জর্জ অরওয়েল – কিছু কথা

জর্জ অরওয়েল – কিছু কথা

মাত্র ৪৬টি বসন্ত এই ধরাধামের রূপ-রস-গন্ধ উপভোগ করতে পেরেছিলেন জর্জ অরওয়েল। তবে তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা পড়েছিল এমন কিছু যা আজ শতবছর পেরিয়েও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বিশ্বের সাহিত্যপ্রেমিদের মাঝে, রাজনৈতিক চিন্তকদের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন শত-সহস্র বছর।

মূল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার (১৯০৩-১৯৫০)। জর্জ অরওয়েল ছিল তার কলমনাম। পুরো পেশাদারি জীবনে একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ব্রিটিশ সংবাদপত্র জগতেই কেবল নয়, হোমেজ টু ক্যাতেলোনিয়ার মতো বইয়েও তাকে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সেরা প্রতিবেদক হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে। জন্ম ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে। বাবা ওয়ালমেসলি ব্লেয়ার ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে। মা আইডা ম্যাবেল ব্লেয়ার (নি লিমোজিন) তার ফরাসি বাবার কর্মযোগে ছিলেন বার্মার বাসিন্দা। তবে এরিকের জন্মের এক বছর পরেই ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডশায়ারে আবাস গাড়েন আইডা ব্লেয়ার। মায়ের দিনপঞ্জী থেকে জানা যায়, ছেলেবেলা আঁকার শখ ছিল এরিকের। মা’র ভীষণ ইচ্ছা ছিল এরিক পাবলিক স্কুলে যাবে। কিন্তু অর্থে কুলাতে পারছিলেন না, বৃত্তি পেলে একমাত্র সে ইচ্ছাপূরণ সম্ভব। সেন্ট সাইপ্রিয়ান’স এর হেডমাস্টারের কৃপায় অবশেষে মিলল সে সুযোগ। কিন্তু স্কুলে তার পারিবারিক দৈন্যের কথা স্পষ্ট হতে সময় লাগাল না। আর তাতে স্কুলের প্রতি ঘৃণাই জন্মাল এরিকের। অনেক পরে এক নিবন্ধে সেই ঘৃণার কথা জানিয়েছিলেন জর্জ অরওয়েল। তবে স্কুলে বসেই গোটা দুই কবিতা লিখে সাড়া ফেলে দেন এরিক।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় পরিবারটি সরে যায় শিপলেকে। সেখানে এরিকের ঘনিষ্ঠতা হয় বাডিকম পরিবারের সঙ্গে। বিশেষ করে পরিবারের কন্যা জাসিনথার সঙ্গে বেশ ওঠাবসা। জর্জ অরওয়েল তাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটির কথা বলেছেন এভাবে, যখন প্রথম দেখা হলো তখন তিনি পাদুটো উপরে তুলে মাথার ওপর দাঁড়িয়েছিলেন। তার মতে, সোজা দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে মাথা উল্টে থাকলে আপনাকে যে কেউ ভালোভাবে দেখতে পাবে। জাসিনথা আর এরিক মিলে অনেক কাব্য করতেন আর খ্যাতিমান লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সে সময়ই একদিন জাসিনথাকেই তিনি বলেছিলেন, একদিন এইচ জি ওয়েলসের ‘অ্যা মর্ডান ইউটোপিয়া’র মতো একটি উপন্যাস লেখার খুব ইচ্ছা তার। সে সময় বন্দুকবাজি, বড়শি ফেলে মাছ ধরা আর জাসিনথার ভাইবোনদের নিয়ে পাখি দেখে দিন কেটে যেত।

আগেই বলেছি, এরিকের ফরাসি নানাভাই কর্মযোগে বাস করতেন বার্মায়। এরিকও বার্মা পুলিশে চাকরি নিয়ে গেলেন সেখানে। সুয়েজখাল আর সিংহল পাড়ি দিয়ে ভারতীয় রাজকীয় পুলিশ বাহিনীতে এসে যোগ দিলেন। পুলিশে তার পদোন্নতি হতে থাকল কিন্তু ১৯২৭ সালে পড়ে গেলেন ডেঙ্গু জ্বরে। এক জ্বরেই কাবু। ফিরে গেলেন ইংল্যান্ডে। শুধু তাই নয়, চাকরি থেকেও ইস্তফা দিলেন। জীবনের মোড় ঘুরে গেল। শুরু করলেন লেখালেখি। বার্মায় তার অভিজ্ঞতাও উঠে এলো সেই লেখায়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হলো ‘বার্মিজ ডেজ’। আর ‘শুটিং অ্যান এলিফ্যান্ট’ প্রকাশিত হলো ১৯৩৬ এ। তবে লেখালেখি শুরু হয় আরও আগে প্যারিসে বসে। কারণ ১৯২৮ সালেই এরিক চলে যান প্যারিসে। সেখানে খালামনি নিলি লিমোজিনের আদর ভালোবাসায় থাকা-খাওয়ার চিন্তা ছিল না। এখানেই শুরু হয় তার গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি। ডেঙ্গুজ্বর ভালো হলেও জের বুঝি থেকেই যায় ১৯২৯ সালে আবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেবার হাসপাতালের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলেন সাড়া জাগানো নিবন্ধ ‘হাউ দ্য পুওর ডাই’। সেবছরের ডিসেম্বরে ফের লন্ডনে ফিরলেন। এরপরের পাঁচবছর টানা লন্ডনেই। এখানে ব্রেন্ডা সাকেল্ড নামে এক নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়, তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন কিন্তু বন্ধুতা টিকে থাকে এরপরেও অনেক বছর। এইসময় পেটের ভাত যোগাতে একটি বাড়িতে দিনে এক ক্রাউনের বিনিময়ে গৃহস্থালীর কাজও করেছিলেন কিছুদিন। এরপর নিয়মিত লিখতে শুরু করেন ‘অ্যাডেলফি’ পত্রিকায়। সেখানেই ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ‘অ্যা হ্যাংগিং’। কিন্তু দারিদ্র্য ঘোচে না। নিউ স্টেটসম্যানে এরিক ব্লেয়ারের ‘হপ পিকিং’ছাপা হয় ১৯৩১ সালেই। এসময়ই পরিচয় হয় লিওনার্ড মুরের সঙ্গে। পরে যিনি তার লিটারারি এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু জর্জ অরওয়েলের দুঃখের দিন সেসময়ই শেষ হয়ে যায়নি। সেসময় তার ‘অ্যা স্কালিয়ন’স ডায়রি’ ছাপতে রাজি হয়নি জনাথন কেন। পরে সেটি নিয়ে যান ‘ফ্যাবের অ্যান্ড ফ্যাবের’ এর কাছে। এর সম্পাদকীয় পরিচালক ছিলেন টি এস এলিয়ট। তিনিও রাজি হলেন না ছাপতে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বছরটি পার হয়ে গেল। হতাশাগ্রস্ত এরিক ব্লেয়ার মনস্থ করলেন এমন কিছু করবেন যাতে পুলিশ তাকে জেলে পুরে দেয় আর ক্রিসমাসটি জেলখানাতেই কাটাতে পারেন। কিন্তু বিধিবাম! মদ খেয়ে মাতালামো করেও পুলিশের কৃপা বেশিদিনের জন্য পেলেন না। মোটেই দুটো দিন জেলখানায় থেকে তাকে ফিরতে হলো নিজের ঘরে।

১৯৩২ এসে গেল, আর উপায়ান্তর না দেখে হথ্রনস হাইস্কুলে মাস্টারির চাকরি নিয়ে নিলেন এরিক ব্লেয়ার। ছেলেদের স্কুল। এখানেই একদিন লিওনার্ড মুর খবর দিলেন ভিক্টর গোলাঙ্কস তার ‘অ্যা স্কালিয়ন’স ডায়রি’ ছাপতে রাজি হয়েছে। ৪০ পাউন্ড অগ্রীম দেবে। রাজি হলেন এরিক আর স্কুলের চাকরিটা থেকে ইস্তফা দিলেন সেবারের গ্রীষ্মে।

সেবছর অ্যাডেলফিতে প্রকাশিত হলো ‘ক্লিঙ্ক’ নামের নিবন্ধ যাতে ফুটে উঠলো জেলে যাওয়ার সেই প্রচেষ্টা আর ব্যর্থতার কথা। আবারও শিক্ষকতা পেশায় ফিরলেন হায়েস স্কুল দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা চালিয়ে গেলেন, তখনই লিখে ফেললেন পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়া বই ‘ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন’। ভাবনা এল পরিবারের ওপর চাপ কিংবা সদস্যদের অস্বস্তি এড়াতে ভিন্ন কোনো নামে বইটি প্রকাশ করবেন। লিওনার্ড মুরকে তখন পি এস বার্টন, কেনেথ মাইলস, জর্জ অরওয়েল ও এইচ লুইস অলওয়েস এই চারটি নাম লিখে পাঠালেন এরিক। আর মুর সেখান থেকে জর্জ অরওয়েল নামটা বেছে নিলেন, এই যুক্তিতে এটি ছিল খাঁটি ইংরেজ একটি নাম। ১৯৩৩ এর ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত হলো ‘ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন’। তখনও চলছিল অরওয়েলের ‘বার্মিজ ডেজ’ লেখার কাজ। ‘ডাউন অ্যান্ড আউট’ সাফল্য পেল। কয়েকদিনেই সেটি আবারও ছাপল নিউইয়র্কের হার্পার অ্যান্ড ব্রাদার্স।

১৯৩৩ এর মাঝামাঝিতে পশ্চিম লন্ডনের আক্সব্রিজের ফ্রেইজ কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন এরিক ব্লেয়ার। ছয় মাস কাটিয়ে সেখানকার চাকরিটি হারালেন আর এরপর কোনোদিনই শিক্ষকতার পথে হাঁটেননি।

হতাশা আবারও পেয়ে বসলো যখন গোলাঙ্কস তার ‘বার্মিজ ডেজ’ ছাপতে রাজি হলো না। হার্পার রাজি হলো বটে তবে তা তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ততদিনে এরিক ব্লেয়ার তার ‘অ্যা ক্লার্জিম্যান’স ডটার’ নামের উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেছেন। অক্টোবর নাগাদ বইটি লেখা শেষ করে লিওনার্ড মুরের হাতে তুলে দিয়ে লন্ডন ফিরলেন। সেখানে একটি চাকরি যোগাড় করে দিলেন খালা নিলি লিমোজিন। সেই কাজেই যোগ দিলেন এরিক ব্লেয়ার।

‘বুকলাভার্স কর্নার’ নামে একটি পুরনো বইয়ের দোকানে ওটি ছিল খণ্ডকালীন কাজ। খালার বন্ধু ছিলেন দোকান মালিক। চাকরির সঙ্গে তাকে একটি থাকার জায়গাও দিয়েছিলেন তিনি। প্রতিদিন বিকেলের দিকটাতে কাজ। তাই সকালের দিকটায় লেখালেখির সুযোগ ছিল। আর রাতটাতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতেও পারতেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই ১৯৩৬ সালে তিনি লিখলেন ‘কিপ দ্য অ্যাসপিডিস্ট্রা ফ্লাইং’। অ্যাডেলফির জন্যও লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাশাপাশি। ১৯৩৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হলো ‘অ্যা ক্লার্জিম্যান’স ডটার’। ততদিনে চাকরি ও বাসস্থান দুটোই ছেড়েছেন এরিক। সেবছরই তার দেখা হয় হবু স্ত্রী এলিন ও’শনেসির সঙ্গে। যে বাড়িতে থাকতেন তার মালকিনের সহপাঠী তারা দুজনই ছিলেন লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী। বাড়িতে ডাকা একটি পার্টিতে প্রথম দেখা। ওই দিনগুলোতেই ব্লেয়ার নিউ ইংলিশ উইকলির জন্য নিয়মিত লেখালেখি করতেন। সেবছর জুনে ‘বার্মিজ ডেজ’ প্রকাশিত হলো। আর নিউ স্টেটসম্যানে সাইরিল কোনোলি’র লেখা পর্যালোচনা ছাপা হলে জর্জ অরওয়েল নামটি ব্যাপক ব্যাপ্তি পেল। এই সময় তার পরিচয় হয় মাইকেল সায়ারস ও রেনার হেপেনস্টলের সঙ্গে। যারা দুজনই পরে বিবিসি ব্রডকাস্টস-এ অরওয়েলের সহকর্মী ছিলেন।

সেবার ভিক্টর গোলাঙ্কস অরওয়েলকে উত্তর ইংল্যান্ডে কিছুদিন কাটিয়ে ওখানকার অর্থনৈতিক দুর্দশার চিত্র অনুধাবনের পরামর্শ দিলেন। ১৯৩৬ এর ৩১ জানুয়ারি অরওয়েল একটি পাবলিক বাস থেকে নেমে পড়লেন আর পায়ে হেঁটে কভেনট্রি, স্ট্যাফোর্ড, পোটারিজ ও ম্যাসেলসফিল্ড পাড়ি দিয়ে ম্যানচেস্টারে পৌঁছালেন। মার্চে লিভারপুলটাও একবার ঘুরে এলেন, ইয়র্কশায়ারে কিছুদিন থাকলেন শেফিল্ড আর বার্নসলেতে সময় পার করে। কেবল তাই নয় ঘুরে ঘুরে বেড়ালেন খনিগুলোতেও সেখানকার কাজ ও সামাজিক অবস্থাও দেখে নিলেন নিজের চোখে। কমিউনিস্ট পার্টির সভাগুলোতেও যোগ দিতেন আর মন দিয়ে শুনতেন নেতাদের বক্তৃতা।

এই ঘোরাঘুরির ফসল হিসেবে ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হলো ‘দ্য রোড টু উইগান পিয়ার’। গোলাঙ্কস থেকেই প্রকাশিত হলো। ততদিনে অরওয়েল স্পেনে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে ওই বইটি লেখার পর থেকেই পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ফেউরা তার পিছনে লেগেই ছিল। টানা বারোটি বছর তিনি ছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারিতে।

এর আগে ১৯৩৬ এর ৯ জুন এলিন ও’শনেসির সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই স্পেনে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর তা কাছে থেকে দেখতেই তিনি পাড়ি জমান স্পেনে। জার্মানির নাৎসি আর ইতালির ফ্যাসিবাদীদের সহায়তা স্পেনে ফ্রান্সিকো ফ্র্যাঙ্কোর সামরিক উত্থান তখন তুঙ্গে। আর অরওয়েল সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজেও নামবেন দেশটির প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষে গৃহযুদ্ধে। ১৯৩৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর স্পেনের উদ্দেশ্যে লন্ডন ছাড়েন তিনি। ক্যাডেট কোর আর এক সময়ের পুলিশি অভিজ্ঞতা থেকে অরওয়েল এই যুদ্ধে তার কৃতিত্ব দেখান। ওদিকে স্ত্রী এলিন ‘দ্য রোড টু উইগ্যান পিয়ার’ প্রকাশের কাজ গুছিয়ে দিয়ে নিজেও স্পেন চলে যান। স্বামীর জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কিছু সামগ্রী পাঠানোর ব্যবস্থাও করেন তিনি। অরওয়েল বিষাক্ত গ্যাসে আক্রান্ত একটি হাত নিয়ে কিছুদিন হাসপাতালেও কাটান। তবে শেষ পর্যন্ত স্পেনে বিপাকেই পড়তে হয় তাদের। আর শেষে ট্রেনে চেপে স্পেন থেকে পালিয়ে আসেন দুজন। স্পেনের গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে পরে ১৯৩৮ সালে অরওয়েল লেখেন ‘হোমেজ টু ক্যাতালোনিয়া’।

সে পরের কথা। ১৯৩৭ এর জুনে ইংল্যান্ড ফিরে কিছুদিন ও শনেসির বাড়িতেই ঘরজামাই হয়ে থাকলেন। কিন্তু গৃহযুদ্ধ নিয়ে লেখালেখি নিয়ে পড়লেন বিপাকে। কেউই ছাপাতে চায় না। কিংসলি মার্টিন দুটো লেখা ফিরিয়ে দিল, গোলাঙ্কস থেকেও সাড়া মিলল না। ওদিকে কম্যুনিস্টদের পত্রিকা ডেইলি ওয়ার্কার তার ‘দ্য রোড টু উইগ্যান পিয়ার’নিয়ে মিথ্যা প্রচারণাও শুরু করে দিল। সেবার মানহানির অভিযোগ আনবেন বলেও হুঁসিয়ার করেছিলেন ডেইলি ওয়ার্কারকে। এর মধ্যে ফ্রেডরিক ওয়ারবার্গের কাছ থেকে সাড়া পান। তাদের সেকার অ্যান্ড ওয়ারবার্গ নামের প্রকাশনা থেকে প্রকাশের নিশ্চয়তায় একটি পশুর খামারে আস্তানা গেড়ে লেখা শুরু করেন ‘হোমেজ টু ক্যাতালোনিয়া’। তখনই মাথায় আসে ভারতবর্ষে যাবেন ‘পায়ওনিয়ার নিয়ে কাজ করতে। ওটি ছিল লক্ষ্ণৌ থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্র। কিন্তু ততদিনে তার শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে পড়ে আর হাসপাতালই হয় গন্তব্য। ধরা পড়ে, যক্ষ্মায় ভুগছেন অরওয়েল। এরই মধ্যে ‘হোমেজ টু ক্যাতালোনিয়া’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু ব্যবসাসফল হলো না। এসময় ঔপন্যাসিক এলএইচ মায়ার্সের গোপন অর্থায়নে শরীর ঠিক করে তুলতে অরওয়েলকে পাঠানো হয় মরোক্কোর ফ্রান্স অংশে। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে স্প্যানিশ মরোক্কো এড়াতে জিব্রালটা প্রণালী হয়ে তাকে মারাকেচ পৌঁছাতে হয়। সেখানে একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকেন। আর সেখানেই তিনি লেখেন ‘কামিং আপ ফর এয়ার’। ১৯৩৯ এর মার্চে তারা ইংল্যান্ড ফেরেন আর জুনে প্রকাশিত হয় ‘কামিং আর ফর এয়ার’

এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। অরওয়েলের স্ত্রী এলিন কাজ নেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের সেন্সরশিপ বিভাগে। অরওয়েলকে সেন্ট্রাল রেজিস্ট্রারে নিজের নাম লেখান চাকরির খোঁজে। কিন্তু তার ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে না। ১৯৩৯ এ রচনা সমগ্র ইনসাইড দ্য হোয়েল’ এর কাজ অনেকটাই গুছিয়ে নেন। আর পরের বছরটি স্রেফ পয়সার জন্য দ্য লিসনার, টাইম অ্যান্ড টাইড, নিউ অ্যাডেলফি’কে নাটক, সিনেমা আর বইয়ের পর্যালোচনা লিখে দিতে থাকেন। ১৯৪০ সালে পুরোদস্তুর সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন ট্রিবিউন এর সঙ্গে। সেবছর গোড়ার দিকে কোনোলি’র হরাইজন পত্রিকাটি বের হয়। আর তাতে অরওয়েলের লেখালেখি ব্যাপকভাবে স্থান পেতে থাকে। একই সময় যুদ্ধ নিয়ে নিজের ডায়রি ভরে ফেলতে থাকেন অরওয়েল। যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য অরওয়েল শারীরিকভাবে সমর্থ ছিলেন না, কিন্তু তাকে হোমগার্ড হিসেবে কাজ দেওয়া হলো। ব্রিটেন যখন যুদ্ধে তখন তার সপ্তাহান্তগুলো কাটত ওয়ারবার্গের আস্তানায়। এসময় তিনি ‘ইল্যান্ড ইওর ইংল্যান্ড’ নিয়েও কাজ চালিয়ে যান। ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হলো তার ‘দ্য লায়ন অ্যান্ড দ্য ইউনিকর্ন : সোশ্যালিজম অ্যান্ড দ্য ইংলিশ জিনিয়াস’। সেসময় অরওয়েল লেখা শুরু করেন ‘পাৰ্টিজান রিভিউ’। এর মধ্য দিয়ে আমেরিকান বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার একটি যোগাযোগ স্থাপিত হয়, যারা তার মতোই স্ট্যালিনিস্ট বিরোধী, বামপন্থী। এছাড়াও তিনি গোলাঙ্কসের ‘দ্য বিট্রেয়াল অব দ্য লেফট’ নামের সংকলনেও অবদান রেখে যাচ্ছিলেন। এসময় তার দেখা হয় ঔপন্যাসিক অ্যান্থনি পাওয়েলের সঙ্গে। যার মাধ্যমে বিবিসির ইস্টার্ন সার্ভিসের কিছু রেডিও সম্প্রচারের কাজ পেয়ে যান।

১৯৪১ সালের আগস্টে বিবিসি ইস্টার্ন সার্ভিসে পূর্ণকালীন কাজ পান জর্জ অরওয়েল। একই সঙ্গে যুদ্ধের কাজও। তার ওপর দায়িত্ব পড়ে জামার্নির নাৎসি প্রোপ্যাগান্ডার বিরুদ্ধে ভারতীয় অংশে সাংস্কৃতিক নানা প্রচার কাজের। এটাই ছিল তার অফিসভিত্তিক প্রথম কাজ। এসময় তিনি বেশ কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তৈরির সুযোগ পান যাতে টিএস এলিয়ট, ডিলান থমাস, ই এম ফ্রস্টার, আহমেদ আলী মুলক, রাজ আনন্দ, উইলিয়াম এমসনের মতো অনেক খ্যাতিমানরা অংশ নেন। দেখা হয় এইচ জি ওয়েলসের সঙ্গেও। বিবিসিতে অরওয়েল ভারতে সম্প্রচারের জন্য ‘ভয়েস’ নামের একটি সাহিত্যভিত্তিক অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিলেন।

সেবছর অক্টোবরে ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হন অরওয়েল। এ সময় দ্য অবজারভার থেকে অরওয়েলের কাছে লেখা চান ডেভিন অ্যাস্টর। আর তার প্রথম আর্টিকেল প্রকাশিত হয় ১৯৪২ এর মার্চে। ১৯৪২ এর পরের দিকে ট্রিবিউনেরজন্যও লেখা শুরু করেন তিনি। ১৯৪৩ সালে অরওয়েল তার এজেন্ট লিওনার্ড মুরকে জানালেন যে, একটি নতুন উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিয়েছেন, যা পরে ‘এনিম্যাল ফার্ম’ নামে প্রকাশিত হয়। সেবছরই তিনি বিবিসি থেকে চাকরি ছাড়েন আর জানা যায়, চাকরি ছাড়ার একটাই কারণ, তার ধারণা খুব কমসংখ্যক ভারতীয়ই তার তৈরি অনুষ্ঠানগুলো শুনছে। চাকরি ছেড়ে ‘এনিম্যাল ফার্ম’ লেখায় মনোনিবেশ করলেন। সেসময় স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে হোমগার্ডের কাজ থেকেও ইস্তফা দেন জর্জ অরওয়েল।

১৯৪৩ সালে ট্রিবিউনের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন আর এই সময়ে অন্তত ৮০টি বইয়ের ওপর পর্যালোচনা লেখেন। আর চলছিল ‘অ্যাজ আই প্লিজ’ নামে নিজের একটি নিয়মিত কলাম লেখা। একই সঙ্গে পার্টিজান রিভিউ, হরাইজন ও নিউইয়র্ক নেশন-এও তার লেখালেখি চলত। এসব লেখালেখির মধ্য দিয়ে গোটা বামপন্থিদের মাঝে তিনি ‘পণ্ডিত’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

১৯৪৪ সালের এপ্রিলের মধ্যেই ‘এনিম্যাল ফার্ম’ প্রকাশের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। গোলাঙ্কস প্রকাশে অস্বীকৃতি জানায়, কারণ এতে সোভিয়েত শাসকের ওপর আক্রমণটি ছিল স্পষ্ট। ফ্যাবের অ্যান্ড ফ্যাবের-এর টিএস এলিয়টও নিলেন না একই কারণ দেখিয়ে। তবে রাজি হলো জোনাথন কেপ। কিন্তু হলে কী হবে, এক পর্যায়ে কেপও ফিরিয়ে দিল। পড়ে থাকল ‘এনিম্যাল ফার্ম’। এরপর পারিবারিক কিছু ঝামেলায় কেটে গেল সময়। অবশেষে সেকার অ্যান্ড ওয়ারবার্গ রাজি হলো ‘এনিম্যাল ফার্ম’ প্রকাশে। ১৯৪৫ এর আগস্টে প্রকাশিত হলো বইটি। তার আগে ফেব্রুয়ারিতেই দ্য অবজারভারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট হওয়ার ডাক পেলেন। এমন একটি কাজ পাওয়ার প্রত্যাশা পূরণ হলো আর যুদ্ধক্ষেত্রগুলো ঘুরে ঘুরে রিপোর্টিং শুরু করলেন। প্যারিস হলো মূল কর্মস্থল। ফেব্রুয়ারির ২৯ মার্চ স্ত্রী এলিন মারা গেলেন হিস্টিরেকটমিতে আক্রান্ত হয়ে। অর্থাভাবের কারণে এক সময়ের ধনাঢ্য বাবার সন্তান এলিন তার স্বামীর কাছে লুকিয়েছিলেন এই রোগের খবর। ১৯৪৫ এর জুলাইয়ে লন্ডন ফিরলেন যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন কাভার করার জন্য। ১৯৪৫ এর ১৭ আগস্ট লন্ডন থেকে প্রকাশের এক বছর পর ১৯৪৬ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও প্রকাশিত হলো ‘এনিম্যাল ফার্ম’

যুদ্ধোত্তর বিশ্বে সাড়া ফেলে দিল এই ‘এনিম্যাল ফার্ম’। বিশ্বজুড়ে নাম ছড়িয়ে পড়ল জর্জ অরওয়েলের। পরের চারটি বছর জর্জ অরওয়েল কাজ করলেন ট্রিবিউন, দ্য অবজারভার ও ম্যানচেস্টার ইভনিং নিউজ’র জন্য। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাহিত্য ম্যাগাজিনেও লেখালেখি করেন। এলিন মারা যাওয়ার পর ওই বছরই তার হাতে রচিত ও প্রকাশিত হয় অন্তত ১৩০টি নির্বাচিত নিবন্ধ। যার প্রতিটি নিয়ে সাড়া পড়ে যায়। আলোচনা, সমালোচনার ঝড় ওঠে।

১৯৪৬ এর সেপ্টেম্বরে একপক্ষকাল জর্জ অরওয়েলের কাটে জুরা দ্বীপে। দ্বীপটিকে তার লন্ডনের ঝঞ্ঝাটময় সাহিত্যজীবন থেকে পালিয়ে থাকার আশ্রয় বলেই মনে হলো। স্ত্রী এলিন মারা যাওয়ার পর ১৯৪৫ এর পরের দিকটা আর ১৯৪৬ এর গোড়ার ভাগে অরওয়েল বেশ কয়েকটি বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ১৯৪৬ এর ফেব্রুয়ারিতে তার যক্ষ্মারোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে কিন্তু অসুস্থতার কথা লুকিয়ে রাখেন। এই সময়েই তিনি ‘ব্রিটিশ কুকারি’ নামে একটি আর্টিকেল লিখে ব্রিটিশদের রসনা-ব্যঞ্জনের কথা তুলে ধরেন অসাধারণ দক্ষতায়। তার সে আর্টিকেল পরে ব্রিটিশ কাউন্সিল কমিশন করে নেয়। জুরা দ্বীপে একটি পরিত্যক্ত বাগানবাড়িতে থাকতে শুরু করেন অরওয়েল। সেখানেই তিনি লিখতে বসেন ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’। বছরের শেষ দিনগুলোতে ফের লন্ডনে ফেরেন আর কাজ নেন সাহিত্য সাংবাদিকতায়। ততদিনে এক সুখ্যাত লেখক বলে কাজের অভাব থাকল না। এই সময় তিনি সম্পাদনা করেন বিশ্বখ্যাত সংকলন গ্রন্থ ব্রিটিশ প্যাম্ফেলেটিয়ার্স’। ‘এনিম্যাল ফার্ম’বিক্রি থেকে আসছিল বড় অংক। অর্থ সামলাতে তিনি একটি ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওরাই তাকে পরামর্শ দেন নিজের একটা কোম্পানি খুলে ফেলতে যাতে রয়্যালটির অর্থ জমা করার কাজটি সহজ হয়, আর সার্ভিস এগ্রিমেন্ট করে নিলে নিজে মাসোহারাটাও নিয়মিত পেতে পারেন। সেইমতে, ১৯৪৭ এর সেপ্টেম্বরে রূপ পেল জর্জ অরওয়েল প্রোডাকশন্স লিমিটেড (জিওপি লি.)। এর আগে ১৯৪৭ এর ১০ এপ্রিল লন্ডন ছাড়েন অরওয়েল। ফিরে যান পছন্দের জুরা দ্বীপেই। নাইনটিন এইটি-ফোর নিয়ে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন আর ভালোই কাজ এগুতে থাকে। এর মধ্যে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞের ডাক পড়ল। তার পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারি নাগাদ তার চিকিৎসা শুরু হয়। জুলাই নাগাদ কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে ফের জুরা দ্বীপে যান। আর ডিসেম্বর নাগাদ ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’র পাণ্ডুলিপি লেখা শেষ করেন। এরপর আবারও হাসপাতালে ভর্তি করা হলো তাকে। শরীরের অবনতি হতেই থাকল। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হলো ‘নাইনটিন এইটি-ফোর’।

এর পরের সময়টা ছিল আরও কিছু ঘটনায় ভরা। মধ্য ১৯৪৯ এর সেপ্টেম্বরে সোনিয়া ব্রোনেল নামে এক নারীর সঙ্গে বাগদান হয় তার। তবে তার দিন কয়েকের মধ্যেই তাকে ভর্তি হতে হয় লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে তাকে দেখভাল করেন সোনিয়া। এই হাসপাতালের কক্ষেই ১৯৪৯ এর ১৩ অক্টোবর তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যের উন্নতি আর হচ্ছিল না। ক্রিসমাস আসতে না আসতে আরও অবনতি হয় শরীরের। এভাবে কেটে যায় একটি মাস। নতুন বছর ১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারি ভোরে কাশির তোড়ে জর্জ অরওয়েলের ফুসফুসের এইট আর্টারি ছিঁড়ে যায়। আর তাতেই মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মৃত্যু ঘটল বিশ্বসেরা এই ঔপন্যাসিকের।

***

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *