জড়ভরত
পুরাণ ও শাস্ত্রগ্রন্থে আমরা একাধিক ভরতের পরিচয় পাই। কৈকেয়ীর গর্ভে রাজা দশরথের যে পুত্র জন্ম নেন তার নাম ভরত। রামায়ণ, বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতে এই ভরতের বিস্তারিত বিবরণ আছে।
সঙ্গীতাচার্য জনৈক মুনির নাম ভরত। মনে করা হয় যে, জগতে সর্বপ্রথম নাট্য ও সঙ্গীতশাস্ত্র প্রবর্তন করেন তিনি।
চন্দ্রবংশীয় রাজা দুষ্মন্তের ঔরসে শকুন্তলার গর্ভজাত সন্তানের নামও ভরত। এই ভরতের বংশধরগণ ভারত নামে খ্যাত হয়। মহাভারত ও বিষ্ণুপুরাণে দুষ্মন্তপুত্র রাজা ভরত সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।
আমরা যে ভরত প্রসঙ্গে আলোচনা করছি তিনি এদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নন। ভাগবতে তার সম্পর্কে যে বিবরণ পাওয়া যায় তা হলো—
ব্রহ্মার সৃষ্ট প্রথম নারী হলেন শতরূপা। এই নারীর গর্ভে ব্রহ্মারই ঔরসে (অজাচারে) জন্ম হয় প্রিয়ব্রত নামে এক পুত্র। বিশ্বকর্মার কন্যা বহিষ্মতীর সাথে তার বিয়ে হয়। প্রিয়ব্রত ছিলেন জম্বুদ্বীপের রাজা। তার সাত পুত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন অগ্নিধ। অগ্নিধ্রের ঔরসে পূর্বচিত্তী নামক অপ্সরার গর্ভে জন্ম হয় নয়টি পুত্রের। তাদের মধ্যে জম্বুদ্বীপ নয়ভাগে ভাগ করে বণ্টন করে দেন রাজা অগ্নিধ্র। এই নয় পুত্রের মধ্যে একজন ছিলেন নাভি। নাভির ঔরসে মেরুদেবীর গর্ভে জন্ম নেন পরমহংস ব্রতের পথ-প্রদর্শক মহাত্মা ঋষভ। ঋষভ ও তার স্ত্রী জয়ন্তী শতপুত্রের পিতামাতা। এদের মধ্যে জ্যৈষ্ঠ হলেন ভরত। শতপুত্রের একাশি জন যজ্ঞশীল, বিনীত, বেদজ্ঞ ও ব্রাহ্মণ হলেন। নয়জন হলেন ভাগবত ধর্ম-প্রদর্শক এবং ভরত ও অন্য নয়জন হলেন রাজা। ঋষভ পরমহংস ছিলেন এবং জৈনেরাও তাকে আদি তীর্থঙ্কর বা আদিনাথ বলে মান্য করে।
এখানে পরমহংস সম্পর্কে একটু ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন মনে হয়। পরমহংস হলেন নির্বিকার যোগসিদ্ধ সন্ন্যাসী। পরম (শ্রেষ্ঠ) যে হংস (সন্ন্যাসী) তিনিই পরমহংস। মন্দির, গাছতলা, নদীতীর বা যে কোনো স্থানে অবস্থান করে সংসারের প্রতি মমতাশূন্য হয়ে তত্ত্বমার্গে বিচরণ করেন তিনি। ঋষভদেবের বড় ছেলে ভরত ছিলেন বিষ্ণুভক্ত রাজা। তিনি বিয়ে করেন বিশ্বরূপের মেয়ে পঞ্চজনাকে। তার গর্ভে ভরতের পাঁচপুত্র যথাক্রমে—সুমতি, রাষ্ট্রভূত, সুদর্শন, আবরণ ও ধূমকেতুর জন্ম হয়। যথাসময়ে পুত্রদের হাতে রাজ্যভার তুলে দিয়ে রাজা ভরত বনবাসে চলে যান তপস্যার উদ্দেশে।
একদিন নদীতীরে স্নানশেষে জপ করছেন ভরত। এমন সময় এক আসন্ন প্রসবা হরিণী সেখানে এসে জল পান করতে লাগলো। তাকে জলপান করতে দেখে নিকটের বন থেকে গর্জন করে উঠলো এক সিংহ। ভয়ে দ্রুতগতিতে পালাতে গিয়ে পা পিছনে পড়ে গেল হরিণী। ফলে গর্ভভ্রষ্ট হয়ে তার মৃত্যু হলো। কিন্তু সদ্য জন্ম নেয়া অসহায় মাতৃহারা মৃগশিশুকে নিজের আশ্রমে এনে পালন করতে থাকেন ভরত।
হরিণ-শাবকের মায়ায় আবদ্ধ হয়ে নিঃসঙ্গ তাপস ভরত জপ-তপ ভুলে দিনরাত শুধু সেটিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকলেন। এভাবে চলতে চলতে কিছুদিন পর তার মৃত্যু হলো।
পরজন্মে হরিণ হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন ভরত। কিন্তু তিনি জাতিস্মর (যে পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারে) হলেন। কালঞ্জর পর্বতে পুলহা ঋষির আশ্রমে থাকতেন মৃগরূপী ভরত। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে।
এর পরের জন্মে ভরত জাতিস্মর হয়েই জন্ম নেন আঙ্গিরসগোত্রের ব্রাহ্মণ-বংশে। এই জন্মে তার নয়টি বৈমাত্রেয় বড় ভাই ও একটি সহোদরা বোন ছিল। সংসারে ভরত অনাসক্ত হয়ে বসবাস করতেন। পূর্বজন্মের কথা স্মরণ থাকায় তিনি কাজকর্মে ভুল করে পরজন্মে যাতে নিম্নশ্রেণীর জন্ম লাভ না করেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে গিয়ে জড়বুদ্ধি মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। জড়িত স্বরে কথা বলতেন এবং সংসারের যাবতীয় কাজে বিমুখ ছিলেন বলে তার নাম হয় জড়ভরত। শাস্ত্রে তার গভীর জ্ঞান ছিল; কিন্তু সবসময় তিনি নিরাসক্ত হয়ে মলিন ও দীনহীনভাবে থাকতেন। সকলে তাকে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ভেবে তার সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করতো, অপমান করতো, অযত্ন করতো, অবহেলা করতো এবং অনেক নিম্নস্তরের কাজ করিয়ে নিতো।
কেউ নিষ্ক্রিয়, নিরুদ্যম ও অত্যন্ত বোকার মতো চলাফেরা করলে মানুষ তাকে এ কারণে জড়ভরত নামে আখ্যায়িত করে।