পঞ্চদশ অধ্যায় – পুরুষোত্তমযোগ
“ভগবান্ বলিলেন, ‘হে অর্জুন! সংসাররূপ এক অব্যয় অশ্বত্থ (সংসারকে অশ্বত্থবৃক্ষে রূপক করা হইয়াছে। ‘শ্ব’ শব্দের অর্থ পরবর্তী প্রভাতকাল। ইহার সহিত স্থিতিবোধক ‘খ’ শব্দযোগে সংসারের অল্পকালস্থায়িত্ব নির্ণীত হইয়াছে; তাহার সহিত আবার অভাবার্থ ‘অ’ যোগ হওয়ায় নিষ্কর্ষার্থ হইয়াছে–অতটুকু অল্পকালও যাহার স্থায়িত্ব নাই। বস্তুতঃ সংসার সেইরূপই ক্ষণভঙ্গুর।) বৃক্ষ আছে, ঊর্দ্ধে উহার মূল এবং অধোদিকে উহার শাখা; বেদসমুদয় উহার পত্র; যিনি এই অশ্বত্থবৃক্ষ বিদিত হইয়াছেন, তিনি বেদবেত্তা। ঐ বৃক্ষের শাখা অধঃ ও ঊর্দ্ধদেশে বিস্তীর্ণ হইয়াছে, উহা সত্ত্বাদিগুণদ্বারা পরিবর্দ্ধিত হইতেছে এবং রূপ, রস প্রভৃতি বিষয়সকল উহার পত্র বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। ঐ বৃক্ষের ধর্মাধর্মরূপ কর্মপ্রসূতি (কার্য্যপরস্পরা) সকল অধঃপ্রদেশে জীবলোকে বিস্তীর্ণ হইতেছে। এই বৃক্ষের রূপ নিরীক্ষিত (উপলব্ধ–জ্ঞানের বিষয়ীভূত) হয় না; ইহার আদি নাই, অন্ত নাই এবং ইহা কিরূপে অবস্থান করিতেছে, তাহাও অবগত হওয়া যায় না। এই বদ্ধমূল অশ্বত্থবৃক্ষ সুদৃঢ় নির্মমত্বরূপ (মমতাশূন্যরূপ) শস্ত্রদ্বারা ছেদন করিয়া উহার মূলীভূত বস্তু অনুসন্ধান করিবে। উহা প্রাপ্ত হইলে পুনরায় প্রত্যাবৃত্ত হইতে হয় না। ‘যাঁহা হইতে এই চিরন্তনী (অনন্তকালস্থায়ী) সংসারপ্রবৃত্তি বিস্তৃত হইয়াছে, আমি সেই আদিপুরুষের শরণাপন্ন হই,’ এই বলিয়া তাঁহার অনুসন্ধান করিয়ে হইবে। যাঁহারা অভিমান, মোহ ও পুত্রকলত্রাদির প্রতি আসক্তি পরিত্যাগ করিয়াছেন এবং সুখ ও দুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়াছেন, সেই সমস্ত আত্মজ্ঞানপরায়ণ, নিষ্কাম, অবিদ্যাশূন্য মহাত্মারা অব্যয় পদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। যাহা প্রাপ্ত হইলে পুনর্বার প্রতিনিবৃত্ত হইতে হয় না; চন্দ্র, সূর্য্য ও হুতাশন যাঁহাকে প্রকাশিত করিতে সমর্থ হয়েন না; তাহাই আমার পরম পদ। এই জীবলোকে সনাতন জীব আমারই অংশ, ইনি প্রকৃতিবিলীন (প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত) পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনকে আকর্ষণ করেন। যেমন বায়ু কুসুমাদি হইতে গন্ধ গ্রহণপূর্বক গমন করিয়া থাকে, সেইরূপ যখন জীব শরীর লাভ ও শরীর পরিত্যাগ করে, তখন পূর্বদেহ হইতে ইন্দ্রিয়সমুদয় গ্রহণপূর্বক গমন করিয়া থাকে। এই জীব শ্রোত্র (কর্ণ), চক্ষু, ত্বক্, রসনা, ঘ্রাণ ও মনোমধ্যে অধিষ্ঠিত হইয়া বিষয়সমুদয় উপভোগ করে। বিমূঢ় ব্যক্তিরা দেহান্তরগামী, দেহাবস্থিত বা রূপাদি বিষয়ের উপভোগে লিপ্ত, ইন্দ্রিয়যুক্ত জীবকে কদাচ নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয় না; জ্ঞানচক্ষুঃসম্পন্ন মহাত্মারাই উহা অবলোকন করিয়া থাকেন। যোগী ব্যক্তিগণ যত্নবান হইয়া দেহে অবস্থিত জীবকে সন্দর্শন করিতে পারে না। চন্দ্র, অনল ও নিখিল ভুবনবিকাশী (বিশ্বের প্রকাশকর) সূর্য্য আমারই তেজে তেজস্বী। আমি ওজঃপ্রভাবে (তেজোযুক্ত শক্তি প্রভাবে) পৃথিবীতে প্রবেশ করিয়া ভূতসকলকে ধারণ এবং রসাত্মক চন্দ্র হইয়া ওষধিসমুদয়ের (বৃক্ষলতাদি) পুষ্টিসাধন করি। আমি জঠরাগ্নি (উদরস্থ পাকাগ্নি) হইয়া প্রাণ ও অপান বায়ুসমভিব্যাহারে দেহমধ্যে প্রবেশপূর্বক চতুর্বিধ ভক্ষ্য পাক করিয়া থাকি।
” ‘আমি সকলের হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া আছি, আমা হইতেই স্মৃতি, জ্ঞান ও উভয়ের অভাব জন্মিয়া থাকে। আমি চারিবেদদ্বারা বিদিত হই এবং আমি বেদান্তকর্তা ও বেদবেত্তা। ক্ষর ও অক্ষর এই দুইটি পুরুষ লোকে প্রসিদ্ধ আছে, তন্মধ্যে সমুদয় ভূতই ক্ষর ও কূটস্থ পুরুষ অক্ষর। ইহা ভিন্ন অন্য একটি উত্তম পুরুষ আছেন, তাঁহার নাম পরমাত্মা; এই অব্যয় পরমাত্মা ত্রিলোকমধ্যে প্রবেশ করিয়া সমস্ত প্রতিপালন করিতেছেন। আমি ক্ষর ও অক্ষর, এই দুই প্রকার পুরুষ অপেক্ষা উত্তম, এই নিমিত্ত বেদ ও লোকমধ্যে পুরুষোত্তম বলিয়া কীর্তিত হইয়া থাকি। যে ব্যক্তি মোহশূন্য হইয়া আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া বিদিত হয়, সেই সর্ববেত্তা, সর্বপ্রকারে আমার আরাধনা করে। হে অর্জুন! আমি এই পরম গুহ্য শাস্ত্র কীর্তন করিলাম, ইহা বিদিত হইলে লোক বুদ্ধিমান ও কৃতকার্য্য হয়।’ “