চৈত্রে রচিত কবিতা

উৎপলকুমার বসুর কবিতাসংগ্রহ

কবিতাসংগ্রহ – উৎপল কুমার বসু
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারী ১৯৬০
সতীনাথ ভাদুড়ীর সম্মানে এই কবিতাসংগ্রহ উৎসর্গ করা হল।

উপদেশ

নীলফামারির খামারঘরে
বাহির সূর্য বিরাজ করে।

বাতাস ওঠে, বৃষ্টি নামে,
আকাশ-জোড়া মেঘলা খামে

পত্র আসে সুসমীচীন
‘এবার আমায় ছুটি করে দিন।‘’

হাতের লেখা ঈষৎ ভীত,
কে পাঠাল? অপ্রত্যাশিত

কবিতা যেন, কাব্যাবলী,
শোনো তোমায় গোপনে বলি:

যে-ই পাঠাক, প্রেরক যে হোক,
অতি কাছের বয়স্ক লোক,

ঐ সে-মানুষ, ঐ জলছবি,
অপটুত্বের সর্দারকবি,

আকাশবিহারী, শুধু ছুটি চায়,
হেথা-হোথা যাবে, যেন নিরুপায়

সারাদিনভর বহু তার কাজ,
নীলফামারির বরকন্দাজ,

এখনি ওনাকে বিদায় কর হে,
কর্ম চুরির ঘোর সন্দেহে,

রৌদ্রে পুড়ুক, জলে যাক ভেসে
সাগরের দিকে, পাহাড়ের দেশে।

.

চৈত্রে রচিত কবিতা

উৎসর্গ

দয়িতা, তোমার প্রেম আমাদের সাক্ষ্য মানে নাকি?
সূর্য ডোবা শেষ হল কেননা সূর্যের যাত্রা বহুদূর।
নক্ষত্র ফোঁটার আগে আমি একা মৃত্তিকার পরিত্যক্ত, বাকি
আঙুর, ফলের ঘ্রাণ, গম, যব, তরল মধু-র

রৌদ্রসমুজ্জ্বল স্নান শেষ করি। এখন আকাশতলে সিন্ধুসমাজের
ভাঙা উতরোল স্বর শোনা যায় গুঞ্জনের মতো–
দয়িতা, তোমার প্রেম অন্ধকারে শুধু প্রবাসের
আরেক সমাজযাত্রা। আমাদেরই বাহুমূলে বিচূর্ণ, আহত

সেই সব সাক্ষ্যগুলি জেগে ওঠে। মনে হল
প্রতিশ্রুত দিন হতে ক্রমাগত, ধীরে ধীরে, গোধূলিনির্ভর
সূর্যের যাত্রার পথ। তবু কেন ষোলো

অথবা সতের–এই খেতের উৎসবশেষে, ফল হাতে, শস্যের বাজারে
আমাদের ডেকেছিলে সাক্ষ্য দিতে? তুমুল, সত্বর,
পরম্পরাহীন সাক্ষ্য সমাপন হতে হতে ক্রমান্বয়ে বাড়ে।

.

চৈত্রে রচিত কবিতা

নিঃসঙ্গ দাঁড়ের শব্দে চলে যায় তিনটি তরণী।

শিরিষের রাজ্য ছিল কূলে কূলে অপ্রতিহত
যেদিন অস্ফুট শব্দে তারা যাবে দূর লোকালয়ে
আমি পাবো অনুপম, জনহীন, উর্বর মৃত্তিকা

তখন অদেখা ঋতু বলে দেবে এই সংসার
দুঃখ বয় কৃষকের। যদিও সফল
প্রতিটি মানুষ জানে তন্দ্রাহীনতায়
কেন বা এসেছে সব নিষ্ফলতা, কবিতা তুমিও,

নাহয় দীর্ঘ দিন কেটেছিল তোমার অপ্রেমে–

তবুও ফোটে না ফুল। বুঝি সূর্য
যথেষ্ট উজ্জ্বল নয়। বুঝি চিরজাগরূক
আকাশশিখরে আমি ধাতুফলকের শব্দ শুনে–
সূর্যের ঘড়ির দিকে নিষ্পলক চেয়ে আছি

এখনি বিমুক্ত হবে মেঘে মেঘে বসন্ত-আলোর
নির্ভার কৃপাকণা। সমস্তই ঝরেছিল–ঝরে যাবে–
যদি না আমার
যদি না আমার মৃত্যু ফুটে থাকো অসংখ্য কাটায়।

.

আসলে মৃত্যুও নয় প্রাকৃতিক, দৈব অনুরোধ।
যাদের সঙ্কেতে আমি যথাযথ সব কাজ ফেলে
যাবো দূর শূন্যপথে-তারা কেমন বান্ধব বলো
কোন্ ঘড়ি? কোন্ সূর্যরথ?

হয়ত প্রকৃত ঐ নগ্ন জলধারা–
যখন দুপুর কাপে গ্রীষ্মের নতুন সাবানে।

ওদের দৈবতা বলে আমি মানি। ওদের ঘড়ির
সমস্ত খঞ্জনপাখা লক্ষবার শোনায় অস্ফুটে—
আমার বন্ধু কি তুমি?
আমি কি তোমার?

কেন যে এখনো নই প্রাকৃতিক দুঃখজটাজাল?
আমার নিয়তি তুমি ঈর্ষা করো–আমার স্মরণে
যাও দূর তীর্থপথে, ভুল পথে–রক্তিম কাঁটায়
নিজেকে বিক্ষত করো। রোমিও–রোমিও

কেন শূন্যে মেঘলীন কম্পিত চাদর উড়ে গেলে–
অনির্বাণ, স্থির নাটকের যারা ছিল চারিত্রিক,
নেপথ্যে কুশল, প্রেম চেয়েছিল, দুঃখ,
তারা একে একে অম্লান ঝরে যায়?

তবে কি আমিও নই তেমন প্রেমিকা?

.

বহুদিন ছুঁয়ে যায় বর্তুল, বিস্মৃত পৃথিবী
লাটিম সূর্যের তাপে নানা দেশ-বিপুল শূন্যতা–
সে যেন বিচিত্র আলো দিয়েছিল আমার ঘরের
গবাক্ষবিহীন কোনো অন্ধকারে–একদিন–শুধু একদিন।

তখন, প্রবল মুহূর্তে আমি জেনেছি অনেক–
সমুদ্র কেমন হয়। কাকে বলে দুর্নিরীক্ষ্য তরু।
আমি কেন রুগ্ন হই। তুমি দূর স্খলিত তারার
কেন বা সমাধি গড়ো বনে বনে।

অথচ আঁধারে ফিরি আমি ক্লান্ত প্রদর্শক আলো,
যারা আসে সহচর রক্ত-লাল, গমের সবুজ,
তারা কেউ ধূর্ত নয়–দয়াশীল, বিনীত ভাষায়
বলে, ‘তুমি ভুলে যাও সমস্ত জ্ঞানের ভার–সমস্ত অক্ষর।’

.

এখনি বৃষ্টির পর আমি পাবো জ্যোৎস্না-ভালোবাসা।
কেননা মেনেছি আমি শোকাকুল তুমিও বন্দিনী
অজেয় শকটে তার। কোনো কোনো রথ
একা যায় ভ্রান্ত পথে–অন্ধকারে–চালকবিহীন

যেখানে সুদীর্ঘ রাত ওড়ে নীল গন্ধের রুমালে
যেখানে জলের মতো পরিসর, অফুরন্ত বায়ু
ধুয়ে দেয় বনস্থলী, বালুতট–দীর্ণ হাহাকার

তুলেছিলে শূন্যতায় পাহাড়ের উর্বর মৃত্তিকা, তুমি দুঃখ, তুমি প্রেম,
শোনননি সতর্কবাণী। যেন স্রোত সহসা পাথরে
রুদ্ধ হল। এবং স্খলিত
বহু রথ, পদাতিক দেখে আমি মেনেছি এখন

প্রতিটি বৃষ্টির পর ছিন্ন হও তুমি, ভালোবাসা।

.

৫.

পৃথিবীর সব তক প্রতিচ্ছায়া খুলে দেয় বসন্তের দিনে।
যখনি তোমাকে ডাকে ‘এসো এসো বিদেহ কলুষ’,
কেন যে লুণ্ঠিত, নীল পরিধান খুলে
তুমি বালিকার স্পষ্টতায় কঁদো–
বসন্তই জানে।

তবুও আমার স্বপ্ন দুপুরের–ঘুমন্ত রাতের–
প্রবল নদীর জলে ধরে রাখে নীল যবনিকা–
সে তোমার পরিচ্ছদ, অন্তরাল, হয়ত বা
যেটুকু রহস্য আমি ভালোবাসি বালিকার কিশোর শরীরে–

এখন বিনিদ্র রাতে পুড়ে যায় সব মোমবাতি!
এবং অলেখা গান নিষ্ফলতা বয়েছিল কত দীর্ঘ দিন
সে নয় প্রেমের দুঃখ? তবু সতর্কতা
ভেঙে ফেলে সুন্দরের প্রিয় পুষ্পধার
বলেছিল, ‘এই প্রেম অন্তিমের, সমস্ত ফুলের’

.

যেন দূর অদেখা বিদ্যুতে তুমি পুড়ে যাও
তুমি সুন্দর নিয়তি
যেন জল, ঝোড়ো রাতে জ্বলে একা বজ্রাহত তরু
তুমি সুন্দর নিয়তি
মৃতেরা নিষ্পাপ থাকে। কারা নামে—অচ্ছোদসরসী–
তুমি বিরূপ নিয়তি
রাখো দূর মেঘপটে যত ক্রোধ, অকাম কামনা
তুমি সুন্দর নিয়তি
ফিরে দাও দীর্ঘ ঝড় মদিরায় প্রাচীন কুঞ্জের
তুমি সুন্দর নিয়তি।

.

গত পূর্ণিমায়

জ্যোৎস্না এখানে নেই। তাকে কাল হাই-ইস্কুলের
পোড়ো বারান্দার পাশে দেখা গেছে। সে তার পুরনো
আধোনীল শাড়িটি বিছিয়ে ঐখানে শুয়েছিল।

‘তুমি কোন্ ঘর ছেড়ে এলে? কোন দুঃখে? কোথায় চলেছ?’
কে যেন শুধালো তাকে। তার অস্ফুট উত্তর
হাজার ডানার শব্দে, নামতা-পড়ার শব্দে, নিরুত্তরে
চাপা পড়ে গেল–

ইস্কুলের বুড়ো ঘণ্টি পাগল-ঘণ্টির মতো বারবার আমাকে জানালো
‘এখন সময় নয়। এত আগে কেউ কি এসেছে?’

.

প্রান্তর থেকে

রূপনগরেতে চলো।

সে-দেশে ধুলোয় সবার নিভৃত নাম লেখা আছে।
যে-নামে তোমায় পুরনো বন্ধুরা চেনে এখনি বাতাস
সেই নাম ডেকে গেল। রূপনগরের পাঁচিলে না হয় বোসো
কিছুক্ষণ–দুটি পায়রার পাশাপাশি। গতবার এত বৃষ্টি হল,

এত রক্তপাত–আমাদের ক্রমশ বয়স হল তারই সঙ্গে।
আমাদের প্রতিটি বসন্ত আজ আধোলীন, সূর্যে মাথা রেখে
স্বপ্নরত। গতবার বনভোজনের শেষে অগণ্য পালক পড়েছিল চতুর্দিকে।
‘তোমাদের মজার গল্প এক বলি শোনো’-কে যেন বললো ডেকে,
কোন গল্প, কাকে নিয়ে, সমস্ত ভুলেছি। শুধু শালবনে–দুরে–
জলার মতন এক স্বচ্ছ জল অন্তিম গোধূলি নিয়ে
আলো হয়ে ছিল–

রূপনগরের পাঁচিলে না হয় বোসো কিছুক্ষণ–অন্যমনে।

.

ভোর সাড়ে ছ-টা

এক একদিন কলকাতা অনুপম উড়ন্ত মেঘের
পালিতা পাখির মতো উড়ে যায়।
যারা ফিরবে বলেছিলে আজ, কাল অথবা আগামী
যে-কোনো সপ্তাহে, মাসে, বছরের ক্লান্ত শেষ দিকে–
তারা মিথ্যে বলেছিলে।

কলকাতা এক একদিন তোমাদের পুরনো প্রলাপে, লঘু
কিশোর মিথ্যেয় ভরে ওঠে–
এখনি সমস্ত নৌকো ভোরবেলা গঙ্গায়
দু’তীরের পাশাপাশি অন্য শত চোখের কুয়াশা
কতো তুচ্ছ জেনে যাবে–

দিন আরো স্পষ্ট হলে যাত্রী হবো দক্ষিণসাগরী।

.

হে প্রিয়

তোমার গান প্রিয়তমা ধ্বনিবিহীন।
তোমার গান প্রিয়তমা প্রতিধ্বনি।
কোথায় ভাঙে পুরুষোত্তম দুর্গচূড়া
সন্ধানীদের সোনার খনি।

এখনো ঘোরে পরিশ্রম মৌমাছির।
এখনো জ্বলে দুপুরবেলা বসন্তে।
আমি কি যাবো তৃষ্ণাতুর যাত্রীদলে
দূরের ঐ দগ্ধবনদিগন্তে
যেখানে সব প্রতিধ্বনি ধ্বনিবিহীন।

আসলে বহু দীপ্ত ঋতু আমায় গড়ে।
আমি তাদের প্রহরী ব’লে–বকুল
ঝরায় শত জীর্ণ পাতা, ফুলগুলি,
যেন তাদের প্রেমাবরণ, উড়ন্তচুল

ছায়াতরুর তন্ময়তা ভঙ্গ করে।
ধ্বনিজালের দুঃখে তুমি রাত্রিদিন
এখনো কাঁপো অস্ফুটিত হৃদয়ভার
আপন গানে কে রয় বলো ধ্বনিবিহীন।

.

চন্দ্রাতপ

বিরহনাটকে গ্রীস আমার চোখের কাছে সমুজ্জ্বল তারা।
আমি এই পৃথিবীকে রক্তমাংসের ধ্রুব বাসনা জেনেছি
যে-দর্পণে সন্ধ্যাবেলা প্রেয়সীর বিকীর্ণ শরীর
জ্বলে ওঠে–অন্য পিঠে ব্যাপ্ত তার রক্তাক্ত পারদ।

বিরহনাটকে গ্রীস আমার চোখের কাছে সমুজ্জ্বল তারা।
রজতফেনার মতো দিকে দিকে সমুদ্র-প্রসারে
হয়ত পর্বতচূড়া ধরে আছে কোনো বাজপাখি
তরঙ্গের আন্দোলন–অনিকাম দু’টি মুক্ত ডানা।

বিরহাটকে গ্রীস আমার চোখের কাছে সমুজ্জ্বল তারা।
হে পৃথিবী, তবুও জননী তুমি। বারংবার দয়িতের রূপে
যখন দুয়ার হতে প্রত্যাহত ফিরে যাবো-শুধু বাজপাখি
তমসার পরপারে খুঁজে পাবে রক্ত, মাংস, চুল।

.

শিল্পীদলে

অনন্ত জলের নীচে প্রস্তুতি আমারও, প্রেমিকা।

তুমি উন্মোচিত হও। তুমি জাগো আন্দোলিত বঙ্কিম সাঁতারে।
তরঙ্গশিলায় দূর শ্রাবণের মেঘপুঞ্জ যেন লেগে আছে।
ফোটে ফুল বসন্তের-আশ্বিনের প্রথম শেফালি–
তুমি উমোচিত হও–তুমি বলো জলের গভীরে

যারা থাকে নিরুত্তাপ, চিরদিন–রক্তের হাঙরে
তারা দেয় ব্যভিচার, গুপ্ত রোগ, যত প্রেম।
আমি তবু অপর্যাপ্ত সাগরের বিপুল বয়ায়
ভেসে উঠি চিরন্তন। গৃহপালিতকে এত কী করুণা তুমি করেছিলে?

অনন্ত জলের নীচে ডুবে যায় ওদের শরীর।

.

এই বেলাভূমি

সুন্দরী আধেকলীনা, তুমি দেহভার
কিছু রাখো দুপুরের হলুদ বেলায়
কিছু রাখা অন্ধকার জলের গভীর দেশে–প্রমত্ত আশার
লক্ষ ঢেউ মুছে যায় একাকার সাগরে, সকালে,

অথচ তোমার কোলে অগ্রন্থির মালা ছেড়ে এখনো বাতাস।
এখনো দুর্লভ যত সংগ্রহে ভরে আছে পর্বত তোমার।
প্রাকৃত জনের মতো আমি ভাবি সহসা নিশ্বাস
তোমারই বুকের কাছে বেজেছিল, সহসা মর্মরে

দিগন্তের তালবন যেন দূর পূর্ণিমাসন্ধ্যার
অন্তরালে তোমাকেও নিয়ে যায়–তুমি নামো
আসন্ন জোয়ারে, প্রথম সাগরস্নানে। অতি দীর্ঘ বালুতট
শূন্য পড়ে থাকে–যদি না ওদের সম্রাট ফিরে আসে
গুপ্তচর, অভিশাপ, যদি না সভ্যতা।

.

জন্মদিন

মায়াবী লণ্ঠন ঘিরে বহু কাঁচ অতসীর মেলা।
হয়ত ধুলোর রেখা মুছে দিলে, তুমি ভাবো,
কোনো ভ্রান্ত কবি একদা জানাবে ঐ প্রত্যেক অতসী
মিথ্যে নয়।

অতসী দুর্বল। তবু লোক-অপবাদে
পথের দুপাশে কেন চেঁচায় স্বৈরিণী?
আমি নিস্পৃহ চলে যাই। অন্য সকলেও।
কোনো ভ্রান্ত কাব দূর থেকে দ্যাখে সব।

অগ্নিরেখা আমাদের সমর্পিত কোল ঘেঁষে।
তুমি উৎসব ফুরোলে ঐ কাঁচপাত্র ধুয়ে রাখো।
আবর্জনা অতীতের বলে নাকি, ‘হায় রে মায়াবী–
লণ্ঠন জ্বালালে কেন? সকলেই অন্য নিমন্ত্রণে চলে গেছে।’

.

চতুর্দশী

তোমার বয়েস আমি ভালোবাসি।
তুমি কোন পাথরে দাঁড়াও মনে থাকে।
যত গান প্রিয় বলল আমি লিখে রাখি মলিন খাতায়।
প্রতিদিন পুরনো সূর্যের রথ ভেঙে পড়ে সন্ধেবেলা।
দূরে—উপকূলে–
ক্রীড়ারত তোমার বয়সী–ওরা কেমন প্রেমিক?

.

কুহক

ওরা চলে যায়-ঋতু, বসন্ত ফুলের শোভা, অন্তিম তুষার।
রাজহংসটির শেষ অস্থিরতা উড়ে যায় কমল-সাগরে–
এখনো মর্তের থেকে নীলাঞ্জন একটি সোনার রেখা
যাকে দেবে বলেছিলে সে-ও দ্যাখো অমর্ত্য ফুলের
সৌরভে মগ্ন আছে। যারা চলে যায় তারা ব্যবহৃত, পুরনো সংসার।

শিউলিবনের তলে স্ফুট চলাচল সব আমাদের–হে পথিক, আমাদের
সহসা তোমার গায়ে উড়ন্ত নিশ্বাস লাগে তা-ও আমাদের
তুমি ভুলে যাও ঋতু, বসন্ত ফুলের শোভা, অন্তিম তুষার,
বৎসল পুরুষ তুমি। তুমি শ্বেতহংসটির চঞ্চলতা বুকে নাও
বুঝি জানো কোথায় তোমার মুক্তি। অস্তভূমি। কোথায় সাগর।

ব্যাকুল, উন্মাদ রক্ত কাকে দেব? তিনি কি সম্রাট?
অথবা ঈশ্বর কোনো-ঈশ্বরীর? তেঁতুলবীথির মগ্নগ্রাম আমাদের,
হে পথিক। ঐ পুষ্করিণী দ্যাখো যাতে তুমি অমর্ত্য ফুলের
আকাঙ্ক্ষায় ডুবেছিলে। তবু কি জেনেছ পুরনো স্মৃতির ভার
দুর্বল পাষাণ-নক্ষত্ৰ-ছায়ায় কাঁপে, জোনাকির কল্পিত গাথায়?
.

আশ্বিন, ১৩৬৫

তুমি স্মৃতি, অপূর্ণ বাসর
ভীত, ত্রস্ত বনতল–ভোরবেলা কাঁপো
বাতাসে, আলোয়-যেন করবীর সকল শাখার
মৃত্যু লাগে তোমার মরণে।

.

গুপ্তচর

স্নিগ্ধ তুমি, প্রথম রাত্রির চাঁদ অস্তে ভ্ৰমাকুল।

তুমি আরেক সিন্ধুর পারে জেগে ওঠো, আরেক নগরে
হলুদ পূর্ণিমা কাঁপে, ম্লান প্রবাসের জল
ছুঁয়ে যায় নৌকোগুলি, আধোজাগা, অর্ধেক ডুবন্ত,
আজো দীর্ঘ মাস্তুলের হাহাকারে শালবন জেগে ওঠে–
যেন লাগে পূর্ণিমা তোমার

কম্পিত ঘুমের পাশে। ওরা যায় দেশান্তরী। কোথায় আমার দেশ?
কোন ঘরে? কোন প্রিয়জনে? আমি কি সাইরেন, শব্দ?
অন্ধকার ঝোড়ো রাত্রে ছুঁয়ে যাই মর্মতল?

জন্মভূমি–কোথায় কোথায় ফোটে অগ্নিরেখা, সিন্ধুর কামান!

.

কখন মোরগ ডাকবে–আমি ঘরে ফিরে যাবো।

কান্তারে সমস্ত রাত শস্য-পাহারার ছলে জেগে আছি
এবং অলৌকিক জ্যোৎস্নায় এই রণভূমি ফসলে, সংগ্রামে, গানে
ভরে গেছে বুঝি মনে হল
সুদূর আলোর পথে তোমাদের অপস্রিয়মাণ ছায়া
আবার উঠেছে জেগে। দীপ্ত নখর মেলে, হা হা শব্দে,
রক্তের তৃষ্ণায় যারা উড়ছ–বুঝি ভেবেছ সহসা
প্রান্তরে একাকী আমি বধ্য আছি। বুঝি জেনেছ গোপনে
এ-কাহিনী সকালের রৌদ্রের পালক দিয়ে ঢাকা যাবে।

.

পরিলিখন

যেখানে ঝরে চিরতুষার সৌগতের সমাধিমন্দিরে
ঘন নিবিড় মেঘের মতো হংসদল চলেছ সেইখানে
কাননময় উন্মীলিতা ফুলে ফুলে আলোর সমারোহ

হে ফুলদল, তোমরা আজো কুয়োতর রক্তে-ভেজা মাটি
ভরে রেখেছ আনন্দিত। আমি ভিন্ন জলের উচ্ছ্বাসে
সমব্যাকুল ফিরে এলাম। শ্বেতপাথরের কঠিন মায়াডোরে
একটি পাখি বেঁধেছ তুমি, সৌগত–চিরতুষার–চিরতুষার।

.

প্রবাসিনী

প্রবাসিনী, তুমি আজ এমন দরিদ্র এক প্রবাসে এসেছ!
আমার ঘরের পাশে, এক রৌদ্রে, একই আকাঙ্ক্ষায়–
আমি সারাদিন তোমাকে রুগের মতো অনৃতভাষণে
আপাতত স্বাস্থ্যে রাখি। আমি বলি—’ও শুধু ডানার শব্দ
–যাত্রী যায় লোকান্তরে। অথচ বাগান এদিকে নির্মূল হল।
সারারাত দুঃস্বপ্নে আমার অসংখ্য শোকের ডাল ওরা কেটে ফ্যালে।

অবেলায় এখন আমার কান্ত রৌদ্রে যেন বেলা যায়।
একদিন দৈর্ঘ্য দেখে, ছায়া দেখে তুমিও গুনেছ ঋতু–প্রথম শীতের শস্য–
আগন্তুক বসন্তপূর্ণিমা ক’লক্ষ কোকিলে ভরে।

প্রবাসিনী, এখন দম্ভের মতো আমার বিশ্বাসে সকলই শোনায় ভালো,
আজো দীপ্ত, উজ্জ্বল, অমল–যখন জলের কাছে তুমি যাও,
আমি যাই, যতক্ষণ জল ধরে প্রতিচ্ছবি স্মরণের–স্মরণাতীতের।

.

রাজার মতো রাজা

রাজার মতো রাজা
ভিনগ্রামেতে চলে গেলেন। কালোমহিষ বাহন।
পরনে সেই পরিচ্ছদ
যা আমরা জন্মকালে পরে থাকি।

মস্ত বড়ো চাষের ঢালু জমি।
অন্যদিকে নীল পাহাড়, বাদাম ক্ষেত-রাজ্যে তাঁর
একটি নদী, কয়েক ঘর
প্রজা এবং আত্মজন।

সন্ধেবেলা বুনোশুয়োর আগুনে ঝলসায়।
রাজা প্রকাণ্ড এই মহাদেশের গল্প বলেন
এবং কোন্ স্রোতস্বতী পেরিয়ে গেলে প্রতি মানুষ
আকাশে যত নতুন তারা ওঠে–

দিন-ফুরানো কাঠের সাঁকো নানান লোকে ভারী।
রাজার মতো রাজা
কালোমহিষ এ-পারে রেখে ঐ পারেতে গেলেন।

.

নবধারাজলে

মন মানে না বৃষ্টি হলো এত
সমস্ত রাত ডুবো-নদীর পারে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে।

এখন এক ঢেউ দোলানো ফুলে
ভাবনাহীন বৃত্ত ঘিরে রাখে–
স্রোতের মতো স্রোতস্বিনী তুমি
যা-কিছু টানো প্রবল দুর্বিপাকে

তাদের জয় শঙ্কাহীন এত,
মন মানে না সহজ কোনো জলে
চিরদিনের নদী চলুক, পাখি।
একটি নৌকো পারাপারের ছলে

স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল
অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার,
তোমার গ্রামে, রেলব্রিজের তলে,
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।

.

সেদিন ঝড়ের রাতে তুমি চাঁদ ডুবন্ত, একাকী
দেখেছিলে লক্ষ ঢেউ জলে ভাঙে প্রতিচ্ছায়া–মেঘজটাজাল
খুলে যায় অন্যমনে। এত অলৌকিক অন্ধকার ঘিরেছিল চতুর্দিকে,
এত অলৌকিক বাতাসে মত্ততা যেন বলে গেল ‘কে খোলে কপাট?
কে যায় বনের যাত্রী–ঝটিকায়–তুমি কোথাকার।’
আমি তখনও নির্বাক থাকি। চন্দ্রাহত–তোমার পূর্ণিমা
কখন দিগন্তে ডোবে আমি ততদিনে স্পষ্ট জেনে গেছি।

.

এখনি যাবে কি তুমি? ফিরে এল বৃষ্টি দুপুরের
মাঠের ওপার থেকে, দুটি শান্ত গৃহকোণে কিছু জল দিয়ে–
উত্তরে, ধানের ক্ষেতে, যেখানে অদেখা
গতরাত্রির সব ভালোবাসাবাসি–জলে মিশে আছে।
যেখানেই থাকো তুমি একটি পথের রেখা ধ্রুব, কূট, নিশ্চিত শ্রাবণে
তোমাকে সহজ কোনো আলে আলে নিয়ে যায়, যখন সহসা
দু’ধারে চঞ্চল স্রোত, জল, নদী, কম্পিত ডাহুক,
একটি মুহূর্তে শুধু তুলে নেয় প্রতিচ্ছবি, ‘তোমার ভঙ্গিমা–
আবার সহজে ভাঙে–যেন খেলা কেবলই মেঘের
প্লাবিত ধানের ক্ষেতে বারবার বৃষ্টি দিয়ে যাওয়া–যেন মত্ত
কখনো আঙুল অন্যের করতলে বিধেছিল–অন্য করতল

রাখে না প্রেমের ভার, সে প্রাচীন, সে চিরন্তন!
অথচ বর্ষা আসে। আদিগন্ত একাকী মাঠের দৈর্ঘ্য কত–
ভয় কত–এখনি যাবে কি তুমি?

.

অমন কালো মেঘের দিনে জন্মেছিলেন আমার প্রিয় কবি।
অন্য সকল দিনের মত বৃষ্টি নামল–রোদ উঠল কত
উনি আমায় রক্তে লীন দেবায়তন দেখিয়েছিলেন।

যদিও ঐ সিংহাসনে কুয়াশাময় সম্রাটের অস্থিরতা ছিল,
তবু আমি ক্ষমাই চেয়েছিলাম–
যা আমাকে ধন্য করে, প্রিয় কবিকে, মহিষটিকে।

নিষ্করুণ মাতাল হাতে ছড়িয়ে থাকা শত বধ্যভূমি।
ভীষণ শব্দে বেজে উঠল মহিষটির দীপ্ত গলা ক্ষমা করুন, ‘ক্ষমা করুন’
আমি শান্ত, অনুচ্চারিত শব্দে বলেছিলাম।

.

স্তম্ভের গান

পাহাড়ে মুক্তর বাড়ি। গম্ভীর অনন্ত শব্দে মুক্ত সারা রাত
আমাকে দুয়ারে ডাকে। সে কী চায় আমার কাছে?
দীপ্ত ধনু? কমণ্ডলু? অথবা বজ্রের
শাখাপ্রশাখায় দূরে জ্বলে ওঠা পর্বতশিখর কোনো?

আমি তার নির্মম পায়ের তলে মাথা রেখে বলি,
তুমি আমাদের আদিম বসুধা, মাতা
নক্ষত্রে তোমার মুক্তি, প্রতিটি তৃণের জন্মের আগে
তুমি উন্মুক্ত প্রান্তর কোনো । তাহলে ঝর্নার ধ্বনি

তোমাতেই স্তব্ধ হোক–নগর ধ্বংসের ’পরে
আমি অনাদি, অনন্ত কাল, রৌদ্রে, তাপে, বৃষ্টিধারাজলে
এমনই অমৃত থাকি–

পাহাড়ে রিক্তর বাড়ি। আমি যদিও ঝর্না নই, স্রোত নই,
তবু সারা রাত সে কেন আমাকে ডাকে?
সে কী চায় আমার কাছে?

.

প্রহবী–ও প্রহরী–এই কি তোমার স্বর ধ্বনিজাল–প্রতিধ্বনিজাল
পাতায় শিশিরবিন্দু মুছে যায়–মুছে যায় যত পলাতক
কিশোরের ভীরু কষ্ট, সমস্ত দুপুর ভরে শরবন ক্ষয়ে যায়,
আলো, তাপ, রক্ত, মাটি, বনের আগুন,

তবু কি তোমার স্বর ডুবোজলে, ফাঁসিকাঠে,
প্রবল বিদ্যুৎশব্দে ধসে যাওয়া অরণ্যে পাখির–

এই কি তোমার গান, নিঃশব্দ, ইশারাময়, গ্রীষ্মরজনীর শেষে
হঠাৎ দিগন্ত পারে উঠে আসা ক্লান্ত চাঁদে
আমি যত গান উৎসারিত করে দিই–
সবই কি তোমার?

.

তাই আমার কল্পনা নেই। তবু দূত আমাকে গোপনে
পাঠাও দুরূহ বার্তা। বোঝো, পড়ো–আমাকে বলেছ
বলেছ সৃষ্টির আগে স্বপ্ন ছিল পরিদৃশ্যমান।
যেদিন ছিল না তারা, ঘাস, ফুল, পতঙ্গ, প্রকৃতি,
যেদিন ছিল না ঢেউ, উপকূল, নক্ষত্র, মাস্তুল,

সমস্ত উদাস স্বপ্নে উড়ে যেতে হাওয়ায়—আকাশে–
নক্ষত্র ছিল না তবু নক্ষত্রের স্বপ্ন ছিল মনে ছিল
না মানুষ তবু কণ্ঠ তার নিয়ত আশায়
বলেছিল, ‘রুদ্ধ করো আমাদের–রুদ্ধ করো প্রেমে কি বিরহে’

তুমিই আমার তন্দ্রা। জাগরণ ভালোবাসে অনুবর্তিতার
যে-সব হরিণ কাল কুয়াশালুপ্তির পথে ছুটেছিল।

.

যত প্রতিচ্ছবি আজ মূল তরুটির দিকে দৃষ্টি তুলে আছে

.

এবং নগরপ্রান্তে ভাঙা দেয়ালের ’পরে আশ্রয়জটিল
হৃতশূন্যতায় তুমি কোন্ অন্ধ কবি প্রাচীনতার গান গাইছ?
অথবা ধুলোর ’পরে নত হয়ে শুয়েছ কোথাও
–যেখানে অস্থিমালা, করোটি, কঙ্কাল, যেখানে তোমার বার্তা
ধ্বনিপ্রতিধ্বনিময় নিদারুণ খেলায় মেতেছে।

এসো আমাদের দীর্ঘ তাপে, এসো সূর্যাস্তবেলায়।
এসো পাহাড়ে ঝর্নার পথে, রিক্ত পথে, রিক্তের বাড়ির
দুয়ারে দাঁড়াও এসে।

.

আবিষ্কার

অসংখ্য চুমোয় আমি একটিই তনু শুধু জীবনে ফোঁটাব।

কেননা তোমার দৃষ্টি উদ্ভিদের। চেতনা তোমার
মহাবনস্পতিতলে এক ম্লান বিপুল গ্রন্থের
হলুদ অধীর পাতা–এখানে সমস্তবেলা অনর্থে কাটানো গেল।

এখন মাঠের ’পরে নত হয়ে তোমাদের চলাচল দেখি।
তোমরা মোরগ কোনো শিমুলতুলায় আজ ছেয়ে আছ
না হয় মানুষ কোনো দুপুরে হাটের দিকে চলেছ কোথাও–
সূর্য এক অদ্ভুত উচ্চতা থেকে আলো দেয় তোমাদের মুখে।

এখন আমার কাছে প্রত্যেকেই নবআবিষ্কৃত।
কেননা বনের তলে আমার সমস্ত পাঠ আজই শেষ হল।
এখানে প্রতিটি গাছ, ডালপালা অথবা বল্কল

সবই যেন লাইব্রেরি, থামের আড়াল রেখে প্রসারিত ভূমি–
যতদূর দৃষ্টি যায়–যতদূর হলুদ, বাদামী পাতা
চৈত্রের বাতাস লেগে ছুটোছুটি করে

তোমাকে এখন নিষ্পত্র, বিরল দেখি!

.

সমস্ত উঠোন জুড়ে রৌদ্র আজ পড়ে আছে অনুজ্জ্বল নখের মতন।
অনেক মালিন্য তার, দীর্ঘ পথের ক্লেদ। আমিও একদা
অমন বর্যার রাতে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাবো বলে আরেক গ্রামের
ভগ্ন নদীর কূলে পৌঁছালাম। ‘তুমি পথচারিণীর ক্লান্তি নিয়ে এসেছে কি’

যখনই বলেছি–সেই খণ্ড, নিষ্প্রভ রোদ্দুর
আরেক প্রাঙ্গণ ‘পরে সরে গেল। সেই থেকে প্রতিবেশী
রাত্রিদিন আমারই বিষয় হয়ে আছে। আমি তার
শান্তি দেখি জানালায়–অলক্ষ্য লতার মতো যা-কিছু নতুন

ফুলে নত, বেগবান অথবা শিথিল–
যা-কিছু পার্থিব তার, নৈসর্গিক, স্বপ্নবিজড়িত,
সমস্ত দেখার শেষে গতকাল, অন্ধকারে, আমি কৌতূহলী
প্রতিবেশিনীর দুয়ারে গিয়েছি যেন–আমার পায়ের কাছে মাথা রেখে

নতজানু অস্ফুট আলোয় সে বলেছে, ‘এ সকলই তোমার বিচার।’

.

যে-কোনো মৃণালে তারা ফুটে থাকে, যে-কোনো পুকুরে।
প্রথম মৌমাছিদলে তারা এস্ত হল–নত হল।
তখন ভোরের বেলা।
কুয়াশায়, মলিন দীঘির প্রান্তে তুমি বসেছিলে।

হায় রূপ, হায় কান্তি, অকূল পদ্মের জালে বাঁধা পড়ো তুমিও তেমনই,
প্রতিটি কীটের কাছে–যারা টানে দূর গুঞ্জরণে
স্বপ্নের উদ্ধত পাল। যে-তুমি নির্বেদ

সহসা লুপ্তির তীরে কেঁপে ওঠো। সহসা ধ্বংসের তীরে
প্রতিটি তন্দ্রা তবু ভেঙে যায় কখন পাখির ডাকে–
এমন মর্ত্যলোক, এমন তৃণের রাজ্য, এতগুলি ক্লান্ত ভোর,
সমস্ত মূল্যের মতো শোধ করে অপরিমিতের কোটি ঋণ।

আমিও তেমনই। আমাকে নির্ভার রাখো, তুমি রূপ, কান্তি তুমি,
তোমার হৃদয়ে শুধু। আমি কপি জলের কাঁপনে–

যখন সূর্যের বেলা। অসংখ্য মৃণাল ’পরে ওরা ফুটে ওঠে।

.

কোনো দিন, কোনোখানে তুমি তাকে মুক্তি দিয়েছিলে।
এখন কপাল তার ভরে গেছে চন্দনে, চুমোয়,

এখন নিদ্রা তার ভরে গেছে অদেখা বাগানে,
তুমি সমস্তই দেখেছিলে পথে যেতে, দূরের প্রবাসে,

নতুন বাঁধের দিকে, অক্টোবরে, সেবার প্রথম কুচিফুল ফুটেছিল–
তারো আগে বহু শ্ৰম লেগেছিল ঐ বাঁধে, ঐ লোকালয়ে।

সকলই শ্রমের অন্ত। সৃষ্টি শুধু রাত্রিজাগরণে
প্রেমিকের, পণ্ডিতের, বিজ্ঞানীর তাপসিক কাজে,

অথচ মুক্তি তার অকল্পিত, অনির্দিষ্ট নামে–একদিন ভোরবেলা–
রাস্তা তখনও ভিজে, ট্রাম ছিল, দু’একটি মানুষ–

ঘুমের প্রান্তে তুমি কুয়াশায় তাকে ডেকেছিলে।

.

যমুনা ব্রিজের ’পরে গোধূলির সূর্য ডুবে যায়।

এখনি রাতের ট্রেন চলে গেল। দূর কিনারায়
তিসিক্ষেত, বালুচর, শৈলচূড়া সবই
যেন এই নদীকূলে উৎসারিত, আকূল পূরবী–
এই নদী অশ্রুনদী তবে?

শূন্যে আকাশ জুড়ে, অন্তিম আলোর কাছে, পতঙ্গের রবে
বিদেশী নৌকো যায়–যেন কোন দিগন্তে যমুনা
শেষ হল। যেখানে স্বপ্নের দেশে স্রোত বিনা, জল বিনা
অগণ্য নৌকো ভাসে। বিস্মৃতির ঘাটে ঘাটে তত দূর

খেয়া-পারাপার করো চিরকাল তুমি পূরবীর সুর।

.

অবকাশ

যেদিন নীরব হবো আমাকে কোরো না তুমি ক্ষমা।

কেননা অনন্ত কাল ব্যাপ্ত করে আয়ুর আঁধার
উপরে এসেছে নেমে-বৎসরে বৎসর যায়, ডুবে যায় দীনা
শ্বেত-সূর্যের রাত্রি। অবসন্ন বাঁধের ওপার
দিয়ে সে শুধু গড়ায়। ধূসর জলের তীরে
তাকে দাও খুলে।
আজো কি বিকেল নয় তত দূর অশ্রুজলপ্লাবী?
অথবা অগ্নিকুণ্ড আজো নয় আগুনে বিশাল?
যেখানে চলেছে রাত্রি, অর্ধদগ্ধ পাণ্ডুলিপি, কিছু বা সন্তাপ,
অথবা, জেনেছে অগ্নি তুমি শুধু দরিদ্র একাকী
যে তার মার্জনা চায়।

আমি চাই শবের উত্থান
দুর্গের প্রাকারতলে, শোনো দূরে গোধূলির ধ্বনি,
শোনো উঁচু শিখরে শিখরে হারা পর্বতের গান–
পশ্চিমদুয়ার খুলে নেমে এসো এই জনপদে।

যেদিন নীরব হবো নিজেকে বোলো না তুমি ‘ক্ষমা
অভিসম্পাতের মতো’–-কেননা আগুন জানে ভস্মের বার্তা সব
সে কি জানে দিতে আমার শঠতাগুলি ইন্দ্রিয়প্রহত?

নিশাজাগরূক ঘণ্টা কেন বাজে এই অবেলায়?

.

দুঃসময়

আমার চেতনা শুধু শব্দের করস্পর্শে ভেঙে যায়।
অথবা তাকেই আমি খুঁড়ে ফেলি যেন উদ্বেলিত
ছায়া-গন্ধ-ঝরা গাছ খুঁড়ে ফেলে বীজের আশায়
সূর্যের আন্দোলনে মাঠে মাঠে যা-কিছু নিহিত।

এ-শ্রমের অন্ত কবে? শুরু বা কোথায়? পূর্ণপুরুষের
মতো প্রেমে অবরোহ কবে বা গিয়েছে জানা
অর্ধেক উদর তার–বাকি সব লজ্জারুণ ঘের,
যৌনপ্রহারের শব্দ নিশীথের অন্ধকারে টানা!

না হয় জালের ফাঁকে জেগে ওঠো কালো স্থপতির
বিষাদকরুণামাখা ভাঙা হাতিয়ার আর লোহার তর্জনী,
না হয় জালের ফাঁকে জেগে ওঠো গতি-অগতির।

আত্মশাসনমুক্ত লোভে ছেঁড়া দ্রৌপদীর বেণী।
ধৈর্যই আমার নাম–চতুর্দিকে তুলেছি দেয়াল,
যখন আঘাত এসে পড়ে শুধু শব্দের, ক্ষতির।

.

তবুও সময় হল। বৎসর টলে পড়ে যায়
আরেক ঋতুর গর্তে। এসো ছুঁড়ে ফেলি
সূর্যঘড়ির ’পরে আমাদের আজানুপ্ৰভায়
অপরাহের ছায়া। আত্মার মুখোমুখি সেই খেলা খেলি।

অথবা অন্ধের সাথে বসি আজ অন্ধতাবপনে।
ক্ষেতের উষর প্রান্তে–পত্রহীন ডুমুরের তলে
যখন উড়েছে কাক। ওড়ে কালো, স্তব্ধ ছায়া নিদ্রা-আরোহণে।
জেনেছ শস্যের জন্ম কত গূঢ় আশঙ্কার ফলে?

যেন-বা লুপ্তির কাছে পৌঁছে যাই–সিঁড়ি শেষ হল।
এ-যাত্রার অন্ত কবে? কবে শুরু? বীজের আঁধারে
ঢেকে রাখি শ্বেত রৌদ্রে আমরণ অন্তঃসার
–আমার চেতনা, তাকে বোলো

যদি না সমস্ত ভাঙে তারই আগে–শব্দের আঘাতে
যদি না বাতাস ভাঙে, রশ্মিপাতে, একই কেন্দ্রে, উৎসারণে,
যদি বারে বারে

জেনে যাই অজ্ঞানতিমিরতলে তারা কি সফলও!

.

নির্জন বালির বুকে পড়ে থাকা নৌকোগুলি তোমাদের জানে
তাদের ছায়ায় বসে গান করে সারাদিন হৃদয়পণ্যের
কখনও নেমেছ ঢেউ-এ, নীলিমায়, স্নানে,
উঠেছে শীর্ণ ধোঁয়া তোমাদের দারিদ্র্যঅন্নের।

বালি তত উষ্ণ নয় যত তাপ আমাকে অসুখ দিয়েছিল,
আমি নই ক্ষুধা, প্রেম, পিপাসাকাতর,
এসেছি ভূর্জবনে, অংশত আরো কিছু ছিল,
তারই আগে এসেছে প্রহর–

উটের ঘণ্টার শব্দে, দিগন্তের অদ্ভুত সম্বলে
তারা যায়-জলের কিনার ঘেঁষে পুব হতে পুবে
আমার চোখের ’পরে পৌরুষের-নারীত্বের মহান কৌশলে

জেগে ওঠে সেই জাল ক্রান্তিহীন, অবলম্বহীন।
ভাঙা হাতিয়ারে তার রোষাগ্নির আলো পড়ে-শুভ ও অশুভে
এনে দিলে ভয়ঙ্কর প্রলয়ের, দুর্যোগের দিন।

.

ক্ষয়

বকুল, তোমাকে শুধু ঈর্ষা করি, কতো না সহজে
তুমি তার মত্ত কেশে ডুবে যাও অনির্বাণ,
তোমার অতীতে নেই প্রবচন, ছায়া, শান্তি, গ্রন্থের বীজাণু,

আমার অনন্ত রক্ত ঝরে যায় অগ্নির সমাজে।
কেননা ফসল কাটা শেষ হলে এত বেশি অবিচ্ছিন্ন খড়
মানুষ টানে নি যেন, আমিও দেখি নি যেন
কোনো কেশে এ-হেন সম্পদ।

.

খেলাঘর

কথা ছিল, পুকুরের কাছাকাছি খেলা শুরু হবে।
সেদিন ঢেউএর নীচে, কচুরিপানার জালে, নিস্তব্ধ সবুজে
যত দূর ডুবে যায় পিতলের থালা-বাটি, বুদ্বুদ, সাবান,
তারো চেয়ে অন্ধকারে
সূর্যহীন, শব্দহীন বিস্ফোরণের মতো আমি অলৌকিক
খেলাঘর বেঁধে দেব।

তাই তারা ডুবে গেল প্রয়োজনে যাদের এনেছ।

আজ, অপরাহ্নকালে, আমি একা জলের আঁধার ছেড়ে উঠে যাব
সেই ক্ষমতা, বিচার, সমস্তই ভুলে গেছি,
মনে হয় উঠে এলে বাহিরের স্থল জুড়ে এমন
অন্ধকার–এত গাঢ়, এত স্তব্ধতার,
আর বুঝি পাবো না জীবনে।

.

কেবল পাতার শব্দে

কেবল পাতার শব্দে আমি আজ জেগেছি সন্ত্রাসে।
ভেবেছি সমস্ত দিন এত লেখা, এত গূঢ় প্রশ্ন উত্থাপন
তার পিছে কোটি কোটি উদ্বেল কাঁচের শিখরে
উঠেছে গীর্জার সারি–ধ্বনিরোল–মাতৃকা মেরীর মতন।

আজ আছি চিরন্তন রৌদ্র ও হিম-সকালের
আবরণ উদ্ভাবনে–যে-প্রহর বাজে না চকিতে
কেবলই বুকের তলে ক্ষয়ে যায়, অজ্ঞান, অলক্ষ্য যাত্রায়,
পুরনো পাতার শব্দে, ঝরে পড়া অঘ্রানে, শীতে।

অথবা পূর্বে এসে দাঁড়িয়েছি–খামারের লোহার শিকল
অব্যবহৃত তাই খোল না, বা খুলিনি কি ভুলে
অথবা শিশির তাকে এত দূর গ্রাস করে–দৃষ্টির অতল

সীমাহীন কুয়াশায় তেমনই উঠেছ কেউ আমার মতন–
ভয়ে, দুঃখে, অকস্মাৎ কোনো শব্দে, দুয়ার না খুলে
শুনেছ সমস্ত দিন নীলিমায় গৃধিনীর অনন্ত পতন।

.

আবাস

পথ হতে সরে যাও। শোনা যায় পাতার মর্মর।
ফেরার সময় হল শিশুদের। হে ধর্মতস্কর,
আর কেন বিদপ্রতীক্ষাম্লান হরীতকী ডালে
বসেছে পাখির মতো, পৌষের এ-হেন সকালে!

আমি বাতায়নতলে শুয়ে আছি–বেশি দূর যাই না কোথাও
কেননা শূন্যতা হতে ঝরে সব–আকাশ কুসুমরাশি,
বার্ষিক ক্ষুধাও,
অফুরান অনুপ্রেরণার মতো মনে হয় সূর্যে এসেছিলে
মনে হয়, নিয়মনিষ্ঠার মতো আরো কিছু আছে কি নিখিলে?

পরিমাপে দিন গেল। যে-কোনো গার্হস্থ্য হতে
যাত্রীবদলের ঘন্টা বাজে। দেখা হবে ফের–
একদিন মূঢ়, অন্ধ পাতালতিমিরে তুমি পেতে বেখো কান,
হে ধর্মতস্কর, হায় বোঝা যাবে নাকি সেই
কবিদের শৈশবের গান!

.

ময়ূর

ময়ুর, বুঝি-বা কোনো সূর্যাস্তে জন্মেছ।
এবং মেঘের তলে উল্লাসে নতুন ডানাটিকে মেলে ধরে
যখন প্রথম খেলা শুরু হবে–সেই স্থির পরকালে
আমি প্রথম তোমার দেখা পেয়েছি, ময়ূর।

সমুদ্রসৈকত ধরে এত দূর, এত গাঢ় স্তব্ধতার কাছে এসে
তোমার প্রবল দৌড় দেখা গেল, যেন
আরো শব্দহীনতার প্রতি–অন্ধকার ঝাউবনে–অস্তিত্ব-জটিল
আমাদের আর্তরবে ডেকেছ সহসা

সেদিন বনের শেষে নির্বসন যৌবনের চোখে
বিদ্যুৎচমক বলে মনে হল তোমার প্রতিভা
মনে হল নবীন নবীনতমা সৃষ্টির ক্ষমতাও বুঝি
এইভাবে ক্রমাগত অন্তহীনতার বুকে মিশে যায়।

ফিরে দাও সাগরে আবার। ফিরে দাও উন্মাদ তুফানে
অস্তিত্বকে ফিরে দাও। বিপুল পৃথিবীময় পাথরের বুকে
আমি তার ভেঙে পড়া দেখেছি গর্জনে। দেখেছি আছাড়
ডুবন্ত জাহাজ থেকে ভেঙে নেয় পাটাতন, জয়ের মাস্তুল।

তবুও ঝড়ের শেষে, তবুও দিনের শেযে, আন্ধকার বনে,
বৃষ্টির মেঘের তলে শোনা গেল আর্ত কেকারব–
বুঝি নির্জনতা পেয়ে পুনর্বার মেলেছ বিশাল,
নক্ষত্রে সাজানো ডানা। পেয়েছ নির্দেশ?

.

সমুদ্রগামী

সেই মাল্লাদের রক্তে আমি জন্মিয়েছি
যাদের জীবনে সূর্য হৃদয়, বিস্ময়,
বুঝেছি সমস্ত নৌকো একই দিকে চলে
যদিও বিভিন্ন চলা, বহু দ্বীপের আশ্রয়।

এখন লবণজলে, আগুনে ও ঘামে,
সূর্যকে দেখেছি ফিরে মাথার উপর–
যাবো দূর অস্তাচলে, সূর্যাস্তের পানে,
যদি শুনি তোমাদের আর্ত কণ্ঠস্বর।

এই স্রোত সামুদ্রিক–সমুদ্র কি জানে?
পিতৃপিতামহ আজ তোমরা কি জেনেছ?
জানাবে কি আমাদের শত অপমানে
গ্লানি নেই। তবু তরঙ্গ রয়েছে
রয়েছে সিন্ধুর ডাক–সিন্ধুশকুনের–
ধাতু-সমুজ্জ্বল সেই বেশ্যাদের মানে।

.

কবির উত্থান

যদি না জাগাও গান খরশব্দে, ইস্পাতনিক্কণে
তবু আজ খোলা তরঙ্গের মতো ভয়াবহ, চেতনাসম্ভব
ফেনপুঞ্জে সেই কবি যাঁর জন্ম দ্রাক্ষা ও পাথরে
অথবা বিপথগামী কোনো মূর্তির শ্বেত, সবুজ অন্তর
ফেটে শৈবালের সন্তানের মতো যাঁর জন্ম ছিল–
তারই বার্তা উন্মার্গের গোধূলিতে এখন উঠেছে।

এ কোন্ নক্ষত্র?

যদি না জাগাও গান ভোরবেলা গাভীর স্বননে
তবুও তোমার পক্ষ চিরকাল এমনই কি কলঙ্কলাঞ্ছন?
ভোরবেলাকার ক্লান্ত জ্যোতির্মণ্ডলতলে গত রজনীর
শেষ চুম্বনের মতো তার নিশ্বাস ফুরালে–

চেতনাউদ্ভূত কবি তাকে কি শায়িত রেখে চলে যাব যে-দিকে সম্ভব?

.

যাত্রাপথ

সমুদ্র এখন আর সমুদ্রের কোনো রূপে নয়
স্তম্ভিত তারার মতো আলো দেয় কূলে, উপকূলে,
জানো নাকি এই জল লঙ্ঘনের—বিজয়শঙ্খের–

হঠাৎ আগুন হয়ে ফেটে-পড়া দূর আরাকানে
হেমন্ত রাত্রির বুক ভরে আছে কর্কট, মিথুন,
এ যেন চূর্ণতা আজ পৃথিবীর, সুরমণ্ডলের–

একটি তরঙ্গ হতে দিগন্তের তরঙ্গনিক্ষেপে
যেতে যেতে শোনা গেল সেই রোল, অর্গ্যানবিধুর–

‘তুমি আজ ব্যবহার–ব্যবহার শুধু।’
সোনালি বালির তলে অব্যবহৃত
রক্ত নারিকেল একি আমার হৃদয়?
এ কি তার অন্তিম বিস্ফার?

.

কার্নিভাল

বেলুন ছেঁড়ার শব্দ, করতালি, ঐ নীল দ্যুতি,
জলের বুকের মাঝে হাউই উঠেছে–চলো কার্নিভালে,
চলো সেই উৎসবের, সৌরভের, নিষেধের, লোহার কাঁপনে,
আবার প্রবল টানে মিশে যাই দ্রুত ঘূর্ণি-চালে

মুছে যাবো যেন ঊর্ধ্বে বাষ্প ক্ষণিকের
পাশাপাশি অনুজ্জ্বল ছোট বড় রথে ও ঘোড়ায়
বিস্মিত ব্যাকুল রেখে–আমি জানি ফুর্তি ও পিপাসা
আমারই প্রতাপ আজ, বাকি সব মৃত, হতকায়

চিকিৎসকের মতো ক্লান্তিহীন, সর্বজ্ঞ, মেধাবী।
আমি দূর নক্ষত্রের উন্মীলনে খুলে ঝরে পড়ি–
এই রাতে, স্ফুলিঙ্গ-ওড়ানো শব্দে, শত বহ্ন্যুৎসবে,

আমার ক্ষমতা চাই–চিরদিন ক্ষমতা, শর্বরী।
আমার ঘূর্ণি চাই, প্রবল বাহুর টান, এ কি নয় নাচ?
এ কি নয় লজ্জাহীন, নষ্টবুদ্ধি, উলঙ্গের সেই আকর্ষণ?

.

সেবাস্টিয়ান বাখ্‌

একদিন বড়ো মুর্খ হবো। বসন্তে ব্যাপক কোনো লতার আড়াল থেকে
গোপন পল্লবজাল সরিয়ে নির্ভয়ে একদিন ডাক দেব ‘কুহু’
অথবা সবুজ আলো গম্ভীর, পত্রবিরহিত,
আমাকে ফলের মতো শূন্যে দেবে দোলা–দেবে সঞ্চালন–

অথবা সূর্যের তাপে, শতমারীবীজে আমি একদিন উন্মুল বনানী
নীল পাহাড়ের তলে চলে গেছি–স্তব্ধ এভিন্যুএ
যত দূর ধ্বনিপল্লববীথি আন্দোলিত—অপস্রিয়মাণ–
তত দূর। সহসা কবির কণ্ঠে কোকিলের মূর্ছা ভেঙে ওঠে।

একটি সুরের জন্ম শত-শতাব্দীর আবহমানতার বুকে দাঁড় ফেলে,
নৌকো বেয়ে যাওয়া
এ যেন উৎসবশেষে, নিরালোক ক্লান্ত ঝড়ে, চূর্ণবিচূর্ণিত
রৌদ্ররশ্মিকণা! আজো নই সুর–নই গান–

নই উত্থানপতনে কোনো ভ্রষ্ট রাজা, গীর্জার আঁধার।
তবুও আঙুল কেন উন্মাদক? কেন আঙুলে অক্ষর?
কেন আমার ক্ষমতা নেই বিশাল ধ্বংস হয়ে জন্মিয়ে ওঠার
-–কেন নেই ভয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *