ছোটিডোঙ্গরির চিতা — ঋজুদা — বুদ্ধদেব গুহ
সূর্য ডোবার দেরি আছে তখনও ঘণ্টাখানেক। আমরা একটা শালগাছের দুদিকে বসে আছি। এমন কখনও আগে করিনি কোথাওই শিকারে গিয়ে। একই গাছে উত্তরমুখো মাচাতে বসেছি আমি আর দক্ষিণদিকের মাচাতে বসেছে ঋজুদা। ডোঙ্গাজারি পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে ঋজুদা যেদিকে বসেছে সেইদিক থেকে আর ছোটিডোঙ্গরির বনবাংলোটা দেখা যাচ্ছে আমি যেদিকে বসেছি সেদিক থেকে। ছোটিডোঙ্গরির বাংলোটা ছোট। অবুঝমারের দিকে যেতে এইটাই সম্ভবত শেষ বাংলো ছত্তিশগড় বনবিভাগের। এখন ছত্তিশগড়ের। আগে ছিল মধ্যপ্রদেশের। সেই অবুঝমার যেখানে বাইসন-হর্ন মারিয়াদের বাস। এখনও অবুঝমারে মেয়েরা গায়ে জামা পরে না। আদিমতা আছে এখনও।
তবে অবুঝমারে যেতে অনেক বাধা নিষেধ আছে। বস্তারের ডি.এম.-এর স্পেশাল পারমিশান লাগে। এদের বাইসন-হর্ন মারিয়া বলে এইজন্য যে এরা নাচবার সময়ে এদের মাথাতে বাইসনের শিং লাগিয়ে নাচে। এদের নাচ এবং রংচঙে পোশাক দেখবার মতো। অনেকে আবার রণপা-তে চড়েও নাচে।
আসলে একটি পরিত্যক্ত ঘোটুলে গত সন্ধেবেলা নাচ দেখতে গিয়েই আমাদের আজকে রাইফেল বাগিয়ে সারা রাত মাচায় কাটাতে হবে। সারা রাত থাকার আমার একটুও ইচ্ছে নেই। তবে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। ঋজুদা যা বলবে তাই করতে হবে।
কাল নাচটা অবশ্য আমরা খুবই এনজয় করেছি। চারধারে কাঠের অসমান তক্তার বেড়া দিয়ে ঘেরা ঘোটুলের সামনে যে ফাঁকা জায়গা থাকে সেই জায়গার ঠিক মধ্যিখানে একটি কাঠ পোঁতা। সেই কাঠের মাথাটাতে একটি সমান চারকোনা কাঠ লাগানো। তারই ওপরে কেরোসিনের হ্যাঁজাক রেখে ছেলেমেয়েরা নাচছিল। গান গাইতে গাইতে। ওরা এক রকমের লাঠি তৈরি করে সেই লাঠি হাতে করেই নাচে, সেই লাঠি শূন্যে নাড়ালে তা থেকে বাঁশির মতো শব্দ বেরোয়। ভারী মজার।
ঘোটুল কাকে বলে তা এখন বলার সময় নেই আমার। ছোটিডোঙ্গরি বাংলোর দিকে আমার চোখ। তিতির ভটকাই আর নারায়ণপুরের ডি.এফ.ও. শর্মা সাহেব বাংলোর সামনের ফাঁকা জায়গাটাতে চেয়ারে বসে জমিয়ে চা খাচ্ছে। চা-এর সঙ্গে টাও খাচ্ছে। দু-তিনজন লোক ট্রেতে বসিয়ে প্লেট নিয়ে আসছে বাবুর্চিখানা থেকে।
দিনের আলো যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ কোনও ভয় নেই। কারওরই। রাত নামার আগেই ওরা বাংলোর মধ্যে ঢুকে যাবে। তবে তিতির ও ভটকাই-এর কাছে একটি শটগান ও একটি রাইফেল আছে। শর্মাসাহেবের আর্দালির কাছে টু-ফিফটিন রাইফেল আছে। চিতাটা বাংলোতে গিয়ে হামলা করার মতো বোকা হবে না, অনুমান করা যায়।
আমরা গতরাতে নারায়ণপুর আর ছোটিভোঙ্গরির মাঝে সেই পরিত্যক্ত ঘোটুলে নাচ দেখার জন্যেই এসেছিলাম নারায়ণপুর থেকে। রেঞ্জার গনজালভেস মানা করেছিলেন, কিন্তু ডি.এফ.ও. শর্মাসাহেব শোনেননি। মানুষটি একটু পাগলাটে আছেন। তার উপরে যখন মদ-টদ খান তখন তার পাগলামি আরও বেড়ে যায়। এইসব জঙ্গলে সালফি’ নামের এক রকমের পানীয় হয়। স্থানীয় মানুষেরা প্রায়ই খায় এবং খেয়ে মারামারি করে মরে। আমাদের যেমন তাল বা খেজুরের রস ওদেরও সালফি। ওড়িশার জঙ্গলে ঋজুদার সঙ্গে গিয়েই দেখেছি বড়লোকদের বাড়ির বাগানে যেমন palm গাছ হয় জঙ্গলে সেইরকম palm গাছ হয়। তাতে হাঁড়ি বেঁধে জঙ্গলের মানুষেরা রস জমায়। ওড়িশাতে ওই গাছগুলোকে বলে সল্প গাছ। আর সেই রসকে বলে সল্প-রস্ব। সেই রসকেই এখানে এই ছত্তিশগড়ের বস্তারে বলে সালফি। শর্মাসাহেবের স্ত্রী উষাদেবী নুন আর গোলমরিচ মিক্সিতে গুঁড়ো করে সালফির জাগ-এ মিশিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যাপারটা কী?’ এবং সমস্ত রকম অভিজ্ঞতাই করতে হয়’ ঋজুদার এই ফরমান মেনে আমরা সকলেই এক গ্লাস করে খেয়েছিলাম। খেতে দারুণ লেগেছিল। ভটকাই বলেছিল, জমে গেছে। আরেক গ্লাস খাব।
ঋজুদা বলেছিল। একদম নয়। তিতির বলেছিল, রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন জানো না?
ভটকাই বলেছিল, কী?
আমি আর ঋজুদা একটু অবাক হয়েছিলাম ‘সালফির’ মধ্যে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ এসে পড়াতে। তিতির বলেছিল, ভাল জিনিস কম বলিয়াই ভাল। বুঝেছ। আর খায় না।
ঋজুদা অবশ্য গ্লাস চারেক খেয়েছিল। শৰ্মাসাহেবের গ্লাস গুনিনি। উনি বলছিলেন, কিডনির পক্ষে এ-জিনিস খুবই ভাল। ওষুধের কাজ করে। যে প্রায়ই সালফি খায় তার কখনওই কিডনির গন্ডগোল হবে না।
কিডনি ঠিক রাখতে তো আর ওড়িশা আর ছত্তিশগড়ের জঙ্গলে প্রায়ই আসা সম্ভব নয়।
ভাবছিলাম আমি।
শর্মা মেমসাহেব কিন্তু একটুও খাননি। স্বামীর পাশে সবসময়ে থাকেন ছায়ার মতো আর পাগলাটে স্বামীকে সামলান। এরকম ভাল মহিলা বেশি দেখা যায় না।
ঋজুদা তিতিরকে বলেছিল, দেখে রাখ, রোল মডেল!
তিতির বলেছিল, আমি এরকম কথা না-শোনা মানুষকে কোনওদিন বিয়েই করব না।
ভটকাই বলল,–তা হলে তিতির দিদি? মনের মধ্যে বিয়ের চিন্তা কি জাগছে। নাকি মাঝে মাঝে?
বাজে কথা বোলো না।
তিতির বলেছিল।
ভটকাই বলেছিল, ইক্কেরে না। অই চিন্তা করনের কাম নাই। তোমার বিয়া হইলে আমাগো দল ভাইঙ্গা যাইব গিয়া।
আমি বলেছিলাম, কেন দলের জনসংখ্যা বাড়লে তো ভালই।
আর সংখ্যা বাড়াইয়া কাম নাই। অন্য জিপ বা গাড়ি লাগব। ঋজুদা সামনে আমরা তিনজন পিছনে। এখন আমাগো টিম সবদিক দিয়াই ইক্কেরে ঠিকেই আছে।
ছোটিডোঙ্গরিটা একটা টিলা-মতো। বাংলোর পেছনে ছোট একটা বস্তি আছে, যে ছেলেটার লাশ পড়ে আছে শালগাছটার সামনে, তার বাড়ি ওই গ্রামেই। ঘোটুলে সে নাচতে গেছিল। ঋজুদা পাঁচশো টাকা বকশিস দিয়েছিল ওদের। নাচ শেষে সে যখন তার জোড়ির সঙ্গে ফিরছিল গ্রামে, আরও অনেকের সঙ্গে, পথে তার শুশু পাওয়ায় সে পথের পাশের একটি ঝোপের আড়ালে শুশু করছিল দাঁড়িয়েই। আর ঠিক সেই সময়েই চিতাটা পেছন থেকে এবং বাঁদিক থেকে একলাফে তার ঘাড় কামড়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তার প্রাণ বের করে তার ঘাড় কামড়ে টানতে টানতে নিয়ে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেছিল। সঙ্গীদের কারও কাছে বন্দুক ছিল না। এমনকী তির-ধনুকও নয়। ছিল সেই বাঁশির মতো আওয়াজ করার নাচের লাঠি। রণপা-টণপা ওসব ঘোটুলেই রেখে এসেছিল।
শুক্লপক্ষের সপ্তমী। আকাশে চাঁদ ছিল। ওরা নাচের আগে ও পরে ভাল পরিমাণ সালফি খেয়েছিল। তাই পথ দিয়েও প্রায় নাচতে নাচতে এ-ওর সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে গ্রামের দিকে ফিরছিল। দূরের গ্রামে একটি চিতাবাঘ মাঝে মাঝেই মানুষ ধরলেও ছোটভোঙ্গরি গ্রাম থেকে একজনকেও ধরেনি। যতক্ষণ না বিপদ এসে নিজের দরজাতে টোকা মারে ততক্ষণ বিপদকে বিপদ বলে মনে করে না কেউই। ওরাও তাই স্বপ্নেও ভাবেনি যে দূরে অন্যদের গ্রামে অঘটন ঘটলেও সেই অঘটন তাদের গ্রামের মধ্যেও ঘটবে।
যখন চিতাটা ছেলেটিকে ধরে, তখন ওরা গ্রামের পাঁচশো গজের মধ্যে এসে গেছিল। নিরস্ত্র আতঙ্কিত ওরা চিৎকার চেঁচামেচি করে ছেলেটিকে উদ্ধার করতে পেরে দৌড়ে গ্রামে এসে খবর দিয়েছিল। গ্রামের লোকেরা আলো টাঙ্গি ও তির-ধনুক নিয়ে ছেলেটির লাশ খুঁজতে বেরিয়েছিল বটে কিন্তু রক্তের চিহ্ন পেয়েও, তাঁর ছেঁড়া-খোঁড়া গাঢ় লাল হলুদ জামা ও ধুতি, মালা-টালা সব ছেঁড়া-খোঁড়া অবস্থাতে বনের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেও ভয়ে আর বেশিদূর এগোয়নি। ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলে করে নারায়ণপুরের বনবাংলোতে এসে খবর দেয় ওরা। যা হবার তা তো ততক্ষণে হয়েই গেছে। লোকদুটিকে ফেরত পাঠিয়ে ছোটিভোঙ্গরি বনবাংলোতে অপেক্ষা করতে বলে দিলেন ডেপুটি রেঞ্জার রায় বাবু। উনি হচ্ছেন মধ্যপ্রদেশের বাঙালি। শৰ্মাসাহেব তাকে কোনও এক হিন্দি ছবির ডায়ালগ নকল করে ডাকেন ‘বাবুমোশোয়’ বলে।
আমরা চান করে ব্রেকফাস্ট খেয়ে তৈরি হয়ে সকাল সাড়ে নটার মধ্যে ছোটিডোঙ্গরিতে পৌঁছে গেলাম। রায়বাবু ওই লোকগুলোকেই বলে দিয়েছিলেন যে আমরা দুপুরে ছোটিডোঙ্গরি বাংলোতেই লাঞ্চ করব। সেই মতো রান্নাবান্নার বন্দোবস্ত যেন করে বাংলোর চৌকিদার দুজন।
চিতাটা ছেলেটাকে ওখানেই খেয়েছিল। ছেলে বলছি বটে, কিন্তু তার বয়স আমাদের থেকে বেশিই ছিল এবং অত্যন্ত হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। পুরোটা খায়নি। তার বুক ও ঘাড় থেকে খেয়েছিল এবং একটি পায়ের মাংস ঊরু থেকে কাফ মাসল অবধি পুরোই খেয়েছিল। পেছনের একদিক খেয়েছিল। মুখের মধ্যে নাক আর চোখ দুটো এবং গালের মাংস খেয়েছিল। বীভৎস দেখাচ্ছিল সেই মৃতদেহ যখন আমরা তা আবিষ্কার করি এই শালবনের ছায়াতে। আংশিক খাওয়ার পরে মৃতদেহটি বয়ে এখানে নিয়ে এসেছিল চিতাটা। এদিকে একটি ঝরনা মতে আছে। মানে নালা। সেই জলের পাশে কতগুলো পুটুস আর বেশরম-এর বোপের আড়ালে এমন করে লুকিয়ে রেখেছিল যাতে ওপর থেকে শকুনের বা জংলি দাঁড়কাকেঁদের চোখ তার ওপরে না পড়ে।
ছেলেটির বাবা ও দাদা তাকে নিয়ে গিয়ে কবর দিতে চেয়েছিল। এমনিতে মৃতদেহ তারা দাহই করে কিন্তু অপঘাতে মৃত্যু হলে কবর দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ডি. এফ. ও. শর্মা সাহেব তার জিপ নিয়ে পৌঁছে গেছিলেন ছোটিডোঙ্গরিতে। উনি বললেন, বিলকুল নেহি।
চিতাটা যেহেতু পুরোটা খায়নি ছেলেটাকে এবং যত্ন করে লুকিয়ে রেখে গেছে জলের অদূরে, তার মানে সে রাত নামলেই খেতে আসবে। চিতাটাকে মারতে না-পারলে তারপরে সে এই জঙ্গলে ত্রাসের সঞ্চার করবে। অবুঝমারে যাওয়ার পথও এখান দিয়েই। লোক মারতে মারতে সে অবুঝমারেও পৌঁছে যেতে পারে।
আমরা তো আর এখানে শিকার করতে আসিনি, এসেছি বস্তারের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখতে। আসবার সময়ে সব জায়গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে এসেছি, ফেরবার সময়ে থেমে থেমে দেখতে দেখতে জানতে জানতে যাব। জগদলপুর চিত্রকুট জলপ্রপাত, কেশকাল, দন্ত্যেশ্বরীর মন্দির সুন্দরী ইন্দ্রাবতী নদী আরও কত কী দেখার আছে ভাল করে। এখানে তো আমরা মৌরসি-পাট্টা গেড়ে বসে থাকতে পারব না। অন্য শিকারির বন্দোবস্ত করতে হবে শর্মাসাহেবকে।
নেহাত স্বভাবদোষে যেখানেই যাই সেখানেই হাতিয়ার সঙ্গে থাকে আমাদের। তাই এই বিপত্তি। অবশ্য ঋজুদার যশও বিপদের অন্য একটা বড় কারণ। তবে খারাপও লাগছিল। কাল রাতের অত আলো, অত রং, অত উচ্ছ্বাস, অত গান, অত আনন্দ! তারপর সেই দলেরই একটি ছেলের অমন করুণ পরিণতির কথা ভাবা। পর্যন্ত যায় না।
এতক্ষণ ছোটিডোঙ্গরি গ্রামের থেকে দিনশেষের নানা আওয়াজ ভেসে আসছিল। ছাগলের ডাক, শিশুর কান্না, কুয়োতলার জল তোলা এবং জল ফেলার নানারকম জলজ আওয়াজ। এখন সেইসব আওয়াজ মরে গেছে। কাল ছেলেটিকে ধরেছে চিতাটা সেই জন্যই বোধহয় আজ এত বিষণ্ণতা ও ভয় সমস্ত গ্রামের জীবনযাত্রার সঙ্গে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। পরে হয়তো ক্রমে ক্রমে সয়ে যাবে। এ গ্রামে নাকি গত ষাট বছরের মধ্যে কোনও মানুষখেকো বাঘ বা চিতার আগমন ঘটেনি। সেই কারণেই অঘটনের অভিঘাতটা ভীষণরকমই বিঁধেছে গ্রামবাসীদের বুকে। তারা যেন ব্যাপারটাকে এখনও ঠিক মেনে নিতে পারছে না।
আলো সরে যাওয়ার আগে সব বনই কাকলিমুখর হয়ে ওঠে। পাখিদের মধ্যে কথা বলার ঝোঁক যেন বেড়ে যায়। অনেক ঘণ্টা কথা বলতে পারবে না তাই সব বলি বলি করা কথাই তারা তখন বলে ফেলে। অন্ধকার হয়ে গেলে দিনের পাখিরা সবাই চুপ। তখন রাত-পাখিরা জাগে একে একে। পেঁচা আর পেঁচানি ঝগড়া করে উড়ে উড়ে। ভুতুড়ে চোখ নিয়ে নাইটজার পাখিরা স্থবির বুড়োর মতো পথের মধ্যে অথবা টাড়ে জঙ্গলে বসে থাকে। পথের ওপরে গাড়ি এলেও তারা নির্বিকার। গাড়ি যখন তাদের প্রায় চাপা দিয়ে দেবে ঠিক সেই মুহূর্তে যেন গাড়ির বনেট খুঁড়ে উপরে ওঠে বাদামি ছাইরঙা ডানা দুটি চক্রাকারে ঘুরিয়ে। রেড বা ইয়ালো ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ জঙ্গলের সীমানাতে মাঠে প্রান্তরে কোনও কিছু নড়াচড়া দেখলেই টিটিরটি-টিটিরটি-টিটিটিটি বা ডিড উ্য ডু ইট, ডিড উ্য ডু ইট-এর মাধ্যমে তাদের নিরন্তর জিজ্ঞাসা বুকে করে লম্বা লম্বা পা দুটি ঝুলিয়ে ও দুলিয়ে ধীরে ধীরে উড়তে থাকে সেই জায়গার উপরে। বড় অস্বস্তি লাগে। কী দেখে সে বা তারা ডাকছে তা দেখা যায় না। কিন্তু কিছু যে দেখেছে সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না কোনও। তাতে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।
সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে নিথর নিস্তব্ধতা নেমে এল। পশ্চিমাকাশে সন্ধ্যাতারাটা উঠল নীলচে সবুজ স্নিগ্ধতার সংজ্ঞা হয়ে। আর চাঁদও উঠল পুবাকাশে পশ্চিমাকাশে সূর্যকে বিদায় জানানোর পরে। এটা মার্চ মাস। সন্ধের পরে ঠান্ডা লাগে। চাঁদটা যত উপরে উঠছে তত উজ্জ্বল হচ্ছে বনভূমি, তত স্পষ্ট হচ্ছে আলো অন্ধকারের বিভাজন।
আমরা দুজনে দুমুখ করে বসেছি। এইজন্যে যে চিতাটা মড়ির কাছে আসার আগেই তাকে যাতে আমরা দেখতে পাই। সে উত্তর বা দক্ষিণ যেদিক দিয়েই আসুক। পুবদিক দিয়ে সে আসবে না। কারণ গ্রামটা পুবদিকে। সে তো আর গ্রামে গা ঢাকা দিয়ে থাকেনি দুপুরে! পশ্চিমদিক দিয়ে এলে তাকে অনেকখানি কাটাবন আর ঘন পুটুস-এর জঙ্গল পেরিয়ে আসতে হবে। নিঃশব্দে আসা ওপথে তার পক্ষে অসম্ভব। আর মড়িতে সব জানোয়ারই নিঃসন্দেহ হয়ে আসতে চায়।
বন যেখানে গভীর এবং জনমানবহীন সেখানে বাঘ বা চিতা বিকেল বিকেলও এসে যায় অনেক সময়। কিন্তু এই জায়গাটা গ্রামের কাছেই। যতক্ষণ আলো ছিল গ্রামে নানা রকম আওয়াজ এবং মানুষ ও গোরু ছাগলের আওয়াজ ছিল। সব শান্ত হলেও চিতা মড়িতে আসতে চারদিক খুব ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে।
মাচা বানাবার সময়ে শাল গাছের যেসব ডাল কাটা হয়েছিল সেই ডালের টুকরো টাকরা এবং ছেঁড়াপাতা সব কুড়িয়ে নিয়ে জিপে তুলে চলে গেছিল ভটকাই ও তিতির, ছোটিডোঙ্গরি বাংলোর ক্যাম্পফায়ার করার জন্যে। আসল কারণ চিতার যেন কোনওরকম সন্দেহ না হয়, আমাদের উপস্থিতি সে যেন কোনওক্রমেই টের না পায়। থাবার দাগ বা Pugmarks দেখে আমরা বুঝেছিলাম যে চিতাটা বেশ বড় কিন্তু পেছনের একটি পায়ের দাগ তেমনি স্পষ্ট করে পড়েনি। তাতে মনে হয়, ওই পা-টা একটু কমজোরি। হয়তো কোনও চোট আছে ওই পায়ে এবং ওই চোটের কারণেই সে হয়তো তার স্বাভাবিক খাদ্য হরিণ শুয়োর ইত্যাদি ধরতে অপারক হয়েই মানুষের কল্যাণে লেগেছে।
রাত ভাল করে নামার ঘণ্টা দেড়েক পরে একটি কোটরা হরিণ হিস্টিরিয়া রোগীর মতো ডাকতে ডাকতে দৌড়ে এল জঙ্গলের ভিতর থেকে। তারপর আমার সামনে দিয়ে দৌড়ে ছোটিডোঙ্গরি বাংলোর দিকে চলে গেল। সেদিকে জঙ্গল ফাঁকা হয়ে গেছে। তার কাণ্ড দেখে অবাক হলাম। তারপরই জঙ্গলের মধ্যে। থেকে টিটিরটি-টিটিরটি করে ডাকতে ডাকতে ল্যাপউইঙ্গটা জঙ্গলের বাইরের দিকে আসতে লাগল। উত্তেজনাতে আমার হাতের তেলো চুলকে উঠল। দুঊরুর উপরে শোয়ানো ঋজুদার থার্টি-ও-সিক্স ম্যানলিকার শুনার রাইফেলটার স্মল অফ দ্য বাট ডান হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে ট্রিগার গার্ডে আঙুল ছুঁইয়ে বসে রইলাম আমি। ঠিক সেইসময়ে জঙ্গল থেকে একটা হুতুম পেঁচা বেজায় দুরগুম-দুরগুম-দুরগুম করে প্রায় কামান দাগার মতো করে ডেকে উঠল পিলে চমকে দিয়ে। যারা জঙ্গলে আগে এ ডাক শোনেনি তারা শুনে মূচ্ছাও যেতে পারে, আমি যেমন গেছিলাম আন্দামানের ডেভিলস আইল্যান্ডে প্রথমবার এর ডাক শুনে।
তারপরই বনের মধ্যে থেকে অস্পষ্ট খসখস আওয়াজ করে কোনও জানোয়ার। এগিয়ে আসতে লাগল। বাঘ বা চিতার পায়ের তলাতে এত মোটা প্যাড থাকে যে তাদের চলাতে শব্দ হয় না কোনও। তা ছাড়া তারা শিকারি জানোয়ার বলে পা ফেলেও সাবধানে যাতে কোনও শব্দ না হয়। নৈঃশব্দই তাদের বর্ম। কিন্তু ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে আসার সময়ে তাদের গায়ের সঙ্গে ঝোপঝাড়ের ঘষা লাগায় মৃদু এক রকমের খস খস আওয়াজ হয়। তৃণভোজী জানোয়ারেরা জঙ্গলে চলাফেরা করলে খচমচ আওয়াজ হয়। তারা শব্দ দিয়ে মাথা ঘামায় না। তা ছাড়া, তাদের পায়ের তলাতে শক্ত খুর থাকে যা পাথুরে জমিতে শব্দ তোলে। যে জানোয়ার আসছে সে মাংসাশী। একটু পরেই একটি ছোট মাপের বাঘ জঙ্গল থেকে বাইরে এসে একটি পাথরের উপরে উঠে চারদিক দেখল। তার নজরে ছেলেটির শবটি পড়েনি। কারণ তা তার বাঁদিকে একটু পেছনে ছিল। পড়লে সে বড়জোর অবাক হত কিন্তু পরের মারা শিকার বাঘ ছোঁয় না। শবকে ছুঁত না। বাঘ চারদিক দেখে একটু এগিয়ে গিয়ে বড় রাস্তার দিকে চলে গেল। মনে হল সে পথ পেরিয়ে ওদিকের জঙ্গলে ঢুকবে শিকারের খোঁজে। ওই পাথরটি থেকে নামবার আগে বহুদুরের ছোটিডোঙ্গরির বাংলোর দিকে দেখল একবার। বাংলোর সামনে আগুন জ্বলছিল। হ্যাঁজাকটা জ্বলছিল বাংলোর বারান্দাতে। বাইরে কেউই ছিল না।
বড় বাঘের এলাকাতে এক বা একাধিক চিতা থাকে। তাতে বড় বাঘ কিছু মনে করে না কিন্তু এক বাঘের এলাকার মধ্যে অন্য বাঘের প্রবেশ নিষেধ। বাঘ তাদের শরীরের একটি গ্ল্যান্ড থেকে ফেরোমন গাছে বা পাথরে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের এলাকা চিহ্নিত করে রাখে। সেই গন্ধ বা দুর্গন্ধই বলে দেয় যে এটি কোনও বড় বাঘের এলাকা। ওর মধ্যে অন্য বড় মদ্দা বাঘ ঢুকলে যুদ্ধ অনিবার্য।
এখন চাঁদের আলো আরও জোর হয়েছে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চারপাশ যদিও আলো এমন জোর নয় যে রাইফেল দিয়ে তার ব্যাকসাইট ও ফ্রন্টসাইট দেখে নির্ভুল নিশানা নেওয়া যায় তবে এই আলোতে শটগান দিয়ে স্বচ্ছন্দে গুলি করা যায় নির্ভুলভাবে।
জঙ্গলের ভিতর থেকে পিউহা ডাকছে মাথার মধ্যে চমক তুলে তুলে। সাধে কি আর সাহেবরা এই পাখিগুলোর নাম দিয়েছে ব্রেইন ফিভার? মস্তিষ্কের জ্বরে আক্রান্ত না হলে এমন করে ডাকতে পারে না কেউ। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে একটা পাগলা কোকিল। বসন্ত চলে যাব যাব করলেও তার যাবার কোনও লক্ষণ নেই। প্রত্যেক জঙ্গলেই এমন একটি দুটি পাগলা কোকিল থাকে তারা গ্রীষ্মে ও বর্ষাতেও গলার শিরা ফাটিয়ে ডেকে চলে। ফুল ফুটুক আর নাই ফুটুক তাদের সবসময়েই বসন্ত।
ঘড়িতে দেখলাম, রাত প্রায় সাড়ে আটটা। আমার ঘড়িতে রেডিয়াম নেই কিন্তু ডায়ালটা সাদা বলে চাঁদের আলোতে পরিষ্কার দেখতে পেলাম ঘড়ি। সেই সময়ে বনের মধ্যে থেকে আরেকটা কোটরা ডেকে উঠল হঠাৎ। ডেকে উঠেই চুপ করে গেল। কেউ কি তার শ্বাসরোধ করল?
তারপরে আবার পিউ কাহা আর কোকিলের ডাক। কিছুক্ষণ পরে আমার মনে হল একটা ছায়া যেন সরে গেল নিঃশব্দে আমার ডানদিকে একটা বড় শিমূলের পায়ের কাছে। শিমূল গাছের গুঁড়িতে অনেকগুলো ভাগ থাকে। মনে হল সেই ছায়াটা সেই ভাগের কোনও একটা ভাগের মধ্যে ঢুকে আড়াল নিল। উৎকর্ণ হয়ে আমি সেদিকে চেয়ে বসে রইলাম। ঋজুদা বলেই দিয়েছিল যে চিতাকে দেখতে পেলে এবং রেঞ্জের মধ্যে পেলে গুলি করবি যদি ভাইটাল জায়গাতে না লাগে নাই-ই লাগল। পরে সেই আহত চিতাকে খুঁজে বের করে মারা যাবে। চিতাটি মানুষখেকো বলেই কোনও ঝুঁকি নেওয়া চলবে না, তাই একে পালাতে দেওয়া চলবে না। যে আগে দেখতে পাবে, মানে যার দিকে সে বেরোবে আড়াল ছেড়ে, সেই গুলি করবে।
রুদ্ধ নিশ্বাসে রাইফেলের স্মল অব দ্য বাট-এ ডান হাতে তর্জনি ছুঁইয়ে বসে আছি। বেশ কিছুক্ষণ পরে ছায়াটাকে আরেকবার নড়তে দেখা গেল। চিতাটা শিমূল গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে চারদিকে ভাল করে দেখল। তারপর খুব সাবধানে হামাগুড়ি দিয়ে ছেলেটি যে জায়গাতে শুয়ে আছে সেদিকে এগোতে লাগল। নালার শব্দটা ততক্ষণ খেয়াল করিনি। হঠাৎই যেন জলের কুলকুলানি স্পষ্ট হল। এতক্ষণ জলের শব্দ কেন যে পাইনি কে জানে! আমাদের ভারতীয় চিতা বা লেপার্ড বা প্যান্থার যেভাবে হামাগুড়ি দেয় তাকে বলে লেপার্ড ক্রলিং। এন.সি.সি.-তে আমাদের রাইফেল হাতে এরকম হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে শেখানো হয়েছিল, লেপার্ড ক্রলিং করে, তাই জানি।
যতক্ষণ না তাকে জুতমতো পাচ্ছি ততক্ষণ হড়বড়িয়ে গুলি করে লাভ নেই। হঠাৎই দেখলাম ছায়াটি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে শবটির দিকে। সে যে পথে যাচ্ছে তাতে সামান্য পরেই সে কতগুলো পুটুস আর বেশরম ঝোপের পিছনে আড়াল পড়ে যাবে। তারপর তাকে দেখা যাবে যখন সে ছেলেটিকে খেতে শুরু করবে। কিন্তু সে জায়গাটা ছায়াচ্ছন্ন বলে তাকে তখন ভাল করে কেন, প্রায় দেখাই যাবে না। এখনও দেখা যাচ্ছে না, যা দেখা যাচ্ছে তা নেহাতই একটি ছায়ামাত্র। মুহূর্তের মধ্যে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে গুলি করলাম। সে আমার দিকে পেছনে ফিরে ছিল। কোনাকুনি। ঠিকমতো গুলি করতে পারলে তার কাধ এবং হার্টকে বিদ্ধ করা যেত কিন্তু গুলিটা বোধহয় ভাল জায়গাতে লাগল না। কোথায় যে লাগল তা বোঝ সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে তখন। তবে গুলি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে একলাফ মারল সোজা উপরে। আমি সজাগ থাকলে সেই অবস্থাতেও শূন্যে তার গায়ে। আরেকটি গুলি করতে পারতাম কিন্তু উত্তেজনাতে তা করতে পারলাম না। লেপার্ডটি মাটিতে পড়েই আরেক লাফে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, আমি হাত কামড়াতে লাগলাম। আমার জায়গাতে ঋজুদা থাকলে লেপার্ড-এর চলে যাবার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। একে ঋজুদার মাথা কুলফির মতো ঠান্ডা, তারপরে হাত আমার চেয়ে অনেকেই ভাল, অভিজ্ঞতাও অনেক বেশি। ঋজুদা প্রথম গুলি যদি বে-জায়গাতে লাগাতও লেপার্ড যখন লাফিয়ে উঠল এবং যখন মাটিতে পড়ল তখন তাকে দ্বিতীয় গুলি করে ওখানেই থিতু করে দিত। কিন্তু এখন আর হাত কামড়ে লাভ নেই কোনও। যা হবার তা হয়ে গেছে।
চিতাটা অদৃশ্য হয়ে যাবার মিনিট পনেরো পরে ঋজুদা বলল,ঝামেলা বাধালি। আগামীকাল ওই চিতাকে খুঁজে বের করে মারতে খুবই ঝামেলা হবে। তবে মারতে তো হবেই। বিটিং করে বের করতে গেলেও একাধিক বিটারকে সে মেরে দিতে পারে। আহত চিতা বলে কথা! তোকে আমাকেও মারতে পারে। চাঁদের আলো আছে বলেই মাচা থেকে নামবার কথা ভাবছি। অন্ধকার রাত হলে সারা রাত মাচাতেই বসে থাকতে হত। সে দূরে চলে গেছে এমন তো কোনও কথা নেই। সে কাছেই তোর দিকে চেয়ে পড়ে আছে হয়তো মাটি কামড়ে।
তারপর বলল, এক কাজ কর। তুই এখন নামিস না। আমি আগে নেমে তোর মাচার নীচে গিয়ে তোকে cover করে দাঁড়ালে তুই নামিস। তারপর বড় রাস্তা ধরে আমরা ছোটিডোঙ্গরি বাংলোতে ফিরে যাব।
আমি বললাম,এখুনি একটা হেস্তনেস্ত করে গেলে হত না?
তুই একটা উন্মাদ। এতদিনে এই শিখলি। আহত চিতার পেছনে রাতের বেলা কেউ যায় আত্মহত্যা করতে? তাও পূর্ণিমার রাত হলে কথা ছিল। তবে পূর্ণিমার রাতও আহত চিতার জন্যে নির্বিঘ্ন নয়। তার উপরে আবার মানুষখেকো!
আমরা বাংলো থেকে আসার আগে বলে এসেছিলাম যে গুলির শব্দ শুনলেও আমাদের খোঁজে জিপ নিয়ে যেন শর্মাসাহেবরা না আসেন। তিতির ও ভটকাইকেও ঋজুদা বারবার করে বারণ করেছিল। বলেছিল আমরা এলে নিজেরাই আসব তবে ফিরতে ফিরতে সকাল হয়ে যাবে। তোরা দরজা বন্ধ করে থাকবি। রাতের পর বাইরে কেউই থাকবি না। শর্মাসাহেব হয়তো সালফি খেয়ে গজল গাইতে চাইবেন বারান্দাতে বসে। চিতাটা তো আর জানে না ইনিই মহামান্য ডি.এফ.ও. নারায়ণপুরের। মানুষখেকো বাঘ বা চিতা non-respector of persons। কারওকেও রেয়াত করে না ওরা। মিসেস শর্মা থাকলে ভাল হত নইলে শর্মাসাহেবকে ম্যানেজ করা মুশকিল।
ঋজুদা আগে নেমে চিতাটা যেদিকে চলে গেছে সেদিকে তো বটেই চারদিকে নিজের দুব্যাটারির টর্চটা ফেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। তারপরে বন্দুক রেডি পজিশনে ধরে বলল, নাম এবারে। আমার দুব্যারেলেই এল.জি. পোরা আছে। চিতা লাফ দিয়ে ঘাড়ে পড়তে পড়তেও ট্রিগার টেনে দিতে পারলে তার দফা রফা হয়ে যাবে।
এই সময়ে সঙ্গে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ থাকলে কাজে লাগত যদিও চাঁদের আলোতে টর্চ-এর আলোর জোর থাকত না। তবে চাঁদের আলোয় সবদিকই কমবেশি দেখা যাচ্ছে। দেখা গেলে কী হবে। পুটুস আর বেশরমের ঝোপের মধ্যে তো দেখা যায় না। আর চিতা হয়তো তাদেরই কোনওটার মধ্যে লুকিয়ে আছে।
আমি নামলে ঋজুদা আরও একবার পেছনে ফিরে দেখে, দুপাশে দেখে ঝোপঝাড় এড়িয়ে ফাঁকা জায়গা দিয়ে চাঁদের আলোতে সুনসান নির্জন কাঁচা লাল ধুলোর বড় রাস্তাটার দিকে এগোতে লাগল। কিছুটা দূর গিয়েই আমরা দাঁড়িয়ে পড়ে পেছনে ও দুপাশে দেখছিলাম। তারপর বড় রাস্তাতে পৌঁছে ঋজুদা বলল, এই বেশরম-এর ঝোপগুলো যেখানে থাকে, তার নীচে কয়লা পাওয়া যায়।
তাই!
হ্যাঁ ভূতত্ত্ববিদেরা তাই বলেন। বস্তার জেলাতে নানারকমের খনিজ পদার্থ আছে, যদিও এখানে কোনও খননকার্য হয়নি তেমন এ-পর্যন্ত। যখন হবে তখন নানারকম ধাতু ও আকর পাওয়া যাবে হয়তো। লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, তামা, কয়লা, আরও কত কী। বস্তারে ডেভালাপমেন্ট কিছুই হয়নি। খুবই গরিব জেলা এই বস্তার। কোনও কলকারখানাও নেই। শুধু ঢোকরার কুটির শিল্প আছে কিছু। এদের তাঁতশিল্পও খুব উন্নত। কীরকম রংচঙে পোশাক পরে নাচছিল ওরা দেখেছিস।
ওদের সভ্য করে তোলা যায় না?
আমি বললাম।
ঋজুদা হাসল। বলল,আমরা নিজেদের সভ্য বলে মনে করি। ওরা হয়তো আমাদের অসভ্য বলে মনে করে। ভেরিয়ার অ্যালউনের লেখা ভাল করে পড়লে এই তথাকথিত অসভ্য গোঁন্দ বাইগা মারিয়াদের কথা জানতে পাবি। এই সেদিন আমার হাতে একটি বই এসেছে, রামচন্দ্র গুহর লেখা, Savaging the Civilized দারুণ বইটা। এখনও শেষ করতে পারিনি।
রামচন্দ্র গুহ কে?
উনি একজন নাম করা নৃতত্ত্ববিদ।
বইটা তোমার পড়া হলে আমাকে পড়তে দেবে?
দেব কিন্তু সময়মতো ফেরত দেবে।
দেব।
এতক্ষণ আসেনি কিন্তু আমরা বড় রাস্তায় এসে উঠতেই একটা ইয়ালো ওয়াটেলড ল্যাপউইঙ্গ চাঁদভাসি আকাশে নিঃশব্দে ভেসে এসে আমাদের মাথার উপরে উড়তে উড়তে ডাকতে লাগল, টিটিরটি টিটিরটি টিটিরটি।
ঋজুদা পথের উপরে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার চারধারে ভাল করে দেখে নিল একবার।
তারপর আবার এগোল। আমার গা ছমছম করতে লাগল।
আমরা যখন ছোটিডোঙ্গরি বাংলোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছি তখন চৌকিদারের লালরঙা কুকুরটা অসীম সাহসে ভর করে দু-তিনবার আহ্লাদের সংক্ষিপ্ত ভুভুক ডাক ডেকে দৌড়ে এসে ঋজুদাকে স্বাগত জানাল লেজ নাড়তে নাড়তে।
এটি সব জায়গাতেই লক্ষ করেছি। যেমন করেছি নাগাল্যান্ডের বঙ্গপোকপিতেও। কুকুরেরা ঋজুদাকে খুবই পছন্দ করে। কী করে যেন দুমিনিটের মধ্যে ঋজুদা তাদের সঙ্গে দোস্তি করে ফেলে।
কী ব্যাপার।
জিজ্ঞেস করলাম আমি।
তারপর বললাম, চিতার ভয়ে কুকুরেরা সব জায়গাতেই সিঁটিয়ে থাকে অথচ এই লালি সব জেনেশুনে মরবার জন্যে উদোমে এল কেন রাতের বেলা? ১৪৬
ঋজুদা হেসে বলল,আমি কুকুরদের জন্যে পকেটে করে বিস্কুট নিয়ে ঘুরি সবসময়ে, তাই জন্যে।
বুঝলাম, কথাটা সত্যি নয়। কোনও মন্ত্রগুপ্তি আছে ঋজুদার।
হয়তো আমাদের গলার স্বর পেয়ে থাকবেন ওঁরা। আমরা বাংলোর হাতায় ঢোকার আগেই দরজা খুলে শর্মাসাহেবের সঙ্গে তিতির এবং ভটকাই বেরিয়ে এল। ভটকাইয়ের হাতে ঋজুদার নতুন পয়েন্ট থ্রি ফিফটিন রাইফেলটা ছিল, ইন্ডিয়ান অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির।
কী হল। ঋজুকাকা? গুলির শব্দ পেলাম যে।
তিতির জিজ্ঞেস করল।
ঋজুদা বলল,-রুদ্র আহত করেছে চিতাটাকে। কাল খুঁজে বার করে মারতে হবে।
তারপর ঋজুদা আমাকে বলল, ওদের ইনকুইজিটিভনেস মেটাতে কী ঘটনা ঘটেছিল বলো রুদ্র, নইলে ওদের ঘুম হবে না রাতে।
ইতিমধ্যে শর্মা সাহেব বললেন, আপলোগোঁকি লিয়ে খানা বানায়া ভটকাইবাবুনে।
ভটকাই আবার বাবু হল কবে?
ঋজুদা বলল।
ভটকাই গলা নামিয়ে বলল, বাইরের লোকের সামনে বে-ইজ্জত কোরো না।
ও বাবা। তা হলে তুই বাবুই।
কেয়া খানা বনা? বলিয়ে ভটকাইবাবু।
তারপর ঋজুদার দিকে ফিরে শর্মাসাহেব বললেন, উনহোনে তো বাবুর্চিখানামেই থে রাইফেল সাথ লে কর।
ভটকাই বলল,লুচি আর টকটক আলুর দম, বেগুন ভাজা, আর পচরঙ্গ কোম্পানির আচার।
লুচি কেয়া হোতা হ্যায় ভটকাইবাবু?
পুরি জানতা আপ? পুরি?
ভটকাই তার অনবদ্য হিন্দিতে বলল।
জি হাঁ, পুরি কওন নেই জানতে হেঁ।
লুচি হচ্ছে পুরিকি ছোটি বহিন।
বলেই হাতের তেলো ছোট করে গোল করে বলল,–এইসি ছোটি ছোটি হোতা।
সমঝা। ঔর আলুকি দোম?
দোম নেই দম।
ভটকাই বলল। তারপর বলল,আলুসে বনতা।
ঋজুদা বলল–আলুকা দম কি বেগুন দিয়ে রাঁধা হবে? ঠিকে হ্যায়। কাল দোপেহরমে ম্যায় আপনোগোঁকি রিকম খিলায়েগা।
রিকম! উ কেয়া চিজ হ্যায়?
রন্ধন-বিশারদ ভটকাই বলল অবাক হয়ে।
ঋজুদা মুচকি মুচকি হাসছিল। শব্দটা চেনা চেনা লাগছিল আমার কিন্তু মনে পড়ছিল না জিনিসটা কী!
ঋজুদা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাব পড়ে বলল,–মধ্যপ্রদেশেরই ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো যেবার মারতে গেছিলাম বোরে শুনেছিলি?
ঠিক মনে নেই। তারপরই আমার মনে পড়ে গেল। ওখানে ধোকার ডালনাকে রিকম বলে। ওখানের বনবিভাগের অফিসারেরা খাইয়েছিলেন বটে।
আমি বললাম, ধোকার ডালনা।
তাই? ভটকাই আর তিতির সমস্বরে বলল। ওরা তো যায়নি ঝিঙ্গাঝিরিয়াতে।
তারপর রাইফেলটা আনলোড করে রেখে মুখ-হাত ধুতে আমি বাথরুমে গেলাম। জানলাটা ভোলা ছিল। জানলাতে পরদা ছিল না। দূরের জঙ্গল ও প্রান্তর দেখা যাচ্ছিল শুক্লপক্ষের চাঁদের আলোতে। আমি ভাবছিলাম ছেলেটার শবটা পড়ে আছে অর্ধভুক্ত অবস্থায়। চিতাটাও কোথায় আছে কে জানে! গুলিটা তার পেটেই লাগল কি? পেটে লাগলে তো খুবই যন্ত্রণাও হচ্ছে, রক্তপাতও হচ্ছে। সারা রাত রক্তক্ষরণ হবার ফলে সকালে সে কি মারা যাবে? আমরা যখন তার রক্তের দাগ অনুসরণ করে তার কাছে গিয়ে পৌঁছব তখন কি সে মরণকামড় দেবে আমাকে? লাফিয়ে উঠে টুটি চেপে ধরবে আমার, তার তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে?
ভাবছিলাম, মানুষ যতক্ষণ বেঁচে থাকে সে মানুষই থাকে, তার একটা নাম থাকে, সে নামে প্রিয়জনে প্রেমভরে তাকে ডাকে। সে কারও ছেলে, কারও ভাই, কারও বন্ধু এই তখন তার পরিচয়। কিন্তু ওই ছেলেটির মতো মরে গেলে তখন তার নাম তখন হয়ে যায় মৃতদেহ, ডেডবডি, লাশ অথবা শিকারের পরিভাষায় kill বা মড়ি। কী আশ্চর্য, না? মানুষের মতো এত তাড়াতাড়ি ভোলার ক্ষমতা বোধহয় অন্য কোনও প্রাণীরই নেই, মানুষের মতো স্বার্থপরও বোধহয় আর নেই।
রাতে খেতে বসে ঋজুদা বলল, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। কাল আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গেই চিতাটাকে খুঁজতে বেরোব আমরা।
শর্মাসাহেব পুরির ছোটবোন লুচি আর আলুর ‘দোম’ খেয়ে রাতেই জিপ নিয়ে নারায়ণপুরে ফিরে যাবেন। আগামীকাল জগদলপুরে কনজার্ভেটর সাহেবের সঙ্গে তার মিটিং আছে। ভোরে ভোরে নারায়ণপুর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে তাকে। ভয়ের কিছু নেই। মানুষখেকো চিতাটা কোথায়, মানে, কোনদিকে আছে তা আমরা জানি। উনি যাবেন উলটোদিকে। তা ছাড়া হেডলাইট জ্বালানো জিপকে সব জানোয়ারই এড়িয়ে চলে, সে মানুষখেকো হোক আর যাই হোক। তা ছাড়া সঙ্গে তার আর্মড বডিগার্ড থাকবে। ড্রাইভার তো থাকবেই। তবে এসব অঞ্চলে, ভারতের অনেক বনাঞ্চলেরই মতো নানারকম আতঙ্কবাদীদের সন্ত্রাস আছে। তারা মানুষখেকো চিতার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। আর এইসব আতঙ্কবাদীদের লক্ষ্য সরকারি অফিসারেরাই, বনবিভাগের অফিসারেরা তো অবশ্যই।
শর্মাসাহেব খেয়ে-দেয়ে উঠে আরও দুগ্নাস সালফি খেয়ে ‘দোস্ত দোস্ত না রহা, পেয়ার পেয়ার না রহা’ গাইতে গাইতে ঋজুদার এবং আমাদের সকলের কাছে বিদায় নিয়ে গিয়ে জিপে উঠলেন।
ওঁর জিপ নারায়ণপুরের দিকে চলে গেলে, তিতির বলল, সব অত্যাচার সহ্য হয় কিন্তু যে মানুষের গলাতে সুর নেই তার গান শোনা অসহ্য।
ভটকাই বলল,–গান কী বলছ তিতির, বলো মেশিন গান। যে গানে অনন্ত গুলি, একটার-পর-একটা বেরিয়েই যাচ্ছে, শ্রোতারা যে গুলিতে, থুরি, গানে গানে একেবারে কঁঝরা হয়ে যাচ্ছে, সেই বোধও নেই গায়কের। একটা দুটো বেসুরো গান তবু সহ্য হয়, ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা এরকম বেসুরো গান সহ্য করা মহামানবের পক্ষে সম্ভব। আমাদের মতো সামান্য মানুষের পক্ষে অসম্ভব।
ঋজুদা বলল, সবরকম বিপদই ফেস করতে হয়। আমি তো জানতাম যে মানুষখেকো চিতা মোকাবিলা করতে গিয়ে রুদ্র বেঁচে গেল, তোদের দুজনকে যে কী বিপদের মধ্যে ফেলে গেলাম সে আমি ভাল করেই জানতাম।
চলো, এবার শুয়ে পড়া যাক।
ঋজুদা বলল, আমি ড্রইং কাম-ডাইনিং রুমের সোফাটিতে শুচ্ছি, খুব পছন্দ। হয়েছে সোফাটা আমার। তোরা দুপাশের দুটো ঘরে শুয়ে পড়।
না, না, তা কী হয়! তুমি সোফাতে শোবে কী? আমরা, মানে আমি আর ভটকাই শুচ্ছি। তুমি ঘরে যাও।
তিতির বলল, ঝামেলা করে কী হবে? আমিই বরং সোফাতে শুচ্ছি। ভটকাই আর রুদ্র একঘরে আর তুমি একঘরে শুয়ে পড়ো ঋজুকাকা।
ঋজুকাকা বলল, যা অর্ডার করছি তাই কর। বলেছি যে, দলে নেতা একজনই থাকে। নইলে সে-দল জগদ্দল হয়ে যায়। আমাকে তোরা শুধু একটা কম্বল আর বালিশ দিতে বল চৌকিদারকে।
কেন আমার ঘরেই তো আছে। ডাবল বেড খাট তো। তারপর বলল: তুমি তো আমার পাশেই শুতে পারতে ঋজুকাকা।
পারতাম। স্বচ্ছন্দেই পারতাম। কিন্তু তুই বড় হয়েছিস, খাটটাও’ছোট, তোরই অসুবিধে হবে আর আমারও অস্বস্তি হবে। সারা পৃথিবী যে নিয়ম মানে সেই নিয়মই মানা ভাল।
কী নিয়ম?
অন্য অনেকরকম অনিয়মই তো সারা দিনরাত করছি আমরা, এই যেমন ভটকাই চন্দ্রর ডিনার। পুরির ছোট বোন লুচিতে যে পরিমাণ গাওয়া ঘি দিয়েছে ভটকাই আজ রাতেই না শর্মাশাহেবের হার্ট অ্যাটাক হয়।
ভটকাই বলল–পচরঙ্গ আচারটা কিন্তু জমে গেছিল। কীসের আচার ওটা।
জানিনা, বড়বাজারে পাওয়া যায়। খাদ্য অখাদ্য সব ফল, বিচি, আঁটি। মানে আমার ছোট পিসের ভাষাতে যা কিছুই ফ্যালানের জইন্য তার সবকিছুই ওর মধ্যে দেওয়া হয়। আর তেল লঙ্কা? ইরিবাব্বা। ইক্কেরে ফাসকেলাস।
ঋজুদা বলল, নাও, শুয়ে পড়ো এবারে।
দাঁড়াও তোমাকে কম্বল আর বালিশটা এনে দিই।
তিতির বলল।
শুয়ে ঘুম আসছিল না। চিতাটা কী করছে এখন তাই ভাবছিলাম। খুবই কি কষ্ট হচ্ছে বেচারার? নাকি গুলিটা বেজায়গায় লেগেছে? গুলি কি মিস করেছি? নাঃ, তা বোধহয় নয়। গন্তব্যে না-পৌঁছুলে গুলির আওয়াজের রকম অন্য। তা ছাড়া ঋজুদাও যখন বলেছে যে লেগেছে, তখন অবশ্যই লেগেছে।
তারপরে ভাবছিলাম, তিতির আমাদের এত বন্ধু, হরিহর আত্মা, সে বড় হয়ে গেছে বলেই তার সঙ্গে শোওয়া যাবে না এ কেমন নিয়ম। অথচ এটাও ঠিক যে কেউই দিদি বা মা বা পিসিমা জেঠিমা ছাড়া কোনও অনাত্মীয়ার সঙ্গে একসঙ্গে শোয় না। শুতে দেখিনি কখনও।
কী জানি জঙ্গলের নিয়মকানুন তবুবুঝতে পারি। শহরের মনুষ্য সমাজের নিয়ম কানুনের মানে বুঝি না কোনও। তিতিরের সঙ্গে শুলে সারারাত পুটুর পুটুর করে কত গল্প করতে পারতাম আমরা। একদিন আমার মামাতো বোন মুমুর সঙ্গে শুতে চেয়েছিলাম কুইজ নিয়ে আলোচনা করে রাত কাবার করব বলে, মা চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন, না।
কেন না মা?
তর্ক কোরো না বড়দের মুখে মুখে। না বলছি, না।
আমাদের দেশে বড়রা বেশি বেশি বড়। বিদেশে, বিশেষ করে পশ্চিমি দেশে, মা বাবা ছাড়া আর সব বড়দের সবাই নাম ধরে ডাকে, ডিক, হ্যারি, ন্যান্সি, জোয়ান, জুনিপার আর ছোটদের সকলেই বড়র মতোই ইম্পর্ট্যান্স দেয়। ছোট বলেই যে এলেবেলে, ফালতু এমন মনে করে না তারা, তারা বিদ্যা-বুদ্ধিতে বয়সে ছোটদের থেকে যত বড়ই হোকনা কেন।
বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান আছে না একটা, প্রতিবছর বৈশাখ এলেই সেই গানের কথা মনে পড়ে যায়। যদিও বৈশাখ আসেনি এখনও।
‘বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ/আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ/স্বপ্নশেষের বাতায়নে হঠাৎ আসা ক্ষণে ক্ষণে আধো ঘুমের প্রান্ত ছোঁওয়া বকুলমালার গন্ধ।…’
আমরা বারান্দাতে বসে চা খাচ্ছি। ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে তিতিরকে বলল, আরেক কাপ চা ঢাল তো তিতির। দারুণ ভাল চা তো! বস্তারের এই পাণ্ডববর্জিত জায়গাতে এরকম দার্জিলিং লপচু চা-এর কথা ভাবা পর্যন্ত যায় না।
তিতির বলল,– শর্মাসাহেবের স্ত্রী উষাদেবী দিল্লির মেয়ে। মিরান্ডা হাউসে পড়াশোনা করা খুব শৌখিন মহিলা, আমি মিশেই বুঝেছি। এসব ওরই জন্য।
ঋজুদা কাল রাতেই চৌকিদারদের বলে দিয়েছিল যে তাদের মধ্যে একজন সকালের আলো ফুটলেই ছোটিভোঙ্গরি গ্রামে গিয়ে খবর দিয়ে আসবে যে চিতাটার চোট হয়েছে এবং ওই শালবনেই পুটুস বা বেশরম ঝোপের মধ্যে কোনও ছায়াচ্ছন্ন জায়গায় সে রাত কাটিয়েছে নিশ্চয়ই। সকালে প্রাতঃকৃত্য করতে-করতে যারা যাবে তারা সকলেই ওই দিকটা যেন এড়িয়ে চলে। এও বলতে বলেছে যে, যদি কোয়া করা মনস্থ করেন সাহেবরা তবে তোমাদের জনা কুড়ি মানুষকে অন্তত হাঁকোয়াতে সামিল হতে হবে। কোয়া করা হবে কি না এবং হলে কখন তা করা হবে তা তোমরা জেনে যাবে। গাঁওবুড়া যেন বাংলোতে সকাল সকালই এসে দেখা করে যায়।
চৌকিদারেরা যে খবর দিয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ আমাদের চা খাওয়া শেষ হবার আগেই গাঁওবুড়া এবং তার সঙ্গে ছেলেটির বাবা ও দাদা এসে হাজির।
ঋজুদা তাদের বলল, আজকে তোমরা দেহ পাবে। খুব সম্ভব চিতা কাল আর খায়নি কিছুই সেই মড়ি থেকে। তবে তোমরা ওখানে এখুনি যেয়ো না।
ওরা উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল, গুলির শব্দ শুনেছিল রাতে, তার কী হল?
কী হল তা তারা চৌকিদারের কাছ থেকে আগেই নিশ্চয়ই জেনেছিল। কিছুই যে হয়নি, মানে মানুষখেকো মারা যে পড়েনি সে খবর তারা পেয়ে গেছে। বাঘ যে আহত হয়েছে, সে খবরও এখন যাকে বলে ফ্রম দ্য হর্সেস মাউথ শুনতে চায় আর কী?
ঋজুদা আমাকে দেখিয়ে বলল–ঈ বাবুনেহি কাল রাতমে গোলি কিয়া থা। গোলি লাগাভি হ্যায় মগর চিতা মরা নেহি। আজ উসকি ইন্তেকাল হোগা।
ইন্তেকাল শব্দটা উর্দু। ওরা ঠিক বুঝল বলে মনে হল না।
ঋজুদা খোলসা করে বলল,আজ উসকো খতম করেগা হামলোগোঁনে।
আপ খুদ যাইয়েগা তো সাহাব? আপ যানেসে উও দুশমন জরুর পিটা যায়গা।
ঋজুদা আমাদের ইমেজ বিল্ডিংয়ের জন্য ওদের কাছে বড়মুখ করে বলল, ঈ সাব লোগ ঔর মেমসাহেবভি বহত আচ্ছা শিকারি হ্যায়। উনলোক মুঝকো মদত দেতে হ্যায়।
বলল বটে, তবে গ্রামের লোকেদের আমাদের দেখে বিশেষ ভক্তি জাগল বলে মনে হল না।
তারপর ঋজুদা আমাদের দিকে ফিরে পাইপ থেকে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আমি ভাবলাম, অন আ সেকেন্ড থট যে, বিটিং করানোর ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক হবে না। বিটারদের মধ্যে একাধিক মানুষের জখম হবার এমনকী মারা যাবারও আশঙ্কা আছে। একজন তো মরেইছে অন্যদেরও মরতে দেওয়াটা ঠিক হবে না। আমরা চারজনই যথেষ্ট।
তারপর বলল, আরও ঠিক করেছি যে সকালেই ব্রেকফাস্ট করে যাব না আমরা।
ভটকাই-এর দিকে ফিরে বলল,–তুই ব্রেকফাস্ট কাম লাঞ্চ ব্রাঞ্চ অর্গানাইজ কর কিচেনে গিয়ে। আমরা সাড়ে দশটা নাগাদ সারা দিনের মতো তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ব। যাতে প্রয়োজনে সূর্য ডোবা অবধি জঙ্গলে থাকতে পারি। চিতাটা কতদুর গেছে, তার চোট কতখানি মারাত্মক হয়েছে তা তো জানি না আমরা। তবে পয়েন্ট থার্টি-ও-সিক্স রাইফেলের মার, শরীর এফোঁড় ওফোঁড় যদি হয়ে গিয়ে থাকে তবে মরবে সে নিশ্চয়ই। তবে কতক্ষণ পরে সেই হচ্ছে কথা। আমি চাই একটু দেরি করে যেতে যাতে আরও রক্তপাত হয়, আরও দুর্বল হয়ে পড়ে যাতে। সে যত দুর্বল হবে ততই আমাদের মঙ্গল এবং সুবিধা তাকে শেষ করার।
তিতির বলল, হাউ আনকাইন্ড না? কোথায় জানোয়ারকে তাড়াতাড়ি শেষ করে তাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেব আমরা, না আমাদের সুবিধার জন্যে তার কষ্ট আরও বাড়াচ্ছি।
ঋজুদা বলল, কী করা যাবে। চিতাটা যে মানুষখেকো এবং ডেসপারেট। এ ব্যাপারে আমি কোনও রিস্ক নিতে চাইনা। আজই এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই নাটকের শেষ দেখতে চাই আমি। তবে আমরা খুবই ভাগ্যবান যে জঙ্গলে এসে মানুষ-মারার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে গেল আমাদের। মানুষখেকো চিতা মারতে কত সময় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, এমনকী বছরের পর বছরও লেগে যায়। মানুষখেকো বাঘ মারার চেয়ে চিতা মারা অনেক কঠিন। কারণ চিতারা গ্রামের আশেপাশে থাকায় মানুষের আদব কায়দার সঙ্গে অনেকই বেশি পরিচিত থাকে। তাই তারা মানুষ ধরা আরম্ভ করলে প্রচণ্ড ধূর্ত হয়ে ওঠে। মানুষখেকো বাঘ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিকার ধরে দিনের বেলাতে আর মানুষখেকো চিতা রাতের বেলাতেই ধরে। তাই ওই নিশাচর মানুষখেকো মারা অনেক হ্যাঁপা।
জিম করবেটের ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’ কে না পড়েছে?
তিতির বলল।
তারপর বলল, তোমাকে ভুগিয়েছিল সবচেয়ে বেশি কোন চিতা। মানে কতদিন ভুগিয়েছিল?
পান্নার চিতা। সে প্রায় দেড় বছর। তবে আমি তো একসঙ্গে দেড় বছর সময়। দিতে পারিনি। এসেছি, ফিরে গেছি, আবার এসেছি। তার দৌরাত্ম্য তো সমানেই ছিল। সে মানুষখেকো ঘোষিত হবার দেড় বছর পরে আমি তাকে মারার চেষ্টা আরম্ভ করি আর আরম্ভ করার দেড় বছর পরে তাকে মারতে পারি। তার মানে তিন-তিনটি বছর সে বহু গ্রামের মানুষদের সিঁটিয়ে রেখেছিল।
সেই গল্প বলবে একদিন আমাদের?
আমি বললাম।
ঋজুদা হেসে বলল,–সে গল্প তো একদিনে বলা যাবে না। দিনে দুঘণ্টা করে বললেও সাতদিন লাগবে কম করে।
তিতির বলল,–ঋজুদার কাছে শুনে পান্নার লেপাৰ্ডির গল্পটা লিখে ফেলো রুদ্র। একটি আলাদা বই হয়ে যাবে, ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’-এর মতো।
ঋজুদা সিটিং দিলে তো অতগুলো।
ঋজুদা হেসে ফেলে বলল, দেখা যাবে। তবে যা ভটকাই, তুই কিচেনে চলে যা। যার যেখানে জায়গা। এবার থেকে তোর নাম বদলে করে দেব নো।
ননা কেন? এত নাম থাকতে না কেন?
ওড়িশাতে সব খাবার দোকানের মালিকদেরই ‘ননা’ বলে। কেন বলে তা আমি জানি না। তুই তো আর শিকারি বা অ্যাডভেঞ্চারার নোস। এখন তো খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেই তোর বেশি উৎসাহ দেখি। তাই তোর নাম নো। নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারলি। তবে ননা নামটা পছন্দ না হলে তোকে কিচেন ম্যানেজার’ এমনকী ‘কোয়ার্টার মাস্টার’ বলেও ডাকতে পারি। তোর যেমন খুশি।
ভটকাই উঠে পড়ে বলল, হায় কপাল। যাদের জন্যে চুরি করি তারাই বলে চোর।
তারপরে আমাদের দিকে ফিরে বলল, তোরা কী বলিস?
আমরাও ঘাড় নাড়লাম।
কাটার উপর নুনের ছিটে পড়ল।
.
ব্রেকফাস্ট কাম-লাঞ্চ বা ব্রাঞ্চ খাবার পরে আমরা জিপে উঠে বসলাম। আমাদের জন্যে আলাদা জিপ ছিলই। শর্মাসাহেব তার নিজের জিপ নিয়েই গেছিলেন নারায়ণপুরে ফিরে। জিপটা বড় রাস্তা ধরে যতদূর যেতে পারে গিয়ে আমাদের নামিয়ে দিল। ঋজুদা ড্রাইভারকে বলল, কোনও বড় গাছের ছায়াতে জিপটা লাগিয়ে তুমি জিপেই থাকো। গুলি খাওয়া চিতা তাড়া খেয়ে যে এদিকে আসবে না তার ঠিক কী? তাই জিপ থেকে নেমে বাইরে থাকার দরকার নেই।
ঋজুদার হাতে ঋজুদার ডাব্লু ডাব্লু গ্রিনারের পয়েন্ট বারো বোরের বত্রিশ ইঞ্চি ব্যারেলের দোনলা বন্দুক। ডাবল ইজেক্টর, ডাবল লক। চমৎকার মারে বন্দুকটা। ব্যারেল বত্রিশ ইঞ্চি হওয়াতে রেঞ্জও অনেক বেশি। ডাবল ব্যারেল বন্দুক ছাব্বিশ বা চব্বিশ ইঞ্চিরও হয়। সেসব যেমন দেখবার মতো, বত্রিশ ইঞ্চি বন্দুকও দেখবার মতো।
আমার হাতে ঋজুদার পয়েন্ট থার্টি-ও-সিক্স সিঙ্গল ব্যারেল রাইফেল। অস্ট্রিয়া থেকে জেঠুমনি ইমপোর্ট করিয়েছিলেন। তিতিরের হাতে ঋজুদার ইংলিশ পয়েন্ট টু সেভেন্টি ফাইভ সিংগল ব্যারেল রাইফেল। আর ভটকাই-এর হাতে ঋজুদার নতুন কেনা ইন্ডিয়ান অর্ডিনান্স কোম্পানির পয়েন্ট থ্রি ফিফটিন রাইফেল।
এতগুলো অস্ত্র নিয়ে তো আর একসঙ্গে চিতাকে মারা হবে না। যে প্রথমে দেখতে পাবে, সেই গুলি করবে এমনই নির্দেশ ছিল ঋজুদা। তবে বারবার সাবধান করে দিল সবাইকেই, খুবই সাবধানে এগোবার জন্যে। আমি আর ঋজুদা রক্তের দাগ অনুসরণ করে পাশাপাশি যাব চার-পাঁচ হাত তফাতে। ওরা আসবে আমাদের পনেরো কুড়ি হাত পেছনে পেছনে কিন্তু দুজনে থাকবে অন্যর তিরিশ হাত তফাতে। মানে, একজন থাকবে আমাদের বাঁদিকে, একজন ডানদিকে। গুলি প্রথমে করব আমি অথবা ঋজুদাই। যদি আমাদের গুলিতে চিতা না পড়ে এবং আমাদের টপকে পেছনে চলে যায় তবে ওরা গুলি করবে।
কাল রাতে যেখানে আমি গুলি করেছিলাম সেখানে পৌঁছে দেখলাম একটি শিশু গাছের গুঁড়িতে চিতার এক দলা মাংস লোমশুদ্ধ আটকে আছে।
ঋজুদা বলল,কিমা বানিয়ে দিয়েছিস দেখছি। তোর গুলি চিতার শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে হয়তো। আবার হয়তো চামড়া ছুঁয়েও চলে যেতে পারে। চামড়া ছুঁয়ে চলে গেলে কপালে দুর্ভোগ আছে। তবে মনে হয় এফোঁড় ওফোঁড়ই করে গেছে। নইলে চিতাটা লাফাত না অতখানি। আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই চৌকিদারেরা ছোটিডোঙ্গরি গাঁয়ের লোকেদের নিয়ে ছেলেটির শব নিতে এল।
ঋজুদার দিকে তাকাতে ঋজুদা বলল,-হায়েনা বা শেয়ালে খেয়ে থাকবে। ও চিতা ফিরে আসেনি যে সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত।
সেই ভিড়ের মধ্যে ছেলেটির বাবা ও দাদাও ছিল। তারা নতুন কাপড়ে মুড়িয়ে শব উঠিয়ে নিল। শব-এ তখন দুর্গন্ধ হয়ে গেছে। পরশু রাতে মেরেছে চিতাটা ছেলেটিকে দুর্গন্ধ হবারই কথা। ফুলেও গেছে শব। তিতির ওডিকোলন মাখানো রুমালে নাক চেপে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রইল। উলঙ্গ বীভৎস ছেলেটির দিকে তার চাইতে হয়তো লজ্জাও করছিল। শত হলেও সে মেয়ে তো।
একটু এগোতেই রক্তর দাগ পাওয়া গেল। তবে সামান্য। তারও পরে রক্তের দাগ আর-একটু স্পষ্ট হল। ঘাসে, আশেপাশের ঝোপঝাড়ের পাতাতে লেগে আছে। রক্তের ছিটে দাগ। ডানদিকে একটি টিলা মতো ছিল। দাগটা সেদিকেই গেছে।
ঋজুদা আমার দিকে তাকিয়ে সেদিকেই এগোতে বলল।
আমি ভাবছিলাম, গুলি খেয়ে চিতা যদি এই টিলাতে চড়তে পারে তা হলে তার চোট এমন কিছু মারাত্মক হয়নি মনে হয়। তার মানে সে ঝামেলা করবে।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সামনে ও দুপাশে দেখতে দেখতে আমরা খুব আস্তে আস্তে হাঁটি আঁটি পা পা করে সামনে এগোচ্ছি। বনের মধ্যে তখন কোকিল ডেকে চলেছে। তবে মার্চেরর ভোরের হাওয়া এখন আর ঠান্ডা নেই। একটু একটু গরম হয়েছে সে হাওয়া। হাওয়াতে ফিসফিসানি তুলে কিছু শুকনো পাতা ঝরঝর শব্দ তুলে গড়িয়ে যাচ্ছে রুখু পাথর শুকনো জমির উপরে। হাওয়াতে এখনও মহুয়ার গন্ধ আছে। সালফি গাছ তো পাম গাছের মতো, তাতে ফুল ফোটে কি না জানি না। ফুটলেও গন্ধ হয় কি না জানি না। বাতাসে আরও নানা ফুলের গন্ধ, পাতার গন্ধও আছে। দিনে রাতের সবসময়েই বনের গায়ের একটা আলাদা গন্ধ থাকেই। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সে নতুন নতুন সুগন্ধি মাখে।
কথাবার্তা বলা মানা। প্রতিটি পা হিসেব করে ফেলছি যাতে পায়ের নীচে শুকনো পাতা না গুঁড়িয়ে যায়, যাতে কোনওরকম শব্দ না হয়। ভাবছিলাম। কাছাকাছি কোথাও জল থাকলে চিতাটাকে তার কাছেপিঠে যাওয়া যাবে। আহত হলে সকলেরই পিপাসা জাগে।
জিপ থেকে নেমেছি প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ছোট টিলা বা এখানকার ভাষাতে ডোঙ্গরির প্রায় মাথাতে উঠে এসেছি আমরা অনেকটা আন্দাজেই। রক্তের দাগ যে সবসময়ে পাচ্ছি এমন নয়। কিছুটা দূর-দূর পাচ্ছি। জানোয়ারের গায়ে গুলি লাগলে তাদের চামড়া কিছুক্ষণ বাদে সেই ক্ষতকে আবার ঢেকেও দেয়। কতখানি ঢাকতে পারে তা ক্ষতর রকমের উপরে নির্ভর করে।
টিলার উপরে পৌঁছে ঋজুদা ও আমি চারধারে ভাল করে চেয়ে এর পরে কী করা যায় তাই ভাবছিলাম। টিলাটার নীচে দেখলাম একটি অতি ক্ষীণ ধারায় বয়ে যাওয়া নালা আছে। তার জল অতি সামান্য। তবু তৃষ্ণা মেটানোর জন্যে যথেষ্ট। তা ছাড়া নালার দুপাশে বড় গাছ তো আছেই ঝোপঝাড়ও বেশি। হয়তো জল যাবার জন্যেই। ওই জলের পাশের ছায়াচ্ছন্ন জমিতে চিতাটার লুকিয়ে থাকাটা আশ্চর্য নয়। রাতে অন্য কোথাও থাকলেও রোদের হাত থেকে বাঁচতে তার এখন এমনি জায়গারই দরকার।
ঋজুদা হাতছানি দিয়ে ভটকাই আর তিতিরকে ডাকল। ওরা আস্তে আস্তে আমাদের কাছে উঠে এলে ঋজুদা তার প্ল্যানটা বলল আমাদের। বলল, আমি আর রুদ্র যেখানে আছি, এই জায়গাতে তোরা জঙ্গলে দুটি গাছের আড়ালে বসে পড়। আমি আর রুদ্র টিলা থেকে কিছুটা নেমে ঘুরে ওই নালার ওপাশে চলে যাচ্ছি। আমার ধারণা চিতাটা ওই জলের কাছেই আছে। আমার ও রুদ্রর চোখে পড়লেই গুলি করব যে আগে দেখতে পাব। সে এই টিলা ধরেই উঠে আসবে। তখন তার পথ আগলে বসে থাকা তোরা গুলি করবি। কে মারল তা নিয়ে বাহাদুরি পরে করবি। দুজনে একসঙ্গে দেখতে পেলে একসঙ্গেই গুলি করবি এবং চিতাটাকে ওখানেই শুইয়ে দিবি। সে যেন আর ত্যান্ডাই-ম্যান্ডাই করতে না পারে।
তারপর আমাদের সকলকেই বলল, ক্লিয়ার? বুঝেছ তো ঠিকমতো? এনি কোয়েশ্চেনস?
আমরা সবাই মাথা নেড়ে জানালাম, না কোনও প্রশ্ন নেই। তারপর আমি আর ঋজুদা দুজনে পাহাড়টার দুপাশে নেমে যেতে শুরু করলাম সাবধানে। ওপর বেয়ে নামাটা অনেক কঠিন, বিশেষ করে নিঃশব্দে যদি নামতে হয়।
আমরা ওখান থেকেই নামলাম, আরও এগিয়ে না-গিয়ে, যাতে চিতা জলের কাছে থাকলেও আমাদের দেখতে বা শুনতে না-পারে। আমরা দুপাশ দিয়ে জলটাও পেরিয়ে গিয়ে তাকে পেছন থেকে আক্রমণ করার চেষ্টা করব।
এখন জঙ্গলের মধ্যে মাঝে মাঝে ছাতারে পাখিদের ছ্যাঃ ছ্যাঃ আর বুলবুলির শিস ছাড়া অন্য শব্দ বিশেষ নেই। তবে হাওয়ার শব্দ আছে। হাওয়াটা ধীরে ধীরে গরম আর জোর হচ্ছে। বস্তারের এই অঞ্চলে এপ্রিলের শুরু থেকেই লু-এর মতো হাওয়া বইতে শুরু করে। সূর্যটাও গরম হচ্ছে ক্রমশ। মাথার টুপিটা নামিয়ে নিলাম ডানদিকে কাত করে।
পনেরোকুড়ি মিনিটের মধ্যে আমরা পাহাড়ের নীচে নেমে এলাম। তারপর আরও দু-তিনশো গজ জঙ্গলে গিয়ে নদীটা পেরোলাম। উপর থেকে নদীটাকে যেন রুগণ মনে হয়েছিল, তা নয়। কোথাও কোথাও বেশ ভাল জল আছে। এই নালাটার নাম কী, তা কে জানে। কিন্তু এই নালাটাই চলে গেছে ছোটিডোঙ্গরি গ্রামের দিকে এঁকে বেঁকে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। নালাটা পেরোতে গিয়ে আমার বাটা কোম্পানির হাঁটার জুতোজোড়া ভিজে গেল। জিনসের ট্রাউজারের নীচটাও ভিজল। তবে গরমের মধ্যে কাপড় আর রাবারের জুতো ও জিনস ভিজে যাওয়াতে আরামই লাগছিল। তা ছাড়া চলতে ফিরতে শব্দও কম হবে।
নদীটা পেরিয়ে আরও পঞ্চাশ গজ গিয়ে তারপরে ঘুরে নদীর দিকে আসতে লাগলাম। ঋজুদা কী করল জানি না। ঋজুদাকে দেখতে তো পাচ্ছিলাম না। সেও আমাকে দেখতে পাচ্ছিল না।
নদীর দিকে আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। এদিকেও শালবন। পায়ের কাছে শাল চারার জঙ্গল। মধ্যে মধ্যে অন্য গাছও আছে বিজা, ধ, অর্জুন, খয়ের, মহুয়া ইত্যাদি। এবারে নদীর খুব কাছে চলে এসেছি। যত কম সময়ে কথাটা বলা গেল কাজটা তত কম সময়ে হল না। অতটুকু আসতে পনেরো থেকে কুড়ি মিনিট লাগল। নদীর খুব কাছে চলে এসেছি এমন সময় হঠাৎ একটা মাছরাঙা নদীর দিক থেকে এবং জঙ্গলের গভীর থেকে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে আমাকে একেবারে চমকে দিয়ে বাইরে এল। সঙ্গে সঙ্গে একদল ছাতারে, ইংরাজিতে যাদের বলে ব্যাবলার, সমস্বরে ছ্যাঃ ছ্যাঃ করে ডেকে উঠল। মুহূর্তের জন্যে আমি দাঁড়িয়ে পড়ে আবার খুব সাবধানে রাইফেল রেডি পজিশনে ধরে একপা একপা করে এগোতে লাগলাম নদীর দিকে, ছায়াচ্ছন্নতার দিকে।
নদীর বালি দেখা যাচ্ছে এখন। নদী মানে, পাহাড়ি জায়গায় যাকে বলে নালা। হিমালয়ে ঝোরা। আরও দশ পনেরো পা যাবার পরে নির্জন নদীর ছায়াচ্ছন্ন বালিতে যখন পা দিয়ে দাঁড়িয়েছি তখন হঠাৎই চোখে পড়ল সামনের একটা বিজা গাছে। গাছটার গুঁড়িতে রক্তের দাগ। সেই দাগ অনুসরণ করে দেখি গাছটার মোটা কাণ্ডেও রক্তের দাগ। আমার মাথার উচ্চতারও উপরে। হতবাক হয়ে গিয়ে ব্যাপারটা কী হতে পারে ভাবছি। মুখটা গাছের আরও ওপরে তুলতেই দেখি চিতাটা দুটো মোটা ডালের সঙ্গমে শুয়ে আছে কোনাকুনি। তাকিয়ে আছে তার হলুদ কালো চোখে আমাদের দিকে। আমি রাইফেল তার দিকে তোলার আগেই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপরে। রিফ্লেক্স অ্যাকশানে আমিও গুলি করলাম সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু বাঘটা ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়তে আমার গুলি তার উড়ন্ত শরীরের তলপেটে লাগল। ট্রিগার টানতে টানতেই আমি একঝটকাতে বাঁদিকে সরে গেছিলাম তবু তার দাঁত আমাকে না-পেয়ে তার ছড়ানো ডান থাবা আমার বাঁ-বাহুমূলে এসে পড়ল এবং সেই ধাক্কাতে আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। বোল্ট টেনে গুলি রিলোড করতে যাওয়ার আগেই চিতাটা মাটিতে পড়ে ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে, আমার থেকে হাত চারেক দূরে এবং পেছনের দুপায়ে ভর করে সে আমাকে চিবিয়ে শেষ করার জন্যে এবারে ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপরে। মাটি থেকে উঠে পড়লেও রাইফেল রিলোড করার সময় আমি তখনও পাইনি। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে পরপর দুটো গুলি হল অদৃশ্য থেকে এবং চিতাটা কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হতভম্ব আমি রাইফেল রিলোড করে চিতার ঘাড়ে নিশানা নিয়ে ট্রিগার গার্ডে আঙুল ছুঁইয়ে রেখে দেখলাম, ঋজুদা একটা মোটা শাল গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে দাঁড়াল। ঋজুদা আমার প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে ছিল। তার অব্যর্থ লক্ষে পরপর দুটি এল. জি. মারাতেই এ-যাত্রা আমি প্রাণে বেঁচে গেলাম। তবে বাঁ-বাহুমূলের ক্ষতটা ঠিক কী ধরনের হয়েছে তা নারায়ণপুরের ছোট হাসপাতালে না গেলে বোঝা যাবে না। গরম পড়ে গেছে। বেশি দেরি করলে নখের ক্ষততে গ্যাংগ্রিন হয়ে যেতে পারে। তাহলে হাত কেটে বাদও দিতে হতে পারে।
ঋজুদা এগিয়ে আসছিল আমার দিকে। আমার বাঁ-হাতটা ভিজে গেল রক্তে। তারপর রক্ত বুকে ও পেটে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
ঋজুদা বলল, উঠে দাঁড়া। কী এমন হয়েছে কী? তুই যে গুলি করে কত যন্ত্রণা দিলি এত ঘণ্টা। তা সে কি তার প্রতিশোধ নেবে না?
আমি রাইফেলের বাটে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ঋজুদা বলল, চল এবারে বড় রাস্তার দিকে। লেপার্ড এখানেই পড়ে থাক। যাদের ছেলেকে সে খেয়েছিল তারা দেখুক এসে। আমরা সোজা নারায়ণপুরে যাব তোকে নিয়ে। মালপত্র সব ছোটিডোঙ্গরি বাংলোতে থাকুক এখন। শর্মাসাহেবের জিপ এসে চিতাকে আর সব মালপত্র নিয়ে যাবেখন। চিতাটাকে নারায়ণপুরে পি. ডাব্লু. ডি. বাংলোর হাতাতে স্কিন করব। ভাল করে দেখতে হবে, এত বড় লেপার্ডটা মানুষখেকো হয়ে গেল কেন?
লেপার্ডটা বিরাট বড়।
আমি বললাম।
নিশ্চয়ই। প্রায় টাইগারের মতো। তা ছাড়া বয়সেও যে খুব বুড়ো, এমন তো মনে হয় না দেখে।
ইতিমধ্যে হড়বড় খরবর শব্দ করে সাবধানতা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বেহিসাবের পতাকা উড়িয়ে তিতির আর ভটকাই লাফিয়ে লাফিয়ে আমাদের দিকে দৌড়ে নেমে এল টিলার উপর থেকে।
ঈসস! কী রক্ত!
তিতির উদ্বিগ্ন গলায় বলল।
আমি দেখলাম, ঋজুদা ওকে চোখ মেরে বলল, কিসসু হয়নি। চিতাটা একটু আদর করে দিয়েছে রুদ্রকে।
আমি বুঝলাম যে, পাছে আমি ঘাবড়ে যাই তাই ঋজুদার এই হরকতা ভটকাই। বলল, উরিঃ সাব্বাস! কী বড় চিতাবাঘ রে! ড্যাডি অফ অল গ্রান্ডড্যাডিজ।
ঋজুদা ভটকাই-এর হাত থেকে রাইফেলটা নিয়ে নিল, বলল, তুই রুদ্রর রাইফেলটা নে ওর হাত থেকে আর ওকে সাহায্য কর একটু। যত তাড়াতাড়ি আমরা বড় রাস্তাতে পৌঁছতে পারি ততই ভাল।
ভটকাই এসে আমার পাশে দাঁড়াল।
বলল, কনগ্রাটস।
আমি বললাম, কীসের জন্যে?
লেপার্ডটা মারার জন্যে।
আমি কোথায় মারলাম? মারল তো ঋজুদা। এই লেপার্ড ঋজুদারই। ঋজুদা ঠিক সময়ে আমাকে না বাঁচালে এতক্ষণে মুর্দা বনে যেতাম।
তিতির বলল পাকাবুড়ির মতো, মরা বাঁচা যাঁর হাতে, তিনিই মারেন তিনিই বাঁচান। তিনিই চিতাটাকে মারলেন আর তোমাকে বাঁচালেন।
ঋজুদা বলল, তোদের এত করে শেখাই তবু তোরা শিকারের নিয়মকানুন এখনও শিখলি না। শিকারে নিয়ম হল, যে প্রথম রক্তপাত ঘটাবে বাঘই হোক কি চিতাই হোক তা সেই শিকারির তা সে যদি লেজের ডগায় গুলি করে রক্তপাত ঘটায় বা শুধু একটা কানের পাতা ফুটো করে দেয়, তাহলেও এই লেপার্ড রুদ্রর।
আমরা টিলাটার উপরে উঠে আসতেই দেখলাম ছোটিডোঙ্গরি গ্রামের বহু মানুষ জমায়েত হয়েছে এসে বড় রাস্তাতে জিপটার পাশে।
ঋজুদা পকেট থেকে রুমালটা বের করে পতাকার মতো নাড়তে নাড়তে তাদের এদিকে আসতে বলল। সেই সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে এল আমাদের দিকে। তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হল টিলা থেকে নামার পরেই। ঋজুদা তাদের ডিরেকশান দিয়ে দিল। বলল, চিতার গোঁফ-টোফ সব যেন লোপাট না হয়। তোমরা বাংলোতে নিয়ে গিয়ে চিতাটাকে রাখো, গ্রামের সবাইকে বলল ওখানে এসেই দেখে যাবে। তারপর ডি. এফ. ও. সাহেবের জিপে এলে তাতে তুলে দিও নারায়ণপুরে নিয়ে যাবার জন্যে। ওখানেই চামড়া ছাড়াব।
আমাদের জিপটা ছোটিডোঙ্গরি বাংলোর সামনে দাঁড়াল এক মিনিট। তিতির বলল, আমি এক মিনিট আসছি ঋজুকাকা।
এক মিনিটই কিন্তু।
আমার খুবই রক্তপাত হচ্ছিল। দুর্বল লাগছিল খুব। এতক্ষণ তেমন ব্যথা বোধ করিনি, এখন ক্রমশই ব্যথাটা বাড়ছে।
তিতির দৌড়ে ফিরে এল ওর ক্যামেরাটা নিয়ে।
ঋজুদা অর্ডার দিল, যত জোরে পার চালাও ড্রাইভার সাহেব। তাড়াতাড়ি নারায়ণপুরের হাসপাতালে পৌঁছতে হবে। সেখানে থেকে ফোন করে দেব শর্মাসাহেবকে।
শর্মাসাহেবের সঙ্গে আমাদের পথেই দেখা হয়ে যাবে স্যার। ওঁর ড্রাইভার কাল বলেছিল যে উনি দুপুরে ভাত খেয়েই এখানে আসবেন এতক্ষণে নিশ্চয়ই রওয়ানা দিয়ে দিয়েছেন নারায়ণপুর থেকে।
চলো তো। পথে দেখা হলে তো ভালই।
ভটকাই আর আমি পিছনে বসেছি। বলতে গেলে ভটকাই-এর গায়ে হেলান দিয়েই বসেছি আমি। ঋজুদা আর তিতির সামনে। বেচারি ভটকাই-এর
জামাকাপড় সব আমার রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
ভটকাই বলল, যাকগে। লোকের আমার উপর সহানুভূতি হবে। বলবে, ঈসস এত রক্ত। নিশ্চয়ই খুব লেগেছে আমারও।
ওই যন্ত্রণার মধ্যেও ওর ফিচলেমি দেখে হেসে ফেললাম।
তারপর ভটকাই হঠাৎই সাহেব হয়ে গিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল আমাকে, হাউ আর উ্য ফিলিং মিস্টার রুদ্র রায়?
সাহেবরা ব্যথা লাগলেও কাঁদুনি গায় না। ওদের কাছ থেকে শেখার আছে অনেককিছু। সহানুভূতি চায় না ওরা কথায় কথায়। তাই ভটকাই-এর ইংরেজি প্রশ্নের জবাবে আমিও ইংরেজ বনে বললাম, ফাইন। থ্যাঙ্ক ঊ্য।
হঠাৎই আমার মনে হল মাথাটা যেন হালকা হয়ে আসছে। আমার জ্ঞান চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
ভটকাই বলল, কী হল রে, রুদ্র?
আমি জবাবে কিছু বলতে পারলাম না। চোখ বুজে এল আমার, খুব পিপাসা পেতে লাগল কিন্তু সে কথাও বলতে পারলাম না কারোকেই।