গ্রানাদা থেকে মাদ্রিদ (অগ্রন্থিত)

গ্রানাদা থেকে মাদ্রিদ (অগ্রন্থিত)

আলবের্টো

বসে আছি। অল্প বাদলা বাতাস দিচ্ছে তাই রক্ষে। ট্রেন তো সেই এগারোটায়। সে তার সময়ে আসবে। আমি ততক্ষণ কী করি’ এই অচেনা অজানা শহরে? এখন সন্ধে, সাইট সিয়িং-এর সময় বিগত। সারাদিনই অবশ্য ঘুরছি, শরীর এখন ক্লান্ত, পা চলছে না আর, কিন্তু মন এখনই ছুটি নিতে রাজি নয়। চোখ যতটুকু গ্রহণ করতে পারে তা-ই সই।

এটা একটা চক। শহরের মাঝখানে একটা প্লাজা। মাঝখানে ফোয়ারা উঠছে—ফোয়ারাকে ঘিরে এই ছোট্ট শহরের জীবন। চাদ্দিকে বেঞ্চি পাতা। কোনও বেঞ্চির ফোয়ারার দিকে মুখ কোনও বেঞ্চিটা পথ চেয়ে বসে আছে। কোনও কোনও বেঞ্চ আবার দু’টোর কোনও দিকেই নয়। এই প্লাজার ভিতরেই তারা মুখোমুখি। আমার হাতে যেন অসীম সময়। এবং পেটে অসীম খিদে। এবং পকেটে নিতান্তই সীমিত মুদ্রা, কয়েকটা পেসেতো বাকি। এদিকে স্পেন দেখবার ইচ্ছে বহুদিনের। সেই যখন প্রায় কিশোরীকালে কেমব্রিজে পড়তুম, সেই তখনকার স্পৃহা স্পেনই ছিল ছাত্রদের সবচেয়ে সস্তা বেড়ানোর জায়গা। (তিরিশ বছর হতে চলল প্রায়! ভাবলেই গা শিরশির করে ওঠে—অ্যা-তো-ব-য়ে-স?) বিলেতের ছাত্রছাত্রীরা তখন সুযোগ পেলেই ছুটিছাটাতে চলে যেত স্পেনে, পিঠে ব্যাকপ্যাক আর স্লিপিং ব্যাগ বেঁধে নিয়ে। স্পেনে বেড়াতে যাওয়া সবচেয়ে সস্তা ছিল। কেবল আমারই কখনও যাওয়া হয়নি। আমি তো একা গেলে হবে না, আরেকজনেরও সময় সুবিধে থাকা চাই। বিলেতে আমার ছাত্রাবস্থা ছিল সংসার করার সঙ্গে সঙ্গে। আমরা ছুটিতে যেতুম ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, কখনও বা কলক তা, দিল্লি, শান্তিনিকেতন। মাত্র একবারই শুধু রেণুকা আর আমি নিজেরা নিজেরা গিয়েছিলুম সুইৎজারল্যান্ডে। কর্তা তখন একটা বই লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলেন। আমাদের সেবার খুব মজা হয়েছিল। ‘অপারেশন ম্যাটারহর্ন’-এ সেই কেচ্ছা কেলেংকারির কথা লিখে ফেলেছি। আর একবার আমরা দু’তিনজন মেয়ে মিলে আয়ারল্যান্ডে যাচ্ছিলুম। যেতে গিয়েও যেতে পারিনি আমি, স্টেশনে যাওয়ার বদলে আমাকে হঠাৎ চলে যেতে হল হাসপাতালে, একটা আকস্মিক অস্ত্রোপচারের জন্য। দুঃখী দুঃখী ভাবে আমাকে ছাড়াই অন্যরা চলে গেল আয়ারল্যান্ডে! আমি অবিশ্যি তার পরে একা একা বারদুই আয়ারল্যান্ডে গিয়েছি। এখন আমি থাকি স্বদেশে, এখন আমি মুক্তকচ্ছ, যথা ইচ্ছা তথা যা। কিন্তু ঝুঁটি যে টেনে ধরে রেখেছে চাকরি। ইচ্ছেমতো উড়ে যেতে দেয় না। এ যাত্রায় মরিয়া হয়ে স্পেনের টিকিট কেটে ভিসা করে ফেললুম। যাত্রা ইংল্যান্ড থেকে। টাকা হাতে এত কম, যে, খোঁজ করছিলুম। স্পেনে কোনও চেনাশুনো লোকজন আছে কি না, দু’চারদিন যার স্কন্ধে অবতারণ করা চলে। আর ইন্ডিয়ান এমব্যাসি তো আছেই যদি বিপদে পড়ি। ১৯৮৭-তে যখন যুগোস্লাভিয়াতে নোভি সাদ-এ একটা Oral literature-এর conference-এ যাচ্ছিলুম—নতুন এয়ারলাইন, মাদ্রিদের জন্য ফ্রি টিকিট দিয়েছিল। টিকিট ফ্রি, কিন্তু ভিসার দাম তিনশো টাকা। তখন সেটা অনেক। তাই সই। তবুও হল না যাওয়া। কপালে থাকলে তো? হল না কেন? কেননা মাত্র একটিই দিন যুগোস্লাভ এয়ারলাইন্স মাদ্রিদ যায়, এবং সপ্তাহে একটিই দিন তারা কলকাতায় যায়। যদি মাদ্রিদ যাই, তবে ১৫ দিনের ধাক্কা। কলকাতার প্লেন মিস। হাতে একদম ছুটি ছিল না। কেমন করে যাই? তখনও যুগোস্লাভিয়া বলে দেশটি ধরাধামে ছিল। যুগোস্লাভ বলে নিজেদের মনে করতেন সে-দেশের বেশ কিছু মানুষ। যেমন স্লোভাকিয়া তো ছিলই, তবুও তো চেকোস্লোভাকিয়া বহুদিন অবিচ্ছিন্ন ছিল? ১৯৮৭-তে যুগোস্লাভিয়ায় সার্বো-ক্রোয়েশিয়ান ভাষায় বই বেরুত, কবিতার ম্যাগাজিন বেরুতো। সার্বরা, ক্রোয়াটরা খাঁটি যুগোস্লাভ বলেই নিজেদের মনে করতেন। তাঁদের শত্রু ছিল তুর্কিরা। কেন জানি না আমার বেলগ্রেড-নোভি সাদ ভ্রমণের কথা আমি লিখিনি কখনও। যেমন লিখিনি (১৯৭৪) চেকোস্লোভাকিয়ায় মেরিনার পোপোভিচের, বা (১৯৭৬) হাঙ্গারিতে লালোর গল্প।

দেশ ভ্রমণের গল্পও এটা ঠিক নয়। এটা হঠাৎ পাওয়া পথের সাথী কিছু মানুষের গল্প। জায়গাটা স্পেনের দক্ষিণে, গ্রানাদা। স্পেনের মাঝামাঝি, টোলিডো, আর মারিয়া আংহুলোর কথাও লিখতে হবে কখনও। মারিয়ার দাদা সাহিত্যের অধ্যাপক হার্ভার্ড-এ, তিনি আমাকে তাঁর নাম-ঠিকানা-টেলিফোন নম্বর দিলেন। মাদ্রিদে মারিয়ার আদরে ছিলুম যাওয়ার পথে। মারিয়ার সঙ্গেই দেখেছি প্রাদো, তার গাড়িতে গিয়েছি টলেডো-তে, আর হেঁটেছি মাদ্রিদের পথে পথে, কফি হাউসে, বার-এ। গ্রানাদা থেকে ফেরার পথে একরাত্রি আমি ছিলুম ভারতীয় দূতাবাসে অতিথি। রাষ্ট্রদূত নিজে কলকাতাতে পড়াশুনো করেছেন, দার্জিলিং-এর ছেলে, আমাকে খুব যত্ন করেছিলেন। সেখানেই দেখা হয়েছিল সাইকেলে বিশ্বভ্রমণরত এক বঙ্গসন্তানের সঙ্গে।

সারাদিন হাঁটতে হাঁটতে আমার খিদে পেয়ে গেছে, একটা বেকারি থেকে রুটি কিনেছি—সঙ্গের বোতলে কেনা জল আছে। ওয়াইন হলে ব্যাপারটা ক্লাসিকাল হত, কিন্তু রেস্ত নেই। বেঞ্চিতে বেশ করে বাবু হয়ে পা তুলে গুছিয়ে বসেছি, শুকনো রুটি জলে ভিজিয়ে অমৃত মনে করে খাচ্ছি। অর্থাৎ সে-রাত্রের ডিনার সারছি। তারিখটা ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ (ভাদ্র ১৪০১), শহরের নাম গ্রানাদা। হ্যাঁ, সেই গ্রানাদা–দক্ষিণ স্পেনের ছোট্ট শহর-গার্থিয়া লোরকার জন্মস্থান, আর বিশ্ববিখ্যাত তুর্কি প্রাসাদ আলহামরাও এইখানেই অবস্থিত। আরও আছে অনেক কিছু। অপূর্ব কারুকার্যখচিত এক সুপ্রাচীন তুর্কি মাদ্রাসা-একেবারে ক্যাথিড্রালের বিপরীতে, রাজকীয় চ্যাপেলের উল্টো দিকেই, অবাক হয়ে দেখতে হয় তার আর্কিটেকচার—’ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়’। গ্রানাদাতে এখনও গোটা একটি আরব পাড়া আছে। সেখানে রয়েছে তুর্কিদের প্রাচীন স্নানঘর। ইংলন্ডের বাথ শহরে দেখছিলুম রোমান বাথ, সে এক দারুণ বস্তু। গুজরাতের ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া অসামান্য কারুকার্যখচিত চৌকো পুকুরের মতো স্নানঘর রয়েছে, রূপ আর রহস্য আজও চোখ থেকে ঘোচেনি। আর লাল কেল্লার বাদশা বেগমদের বিলাসবহুল জাফ্রিকাটা দেয়াল, আর সুগন্ধি ফোয়ারাওয়ালা মর্মর স্নান ক্ষগুলির কারুকাজ নিয়ে বলার কিছু নেই। এবারে দেখি টার্কিশ বাথ কী ব্যাপার। নাম তো এনেছি বহু। তুর্কিতে গিয়েছি বটে একবার, সোফিয়া মসজিদ আর ময়ূর সিংহাসন দেখেছি ইস্তাম্বুলে, এশিয়া ইয়োরোপের সীমারেখা, বসফরাস খাল-এর পাড়ে বেড়িয়েছি, তখন তো আমি ছেলেমানুষ মেয়ে। সেবারে টার্কিশ বাথ দেখার কথা মনে আসেনি। এখন আমি বড় মেয়ে, ম্যাপ দেখে হেঁটে হেঁটে সেতু পেরিয়ে অলিগলি ঘুরে যখন সেখানে পৌঁছুলুম, হায়, আমার এত শখের স্নানঘর তখন বন্ধ। সিয়েস্তার সময় হয়ে গিয়েছে। ইটালি আর স্পেনে দুপুরে চাবাই সব ব্যবসাপাতি বন্ধছন্দ করে ঘুমোয়। খুলতে দুই ঘণ্টা। আমার তত সময় কোথায় হাতে? লোরকার বাড়ি দেখতে যেতে হবে না? ফলে আর টার্কিশ বাথ পরিদর্শন হল না, মাঝ থেকে নামার স্নানটাও করা হল না। এখানে রোদ চড়া, বেশ গরম বাপু, স্নান না করে কষ্টে আছি। ‘আশা ছিল টার্কিশ বাথ নিয়ে নেব! দুরাশাই বটে। আসল কথাটাই জানি না অবশ্য, স্নানঘরট। সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য চালু আছে কি এখনও? আরব পাড়াতে আরব জিনিস বলে ধরেই নিয়েছি চালু আছে। স্নান করার ইচ্ছে ছিল ১০০%, প্ল্যান ছিল সেটাই। আজও স্নান হল না।

হবে কেমন করে? কোনও হোটেলে তো উঠিনি? এদিকে গরম প্রচণ্ড। সারাদিন ঘুরি শ্রীচরণকাল দু’টির ওপরে ভরসা করে—চটি পায়ে হেঁটে, আর সারারাত ট্রেনে বসে বসে নিজেই নিজের পা টিপি, মলম লাগাই। বসার সিটের টিকিটে এসেছি কিনা? দিনে বেড়াই, রাতে ট্রাভেল করি। এতে হোটেল-খরচ বেঁচে যায়। শোওয়ার সিট আর বসার সিটের প্রায় একই ভাড়া। ইচ্ছে ছিল শুতে, কিন্তু এত দেরিতে শোওয়ার সিট পাওয়া যায়নি। এখানে তো আমার বক্তৃতা নেই, টিকিট দেবে কে? স্নানটা একটুখানি কাক-চড়ুই পাখিদের মতন হয়ে যাচ্ছে ক’দিন ধরে। দাঁত মাজার সময়ে ভক্তিভরে মাথায় মুখে হাতে জল ছিটিয়ে, কনুই অবধি হাত ধুয়ে, পা দু’টো মুছে, ওঁ শ্রী শ্রী গঙ্গা দেব্যৈ নমো নমঃ। আর পুণ্ডরীকাক্ষকে স্মরণ! গ্রানাদা অঞ্চলে এসে একটিও উপমহাদেশীয় (অর্থাৎ ভারতীয়, নেপালি, বাঙলদেশি, পাকিস্থানি, সিংহলি) সহোদর-সহোদরার পাত্তা পাইনি। হ্যাঁ, মাদ্রিদে ৯ জন বাংলাদেশি ভাই পেয়েছিলাম। তারা পথে পথে পার্কে পার্কে পসরা পেতে বসে কত কী ফেরি করে বেড়ায়-আর পুলিশ দেখলেই সওদা গুটিয়ে পাঁই পাঁই করে ছুট লাগায়। তাদের ৪ জন হিন্দু ছেলে, ৫ জন মুসলমান। তাদেরই সঙ্গে ছিল ৩/৪ টি আফ্রিকান ছেলেও। তারাও ঠিক ওইভাবেই, ওই একই সওদা বেচয়ে (ভারতীয় স্কার্ট ও মালা), এইভাবেই ছুটে পালাচ্ছে। কিন্তু সে তো মাদ্রিদের কথা। মাদ্রিদ হল বড় শহর, স্পেনের রাজধানী। মাদ্রিদ নাকি সমগ্র দেশের, পুরো স্পেনের ভৌগোলিক কেন্দ্রবিন্দু। এক্কেবারে বৈজ্ঞানিক হিসেব মাফিক বেছে নেওয়া, এক পাগলরাজার কীর্তি। মাদ্রিদের পাশে ব্যবসার কোনও দরজা খোলা নেই, অর্থাৎ না আছে নদী, না আছে সমুদ্র। সাধারণত দেখা যায় রাজধানী তৈরি হয় নদীর তীরে, কি বন্দর দেখে। এটা হয়েছিল অঙ্ক কষে। রাজধানী দেশের ভৌগোলিক কেন্দ্রবিন্দুতে হওয়া এই কারণে তাঁর জরুরি মনে হয়েছিল যে, সেখান থেকে রাজার নজর রাখার পক্ষে দেশের সব দিকই সমান দূরত্বের হবে। রাজা সব প্রজাদের সমদৃষ্টিতে দেখতে পারবেন। রাজামশাই দার্শনিক ছিলেন, বাণিজ্যবুদ্ধিতে হিসেবি ছিলেন না। স্পেনের গল্প বলি। জানি তো আপন মনে রুটি চিবুচ্ছি, ঠিক যেন অমৃত আস্বাদ করছি। বেঞ্চিতে আমি কিন্তু একা নই। লাঠির ওপর থুতনি রেখে এক ভদ্রলোকও বলে আছেন একটু দূরে। আমি যতবার তাঁর দিকে দেখি তিনি ততবারই আমার দিকে চেয়ে গোঁফের ফাকে মৃদু হাস্য করেন। হাস্যটি কেন? আমি ভিকিরির মতো শুকনো রুটি-জল খাচ্ছি বলে কি? না উনি ভদ্রলোক, বন্ধুত্বপূর্ণ হাসিতে অমায়িক আপ্যায়ন জানাচ্ছেন? আমি বেশিক্ষণ ভাবনাচিন্তা করতে পারি না, দিলুম ফ্যাক করে হেসে। উনি সঙ্গে সঙ্গে লাটি নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে ঘেঁষটে এলেন আমার কাছাকাছি। অতএব, ভাল করে শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে মুখটা নিরীক্ষণ করে দেখতে হল। বয়েস হয়েছে। দেখে মনে হল মানুষ ভালই। কোনও বদ উদ্দেশ্য সম্ভবত নেই। অন্তত এখন অবধি। রাত ৮টা বেজে গেছে। আকাশে বাতাসে ওটা কি বিকেলের আলোর আহ্লাদ, না এটা সুয্যিঠাকুরের অবসরের আগে গেরুয়া গোধূলি? প্লাজা-তে বাচ্চারা খেলছে। তাদের কিচিরমিচির এতই জোরালো যে সন্ধ্যার পাখির কিচিরমিচির যেন ডুবে যাচ্ছে। আকাশ দিয়ে মাঝে মাঝে পাখির মালা উড়ে যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে না কিছুই। কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন কুকুরের মালিকেরা। কুকুরের মালিকদের সব দেশেই একরকমের দেখতে লাগে কেন যেন। আমাকেও কি অমনি দেখায়? আলবের্টো হঠাৎ নিজের বুকে লাঠিটা ঠেকিয়ে বললেন—’আলবের্টো।’ তারপর আমার কপালের টিপের দিকে লাঠি উঁচিয়ে বললেন— ইন্দিয়ান? হিন্দু?’– অভ্যাস বড় দোষ। কেন যে মরতে টিপটা পরি এই জগৎজোড়া মৌলবাদী দুঃসময়ে। কে জানিত যে এই একফোঁটা লাল রংয়ের মধ্যে রাজনীতি, ধর্মনীতি, ইতিহাস, ভূগোল, সব গেরো বেঁধে আছে। হিন্দুয়ানির লক্ষণ হয়েছেন তিনি। এবং স্বদেশের পতাকা। দূর দূর। টিপটা কপাল থেকে (Sticker বিন্দি পরার এটাই খুব সুবিধা—যশোধরা বলেছিল, কখনও ইচ্ছে করলে টিপটাকে তুলে চুলকেও নিতে পারিস কপালটা’, সিঁদুরে বা মাদ্রাজী কুমকুমে যা সম্ভব নয়) তুলে ফেললুম, এবং নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে গড়গড়িয়ে লেকচার দিলুম, ‘নবনীতা। ইন্ডিয়ান।—ওনলি ইন্ডিয়ান-নো হিন্দু মুসলিম, নো ক্রিশ্চিয়ান জুডেইক, ওনলি নবনীতা, ওনলি ইন্ডিয়ান’—তার পরে আবার টিপটা লাগাই কপালে। আমি কথা বলছি আর ভাবছি আলবের্টোর তো ইংরিজি জ্ঞান নেই, আমার অতি সরল করে বলা ইংরিজি হয়তো তিনি অনুধাবন করবেন না। আলবের্টোর ষাট পেরিয়েছে মনে হয়। সাদাপাকা ঝাঁকড়া গোঁফ, গালে সাদা পাকা দাড়ি, চুল আছে কি না জানি না—মাথায় সবুজ বেরে-টুপি, চোখে শেলফ্রেমের চশমা। হাতে পালিশকরা লাঠির মুণ্ডুটি ঝকঝকে পেতলে বাঁধানো। পরনে ভদ্র টাই আছে, জ্যাকেট-সহ। কিন্তু পায়ে রানিং শু–কেম্বিসের জুতো। বোধহয় হাঁটতে বেরিয়েছেন। তিনি জ্যাকেট, টাই পরলে কী হবে, এই প্লাজা-তে তরুণী মায়েরা গরমের দোহাই দিয়ে প্রায় নগ্ন পোশাকে সেজেগুজে, দু-তিনজন মা একসঙ্গে দল বেঁধে পুতুলের মতো বাচ্চাদের প্র্যামে ঠেলে, কি হাত ধরে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বাবারা ধারে-কাছে নেই। ক্যাথলিক নীতির কল্যাণে এখানে শিশুদের বেশ বোলবোলাও চোখে পড়ে। নানাবয়সি বাচ্চারা ছুটে ছুটে খেলছে। হুড়োহুড়ি, ঠেলাঠেলি করছে। মনের সুখে চেঁচাচ্ছে।

আর আছেন কুকুরপ্রেমীরা, তাঁরা তাঁদের প্রিয় জীবদের সান্ধ্যভ্রমণে নিয়ে এসেছেন। কুকুরদের আচার-আচরণ এবং কুকুরদের মালিকদের আচার-আচরণ কিন্তু দেখবার মতন। কুকুররা সত্যিসত্যিই সামাজিক ভদ্রলোক। মিশুক, ধনী-দরিদ্র ফারাক করে না, চেনা-অচেনা তফাত করে না, বন্ধুত্বপূর্ণ পারে, চোখভর্তি ভালবাসা নিয়ে, আকুল হয়ে সবার কাছে ছুটে যেতে চেষ্টা করে। সামাজিক মানুষের যেমনটি হওয়া উচিত। আর তাদের মনিব-মনিবানী? ওহ্! কুকুরওয়ালাদের অহংকার আর চালিয়াতি দেখলে হাসিও পায়, কান্নাও পায়, পিটুনিও দিতে ইচ্ছে করে। অমন সুসভ্য চতুষ্পদ প্রাণীগুলিকে দিনরাত চোখে দেখেও, ওরা শেখে না ঈশ্বর মানুষদের কীভাবে সমাজজীবন যাপন করতে শিখিয়েছেন? রাস্তার কুচো কুচো গোল গোল কুকুরছানারা লাফিয়ে লাফিয়ে খেলতে আসছে ওদের সঙ্গে, আর কুকুরওয়ালাদের ছড়ির মার খেয়ে ছুটে পালাচ্ছে। আমার ইচ্ছে করছিল ওদেরই ধরে মারি। ইয়োরোপের অন্যান্য দেশে রাস্তার কুকুর কিন্তু দেখিনি। এটা বিশেষ দ্রষ্টব্য মনে হল দক্ষিণ স্পেনে। এদের সব দেশে কুকুর মাত্রেই পোষ্যপুত্তুর। এমন সপরিবার ঘরছাড়া কুকুর দেখা যায় না তো? এ বেশ দিশি দিশি আবহাওয়া! আলবের্টোর সঙ্গে কুকুর ছিল না। আমারও না। আস্তে আস্তে আমাদের ভাব হল। সেও ইংরিজি জানে না, আমিও জানি না তার ইস্পানী ভাষা। দু’জনে কিছু ভাঙা ফরাসি কিছু ভাঙা জার্মানে আর প্রভূত অঙ্গভঙ্গি সহকারে যথেষ্টই ভাবনার আদানপ্রদান করতে পারলুম। আলবের্টো বললেন তিনি ব্যবসায়ী। তাঁর দোকান আছে। আমি লিখি ও পড়াই শুনে ভীষণ খুশি হয়ে তিনি উঠে গিয়ে অন্য একজনকে ধরে আনলেন। কেন না আমার স্বগোত্র সে। সেও একটু একটু লেখে। আর ইস্কুলে পড়ায়। বেচারা তার বউ ছেলেপুলে এবং কুকুর নিয়ে একটু দূরের বেঞ্চিতে শান্তিতে বসেছিল। তার নাম ফ্রাঞ্চেস্কো। ফ্রাঞ্চেস্কো নিজের বুকে এক হাত আর আলবের্টোর বুকে অন্য হাত রেখে চিৎকার করে বলল ‘আমিগো’ তারপর বলল ‘বেস্টফ্রেন্ড’। বহুল অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, জগতের সব মানুষেরই ধারণা চিৎকার করে বললেই সব অচেনা ভাষার কথাবার্তা সরল হয়ে আগন্তুকদের বোধগম্য হয়ে যায়। তারপর ফ্রাঞ্চেস্কো সহাস্যবদনে আমাকে দু’টো বিস্কুট অফার করল। সম্ভবত ওদের ওই অতি আদুরে, অতি আহ্লাদে, অতি অসভ্য কুকুরের জন্যই ছিল—আমি কিন্তু বিনাবাক্যব্যয়ে খেয়ে ফেললুম—ওই একইরকমের হাস্যবদনে ‘গ্রাৎসিয়াস, মুচো গ্রাৎসিয়াস’ বলতে বলতে। খাবার পরে খেয়াল হল, যদি বিস্কুটে বিষ থাকে? অচেনা লোকের দেওয়া জিনিস খেতে নেই, বিশেষ করে ভ্রমণের সময়ে। এ কথা কে না জানে? কিন্তু ধনরতন ভর্তি বাক্স প্যাটরা তো আমার নেই সঙ্গে। একটা চেঞ্জ, মাজন-বুরুশ-গামছা-সাবান-ওষুধপত্র-চিরুনি-ইনহেলার, আর পাসপোর্ট-ড্রইভিং লাইসেন্স-বিদেশি টাকা—এই নিয়ে কাঁধে একটা ঝোলা মাত্র। কিন্তু মহামূল্য কিডনি দু-খানা তো আছে। সম্প্রতি পড়েছি এভাবে নাকি পথে ভাব জমিয়ে তারপর অজ্ঞান করে বিদেশিদের দু’টি কিডনিই কেটে নিয়ে তাদের রাস্তায় ফেলে রাখা হচ্ছে পশ্চিম গোলার্ধে। অবশ্য এ ঘটনা ঘটেছে আমেরিকাতে। স্পেনে এখনও এত দূর মরাল-টেকনিকাল কমার্শিয়াল উন্নতির সংবাদ শুনিনি। তবে স্পেন এখন EEC Country তো! এইটুকু এগুতে আর কতক্ষণ? ভুক্তস্য শোচনা নাস্তি, আর ভেবে কী হবে, বিস্কুট তো দিব্যি পেটে চলেই গেছে! এখন দেখতে হবে যাতে কিডনি দু’টোও পেটেই থাকে। এখনও ট্রেনের ঢের দেরি। গ্রানাদা স্টেশনটি যা তা। এই সব প্লাজা কত সুন্দর। স্টেশনে নয়, আমি বাপু এখানেই বসে থাকব যতক্ষণ ট্রেন না আসে। আপাতত বরং হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে তো কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়বে না? দেহ সচল থাকলে হয়তো ওষুধের এফেক্ট কেটে যাবে। প্রথমে একটা কড়া কফি খাই। পয়সা যাবে, যাক—কিডনি তো থাকুক! উল্টোদিকেও একটা প্লাজা আছে, সেটা এমন ফাঁকা নয়। মস্ত মস্ত মেপ্ল গাছের নীচেগুলো বেদির মতন লাল ইট, আর সাদা-কালো পাথরে সাজিয়ে বাঁধানো। তাতে লোকজন বসে আছে গোল করে। তার চারপাশে সাজা চেয়ারে টেবিল পাতা। আঁকা ছবির মতো দেখাচ্ছে। পাশেই রেস্তোরাঁ আছে, সাজুগুজু করা বেয়ারারা ছুটোছুটি করে ধোঁয়া ওঠা কফি, শীতল বিয়ার আর রঙিন ওয়াইন আনছে টেবিলে। প্রচুর বয়স্ক মানুষ, এবং প্রচুর অল্পবয়সিরাও বসে আছেন সেখানে। দেখি, ওইদিকেই যাওয়া যাক আপাতত।

মার্গারিতা

এদের কত অবসর। ইংলন্ডে অল্পবয়সিদের মধ্যে এমন অঢেল অবসরের দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে না। তরুমূলের বেদিতে দেখি ঠিক কলকাতার লেকের মতন রিটায়ার্ড বৃদ্ধদের মিটিং চলছে। তাঁরা চা, কফি বিয়ারের দিকে নেই। পাঁচ-ছ’জন মিলে পাশাপাশি হেঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বেদিতে বসছেন, সান্ধ্য কাগজ পড়ছেন, গল্প করছেন। দেখতে ভাল লাগছে। টেবিলে বসে আমি এক কাপ কফি নেই। কাপুচিনো। আমার পাশে গ্লাস হাতে নিয়ে এক সুশ্রী মহিলা এসে বসলেন, বয়সে তিনি আমার মা-ও হতে পারতেন। হেসে বললেন—”তোমাকে অনেকক্ষণ দেখছি। তুমি তো ওদিকের ফোয়ারায় বসেছিলে। আলবের্তোর বেঞ্চিতে।’

‘আপনি আমাকে দেখেছিলেন?”

—’দেখব না? ফ্রাঞ্চেস্কোর আহ্লাদি কুকুরটাকে নিয়ে ওরা যখন অসভ্যতা করছিল তখন তুমিই তো গিয়ে পথের কুকুরছানাটকে আদর করছিলে। পথের কুকুরছানা বলে কি সে কেউ নয়? তোমাকে মেরিমাতা আশীর্বাদ করবেন। এই দ্যাখো, ওইখানে আমাদের গির্জে। দেখেছ? অপূর্ব। এই শহরের পেট্রন সেন্ট মেরিমাতার ক্যাথিড্রাল এইটা।’ আঙুল তুলে দেখালেন, যদ্দুর মনে হচ্ছে প্লাজার ভিতরেই সুন্দর একটি গির্জে রয়েছে।

‘আমি কফিটা খেয়ে নিয়ে দেখে আসব।’

—’নাঃ, পারবে না। এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। খুব অন্যায়। কোনও পুজোর ঠাঁই কি আফিস? যে বন্ধ করবে? সদা সর্বদা মেরিমায়ের দরজা খোলা থাকা উচিত। কে কখন আসতে চাইবে। এসব যে এদের কী নিয়ম! খুব বিশ্রী! তুমি কাল যেও বরং।’

-–’কাল আমি থাকব না। আজই মাদ্রিদ ফিরে যাচ্ছি রাত্রের ট্রেনে।’

— আহা। আলবের্তোর তোমাকে আগেই পাঠানো উচিত ছিল গির্জে দেখতে।’

—উনি তো আমাকে চেনেন না।’

—’তুমি ওর গেস্ট নও?’

—’নাঃ। এইমাত্র তো আলাপ হল। কিন্তু আপনি এ শহরে সবাইকেই চেনেন দেখছি।’

—’তা চিনি। বহুদিনের বাসিন্দা আমরা। আলবের্তোও বহুকালের। ফ্রঞ্চেস্কো বরং অল্পবয়সি ছেলে, ওর কত আর, ষাট বাষট্টি হবে। ছোট পাড়া, সবাই সবার চেনা। নাতি নাতনিদের নিয়ে সব প্লাজাতে বেড়াতে এসেছে।’

—’আলবের্তো কী করেন?’

—’ওই তো চিরকালের বই-পাগলা, বইয়ের দোকান আছে ওর। বিয়ে থা করেনি। একটা পা একটু ডিফেকটিভ তো? পড়াশুনো আছে প্রচুর। খুব ভালমানুষ, আর তেমনি লাজুক আলবের্তো। তোমার সঙ্গে অত কথা বলছে দেখে ভাবলুম তুমি ওরই গেস্ট হয়তো। ও তো বিপ্লবী, অনেক ধরনের লোককে চেনে। ফ্রাঙ্কোবিরোধী ছিল কিনা? ওই সময়টায় দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে চলে গিয়েছিল ও। মুক্তির পরে স্পেনে ফিরেছে।’

ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আলবের্তো নামের গোটা মানুষটার রূপরেখা আস্তে আস্তে আকার নিতে লাগল আমার মনের মধ্যে। সামনে যাকে দেখছি তার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করি। অসুবিধে হয় না। কফি শেষে আমি হঠাৎ খেয়াল করি, আরে, মহিলা তো চমৎকার ইংরিজি বলেন। কী ইটুপিট আমি, এতক্ষণ এই জরুরি ব্যাপারটা মোটে খেয়ালই করিনি? আমার ঔপনিবেশিক অভ্যেস ইংরিজি বলাটা সহজ ভাবে মেনে নিয়েছি।

এবারে তবে পরিচয় বিনিময় হয়ে যাক।

‘আমি নবনীতা, কলকাতায় থাকি। আপনার নাম?”

—’মার্গারিতা।’ দুষ্টু হেসে তিনি বলেন ‘দ্যাট্স হোয়াট আই অ্যাম ড্রিংকিং টু!’ সহাস্যে মহিলা তাঁর হাতের চ্যাপ্টা তেকোনা স্ফটিকের গ্লাসটি তুলে দেখান। মার্গারিটা টলটল করে ওঠে। আমরা ওটিকে মেক্সিকান পানীয় বলে জানি, কিন্তু তার মূল হয়তো এইখানেই। মেক্সিকোর শিল্প সংস্কৃতির নিজস্ব মুখ স্পেনের ঔপনিবেশিক চাপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এখনকার মুখচ্ছবি প্রধানত স্পেনের থেকে পাওয়া

—’এত ভাল ইংরিজি বলেন আপনি—’

—’আমি স্কুলে ইংরিজি পড়াতুম যে! এখন অবসর নিয়েছি। তুমি?’

—’আমিও আমার দেশে, ভারতবর্ষে, সাহিত্য পড়াই। ইংলন্ডে এসেছিলুম কাজে। স্পেনে কখনও আসা হয়নি আগে, তাই এদিকে একটু ঘুরতে বেরিয়েছি, আজই রাত্রে ফিরে যাচ্ছি মাদ্রিদ। কাল লন্ডন। পরশু সাসেক্স। আর তার পরদিন কলকাতা। আমার বাড়ি কলকাতায়। অনেক দূর,—ওই যে, কালকুত্তা?’

‘কালকুত্তা?’ মার্গারিতার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, ‘চিনি তো, চিনব না? মাদার তেরেসার শহর!’

বিদেশিনী কত অনায়াসে, মুহূর্তেই চিনে গেলেন আমার শহর। এবং আমাকে টেনে নিলেন তাঁর মনের কাছাকাছি। যেন একটা চাবি দিয়ে একটি নতুন দরজা খুলে গেল। অবিকল এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল ইতালিতে, লেক কোমোর তীরের একরত্তি এক গ্রামে, আমি বেলাজিয়োর ভিলা সেরবেলোনি থেকে নৌকো করে গিয়েছিলুম ওখানে একটা বিখ্যাত বাগানের ফুলের শোভা দেখতে। কোমো হ্রদের তীরের একটি ছোট্ট দোকানের দোকানি আমার সঙ্গে আলাগ করে জানতে চেয়েছিলেন আমি কোথা থেকে এসেছি। ‘কালকুত্তা’ শুনে তাঁর সে কী আহ্লাদ! তক্ষুণি আমাকে মাদার তেরেসার ছবি দেখালেন একটি বই বের করে। আমাকে একটি উপহারও দিলেন, এই সহসা সাক্ষাতের স্মারক। সাক্ষাৎ তো নয়, স্বজন-মিলনের আনন্দ ছিল তাঁর চোখেমুখে। মার্গারিতাও তেমনি উজ্জ্বল হাসিমুখে, অন্য এক সুরে, চেনা লোকের মতো গলাতে বলে উঠলেন,

—’জানি জানি। কালকুত্তা তো ‘City of Joy’? আমি ছবি দেখেছি, আমি জানি, ওটা তো আমাদেরই মাদার তেরেসার শহর।’ তার পরে মার্গারিতার কণ্ঠে উদ্বেগ ফুটে উঠল। ‘কিন্তু শহরটা কি এখনও আছে? আমি তো ভেবেছি প্রবল বৃষ্টিতে-বন্যায় কালকুত্তা বুঝি ডুবেই গিয়েছে। তুমি কি এখনও ওইখানে থাকো?’

—’নাঃ। এখনও ডোবেনি শহরটা, ভেসে আছে। আমি ওইখানেই থাকি।’—কী আর বলব? সিটি অফ জয়ের ওই বৃষ্টিতে কি শহর ডোবানো বান ডাকে? কলকাতা শহরে অমন বৃষ্টির বন্যা তো বছর বছর হচ্ছে। ওতেই মুছে গেলে আমাদের চলবে? শহর কলকাতার অতি কড়া প্রাণ। হ্যাঁ, কয়েক বছর ধরে শুনে আসছি বটে শেষের সেদিন ভয়ংকরের কথা। ২০১০ নাগাদ উষ্ণায়নের বানের জলে ডুবে যাবে কলকাতা। মর্তের বৈজ্ঞানিক অনাচারে আকাশের ওজোন স্তরের পর্দা ঘুচে যাচ্ছে, সোজাসুজি ঠিকরে আসা গনগনে রোদে দক্ষিণ মেরু বিগলিত হয়ে একদিন বঙ্গোপসাগরে বান ডাকাবে, আর সেদিন কলকাতা সুদ্ধু গোটা চব্বিশ পরগনার গঙ্গাপ্রাপ্তি হবে। বালাই ষাট! অমন দিনে সিন্ধুতীরের স্পেনই কি আর অক্ষত থাকবে? আমি কথা ঘোরাই।

—একটু হেঁটে আসি? চলুন না, যাবেন? ওই প্রমেনাদ-টা দিয়ে? বড় সুন্দর। বেড়াতে খুব লোভ হচ্ছে।’ পায়ের ব্যথা ভুলে গিয়ে বলি। ‘সত্যি বড় সুন্দর আপনার শহরের প্লাজা। একটু দেখে আসি। আর তো আসা হবে না।’

ইতিমধ্যে আলবের্তো এসে পড়েছেন। গলা খাঁকারি দিয়ে প্রশ্ন করেন,—ট্রেন ক’টায়? ১১নং, ৩নং, আর ৯নং বাস স্টেশনে যাবে। যেতে এখান থেকে ১৫ মিনিট লাগে। প্ৰমেনাদে বেড়াতে গেলে, বাসের সময়টা মনে রেখো।’ শ্রীমতী মার্গারিতার গেলাসের মার্গারিটা শেষ হয়নি, তিনি আর পা চালাতে উঠলেন না। আলবের্তোও বসে পড়লেন তাঁর পাশে। প্ৰমেনাদে অত পুলক নেই দু’জনের কারুরই। এ তো ওঁদের প্রত্যহের চলার পথ।

-’ধন্যবাদ। ধন্যবাদ।’ বলতে বলতে অগত্যা প্রমেনাদ দিয়ে একা একাই হাঁটতে শুরু করি। এ রাস্তা তো যে সে রাস্তার মতো নয়, এ হল একেবারে বড়লোকের বাড়ির মার্বেলের দালান, দাবার ছকের মতো কালো সাদা চেক কাটা মেঝে। দু’ধারে বড় বড় ছায়াময় গাছতলায় সুদৃশ্য বেঞ্চি পাতা। তাতে সঘন প্রেমিক প্রেমিকা, একক বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, দুঃখী যুবক, ড্রাগ অ্যাডিক্ট, ঘুমন্ত হোমলেস, সবরকমই মজুত আছে। পথটির দু’পাশে সারিবন্দি সুন্দর বাতিস্তম্ভ, আর তার নীচে স্বাস্থ্যবান, হাসিখুশি নর্থ আফ্রিকান ছেলেরা ফেরি সাজিয়ে বসেছে। তাদের ডালাতেও কিন্তু মাদ্রিদের মতো, অধিকাংশই ভারতীয় হ্যান্ডিক্রাফট, আফ্রিকান পণ্যদ্রব্য নয়। এই জাগয়াটাতে বেড়াতে খুব ভাল লাগছে। বিশ্রাম নিতে মাঝে মাঝে বেঞ্চিতে বসছি, কেননা পা আপত্তি করছে। –বেচারি পায়ের দোষ নেই, অত্যেচারটা কি কম হয়েছে? একে তো সারাদিন ধরে হেঁটে হেঁটে অসাধারণ ইসলামি স্থাপত্যের কারুকার্য সমৃদ্ধ সেই ‘আলহামব্রা’ প্রাসাদ ঘুরে দেখেছি, সব পরিশ্রম সার্থক। তারপরে নগরের প্রান্তে লোরকার গ্রীষ্মাবাস দেখে এসেছি। এটি খুঁজে বের করতে খুব জেদ আর খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে আমাকে। দক্ষিণ স্পেনের চড়া রোদ্দুরে হাঁটাহাঁটি করতে হয়েছে প্রচুর। আলহামরা এখানকার প্রসিদ্ধতম ঐতিহাসিক ট্যুরিস্ট স্পট, সেটা দর্শনের সরকারি বেসরকারি বহু ব্যবস্থা রয়েছে। আমার একটুও অসুবিধে হয়নি সেখানে পৌঁছে যেতে। কিন্তু হায়, লোরকার গ্রীষ্মাবাসের খবরই যে শহরের লোকজনে বিশেষ রাখে না দেখছি। হাঁটতে হাঁটতে জিগ্যেস করতে করতে হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, একে তো আমার ভাষার বাধা, তায় পথচারীদের অজ্ঞানতার আড়াল। এমন সময়ে রাস্তার মোড়ে পিঠে ব্যাকপ্যাক বাঁধা একজন মার্কিনি ছাত্রের উদয় হল। আমি অমনি শ্রীরাধার মতো আকুল হয়ে তার দিকে ছুটে যাই। ও তো ছাত্র ট্যুরিস্ট, ও নিশ্চয় খবর রাখবে। কমসে কা ইংরেজি তো জানবে। দৈববাণীর মতো, সেই ছেলে আমাকে খোঁজ দিল বাড়িটার। ‘যাচ্ছ যাও, দেখে এসো, তবে অসাধারণ কিছু নয়।’ কথাটা সত্যি। তাছাড়া অত খুঁজে পেতে যে-বাড়িটি দেখতে পেলুম সেটি তখন বন্ধ। ভিতরে প্রবেশ করা গেল না। বাড়ির দেখভাল যিনি করেন, তাঁকেও খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু শুধু বাইরে থেকে দেখতে পেয়েও আনন্দ হল আমার, হাজার হোক লোরকার বাড়ি তো? এত খুঁজে না পেয়ে ফিরে গেলে আফসোস থেকে যেত।

প্রমেনাদে বেঞ্চিতে বসে এইসব এটা সেটা ভাবছি, হঠাৎ দেখি লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে আলবের্তো সেখানে এসে হাজির। বললেন—’এবারে ওঠো। সাড়ে দশটা বাজে। তোমার ট্রেন এগারোটায়। চলো তোমাকে বাসে তুলে দিই।’

সবই বললেন অবশ্য স্প্যানিশে, আমিও দিব্বি আন্দাজে বুঝে গেলুম আদ্যোপান্ত। এই যত্নটি কিন্তু বিশেষ, কেননা এত সমাদর শাড়ির গুণে নয়, আমার পরনে এ যাত্রায় শাড়ি নেই, জিন্স আর কুর্তা। শুধু গায়ের রঙে দিশি জেল্লাটা আছে, আর বাদামি কপালে মাঝখানে লালাটলিপির মতো শোভা পাচ্ছে মেরুন ফোঁটা। মালপত্তর বলতে একখানা চামড়ার পুঁটলি-ঝোলা ঝুলছে কাঁধে, এই নিয়েই ঘুরছি স্পেনে সারাদিন সারারাত। চলো মুসাফির বাঁধো গাঠেরিয়া। ইউরোপের রাস্তায় আমার মতন এরকম মূর্তি গণ্ডায় গণ্ডায়, খুবই সাধারণ দৃশ্য। কেবল বাদামি রং, কালো খোঁপা, আর কপালের ওই এক ফোঁটা মেরুনটুকুই যা আলাদা। তাতেই আমি এদের চোখে যথেষ্ট দূরের, যথেষ্ট অচেনা যথেষ্ট রহস্যময়। বিদেশিনী অতিথির প্রতি দেশের বিবেকী গৃহস্থের দায়িত্ব, কর্তব্যবোধ, সব জেগে উঠেছে আলবের্তোর স্বদেশি চেতনায়। নার্গারিতাকে বিদায় জানিয়ে, সপরিবার ফ্রাঞ্চেস্কো আর তার সারমেয়কে হাত নেড়ে, আমি প্লাজা ছেড়ে চলি আলবের্তোর সঙ্গে, বাস স্টপের দিকে।

আমাকে যত্ন করে সঠিক বাসে তুলে দিয়ে, নিজেই বাস ড্রাইভারকে ডেকে আমার টিকিটটা কেটে দিলেন আলবের্তো, আর শুধু তাকেই নয়, যাত্রীদেরকেও বারবার বলে দিলেন আমাকে যেন স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হয়। আলবের্তোকে অভয় দিয়ে, আমায় নিয়ে বাস চলল গ্রানাদা ইস্টিশনে। এখানকার পালা শেষ। জানি না আবার কবে আসব, কোনও দিন আসা হবে কি না। অনেক কিছু বাকি রইল। কখনও তো কিছু সম্পূর্ণ হয় না আমার জীবনে। অসম্পূর্ণতার মালা গেঁথে চলা। তবু যা পাই তার জন্যই আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। এতটা কি আমার প্রাপ্য ছিল? ফোয়ারার উজ্জ্বল, আলোর ঝলমল, মানুষে ভরা, উৎসমুখর প্লাজাতে লাঠি হাতে একটা একটি নিঃসঙ্গ সিলুয়েৎ ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। আমাকে বিদায় জানিয়ে তখনও সাদরে হাত নাড়ছিলেন আলবের্তো, আমিও হাত নাড়ছি বাস থেকে, বাসটা মোড় ঘুরল।

ট্রেনের কামরার সহোদরা

সময়মতো ট্রেনে উঠে নিজের জায়গায় বসেছি। সারাদিনের ক্লান্তি এতক্ষণে আমাকে চেপে ধরেছে। অসহ্য পা ব্যথা করছে। ঝোলা থেকে বেরুল আমার মলম, চটি খুলে, মোজা খুলে, আমি পায়ের শুশ্রূষার চেষ্টা শুরু করি। দু’টো পা-ই ফুলে উঠেছে হেঁটে হেঁটে। ভাগ্যিস জুতো পরিনি, জুতোতে পা ঢুকত না। যন্ত্রণায় প্রায় কান্না পাচ্ছে। আজ রাত্তিরের মতো ঘুমের দফারফা। গত রাত্রেও পা ব্যথা করেছিল কিন্তু এতটা বাড়াবাড়ি হয়নি। তবুও ঘুমের বেশ ব্যাঘাত হয়েছিল পায়ের কষ্টে। উৎসাহের চোটে সে কথা সারাদিন মনে পড়েনি। এটাই আমার অবিমৃষ্যকারী স্বভাবের গুণপনা!

সামনের সিটে তিনটি মেয়ে, আমার পাশেও দু’টি মেয়ে, সবাই ছেলেমানুষ, উনিশ-কুড়ির বেশি নয় কেউ। কিচিরমিচির করে ইতালিয়ান বলছে। ইতালিয়ান শুনতে ভারি মিষ্টি। ট বর্গের কোনও কঠিন ব্যঞ্জনবর্ণ নেই, শুধুই যেন নরম ‘চ’ ‘ল’ আর ‘ত’-তে ভর্তি। আর সব শব্দই মিঠে স্বরান্তে শেষ হয়, ‘ও’, ই’, ‘এ’, ‘আ’ দিয়ে। বাঙালি শ্রবণে মিষ্টি শোনাবেই। আমাদেরও চ’ আর ‘ত’ অনেক, আর স্বরান্ত শব্দই বেশি। ইংরেজি আমাদের কানে একটু কাঠকাঠ শোনায়, সেই ভাষার ব্যঞ্জনান্ত শব্দেরা প্রায়শই হসন্তে শেষ হয় বলে। ইতালিয়ানে শব্দের ঝংকারটি আমাদের নিজের ভাষার মতনই শুনতে অনেকটা। স্প্যানিশ ততটা নয়। আমার দুই মেয়েই স্প্যানিশ পড়ত। স্বভাবতই, তাদের বাঙালি উচ্চারণের স্প্যানিশ বেশ মিষ্টি শোনাত তাদের মা জননীর কানে। সিডিতে শোনা নেরুদার নিজের কবিতা ও আবৃত্তির মাধুর্য তো তুলনাহীন। কিন্তু স্পেনের এই দক্ষিণ অঞ্চলে পথেঘাটে শোনা সাধারণ মানুষের স্প্যানিশ সেরকম শুনতে নয়। এখানে কণ্ঠনালীর পিছন দিক থেকে আরবি ধরনের ‘খ’ উচ্চারণের জন্য ভাষাটা মিঠে লাগে না আমার পশ্চিমবঙ্গীয় কানে, বরং মাঝে মাঝে বেশ রুক্ষই শোনায়। এই মেয়েদের ইতালিয়ান তাই আমার শ্রবণে বুঝি মধুস্রাবী। মেয়েগুলি দল বেঁধে বেড়াতে বেরিয়েছে মনে হয়। আমি ওদের কাছে অনুমতি চাই, সামনের সিটে একটু পা তুলতে পারি কি? সঙ্গে সঙ্গে তারা সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়। আমি মনোযোগ দিয়ে শ্রীচরণের সেবা শুরু করি। ওদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল যেন ওরা আমার পা বিষয়ে কিছু বলাবলি করছে। আমার বিরক্ত লাগল। পা ব্যথা বুঝি করে না লোকের? কী জানি, ওরা বোধহয় আমার পায়ের আঙুলের রুপোর আঙ্গোট নিয়ে কিছু বলছে। এ বস্তু দখে না তো।

ঠিক তাই। হঠাৎ একজন মেয়ে আমার পায়ের রুপোর আঙ্গোটটা আলতো স্পর্শ করে দেখল। দুই পায়েই আছে কি না, সেটাও চেক করল। কী রে বাবা? কী ভাবছে ওরা? তারপরে ইতালিয়ানে বলল, ‘খুব সুন্দর’। আমি রিল্যাক্স করে যাই। যাক। ব্যাগ থেকে এবারে বের করেছি জল আর পেনকিলার বড়ি। মালিশে কুলোচ্ছে না। হঠাৎ সামনের মেয়েটি আমার পা দু’খানা টেনে নিয়ে দুই হাতে চেপে ধরল। এবং আরেকজন একে একে আঙ্গোট দু’টো ফুলো পা থেকে মনোযোগ দিয়ে পটাপট খুলে নিল। আমি স্তম্ভিত। ওরা পাঁচজন, নিধিরাম একা। এবারে কি হাতের বালা, কানের মাকড়ি, গলার মঙ্গলসূত্র —? আমার মনের ভাষাও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। এবারে শুধু অপেক্ষা। ওরা কি আমাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেবে?

এক মুহূর্ত মাত্র। খুলে নিয়ে আঙ্গোট দু’টো আবার মিষ্টি হেসে আমার হাতেই ফিরিয়ে দিল মেয়েটা। তারপরে একটি পায়ের পাতা নিজের ঊরুর উপরে টেনে নিয়ে খুব সুন্দর করে আমার পা ম্যাসাজ করতে শুরু করে দিল। নিজেদের ব্যাগ থেকে অন্য একটি মলম বের করে লাগিয়ে দিল আমার পায়ে। অনেকক্ষণ ধরে অতি যত্নে পাকা হাতে ম্যাসাজ করা চলল। একে একে দুই পা-ই। সে যে কী আরাম, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। করুণা ছাড়া আমি একে কী আখ্যা দেব? ভাঙা ফরাসি আর ভাঙা ইংরেজির কল্যাণে কথায় কথায় জানতে পারি ওরা এসেছে মিলানো থেকে, এক নার্সিং স্কুলের ছাত্রী। বিভিন্ন গ্রামের মেয়ে ওরা, কিন্তু পাঁচ বন্ধু একই বোর্ডিং-এ থাকে। এই প্রথম দেশের বাইরে বেড়াতে বেরিয়েছে, স্পেনের অনেক জায়গা ঘুরেছে একসঙ্গে, এখন ফিরে যাচ্ছে। ওই মেয়েটি ভাল ম্যাসাজ জানে, সে ফিজিওথেরাপি শেখে। এতে আমার আরাম হবে। সত্যি খুব আরাম হল, ঠিক যেন ভালো-বাসা বাড়ির সংসারের মাঝখানে আছি। আর কী-ই বা বেশি আদর, বেশি যত্ন পেতে পারতে তুমি নবনীতা, নিজের বাড়িতে এলে? (নির্লজ্জ নবনীতা বলে, আর কিছু না, শুধু ওই এক গামলা নুন দেওয়া গরম জল!) অচেনা অনাত্মীয়া এক বিদেশিনীর প্রতি মমতায় মেয়েগুলির ওই আন্তরিক সেবা সেই রাত্রে, সেই দূর দেশের ট্রেনের মধ্যে, সেই একাকী বেদনার মুহূর্তে ঈশ্বরের করুণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কতবার কতভাবে যে সৃষ্টিকর্তা তাঁর এই অযোগ্য সন্তানটিকে রক্ষা করেন, পালন পোষণ করেন! পথের মধ্যে কোথা থেকে জুটিয়ে দিলেন এমন সেবিকা? আস্তে আস্তে পায়ের যন্ত্রণা মনের আরামের নরম আস্তরণে ঢাকা পড়ে গেল। মানুষের সহানুভূতি, মানুষের মমতা, এর চেয়ে বড় জাদুমন্ত্র আর কী আছে জীবনে? (‘মমত্ব’ কথাটা কি সুন্দর, না? ‘নিজের মতো’।) ইহজগতের সব যাতনার নিরাময় হয় হৃদয়ের স্পর্শে। গল্প করতে করতে এক সময়ে আমরা সবাই বসে বসেই স্বচ্ছন্দে ঘুমিয়ে পড়লুম। (আমাদের যে বসে বসে ভ্রমণের টিকিট!) সকালে ঘুম ভাঙল মাদ্রিদে।

‘সুপ্রভাত’-এর পরে মেয়েরা প্রথমেই আমার পা নেড়েচেড়ে দেখল ব্যথার ও ফুলো কী অবস্থা। অনেক ভাল। ব্যথা কম, ফুলো নেই। ইস্টিশানে আমাকে নিতে আসবেন ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মচারী। আমার লাইফস্টাইল এই শহরে কিঞ্চিৎ পাল্টাবে, এবারে রাষ্ট্রদূতের অতিথি কিনা। আর আমাকে ভাবতে হবে না পরের ধাপে কীভাবে কী করা। বর্তমান রাষ্ট্রদূত বাংলাভাষী, দার্জিলিং-এর বাসিন্দা, কলকাতায় পড়াশুনো। দয়াময়ী সহযাত্রিণীদের কাছে আমার বিদায় নেওয়ার লগ্ন এসে গিয়েছে। এইবারে মিলানো আর কলকাতার দু’টি পথ দু’টি দিকে যাবে। কিন্তু ভুলব না তোমাদের। কোনওদিন ভুলতে পারব না গ্রানাদা থেকে মাদ্রিদের যাত্রাপথে রাতের রেলগাড়ির কামরায় তোমাদের জীবনে ঠিক যে এই আশীর্বাদটিই ফিরে ফিরে আসে সংবেদনের আশ্বাস নিয়ে, ঠিক এমন ভাবে, একাকিত্বের মুহূর্তে, যাতনার মুহূর্তে মানুষের অন্তরের উষ্ণতার, অযাচিত শুশ্রূষার কৃপাস্পর্শ নিয়ে। না চাইতেই আজ যা পেয়েছি, এর চেয়ে বেশি আর কী মিরা চাইতে পারে মানুষ?

আরিভেদিয়ের্চি। পুনর্দর্শনায় চ। (৮।৯।৯৪)

রোববার, জানুয়ারি ২০১০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *