ঘুঁটো জগন্নাথ
ঘুঁটো বা ঠুটা অর্থে বুঝায় হস্তহীন, নুলা বা নুলো (হাত কাটা বা বিকল)। শক্তিমান বলে বিবেচিত হলেও উদ্যোগহীন অক্ষম ব্যক্তিকে হস্তহীন জগন্নাথের সাথে তুলনা করে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।
বিষ্ণু বা শ্রীকৃষ্ণের প্রতিভূ হিসেবে কল্পিত জগন্নাথ বাংলাদেশ, ভারতের উড়িষ্যাসহ নানা অঞ্চলে পূজিত। উড়িষ্যার পুরীতে জগন্নাথের মন্দির আছে। জগন্নাথদেবের হস্তবিহীন মূর্তি সম্পর্কে যে কাহিনী রয়েছে তা হলো—
শোচনীয়ভাবে যদুবংশ ধ্বংস হলে নিরুপায় ও দুঃখ ভারাক্রান্ত শ্রীকৃষ্ণ বনবাসী হতে সংকল্প করেন। গভীর মনঃকষ্ট নিয়ে তিনি এক গাছের নিচে চুপচাপ বসে ছিলেন। জরা নামে এক ব্যাধ দূর থেকে মাটিতে বসে থাকা শ্রীকৃষ্ণকে হরিণ মনে করে তীর ছুড়ে মারে। শ্রীকৃষ্ণের পায়ে সে তীর লাগে এবং এতে তার মৃত্যু হয়। তার মৃতদেহ দীর্ঘদিন পড়ে থাকে গাছের নিচে।
কৃষ্ণের কিছু অনুরাগী ভক্ত বৃক্ষতল হতে তার অস্থি সংগ্রহ করে একটি বাক্সের মধ্যে রেখে সংরক্ষণ করে। মালবদেশ বা অবন্তীর (উজ্জয়িনী সূর্যবংশীয় রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন (ইন্দ্রের মতো দ্যুম্ন বা ধন যার) ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। একদিন তিনি পুরুষোত্তম (পুরী, শ্রীক্ষেত্র, নীলাচল) ক্ষেত্রের মাহাত্ম্য সম্পর্কে শুনে সেখানে বিদ্যাপতি নামে এক ব্রাহ্মণকে পাঠালেন পুরুষোত্তম বিষ্ণুর মন্দির দর্শনে।
বিদ্যাপতি দেশে ফিরে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে তার সফরের বিস্তারিত বিবরণ জানালেন। দেবর্ষি নারদকে সাথে নিয়ে রাজা তার পরিবার ও কিছু প্রজাসহ বিষ্ণুদর্শনের উদ্দেশ্যে একদিন যাত্রা করলেন নীলাচলে (দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে নীলগিরি নামক পার্বত্যভূমির প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত বলে জগন্নাথক্ষেত্রের আর এক নাম নীলাচল)। পথে নানা রকম অমঙ্গল দর্শন করে নারদকে তার কারণ জিজ্ঞেস করলেন রাজা। নারদ জানালেন যে, বিদ্যাপতি যেদিন নীলাচল ত্যাগ করেছেন রমাপতি বিষ্ণুও (নারায়ণ) সেদিন অন্তর্হিত হয়েছেন এখান থেকে। সে কারণে চারদিকে অমঙ্গল চিহ্ন। দেবর্ষি নারদের কথায় হু হু করে কেঁদে উঠলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। নারদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বিষ্ণুর চারটি কাঠের (দারু) মূর্তি নির্মাণ করে স্থাপন করার পরামর্শ দিলেন।
নারদের উপদেশমতো রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্রহ্মার উপদেশ নিতে গেলেন। অনেক স্তবস্তুতি করার পর ব্রহ্মা তুষ্ট হয়ে রাজাকে বললেন, ‘তুমি এক মুহূর্ত অপেক্ষা কর। আমি সন্ধ্যা (আহ্নিক) করে এসে তোমাকে বর দিব।’ এ কথা বলে ব্রহ্মা চলে গেলেন। অপেক্ষা করতে থাকলেন ইন্দ্ৰদ্যুম্ন।
ব্রহ্মার এক মুহূর্ত মানে মর্ত্যলোকের ষাট হাজার বছর। ষাট হাজার বছর পর ব্রহ্মা ফিরে এলেন রাজার কাছে। ব্রহ্মলোকে ষাট হাজার বছর কিভাবে কেটে গেল ইন্দ্রদ্যুম্ন টেরই পেলেন না। ব্রহ্মা তাকে বললেন, “তুমি তোমার রাজ্যে ফিরে যাও। আমি তোমাকে এক মূর্তি প্রদান করবো।’
ইন্দ্রদ্যুম্ন ফিরে এলেন নিজ রাজ্যে। এদিকে মর্ত্যলোকের ষাট হাজার বছর অতিক্রান্ত হওয়ায় রাজা তার রাজ্যের চিহ্নমাত্র দেখতে পেলেন না। কিছুই চিনতে পারছেন না তিনি। কাউকে জিজ্ঞেস করেও ঠিকমতো উত্তর পাচ্ছেন না। অবশেষে এক পেঁচা ও পরে এক কচ্ছপ পূর্বকাহিনী বর্ণনা করলো। ঐ স্থানে ইন্দ্রদ্যুম্ন আবার রাজা হলেন স্বীয় যোগ্যতাবলে। কৌমাদ্য রাজার মেয়ে মালাবতীর সাথে তার বিয়ে হলো।
ব্রহ্মা ইন্দ্রদ্যুম্নকে জানিয়েছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ নিমগাছের নিচে প্রাণত্যাগ করবেন। সেই নিমগাছ ভেসে এসে সমুদ্রের তীরে আসবে। সেই গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করতে হবে জগন্নাথ মূর্তি। তাতে স্থাপন করতে হবে শ্রীকৃষ্ণের অস্থি।
জগন্নাথদেবের প্রস্তরনির্মিত মন্দির তৈরি করলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। একদিন দূত এসে জানালো যে, সমুদ্রের তীরে একটি কাঠ ভাসছে (যাদববংশ ধ্বংসের পর দ্বারকানগরী আরব সাগরে ডুবে গিয়েছিল)। ইন্দ্রদ্যুম্ন ছুটে গেলেন সমুদ্রতীরে। কাঠ উদ্ধার করে মূর্তি গড়ার উদ্দেশ্যে নিজেই তা কাটতে শুরু করলেন কুড়াল দিয়ে। এমন সময় বিষ্ণু ও বিশ্বকর্মা ছদ্মবেশে হাজির হলেন সেখানে। ছদ্মবেশী বিষ্ণু বললেন, ‘মহারাজ! আপনি সঠিকভাবে মূর্তি তৈরি করতে পারবেন বলে মনে হয় না। আমার সাথে এই শিল্পী আছেন, তিনি সুচারুরূপে মূর্তি তৈরি করে দিতে পারবেন।’
অতঃপর রাজা ইন্দ্রদ্রুম্ন ছদ্মবেশী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে ভার দিলেন জগন্নাথমূর্তি নির্মাণের। তবে বিশ্বকর্মা শর্ত দিলেন যে, যতদিন পর্যন্ত এই মূর্তি সম্পূর্ণ না হয় ততদিন পর্যন্ত কেউ যেন তা দর্শন না করে বা মূর্তির জন্য বিরক্ত না করে। সে রকম হলে তিনি মূর্তি নির্মাণের কাজ ফেলে চলে যাবেন।
মন্দিরের দরজা জানালা বন্ধ করে মূর্তি নির্মাণ করতে লাগলেন বিশ্বকর্মা। এদিকে রাজাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তার আর তর সইছে না। পনেরো দিন কেটে যাবার পর অস্থির রাজা মূর্তি দর্শনের জন্য নির্মাণগৃহের দরজা খুলে ফেললেন। শর্ত মোতাবেক বিশ্বকর্মাও কাজ অসম্পূর্ণ রেখে অন্তর্হিত হলেন।
তখনও জগন্নাথমূর্তির হাত-পা তৈরি হয়নি। ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্রহ্মাকে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেবার অনুরোধ করায় ব্রহ্মা এই অসম্পূর্ণ মূর্তির চোখ ও প্রাণ দান করেন এবং নিজে পুরোহিত হয়ে হাতপাবিহীন জগন্নাথমূর্তি স্থাপন করে পূজা করেন। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, ভক্তের মনে নিরাকার ব্রহ্মভাব জাগ্রত করার উদ্দেশ্যেই জগন্নাথমূর্তি এমন অসম্পূর্ণভাবে তৈরি করা হয়েছে।
জগন্নাথ সম্পর্কে এই কাহিনী পাওয়া যায় স্কন্দপুরাণের উৎকলখণ্ড, কপিল-সংহিতা, পুরুষোত্তম-মাহাত্ম্য, মুকুন্দরামের জগন্নাথমঙ্গল ইত্যাদি গ্রন্থে। ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, ১১৯৪ খ্রিস্টাব্দে জগন্নাথ মন্দিরের পুনঃসংস্কার করেছিলেন একজন ইন্দ্রদ্যুম্ন। কথিত ইন্দ্রদ্যুম্নের সাথে এই ইন্দ্রদ্যুম্নকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে কিনা তা আমরা জানি না। তবে প্রবাদের ক্ষেত্র আলোচনায় আমরা প্রচলিত কাহিনী বা কিংবদন্তিকে গুরুত্ব দিচ্ছি এজন্য যে, এর সাথে লোকশিক্ষা ও লোকসমাজে গৃহীত বিষয় রয়েছে।
যাহোক, আমরা ঘুঁটো জগন্নাথের প্রবাদটি হস্তপদহীন জগন্নাথদেবের ধারণা থেকে গ্রহণ করেছি এবং সেটিই উৎস হিসেবে পরিচিত। অলস ব্যক্তির কর্মহীন বসে থাকা পুঁটো জগন্নাথের অবস্থানের মতো বলেই এই প্রবাদ।