চৌধুরীদের রথ

চৌধুরীদের রথ
ডান ধারে তার ধূলায় ধূসর তালমা হাটের পথ।
চামচিকে আর আরসূলারা নির্ভাবনায় বসি,
করছে নানান কল-কোলাহল রথের মাঝে পশি!
বাদুর সেথা ঝুলছে সুখে, বাহির জগৎখানি,
অনেক দিনই ত্যাগ করেছে তাদের জানাজানি।
গরুর বীরের মাথায় বসি পাঁকুড় গাছের চারা,
মেলছে শিকড়, তবু ঠাকুর দেয়নি কোন সাড়া।
কাঠের ঘোড়ার ঠ্যাং ভেঙেছে, খসছে রথের ছাদ,
আজো তবু কেউ করেনি ইহার প্রতিবাদ।

রাস্তা দিয়ে নানান রকম লোকের চলাচল;
নানান রকম আলাপ বিলাপ, নানান কোলাহল।
কেউ বা চাষী, কেউ বা ধনী, পরদেশী, কেউ দেশী,
ভাবে তারা সবার চেয়ে কাজের কথাই বেশী।
কেউ বা ভাবে, মোকদমায় হারিয়ে দিয়ে কার
বসত-বাড়ি করবে নিলাম বাঁশ-গাড়ীতে তার।
কেউ বা ভাবে, কি কৌশলে মেলি কথার জাল,
এক আনিতে আনবে টেনে ছয়পয়সার মাল।
যতই কেন ব্যস্ত থাকুক, যতই কাজের তাড়া;
হেথায় এলে সব ভুলে চায় রথের পানে তারা।
চাক ভাঙা আর বয়স মলিন চৌধুরীদের রথ,
তাদের পানে করুন চেয়ে শুধায় যেন পথ;-
শুধায় যেন, সেই অতীতের চৌধুরীদের কে,
ছুতোর ডেকে রঙিন এ রথ গড়লপুলকে!
আসল গাঁয়ের বৃদ্ধ পোটো, রঙিন তুলির সনে,
রেখায় রেখায় বাঁধল সে কোন সোনার স্বপনে।
রথের চূড়ায় উড়ল ধ্বজা, গাঁয়ের ছেলে-মেয়ে,
চলতে পথে থাকত খানিক রথের পানে চেয়ে।

তারপরে সে রথের দিনে হাজার লোকের মেলা,
দোকান পসার, ভোজবাজী আর ভানুমতীর খেলা,
আসত গাঁয়ের বৌ ঝিরা সব, আসত ছেলে-মেয়ে,
রঙিন হাসির দুলত লহর রঙিন কাপড় ছেয়ে।
বুড়ো মাসীর স্কন্ধে উঠে ছোট্ট শিশু ছেলে;
এই রথেরি ঠাকুরটিরে দেখত আঁখি মেলে।
গাঁর বধূরা ভালের সিদুর মেলে পথের পরে
সরল বুকের আঁকত পূজা এই ঠাকুরের তরে।
আঁচল তাদের জড়িয়ে ধরে ছোট্ট শিশুর দল,
তালের পাতার বাজিয়ে বাঁশী করত কোলাহল।
দৌড়ের নাও ভাসত গাঙে, রঙিন নিশান লয়ে,
গলুই ভরি জ্বলত পিতল নব-রতন হয়ে।
তাহার গলে পরিয়ে দিত রঙিন সোলার মালা,
এমনি মত হাজার নায়ে গাঙটি হত আলা।
সেই নায়েতে বাছ খেলাত গাঁয়ের যত চাষী;
বৈঠা পরে বৈঠা হাঁকি চলত তারা ভাসি।
তারি তালে গাইত তারা ভাটির সুরে গান,
শুনে নদী উথল পাথাল, ঢেউ ভেঙে খান খান।
কৌতুহলী দাঁড়িয়ে তীরে হাজার নয়-নারী,
হাতে তাদের দুলত মালা গলায় দিতে তারি,
যাহার তরী সব তরীরে পেরিয়ে যাবে আগে,
তারে তারা করবে বরণ মনের অনুরাগে।

সে সব আজি কোথায় গেল, চৌধুরীদের রথ,
আজো যেন শুধায় সবে তাদের চলা-পথ।
চাকাগুলো ভেঙেছে তার উই ধরেছে কাঠে,
কোন অভিযোগ বক্ষে লয়ে সময় তাদের কাটে!
ছবিগুলো যাচ্ছে মুছে, ভাঙা কদম ডাল,
ত্যাগ করিয়া পালিয়ে গেছে নিঠুর বংশীয়াল।
তলায় বসে একলা রাধা কাঁপছে পুলকে,
জানতে আজো পায়নি তাহার বন্ধু নিল কে।
মাঠের পথে চলছে ধেনু বিরাম নাহি হ্যয়,
রাখাল কবে ঠ্যাং ভেঙেছে, কেউ না ফিরে চায়।
দল বাঁধিয়া চলছে কোথায় গাঁয়ের ছেলে-মেয়ে,
মৃদঙ্গ আর ঢোল বাঁজায়ে বাঁশীতে গান গেয়ে।
হয়ত কোন পরব গাঁয়ের করবে সমাপন,
হাজার বরষ আগেই তাহার করছে আয়োজন।
কারো কাঁধের ঢোল ভেঙেছে কাহারো একতারা,
দলপতি যে নেইক সাথে, টের পায়নি তারা।
এমনি কালের কঠোর ঘায়ে দিনের পরে দিন,
এ সব ছবির একখানিকরও থাকবেনাক চিন।
এর সাথে সেই গাঁয়ের পোটো, -তাহার কথাও সবে,
ভুলে যাবে অজানা কোন দিনের মহোৎসবে।
কোন সে অতীত আঁধার সাগর, তাহারপারে বসি,
এঁকেছিল সোনার স্বপন বরণ ঘষি ঘষি।
হয়ত তারি গাঁয়ের যত নর-নারীর দল,
মনে তাহার ফুটিয়েছিল স্বপন শতদল;
তারি একটি সোনার কলি আলোক- তরীর প্রায়,
সপ্ত সাগর পার হইয়া ভিড়ছে রথের গায়!
আজ হয়ত অনাদরেই অনেক অভিমানে,
চলছে ফিরে প্রদীপ তরী সেই অতীতের পানে;
সেখানে সেই বৃদ্ধ পোটো বনস্পতির প্রায়,
হাজার শাখা এলিয়ে বায়ে ঢুলছে নিরালায়।
চাক ভাঙা আর বয়স মিলন চৌধুরীদের রথ,
আজো যেন চক্ষু মুদে খুঁজছে তাদের পথ।
বনের লতায় গা ছেয়েছে, গাছের শাখা তারে,
জড়িয়ে ধরে এ সব কথা শুনছে বারে বারে।

1 Comment
Collapse Comments

khub valo laglo dukher onto dekhe….

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *