গোলাপ ফোটার পরে

গোলাপ ফোটার পরে

নির্জন রাস্তাতে চাকার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তুলে ছুটছিল টাঙ্গাটা। রাস্তার একপাশে ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে নদীতট দেখতে পাচ্ছে সায়ক। দ্বিপ্রহরের শূন্য নদীতট। সুরকি বিছানো পথের অন্যদিকে কখনো বা চোখে পড়ছে প্রাচীন মোগল আমলের চিহ্ন। গম্বুজ আকৃতির ছাদওয়ালা পরিত্যক্ত, জীর্ণ স্থাপত্য, দেওয়াল বা স্তম্ভর ভগ্নাবশেষ। সায়কের ট্রেনটা ছ-ঘণ্টা লেট ছিল। আগ্রাতে নামতে তাই সকালের বদলে দুপুর হয়ে গেল। সায়ক যেখানে যাচ্ছে, সে জায়গা শহরের বাইরে বলে অন্য কোনো যানবাহন সেখানে যায় না একমাত্র ঘোড়ার গাড়ি বা টাঙ্গা ছাড়া। তাই টাঙ্গাতেই যাচ্ছে সায়ক। মে মাস। দুপুরবেলাতে বেশ গরম পড়লেও এই নির্জন যাত্রাপথটা সায়কের মন্দ লাগছে না। দুপুরের নিস্তরঙ্গতা ভঙ্গ করে কোনো একটা পাখির কর্কশ চিৎকার ভেসে এল রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে। বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালা বলল ‘মোর কি আওয়াজ’।—অর্থাৎ ময়ূরের ডাক।

আর এর একটু পরেই যেন টাঙ্গাওয়ালা আকাশের একদিকে সায়কের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল ‘সাব, উও তাজ দেখিয়ে।’ বৃদ্ধর দৃষ্টি অনুসরণ করে সায়ক তাকিয়ে দেখল বেশ অনেকটা দূরে আকাশের বুকে উজ্জ্বল সূর্যকিরণে জেগে আছে তাজের গম্বুজ আকৃতির শীর্ষদেশ। মুমতাজ বেগমের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শাহজাহান নির্মিত পৃথিবী বিখ্যাত আগ্রার তাজমহল! তাজমহল চাক্ষুষ না করলেও বইয়ের পাতাতে বা ছবিতে তাজমহল দেখেনি এমন মানুষ মনে হয় এ দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই এর আগে কোনোদিন আগ্রাতে না এলেও সায়ক সেই স্থাপত্যকে দূর থেকে দেখেই চিনতে পারল। হ্যাঁ, ওটাই তাজমহল!

সায়ক কিন্তু তাজমহল দেখার জন্য আগ্রাতে আসেনি। তবে মনে মনে ভেবে রেখেছে সময়, সুযোগ হলে অবশ্যই সে একবার দেখার চেষ্টা করবে ওই বিখ্যাত স্মৃতিসৌধ। আগে তাকে দেখতে হবে যে জিনিসের সন্ধানে সে কলকাতা থেকে আগ্রা ছুটে এসেছে তার খোঁজ সত্যিই মেলে কি না? একটা অদ্ভুত জিনিসের সন্ধানে সায়ক এখানে এসেছে। সে এসেছে, ‘কালো গোলাপের খোঁজে!’ আর এই খোঁজের পিছনে একটা কারণ আছে।

সায়ক কলকাতাতে একটা ‘সাপ্লায়ার্স কোম্পানি’তে চাকরি করে। যে কোম্পানির কাজ হল, যাকে বলে ‘ফ্রম সেফটিপিন টু এলিফ্যান্ট’ সাপ্লাই দেওয়া। বিশেষত ধনী কাস্টমার বা গ্রাহকদের সঙ্গেই কারবার করে সায়কদের কোম্পানি। তেমনই এক ধনী কাস্টমার চলচ্চিত্র জগতের এক বিখ্যাত অভিনেতা তার বান্ধবীকে দুষ্প্রাপ্য কালো গোলাপ উপহার দেওয়ার ইচ্ছাতে তা জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সায়কদের কোম্পানিকে। ওই গোলাপের দাম যদি লাখ টাকারও বেশি হয় তা দিতেও আপত্তি নেই সেই নায়কের। শর্ত শুধু একটাই, জিনিসটা আসল অর্থাৎ খাঁটি হতে হবে। আর এ জিনিস সংগ্রহ করার জন্য সায়ককে দায়িত্ব দিয়েছে তার কোম্পানি।

ব্যাপারটা সায়কের কাছে প্রথমে যত সহজ মনে হয়েছিল, কাজে নামার পর সায়ক বুঝতে পেরেছে তা মোটেও সহজ নয়। কাজের দায়িত্ব নেবার পর সায়ক প্রথমে ছুটেছিল কলকাতার বিখ্যাত ফুল ব্যবসায়ী নিউ মার্কেটের হাফিজের কাছে। বড়ো বড়ো হোটেলে, ধনী ব্যক্তিদের নানা অনুষ্ঠানে, ফুল, ফুলের স্তবক এসব সরবরাহ করে থাকেন হাফিজ। সায়ক তার কোম্পানির কাজের সূত্রেই হাফিজের সঙ্গে পূর্বপরিচিত। কালো গোলাপের খোঁজ করাতে হাফিজ সাহেব বললেন, ‘তিন পুরুষ ধরে ফুলের ব্যবসা আমাদের। বহু সাহেব, জমিদারদের বাড়িতে একসময় তাদের ইচ্ছামতো ফুল যেত আমাদের এই দোকান থেকে, এখনও নানা বিখ্যাত মানুষের বাড়িতে যায়। কখনো সে ফুল বিদেশ থেকে আনানো হয়। যেমন সুইৎজারল্যান্ড থেকে পপি, ইরাক থেকে খাঁটি বসরার লাল গোলাপ। কিন্তু কালো গোলাপের নাম শুনলেও সত্যিকারের কালো গোলাপ আমি নিজেও কোনোদিন চোখে দেখিনি। যা দেখেছি সবই ঝুটা। অর্থাৎ ফুলের গায়ে কালো রং করা। তবে শুনেছি ওই দুষ্প্রাপ্য গোলাপ নাকি বসরাই গোলাপেরই একটা প্রজাতি। শুনেছি খুব কম সংখ্যায় ফোটে বলে দামও অবিশ্বাস্য। একটা ফুলের দামই হয়তো কয়েক লক্ষ টাকা হবে।’

কথাটা শুনে সায়ক বলল, ‘দাম, যাই হোক। আপনি গোলাপটা আনিয়ে দিতে পারবেন?’

বৃদ্ধ হাফিজ সাহেব বললেন, ‘আমি এর আগে বেশ কয়েকবার বাগদাদ থেকে বসরাই গোলাপ আনলেও কালো গোলাপের খোঁজ করিনি। আর এখন তো ওদিকে প্রায়সই নানা যুদ্ধ লেগে থাকে। ও গোলাপ আনানো এখন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। আর ও জিনিস নিজের চোখে দেখে গাছ থেকে তুলে আনা দরকার, নইলে ঠকে যাবার সম্ভাবনা।’

হাফিজ সাহেবের কথা শুনে সায়ক হতাশভাবে বলল, ‘তবে কি কালো গোলাপ পাওয়া যাবে না? অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। এটা শুধু আমাদের কোম্পানির লাভ-লোকসানের ব্যাপার নয়, গোলাপটা জোগাড় করে দিতে পারার ওপর কোম্পানির গুডউইল নির্ভর করছে।’

সায়কের কথা শুনে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে হাফিজ সাহেব বললেন, ‘আগ্রাতে নৌরজা নামের এক ভদ্রলোক থাকেন। গোলাপের চাষ করেন। বিশেষত বসরাই গোলাপ। বাগদাদ থেকে বসরাই গোলাপের চারা আর মাটি এনে যমুনার তীরে ‘গুলাববাগ বানিয়েছেন। আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে কারবার হয়। আমাকে একবার তিনি বলেছিলেন, যে তিনি নাকি কালো গোলাপের চারা আনিয়ে গোলাপ ফোটাবার চেষ্টা করছেন। আমি ওনার ফোন নম্বর আপনাকে দিচ্ছি, আপনি একবার ওঁর সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।’

হাফিজ সাহেবের কথামতোই নৌরজা সাহেবকে টেলিফোন করেছিল সায়ক। তার কথা শুনে নৌরজা সাহেব বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমার গুলাববাগেই কালো গুলাব ফুটবে আরও দিন পনেরো পর। কুঁড়ি বেরিয়েছে। আমি ফোন করলেই নিতে চলে আসবেন। নিজের চোখেই দেখবেন সেটা আসল নাকি নকল। তবে একটা গুলাবের দাম পড়বে ক্যাশ দু-লক্ষ টাকা। কোনো দরাদরি চলবে না। খাঁটি বসরাই কালো গুলাব। তবে একটিমাত্র গুলাবই আমি আপনাকে দিতে পারব।’

কোম্পানি আর তার গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে সায়ক সম্মত হয়েছিল নৌরজা সাহেবের প্রস্তাবে। এই মে মাসের ঠিক মাঝামাঝি দু-দিন আগে নৌরজা সাহেব সায়ককে টেলিফোন করেছিলেন আগ্রা চলে আসার জন্য। আর তার পরদিনই ট্রেনে চেপে আজ আগ্রা এসে উপস্থিত হয়েছে সায়ক। টাঙ্গায় চেপে সে চলছে যমুনার পাড়ে নৌরজা সাহেবের ‘গুলাববাগের’ দিকে। মনের ভিতরে ভিতরে বেশ একটা উত্তেজনা বোধ হচ্ছে সায়কের। যদি কালো গোলাপ সত্যিই থেকে থাকে তবে তা চোখে দেখার, ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য ক-জন মানুষের হয়?’

দূর থেকে তাজমহল দর্শনের বেশ কিছু সময় পর গাছপালার আড়াল থেকে রাস্তার যে পাশে যমুনা নদী সেদিকে একটা অতিপ্রাচীন হাবেলি বা বেশ বড়ো বাড়ি চোখে পড়ল। টাঙ্গাওয়ালা বলল, ‘সাব আমরা এসে গেছি। ওই হল গুলাববাগের গুলাব মঞ্জিল। এদিকে তো গাড়ি আসে না। আপনাকে টাঙ্গা স্ট্যান্ডের ফোন নম্বর দিয়ে দেব। যদি তাজ বা আগ্রা কিলাতে ঘুমনে যান তবে ফোন করলেই এই বুড়ো আনোয়ার টাঙ্গা নিয়ে হাজির হবে।’

সায়ক এসে উপস্থিত হল বাড়িটার সামনে। তার সঙ্গে পিঠে নেবার মতো একটা ছোটো ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই। যেটা নিয়ে সে টাঙ্গা থেকে মাটিতে নেমে ভাড়া মেটাবার পর টাঙ্গাওয়ালা তার হাতে ফোন নম্বর লেখা একটা চিরকুট ধরিয়ে তার টাঙ্গার মুখ ফিরিয়ে নিল।

হাবেলির সামনের অংশটা উঁচু প্রাকার বেষ্টিত। তার গায়ে ভিতরে প্রবেশ করার জন্য লোহার পাল্লাওয়ালা বেশ বড়ো একটা লোহার গেট। তবে তার পাল্লা দুটো পুরোপুরি বন্ধ নয়। দুই পাল্লার মাঝখানে মানুষ গলে যাবার মতো একটা ফাঁক আছে। সায়ক প্রথমে পাল্লার গায়ে হাত দিয়ে মৃদু শব্দ করল। কিন্তু সে শব্দে ভিতর থেকে কোনো সাড়া মিলল না দেখে সায়ক বুঝতে পারল সম্ভবত কাছাকাছি কেউ নেই। সাড়া না পেয়ে একটু ইতস্তত করে ভিতরে প্রবেশ করল সায়ক। ভিতরে ঢুকেও প্রথমে কাউকে সে দেখতে পেল না। দ্বিতল হাবেলির থাম সমৃদ্ধ একতলার বারান্দাতে কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। সেই সিঁড়ি থেকে সায়ক যেখানে দাঁড়িয়ে তার মধ্যবর্তী জমিটার চারদিকে কোথাও ডাঁই করে রাখা গোলাপের কলম, মাটি অথবা সিমেন্টের টব, খড়ের স্তূপ, সারের বস্তা, ফুল চাষের নানা সামগ্রী। বাড়িটার এক পাশে ছাউনির নীচে একটা দামি গাড়িও সায়কের চোখে পড়ল। চারপাশে কাউকে না দেখে সায়ক এগোল বারান্দাতে ওঠার সিঁড়ির দিকে।

সায়ক সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছোতেই বারান্দার কোনো একটা অংশ থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়াল মাঝবয়সি একজন লোক। পরনে ধবধবে সাদা পাজামা-কুর্তার উপর জরিবোনা একটা হাফ জ্যাকেট, পায়ে শুঁড়তোলা নাগরার মতো জুতো, মেহেন্দি রাঙানো দাঁড়ি। সব মিলিয়ে লোকটার চেহারাতে বেশ একটা আভিজাত্য আছে। তীক্ষ্ন নজরে সায়ককে একবার দেখল লোকটা। তারপর সায়কের পরিচয় অনুমান করে বলল, ‘আইয়ে জনাব। তসরিফ রাখিয়ে। মেরা নাম নৌরজা।’

নৌরজা সাহেবের পরিচয় পেয়ে সায়ক বারান্দাতে উঠে এল। করমর্দন করে মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, আমিই সায়ক। কলকাতা থেকে আসছি। ট্রেনটা বড্ড লেট করল তাই পৌঁছোতে দেরি হল।’

নৌরজা সাহেব বললেন, ‘আমি রেল স্টেশনে খবর নিয়ে জেনেছি ব্যাপারটা।’

যে কারণে সায়ক এত দূর ছুটে এসেছে সে ব্যাপারটা সম্বন্ধে প্রথমেই খোঁজ নিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তাই সে প্রশ্ন করল—

‘কালো গোলাপ ফুটেছে তো? আমি কিন্তু আপনার কথামতো তৈরি হয়ে এসেছি।’

সায়কের কথা শুনে নৌরজা সাহেব বললেন, ‘বহত খুব! হ্যাঁ, ফুটেছে। কালো রং ধরতেও শুরু করেছে। আশা করছি দু-রাতের মধ্যেই ওই বসরাই গুলাব ‘কালা গুলাব’ হয়ে যাবে। পরশু ভোরে ওই গোলাপ নিয়ে রওনা হয়ে যাবেন আপনি। আমি এমনভাবে প্যাকিং করে দেব যে সাত দিন তাজা থাকবে ফুলটা। আপনাকে দুটো রাত থাকতে হবে এই হাবেলিতে। অবশ্য আপনি হোটেলেও থাকতে পারেন। অনেকটা পথ এসেছেন। আপাতত বিশ্রাম নিন।’

নৌরজা সাহেবকে অনুসরণ করে লম্বা বারান্দা পেরিয়ে সায়ক তার সঙ্গে উপস্থিত হল হাবেলির শেষ প্রান্তে একতলার একটা ঘরে। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম একটা ঘর। খাট-বিছানা পাতা আছে। ঘর সংলগ্ন বাথরুমও আছে। বেশ বড়ো একটা জানলা আছে ঘরটাতে। তা দিয়ে প্রচুর আলোও ঢুকছে ঘরে। সায়ক জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল কিছুটা দূরে যমুনা নদীর জল দুপুরের সূর্যালোকে চিকচিক করছে। নদী আর ওই হাবেলির মধ্যবর্তী অংশ জুড়ে এই জানলা থেকে যতদূর চোখ যায় শুধু গোলাপের বাগান। নানা রঙের গোলাপ ঝলমল করছে সূর্যের আলোতে।

নৌরজা সাহেব মনে হয় অনুমান করলেন, বাইরে তাকিয়ে বেশ ভালো লেগেছে সায়কের। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এই বাগানেই আপনার কালো গুলাব আছে। রোদের তেজ কমলে বিকালে আপনাকে বাগান দেখাতে নিয়ে যাব। আর কামরাটা পছন্দ হয়েছে কি না বলুন? যদি থাকেন তবে এখানেই থাকতে হবে।’

সায়ক বলল, ‘হ্যাঁ পছন্দ হয়েছে। আমার কোনো অসুবিধে হবে না।’

সায়ককে ঘরটাতে রেখে ফিরে গেলেন নৌরজা সাহেব।

নৌরজা সাহেব চলে যাবার পর সায়ক স্নান সেরে সঙ্গে আনা শুকনো খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। তার যখন ঘুম ভাঙল তখন বিকাল পাঁচটা বেজে গেছে, যমুনার বুকে সূর্য ডোবার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তার ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজাতে টোকা পড়ার শব্দ শুনে দরজা খুলতেই সায়ক দেখল নৌরজা সাহেব হাজির হয়েছেন। তিনি বললেন, ‘চলুন জনাব, আপনাকে এবার গুলাববাগ আর সেই কালো গুলাব দেখিয়ে আনি।’

ঘরের বাইরে বেরিয়ে নৌরজা সাহেবের পিছনে এগোল সায়ক। কোথাও কোনো শব্দ নেই। বারান্দার গায়ে সার সার তালাবন্ধ ঘর। কোথাও কোনো লোকজনও নেই। কেমন যেন একটা অতিপ্রাচীন গন্ধ ছড়িয়ে আছে স্তম্ভ, খিলানওয়ালা লাল পাথরের তৈরি বাড়িটাতে। থাম দেওয়ালের গায়ের কারুকার্যগুলো অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে বয়সের ভারে। তবে এ বাড়িটা যে কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তি বানিয়েছিলেন তা অনুমান করে সায়ক জানতে চাইল, ‘এ বাড়িটা কত পুরোনো? কার বাড়ি ছিল?’ নৌরজা সাহেব হেসে জবাব দিলেন, ‘এই হাবেলির বয়স চারশো বছর। মোগল আমলের তৈরি এত পুরানো বাড়ি আগ্রা কেল্লার বাইরে খুব কমই টিকে আছে। আমার এক পূর্বপুরুষ বাদশাহ জাহাঙ্গিরের-শাহজাহানের প্রাসাদের ‘বাগ-নফর’ অর্থাৎ মালি ছিলেন। তার নাম ছিল গোলাম হায়দার। বাদশাহদের খুব পেয়ারের লোক ছিলেন তিনি। তাজমহল যখন নির্মিত হয় তখন তাজমহলের গুলাববাগ নির্মাণের জন্য ‘বাগ-নফর’ আগ্রা চলে আসেন। সম্রাটদের অর্থ আনুকূল্যে এ হাবেলি নির্মিত হয়। সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময় থেকেই অবশ্য আগ্রা কেল্লাতে আসতেন তিনি। এ কথা বলার পর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘ওই গোলাম হায়দারের সময় থেকেই পনেরো পুরুষ ধরে বংশানুক্রমিকভাবে ফুল, বিশেষত গোলাপ চাষই, বা মালির কাজই আমাদের একমাত্র পেশা। শুধু সম্রাটদের দিল্লি-আগ্রার প্রাসাদ বা তাজেই নয়, কাশ্মীরে যে মোগল গার্ডেনগুলো আছে সেখানে ফুল ফুটিয়েছিল আমার পূর্বপুরুষরা। বিশেষত বসরাই গুলাব। বাবর বাদশা থেকে সম্রাট শাহজাহান, আর তাদের বেগমরা গুলাব খুব পছন্দ করতেন।’

 নৌরজা সাহেবের কথা শুনে বেশ চমৎকৃত বোধ করল সায়ক। সে প্রশ্ন করল ‘এই হাবেলিতে কে কে থাকেন?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘বর্তমানে আমি একলাই থাকি। তবে চারা লাগাবার মরশুমে, মাটি তৈরি, কলম করা, ফুল তোলা ইত্যাদি কাজের জন্য বাইরে থেকে কিছু লোক আসে, কাজ মিটলে আবার তারা ফিরে যায়। আমার গুলাববাগের শ্রমিক তারা।’

সায়ককে নিয়ে বারান্দা থেকে নীচে নেমে নৌরজা হাবেলিটাকে বেড় দিয়ে উপস্থিত হল বাড়ির পিছনের অংশে। গোলাপ বাগানটা এবার স্পষ্ট চোখে পড়ল সায়কের। যমুনার পাড় বরাবর বাড়ির পিছনদিকে দু-পাশে অনেক দূর পর্যন্ত শুধু গোলাপের বাগান। নানা ধরনের, নানা আকারের গোলাপ গাছ। তাদের মধ্যে কোথাও কোথাও লাল, হলুদ, সাদা ইত্যাদি নানা বর্ণের, নানা আকারের গোলাপ ফুটে আছে। দিনের শেষ রাঙা আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। সেই আলোতে এক অপূর্ব মায়াবী সৌন্দর্যে ভরে আছে বাগানটা। গোলাপের ঝোপ থেকে নানাধরনের পাখির ডাকও ভেসে আসছে। চারদিকে তাকিয়ে সায়ক বলে উঠল ‘অপূর্ব। এতবড় গোলাপ বাগান যে হতে পারে, এ আমার ধারণাই ছিল না!’ সায়কের কথা শুনে তাকে নিয়ে বাগানে প্রবেশ করতে করতে নৌরজা বললেন, ‘এ বাগানে যত গোলাপ আছে তা সবই বসরাই গুলাব অথবা বসরাই গুলাবের সঙ্গে অন্য গুলাবের কলম। বসরা থেকে শাহেনশাহ বাবর প্রথম বড়ো আকারের লাল বসরাই গুলাব আনিয়েছিলেন এই মুলুকে। তারপর চারশ বছর ধরে তা দিল্লি-আগ্রা হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই গুলাববাগ দেখে আপনি অবাক হচ্ছেন! আমি বাগদাদ-বসরা কয়েকবার গেছি ওখানে দজলা আর ফৈরাত নদীর তীর বরাবর মাইলের পর মাইল বিস্তৃত গোলাপের খেত। চাঁদনী রাতে লক্ষ-কোটি গোলাপ কুড়িগুলো যখন একসঙ্গে পাপড়ি মেলতে শুরু করে তখন অদ্ভুত এক সুরেলা শব্দ বহু দূর থেকেও শোনা যায়! আশ্চর্য অদ্ভুত সেই শব্দ!’

নৌরজা সাহেবের কথা শুনে সায়ক একবার মনে মনে কল্পনা করার চেষ্টা করল সেই আশ্চর্য সুন্দর ব্যাপারটা! নৌরজা সাহেব তাকে নিয়ে এগিয়ে চললেন নির্দিষ্ট স্থানের দিকে। চারদিকে কত ধরনের গোলাপ গাছ! লম্বা, বেঁটে, লতানো, আবার কোনোটা ঝোপের মতো। আর তাতে কত আকৃতির, কত বর্ণের যে গোলাপ ফুটে আছে তার হিসাব নেই! লাল বর্ণের গোলাপের সংখ্যাই তো প্রচুর! কত ধরনের রঙের গাঢ়ত্ব তাদের! এগোতে এগোতে নৌরজা কিছু গোলাপ চিনিয়ে দিতে লাগলেন সায়ককে। তাদের কারও নাম ‘জাহাঙ্গির’, কারও নাম ‘নুরজাহান’, ‘মুমতাজ’ অথবা ‘তাজমহল’। মোগল বাদশা-বেগমের অনেকেরই নামে গোলাপগুলোর নামকরণ করা! হঠাৎ সায়ককে চমকে দিয়ে একজোড়া বেশ বড়ো আকারের ঝুঁটিওয়ালা বুলবুল পাখি একটা গোলাপ ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলে গেল বাগানের অন্যদিকে। নৌরজা হেসে বলল ‘শাহি বুলবুল। বসরাই গোলাপের মতো এ পাখিগুলোকেও তুর্কি মুলুক থেকে এনে প্রাসাদের বাগে ছাড়তেন শাহেনশাহ মোগল বাদশাহরা। গুলাববাগের শাহি বুলবুল! আরব কিতাবে একটা গল্প আছে। যে গল্পে আছে, গুলাবের রং নাকি প্রথমে সাদা ছিল। একবার একটা বুলবুল পাখি গুলাবকে আলিঙ্গন করে। তখন কাঁটার ঘায়ে বুলবুলির রক্তে সাদা গুলাব লাল হয়ে যায়। এভাবেই লাল গুলাবের জন্ম হয়।’

বাগানের ভিতর দিয়ে কথা বলতে বলতে সায়ককে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে এসে থামলেন নৌরজা সাহেব।

যেখানে একটা ঘরের মতো চৌকোনা জায়গা কাঁটাতারের আচ্ছাদন দিয়ে ঘেরা। সে জায়গার মাথার উপর ছাদ না থাকলেও সেখানে কাঁটাতারের আবরণ আছে যাতে ঘেরা জায়গার ভিতর কেউ প্রবেশ না করতে পারে। একটা কাঁটাতারেরই দরজা মতো আছে ভিতরে প্রবেশ করার জন্য। যেটার গায়ে বাইরে থেকে তালা ঝুলছে। জায়গাটা বাগানের অন্য অংশের তুলনায় কেমন যেন নিস্তব্ধ। কোনো পাখির ডাক সেখানে নেই। চারপাশে তাকিয়ে কিছু দূরে হাভেলির পিছনের অংশে নিজের ঘরের খোলা জানলাটা দেখতে পেল সায়ক। একটা তোয়ালে শুকোতে দিয়ে রেখেছিল যে জানলার গায়ে। তাই জানলাটা চিনতে পারল সায়ক। তবে ঘরের ভিতর থেকে এই কাঁটাতার ঘেরা জায়গা ঠিক খেয়াল করেনি। নৌরজা সাহেব তাকে এনে দাঁড় করালেন কাঁটাতারের বেড়ার ঠিক গায়ে। তারপর আঙুল তুলে ভিতরের দিকে দেখালেন। সায়ক তাকাল সেদিকে।

ঘেরা জায়গাটার কেন্দ্রস্থলে একটা বুক সমান উঁচু সরু কাঠের দণ্ড পোঁতা আছে। আর তাকে আবৃত করে মাটি থেকে উপরে উঠেছে বড়ো বড়ো কাঁটাওয়ালা একটা লতানো গোলাপ গাছ। দণ্ডর মাথার কাছে বেশ বড়ো একটা গোলাপ ফুটেছে। তার দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে সায়ক দেখতে পেল গোলাপের বৃন্তর কাছে নীচের অংশের পাপড়িগুলো কালো রঙের আর তার উপরের অংশের পাপড়িগুলো ঘন রক্ত বর্ণের।

সায়কের পাশ থেকে নৌরজা বললেন, ‘এই হল বসরার কালা গুলাব। এখন অবশ্য একে এ দেশের কালো গুলাবও বলতে পারেন। কারণ, এ দেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছে ও।’

সায়ক বলল, ‘কিন্তু ওর ওপরের অংশর পাপড়িগুলো লাল কেন?’

নৌরজা বললেন, ‘আসলে কুঁড়ি থেকেই কালো গুলাব ফোটে না। প্রথমে ফোটে গাঢ় রক্তবর্ণের লাল গুলাব। শুকনো রক্ত যেমন জমাট বেঁধে কালো বর্ণ ধারণ করে তেমন গাঢ় লাল বর্ণের এই বসরাই গুলাব আরও গাঢ় বর্ণ ধারণ করতে করতে একসময় মানুষের চোখে কালো দেখায়। তুর্কি মুলুকের শুধুমাত্র একটি গ্রামেই এই গ্রীষ্মকালে মে-জুন মাসে কয়েকটা গাছে এই দুষ্প্রাপ্য কালা গুলাব ফোটে। তবে আপনার চিন্তার কোনো ব্যাপার নেই। দেখছেন তো লাল রং জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। দু-রাতের মধ্যে ওর রং পুরো কালো হয়ে যাবে। তখন ওকে দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না ওর রং ফোটার সময় লাল ছিল।

ব্যাপারটা শুনে সায়ক আশ্বস্ত হয়ে বলল, ‘এ গোলাপ এ দেশের মাটিতে বা অন্য কোথাও আর ফোটে না কেন?’

নৌরজা বললেন, ‘আবহাওয়ার জন্য। বিশেষত মাটির জন্য। মাটির ভিতর যে সব উপাদান থাকে তা জায়গা অনুসারে বদলে যায় তা নিশ্চয়ই জানেন? তুরস্কর ফোরাত নদী অর্থাৎ ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব উপকূলে যে গ্রামে এই কালো গুলাব ফোটে সে গ্রামের নাম ‘হালফেতি’। যে কারণে এই কালো গুলাবকে অনেকে ‘হালফেতি গুলাবও’ বলে। ওই হালফেতি গ্রামের মাটি আর পরিবেশ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না বলে এই বসরাই কালা গুলাব অন্য কোনো জমিনে ফোটে না।’

সায়ক বলল, ‘তবে কি এ দেশের মাটিতে আপনি প্রথম কালো গোলাপ ফোটালেন? কীভাবে ফোটালেন?’ নৌরজা বললেন, ‘বংশানুক্রমে আমাদের পরিবারে এক কাহিনি প্রচলিত আছে। সেই কাহিনি অনুসারে আগ্রা কেল্লার বাগিচাতে বাদশাহ জাহাঙ্গিরের নির্দেশে আমার পূর্বপুরুষ গোলাম হায়দার নাকি একবার কালো গুলাব ফুটিয়েছিলেন। আর তার চারশো বছর পর আমি আগ্রার মাটিতে দ্বিতীয়বার কালো গোলাপ ফোটালাম।’ এ কথাগুলো বেশ আত্মশ্লাঘার সঙ্গে বলার পর একটু থেমে নৌরজা বললেন, ‘ঘেরা জায়গার ভিতরে যে মাটি দেখছেন ও মাটি তুর্কি মুলুকের হালফেতি গ্রামের মাটি। এই ঘরের মতো জায়গাটার মাটি দশ হাত খুঁড়ে তুলে ফেলে, হালফেতি গ্রাম থেকে আনা মাটি দিয়ে জায়গাটা ভরতি করে তারপর গাছ লাগাই আমি। গাছটাও হালফেতি থেকে আনা।’

সায়ক বলল, ‘তবে ওই হালফেতি গ্রাম থেকে মাটি এনে অন্যরা এ দেশে কালো গোলাপ ফোটায়নি কেন?’

প্রশ্নটা শুনে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে সায়কের দিকে তাকিয়ে রইলেন নৌরজা সাহেব। তারপর বললেন, ‘শুধু মাটি আনলেই তো হবে না। নানারকম সার ইত্যাদি দিয়ে জমি তৈরি করতে হয় ফুল ফোটাবার জন্য। এই ব্যাপারটাই আসল। আমি দশ বছর ধরে চেষ্টা করে গেছি এই গুলাব ফোটাবার জন্য। শেষপর্যন্ত গুলাব ফুটল।’

সায়ক বলল, ‘আচ্ছা বুঝলাম। তবে এত কষ্ট করে ফোটানো ফুল আপনি বিক্রি করে দিচ্ছেন কেন?’

নৌরজা বললেন, ‘গুলাব কালা হোক বা লাল, ফুল ফোটার পর এক সময় তো ঝরেই যাবে। গাছে তো আর রাখা যাবে না। তাই বিক্রি করে দিচ্ছি। তা ছাড়া একবার যখন আমি এই গুলাব ফোটাতে পেরেছি তখন আমি আবারও পারব।’

গোলাপটার দিকে এরপর বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সায়ক। তাকিয়ে রইলেন নৌরজা সাহেবও। কিছুটা স্বগতোক্তির সুরেই তিনি বললেন, ‘এ গুলাবটা নানা হাত ঘুরে শেষপর্যন্ত যে সুন্দরী নারীর কাছে পৌঁছোবে সে জানবেও না যে এই একটা গুলাব ফোটাতে আমাকে কত মেহনত, কত কিছু করতে হয়েছে!’

যমুনার বুকে সূর্য ডুবতে শুরু করল এরপর। সে জায়গা ছেড়ে সায়ককে নিয়ে হাভেলিতে ফেরার পথ ধরলেন নৌরজা সাহেব। ফেরার পথে তিনি বললেন, ‘আপনাকে বলা হয়নি যে হাভেলিতে ইলেকট্রিসিটি নেই। তবে লণ্ঠন দিয়ে দেব।’ বারান্দাতে উঠে আসার পর সায়ক নৌরজা সাহেবকে বলল, ‘ভাবছি কাল সকালবেলা তাজমহল আর আগ্রা কেল্লা দেখতে বেরব। টাঙ্গাওয়ালার ফোন নম্বর আছে। ডাকলে আসবে বলেছে।’

নৌরজা বললেন, ‘হ্যাঁ ঘুরে আসুন। ভালো লাগবে। এ জায়গাগুলো দেখলে বুঝতে পারবেন মোগল বাদশাহদের মেজাজ, শখ-শৌকিন কেমন ছিল। ওই জায়গাগুলোর সঙ্গে আমার পূর্বপুরুষরাও জড়িয়ে আছেন।’

কথাগুলো বলার পর নৌরজা সাহেব একটা লণ্ঠন এনে দিলেন সায়ককে। সেটা নিয়ে ঘরে ফিরে এসে সায়ক প্রথমে তার সেলফোন থেকে টাঙ্গা স্ট্যান্ডে ফোন করে জানাল টাঙ্গাওয়ালা আনোয়ারকে পরদিন সকালে হাভেলিতে আসার জন্য। বাইরে অন্ধকার নামার কিছু সময় পর ধীরেসুস্থে খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল সায়ক। আগের রাতে ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে প্রায় জেগেই কাটাতে হয়েছে সায়ককে। বিছানায় শোবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম নেমে এল তার চোখে।

কিন্তু মাঝরাতে সায়কের ঘুম ভেঙে গেল। মশা ঘিরে ধরেছে তাকে। সায়ক খেয়াল করল বিছানায় শোবার আগে জানলাটা বন্ধ করা হয়নি। আর তা দিয়ে মশা ঢুকছে ঘরে। তন্দ্রা জড়ানো চোখে সায়ক বিছানা ছেড়ে উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল পাল্লাটা বন্ধ করার জন্য। বেশ বড়ো চাঁদ উঠেছে আকাশে। তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে নিস্তব্ধ গোলাপ বাগানে। পাল্লাটা বন্ধ করার আগে সায়ক তাকাল বাগানের মধ্যে কিছুটা দূরে কাঁটাতার ঘেরা জায়গাটার দিকে। পাল্লাটা বন্ধ করতে গিয়ে প্রথমে থমকে গেল সায়ক। একটা ছায়ামূর্তি যেন দাঁড়িয়ে আছে কাঁটাতার ঘেরা জায়গার ভিতর। গাছটা এত দূর থেকে দেখা না গেলেও সায়কের যেন মনে হল সেই ছায়ামূর্তি কালো গোলাপের গাছের উপর ঝুঁকে পড়ে দেখছে গাছটাকে! কে? ওই কাঁটাতার ঘেরা জায়গার ভিতরে ঢুকল কীভাবে? তবে কি নৌরজা সাহেব মধ্যরাতে গাছের পরিচর্যা করতে বেরিয়েছেন? চোখ কচলে ভালো করে সেদিকে তাকাল সায়ক। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গেই সেই ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল! হয়তো ঘুম চোখে তার দৃষ্টি-বিভ্রম হয়েছে—এ কথা ভেবে নিয়ে জানলা বন্ধ করে আবার বিছানাতে ফিরে এল সায়ক।

পরদিন সকাল হল। ঘুম থেকে উঠে জানলা খুলতেই সকালের আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। জানলার বাইরে কিছুটা দূরে কাঁটাতার ঘেরা সে জায়গাটা। বাইরে বেরতে হবে সায়ককে। টাঙ্গা আসবে তাকে নিতে। সায়ক যখন তৈরি হয়ে ঘরের বাইরে বেরল তখনও টাঙ্গা এসে উপস্থিত হতে কিছুটা দেরি আছে। তাই সায়ক এগোল বাগানের নিকে। সকালের আলোতে ঝলমল করছে বাগান। চারদিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে নানা রঙের গোলাপ। পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারদিক। বেশ মন ভালো করা পরিবেশ চারপাশে। সায়ক বাগানের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে উপস্থিত হল কাঁটা তার ঘেরা ঘরের মতো জায়গাটার সামনে। এই সকালবেলাতেও সেখানে পৌঁছে আগের দিন বিকালের মতো একটা ব্যাপার অনুভব করল সায়ক। এ জায়গা যেন বাগানের অন্য অংশের থেকে সত্যিই বিচ্ছিন্ন। এখানে কোনো শব্দ নেই, কোনো পাখি ডাকছে না, কেমন যেন অপার্থিব নিস্তরঙ্গতা বিরাজ করছে জায়গাটা ঘিরে। কাঁটাতারের বেড়ার সামনে গিয়ে সকালের আলোতে ভালো করে তাকাল সায়ক। নৌরজা সাহেব ঠিকই বলেছিলেন। এক রাতের মধ্যেই গোলাপের উপরের পাপড়িগুলো প্রায় সম্পূর্ণই কালো রং ধারণ করেছে। যে সামান্য অংশ কালো রং ধরতে বাকি তাও নিশ্চয়ই রাতের মধ্যেই কালো রং ধরবে। গাছটাকেও দিনের আলোতে ভালো করে লক্ষ করল সায়ক। কাণ্ডটা লতানো হলেও অনেকটা মোটা নাইলনের দড়ির মতো দেখতে। আর তার গায়ের কাঁটাগুলোও বেশ ঘন আর তীক্ষ্ন। সায়কের হঠাৎ মনে পড়ে গেল গতকাল রাতে দেখা সেই ছায়াটার কথা। ঘেরা জায়গার প্রবেশ মুখে গতকালের মতোই তালা ঝুলছে। সায়কের তা দেখে ধারণা হল, ঘুম চোখে নিশ্চয়ই তার দৃষ্টি-বিভ্রম হয়েছিল, কিছু সময় সায়ক সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর সেখান থেকে ফেরার পথ ধরল।

সায়ক যখন হাভেলির সামনের অংশে উপস্থিত হল তখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন নৌরজা সাহেব। তাকে দেখে নৌরজা সাহেব জানতে চাইলেন, ‘গুলাবটা দেখে এলেন? কেমন দেখলেন?’

সায়ক উৎফুল্লভাবে জবাব দিল, ‘আপনার কথাই ঠিক, এক রাতের মধ্যেই কালো হয়ে গেছে অন্য পাপড়িগুলোও। আর সামান্য কিছু অংশই বাকি।’

নৌরজা হেসে বললেন, ‘আজ রাতের মধ্যেই গুলাবের বাকিটুকুও কালো হয়ে যাবে। কাল ভোরেই আপনি গুলাবটা নিয়ে রওনা হয়ে যেতে পারবেন। বসরার কালা গুলাব—আগ্রার কালা গুলাব!’

নৌরজা সাহেবের কথা শেষ হবার পরই বাইরে টাঙ্গার শব্দ শোনা গেল। তারপর টাঙ্গাওয়ালার কণ্ঠস্বরও শোনা গেল—’সাব, টাঙ্গা নিয়ে এসেছি।’

নৌরজা সাহেব, সায়ককে নিয়ে সামনের জমিটা অতিক্রম করে হাভেলির ফটকটা খুলে দিয়ে বললেন—’যান, তাজ আর আগ্রা কেল্লা ভালো করে ঘুরে আসুন। দুটোই খুব খুবসুরত জায়গা। বেশ কিছু ভালো জাতের গুলাবও ওখানে দেখতে পাবেন। তারমধ্যে কিছু গাছের চারা আমার এখান থেকেই নিয়ে যাওয়া।’ হাভেলি ছেড়ে বুড়ো আনোয়ারের টাঙ্গাতে উঠে বসল সায়ক। আনোয়ারের টাঙ্গা সায়ককে নিয়ে প্রথমে এগোল তাজমহলের দিকে। ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘোরে টাঙ্গাওয়ালা আনোয়ার। গাইড যেমন গল্প বলে তেমনই তার মুখ থেকে আগ্রা নগরীর গল্প শুনতে শুনতে একসময় তাজমহলের কাছে পৌঁছে গেল সায়ক। টিকিট কেটে সৌধ-চত্বরে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ সে মুগ্ধভাবে চেয়ে রইল দৃষ্টিনন্দন সেই অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর দিকে। এমনিতে সায়কের মনে কাব্য খুব একটা আসে না। কিন্তু স্থান-মাহাত্ম্যর কারণেই হয়তো সায়কের মনে পড়ে গেল কলেজে পড়ার সময় পড়া রবি ঠাকুরের লেখা কবিতার একটা লাইন— ‘কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহল।’ সম্রাট শাহজাহানের তৈরি বিশ্ববিখ্যাত স্থাপত্য তাজমহল! চারপাশে দেশি-বিদেশি নানা ট্যুরিস্টের ভিড়। তাদের সঙ্গে মিশে সায়ক ঘুরে দেখতে শুরু করল সেই সৌধমন্দির ও তার সংলগ্ন নীচের চত্বর। সেই চত্বরের বাগিচাতেই কয়েকটা স্থানে গোলাপও ফুটে আছে। কীভাবে যে সময় অতিবাহিত হল তা বুঝতেই পারল না সায়ক। তাজমহল চত্বর পরিত্যাগ করে সে যখন টাঙ্গাতে উঠল ইতিমধ্যে ঘণ্টা তিনেক সময় কেটে গেছে। আনোয়ারের টাঙ্গা তাকে নিয়ে ছুটল পরবর্তী গন্তব্য আগ্রা কেল্লার দিকে। সায়ক যখন কেল্লার সামনে টাঙ্গা থেকে নামল তখন সূর্য ঠিক মাথার ওপর।

লাল রঙের বেলে পাথরের তৈরি সুবিশাল আগ্রা কেল্লা নানা প্রাসাদ ও মন্দির শোভিত। এই প্রাচীন কেল্লার প্রথমে সংস্কার শুরু করেন সম্রাট আকবর। তারপর জাহাঙ্গির, শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের হাত ধরে আগ্রা কেল্লা বিস্তারলাভ করে। মোগল সম্রাটরা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ রাজত্বকালে বহু প্রাসাদ, মহল, মিনার, মসজিদ নির্মাণ করান। সম্রাট শাহজাহান জীবনের শেষ সময় এই আগ্রা কেল্লাতেই বন্দি অবস্থায় চেয়ে থাকতেন দূরে যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে থাকা তাজমহলের দিকে। ফতেপুর সিক্রিতে মৃত্যুর আগে সম্রাট আকবরও থাকতেন এই আগ্রা কেল্লাতে। আর বাদশা জাহাঙ্গিরও বহু সময় এ কেল্লায় অতিবাহিত করেছেন তাঁর বেগমদের নিয়ে। সায়ক ঘুরে দেখতে শুরু করল কেল্লা। খাসমহল, শিশমহল, দেওয়ানি-আম, দেওয়ানি-খাস, মুহাম্মান বুর্জ, মতি মসজিদ ইত্যাদি নানা স্থান ঘুরে দেখতে দেখতে একসময় সে উপস্থিত হল উঁচু প্রাকার বেষ্টিত একটা জায়গায়। প্রাকারের ঠিক মাঝখানে ক্ষুদ্রাকৃতির একটা মহল আর তাকে ঘিরে ফুলের বাগান—গোলাপ বাগান। ক্ষুদ্রাকৃতি মহলটা বয়সের ভারে কিছুটা জীর্ণ হলেও তার স্তম্ভ, গম্বুজ আকৃতির ছাদে এখনও পারসিক শিল্পকলার অপূর্ব নিদর্শন বর্তমান। ঘড়ি দেখল সায়ক। বেলা প্রায় দুটো বাজে। মাথার উপর চড়া রোদ। এ জায়গায় অন্য কোনো ট্যুরিস্ট নেই। যেন কিছুটা অবহেলাতেই পড়ে আছে প্রাকারঘেরা প্রাসাদটা। কিন্তু ভিতরে বাগান দেখে সায়ক একটু আকৃষ্ট হয়ে উন্মুক্ত, আগলহীন তোরণের নীচ দিয়ে সে জায়গায় প্রবেশ করল।

লাল সুরকি বিছানো রাস্তা সামনে এগিয়ে গিয়েছে লাল পাথরের মহলটার দিকে। তার দু-পাশে গোলাপ বাগান। কোনো কোনো গাছে গোলাপ ফুটে আছে। লাল বসরাই গোলাপ। সায়ক দু-পাশের গোলাপ গাছগুলো দেখতে দেখতে এগোল মহলটার দিকে। স্তম্ভ আর আর্চের খিলান সমৃদ্ধ একটা অলিন্দ ঘিরে রেখেছে মহলটাকে। তার গায়ের অংশের জমিটা বেশ ছায়াঘন। মহলের ছায়া এসে পড়েছে মহল সংলগ্ন সামনের জমিতে। জমি থেকে হাতখানেক উঁচুতে মহলের অলিন্দর অবস্থান। মহলের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎই তার গায়ের জমিতে একটা গাছে চোখ আটকে গেল সায়কের। একটা কালো গোলাপ যেন ফুটে আছে সেখানে! সেটা দেখেই সায়ক দ্রুত এগিয়ে গেল সে জায়গাতে। ভালো করে ফুলটার দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল, না, সেটা কালো গোলাপ নয়। গাঢ় রক্তবর্ণের একটা গোলাপের গায়ে একটা স্তম্ভর ছায়া এমনভাবে এসে পড়েছে যে দূর থেকে ফুলটাকে কালো গোলাপ মনে হচ্ছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সায়ক মনে মনে হাসল। তার মনে হল, সর্বক্ষণ কালো গোলাপের ব্যাপারটা তার মাথার মধ্যে ঘুরছে বলেই এমন দৃষ্টি-বিভ্রম হল।

ঠিক এই সময়েই বেশ কাছ থেকে একটা নারী কণ্ঠে ভেসে এল—’না, ওটা কালো গোলাপ নয়, তবে কালো গোলাপ সত্যি একদিন এ জমিনে ফুটেছিল।’

হিন্দিতে বলা কথাগুলো শুনে মৃদু চমকে উঠে মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেল অলিন্দর থামের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। শুভ্র বসন তার পরনে। চুড়িদার-কুর্তি ধরনের পোশাক। একটা জরিদার দোপাট্টা বা ওড়না দিয়ে মাথা ও মুখের বেশ কিছুটা অংশ আবৃত। প্রথম দর্শনেই তাকে যুবতী বলে মনে হল সায়কের।

তার মনে পড়ে গেল নৌরজা সাহেবও তাকে বলেছিলেন আগ্রা কেল্লাতে নাকি একবার গোলাপ ফুটেছিল। সায়ক সেই থামের কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ব্যাপারটা সত্যি? সচ বাত?’

সেই নারী জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, সত্যি। এই যে মহল দেখছেন। আসলে এটা ছিল আয়েশা নামের এক বাঁদির মহল। সম্রাট জাহাঙ্গির তাকে দিল্লি থেকে আগ্রাতে এনে এ মহল বানিয়ে এখানে রেখেছিলেন। আর মহল সংলগ্ন এই ছোট্ট বাগানেই একসময় ফোটানো হয়েছিল কালো গোলাপ। বাদশাহ আর তার ‘বাগ নফর’ অর্থাৎ ‘মালি’ ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার ছিল না এই প্রাকার ঘেরা অঞ্চলের ভিতর। শোনা যায় এই কালো গোলাপ নাকি সম্রাট তাঁর প্রিয়তমা বেগম নুরজাহানকে উপহার দিয়েছিলেন।’ — ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর ইংরেজি মিশিয়ে কথাগুলো বলল সেই মহিলা।

সায়ক কথাগুলো শুনে বেশ চমৎকৃত বোধ করল। নীচের জমি ছেড়ে মহলের অলিন্দে উঠে এসে সেই অপরিচিতা রমণীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কথা বলার সময় সেই অপরিচিতা নারীর মুখমণ্ডল থেকে ওড়নাটা সরে গেছে। ফর্সা মুখমণ্ডলের এক অপরূপ সুন্দরী যুবতী দাঁড়িয়ে আছে সায়কের সামনে। তার চোখের মণির রং সমুদ্রের জলের মতো নীল, আর কিছুটা স্বচ্ছ। সে তাকিয়ে আছে সায়কের দিকে।

যুবতীর মুখমণ্ডল, চোখের মণির রং আর কথা বলার ধরন দেখে সায়কের কেমন যেন মনে হল যে তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার পোশাকের ধরন ভারতীয়দের মতন হলেও সে যেন ঠিক ভারতীয় নয়। কেমন যেন একটা প্রচ্ছন্ন বিদেশি ছাপ আছে তার চেহারা আর কথাবার্তার মধ্যে।

সায়ক তাকে প্রশ্ন করল ‘আপনি কি ট্যুরিস্ট? কোথা থেকে আসছেন?’

মেয়েটা জবাব দিল ‘আমার দেশ হল তুরস্ক। দিল্লির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দেশের ইতিহাস, বিশেষত মোগল যুগের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে প্রথমে এ দেশে এসেছিলাম। তারপর সে কাজেই আগ্রা এসেছিলাম। এখন বছরখানেক ধরে আগ্রাতেই আছি। আমার নাম ইয়াসমিন।’

যুবতীর পরিচয় পেয়ে সায়ক বলল, ‘ও এইজন্যই আপনি এখানে কালো গোলাপ ফোটার ঐতিহাসিক ঘটনার ইতিহাসটা বলতে পারলেন। এ গল্প আমি অন্য একজনের মুখেও শুনেছি। আপনি এখানকার ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছেন বলে জানেন ব্যাপারটা। আপনার দেশেও তো কালো গোলাপ ফোটে তাই না?’

কথাটা শুনে ইয়াসমিন নামের তরুণী মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু সে দেশে আমি সে গোলাপ চোখে দেখিনি। আর আপনাকে এখানে কালো গোলাপ ফোটার যে কাহিনি বললাম, সেটা লিখিত প্রামাণ্য ইতিহাস বইতে পাবেন না। এটা একটা মিথ—অতি প্রাচীন একটা লোককথা। তবে খুব অল্প সংখ্যক মানুষই আজ জানেন এখানে কালো গোলাপ ফোটার কাহিনি। আমি আমার কাজের সূত্রে গবেষণা করতে গিয়ে এ কাহিনির সন্ধান পেয়েছিলাম। তবে আমি আজ বিশ্বাস করি আগ্রা কেল্লার এই ছোট্ট বাগানে কালো গোলাপ ফোটার গল্প নিছক প্রাচীন গল্প নয়। তা সত্যি ছিল। সম্রাটের বাঁদি আয়েশার এই ছোট্ট মহলে সত্যিই বসরাই কালো গোলাপ ফুটেছিল।’

হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলার পর এই তুর্কি রমণী, সায়ককে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘এই আগ্রা কেল্লাতে কালো গোলাপ ফোটার গল্প আপনাকে নৌরজা বলেছেন, তাই না? কালো গোলাপ ফোটার কাহিনি তো সব লোকের জানা নেই।’

সায়ক কথাটা শুনে বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নৌরজা সাহেবের মুখ থেকেই শোনা। আপনি তাকে চেনেন!’

ইয়াসমিন নামের তুর্কি ললনা বলল, ‘হ্যাঁ, তাঁকে আমি চিনি। এই বাঁদি মহলের বাগানেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তিনি আমাকে তার গুলাব মঞ্জিলের বাগানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি জানি তার বাগানে কালো গোলাপ ফুটছে।’

এ কথা বলার পর একটু থেমে ইয়াসমিন তাকে প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু আপনাকে তো স্থানীয় লোক বলে মনে হয় না। নৌরজার সঙ্গে আপনার পরিচয় হল কীভাবে? আর হঠাৎ তিনি কালো গোলাপের গল্প আপনাকে কেন বললেন?’

এই বিদেশিনী যুবতী যে শুধু নৌরজা সাহেবকে চেনে তাই নয়— এমনকি নৌরজা সাহেবের বাগানে যে কালো গোলাপ ফুটেছে এ কথাও জানে দেখে সায়ক আর কোনো কথা গোপন না করে বলল, ‘আমি কলকাতার এক কোম্পানিতে চাকরি করি যারা বিভিন্ন জিনিস তাদের ক্লায়েন্টদের জোগাড় করে দেয়। সেই কোম্পানির হয়ে আমি ওই কালো গোলাপটা কিনতে এসেছি। নৌরজা সাহেবের বাড়িতেই আমি আছি। সকালে কোনো কাজ না থাকায় তাজমহল আর এই আগ্রা কেল্লা দেখতে বেরিয়ে পড়েছি।’

মৃদু হেসে যুবতী বলল, ‘সেই কালো গোলাপ আপনি দেখেছেন?’

সায়ক জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, দেখেছি। প্রায় সম্পূর্ণ ফুলটাই কালো হয়ে এসেছে। সামান্য যেটুকু বাকি তাও আজ রাতেই কালো হয়ে যাবে।’

যুবতী জবাব শোনার পর আবারও প্রশ্ন করল, ‘এ মাটিতে ওই হালফেতি কালো বসরাই গোলাপ নৌরজা কীভাবে ফোটালেন, সে সম্পর্কে কিছু জানেন আপনি?’

সায়ক বলল, ‘নৌরজা সাহেব বলেছেন, বহু বছরের পরিশ্রমের ফলে তিনি শেষপর্যন্ত কালো গোলাপ ফুটিয়েছেন। ও গোলাপ ফোটার জন্য বসরার হালফেতি গ্রাম থেকে মাটি এনেছেন তিনি। তারপর নানা ধরনের সার ইত্যাদি মিশিয়ে মাটিটা কালো গোলাপ ফুটিয়ে তোলার জন্য উপযুক্ত করেছেন।’

সায়কের কথা শুনে মুক্তোর মতো দাঁত বার করে এবার স্পষ্ট হাসল মেয়েটা। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ, যে কোনো ভালো জাতের গোলাপ ফোটাবার জন্য উপযুক্ত সার ইত্যাদি দিয়ে জমি তৈরিটাই আসল ব্যাপার। আপনি কোনোদিন টবে বা বাগানে গোলাপ ফুটিয়েছেন? ভালো গোলাপ ফোটাতে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে কী জিনিস সার হিসেবে ব্যবহার করা হয় জানেন?’

প্রশ্ন শুনে সায়কও হেসে ফেলে বলল, ‘না, না, এ ব্যাপারে আমার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। বাগান করা তো অনেক দূরের ব্যাপার, কলকাতাতেও আমি যে এক কামরার এক চিলতে ফ্ল্যাটে থাকি সেখানে একটা টব রাখারও জায়গা নেই। কালো গোলাপ সংগ্রহ করতে এসে নৌরজা সাহেব যতটুকু নিজে থেকে জানিয়েছেন, জেনেছি। যে কোনো সাধারণ মানুষ যেমন ফুল ভালোবাসে, গোলাপ ভালোবাসে আমিও তেমনই। আপনি গোলাপ চাষের ব্যাপারে অনেক কিছু জানেন তাই না?’ তুর্কি যুবতী ইয়াসমিন বলল, ‘অনেক কিছু জানি বললে ভুল হবে। আমার বাড়িতে কেউ কোনোদিন ফুল বা গোলাপ চাষ করেননি। সে দেশে আপনার মতোই শহরের মানুষ আমি। উদ্ভিদবিদ্যা আমার পাঠ্যক্রমের বা গবেষণার বিষয় ছিল না, ছিল ইতিহাস। সেই সূত্র ধরে এদেশে, বলা ভালো আগ্রাতে আসার পর আমার গবেষণার সূত্র ধরে মোগল শিল্প-সংস্কৃতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে কালো গোলাপের কাহিনির সন্ধান পেলাম, তারপর আমার পরিচয় হল নৌরজার সঙ্গে। আমি তার বাগানে গেলাম। আমিও তার থেকেই গোলাপ চাষ সম্পর্কে কিছুটা জেনেছি।’

সায়ক বলল, ‘আমি নৌরজা সাহেবকে বলব আপনার কথা। বলব আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে।’

সায়কের কথা শুনে ইয়াসমিন বেশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে রইল সায়কের দিকে। তারপর বলল, ‘এ ব্যাপারে আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে।’

‘কী অনুরোধ,’ জানতে চাইল সায়ক।

তুর্কি যুবতী বলল, ‘তার বাগানের কালো গোলাপ গাছকে কেন্দ্র করে বিশেষ কারণবশত আমাদের দুজনের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। বলা ভালো প্রচণ্ড তিক্ত হয়ে গেছে। আপনি আমার সঙ্গে দেখা হবার কথা নৌরজাকে বললে অস্বস্তিবোধ করতে পারেন তিনি। আর আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক এতটাই তিক্ত যে আমি চাই না আমার সম্পর্কে তার সঙ্গে একটা বাক্যও কেউ আলোচনা করুন। তাই আমার অনুরোধ আমার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা নৌরজাকে বলবেন না।’

ইয়াসমিনের অনুরোধ শুনে সায়ক বলল, ‘বেশ তাই হবে। তবে আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার বেশ লাগল।’

কথাটা শুনে সেই রূপবতী বিদেশি যুবতী হেসে বলল, ‘আমারও বেশ লাগল। হয়তো আমাদের আবার কোথাও দেখা হয়ে যাবে। এবার আমাকে যেতে হবে।’

ইয়াসমিনের কথার জবাবে সায়ক তার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল। সামান্য পরিচয়েই তার সত্যিই বেশ ভালো লেগেছে এই বিদেশি যুবতীকে। তা ছাড়া কোন পরিচয় ভবিষ্যতে কোন কাজে লাগে তা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু মেয়েটার কাছে সে সব জানার আগেই পিছনদিক থেকে কথাবার্তা ভেসে আসার শব্দ শুনে সেদিকে তাকাল। একদল ট্যুরিস্ট বাচ্চাকাচ্চা সমেত ঘুরতে ঘুরতে চলে এসে প্রবেশ করছে প্রাকারের ভিতর। তাদের দেখে নিয়ে সায়ক সামনে তাকিয়ে দেখল তুর্কি যুবতী আর তার সামনে নেই, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল কোথাও।

হয়তো বা ছায়াঘেরা কোনো থামের আড়ালে অথবা অলিন্দ সংলগ্ন কোনো প্রাচীন কক্ষের ভিতর।

ট্যুরিস্টদের দলটা ভিতরে প্রবেশ করল। আর সায়কও অলিন্দ থেকে নেমে বাগান ছেড়ে প্রাকারের বাইরে বেরিয়ে এল। আগ্রা কেল্লা দেখা হয়ে গিয়েছিল সায়কের। আড়াইটে বাজে। খিদেতে পেটও চুঁই চুঁই করছে। তাই কেল্লা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল সে। টাঙ্গা তাকে তার নির্দেশমতো প্রথমে একটা ভাতের হোটেলে নিয়ে গেল। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে, রাতের জন্য শুকনো খাবার আর কিছু প্রয়োজনীয় টুকিটাকি জিনিস কিনে সায়ক যখন গুলাব মঞ্জিলের সামনে ফিরল তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে।

লোহার ফটকের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নৌরজা সাহেব। সায়ক যখন টাঙ্গা থেকে নেমে ভাড়া মেটাচ্ছে তখন তিনি তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ওকে কাল ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে স্টেশনে নিয়ে যাবার জন্য বলতে পারেন। কাল ভোর সাড়ে ছ-টা নাগাদ কলকাতাগামী একটা সুপারফাস্ট ট্রেন আগ্রাতে থামে। আমিও কাল ভোরে আগ্রার বাইরে যাব। তাই রেলওয়ে টাইম টেবিল দেখছিলাম। তখনই ওই কলকাতাগামী ট্রেনের ব্যাপারটা দেখলাম।’ সায়কের ট্রেনের খবরটা জেনে ভালোই লাগল। রিজার্ভেশন হয়তো পাবে না। কিন্তু ওই ট্রেন ধরতে পারলে, জেনারেল কম্পার্টমেন্টে কোনোরকমে একটা বসার ব্যবস্থা করতে পারলে ও দ্রুত কলকাতায় পৌঁছে যেতে পারবে। কাজেই নৌরজা সাহেবের পরামর্শমতো বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালা আনোয়ারকে তাকে ভোরের আলো ফুটলেই নিতে আসার জন্য বলল। পরদিন ঠিক সময় আসবে বলে টাঙ্গা নিয়ে চলে গেল আনোয়ার।

নৌরজা সাহেবের সঙ্গেই তার হাভেলি চত্বরে প্রবেশ করল সায়ক। নৌরজা বললেন, ‘কেমন বেড়ালেন?’ সায়ক বলল ‘খুব ভালো। তাজমহল দর্শন তো তুলনাহীন অভিজ্ঞতা আর আগ্রা কেল্লাও খুব ভালো লেগেছে।’ এগোতে এগোতে নৌরজা সাহেব এরপর প্রশ্ন করলেন, ‘গোলাপ দেখেছেন’?

সায়ক জবাব দিল ‘হ্যাঁ, দেখেছি। বিশেষত আগ্রা কেল্লার ভিতর ঘুরতে ঘুরতে আমি একটা নির্জন, প্রাচীরঘেরা মহলের সামেন পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা গোলাপ বাগান আছে?’

কথাটা শুনেই নৌরজা বললেন, ‘ সেই ছোটো মহলটার সামনে স্তম্ভ ঘেরা অলিন্দ আছে?’

সায়ক বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’

কথাটা শুনেই কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নৌরজা সাহেব বললেন, ‘ওই মহলের নাম আয়েশা মহল। সম্রাট জাহাঙ্গির তার বাঁদি আয়েশাকে ওই মহল বানিয়ে দিয়েছিলেন। ওখানেই আমার পূর্বপুরুষ গোলাম হায়দার প্রথম কালা গুলাব ফুটিয়েছিলেন। কালো গোলাপ ফোটাবার গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য বাদশাহ জাহাঙ্গির দিল্লির লালকেল্লার পরিবর্তে আগ্রা কেল্লার ওই নিভৃতস্থানে বাগ নফরকে কালা গুলাব ফোটাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন।’

ওই মহলের নাম ও যেখানে কালো গোলাপ ফুটেছিল, এ কথা ইয়াসমিন নামক সেই তুর্কি রমণীর থেকে ইতিপূর্বে জানলেও তা প্রকাশ না করে সায়ক বলল, ‘তাই নাকি! আগে জানলে জায়গাটা আরও ভালো করে দেখতাম।’

নৌরজা আবার হাঁটতে শুরু করে বললেন, ‘জানেন, গোলাম হায়দার কেমনভাবে আয়েশা বাঁদির মহলে কালা গুলাব ফুটিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে আমাদের বংশপরম্পরায় চলে আসা কাহিনিটা যদি আগে বিশ্বাস করতাম তবে আগেই কালো গুলাব ফোটাতে পারতাম। আজ আমি বুঝেছি সে পদ্ধতিতেই কালো গোলাপ ফোটে।’

সায়ক বলল, ‘পদ্ধতিটা কী?’

সায়কের প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে নৌরজা সাহেব বললেন, ‘বাগানের দিকে কালো গুলাবটা একবার দেখতে যাবেন নাকি? আমিও বাইরে থেকে একটু আগে ফিরলাম। ওদিকে সারাদিন যাইনি।’

সায়ক উৎসাহ ভরে বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন।’

হাভেলিতে না ঢুকে বাগানে প্রবেশ করল তারা দুজন। তারপর গিয়ে উপস্থিত হল কাঁটাতার ঘেরা সেই জায়গার সামনে। তার চারপাশে সকাল-সন্ধ্যার মতো একইরকম নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। পাখির, কীটপতঙ্গের ডাকের শব্দ সায়কদের সঙ্গে চলতে চলতে এ জায়গার কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎই যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে তাদের পিছনে। সায়ক বলেই ফেলল—’এ জায়গাটা বাগানের অন্য জায়গার তুলনাতে এমন নিস্তব্ধ কেন?’

নৌরজা মৃদু হেসে বললেন, ‘হয়তো বা ওই কালো গোলাপের জন্য। কালো রং যে শুধু মানুষ অপছন্দ করে তা নয়। পাখি-কীট-পতঙ্গ-প্রজাপতি কাউকেই কালো রং আকৃষ্ট করে না। যে কারণে সাধারণত প্রকৃতিতে কোনো ফুলের রং কালো হয় না।’ কাঁটাতারের ভিতর ফুলটার দিকে তাকাল তারা দুজন। ইতিমধ্যেই ফুলগুলোর ভেলভেটের মতো পাপড়িগুলো সম্পূর্ণ কালো হয়ে গেছে! বাইরে কোথাও আর একবিন্দু লালচে রং দেখা যাচ্ছে না।

গোলাপটার দিকে একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হাসি ফুটে উঠল নৌরজা সাহেবের মুখে। সফলতার হাসি। তিনি বললেন, ‘যদি গুলাবের পাপড়ির ভিতর দিকে কোথাও লালচে ছিট থেকেও থাকে তবে তাও রাতের মধ্যেই কালো হয়ে যাবে। কাল ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই আমি এই গুলাব আপনার হাতে তুলে দেব টাকাটা নিয়ে।’

সায়ক বলল, ‘হ্যাঁ, টাকা তো আমার সঙ্গে আছে। যখনই আপনি গোলাপটা দেবেন তখনই দেব।’

কিছুক্ষণ সে জায়গাতে থাকার পর বাগান ছেড়ে হাভেলিতে ফেরার পথ ধরল তারা দুজন। হাভেলির বারান্দাতে উঠে এসে সায়ককে বিদায় জানাবার আগে নৌরজা বললেন, ‘যান, এবার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। কালা গুলাবটা পাবার জন্য আপনার মন যে ছটফট করছে তা আমি বুঝতে পারছি। ওইজন্যই আপনি ঘরে ঢোকার আগে আপনাকে কালা গুলাবটা দেখিয়ে আনলাম। আজ আর গতবারের মতো মাঝরাতে উঠে গুলাব গাছ দেখতে যেতে হবে না। ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরবেন।’

নৌরজা সাহেবের কথা শুনে সায়ক বলল, ‘কই, আমি গত রাতে বাগানে যাইনি তো!’

সায়কের কথা শুনে একটু চুপ করে থেকে নৌরজা সাহেব মৃদু বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘আপনি যাননি! আমি যেন গতকাল মাঝরাতে ওই কালো গুলাবের কাঁটাতারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। যদিও আমার পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত একটা রইস মুঘলি নেশা আছে আমার। আফিমের নেশা। তবে কি সেই নেশার ঘোরে দোতলার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি ভুল দেখলাম?’

নৌরজা সাহেবের কথা শুনে সায়কের মনে পড়ে গেল গত রাতের কথা। সে বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘আমিও গতকাল মাঝরাতে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে ওখানে একজনকে দেখেছি বলে মনে হয়েছিল। আমার তো মনে হয়েছিল তারকাঁটার ঘেরার বাইরে নয়, ভিতরেই সে ছিল! তবে সে কে, কীরকম দেখতে দূর থেকে আমি তা বুঝতে পারিনি। ভালো করে দেখতে না দেখতেই সে যেন মিলিয়ে গেল! আমি তো ভেবেছিলাম ওই দেখাটা আমার মনের ভুল!’

নৌরজা সাহেব, সায়কের কথার জবাবে বিস্মিতভাবে বললেন, দুজনের পক্ষে একইসময় একই ব্যাপার কীভাবে ভুল দেখা সম্ভব? তবে কি কেউ প্রাচীর ডিঙিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল? কিন্তু লোকটা যদি বাগানে ঢুকেও থাকে তবুও কাঁটাতারের ভিতরে ঢোকা তার পক্ষে কীভাবে সম্ভব? আগলের তালার চাবি তো আমার কাছে।’

চিন্তার স্পষ্ট ভাঁজ নেমে এল নৌরজা সাহেবের কপালে। এরপর তিনি সায়ককে বললেন, ‘ঠিক আছে আপনি এখন ঘরে যান। আপনার কোনো চিন্তা নেই। আমি সারারাত জেগে থাকব। বাগানের ওপর নজর রাখব।’ এদিকে চোর-ডাকাতের কোনো উপদ্রব নেই। হয়তো-বা কোনো ভবঘুরে-পাগল বা ভিখারি ধরনের লোক কাল রাতে কোনোভাবে বাগানে ঢুকেছিল, আবার চলে গেছে।

সায়ক ঘরে ফিরে এল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল একসময়। তারপর রাত। পরদিন কাকভোরে সায়ককে বিছানা ছাড়তে হবে। তাই রাত আটটা নাগাদ খাওয়া সেরে তার টুকিটাকি সামান্য যা জিনিস আছে তা তার ব্যাগে ভরে নিল সে। বিছানাতে শোবার আগে জানলা বন্ধ করার জন্য সে জানলার কাছে গেল। বেশ বড়ো চাঁদ উঠেছে আকাশে। পূর্ণিমার চাঁদ। তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে বাগানে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সেই কাঁটাতার ঘেরা জায়গাটা, যার মধ্যে ফুটে আছে কালো গোলাপ। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জানলার পাল্লা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সে।

সায়কের ঘুম ভেঙে গেল শেষ রাতের দিকে। হয়তো-বা ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গোলাপটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ার উত্তেজনাতেই তার ঘুম ভাঙল। সেল ফোনে সময় দেখল সায়ক। রাত সাড়ে তিনটে বাজে। গ্রীষ্মে ভোর চারটের পর থেকেই আলো ফুটতে শুরু করে এসব অঞ্চলে। অর্থাৎ আলো ফোটার আর বেশি সময় বাকি নেই। আর এক ঘণ্টা তো দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। পাছে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, উঠতে দেরি হয়ে যায় তাই সায়ক বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল। চানঘরে গিয়ে চোখ-মুখ ধুয়ে সায়ক তৈরি হয়ে নিল ভোরের আলো ফুটলে বাইরে বেরবার জন্য।

জানলার কাছে গিয়ে পাল্লা খুলল সায়ক। আকাশের চাঁদ তার শেষ আলো ছড়াচ্ছে ম্রিয়মাণ হয়ে যাবার আগে। এক অদ্ভুত উজ্জ্বল মায়াবী আলো। আর সেই আলোতে উদ্ভাসিত আগ্রা নগরীর প্রান্ত-সীমায় যমুনা নদীর তীরে নৌরজা সাহেবের গোলাপবাগ। যেখানে ‘কালা গুলাব’ ফুটিয়েছেন তিনি।

সায়ক তাকাল কাঁটাতার ঘেরা সেই জায়গার দিকে। আর সেদিকে তাকিযে সায়কের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। গত রাতের মতোই কাঁটাতার ঘেরা জায়গাটার ভিতর দাঁড়িয়ে আছে একজন মানুষ। না, সায়কের আজকের দেখায় কোনো ভুল নেই। কেউ একজন নিশ্চিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে ঘেরা জায়গার ভিতরে। এতটা দূর থেকে সায়কের পক্ষে তার মুখমণ্ডল বোঝা সম্ভব না হলেও, যে দাঁড়িয়ে আছে সে যে নৌরজা সাহেব নয় তা তার অবয়ব দেখে বুঝতে পারল সায়ক। তবে ও কে?

সায়ক তাকিয়ে রইল তার দিকে। হ্যাঁ, সেই ছায়ামূর্তির মতো লোকটা যেন কয়েকবার নড়েও উঠল!

হঠাৎ সায়কের মনে হল, ওই ছায়ামূর্তি কালো গোলাপটা চুরি করতে আসেনি তো?

আর তারপরই সায়ক ভাবল, নৌরজা সাহেব কোথায়?

তিনি তো রাতে জেগে থাকবেন বলেছিলেন, তিনি কি দেখতে পেয়েছেন লোকটাকে?

ঘড়ি দেখল সায়ক, পৌনে চারটে বাজে। কিন্তু নৌরজা সাহেব যদি ওই লোকটাকে না দেখে থাকেন তবে তা তাকে দেখানো প্রয়োজন। বলা যায় না কোনো অসাধু উদ্দেশ্য নিয়ে পরপর দু-রাত বাগানে প্রবেশ করতে পারে লোকটা। সায়কের মনে হল, নৌরজা সাহেব যদি তার ঘর থেকে ব্যাপারটা খেয়াল না করে থাকেন তবে ব্যাপারটা তাকে জানানো প্রয়োজন। কথাটা ভেবে সায়ক দরজার দিকে এগোল। দরজা খোলার আগে ব্যাগটাকে তুলে নিল সে। টাকা আছে ব্যাগটাতে। সেটা ঘরে রেখে যেতে মন চাইল না তার। ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে দরজা খুলে সায়ক বারান্দাতে বেরিয়ে এল। সায়ক দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকে এগোতে যাচ্ছিল কিন্তু সে দেখতে পেল বাইরে চাঁদের আলোতে নৌরজা সাহেব হাভেলি থেকে জমিতে নেমে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পিছনের বাগানের দিকে। সায়কের মনে হল নৌরজা সাহেব সম্ভবত দেখতে পেয়েছেন সেই রহস্যময় মূর্তিকে। সে জন্যই তিনি বাগানের দিকে গেলেন। অথবা ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই বলে হয়তো তিনি কালো গোলাপটা তুলে আনার জন্য সেদিকে এগোচ্ছেন। সায়ক নেমে পড়ল বারান্দা থেকে। তারপর নৌরজা সাহেব যেদিকে এগোলেন সায়কও এগোল হাভেলির পিছনের অংশের সেই গুলাববাগের দিকে।

বাগানে প্রবেশ করে সায়ক দেখল সেই ঘেরা জায়গার দিকে এগিয়ে চলেছেন নৌরজা সাহেব। তার পিছনে পিছনে কিছুটা তফাতে সায়কও চলল। কাঁটাতার ঘেরা জায়গাটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে তার চোখে। সায়ক একসময় এ ব্যাপারে নিশ্চিত হল যে তার দেখাটা ভুল ছিল না। হ্যাঁ একজন সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে কাঁটাতার ঘেরা জায়গাটার ভিতর! যে দাঁড়িয়ে আছে তার অবয়ব দেখে সায়কের মনে হল সে একজন নারী!

নৌরজা সাহেব জায়গাটার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। সায়ক এগিয়ে গিয়ে নৌরজা সাহেবের কিছুটা পিছনে একটা গোলাপ ঝোপের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। সায়কের উপস্থিতি খেয়াল করেননি নৌরজা সাহেব। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বিস্মিতভাবে তিনি তাকিয়ে আছেন কাঁটাতার ঘেরা ঘরের মতো জায়গাটার দিকে। সায়ক যেখানে দাঁড়িয়ে তার হাত পঁচিশ দূরে কাঁটাতার ঘেরা জায়গার ভিতরটা চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার ভিতর দাঁড়িয়ে আছে একজন নারী। তার পরনে সাদা পোশাক। তবে একটা কালো ওড়না দিয়ে তার মুখমণ্ডল আবৃত। মাটিতে পোঁতা যে কাঠের দণ্ডটাকে আবৃত করে গোলাপ গাছটা দাঁড়িয়েছিল সেটা এখন মাটিতে পড়ে আছে। লতানো গোলাপ গাছটা নারী শরীরকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা বলা যেতে পারে ওই অবগুণ্ঠনবতী নিজের শরীরে পেঁচিয়ে নিয়েছে সেটা। আর গাছের মাথায় ফোটা কালো গোলাপটাকে ধবধবে সাদা হাতে সে ধরে রেখেছে ঠিক নিজের বুকের মাঝখানে! ঘেরা জায়গার আগল কিন্তু তালা দেওয়া। নৌরজা সাহেব তার প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সেই নারী মূর্তির উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কে তুমি?’

প্রথমবার প্রশ্ন শুনে সেই নারী মূর্তি কোনো জবাব দিল না। শুধু তার ধবধবে সাদা হাতের আঙুলগুলো কালো গোলাপটার পাপড়িগুলোর উপর রাখল।

নৌরজা আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘কে তুমি? জবাব দিচ্ছ না কেন? ভিতরে ঢুকলে কীভাবে?’

এবার খিলখিল করে হেসে উঠে সেই নারী মূর্তি বলে উঠল, ‘সে কী! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না! কতদিন হয়ে গেল আমি তোমার কাছে আছি। আমার কাছে এসো। তুমি ঠিক চিনতে পারবে আমাকে।’

সেই রহস্যময়ীর কথা শুনে নৌরজা বললেন, ‘কী বাজে বকছ! মুখ থেকে পরদা সরাও। দেখি তুমি কে?’

আবারও প্রথমে খিলখিল করে হেসে উঠে সে নারী প্রথমে বলল, ‘আমি তো দেখাতেই চাই আমি কে; তুমি দেখলেই আমাকে চিনবে। এসো, ভিতরে ঢোকো, আমার কাছে এসো।’

এ কথা বলার পর সেই অবগুণ্ঠনা একটু রুক্ষভাবে বলল, ‘আর যদি না আসো তবে দেখো কী হয়?’

‘কী হবে তবে? তোমাকে আমি আর বাইরে বেরতে দেব না। আলো ফুটলেই পুলিশ ডেকে চুরির অভিযোগে তোমাকে তাদের হাতে তুলে দেব। এখনও বলছি, ওড়না সরাও।’

নৌরজা সাহেবের কথার জবাবে সেই নারী কঠিন স্বরে বলল, ‘আমাকে আজ আর কিছু করার ক্ষমতা তোমার নেই। আমার কাছে না এলে কী হয় দেখো— এই বলে সে নৌরজা সাহেব আর সায়ককে হতবাক করে সেই দুর্মূল্য-দুষ্প্রাপ্য কালো গোলাপ থেকে একটা পাপড়ি ছিড়ে ফেলল।

সেই দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠলেন নৌরজা। রহস্যময়ী সেই নারী এরপর দ্বিতীয়বার গোলাপের আর একটা পাপড়ি ছিড়তে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই নৌরজা আতঙ্কিতভাবে বলে উঠল ‘ছিঁড়ো না ছিঁড়ো না, গুলাবটা নষ্ট করো না। আমি আসছি।’ তার কথা শুনে থেমে গেল সেই নারী।

নৌরজা সাহেব ওই নারীর কবল থেকে গোলাপটা রক্ষা করার জন্য এগিয়ে গেলেন কাঁটাতার ঘেরা জায়গাটার দিকে। বিস্মিত সায়ক তার কী করা উচিত বুঝতে না পেরে একই জায়গাতে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল সামনের দিকে। সে দেখল নৌরজা সাহেব তার পোশাকের ভিতর থেকে চাবি বার করে আগলের তালাটা খুলে ফেললেন। তারপর ভিতরে প্রবেশ করে মুখ ঢাকা সেই নারীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। মাথার উপরের চাঁদের ঔজ্জ্বল্য হঠাৎই যেন এবার কমতে শুরু করল। নৌরজা সাহেব সেই নারীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘দাও, গোলাপটা আমাকে দাও।’

সেই নারী হেসে বলল, ‘গোলাপ নেবার আগে জানবে না আমি কে? সেটা জেনে নাও।’

কথাটা শুনে নৌরজা সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো তুমি কে? আর গুলাবটা দাও।’

কালো ওড়নাতে মুখ ঢাকা নারী মুহূর্তের জন্য চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি হলাম সে। যে তোমাকে তোমার পূর্বপুরুষের আগ্রা কেল্লাতে বাঁদি মহলে গোলাপ ফোটাবার কাহিনি শুনিয়েছিল। কাহিনি মিলে গিয়েছিল বংশপরম্পরায় তোমার পূর্বপুরুষদের বলা বাগ নফর হায়দারের গোলাপ ফোটাবার কাহিনির সঙ্গে। আর দুটো কাহিনি মিলে যাওয়াতে শেষপর্যন্ত যাকে দিয়ে তুমি কালো গোলাপ ফোটালে সে আমি।’

বিস্মিত সায়ক স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে তাদের দুজনের কথোপকথন। ওই নারীর কণ্ঠস্বর এবার যেন কেমন চেনা মনে হল সায়কের।

মুখ ঢাকা সেই রমণী এরপর বলল, ‘হ্যাঁ, আমি সেই। যে তোমার গোলাপ বাগান দেখতে এসে আর কোনোদিন এই বাগান ছেড়ে বাইরে বেরতে পারেনি, যে হারিয়ে গিয়েছিল, ঠিক যেমন কালো গোলাপ ফোটাবার জন্য আগ্রা কেল্লার সেই বাঁদি মহল থেকে হারিয়ে গিয়েছিল জাহাঙ্গিরের রূপসী বাঁদি আয়েশা।’

আর এ কথা বলার পরই মুখের অবগুণ্ঠন সরিয়ে ফেলল সেই নারী। অপস্রিয়মাণ চাঁদের আলোতে সায়ক স্পষ্ট চিনতে পারল তাকে। আরে এ যে আগ্রা কেল্লার বাঁদি মহলে সায়কের সঙ্গে দেখা হওয়া তুর্কি যুবতী ইয়াসমিন!

আর সেই যুবতীও ওড়না সরিয়ে নৌরজা সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল, ‘এবার নিশ্চয়ই তুমি আমাকে চিনতে পারছ? আমি ইয়াসমিন।’

সায়কের মনে হল সেই তুর্কি যুবতীর মুখ দেখে যেন প্রথমে একটু কেঁপে উঠলেন নৌরজা। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি নিজেকে সংযত করে বলে উঠলেন, ‘দাও কালা গুলাবটা আমাকে দাও। তুমি ইয়াসমিন সেজে আমাকে ধোঁকা দিতে এসেছ। তুমি ইয়াসমিনের হামসকল হতে পারো। কিন্তু তুমি ইয়াসমিন নও। কারণ আমি নিজের হাতে লতানো গোলাপ ডালের ফাঁস দিয়ে তাকে…।’

নৌরজা সাহেব তার কথাটা আর শেষ না করে কালো গোলাপটা মেয়েটার হাত থেকে ছিনিয়ে নেবার জন্য হঠাৎই মেয়েটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুচড়ে ধরল তার গোলাপ ধরা হাত। মুহূর্তের মধ্যেই তাদের দুজনের মধ্যে ঝটাপটি শুরু হল। আর সেই ধস্তাধস্তির মধ্যে উড়তে লাগল কালো গোলাপের পাপড়িগুলো! টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে নৌরজা সাহেবের অতি যত্নে ফোটানো বসরাই কালা গুলাব। আর এরপরই মুহূর্তের মধ্যে এক অভাবনীয় ভয়ংকর দৃশ্য দেখল সায়ক। সে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ইয়াসমিন কোথায়! নৌরজাকে নাগপাশের মতো জড়িয়ে ধরেছে কালো গোলাপের গাছটা! যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে সে গাছ! নৌরজা সাহেব আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তার কবল থেকে মুক্ত হতে, কিন্তু পারছেন না। গোলাপের কাঁটাতে রক্ত ঝরছে নৌরজা সাহেবের শরীর-মুখমণ্ডল থেকে। জীবন্ত হয়ে ওঠা কালো গোলাপ গাছের শেষ অংশটা ঠিক যেন দড়ির ফাঁসের মতোই চেপে বসেছে তার গলাতে। তিনি দু-হাতে সেটা খোলার চেষ্টা করেও কিছুতেই সেটা খুলতে পারছেন না। সেই ফাঁস ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে নৌরজা সাহেবের চোখ। জিভ বেরিয়ে পড়ল নৌরজা সাহেবের! আর এরপরই যেন চাঁদ মুছে গিয়ে অন্ধকার নেমে এল চারদিকে। কিছুক্ষণের জন্য যেন সায়কের চোখের সামনে থেকে মুছে গেল সবকিছু। সে শুধু দাঁড়িয়েই আছে, কিন্তু যেন তার কোনো চেতনা নেই, কোনো অঙ্গ নাড়ানোর ক্ষমতা নেই। যে ভয়ংকর, অবিশ্বাস্য দৃশ্য তার চোখের সামনে ঘটল তা যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত করেছে সায়ককে।

একসময় সেই গাঢ় অন্ধকার কেটে গিয়ে আস্তে আস্তে আবছা আলো ফুটতে শুরু করল। পুব আকাশে জেগে উঠেছে শুকতারা। আর ধীরে ধীরে সায়কও যেন মনের শক্তি কিছুটা হলেও ফিরে পেল। আলো কিছুটা স্পষ্ট হলে সায়ক দেখল সেই কাঁটাতার ঘেরা জায়গাটার মধ্যে পড়ে আছেন নৌরজা সাহেব। লতানো গোলাপ গাছটা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তার শরীর। আর গোলাপের ছিন্নভিন্ন কালো পাপড়িগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে নৌরজা সাহেবের চারপাশে।

নৌরজা সাহেব কি বেঁচে আছেন? তা দেখার জন্য কাঁটাতার ঘেরা জায়গার দিকে এগোতে যাচ্ছিল সায়ক। কিন্তু একটা কণ্ঠস্বর তাকে থামিয়ে দিল— ‘ওদিকে এগোবেন না।’

চমকে উঠে সায়ক তাকিয়ে দেখল গোধূলির আলো-আঁধারিতে কিছুটা তফাতে তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই তুর্কি সুন্দরী ইয়াসমিন!

সায়ক তাকে দেখে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, ‘নৌরজা সাহেব কি মারা গেছেন? যা দেখলাম তা কি সম্ভব? গোলাপ গাছটা ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলল নৌরজা সাহেবকে!’

ইয়াসমিন বলল, ‘হ্যাঁ। নৌরজা মারা গেছে। ঠিক এভাবেই তো ফাঁস দিয়ে সেও মেরেছিল একজনকে।’

সায়ক কথাটা শুনে কেঁপে উঠল।

ইয়াসমিন তা দেখে বলল, ‘আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে এ জায়গা ছেড়ে যেতে হবে আপনাকে দিনের আলো ফোটার আগেই। আসুন আমার সঙ্গে আসুন, আমি বাইরে কিছুটা পথ আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি। যাতে কেউ এই হাভেলিতে আসার আগেই আপনি এ স্থান ত্যাগ করতে পারেন। আসুন আমার সঙ্গে—।’

সেই নারীর কথার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা সায়ক অগ্রাহ্য করতে পারল না। ইয়াসমিনকে সে অনুসরণ করল। সেই গোলাপবাগ, সেই হাভেলি ত্যাগ করে আধো-অন্ধকার রাস্তায় নামল তারা দুজন।

প্রথমে নিশ্চুপভাবে পাশাপাশি হেঁটে চলছিল তারা। ক্রমশ মুছে যেতে শুরু করল অন্ধকার। ইয়াসমিন একসময় নিজে থেকেই বলল, ‘আমি দুঃখিত আপনাকে ওই কালো গোলাপটা না নিয়েই ফিরে যেতে হচ্ছে বলে। গোলাপটা আপনাকে দিতে পারলাম না বলে। কারণ, আমি চাই না যে কালো গোলাপ দেখে আর কেউ এই কালো গোলাপের প্রতি আকৃষ্ট হোক। আর তাদের হাতে ওই গোলাপ তুলে দেবার জন্য গোলাম হায়দার বা নৌরজারা অন্যের প্রাণের বিনিময়ে কালো গোলাপ ফোটাক।’

তুর্কি যুবতীর কথা শুনে সায়ক বলল, ‘অন্যের প্রাণের বিনিময় মানে?’

ইয়াসমিন বলল, ‘নৌরজা আপনাকে বলেছিলেন যে কালো গোলাপ ফোটাবার জমি তৈরিটাই আসল তাই না?’

সায়ক বলল, ‘হ্যাঁ’।

ইয়াসমিন বলল, ‘ঠিকই বলেছিল নৌরজা। তবে কী জিনিস সার হিসাবে জমিতে মিশিয়ে গোলাম হায়দার বা নৌরজা কালো গোলাপ ফুটিয়েছিল তা আপনাকে বলেনি সে।’

সায়ক বলল, ‘না, বলেননি।’

ইয়াসমিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর একটু হেসে বলল, ‘যে কোনো গোলাপ ফোটাবার বা গোলাপ চাষের ব্যাপারে আপনার যদি অভিজ্ঞতা থাকত তবে আপনি জানতেন যে গোলাপ চাষের জমি তৈরির জন্য সর্বোত্তম সার হল— ‘বোন ডাস্ট’ অর্থাৎ বিভিন্ন প্রাণীর হাড়ের গুঁড়ো। আর এ দেশের মাটিতে কালো গোলাপ ফোটাবার জন্য জাহাঙ্গিরের বাগ নফর আর নৌরজা সার হিসেবে যা ব্যবহার করেছিলেন তা হল সুন্দরী রমণীর হাড়ের গুঁড়ো। আর তা সংগ্রহ করার জন্য গোলাপ হায়দার খুন করেছিল সুন্দরী বাঁদি আয়েশাকে, আর নৌরজা খুন করল আমাকে। আমি শুয়ে আছি এই গোলাপ গাছের নীচে।’

কথাটা শুনেই চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে সায়ক পাশে তাকাল। কিন্তু তার পাশে কেউ নেই। সুন্দরী তুর্কি যুবতী ইয়াসমিন যেন মুহূর্তের মধ্যে বাতাসে মিলিয়ে গেছে! না, সায়কের চারপাশে কেউ নেই! আর ঠিক তার পরমুহূর্তেই যমুনা নদীর বুকে সূর্যোদয় হল। ভোরের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। সামনের রাস্তার বাঁকে ঘোড়ার গলার ঘণ্টার টুংটাং শব্দে দেখা দিল তাকে নিতে আসা আনোয়ারের টাঙ্গা। সায়কের চোখে পড়ল ইয়াসমিন ঠিক যে জায়গা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল, সেখানে রাস্তার উপর পড়ে আছে গোলাপের একটা পাপড়ি! কালো গোলাপের পাপড়ি!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *