গুনিন
বহুদিন পরে গাঁয়ের স্টেশনে পা দিয়ে নকুড় অচেনা এক দেশে আসার মতো এক মুহূর্ত অবাক হয়ে রইল। যে গ্রামকে সে ছেড়ে গিয়েছিল, এ সে গ্রাম নয়। রেল লাইনের পশ্চিম দিকটা অবশ্য বরাবরই খানিক শহর-পানা জায়গা, কিন্তু এখন তো প্রায় আস্ত একটা শহর হয়ে উঠেছে। মেলাই পাকা বাড়ি উঠেছে, কারখানাও উঠেছে দু একটা।
কিন্তু পরমুহূর্তেই তার বুক উজাড় করে মস্ত একটা নিশ্বাস পড়ল, তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল এক মহাসুখের হাসি। বহুদিন পরে যেন আচমকা গাঁয়ের হাওয়া লেগে তার শরীরটা আনন্দে শিউরে উঠল, ইস্! কতদিন পর। সে দিন-মাসের বুঝি বা হিসেবই নেই। তার জন্মভূমি। ওই তো পুবে বেনাহাটি গাঁ, সামনের মাঠটায় গরু চরাচ্ছে হয়তো দাশু রাখালই কিন্তু রাস্তার ধারে ধারে অনেকগুলো চালা ঘরও উঠেছে। বোধ হয় নতুন দোকান-পাট হয়েছে।
একে একে গাঁয়ের সবার কথাই তার মনে হতে লাগল আর তাকে দেখে সকলে কী বলবে, কেমন করে তাকাবে সে কথাটা ভাবতে গিয়ে তার ঠোঁটের কোণে মজার হাসি খেলে গেল। সেই সঙ্গে নিজের কৌতূহলও তার বড় কম নয়। …তা ছাড়া মা, মা কি তার বেঁচে আছে। বোনটার হয়তো এতদিনেও কোনও গতি হয়নি। কে বিয়ে দেবে। ফুটো চাল, ফাটা হাঁড়ি, কে-ই বা মেয়ে নেবে সে ঘরের। তা বলে এতদিন কি আর বসে আছে, কিছু হয়তো হয়েছে। সে তাড়াতাড়ি টিনের সুটকেশটা নিয়ে গেটের দিকে এগুলো, ভেবেছিল বোধ হয় তাদের সেই পুরনো স্টেশন মাস্টারই আছেন। তাই সে হাসতে হাসতে আসছিল। কিন্তু কাছে এসে দেখল একজন অন্য বাবু।
তবু সে টিকিটটা দিয়ে দু হাতে সুটকেশটা কপালে ঠেকিয়ে বলল, বাবু তো আমাকে চিনবেন না, নতুন মানুষ। কদ্দিন এসেছেন এখানে বাবু। স্টেশনমাস্টার একটু অবাক হয়ে নকুড়কে দেখলেন। কালো কুচকুচে বর্ণ, একহারা অথচ পেটানো শক্ত শরীর। গায়ের চেয়ে কয়েক পোঁচ কালো পাতলা জ্যালজেলে কাপড়ের জামা, একটা সাদা প্যান্ট পরনে। পায়ে কালো জুতো, সেটিও বেশ পালিশ করা। একমাথা ঘন কালো বাবরি চুল।
দেখে শুনে স্টেশন-মাস্টার বোধ করি অভক্তিতেই ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, এসেছি তো অনেকদিন। তা তুমি কে বটে?
নকুড় মুখ ভরে হেসে বলল, আজ্ঞে আমি? আমি আপনার এই বেনাহাটির ননী দিগরের ছেলে ছিরি নকুড়চন্দর.. বলতে বলতে সে হঠাৎ থামল দিগর হল তাদের পদবি। কিন্তু সে পদবি ছেড়ে তো..সে নতুন পদবি নিয়েছে, তবু এক ঝটকায় বলতে আটকাল, পরে বলল, ছিরি নকুর চন্দর গুনিন।
দিগরের ছেলে গুনিন? স্টেশনমাস্টার বিদ্রূপে হেসে বললেন, গুন-তুক শিখেছ বুঝি?
আজ্ঞে তাই! নইলে, পরম বিনয়ে হেসে বলল নকুড়, এই যেমন আপনার গে রেলের ইঞ্জিন যারা চালায় তাদের বলি আমরা ডেরাইবার। কিম্বা ধরেন
হ্যাঁ, যেমন আমি আর হরকেষ্ট পাল নই, শুধু স্টেশন-মাস্টার।বললেন তিনি।
ঠিক ধরেছেন বাবু। তাই হল আর কী।
মাস্টারের মনটা খুশি হয়ে উঠল। বললেন, আচ্ছা গুনিন তা হলে এসো মাঝে মাঝে।
লিশ্চয় বাবু। আর এক দফা কপালে হাত ঠেকিয়ে স্টেশন থেকে নকুড় বেরিয়ে এল। মাস্টারের গুনিন বলে আমন্ত্রণে মনটা তার আরও চাঙ্গা হয়ে উঠল। মনে যে তার একটা ছোট কাঁটার খচখচানি ছিল, তা যেন কেটে গেল অনেকখানি। যতই শহুরে হও আর মাথা চাড়া দাও, গুনিনের কেরামতি মারতে পারে না কেউ।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখল কয়েকটা সাইকেল রিকশা, একটু দূরে দুটো ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে। রিকশাওয়ালাদের কাউকেই সে চিনতে পারল না, ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানও চেনা দেখা গেল না। একপাশে একটা গরুর গাড়িতে সে দেখল পালদিঘির কাশেম সওয়ারির জন্য অপেক্ষা করছে।
কাশেম! শালা উল্লুকের মতো দেখছে, তার ল্যাংটাকালের বন্ধু নকড়েকে, চিনতেও পারছে না। কাশেমের চেহারাটা অনেক বদলে গেছে।
সবাই তার দিকে তাকিয়েছিল। তাতে নকুড়ের বুকটা উঁচু হয়ে উঠল আরও খানিক, ঠোঁটের কোণে কষ্ট করে সে হাসিটা চেপে রাখল। গম্ভীর হয়ে বোধ করি তার বেশ বাসের উপযুক্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করল।
সে সকলের দিকে দেখে কাশেমের দিকে এগিয়ে গেল। কাশেম তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে বলল, কোথা যাবেন কত্তা?
নকুড় চোখ পিটপিট করে হেসে উঠল খিলখিল করে। কাশেমের বোকাটে মুখটার দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, এই দেখ, দেখ শালা আমাকে চিনতে পারল নি।
কাশেম তাড়াতাড়ি কাছে এসে আধা পরিচয়ের হাসি হেসে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, হা হা মনে নিচ্ছিল বটে যে—
আমি তো সোয়ারি, কত্তা মানুষ? নকুড় বলল।
কাশেম তবু দ্বিধা করে বলল, না নকুড় তো তুমি বলতে বলতে তারা দুজনেই হো হো করে হেসে উঠে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল।
নকুড় বলে উঠল, চিনি চিনি মনে লয়, তুমি কি কুবজর কাল বট হে?
কাশেম বলল, ইস একটা যুগ গেল যে। সেই কবে গেছ।
আট বছর। বলল নকুড়।
সেই কি কম, বলতে বলতে কাশেমের গলা গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, কত কী গেল, এল। কী দিন দেখে গেছলে, কী দিন হয়েছে। পাকিস্তান হিন্দুস্থানের ব্যাপার।
তাতে কী হয়েছে! তোমরা থাকো না কার কী বলার আছে। বেশ ভারিক্তি গলায় বলে উঠল নকুড়। যেন সে থাকতে দেওয়ার মালিক।
কাশেম একটু অবাক হয়ে নকুড়ের মুখের দিকে দেখল। না ঠাট্টা নয়, তবে নকুড়ের একথায় বিশেষ মনও নেই। বলতে হয় বলছে।
ইতিমধ্যে আরও দুচারজন এসে ভিড় করেছে তাদের কাছে। কিন্তু সকলেই নকুড়ের কাছে অচেনা।
কাশেম কয়েকজনকে দেখিয়ে বলল, এই তো, এরা তোমার ব্যানাহটির লোক, ওই তো তোমাদের পাড়ার কান্ত বাগদির ছেলে নলিত। চিনতে পারবে না এখন বড় হয়ে গেছে, রিশকা চালায়।
বটে কান্ত খুড়োর ছেলে। ভারী জোয়ান হয়ে গেছে দেখছি। ললিত বিস্মিত হেসে দেখছিল নকুড়কে। আপনি বলবে, তুমি বলবে বুঝতে না পেরে বলল, শুনে আসছি ছোটকাল থেকে, অমুকে বিবাগী হয়ে গেছে, নোকে বলে নানান কথা। কেউ বলে লড়ায়ে সে মরে গেছে, কেউ বলে ওই তো অমুক জায়গায় দেখে এসেছি।
নকুড় হো-হো করে হেসে উঠল।
সকলেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল তার প্যান্ট, জামা, জুতো বাবরি, তার কথা বলার ঢঙ। টিনের নতুন সুটকেশখানিও বেশ। সকলেই ভাবল, বেশ দু পয়সা কামিয়ে এসেছে নকুড়। সম্রম ও সম্মানের পাত্র মনে হল। সকলেই তাকে নানান প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। সবই কাজের কথা। বাইরে কী রকম সুবিধা, কিছু করা-টরা যাবে কি না ইত্যাদি।
নকুড় প্রায় এক কথায় সবাইকে জবাব দিল, কাজ, সে তো ভাগ্যের কথা। যেখানেই যাবে কপাল তো আর রেখে যেতে পারবে না। তবে বাইরে গেলে মনে এট্টা জেদ আসে বুইলে। তবে আমি…আমি তো ও সবের দিকে বড় এট্টা নজর দেইনি। আমি তোমার গে এক গুরুর কাছে কিছু মন্তর তন্তর শিখেছি। মানে আসলে এক গুনিনের সারেদি করেছি।
কেউ কেউ ভড়কে গেল, কেউ কেউ হতা হয়ে গেল নকুড়ের কথায়, কেউ কেউ তাকে রীতিমতো একটা গুনিন ভেবে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। নকুড় আবার বলল, তবে কাজও করেছি। করেছি ভাই অনেক কিছু; সে সব পরে হবে। এখন আমি বাড়ি যাই।
বলতে বলতে বেশ খানিকটা ভয়ে ও আগ্রহে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আমার মা বোনের খবরটা এটুবলো তো তোমরা। সব বেঁচেবর্তে আছে তো?
ললিত বলল, হ্যাঁ বেঁচে আছে। মা তো বুড়ি থুখুড়ি, কোনও কোনও দিন দুটো কলমি হিংচে শাক বিক্কিরি করে, রেললাইনের কয়লা কুড়োয়, খুঁটে দেয় আর
ললিত থেমে গেল।
নকুড় বড় বড় চোখে হাঁদার মতো চেয়ে রইল। ললিত বলল, রাধা চলে গেছে, তোমার বোন।
কোনও কথা বেরোল না নকুড়ের মুখ দিয়ে কেমন একরকম হতভম্ব হয়ে বেনাহাটির রোদ ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। …অবশ্য এখানে আসার আগে কেবলি তার ভাবনা হয়েছিল; হয়তো গিয়ে দেখবে মা-বোন দুটো মরে গেছে। ফিরে গেলে গাঁয়ের লোক বলবে, আহা এতদিনে এলি, সে-দুটোকে দেখতে পেলি নে। আর ঘর তো নকুড় বড় সহজে ছাড়েনি। ঘরে ছিল না খুদকুড়ো। অতবড় দামড়া ছেলে নকুড় দুপয়সা পারত না রোজগার করতে। কাজের আকাল সেদিনে এদিনে একই রকম। নকুড় তার নিজের খেয়ালে ঘুরত ওঝা সাপুড়ের পিছে পিছে। ওই ছিল তার এক বাই। মা বলত, দূর দূর, বোনটার ছিল না বড়ভাই বলে একটা মান্যি। ..
তা ছাড়া বয়সকালে যা হয়। মনটা পড়ে গিয়েছিল হরিমতির উপর, ওই ললিতেরই দিদি, কান্ত খুডোর মেয়ে। সে নিয়েও কত কথা। কত কথা কেন? না, দু পয়সা রোজগার ছিল না নকুড়ের, তাই তো; নইলে হরিমতি আজ (কে জানে কার ঘরে আছে) নকুড়ের ঘর করত কি না! না, রোজগার নেই, সবাই টিটকারি দিত, মা দিত ধিক্কার। এক ফোঁটা হরিমতিও ঠোঁট উলটে বলত না কামানোর নোক কেন আবার বে করবে।
সত্যি, একটা পোড়া বিড়ির জন্যও হাত পাততে হয়। ধুর শালার জীবন, মরি বাঁচি করি সে বেরিয়ে পড়েছিল।
আজ যদি বা ফিরল ভরাট হয়ে, অন্যদিকে সবটাই প্রায় খালি হয়ে গেছে, হ্যাঁ, দু পয়সা রোজগার করেছে নকুড়, গুনতুকও শিখেছে অনেক। সেটা লাভ হিসেবে অবশ্য অনেকখানি। কিন্তু আর কী আছে, বোনটাও ঘর ছেড়ে গেছে।
সে হঠাৎ রাগে চোখ পাকিয়ে বলল, কোন শালার সঙ্গে গেছে একবার বলো দিকিনি, তাকে আমি কাটা পাঁঠার মতো আমার পায়ের তলায় এনে মারি।
যেন জানতে পারলে এখুনি বান মেরে তাকে মেরে ফেলবে সে। কিন্তু সে হদিস কেউই জানত না। সবাই তাকে সান্ত্বনা দিল, বলল, রাগ সামলাতে।
সে কথাও ঠিক। গুনিনের আবার যখন তখন মেজাজ গরম করতে নেই। গুরুর বারণ। তবু বুকটার মধ্যে ভারী টাটাতে লাগল নকুড়ের। ফিরে আসাটা যেন ব্যর্থ হয়ে গেছে।
ললিতের মনটা বিস্ময়ে ও সম্মানে অনেকক্ষণ পড়ে গিয়েছিল নকুড়ের উপর। সে বলে উঠল, দাদা অত ভাবনার কুল নেই। ঘরে মা-টা তো রয়েছে অ্যাদ্দিন বাদে এলে আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকে না। চলো গাঁয়ে চলো।
বলে সে সুটকেশটা নিয়ে তুলে ফেলল তার রিকশায়।
মনটা আবার নকুড়ের এ-দিকে ফিরে এল। আবার একটু গুনিনের হাসি হেসে বলল, রিকশাতে যাব নাকি? মস্ত বড় তিনটে খানা রয়েছে যে পথে। ললিত বলল, সে কবে বুজে দিয়েছে পুল হয়ে গেছে না।
বটে? ভারিক্কি চালে সবাইকে আসি ভাই, চলি গো ইত্যাদি বলে রিকশায় উঠে বসল নকুড়। বসল বেশ পায়ের উপর পা দিয়ে। শহরকে পশ্চিমে রেখে পুবে কাঁচা সড়কের উপর দিয়ে রিকশা চলল।
রোদ ভরা সকাল, পরিষ্কার আকাশ। ঝিরঝিরে হাওয়ায় হাওয়ায় দিন যেন মন্থর মনোরম, নকুড় বলল, কান্ত খুড়ো কেমন আছে হে? ওই আছে আর কী? থাকে থাকে যায় যায়। গেলেও তো হয়। প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে বলল ললিত।
বুড়ো রুগী ঘরে থাকলে অমনি কথাই বলে লোকে, নকুড় কয়েকবার কাশল, ঢোক গিলে চারদিকে তাকাল, তাকিয়ে দেখল ললিতের ঘাড় আর মাথাটা। তারপর যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করল, তোমার দিদি-মানে হরিমতি, ওকে বে দিলে কোথা।
ললিত সামনের দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেই জবাব দিল, বে তো দেছেলাম পাল দিঘির কালী মোড়লের ছেলের সঙ্গে, তা….
হঠাৎ কথা পালটে বলল, এই, এই হল সেই খানা, এখন পুল হয়ে গেছে। জানলে দাদা সেব্যানাহাটি আর নেই—কো।
হঠাৎ যেন হোঁচট খেয়ে নকুড় বোকার মতো হাসতে হাসতে পুলটার দিকে অর্থহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল, হা হা, অনেক পালটে গেছে।
কিন্তু সমস্ত বেনাহাটি যেন হারিয়ে গেছে নকুড়ের কাছে। তাদের কথাও যেন হারিয়ে গেছে।
নকুড় কয়েকবার তাল ঠুকল রিকশার গদিতে। বোধহয় গুনগুনও করল একটু। তারপর আবার বলল, তা কালী মোড়লের অবস্থা তো—।
আর অবস্থা। বলে উঠল ললিত, মোড়লের ছেলে মরে গেল, দিদি তো এখন আমাদের ঘাড়ে, ছেলে একটা হয়েছে, সেটা মরে গেছে।
নকুড়ের মনটা আহা করে উঠতে গিয়েও হঠাৎ প্রাণটার কোথায় যেন খুশির বাজনা বেজে উঠল। হঠাৎ বেনাহাটির আকাশ বাতাস বড় মিষ্টি হয়ে উঠল, মনে হল, যা বহুদিন বাদেই সে ফিরে আসছে গাঁয়ে। মায়ের জন্য ব্যাকুলতা, বোনটার জন্য দুঃখে ভরে উঠল মনটা।
পাড়ায় ঢুকতে না ঢুকতে রাষ্ট্র হয়ে গেল বিবাগী নকুড় গাঁয়ে ফিরেছে। আধকানা বুড়ি নকুড়ের মা তো ড়ুকরে চেঁচিয়ে কান্নাই জুড়ে দিল। একদিন যাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তাকেই আজ গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আর আশ মেটে না।
মুহূর্তে একথাও রটে গেল, নকুড় শুধু দু পয়সা কামিয়েই আসেনি, এসেছে এক মস্ত গুনিন হয়ে।
পাড়াটা ভেঙে পড়ল নকুড়দের উঠোনে। সোমত্ত মেয়ে বউরাও ঝোপঝাড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখে নিল নকুড়কে।
আশ্চর্য, নকুড় এত সুন্দর, এত গুণবান, এত বড় মানুষ। কান্তখুড়ো মনে মনে কপাল চাপড়ে বলল, কে জানত এমন দিনও আসবে। একেই বলে বরাত, বরাত বলে। নইলে মতি খুড়ো অমন নকুড়ের গা ঘেঁষে খাতির করে। মতির ঘরে আছে আইবুড়ো মেয়ে। নকুড়কে যদি রাজি করানো যায় তা হলে আর পায় কে?
নানান জনে নানান কথা বলল। কেউ কেউ তো তর্ক বিতর্কেই গেল লেগে।
নকুড়ও কিছু অবাচীন নয়, সে রীতিমতো দুরস্তভাবে জোড়হাতে হেসে নরম গলায় সবাইকে আপ্যায়ন করল এবং ঘোষণা করে দিল, এই দেখেন কান্তখুড়ো আছেন, মতি খুড়ো আছেন, আপনারা সবাই জানেন, জাতে তুমি দিগর হলে কি মস্তান হলে, সেটা বড় কথা নয়, গুণের একটা নাম আছে। আমাকে কিন্তু পিথিমীর লোক গুনিন বলেই জানে, নকুড় গুনিন। সবাই বলল, নিশ্চয়, গুনিনকে আমরা গুনিন বলব। ভাল ভাল।
কিন্তু হরিমতি, হরিমতি কোথায়? আশেপাশে এত বউ ঝি, হরিমতি তো আসেনি। লজ্জায়ই হয় তো আসেনি সে। সেদিনের নকুড় একেবারে অন্য মানুষ হয়ে এসেছে, লজ্জা তো হবেই। শত হলেও সেদিনের অচ্ছেদ্দাটা কি কম ছিল।
পরদিন সকালের ভিড় কাটলে দুপুরের ঝোঁকে এল হরিমতি।
নকুড় তখন খাওয়া শেষে বসে বসে পান চিবোচ্ছে। পরনে একখানি নতুন ধুতি। তেলে জলে ধোওয়া চকচকে খালি গা, মাঝখানে সিথি কেটে বাবরি চুল আঁচড়েছে পাতা পেড়ে।
হরিমতিকে দেখে এক মুহূর্ত কথা সরল না নকুড়ের। আধা পরিচয়ের হাসিতে থমকে গেল সে।
মাজা মাজা রং হরিমতির, সেই কিশোরী শরীরটা লম্বায় চওড়ায় বেড়ে উঠেছে শুধু নয়, শক্ত পুষ্ট গায়ে তার রূপেরই বা কী বাহার হয়েছে। গায়ে জামা নেই, শাড়ির রেখায় রেখায় শুধু শ্রী নয় প্রাণ ভোলানো গমকের ওঠা নামায় তা অপূর্ব। মুখে ঠাসা পান, ঠোঁট দুটি লাল টুকটুক করছে। সেই ঠোঁটে ও স্থির চোখে তার বিচিত্র হাসি। একে বিধবা, তায় বাপের বাড়ি। মাথায় তার ঘোমটা নেই, টাস করে বাঁধা আলগা চুল। কে বলবে মেয়ের বিয়ে হয়েছিল?
হরিমতিও হেসে বলল চিনতে পারলেনি?
চকিতে থমধরা ভাব কাটিয়ে হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়াল নকুড়। বলল, খুব খুব চিনেছি। এসো এসসা, বসো এসে।
হাসলে পরে বেঁকে ওঠে হরিমতির ঠোঁট। থাক থাক কুটুম তো লই, তুমি বসো।
নকুড় বসল, কিন্তু তার মনটা বসল না। আচমকা সব গুছনো বস্তু হুড়মুড় করে পড়ে যাওয়ার মতো মনটা এলোমেলো হয়ে গেল তার। সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মা মা হরিমতি এসেছে গো।
সে কথা শুনে মায়ের পিত্তি জ্বলে গেল ঘরের মধ্যে। একদিন যে ধিক্কার দিয়েছে নকুড়কে, আজ সেই ধিক্কারেই সোয়ামীখাগী হরিমতিকে মনে মনে গাল দিয়ে উঠল বুড়ি। শুধু রাগ নয়, ভয়ও হল, তার অমন ছেলের মাথাটা না আবার খারাপ করে ছুঁড়ি।
হরিমতি বসে পড়ল নকুড়ের অদূরেই। বলল, তুমি নাকি মস্ত গুনিন হয়ে এসেছ?
নকুড় হরিমতির দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি এবং বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে রইল। কোথায় লজ্জা হরিমতির মুখে, দিব্যি ঠোঁট টিপে বাঁকা হেসে কথা বলছে চোখের কোণে দৃষ্টি অপলক। জড়তাহীন স্বচ্ছন্দ ভাব।
নকুড় বলল, মস্ত আর কী, তবে একটু আধটু শিখে-টিখে এয়েছি।
হঠাৎ ঘাড় বেঁকিয়ে হরিমতি বলে উঠল, আমিও কিন্তু গুনিনী হয়েছি সত্যি।
ঠাট্টা না সত্যি, নকুড় বুঝতে পারল না হরিমতির মুখ দেখে। হ্যাঁ, সেদিনের কিশোরী হরিমতির মুখ চোখেও অনেক কথা ফুটে বেরুত। আজও তার সারা মুখ চোখে যেন কত কথা, কিন্তু সবই ধাঁধার মতো রহস্যময়ী মনে হল নকুড়ের। টিপে টিপে হাসে, ঠেরে ঠেরে দেখে। নকুড় তাড়াতাড়ি বলল, সে তালে আমারও কপাল, গুরু ছেড়ে এসেছি, নতুন গুরু পেলাম। তোমার শিষ্যি করে নিয়ে আমাকে।
হরিমতি বলল, গুরু যেমন আপনি পাওয়া যায় শিষ্যিও তেমনি আপনি হবে, অবিশ্যি শিষ্যির মতন শিষ্যি হলে।
বটে? তবে পরখ করে নেও।
করব। বলে খিলখিল করে হেসে উঠল হরিমতি। বলল, পেরায় আগের মতনই আছ বাপু।
তুমি কিন্তুন বদলে গেছ, নকুড় বলল।
তা গেছি। বলে চকিতে যেন নকুড়ের বুকের শেষ অবধি দেখে হরিমতি বলল, তা পর বে টে করবে তো?
কেবলি কথা আটকায় নকুড়ের গলায়। বলল, তা মেয়ে পেলে—
ও মা। মেয়ের কি এ সংসারে অভাব?
না কিন্তুন মনের মানুষের অভাব।
আবার হরিমতি হেসে উঠল খিলখিল করে। মনের মানুষ।
কিন্তু হরিমতিও হঠাৎ চুপ করে গেল।
নকুড় সমস্ত আড়ষ্টতা কাটিয়ে স্থির দৃষ্টিতে হরিমতির দিকে তাকাল।
হরিমতি বলল, কী দেখো?
দেখি তোমাকে।
এক মুহূর্তে সমস্ত হাসি-মস্করা উবে গেল হরিমতির মুখ থেকে। পরে হেসে বলল, তুমি তেমনি আছ। কেন লোকে বলে তুমি পালটেছ?
লোকে বলুক। তোমার কাছে তো পালটাইনি। এবার হরিমতি হাসতে হাসতে উঠে পড়ল। কিন্তু বাড়ির বাইরে এসে এলোমেলো মনটা নিয়ে সে বড় ফাঁপরে পড়ে গেল দ্রুত নিশ্বাসে বুকটা দুলে উঠল, চলার গতিতে সব উদ্ধত স্তব্ধ যৌবন যেন আচমকা আজ নেচে নেচে উঠল।
দম ভারী হয়ে গেল নকুড়ের। আচমকা ঝড়ের মতো এসে হরিমতি তার আটঘাট বাঁধা মনটাকে খুলে ফেলে ছড়িয়ে একাকার করে দিয়ে গেল। হরিমতির আশা নিয়ে সে ফেরেনি গাঁয়ে সত্যি, কিন্তু তাকে এসে এমনটি দেখবে তাও আশা করেনি। আর যদি দেখল তবে হরিমতির মনের হদিস পেল না শুধু নয়, তার হাবভাব দেখে তার বুকটাতে জমাট বেঁধে উঠল ব্যথা আর অস্বস্তি। মন তার হরিমতির পিছে পড়ে রইল। কিন্তু লোকজন, বন্ধুবান্ধবের হাত থেকে তার রেহাই নেই। সকালে বিকালে তাকে অনেকে ঘিরে থাকে। সে যে গুনিন। বহুজনের বহু প্রার্থনা। এ এটা চায় সে ওটা চায়।
সে কাউকে মাদুলি দেয়, জলপড়া দেয়। তবু রোগের ঝামেলার চেয়ে বেশি আসে সব অন্য ফিকিরে। বলে, বশীকরণ শিখিয়ে দাও। আর বশীকরণের ব্যাপারটা এমনই ছোঁয়াচে যে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে মহকুমা জেলায় পর্যন্ত যেন বাতাসের আগে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
ছেলে বুড়ো নেই, মেয়ে পুরুষ নেই, সকলের সব কথা শোনে নকুড়। বিধি ব্যবস্থা বাতলে দেয়। হরিমতির ভাই ললিতও বশীকরণের বিধি চায়।
গুনিন গম্ভীর হয়ে ব্যবস্থা দেয়, পেখমে ছোট পেতলের বাটিতে একটু তেল নেবে। সে তেল আমি দেব, গুণ তেল। নেয়ে শুদ্ধ হয়ে না খেয়ে ভোরবেলা পুবমুখো বসবে। সামনে তেল রেখে, সূর্যের দিকে চেয়ে এক হাজার আটবার এই বলবে, বলে এক মুহূর্ত থেমে হাত পেতে বলে সোয়া পাঁচ আনা পয়সা দেও।
পয়সা পেলে বলবে,
শিব
ঠাকুরে পাথর ঘষে,
গৌরী ছোটে কৈলাসে।
বাঁশি বাজায় কেষ্ট বসে,
আয়ানের বৌ ছুটে আসে।
আমি ভূতের মাথার ঘিলু নিয়ে
ছিটা দিলাম অমুকের গায়ে।
অমুক মানে যাকে বশীকরণ করবে। তবে দেখো, কারও সব্বোনাশ করো না। ঘর ভেঙো না কারও। এই হল গুরুর আদেশ। আর হাজার আটবার গুণে সেই তেল নে গে ছিটিয়ে দেবে তার গায়ে।
যদি কোনও ভুলটুল হয়, তা হলে জীবনে আর হবে না। অর্থাৎ গুণ তেলে আর হবে না।
শুধু তেল নয়, কাউকে কাউকে সে সিঁদুর দেয়। সে সিঁদুর টিপ দেখলেই জন্মশত্রুও নাকি বশ মানবে।
ফলের চেয়ে অফল বেশি। তবু আশ্চর্য রকমেই দু একটা লোক ফল পেয়ে যায় তাতেই বিশ্বাস আরও বেড়ে যায় লোকের।
যাদের ফলে না, তারা জীবনভর ভুলের মাশুল দেওয়ার জন্য মন টুণ্ডা করে বসে থাকে। গুণতুকের চারপাশে এত ফাঁক যে হাজার আটঘাট বাঁধলেও ফসকে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলোআনা।
যখন কোনও কিছুতেই হয় না, তখন নকুড় শেষ ব্যবস্থার কথা বলে। বলে অমাবস্যার দিন মাঝরাতে মাটি খুঁড়ে মানুষের হাড় তুলতে হবে। সে তোমার মুসলমানের বা হিন্দু বোষ্টমের গোর থেকেই হোক, হলেই হল। গায়ে কিন্তুন বস্তর থাকবে না। যেমনি হাড় তুলবে অমনি এক দমে ছুটে গিয়ে হাড়সুদ্ধ জলে ড়ুব দিয়ে উটবে। খবরদার, দম ছেড়ো না, পেছন থেকে কতজনা ডাকবে, কিন্তুন ফিরে তাকাবে না, সাড়া দেবে না। সামনে কেউ দাঁড়ালে, থুতু দিয়ে এগিয়ে যাবে। ভয় পেয়ো না। তাপর সে হাড় নে যদি একবার উঠতে পারো সোজা চলে আসবে আমার কাছে, যা করবার আমি করব।
শুনেই সকলের বুকের মধ্যে হিম হয়ে আসে। এ প্রচেষ্টার দুঃসাহস কারও নেই।
অবিশ্বাসীও অনেক আছে তার বন্ধুদের মধ্যে। তারা বলে, এ সব ছাড় নড়ে, অন্য কিছু কর। নকুড় অমনি বলে, জানিস কলকাতায় এসব কাজে এক এক জন লক্ষপতি হয়ে গেছে। রাজা মহারাজা তাদের দরজায় বাঁধা, সারা পিখিমির লোক আসে তাদের কাছে।
বন্ধুরা বলে, তবে এত জানিস তো দে শালা হারান কায়েতকে বান মেরে। ব্যাটা চল্লিশ টাকা মণ চাল বিকির করে।
নকুড় তাড়াতাড়ি জিভ কেটে চোখ বুজে হেসে বলে, ছি, যখন তখন এসব করলেই হল?
তবে দে বশীকরণ করে হারান কায়েতকে, শালা ধামা ধামা চাল মাগনা নে আসি। বলে বন্ধুরা। এ-সব কথার কোনও মূল্য নেই নকুড়ের কাছে। সে এদের গম্ভীর গুনিনের মতোই মিষ্টি হেসে ঠাণ্ডা করে।
ঠাণ্ডা হয় না হরিমতি। হায়, সে গুনিনী কিনা কে জানে, কিন্তু সে গুণ করেছে গুনিনকে। কাজে ভুল, মন্তরে ভুল, সব গোলমাল হয়ে যায়। এক এক সময় বিরক্ত হয়ে ওঠে লোকজনের উপর। এমন কী মতি মোড়লের তোষামোদের তোও বোঝে না সে।
হরিমতি তেমনি আসে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। টিপে টিপে হাসে। তার শরীরের বন্য ঢেউয়ের উত্তরঙ্গ জলে ফেলে দেয় নকুড়কে। আর কথায় কথায় কেবলি বলে, আমিও কিন্তুন গুনিনী, মাইরি বলছি।
নকুড় জোড়হাতে ব্যথিত অসবুর গলায় বলে ওঠে, মানি আমি তা হরিমতি। তুমি আমার গুরু, এটুখানিক নজর দেও তোমার শিষ্যির পরে।
অমা গো! বলে ছুটে পালিয়ে যাগ হরিমতি। তারপর দেখা যায়, ঝোপে ঝাড়ে তার হাসি ভরা চোখে জলের বন্যা। নকুড় গুনিন বলে কি বোঝে না কিছু? কেবলি গুরু শিষ্যি কথা। কেন, প্রাণ খুলে কথা বলুক, যা প্রাণ চায় করুক। কে বা জানত তার পোড়া মনে আবার এমন পোড়ানি আসবে, আসবে নকুড় ফিরে জোড়হাতে তারই প্রাণের দরজায়। এল যদি বা, তবে এত আনুকথা কেন? নিজের কপালকেও দূষে সে। সবই যদি গিয়েছিল, তবে আর সাধ কেন প্রাণে?
কিন্তু হরিমতি বোঝে না নকুড়কে, ধাঁধা লাগায় সে-ই। সে ভাবে, নকুড় কি আগের দিনের শোধ তুলতেও জানে না। না, এ জন্মবির দুঃখ সে বোঝে না। .এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই এক সময় মনে হয় হরিমতির, তার সারা গায়ের মধ্যে যেন শিরশির করছে। অজানতে বুকের কাপড় সরিয়ে কোল গুছিয়ে বসে সে। যেন তার সেই মরা ছেলেকে সে স্তন পান করাচ্ছে। তারপর আচম্বিতে হাওয়া লেগে গা ঢেকে ড়ুকরে ওঠে সে।
হরিমতি শুকোয়। চোখের কোল বসে যায়। তবু হা পিত্যেশে বসে থাকা নকুড়ের কাছে এসে আবার তেমনি হাসে। নকুড়ের মা তো হাড়েমাসে জ্বলে যায়। ছেলেকে বিয়ের তাড়া দেয়।
নকুড় অন্য লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে, হরিমতির কোনও দোষ টৈায় আছে নাকি?
জবাব পায়, চাল দেখে বুঝতে পারো না?
চাল দেখে? হ্যাঁ, তা ধন্দ তো খানিকটা লাগেই নকুড়ের মনে।
কয়েক মাস কেটে গেল। নকুড় ঘোরে এখানে সেখানে। স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে ভারী ভাব জমেছে। সেখানে নানান কথায় সময় কাটায়। মাস্টারের বন্ধ্যা বউ আবার তার কাছ থেকে মাদুলি নিয়েছে।
মাস্টার বলেন, সবই বুঝলাম গুনিন। তা একটা গুরু ঠিক করো, মানে প্রাণের গুরু হে। নইলে সব যে ভেস্তে যাবে।
মাস্টার তাঁর বউকে দেখিয়ে বলেন, এই যে আমার গুরু। এ গুরু যদি না ঠিক ধরতে পারো, তবে গুনিনের মন যে আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে।
বাঃ মাস্টার এত গুণের কথাও বলতে পারে? শুনে নকুড়ের মনটা আরও বেদনায় যন্ত্রণায় ব্যস্ততায় ভরে ওঠে। সে স্থির করে ফেলে, এবার বলেই ফেলবে সে হরিমতিকে তার প্রাণের কথাটা।
সেদিনও যখন হরিমতি এল, নকুড় মন স্থির করে ভাল করে তাকাল তার দিকে। শরীরটা ভারী শুকিয়ে গেছে হরিমতির কিন্তু হাসির ধার তাতে কমেনি, বরং বেড়েছে। তার বাঁকা ঠোঁটের পাশে হাসি যেন তিক্ত হয়ে উঠেছে খানিকটা। তার অপলক চোখে, কথায় লাঞ্ছনার ছায়া।
নকুড় বলল, ভারী শুক্কে গেছ।
যাব না। তোমাদের মতো গুনিন গাঁয়ে থাকলে আর কী হবে?
কেন কেন?
হরিমতি বলে ফেলল, আমাকে এটুস মন্তর শিখে দেও না?
কীসের?
বশীকরণের।
চকিতে নকুড়ের বুকটা পাথরের মতো জমে গেল। কথা বেরুল না তার মুখ দিয়ে। যেন চোখের সামনেই কেউ তার হৃৎপিণ্ডটা খুলে নিয়ে ঘেঁটে চটকে ফেলেছে। বলল, বশীকরণের। কেন?
হরিমতি তেমনি হেসে বলল, মরণ আমার। পিরিত হয়েছে, বুঝেছ? সে মিসের কোনও রীতি বুঝি না আমি, দেও দিনি এটু কিছু।
হরিমতির পিরিতের সে বস্তু আবার দিতে হবে নকুড়কেই? নকুড় বলল, তুমিও তো গুনিনী।
আমি তো পারলমনি বাপু।হাসির ছটায় যেন দপদপ করে জ্বলে উঠল হরিমতির মুখ।
সব, সমস্ত কিছু গোলমাল হয়ে গেছে নকুড়ের, ছিঁড়ে গেছে মনের সব আটঘাট। কিছুক্ষণ সে কথা বলতে পারল না। তার চোখে হঠাৎ রক্ত উঠে এসেছে, দপদপ করছে মাথার শিরাগুলি। মনের গুমরানি ফুটে উঠল তার শক্ত পেশিগুলিতে। বলল চিবিয়ে ফিসফিস করে, দেব, দেব মন্তর। থাকল আমার মনে, তুমি যাও।
নকুড়ের সে মুখ দেখে ভয় পেল হরিমতি। বলল, রাগ-মাগ করলে নাকি বাপু?
রাগ? হেসে বলল নকুড়, আমার কাছ থেকে বশীকরণ শিখবে, রাগ করব কেন?
তবু মনটায় ভারী অস্বস্তি নিয়ে গেল হরিমতি। গুনিনদের মাথায় কী আছে? এ সমসারের মানুষদের কি ওরা চোখ চেয়ে একটু দেখতেও পায় না। গুণতুক ছাড়া কি আর কিছু নেই? পোড়াকপাল, বশীকরণের গুণই যদি কিছু ঠাওর না পেল।
কিন্তু অদ্ভুত উত্তেজনায় ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল নকুড়। তারই দেওয়া বস্তু দিয়ে নিজের জীবন ভরবে হরিমতি? না, তার আগে নকুড় নিজের জন্যই সে বস্তু আনবে। তার আগে সে-ই হরিমতিকে বাঁধবে আষ্টেপৃষ্ঠে। সে আর হেলাফেলার জিনিস নয়। একেবারে আসল অস্ত্রই ছাড়বে সে। যক্ষ রক্ষ দত্যি দানো, যে-ই হও, কেউ ঠেকাতে পারবে না নকুড়কে।
দুদিন বাদেই অমাবস্যা এল।
নকুড় বেশ খানিকটা সিদ্ধি খেয়ে ভাম হয়ে রইল। তারপর মাঝরাত্রে নিশ্চুপে কোদালখানা নিয়ে গাঁয়ের বাইরের পথ ধরল।
ঘুটঘুটে কালো রাত। অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। মনে হয় প্রতিমুহূর্তেই যেন কারা আশেপাশে উপরে নীচে যাওয়া আসা করছে। গাছগুলো যেন ওতপাতা ভূতের মতো আছে দাঁড়িয়ে। বিদঘুটে নৈঃশব্দ্যকে ছাপিয়ে থেকে থেকে শেয়াল ডেকে উঠছে।
নকুড় হনহন করে এসে হাজির হল বেনাহাটি ও পানদিঘি গাঁয়ের সীমানায়। পানদিঘির কোল ঘেঁষে গোরস্থান। অদূরেই মস্ত দিঘি। দুদিকেই দিগন্তবিস্তৃত তেপান্তর অন্ধকার প্রেতের মতো ঘাপটি মেরে পড়ে আছে।
মুহূর্তে নিজেকে বিবস্ত্র করে নকুড় একটা মাস কয়েক আগের গোরে কোপ দিল। …অমনি মনে হল কারা যেন দুড়দাড় করে পালিয়ে গেল ছুটে।
কিন্তু নকুড় থামল না। সে কুপিয়ে চলল ঝপঝপ করে। আর কী সব বিড় বিড় করতে লাগল। তার সারা গায়ে ঘাম ফুটে বেরুল।
শেয়াল ডাকছে, কাঁদছে বুঝি বা শকুনের বাচ্চা।
কোদাল ঠক করে উঠল। পাওয়া গেছে? তাড়াতাড়ি নকুড় দু হাতে মাটি সরিয়ে ফেলতেই কী যেন ঠেকল হাতে নরম আর ভেজা। —এঃ টুকরো টুকরো মাংস লেগে থাকা কঙ্কাল। কিন্তু কঙ্কাল যেন নীরবে হাসছে!
কে যেন হেসে উঠল উপর থেকে খিলখিল করে। হরিমতি। হরিমতি হাসছে! মাটির তলা থেকে চকিতে ফিরে দেখল নকুড়। …না কেউ নেই।
সে প্রাণপণ শক্তিতে কঙ্কালের কবজিতে চাড় দিল। কিন্তু চকিতে মনে হল, একী করল সে? সে ফিরে তাকাল? তবে কি সব পণ্ডশ্রম হল!
এবার কঙ্কালও হা হা করে হেসে উঠল। উপর থেকে বার বার ডাকতে লাগল হরিমতি। ..নকুড় দাদা, নকুড় দাদা। ..একী করল সে? বার বার খালি একই কথা মনে হতে লাগল। তবু মট করে হাড় ভেঙে ফেলল সে কঙ্কালের কজি থেকে কনুই পর্যন্ত।
কিন্তু চারদিকে তার বিচিত্র হাসির কলরোল। কারা যেন তাকে ঘিরে ফেলে নাচছে।
সে লাফ দিয়ে উঠতে গেল। কিন্তু পা হড়কে যেতে লাগল, আছাড় খেতে লাগল বার বার।
কোনও রকমে যেই উঠল, অমনি হরিমতি তাকে পেছন থেকে স্পর্শ করে ডাকল। চমকে সে পিছন ফিরল। কিন্তু কোথায় হরিমতি!…আবার..আবার ভুল!
তাড়াতাড়ি দম আটকে সে ছুটে গেল দিঘির ধারে। নিস্তরঙ্গ কালো জল, তারার ছায়ায় চকচক করছে।
আবার ডাকছে হরিমতি …জলে লাফ দিতে গিয়ে এক মুহূর্ত চমকাল নকুড়। তখন আর দম থাকছে না। তার ভয় করছে। তার ভুল হয়েছে, সে পেছন ফিরেছে।
দত্যি-দানোর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে এসে সে নিজেই অন্ধকারে একটা উদোম ন্যাংটো প্রেতমূর্তি যেন।
ঝপ করে জলে লাফিয়ে পড়ল নকুড় হাড়সুদ্ধ। কিন্তু সেখানেও হাসি, সেখানেও হরিমতি। নকুড় পাড় খুঁজতে লাগল। যত খোঁজে, তত তলিয়ে যায়। কোথাও পাড় নেই।
কিছুক্ষণ বাদে দিঘির জল স্থির হয়ে গেল। কেবল এক জায়গায় কতগুলি বুদবুদ উঠে গেল মিলিয়ে।
নকুড় আর উঠল না।
পরদিন খানিক বেলায় গুনিনের মৃতদেহ যখন ভেসে উঠল দিঘির জলে, তখন লোকজন ছুটে গেল সেখানে। দেখল সবাই অদূরে মাটি খোঁড়া কবরের পাশে পড়ে আছে একটা কোদাল।
সবাই বলল, দানোয় মেরেছে চুবিয়ে গুনিনকে।
.
কেবল হরিমতি জলভরা চোখে ঘরের ছেঁচে আকাশের দিকে মুখ করে হাহাকার করে উঠল, গুনিন, তুমি হরিমতির মন বুঝলে নি। ও ছাই বস্তু কে চেয়েছিল। আবার যে জীবনে বাঁচতে চেয়েছিলাম, তুমি তা দিলেনি–দিলেনি।