৮ |
|
অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা |
|
অর্জুন। | কোনো গৃহ নাই তব, প্রিয়ে, যে ভবনে কাঁদিছে বিরহে তব প্রিয়পরিজন? নিত্য স্নেহসেবা দিয়ে যে আনন্দপুরী রেখেছিলে সুধামগ্ন করে, যেথাকার প্রদীপ নিবায়ে দিয়ে এসেছ চলিয়া অরণ্যের মাঝে? আপন শৈশবস্মৃতি যেথায় কাঁদিতে যায় হেন স্থান নাই? |
চিত্রাঙ্গদা। | প্রশ্ন কেন। তবে কি আনন্দ মিটে গেছে। যা দেখিছ তাই আমি, আর কিছু নাই পরিচয়। প্রভাতে এই-যে দুলিতেছে কিংশুকের একটি পল্লবপ্রান্তভাগে একটি শিশির, এর কোনো নামধাম আছে? এর কি শুধায় কেহ পরিচয়। তুমি যারে ভালোবাসিয়াছ, সে এমনি শিশিরের কণা, নামধামহীন। |
অর্জুন। | কিছু তার নাই কি বন্ধন পুথিবীতে। এক বিন্দু স্বর্গ শুধু ভূমিতলে ভুলে পড়ে গেছে? |
চিত্রাঙ্গদা। | তাই বটে। শুধু নিমেষের তরে দিয়েছে আপন উজ্জ্বলতা অরণ্যের কুসুমেরে। |
অর্জুন। | তাই সদা হারাই-হারাই করে প্রাণ; তৃপ্তি নাহি পাই, শান্তি নাহি মানি। সুদুর্লভে, আরো কাছাকাছি এসো। নামধামগোত্রগৃহ-বাক্যদেহমনে সহস্র বন্ধনপাশে ধরা দাও প্রিয়ে। চারি পার্শ্ব হতে ঘেরি পরশি তোমায়, নির্ভয় নির্ভরে করি বাস। নাম নাই? তবে কোন্ প্রেমমন্ত্রে জপিব তোমারে হৃদয়মন্দিরমাঝে? গোত্র নাই? তবে কী মৃণালে এ কমল ধরিয়া রাখিব? |
চিত্রাঙ্গদা। | নাই, নাই, নাই। যারে বাঁধিবারে চাও কখনো সে বন্ধন জানে নি। সে কেবল মেঘের সুবর্ণছটা, গন্ধ কুসুমের, তরঙ্গের গতি। |
অর্জুন। | তাহারে যে ভালোবাসে অভাগা সে। প্রিয়ে, দিয়ো না প্রেমের হাতে আকাশকুসুম। বুকে রাখিবার ধন দাও তারে, সুখে দুঃখে সুদিনে দুর্দিনে। |
চিত্রাঙ্গদা। | এখনো যে বর্ষ যায় নাই, শ্রান্তি এরি মাঝে? হায় হায়, এখন বুঝিনু পুষ্প স্বল্পপরমায়ু দেবতার আশীর্বাদে। গত বসন্তের যত মৃতপুষ্পসাথে ঝরিয়া পড়িত যদি এ মোহন তনু আদরে মরিত তবে। বেশি দিন নহে, পার্থ। যে কদিন আছে, আশা মিটাইয়া কুতূহলে, আনন্দের মধুটুকু তার নিঃশেষ করিয়া করো পান। এর পরে বারবার আসিয়ো না স্মৃতির কুহকে ফিরে ফিরে, গত সায়াহ্নের চ্যুতবৃন্ত মাধবীর আশে তৃষিত ভৃঙ্গের মতো। |