চেনা বামুনের পৈতা লাগে না
বামুন বা বামন হলো ব্রাহ্মণ। পুরোহিত অর্থেও বামুন পরিচিত। আজকে ব্রাহ্মণ বা বামুন হিসেবে পরিচিত যারা তারা শাস্ত্রনিয়মে সবাই কিন্তু ব্ৰাহ্মণ বলে গণ্য হয় না। অর্থাৎ ব্রাহ্মণের সন্তান হলেই ব্রাহ্মণ হবে তা শাস্ত্রব্যাখ্যা নয়। ব্রাহ্মণের লক্ষণ হলো—
যোগস্তপো দমো দানং ব্রতং শৌচং দয়া ঘৃণা
বিদ্যা বিজ্ঞানমাস্তিক্যমেতদ্ ব্ৰাহ্মণলক্ষণং ॥
অর্থাৎ— যোগ, তপ, দম (শাসন বা নিয়ন্ত্রণ), দান, ব্রত, শৌচ (পবিত্রতা), দয়া, ঘৃণা, বিদ্যা, বিজ্ঞান, আস্তিক্য (শাস্ত্রে আস্থাশীল) এই কয়েকটি হলো ব্রাহ্মণের লক্ষণ। ব্রহ্ম বা বেদ যে জানে, তা অধ্যয়ন করে এবং তদ্বারা উপাসনা করে সেই ব্রাহ্মণ। আর দ্বাদশ শতকে প্রচলিত কুলীন ব্রাহ্মণের লক্ষণ হলো—
আচারো বিনয়ো বিদ্যা প্রতিষ্ঠা তীর্থদর্শনং।
নিষ্ঠাবৃত্তিস্তপোদানং নবধা কুললক্ষণম্।।
অর্থাৎ-সদাচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থদর্শন, নিষ্ঠা, শাস্ত্রপাঠ, তপ ও দান-এই নয়টি হলো কুলীনের লক্ষণ। এজন্য পৈতা বা যজ্ঞসূত্রে নয়টি সুতা থাকে নয়টি গুণের প্রতীকরূপে। পৈতা শব্দ এসেছে পবিত্রা শব্দ থেকে। নয়টি গুণ বা নবগুণের জন্য পৈতার আরেক নাম নগুণ। আজকের ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত অর্থাৎ বিদ্যা না থাকলেও ব্রাহ্মণের সন্তানকে ব্রাহ্মণ হিসেবে দেখে অভ্যস্ত বর্তমান সমাজে উপনয়ন বা পৈতা বা নগুণ ধারণের রেওয়াজ চালু আছে।
প্রাচীনকালে বেদবিদ্ ব্রাহ্মণরা যখন তখন যজ্ঞসূত্র বা পৈতা ব্যবহার করতেন না। এ বিষয়ে দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯ খ্রি.) বলেন—
‘নব্রাহ্মণ্যের পূর্বে (অর্থাৎ মোটামুটিভাবে ১১৫০ খ্রিস্টাব্দের আগে এদেশে সামাজিক যে অবস্থা বিদ্যমান ছিল, তাহা এখন অনুমান করাও দুঃসাধ্য। ব্রাহ্মণেরা সমস্ত সমাজ ভাঙ্গিয়া চুরিয়া নূতন করিয়া গড়িয়াছিলেন। বৈদিক সময়ের অনেক পরেও পৈতাটা সর্বদা কাঁধে ঝুলাইয়া রাখা ব্রাহ্মণগণের পক্ষে অপরিহার্য ছিল না। গৃহ্যসূত্রে পুনঃপুন যজ্ঞ অথবা অপরাপর ধর্মকার্যের সময়ে পৈতা ব্যবহারের প্রয়োজন স্বীকৃত হইয়াছে। এমন কি পৈতা না থাকিলে উত্তরীয় গলে দিয়া ঐ সকল কার্য করিবার বিধি প্রদত্ত হইয়াছে। সহজ বুদ্ধি দ্বারাও বুঝা যায় যে, অনাবশ্যক একটা ভার কাঁধে করিয়া দিনরাত লোকের পৈতা পরার শখ মিটাইবার ইচ্ছা স্বাভাবিক নহে। পৈতার নাম যজ্ঞসূত্র, যজ্ঞের সময়েই উহা পরিবার বিধি, এই জন্যই উহার ঐ নাম হইয়াছিল। পুরোহিতগণের সর্বদা পূজা, যজ্ঞ ইত্যাদি করিতে হইত, তাহারা পৈতা অনেক সময়েই গলায় পরিয়া থাকিতেন।
বাঙ্গলা ময়নামতীর গানে দৃষ্ট হয়, গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাসগ্রহণের শুভ সময় নির্ণয় করিবার জন্য পুরোহিতকে ডাকাইয়া পাঠান হইলে, তিনি উত্তরীয় ও পৈতাটি পরিয়া রাজসভায় চলিলেন। উহার কোনোটিই তাহার গলায় ছিল না—
চটক ধুতি মটক ধুতি পরিধান করিয়া।
যোড় যোড় পৈতা দিল গলায় তুলিয়া ॥
বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে বাঙ্গলার অনেক ব্রাহ্মণই পৈতা ছাড়িয়াছিলেন। কুলজীগ্রন্থের একটিতে এক ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে লিখিত আছে—পৈতা ছাড়ি পৈতা লয় বৈদিক দেয় পাতি।
সুতরাং ব্রাহ্মণ্যপ্রভাবের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে যে পৈতা নূতন করিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা প্রমাণিত হইতেছে।…মুসলমান বিজয়ের বহু পরেও যে পৈতা সম্বন্ধে খুব আঁটাআঁটি নিয়ম ছিল না—তাহার আভাস লোচনদাসকৃত চৈতন্যমঙ্গলে দৃষ্ট হয়। চৈতন্য প্রভু যখন পূর্ববঙ্গে ভ্রমণের জন্য যাইতেছিলেন, তখন তিনি তাহার স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ নিজের গলার পৈতাটি খুলিয়া পত্নী লক্ষ্মীদেবীকে দিয়া যান। সর্পদষ্ট হইয়া লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যুর প্রাক্কালে তাহার স্বামীর পাদুকা ও পৈতা সম্মুখে রাখিয়াছিলেন। উত্তরকালে অপরাপর শ্রেণীর সঙ্গে ব্রাহ্মণের পার্থক্য সুস্পষ্ট করিবার জন্য ব্ৰাহ্মণগণ পৈতার ব্যবহারটা অপরিহার্য করিয়াছিলেন।
আগে বিদ্যা ও গুণের কারণে এবং সমাজে মান্য হিসেবে ব্রাহ্মণরা যখন তখন পৈতা ব্যবহার করার প্রয়োজন মনে করতেন না। অন্তত মোগল আমলের আগে পর্যন্ত ব্রাহ্মণের পৈতা ব্যবহার আজকের মতো সার্বক্ষণিক ছিল না। আজ জ্ঞান, গুণ, পাণ্ডিত্য, পবিত্রতা ইত্যাদির অভাব সর্বত্র। আসল জ্ঞানীর বাহ্য-পরিচয় দরকার না হলেও অজ্ঞ বা মূর্খেরা নিজেদের বাহ্য- পরিচয়কে প্রধান করে সমাজকে ধোঁকা দিতে চায় বলে এই প্রবাদ।