ঘড়ির কাঁটা – ৬

আদালত বসার পর বাসু-সাহেব প্রতিবাদী তরফের প্রথম সাক্ষীকে ডাকলেন। পূর্বদিন প্রসিকিউশনের সব সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। জেরাও শেষ হয়েছিল।

প্রতিবাদীর প্রথম সাক্ষী ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মিস্টার পি শেষাদ্রি!

—মিস্টার শেষাদ্রি, আপনার ব্রাঞ্চে কি মৃত কমলেশ মিত্রের একটি অ্যাকাউন্ট ছিল?

— ছিল।

—বর্তমানে কত টাকা ব্যালেন্স পড়ে আছে?

—সাত হাজার পাঁচশো বত্রিশ টাকা তেরো নয়া পয়সা।

—ওই অ্যাকাউন্টে সর্বোচ্চ কত টাকা ছিল এবং কবে ছিল?

—সর্বোচ্চ ব্যালেন্স ছিল প্রায় সাতাশি হাজার টাকা, বছর তিনেক আগে। এজ্যাক্ট অ্যাকাউন্ট এবং ডেট লেজার দেখে বলতে পারি।

—তার প্রয়োজন নেই। আমি শুধু জানতে চাই, আপনার অ্যাকাউন্ট-হোল্ডার প্রায় আশি হাজার টাকা খরচ করেছেন কিনা গত তিন বছরে?

—তা জানি না। তবে আমার ব্যাঙ্কে তাঁর জমা টাকা ওই পরিমাণ কমেছে।

—তাকেই তো আমরা খরচ করা বলি, না কী?

—না, আমরা, মানে ব্যাঙ্কের লোকেরা, তা বলি না। কারণ আমার ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে তিনি অন্য ব্যাঙ্কে রেখে আসতে পারেন, শেয়ারে বিনিয়োগ করতে পারেন, ফিক্সড ডিপোজিট কিনতে পারেন—তাকে খরচ করা বলে না।

—অন্তত আপনার ব্যাঙ্কে তিনি ফিক্সড ডিপোজিট করেননি?

—না।

—একথা কি সত্য যে, কমলেশবাবু গত ত্রিশে মার্চ, শনিবার, তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে দশ হাজার টাকা নগদে তোলেন?

—হ্যাঁ, সত্য।

—এ-কথা কি সত্য যে, উনি ওই শনিবার আপনাকে প্রথমে বলেন—নগদে টাকা তিনি নিতে চান না। তার বদলে দশখানি হাজার টাকার ট্র্যাভলার্স চেক নিতে চান?

—হ্যাঁ বলেছিলেন, কিন্তু তখন ব্যাঙ্কিং আওয়ার্স প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাই আমি বলেছিলাম, সোমবারের আগে ওটা করানো যাবে না। তখন তিনি ওই দশ হাজার টাকা নগদে নিয়ে যান। কারণ তিনি বলেছিলেন যে, সোমবার সকালের প্লেনে তিনি দার্জিলিং চলে যাচ্ছেন।

—এ-কথা কি সত্য যে, সোমবার বেলা ঠিক দশটার সময় ব্যাঙ্ক খোলার সঙ্গে সঙ্গে কমলেশবাবু আপনার সঙ্গে দেখা করেন এবং বলেন যে, তিনি সোমবারের বদলে মঙ্গলবারে দার্জিলিং যাচ্ছেন; আর তাই আপনাকে দশ হাজার টাকা দিয়ে বলেন দশখানি ট্র্যাভলার্স চেক করিয়ে দিতে?

—হ্যাঁ, এ কথা সত্য।

—সেই অনুসারে আপনি তাঁর কাছ থেকে নগদে দশহাজার টাকা নিয়ে দশখানি ট্রাভলার্স চেক করিয়ে আনেন স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে—রাইট?

—রাইট।

—আপনি কমলেশবাবুকে বিকাল চারটে নাগাদ ওই দশখানি ট্র্যাভলার্স-চেক ডেলিভারি নিয়ে যেতে বলেন? ইয়েস?

—ইয়েস।

—তার মানে শনিবার যে-টাকা কমলেশবাবু ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিলেন সে-টাকা সোমবার বেলা দশটার পর আর তাঁর কাছে ছিল না?

—সেটাই সম্ভব; কারণ কমলেশবাবু বলেছিলেন, ওই টাকাই তিনি নিয়ে এসেছিলেন। তিনি যদি সত্য কথা বলে থাকেন, তাহলে শনিবার যে টাকা তিনি ব্যাঙ্ক থেকে তোলেন সেই দশ হাজার টাকা সোমবার বেলা দশটার পর আর তাঁর কাছে ছিল না।

—ওঁর স্পেসিমেন—সিগনেচার কি আপনি সঙ্গে করে এসেছেন?

—হ্যাঁ, এ বিষয়ে আপনার নির্দেশ ছিল। এনেছি।

—আপনি ওটা দেখে আদালতকে কি জানাবেন, ‘মিত্র’ বানান তিনি কী ভাবে লিখতেন?

—MITTER.

—আপনাকে আমি পরশুদিন একটি সইয়ের ‘ফোটোস্ট্যাট্-কপি’ দিয়ে এসেছিলাম, যেটি হোটেল হিন্দুস্থানের চেক-আউট রেজিস্টার থেকে ফোটো নেওয়া। সেখানে। সেখানে ‘মিত্র’ বানান কী ভাবে আছে পড়ে শোনাবেন কি?

—MITRA

—আপনি একটি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, এখনই বলেছেন যে, বাইশ বছর চাকরি করছেন আপনি, সুতরাং সই-মেলানোর অভিজ্ঞতা আপনার যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে সেই অভিজ্ঞতা থেকে আপনি জানাবেন কি যে, ওই দুটি সই এক ব্যক্তির কি না।

—না। সই দুটি এক ব্যক্তির নয়!

বাসু বললেন, মি-লর্ড, ওই স্পেসিমেন সিগনেচার-ইন-অরিজিনাল এবং হোটেল রেজিস্টারের সইয়ের ফটোস্ট্যাট কপিখানি প্রতিবাদীর এক্‌জিবিট হিসাবে আদালতের নথিভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।

মাইতি আপত্তি জানিয়ে বলেন, ওই ফোটোস্ট্যাট কপিখানি হোটেল রেজিস্টার থেকে ফোটো নেওয়া এ-কথা আমরা মেনে নিচ্ছি না।

জজ-সাহেব বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, কে বলেছে মেনে নিতে? সেজন্যই তো দুটি নথিভুক্ত হওয়া প্রয়োজন। যাতে আপনি মূল রেজিস্টারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন।

—দ্যাটস্ অল মি-লর্ড—বাসু তাঁর ছেদ টানেন।

মাইতি জেরা করতে উঠে প্রশ্ন করেন, হোটেল রেজিস্টারে সই করবার সময় কেউ যে ব্যাঙ্কের সই করবে তার নিশ্চয়তা কী? তাহলে আপনি কেন বললেন, দুটি লেখা একজনের নয়?

শেষাদ্রি সম্প্রতিভভাবে বললেন, আমি এ-কথা বলিনি যে, দুটি ‘লেখা’ একজনের নয়, আমি বলেছি দুটি ‘সই’ একজনের নয়। দুটো জিনিস এক নয়। নাউ, লেট মি এক্সপ্লেন-

মাইতি ধমক দিয়ে ওঠেন, আপনাকে পাণ্ডিত্য জাহির করবার জন্য এখানে ডাকা হয়নি। আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না। যা জিজ্ঞাসা করছি, তার জবাব দিন-

শেষাদ্রি পাকা লোক। উকিলের ধমকে ঘাবড়াবার পাত্র সে নয়। বিচারকের দিকে ফিরে সে সবিনয়ে বললে, আমি মাননীয় বিচারকের কাছে প্রার্থনা করছি—আমাকে জিনিসটা ব্যাখ্যা করতে দেওয়া হোক। এ আদালতে হয়তো এমন দর্শক উপস্থিত আছেন যাঁর অ্যাকাউন্ট আমাদের ব্যাঙ্কে আছে। এ-ক্ষেত্রে তাঁদের স্বার্থ ব্যাঙ্ক কী ভাবে দেখে থাকেন, তাঁদের সইয়ের মূল্য কত তা বুঝিয়ে বলার অধিকার আমার আছে বলে আমি মনে করি। সরকার ব্যাঙ্ক ন্যাশনালাইজ করেছেন, আমি ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কিং-এর একজন অফিসার। মাননীয় পি.পি. বাধা দেওয়ায় আমানতকারীদের ক্ষতিকর কোনো ‘ইন্টারপ্রিটেশন’ আমার সাক্ষ্য থেকে উদ্ভূত হয় এটা আমি চাই না। আমি মহামান্য আদালতের রুলিং প্রার্থনা করছি।

জাস্টিস ভাদুড়ী বলেন, ইয়েস। য়ু মে এক্সপ্লেন য়োরসেলফ্।

শেষাদ্রি যে কায়দায় ‘বাও’ করল তাতে মনে হয় ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢোকার আগে সে বোধকরি ওকালতি করত। বলেন, MITTER বানানে যিনি নিজের নাম লেখেন, তিনি ‘সই’ করুন বা না করুন, নিজের নামের বানান কখনও MITRA লিখবেন না। তা ছাড়া এই প্রশ্ন করা হতে পারে আশঙ্কা করে আমি লেট কমলেশ মিত্রের গোটা ফাইলটা নিয়ে এসেছি। তাতে তাঁর লেটার-হেডের মাথায় ছাপা অক্ষরে MITTER বানান আছে। সর্বত্র তিনি নিজের নাম MITTER বানানে লিখেছেন—সই করুন, আর না করুন। এমনকি তাঁর স্ত্রী উল্লেখ করতেও ‘Mrs. Mitter’ লিখেছেন।

জাস্টিস ভাদুড়ী বললেন, থ্যাঙ্কু। নাউ ইউ মে প্রসিড উইথ য়োর ক্রস একজামিনেশন। মাইতি কিন্তু আর ঘাঁটাতে সাহস পেলেন না। শেষাদ্রির সাক্ষ্যে ইতিমধ্যেই দু-দুটো বিস্ফোরণ ঘটেছে। প্রথম কথা, সোমবার দ্বিপ্রহরে হোটলের ওই ঘরে যে নগদ দশ হাজার টাকা ছিল না, এটা প্রমাণ হয়েছে—অর্থাৎ আসামির অপরাধের যেটা ছিল মূল ‘মোটিভ’ সেটাই ধসে গেছে। দ্বিতীয়ত দেখা যাচ্ছে—হোটেলে রেজিস্টারে কমলেশ সই করেনি। কেন?

মাইতি শুধু বললেন, থ্যাঙ্কু মি লর্ড!

প্রতিবাদীর পরবর্তী সাক্ষী রতন বেয়ারা। হোটেল হিন্দুস্থানের রুম সার্ভিস বেয়ারা। বাসু তাকে প্রশ্ন করলেন, তুমি ওই হোটেলে কতদিন চাকরি করছ?

—হোটেল খোলা ইস্তক হুজুর। তারিখ আমার মনে নেই!

—গত দোশরা এপ্রিল অটোপ্সি-সার্জেন, মানে ওই ডাক্তারবাবু কি হোটেলে এসে তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন রুম 528-এ কখন তুমি লাঞ্চ সার্ভ করেছিলে?

—আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর, জিজ্ঞাসা করেছিলেন। কবে শুধিয়েছিলেন তার তারিখটা আমার মনে নেই, তবে মনে আছে খুনের পরদিন।

—তুমি তাঁকে কী বলেছিলে?

—সত্যি কথাই বলেছিলাম হুজুর-বেলা দুটোর সময় আমি 528 নম্বর ঘরে লাঞ্চ দিয়ে আসি।

—কী কী ছিল লাঞ্চ প্লেটে?

—আজ্ঞে মনে নেই। মেমোতে যা লেখা আছে তাই-তাই তবে-

—”তবে’ বলে থামলে কেন? বল?

—আজ্ঞে লাঞ্চ-মেমোতে ‘গ্রিন পিজ’ লেখা হয়নি, কিন্তু প্লেটে বোধ হয় ছিল— –প্লেটে ‘বোধ হয়’ ছিল? কী করে জানলে?

—আজ্ঞে জানি এইজন্য যে, পরে ওই নিয়ে খুব ধ্যাতানি খেয়েছিলাম। শুনেছি, ওনার পেটের ভিতর থেকে মটরশুঁটি বেরিয়েছে, যার দাম নেওয়া হয়নি।

—তার মানে, তুমি নিজের জ্ঞানমতো জান না, লাঞ্চ প্লেটে মটরশুটি ছিল, কি ছিল না?

—আজ্ঞে না, তা আমার মনেই নেই। থাকে কখনও? রোজ এত-এত লোক গোগ্রাসে গিল্‌ছে, মানে গিলছেন, এ কি কারও মনে থাকে কে মটরশুঁটি খেল, কে খেল না?

—সে তো বটেই। আচ্ছা এবার তুমি বল তো রতন, বেলা দুটোর সময় যখন তুমি খাবার পৌঁছে দিতে তখন তিনি কী করছিলেন?

—আমার বাগে পিছন ফিরে টেবিলে বসে চিঠি লিখছিলেন। আমি খাবারটা নামিয়ে রেখে চলে আসি।

—অর্থাৎ তাঁর মুখ তুমি দেখনি, তাই নয়?

—আজ্ঞে না, দেখিনি।

—তাঁকে দেখলে চিনতে পারবে?

—আজ্ঞে না তবে তিনি তো গঙ্গা পেয়েছেন হুজুর, চেনাচিনির তো বালাই মুছে গেছে।

—মারা যাবার পর মৃতদেহ তুমি দেখেছিলে?

—তাও দেখিনি। আমাদের কাউকে ও বাগে যেতেই দেওয়া হয়নি!

—তাই নাকি! কোনও বেয়ারাই মৃতদেহ দেখেনি?

—দেখবে কেমন করে হুজুর? পুলিশ এসেই ঘর তালাবন্ধ করল। পরে যখন নামিয়ে নিয়ে গেল তখন তো তিনি পর্দানসীন—আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা।

—আচ্ছা বলত রতন, 524 নম্বর ঘরে তুমি কখন লাঞ্চ সার্ভ করেছিলে?

—আজ্ঞে, বেলা ঠিক সাড়ে দশটায়।

—ওই ঘরে যিনি ছিলেন, তাঁর নামটা কী?

—আজ্ঞে পি.কে.মৈত্র। মানে মিস্টার পি.কে.মৈত্র।

—তাঁকে কি ‘গ্রিন-পিজ’ সার্ভ করা হয়েছিল?

মাইতি আপত্তি জানান। ‘অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন’—এই অজুহাতে। বাসু তাঁর সওয়ালে এর প্রাসঙ্গিকতা প্রতিষ্ঠিত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় জজ-সাহেব রতনকে প্রশ্নটির জবাব দিতে বললেন।

রতন বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সকাল সাড়ে দশটায় ‘গ্রিন পিজ’ সার্ভ করা হয়েছিল 524 নম্বরে।

— দ্যাটস্ অল মি লর্ড।

মাইতি জেরা করতে উঠে প্রথমেই প্রশ্ন করেন, বাবা রতন, বল তো 523 নম্বরে ঐ দিনে লাঞ্চে কী কী দেওয়া হয়েছিল?

—523 হুজুর? তা তো জানি না। অত কি মুখস্থ থাকে?

—থাকে না বুঝি? তাহলে 524 নম্বরের খবর অমন চট করে বললে কেমন করে? -বা-রে! কেন বলব না? ওই হুজুর পরশু দিন গিয়ে যে আমাকে শুধিয়েছিলেন। একটি বেলা ধরে আমরা পুরোনো সব মেমো ঘেঁটে দেখেছিলাম। উনি আমাকে তা দেখিয়েও দিয়েছিলেন। কোন সওয়ালের কী জবাব হবে তাও বলে দিয়েছিলেন।

—তাই বল, তার মানে তুমি ওঁর শেখানো মতো বলছ?

—আজ্ঞে না হুজুর, তা কেন? কোন প্রশ্নের কী ন্যায্য উত্তর হবে রেকর্ড ঘেঁটে উনি আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। উনি এ-কথাও বলেছিলেন যে, জেরায় আপনি আমাকে কাৎ করতে চাইবেন। তখন যেন 528 নম্বর ঘরের লাঞ্চ মেমোটার কাউন্টার ফয়েল আপনাকে দেখাই। আমি সাথে করেই এনেছি হুজুর। দেখছেন?

সাক্ষী তার পকেট থেকে একটি লাঞ্চ-মেমোর কাউন্টার-ফয়েল সবিনয়ে বাড়িয়ে ধরে—ডানহাতের কনুইয়ে বাঁ-হাতের আঙুল স্পর্শ করে।

কোর্টে হাস্যরোল ওঠে।

মাইতি জেরা শেষ করে বসে পড়েন।

বাসু উঠে বলেন, আমাদের আর কোনো সাক্ষী নাই। আদালত যদি অনুমতি করেন তবে বাদী এবার তাঁর কেস ‘আরগু’ করতে পারেন।

জাস্টিস ভাদুড়ী মাইতিকে প্রশ্ন করেন, আপনি প্রস্তুত?

মাইতির ভঙ্গিমায় মনে হল, চূড়ান্ত অপ্রস্তুত কিন্তু মুখে তিনি তা স্বীকার করলেন না। বললেন-

মহামান্য আদালত যখন অনুমতি করছেন তখন আমি যুক্তিনির্ভর সমাপ্তি ভাষণ দিচ্ছি। আমি প্রথমেই বলে রাখতে চাই যে আমি একটু অসুবিধাজনক অবস্থায় আছি। মাননীয় সহযোগী মামলার একেবারে শেষ পর্যায়ে কিছু ভেলকি দেখিয়েছেন। তা থেকে তিনি কী সিদ্ধান্তে আসতে চাইছেন তা আমি এখনও জানি না; ফলে সেইসব যুক্তির বিরুদ্ধ-যুক্তি আমি এখন দেখাতে পারছি না। মামলার চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী বাদীপক্ষ প্রথমে ‘আরগু’ করেন, এবং বিবাদীপক্ষ তার পরে করেন। সে যাই হোক, মিস্টার শেষাদ্রির সাক্ষ্যে প্রতিবাদী প্রমাণ করেছেন যে, পয়লা এপ্রিল বেলা দশটার পর মৃত কমলেশ মিত্রের কাছে নগদ দশ হাজার টাকা ছিল না। তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত করতে হবে যে, হত্যার উদ্দেশ্য ওই টাকা অপহরণ নয়। কিন্তু এ-কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আসামি ওই দিন বেলা তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ ওই 528 নম্বর ঘরে ঢুকেছিলেন। ফিঙ্গার-প্রিন্ট এক্সপার্টের সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয়েছে, যে বাথরুমে কমলেশ মিত্রের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেই বাথরুমের ‘ডোর-নবে’ আসামির সন্দেহাতীত আঙুলের ছাপ রয়েছে। ওই ঘরের অ্যাশট্রে থেকে উদ্ধার পাওয়া সিগারেট-স্টাম্প ও যে ব্র্যান্ডের সিগারেট আসামি সেই সিগারেটেই অভ্যস্ত। আশট্রেতেও ফিঙ্গার-প্রিন্ট পাওয়া গেছে। আমরা মামলা চলাকালে দেখেছি যে, আসামি ভিন্ন কমলেশ মিত্রের আরও দু’তিনটি বন্ধু ঐদিন হোটেলে; এসেছিলেন। কিন্তু তাঁদের কেউ যে ওই ঘরে প্রবেশ করেছিলেন এমন প্রমাণ প্রতিবাদীপক্ষ উপস্থিত করতে পারেননি। অপরপক্ষে আসামি যে ওই ঘরে প্রবেশ করেছিলেন তা আমরা প্রমাণ করেছি—সেটা প্রকারান্তরে প্রতিবাদীপক্ষ স্বীকারও করে নিয়েছেন। আমরা দেখেছি, কমলেশ মিত্রের হেপাজতে মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে দু-দুটি রিভলভার ছিল, এবং মৃত্যুর পর সে-দুটোই খোয়া যায়। অত্যন্ত আশ্চর্যের কথা—ওই দুটি রিভলভারই আসামির হেপাজতে পাওয়া গেল! একটি তার গাড়ির ভিতর, একটি তার বাড়ির চৌহদ্দিতে! এর পরে হত্যা কে করেছে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে কি? দুটি রিভলভারের মিলিত মূল্য ছয়-সাত হাজার টাকা। হত্যার আরও কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যে কথা এ মামলায় উদ্ঘাটিত হয়নি। উদ্দেশ্য যাই হোক—এ-কথা স্পষ্ট যে, হত্যা আসামি ছাড়া আর কেউ করেনি, করতে পারে না। এর জ্বলন্ত প্রমাণ আসামির বাড়ি থেকে উদ্ধার পাওয়া দ্বিতীয় রিভলভারটি, যেটি মামলা চলাকালে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি ‘মার্ডার-ওয়েপন’ রূপে।

সহযোগী ডিফেন্স কাউন্সেল বর্মনকে জেরা করার সময় এমন একটি তির্যক ইঙ্গিত দিতে গেছেন যে, পুলিশ-খানা তল্লাশির সময় নিজেরাই রিভলভারটি ওখানে রেখেছে। সহযোগী একটা কথা খেয়াল করে দেখেননি যে, এটা কোনো পুলিশ অফিসারের পক্ষে আদৌ সম্ভবপর নয়। পুলিশ অপরাধীকে চিহ্নিত করতে উৎসাহী—নিরপরাধকে অহেতুক জড়িয়ে তার কোনও লাভ নেই। তাতে তার প্রমোশন হয় না। চাকরিতে কোনো ভাবেই কোনো লাভ হয় না। উপরন্তু ও অপকীর্তি করতে গিয়ে যদি সে ধরা পড়ে তবে তার চাকরি তো যাবেই, এমনকি জেল পর্যন্ত হতে পারে। দ্বিতীয় কথা, আসামির স্বীকারোক্তি মতে সে তার মোটরে কমলেশের রিভলবার ‘কুড়িয়ে পায়’। আশা করি, ডিফেন্স কাউন্সেল এ-কথা বলবেন না যে, কোনও অসৎ পুলিশ অফিসার সেটা ওঁর গাড়িতে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল! তৃতীয়ত, আসামি তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন, মীনাক্ষী দেবী তাকে টেলিফোন করে বিকাল সাড়ে তিনটায় হোটেল হিন্দুস্থানে যেতে বলেন। অথচ মীনাক্ষী দেবী তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন যে, তিনি অমন কোন টেলিফোন করেননি। তিনি আদৌ আসামিকে চেনেন না। এ-ক্ষেত্রে অপরিচিত একজন ভদ্রলোককে তিনি অহেতুক টেলিফোন করে কেন হোটেলে যেতে বলবেন, এবং কেনই বা সেটা হলপ নিয়ে অস্বীকার করবেন? তাহলে আসামি কেন বললেন যে, তিনি মীনাক্ষী দেবীর আমন্ত্রণে হোটেলে গিয়েছিলেন? বললেন এ জন্য যে, তাঁকে একটা কৈফিয়ত খাড়া করতে হয়েছিল—কেন তিনি বিনা আমন্ত্রণে ওই হোটেলে গেলেন, কেমন করে তিনি জানলেন যে, কমলেশ ওই হোটেলে আছে!

—উদ্দেশ্য যাই হোক, এ-কথা অবিসংবাদিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, আসামি স্বহস্তে ওই রিভলভার দিয়ে তাঁর বন্ধু কমলেশ মিত্রকে খুন করেন। মৃতদেহটি বাথরুমে রেখে স্বহস্তে দরজার বন্ধ করেন—যখন ‘ডোর-নবে’ তাঁর আঙুলের ছাপ পড়ে। ঘর ছাড়ার আগে তিনি দরজায় ‘DO NOT DISTURB’ বোর্ড ঝুলিয়ে যান, যাতে মৃতদেহ আবিষ্কারে বিলম্ব হয়। ওই জন্যই তিনি লিফট দিয়ে নিচে নামেন না—যাতে লিফটম্যান তাঁকে শনাক্ত না করতে পারে। মার্ডার-ওয়েপনটি তিনি কায়দা করে সরিয়ে ফেলে দ্বিতীয় রিভলভারটি নিয়ে হাজির হন তাঁর কাউন্সেলের কাছে। সেটি তিনি নির্ভয়ে থানায় জমা দেন—একথা জেনে যে, সেটি মার্ডার ওয়েপন নয়।

—সহযোগী মৃতদেহের পাকস্থলীতে কিছু মটরশুঁটির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে হয়তো তাঁর আসামিকে নিরপরাধ বলতে চাইবেন। এমন অদ্ভুত যুক্তির কোনো অর্থ হয় না। কমলেশ মিত্র ওই লাঞ্চ ছাড়া সারা দিনে আর কোথাও কিছু খাননি এমন সিদ্ধান্ত অর্থহীন। ফলে মটরশুঁটি প্রসঙ্গে তিনি অহেতুক কালক্ষেপ করছেন!

—সহযোগী হয়তো প্রমাণ করবার চেষ্টা করবেন যে, হোটেল রেজিস্টারে যে ‘সই’ আছে সেটা কমলেশের নয়। তা থেকে কী প্রমাণ হয়? কমলেশ মিত্র ওই 528 নম্বর ঘর বুক করেননি? অর্থাৎ 528 নম্বরে আবিষ্কৃত মৃতদেহটা কমলেশ মিত্রের নয়? আমরা আগেই দেখেছি, কমলেশ ছিলেন খেয়ালি কৌতুকপ্রিয় মানুষ–হয়তো তিনি ইচ্ছে করেই রেজিস্টারে ভিন্ন বানানে নিজের নাম লিখেছিলেন। কিন্তু যে ঘর তিনি বুক করেছেন, যে ঘরে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া গেল, সে ঘরের তিনিই তো বাসিন্দা! কমলেশ বোধহয় ‘মরিয়াই প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই।’

—সই যারই হোক সার্ভ করা হোক বা না হোক, কমলেশের হেপাজতে দশ হাজার টাকা থাক বা না থাক, এ-কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, আসামিই হত্যাকারী। আমরা এ ক্ষেত্রে আসামির চরমতম দণ্ডের দাবি জানাই।

মাইতি ভাষণ শেষ করেন।

–এবার আপনি বলুন—জজ-সাহেব প্রতিবাদীর দিকে ফিরে বললেন। বাসু তাঁর সওয়াল শুরু করেন-

—মহামান্য আদালতের কাছে আমার সর্বপ্রথম প্রতিবেদন : মামলার প্রারম্ভিক ভাষণে আসামির অপরাধের যেটাকে ‘মোটিভ’ বা উদ্দেশ্য রূপে বলা হয়েছিল সেটা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। মৃত কমলেশের হেপাজত মৃত্যু-সময়ে দশ হাজার টাকা ছিল না। ছিল মাত্র পাঁচশ’ বাহাত্তর টাকা, যে টাকা অপহৃত হয়নি; তার মানিব্যাগেই ছিল। ফলে অর্থলোভে আসামি হত্যা করেছে এ অভিযোগ ধোপে টেনে না। প্রারম্ভিক- ভাষণে মোটিভ ধসে যাবার পর সহযোগী বললেন, হত্যার উদ্দেশ্য হচ্ছে এক জোড়া রিভলভার চুরি করা—অথচ দেখা যাচ্ছে আসামি তার একটি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে থানায় জমা দিয়েছেন, এবং সহযোগীর মতে দ্বিতীয়টি নিজে বাড়ির আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছেন। ডক্টর সেনগুপ্তের মতো জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত বিশিষ্ট নাগরিক এক জোড়া রিভলভার চুরির জন্য হত্যা করেছেন, যে রিভলভার দুটি তিন নিজের কাছে রাখলেন না—এ যুক্তি যে হাস্যকর তা সহযোগী নিজেই বুঝতে পেরেছেন। তাই শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন—’হয়তো হত্যার অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল, যা এ মামলার উদ্‌ঘাটিত হয়নি।’ মামলায় যে প্রসঙ্গ আদৌ ওঠেনি তার জবাবদিহি কেমন করে করি? তাই অবস্থাটা দাঁড়াচ্ছে এই রকম : আমার দায় হচ্ছে প্রমাণ করা—বিনা উদ্দেশ্যে শুধু হত্যার আনন্দে ডক্টর প্রকাশ সেনগুপ্ত এম.বি.বি.এস. যে হত্যা করেননি এটুকুই প্রমাণ করা। অতঃপর তাই আমি করব :

—মাননীয় আদালতকে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, লটারি-ডাইরেক্টরের অ্যাকাউন্টেন্টের জবানবন্দি এবং সংবাদপত্র প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রথম প্রাইজ পাওয়া টিকিটের নম্বর হচ্ছে C/506909 এবং আমি প্রতিবাদীর এক্সিবিট নং 7 বিচারককে পরীক্ষা করে দেখতে বলব। যেটি মৃত কমলেশ মিত্রের পকেট থেকে উদ্ধার করা গেছে আদালতে নথিভুক্ত হওয়ার সময় আমি তার নম্বর টুকে রেখেছি। নম্বরটি হচ্ছে C/ 506906। এটি আদৌ প্রাইজ পাওয়া টিকিটখানি নয়।

বাসু একটু থামলেন। বিচারক এক্সিবিটখানি পুনরায় পরীক্ষা করে দেখলেন। মাইতিও উঠে গিয়ে দেখে এলেন। বাসু সওয়াল শুরু করেন :

—এ থেকে প্রমাণ হয়, মৃত কমলেশ মিত্র আদৌ পুরস্কার পাননি। তাহলে এত হৈ-চৈ কীসের জন্য? তার একমাত্র হেতু কমলেশ মিত্রের কৌতুকপ্রিয়তা। যে জন্য সে সকাল পাঁচটায় আসামিকে ফোন করেছিল, যে জন্য সে রবির আলমারি থেকে তার সার্ভিস-রিভলভারটি অপহরণ করেছিল। ঠিক সেই জন্যই সে এই মিথ্যা প্রচার করে। সমস্ত ব্যাপারটাই তার কাছে ছিল : ‘এপ্রিল ফুল!’

—এবার আমি মাননীয় বিচারককে প্রতিবাদীর এক্সিবিট নং ইলেভেন পরীক্ষা করে দেখতে বলি। সেটা হচ্ছে হোটেল হিন্দুস্থানের রেজিস্টারের একটি পৃষ্ঠার ফোটোস্ট্যাট কপি। ওতে লক্ষণীয় যে, কমলেশ মিত্র 528 নম্বর ঘরে সই করেনি। শুধু সইয়ের মিল হচ্ছে না এই এটাই একমাত্র কারণ নয়। আরও একটি মারাত্মক কারণ আছে। 528 নম্বর ঘরে যেই সই করে থাক তার ‘চেক-ইন’ টাইম হচ্ছে সকাল দশটা পাঁচ। ইউ.বি.আইয়ের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার মিস্টার শেষাদ্রির সাক্ষ্য অনুযায়ী আমার জানি—সোমবার পয়লা এপ্রিল বেলা দশটা-পাঁচ মিনিটে কমলেশ মিত্র ছিলেন ব্যাঙ্কে। হোটেলে নয়। মোক্ষম অ্যালিবাই!

—সহযোগী বলেছেন, মৃতদেহই প্রমাণ করে যে, কমলেশ মিত্র 528 নং ঘরের বাসিন্দা। আমি আপত্তি জানাব। আমি বলব, না–528 নম্বর ঘরে আবিষ্কৃত মৃতদেহ একথা প্রমাণ করে না যে, সে ওই ঘরই ‘বুক’ করেছিল। সহযোগী কাব্য করে বলেছেন, ‘কমলেশ মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই।’ তা থেকে কমলেশের মৃত্যুই প্রমাণিত হয়, আসামির হত্যাপরাধ নয়। কমলেশের মৃত্যু সম্বন্ধে কেউ কোনো সন্দেহ প্রকাশ করেনি, ফলে সেটা প্রমাণের জন্য রবীন্দ্র সাহিত্যের উদ্ধৃতিটা বাহুল্য! আমার মতে—কমলেশ সকাল নয়টা পঁয়ত্রিশ মিনিটে ওই হোটেলে ‘চেক-ইন’ করে। ‘বুক’ করে 524 নম্বর ঘর। আই রিপিট—528 নয়, 524 নম্বর ঘর। ‘পি.কে.মৈত্র’ এই ছদ্মনামে। ফোটোস্টাটি কপি করা পৃষ্ঠাটিতে দেখা যাচ্ছে 524 নম্বর ঘরের বাসিন্দা মিস্টার ‘পি.কে.মৈত্র’ সোমবার সকাল নয়টা পঁয়ত্রিশে চেক-ইন করেন এবং বেলা তিনটেয় চেক-আউট করে যান। আমি মাননীয় বিচারককে পুনরায় কমলেশ মিত্রের সই এবং ‘পি.কে.মৈত্রর’ সইটি মিলিয়ে দেখতে অনুরোধ জানাব ঘটনাচক্রে কমলেশ যে ছদ্মনাম নিয়েছিল তাতে দুটি ‘ক্যাপিটাল-লেটার’ আছে, আর সঙ্গে তার সইয়ের দুটি ক্যাপিটাল অক্ষর মিলে যায়। ‘কে’ এবং ‘এম’। ওই পি. কে. মৈত্রের স্বাক্ষরে কে এবং ‘এম’ কমলেশ মিত্রের সইয়ের হুবহু নকল। আমি হস্তরেখাবিদ পণ্ডিতের মত জেনে নিয়েই এ-কথা বলছি। মাননীয় আদালত প্রয়োজনবোধে বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়ে এ সত্য যাচাই করে নিতে পারেন। আরও একটা কথা। ‘পি.কে.মৈত্র’ নামটা সই হয়েছে সবুজ কালিতে। ওই পাতায় ওই একটাই মাত্র সবুজ কালির এনট্রি! আশ্চর্যের কথা—কমলেশের পকেট থেকে উদ্ধার করা কলমের কালি ছিল সবুজ।

—মোটকথা, 524 নম্বর ঘরের বোর্ডার ‘পি.কে. মৈত্র’ নামধারী কমলেশ মিত্রকে আর একজন অনুসরণ করছিল। কমলেশের চরিত্রটা কেমন তা আমরা জেনেছি। এমনকি সহযোগী পি.পি-র মতে ‘কমলেশ কিছু প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি ছিল না। ফলে ওই পশ্চাদ্ধাবনকারী ব্যক্তিটি কে, সে কথা না জানলেও এমন লোকের অস্তিত্ব আমরা যুক্তির খাতিরে মেনে নিতে পারি। আমার দায় প্রমাণ করা—সেই পশ্চাদ্ধাবনকারী আততায়ী আর যাই হোক, আসামি নয়। কমলেশ মিত্র যখন 524 নম্বর ঘরটি ছদ্মনামে বুক করে তখন ঘটনাচক্রে সে নিকটেই ছিল। ওই সকাল নয়টা পঁয়ত্রিশে। সে এই সুবর্ণসুযোগ গ্রহণ করে। কমলেশ চেক-ইন করার পরেই যখন ট্যাক্সি নিয়ে ব্যাঙ্কে চলে গেল তখন সে ওই 528 নম্বর ঘরটি ‘বুক’ করল। স্বনামে নয়, ছদ্মনামে। সে ছদ্মনাম নেয় ‘কমলেশ মিত্ৰ। ‘ চলে যায় 528 নম্বর ঘরে।

—কমলেশ ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে আসে সাড়ে দশটা নাগাদ। এসেই লাঞ্চের অর্ডার দেয়। রতন বেয়ারার সাক্ষ্য থেকে আমরা জানি 524 নম্বর ঘরের বোর্ডার, অর্থাৎ কমলেশ মিশ্ৰ স্বয়ং সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ লাঞ্চ খেয়ে নেয়! উল্লেখ্য—লাঞ্চ মেমো অনুযায়ী সে মটরশুঁটিও খায়!

—কমলেশের আহার শেষ হবার মুখে—ধরা যাক বেলা এগারোটা নাগাদ, ওই আততায়ী 524 নম্বর ঘরে ঢুকে পড়ে। যেমন করেই হোক, সে কমলেশের অপহরণ করা রিভলভারটা হস্তগত করে এবং তৎক্ষণাৎ কমলেশকে হত্যা করে।

—হোটেলের ম্যাপ অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে 524 নম্বর ঘরের দু-পাশেই দুটি ঘর ফাঁকা ছিল। এয়ার-কন্ডিশন করা ঘরে পিস্তলের শব্দও কম হয়। তাই এ ঘটনাটা জানাজানি হয় না। আততায়ী তারপর করিডরে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সুযোগ বুঝে মৃতদেহটি 524 নম্বর ঘর থেকে তার নিজের ঘর 528 নম্বর ঘরে নিয়ে আসে। বাথরুমে রেখে দেয়। এখন তার কাছে দুটি ঘরেরই চাবি আছে। দুটিরই ডুপ্লিকেট চাবি। শুধু তাই নয়, তার কাছে দুটি রিভলভারও আছে।

আসামির জবানবন্দি অনুযায়ী মীনাক্ষী দেবী আসামিকে বেলা সাড়ে তিনটেয় আসতে বলেছিলেন। মীনাক্ষী দেবী অবশ্য সে-কথা স্বীকার করেছেন। অথচ আমরা নিঃসন্দেহে জানি—আসামি একটি মহিলা কণ্ঠে বেলা সাড়ে তিনটেয় হোটেল হিন্দুস্থানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। আসামির ভগ্নী সতী দেবী এবং বৌদির জবানবন্দি থেকে আমরা জানি আসামির এই উক্তি মিথ্যা নয়। মীনাক্ষী দেবীর পরিচয়ে কোনও মহিলা যে তাঁকে ফোন করেছিল এ-কথা অবিসংবাদিত সত্য। সে নারীকণ্ঠ যারই হোক, আততায়ী এ সংবাদ জানত। তাই সে একটি খামের ভিতর 528 নম্বর ঘরের চাবিটি ভরে ফেলে। সে বেলা পৌনে দুটোয় লাঞ্চের অর্ডার দেয় এবং দুটো নাগাদ লাঞ্চ সেরে নেয় ওই 528 নম্বর ঘরে বসে। বেলা দুটোর সময় ‘গ্রিন পিজ’ শেষ হয়ে গিয়েছিল অর্থাৎ যে লোকটি 528 নম্বর ঘরের লাঞ্চ মেমো তৈরি করেছিল সে কিছুই ভুল করেনি। রতন বেয়ারা বৃথাই বকুনি খেয়েছিল। 528 নম্বর ঘরে বসে আততায়ী বেলা দুটোর সময় আদৌ মটরশুঁটি খায়নি। রতন আততায়ীকে দেখেনি, মৃতদেহও দেখেনি। তার কাছে বোর্ডাররা শুধু নম্বর মাত্র।

বেলা আড়াইটে নাগাদ আততায়ী ঘরে তালা লাগিয়ে চাবিটি খামে ভরে রিসেপশান-কাউন্টারে 528 নম্বর খোপে রেখে যায় ডক্টর পি. সেনগুপ্তের উদ্দেশে। একটু পরে সে আবার কাউন্টারে গিয়ে 524 নম্বর ঘরের চাবিটি জমা দেয় এবং ‘পি.কে.মৈত্রের’ পরিচয়ে চেক-আউট করে চলে যায়।

—আমার অনুমান, যে কোনো কারণেই হোক, আততায়ী শুধু কমলেশকেই শত্রু বলে মনে করে না, আসামি সেনগুপ্তকে সে ফাঁসাতে চায়। তাই আসামি যখন খাম নিয়ে উপরে উঠে যায় তখন সে তার গাড়িতে রিভলবারটি রেখে সরে পড়ে।

—এখানেই আততায়ী একটা ‘মাস্টার-টাচ’ দেয়। সে ওই গাড়িতে মার্ডার-ওয়েপনটা রাখে না। রাখে কমলেশের রিভলভারটা, কারণ সে ভেবেছিল যে, প্রকাশ সেটি আবিষ্কার করা মাত্র কোনো ম্যানহোলে ফেলে দেবে। তাই সে মার্ডার-ওয়েপনটা লুকিয়ে রেখে আসে প্রকাশবাবুর বাড়ির চৌহদ্দিতে। আমার প্রশ্ন করার অধিকার নেই, কিন্তু মাননীয় বিচারক রায়দানের পূর্বে যদি পুলিশ বিভাগকে প্রশ্ন করেন,তবে তাহলে জানতে পারবেন যে কোনও অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি পুলিশকে টেলিফোন করে জানায়—সে দেখেছে আসামি রাত্রের অন্ধকারে কালোমতন কিছু একটা জিনিস ওই ইটের স্তূপে লুকিয়ে রাখছে এবং সেজন্যই সেরাত্রে আসামির বাড়ি সার্চ হয়।

—আমি জানি, আমার এ ব্যাখ্যায় একটি জিনিস অনুক্ত থেকে গেল। কে সেই আততায়ী? কী কারণে সে কমলেশ ও প্রকাশবাবুকে শত্রু হিসাবে গণ্য করে? সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার দায় আমার নয়। আমার দায় প্রমাণ করা যে, সেই আততায়ী কোনোক্রমে ডক্টর প্রকাশ সেনগুপ্ত হতে পারে না। সে-কথা প্রমাণের জন অসংখ্য যুক্তির ভিতর আমি একটিমাত্র যুক্তি পেশ করছি—আততায়ী 528 নম্বর ঘরটি ‘বুক’ করে সকাল দশটায় ‘কমলেশ মিত্রের’ পরিচয়ে এবং বেলা দুটোর সময় লাঞ্চ খায়। ওই দুটি সময়েই আসামি ডক্টর প্রকাশ সেনগুপ্ত ছিলেন তাঁর নিজের বাড়িতে। তার একাধিক অকাট্য অ্যালিবাই আছে।

—আমার এই ব্যাখ্যায় আটটি মূল সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যাচ্ছে। এক, কেন মৃতের পাকস্থলীতে অর্ধজীর্ণ মটরশুঁটি পাওয়া গেল। দুই, কেন হোটেল রেজিস্টারে কমলেশের সই মিলল না। তিন, কেন 524 নম্বর ঘরের বোর্ডার পি.কে.মৈত্রের হস্তাক্ষরের সঙ্গে কমলেশের হস্তাক্ষর আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। চার, কেন পি.কে.মৈত্রের নামটি সবুজ কালিতে লেখা। পাঁচ, কেন মীনাক্ষী দেবীর পরিচয়ে কোনো একজন অজ্ঞাতনামা মহিলা প্রকাশবাবুকে হোটেল হিন্দুস্থানে টেনে নিয়ে যায়। ছয়, কেন কমলেশের ঘরের চাবি খামের মধ্যে ওইভাবে পাওয়া গেল। সাত, কেন আসামির গাড়িতে কমলেশের রিভলভার আবিষ্কৃত হল। এবং আট নম্বর—কেন ওই আসামি প্রকাশবাবুর বাড়ির চৌহদ্দিতে আবর্জনা-স্তূপের ভিতর মার্ডার-ওয়েপনটা পাওয়া গেল।

—মাননীয় পি. পি. বলেছেন, তিনি নাকি অসুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী আমিই শেষ আরগুমেন্ট করব। তাই তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেছেন, আমার যুক্তির বিরুদ্ধ-যুক্তি দেখাবার সুযোগ তিনি পাবেন না। মাননীয় বিচারককে আমার সবিনয় নিবেদন : আমরা এখানে কবির লড়াই করতে আসিনি। আমরা এসেছি একটি সত্য-উদ্ঘাটন করতে। তাই মাননীয় আদালতকে আমার অনুরোধ—সহযোগী পি.পি.-কে আর একবার আরগুমেন্ট করবার সুযোগ দেওয়া হোক। তিনি হয়তো বলবেন, আমার এই ‘হাইপথেসিস্’ একটি ‘আষাঢ়ে গল্প’! সেক্ষেত্রে আমরা তাঁর কাছে একটি শ্রাবণী গল্প’ শুনতে চাই! অর্থাৎ ‘আসামি অপরাধী’–এই হাইপথেসিসে তিনি সে কাহিনিতে ওই আটটি মূল সমস্যার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা বা সমাধান দাখিল করুন। তা যদি তিনি পারেন, তবে নিশ্চয়ই আমরা বিষয়টি পুনরায় পর্যালোচনা করব। আর তা যদি না পারেন, তাহলে আমরা আশা করব—তিনি স্বয়ং আসামির বেকসুর খালাসের আবেদন পেশ করবেন।

বিচারক বললেন, বাদী ও প্রতিবাদী মামলায় একবার করে ‘সাম-আপ’ করেন— এটাই প্রথা। তবু মিস্টার ডিফেন্স কাউন্সেল যে অনুরোধ করেছেন তা আমি মেনে নিচ্ছি। তাই আমি পি.পি.-কে অনুরোধ করছি, তিনি কি আর কিছু বলবেন?

মাইতি উঠে দাঁড়ালেন। বিহ্বলভাবে শুধু বললেন, থ্যাঙ্কু, মি. লর্ড। আমার আর কিছু বক্তব্য নেই। মামলায় রায় কী বের হল তা বোধ করি এখন লেখা বাহুল্য!

কিন্তু আসামির বেকসুর মুক্তিলাভে মামলা শেষ হয়; গল্প শেষ হয় না।

রাত্রে নৈশাহারে বসেছিলেন ওঁরা—বাসু-সাহেব, মিসেস বাসু, কৌশিক আর সুজাতা।

সুজাতা বললে, আমি কিন্তু একটা জিনিস এখনও বুঝতে পারছি না—প্রাইজ পাওয়া টিকিটটা তাহলে কার কাছে?

কৌশিক বলে, সম্ভবত এদের কারও কাছেই নয়।

—কিন্তু মৃত কমলেশের বুক-পকেট থেকে উদ্ধার করা টিকিটখানা সত্যই প্রাইজ পাওয়া টিকিট কি না, তা পুলিশ মিলিয়ে দেখেনি?

বাসু-সাহেব ফর্ক দিয়ে মাংসের টুকরোটা চেপে ধরে ছুরি দিয়ে কাটতে ব্যস্ত ছিলেন। বলে ওঠেন, হয় তাই সুজাতা—গোয়েবলস্-এর থিয়োরি। কমলেশ প্রাইজ পেয়েছে—এই মিথ্যেটার প্রচার এমন ঢাল-ঢোল বাধিয়ে ব্যাপকভাবে করা হল যে, ‘নয়’ আর ‘ছয়ে’ গোলমাল করে ওরা কেসটাকে নয়-ছয় করে দিল।

কৌশিক বলে, আমার বক্তব্য কিন্তু অন্য ধরনের। আপনার ব্যাখ্যার একটা বিরাট ফাঁক ছিল। সেটা আপনিও কৌশলে এড়িয়ে গেলেন, মিস্টার মাইতিও খেয়াল করেননি।

—কী ফাঁক?

—কমলেশ মিত্র একজন ধুরন্ধর ব্যক্তি; পকেটে রিভলভারটি নিয়ে ঘোরাফেরা করে। সে নিজেই নবীনবাবুকে বড়াই করে বলেছিল— সিংহের বিবরে ঢুকে কেউ সিংহের-শাবককে অপহরণ করতে পারে না! অথচ আপনি আপনার ব্যাখ্যায় সেই রকম কথাই বলেছেন। আপনার ‘আষাঢ়ে’ গল্প অনুযায়ী আততায়ী সিংহের বিবরে ঢুকে সিংহ শিকার করে, এবং ছিনিয়ে যায় এক জোড়া সিংহশাবক! আততায়ী যেমন কমলেশকে চেনে, কমলেশও নিশ্চয় তেমনি হাড়ে হাড়ে চিনত ওই লোকটাকে। কমলেশের এক্তিয়ারে তখন দু-দুটো রিভলভার! একটা নিজের, একটা রবিবাবুর। এ-ক্ষেত্রে কেমন করে সে নিজের এক্তিয়ার-ভুক্ত রিভলভারে নিজেই হত হল?

বাসু-সাহেব এতক্ষণে মাংসের টুকরোটাকে কায়দা করেছেন। মুখবিবরে ফেলে দিয়ে বললেন, পার্টিনেন্ট কোশ্চেন! কেউ কোনো ব্যাখ্যা দিতে পার?

মিসেস বাসু বলেন, ওসব ছেঁদো কথা থাক—তুমি বারে বারে বলেছ, কে কমলেশকে খুন করেছে তা তুমি জান। এবার আসল কথাটা বল দিকি?

বাসু বলেন, আগে তোমরা বল?

সুজাতা বলেন, আমার মনে হয় সুদীপ অথবা নবীনবাবু-

কৌশিক বললে, আমার কিন্তু ধারণা মীনাক্ষী অথবা রবি—

বাসু সাহেব স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, আর রানু? তোমার কি মনে হচ্ছে, মনোরঞ্জন হাঁসদা অথবা ওই শেষাদ্রি! আচ্ছা জাস্টিস্ সদানন্দ ভাদুড়ী নন তো?

মিসেস বাসু ধমক দিয়ে ওঠেন, ইয়ার্কি থাক! বল, সত্যি করে।

আর একটি মাংসের টুকরো মুখবিবরে নিক্ষেপ করে বাসু বলেন, আসল হত্যাকারীকে তোমরা ধরতেই পারনি। হত্যাকারীর নাম সমরেশ!

—সমরেশ! সমরেশ মানে? কোন সমরেশ?—সমবেত প্রশ্নের টাইফুন।

—সমরেশ মিত্র। কমলেশ মিত্রের যমজ ভাই!

সবাই স্তম্ভিত। সুজাতা বলে, যমজ ভাই! তার প্রসঙ্গই তো ওঠেনি।

—সো হোয়াট? তোমরা কেউ জান না, কমলেশের এক যমজ ভাই ছিল : সমরেশ!

বাপ তাকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিল। সেই রাগে….

কৌশিক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, স্যার, এতক্ষণে আপনি একেবারে তৃতীয় শ্রেণির গোয়েন্দা-গল্প লেখক হয়ে উঠেছেন।

—কেন?

—ওই জাতীয় গোয়েন্দা গল্পের লেখক যখন শেষমেশ হালে পানি পান না, তখন শেষ পৃষ্ঠায় একটি নতুন চরিত্র আমদানি করেন, যাকে কেউ চেনেই না।

বাসু বলেন, উপায় কী বল? তোমরা তিনজনে যে ডিটেকটিভ গল্পের একেবারে তৃতীয় শ্রেণির পাঠক হয়ে উঠেছ। শেষ পৃষ্ঠায় পৌঁছে জিজ্ঞাসা করলাম তোমাদের মতামত, আর তোমরা এক নিশ্বাসে পাইকারি হারে সবকটা পরিচিত নাম বলে চলেছ। একটা না একটা তো মিলবেই!

মিসেস বাসু বলেন, তবে কি আমাদের একটিমাত্র নাম বলতে হবে?

—না। নাম আদৌ বলতে হবে না। শুধু প্রত্যেকটি অসঙ্গতি মিটিয়ে দিতে হবে। মাইতিকে আমি যে ‘শ্রাবণী গল্পটা’ বলার জন্য চ্যালেঞ্জ করেছিলাম শুধু সেটাই রচনা করতে হবে। নাম আপনিই এসে যাবে। প্রথমেই দিতে হবে ব্যাখ্যা—যে প্রশ্নটা কৌশিক একমাত্র তুলেছে : আততায়ী কেমন করে সিংহের বিবরে ঢুকে সিংহ শিকার করল। বুঝিয়ে বলতে হবে, নিজে এক্তিয়ারে দু-দুটো রিভলভার থাকা সত্ত্বেও কমলেশের মতো মানুষ কী করে খুন হতে পারে। তারপর দিতে হবে ব্যাখ্যা—যে প্রশ্ন সুজাতা তুলেছে : কমলেশের টিকিট যে প্রাইজ পাওয়া টিকিট নয় তা এতগুলো ধুরন্ধর পুলিস অফিসার কেন খেয়াল করেনি? সব শেষে মিটিয়ে দিতে হবে মামলায় যে আটটি অসঙ্গতির কথা বলেছি। আমার ‘আষাঢ়ে গল্প’ ওই আটটা প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ কিছু ফাঁক বা ফাঁকি আছে। তাই এখন চাই একটা ‘শ্রাবণী গল্প’

অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। মিসেস বাসুই নীরবতা ভঙ্গ করে বলেন তুমি এমন একটা শ্রাবণী গল্প’ শোনাতে পারে?

— পারি।

—তাতে সব কটা অসঙ্গতির সমাধান পাওয়া যাবে?

—তাই তো আশা করি।

—এবং তুমি জান, হত্যা কে করেছে?

—জানি!

—তবু তুমি চুপচাপ বসে আছে? হত্যাকারীর ফাঁসি হ’ক এটা তুমি চাও না?

বাসু বলেন, আমি পুলিশ কমিশনার নই রানু। তবে একটা কথা মানছি, সামাজিক মানুষ হিসাবেও আমার একটা দায়িত্ব আছে। কিন্তু সে তো তোমাদেরও আছে। বেশ তো, এবার আমি আমার সেই ‘আষাঢ়ে গল্পটা’ প্রত্যাহার করে নতুন করে একটা গল্প শোনাই, যাকে বলেছি : শ্রাবণী গল্প’। গল্প গল্পই, এটা যে সত্য ঘটনা এমন দাবি আমি করছি না, কিন্তু তোমরা লক্ষ করে দেখ, এই কাহিনি অনুযায়ী কোথাও কেন অসঙ্গতি থাকবে না। সব কয়টি সমস্যার বেমালুম সমাধান হয়ে যাবে। ‘জিগ্‌-স্‌’–ধাঁধায় যেমন খাঁজে খাঁজে মিলে যায়। গল্পটা শেষ হবার পর তোমরা সবাই যদি পরামর্শ দাও তাহলে আমি পুলিশ কমিশনারকে না হয় গল্পটা শুনিয়ে আসব।

—তুমি শুরু কর দিকিন—তাগাদা দেন মিসেস বাসু।

—মনে করো, ডাক্তার সেনগুপ্ত বন্ধুদের টাকায় ছয়খানা টিকিট কাটে। নিজে একখানা রাখে, বাদবাকি একখানা করে দিয়ে দেয় রবি, সুদীপ, নবীনকে। কমলেশ দুখানি টিকিট নেয়, একটা নিজে রাখে, একটি দেয় মীনাক্ষীকে। হল?

—এখানে মনে করা যাক, কমলেশ তার ডায়েরিতে ছয়খানা টিকিটের নম্বর টুকে রেখেছিল—কে কোনখানা রেখেছে তার উল্লেখ সমেত। লটারির ‘ড্র’ কবে হবে তা কেউ খেয়াল করেনি; শতকরা 99.99 ভাগ লোকই তা করে না। পয়লা এপ্রিল খবরের কাগজে ফলাফলটা ছাপা হল। সেটা সর্বপ্রথম ওই ছয় জনের মধ্যে কার নজরে পড়বে? নিঃসন্দেহে নিউজ এডিটর কমলেশ মিত্রের। ওই দিন ভোর পাঁচটার সময় সে জানতে পারে যে, রবি বসুর C/506909 টিকিটখানি প্রথম প্রাইজ পেয়েছে। খবরটা তখনও আর কেউ জানে না; কাগজ তখনও সংবাদপত্রের অফিসের বাইরে যায়নি। কমলেশ লোভ সামলাতে পারেনি। এক লপ্তে সওয়া লক্ষ টাকা! সে রবির টিকিটখানা হাতিয়ে নিজেরখানা সেখানে রেখে আসার পরিকল্পনা করে। তা করতে হলে প্রথমেই রবিকে বাড়ির বাইরে আনতে হয়—অন্তত দৈনিক পত্রিকা রবির হস্তগত হবার আগেই। চমৎকার পরিকল্পনা তার—তাই সে প্রকাশের সাহায্যে রবিকে বিছানা থেকে তুলে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। রবি এবং প্রকাশ দুজনেই তখন ভেবেছিল, এটা এপ্রিল ফুলের ছেলেমানুষি। কমলেশ ছুটল রবির বাড়ি—হাসপাতালে নয়। হয়তো ভেবেছিল, রবির স্ত্রীকে বলবে—লটারির টিকিটটা দেখি, নম্বরটা টুকে রাখব। আজকালের মধ্যে ‘ড্র’ হবে।

রবির বউ টিকিটটা বার করে দেখালে, কমলেশ হাত-সাফাই করে ফিরে আসত; অর্থাৎ নিজের টিকিটখানা ওখানে রেখে রবিরটা হাতিয়ে। কিন্তু পরে পর মনে হল, এতে রবির সন্দেহ হতে পারে। তাই প্রথমে সে রবির ড্রয়ার আলমারি হাতিয়ে দেখতে চাইল। যদি ঘটনাচক্রে সেটা পেয়ে যায়, তাহলে রবির কোনো সন্দেহ হবে না। এই সুযোগটা করে নিতেই সে অঞ্জলির সঙ্গে এমন ব্যবহার করল যাতে রবির স্ত্রী সাহস করে ওই শয়নকক্ষে ঢুকতেই পারেনি।

সৌভাগ্য কমলেশের-আলমারি পাল্লাটা খোলা ছিল। কমলেশ টিকিটখানা খুঁজে পায়। সেটি আত্মসাৎ করে, নিজের টিকিটখানা সেখানে রেখে একটু পরে সে চলে যায়। রবির রিভলভার সে আদৌ নেয়নি। আই রিপিট—রবির রিভলভার কমলেশ আদৌ নিয়ে যায়নি।

আধঘণ্টা পরে রবি ফিরে আসে। স্ত্রীর কাছে যখন শুনল যে, কমলেশ তার শয়নকক্ষে রুদ্ধদ্বার জনান্তিকে বেশ কিছুক্ষণ ছিল তখনই সে সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ে। সে আলমারি হাতড়ে দেখে। তার ভয় হয়, কমলেশ হয়তো তার সার্ভিস রিভলভারটা সরিয়েছে একটা ‘প্র্যাক্টিকাল জোক’ করতে। কিন্তু না, রিভলভার যথাস্থানেই আছে। টাকা-পয়সা কমলেশ নেবে না। তাহলে কেন সে হঠাৎ শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করেছিল?

রবির স্ত্রী যখন দ্বিতীয়বার চা বানাতে ব্যস্ত তখন রবি খবরের কাগজ পড়ছে। হঠাৎ নজরে পড়ল—কাগজে লটারির ফলাফল বার হয়েছে। তখন সে উঠে গিয়ে আলমারি থেকে নিজের টিকিটখানা বের করে মিলিয়ে দেখে। দেখে, খুব কান ঘেঁষে মিস করেছে। এই সময়েই বিদ্যুৎচমকের মতো একটা সম্ভাবনার কথা মনে হয়। তাই কি কমলেশ রুদ্ধদ্বার কক্ষে কয়েক মিনিট কাটিয়ে গেল, রবির অনুপস্থিতিতে?

কমলেশের নিতান্ত দুর্ভাগ্য : সে যেমন ছয়খানি টিকিটের নম্বর নাম অনুসারে ডায়রিতে লিখে রেখেছিল, ঠিক সে ভাবেই রবিও লিখে রাখে। ডায়েরি খুলে বুঝতে পারে তার টিকিটখানিই ছিল C/506909 যা এখন হয়ে গেছে C/506906! মুহূর্তমধ্যে রবি বুঝে ফেলে, কমলেশ তার সঙ্গে কতবড় তঞ্চকতা করেছে। অসাধারণ মনোবল এই পুলিশ অফিসারটির! এতবড় বজ্রাঘাতটা বুক পেতে সহ্য করল। স্ত্রীকে পর্যন্ত কিছু বলল না। মন্ত্রগুপ্তি ওর মজ্জায় মজ্জায়—ও হচ্ছে পুলিশ ইন্সপেক্টর। প্রথমেই কমলেশের বাড়িতে ফোন করে; তার গৃহভৃত্য জানায় যে, কমলেশ সাতদিনের ছুটির বাইরে গেছে। তারপর সে মীনাক্ষীকে ফোন করে এবং শোনে যে,মীনাক্ষীই ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে। রবি বুদ্ধিমান। তৎক্ষণাৎ বুঝে নেয় কমলেশ কেন নিজে প্রথম পুরস্কার না নিয়ে মীনাক্ষীকে সেটা নেওয়ার সুযোগ দিচ্ছে।

বাধা দিয়ে সুজাতা বলে : কেন?

—দুটি প্রয়োজনে। প্রথম কথা, মীনাক্ষী প্রাইজ পেলে রবির সন্দেহটা হবে না। দ্বিতীয় কথা, তার ডিভোর্সের মামলা আদালতে ঝুলছে। মানি-সেটেলমেন্ট কেস-এ ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স কম রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়, শেষাদ্রি বলেছিল, কমলেশ আশি হাজার টাকা উড়িয়েছে কি না তা সে জানে না, যদিও তার ব্যালেন্স ওই পরিমাণ কমেছে। বস্তুত শেষাদ্রি ঠিকই ধরেছিল—কমলেশ ওই টাকা ধীরে ধীরে বেনামি করছিল, যাতে মানি-সেটেলমেন্টের সময় তার ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স খুব কম থাকে। সে যাই হোক, মীনাক্ষীর কাছ থেকে হোটেল হিন্দুস্থানের খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ সেখানে যায়। যাবার সময় তার লোডেড সার্ভিস রিভলভারটা নিতে ভোলে না।

—বেলা সাড়ে নয়টা নাগাদ কমলেশ যখন নিজের খোপে চাবি রেখে ব্যাঙ্কে গেল, তখনই রবি জানতে পারল যে, 524 নম্বর ঘরের বোর্ডার মিস্টার পি.কে মৈত্র হচ্ছে কমলেশ মিত্র। কমলেশ কোনও রকম রিস্ক নিতে চায়নি, কী জানি রবি সন্দেহ করে তাকে খুঁজতে বের হয়। তাই সে ছদ্মনামে ঘরটা বুক করে। এমনকি ঘরের নম্বর মীনাক্ষীকেও জানায় না। তাকে বলেছিল; লাউঞ্জে সে ওর জন্য অপেক্ষা করবে। রবি তৎক্ষণাৎ 528 নম্বর ঘরটা বুক করে। কমলেশ যদি ডালে-ডালে ঘোরে তো রবি ঘোরে পাতায়-পাতায় সে চেক-ইন রেজিস্টারে সই করল ‘কমলেশ মিত্র’ নামে খাতা কলমে কমলেশ মিত্ৰ হল 528 নম্বর ঘরের বোর্ডার।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই ব্যাঙ্ক থেকে কমলেশ ফিরে এল। সারা দিনে সে অনেকগুলি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। মীনাক্ষী, নবীন, সুদীপকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আসতে বলেছে, নিজে বেলা চারটেয় ব্যাঙ্কে যাবে বলে এসেছে; তাই সে ঘরে ফিরেই আরলি-লাঞ্চের অর্ডার-রুমে গিয়ে খাবার সাহস পায় না, কারণ তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছিল; রবি তাকে সন্দেহ করতে পারে এবং এ সংবাদ পেতে পারে যে, সে হোটেল হিন্দুস্থানে আছে।

আহার সার্ভ করতে যেটুকু সময় লাগল তার মধ্যে কমলেশ লটারি অফিসে হাঁসদার সঙ্গে কথা বলে।

কমলেশের আহার পর্ব যখন শেষ হচ্ছে তখন রবি ওর ঘরে নক করে। কমলেশ দরজা খুলেই যেন ভূত দেখল! এরপর রুদ্ধদ্বার কক্ষে ঠিক কী কী ঘটেছিল তা অনুমান নির্ভর। সম্ভবত রবি বলে, আমার টিকিটটা নিয়ে যাও, আই শ্যাল ফরগিভ য়ু! এটা অবশ্য আমার আন্দাজ মোটকথা খুব সম্ভবত দুজনের বচসা হয়। আমার ধারণা, কমলেশ ঠিক তখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়—অর্থাৎ রবিকে খুন করার পরিকল্পনা। সে রাজি হয় টিকিটটা ফেরত দিতে। পকেটে হাত ঢোকায়, এবং হাত যখন বার করে আনে তখন তার হাতে রিভলভার। রবি অত্যন্ত দুঃসাহসী। আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার সে জানে। সে ‘তাক’করে এবং নিজের রিভলভারটা বার করে। কমলেশ ফায়ার করে কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

কৌশিক বাধা দিয়ে বলে, এটা আপনি কেমন করে আন্দাজ করছেন?

বাসু বললেন, আমি আগেই বলেছি—এটা নিছক গল্প। সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করার মতো এভিডেন্স আমার হাতে নেই। তবু আমার যুক্তির সপক্ষে বলব : প্রকাশ যখন তার গাড়ির ভিতর কমলেশের রিভলভারটি পায় তখন তাকে একটা ডিসচার্জড বুলেট ছিল, এবং ব্যারেলে বারুদের গন্ধ ছিল। ওই দুটি সূত্র থেকেই আমার গল্পের এই অংশটার উপাদান সংগৃহীত। আমার ধারণা ওই 524 নম্বর ঘরটা তল্লাশি করলে ডিচার্জড বুলেটটা এখনও আবিষ্কার করা যায়!

—সে যাই হোক, পরমুহূর্তেই রবি ফায়ার করে এবং কমলেশের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ে।

—ঘটনা যদি এই খাতে বয়ে থাকে তাহলে রবি তখন কী করতে পারে?

—আত্মরক্ষার্থে সে গুলি ছুড়ছে এ গল্প পুলিশকে বিশ্বাস করনো শক্ত। প্রথমত, লটারির টিকিট চুরির যাওয়ার কথা কেউ জানে না। দ্বিতীয়ত, হোটেল-রেজিস্টারে জাল পরিচয় দিয়ে ঘর নিয়েছে, যেটা আইনত অপরাধ। ফলে, সে আত্মগোপন করতে চাইল–ভেবে দেখল, সে যে হোটেল হিন্দুস্থানে এসেছিল তার কোনও প্রমাণ নেই, তাকে কেউ সন্দেহ করবে না। কমলেশ আত্মহত্যা করেছে এ-কথা প্রমাণ করা যাবে না, কারণ সে মরেছে 38 বোরের সার্ভিস রিভলভারের গুলিতে। রবি তখন কমলেশের পকেট থেকে লটারির টিকিটখানি উদ্ধার করে নিজের টিকিটটা সেখানে রেখে দিল। ঘরটা তালাবন্ধ করে ফিরে এল নিজের বাড়িতে। রবি কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিল না, কারণ মার্ডার-ওয়েপনটা তখনও তার পকেটে! বাড়ি ফেরার পথেই ওর হঠাৎ সন্দেহ হয়–হয়তো ডক্টর প্রকাশ সেনগুপ্তও ছিল কমলেশের ষড়যন্ত্রের ভিতর! তাই সে সাত-সকালে রবিকে ভুল খবর দিয়ে হাসপাতালে ডেকে পাঠায়। অদ্ভুত তার মনের জোর। একটা মানুষকে খুন করে এসে, মার্ডার-ওয়েপনটা পকেটে নিয়েও সে ঘাবড়ায় না। বাড়ি ফিরে সে তার স্ত্রীকে বলে, সকালবেলা প্রকাশ যেমন তাকে নাকাল করেছিল, এ-বেলা সে তার শোধ নেবে। তার পরামর্শমতো রবির স্ত্রী অঞ্জলি, পরিচয়ে প্রকাশকে ফোন করে। বলে, সে মীনাক্ষী মজুমদার, কমলেশের নির্দেশমতো সে প্রকাশকে হোটেল হিন্দুস্থানে যেতে বলে। ঠিক সাড়ে তিনটেয়। এ সময় প্রকাশ মারাত্মক ভুল করে। মীনাক্ষীরূপী অঞ্জলিকে সে কৌতুক করে বলে যে, কমলেশ যে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছে সে-কথা সে সকাল পাঁচটা থেকে জানে।

—আমার এই শ্রাবণী গল্পের’ মর‍্যাল কিন্তু এখানেই : ‘কৌতুকের হলেও কদাচ মিথ্যা কথা বলিও না!’ প্রকাশ এটুকু মিথ্যার জন্য ফাঁসিকাঠে ঝুলতে বসেছিল! কারণ এ কথা শুনে রবি নিঃসন্দেহ হল যে, প্রকাশ কমলেশ দুজনে মিলে তার লটারির টিকিটটা চুরি করেছিল। কারণ প্রকাশ যদি ভোর পাঁচটায় এতবড় খবরটা পেয়ে থাকে তাহলে সে হাসপাতালে সে কথা বলেনি কেন? দ্বিতীয়ত, টেলিফোনে মিথ্যা খবর দিয়ে সে রবিকে বাড়ি থেকে সরিয়েই বা দিল কেন? অমল আহত হয়ে হাসপাতালে আসাটা নিতান্ত কাকতালীয় ঘটনা। অন্তত তার পনেরো-বিশ মিনিট আগে প্রকাশ টেলিফোন করেছিল রবিকে! সুতরাং রবি চরম প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুত হল। টেলিফোনের কথা-মুখে চাপা দিয়ে অঞ্জলি যখন তাকে জানাল যে, প্রকাশ সকাল পাঁচটা থেকে জানে কমলেশ প্ৰাইজ পেয়েছে তখনই মুহূর্তমধ্যে সে মনস্থির করে। কমলেশকে সে শেষ করেছে, এরপর হত্যাপরাধটা প্রকাশের স্কন্ধে চাপিয়ে দিতে হবে। তৎক্ষণাৎ সে অঞ্জলির মাধ্যমে প্রকাশকে হোটেলে আসতে বলে, ঠিক সাড়ে তিনটেয়—পাঙ্কচুয়ালিটির বিষয়ে বিশেষভাবে অবহিত করে।

—ভেবে দেখ, দ্রুত সিদ্ধান্তে এসেছে সে। বোধহয় সে পরিকল্পনাটা মোটমুটি মনে মনে ছকেই রেখেছিল—প্রকাশ যে মুহূর্তে স্বীকার করল যে, সে সকাল পাঁচটা থেকে এ খবরটা জানে তৎক্ষণাৎ সে পরবর্তী পরিকল্পনা কার্যকরী করল। মোটর বাইক নিয়ে ফিরে গেল হোটেলে। বেলা তখন দুটো। খুব তাড়াতাড়ি সে 528 নম্বর ঘরে বসে লাঞ্চ সেরে নেয়। তারপর সুযোগমতো মৃতদেহটা এ-ঘর থেকে ও-ঘরে নিয়ে আসে। বাথরুমে মৃতদেহটা রেখে বেরিয়ে আসে। Do not disturb বোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। তারপর ঘরের চাবিটি খামবন্ধ অবস্থায় কাউন্টারে জমা দিয়ে অদূরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। প্রকাশ যখন এসে খামটা নিয়ে উপরে উঠে গেল তখন সে কমলেশের রিভলভারটা তার গাড়ির ভিতর রেখে চলে যায়। বলাবাহুল্য সে রাত্রে সে মার্ডার ওয়েপনটাও রেখে আসে প্রকাশের বাড়িতে। আশা করি আমার গল্পের নটে গাছটি এতক্ষণে নিঃশেষে মুড়িয়ে গেছে! কারও কোনো অসঙ্গতি নজরে পড়ছে?

সবাই একমনে ভাবছে।

রানী বলেন, তোমার এই আষাঢ়ে গল্পটা, না, না, ‘শ্রাবণী’ গল্পটা সত্যি কি না, তা কোনোদিনই জানা যাবে না—না গো?

—কে বললে জানা যাবে না? তিনমাসের মধ্যেই তা জানতে পারবে!

—তিন মাসের মধ্যেই ধরা পড়ে যাবে রবি বোস?

—যাবে। পুলিশের কাছে নয়, আমাদের তিনজনের কাছে।

–কেমন করে?

—ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট লটারির প্রাইজ ফলাফল ঘোষিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে দাবি পেশ করতে হয়। ইতিমধ্যে পুলিশ যেই ফাইনাল রিপোর্ট দাখিল করে বলবে—কমলেশ মিত্রের হত্যাকারীকে আর সন্ধান করা হচ্ছে না, অমনি দেখবে রবি বোস তার ড্রয়ার থেকে একখানি লটারির টিকিট খুঁজে পাবে! কী আশ্চর্য! তার নম্বর C/ 506909! তাই আমার প্রশ্নের জবাবে সে বলেছিল, তার নিজের টিকিটের নম্বর সে আদৌ যাচাই করে দেখেনি; বলেছিল সেই টিকিটখানা বর্তমানে কোথায় আছে তা সে জানে না, ফেলে দিয়েও থাকতে পারে।

—তখন হয়তো রবিই একটা ডিনার থ্রো করবে। তাই নয়?

—বড় স্কেলে পার্টি দিক আর না দিক সে আমাকে নিমন্ত্রণ করবেই।

সুজাতা বলে, কেন? এত লোক থাকতে আপনাকেই বা বিশেষভাবে নিমন্ত্রণ করতে যাবে কেন?

—চক্ষুলজ্জায়! অত্যন্ত ধূর্ত সে! অত্যন্ত বুদ্ধিমান! তাই রবি জানে যে, আমি জানি!!

–সে আবার কী! তার মানে?

—সেটা বোঝা ভারি শক্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *