চরিত্রহীন – ১১-১২

এগার

উপেন্দ্র সতীশের শীর্ণ শুষ্ক মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন, ভায়ার কি এই ডাক্তারি শেখার নমুনা নাকি?

সতীশ হাসিয়া কহিল, হলো না উপীনদা।

উপেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হলো না কি রে?

সতীশ লজ্জিত হইয়া বলিল, ডাক্তারি আমার সহ্য হল না উপীনদা।

উপেন্দ্র স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল সতীশের উন্নত দেহটার দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন, ভালই হয়েছে। পাড়াগাঁয়ে গিয়ে অনর্থক কতকগুলো জীবহত্যা করতিস, তার পাপ থেকে ভগবান তোকে রক্ষা করেছেন।

মাস-খানেক পরে আর একদিন উপেন্দ্র সতীশকে ডাকিয়া বলিলেন, আমার সঙ্গে একবার কলকাতায় যেতে হবে সতীশ।

সতীশ হাতজোড় করিয়া বলিল, ঐ হুকুমটি করো না উপীনদা। কলকাতা বেশ শহর, চমৎকার দেশ, সব ভাল, কিন্তু আমাকে যেতে বলো না।

কথাটা সতীশ তামাশার ছলেই বলিতে গেল বটে, কিন্তু সে ছলনা তাহার চাপা ব্যথাটাকে চাপিয়া রাখিতে পারিল না। তাহার ছদ্মহাসি বেদনার বিকৃতিতে এমনই রূপান্তরিত হইয়া দেখা দিল যে, উপেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার নিশ্চয় বোধ হইল, সতীশ কি যেন সেখানে করিয়া আসিয়াছে, তাহা তাঁহার কাছে গোপন করিতেছে। ক্ষণেক পরে বলিলেন, তবে থাক সতীশ। তোর শরীরও ভাল নয়, আমি একাই যাই।

উপেন্দ্রর মনের ভাব অনুমান করিয়া সতীশ কুণ্ঠিত হইয়া প্রশ্ন করিল, কবে যাবে উপীনদা?

আজ।

আজই? আচ্ছা চলো, আমিও যাই। বলিয়া হঠাৎ সম্মত হইয়া সতীশ ঘরে ফিরিয়া আসিল, এবং মুহূর্তকালের মধ্যেই কলিকাতার জন্যই অধীর হইয়া উঠিল। বেহারীকে বলিল, আর একবার তল্পী বেঁধে ফ্যাল বেহারী, কলকাতায় যেতে হবে।

বেহারী চিন্তিত-মুখে জিজ্ঞাসা করিল, কবে বাবু?

সতীশ সহাস্যে বলিল, কবে কি রে! আজই রাত্রের ট্রেনে।

আচ্ছা, বলিয়া বেহারী মুখ ভারী করিয়া চলিয়া গেল।

সতীশ তাহার অপ্রসন্ন মুখ লক্ষ্য করিয়া মনে মনে কহিল, বেহারীর এখানে ত কাজকর্ম নেই, তাই ওখানে খাটুনির ভয়ে যেতে চায় না। কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, সতীশ বৃদ্ধের মনের কথা একেবারেই বুঝে নাই।

ইতিপূর্বে একদিন সতীশ কথায় কথায় বেহারীকে বলিয়াছিল, আচ্ছা বেহারী, এতদিনে সাবিত্রী ত নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে, কিন্তু তখন কোথায় গিয়েছিল বলতে পারিস?

বেহারী সংক্ষেপে বলিয়াছিল, না বাবু! বলিলে ত সে অনেক কথাই বলিতে পারিত, কিন্তু একদিন সাবিত্রীর মুখের উপর সে নাকি তাহার পুরুষত্বের অহঙ্কার করিয়া আসিয়াছিল, কোন উপলক্ষেই সেইটুকু গর্বকে সে ক্ষুণ্ণ করিতে পারিল না।
যেদিন কলিকাতা হইতে বাটী ফিরিয়া আসিয়া সতীশ নিজের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই যুক্তকরে আর্দ্রকণ্ঠে বলিয়াছিল, ভগবান, যা কর তুমি ভালর জন্যই কর! সেদিন সৃষ্টিকর্তার কোন্‌ বিশেষ কর্মটা স্মরণ করিয়া যে সে এতবড় ধন্যবাদ উচ্চারণ করিয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিলে বোধ করি সে বলিতে পারিত না। অথচ কতবড় সঙ্কটের মুখ হইতে সে যে নিরাপদে ফিরিয়া আসিতে পারিয়াছে, কতবড় দুশ্ছেদ্য জালের ফাঁস কত সহজে ছিন্ন করিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইতে পাইয়াছে ইহা সে নিশ্চিত জানিত, এবং এ সৌভাগ্যকে সে কৃতজ্ঞতার সহিতই গ্রহণ করিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু অন্তরশায়ী অবোধ মন তাহার সেদিকে দৃক্‌পাতমাত্র করে নাই, উপুড় হইয়া পড়িয়া নিশিদিন একভাবেই কাঁদিয়া কাটাইতেছিল। তবু চেষ্টা করিয়া সে পূর্বের মতই তাহার ছেলেবেলার বন্ধু-বান্ধব, থিয়েটার, গান-বাজনার আখড়া প্রভৃতিতে মিশিতেছিল, কিন্তু কোনক্রমেই পূর্বের মত আর মিলিতে পারে নাই। বরং যে লোক ঘরের গৃহিণীর সহিত কলহ করিয়া বাহিরের কর্তব্য সম্পন্ন করিতে আসে, তাহারই মত সে ছিদ্রান্বেষী ও অসহিষ্ণু হইয়া নির্বিচারে সমস্তই দংশন করিয়া ফিরিতেছিল। এমনি করিয়া দিনযাপনের মাঝখানে হঠাৎ আজ কলিকাতা যাইবার আহ্বান শুনিয়াই তাহার বিদ্রোহী গৃহলক্ষ্মী ধূলিশয্যা ছাড়িয়া উঠিয়া বসিল, এবং ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দর প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করিয়া যাত্রা করিয়া পা বাড়াইয়া দাঁড়াইল।

সেই রাত্রেই কলিকাতার উদ্দেশে উপেন্দ্র ও সতীশ মেল-গাড়ির একখানা সেকেন্ড ক্লাস কামরায় চড়িয়া বসিলেন।

বাঁশী বাজাইয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিলে উপেন্দ্র জানালা হইতে মুখ সরাইয়া লইয়া বিছানায় কাত হইয়া শুইয়া পড়িলেন, কিন্তু সতীশ জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিল।

মেল-ট্রেন সব স্টেশনে থামে না। প্রান্তর, নদ-নদী, গ্রাম, পথ অতিক্রম করিয়া হুহু শব্দে ছুটিয়া চলিয়াছে এবং সেই দ্রুত ধাবনের পরিমাণ করিয়া কদাচিৎ নিঃসঙ্গ অদূরবর্তী বনস্পতি নিমেষে অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে। দিগন্তে বৃক্ষরাজি ও বাঁশঝাড় অন্ধকার করিয়া আছে এবং তাহারই নিম্নে নদীর বক্রাংশে শুভ্র জলরেখা জানালার নীল কাচের ভিতর দিয়া দেখা যাইতেছে। বাহিরে বৃক্ষ, গুল্ম, মাঠ, লাইনের পাশে উলুবন ও শুষ্ক জল-খাদ সর্বত্র ম্লান জ্যোৎস্না বিকীর্ণ হইয়া আছে। সতীশের চোখে জল আসিয়া পড়িল। এই পথে কতবার সে আসিয়াছে, গিয়াছে, এই নিস্তব্ধ শান্ত প্রকৃতি কতবার সে এমনি ম্লান জ্যোৎস্নালোকে দেখিয়া গেছে, কিন্তু কোনদিন এমনভাবে তাহার চোখে ধরা দেয় নাই। তাহার মনে হইতে লাগিল, সমস্তই বিচ্ছিন্ন, নির্লিপ্ত, মৃত। কেহই কাহারও জন্য ব্যাকুল নয়, কেহই কাহারও মুখ চাহিয়া অপেক্ষা করিয়া নাই। সবাই স্থির, সবাই উদ্বেগশূন্য, সবাই আপনা-আপনি সম্পূর্ণ। এই নির্বিকার, উদাসীন ধরিত্রীর পানে চাহিয়া থাকিতে তাহার ক্লেশ বোধ হইতে লাগিল। সে চোখ মুছিয়া সরিয়া আসিয়া বেঞ্চের উপর চিত হইয়া শুইয়া পড়িল। কিন্তু ক্ষণকাল পরেই উঠিয়া পড়িয়া, তোরঙ্গ খুলিয়া একটা সানাই বাহির করিয়া উপেন্দ্রকে লক্ষ্য করিয়া আস্তে আস্তে কহিল, গাড়ির শব্দে যদি তোমার ঘুমের ব্যাঘাত না হয় ত বাঁশীর শব্দেও হবে না। আমি ত ঘুমুতে পারিনে, বলিয়া সে আর একবার জানালার কাছে সরিয়া আসিয়া বসিল এবং বাহিরের দিকে চাহিয়া বাঁশীতে ফুঁ দিল।
উপেন্দ্রর সাড়া পাওয়া গেল না। ভগবান সতীশকে গাহিবার গলা এবং বাজাইবার হাত দিয়াছিলেন। এদিকে তিনি কৃপণতা করেন নাই। শিশুকাল হইতে শুরু করিয়া এই বিদ্যাটাই সে শিক্ষা করিয়াছিল এবং শিক্ষা বলিতে যাহা বুঝায়, ঠিক তেমনি করিয়াই শিখিয়াছিল। সতীশ বাঁশী বাজাইতে লাগিল। সেই শুদ্ধসুন্দর অনির্বচনীয় সঙ্গীত-সৃষ্টি বুঝিবার লোক কেহ ছিল না—শুধু বাহিরে আকাশের খণ্ড চন্দ্র তাহাকে অনুসরণ করিয়া ছুটিয়া চলিতে লাগিল এবং মাটির উপর সুপ্ত জ্যোৎস্নার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। ক্রমে গাড়ির গতি যখন মন্দ হইয়া আসিল এবং বুঝা গেল, স্টেশন নিকটে আসিয়াছে, তখন সে বাঁশী নামাইয়া রাখিল।

উপেন্দ্র হাই তুলিয়া উঠিয়া বসিলেন, নাঃ, যদি শিখতে হয় ত সানাই বাজাতে শিখব। সেদিন তোর সেতার শুনে মিথ্যে একটা সেতার কিনে ফেললাম। টাকাগুলোই মাটি।

সতীশ হাসিয়া বলিল, রক্ষে কর উপীনদা, তাই বলে যেন সানাই কিনো না। ঘরে বসে ও যন্ত্রটা শেখবার চেষ্টা করলে আর পাড়ায় লোক টিকতে পারবে না।

উপেন্দ্র লেশমাত্র কুণ্ঠিত না হইয়া বলিলেন, না, শিখি ত তোরই ঘরে বসে শিখব। বলিতে দুজনেই হাসিয়া উঠিলেন।

পরদিন অনেক বেলায় গাড়ি হাওড়ায় থামিলে উপেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, তুই কোথায় যাবি রে?

সতীশ আশ্চর্য হইয়া বলিল, ও আবার কি কথা? তোমার সঙ্গে।

তোর যাবার জায়গা নেই?

বেশ যা হোক তুমি!

এ সম্বন্ধে আর কোন কথাও হইল না।

স্টেশনে নামিতেই একজন বিলাতী পোশাক-পরা বাঙ্গালী সাহেব উপেন্দ্রর হাত ধরিলেন। ইনি উপেন্দ্রর বাল্যবন্ধু জ্যোতিষ রায়, ব্যারিস্টার। ‘তার’ পাইয়া লইতে আসিয়াছেন। বাহিরে তাঁহার গাড়ি দাঁড়াইয়া ছিল। অল্পস্বল্প জিনিসপত্র যাহা সঙ্গে ছিল, কুলি গাড়ির উপরে তুলিয়া দিলে তিনজনে ভিতরে উঠিয়া বসিলেন। বেহারী কোচ-বাক্সে চড়িয়া বসিল এবং কোচম্যান গাড়ি হাঁকাইয়া দিল। অনেক পরে, অনেক রাস্তা-গলি পার হইয়া বড় বড় থাম দেওয়া প্রকাণ্ড একটা বাটীর সম্মুখে আসিয়া গাড়ি থামিল। তিনজনে নামিয়া গেলেন।

বারো

সন্ধ্যা হইতে আর বিলম্ব নাই। উপেন্দ্র ও সতীশ পাথুরেঘাটায় একটা অতি সঙ্কীর্ণ গলির মোড়ে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

উপেন্দ্র কহিলেন, এই গলিটাই নিশ্চয় বোধ হচ্চে।

সতীশ সন্দেহ প্রকাশ করিল, এর ভেতরে থাকতে পারে না, এটা কখনও নয়।

ভাঙ্গা দেওয়ালের গায়ে টিন মারা আছে, খুব সম্ভব ইহাতে একদিন গলির নাম লেখা ছিল, এখন আর পড়া যায় না। সতীশ বলিল, ভাল করে না জেনে ঢোকা যায় না, এটা পাতাল-প্রবেশের সুড়ঙ্গও হতে পারে!

উপেন্দ্র সহাস্যে বলিলেন, তুই তবে প্রহরী হয়ে থাক, আমি ভিতরে গিয়ে দেখে আসি।

সতীশ প্রথমে বাধা দিবার চেষ্টা করিল, পরে উপেন্দ্রর পশ্চাতে চলিতে চলিতে বলিল, উপীনদা, আমাদের মত বম্বেটে লোকেরাও এ-সব স্থানে সন্ধ্যের পরে আসতে সাহস করে না, তোমার খুব সাহস ত!

উপেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, বোম্বেটের সাহস কি ভদ্রলোকের চেয়ে বেশী সতীশ? দুষ্কর্ম করতে পারাকেই সাহস বলে না।

সতীশ সে কথার প্রতিবাদ না করিয়া অত্যন্ত সাবধানে পথ দেখিয়া চলিতে লাগিল। পায়ের নীচেই দুর্গন্ধ-পঙ্কিল খোলা নর্দমা, ক্ষীণদৃষ্টি সতীশের তাহাতে পড়িয়া যাইবার সম্পূর্ণ আশঙ্কা ছিল। একস্থানে ক্ষুদ্র গলি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ এবং অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিল। সতীশ পিছন হইতে উপেন্দ্রর জামার খুঁট টানিয়া ধরিল—উপীনদা, করচ কি, এই রাত্রে মারা পড়বে নাকি?

উপেন্দ্র হাসিয়া বলিলেন, আমার এতক্ষণে ঠিক মনে পড়েচে। আর একটা বাড়ির পরেই তেরো নম্বরের বাড়ি। প্রায় বছর-আষ্টেক আগে একদিন মাত্র এখানে এসেছিলাম, সেইজন্যেই প্রথমে চিনতে পারিনি। এখন চিনেছি, এই পথই বটে।

সতীশ বিশ্বাস করিল না। বলিল, পথ বটে, কিন্তু তোমার আমার জন্যে নয়। যাদের জন্যে বিশেষ করে এই পথের সৃষ্টি, তাদের কারো সঙ্গে গা ঠেকাঠেকি হয়ে গেলে, এ রাত্রে স্নান করে মরতে হবে, এইবেলা ফিরে যাই চল।

উপেন্দ্র জবাব না দিয়া সতীশের হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিলেন, এবং আরো একটু আগে আসিয়া একটা বাটীর সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিলেন, তুই সিগারেট খাস, তোর পকেটে দেশলাই আছে; একবার জ্বেলে দেখ দেখি, এটা ক’নম্বরের বাড়ি।

সতীশ আলো জ্বালিয়া বেশ করিয়া বাড়ির নম্বর পরীক্ষা করিয়া বলিল, ভাল পড়া গেল না, কিন্তু চৌকাঠের গায়ে খড়ি দিয়ে ১৩ নম্বর লেখা আছে। বোধ হয় তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু এই কথা জিজ্ঞাসা করি আমি, বাড়ির নম্বর তেরোই হোক আর তিপ্পান্নই হোক, এখানে তোমার প্রয়োজনটা কি হতে পারে?

উপেন্দ্র উত্তর না দিয়া ডাকিতে লাগিলেন, হারানদা! ও হারানদা!

উপরে, নীচে, কাছে, দূরে সর্বত্র অন্ধকার, শব্দমাত্রই নাই। সতীশ ভীত হইয়া উঠিল, উপেন্দ্র আবার ডাকিতে লাগিলেন।
বহুক্ষণে উপরের জানালা ঈষৎ মুক্ত করিয়া স্ত্রীকণ্ঠে সাড়া আসিল, কে?

উপেন্দ্র বলিলেন, দরজা খুলে দিতে বলুন। হারানদা কোথায়?

যাচ্চি, একটু দাঁড়ান।

ক্ষণপরেই দরজা খোলার শব্দের সহিত ক্ষীণ আলোর রেখা পথের উপরে আসিয়া পড়িল। উপেন্দ্র দরজা ঠেলিয়া চৌকাঠের উপর দাঁড়াইয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। স্ত্রীলোকটি কেরোসিনের ডিবা হাতে করিয়া একপাশে দাঁড়াইয়া আছে। মাথার উপরে অল্প একটুখানি আঁচলের ফাঁক দিয়া সযত্নরচিত কবরীর এক অংশ দেখা যাইতেছে। দেখা গেল, তাহার একটিমাত্র কেশও স্থানভ্রষ্ট হয় নাই। নিখুঁত সুন্দর মুখের উপর হাতের আলোকসম্পাতে ভ্রূযুগের মধ্যে সন্নিবিষ্ট কাঁচপোকার টিপ চিকচিক করিয়া উঠিল এবং ঈষৎ আনত চোখ দুটি দিয়া যে বিদ্যুৎ-প্রবাহ বহিয়া গেল, চতুর্দিকের নিবিড় অন্ধকারে তাহার অপূর্ব জ্যোতি ক্ষণকালের জন্য উভয়কেই বিভ্রান্ত করিয়া ফেলিল। সতীশ স্পষ্ট দেখিতে পাইল, ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা বাধা পাইয়া বারংবার ফিরিয়া যাইতেছে। সে উপেন্দ্রর গা ঠেলিয়া দিল। উপেন্দ্র সচকিত ব্যস্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, হারানদা কোথায়?

স্ত্রীলোকটি বলিল, তিনি উপরে আছেন। উঠতে হাঁটতে পারেন না। মা-ও আজ সাত-আটদিন শয্যাগত, বাড়ির মধ্যে শুধু আমি ভাল আছি। আপনি উপেন্দ্রবাবু ত? আমরা আশা করেছিলুম আপনি কাল আসবেন, তাই প্রস্তুত ছিলাম না। রান্নাঘরে থাকলে এদিকের সাড়াশব্দ শোনা যায় না, অনেক ডাকাডাকি করতে হয়। ওপরে আসুন, এখানে বড় ঠাণ্ডা,—বলিয়াই পথ দেখাইয়া উপরে যাইবার সিঁড়িতে উঠিতে লাগিল। দুই-তিন ধাপ উঠিয়া মুখ ফিরাইয়া হাতের আলোটা নীচু করিয়া বলিল, সাবধানে উঠিবেন, সিঁড়ির ইট অনেকগুলো খসে গেছে।

ইহার আশঙ্কা যে অমূলক নহে, তাহা চাহিবামাত্রই উভয়ে টের পাইলেন এবং সতর্ক হইয়া উঠিতে লাগিলেন। কোঠা-বাড়ি। পূর্বে উপরতলায় চার-পাঁচটি ঘর ছিল, তাহার গোটা-দুই একেবারে পড়িয়া গিয়াছে এবং একটা আগামী বর্ষায় পড়িবার জন্য ঠিক হইয়া আছে। বাকী তিনটার মধ্যে সুমুখের ঘরটায় তিনজনেই প্রবেশ করিলেন। প্রবেশমাত্রই বোঝা গেল, অত্যন্ত অনধিকার-প্রবেশ হইয়াছে। মূষিকের দল তখন জীর্ণ ও পুরাতন অব্যবহার্য শয্যা ও উপাধান হইতে তুলা বাহির করিয়া ঘরময় ছড়াইয়া যদৃচ্ছা বিচরণ করিয়া ফিরিতেছিল, অসময়ে আলোক ও জনসমাগমে ছুটাছুটি চেঁচামেচি করিয়া উঠিল। সমস্ত ঘরময় ভাঙ্গা টেবিল-চেয়ার, ভাঙ্গা কাঠের তোরঙ্গ, ভাঙ্গা টিন, খালি শিশি-বোতল এবং আরও কত কি প্রাচীন দিনের গৃহসজ্জার ভগ্নাংশ ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে। তাহারি একধারে একটা তক্তপোশ পাতা। ছেঁড়া গদি, ছেঁড়া তোশক, ছেঁড়া বালিশ প্রভৃতি গাদা করিয়া জোর করিয়া একধারে ঠেলিয়া রাখিয়া তাহারই একাংশে একটা মাদুর পাতা রহিয়াছে। এটা অভ্যাগতদের জন্য।
স্ত্রীলোকটি মেঝের উপর কেরোসিনের ডিবাটা রাখিয়া দিয়া কহিল, একটু অপেক্ষা করুন, আমি সংবাদ দিই। বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইবামাত্রই সতীশ জুতাসুদ্ধ সেই অভ্যাগতের আসনটির উপর লাফাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল।

উপেন্দ্র সভয়ে বলিয়া উঠিলেন, ও কি ও?

সতীশ ফিসফিস করিয়া তর্জন করিয়া উঠিল, আগে প্রাণ রক্ষে হোক, তার পরে ভদ্রতা রক্ষে হবে; দেখচ না, পায়ের কাছে আলো দেখে ঘরের সমস্ত সাপ-খোপ ছুটে আসচে।

সতীশ যেমন করিয়া ভয় দেখাইল, তাহাতে বিচার-বিতর্কের আর অবসর রহিল না। উপেন্দ্রও লাফাইয়া উঠিয়া পড়িলেন।

তক্তপোশের সেই সঙ্কীর্ণ জায়গাটিতে স্থানাভাবে উভয়ে যখন ঠেলাঠেলি করিতে লাগিলেন, স্ত্রীলোকটি ফিরিয়া আসিয়া সেই সময়ে কবাটের সুমুখে দাঁড়াইয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। ইঁহারা যে ভয় পাইয়াছেন, তাহা সে বুঝিতে পারিয়াছিল। বলিল, এটি আমার শ্বশুরের ভিটা, আপনারা অমর্যাদা করছেন!

উপেন্দ্র অপ্রতিভ হইয়া তাড়াতাড়ি নামিয়া পড়িলেন এবং সতীশের উপর অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বিড়বিড় করিতে লাগিলেন, এমনি ভয় দেখিয়ে দিলে,—এমনি করে উঠল—

সতীশ নামিল না। কিন্তু বিনয় করিয়া বলিল, ভয় কি সাধে দেখাই উপীনদা। আমার বিদ্যে চাণক্য শ্লোকের বেশী নয় জানি, কিন্তু এটুকু শিখেচি যে, আত্মরক্ষা অতি শ্রেষ্ঠ ধর্ম।

স্ত্রীলোকটির পানে চাহিয়া বলিল, আচ্ছা, আপনিই বলুন দেখি, আত্মরক্ষার্থে একটু নিরাপদ জায়গা বেছে নেওয়া কি অন্যায় কাজ হয়েছে? আপনার শ্বশুরের ভিটার অসম্মান করা আমাদের সাধ্য নয়, বরং যথেষ্ট সম্মাননার সঙ্গেই আপনার আশ্রিত প্রজাপুঞ্জের পথ ছেড়ে দিয়ে এইটুকু জায়গায় দুজনে দাঁড়িয়ে আছি।

তিনজনেই হাসিয়া উঠিলেন। ইহার পরিহাস যে এই দরিদ্র গৃহলক্ষ্মীটিকে ব্যথিত করে নাই, বরং ইহার ভিতর যে সরলতা ও সমবেদনা প্রচ্ছন্ন ছিল, এই তরুণী অতি সহজেই তাহা গ্রহণ করিতে পারিয়াছেন, তাহার হাস্যোজ্জ্বল মুখের ’পরে ইহার সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখিতে পাইয়া উপেন্দ্র মনে মনে অত্যন্ত আরাম বোধ করিলেন। তাহার মুখপানে চাহিয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন, প্রজাপুঞ্জ আপনার সুমুখে কখনই ওর উপরে অত্যাচার করতে সাহস করবে না। এখন ওই লোকটি বোধ করি নেমে আসতে পারে।

নিশ্চয়, বলিয়া কেরোসিনের ডিবাটা হাতে তুলিয়া লইয়া বধূ সতীশের দিকে চাহিয়া ভুবনমোহন হাসি হাসিয়া বলিল, এখন নির্ভয়ে রাজদর্শনে চলুন।

এইটুকু হাস্য-পরিহাসেই অপরিচিতের দূরত্বটা যেন একেবারেই কমিয়া গেল, এবং তিনজনেই প্রফুল্লমুখে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

রাজ-দর্শনেচ্ছু উপেন্দ্র ও সতীশ হাসিমুখে আর একটি ঘরে ঢুকিয়াই শিহরিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন। ক্রুদ্ধ গুরুমশায়ের অতর্কিত চড় খাইয়া হাস্য-নিরত শিশু-ছাত্রের মুখের ভাবটা যেমন করিয়া বদলায়, এই দুজনের মুখের হাসি তেমনি করিয়া এক-নিমেষে কালি হইয়া গেল।
ক্ষণেক পরে লাঞ্ছিত ভাবটা কাটিয়া গেলে উপেন্দ্র অদূরবর্তী শয্যার নিকটে গিয়া ডাকিলেন,—হারানদা!

হারান নির্জীবের মত পড়িয়া ছিলেন, অস্ফুটে বলিলেন, এস ভাই, এস। আর উঠতে বসতে পারিনে, তোমাকেও ক্লেশ দিলুম। এইটুকু বলিয়াই তিনি হাঁপাইতে লাগিলেন।

উপেন্দ্র ধপ করিয়া বিছানার একদিকে বসিয়া পড়িলেন। দুই চোখ তাঁহার জলে ভরিয়া গেল এবং সমস্ত বক্ষপঞ্জর দুলাইয়া দিয়া একটা অদম্য বাষ্পোচ্ছ্বাস তাঁহার কণ্ঠের প্রান্তসীমা পর্যন্ত ব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। কথা কহিতে সাহস করিলেন না—দাঁতের উপর দাঁত চাপিয়া শক্ত হইয়া বসিয়া রহিলেন। ওদিকে সতীশচন্দ্র মস্ত একটা কাঠের সিন্দুকের উপর শুষ্কমুখে বসিয়া রহিল।

মলিন ও শতচ্ছিন্ন শয্যার শিয়রে একটা মাটির প্রদীপ মিটমিট করিয়া জ্বলিতেছে, ঘরে অন্য আলো নাই, এইটুকু আলো রক্তশূন্য বিবর্ণ শীতল মুখের ’পরে লইয়া হারানের জীবন্ত মৃতদেহটা পড়িয়া আছে। সূর্যের উত্তাপ ও আকাশের বায়ু হইতে চিরদিন বিচ্ছিন্ন এই গৃহের অস্থিমজ্জায় যে জীর্ণতা ও অন্ধকার লালিত ও পুষ্ট হইয়া আসিয়াছে, এই কন্‌কনে শীতের রাত্রে অত্যল্প আলোকে, কুষ্ঠরোগের মত তাহা সমস্ত দেয়ালের গায়ে ফুটিয়া পড়িয়াছে। এই দিবানিশি অবরুদ্ধ গৃহের রুদ্ধ দুষ্ট বায়ু আত্মঘাতীর মুখোদ্গত বিষাক্ত ফেনের মত ফাঁপিয়া ফুলিয়া গৃহবাসীর কণ্ঠনালী যেন প্রতিমুহূর্তে রুদ্ধ করিয়া আনিতেছে। দ্বারে মৃত্যুদূতের প্রহরা পড়িয়াছে। সমস্ত দিকে চাহিয়া সতীশ বারংবার শিহরিয়া উঠিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, সে চীৎকার করিয়া ছুটিয়া একেবারে রাস্তার উপর আসিয়া পড়িতে পারিলে বাঁচে, এখানে মানুষের জীবন থাকে কি করিয়া? অনতি দূরে বধূটি দাঁড়াইয়া ছিল, সেদিকে একবার চাহিয়াই সে আরো যেন ভয় পাইয়া গেল। কোথায় গেল ঐ অতুল রূপ! কোথায় গেল ঐ হাসি; তাহার দৃষ্টির সম্মুখে যেন কোন্‌ এক প্রেতলোকের পিশাচ উঠিয়া আসিল। সে ভাবিতে লাগিল, স্বামী যার এই, সে আবার হাসে, পরিহাসে যোগ দেয়, খোঁপা বাঁধে, টিপ পরে! একমুহূর্তের জন্য তাহার সমস্ত নারীজাতির উপরেই ঘৃণা জন্মিয়া গেল।

এমন সময়ে হারান ডাকিলেন, কিরণ, উপীন এসেছে মা জানেন?

বধূ কাছে আসিয়া ঝুঁকিয়া পড়িয়া আস্তে আস্তে বলিল, মা ঘুমুচ্ছেন। ডাক্তার বলে গেছেন ঘুমুলে তাঁকে যেন জাগানো না হয়।

হারান মুখ বিকৃত করিয়া চেঁচাইয়া উঠিল, চুলোয় যাক গে ডাক্তার, তুমি যাও, বলো গে তাঁকে।

উপেন্দ্র নিকটে বসিয়া সমস্তই শুনিতে পাইতেছিলেন, ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, আজ রাত্রে জানিয়ে প্রয়োজন নেই হারানদা। কাল সকালে জানালেই হবে।
উপেন্দ্র বুঝিতে পারিলেন, ক্রমাগত রোগে ভুগিয়া হারান অত্যন্ত খিটখিটে হইয়া গিয়াছে। তাই, এই নিরপরাধিনী সেবাপরায়ণা বধূটির অকারণ তিরস্কারে একটা ব্যথা অনুভব করিয়া একটুখানি সান্ত্বনার ইঙ্গিত করিতে একবার তাহার মুখপানে চাহিয়া দেখিলেন। কিছুই দেখা গেল না। কিরণময়ীর আনত মুখে দীপের আলোক পড়ে নাই।

মুহূর্তমাত্র। পরক্ষণেই ক্রুদ্ধ বধূ দ্রুতপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

উপেন্দ্র বিমর্ষ হইয়া বসিয়া রহিলেন, এবং হারান পূর্বের মত হাঁপাইতে লাগিলেন। নিস্তব্ধ কক্ষ সতীশের কাছে আরও ভীষণ হইয়া উঠিল। অনতিকাল পরেই হারান হাত বাড়াইয়া উপেন্দ্রকে স্পর্শ করিয়া কাছে আসিতে ইশারা করিয়া অতি ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, সাত-আট বছর পরে দেখা, এর মধ্যে একবারও কি তোমার এখানে আসা হয়নি?

ইহার মধ্যে অনেকবারই উপেন্দ্রকে এদিকে আসিতে হইয়াছিল, কিন্তু তাহা স্বীকার করিতে পারিলেন না। বলিলেন, অসুখটা কি হারানদা?

হারান কহিলেন, জ্বর, কাসি ইত্যাদি। এখন ও-প্রসঙ্গের আর প্রয়োজন নেই, সমস্তই শেষ হয়েছে।

ওধারে সিন্দুকের উপর উপবিষ্ট সতীশ মনে মনে মাথা নাড়িল।

হারান পুনশ্চ বলিলেন, আমারও তোমার কথা মনে পড়েনি, সময়ে মনে পড়লে হয়ত কাজ হতো।

ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া নিজেই বলিলেন, কাজ আর কি হতো, তা নয়, থাক গে ও-সব কথা, একটা কাজ করো ভাই, আমার হাজার দুই-টাকার লাইফ-ইন্‌সিওর আছে, আর আছে এই ভাঙ্গা বাড়িটা, তুমি উকীল, একটা লেখাপড়া করে দাও, যেন সব জিনিসের উপর তোমারি পুরো হাত থাকে। তার পরে রইলে তুমি, আর আমার বুড়ো মা।

উপেন্দ্র বলিলেন, আর তোমার স্ত্রী?

আমার স্ত্রী কিরণ? হাঁ, ও ত আছেই। ওর বাপ-মা কেউ বেঁচে নেই, ওকেও দেখো।

উপেন্দ্র নির্নিমেষ-চোখে মুমূর্ষুর মুখের পানে চাহিয়া চাহিয়া ভাবিতে লাগিলেন।

সতীশ পকেট হইতে ঘড়ি বাহির করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, উপীনদা, রাত্রি দশটা বেজে গেছে, ওখানে ওঁরা বোধ হয় ব্যস্ত হচ্চেন।

হারান চাহিয়া দেখিয়া বলিলেন, এটি কে উপীন?

আমার বন্ধু, একসঙ্গেই কলকাতায় এসেছি। এখন তবে আসি হারানদা, কাল সকালেই আবার আসব।

না, কাল নয়, একেবারে কাগজ তৈরী করে পরশু এসো। যা-কিছু আমার আছে, আর যা-কিছু আমার বলবার আছে, সেইদিনেই বলে দেব, কোথায় আছ এখানে?

শহরের একধারে একজন বন্ধুর ওখানে উঠেছি।

যাইতে উদ্যত হইলে হারান ডাকিয়া বলিলেন, কিরণ?

উপেন্দ্র তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া বলিলেন, থাক হারানদা! সতীশের পকেটে দেশলাই আছে, স্বচ্ছন্দে নেমে যেতে পারব। তিনি বোধ করি কাজে ব্যস্ত আছেন।
তদুত্তরে হারান কি যে বলিলেন, বোঝা গেল না।

সতীশ কবাট খুলিতেই বোধ হইল কে যেন দ্রুতপদে সরিয়া গেল। সে সভয়ে পিছাইয়া দাঁড়াইল।

উপেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন, কি সতীশ?

কিছু না—তুমি এস, বলিয়া সে উপেন্দ্রর হাত ধরিয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। কি নিবিড় অন্ধকার! একে কৃষ্ণপক্ষের আকাশে মেঘ করিয়া আছে, তাহার উপরে চতুষ্পার্শ্বের উঁচু বাড়িগুলো সেই অন্ধকারকে যেন ঠেলিয়া আনিয়া নীচের অপ্রশস্ত উঠানটির উপরে এই ভাঙ্গা খোলা বারান্দার ভিতরে একেবারে জমাট বাঁধাইয়া দিয়াছে। দু’জনে আন্দাজ করিয়া সিঁড়ির নিকটে আসিতেই দেখিলেন, নীচে সেই কেরোসিনের ডিবাটা রাখিয়া কিরণময়ী স্থির হইয়া বসিয়া আছে। যাইতেই দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, আলো দেখাচ্ছি, সাবধানে নেমে আসুন। আপনাদের জন্যই বসে আছি।

এই অন্ধকার শীতল রাত্রে, এই দুরন্ত হিমের মধ্যে স্যাঁতসেঁতে ভিজা মাটির উপর একাকিনী বধূকে তাঁহাদের অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতে দেখিয়া এবং তাহার আসন্ন বৈধব্যের কথা মুহূর্তে স্মরণ করিয়া উপেন্দ্রর চোখে জল আসিয়া পড়িল।

সদরের কবাট তখনও বন্ধ করা হয় নাই, নীচে নামিয়াই সতীশ একেবারে গলির মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু উপেন্দ্র পিছন হইতে বাধা পাইয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলেন।

কিরণময়ী তাহার সকরুণ তীব্র চক্ষু দুটি তাঁহার মুখের উপরে পাতিয়া একটা বিশেষ ভঙ্গী করিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ক্ষণকালের নিমিত্ত উপেন্দ্র হতবুদ্ধির মত নিশ্চল হইয়া রহিলেন।

কিরণ জিজ্ঞাসা করিল, উপেন্দ্রবাবু, আপনি আমাদের কে?

এই অদ্ভুত প্রশ্নের কি উত্তর উপেন্দ্র ভাবিয়া পাইলেন না। সে পুনরায় বুঝাইয়া বলিল, আপনি আমার স্বামীর কি কোন আত্মীয়? এতদিন এ বাড়িতে এসেছি, কিন্তু কোনদিন আপনার নাম ওঁর কাছেও শুনিনি, মার কাছেও শুনিনি। শুধু যেদিন আপনাকে চিঠি লেখা হয়, সেদিন শুনি—তাই জিজ্ঞাসা কচ্চি।

বাহির হইতে সতীশ ডাকিল, উপীনদা, এস না!

উপেন্দ্র বলিলেন, না, আত্মীয় নয়—তবে বিশেষ বন্ধু। বাবা যখন নওয়াখালিতে ছিলেন, হারানদার পিতাও সরকারী স্কুলে মাস্টারি করতেন, আমাকেও বাড়িতে পড়াতেন। হারানদা আর আমি অনেকদিন একসঙ্গে পড়ি।

কিরণময়ী একটুখানি হাসিয়া বলিল, ওঃ এই! এর জন্যে লেখাপড়া করা! আচ্ছা উপীনবাবু, আপনি সমস্তই নিজের নামে লিখে নেবেন?

বিলম্ব দেখিয়া সতীশ মুখ বাড়াইয়াছিল, সে-ই চট করিয়া জবাব দিয়া ফেলিল, সেই রকম ত স্থির হয়েছে।

হারানের ঘর হইতে বাহির হইবার সময়ে, কে যে দ্রুতপদে বাহিরে সরিয়া গিয়াছিল, তাহা সে পূর্বেই বুঝিয়াছিল।

বধূ তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, এই যে, আপনিও আছেন। বেশ কথা! ভাল কথা! এতদিন এত কষ্ট করেও যা করে হোক দু’সন্ধ্যা দু’মুঠো জুটেছিল—এখন পথে দাঁড়াতে হবে। তাই হোক, আপনারাই সমস্ত ভাগ করে নিন।
উপেন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া গেলেন।

সতীশ জবাব দিল, যার জিনিস সে যদি দিয়ে যায়, কারো কিছু বলবার নেই।

কিরণময়ীর দুই চোখ আগুনের মত জ্বলিয়া উঠিল। বলিল, আমার আছে। মরণকালে মতিচ্ছন্ন হয়, আমার স্বামীর তাই হয়েছে। কিন্তু আপনারা লিখে নেবার কে?

সতীশ কিছুমাত্র কুণ্ঠিত না হইয়া তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, তা জানিনে, কিন্তু হারানবাবুর আজো যে বুদ্ধি আছে, আমার অন্তর্যামী এ কথায় সায় দিচ্ছেন।

কিরণময়ী অত্যন্ত বিদ্রূপের স্বরে জবাব দিল, চমৎকার যুক্তি! লোকে কথায় বলে—যাক লোকের কথা। উপেন্দ্রকে উদ্দেশ করিয়া কহিল, কিন্তু এই কথা জিজ্ঞাসা করি, আমি কি করে জানব, শেষকালে ইনি পথে বসাবেন না? কেমন করে বিশ্বাস করব, ইনি ফাঁকি দেবেন না?

এতবড় আঘাত হঠাৎ উপেন্দ্রর যেন অসহ্য বোধ হইল; কি একটা বলিতেও গেল, কিন্তু না বলিয়া চুপ করিয়া নিজেকে সামলাইতে লাগিল।

সতীশ মৃদুস্বরে বলিল, বৌঠাকরুন, জানবার আবশ্যক আপনার নেই।

কিরণময়ীও তৎক্ষণাৎ জবাব দিতে পারিল না। এই বিদ্রূপাত্মক আত্মীয় সম্বোধনের স্পর্ধায় সে অবাক হইয়া গিয়াছিল। ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া শুধু কহিল, বৌঠাকরুন! আবশ্যক নেই!

সতীশ বলিল, না। আপনি নিজের অধিকার যদি নিজে নষ্ট না করতেন, হারানবাবুর এ সতর্কতার আবশ্যক ছিল না। এত রাত্রে রাগারাগি করবেন না—একটু বুঝে দেখুন দেখি।

তীব্র কার্বলিকের গন্ধে সাপ যেমন করিয়া তাহার উদ্যত ফণা মুহূর্তে সংবরণ করিয়া আঘাতের পরিবর্তে আত্মরক্ষার পথ অন্বেষণ করে, এই নিরুপমা, এই লীলাকৌশলময়ী তেজস্বিনী যুবতী চক্ষের পলকে তেমনি সঙ্কুচিত হইয়া বলিল, আমার কথা উনি কি বলেচেন শুনি?

উপেন্দ্র আর চুপ করিয়া থাকিতে পারিলেন না। এই গর্বিতা নারীর সন্দিগ্ধ তিরস্কার তাঁহাকে তপ্তশেলে বিঁধিতে থাকিলেও তাঁহার উচ্চশিক্ষিত ভদ্র-অন্তঃকরণ সতীশের এই গোয়েন্দাগিরির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়া উঠিল। সে যে অন্যায় উত্তেজনার দ্বারা কি একটা গুপ্ত রহস্য টানিয়া বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছিল, ইহা তিনি বুঝিয়াছিলেন। সতীশকে বাধা দিয়া কিরণময়ীকে বলিলেন, কেন আপনি সতীশের পাগলামিতে কান দিয়ে নিজেকে উদ্বিগ্ন করচেন! স্বামীর বিষয় থেকে বঞ্চিত করবার অধিকার কারো নেই—আপনি নিশ্চিন্ত হোন। তবে বোধ করি, আপনাদের বিশেষ সুবিধা হবে মনে করেই, হারানদা একটা লেখাপড়ার কথা তুলেচেন। কিন্তু আপনার অমতে ত কোনমতেই হতে পারবে না। রাত্রি অনেক হয়েছে, কবাট বন্ধ করে দিন। চল্‌ সতীশ, আর দেরী করিস নে। সতীশকে ঠেলিয়া দিয়া গলির মধ্যে দাঁড়াইয়া মৃদু হাসিয়া বলিলেন, কাল-পরশু আবার দেখা হবে—নমস্কার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *