গৃপ্রকূট

গৃপ্রকূট

বোধগয়া থেকে ছেষট্টি কিলোমিটারের মতো অ্যামবাসাডরে। তিনটি জাপযুবক, একটি বাঙালি দম্পতি। জাপানিদের তীর্থযাত্রা, দম্পতির মধুচন্দ্রিমা। বৈভার,। বিপুল, রত্নগিরি, উদয়গিরি, শৈলগিরিতে ঘেরা পাঁচ-পাহাড়ি এই বৌদ্ধ তীর্থে দু ধরনের যাত্রা কী অনায়াসে মিলে যায়।

ডিসেম্বরের দাঁত-কাঁপানো কুয়াশার ভেতর থেকে রোদ-ঝলমলে সকাল আস্তে আস্তে ফুটে বেরোচ্ছে। নরম রোদ। শালুক ফুলের মতো নম্র, নরম।

পাঁচজনের মধ্যে অন্তত চারজন কী রকম একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। বুদ্ধে বুদ্ধে ছয়লাপ। তিববতি বুদ্ধ, থাই বুদ্ধ, নেপালি বুদ্ধ, ভুটানি বুদ্ধ, আর জাপানি বুদ্ধ মন্দিরের সেই আকাশচুম্বী বুদ্ধিমূর্তি।

বুলা জন্মেছে জুরিখে। এক পৃথিবীচর পরিবারের মেয়ে সে। বাবার সঙ্গে ছোটোবেলায় কত যে ঘুরেছে। ভারতবর্ষ তো বটেই, ভারতের বাইরেও।

নৈনিতাল, রানিক্ষেত্র, কৌশানি?

হ্যাঁ।

কুলু-মানালি-চম্বা?

হ্যাঁ।

মুসৌরি-দেরাদুন!

কতবার।

পূর্ণিমায় তাজমহল, মাৰ্বল রকস।

অবশ্যই।

অজন্তা-ইলোরা-ঔরঙ্গাবাদ-গোয়া?

সব। সব।

সবই বুলার যাওয়া, দেখা, কোনো কোনোটা একাধিকবার। অমন যে বিশাল দাক্ষিণাত্যের মালভূমি—তারও পুঙ্খানুপুঙ্খ তার দেখা।

তাহলে তো তোমাকে হংকং নিয়ে যেতে হয়।

হংকং তো বাজার-নগরী। বিয়ের বাজার তো ওখান থেকেই করলাম। না হলে তোমার নাইকন ক্যামেরা, লেটেস্ট মডেলের রোলেক্স ঘড়ি, অ্যামস্টারডামের হিরের আংটি, সার্জিয়ো ভ্যালেনটাইনোর শেভিং কিট, ম্যানিকিয়োর সেট কোথা থেকে আসত?

তবে কি সুইজারল্যান্ড? সে তো আমার ক্ষমতায় আর ইহজীবনে কুলোবে না!

এই জায়গায় বুলা সতর্ক হয়ে যায়। ইচ্ছা প্রকাশ করলে যে বাবা সুইজারল্যান্ডের ব্যবস্থাটাও করে দিতে পারেন এ কথাটা কি বলা যায়? এতে তো কুমারেশের অমর্যাদা! কুমারেশের হলে অমর্যাদাটা তারও হয়। এই কথাটুকু ধনীর দুলালি হলেও সে মোক্ষম বোঝে। মলম-মাখানো গলায় সে বলে—আহা! সুইজারল্যান্ড কেন? অরোরা বেরিয়ালিস দেখতে নিয়ে যাওয়াও হয়তো একদিন তোমার হাতের পাঁচ হয়ে দাঁড়াবে! কে বলতে পারে?

নাঃ—কুমারেশ মনমরা গলায় বলে।

কেন যে ও ওরকম নঞর্থক চিন্তা করে? বুলা তো সমানেই উৎসাহ দিয়ে যায়।

সে অগত্যা বলে, দূর, জায়গাটা সুন্দর হলেই হল। আর নতুন। নতুন হলেই ভালো হয়। ব্যস।

বিদেশি ইলেট্রনিক্স গুডস-এর লোক্যাল এজেন্ট কুমারেশকে তার বিয়ে করার কথাই নয়।

এ নিয়ে অশান্তি কি কম হয়েছে?

একটা স্ট্রোকের পর বাবা এখন অবসর নিয়েছেন। একটু বেশিই দুশ্চিন্তা করেন। বলেছিলেন, কী পরিচয় ওর আমি দেব?

মা বলেছিলেন, আহা, এম. কম. ডিগ্রিটা তো আছে? উদ্যমী হলে ওইখান থেকেই ও উন্নতি করবে। আমি ও দিকটা ভাবছি না। ছেলেটার আপনজন বলে কেউ নেই। কুটুম বলে কিছু থাকবে না?

ওটা একটা কথা হল? যত আপনার জন থাকবে ততই কমপ্লিকেশন বাড়বে। আপনার জন তো আমরাই হতে পারি। ছেলে তো বড়ো বংশেরই। হাটখোলার দৌহিত্র বংশ। কিন্তু আসল যে উদ্যমের কথা বললে, সেটাই ছেলেটার নেই। লোক তো কম চরালাম না জীবনে! আমরা বুঝতে পারি।

একশোবার, মা বলেছিলেন, তবে এ কথাও সত্যি যে মেয়েকে যদি কাছে রাখতে চাও তো এর চেয়ে ভালো পাত্র পাওয়া শক্ত। স্বাস্থ্য ভালো, চেহারা তো রূপকথার রাজপুত্র!

ওই দেখেই তো বুলাটা ভুলেছে।

বুলার সামনেই আলোচনা হচ্ছিল। সে এই সময়ে ফোঁস করে ওঠে, তুমি ভোলনি? মা ভোলেনি? কী চমৎকার কথাবার্তা! রাজপুত্রের মতো চেহারা!–বলোনি?

 তা বোধহয় বলে ফেলেছি, আবছাভাবে হলেও মনে পড়ছে—বাবা স্বীকার করেছিলেন। মা স্মিত মুখে চুপ।

তবে? দোকানদার শুনেই চুপসে গেলে?—বুলা বেশ চোখা চোখা কথা ব্যবহার করতে ভালোবাসে।

বাবা হেসে ফেলেন, সত্যিই তোর এত পছন্দ? হাবুডুবু খাচ্ছিস? না কী?

খাচ্ছিই তো!

আর ও? ও কী খাচ্ছে?

ও বিষম খাচ্ছে। বলছে কোনোদিন যদি উন্নতি করতে পারে, আ চেন অফ শো রুমস ইন অল দা বিগ সিটিজ অফ ইন্ডিয়া, সে দিনই ও আমাকে প্রোপোজ করার কথা ভাবতে পারে!

কথাটা তো ঠিকই বলেছে। কাণ্ডজ্ঞানটা তাহলে আছে।

হয়তো বম্বে, দিল্লি, মাদ্রাজ, সরি, মুম্বই, দিল্লি, চেন্নাইয়ে দোকান-শৃঙ্খল ওর হবে বাবা। তবে তখন আর আমি বিবাহযোগ্য থাকব না। আমিও তখন তোমারই মতো রিটায়ার্ড।

মেয়ের কথার ধরনে বাবা-মা হেসে ফেলেছিলেন। একমাত্র সন্তান, কত আদরের। তার কথা কি শেষ পর্যন্ত ফেলতে পারেন?

তা জামাই দেখে সব ধন্য-ধন্যই করেছিল। বুলাও খুব জ্বলজ্বলে চেহারার মেয়ে। দু-তিন পুরুষে ধনীর ঘরে যেমন হয়। ফর্সা রং, বড়ো বড়ো চোখ, চোখা নাক। কিন্তু কুমারেশের রূপ একেবারে অন্য গোত্রের।

বেড়াতে বোররাতে ওদের একটু দেরিই হয়ে গেল। প্রথমত কুমারেশ তার বিয়ের যৌতুক পাওয়া ল্যান্সডাউনের শো রুমটা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিল। দ্বিতীয়ত প্রচণ্ড গরম। ডিসেম্বরের গোড়া এখন। যখন দেখা গেল ভারতের সব বিখ্যাত রূপমহলই বুলার দেখা, তখন কুমারেশ এই চমৎকার ভ্রমণসূচিটি তার মাথা থেকে বার করে।

গিরিডি গিয়েছো? ফুলডুংরি? রাজরাপ্পা? রাজগির?

এত কাছে, অথচ বুলা যায়নি। সুতরাং সব ঠিকঠাক করে গর্বিত হাসি হেসে কুমারেশ বলে, চলো যাই বিহারে।

নির্জনতার খোঁজে সে তার বউকে নিয়ে অদ্ভুত সব রোমাঞ্চকর জায়গায় ঘুরবে। বুনো ঝোরার ধারে ছিন্নমস্তার মন্দির, শাল-মহুয়া-পলাশ-পাইনের জঙ্গলে ছাওয়া ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট যেখানে ভালুকের ভয় আর সূর্যোদয়ের রোমাঞ্চ দুটোই সমান উপভোগের, পাহাড়ের ঢালে পাখির কলকাকলিতে ভরা নিঃসঙ্গ লেক…

কিন্তু আশ্চর্য কথা উশ্ৰী ফলসে ওরা অভীষ্ট নির্জনতা পেলই না। ফলসটাকে ঘিরে কত যে পিকনিক পার্টি। কত যে রকম-বেরকমের পোজ আর সেই সঙ্গে ক্যাসেটের কী যে মস্তানি! তবে কুমারেশের মতো গোমড়া মুখে বুলা বসে থাকেনি। সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পিকনিক পার্টিদের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে, উশ্রীর এলোচুলের ধারায় চান করে যথাসম্ভব মজা করে নিয়েছে। উশ্রী বড়ো ভয়ংকরী। ওখানে চানটান করা বিপজ্জনক। ওরা দেখেছিল সেই স্পটটা যেখান থেকে পা ফসকে পড়ে বোল্ডারের পর বোল্ডারের ধাক্কা খেতে খেতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ভেসে গিয়েছিল একটি বেপরোয়া ছেলে মাত্র মাস তিনেক আগে।

তবু বুলা তাকে নামিয়েছিল, নিজে তো নেমেছিলই। একবার নামবার পর কুমারেশেরও নেশা ধরে গিয়েছিল। আর একটা, আরও একটা পাথরে যাবার জন্য ছটফট করছিল সে।

এই সময়ে একজন পেছন থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, অনেক হয়েছে দাদা, খুব বীরপুরুষ আপনি, আর এগোলে নিজে যদি বাঁচেনও, বধূহত্যার দায়ে পড়বেন নির্ঘাত।

কুমারেশ ভয় পেয়ে যায়, প্লিজ বুলা এবার ফেরো।

ওঃ, তুমি এক ভীতু!–বুলা ঝাঁকিয়ে ওঠে। কিন্তু বুদ্ধগয়ার সেই অশোকের-আরম্ভ-করা কানিংহানের-শেষ-করা মন্দির, শ্রীলঙ্কা থেকে আনা বোধিবৃক্ষের ছায়া আর আকশেছোঁয়া বুদ্ধমূর্তি দেখে ও কেমন ঘোরে আছে। জাপানি ছেলেগুলির মধ্যে তোসিকোই একমাত্র একটু ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে, দু-দিন বোধগয়ার আই.টি.ডি.সি-র হোটেল অশোকে থাকাকালীন বুলা ওর কাছে থেকে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে অনেক জাপানি জ্ঞান সঞ্চয় করছিল এবং ওকে তথ্য দিচ্ছিল।

ওই দেখো ওই গৃধকূট—ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলল বুলা।

ড্রাইভার বলল, বহি গৃধকূট, মেমসাবনে ঠিক বোলি।

তুমি চিনলে কী করে?—কুমারেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। বুলা হাতটা মাছি ওড়াবার ভঙ্গিতে নেড়ে বলল, দেখলেই তো বোঝা যায়। শকুনের পিঠের ঢালটা তার পর মাথার গোল আর বাঁকানো ঠোঁটের শেপ দেখলেই চিনতে পারা যায়। লম্বা গলাটা নেই।

তোসিকোদের যতই দেখায় সে, তারা চিনতে পারে না, কুমারেশ তো নয়ই।

রাজগিরের টুরিস্ট বাংলোয় বুকিং ছিল। পা দিয়েই কুমারেশ খুশি হয়ে উঠল। সারা দোতলাটায় এক বৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি ছাড়া কেউ নেই। জাপানি তিনজন নীচে। ব্যাস।

এই নাও তোমার নির্জনতা।–কুমারেশ হেসে উঠল।

আমার নির্জনতা মানে? লোকজন হইচই আমার সবসময়ে ভালো লাগে। নির্জনতা তোমারই বেশি দরকার মনে হচ্ছে। এমন করছ যেন কোনোদিন আর

আমাকে একা পাবে না।

ভ্রূভঙ্গি করে বুলা কুমারেশের কাছে ঘেঁষে আসে। তার মাথা কুমারেশের কাঁধ ছাড়িয়ে, মুখটা উঁচু করে সে আয়নার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে, দেখো দেখো!

আসল তোমাকে দেখব, না তোমার ছায়া দেখব?

আমাকেও না, আমার ছায়াও না, খাজুরাহোর ওই মিথুন-মূর্তি দেখো আয়নার

এমন একটা মুগ্ধ আকুলতার সঙ্গে সে কথাগুলো বলে যেন সত্যিই কোনো শিল্পকৃতি দেখছে, যেন এক দম্পতির ক্ষণ-মিলনের দৃশ্য থেকে সত্যিই সে শাশ্বত মিথুনের কোনো দর্শনে পৌঁছে গেছে।

মনে হচ্ছে না আমরা অনেক আগের যুগে ফিরে গেছি? বলতে বলতে শিউরে ওঠে বুলা।

…রাজগৃহ থেকে রাজগির। রাজগিরের পথে-পথে পায়ে-পায়ে ইতিহাস। গাইড বলছিল, অজাতশত্রু রাজা এই শহরের নাম দেন গিরিজ।

না তো! বুলা বলে, গিরিব্রজই আগেকার নাম। জরাসন্ধের সময়ে মানে মহাভারতের কালেই গিরিব্রজ নাম ছিল। রাজগৃহ নাম তো বিম্বিসারের সময় থেকেই।

জাপানিদের সে বুঝিয়ে দেয়। ওরা পাঁচজনে এই গাইডের শরণ নিয়েছে।

এই হল অজাতশত্রুর দুর্গা পথের আশেপাশে ভগ্ন প্রাচীন প্রাচীরের ধবংসাবশেষ দেখিয়ে গাইড বলে।

না তো! অজাতশত্রুর দুৰ্গটা পাটলিপুত্র মানে পাটনায়। বৈশালীর ঠিক উলটো দিকে স্ট্রাটেজিক পয়েন্টে দুৰ্গটা করেন অজাতশত্রু। এ দুর্গ তো মহারাজ বিম্বিসারের করা। অজাতশত্রু তাতে হয়তো কিছু যোগ করেন।

ইউ সিম তু নোলত হিসত্রি? তোসিকো শ্রদ্ধার চোখে তাকায়, ইউ স্তাদি?

বুলা হেসে মাথা নাড়তে থাকে। না না, সে কিছুই জানে না। ক-টা কথা বলেছে বলেই এরা তাকে পণ্ডিত ঠাউরে নিয়েছে।

মূল রাস্তা তো দুটো? ওমা ওই তো বেণুবন, ঢুকব না আমরা? সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে।

গোছা গোছা বাঁশগাছ ফোয়ারার মতো আকার নিয়ে ওপরে ঠেলে উঠছে, ঠিক, ওটাই বেণুবন।

তবে যে বললে রাজগিরে আগে আসোনি?–কুমারেশ জিজ্ঞেস করে।

আসিনিই তো। হয়তো পড়েছি। হয় তো পড়িনি.মুখে রহস্য মেখে কুমারেশের দিকে তাকায় বুলা।

মস্ত বড়ো ফলকের ওপর বেণুবনের পরিচয় লেখা এই বেণুবন বা বেলুবন ছিল লর্ড বুডটাকে মহারাজ বিম্বিসারের প্রথম উপহার। জীবনের বারোটি বছর বেণুবনে দেশনা করেন লর্ড বুডটা। অনুপম সৌন্দর্যের জন্য বেণুবন ছিল তাঁর বিশেষ প্রিয়।

বাঁশগাছগুলো গোছা গোছা করে লাগিয়ে মন্দ দেখাচ্ছে না অবশ্য। কিন্তু এমনকী সৌন্দর্য আছে এর, বুঝলাম না—কুমারেশ বলে।

তুমি কী মনে করেছ শুধু বাঁশগাছ দিয়ে বেণুবন সাজানো ছিল? বেণুর সৌন্দর্য অনুভব করে বিম্বিসারের বনবিভাগ বেণুর একটু প্রাচুর্যই রেখেছিলেন অবশ্য। কিন্তু আরও বহুরকম গাছ ছিল এ বাগানে। ফুলের তো সীমাসংখ্যা নেই। এত সুন্দর ছিল এ বাগান যে বিম্বিসার তাঁর এক রানি ক্ষেমাদেবীকে বেণুবনের সৌন্দর্য দেখাবার ছল করেই বুদ্ধদর্শনে নিয়ে এসেছিলেন।

কেন? ছল করে কেন?—কুমারেশও বেশ কৌতূহলী হয়ে পড়েছে।

রানি ক্ষেমা যে গোড়ার দিকে বুদ্ধের ওপর হাড়ে চটা ছিলেন। ওই রানিই এই বেণুবনে বুদ্ধকে প্রথম দেখবার পর এমনই প্রভাবিত হন যে প্রব্রজ্যাই নিয়ে ফেলেন। এই যে এইখানে রানি ক্ষেমার সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের প্রথম দেখা হয়েছিল।–নাটকীয়ভাবে বুলা একটা অশ্বত্থ গাছের দিকে আঙুল দেখায়।

সে মিটিমিটি হাসছে। সেদিকে তাকিয়ে তোসিকো বলল, ক্র? অর নো ক্র?

কুমারেশ বলল, শিজ জাস্ট কিডিং।

কিদিং? কিদিং?–ওরা তিনজনেই তিরস্কারের চোখে বুলার দিকে তাকাল।

পরে কুমারেশ বুলাকে সাবধান করে দেয়, দেখো, ওরা কিন্তু বৌদ্ধ। বুদ্ধকে ওরা ভগবান বলে মানে। ওদের সামনে ওভাবে বুদ্ধকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা কোরো না।

তুমিই তো ঠাট্টার কথা বললে। আমি তো ঠাট্টা করিনি। বুলা অবাক হয়ে বলল, একটু পরে বলল, আমি যদি বলি ওইখানেই সেই স্পট যেখানে ক্ষেমা এসে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথমে দেখেছিলেন বুদ্ধকে, এর বিপক্ষে তুমি কোনো প্রমাণ দিতে পারবে?

আড়াই হাজার বছর আগে কোথায় কী ঘটেছিল সে প্রমাণ আবার কেউ দিতে পারে না কি? কুমারেশ বলল বেশ অবজ্ঞার সঙ্গেই।

প্রমাণ না পেলে আর ইতিহাস রচনা হচ্ছে কী করে?

তা অবশ্য। কিন্তু বুলা, তুমি যে বৌদ্ধযুগের ইতিহাস এত জানো সেটা আমি জানতাম না।

জানিই তো!

জেদি মেয়ের মতো বুলা বলে, ধরো যদি বলি আজ যেখানে এই ট্যুরিস্ট বাংলো সেইখানেই বিম্বিসার রাজামশায়ের কোষাধ্যক্ষর কোয়ার্টার্স ছিল। যদি বলি এইখান দিয়ে, এই করিডর দিয়ে নূপুরের নিক্কণ তুলে হেঁটে যেতাম তখন গরবিনির মতো! বুলা তখন নূপুর মেঝেতে ঠুকে ঠুকে বাজায়। ছুন ছুন ছুন শব্দ হয়।-যদি বলি এক ভীষণ দস্যি আবদেরে মেয়ে ছিলাম আমি, বাবা-মা আমাকে সামলাতে পারতেন না! যখন যা ধরব, তা-ই চাই।

সে তো এখনকার কথাই বলছ। এর জন্যে আড়াই হাজার বছর আগে যেতে হবে কেন?—কুমারেশ হেসে বলল।

দু-জনে বারান্দায় দুটো চেয়ার টেনে বসেছিল। সামনে বিস্তৃত লন। ধারে ধারে ফুলগাছ। সন্ধের ছায়ায় এখন সব আবছা হয়ে এসেছে। বুলা বলল, ওই তো সেই জানলা, যেখান দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে একদিন তোমায় দেখতে পেলাম। লভ অ্যাট ফাস্ট সাইট। কিছু একটা শয়তানি করেছিলে, বুঝলে? তোমাকে তখনকার পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।

বুলা হেসে উঠল। কুমারেশ বলল, তখন পুলিশও ছিল?

ছিল বইকি, নইলে একটা রাজ্য চলে?

তো তারপর?

তারপর আমি আবদার ধরলাম, তোমাকে আমার চাই। তখনও নিশ্চয়ই এখনকার মতো লালটুস দেখতে ছিলে। বাবা বলে-কয়ে জরিমানা দিয়ে তোমাকে রাজরোষ থেকে উদ্ধার করলেন। তারপর ঘটাপটা করে বিয়ে হল।

তারপর কাল শুনো এখন ভীষণ খিদে আর ঘুম পাচ্ছে, বুলা হাই তুলল একটা, মুখে হাত চাপা দিয়ে আলগা করে, চোখে জল এসে গেছে।

এরই মধ্যে ঘুম?

বাঃ, কত হেঁটেছি, কত পাহাড় চড়েছি বলো তো? ব্রহ্মাকুণ্ড দেখে পুরো জরাসন্ধ কা বৈঠক পর্যন্ত উঠে গেলাম। সপ্তপর্ণী গুহা তো তারপর ঘুরে, আবার নেমে যেতে হয়। তুমি তো গেলেই না!

তোমাকেই বা কে যেতে বলছিল?

বাঃ, প্রথম বৌদ্ধধর্মসঙ্গীতির অকুস্থল! দেখব না? জানো তো ত্রিপিটক ওইখানেই প্রথম সংকলিত হয়! বিনয় পিটকের এডিটর ছিলেন একজন নাপিত, তাঁর নাম উপালি। ভাবতে পারছ?

উঃ, তুমি তো দেখছি একেবারে ইতিহাসের দিদিমণি হয়ে গেলে?

কবে যে জানতাম! ভুলেই গিয়েছিলাম। এখানে এসে মনে পড়ে যাচ্ছে,-বুলা আবার হাই তুলল।

মাঝরাত্তিরে কুমারেশকে ডেকে তুলল বুলা, বলল, মনে পড়েছে, ওই মেয়েটার নাম ভদ্রা, আর ওই লোকটার নাম সণহুক।

কোন মেয়ে?–কুমারেশ ঘুম চোখে জিজ্ঞেস করল।

ওই যে, যে মেয়েটা এখানে থাকত, আর যে লোকটাকে সে জানলা থেকে দেখল! বলে বুলা আবার ধপাস করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

যা বাবা। স্বপ্ন-টপ্ন দেখল না কী? … কুমারেশ উঠে বারান্দার দিকে জানলা খুলে একটা সিগারেট ধরায়।

শৈলগিরি। গৃধকূট যার শিখর। রোপওয়েতে করে দুলতে দুলতে পৌঁছে যাওয়া। চমৎকার দুপুরে জাপানি বুদ্ধমন্দির শান্তিপ। পৃথিবীর যাবতীয় কলুষকালির উপর বাটি উপুড় করে দিয়েছে কেউ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিধবস্ত জাপানের গড়া। শান্তিপ। বাইরেও অনুপম বুদ্ধমূর্তি। ভেতরেও। ধ্যানস্থ। তিনটি জাপ যুবক, একটি বাঙালি যুবতি নতজানু। বাঙালি? না মাগধী? বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি বলছে না কি তোসিকো? ধম্মং শরণং গচ্ছামি, বলছে মগধিনী? ধর্মের শরণই আবার নেবে নাকি?

জাপানিরা স্থূপ প্রদক্ষিণ করতে গেল। মধ্যদিন পার হয়ে যায় যায়! ছায়া পড়ে যায় যায়। গৃধকূট! গৃধকূট! গৃধ্র চঞ্চু ক্ষয়ে গেছে কালের প্রকোপ। বাইরে থেকে চেনা যায় না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে বুঝি আজও সেই গৃধ্রকূট।

মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো গাছ। ক্লান্ত শরীর জুড়িয়ে যায়। আজ অনেক ঘোরা হয়েছে। শুধু আজই বা কেন? এই ক-দিন? এ যাত্রায়। ফেরবার সময়ে রাঁচি, রাজরাপ্পায় ছিন্নমস্তার মন্দির। বেড়াতে বেড়াতে দু-জনে রুক্ষ পাথরের উপর অদৃশ্য পায়ের ছাপে পা রেখে রেখে কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়। সমস্ত রাজগৃহ নগরটা দিনান্তের রোদে ঝিমিয়ে আছে। দেখা যাচ্ছে বিম্বিসারের কারুগৃহ, সোন-ভাণ্ডার, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুটি প্রায় সমান্তরাল পথ নগরীর দৈর্ঘ্য ফিতে দিয়ে মাপছে।

বুলা হঠাৎ ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, বলে, আর কোথাও যাব না বুঝলে? এই রাজগৃহর স্মৃতি নিয়েই এবার ফিরব।

সে আবার কী? টিকিট কাটা, বুকিং রয়েছে।

তাতে কী? আমার আর ইচ্ছে করছে না।

যতটুকু চিনেছে বুলাকে কুমারেশ জানে এই ওর শেষ কথা। ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে যদি না করে ভগবানের বাবার সাধ্য নেই, ওকে দিয়ে সে কাজ করায়। অতএব এই রাজগির, এই গৃধকূট, এই-ই শেষ। নির্জন গিরিপ্রান্ত। গাছের আড়াল। কোথাও কেউ নেই। চোখে মোহ নিয়ে কুমারেশ ডাকে, এসো, এসো বুলা। এসো।

বুলা ঝাঁপিয়ে পড়তে যায় কুমারেশের বুকে। পরক্ষণেই একটা আর্ত চিৎকার গিলে নেয় গৃধকূট। পাথরে ধাক্কা খেতে, খেতে, বাতাসে ওলট পালট হতে হতে নীচে পড়তে থাকে কুমারেশ। নীচে পড়তে থাকে।

বুলা তার ওড়না কোমরে গুঁজে নেয়। একবারও পেছন ফিরে তাকায় না। ও ভেবেছিল বুলা ওর বুকে ঝাপাতে গেলেই ও সরে যাবে। ও জানে না বুলা কত সতর্ক খেলোয়াড়। দিয়েছে একটা বিদ্যুৎগতিতে আপার কাট। এখন সে বুঝতে পারছে উশ্রীতে যে বোল্ডারটার দিকে তাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল লোকটা, সেটা কত পেছল, কত গড়ানে, পা দিলে আর দেখতে হত না, সঙ্গে সঙ্গে হোস, পাথর-ভরতি উন্মাদ জলে, যেখানে সাঁতারশিক্ষা কোনো কাজে লাগে না। এখন বুঝতে পারছে ট্রেন যখন হু হু করে ছুটছিল, তখন বারবার কেন খোলা দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছিল লোকটা। স্রেফ তাকে লোভ দেখাবার জন্যে। যাতে ওর দেখাদেখি সে-ও গিয়ে দাঁড়ায়, তারপর সেই আকস্মিক দুর্ঘটনাটি ঘটে।

চলন্ত ট্রেন থেকে দুঃসাহসিনী যাত্রিণীর পতন ও মৃত্যু। তদন্ত কি আর হত? হত। কিন্তু এ ক-মাসে বাবা-মার স্নেহ ভালোবাসা ভালোই আদায় করেছে লোকটা। না হলে বাবা বিশাল খরচ করে ল্যান্সডাউনের শো-রুমটা এত তাড়াতাড়ি…

আর সেই ফোন? দানাপুর জংশন থেকে শান্তিনিকেতনে বাবা-মাকে এস.টি.ডি?

বুলা বলছে…চমৎকার আছি মা। দারুণ এনজয় করছি। একদম ভাববে না।

তার হাত থেকে রিসিভারটা কেড়ে নিয়ে কুমারেশ বলেছিল, চমৎকার ঠিকই। তবে মেয়েকে সামলাবার জন্যে আপনাদের আসা উচিত ছিল মা। ট্রেনের খোলা দরজায় গিয়ে দাঁড়ানো চাই, উশ্রীর জলে কেউ চান করে না, ওর করা চাই-ই।

মা বলছেন, সে কী? বুলা বেপরোয়া সাহস ভালো না। কুমারেশের কথা শুনো।

মনের মধ্যে একটা খটকা লেগে গিয়েছিল। কোথায় বেসুর বাজছে, খচখচ করছে। প্রথমটায় সে বুঝতে পারেনি। ট্রেনের দরজায় ও তো দাঁড়ায় না, দাঁড়ায়নি। কুমারেশই তো দাঁড়ায়। সিগারেট মুখে নিয়ে, বেপরোয়া ভঙ্গিতে। তবে?

রাজগিরের মাটিতে পা দেবামাত্র বুলা বুঝতে পারে। ভদ্রা, ভদ্রাই ওকে বলে দেয়। আড়াই হাজার বছর বয়সের এক সুন্দরী তরুণী, ভদ্রা। মগধ রাজ্যের কোষাধ্যক্ষের একমাত্র আদূরে-আবদেরে মেয়ে। সে এক সুন্দর চোরের মোহে পড়ে। বাবা-মার সম্মতি আদায় করে বিয়েও করে। সবই দিয়েছিল তাকে—সুন্দর বরতনু, গরবিনি মন, সুউচ্চ উদার হৃদয়। কত সেবা, কত বিলাস, সৎ সুন্দর জীবনযাপনের কত আয়োজন। কিন্তু জাতচোরের স্বভাব যাবে কোথায়? একদিন পুজোর ছলে ভদ্রাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার সমস্ত অলংকারে মুড়ে নিয়ে সক চড়ল গৃধ্রুকূটে। তার পর বলে কি না, সব অলংকার খুলে দাও, অলংকারের জন্যই তোমায় বিবাহ করেছি। ভদ্রা তীক্ষ্ণধী মেয়ে। বুঝেছিল শুধু অলংকার নিয়েই ক্ষান্ত হবে না দুবৃত্ত। তাকে হত্যা করবে। তাই সে অশ্রুমুখী সেজে শেষবার সালংকার আলিঙ্গনের প্রার্থনা জানায়, আর সেই ছুতোয় দুবৃত্তকে ঠেলে ফেলে দেয়।

গল্পটা কেমন করে যে তার জানা ছিল, কোথায় যে পড়েছে, কিছুতেই মনে করতে পারছে না বুলা। এখন এই মুহূর্তে তো নয়ই। এখন বুক কাঁপছে। ভীষণ দুঃখ। ভীষণতর হতাশা, ভীষণতম ভয়।

কিন্তু না, সে ভদ্রার থেকে আড়াই হাজার বছরের ছোটো হলেও আসলে তো আড়াই হাজার বছরের বড়োই। তখন ভদ্রা নিশ্চয় রাজদ্বারে সুবিচার পেয়েছিল। বিম্বিসার ধরতে পেরেছিলেন, পারতেন, কে প্রকৃত অপরাধী, কে নয়। এখন সে রাজদ্বার নেই, সে বিচারক নেই। নেই সে জনগণ। এখন চলবে দিনের পর দিন খবরে-কাগুঁজে বিচার। স্টোরির খোঁজে পাপারাৎজি গল্পের মধ্যে গল্প খুঁজবে, উদ্দেশ্যর মধ্যে উদ্দেশ্য। জনগণ হয়তো চ্যাঁচাবে, মৃত্যুদণ্ড চাই, পতিঘাতিনীর মৃত্যুদণ্ড চাই!

আলুথালু বসনে চিৎকার করতে করতে ছুটতে থাকে বুলা শান্তিপের উদ্দেশে যেখানে তোসিকো আর তার দুই বন্ধু পরম শ্রদ্ধাভরে স্থূপ প্রদক্ষিণ করছে। আছড়ে পড়ে সে পাথুরে জমিতে।

হোয়াত রং? হোয়াত রং?—চকিতে তিন জাপ যুবক ঘুরে দাঁড়ায়। খসা টালি যত্ন করে বসাচ্ছিল জাপ কারিগর। ভেতরে ছিল মন্দিররক্ষক জাপ কর্মচারীকুল। সব বৌদ্ধ। ছুটে আসে। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, কিন্তু যথেষ্ট।

আমার স্বামী পাহাড়ের ওপর থেকে পা ফসকে পড়ে গেছেন। ফর লর্ড বুদ্ধজ সেক সেভ হিম। বাঁচান, বাঁচান ওকে।

ছুটোছুটি পড়ে যায়। আতঙ্কিত ছুটোছুটি। সান্ত্বনাহীন কান্না কাঁদতে থাকে ভদ্রা।

আড়াই হাজার বছরেও লোকটার স্বভাব শোধরাল না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *