডি।’
হাসল কিশোর। ‘মিটার আর গরু এক জিনিস নয়। একটা অচল, আরেকটা সচল। সচল প্রাণীর গায়ে ফাঁস পরানো অনেক কঠিন।’
জেনারেল স্টোরের বারান্দায় সবে পা রেখেছে ওরা, পার্কিং লটের দিক থেকে গর্জন শোনা গেল, ‘নড়লেই গলা ফাঁক করে দেব!’ জলাভূমির আতঙ্ক
ঝট করে ফিরে তাকাল কিশোর। একজন পুলিশ অফিসারের গলায় ছুরি চেপে ধরেছে একজন স্থানীয় ইনডিয়ান।
‘আরে, কী করছে!’ চেঁচিয়ে বলল রবিন।
রাস্টি সহ সবাই দৌড় দিল সেদিকে।
ওদের দেখে ছুরি নামালো ইনডিয়ান। অফিসারকে ছেড়ে দিল। ধূসর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে হাসিমুখে বলল, ‘আরে, রাস্টি যে! কেমন আছো?’
‘ভাল,’ জবাব দিল রাস্টি।
রাস্টির দিকে অবাক চোখে তাকাল রবিন। ওঁকে চেনেন?’
‘চিনি, বিশ বছর ধরে, সেই সোয়াম্পল্যান্ড গুডস খোলার সময় থেকেই। ও ডিন ওয়াটারম্যান।
‘একটু আগে কী করছিলেন আপনি?’ ডিনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘আমার গলায় ছুরি চেপে ধরে ডাকাতটা কীভাবে হুমকি দিচ্ছিল ডেপুটি ক্যানারকে দেখাচ্ছিলাম।’ ছুরিটা খাপে ভরে রাখলেন ডিন।
‘ডাকাত!’ ভুরু কুঁচকে গেছে রবিনের।
‘হ্যাঁ,’ ডিন জানালেন। ‘দুদিন আগে মায়ামির একটা ব্যাংকে পঞ্চাশ লাখ ডলার ডাকাতি হয়েছে। প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছিল সে-সময়।’
‘কিন্তু আপনার গলায় ছুরি চেপে ধরেছিল কেন?’ জানতে চাইল রাস্টি।
‘পুলিশ রোড ব্লক দিয়েছিল। গাড়িতে করে পালাতে পারবে না বুঝে সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে এসে ঢুকল ওরা। এখানে গাড়ি ফেলে আমার একটা এয়ারবোট নিয়ে পালিয়েছে। বোটের চাবি দেয়ার জন্যে আমার গলায় ছুরি চেপে ধরেছিল।’
কিশোর ও রবিনের দিকে ফিরে রাস্টি বলল, ‘করাত-ঘাসের ভিতর দিয়ে সহজেই ছুটে যেতে পারে এয়ারবোট।’
‘জানি,’ মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘মাত্র কয়েক ইঞ্চি পানিতেও চলতে পারে।’
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ ডেপুটি শেরিফ গ্রেগ ক্যানার। পেন্সিলের পিছনটা ঠুকলেন নোটপ্যাডে। ডিনকে বললেন, ‘চলুন, তদন্তটা সেরে ফেলা যাক। আপনি বলছিলেন ডাকাতদের চেহারা দেখতে পাননি।
‘না, পাইনি। কালো হুড দিয়ে মুখ মাথা সব ঢেকে রেখেছিল, ‘ ডিন জবাব দিলেন।
‘ডাকাতদের বোটটা খুঁজে পেয়েছে পুলিশ?’ কিশোর জানতে চাইল।
‘আমার এয়ারবোটটার কথা জিজ্ঞেস করছ তো?’ ভুরু কোঁচকালেন ডিন।
‘না,’ মাথা নাড়ল কিশোর। ‘আমি বলছি ডাকাতদের বোটটার কথা। এই জায়গাটার নাম ফ্রগ’স পেনিনসুলা, তাই তো?’ ডিন মাথা ঝাঁকালে আবার বলল কিশোর, ‘তারমানে এটা উপদ্বীপ। তিন পাশ থেকে ঘিরে রেখেছে পানি। পুলিশের তাড়া খেয়ে পেনিনসুলায় এসে আটকা পড়ত ডাকাতরা, যদি বোটে করে পালাতে না পারত।
ভুরু উঁচু করলেন ডেপুটি ক্যানার। ‘ভাল কথা বলেছ তো! এটা তো ভাবিনি! খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’ নোটবুকে দ্রুত নোট করে নিলেন তিনি। ‘প্রচুর রহস্য উপন্যাস পড়ো বুঝি?’
‘পড়ে মানে?’ রাস্টি বলল। ‘রহস্যের মধ্যেই বাস করে ওরা। রহস্যের সমাধান করা ওদের নেশা। রকি বিচে ওরা বিখ্যাত গোয়েন্দা। অসংখ্য জটিল রহস্যের সমাধান করেছে, পুলিশকে সহায়তা করেছে…
রাস্টির প্রশংসা থামানোর জন্য তাড়াতাড়ি বাধা দিল কিশোর, ‘তবে এখানে রহস্য সমাধান করতে আসিনি আমরা, ছুটি কাটাতে এসেছি।’
খড়খড় করে উঠল স্কোয়াডকারের রেডিও-স্পিকার। গাড়ির জানালার কাছে গিয়ে কাত হলেন ডেপুটি ক্যানার। রেডিওতে পাঠানো মেসেজ শুনে নিয়ে ডিনকে জানালেন, ‘কোস্ট গার্ড। আপনার ছিনতাই হওয়া এয়ারবোটটার সন্ধান পাওয়া গেছে।’
‘কোথায়?’ ডিন জানতে চাইলেন।
‘ফ্লোরিডা বে’র পানির নীচে। ঝড়ে ডুবে গেছে। নিশ্চয় বেঘোরে মারা পড়েছে ডাকাতগুলো। তীর থেকে অত দূরে, দশ ফুট উঁচু ওই ঢেউয়ের মধ্যে বোট ডুবলে কোনমতেই বাঁচা সম্ভব নয়। তারমানে, বোটের সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতির মালও এখন সাগরের তলায়।’ স্কোয়াডকারে উঠলেন ক্যানার। ‘কথাটা গোপন রাখলে ভাল হয়। পঞ্চাশ লাখ ডলার পানির নীচে আছে শুনলে পঙ্গপালের মত ছুটে যাবে মানুষ।’
স্কোয়াডকারটা চলে গেলে কিশোর বলল, ‘ম্যাপে দেখলাম ফ্লোরিডা বে তো বিশাল।’
‘হ্যাঁ,’
মাথা ঝাঁকাল রাস্টি। ‘গাল্ফ অভ মেক্সিকোর অংশই বলা চলে।’
‘ঝড়ের মধ্যে কোন্ সাহসে সাধারণ একটা এয়ারবোট নিয়ে খোলা সাগরে গেল ডাকাতেরা?’ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। চিমটি কাটল নীচের ঠোঁটে। ঝড়ের মধ্যে উত্তাল সাগরে যে ওটা ডুবে যাবে, নিশ্চয় জানত ওরা।’
‘হয়তো কোনও দ্বীপে পৌছানোর চেষ্টা করছিল,’ রবিন বলল। ‘কিংবা কিউবায় যাবার মতলব করেছিল।’
‘মরিয়া হয়ে গেলে মস্ত ঝুঁকি নেয় মানুষ,’ রাস্টি বলল। ‘থাকগে, এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, আমাদের নিজেদেরই অনেক কাজ পড়ে আছে। চলো, আস্তাবলে যাই।’ পার্কিং লটের পাশে লম্বা সরু একটা কাঠের ছাউনি দেখাল ও। পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করল। ‘রবিন, এই নাও, শপিং লিস্ট। স্টোরে গিয়ে জিনিসগুলো বের করো। মুসা…’ ঘুরে তাকিয়ে মুসাকে না দেখে থেমে গেল রাস্টি।
পার্কিং লটের পাশে জাঙ্কইয়ার্ডে মুসাকে দেখতে পেল রবিন। একটা পুরানো মরচে পড়া গাড়ির সাইড মিররে ল্যাসো প্র্যাকটিস করছে।
জেনারেল স্টোরে ঢুকল রবিন। দরজার ওপরে ঝোলানো ঘণ্টা বেজে উঠল। লিস্ট দেখে প্রথমে টিনের খাবারগুলো বের করে কাউন্টারে জড় করতে লাগল ও। পিছনে আবার ঘণ্টা শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে লম্বা, পেশিবহুল একজন লোক। লাল চুল লাল দাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে।
‘এই, স্নরকেলিং ইক্যুইপমেন্ট বিক্রি করো তোমরা?’ ভারি কণ্ঠস্বর লোকটার।
‘স্নরকেল!’ হাসল রবিন। ‘জলাভূমির ঘাসের দঙ্গলে ডাইভিঙের জায়গা কোথায়?’
লোকটা হাসল না। ‘আমি কী-ওয়েস্টে যাচ্ছি।’
‘সে তো বহুদূর। এখান থেকে কম করে হলেও একশো মাইল।’ রেগে উঠল লোকটা। ‘এত কথা বলো কেন? স্নরকেলিং ইক্যুইপমেণ্ট আছে না নেই?’
‘আমি এই দোকানে চাকরি করি না।’ মাথা ঘুরিয়ে ইঙ্গিতে দোকানের পিছন দিক দেখাল রবিন। ‘ওখানে তাকের ওপর ডুবুরির যন্ত্রপাতি দেখেছি।’ নিজের কাজে মন দিল ও।
দরজার ঘণ্টা বাজল আবার। মাথা ঘুরিয়ে রবিন দেখে লোকটা চলে গেছে। কৌতূহল হলো ওর। লোকটা কোথায় যায় দেখার জন্য দরজার বাইরে বেরিয়ে এল। ডকের শেষ মাথায় বাঁধা একটা এয়ারবোটে উঠতে দেখল ওকে। বোটে আরেকজন লোক দাঁড়ানো। এদিকে পিছন ফিরে আছে। চেহারা দেখা যাচ্ছে না। মাথায় একটা সাদা কাউবয় হ্যাট। ব্যান্ডে কালো আর কমলা রঙ করা পালক গোঁজা।
লাল চুলওয়ালা লোকটাকে ভালমত দেখার জন্য ডকের দিকে এগোল রবিন। লোকটার ঘোঁৎ-ঘোঁৎ কানে এল, ‘নাহ্, এভাবে হবে না!’
সাদা হ্যাট পরা লোকটার চেহারা দেখার আর সুযোগ হলো না রবিনের। হঠাৎ গোড়ালিতে জড়িয়ে গেল কী যেন। হ্যাঁচকা টান লেগে পা’টা সরে গেল মাটি থেকে। উপুড় হয়ে পড়ে যাচ্ছে ও।
দুই
জলাভূমির ঘোলা নোনাপানিতে পড়ে গেল রবিন।
‘সরি, রবিন!’ ঝুঁকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল মুসা। রবিনকে টেনে তুলল ডকের ওপর। ওর পা থেকে দড়ির ফাঁস খুলে নিল। ‘একটা সচল নিশানার ওপর প্র্যাকটিস করতে চেয়েছিলাম। গরুর কাছাকাছি, মানে, সচল প্রাণী বলতে একমাত্র তোমাকেই পেলাম।’
‘যাক, এতবড় একটা সম্মান দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ,’ তিক্তকণ্ঠে বলল রবিন। ‘পরেরবার দয়া করে আমাকে বাদ দিয়ে গরুর কাছাকাছি অন্য কোন প্রাণী বেছে নিয়ো। দেখো তো, কেমন ভিজিয়ে দিয়েছো।’
আস্তাবলের দিক থেকে দৌড়ে এল কিশোর। ‘কী হয়েছে, রবিন?’
‘কিছু না,’ জবাব দিল রবিন। ‘ডুবুরির যন্ত্রপাতি কিনতে একটা লোক দোকানে ঢুকেছিল। লাল চুল লাল দাড়ি। বলল, কী-ওয়েস্টের দিকে যাচ্ছে। ডাইভিং ইক্যুইপমেন্ট আছে কিনা জিজ্ঞেস করল আমাকে। আমি বললাম, আমি এখানে চাকরি করি না। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল লোকটা। কোথায় যায় দেখার জন্যে আমিও বেরোলাম। একটা এয়ারবোটে উঠল ও। ওর সঙ্গে সাদা হ্যাট পরা আরেকজন লোক। হ্যাটের ব্যান্ডে কালো আর কমলা রঙের পালক গোঁজা।’
পানির ওপর দিয়ে তাকাল রবিন। সকালের সূর্য চোখে লাগছে। কপালে হাত রেখে আড়াল করল। ‘ওই যে, যাচ্ছে!’
সরু একটা খাঁড়ির দিকে এগোচ্ছে এয়ারবোট। কয়েকটা গাছের আড়ালে হারিয়ে গেল।
‘খুব তাড়া মনে হচ্ছে ওদের,’ কিশোর বলল।
‘এই যে, নিয়ে এসেছি!’
রাস্টির ডাক শুনে ফিরে তাকাল ছেলেরা। দুটো ঘোড়া আর একটা খচ্চর নিয়ে এগোতে দেখল রাস্টি ও ডিনকে।
‘এতদূর থেকে এত পথ পাড়ি দিয়ে যখন এসেই পড়লে, ‘ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল রাস্টি, ‘আসল কাউবয় হওয়ার স্বাদটা নিয়েই যাও। উইকএন্ডের জন্যে ডিন তোমাদেরকে এগুলো ধার দিয়েছে।’
ধূসর ঘোড়াটা ইঙ্গিতে দেখালেন ডিন। ‘ওর নাম গ্রে স্টোন। দ্বিতীয় ঘোড়াটা সাদা রঙের একটা পিন্টো, গায়ে ছোট ছোট বাদামী দাগ। ‘আর ও সোয়াম্প রাইডার।’
বিকট স্বরে হাঁক ছাড়ল খচ্চরটা। ‘আরে আস্তে, আস্তে।’ বুড়ো খচ্চরটার গলায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন ডিন। ‘এর নাম বুড়ো জন। রোডেওতে অংশ নিতে আসা লোকেরা আমার আস্তাবল খালি করে সব নিয়ে গেছে, রেখে গেছে একমাত্র এই বুড়োগুলোকেই।’
‘এতেই চলবে, মিস্টার ওয়াটারম্যান,’ রবিন বলল। ‘একটা কিছু তো পেলাম। পায়ে হেঁটে তো আর রোডেওতে যেতে হচ্ছে না।’
‘এরা এখানেই থাক। বিকেল বেলা এসে নিয়ে যেয়ো,’ রাস্টি বলল। ‘এখন চলো, ফিশিং ক্যাম্পে। পেটে খিদে নিয়ে নিশ্চয় অতিথিরা আমাদের পথ চেয়ে বসে আছে।’
দশ মিনিট পর হাইড্রোপ্লেন একটা ছোট দ্বীপের কিনারে নামল। গেইটর সোয়াম্পের পানি এখানে মিলিত হয়েছে ফ্লোরিডা বে’র সঙ্গে। নদীর মোহনার মতই জায়গাটা, জলাভূমির বাড়তি পানি সাগরে পড়ছে।
‘এই দ্বীপের নাম কালাহান’স-কী,’ গর্বের সঙ্গে জানাল রাস্টি ‘আমার দাদার-দাদার নামের সঙ্গে মিলিয়ে একশো বছর আগে রাখা হয়েছিল এই নাম।’
নয়া চাঁদের মত চেহারা দ্বীপটার। বালিতে ভর্তি। পূর্ব তীর ঘেঁষে খুঁটির ওপর বসানো ডজনখানেক কেবিন। ছোট দ্বীপটার নিচু উত্তরাঞ্চল ঘন করাত-ঘাসে ছাওয়া।
ভাসমান ডকের মুরিঙে প্লেন বাঁধতে বাঁধতে রাস্টি বলল, ‘কালাহান’স ফিশিং ক্যাম্পে স্বাগতম। এখানে ফিশিং ক্যাম্প করেছি বলে সবাই আমাকে পাগল ভাবে, কিন্তু আসল সমঝদাররা ঠিকই চিনে নিয়েছে জায়গাটা।’
‘আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছে,’ চারপাশে তাকিয়ে বলল রবিন। ‘এত শান্ত। এত চুপচাপ।’
কিন্তু শান্ত পরিবেশ খানখান হয়ে গেল হঠাৎ গর্জে ওঠা শটগানের শব্দে।
‘কে গুলি করল?’ চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছে মুসা।
‘নিশ্চয় হ্যারিস, আমার কেয়ারটেকার,’ উদ্বিগ্ন শোনাল রাস্টির কণ্ঠ। ‘ওর একটা শটগান আছে। কিন্তু কীসের ওপর গুলি চালাল তা তো বুঝতে পারছি না!’
‘চলুন, দেখি,’ বলে শব্দটা যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে ছুটতে শুরু করল কিশোর।
করাত-ঘাস গম ক্ষেতের মত ঘন। ঘাসের ডগা কোথাও কোথাও সাত ফুট উঁচু। এর মধ্যে ঢুকে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলল কিশোর। চারপাশে ঘাস ছাড়া আর কোন কিছুই চোখে পড়ছে না।
‘ওরে বাবারে, খেয়ে ফেললরে!’ চিৎকার শোনা গেল।
ঘাস ঠেলে সেদিকে ছুটল কিশোর। ঘাসের লম্বা পাতার ধারাল কিনারা হাতের চামড়ায় আঁচড় কাটছে। এসে পড়ল দাঁড়টানা ছোট একটা নৌকার কাছে। নৌকায় একজন লোক বসা। গালে ধূসর দাড়ি। হাতের শটগানের নল থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। থরথর করে কাঁপছে লোকটা।
মুসাকে সঙ্গে নিয়ে রাস্টিও এসে দাঁড়াল। ‘কী হয়েছে, হ্যারিস!’
‘অ্যালিগেইটর!’ নৌকার পাটাতনে ফেলে রাখা একটা দাঁড়ের অর্ধেকটা দেখাল ও, বাকি অর্ধেকটা নেই। ‘দেখুন, কীভাবে কেটেছে। ক্ষুরের মত ধারাল দাঁত। আস্ত একটা দানব। পনেরো ফুটের কম না। একটা চোখ সাদা। এ রকম অ্যালিগেইটর জীবনে দেখিনি আমি!’
কিশোর জানে, অ্যালিগেইটর হলো কুমির প্রজাতির এক ভয়ঙ্কর প্রাণী। অনেক সময় মানুষখেকো হয়ে ওঠে।
‘ওই দাঁড় দিয়ে আর নৌকা বাওয়া যাবে না,’ রাস্টি বলল। ‘নৌকাটা টেনে আনতে হবে।’
ঘাসের ওপর দিয়ে নৌকাটাকে ডাঙায় টেনে আনা হলো। ফিরে তাকাল কিশোর। দানবীয় অ্যালিগেইটরটা ওদের পিছু নিল কিনা দেখল। কিন্তু স্থির হয়ে আছে পানি। দূরে একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল হঠাৎ। পাশের একটা দ্বীপে পাশাপাশি দুটো সাইপ্রেস গাছ আছে, অবিকল একই রকম দেখতে। একটা গাছের উঁচু ডালে একজন মানুষ বসা। ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে মনে হলো।
‘মিস্টার কালাহান, ওই দ্বীপে কেউ থাকে?’ কিশোর জিজ্ঞেস করল।
কিশোরের দৃষ্টি অনুসরণ করে ফিরে তাকাল রাস্টি। টুইন সাইপ্রেস-কী’তে? নাহ্, গত একশো বছর ধরে খালি পড়ে আছে। কেন?’
‘কিন্তু একটা লোক…’ থেমে গেল কিশোর। উধাও হয়ে গেছে লোকটা। ‘আশ্চর্য! এক সেকেন্ড আগেও তো ছিল!’
‘নিশ্চয় আজব কিটি’ হ্যারিস বলল।
‘আজব কিটি!’ ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোর।
‘আজব! আজব!’
‘তোমার কাছে আজব! আর তোমার কিছু মাথামোটা বন্ধুর কাছে!’ রেগে উঠল রাস্টি। ছেলেদের দিকে তাকাল। ‘ডিন ওয়াটারম্যানের নাতি কিটি। মিশুক না, এটা ঠিক। তবে আজব বলতে যা বোঝায় তা-ও না। বেশিরভাগ সময় জলাভূমিতে কাটায়, পূর্বপুরুষদের মত। সৌখিন মাছশিকারি আর টুরিস্ট এসে জায়গাটাকে যেভাবে ওলট-পালট করে দিচ্ছে, সেটা ওর পছন্দ না। টুইন সাইপ্রেস-কী’র একটা বিশেষ মর্যাদা আছে ওর কাছে।’
‘আরে,’ এদিক ওদিক তাকাতে লাগল কিশোর, ‘রবিন গেল কোথায়?’
‘রবিন!’ চিৎকার করে ডাকল মুসা। ‘কোথায় তুমি?’
‘এই যে এখানে,’ সাড়া দিল রবিন। ‘তোমরা কোথায়?’
শটগানের গুলির শব্দ শোনার মিনিটখানেক পর ঘাসের জঙ্গলে ঢুকেছিল ও। কোমরসমান উঁচু ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে এখন। সঙ্গীদের কাউকে চোখে পড়ছে না। পানিতে একটা কাঠের টুকরো ভাসতে দেখে তুলে নিল। একটা দাঁড়ের অর্ধেকটা
হুস করে পানির ওপর মাথা তুলল এক বিশাল অ্যালিগেইটর। মস্ত হাঁ করে রবিনকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল ওটা।
তিন
ভাঙা দাঁড় দিয়ে ঠেকানোর চেষ্টা করল রবিন। দাঁড়টা কামড়ে ধরল অ্যালিগেইটর। মাথা ঝাঁকি দিয়ে হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিল। চিবিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলল।
লম্বা ঘাসের ভিতর দিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে ছুটল রবিন। ঠিক পিছনেই রয়েছে অ্যালিগেইটরটা। কোনমতে এসে ডাঙায় উঠল ও। ফিরে তাকাল। ডাঙায় উঠল না আর অ্যালিগেইটরটা। জলাভূমির কালো ঘোলাপানির ভিতর তলিয়ে যাওয়ার আগে অদ্ভুত একটা সাদা চোখ দিয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল যেন দীর্ঘ একটা মুহূর্ত।
রবিনের চিৎকার শুনে পানির কিনার ধরে দৌড় দিল কিশোর। কয়েক কদম পিছনে রয়েছে রাস্টি, মুসা আর হ্যারিস।
‘রবিন, কী হয়েছে?’ কাছে এসে জিজ্ঞেস করল মুসা।
‘আরেকটু হলেই অ্যালিগেইটরের নাস্তা হয়ে যাচ্ছিলাম,’ হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল রবিন।
এতক্ষণে কেয়ারটেকারের সঙ্গে ছেলেদের পরিচয় করিয়ে দেবার সুযোগ হলো রাস্টির। ‘ও হ্যারিস স্মিথ, ক্যাম্পের কেয়ারটেকার, এবং আমার স্টিয়ার-রোপিং পার্টনার।’
স্টিয়ার-রোপিং হলো গরুর গলায় ফাঁস পরানোর খেলা, জানে রবিন। হাত বাড়িয়ে দিল। ‘আমি রবিন।’
‘আমাকে শুধু হ্যারিস ডাকলেই চলবে। বিশ্বাস করো আর না করো, একটা কথা বলি, ওই দানব অ্যালিগেইটরটাকে আমাদের পিছনে লেলিয়ে দিয়েছে আজব কিটি। অলৌকিক ক্ষমতা আছে ওর। জলাভূমির প্রাণীকে জাদু করে ওদের দিয়ে যা খুশি করাতে পারে।’
‘আবার শুরু করলে!’ হ্যাট দিয়ে হ্যারিসের কাঁধে আলতো বাড়ি মারল রাস্টি।
‘আজব কিটিটা কে?’ রবিন জানতে চাইল।
‘ডিন ওয়াটারম্যানের নাতি,’ জবাব দিল কিশোর। টুইন সাইপ্রেস-কী’তে গাছের ওপর ওকে কীভাবে বসে থাকতে দেখেছে, বলল।
‘কী হয়েছে?’ ভারি পুরুষকণ্ঠে হাঁক শোনা গেল। ফিশিং ক্যাম্পের দিক থেকে আসতে দেখা গেল একজন লোককে। মাথায় সোনালি চুল, নীল চোখ, পুরু গোঁফ। পিছন পিছন আসছে আরও চারজন, তাদের তিনজন পুরুষ, একজন মহিলা।
‘একটা অ্যালিগেইটর আমাদের আক্রমণ করেছিল, মিস্টার বার্নার!’ জবাব দিল হ্যারিস। ‘বিশাল অ্যালিগেইটর। দুটো ক্যানু জোড়া দিলেও অত লম্বা হবে না। আরেকটু হলেই আমাকে খেয়ে ফেলছিল!’ রবিনকে দেখাল ও। ‘ওকেও নাকি আক্রমণ করেছিল।’
পানির কিনারে গিয়ে দাঁড়ালেন বার্নার। নিচু হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কী যেন দেখতে লাগলেন। দুই হাতে লম্বা ঘাস সরিয়ে উঁকি দিলেন ভিতরে। ‘দেখে যাও।’
এগিয়ে গেল ছেলেরা। ঘাসের মধ্যে মরা পাতা আর জলজ ঘাস জড় করে রাখা হয়েছে।
‘অ্যালিগেইটরের বাসা!’ চিনতে পেরে আচমকা চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে ও দেখেছে এ রকম বাসা।
‘আশপাশে একটা মা-অ্যালিগেইটর আছে,’ মিস্টার বার্নার বললেন। ‘ওই পাতার নীচে ডিম আছে। ডিমের কাছে কাউকে আসতে দেখলেই তেড়ে আসছে।’
‘আশ্চর্য!’ রাস্টি বলল। ‘সাগরের এত কাছে তো কখনও ডিম পাড়ে না অ্যালিগেইটর। পানি এখানে অতিরিক্ত নোনা। আমি তো জানতাম, জলাভূমির দুর্গম জায়গায় মানুষ ও বোটের কাছ থেকে দূরে কোথাও ডিম পাড়ে ওরা।’
‘ঠিকই জানেন, বার্নার বললেন। ‘কিন্তু এই বিশেষ অ্যালিগেইটরটা যে কোন কারণেই হোক দ্বীপের এই কিনারটাকে ডিম পাড়ার জন্যে বেছে নিয়েছে।’
‘তারমানে অ্যালিগেইটরটা মানুষখেকো, হ্যারিস বলল। ‘মানুষকে ভয় পায় না বোঝাই যাচ্ছে। খুঁজে বের করে ওটাকে মেরে ফেলা দরকার।’
‘সমস্যাটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে,’ রাস্টি জবাব দিল। ‘দুপুর হয়ে গেছে। চলো, কেবিনে যাই। খেয়ে নিয়ে রোডেওতে যেতে হবে।’
শুকনো কাপড় পরল ছেলেরা। তাজা ট্রাউট ভাজা আর জইয়ের রুটি দিয়ে লাঞ্চ সারল। তারপর রাস্টির চ্যাপ্টা তলাওয়ালা পন্টুন বোটে উঠল। ফিশিং ক্যাম্প থেকে অতিথিদের মেইনল্যান্ডে আনা-নেয়া করে এই ফেরিবোট।
ক্যাম্পে আরও কয়েকজন অতিথির সঙ্গে তিন গোয়েন্দার দেখা হলো। তাদের মধ্যে আছে টনি ও রনি ওয়াকার নামে দুই ভাই, আর হার্ভে কাসনার নামে এক লোক। রোডেওতে প্রতিযোগিতা করতে এসেছে এদের বেশির ভাগই। কাফ-রোপিং, অর্থাৎ বাছুরের গলায় ফাঁস পরানোর খেলায় অংশ নেবে টনি ও রনি। ব্রঙ্কো বাস্টিং মানে বুনো ঘোড়াকে পোষ মানানোর খেলায় অংশ নেবে হার্ভে কাসনার। আর গুজ বার্নার হবে ওয়াইল্ড-বুল রাইডার-খেপা-ষাঁড়ের পিঠে চড়ে টিকে থাকার খেলা।
সোয়াম্পল্যান্ড গুডস-এ পৌঁছল ফেরিবোট। রোডেও গ্রাউন্ডে যাওয়ার জন্য অতিথিদের নিয়ে ওয়াটারম্যানের পিকআপ ট্রাকের পিছনে চড়ল রাস্টি। ছেলেদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, ‘আমরা গেলাম। তোমরা এসো।’
ধুলো উড়িয়ে ছুটল ট্রাক।
দুটো ঘোড়া আর খচ্চরের মধ্যে কে কোনটাতে চড়ে যাবে এ নিয়ে কোন ওজর-আপত্তি হলো না। নিজের ইচ্ছেতেই বুড়ো জনের পিঠে চড়ল মুসা।
ভালমত ট্রেনিং দেয়া হয়েছে তিনটে জানোয়ারকেই। দুই লেনের রাস্তা ধরে যাওয়ার সময় গাড়ি, ট্রাক কিংবা ঘোড়ায় টানা গাড়িগুলোর কাছে ঘেঁষল না। দূর দিয়ে এগিয়ে চলল। রাস্তার গাড়িঘোড়াগুলো সব সোয়াম্পল্যান্ড রোডেওতে চলেছে।
চলতে চলতে রাস্তায় মাইলফলক চোখে পড়লেই ল্যাসো ছুঁড়ছে মুসা।
‘কেমন বুঝছ?’ ছয় নম্বর মাইলফলকটা থেকে ফাঁস খুলে নিয়ে হাসিমুখে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল মুসা।
‘মুসা, তোমার এই ল্যাসো ছোঁড়া বন্ধ করো,’ অধৈর্য হয়ে বলল রবিন। ‘যে হারে সময় নষ্ট করছো, প্রতিযোগিতার পুরোটাই মিস করব আমরা।’
বিনা প্রতিবাদে দড়িটা কুণ্ডলী পাকিয়ে রেখে দিল মুসা। বাকি পথ আর একবারের জন্যও খুলল না।
.
রোডেওতে রাস্টি আর হ্যারিসের সঙ্গে দেখা হলো ওদের। দ্রুত রোডেও গ্রাউন্ডটা ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য নিয়ে চলল রাস্টি। জানাল, জায়গাটার মালিক ক্লিন্ট গিবসন নামে একজন কোটিপতি। একটা ক্যা র্যাঞ্চের কিছুটা অংশকে আলাদা করে প্রতি বছর রোডেওর আয়োজন করেন। এ সময় ট্রাক ভর্তি করে রোডেওর জন্য জিনিসপত্র আর গরুঘোড়া নিয়ে আসা হয়। মেইন রোডেও রিঙের চারপাশ ঘিরে দর্শকদের জন্য জায়গা করে দেয়া হয়েছে, এর নাম গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড। রিঙের একপাশে বিশাল সামিয়ানা টাঙানো।
‘ওখানে কী?’ রবিন জানতে চাইল।
‘ফার্মের জিনিসপত্রের প্রদর্শনী, রোডেও রেজিস্ট্রেশন টেবিল, খাবারের দোকান এসব। আয়োজনটা সব মিলিয়ে সেই পুরনো দিনের কার্নিভালের মত।’
‘দূরের ওই বিল্ডিংগুলো কীসের?’ হ্যারিসকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘একটা গোলাঘর।
বাকিগুলোতে বাঙ্কহাউস, রোডেও রাইডারদের জন্যে,’ হ্যারিস বলল। ‘পার্কিং লটের শেষ মাথায় ট্রেইলারগুলোতে থাকেন বিচারক ও রোডেও ভাঁড়েরা।’
মূল সামিয়ানাটায় ঢুকল ওরা। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নিতে হয়। রাস্টি আর হ্যারিস লাইনে দাঁড়াল গিজগিজ করছে কাউবয় আর দর্শক। সেদিকে তাকিয়ে রবিন জিজ্ঞে করল, ‘প্রতিযোগীরা কোনখান থেকে আসে?’
‘বেশির ভাগই স্থানীয়, ফ্রগ’স পেনিনসুলার বাসিন্দা,’ রাস্টি জানাল। ‘বাকিরা পেশাদার, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা। রোডেও হবে শুনলেই ছোটে, যেখানেই হোক।’
‘মাত্র দশ ডলার কম, মিস্টার গিবসন,’ সারির সামনে থেকে চেঁচিয়ে বলল লম্বা, হালকা-পাতলা একটা টিনেজ ছেলে।
‘সরি, ইয়াং ম্যান,’ জবাব দিলেন সাদা চুল আর গালে পোড় দাগওয়ালা একজন ভদ্রলোক। তিনিই মিস্টার গিবসন। ‘কাল রাে বুল-রাইডিং শুরু হওয়ার আগে যদি দশ ডলার পূরণ করে দিে পারো, তোমাকে আমি খেলায় নেব, যাও, কথা দিলাম। কিন্তু আ রাতে শুধু ব্রঙ্কো বাস্টিঙেই খেলতে হবে তোমাকে।’
‘ঠিক আছে!’ হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছেলেটা। বার বার একটা মুদ্রা টোকা দিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে লুফে নিচ্ছে।
রেজিস্ট্রি খাতায় নাম লিখে নিয়ে একটা অফিশিয়াল নম্বর দিলেন ওকে মিস্টার গিবসন।
ছেলেটা ফিরে তাকাতেই রবিনের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। ‘কী দেখছ?’ ভুরু নাচাল ছেলেটা। মারমুখো ভঙ্গি। হতাশায়ই বোধহয়।
‘কিছু না,’ ঝামেলা এড়ানোর জন্য বলল রবিন।
‘দাঁড়াও না, আজ রাতে সবাইকে দেখিয়ে দেব আমি,’ অহঙ্কার ফুটে বেরোচ্ছে ছেলেটার চেহারায়। ‘ব্রঙ্কো-রাইডিং প্রতিযোগিতায় জিতবই।’
আবার মুদ্রাটা ওপরে ছুঁড়ে দিল ও। সোনার মোহর, চিনতে পারল রবিন। চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওর। পকেটে টাকা নেই, দশ ডলারের জন্য খেলায় অংশ নিতে পারছে না, অথচ সোনার মোহর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
‘আমার নাম বিল ওয়াটমোর। বোর্ডের লিস্টে একেবারে প্রথম দিকে দেখতে পাবে আমার নাম।’ অহঙ্কারী ভঙ্গিতে চোখা চোয়ালটা উঁচু করে ধরল ছেলেটা। ‘কারণ, আমি জিতবই।’
কিশোর লক্ষ করল, কাছেই একটা সুভনির স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে গুজ বার্নার স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। এগিয়ে এল, ‘এই ছেলে, বেশি বড় বড় কথা হয়ে যাচ্ছে না?’
‘আমি ছেলে নই, মিস্টার,’ ভুরু কুঁচকে তাকাল বিল। ‘ছেলে বলার বয়েস পার হয়ে এসেছি। কে আপনি?’
‘আমার নাম গুজ বার্নার। আমি একজন ব্রঙ্কো বাস্টার। গত বছর নর্থ ডাকোটার ফার্গোতে দেখেছি তোমাকে, তাই না?’
‘অ্যা!’ হঠাৎ করেই আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলল যেন বিল।
‘আমি প্রথম হয়েছিলাম,’ হাসিমুখে বলল বার্নার। ‘যে রকম বড়াই করছ, ওর অর্ধেক ক্ষমতাও যদি তোমার থাকে, স্পন্সরের অভাব হবে না তোমার। প্রতিযোগিতার জন্যে তোমার রেজিস্ট্রেশনের টাকাটা দিয়ে দেবে। তবে তোমার পুরস্কারের টাকা থেকে একটা ভাগ অবশ্যই কেটে নেবে।’
‘স্পন্সর পাওয়ার উপযোগী আমি, তাতে কোন সন্দেহ নেই, ‘ আত্মবিশ্বাস ফিরে এল আবার বিলের।
‘চলো দেখি, তোমার জন্যে একজন স্পন্সর খুঁজে বের করা যায় কিনা,’ বার্নার বলল।
‘আপনি রেজিস্ট্রি করাবেন না?’ জিজ্ঞেস করল হ্যারিস।
‘পরেও করতে পারব।’ বিলের কাঁধে হাত রাখল বার্নার। ওকে নিয়ে চলে গেল।
‘বেশি অহঙ্কার,’ ছেলেটার কথা বলল রাস্টি। রেজিস্ট্রেশন টেবিলের সামনে পৌঁছে গেছে।
‘তাড়াতাড়ি যান,’ রাস্টির হাতে একটা নম্বরের টিকেট ধরিয়ে দিয়ে গিবসন বললেন। ‘আপনার খেলা পনেরো মিনিটের মধ্যেই শুরু হবে।’
‘আমি যাচ্ছি, পরে দেখা হবে,’ কিশোরদের দিকে ফিরে বলল
রাস্টি।
‘গুড লাক!’ রবিন বলল।
তাড়াহুড়া করে চলে গেল রাস্টি।
‘আমার গলা শুকিয়ে গেছে,’ কিশোর বলল। ‘কোকটোক কিছু খাওয়া দরকার। তোমরা খাবে?’
‘খাব তো বটেই,’ মুসা জবাব দিল। ‘সবচেয়ে বড়টা।’
‘তোমরা যাও, আমি নিয়ে আসছি।’
মুসাকে নিয়ে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের দিকে এগোল রবিন।
কোকের জন্য কনসেশন স্ট্যান্ডের লাইনে দাঁড়িয়েছে কিশোর সামনে দুজন রোডেও প্রতিযোগী তরুণের কথা কানে এল। হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া শীতকালের ঝড়ে ফ্লোরিডা বে’তে ডুবে যাওয়া ব্যাংক ডাকাতরা মরে গেছে না বেঁচে আছে, এ নিয়ে তর্ক করছে লোকগুলো। কিশোরও তাতে যোগ দিল। কাউন্টারের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে এতটাই খাতির জমিয়ে ফেলল লোকগুলোর সঙ্গে, সেদিন বিকেলে রোডেও প্রতিযোগিতার পর সামিয়ানার পিছনে বারবিকিউতে দাওয়াত পেয়ে গেল।
বড় বড় তিনটে কোকের বোতল হাতে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের দিকে এগোনোর সময় রাস্টির ফিশিং ক্যাম্প থেকে আসা তিনজন অতিথিকে গভীর মনোযোগে আলোচনা করতে দেখল কিশোর। কানে এল, রনি ওয়াকার বলছে, ‘জলাভূমিতে একটু ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে ছিল আমার আর টনির, কিন্তু অ্যালিগেইটরটার জন্যে সাহস পাচ্ছি না।’
অ্যালিগেইটরের কথা শুনে কান খাড়া করে ফেলল কিশোর।
‘বেশি সাহস না করাই ভাল,’ বার্নার বলল।
‘আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি,’ ভারি একটা কণ্ঠ ওদের পিছন থেকে বলল। লাল দাড়িওয়ালা একজন লোক সামনে এগিয়ে এল। আমার নাম মরিস মরিসন। সারাজীবন অ্যালিগেইটর ঘাঁটাঘাঁটি করেছি।’ ডান হাতটা উঁচু করে দেখাল ও। কড়ে আঙুলের পুরোটা আর ওর পাশের আঙুলের অর্ধেকটা নেই। ‘পঞ্চাশ ডলার ফি আর দুই রাত সময় দিলে অ্যালিগেইটর সমস্যার সমাধান আমি করে দিতে পারি।’
‘স্পেশাল পারমিশন ছাড়া অ্যালিগেইটর মারা বেআইনী,’ টনি ওয়াকার বলল।
‘অ্যালিগেইটর মারার কথা কে বলছে। আমি ওটাকে ধরে নিয়ে গিয়ে জলাভূমির নির্জন কোন জায়গায় রেখে আসব।’
‘তাহলে পঞ্চাশ ডলার খরচ করা যায়।’ রনি-টনির দিকে তাকাল বার্নার। মানিব্যাগ বের করল। টাকাটা আমিই দিচ্ছি।’
‘তবে আমার একটা অনুরোধ আছে,’ মরিস বলল। ‘আমি রাতের বেলা কাজ করব। ওই সময় আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করা চলবে না। বেশি লোকজন দেখলে অ্যালিগেইটরটা লুকিয়ে পড়বে। মাঝরাতের পর থেকে কারফিউ জারি করলাম—গেইটর সোয়াম্পের ধারে কাছে যাবেন না কেউ।’
তিনজনেই মরিসের কথায় রাজি। থেমে দাঁড়িয়েছিল, আবার গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়াল কিশোর। মুসা আর রবিনকে পাওয়া গেল। কিশোর বলল, ‘রবিন, তোমার সেই লাল দাড়িওয়ালা লোকটাকে দেখলাম। অ্যালিগেইটরটাকে সরানোর জন্যে তাকে নিয়োগ করেছে গুজ বার্নার।’
‘অ্যালিগেইটর শিকারি নাকি লোকটা?’ রবিনের প্রশ্ন। ‘আমি তো ভেবেছিলাম ও ডুবুরি। স্নরকেল পরে পানিতে ডুব দেয়।’
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘আমার মনে হয়, দুটোই। অ্যালিগেইটরও শিকার করে, আবার ডুবুরিও। কিন্তু তুমি না বললে কী-ওয়েস্টের দিকে চলে গেছে লাল দাড়িওয়ালা লোকটা?’
ঠিক এই সময় গেট খুলে গেল। ঘোড়ার পিঠে চড়ে শূট থেকে বেরিয়ে রিঙে ঢুকল প্রথম ব্রঙ্কো রাইডার।
‘বিল ওয়াটমোর!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
পিঠ বাঁকিয়ে লাফানো শুরু করল ঘোড়াটা। অনবরত পিছনের দুই পা ছুঁড়ছে। চাবুকের মত সামনে পিছনে ঝাঁকি খাচ্ছে ওর পিঠে বসা আরোহী। কিন্তু পড়ছে না। শক্ত হয়ে পিঠে চেপে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর ঘণ্টা বাজিয়ে ওকে যোগ্য এবং পরের খেলার জন্য নির্বাচিত ঘোষণা করা হলো।
লাফ দিয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এল বিল। আস্তে করে পা রাখল পুরু ধুলোয় ঢাকা রিঙের মাটিতে। স্বচ্ছন্দ ভঙ্গি। ঢোলা পোশাক পরা, মুখে রঙ মাখা দুজন ভাঁড় বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করতে করতে ছুটে এসে দু’পাশ থেকে লাগাম ধরে ঘোড়াটাকে সরিয়ে নিয়ে গেল।
‘মুসা, ল্যাসো ছুঁড়তে যদি হাত কাঁপে তোমার, ওদের সঙ্গে যোগ দিতে পারো,’ ভাঁড়দের দেখিয়ে রসিকতা করল রবিন।
‘না জেনে কথা বোলো না,’ ঝাঁঝিয়ে উঠল মুসা। ‘রোডেও ভাঁড় হওয়া অত সোজা না। ভীষণ কঠিন কাজ। আর খুবই বিপজ্জনক। ওস্তাদ লোক ছাড়া ভাঁড় হতে পারে না।’
দর্শকদের উদ্দেশ্যে বাউ করল বিল। হ্যাট তুলে নাড়ল। রবিন লক্ষ করল, হ্যাটটা সাদা। ব্যান্ডে কমলা ও কালো রঙের পালক পরানো। এয়ারবোটে মরিস মরিসনের সঙ্গে যে লোকটাকে দেখেছিল, তার মাথায়ও এ রকম হ্যাট পরা ছিল।
‘রাস্টি আসছে!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
শূটের ভিতর দেখা যাচ্ছে রাস্টিকে। ব্ল্যাক ডেভিল নামে একটা কালো ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। দরজা খুলে গেল। পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে এল ঘোড়াটা। ‘কালো শয়তান’ই। নামের সঙ্গে স্বভাবের মিল আছে। পাক খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে আরোহীকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু লাগাম ধরে শক্ত হয়ে বসে থাকল রাস্টি। মজা পেয়ে একনাগাড়ে চিৎকার করছে বাচ্চা ছেলের মত। নির্বাচিত ঘোষণা করা হলো ওকেও। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে এল ও। বিপুল করতালির মাধ্যমে অভিনন্দন জানাল দর্শকরা। এ অঞ্চলে প্রচুর ভক্ত আছে ওর, বোঝা গেল।
‘হারিক্যানে চড়ে আসবে এখন কিটি ওয়াটারম্যান,’ ঘোষণা দিলেন মিস্টার গিবসন। মুহূর্তে হট্টগোল থেমে গেল। চুপ হয়ে গেল দর্শক।
‘কিটি ওয়াটারম্যান?’ রবিন বলল, ‘কিশোর, হ্যারিসের আজব কিটি না তো? টুইন সাইপ্রেস কীতে যে লোকটাকে দেখেছিলে?’
কিশোর জবাব দেয়ার আগেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল শূটের দরজা। শূন্যে পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে তীব্র গতিতে বেরিয়ে এল আরেকটা ঘোড়া। ভীষণ বেয়াড়া। প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে আরোহীকে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু আরোহীও কম না। জোঁকের মত লেগে রইল ঘোড়ার পিঠে। নির্বাচিত ঘোষিত হওয়ার ঘণ্টা বাজতেই আলগোছে লাফ দিয়ে নেমে এল ঘোড়ার পিঠ থেকে, তিন গোয়েন্দার একেবারে সামনে।
শীতল কালো চোখ মেলে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে রইল কিটি দর্শকদের করতালি থেমে এলে লাফিয়ে রিঙের বেড়া ডিঙাল ও, তিন গোয়েন্দার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘গেইটর সোয়াম্প থেকে দূরে থেকো, নইলে…’ নইলে কী হবে মুখে না বলে হাত দিয়ে গলায় পোঁচ মেরে বুঝিয়ে দিল।
চার
‘এই শোনো, দাঁড়াও!’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
কিন্তু ফিরল না কিটি। রিঙের উল্টো দিকের একটা গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
‘আচ্ছা, হচ্ছেটা কী, বলো তো?’ মুসার প্রশ্ন।
‘জানি না, তবে জানার চেষ্টা করতে যাচ্ছি। তুমি এখানে থাকো, বলে রবিনকে নিয়ে দর্শক বেরোনোর গেটের দিকে ছুটল কিশোর।
বেরিয়ে এসে কিটিকে কোথাও দেখল না। লাল রঙের চওড়া কানাওয়ালা হ্যাট পরা একজন ভাঁড়কে চোখে পড়ল রবিনের, ব্ল্যাক ডেভিলকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গোলাবাড়ির কাছে আস্তাবলে।
কিটির চেহারা ও পোশাকের বর্ণনা দিয়ে ওরকম কাউকে যেতে দেখেছে কিনা লোকটাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আঙুল তুলে গোলাঘরের পিছনের একটা মাঠ দেখাল ভাঁড়।
দূরের বনের দিকে একজন মানুষকে চলে যেতে দেখল কিশোর।
‘জলাভূমিতে যাচ্ছে,’ ভাঁড় জানাল। ‘ওর পিছু নিয়ে লাভ নেই।’
‘কেন?’ মাঠের ওপাশে বনের ভিতর কিটিকে চলে যেতে দেখছে কিশোর।
‘ধরতে পারবে না, তার কারণ,’ ভাঁড় জবাব দিল, ‘এখানকার জলাভূমির প্রতিটি ইঞ্চি ওর চেনা। কোথায় সাপ, কোথায় অ্যালিগেইটরের বাসা, কোথায় চোরাবালি, সব জানে। ওই জলাভূমিতে তোমরা পাঁচ মিনিটও টিকতে পারবে না।’
‘মনে হয় ঠিকই বলছে, কিশোর,’ রবিন বলল। ‘অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। কিটিকে খুঁজে পাব না আমরা।’
‘কিটিকে তারমানে আপনি ভাল করেই চেনেন?’ ভাঁড়কে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘সারা জীবন এখানে কাটিয়েছি, চিনব না। ও, আমার নাম ডিক, ডিক টোম্যান।’
আচমকা বিরক্ত ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠল ব্ল্যাক ডেভিল। পিছনের পায়ে খাড়া হয়ে যেতে চাইছে। তাড়াতাড়ি ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টা করল টোম্যান। ‘সরি, এখন আর কথা বলতে পারব না। ঘরে যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে গেছে ও।’ মস্ত হ্যাটের কানা ছুঁয়ে মৃদু বাউ করল ভাঁড়। ঘোড়াটাকে টেনে নিয়ে গোলাঘরের দিকে চলে গেল।
মুসাও চলে এসেছে ততক্ষণে। কিশোর বলল, ‘গেইটর সোয়াম্পে কিছু একটা ঘটছে।’
‘কী ঘটছে?’ মুসার প্রশ্ন।
পঞ্চাশ ডলারের বিনিময়ে অ্যালিগেইটরটাকে সরিয়ে দেওয়ার চুক্তি করেছে মরিস, দু’রাত কাউকে জলাভূমিতে যেতে নিষেধ করেছে, এ কথা দুই সহকারীকে জানাল কিশোর। তারপর বলল, ‘মরিসের ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে। রবিন, তোমরা দুজন বিল ওয়াটমোরের ব্যাপারে জানার চেষ্টা করো। মরিসের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা কী, বোঝা দরকার। আমি মরিসের খোঁজ নেব।’
.
পরের একটি ঘণ্টা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিল কিশোর। অনেককেই জিজ্ঞেস করল মরিস মরিসনকে চেনে কিনা। ফ্রগ’স পেনিনসুলার স্থানীয় কেউ তো চেনেই না, বাইরে থেকে রোডেও রাইডে অংশগ্রহণ করতে আসা কেউও চেনে না ওকে।
রবিন আর মুসা ওদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে, সামিয়ানার ভিতর। অবশেষে রেজাল্ট বোর্ডের সামনে এসে বিলকে পেল, যেখানে ব্রঙ্কো-রাইডিঙে অংশগ্রহণকারীদের নামের তালিকা টানিয়ে দেয়া হয়েছে।
‘এই, বিল,’ ডাক দিল রবিন।
ফিরে তাকাল বিল। ‘ও, তোমরা।’
‘তোমার খবর কী?’ জানতে চাইল মুসা।
‘আর বোলো না,’ বিড়বিড় করল বিল। ‘দেখো না কী কাণ্ড করে রেখেছে!’
বোর্ডের দিকে তাকাল রবিন। প্রথম দুজন রাস্টি কালাহাল ও কিটি ওয়াটারম্যান। বিলের নাম বারো নম্বরে। রবিন জিজ্ঞেস করল, ‘তোমাকে এত নীচে নামাল কেন? ঘণ্টা না বাজানো পর্যন্ত তো টিকেই ছিলে।’
‘শুধু টিকে থাকলেই হয় না, আরও অনেক ব্যাপার আছে। ঘোড়ার পিঠে বসে থাকার ভঙ্গি, কতটা সাবলীল, কেমন ঘোড়া, এ রকম নানা জিনিস বিবেচনায় আনা হয়।’
‘তোমরা এখানে!’ তাড়াহুড়া করে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল রাস্টি। ‘সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে ফিরে যাচ্ছি আমরা। এখুনি যেতে হবে।’
‘আমাদের বয়েসীরা একটা বারবিকিউর ব্যবস্থা করেছে,’ মুসা জানাল। ‘দাওয়াতও পেয়েছি। যোগ দিতে চাচ্ছিলাম।’
‘আমার তো কোন তাড়া নেই,’ রাস্টি জবাব দিল। ‘কিন্তু অতিথিরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পন্টুন বোটে আমাদের সঙ্গে ফিশিং ক্যাম্পে না গেলে এখানে আটকে পড়বে তোমরা। যাওয়ার আর কোন ব্যবস্থা নেই। ‘
‘আমি ওদের পৌঁছে দিতে পারি,’ বিল বলল। ‘সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে আমার একটা বোট বাঁধা আছে। কালাহান’স ফিশিং ক্যাম্পে যাবে তো ওরা? যাওয়ার সময় আমার পথেই পড়বে।’
‘বাড়ি কোথায় তোমার?’
‘ফ্রগ’স পেনিনসুলাতেই।’
‘গেইটর সোয়াম্প পাড়ি দিয়ে বোটে করে সোয়াম্পল্যান্ড গুডস হয়ে এসেছ?’ অবাক মনে হলো রাস্টিকে। ‘ফ্রগ’স পেনিনসুলা থেকে হেঁটেও তো এর অর্ধেক সময়ে এখানে চলে আসা যায়।’
জবাব দেয়ার আগে দ্বিধা করল বিল। ‘জলাভূমি দিয়ে বোটে চলাচল করতে আমার ভাল লাগে।’
সন্দিহান চোখে বিলের দিকে তাকিয়ে রইল রাস্টি। রবিন লক্ষ করল, অস্বস্তি বোধ করছে বিল। ওর কাছ থেকে তথ্য জানার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, বিল। তোমার সঙ্গেই যাব আমরা। গেইটর সোয়াম্প হয়ে বোটে করে যাওয়াটা নিশ্চয়ই খুব মজার।’
‘যা-ই করো, মাঝরাতের আগে যাবে,’ রাস্টি বলল। ‘অ্যালিগেইটরটাকে সরানোর জন্য টাকা নিয়েছে মরিস। মাঝরাতের পর আর জলাভূমিতে থাকা চলবে না।’ পার্কিং লটের দিকে হাঁটতে শুরু করল ও।
‘বাঙ্ক-হাউসে গিয়ে চট করে গোসলটা সেরে আসি,’ বিল বলল। ‘বারবিকিউতে দেখা হবে তোমাদের সঙ্গে।’
বিল চলে গেলে রবিনের দিকে তাকাল মুসা। ‘মরিসের কথা বিলকে জিজ্ঞেস করলে না যে?’
‘করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম বিলের সন্দেহ হয়ে গেলে শেষে কোন প্রশ্নেরই জবাব দেবে না।’
মাথা ঝাঁকাল মুসা। ‘তা ঠিক।’
‘প্রথমে এখন কিশোরকে খুঁজে বের করতে হবে,’ রবিন বলল। ‘ও কী জানল, শুনি।’
গরুর খুপরিগুলোর কাছে পাওয়া গেল কিশোরকে। দুজন রোডেও শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলছে। রবিন আর মুসাকে দেখে সরে এল কিশোর। ‘এখানে মরিস মরিসনকে কেউ চেনে না।’
বিলের সন্দেহজনক আচরণের কথা কিশোরকে জানাল রবিন। ‘আমার মনে হয় গেইটর সোয়াম্পে অবৈধ কিছু একটা করছে বিল আর মরিস মিলে।’
‘বেআইনীভাবে অ্যালিগেইটর শিকার করছে হয়তো,’ কিশোর বলল। ‘অ্যালিগেইটরের চামড়ার অনেক দাম, চোরাই বাজারে বিক্রি করে।’ চিন্তিত ভঙ্গিতে নীচের ঠোঁটে চিমটি কাটল ও। ‘জলাভূমিতে গিয়ে দেখা দরকার।’
‘আপাতত জলাভূমির কথা বাদ। বারবিকিউতে যাই, চলো,’ বলল মুসা।
.
সামিয়ানার পিছনে গনগনে অগ্নিকুণ্ড ঘিরে বসেছে বেশ কিছু তরুণ- তরুণী। রোডেও শ্রমিকরা খুঁটির মাথায় আলো জ্বেলে দিয়েছে। মস্ত দুটো সিকে গেঁথে গরুর আস্ত রান কয়লার আঁচে পুড়িয়ে কাবাব বানানো হচ্ছে। সুগন্ধ ভুরভুর করছে বাতাসে।
ডেপুটি শেরিফ গ্রেগ ক্যানারকে দেখা গেল ওখানে। পরনে এখন ইউনিফর্ম নেই। সাদা শার্ট, নীল জিনস আর কাউবয় বুট পরেছেন। কথা বলছেন মিস্টার গিবসনের সঙ্গে। কিশোরদের দেখে হাত নাড়লেন।
হাতে একটা ছোট সাইজের কাবাবের সিক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল বিলকে। থেকে থেকেই সোনার মোহরটায় টোকা দিয়ে শূন্যে ছুঁড়ছে। ‘বুনো ষাঁড়কেও পরোয়া করি না আমি,’ বড়াই করছে ও। ‘কাল দেখো। ব্ল্যাক সাইক্লোনের পিঠে চড়ব।’
‘মিস্টার বার্নার তারমানে একজন স্পন্সর জোগাড় করে দিয়েছেন তোমাকে,’ বিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর।
‘হ্যাঁ।’
মোহরটার দিকে ইঙ্গিত করে কিশোর বলল, ‘ওটা কী? তোমার সৌভাগ্যের প্রতীক?’
‘অ্যা? হ্যাঁ, সৌভাগ্যের প্রতীক।’ হাতের মুঠো বন্ধ করে মোহরটা লুকিয়ে ফেলল বিল, যাতে কিশোর আর দেখতে না পায়।
অন্ধকার ছায়া থেকে ক্যাম্পফায়ারের আলোয় বেরিয়ে এল লম্বা, টাকমাথা, কালো চশমা পরা একজন মানুষ। বিলকে বলল, ‘হ্যাঁ, লুকিয়ে ফেলো, খোয়া যাওয়ার আগেই।’
মোহরটা পকেটে ভরল বিল। কিশোরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল, ‘ইনি আমার স্পন্সর, মিস্টার ফক্স ডেনভার।’
হাত বাড়িয়ে দিল কিশোর। কর্কশ হাতে কিশোরের হাতটা চেপে ধরে ডেনভার বলল, ‘মাছধরা আমার পেশা। রোডেওতে আসি বিনোদনের জন্যে। তোমরা বিলের বন্ধু নাকি?’
‘বলতে পারেন। অবশ্য আজই ওর সঙ্গে পরিচয় হলো।’
‘ও। তারমানে আমার মতই নতুন পরিচয়।’
‘হ্যাঁ,’ জবাবটা দিল রবিন। ‘সচরাচর এ রকম অপরিচিত রাইডারদেরকেই স্পন্সর করেন নাকি আপনি, সার?’
রবিনের প্রশ্ন শুনে হাসল ডেনভার। ‘না, তা করি না। তবে বিলকে দেখে মনে হলো, পারবে, তাই স্পন্সর করলাম। কেন, এ প্রশ্ন কেন?’
‘রবিন আসলে বলতে চাইছে বিলের বয়েস কম,’ কিশোর বলল। ‘আরও অভিজ্ঞ কাউকেই সাধারণত স্পন্সর করা হয় তো।’
‘আমার বয়েস কম কে বলল?’ রেগে গেল বিল। ‘আঠারো! কম হলো? এরচেয়ে কম বয়েসীদেরও স্পন্সর করা হয়। যোগ্যতাটাই আসল কথা।’
কিশোর-রবিন দুজনের কাঁধেই কঠিন হাতের চাপ লাগল হঠাৎ। ওরা দেখল মরিস মরিসন দুই হাতে ওদের কাঁধ ধরেছেন। ‘তোমাদের তো এখন ফিশিং ক্যাম্পে বিছানায় থাকার কথা।’
‘হ্যাল্লো, মিস্টার মরিসন।’ বলে রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। ‘রবিন, এঁর কথাই তোমাকে বলেছিলাম, অ্যালিগেইটর শিকারি। মিস্টার মরিসন, ও আমার বন্ধু, রবিন।’ মুসার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে মুখ ফেরাল ও। কিন্তু কাছাকাছি নেই মুসা। বেশ কিছুটা দূরে আগুনের একেবারে কাছ ঘেঁষে বসেছে, কাবাব ঝলসানো হচ্ছে যেখানে।
মরিসনের সঙ্গে হাত মেলাল রবিন। চট করে তাকাল একবার কিশোরের দিকে। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, সকাল বেলা সোয়াম্পল্যান্ড গুডস জেনারেল স্টোরে এই লোকটার সঙ্গেই কথা হয়েছিল। ‘আমি তো ভাবলাম,’ রবিন বলল, ‘কী-ওয়েস্টে চলে গেছেন আপনি।’
চোখের পাতা সরু হয়ে এল মরিসের। মত বদলেছি।’
‘বিল ওয়াটমোরের সঙ্গে আপনার আগে থেকেই পরিচয় আছে মনে হচ্ছে?’ কিশোরের প্রশ্ন।
‘না, নেই।’ বিলের দিকে তাকাল মরিস। হাত বাড়িয়ে দিল। ‘হাই, বিল।’
ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের।
‘হাই!’ রবিন লক্ষ করল হাত মেলানোর সময় মরিসের কাটা আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছে বিল, যেন আগে আর চোখে পড়েনি।
ব্যাপারটা মরিস লক্ষ করল বলে মনে হলো না। কিশোরের দিকে তাকাল। ‘কুইসটনে আমার বাড়ি, লেক ওকিশবির একটা ছোট্ট শহরে। এখানে এসেছি রোডেও দেখতে, আমার এক বন্ধু প্রতিযোগিতা করছে। টাকার প্রয়োজনে অ্যালিগেইটরটা সরানোর কাজ নিয়েছি, পঞ্চাশ ডলার।’ আবার কিশোর ও রবিনের কাঁধ চেপে ধরল ও। ‘কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারো।’
দুজনকে চুপ করে থাকতে দেখে হাত সরিয়ে নিল মরিস। হাঁটতে শুরু করল। পিছু নিতে গেল রবিন। বাধা দিল কিশোর।
‘এসব কী?’ জানতে চাইল ডেনভার।
‘আমিও তো বুঝতে পারছি না,’ রবিন জবাব দিল।
রোডেওর একজন বাদক একটা ট্রাকের পিছনে চেপে এসে হাজির হলো। হাতে একটা বেহালা। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘বন্ধুগণ, নাচতে এসো! যার যার জোড়া বেছে নাও!’
খুঁটির মাথায় আলো জ্বেলে ঘিরে দেয়া জায়গাটায় নাচার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানে জড় হয়েছে জনাবিশেক তরুণ-তরুণী
এক ফাঁকে কিশোরকে বলল রবিন, ‘বিল এমন ভান করল, যেন মরিসকে চেনেই না।‘
শুনে ফেলল বিল। ‘এই, কী বলছ?’
শুনেই যখন ফেলেছে আর গোপন করার কোন মানে হয় না। রবিন জিজ্ঞেস করল, ‘বিল, গেইটর সোয়াম্পে কী করছ তোমরা?’
‘মানে?’
‘মানে, কী করছ জানতে চাইছি।’
‘জেরা করছ কেন?’
পিছন থেকে ডেপুটি ক্যানার বলে উঠলেন, ‘করবেই তো। ওরা শখের গোয়েন্দা যে। এটাই তো ওদের কাজ।’
ভয় দেখা গেল বিলির চোখে। পিছিয়ে যেতে শুরু করল।
‘আরে! কোথায় যাচ্ছ?’ বিলকে ধরার জন্য হাত বাড়াল রবিন। আচমকা ঘুরে দৌড় দিল বিল। অগ্নিকুণ্ডের পাশ ঘুরে ওপাশের অন্ধকারে চলে গেল।
‘বিল! আরে এই বিল! দাঁড়াও! দাঁড়াও!’ রবিনও ছুটতে শুরু করল।
অগ্নিকুণ্ডের কাছে বসে নিশ্চিন্তে কাবাব চিবাচ্ছে মুসা। হাত ধরে একটানে ওকে তুলে নিল কিশোর। রবিনের পিছনে ছুটল দুজনে।
পাঁচ
অগ্নিকুণ্ডের অন্যপাশে চলে এসেছে, ঠিক এই সময় কারও জুতোয় হোঁচট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল রবিন।
‘সরি!’ মাটি থেকে রবিনকে টেনে তুলল ফক্স ডেনভার। ‘লাগেনি তো?’
বিলকে আর দেখা যাচ্ছে না। চিন্তিত ভঙ্গিতে ডেনভারের দিকে তাকাল রবিন। ইচ্ছে করে ওকে বাধা দেয়নি তো ডেনভার? জুতো বাড়িয়ে দিয়েছিল, না সত্যিই এটা দুর্ঘটনা?
কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর ও মুসা।
ফক্স ডেনভার চলে গেল।
‘চলো,’ রবিনকে বলল কিশোর, ‘ডেপুরি ক্যানারকে জানাই।’ বিকেলের পর থেকে যা যা ঘটেছে, সব ক্যানারকে খুলে বলল ওরা।
‘অদ্ভুত লাগছে,’ ক্যানার বললেন। ‘মরিস মরিসন কিংবা বিল ওয়াটমোর কাউকেই চিনি না আমি। হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কিটির সঙ্গেও কথা বলা দরকার। কিন্তু ওকে পাওয়াই মুশকিল।’
‘বুল রাইডিঙে প্রতিযোগিতা করার জন্যে কাল বিকেলে কিটি আবার আসবে এখানে,’ কিশোর বলল।
‘ঠিক। কাল বিকেল পাঁচটায়। তখন ধরব ওকে। এখানেই তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে আমার।
‘ঠিক আছে।’ কিশোর জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, ব্যাংক ডাকাতরা যে বোটটাতে করে পালিয়েছে ভাবা হচ্ছে সেটার খোঁজ পেয়েছেন?’
‘নাহ্!’ ভ্রূকুটি করলেন ডেপুটি। ‘এখনও পাইনি। খোঁজা হচ্ছে।’
‘ডাকাতির টাকাও নিশ্চয় পাননি এখনও?’
‘না। মজার ব্যাপারটা হলো, একজন ডাকাতেরও লাশ পাওয়া যায়নি। বেমালুম হাওয়া। ঝড়ের সময় ঢেউয়ের টানে বহুদূরে চলে গিয়ে থাকতে পারে।’
‘আর টাকাগুলোও নিশ্চয় নষ্ট হয়ে গেছে পানিতে ভিজে,’ কিশোর বলল।
‘না, ওই একটা ব্যাপারে আমরা চিন্তিত নই।’
‘মানে?’
‘ওই টাকা পানিতে ভাসে না,’ রহস্যময় কণ্ঠে জবাব দিলেন ক্যানার। ঘড়ি দেখলেন। ‘আমাকে এখন যেতে হবে। গুড নাইট। হ্যাঁ, ডাকাতি নিয়ে তোমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। উন্নতমানের যন্ত্রপাতি আছে কোস্ট গার্ডের। টাকা, লাশ, সবই উদ্ধার করে ফেলবে।’
ডেপুটি চলে গেলে মুসা বলল, ‘আর আমার নাচতে ইচ্ছে করছে না। চলো, ক্যাম্পে যাই।’
‘নাচলে আর কোথায়? সারাক্ষণ তো বসে বসে মাংসই গিললে দেখলাম।’
‘যা-ই হোক, ভরা পেট নিয়ে নাচতে পারব না।’
‘কিন্তু নৌকা ছাড়া যাব কীভাবে?’ রবিনের প্রশ্ন। ‘বিল তো চলে গেছে।’
‘এখানে বসে থেকেই বা কী করব? সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে যাই আগে, তারপর দেখি, কোনও ব্যবস্থা হয় কিনা।’
গোলাঘরের দিকে এগোল ওরা। ওদের দেখে ঘোড়া দুটো আর খচ্চরটাকে নিয়ে বেরিয়ে এল ডিক টোম্যান। হেসে বলল, ‘দেরি দেখে আমি তো ভাবলাম ঘোড়া ফেলেই চলে গেছ।’
.
শূন্য হাইওয়ে। আকাশের আধখানা চাঁদের আলোয় কোনমতে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে রাস্তাটা। কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলল ছেলেরা। কিশোর-রবিন চুপ। ওদের মনে গভীর ভাবনা। আর মুসা কথা বলারই সুযোগ পাচ্ছে না। খচ্চরটাকে সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে।
‘এমন যদি হয়, মরিস আর বিল গেইটর সোয়াম্পে কিছু পেয়েছে, যেটা জানতে দিতে চায় না কাউকে?’ অবশেষে কথা বলল কিশোর।
‘কী পাবে? ডাকাতির টাকা?’ মুসার প্রশ্ন।
‘ডেপুটি ক্যানার কি বলেছেন, মনে করো। তিনি বলেছেন, ডাকাতরা যা নিয়েছে সে-টাকা পানিতে ভাসে না।’
‘টাকা পানিতে ভাসে না! কথাটা কেমন অদ্ভুত, তাই না?’ রবিন বলল। ‘বিল আর মরিসের ব্যাপারটাও অদ্ভুত। হাত মেলানোর সময় এমন ভান করল, যেন একে অন্যকে চেনেই না। হয়তো সত্যিই চেনে না। আজ সকালে সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে সাদা হ্যাট পরা যে লোকটাকে দেখেছি সে অন্য কেউও হতে পারে। চেহারা তো আর দেখিনি।’
‘হ্যাঁ, এটা একটা যুক্তি। আবার এমনও হতে পারে, বিল আর মরিস দুজনেই মিথ্যুক। আমাদের সামনে অভিনয় করেছে।’
‘তাহলে বলতে হয় মস্ত অভিনেতা ওরা।’
সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে পৌঁছে দেখা গেল বোট আছে, কিন্তু সবগুলোকেই শিকল দিয়ে বেঁধে তালা লাগিয়ে রেখে চলে গেছেন ডিন ওয়াটারম্যান। তালা খোলা সম্ভব না।
কী করবে চিন্তা করতে লাগল ওরা। হঠাৎ তুড়ি বাজিয়ে মুসা বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে।’
জেনালের স্টোরের পিছন দিয়ে ঘুরে ডিনের স্যালভিজ ইয়ার্ডে কিশোর ও রবিনকে নিয়ে এল ও। বিচিত্র চেহারার একটা জলযান দেখিয়ে হেসে বলল, ‘ওই যে আমাদের বাড়ি ফেরার বাহন।’
ভ্রূকুটি করল রবিন। ‘কী ওটা?’
‘প্যাডল বোট। সকাল বেলা ল্যাসো প্র্যাকটিস করার সময় দেখেছি।’
‘ইঞ্জিন কই?’
‘ইঞ্জিন নেই। সাইকেলের মত প্যাডল ঘুরিয়ে চালাতে হয়।’
‘কিন্তু এটাতে করে ফিশিং ক্যাম্পে পৌছতে তো অনন্তকাল লেগে যাবে।
‘উপায় কী? অনন্তকাল লাগলেও একটা সময় তো পৌঁছব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো যাওয়াই হবে না।’
টেনে-হিঁচড়ে বোটটাকে ডকে নিয়ে এল ওরা। পানিতে নামিয়ে চড়ে বসল। একমাত্র সিটটায় বসল মুসা, যেটাতে বসে প্যাডল খোরাতে হয়। দুই পাশে হাঁটু মুড়ে বসল কিশোর ও রবিন, এমনভাবে যাতে বোটের ভারসাম্য বজায় থাকে। একটু এদিক ওদিক হলেই কাত হয়ে ডুবে যাওয়ার ভয় আছে।
ধীরে ধীরে প্যাডল ঘোরাতে লাগল মুসা। ঘণ্টায় এক মাইল গতিতে চলতে থাকল বোট।
’এই গামলায় করে মাঝরাতের আগে কোনমতেই ক্যাম্পে পৌঁছতে পারব না,’ রবিন বলল। ‘মরিস তো ওদিকে ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, মাঝরাতের পর আর পানিতে থাকা যাবে না।
‘যাদের দিয়েছে দিয়েছে, আমাদের তো আর দেয়নি,’ হেসে বলল কিশোর। ‘ভাল বোট না পাওয়াতে এক হিসেবে ভালই হয়েছে। ওর সামনে পড়ে গেলে এত রাতে জলাভূমিতে থাকার একটা ছুতো দেখাতে পারব। বোট জোরে না চললে আমরা কী করব?’
প্যাডল ঘুরিয়ে বোটটা চালানো খুব পরিশ্রমের ব্যাপার। একা একটানা বেশিক্ষণ পারল না মুসা। পালা করে ঘোরাতে লাগল তিনজনে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল সবাই।
‘রবিন, চালানো বন্ধ করলে কেন?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।
‘পায়ের পেশিতে খিঁচ ধরে গেছে।’
‘তা বললে তো হবে না। ক্যাম্পে পৌঁছতে হলে চালাতেই হবে।’
‘আমার মনে হয় কাছাকাছি চলে এসেছি,’ কিশোর বলল।
ভারি দম নিল রবিন। আবার প্যাডল ঘোরানো শুরু করল।
‘এই, একটু থামো তো!’ আচমকা বলে উঠল মুসা। ‘ওই দেখো!’
বোটের একপাশে কালো আবছামত একটা দ্বীপ দেখা যাচ্ছে, কালো আকাশের পটভূমিতে একজোড়া সাইপ্রেস গাছও চোখে পড়ছে। ওগুলোর সামনে একটা ভুতুড়ে আলো আগেপিছে নড়ে বেড়াচ্ছে, যেন কোন দানবের চোখ।
‘মরিস নিশ্চয় অ্যালিগেইটর ধরতে বেরিয়েছে,’ রবিন বলল। ‘তার বোটের আলো।’
‘আশ্চর্য!’ তাকিয়ে আছে মুসা। ‘আলোটা পানির নীচে!’
‘শব্দ শুনছো!’ ফিসফিস করল রবিন। ‘মানুষ ওরকম শব্দ করে না!’
অদ্ভুত এক ধরনের ঘড়ঘড়ে শব্দ, যেন পানিতে ডুবে টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে কেউ, নিতে কষ্ট হচ্ছে। এরই ফাঁকে ফাঁকে শোনা যাচ্ছে গুঞ্জনের মত শব্দ।
আলো আর এই শব্দ কীসের না দেখে যাবে না কিশোর। রবিনকে সেদিকে যেতে বলল।
প্যাডল ঘুরিয়ে আলোর দিকে এগোতে শুরু করল রবিন। ওরা চল্লিশ গজ দূরে থাকতে নিভে গেল আলোটা। কেবল আধখানা চাঁদের আলো পানির ওপর আভা সৃষ্টি করে রেখেছে।
‘খাইছে! বুদবুদ!’ আমচকা বলে উঠল মুসা। কণ্ঠের আতঙ্ক চাপা দিতে পারল না।
কিশোর আর রবিনও দেখল পানির নীচ থেকে ওঠা বুদবুদের একটা লম্বা সারি এগিয়ে আসছে বোটের দিকে।
‘কী ওটা?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘যা-ই হোক,’ জবাব দিল কিশোর, ‘আমাদের বোটের নীচ দিয়ে যেতে চায়!’
‘অ্যালিগেইটর!’ গলা কাঁপছে মুসার। ‘আজ আর বাঁচব না! মরব সবাই! কোন্ কুক্ষণে যে এই প্যাডল বোটের কথা মাথায় এসেছিল…’ কথা শেষ হলো না ওর। বোটের তলায় প্রচণ্ড আঘাত হানল কীসে যেন। কাত হয়ে যাচ্ছে বোট।
ছয়
‘ঝাঁপ দাও, জলদি!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
পুরো কাত হয়ে গেল বোট। একটা পাশ ডুবে গেল। জলাভূমির পানিতে ছিটকে পড়ল তিনজনে।
সঙ্গীদের সাঁতার কাটতে বলে যত দ্রুত সম্ভব দ্বীপের দিকে সাঁতরে চলল কিশোর।
সাঁতার কাটার সময় জোরে জোরে পানিতে লাথি মারছে মুসা। আশা, এতে যদি ঘাবড়ে গিয়ে কামড়ে ধরা থেকে বিরত থাকে অ্যালিগেইটরটা।
হঠাৎ ওর পায়ে কাদা ঠেকল। সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায়। পানি মাত্র কয়েক ফুট গভীর ওখানে। পা টেনে টেনে হেঁটে এগোল দ্বীপের দিকে। তীরে উঠে দুটো গাছের একটাতে উঠে পড়ল ও। প্রায় টেনে- হিঁচড়ে কিশোর আর রবিনকে তুলে নিল গাছের ডালে। পরিশ্রমে কাহিল হয়ে গেছে।
অ্যালিগেইটরটা কী করছে এতক্ষণে দেখার সুযোগ পেল ওরা। কিন্তু কোথাও চোখে পড়ল না ওটাকে। রহস্যময় সেই আলোও অদৃশ্য।
‘কী করব এখন?’ রবিনের প্রশ্ন।
‘আপাতত একটা আশ্রয় তো পেলাম,’ কিশোর বলল। ‘রাতটা গাছে বসেই কাটাতে হবে। সকাল না হলে আর কিছুই করার নেই।’
কাণ্ডে হেলান দিয়ে গাছের ডালে যতটা সম্ভব আরামে বসার চেষ্টা করল ওরা। সীমাহীন ক্লান্তি। মশার কামড় আর নিশাচর ইগ্রেটের ডাককে উপেক্ষা করে বাকি রাতটা ঘুমিয়ে কাটাল।
সকাল বেলা পাঁজরে খোঁচা খেয়ে ঘুম ভাঙল রবিনের। চোখ মেলে দেখে তীর ঘেঁষে ভেসে রয়েছে পন্টুন বোটটা। একটা মাছধরার ছিপ দিয়ে ওকে খোঁচা দিচ্ছে হ্যারিস স্মিথ।
‘ওখানে কী করছ তোমরা?’ হ্যারিস জিজ্ঞেস করল। ‘এদিকে দুশ্চিন্তায় পাগল হওয়ার জোগাড় আমাদের।’
‘আমাদের খুঁজে বের করলেন কী করে?’ মুসা জানতে চাইল।
‘ওখান থেকেই দেখলাম, গাছে বসে আছো, ছিপের মাথা দিয়ে একশো গজ দূরের দ্বীপটা দেখাল হ্যারিস। খুঁটির ওপর বসানো সারি সারি কেবিন।
‘ফিশিং ক্যাম্প?’ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ‘তারমানে টুইন সাইপ্রেস- কী-তে উঠেছি আমরা!
গাছ থেকে নেমে বোটে উঠল ছেলেরা।
একটা এরোপ্লেনের শব্দ কানে এল। ওদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল রাস্টির হাইড্রোপ্লেন।
‘ভোর থেকে তোমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে রাস্টি।’ বোটের ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে দিতে হ্যারিস বলল, ‘তোমরা ভাল আছো জানিয়ে ওকে নিশ্চিন্ত করা দরকার।’ প্লেনের উদ্দেশে হাত নাড়ল ও।
.
কেবিনে ফিরে প্রথমেই ভালমত সাবান দিয়ে ডলে গোসল করে নিল তিন গোয়েন্দা। শুকনো কাপড় পরল। মুখে, হাতে অজস্র মশার কামড়ের দাগ। শরীরের যেখানেই খোলা পেয়েছে, কামড়েছে।
‘খাইছে! মশা তো না, ড্রাকুলার খালাতো ভাই!’ লোশন লাগাতে লাগাতে বলল মুসা। ‘ঝাঁক বেঁধে এসে নিশ্চয় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।’
কেবিনের দরজা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দিল রাস্টি। ‘যাক, ভালই আছো তাহলে।’
‘একে কি ভাল থাকা বলেন?’ মশার কামড় খাওয়া একটা হাত বাড়িয়ে দিল মুসা। অসংখ্য গোটার মত ফুলে উঠেছে কামড়গুলো।
হাসিমুখে ঘরে ঢুকল রাস্টি। গতকাল ও চলে আসার পর থেকে যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল কিশোর। ওরা গোয়েন্দা, এটা শোনার পর বিল কীভাবে পালিয়েছিল, জানাল।
‘জলাভূমিতে যে রহস্যময় আলো দেখেছি, সেটার কথা বলবে না?’ ভুরু নাচাল মুসা।
রাস্টি শুনে বলল, ‘চোখের ভুল হতে পারে। ‘ঢেউয়ের মধ্যে চাঁদের আলোকেই অন্য আলো ভেবেছ। কিন্তু আমি ভাবছি অ্যালিগেইটরটার কথা। কাল রাতে তো তোমরা ওটার বাসার কাছে যাওনি। তাহলে হামলা করল কেন?’
‘নিশ্চয় ওটা কিটির পোষা অ্যালিগেইটর,’ মুসা বলল। ‘ওর কথা শোনে। কিটিই ওটাকে আমাদের ওপর লেলিয়ে দিয়েছিল।’
‘উঁহুঁ, আমি মানতে পারলাম না,’ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রাস্টি। ‘এক কাজ করি। বিগ সাইপ্রেস সোয়াম্পে আমার এক বন্ধু আছে, সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ। অ্যালিগেইটরটার রহস্যময় আচরণের কারণ কেউ যদি জানাতে পারে, সে-ই পারবে।’
‘কথা বলতে হলে তো ওখানে যেতে হবে আপনাকে,’ রবিন বলল। ‘রোডেওর কী হবে? আজ রাতে প্রতিযোগিতায় অংশ নেবেন না?’
‘চলে আসব সময়মত।’
‘আমি যদি আপনার সাথে যাই, কোন অসুবিধে আছে?’ কিশোর বলল।
‘না, অসুবিধে কীসের? চলো।’
‘হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে, আমি আর মুসা গিয়ে বরং যেখানে আমাদের প্যাডলবোট ডুবেছে সে-জায়গাটা দেখে আসি,’ রবিন বলল। ‘দিনের আলোয় দেখলে আসলে কী ঘটেছিল হয়তো বুঝতে পারব।’
‘হ্যাঁ, তা-ই করো,’ কিশোর বলল।
‘একটা বোট লাগবে,’ মুসা বলল। ‘সোয়াম্পল্যান্ড গুডস থেকে ভাড়া নিতে পারি।’
‘হ্যাঁ।’ পায়ের পেশি ডলল রবিন। ‘কাল রাতে প্যাডেল মারতে মারতে জীবন শেষ। জীবনে আর ওই গামলা চালাতে রাজি হবো না আমি।’
কেবিন থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে এল চারজনে। হাইড্রোপ্লেনের দিকে এগোচ্ছে ওরা, এ সময় কফির মগ হাতে দৌড়ে এলেন গুজ বার্নার। ‘আবার নাকি তোমরা অ্যালিগেইটরের খপ্পরে পড়েছিলে?’
‘হ্যাঁ, সার,’ কনুইয়ের নীচে চুলকাতে চুলকাতে জবাব দিল মুসা। ‘একদল ড্রাকুলার খপ্পরেও পড়েছিলাম।’
বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন বার্নার।
‘বুঝলেন না, সার? মশা, মশা। রক্তচোষা ড্রাকুলার চেয়ে খারাপ। দেখুন না, হাতের কী অবস্থা করেছে।’
‘জলাভূমিতে বাইরে রাত কাটালে কী হয়, শিক্ষা তাহলে হয়েছে, ‘ তীক্ষ্ণ হলো বার্নারের কণ্ঠ।
স্থির দৃষ্টিতে ওঁর দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। সেটা লক্ষ নরম হলো বার্নারের চেহারার কঠোরতা। হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘আজ রাতে নিশ্চয় অ্যালিগেইটরটা ধরে ফেলতে পারবে মরিস। তখন সবাই আমরা নিরাপদ।’
মিস্টার মরিসন কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল রবিন। ‘কাল সারারাত তো বাইরেই কাটালাম। ওঁর ছায়াও দেখলাম না।’
‘হয়তো তোমাদের ওদিকটায় যায়নি। অন্য জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেছে।’ রাস্টির দিকে তাকালেন বার্নার। ‘কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?’
‘বিগ সাইপ্রেস সোয়াম্প।’
‘ওখানে কী?’
‘অ্যালিগেইটরের খামার।’
মুহূর্তের জন্য বার্নারের মুখে ছায়া নামতে দেখল কিশোর। পরক্ষণে হাসিটা ফিরে এল। ঠিক আছে, যান। ভাল থাকবেন।’ হ্যাটের কানা দু’আঙুলে টিপে ধরে সামান্য মাথা নোয়ালেন তিনি, তারপর কেবিনের দিকে রওনা হলেন তিনি।
মিনিটখানেক পর আকাশে উঠল রাস্টির বিমান। উত্তর দিকে উড়ে গেল।
হ্যারিসের খোঁজে কেবিনগুলোর দিকে এগোল রবিন ও মুসা। বার্নারের কেবিনের জানালার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কথা কানে আসতে থমকে দাঁড়াল রবিন। হাত ধরে টেনে থামাল মুসাকে। শর্টওয়েভ রেডিওতে কথা বলছেন বার্নার, ‘ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে ওরা।’
‘ঠিক আছে,’ জবাব শোনা গেল। ‘কী করা যায় দেখছি।’ স্পিকারের খড়খড় শব্দের কারণে কণ্ঠস্বরটা চেনা গেল না। রেডিওর সুইচ অফ করে দিলেন বার্নার।
দ্রুত জানালার কাছ থেকে সরে এল রবিন ও মুসা।
প্রধান কেবিনটায় পাওয়া গেল হ্যারিসকে। বড়শি মেরামত করছে। বলল, ট্রাউট মাছ ধরতে যাবে। রবিন ওদেরকে সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে দিয়ে আসার কথা বলায় মুখ গোমড়া করে ফেলল।
বার্নারের রেডিওটার কথা হ্যারিসকে জানাল রবিন।
পাত্তাই দিল না হ্যারিস। ‘এখানে অনেকের কাছেই ওরকম রেডিও আছে। জলাভূমিতে আমরা রেডিও ছাড়া অচল। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা। আমার কাছেও একটা আছে। তারমানে কি আমাকেও সন্দেহ করবে?’
এর কাছ থেকে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না বুঝে চুপ হয়ে গেল রবিন।
মুসা অনুরোধ করল, ‘গতরাতে আমাদের বোট যেখানে ডুবেছিল, সেখানটা একটু হয়ে যেতে পারবেন? সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে যাওয়ার পথেই তো পড়ে।’
মুখটা গোমড়াই করে রাখল হ্যারিস, তবে ‘পারব না’ বলল না।
.
দিনের আলোয় জলাভূমিটাকে রাতের মত অত ভয়ঙ্কর লাগছে না। প্যাডল বোটটাকে পানিতে কাত হয়ে থাকতে দেখল রবিন ও মুসা। পানি কম এখানে। একটা কোণা পানির ওপর বেরিয়ে আছে।
‘ডিনের জিনিস, ওঁকে ফেরত দেয়া উচিত,’ রবিন বলল। পানিতে নামতে হতে পারে ভেবে সাঁতারের পোশাক পরেই এসেছে। তার ওপরে শার্টপ্যান্ট পরেছে। সেগুলো খুলতে শুরু করল।
‘সত্যিই তুমি নামবে ওখানে?’ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল হ্যারিস। ‘কে জানে ওই ঘোলা পানির নীচে কী আছে!’
‘যা-ই থাক, আমি নামব। আপনারা আমার ওপর চোখ রাখুন, না দেখলে জানাবেন, সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে আসব।’
পন্টুন বোটের গলুইয়ের কাছ দিয়ে পানিতে নেমে গেল রবিন। পানি কম। পায়ের পাতা সোজা করে দাঁড়ালে আঙুল দিয়ে তলার মাটি স্পর্শ করা যায়। ডুবে থাকা বোটটার কাছে এসে দাঁড়াল ও। ফাইবারগ্লাসে তৈরি খোলসের তলায় হাত বুলিয়ে দেখতে লাগল কিছু আছে কিনা। হঠাৎ বলে উঠল, ‘আরে, বোটের নীচে একটা বিরাট ফুটো!’
‘আমি তো আগেই বলেছি, অ্যালিগেইটরের কাজ,’ পন্টুন বোটে দাঁড়ানো হ্যারিস বলল। ‘থুতনি দিয়ে গুঁতো মেরেছে।’
‘থুতনি দিয়ে গুঁতো মেরে বোট ফুটো করেছে?’ বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। ‘আসলে দাঁত দিয়ে কামড়ে বলতে চাইছেন। ‘
‘অ্যালিগেইটরের যে কি ক্ষমতা, তুমি জানো না…’
চেঁচিয়ে উঠল রবিন, ‘ফুটোর ভিতরে কী যেন আটকে রয়েছে। খুব শক্ত করে আটকানো।’
টানাটানি করে জিনিসটা খুলে নিয়ে এল ও। মুসার হাতে দিল। তারপর উঠে এল পন্টুন বোটে।
জিনিসটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মুসা ও হ্যারিস। ‘এই হলো কাল রাতের ভুতুরে আলোর রহস্য,’ হাসিমুখে বলল রবিন।
জিনিসটা একটা হেভি-ডিউটি ওয়াটারপ্রুফ টর্চলাইট। গায়ে স্টিকার লাগানো। তাতে লেখা : প্রপার্টি অভ সোয়াম্পল্যান্ড গুডস।
সাত
সোয়াম্পল্যান্ড গুডস সরগরম। বিকেল বেলা রোডেও, তাই সকালটাই রোডেওতে আসা টুরিস্টদের কেনাকাটার সময়। রবিন আর মুসাকে দেখেই ভুরু কুঁচকে গেল ডিন ওয়াটারম্যানের। মুখ ঘুরিয়ে ফেললেন। খরিদ্দারদের দিকে বেশি বেশি নজর দিতে লাগলেন। ছেলেরা বুঝল, ওদের এড়াতে চাইছেন তিনি
দোকানে যখন আর একজন খরিদ্দারও রইল না, কথা বলার সুযোগ পেল রবিন, ‘একটা এয়ারবোট ভাড়া করতে চাই।’
‘বোট নেই।’
কিন্তু কাউন্টারের পিছনের হুকে দুটো চাবি ঝুলতে দেখল রবিন। ‘কিছু হয়েছে, মিস্টার ওয়াটারম্যান?’
একটা মুহূর্ত রবিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন ওয়াটারম্যান। ‘তোমার বাপ-দাদার কবরের ওপর কেউ হাঁটাহাঁটি করলে, কবর মাড়ালে, কেমন লাগবে তোমার?’
ডিন কী বলতে চাইছেন বুঝে গেল রবিন। ‘ও, তাহলে কিটি এসে বলে গেছে টুইন সাইপ্রেস-কী’তে আটকা পড়েছিলাম আমরা?
‘আটকা পড়েছিলে? কিন্তু কিটি তো বলল সাঁতরে গিয়ে ওই দ্বীপে উঠেছ তোমরা। খোঁজাখুঁজি করেছ।’
‘ঠিক বলেনি।’
‘ওই দ্বীপটাতে আমার দাদার কবর। আমাদের কাছে দ্বীপটা মহাপবিত্র। কাল রাতে ওখানকার একটা সাইপ্রেস গাছে রাত কাটিয়েছ তোমরা।’
‘কাটানোর প্রয়োজন পড়ত না, যদি কিটি আমাদের প্যাডল বোটটা ডুবিয়ে না দিত!’ মুসা আর চুপ থাকতে পারল না।
দ্বিধায় পড়ে গেলেন ওয়াটারম্যান। ‘জাঙ্কইয়ার্ডে যেটা ফেলে রেখেছিলাম সেটার কথা বলছ?’
‘হ্যাঁ। না বলে নিয়েছি, সরি।’
‘কিটি ওরকম কাজ করবে না।’
‘তাহলে বোটের তলায় এটা এল কীভাবে?’ টর্চটা বের করে কাউন্টারে রাখল রবিন। ‘আটকে ছিল।’ টর্চে লাগানো লেবেলটা দেখাল ডিনকে।
‘গতকাল থেকেই টর্চটা খুঁজে পাচ্ছি না।’ চোয়াল ডললেন ওয়াটারম্যান। ‘মনে হচ্ছে কিটি আমাকে সব কথা বলেনি। ‘
‘ও এখন কোথায়?’ জানতে চাইল রবিন।
‘সকাল বেলা এসে কিছু জিনিসপত্র বেঁধেছেঁদে নিয়ে গেল। বলল, কয়েকদিন গেইটর সোয়াম্পে থাকবে। পাহারা দেবে। টুরিস্টরা ঘুরতে বেরিয়ে যাতে টুইন সাইপ্রেস-কী’তে উঠে পড়তে না পারে।’
‘কিটির সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হতো। কোথায় পাওয়া যাবে ওকে?’
কী যেন ভাবলেন ওয়াটারম্যান। দ্বিধা করতে করতে শেষে বলেই ফেললেন, ‘গেইটর সোয়াম্পের পুব ধারে একটা পরিত্যক্ত শিকারির ছাউনিতে ক্যাম্প করে থাকে ও। ওখানে গেলে দেখা হতে পারে।’
‘যাব কীভাবে?’ মুসার প্রশ্ন।
‘বোটে করে।’ এতক্ষণে হাসি ফুটল ওয়াটারম্যানের মুখে। ‘অবশ্যই একটা বোট ভাড়া দেব তোমাদেরকে।’
পাঁচ মিনিট পর এয়ারবোটের চালকের আসনে দেখা গেল মুসাকে। কীভাবে চালাতে হয় বুঝিয়ে দিচ্ছেন ওয়াটারম্যান।
ইগনিশন কী’তে মোচড় দিল মুসা। ঘুরতে আরম্ভ করল পিছনে লাগানো বিশাল ফ্যানটা। প্রবল বাতাসের চাপে বোটের পিছনের ঘাস প্রায় শুয়ে পড়ল পানির ওপর। ইঞ্জিনের প্রচণ্ড শব্দ সহ্য করতে না পেরে কানে হাতচাপা দিল রবিন।
বোটের দড়ি খুলে দিলেন ওয়াটারম্যান।
‘রবিন, হাত সরাও!’ চেঁচিয়ে বলল মুসা। ‘শিকারির ছাউনিতে কীভাবে যেতে হবে, বুঝে নিয়েছ?’
ওয়াটারম্যানের এঁকে দেয়া নকশাটা দেখাল রবিন। ইঙ্গিতে বোঝাল কোনদিকে যেতে হবে।
পূর্ব দিকে রওনা হলো মুসা।
ঘন হয়ে জন্মানো উঁচু ঘাস আর জলজ উদ্ভিদের মধ্যে পথ করে মাত্র কয়েক ইঞ্চি পানির ওপর দিয়েও যেভাবে ছুটে চলে এয়ারবোট, দেখে বিস্মিত হতে হয়।
জায়গামত পৌঁছতে বেশি সময় লাগল না। ইঞ্জিনের শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল রবিন, ‘পরের ওই বাঁকটা পেরোলেই দেখা যাবে।’
সত্যিই দেখা গেল। দূর থেকেই কাঠের তৈরি ছাউনিটা চোখে পড়ল ওদের। টিনের চালায় মরচে পড়া। ডেবে গেছে। জানালার পর্দাগুলো ছেঁড়া। পরিত্যক্ত, বোঝাই যায়।
‘লম্বা ঘাসের মধ্যে বোট লুকিয়ে বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে পারি আমরা,’ মুসা বলল। তাহলে কারও চোখে পড়ব না।’
‘ঠিক বলেছো,’ রবিনও একমত।
ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল মুসা। একটা ম্যানগ্রোভ গাছের সঙ্গে বোটের দড়ি বাঁধল। নেমে পড়ল মাটিতে। ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলল দুজনে। মাটি এখানে মোটামুটি শক্ত। পা ডাবছে না তেমন।
কিছুদূর গিয়ে হাত তুলে মুসাকে থামতে ইশারা করল রবিন। দুটো গাছের মাঝখানের ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এখন ছাউনিটা। নীরব। নির্জন। কিটি বা অন্য কোন মানুষের ছায়াও চোখে পড়ছে না।
‘তুমি এখানে থাকো,’ রবিন বলল। ‘কেউ এলে সঙ্কেত দিয়ে আমাকে জানাবে।’
প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ছাউনির পিছনে একটা জানালার কাছে চলে এল ও। সাবধানে মাথা তুলে জানালা দিয়ে উঁকি দিল। ভিতরে অন্ধকার। কেউ নেই। জানালা টপকে ভিতরে ঢুকল ও।
বাতাস ভেজা। ফাঙ্গাসের ভাপসা গন্ধ। মাছি ভনভন করছে। খোলা জানালাটা দিয়ে ক্রমাগত ঢুকছে-বেরোচ্ছে মাছিগুলো। মেঝেতে খড়ের একটা গদি পাতা। পাশে এক জগ পানি। চোখে আলো সয়ে এলে ঘরের কোণে একটা প্লাস্টিকের বস্তা চোখে পড়ল ওর।
বস্তার ভিতর রয়েছে একটা স্নরকেল, একটা সুইম মাস্ক, আর একটা ছোট যন্ত্র। একটা হাতল আর একটা ডায়াল লাগানো রয়েছে যন্ত্রটায়। ডায়াল ঘোরাতেই গুঞ্জন করে উঠল। সুইম মাস্কের ধাতব ধারগুলোর কাছে যন্ত্রটা আনতেই গুঞ্জনটা অনেক বেড়ে গেল।
‘মেটাল ডিটেক্টর!’ বিড়বিড় করল রবিন। মনে পড়ল, আগের রাতে প্যাডল বোটে বসে জলাভূমিতে অনেকটা এ রকম গুঞ্জন কানে এসেছিল। আরও একটা শব্দের কথা মনে পড়ল। ঘড়ঘড়ে শ্বাস টানার শব্দ।
কলটার ওপর হাত রেখে আপনমনেই হাসল রবিন। অদ্ভুত ওই শ্বাস টানার শব্দ কীসের ছিল, বুঝতে পারছে। মুখে সুরকেল লাগিয়ে পানিতে ডুব দিয়েছিল কেউ। টর্চের আলোয় মেটাল ডিটেক্টরের সাহায্যে পানির নীচে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছিল লোকটা।
হঠাৎ ডেকে উঠল একটা বুনো হাঁস। কান খাড়া করল রবিন।
মুসার সঙ্কেত। কাউকে আসতে দেখেছে ও।
সামনের একটা জানালার কাছে এসে দাঁড়াল রবিন। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখল একটা ক্যানু এসে তীরে ভিড়েছে। ভোজালীর মত মস্ত একটা ছুরি হাতে ছাউনির দিকে এগিয়ে আসছে কিটি।
তিন লাফে পিছনের খোলা জানালাটার কাছে চলে এল রবিন। নিঃশব্দে জানালা ডিঙিয়ে বেরিয়েই শুয়ে পড়ল মাটিতে। গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেল মাটির একটা ডিবির কাছে। ঢিবিটার গোড়ায় পানি জমে আছে। ভিজে গেল কাপড়। কাদায় মাখামাখি শরীর। তবে কিটির অলক্ষে পালিয়ে আসতে পেরেছে এটাই স্বস্তি।
কেবিনের বেশ কিছুটা দূর দিয়ে ঘুরে মুসার কাছে চলে এল ও।
‘ভিতরে ঢুকেছে কিটি, ফিসফিস করে মুসা বলল। ‘কী দেখলে?’
‘একটা স্নরকেল, একটা সুইম মাস্ক আর একটা মেটাল ডিটেক্টর। কাল রাতে অ্যালিগেইটর গুঁতো মেরে আমাদের বোট ডোবায়নি। মানুষই ডুবিয়েছে। কিটিও হতে পারে। ওসব যন্ত্রপাতি দিয়ে পানির নীচে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছিল ও।’
‘কী খুঁজছিল?’ মুসার প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল রবিন। ‘জানি না।’
মরচে পড়া কব্জার ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে খুলে গেল ছাউনির দরজা। বেরিয়ে এল কিটি। হাতে স্নরকেল, মাস্ক আর মেটাল ডিটেক্টর।
ঘন ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল মুসা ও রবিন। আড়াল থেকে দেখতে লাগল।
ক্যানুটার কাছে হেঁটে গেল কিটি। দুজনকে অবাক করে দিয়ে মেটাল ডিটেক্টরটা আছড়ে ভেঙে ছুঁড়ে ফেলল খাঁড়ির মাঝখানে পানিতে। ভোজালী দিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটল স্নরকেল আর মাস্কটা। তারপর ক্যানুতে চেপে চলে গেল।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দুজনে। অবশেষে কথা বলল মুসা, ‘জিনিসগুলো ওরকম করে ভাঙল কেন? প্রমাণ নষ্ট করল?’
‘না। প্রমাণ নষ্ট করতে চাইলে ওগুলো কেটেকুটে ছাউনির কাছে ফেলে যেত না। কিশোর থাকলে এখন ভাল হতো। ও হয়তো বুঝতে পারত।’
‘এতক্ষণে নিশ্চয় ফিরে এসেছে। চলো, যাই।’
ফিশিং ক্যাম্পে ফিরতেই ছুটে এল উত্তেজিত হ্যারিস। ‘এইমাত্র রেডিওর স্থানীয় সংবাদে খবর শুনলাম বিগ সাইপ্রেস সোয়াম্পে একটা হাইড্রোপ্লেন ক্র্যাশ ল্যান্ডিং করেছে।’
চমকে গেল রবিন। ‘রাস্টি!’
‘কী হয়েছিল?’ ডকে এসে হাজির হয়েছেন গুজ বার্নার।
‘বিগ সাইপ্রেস সোয়াম্পে ক্র্যাশ ল্যান্ডিং, হ্যারিস জানাল। ‘আমার মনে হয় রাস্টির প্লেনটাই।’
‘তাই নাকি!’ চোখ বড় বড় হয়ে গেছে বার্নারের।
‘থাক, আর ভাল সাজার দরকার নেই!’ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ‘কিছুক্ষণ আগে আপনিই ওদের যাওয়ার খবরটা রেডিওতে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আপনি বলেননি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ওখানে পৌঁছে যাবে ওরা? বেশ, কী করা যায় দেখছি।’
হাসলেন বার্নার। ‘বলেছি। এক বন্ধুকে। আমার দুটো ঘোড়া বিক্রি করব। ওগুলোর জন্যে খদ্দের ঠিক করেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌছে যাবে ‘ওরা’ বলে ঘোড়াগুলোর কথা বুঝিয়েছি।’
‘আপনার বন্ধুর নাম কী?’
বার্নারকে বিব্রত হতে দেখে বাধা দিল হ্যারিস, ‘দেখো, মুসা, আমার অতিথিদের অভিযুক্ত করে কথা বলার কোন অধিকার তোমার নেই!’
হ্যারিসের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল মুসা। কড়া একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল, এ সময় মেইন কেবিন থেকে বেরিয়ে এল টনি ওয়াকার। ‘হ্যারিস, রেডিওতে রাস্টি তোমাকে ডাকছে।’
হ্যারিসের সঙ্গে এল মুসা ও রবিন। রিসিভারের সুইচ অন করে হ্যারিস বলল, ‘রাস্টি, সত্যিই আপনার সঙ্গে কথা বলছি তো?’
‘আমি না, আমার ভূতের সঙ্গে বলছ,’ হেসে জবাব দিল রাস্টি। ‘ফ্রগ’স পেনিনসুলার পুলিশ স্টেশনে আছি আমি আর কিশোর। ভালই আছি। রবিনদেরকে চিন্তা করতে মানা কোরো।’
থাবা দিয়ে হ্যারিসের হাত থেকে রিসিভারটা কেড়ে নিল রবিন ‘কিশোর! কী হয়েছিল?’
‘স্যাবটাজ। আরেকটু হলেই গেছিলাম,’ রেডিওতে ভেসে এল কিশোরের কণ্ঠ। ‘প্লেনের তেলের লাইন নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। মরতে মরতে বেঁচেছি। ফিরে আসি। সামনাসামনি সব খুলে বলব।’
‘কিছু জেনেছ?’
জেনেছি। চমকে দেয়ার মত খবর। মরিস মরিসন এখানে অ্যালিগেইটরের খামারে চাকরি করত। ক্যাশবাক্স থেকে টাকা চুরি করার অপরাধে ওকে বের করে দিয়েছেন রাস্টির বন্ধু খামারের মালিক মিস্টার ব্রেক জনসন। খামার থেকে তাঁর সবচেয়ে বড় অ্যালিগেইটরটা ডিমসহ গায়েব হয়ে গেছে। রবিন, আমার ধারণা, গেইটর সোয়াম্পের অ্যালিগেইটরটা সেই চুরি যাওয়া অ্যালিগেইটর। খামার থেকে নিয়ে গিয়ে জলাভূমিতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’
‘কিশোর, আমাদের এখানেও খবর আছে। কিটির ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়েছি। তোমরা কখন আসছো?’
‘ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। গাড়িতে করে সোজা রোডেও গ্রাউন্ডে চলে যাব। হাইড্রোপ্লেনটা মেরামত করার দায়িত্ব নিয়েছেন মিস্টার জনসন। আগামীকাল তিনি নিজেই ফিশিং ক্যাম্পে পৌঁছে দেবেন বলেছেন।’
ঘড়ি দেখল রবিন। চারটে বেজে পাঁচ। ডেপুটি শেরিফ ক্যানারের সঙ্গে বিকেল পাঁচটায় রোডেও গ্রাউন্ডে দেখা করার কথা ওদের। খুব বেশি সময় নেই আর।
‘কিশোর, আমরাও যাচ্ছি। ওখানেই দেখা হবে।’
মুসাকে নিয়ে বাইরে বেরোল রবিন। কী যেন ভাবছে।
‘কী ভাবছ?’ জানতে চাইল মুসা।
‘মুসা, অ্যালিগেইটরের বাসাটা একবার ভাল করে দেখতে চাই।’
‘কী দেখবে?’
‘জানি না।‘
‘সময় পাবে?’
‘পাব। চলো, যাই।’
দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে রওনা হলো রবিন। যেখানে ওর ওপর হামলা চালিয়েছিল অ্যালিগেইটরটা সেখানে এসে দাঁড়াল। ঘাসের মধ্যে অ্যালিগেইটরের বাসাটা খুঁজে বের করল। বার্নারের মত করেই ঘাস সরিয়ে ভিতরে তাকাল। বাসার ওপর বিছানো মরাপাতা সরাল। ঘাসের মধ্যে মাটি দিয়ে লেপে বাসা বানানো হয়েছে। বাসাটা দেখতে অনেকটা গর্তের মত। মাটির দু’এক জায়গায় কমলা রঙের দাগ। গর্তের তলায় রয়েছে ডিমগুলো।
হাসি ছড়িয়ে পড়ল রবিনের মুখে। মুসার দিকে তাকাল। ‘বুঝলে?’
‘কিছুই না। আমি অ্যালিগেইটর বিশেষজ্ঞ নই।’
‘এটা বোঝার জন্যে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। ওই বাসা মানুষের তৈরি। গর্তের দেয়াল এত নিখুঁতভাবে মাটি দিয়ে লেপতে পারবে না অ্যালিগেইটর। তা ছাড়া দেয়ালে কমলা রঙের দাগ দেখতে পাচ্ছ?’
‘কী ওগুলো?’
‘মরচের দাগ! বেলচা থেকে লেগেছে। গর্ত বানানোর জন্যে বেলচা দিয়ে মাটি তোলা হয়েছিল।’
‘তারমানে ডিমগুলো সত্যি সত্যি অন্য কোনখান থেকে এনে রাখা হয়েছে?’
‘অন্য কোনখান থেকে নয়, বিগ সাইপ্রেস অ্যালিগেইটর ফার্ম থেকে।’
‘কিন্তু এতবড় জানোয়ারটাকে চুরি করে আনল কীভাবে এখানে?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না….’
বাঁয়ে ঘাসের মধ্যে খসখস শব্দ শুনে ফিরে তাকাল রবিন। বিশাল এক অ্যালিগেইটরের মাথা চোখে পড়ল। একটা চোখ একেবারে সাদা। ওই চোখ ওর পরিচিত
বাসার দিকে এগোচ্ছে অ্যালিগেইটর।
‘খাইছে! রবিন, পালাও!’ বলেই ঘুরে ডাঙার দিকে ছুটল মুসা।
আট
পানির কিনার থেকে বহুদূরে এসে থামল মুসা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘আমরা কি অ্যালিগেইটরের পেটে চলে গেছি?’
‘এখনও যাইনি!’ হাঁপাচ্ছে রবিনও।
ফিশিং ক্যাম্পে পৌছল ওরা। পন্টুন বোটে করে চলে গেছে অতিথিরা। রবিন আর মুসাও দেরি না করে রওনা হলো। এয়ারবোটে করে সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে পৌঁছতে মাত্র পনেরো মিনিট লাগল।
আগের দিন খচ্চর সামলাতে কষ্ট হয়েছে মুসার, তাই আজ ওকে ঘোড়ায় চেপে যেতে বলল রবিন। রাজি হলো না মুসা। বলল, বুড়ো জনের ওপর ওর বিশেষ মায়া পড়ে গেছে। কথা না বাড়িয়ে একটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে দ্বিতীয়টাকে টেনে নিয়ে এগোল রবিন। ফেরার সময় ঘোড়াটা কিশোরের প্রয়োজন হবে।
আগের দিনের চেয়ে বেশি লোক এসেছে আজ রোডেওতে। বারবিকিউ করা হয়েছিল যেখানে, সেই জায়গাটার কাছে পাওয়া গেল কিশোরকে।
‘ডেপুটি ক্যানার কোথায়?’ জানতে চাইল রবিন।
‘আমারও তো সেটাই প্রশ্ন!’ জবাব দিল কিশোর। ‘পাঁচটায় থাকার কথা। সাড়ে পাঁচটা বাজে।’
অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। শিকারির কেবিনে যাওয়ার কথা কিশোরকে জানাল রবিন। প্যাডল বোটের নীচে পাওয়া টর্চটার কথা বলল। কিটি ওয়াটারম্যানকে ওর সন্দেহ, সেটাও জানাল।
‘হুঁ!’ মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘সন্দেহজনক।’
‘মরিস, বিল আর কিটি, হয়তো তিনজনেই জড়িত,’ মুসা বলল। ‘গুজ বার্নারকেই বা বাদ দেব কেন তাহলে?’ বার্নারের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে শোনা কথাগুলো কিশোরকে জানাল রবিন। ওই লোকটার আচরণও সন্দেহজনক। কিশোর, বিল আর কিটিকে রোডেওতে দেখেছো?’
‘না। ওয়াইল্ড বুল রাইডিং শুরু হবে শীঘ্রি। রিঙে না এলে বাঙ্কহাউসে পাওয়া যাবে।’
‘চলো, যাই। দেখে আসি।’
‘তোমরা যাও,’ কিশোর বলল। ‘আমার কাজ আছে।’
‘ক্যানারের জন্যে অপেক্ষা করবে?’
‘না। মিস্টার সাইমনকে ফোন করব।’
‘কেন?’
‘তথ্য জানার জন্যে।’
.
রকি বিচে ফোন করতে গেল কিশোর, শখের গোয়েন্দা মিস্টার সাইমনের বাড়িতে। রবিন আর মুসা চলে এল বাঙ্কহাউসে। রোডেওর জন্য তৈরি হচ্ছে খেলোয়াড়রা। ভীষণ ব্যস্ততা। কাউবয়রা কেউ বুট পরছে। আগের দিনের জখমে মলম লাগাচ্ছে কেউ। যারা সেদিন খেলবে না, তারা পিছনের টেবিলে বসে তাস খেলছে।
একটা লকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিল ওয়াটমোর। রবিনকে দেখে আরেক দিকে সরে যেতে চাইল। সামনে দাঁড়িয়ে ওকে আটকাল রবিন।
‘আরে, রবিন!’ বিল বলল।
‘বারবিকিউতে ওরকম দৌড়ে পালিয়েছিলে কেন?’
‘সে-কৈফিয়ত কি তোমাদের দিতে হবে?’ রেগে উঠল বিল। ‘ছাড়ো। রিঙে যাব। একটা পাজি ষাঁড়ের পিঠে চড়তে হবে আজ আমাকে। ব্ল্যাক সাইক্লোন। মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।’
‘বুল রাইডিং খুব বিপজ্জনক খেলা,’ মুসা বলল। ‘তোমার মত এত কম বয়েসে তো কেউ খেলে না।’
‘তাতে তোমাদের কোন অসুবিধে আছে?’ রবিনের পাশ কাটিয়ে গিয়ে লকারের সামনে দাঁড়াল বিল। কম্বিনেশন লকের ডায়াল ঘুরিয়ে লকার খুলল। ভিতর থেকে থাবা দিয়ে একটা হ্যাট তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
‘ওটা তোমার হ্যাট!’
‘হ্যাঁ। কেন, কী হয়েছে?’ অবাক মনে হলো বিলকে।
রবিনও অবাক। বিলের হাতে একটা কালো হ্যাট, লাল পালক লাগানো। ‘তোমার কমলা-কালো পালক লাগানো সাদা হ্যাটটা কোথায়?’
‘সরো, আমি যাই!’ রবিনকে ঠেলে সরিয়ে পাশের একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল বিল 1.
‘ও হ্যাট বদল করল কেন?’ নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল রবিন।
‘ওকে যে সন্দেহ করছি, জেনে গেল নাকি?’
‘মনে হয়,’ মুসা বলল। ‘বয়েস কম বলাতে রেগে গেল কেমন দেখলে না। হ্যাটের কথা জিজ্ঞেস করলে, জবাব দিল না…’
‘রবিন!’ দৌড়ে আসতে দেখা গেল কিশোরকে। ‘সাংঘাতিক খবর আছে। গেইটর সোয়াম্পে কী খোঁজা হচ্ছে জেনে গেছি। মিস্টার সাইমনের কাছে জানলাম, ডাকাতরা মায়ামির ব্যাংক থেকে টাকার বান্ডিল চুরি করেনি।’
‘তাহলে কী চুরি করেছে?’ ভুরু নাচাল মুসা।
‘সোনার মোহর!’
‘তিনি জানলেন কীভাবে?’
‘তাঁকে সব কথা জানিয়ে খোঁজ নিতে অনুরোধ করেছিলাম।’
অবাক হয়ে একটা মুহূর্ত কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল রবিন। বিড়বিড় করে বলল, ‘শিকারির ছাউনিতে মেটাল ডিটেক্টর…এ টাকা পানিতে ভাসে না -ক্যানারের মন্তব্য… বিলের কাছে সোনার মোহর…সব এখন খাপে খাপে বসে যাচ্ছে!’
নয়
‘একটা কথা ভেবে দেখো, কিশোর বলল। ‘এয়ারবোট নিয়ে পালানোর সময় ডাকাতরা যদি বুঝে গিয়ে থাকে ওদের পিছু নেয়া হয়েছে, কী করবে? মালসহ নিশ্চয় হাতেনাতে ধরা পড়তে চাইবে না। জলাভূমির পানিতে মোহরের বস্তা ফেলে দেয়াটা ওদের জন্যে নিরাপদ।’
‘কিন্তু তাহলে এত খোঁজাখুঁজি কেন?’ রবিনের প্রশ্ন। ‘পানিতে বস্তা ফেলে নিশানা রেখে গেলেই তো পরে সময়-সুযোগমত এসে তুলে নিতে পারত।’
‘আমার ধারণা, ওরা ঠেলে ফেলেনি,’ মুসা বলল। ‘ঝড়ের মধ্যে ওদের অজান্তে বোট থেকে পড়ে গেছে। আর তা-ই যদি হয়ে থাকে, এতবড় জলাভূমিতে খুঁজে বের করা খুব কঠিন।’
‘হ্যাঁ, সত্যিই কঠিন।’ নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। মুসার কথাটা ভেবে দেখল। তারপর বলল, ‘তারমানে বিল ওয়াটমোরের আসল পরিচয় জানে এমন কাউকে ওর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা দরকার।’ বাঙ্কহাউসের পিছন দিকে বসা তাস খেলুড়েদের দিকে তাকাল ও। রোডেও ভাঁড় ডিক টোম্যানকে চিনতে পারল। ভাঁড়ের মুখে এখন সাদা মেকআপ নেই, লাল রঙের বিশাল কানাওয়ালা হ্যাটও নেই।
‘মিস্টার টোম্যান?’ টেবিলের দিকে এগোল কিশোর। ‘খেলার মধ্যে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। বিল ওয়াটমোরকে নিশ্চয় চেনেন আপনি?’
‘কোন বিল? যে কাল রোডেওতে প্রতিযোগিতা করল?’
‘হ্যাঁ।’
‘চিনি না। কালকেই দেখলাম। কেন?’
‘তার সম্পর্কে জানতে চাই।’
‘জানতে চাইলে বই দেখো।’
‘বই?’
‘রোডেও বুক। মিস্টার গিবসনের কাছে এক কপি আছে। ফ্লোরিডার সমস্ত রোডেও রাইডারদের নাম আর তথ্য ওই বইতে পাবে।’ হাতের তাসগুলো টেবিলে ছুঁড়ে ফেলল টোম্যান। ‘আমার রোডেওর সময় হয়ে গেল। যাই। মেকাপ নিতে হবে।’
টোম্যানকে ধন্যবাদ দিল কিশোর।
উঠে পাশের একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল টোম্যান।
‘আমি মিস্টার গিবসনের কাছে বই দেখতে যাচ্ছি,’ কিশোর বলল। ‘তোমরা গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে চলে যাও। আমিও আসছি। রাস্টির খেলা মিস করতে রাজি নই।’
‘কিন্তু কিটিকে তো দেখলাম না কোথাও,’ রবিন বলল।
‘দেখা দিতে ভয় পাচ্ছে বোধহয়,’ মুসা বলল।
‘কিটি পাচ্ছে ভয়?’ হেসে মাথা নাড়ল রবিন। ‘ও ভয় পাওয়ার বান্দা নয়। আশেপাশেই আছে কোথাও। মুসা, তুমি গিয়ে ভাল জায়গায় আমাদের জন্য দুটো সিট রাখো। আমি কিটিকে খুঁজতে যাচ্ছি।’
তিনজন তিনদিকে চলল ওরা। মিস্টার গিবসনের ট্রেইলারের কাছে যখন পৌছল কিশোর, ট্রেইলার থেকে তখন বেরোচ্ছেন তিনি। রোডেও বুকটার কথা জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘আমাকে এখুনি মেইন রিঙে অ্যানাউন্সমেন্ট বুদে যেতে হবে।’ কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবলেন মিস্টার গিবসন। দ্বিধা করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বই দেখাটা কী জরুরি?’
‘হ্যাঁ। মায়ামিতে ব্যাংক ডাকাতির ব্যাপারে কিছু তথ্য দরকার।’
‘কে তুমি?’
‘ফিশিং ক্যাম্পের মালিক রাস্টি কালাহানের বন্ধু। শখের গোয়েন্দা।’
এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন মিস্টার গিবসন। চাবি দিয়ে ট্রেইলারের দরজার তালা খুললেন। ভিতরে ঢুকে ডেস্ক থেকে একটা মোটা বই তুলে নিয়ে কিশোরকে দিলেন। ‘সাবধানে রেখো। দেখা শেষ হলে অ্যানাউন্সার বুদে আমাকে দিয়ে এসো।’
কনসেশন স্ট্যান্ডের কাছে আলো আছে। বইটা উল্টে দেখতে শুরু করল কিশোর। দশ মিনিট পর বন্ধ করল। মুসা ও রবিনের খোঁজে চলল।
বুলেটিন বোর্ডের ‘কাছে মুসাকে পাওয়া গেল। হাতে একটা আধখাওয়া কর্ন ডগ। চেহারায় বিস্ময়।
‘কী হয়েছে, মুসা?’
ঘুরে তাকাল মুসা। ‘লিস্টে ওর নাম নেই। ‘
‘বইতেও খুঁজে পেলাম না। গত তিন বছরে যারা প্রতিযোগিতা
করেছে, তাদের মধ্যে বিলের নাম নেই…’
‘আমি বিলের কথা বলছি না। গুজ বার্নারের কথা বলছি।’
‘কী?’
‘খেতে খেতে মনে হলো লিস্টটা একবার দেখি। কিন্তু বার্নারের নাম নেই। ও বলেছে, নর্থ ডাকোটার ফার্গোতে নাকি ব্রঙ্কো-বাস্টিঙের খেলায় ট্রফি পেয়েছে। অথচ এখানে এসে খেলায় নাম পর্যন্ত লেখায়নি। একজন রোডেও খেলোয়াড়ের জন্যে অস্বাভাবিক না ব্যাপারটা?’
চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের। ‘এক সেকেন্ড!’ হাতের বইটা খুলে দ্রুতহাতে পাতা ওল্টাতে শুরু করল ও। খানিকক্ষণ দেখে মাথা নাড়ল, ‘নাহ্, ব্রঙ্কো-বাস্টিঙে ট্রফি পাওয়া তো দূরের কথা, নামই নেই ওর।’
.
পুরো রোডেও গ্রাউন্ড চষে ফেলল রবিন। আগের দিনের পর কিটিকে আর কেউ দেখেনি।
গরুর ঘরগুলোর কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিসে কথার শব্দ কানে এল ওর। থেমে দাঁড়িয়ে কান পাতল। বিশাল জানোয়ারগুলোর জোরাল নিঃশ্বাস আর ঘোঁৎ-ঘোঁৎ কানে এল। তারপর আবার কথা শোনা গেল।
মাথা নিচু করে, পা টিপে টিপে বেড়ার ধার ঘেঁষে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল ও। চলে এল একটা গেটের কাছে। গেটের ওপরে লেখা : ব্ল্যাক সাইক্লোন। ভিতরে একটা মস্ত ষাঁড়, গায়ের রঙ কয়লার মত কালো।
গরুটার কানে কানে কথা বলছে কিটি ওয়াটারম্যান। ‘তুই একটা মস্ত যোদ্ধা, সাইক্লোন। আজ তুই আমাকে জেতাবি। পিঠ থেকে ছুঁড়ে ফেলবি না। আজকের রাতটা আমার।’ হঠাৎ ঘাড় কাত করে কান পাতল ও। জোরে জোরে বলল, ‘কে জানি গেটের বাইরে আড়ি পেতেছে। বেজির মত উঁকিঝুঁকি মারছে। দাঁড়া, দেখে আসি।’
টের পেয়ে গেছে কিটি। আর লুকিয়ে থাকতে পারবে না বুঝে সোজা হয়ে দাঁড়াল রবিন। ‘আমি বেজি নই।’
মসৃণ ভঙ্গিতে এক লাফে বেড়া ডিঙিয়ে গেটের বাইরে চলে এল কিটি। রবিনের মুখোমুখি দাঁড়াল।
‘বিকেল বেলা আপনাকে দেখেছি,’ হেসে বলল রবিন। ‘ভোজালী হাতে।’
‘শিকারির ছাউনিতে যন্ত্রপাতিগুলো তাহলে তোমরাই রেখে এসেছিলে।’
‘আমরা রাখব কেন? স্নরকেল আর মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে আমাদের কী কাজ?’
চোখের পাতা সরু হয়ে এল কিটির। ‘অ্যান্টিক খুঁজতে গিয়েছিলে, আমি জানি। সেমিনোলদের গুপ্তধন, তীরের মাথা, এসব জিনিস। দ্বীপে উঠে আমাদের পূর্বপুরুষদের সমাধিস্থানের পবিত্রতাও নষ্ট করে এসেছ।’
‘আপনি অযথা আমাদের দোষ দিচ্ছেন, কিটি।’
রবিনের কথা যেন কানেই গেল না কিটির। ‘রাস্টি কিন্তু ওরকম না। ও আমাদের পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা করে, দ্বীপের পবিত্রতাও নষ্ট করতে যায়নি কখনও। কিন্তু তুমি আর তোমার দুই বন্ধু মোটেও ভাল না। বড় বেশি নাক গলানো স্বভাব তোমাদের।’
‘আমরা দ্বীপের পবিত্রতা নষ্ট করতে যাইনি, ব্যাংক ডাকাতদের খোঁজ করছি।’
‘মিথ্যে কথা বলছ!’
‘আপনার দাদাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।’
‘তুমি একটা মিথ্যুক!’
রবিন বুঝল, ওকে মারার ছুতো খুঁজছে কিটি। বাঁচিয়ে দিল মিস্টার গিবসনের একজন কাউহ্যান্ড। দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। ‘এই, কী হচ্ছে! বুল রাইডিং শুরু হবে এখুনি। চলো, চলো!’
‘পরে দেখব তোমাকে,’ রবিনকে শাসিয়ে গটমট করে চলে গেল কিটি।
কিটির আচরণে ক্ষুব্ধ রবিন। তবু কিছুতেই ব্যাংক ডাকাত ভাবতে পারল না ওকে।
.
‘চারজন গেল! টিকতেই পারল না ষাঁড়ের পিঠে। নির্বাচিত হওয়া তো দূরের কথা,’ মুসা বলল।
গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে বসে খেলা দেখছে তিন গোয়েন্দা।
‘কিটিকে খুঁজে পেয়েছি আমি,’ ষাঁড় নিয়ে মাথাব্যথা নেই রবিনের। ‘ডুবুরির যন্ত্রপাতিগুলো ওর, এ কথা তো স্বীকার করলই না, উল্টো আমাদেরকেই দোষ দিল। শিকারির ছাউনিতে ডুবুরির যন্ত্রপাতিগুলো নাকি আমরা রেখে এসেছি।’
বইতে গুজ বার্নার আর বিল ওয়াটমোরের নাম নেই, রবিনকে জানাল কিশোর।
‘তারমানে বার্নারটা একটা ভুয়া,’ রবিন বলল। ‘বিলটাও তাই।’
‘কিটির কথা বাদ দিচ্ছ কেন?’ ভুরু নাচাল মুসা।
‘সত্যি কথা বলতে কী, মুসা, কিটিকেই বরং আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।’
‘কিন্তু কিটির ছাউনিতে ডুবুরির যন্ত্রপাতি আর মেটাল ডিটেক্টর ও নিজে ছাড়া আর কে রাখবে?’
‘বুঝতে পেরেছি!’ হঠাৎ করেই জবাবটা মাথায় এসে গেল রবিনের। ‘মরিস মরিসন! কোন সন্দেহ নেই! স্নরকেলিং ইক্যুইপমেন্ট পাওয়া যাবে কিনা, ডিনের দোকানে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে। আমি একটুক্ষণের জন্যে যখন অন্যদিকে ঘুরেছিলাম, খুব সহজেই একটা টর্চলাইট চুরি করা সম্ভব ছিল ওর পক্ষে। শিকারির ছাউনিটা পরিত্যক্ত ভেবে যন্ত্রপাতিগুলো ওখানে রেখে এসেছিল। ভেবেছিল লুকানোই থাকবে। কী বলো, কিশোর?’
‘ঠিকই অনুমান করেছ,’ মাথা দোলাল কিশোর। ‘গেইটর সোয়াম্পে কাল রাতে অ্যালিগেইটর খোঁজার নাম করে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে মোহর খুঁজতে গিয়েছিল মরিস। তবে সেটা প্রমাণ করতে হবে আমাদের।’
মাইকে ভেসে এল মিস্টার গিবসনের কণ্ঠ, ‘পরের প্রতিযোগী, রাস্টি কালাহান।’
আলোচনা বাদ দিয়ে রিঙের দিকে তাকাল ছেলেরা। রাস্টি এসে চমৎকার খেলা দেখিয়ে গেল। এতক্ষণে আজ প্রথম নির্বাচিত হলো একজন।
‘এরপর আসছে বিল ওয়াটমোর!’ মিস্টার গিবসন জানালেন। ‘ব্ল্যাক সাইক্লোনের পিঠে চড়ে!’
কান খাড়া হয়ে গেল গোয়েন্দাদের। দৃষ্টি ঘুরে গেল খুপরির দিকে, রিঙে ঢোকানোর আগে যেখানে ষাঁড়গুলোকে রাখা হয়। একটা ষাঁড়ের পিঠে বসা দেখল বিলকে। রোডেও ক্লাউন গেট খুলে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু হাত তুলে বিল ইঙ্গিত করল, সে এখনও রেডি হতে পারেনি
‘ভয় পাচ্ছে,’ মুসা বলল।
‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘কিন্তু ভয়টা কীসের? ষাঁড়ের পিঠে চড়ার, না অন্য কিছু?’
বিলের ইঙ্গিত যেন দেখতেই পায়নি ক্লাউন। গেট খুলে দিল। বিলকে পিঠে নিয়ে তীব্র গতিতে রিঙে ঢুকে পড়ল ষাঁড়। ঝাড়া দিয়ে, পিঠ বাঁকিয়ে, শরীর মুচড়ে আরোহীকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। গাইড রোপ হাতে নেই। তৈরি হতে পারেনি বিল। অসহায় ভঙ্গিতে ষাঁড়ের পিঠ আঁকড়ে ধরে বসে থাকার চেষ্টা করছে। বিপদটা বুঝে গেছে দর্শকরা। চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচি হই-চই।
আচমকা প্রচণ্ড এক মোচড় মারল ব্ল্যাক সাইক্লোন। শরীর বাঁকিয়ে এমন এক ঝাঁকি দিল, আর টিকে থাকতে পারল না বিল। উড়ে গিয়ে পড়ল বেড়ার কিনারে। আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেল দর্শক।
গেটের দিকে চোখ গেল মুসার। ‘টোম্যান তো কিছু করছে না! টেনে সরাচ্ছে না কেন বিলকে?’
কিশোরও অবাক হয়ে দেখছে। কিছু তো করলই না রোডেও ভাঁড়—যা ওর দায়িত্ব—বরং দৌড়ে রিঙের কাছ থেকে সরে বাঙ্কহাউসের দিকে চলে যাচ্ছে। চেহারা ঢাকা পড়েছে মাথার মস্ত হ্যাটের আড়ালে। চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, ‘ইচ্ছে করে বিপদে ফেলেছে বিলকে!’
কিছু একটা করা দরকার। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল ও। দেখাদেখি রবিন আর মুসাও উঠল। কিশোরের পিছন পিছন দৌড় দিল।
নিথর হয়ে পড়ে আছে বিল। একটুও নড়ছে না। মরেই গেল নাকি! ওদিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ব্ল্যাক সাইক্লোন। চোখে আগুন। নিঃশ্বাসের ফোঁসফোঁসানির সঙ্গে নাক দিয়ে যেন বাষ্প বেরোচ্ছে। বিলকে ভর্তা বানানোর জন্য মাথা নিচু করে শিং বাগিয়ে ছুটল। চেঁচিয়ে, হাত নেড়ে ষাঁড়টাকে থামানোর চেষ্টা করল মুসা।
চেঁচামেচিতে ফিরে তাকাল ষাঁড়। নিরাপদ জায়গায় বিলকে সরানোর জন্য ছুটে যাচ্ছে রবিন ও কিশোর। মুসাকে তাড়া করল ষাঁড়। ঘুরে বেড়ার দিকে দৌড়াতে শুরু করল মুসা।
খেপা ষাঁড়ের সঙ্গে পারা কঠিন। মুহূর্তে মুসার কাছে চলে এল ওটা। ঠিক পিছনেই রয়েছে। ওটার গরম নিঃশ্বাসও গায়ে লাগছে। সময়মত বেড়া ডিঙাতে না পারলে ষাঁড়ের মারাত্মক শিঙের গুঁতো খেতে হবে।
শেষ মুহূর্তে বাউলি কেটে একপাশে সরে গেল মুসা। বেড়ার রেলিঙ চেপে ধরে লাফ দিল ওপর দিকে। ঠিক ওর নীচে বেড়ার গায়ে লাগল ষাঁড়ের শিঙের গুঁতো। একটুর জন্য বেঁচে গেল মুসা।
দশ
ছুটে এল কয়েকজন কাউহ্যান্ড। ষাঁড় সামলাতে ব্যস্ত হলো। বিলকে তুলে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের অন্যপাশে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে গেল রবিন আর কিশোর। হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের কাছে এসে দাঁড়াল মুসা।
খবর শুনে বাঙ্কহাউস থেকে দৌড়ে এল রাস্টি। সহকারী নিয়ে ডাক্তার এলেন বিলকে দেখতে।
‘কী হয়েছে?’ রাস্টি জানতে চাইল।
‘ভুল করে আগেভাগেই গেট খুলে দিয়েছিল রোডেও ক্লাউন, ‘ একজন দর্শক জানাল। ‘অ্যাক্সিডেন্ট।’
‘অ্যাক্সিডেন্ট না,’ রাস্টিকে বলল কিশোর। ‘ষাঁড়টা বিলকে পিঠ থেকে ফেলে দিতেই দৌড়ে পালিয়েছে ভাঁড়।’
‘কোন ভাঁড়?’
‘ডিক টোম্যান।’ জবাবটা দিল বয়স্ক একজন দর্শক। ‘টেন- গ্যালন হ্যাট দেখে চিনেছি।’
‘হ্যাটটা মাথায় দিয়েছিল চেহারা লুকানোর জন্যে,’ ফিসফিস করে রবিনকে বলল কিশোর।
‘তুমি ঠিকই বলেছো,’ রবিন জবাব দিল। ‘একটিবারের জন্যেও ভালমত ওর চেহারা দেখিনি।’
বিলকে পরীক্ষা করে দেখে ডাক্তার বললেন, ‘জ্ঞান হারিয়েছে। ওকে ফ্রগ’স পেনিনসুলায় হাসপাতালে নিতে হবে।’
এ ধরনের জরুরি অবস্থার জন্য সব সময় রোডেও রিঙের বাইরে একটা অ্যামবুলেন্স রেডি থাকে। সেটা থেকে স্ট্রেচার নিয়ে এল ডাক্তারের একজন সহকারী। সাবধানে বিলকে স্ট্রেচারে তোলা হলো।
‘চলো, ডিক টোম্যানকে খুঁজে বের করি,’ রাস্টি বলল।
দর্শকরা চলে গেল। কিশোর বলল, ‘আমি বিলের সঙ্গে হাসপাতালে যাচ্ছি।’
‘যাও,’ রবিন বলল। ‘হুঁশ ফিরলেই সোনার মোহরটার কথা জিজ্ঞেস কোরো। তাকে কে খুন করতে চায়, কেন, জানারও চেষ্টা কোরো।’
‘তা তো করবই। তবে ওর সঙ্গে যাওয়ার আমার আসল উদ্দেশ্য ওকে পাহারা দেয়া, আবার যাতে কেউ হামলা চালাতে না পারে। এবার হয়তো আর ব্যর্থ হবে না খুনী।’
‘সন্দেহভাজন একজন ডাকাতের প্রতি বেশি মায়া দেখানো হয়ে যাচ্ছে না?’ ভুরু নাচাল মুসা।
হাসল কিশোর। ‘মায়াটা কিন্তু তুমিই আগে দেখিয়েছো। রিঙের মধ্যে ষাঁড়টাকে ঠেকাতে তুমি সবার আগে দৌড় দিয়েছিলে।’
হেসে ফেলল মুসা। ‘কিটিকে যেমন রবিনের অপরাধী মনে হয় না, আমারও তেমনি বিলকে মনে হয় না।’
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ‘তবে কিছু একটা গোপন করছে বিল। আজ রাতেই সেটা জানার চেষ্টা করব।’
‘ঠিক আছে, যাও তুমি,’ মুসা বলল। ‘আমি আর রবিন রাস্টির সঙ্গে যাচ্ছি, ডিক টোম্যানের সঙ্গে কথা বলতে।’
তাড়াহুড়া করে পার্কিং লটের দিকে চলে গেল কিশোর। দূর থেকেই দেখল স্ট্রেচারে করে অ্যামবুলেন্সে তোলা হচ্ছে বিলকে।
অ্যামবুলেন্সের কাছে এসে কিশোর বলল, ‘আমি অনি ওয়াটমোর। বিলের ভাই।’
‘এসো এসো, ভালই হলো,’ ডাক্তার বললেন।
অ্যামবুলেন্সের পিছনে বিলের সঙ্গে উঠে বসল কিশোর।
সাইরেন বাজিয়ে চলতে শুরু করল অ্যামবুলেন্স। বিলের মুখের দিকে তাকাল কিশোর। চোখ বোজা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসা। এখনও বেহুঁশ। এই অবস্থায় মোটেও ওকে অপরাধীর মত লাগছে না।
.
রাস্টির পিছনে বাঙ্কহাউসে চলেছে রবিন ও মুসা। রোডেও ভাঁড়কে যেদিকে দৌড়ে যেতে দেখা গেছে।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল রবিন। ‘মুসা, দাঁড়াও! টোম্যান বলেছিল মেকাপ নিতে যাচ্ছে। তারমানে ট্রেইলারে। বাঙ্কহাউসে না গিয়ে আগে ওখানে খুঁজে দেখা দরকার আমাদের।’
‘টোম্যানের ট্রেইলারটা পার্কিং লটের পিছনে,’ মুসা বলল। ‘কিন্তু ওখানে খুঁজে কী হবে?’
‘কিশোরের সন্দেহ, রিঙে টোম্যান যায়নি। আর আমার মনে হচ্ছে, ট্রেইলারে গেলেই জবাবটা পেয়ে যাব। এসো।’
ট্রেইলারের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই থমকে গেল রবিন। সারা ঘর তছনছ। ঝড় বয়ে গেছে যেন ঘরটায়। প্রচুর ধস্তাধস্তি হয়েছে।
মেকাপের জিনিসপত্র আর কাপড়চোপড় ছড়িয়ে আছে সবখানে। মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ঢোলা ওভারঅল নড়ে উঠল হঠাৎ। গোঙানি শোনা গেল।
ওভারঅলটা তুলে নিল রবিন। টোম্যানকে দেখা গেল। কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। মাথার একপাশে গোলআলুর মত ফুলে আছে। ‘কী…’ রবিন আর মুসার ওপর চোখ পড়তে বলে উঠল, ‘আমাকে মারলে কেন?’
‘আমরা মারিনি, মিস্টার টোম্যান,’ মুসা জবাব দিল। ‘অন্য কেউ মেরেছে।’
‘মেকাপ টেবিলে বসা ছিলাম…’ পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পায়নি এখনও টোম্যানের। ‘কী চুরি করেছে?’
‘আমার ধারণা, একটা জিনিসই চুরি করেছে,’ জবাব দিল রবিন, ‘আপনার পরিচয়।’
‘মানে?’
‘আপনার পরচুলা, আপনার হ্যাট, আপনার পোশাক,’ বুঝিয়ে দিল মুসা।
টোম্যানের বাঁ হাতে নীল-সাদা ফ্ল্যানেলের কাপড়ের একটা ছেঁড়া টুকরো দেখতে পেল রবিন। ‘আপনার হাতে কী?’
‘মাথায় বাড়ি খাওয়ার আগে ওদের সঙ্গে প্রচুর ধস্তাধস্তি করেছি। মনে হয় একজনের পকেট থেকে ছিঁড়ে রয়ে গেছে কাপড়টা।’
‘চেহারা দেখেছেন?’ মুসার প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল টোম্যান।
‘পোশাকটা দেখলে চিনতে পারবেন?’ জিজ্ঞেস করল রবিন।
আবার মাথা নাড়ল টোম্যান। ‘অনেক কাউবয়ই ফ্লানেলের শার্ট পরে। তাদেরই কারও পকেট….
‘ছিঁড়েছেন!’ টোম্যানের কথাটা শেষ করে দিল রবিন। ‘পকেটে কোন জিনিস থেকে থাকলে নিশ্চয় পড়ে গেছে!’
ট্রেইলারের মেঝেতে খুঁজতে শুরু করল রবিন। এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। তুলে নিয়ে খুলল।
‘কী লেখা?’ এগিয়ে এল মুসা।
‘একটা নোট।’ জোরে জোরে পড়ল রবিন, ‘ছেলেটাকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। ব্যবস্থা করো।’
‘মানে কী?’ বুঝতে পারছে না টোম্যান।
মুসার দিকে তাকিয়ে জবাবটা দিল রবিন, ‘কেউ একজন বিল ওয়াটমোরকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে।’
এখানে আর কিছু করার নেই। ডাক্তারকে খবর দেবে কিনা জিজ্ঞেস করল রবিন। টোম্যান বলল, ‘লাগবে না। বরফের সেঁক দিলেই সেরে যাবে।’
মুসাকে নিয়ে বেরিয়ে এল রবিন। বাঙ্কহাউসে রাস্টির খোঁজে চলল।
যাওয়ার পথে মাইকে মিস্টার গিবসনের ঘোষণা শুনল। বিলের দুর্ঘটনার পুলিশী তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত বুল-রাইডিং প্রতিযোগিতা বন্ধ থাকবে। বন্ধ করে দেয়ার আরও একটা কারণ, ঝড়ের সঙ্কেত দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। আরেকটা বড় ধরনের ঝড় এগিয়ে আসছে এই এলাকার দিকে।
বাঙ্কহাউসের সামনে রাস্টির সঙ্গে জটলা করছে কয়েকজন কাউহ্যান্ড। টোম্যানের দুরবস্থার কথা ওদেরকে জানাল রবিন।
‘হুঁ,’ মাথা দুলিয়ে রাস্টি বলল, ‘বুঝলাম, ভুয়া টোম্যান সেজেছিল যে, সে বাঙ্কহাউসের সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে কেউ দেখার আগেই পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’ রবিন ও মুসার দিকে তাকাল। ‘এখানে আর কিছু করার নেই। তাঁবুতে চলো।’
‘ওর নাম বিল ওয়াটমোর, ফ্রগ’স পেনিনসুলাতে থাকে,‘ হাসপাতালের অ্যাডমিশন নার্সকে বলল কিশোর।
‘তুমি ওর ভাই?’ নার্স জিজ্ঞেস করলেন।
আবারও সরাসরি মিথ্যে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করছে কিশোর। ‘ইয়ে…আমি ঠিক ওর ভাই না… বন্ধু।’
‘ডাক্তার বলেছেন মাথায় আঘাত পেয়েছে ও। সামান্য সময়ের জন্যে মানসিক ভারসাম্য কিংবা স্মৃতিও হারিয়ে ফেলতে পারে। তবে চিন্তার কিছু নেই। সেরে যাবে। তোমার বন্ধুর বয়েস কত?’
‘আঠারো।’
দ্রুত কম্পিউটারের কী টিপলেন নার্স। মনিটরের পর্দায় ফুটে ওঠা লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হাসপাতালের ফাইলে ওর নাম আছে। আরও একবার ভর্তি হয়েছিল। বিল ওয়াটমোর। সিক্স ম্যানাটি লেন। গত বছর টনসিল অপারেশন করিয়েছিল।’
‘গত বছর? তারমানে পনেরো বছর বয়েসে?’
‘উঁহু। তেরো।’ বলেই কিশোরের দিকে ফিরে তাকাল বিস্মিত নার্স।
কিশোরও অবাক। ‘জন্মতারিখ আছে আপনাদের রেকর্ডে?’
‘দেখি। হ্যাঁ, এই তো। আর সাত দিন পরেই পনেরো বছরে পা দেবে ও।’
মাথার মধ্যে সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কিশোরের। ‘আপনাদের পে ফোনটা কোথায়?’
নার্সের কাছ থেকে জেনে নিয়ে ফ্রগ’স পেনিনসুলার পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ফোন করল ও। ডেপুটি ক্যানারকে পাওয়া গেল না। বিকেল থেকেই ওর কোন খোঁজ নেই।
‘কোথায় গেছে বলতে পারবেন?’ ডেস্ক সার্জেন্টকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
‘দুপুর একটায় বেরিয়ে গেছে থানা থেকে। বলেছে রোডেওতে যাবে।’
‘আর কিছু বলেননি?’
‘আর…আর…ও হ্যাঁ, বলেছে। ম্যারিনায় যাবে একবার। কী নাকি একটা কাজ আছে।’
‘ম্যারিনা? থ্যাংক ইউ, সার্জেন্ট।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। বিলকে যে ঘরে রাখা হয়েছে, তাড়াতাড়ি সেখানে ছুটল।
ঘর অন্ধকার। নিশ্চয় ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে বিলকে। কিন্তু ঘুম থেকেই ডেকে তুলতে হবে। কয়েকটা প্রশ্নের জবাব জানা অতি জরুরি।
‘বিল?’ আস্তে করে ডাক দিল কিশোর। জবাব না পেয়ে আবার ডাকল, ‘বিল?’ এবারও সাড়া পেল না।
সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে দিল কিশোর।
শূন্য বিছানা!
বিল ওয়াটমোর নেই!
.
রাস্টির সঙ্গে সামিয়ানায় পৌঁছল রবিন ও মুসা। মিস্টার গিবসনকে ঘিরে ধরেছে তখন প্রতিযোগীরা।
‘সত্যিই তাহলে রোডেও বন্ধ করে দিলেন?’ হতাশ টনি ওয়াকার বলল।
‘একেবারে বন্ধ করিনি,’ জবাব দিলেন গিবসন। ‘আপাতত।’
জোরাল গুঞ্জন উঠল প্রতিযোগীদের মাঝে। সবাই হতাশ।
‘দেখো, মিস্টার গিবসন বললেন, ‘ওরকম একটা দুর্ঘটনার পর রোডেও বন্ধ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না আমার। তা-ও না হয় ভেবে দেখা যেত, কিন্তু ঝড়? আসবে তো বোঝাই যাচ্ছে। ঝড়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবে কীভাবে? ঠিক আছে, আজ যাও, কাল আবহাওয়া ভাল থাকলে কিছু করা যায় কিনা দেখব।’
নিজের অতিথিদের উদ্দেশ্যে হ্যারিস বলল, ‘ঝড় আসার আগেই আমাদের ফিশিং ক্যাম্পে ফিরে যেতে হবে। কেবিনে ঢুকে পড়তে হবে।’
আর ওখানে জটলা করল না কেউ। যে যার মত সরে পড়তে লাগল। কাউহ্যান্ডরা জিনিসপত্র গুছিয়ে রোডেও বন্ধ করে দিচ্ছে। অতিথিদের নিয়ে পার্কিং লটের দিকে ছুটল হ্যারিস।
রবিন ও মুসার সঙ্গে এগোল রাস্টি। ‘এবারের রোডেওটার সর্বনাশ করে দিল ওই ডাকাতেরা! তার ওপর ঝড়েও যে কী পেল!’
পার্কিং লটে পৌঁছে দেখা গেল হ্যারিসের পিকআপ ট্রাকের পিছনে উঠে পড়েছে অতিথিরা। রাস্টির জন্য অপেক্ষা করছে হ্যারিস। ওকে দেখামাত্র বলে উঠল, ‘দেরি করছেন কেন? উঠে পড়ুন। তুফানের আগেই পালাতে হবে।’
ট্রাকের অতিথিদের ওপর চোখ বোলাল মুসা। ‘গুজ বার্নার কোথায়?’
তেড়া চোখে ওর দিকে তাকাল হ্যারিস। ‘আমাদের সঙ্গে আর থাকতে রাজি না। ম্যারিনায় চলে গেছে। মোটেলে রাত কাটাবে।’
গাড়ি ছেড়ে দিল ও। চাকার ঘায়ে ধুলো উড়িয়ে পার্কিং লট থেকে গিয়ে রাস্তায় উঠল ট্রাক।
এগারো
হাসপাতাল থেকে মাইলখানেক পথ হাঁটার পর ৬, ম্যানাটি লেনে পৌঁছল কিশোর। ছোট্ট বাড়িটার ভিতরে অন্ধকার। বিল ওখানে আছে বলে মনে হলো না।
ঘুরে পিছন দিকে চলে এল ও। সাগরের কিনারে। ফ্লোরিডা বে’র কালো পানির দিকে তাকাল। দূরে একপাশে আলো দেখা যাচ্ছে। অনুমান করল, ওটা রাস্টি কালাহানের ফিশিং ক্যাম্প।
বিলদের বাড়ির ডকে বাঁধা একটা ছোট বোট। ডক থেকে নজর রাখার সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। তাতে ডকের ওপর তো বটেই, বাড়িটার ওপরও চোখ রাখতে পারবে।
ঘড়ি দেখল। দশটা বেজে তিন মিনিট। বসে পড়ল ও। তীরে এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের শব্দ শুনছে। ঠাণ্ডা বাতাসের সাঁই-সাঁই শব্দ। বৃষ্টিটা শীঘ্রি আসছে, বুঝতে পারছে ও।
ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। বাতাসের মোলায়েম স্পর্শ আর ঢেউয়ের একটানা শব্দ নেশা ধরিয়ে দেয়। ঝিমুনি এসে গেল ওর। ঘুমিয়ে পড়ল। ঝটকা দিয়ে মাথা তুলল একসময়। ওর মনে হলো মিনিটখানেক পেরিয়েছে। কিন্তু ঘড়িতে দেখে এগারোটা তিরিশ।
পানির দিক থেকে আসছে ইঞ্জিনের মৃদু গুঞ্জন। ধীরে ধীরে বাড়ছে। এদিকেই আসছে। তাড়াতাড়ি উঠে একটা নারকেল গাছের আড়ালে লুকাল ও। বন্ধ হয়ে গেল ইঞ্জিন। ডকের দিকে বোটটাকে ভেসে আসতে দেখল কিশোর। তাতে বসা বিলকে চিনতে অসুবিধে হলো না।
নিজের অজান্তেই কুঁচকে গেল কিশোরের ভুরু। হাসপাতাল থেকে হাঁটাপথে মাত্র এক মাইল। এত সহজ রাস্তা দিয়ে না এসে সোয়াম্পল্যান্ড গুডসে গিয়ে বোট নিয়ে এতটা পথ ঘুরে আসার কী মানে?
বোটটা তীরে টেনে তুলে রাখল বিল। বাড়ির দিকে এগোল।
বিলের বয়েস মাত্র চোদ্দ হলে কী হবে, গায়ে অনেক জোর। একটা বুদ্ধি করল কিশোর। নিঃশব্দে পিছনে গিয়ে আঙুল বাঁকিয়ে পিস্তলের নলের মত বিলের পিঠে ঠেসে ধরল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘দাঁড়াও!’
শক্ত হয়ে গেল বিল। কণ্ঠস্বরটা অন্যরকম করে ফেলায় কিশোরকে চিনতে পারেনি। ‘প্লিজ, গুলি করবেন না! সোনার মোহরটার কথা কাউকে বলব না আমি! সত্যি বলছি!’
দ্রুত বিলের দেহতল্লাশি করে নিল কিশোর। অস্ত্রটস্ত্র আছে কিনা দেখল। আড়চোখে তাকাল বিল। কিশোরকে চিনতে পেরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুমি!’ ঘুরে দাঁড়িয়ে জোরে এক ধাক্কা মারল কিশোরের বুকে। ‘আমার পিছনে লেগেছ কেন তুমি? তোমার কারণে আজ আরেকটু হলে মারা পড়েছিলাম আমি।’
ঘুসি মারতে এল বিল। হাতটা ধরে ফেলে জুজিৎসুর প্যাঁচে মুচড়ে পিছনে নিয়ে গেল কিশোর। চাপ দিয়ে বলল, ‘যতক্ষণ আমার কথার জবাব না দিচ্ছ, ততক্ষণ ছাড়ছি না আমি। আর এবার সত্যি কথাটা বলবে। তোমার বয়েস কত?’
‘আঠারো!’ শরীর মুচড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল বিল।
‘কত? সত্যিটা বলো!’ হাতের চাপ আরও বাড়াল কিশোর।
যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল বিল। চোদ্দ! গেইটর সোয়াম্পে কী পেয়েছি সেটা জানতে এসেছ তো? সত্যি বলছি মোহরটা ছাড়া সেমিনোল ইনডিয়ানদের হারানো গুপ্তধনের আর কিচ্ছু পাইনি।’
‘সেমিনোল গুপ্তধন?’
‘হ্যাঁ। আমাকে বলেছে, মুখ বন্ধ রাখলে গুপ্তধনের একটা ভাগ দেবে।’
‘কে বলেছে?’
‘আমি সেটা বলতে পারব না। তাহলে আমাকে খুন করে ফেলবে।’
‘শোনো, বিল, যে তোমাকে খুন করতে চায় সে একবার খুনের চেষ্টা করে ফেলেছে। আমাদের জন্যে পারেনি। আরেকটা কথা শুনে রাখো, সেমিনোলরা কখনই সোনার মোহর বানায়নি।’
শরীর মোচড়ানো থামিয়ে দিল বিল। ‘কী বলতে চাও?’
‘তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছে ও,’ কিশোর বলল। ‘তুমি যে মোহরটা পেয়েছ, সেটা এসেছে মায়ামির একটা ব্যাংকের ভল্ট থেকে। পঞ্চাশ লাখ ডলারের মোহর গেইটর সোয়াম্পে হারিয়ে গেছে।’
‘বলো কী!’ জোরে নিঃশ্বাস ফেলল বিল। ‘জানতামই না। কিশোর, আমাকে ছেড়ে দাও। আমি আর পালানোর চেষ্টা করব না।’
ছেড়ে দিল কিশোর। হাত দিয়ে কাপড়ের ময়লা ঝেড়ে নিল বিল। তারপর ওর রহস্যময় আচরণের কারণ খুলে বলতে লাগল, ‘শহরের মেইন রোডে একটা অল-নাইট পেট্রোল পাম্পের মালিক আমার বাবা। রোডেওতে কোনমতেই আমাকে যেতে দিতে রাজি হবে না।’
‘বয়েস কম বলে?’
‘না। বাবা আমাকে আঠারো বছর বয়েসেও যেতে দেবে না। রোডেওতে যাওয়াটাই বাবার পছন্দ না। আমি জখম হব, তাই ভয় পায়।’
বিলের মাথার জখমটার দিকে তাকাল কিশোর।
মাথার ফুলে ওঠা জায়গাটায় হাত দিল বিল। ‘এসব জখম নিয়ে বাবার পাম্পের পাশ দিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছিলাম। বাবা কিংবা ওর কোনও বন্ধুর চোখে পড়ে গেলে সর্বনাশ হতো। আমার রোডেওতে যাওয়ার আশা একদম শেষ। তাই কোন ঝুঁকি নিতে চাইনি। বহু পথ ঘুরে বোট নিয়ে গেইটর সোয়াম্পের ভিতর দিয়ে আসতে হয়েছে।’
‘এত কষ্ট, তা-ও রোডেও খেলার শখ?’
‘রোডেও আমার নেশা! মাত্র এক বছর হলো এখানে এসেছি আমরা। এখনও কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সুযোগ হয়নি। প্রয়োজনও মনে করি না। রোডেওই এখন আমার ধ্যান-জ্ঞান।’
‘কিন্তু বারবিকিউ থেকে পালিয়েছিলে কেন?’
‘ডেপুটি ক্যানার যখন বললেন তোমরা ডিটেকটিভ, ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। আমার রোডেও খেলার কথা বাবার কানে চলে যাওয়ার ভয়। তা ছাড়া আমাকে যে স্পন্সর করেছে, সে বলে দিয়েছে সেমিনোল গুপ্তধনের কথা গোপন রাখতে, কাউকে যেন না বলি।
‘তোমার স্পন্সর?’ হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল কিশোরের। ‘ফক্স ডেনভার, গুজ বার্নারের মাধ্যমে যার সঙ্গে তোমার পরিচয়?’
‘হ্যাঁ। রোডেও শেষ হয়ে গেলে গুপ্তধন খোঁজায় আমাকে সাহায্য করবে বলেছিল।’
‘হুঁ!’ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। তারমানে আমার ধারণাই ঠিক। ডাকাতেরা ডুবে মরেনি।’
‘তা কী করে সম্ভব? যা ঝড় হয়েছিল। পাহাড়ের মত ঢেউ। এ রকম উত্তাল সাগরে এয়ারবোট ডুবলে কেউ বাঁচতে পারবে না।’
‘সাগরে আসলে ডোবেইনি ওরা,’ জবাব দিল কিশোর। ‘সাগরের মোহনায় পৌছে জাহাজে চড়েছে। এয়ারবোটটাকে সাগরে টেনে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে। পুলিশকে বোঝাতে চেয়েছে এয়ারবোটে করে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ঝড়ের সময় ডুবে মরেছে ওরা। সেই জাহাজটা কীসের এবং কার, বুঝতে পারছি। জাহাজটা একটা মাছধরা জাহাজ। মালিক ফক্স ডেনভার।’
বারো
‘গুজ বার্নার ডাকাতিতে জড়িত এ ধারণা হলো কেন তোমার?’ রবিন জিজ্ঞেস করল। রোডেও গ্রাউন্ড থেকে খচ্চরে চড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে খিদে পেয়ে গেছে ওর। নজর রাখছে ফ্রগ’স পেনিনসুলার ম্যারিনায় সাগরপাড়ে তৈরি এখানকার একমাত্র মোটেলটার দিকে 1
‘গোড়া থেকেই ওর আচরণ ছিল সন্দেহজনক,’ জবাব দিল মুসা। ‘আর আজকে হঠাৎ করে ওর ফিশিং ক্যাম্পে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটা তো আরও সন্দেহজনক। চুপ করে বসে থাকো। আমার ধারণা, মোটেল থেকে বেরোবেই বার্নার। ওর দোস্তদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। পিছু নিয়ে তখন দেখব কোথায় যায়।’
‘কিন্তু কতক্ষণ বসে থাকব? আমার পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে।’
‘মোচড়টা আপাতত চেপে রাখো। এখান থেকে মুহূর্তের জন্যেও ওঠা চলবে না।’
‘আমরা আসার আগেই যদি বেরিয়ে গিয়ে থাকে?’
‘আরও পনেরো মিনিট দেখব। এর মধ্যে যদি না বেরোয়, আমি গিয়ে রিসিপশনিস্টের সঙ্গে কথা বলব। ততক্ষণ তুমি এখানে বসে থাকবে।’
‘কিন্তু তোমার ভুলও তো হতে পারে?’
‘না, ভুল আমার হয়নি। বার্নারও এ ডাকাতিতে জড়িত। আমি শিওর, ডিক টোম্যানের মাথায় ও-ই বাড়ি মেরে বেহুঁশ করেছে। ভাঁড়ের পোশাক চুরি করে ভাঁড় সেজে রিঙে ঢুকেছে।’
‘কিন্তু ছদ্মবেশেই যদি ঢুকবে, তা হলে আর রোডেও রাইডার সাজার কী প্রয়োজন ছিল?’
‘যাতে ফিশিং ক্যাম্পের কাছাকাছি থাকতে পারে, জলাভূমিতে হারিয়ে যাওয়া সোনাগুলো পাহারা দিতে পারে, যাতে রোডেও গ্রাউন্ডে আনাগোনা নিয়ে তাকে কেউ সন্দেহ না করে…ওই যে, বেরোচ্ছে! বলেছিলাম না?’
মোটেলের সামনের গেট দিয়েই বেরোল বার্নার। গোপনীয়তার ধার ধারছে না। তারমানে সে কল্পনাই করেনি ওর ওপর কেউ নজর রাখছে। সোজা এগোল ডকের দিকে।
নারকেল গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে ওর পিছু নিল রবিন ও মুসা।
ডকে নোঙর করে রাখা ‘শার্ক’ নামের একটা মাছধরা জাহাজে গিয়ে উঠল
ডকে স্তূপ করে রাখা কতগুলো কাঁকড়া-ধরা ফাঁদের আড়ালে আত্মগোপন করে জাহাজটার ওপর নজর রাখতে লাগল দুজনে। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পরও বোটের ভিতর থেকে কাউকে বেরোতে না দেখে ফিসফিস করে মুসা বলল, ‘ওই জাহাজে উঠব কী করছে ওরা দেখব।’
‘পাগল হয়ে গেলে নাকি!’ বলল রবিন। ‘পুলিশকে খবর দিলেই তো হয়।’
‘পুলিশকে খবর দেয়ার মত প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। অত সময়ও নেই। ডাকাতগুলো কী করে দেখতে হলে এটাই সুযোগ।’
কাঁকড়া-ধরা ফাঁদের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল দুজনে। কয়েকটা মাছধরা জাহাজ, সেইলবোট আর ইয়টের সামনে দিয়ে চলে এল শার্ক জাহাজটার কাছে।
রবিনকে মাথা নিচু করে রাখতে বলল মুসা। জাহাজ থেকে আসা আলোর কাছ থেকে দূরে থাকতে বলল। পা টিপে টিপে তক্তার সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে উঠে এল দুজনে। পা রাখল ডেকে।
মুসার ভারে মড়মড় করে উঠল তক্তা। বরফের মত জমে গেল ও।
কেউ বেরোল না কেবিন থেকে। রবিনকে নিয়ে আবার এগোল মুসা। ডেকে উঠে নিচুস্বরে বলল, ‘এখানেই থাকো।’
প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে প্রধান কেবিনটার কাছে চলে এল ও। ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করল একটা জানালার কাছে। সাবধানে উঁকি দিল ভিতরে।
বদ্ধ কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে গুজ বার্নারকে দেখতে পেল। ফক্স ডেনভারের সঙ্গে কথা বলছে। দুজনেরই চোখেমুখে রাগ। কোনও একটা ব্যাপারে যেন একমত হতে পারছে না।
কথা বোঝা যাচ্ছে না। ভালমত শোনা দরকার। গলা লম্বা করে দিয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল মুসা। কেবিনের পিছনের দরজাটা চোখে পড়ল। খোলা।
কেবিনের পাশ ঘুরে দরজাটার কাছে চলে এল ও।
‘সময় থাকতে কেটে পড়া দরকার,’ বার্নারের কথা কানে এল মুসার। ‘ওই ছেলেগুলো আমাকে সন্দেহ করে ফেলেছে। পিছে লেগেছে। ঝড়টা আঘাত হানার আগেই গেইটর সোয়াম্প থেকে মোহরগুলো তুলে নিতে না পারলে আর কখনও পারব না।’
‘তোমার অসাবধানতার কারণেই আজ এতসব সমস্যা,’ ডেনভারের উত্তপ্ত কণ্ঠ শোনা গেল। ‘বস্তাটা রাখলে এয়ারবোটের একেবারে গলুইয়ের কাছে, ওরকম জায়গায় কেউ রাখে? ওখানে না রাখলে পানিতেও পড়ত না, এত ঝামেলাও পোহাতে হতো না আমাদের।’
‘আমাকে বকে কী হবে? ব্যাংকের ভল্টের তালা খুলতে নিয়ে গিয়েছিলে, খুলে দিয়েছি। আমি যেটা পারি না সেই দায়িত্ব আমার ওপর চাপালে কেন?’
হঠাৎ খড়খড় করে উঠল শর্টওয়েভ রেডিওর স্পিকার। ভারি একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘গেইটর বলছি শার্ককে। হারানো মালগুলো খুঁজে পেয়েছি আমি। তিরিশ মিনিটের মধ্যে জাহাজে পৌছাচ্ছি।’
রাগ চলে গেল ডেনভার আর বার্নারের চেহারা থেকে। হাসি ফুটল। রেডিওর হ্যান্ড রিসিভার তুলে নিল ডেনভার। ‘একটা কাজের কাজই করেছ, গেইটর। শত্রুক্যাম্পের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছ? ওভার।
‘বিচ্ছিন্ন করেছি। একটা দারুণ চমকও রেখে এসেছি বিচ্ছুগুলোর জন্যে।’
সাঙ্কেতিক বাক্য ব্যবহার করছে ওরা। রেডিওর কণ্ঠটা মুসার পরিচিত। মরিস মরিসন। বুঝতে পারল, ওর সাঙ্কেতিক নাম গেইটর। হারানো মাল বলে নিশ্চয় সোনার মোহরগুলোকেই বুঝিয়েছে। কিন্তু ‘শত্রুক্যাম্পের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন’ আর ‘দারুণ চমক’ বলে কী বোঝাতে চেয়েছে?
‘ভাল, গেইটরটেইল, ডেনভার বলল। ‘ফ্লোরিডা বে’র নি জায়গায় দেখা হবে। ওভার অ্যান্ড আউট।’
রিসিভার নামিয়ে রাখল ডেনভার। সাদা রঙের একটা হ্যাট তুলে মাথায় দিল। কমলা-কালো পালক লাগানো। কেবিনের দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। চট করে সরে গেল রবিন। জাহাজের সামনের দিকে ছুটল। গ্যাঙপ্ল্যাঙ্ক বেয়ে আর নামার সময় নেই। নামতে গেলেই ডেনভারের চোখে পড়ে যাবে।
বুনো হাঁসের পরিচিত ডাক কানে এল।
ঝটকা দিয়ে ডানে মাথা ঘোরাতেই চোখে পড়ল মুসাকে। কার্গো হ্যাচের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পাগলের মত হাত নেড়ে হ্যাচ দেখিয়ে নীচে নেমে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে।
তাড়াতাড়ি হ্যাচের কাছে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। ঢাকনাটা তুলল। রবিনকে নিয়ে নীচে নেমে এল। জাহাজের স্টোরেজ এরিয়া অর্থাৎ মাল রাখার জায়গা এটা। কিন্তু ‘মাল’-এর নমুনা দেখে হাঁ হয়ে গেল দুজনেই।
হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে জাহাজের খোলে ফেলে রাখা হয়েছে ডেপুটি ক্যানার আর কিটি ওয়াটারম্যানকে।
গোঁ-গোঁ করে কিছু বলার চেষ্টা করলেন ডেপুটি। হাত তুলে ওপর দিক দেখিয়ে চুপ থাকতে ইশারা করল মুসা।
ওপরে জাহাজের ডেকে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা সরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল মুসা ও রবিন। তারপর ক্যানার ও কিটির বাঁধন খুলতে শুরু করল।
মুখ থেকে কাপড় খুলতেই ডেপুটি বললেন, ‘বাঁচালে!’
‘এখানে এলেন কী করে?’ ডেপুটির পায়ের বাঁধন খুলছে রবিন।
‘ডকমাস্টারকে জরুরি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম,’ ডেপুটি জানালেন। ‘ডাকাতির রাতে বন্দরে যত জাহাজ ছিল সব স্থানীয়। আমি জানতে এসেছিলাম, এগুলোর মধ্যে কোনওটা ঝড়ের সময় জেটি থেকে সরেছিল কিনা।’
‘শার্ক,’ রবিন বলল।
‘ঠিক। ডকমাস্টারের কাছে শোনার পর ফক্স ডেনভারকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম ঝড়ের মধ্যে কোথায় বেরিয়েছিল ও। জবাব না দিয়ে একটা বন্দুক বের করে আমার দিকে তাক করল।’
‘যা বোঝা যাচ্ছে, পুরো দলের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এই লোকটাই।’
‘দল?’ বুঝতে পারলেন না ডেপুটি ক্যানার
কিটির হাত মুক্ত হলে ও নিজেই মুখে গোঁজা কাপড়টা টেনে বের করল। ‘অ্যালিগেইটর শিকারি, মরিস। মাছ শিকারি, ডেনভার। ওদের পিছু নিয়ে জলাভূমিতে যাওয়ার সময় আমাকে ধরে ফেলল। হাত-পা বেঁধে এখানে নিয়ে এসেছে ডেনভার।’
‘তৃতীয় আরও একজন আছে দলে, গুজ বার্নার,’ রবিন বলল। ‘তালা খোলার ওস্তাদ।’
‘ওরা কারা?’ এখনও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে কিটি।
‘ডাকাত। মায়ামির ব্যাংক থেকে ওরাই সোনার মোহর চুরি করেছে।’
‘তুমি শিওর?’ ডেপুটি জিজ্ঞেস করল।
‘শিওর।’
‘কথা পরেও বলা যাবে,’ তাগাদা দিল মুসা। ‘এখান থেকে বেরোনো দরকার আগে।’
কিন্তু দেরি যা করার করে ফেলেছে। ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার শব্দ হলো। কার্গো হোল্ডে থেকেও বোঝা যাচ্ছে, ডক থেকে সরে যাচ্ছে জাহাজটা।
‘বাহ্, চমৎকার,’ তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা।
‘হুঁ, তাহলে ফক্স ডেনভারই হ্যাটটা ধার দিয়েছিল তোমাকে তোমার চেহারা আড়াল করে বয়েস লুকানোর জন্যে,’ কিশোর বলল। বিলের বোটে করে ওর সঙ্গে গেইটর সোয়াম্পে চলেছে।
তীর ঘেঁষে চালাচ্ছে বিল। ‘হ্যাঁ। প্রথম দিন ভুলে আমার হ্যাটটা বাড়িতে ফেলে এসেছিলাম। ডেনভার বলল, হ্যাট ছাড়া আমাকে একেবারেই কচি খোকার মত দেখাচ্ছে, অনভিজ্ঞ রাইডার। তখন আমাকে এক রাতের জন্যে ওর হ্যাটটা ধার দিল।’
‘আর টাকা দিল প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়ার জন্যে।’
‘হ্যাঁ। এক শর্তে, সোনার মোহরটা পাওয়ার কথা কাউকে বলতে পারব না।’
‘মোহরটা কোথায় পেয়েছিলে?’
‘রাতের বেলা ঠিক জায়গাটা দেখানো কঠিন, তবে চেষ্টা করব।’
ইঞ্জিন সামলাচ্ছে বিল। গলুইয়ের কাছে বসে আছে কিশোর। নজর রাখছে, যাতে পানিতে ডুবে থাকা মরা গাছে না লাগে, কিংবা ঘাসের দঙ্গল প্রপেলারে জড়িয়ে না যায়।
অবশেষে সেই দ্বীপটার কাছে পৌছল বিল। চিনতে পারল কিশোর। রাতের বেলা সেদিন এটাতেই আটকা পড়েছিল।
‘এখানে পেয়েছ? টুইন সাইপ্রেস-কী!’
না। কাছের আরেকটা দ্বীপের কিনারের অল্প পানিতে। চকচক করছিল। তুলে নিয়েছি। এটার সঙ্গে মিল ছিল দ্বীপের একটা জিনিসের।’
‘ছিল? এখন নেই?’
‘দেখলেই বুঝতে পারবে, কী বলতে চাইছি।’
কয়েক মিনিট পর একটা বাঁক ঘুরে এল বোট। সামনে একটা দ্বীপ, দেখতে টুইন সাইপ্রেস-কী’র মত। তবে একটা বড় পার্থক্য আছে।
‘এটাতে মাত্র একটা সাইপ্রেস গাছ,’ কিশোর বলল। আরেকটু কাছে যেতে দ্বিতীয় গাছটা চোখে পড়ল। তীরের কাছে কাত হয়ে পড়ে আছে। অর্ধেক পানিতে, অর্ধেক ডাঙায়। ‘ও, তারমানে ঝড়ে উপড়ে পড়েছিল!’
‘হ্যাঁ, বিল জবাব দিল। ‘ঝড়ের আগে বহুবার এসেছি এখানে। প্রায়ই ভুল করতাম। গাছ দুটোর কারণে কোনটা যে আসল টুইন সাইপ্রেস-কী বুঝতে অসুবিধে হতো।’
‘তারমানে ডাকাতরাও একই ভুল করেছে,’ এতক্ষণে বুঝতে পারল কিশোর। ‘মোহরগুলো পড়ে যাওয়ার সময় দুটো গাছ দেখেছিল ওরা। গাছ দুটোকে নিশানা রেখেছিল। ঝড়ে একটা গাছ উপড়ে যাওয়ার পর আর নিশানা ঠিক রাখতে পারেনি। ভুল করে বার বার টুইন সাইপ্রেস-কী’তে খুঁজতে চলে গেছে। ঠিক কোন জায়গাটায় মোহরটা পেয়েছ তুমি?’
‘ওই যে, ওখানে,’ দেখাতে গিয়ে কেঁপে উঠল বিলের গলা। ‘ওই অদ্ভুত আলোটা কীসের?’
পানির নীচে আলো। ওর পঞ্চাশ গজ দূরে নোঙর করা একটা এয়ারবোট।
‘মরিস মরিসন, আমি শিওর,’ কিশোর বলল। ‘ভুলটা নিশ্চয় বুঝে গেছে।’
ইঞ্জিন বন্ধ করতে ইশারা করল ও। এয়ারবোটের পাশে এসে থামল বিলের বোট। এয়ারবোটে একটা শর্টওয়েভ রেডিও দেখতে পেল কিশোর।
‘আরে, আলোটার কী হলো?’ চেঁচিয়ে উঠল বিল। এয়ারবোটের দিকে নজর ছিল ওদের। মাত্র এক মুহূর্তের জন্য। ওটুকু সময়েই গায়েব হয়ে গেছে আলো।
ভয়ঙ্কর চেহারার একটা জীব লাফিয়ে উঠল পানির ওপর। বিলের পিছনে। প্রচণ্ড শক্তিতে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল ওকে। তারপর টেনে নিয়ে গেল জলাভূমির পানিতে।
তেরো
‘বিল!’ চিৎকার দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিশোর।
পানির নীচে শক্তিশালী জীবটার সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করল। রবারের মত চামড়া প্রাণীটার। বড় বড় চ্যাপ্টা পায়ের পাতা। জীবটাকে চিনতে পারল ও। ডুবুরির পোশাক পরা মানুষ।
বিলকে লোকটার হাত থেকে ছাড়াতে পারল না কিশোর। তবে ঠেলেঠুলে বিলকে খানিকটা ওপরে তুলে আনতে পারল যাতে নাক ভাসিয়ে শ্বাস অন্তত নিতে পারে।
আচমকা টান দিয়ে লোকটার মাস্ক খুলে নিল ও। মুখোশের আড়ালে কার মুখ ঢাকা পড়ে ছিল দেখতে পেল। যা সন্দেহ করেছিল তাই। মরিস মরিসন।
বিলকে ছেড়ে দিয়ে সাঁতরে সরে যেতে শুরু করল মরিস। ওর পিছু নেয়ার চেয়ে এখন বিলকে সাহায্য করা জরুরি। ওকে বোটে উঠতে সাহায্য করল কিশোর। নিজে বোটের কিনারে ঝুলে রইল, অর্ধেক শরীর পানিতে। এতক্ষণে আবার মরিসের দিকে তাকানোর সুযোগ পেল। ভেবেছিল, আক্রমণ করবে। কিন্তু যেখানে দেখবে ভেবেছিল, সেখানে নেই লোকটা।
‘ওই তো!’ গলুইয়ের দিকটায় আঙুল তুলে চেঁচিয়ে উঠল বিল। ‘এয়ারবোটে উঠছে!’
কিশোরও দেখতে পেল। পানির নীচ থেকে একটা চটের বস্তা বোটে টেনে তুলছে মরিস। কিশোরও চেঁচিয়ে উঠল, ‘মোহরগুলো পেয়ে গেছে!’
বস্তার মুখ খোলা। দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে বাঁধল মরিস। পানিতে পড়ার সময় নিশ্চয় বস্তার মুখ খুলে গিয়েছিল। দু’চারটা মোহর হয়তো ছিটকে পড়েছিল এদিক ওদিক। ঢেউয়ের ধাক্কায় একটা চলে গিয়েছিল তীরের কাছাকাছি। সেটাই খুঁজে পেয়েছে বিল।
এয়ারবোটের ইঞ্জিন স্টার্ট দিল মরিস। গেইটর সোয়াম্প ধরে ফ্লোরিডা বে’র দিকে রওনা হয়ে গেল। পুল কর্ড টেনে বিলও ওর বোটের ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। মরিসের পিছু নিল। কিন্তু গতি এতই কম, বুঝল, এয়ারবোটের সঙ্গে কোনভাবেই পেরে উঠবে না। চিৎকার করে কিশোর বলল, ‘বিল, রাস্টির ফিশিং ক্যাম্পে চলো!’
.
শার্কের কার্গো হোল্ডে ওদিকে শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য সুবিধেমত একটা অস্ত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে মুসা।
ভয়ানক উত্তাল সাগর। ভীষণভাবে দোল খাচ্ছে জাহাজ। সোজা হয়ে বসে থাকাও কঠিন। ডেপুটি ক্যানারের পায়ের শেষ গিঁটটা খুলতেও হিমশিম খাচ্ছে রবিন।
‘কিছু পেলে?’ দড়ির চাপে লাল হয়ে যাওয়া হাতের কব্জি ডলছে কিটি।
‘নাহ্, অস্ত্র পাইনি,’ জবাব দিল মুসা। তবে লাইফ জ্যাকেটগুলোর নীচে কী পেয়েছি দেখুন।’ কালো কাপড়ের দুটো হুড তুলে দেখাল ও।
‘হুড!’ কিটি অবাক।
‘হ্যাঁ, হুড। এগুলো পরেই নিশ্চয় ব্যাংকে ডাকাতি করতে গিয়েছিল,’ ডেপুটি বললেন। কিন্তু বোটে এল কী করে এগুলো?’
‘ডাকাতি করে পালিয়ে এসে এই জাহাজেই লুকিয়েছিল ডাকাতেরা,’ মুসা অনুমান করল। ‘ওরাই রেখেছে। ডাকাতির পর পুলিশের তাড়া খেয়ে প্ল্যান বদল করেছিল গুজ বার্নার আর মরিস মরিসন। ডিন ওয়াটারম্যানের একটা এয়ারবোট চুরি করে ফ্লোরিডা বে’তে ডেনভারের জাহাজে ওঠার বুদ্ধি করেছিল।‘
‘তারমানে জাহাজে ঠিকমতই উঠতে পেরেছিল, ক্যানার বললেন। ‘গাল্ফ্ অভ মেক্সিকোর দিকে পালিয়ে না গিয়ে এখানে থেকে যাওয়ার কারণটা কী?’
‘মোহরগুলো আনতে পারেনি ওরা। ঝড়ের সময় ওদের ছিনতাই করে আনা এয়ারবোট থেকে মোহরগুলো গেইটর সোয়াম্পের পানিতে পড়ে যায়। একটু আগে বার্নার আর ডেনভার সেটা নিয়ে ঝগড়া করছিল।’
‘দেখো মুসা,’ ডেপুটি বললেন, ‘পড়ালেখা শেষ করে যদি পুলিশের গোয়েন্দা হতে ইচ্ছে করে, সোজা চলে এসো ফ্রগ’স পেনিনসুলায়, আমি নিজে তোমার জন্যে সুপারিশ করব।’
‘চাকরি তো পরে, আগে বাঁচার চেষ্টা করা দরকার। এখান থেকে বেরোতে হবে।’
‘বেরিয়ে কী করবে?’ কিটির প্রশ্ন। ‘সাঁতরে সাগর পাড়ি দেবে?’
‘এ ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখছি না।’ কিটির দিকে তাকাল মুসা।
‘এখানকার সাগরে হাঙর আছে?’ জিজ্ঞেস করল রবিন।
‘কিলবিল করছে,’ জবাবটা দিলেন ডেপুটি।
‘ঝড়ের সময় অন্য প্রাণীরা যেখানে প্রাণের ভয়ে অস্থির, তখনও খাওয়াটাই একমাত্র কাজ বলে মনে করে এখানকার হাঙরেরা,’ যোগ করল কিটি।
‘যাক, সুখবর, তিক্ত শোনাল মুসার কণ্ঠ। ‘তাহলে কি কোন উপায়ই নেই?’
‘উপায় একটা আছে,’ ডেপুটি বললেন। ‘রেডিওটা কোনভাবে হাত করতে পারলে কোস্ট গার্ডের সাহায্য চাইতে পারি।’
কেউ কিছু বলার আগেই উঠে দাঁড়াল কিটি। নিঃশব্দে হ্যাচের ঢাকনা ফাঁক করে উঁকি দিল। মাথা নামিয়ে জানাল, ‘জাহাজ চালাচ্ছে ডেনভার। বার্নারকে দেখা যাচ্ছে না।’
‘নিশ্চয় কেবিনে,’ মুসা বলল। ‘ডেনভারের চোখ এড়িয়ে ওখানে যাওয়া যাবে?’
আবার হ্যাচের ঢাকনা ফাঁক করে দেখল কিটি। ‘এসো!’
ঢাকনা সরিয়ে দুই হাতে কার্গো হোল্ডের ফোকরের দুই পাশ চেপে ধরে দোলা দিয়ে বানরের মত ওপরে উঠে গেল কিটি। ওর ক্ষিপ্রতা বিস্মিত করল সবাইকে। কেন ওর নামের আগে ‘আজব’ শব্দটা জুড়ে দেয়া হয়েছে বুঝতে পারল মুসা ও রবিন।
কিটির পিছনে বেরোল ও। জাহাজের গলুইয়ের দিকে ডেনভারের নজর। ওদের দিকে ঘুরতে লাগল ওর মুখ। ডেকে তুলে রাখা নোঙরের পিছনে চট করে বসে পড়ল দুজনে। যে কোন কারণেই হোক, ডেনভারের নজর ওদের ওপর পড়ল না, ওর চোখ আবার গলুইয়ের দিকে ফিরলে রওনা হলো দুজনে।
হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে লাগল দুজনে। মেইন কেবিনের খোলা দরজার কাছে পৌঁছল। ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে নিল কিটি। মুসাকে আসতে ইশারা করল। ঢুকে পড়ল কেবিনে।
কেবিনের সামনের দিকে আরেকটা দরজা। জাহাজের স্লিপিং কোয়ার্টারে যাওয়ার পথ, বুঝতে পারল রবিন। একটা ধাতব ডেস্কের ওপর রাখা রেডিওটা। পাশে আরেকটা ইলেকট্রনিক যন্ত্র। ফিশ ফাইন্ডার। সাগরতলে মাছ কোথায় আছে খুঁজে বের করার জন্য ব্যবহার হয় এই যন্ত্র।
ডেস্কে ছড়ানো গেইটর সোয়াম্পের একটা ম্যাপ। সমস্ত দ্বীপের ওপর লাল ‘ক্রস’ চিহ্ন দেয়া। রাস্টি কালাহানের ফিশিং ক্যাম্প ঘিরে কালো কালির দাগ।
রেডিওর সুইচ অন করল রবিন। তীক্ষ্ণ চিৎকারের মত শব্দ বেরোতে থাকল স্পিকার থেকে। তাড়াতাড়ি ভলিউম কমিয়ে দিল ও। রবিনকে চুপ থাকতে ইশারা করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল কিটি। মুহূর্ত পরেই ফিরে এল আবার। ইশারাতেই জানাল, সব ঠিক আছে।
হ্যান্ড রিসিভার তুলে নিয়ে ট্র্যান্সমিট করার বোতাম টিপল মুসা। ‘মুসা কলিং কালাহান’স ফিশিং ক্যাম্প,’ নিচু স্বরে কথা বলল মুসা। সাড়া পেল না। কণ্ঠস্বর সামান্য উঁচু করে আবার চেষ্টা করল। এবারও সাড়া এল না। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে যখন হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল, কথা বলে উঠল স্পিকার, ‘হাই, মুসা। তুমি আবার রেডিও কিনলে কবে?’
হ্যারিসের কণ্ঠ চিনতে পারল মুসা। ‘হ্যারিস, ভীষণ বিপদের মধ্যে আছি আমরা।’
‘সে তো বোঝাই গেছে। কড়া ঘুম থেকে আমাকে ডেকে তুলেছ। কোথায় তুমি? ওভার।’
‘ফক্স ডেনভারের ফিশিং বোটে।’
‘ফিশিং বোট! ঝড় আসছে জানো না?’
‘আস্তে বলুন! জাহাজটায় ডাকাতদের সঙ্গে রয়েছি আমরা। মায়ামিতে ব্যাংক ডাকাতি করেছে যারা। ওভার।’
‘বলো কী!’ চেঁচিয়ে উঠল হ্যারিস।
‘আস্তে! আস্তে! কিশোরকে বলুন, জাহাজ নিয়ে মরিস মরিসনকে তুলে নিতে যাচ্ছে ডাকাতগুলো।’
‘কিশোর তো এখানে নেই…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই আচমকা থেমে গেল হ্যারিসের কণ্ঠ। রেডিওতে গোলমাল হয়েছে না অন্য কিছু, বোঝা গেল না।
‘তাই তো বলি, কথা বলে কে!’ পিছনে পরিচিত কণ্ঠ শুনে পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল মুসা। বার্নারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। স্লিপিং কোয়ার্টারের দরজা দিয়ে ঢুকেছে। ‘ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। তোমার কথা কানে গেল…আরও আস্তে বলা উচিত ছিল তোমার।’
‘দেরি করে এসেছেন,’ মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করল রবিন। ‘পুলিশকে এস ও এস পাঠিয়ে দিয়েছি।’
চোখের পাতা সরু হয়ে এল বার্নারের। ‘গুড। ভালই করেছ। তোমাদের লাশ খুঁজে পেতে আর বেশি কষ্ট করতে হবে না ওদের। যদি ততক্ষণে হাঙরে খেয়ে না ফেলে।’
এক পা এগিয়ে এল বার্নার। আচমকা ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ডেকে বেরোনোর দরজার দিকে দৌড় দিতে গেল মুসা। পারল না। ওকে ধরে ফেলল বার্নার। হাত মুচড়ে পিঠের ওপর নিয়ে এসে অসহায় করে ফেলল। গর্জে উঠল, ‘বহুত জ্বালান জ্বালিয়েছ। এবার বোঝাব মজা!’
কিন্তু মুসাকে ‘মজা বোঝানোর’ আগেই কেবিনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল কিটি। ঘুসি মারল বার্নারের চোয়ালে। পিছনে ছিটকে পড়ল বার্নার। নাক চেপে ধরেছে। আঙুলের ফাঁকে রক্ত। ঘুসি খেয়ে নাক ভেঙে গেছে। রক্ত বেরোচ্ছে।
ক্ষুধার্ত বাঘের দৃষ্টিতে কিটির দিকে তাকাল বার্নার। কিন্তু আক্রমণ করতে দ্বিধা করছে। ও এখন একা। শত্রুরা দুজন।
‘খবরদার! নড়বে না!’ মুসার পিছন থেকে ধমক শোনা গেল।
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল মুসা ও কিটি। শটগান হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল ডেনভারকে। বন্দুকের নল ওদের দিকে তাক করা। তাড়াতাড়ি ডেস্কের ড্রয়ার খুলে একটা রিভলভার বের করে নিল বার্নার। তুলে ধরল মুসার দিকে।
কেবিনের দরজার দিকে ফিরে হাঁক দিল ডেনভার। ‘এই, এসো তোমরা, ভিতরে এসো! কোন চালাকি করবে না, যদি তোমাদের বন্ধুদের সুস্থ দেখতে চাও!’
ভিতরে ঢুকল রবিন ও ক্যানার।
রক্তাক্ত নাকের ভিতর থেকে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ বেরিয়ে এল বার্নারের। ‘বাহ্, চমৎকার! হাঙরের ভোজ আজ ভালই জমবে।’
চোদ্দ
‘হ্যারিস! রাস্টি!’ চিৎকার করছে কিশোর। অন্ধকারে ফিশিং ক্যাম্পের কেবিনের দিকে দৌড়াচ্ছে। ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে দিল। আলো জ্বলল না।
বাইরে বেরিয়ে এল ও। বোট থেকে একটা টর্চ থাবা দিয়ে তুলে নিয়ে দৌড় দিল বিল। কিশোরের কাছে চলে এল।
‘আলো জ্বলছে না। মেইন কেবিনে কেউ নেই। আমাদের কেবিনে গিয়ে দেখি।’ দৌড় দিল কিশোর 1
চাবুকের মত আঘাত হানছে বাতাস। চোখেমুখে সুচ ফুটাচ্ছে বৃষ্টি। সব কিছু উপেক্ষা করে খুঁটিতে বসানো কেবিনের সারির পাশ দিয়ে ছুটছে দুজনে।
‘এটাই।’ থামল না কিশোর। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠতে শুরু করল।
‘রবিন!’ কেবিনে ঢুকে চিৎকার করে ডাকল কিশোর। বিলও ঢুকল। টর্চের আলো ফেলল অন্ধকার কেবিনে। অদ্ভুত দৃশ্য ফুটে উঠল চোখের সামনে। মেঝেতে পানি জমে আছে। কাদার চিহ্ন সরে গেছে পানির কাছ থেকে। বিছানার পাশ থেকে নড়ে উঠল বিশাল একটা জীব। মাথা দিয়ে দরজা আটকাল, লেজ দিয়ে জানালার দিকটা।
‘কি-কি-ক্কিশোর!’ ভয়ে তোতলানো শুরু করল বিল। ওর ট আলো প্রতিফলিত হচ্ছে মস্ত একটা সরীসৃপের দুধসাদা চোখে।
‘অ্যালিগেইটরটা এখানে এল কীভাবে!’ কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিশোর। বিল, আস্তে আস্তে সরতে থাকো। পিছন দিকে চলে যাও। সাদা চোখটা কানা। ওটা দিয়ে দেখতে পায় না।’
‘আমার পা অবশ হয়ে গেছে!’ কম্পিত কণ্ঠে বিল বলল।
‘তাহলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। ধীরে ধীরে সরতে আরম্ভ করল কিশোর। অ্যালিগেইটরের লেজের দিকে চলে আসছে। অ্যালিগেইটর এমনিতেই চোখে ভাল দেখে না, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে বিশেষজ্ঞদের মুখে শুনেছে; তার ওপর এটার একটা চোখ নষ্ট। সেই সুযোগটাই নিতে যাচ্ছে ও।
‘বিল, অ্যালিগেইটরের পিঠে চড়ব আমি।’
‘কী করবে?’
‘পিঠে চড়ব। আটকানোর চেষ্টা করব। আমি পিঠে চড়লে আর এক মুহূর্তও দেরি করবে না, সোজা দৌড় দেবে দরজার দিকে।’
বিলের দিকে কয়েক ফুট এগোল অ্যালিগেইটর। যা করার দ্রুত করতে হবে, বুঝতে পারছে কিশোর, একেবারে সময় নেই। আরেকটু এগোল ও। তারপর লাফ দিয়ে গিয়ে বসল অ্যালিগেইটরটার পিঠে দুই হাতে ওটার নাকের ওপর চাপ দিয়ে ওপরের চোয়াল নামিয়ে মুখটা মেঝেতে ঠেসে ধরার চেষ্টা করল।
এভাবেই চোয়াল চেপে ধরে অ্যালিগেইটরকে আটকানো হয়, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে দেখেছে। চাপা গর্জন করে উঠল অ্যালিগেইটর। মাথা ঝাড়া দিয়ে হাত সরানোর চেষ্টা করল। মুখটা সরে গেল দরজার কাছ থেকে।
‘কিশোর!’ রাস্টির চিৎকার শোনা গেল। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল কেবিনের দরজা। ঘরে ঢুকল ও।
ভয়ঙ্করভাবে লেজ দোলাচ্ছে তখন অ্যালিগেইটর। মাথাটা এপাশ ওপাশ ঝাঁকি দিচ্ছে। বহু কষ্টে ওটার পিঠ আঁকড়ে রয়েছে কিশোর।
আর কোন উপায় না দেখে রাস্টিও এসে বসল অ্যালিগেইটরের পিঠে। মেঝেতে চেপে ধরে রাখতে চাইল। কোনভাবে যদি উল্টে যেতে পারে ওটা, পিঠের নীচে ফেলে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে দুজনকেই।
‘পালাও!’ বিলের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
মাথা দিয়ে বাড়ি মেরে দরজার পাল্লা লাগিয়ে দিয়েছে অ্যালিগেইটর। ওখান দিয়ে বেরোনোর উপায় নেই। জানালার দিকে ছুটল বিল। মাথা নিচু করে ডাইভ দিল। পর্দা ছিঁড়ে ডিগবাজি খেয়ে গিয়ে পড়ল বাইরের অন্ধকারে।
মারাত্মক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে অ্যালিগেইটর। দুজন লোক পিঠে চেপে বসে চোয়াল চেপে ধরেও কিছুই করতে পারছে না।
‘আর পারব না!’ হাঁপিয়ে গেছে কিশোর। চেপে ধরে রাখতে রাখতে অবশ হয়ে আসছে হাত।
‘আমিও না!’
লেজ আছড়াচ্ছে অ্যালিগেইটর। যা নাগালে পাচ্ছে তাতেই বাড়ি মারছে। একটা চেয়ার বাঁধল লেজের ডগায়। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
‘আমি এক দুই তিন গোনার সাথে সাথে গিয়ে জানালায় ঝাঁপ দেবেন! ঠিক আছে?’ চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
‘আমি না, তুমি!’ গুণতে আরম্ভ করল রাস্টি, ‘এক…দুই…তিন!’
‘দুজনে একসঙ্গে!’ কিশোর বলল।
আচমকা অ্যালিগেইটরের চোয়াল থেকে হাত সরিয়ে আনল দুজনে। জানালার দিকে দৌড় দিল। চোখের পলকে দেহটাকে বাঁকিয়ে কামড় মারল দানবটা। ভয়ানক শব্দে বন্ধ হলো চোয়াল। এক ইঞ্চির জন্য ফসকে গেল কিশোরের ডান গোড়ালি।
মাথা নিচু করে ডাইভ দিয়ে জানালার বাইরে চলে এল রাস্টি। ডিগবাজি খেল শূন্যে। বেমক্কাভাবে কাঁধটা পড়ল মাটিতে। গড়ান দিয়ে সোজা হলো।
কিশোর দুই হাতে জানালার কিনার ধরে ঝুলছে। একটা সেকেন্ড ঝুলে থেকে ছেড়ে দিল হাত। পড়ল খাড়া হয়ে, পায়ের ওপর। নিরাপদে।
মাটিতে বসে হাঁপাচ্ছে বিল। কিশোরকে দেখে বলল, ‘আমি ভাল আছি!’
‘রাস্টি, আপনার খবর কী?’ জানতে চাইল কিশোর।
‘পঞ্চাশটা খেপা ষাঁড়ের পিঠে চড়েছি আমি, একশোটা বুনো ঘোড়া, কিছুই হয়নি,’ রাস্টি জানাল। ‘কিন্তু একটামাত্র কানা অ্যালিগেইটরের পিঠে চড়েই হাতটা ভাঙলাম।’
হ্যারিস এসে হাজির হলো। বিড়বিড় করে গাল দিচ্ছে কাউকে। ‘পন্টুন বোটটা নড়ছে না। ইঞ্জিনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আটকা পড়লাম। দ্বীপ থেকে আর বেরোতে পারব না।’
কী ঘটেছে, সংক্ষেপে হ্যারিসকে জানাল কিশোর। তিনজনে মিলে রাস্টিকে দাঁড় করাল। ধরে ধরে মেইন কেবিনের দিকে নিয়ে চলল।
‘শর্ট-সার্কিট করে জেনারেটরটাও অচল করে দিয়েছে!’ রাস্টি জানাল। ‘মেরামত করতে বসেছিলাম আমি আর হ্যারিস, এ সময় তোমাদের চিৎকার শুনলাম।’
‘জেনারেটরটা নষ্ট হওয়ার আগে রেডিওতে কথা বলছিলাম রবিনের সাথে,’ হ্যারিস বলল। ‘কথা বলতে বলতেই পাওয়ার চলে গেল, রেডিও অফ। রবিন আর মুসা ফক্স ডেনভারের ফিশিং বোটে আটকা পড়েছে। জাহাজটা কোথায় আছে, রবিনের কাছ থেকে জানার সুযোগ পাইনি, তার আগেই বিদ্যুৎ চলে যাওয়াতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।’
‘জাহাজের অবস্থান জানতে হবে না,’ কিশোর বলল। ‘মরিস মরিসনকে অনুসরণ করলেই আমাদেরকে জাহাজের কাছে নিয়ে যাবে।’
‘কীভাবে অনুসরণ করবে?’ বিল জানতে চাইল। ‘তুমিই তো তখন বললে, ওকে ধরার একমাত্র উপায় এখন আরেকটা এয়ারবোট জোগাড় করা। ইতিমধ্যেই দশ মিনিট সময় নষ্ট করে ফেলেছি আমরা। আমাদের চেয়ে দশ মিনিটের পথ এগিয়ে আছে ও।’
‘তা ঠিক!’ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর।
‘রাস্টিকে পাঁচ মিনিট সময় দাও,’ বিল বলল। ‘জেনারেটরটা ঠিক করে ফেলুক। রেডিওতে কোস্ট গার্ডকে খবর দেয়া যাবে।’
এ ছাড়া আর কোন উপায়ও দেখল না কিশোর। চুপ হয়ে গেল। হই-হট্টগোলে অন্য অতিথিদেরও ঘুম ভেঙে গেছে। কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছে তারা। হাতে লণ্ঠন। গায়ে রেইন কোট।
রাস্টির ভাঙা হাতটা পরীক্ষা করল টনি ওয়াকার। ‘হাড্ডিটা ঠিকমত বসিয়ে দিতে পারব আমি। পেইন কিলার আছে?’
‘আছে,’ হ্যারিস জানাল।
হাসপাতালে নিতে সময় লাগবে। তাই টনির কথায় রাজি হয়ে গেল রাস্টি।
প্রবল গতিতে ঝাপটা মারছে বাতাস। সেইসাথে ভারি বৃষ্টি। যেন মার্বেলের মত আঘাত হানছে চোখেমুখে। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় সেসব উপেক্ষা করছে কিশোর। ওর বন্ধুরা মারাত্মক বিপদের মধ্যে আছে। ওদের সাহায্য করা দরকার। কিন্তু কীভাবে?
‘তোমার জন্যে আমার খারাপ লাগছে, কিশোর,’ বাইরে এসে বলল বিল।
‘থ্যাংকস।’
ঠিক এই সময় বাতাসের শব্দকে ছাপিয়ে আরেকটা শব্দ ক্ষণিকের জন্য কানে এল কিশোরের। ইঞ্জিনের। ভুল শুনেছে ভেবে গুরুত্ব দিল না। কিন্তু আবার শোনা গেল শব্দটা। বাড়তেই থাকল। না, ভুল শোনেনি ও। বুকের মধ্যে লাফ দিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ডটা। চিৎকার করে উঠল, ‘হাইড্রোপ্লেন!’
পনেরো
ওপর দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। প্লেনের ছোট্ট রানিং লাইটটা চোখে পড়ছে। ঝোড়ো বাতাসকে উপেক্ষা করে কালাহান’স-কী’তে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ঢেউয়ে উত্তাল পানিতে নামতে গিয়ে কেঁপে উঠল হাইড্রোপ্লেন। ডকের দিকে দৌড়ে গেল কিশোর। ককপিট থেকে নেমে এলেন রাস্টির বন্ধু ব্রেক জনসন। ‘এই তুফানের মধ্যে প্লেন ওড়ানো! মনে হচ্ছিল রোডেও খেলছি।’
‘তারমানে মজাই পেয়েছেন,’ চোখ থেকে বৃষ্টির পানি মুছল কিশোর। ‘কিন্তু এ সময় এখানে কেন আপনি? ঝড়ের মধ্যে শুধু শুধু প্রাণ হাতে করে উড়াল দেননি নিশ্চয়?’
‘না। আজ বিকেলে এমন কিছু খবর পেয়েছি, না এসে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।’
‘কী খবর?’
‘বিগ সাইপ্রেসে আমার এক বন্ধু মরিসের ব্যাপারে কতগুলো তথ্য দিয়েছে। আমার ফার্ম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অবৈধভাবে অ্যালিগেইটর শিকারের অপরাধে নয় মাস জেল খেটে সবে বেরিয়েছে ও। আমার এক কর্মচারীর সঙ্গে সহযোগিতা করে আমার কানা অ্যালিগেইটরটাকে চুরি করেছে। জেলে থাকতে এমন একটা লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে ওর, যে তালা খোলার ওস্তাদ।’
‘গুজ বার্নার।’
‘হ্যাঁ। তুমি জানলে কী করে?’
‘সে-এক লম্বা কাহিনী,’ কিশোর বলল। ‘এখন ওসব বলার সময় নেই। দুজন খুনে ডাকাতের সঙ্গে একটা জাহাজে আটকা পড়েছে আমার বন্ধু রবিন আর মুসা। ওদের কথা আপনাকে বলেছিলাম।’
‘এই আবহাওয়ায় প্লেন নিয়ে ওড়ার চিন্তা কোরো না,’ সাবধান করে দিল ব্রেক। ‘আমার মাথা খারাপ, সেজন্যে বেরিয়েছিলাম। তা- ও তো তুফান একটু কম ছিল। এখন আরও বাড়ছে।’
‘বাড়ুক। আমি কেয়ার করি না।’
কিশোরের দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে জনসন জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাস্টি কোথায়? এখন ওই প্লেন নিয়ে যদি কেউ উড়তে পারে, তো ও পারবে।’
‘রাস্টির হাত…’ জবাব দিতে যাচ্ছিল বিল।
তাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বলে উঠল, ‘মেইন কেবিনে।’
বিলের কথা বুঝতে পারেননি জনসন। দৌড় দিল কেবিনের দিকে।
‘বলতে দিলে না কেন?’ বিল বলল, ‘তুমি জানো, ভাঙা হাত নিয়ে প্লেন ওড়াতে পারবে না রাস্টি।’
‘জানি। এ-ও জানি, রাস্টি আর জনসন কোনমতেই আমাকেও এখন প্লেন ওড়াতে দেবেন না।’
ককপিটে চড়ল কিশোর। ইগনিশনেই লাগানো রয়েছে চাবিটা। ‘ওটা তুমি ওড়াবে?’ বিল অবাক।
‘আর কোন উপায় নেই। মরিসের আগেই আমি জাহাজটায় পৌঁছতে না পারলে মুসা ও রবিনের বাঁচার আশা শেষ।’
‘আমিও তোমার সাথে যাব।’
‘প্লেন ওড়াতে জানো?’
‘না। তবে আমি সঙ্গে থাকলে তোমার সুবিধে হবে।’ কিশোর বাধা দেয়ার আগেই কো-পাইলটের সিটে উঠে বসল বিল
বাতাসের অনুকূলে প্লেনের নাক ঘোরাল কিশোর, বাতাসের ধাক্কাটাকে কাজে লাগানো গেলে ওপরে উঠতে সুবিধে হবে। ফুল থ্রটল দিল। গতিবেগ যতটা সম্ভব বাড়িয়ে দিল। ঝোড়ো বাতাসে জলাভূমির বদ্ধ পানিতেও উত্তাল ঢেউ। তার ওপর দিয়ে ছুটতে গিয়ে মোচার খোলার মত দুলতে লাগল প্লেন।
‘শক্ত হয়ে বসে থাকো,’ বিলকে বলল কিশোর। আস্তে করে কন্ট্রোল ধরে টান দিল। পানি থেকে উঠে পড়ল প্লেন। বাতাসের স্রোতে ভর করে দ্রুত ওপরে উঠতে থাকল।
তুমি চোখ রাখো,’ ইঞ্জিন আর বাতাসের গর্জনকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল কিশোর। ‘মরিসের বোটটা দেখা যায় নাকি দেখো।’
‘দেখেছি!’ একটু পরেই চেঁচিয়ে উঠল বিল। ডানে হাত তুলল।
মোহনার কাছে পৌছে গেছে বোট। উত্তাল সাগরের ঢেউ এসে জলার পানিতেও বড় বড় ঢেউ সৃষ্টি করছে। মরিসের হালকা এয়ারবোটকে এগোতে দিচ্ছে না। সামনে আধমাইল দূরে আলো দেখা যাচ্ছে। একটা জাহাজ। রানিং লাইট জ্বেলে দিয়েছে। মরিসের লক্ষ্য ওই জাহাজটাই, বুঝতে পারল কিশোর। চেঁচিয়ে বলল, ‘শিওর, ওটাই ডেনভারের জাহাজ!’
জাহাজটার কাছে পৌঁছতে সময় লাগল না। ভালমত দেখার জন্য প্লেন নিচুতে নামিয়ে আনল কিশোর। জাহাজের ডেকে কয়েকজন মানুষ। দুজন লোক বন্দুক দেখিয়ে চারজন মানুষকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে জাহাজের পিছন দিকে। মুহূর্ত পরেই ওই চারজন মানুষকে উত্তাল সাগরে ফেলে দিল বন্দুকধারীরা।
‘মুসাদেরকেই ফেলেছে!’ কিশোর বলল। ‘ওদের তুলতে হবে!’
‘ঠিক আছে। আমি রেডি,’ জবাব দিল বিল।
প্লেনের পিছন দিক থেকে এখন বাতাস বইছে। চক্কর দিয়ে ধীরে ধীরে নীচে নামতে শুরু করল কিশোর। প্লেনের তলায় লাগানো পন্টুন দুটো আলতো করে রাখল দুটো ঢেউয়ের মাঝখানের খাঁজে। কিন্তু একটা ঢেউয়ের চূড়া ভেঙে পড়াতে সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠতে বাধ্য হলো আবার। সময়মত উঠতে না পারলে ঢেউটা প্লেনের ওপরই ভাঙত। ধাক্কায় কাত হয়ে গেলে আর সোজা হবার সাধ্য ছিল না প্লেনটার।
শক্ত হাতে কন্ট্রোল চেপে ধরে রেখেছে কিশোর। আবার প্লেন নামাল। পন্টুন ছোঁয়াল দুটো ঢেউয়ের মাঝখানে। এবার সফল হলো।
ক্রমাগত এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঢেউ। প্লেনের একপাশে আঘাত হেনে ওটাকে কাত করে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে যেন। কিন্তু পন্টুনে ভর করে ভেসে থাকায় ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্লেনটাও দুলছে; ওপরে উঠছে, নীচে নামছে।
ককপিটের হ্যাচ খুলে বাইরে বেরোল ও। একটা পন্টুনের ওপর নামল। পঞ্চাশ গজ দূরে পানিতে হাবুডুবু খেতে দেখল রবিন, মুসা, কিটি ও ডেপুটি ক্যানারকে। পানির ওপর মাথা ভাসিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে ওরা, সাঁতরে এগোনো তো দূরের কথা।
‘আমার মনে হয় হাত বেঁধে ফেলেছে,’ বিলকে বলল কিশোর। ‘আমি যাচ্ছি।’
‘আমিও যাব!’ অন্য পন্টুনটায় নেমে পড়ল বিল।
পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুজনে। বন্দিদের কাছে পৌঁছতে যেখানে পাঁচ মিনিট লাগার কথা, প্রতিকূল ঢেউয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে এগোতে সেখানে লাগল তিন গুণ বেশি সময়।
‘আমি ঠিক আছি,’ কিশোরকে বলল মুসা। ‘আগে রবিনের দড়ি খোলো।’
ওদের কাছ থেকে বিশ ফুট দূরে রয়েছে রবিন। পানির নীচে মাথা ডুবে যাচ্ছে। তুলতে পারছে না। প্রচুর পানি পেটে যাচ্ছে।
কাছে এসে রবিনকে ধরল কিশোর।
রবিন বলল, ‘হাতের দড়িটা শুধু কেটে দাও, কিশোর, তাতেই চলবে। ওদের বাঁচাও।’
ব্যাক পকেটে হাত দিল কিশোর। পেননাইফটা হাতে লাগতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রবিনের হাতের দড়ি কাটতে শুরু করল। বেশির ভাগটাই কেটে যাবার পর সামান্য একটু যা লেগে রইল, টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল রবিন।
ফিরে তাকাল কিশোর। ডেপুটি শেরিফকে প্লেনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বিল। অর্ধেক পথ চলে গেছে। সাঁতরে মুসার কাছে ফিরে এল কিশোর। দড়ি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করল, ‘কিটি কোথায়?’
চারপাশে তাকাল মুসা। কিটিকে দেখতে পেল না। অথচ খানিক আগেও ছিল। বাঁধন কেটে যেতেই প্লেনের দিকে সাঁতরাতে শুরু করল ও। পিছনে কিশোর। সাঁতরানোর সময় চারপাশে কিটিকে খুঁজছে ওদের চোখ।
কিশোরের কাঁধ চেপে ধরল মুসা। ‘পানিতে তলিয়ে গিয়ে থাকলে আর ভাসতে পারবে না! ডুব দিয়ে দেখব নাকি?’
মুসার হাত ধরে টান দিল কিশোর। ‘পাগল! এই ঢেউয়ের মধ্যে ডুব দিলে আর ভাসতে পারবে?’
মুসাও সেটা জানে। মনে একটা খুঁতখুঁতি নিয়ে প্লেনের দিকে সাঁতরে চলল ও। পৌছে গেছে বিল আর ডেপুটি ক্যানার। পন্টুনে উঠে ক্যানারের বাঁধন খুলে দিয়েছে বিল। দুজনে হাত বাড়িয়ে দিল কিশোরকে উঠতে সাহায্য করার জন্য।
প্লেনের প্যাসেঞ্জার সাইডের পন্টুন থেকে আরেকটা হাত বাড়িয়ে দেয়া হলো মুসাকে তোলার জন্য। হাঁ হয়ে গেল মুসা। ‘কিটি! তুমি কী করে এলে?’
‘সেমিনোল ম্যাজিক,’ হেসে জবাব দিল কিটি। ‘একে আমরা বলি ডলফিন-সাঁতার। অনেকটা বাটারফ্লাই সাঁতারের মত, হাত বাঁধা অবস্থায় সাঁতরানো। ‘
হেসে উঠল মুসা। ওপরে উঠে কিটির কাঁধ চাপড়ে দিল। হঠাৎ বন্দুকের গুলির শব্দ হলো। ওদের কয়েক ফুট পিছনে পানি ছিটাল গুলি।
পঞ্চাশ গজ দূরে এয়ারবোটের গলুইয়ে বসে থাকতে দেখা গেল তাকে। হাতে একটা দোনলা বন্দুক। দ্বিতীয় নল থেকে আবার গুাণ করল ও। বাঁয়ের পন্টুনে এসে লাগল গুলি।
‘ভিতরে ঢোকো!’ চিৎকার করে বলল কিশোর।
হাইড্রোপ্লেনের ছোট্ট ককপিটে গাদাগাদি করে বসল সবাই। সবার শেষে প্লেনে উঠল মুসা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘এত বোঝা নিয়ে এখন এটা উড়তে পারলে হয়!
‘আরও বিপদ আসছে!’ হাত তুলে দেখাল ক্যানার। উইন্ডশীল্ডের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে আছে। ডেনভারের জাহাজ ‘শার্ক’ ছুটে আসছে ওদের দিকে।
‘কী করছে?’ ভয় পেয়ে গেল মুসা।
চোখ বড় বড় হয়ে গেছে রবিনের। ‘প্লেনের গায়ে গুঁতো মারবে!’
এক মুহূর্ত দেরি না করে ইঞ্জিন স্টার্ট দিল কিশোর। থ্রটল খুলে গতি বাড়ানো শুরু করল।
ডানে ঘুরে গিয়ে ওদের পথ আটকানোর চেষ্টা করল শার্ক।
‘কোনভাবেই সময়মত ওড়া সম্ভব না,’ ক্যানার বললেন।
ভারি দম নিল কিশোর। জবাব দিল না। নিজের কাজ করে গেল।
মরিসকে শটগানে আবার গুলি ভরতে দেখল রবিন। নাক বরাবর সামনে চলে গেছে এখন শার্ক। চেঁচিয়ে বলল, ‘কিশোর, জলদি করো!’
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আলতো করে টান দিল কন্ট্রোলে। নাক উঁচু করল প্লেন। শটগানের গুলি ওদের ঠিক নীচ দিয়ে চলে গেল।
জাহাজের দিকে উড়ে যাচ্ছে প্লেন। উঁচু! আরেকটু উঁচু! জাহাজের গায়ে গুঁতো লাগে লাগে অবস্থা। ককপিটে বসা সবাই চেঁচিয়ে উঠল। জাহাজের ডেকের মাত্র কয়েক ফুট ওপর দিয়ে উড়ে গেল প্লেন। শেষ মুহূর্তে জাহাজের ডেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল গুজ বার্নার। নইলে প্লেনের পন্টুনের বাড়ি খেত মাথায়।
‘ইয়াহু!’ রোডেও-চিৎকার দিয়ে উঠল কিটি। ‘মনে হচ্ছে হারিক্যানের পিঠে চড়েছি!’
নীচে তাকিয়ে আছে রবিন। এয়ারবোট থেকে মরিসের বাড়িয়ে দেয়া একটা বস্তা জাহাজে টেনে তুলতে দেখল বার্নার আর ডেনভারকে। ‘মোহরের বস্তা! ওদের এই পালানো দেখতে ভাল লাগছে না আমার!’
‘পালাতে পারবে না,’ কিটি বলল।
ভুরু নাচাল মুসা। ‘ভবিষ্যৎ দেখারও ক্ষমতা আছে নাকি আপনার?’
‘না। ওই দেখো, কোস্ট গার্ডের বোট।’
কোস্ট গার্ডের কাটার জাহাজটাকে কিশোরও দেখল। শক্তিশালী ইঞ্জিনওয়ালা ওই জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সাধ্য নেই ফিশিং বোটের। আনন্দে হই-চই শুরু হলো হাইড্রোপ্লেনের ছোট্ট ককপিটে। এত বোঝা না থাকলে ফিশিং বোটটাকে পাকড়াও করার দৃশ্যটা না দেখে যেত না কিশোর।
ফিশিং ক্যাম্পের আলো দেখা গেল। শক্ত হয়ে বোসো সবাই। আমি এখন ল্যান্ড করব!’
একটু পর পানিতে আঘাত হানল প্লেনের একপাশের একটা পন্টুন। সাগরের ঢেউয়ের খাঁজে নামার চেয়ে জলাভূমির অপেক্ষাকৃত স্থির পানিতে নামাটা কঠিন হলো। প্রচণ্ড ঝাঁকি লাগল। দ্বিতীয় পন্টুনটাও পানি ছুঁলো। আবার প্রচণ্ড ধাক্কা। ডকের দিকে ছুটে যাচ্ছে তীব্র গতিতে। আর রক্ষা নেই। চোখ বুজে ফেলল সবাই। কিন্তু ভাসমান ডকের ওপর উঠে পড়ল পন্টুন দুটো। পিছলে ছুটল।
মনে হলো যেন অনন্তকাল পর অবশেষে থামল প্লেনটা। এক এক করে চোখ মেলল সবাই। ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ। আবার শুরু হলো গুঞ্জন। বেঁচে গেছে এবারকার মত।
কোথায় আছে বুঝতে পেরে হেসে উঠল রবিন। হাসিটা সংক্রমিত হলো মুসার মাঝেও। প্লেনের দুদিকে দুটো খুঁটি। ওদের কেবিনটার ঠিকনীচে এসে থেমেছে প্লেন।
‘একেবারে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।’ প্লেনের গা চাপড়ে দিয়ে বলল রবিন, ‘সাবাস বেটা!’
‘কিন্তু কেবিনের ভিতর কে আটকা পড়ে আছে শুনলে আনন্দের সীমা থাকবে না তোমাদের,’ হেসে জবাব দিল কিশোর। বিলও ওর হাসিতে যোগ দিল। রবিন, মুসা, কিটি আর ক্যানার এ-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কিছু না বুঝে বোকার হাসি হাসল।
.
রাতে ঝড়ের মধ্যেই অ্যালিগেইটরটাকে বাইরে বের করার ব্যবস্থা করল কিটি আর ব্রেক। ওটাকে কেবিনে আনা হয়েছিল কীভাবে, রহস্যটা ভেদ হলো। ডিমগুলো নিয়ে এসে রেখে দিয়েছিল মরিস। ডিমের আকর্ষণেই উঁচু সিঁড়ি বেয়ে উঠে কেবিনে ঢুকে পড়েছিল অ্যালিগেইটরটা। বোঝা গেল, ওই ডিম দেখিয়েই বিগ সাইপ্রেস থেকে জলাভূমি দিয়ে ওটাকে সোয়াম্প ল্যান্ডে টেনে এনেছিল মরিস। এখন ওই ডিমের সাহায্যেই আবার ওটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে বিগ সাইপ্রেসে, অ্যালিগেইটরের খামারে, ওর পুরানো বাড়িতে।
পরদিন সকালে ঝড় থামল। দুপুর একটা নাগাদ মেঘ কেটে গিয়ে রোদ হেসে উঠল। আকাশ ঘন নীল। দেখে মনেই হয় না এতবড় একটা ঝড় বয়ে গেছে।
রোডেও গ্রাউন্ডের গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে বসে খেলা দেখছে কিশোর ও রবিন। একের পর এক কাউবয় এসে রিঙে ঢুকছে, প্রতিযোগিতা করছে। মারাত্মক বিপজ্জনক এক খেলা। সেদিকে তাকিয়ে রবিন বলল, ‘নিজে বিপদে পড়ার চেয়ে অন্যের বিপদ দেখে মজা পাওয়া সহজ!’
হাসল কিশোর। ‘ডাকাতের সাথে টক্কর লাগার কথা বলছ তো?’
‘হ্যাঁ,’ মাথা ঝাঁকাল রবিন। ‘এই জলার অঞ্চল আর আমার ভাল লাগছে না। রকি বিচে ফিরে যেতে পারলে বাঁচি। আগামী একশো বছর শাওয়ার ছাড়া অন্য কোন ধরনের পানিতে ভিজতে রাজি নই আমি।’
বুল-রাইডিঙের খেলায় ব্ল্যাক ডেভিলের পিঠে চড়ে কিটিকে ঢুকতে দেখা গেল। সফল খেলা দেখিয়ে চলে গেল।
তারপর যাকে ঢুকতে দেখল, চোখ কপালে উঠে গেল কিশোর- রবিনের। রাস্টি কালাহান। সাথে ওর সহকারী হ্যারিস। রাস্টির এক হাত স্লিঙে ঝোলানো। ভাঙা হাত নিয়েই খেলতে চলে এসেছে। ল্যাসো হাতে স্টিয়ার রোপিং খেলা শুরু করল।
হ্যারিসের এক হাতে ল্যাসো, আরেক হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরা। রাস্টির ভাল হাতটায় ল্যাসো, ভাঙা হাত দিয়ে লাগাম ধরতে পারছে না, কোন কিছু না ধরেই বসে আছে ঘোড়ার পিঠে। বিস্ময়কর দক্ষতায় এক হাতেই ল্যাসো ছুঁড়ে গরুর শিঙে আটকে ফেলল। হ্যারিস গরুর পিছনের পায়ে ল্যাসো আটকে দিল। হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল গরু।
রুদ্ধশ্বাসে এই খেলা দেখছিল দর্শকরা। তুমুল করতালিতে ফেটে পড়ল। হাততালি দিতে দিতে কিশোর বলল, ‘আরিব্বাপরে, কী খেলা! গিনেস রেকর্ড বুকে নাম উঠে যাওয়া উচিত। ভাঙা হাত নিয়ে স্টিয়ার রোপিং!’
এক হাতেই ল্যাসো খুলে নিল রাস্টি। গরুটাকে মাটি থেকে উঠতে সাহায্য করল রোডেও ভাঁড়, এবার আর নকল নয়, আসল ডিক টোম্যান। দর্শকদের দিকে হ্যাট নেড়ে ধন্যবাদ জানাল রাস্টি।
মাইকে শোনা গেল মিস্টার গিবসনের ঘোষণা, ‘এবার খেলা দেখাতে আসছে বিল ওয়াটমোর আর মুসা আমান।’
রবিনের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে কিশোর বলল, ‘আমাদের মুসা রোডেও খেলছে, ভাবতে পারো?’
‘নাহ্, সত্যিই পারি না,’ রবিন বলল। ‘কিন্তু আমার অবাক লাগছে, যে বাবার ভয়ে এত কাণ্ড করল বিল, তিনি তাকে খেলতে দিতে রাজি হলেন কী করে?’
‘এতবড় একটা ডাকাতির কেসের সমাধান করতে পুলিশকে সহযোগিতা করেছে বলে এতই খুশি হয়েছেন মিস্টার ওয়াটমোর, ছেলের এই আবদার তিনি পূরণ করেছেন।’
‘তুমি জানলে কীভাবে?’
‘বিল আমাকে বলেছে।’
শূটের দরজা খুলে দিল টোম্যান। ঘোড়ায় চড়ে রিঙে ঢুকল মুসা। প্রথমেই ল্যাসো না ছুঁড়ে সোজা গিয়ে টারজানের মত গরুর দুই শিং চেপে ধরল। ষাঁড়টাও নাছোড়বান্দা। এত সহজে পরাজিত হতে রাজি নয়। হ্যাঁচকা টানে ঘোড়ার পিঠ থেকে তুলে নিয়ে এল মুসাকে। মুসাও ছাড়ল না। দুই শিং ধরে ঝুলে রইল।
মুসার ওজনের কারণেই বোধহয় শেষ পর্যন্ত মাথা নোয়াতে বাধ্য হলো ষাঁড়। তা ছাড়া এত নাছোড়বান্দা বেয়াড়া খেলোয়াড়ও বোধহয় এই প্রথম পেয়েছে। ষাঁড়ের দ্বিধাকে কাজে লাগিয়ে ওটাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলল মুসা।
আবার করতালিতে ফেটে পড়ল উত্তেজিত দর্শক। এ সময় রিঙে ঢুকল বিল। কয়েকটা গরু ছেড়ে দেয়া হলো রিঙে। ঘোড়ার পিঠে চড়ে রিঙের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ছুটে বেড়াতে লাগল মুসা। বিল ওর সহকারী। একের পর এক গরুকে ল্যাসোয় আটকে ধরাশায়ী করতে থাকল দুজনে।
করতালির পর করতালি!
উত্তেজনায় কখন সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে কিশোর ও রবিন, বলতে পারবে না। দর্শকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে ওরাও। চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে। হাততালি দিচ্ছে। মনে রাখার মত একটা দিন ওদেরকে উপহার দিচ্ছে ওদের বন্ধু মুসা আমান।
***