২৮
সেদিন রাত্রিজাগরণ ও প্রবল আবেগের পরে সকালবেলায় মহেন্দ্রের শরীর-মনে একটা অবসাদ উপস্থিত হইয়াছিল। তখন ফাল্গুনের মাঝামাঝি, গরম পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। মহেন্দ্র অন্যদিন সকালে তাহার শয়নগৃহের কোণে টেবিলে বই লইয়া বসিত। আজ নীচের বিছানায় তাকিয়ায় হেলান দিয়া পড়িল। বেলা হইয়া যায়, স্নানে গেল না। রাস্তা দিয়া ফেরিওয়ালা হাঁকিয়া যাইতেছে। পথে আপিসের গাড়ির শব্দের বিরাম নাই। প্রতিবেশীর নূতন বাড়ি তৈরি হইতেছে, মিসিত্র-কন্যারা তাহারই ছাদ পিটিবার তালে তালে সমস্বরে একঘেয়ে গান ধরিল। ঈষৎ তপ্ত দক্ষিণের হাওয়ায় মহেন্দ্রের পীড়িত স্নায়ুজাল শিথিল হইয়া আসিয়াছে; কোনো কঠিন পণ, দুরূহ চেষ্টা, মানস-সংগ্রাম আজিকার এই হালছাড়া গা-ঢালা বসন্তের দিনের উপযুক্ত নহে।
“ঠাকুরপো, তোমার আজ হল কী। স্নান করিবে না? এ দিকে খাবার যে প্রস্তুত। ও কী ভাই, শুইয়া যে! অসুখ করিয়াছে? মাথা ধরিয়াছে?” বলিয়া বিনোদিনী কাছে আসিয়া মহেন্দ্রের কপালে হাত দিল।
মহেন্দ্র অর্ধেক চোখ বুজিয়া জড়িতকণ্ঠে বলিল, “আজ শরীরটা তেমন ভালো নাই–আজ আর স্নান করিব না।”
বিনোদিনী কহিল, “স্নান না কর তো দুটিখানি খাইয়া লও।” বলিয়া পীড়াপীড়ি করিয়া সে মহেন্দ্রকে ভোজনস্থানে লইয়া গেল এবং উৎকণ্ঠিত যত্নের সহিত অনুরোধ করিয়া আহার করাইল।
আহারের পর মহেন্দ্র পুনরায় নীচের বিছানায় আসিয়া শুইলে, বিনোদিনী শিয়রে বসিয়া ধীরে ধীরে তাহার মাথা টিপিয়া দিতে লাগিল। মহেন্দ্র নিমীলিতচক্ষে বলিল, “ভাই বালি, এখনো তো তোমার খাওয়া হয় নাই, তুমি খাইতে যাও।”
বিনোদিনী কিছুতেই গেল না। অলস মধ্যাহ্নের উত্তপ্ত হাওয়ায় ঘরের পর্দা উড়িতে লাগিল এবং প্রাচীরের কাছে কম্পমান নারিকেলগাছের অর্থহীন মর্মরশব্দ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। মহেন্দ্রের হৃৎপিণ্ড ক্রমশই দ্রুততর তালে নাচিতে লাগিল এবং বিনোদিনীর ঘন নিশ্বাস সেই তালে মহেন্দ্রের কপালের চুলগুলি কাঁপাইতে থাকিল। কাহারো কণ্ঠ দিয়া একটি কথা বাহির হইল না। মহেন্দ্র মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “অসীম বিশ্বসংসারের অনন্ত প্রবাহের মধ্যে ভাসিয়া চলিয়াছি, তরণী ক্ষণকালের জন্য কখন কোথায় ঠেকে, তাহাতে কাহার কী আসে যায় এবং কতদিনের জন্যই বা যায় আসে।”
শিয়রের কাছে বসিয়া কপালে হাত বুলাইতে বুলাইতে বিহ্বল যৌবনের গুরুভারে ধীরে ধীরে বিনোদিনীর মাথা নত হইয়া আসিতেছিল; অবশেষে তাহার কেশাগ্রভাগ মহেন্দ্রের কপোল স্পর্শ করিল। বাতাসে আন্দোলিত সেই কেশগুচ্ছের কম্পিত মৃদু স্পর্শে তাহার সমস্ত শরীর বারংবার কাঁপিয়া উঠিল, হঠাৎ যেন নিশ্বাস তাহার বুকের কাছে অবরুদ্ধ হইয়া বাহির হইবার পথ পাইল না। ধড়ফড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া মহেন্দ্র কহিল, “নাঃ আমার কালেজ আছে, আমি যাই।” বলিয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে না চাহিয়া দাঁড়াইয়া উঠিল।
বিনোদিনী কহিল, “ব্যস্ত হইয়ো না, আমি তোমার কাপড় আনিয়া দিই।” বলিয়া মহেন্দ্রের কালেজের কাপড় বাহির করিয়া আনিল।
মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কালেজে চলিয়া গেল, কিন্তু সেখানে কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিল না। পড়াশুনায় মন দিতে অনেকক্ষণ বৃথা চেষ্টা করিয়া সকাল সকাল বাড়ি ফিরিয়া আসিল।
ঘরে ঢুকিয়া দেখে, বিনোদিনী বুকের তলায় বালিশ টানিয়া লইয়া নীচের বিছানায় উপুড় হইয়া কী একটা বই পড়িতেছে–রাশীকৃত কালো চুল পিঠের উপর ছড়ানো। বোধ করি বা সে মহেন্দ্রের জুতার শব্দ শুনিতে পায় নাই। মহেন্দ্র আস্তে আস্তে পা টিপিয়া কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। শুনিতে পাইল, পড়িতে পড়িতে বিনোদিনী একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
মহেন্দ্র কহিল, “ওগো করুণাময়ী, কাল্পনিক লোকের জন্য হৃদয়ের বাজে খরচ করিয়ো না। কী পড়া হইতেছে।”
বিনোদিনী ত্রস্ত হইয়া উঠিয়া বসিয়া তাড়াতাড়ি বইখানা অঞ্চলের মধ্যে লুকাইয়া ফেলিল। মহেন্দ্র কাড়িয়া দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। অনেকক্ষণ হাতাহাতি-কাড়াকাড়ির পর পরাভূত বিনোদিনীর অঞ্চল হইতে মহেন্দ্র বইখানি ছিনাইয়া লইয়া দেখিল–বিষবৃক্ষ। বিনোদিনী ঘন নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে রাগ করিয়া মুখ ফিরাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল।
মহেন্দ্রের বক্ষঃস্থল তোলপাড় করিতেছিল। অনেক চেষ্টায় সে হাসিয়া কহিল, “ছি ছি, বড়ো ফাঁকি দিলে। আমি ভাবিয়াছিলাম, খুব একটা গোপনীয় কিছু হইবে বা। এত কাড়াকাড়ি করিয়া শেষকালে কিনা বিষবৃক্ষ বাহির হইয়া পড়িল।”
বিনোদিনী কহিল, “আমার আবার গোপনীয় কী থাকিতে পারে, শুনি।”
মহেন্দ্র ফস্ করিয়া বলিয়া ফেলিল, “এই মনে করো, যদি বিহারীর কাছ হইতে কোনো চিঠি আসিত?”
নিমেষের মধ্যে বিনোদিনীর চোখে বিদ্যুৎ স্ফুরিত হইল। এতক্ষণ ফুলশর ঘরের কোণে খেলা করিতেছিল, সে যেন দ্বিতীয় বার ভস্মসাৎ হইয়া গেল। মুহূর্তে-প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার মতো বিনোদিনী উঠিয়া দাঁড়াইল। মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া কহিল, “মাপ করো, আমার পরিহাস মাপ করো।”
বিনোদিনী সবেগে হাত ছিনাইয়া লইয়া কহিল, “পরিহাস করিতেছ কাহাকে। যদি তাঁহার সঙ্গে বন্ধুত্ব করিবার যোগ্য হইতে, তবে তাঁহাকে পরিহাস করিলে সহ্য করিতাম। তোমার ছোটো মন, বন্ধুত্ব করিবার শক্তি নাই, অথচ ঠাট্টা।”
বিনোদিনী চলিয়া যাইতে উদ্যত হইবামাত্র মহেন্দ্র দুই হাতে তাহার পা বেষ্টন করিয়া বাধা দিল। এমন সময়ে সম্মুখে এক ছায়া পড়িল, মহেন্দ্র বিনোদিনীর পা ছাড়িয়া চমকিয়া মুখ তুলিয়া দেখিল, বিহারী।
বিহারী স্থির দৃষ্টিপাতে উভয়কে দগ্ধ করিয়া শান্ত ধীর স্বরে কহিল, “অত্যন্ত অসময়ে উপস্থিত হইয়াছি, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকিব না। একটা কথা বলিতে আসিয়াছিলাম। আমি কাশী গিয়াছিলাম, জানিতাম না, সেখানে বউঠাকরুণ আছেন। না জানিয়া তাঁহার কাছে অপরাধী হইয়াছি; তাঁহার কাছে ক্ষমা চাহিবার অবসর নাই, তাই তোমার কাছে ক্ষমা চাহিতে আসিয়াছি। আমার মনে জ্ঞানে অজ্ঞানে যদি কখনো কোনো পাপ স্পর্শ করিয়া থাকে, সেজন্য তাঁহাকে যেন কখনো কোনো দুঃখ সহ্য করিতে না হয়, তোমার কাছে আমার এই প্রার্থনা।”
বিহারীর কাছে দুর্বলতা হঠাৎ প্রকাশ পাইল বলিয়া মহেন্দ্রের মনটা যেন জ্বলিয়া উঠিল। এখন তাহার ঔদার্যের সময় নহে। সে একটু হাসিয়া কহিল, “ঠাকুরঘরে কলা খাইবার যে গল্প আছে, তোমার ঠিক তাই দেখিতেছি। তোমাকে দোষ স্বীকার করিতেও বলি নাই; অস্বীকার করিতেও বলি নাই; তবে ক্ষমা চাহিয়া সাধু হইতে আসিয়াছ কেন।”
বিহারী কাঠের পুতুলের মতো কিছুক্ষণ আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল–তার পরে যখন কথা বলিবার প্রবল চেষ্টায় তাহার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল, তখন বিনোদিনী বলিয়া উঠিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, তুমি কোনো উত্তর দিয়ো না। কিছুই বলিয়ো না। ঐ লোকটি যাহা মুখে আনিল, তাহাতে উহারই মুখে কলঙ্ক লাগিয়া রহিল, সে কলঙ্ক তোমাকে স্পর্শ করে নাই।”
বিনোদিনীর কথা বিহারীর কানে প্রবেশ করিল কি না সন্দেহ–সে যেন স্বপ্নচালিতের মতো মহেন্দ্রের ঘরের সম্মুখ হইতে ফিরিয়া সিঁড়ি দিয়া নামিয়া যাইতে লাগিল। বিনোদিনী তাহার পশ্চাতে গিয়া কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, আমাকে কি তোমার কোনো কথা বলিবার নাই। যদি তিরস্কারের কিছু থাকে, তবে তিরস্কার করো।”
বিহারী যখন কোনো উত্তর না করিয়া চলিতে লাগিল, বিনোদিনী সম্মুখে আসিয়া দুই হাতে তাহার দক্ষিণ হাত চাপিয়া ধরিল। বিহারী অপরিসীম ঘৃণার সহিত তাহাকে ঠেলিয়া দিয়া চলিয়া গেল। সেই আঘাতে বিনোদিনী যে পড়িয়া গেল তাহা সে জানিতেও পারিল না।
পতনশব্দ শুনিয়া মহেন্দ্র ছুটিয়া আসিল। দেখিল, বিনোদিনীর বাম হাতের কনুয়ের কাছে কাটিয়া রক্ত পড়িতেছে। মহেন্দ্র কহিল, “ইস্, এ যে অনেকটা কাটিয়াছে” বলিয়া তৎক্ষণাৎ নিজের পাতলা জামা খানিকটা টানিয়া
ছিঁড়িয়া ক্ষতস্থানে ব্যাণ্ডেজ বাঁধিতে প্রস্তুত হইল। বিনোদিনী তাড়াতাড়ি হাত সরাইয়া লইয়া কহিল, “না না, কিছুই করিয়ো না, রক্ত পড়িতে দাও।” মহেন্দ্র কহিল, “বাঁধিয়া একটা ঔষধ দিতেছি, তা হইলে আর ব্যথা হইবে না, শীঘ্র সারিয়া যাইবে।” বিনোদিনী সরিয়া গিয়া কহিল, “আমি ব্যথা সারাইতে চাই না, এ কাটা আমার থাক্।” মহেন্দ্র কহিল, “আজ অধীর হইয়া তোমাকে আমি লোকের সামনে অপদস্থ করিয়াছি, আমাকে মাপ
করিতে পারিবে কি।”
বিনোদিনী কহিল, “মাপ কিসের জন্য। বেশ করিয়াছ। আমি কি লোককে ভয় করি। আমি কাহাকেও মানি না। যাহারা আঘাত করিয়া ফেলিয়া চলিয়া যায়, তাহারাই কি আমার সব, আর যাহারা আমাকে পায়ে ধরিয়া টানিয়া রাখিতে চায়, তাহারা আমার কেহই নহে?”
মহেন্দ্র উন্মত্ত হইয়া গদগদকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “বিনোদিনী, তবে আমার ভালোবাসা তুমি পায়ে ঠেলিবে না?” বিনোদিনী কহিল, “মাথায় করিয়া রাখিব। ভালোবাসা আমি জন্মাবধি এত বেশি পাই নাই যে, “চাই না” বলিয়া ফিরাইয়া দিতে পারি।”
মহেন্দ্র তখন দুই হাতে বিনোদিনীর দুই হাত ধরিয়া কহিল,”তবে এসো আমার ঘরে। তোমাকে আজ আমি ব্যথা দিয়াছি, তুমিও আমাকে ব্যথা দিয়া চলিয়া আসিয়াছ–যতক্ষণ তাহা একেবারে মুছিয়া না যাইবে, ততক্ষণ আমার খাইয়া শুইয়া কিছুতেই সুখ নাই।”
বিনোদিনী কহিল,”আজ নয়, আজ আমাকে ছাড়িয়া দাও। যদি তোমাকে দুঃখ দিয়া থাকি, মাপ করো।”
মহেন্দ্র কহিল, “তুমিও আমাকে মাপ করো, নহিলে আমি রাত্রে ঘুমাইতে পারিব না।”
বিনোদিনী কহিল,”মাপ করিলাম।”
মহেন্দ্র তখনই অধীর হইয়া বিনোদিনীর কাছে হাতে-হাতে ক্ষমা ও ভালোবাসারএকটা নিদর্শন পাইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিল। কিন্তু বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিয়া থমকিয়া দাঁড়াইল। বিনোদিনী সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চলিয়া গেল–মহেন্দ্রও ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া ছাদে বেড়াইতে লাগিল। বিহারীর কাছে হঠাৎ আজ মহেন্দ্র ধরা পড়িয়াছে, ইহাতে তাহার মনে একটা মুক্তির আনন্দ উপস্থিত হইল। লুকোচুরির যে-একটা ঘৃণ্যতা আছে, একজনের কাছে প্রকাশ হইয়াই যেন তাহা অনেটা দূর হইল। মহেন্দ্র মনে মনে কহিল, “আমি নিজেকে ভালো বলিয়া মিথ্যা করিয়া আর চালাইতে চাহি না–কিন্তু আমি ভালোবািস–আমি ভালোবাসি, সে কথা মিথ্যে নহে।” –নিজের ভালোবাসার গৌরবে তাহার স্পর্ধা এতই বাড়িয়া উঠিল যে, নিজেকে মন্দ বলিয়া সে আপন মনে উদ্ধতভাবে গর্ব করিতে লাগিল। নিস্তব্ধ সন্ধ্যাকলে নীরব-জ্যোতিষ্কমণ্ডলী-অধিরাজিত অনন্ত জগতের প্রতি একটা অবজ্ঞা নিক্ষেপ করিয়া মনে মনে কহিল, “যে আমাকে যত মন্দই মনে করুক, কিন্তু আমি ভালোবাসি।” বলিয়া বিনোদিনীর মানসী মূর্তিকে দিয়া মহেন্দ্র সমস্ত আকাশ, সমস্ত সংসার, সমস্ত কর্তব্য আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। বিহারী হঠাৎ আসিয়া আজ যেন মহেন্দ্রের জীবনের ছিপি-আঁটা মসীপাত্র উলটাইয়া ভাঙিয়া ফেলিল–বিনোদিনীর কালো চোখ এবং কালো চুলের কািল দেখিতে দেখিতে বিস্তৃত হইয়া পূর্বেকার সমস্ত সাদা এবং সমস্ত লেখা লেপিয়া একাকার করিয়া দিল।