জন্তুওয়ালা অনেক জন্তু লইয়া শহরে একটি ঘর ভাড়া করিয়াছে। মনে করিয়াছে, আজ হাটের দিন বিন্তর লোক আসিবে, আর তামাশা দেখিয়া পয়সা দিবে। হাটে লোকের কম নাই, কিন্তু জন্তুওয়ালার ঘরের আধখানাও ভরিল না। জন্তুগুলারও যেন ফুর্তি নাই। লোক কম দেখিয়া তাহারাও কেমন হাল ছাড়িয়া দিয়াছে। ভাল তামাশা হইতেছে না দেখিয়া যে দু-চার জন দর্শক উপস্থিত, তাহারাও হাসি- ঠাট্রা করিতেছে।
এমন সময়ে বাঘটার যেন কি হইল। সে এতক্ষণ খাঁচার এক কোণে শুইয়া ঝিমাইমেছিল। কথা নাই, বার্তা নাই, হঠাৎ লাফাইয়া উঠিয়া, খাঁচার শিক ধারিয়া দাঁড়াইয়া ভয়ানক গর্জন! সেই গর্জন শুনিয়া দর্শকেরা হাসি ঠাট্রা ফেলিয়া, দুই লাফে দূরে সরিয়া গেল।
ব্যাপারখানা কি? এত রাগের ত কোনো কারণই দেখা যায় না- তবে ঐ যে গাঁট্রাগোট্রা, লাল-গোঁপওয়ালা জাহাজের মাল্লাটা, নীল কোট পরিয়া থেঁতলো টুপি মাথায় দিয়া, এইমাত্র তামাশা দেখিবার জন্য ঘরের ভিতরে আসিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া যদি বাঘ মহাশয়ের ক্রোধ হইয়া থাকে।
মাল্লা বাঘের খাঁচার দিকে চাহিল, বাঘটাকেও খানিকক্ষণ ধরিয়া মনোযোগ করিয়া দেখিল, তারপর অমনি একেবারে বাঘের কাছে গিয়া উপস্থিত! বাঘ তাহাকে কাছে পাইয়া আরো গর্জন করিয়া উঠিল। দর্শকেরা ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল, আর তাহাদের বড় ভয়ও হইল। মাল্লা কিন্তু ততক্ষণে খাঁচার ভিতর হাত ঢুকাইয়া দিয়া, দিব্যি বাঘের মাথা চাপড়াইতে আরম্ভ করিয়াছে- সেটাকে যেন সে বিড়াল ছনা পাইয়াছে। মাল্লা বলিল- কি রে বিল্লি, কেমন আছিস ভাই? লোকগুলি ভয়ে শিহরিয়া উঠিল্ যে- ভয়ংকর দাঁত, এক কামড়েই ত মাল্লার হাতখানাকে একেবারে ছিঁড়িয়া ফেলিবে। বাঘ কিন্তু তেমন কিছুই করিল না। সে তাহার প্রকাণ্ড মাথাটা আনিয়া, আদর করিয়া জ্যাকের (মাল্লার নাম) হাত ঘষিতে লাগিল, আর আদর পাইলে বিড়ালের গলায় যেমন গুড়গুড় শব্দ হয়, তেমনি শব্দ করিতে লাগিল।
মূহুর্তের মধ্যে বাহিরের লোকে ইহার খবর পাইয়া দৌড়িয়া ঘরে আসিতে লাগিল, ঘরে আর লোক ধরে না। কত লোক দরজার এক পয়সার জায়গায় সিকি দুআনি ফেলিয়া দিয়া আর বাকি পয়সার জন্য দাঁড়ায় নাই, তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকিতে পারিলেই ঢের মনে করিয়াছে। জন্তুওয়ালার এখন আর দুঃখ করিবার কোনো কারণ নাই। তাহার বাক্স বোঝাই হইয়া গিয়াছে।
মাল্লা ততক্ষণে জন্তুদের একজন প্রহরীর হাত ধরিয়া বলিল, ‘বিল্লির খাঁচাটা একবার খোলো না ভাই। ও আমার পুরনো বন্ধু। একবার ভেতরে গিয়ে ওর সঙ্গে পুরনো কালের দুটো গল্প করে নিই।’
প্রহরি বেচারা একটু মুশকিলে পড়িল, আর তা হওয়ারই কথাল বাঘকে বিশ্বাস কি? চোখের সামনে একটা লোককে চিবাইয়া খাইবে, এরূপ দেখিতে তাহার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না। আর খাঁচা খুলিলে জ্যাক ঘরে যাইবেন, অথচ বাঘ বাহিরে আসিবেন না, এরূপ করাও ত সহজ ব্যাপার নয়। বাঘ যদি একবার বাহিরে আসিয়া হাই তোলেন, তবে তামাশাটা কি রকমের হইবে! প্রহরী আমতা আমাতা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি সত্যি বলছ নাকি?’ জ্যাক একটু চটিয়া বলিল, ‘সত্যি বলছি না ত কি? এ কোথাকার বোকা! দেখতে পাচ্ছ না, ও আমাকে চিনতে পেরেছে?’
বাঘ সেই সময় আর- এক হাঁক দিয়েছে, যেন বলিতেছে- ‘হ্যাঁ হে হ্যাঁ।’
প্রহরী অনেক ইতস্তত করিয়া একহাতে দরজা খুলিল, আর- এক হাতে একখানা লোহার রুল বাগাইয়া ধরিল। জন্তুগুলি কথা না শুনিলে ঐ রুল দিয়া সে তাহাদের শাসন করে।
যেই দরজা খুলিল, অমনি দর্শকেরা তাড়াতাড়ি সরিয়া দাঁড়াইল- পাছে বাঘমহাশয়ের হঠাৎ জলযোগের খেয়াল হয়, আর বাহিরে আসিয়া দু- একটিকে ধরিয়া মুখে দেয়! কিন্তু বিল্লি তাহার বন্ধুকে লইয়া ব্যস্ত ছিল, অন্য লোকের কোনো খবর নেয় নাই।
বাঘ অনেকবার মাল্লার চারিদিকে ঘুরিয়া অত্যন্ত স্নেহের সহিত তাহার গায়ে মাথা ঘষিতে লাগিল। তারপর দুই পায়ে দাঁড়াইয়া, হাত দুখানি জ্যাকের কাঁধে তুলিয়া দিল, জ্যাকও তাহার টুপিটা লইয়া বাঘের মাথায় পরাইয়া দিল।
টুপি পরিয়া বাঘকে নেহাত মন্দ দেখিতে হইল না- দর্শাকেরা খুবই হাসিয়াছিল। কিন্তু তারপর আরো মজা হইয়াছিল।
টুপিটি ফিরাইয়া লইয়া মাল্লা বলিল, ‘বিল্লি, যা শিখিয়েছিলাম, মনে আছে ত? দেখি- লাফা।’ মাল্লা হাত খুব বাড়াইয়া ধলিল, আর বাঘ তাহার ঐ প্রকাণ্ড শরীরটা লইয়া পরিষ্কার তাহার উপর দিয়া লাফাইয়া গেল।
‘আচ্ছা, ফিরে এসো।’ বাঘ অমনি আবার লাফাইয়া ফিরিয়া আসিল। ভারি বাধ্য ছাত্র! প্রহরী ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল। সে কত চেষ্টা করিয়াও সেই বাঘকে দিয়া এত কাজ করাইতে পারে নাই। তাই সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ভাই,এত কথা ওকে কি করে শেখালে?’
জ্যাক হাসিয়া বলিল, ‘জাহাজে থাকতে ওকে খাওয়ানোর ভারটা আমার হাতেই ছিল। সেটা দেখছি আজও সে ভোলে নি, কেমন রে বিল্লি?’ বাঘ একটু ঘোঁত করিল, যেন বলিল ‘আরে,না।’
মাল্লা বলিল, ‘আচ্ছা বিল্লি, বোসো ত’। অমনি বাঘ মাটিতে বিড়ালের মতন করিয়া বসিয়া পড়িল। মাল্লা তাহার গায়ে ঠেসান দিয়া বসিয়া এক হাতে তাহার থাবা চুলকাইয়া দিতে লাগিল। তারপর গান ধরিল।
বাঘ গানের সঙ্গে সঙ্গে ধুপধাপ করিয়া খাঁচার মেঝে চাপড়াইতে লাগিল। খাঁচাখানা কাঁপিতে লাগিল। মাল্লা যখন খুব জোরে গাহিতে লাগিল, তখন বাঘ ‘এয়াও’ করিয়া তাহার সঙ্গে তান ধরিল। সেই তানের চোটে ঘরের জানলাগুলি খট খট করিয়া উঠিল।
আরো তামাশা হইত,কিন্তু জ্যাক এই সময়ে জানালার ভিতর দিয়া গির্জার ঘড়ি দেখিতে পাইল। তাহাকে রেলে অনেক দূর যাইতে হইবে, আর দেরি করিলে চলিতেছে না। সুতরাং সে বিল্লির কাছে বিদায় লইল। বিল্লি কিন্তু তাহাকে অত তাড়াতাড়ি ছাড়িতে রাজি নহে। জ্যাকের সঙ্গে সঙ্গে সেও খাঁচার দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। প্রহরী দরজা খুলিলে সেও জ্যাকের সঙ্গে যাইবে! প্রহরী দরজা খুলিতেছিল, বাঘের কাণ্ড দেখিয়া আর খুলিল না। জ্যাক তিনবার চুপচাপ সরিয়া পড়িতে চেষ্টা করিল, বাঘ তাহার কোটের কোণ কামড়াইয়া ধরিয়া তিনবার ফিরাইল। জ্যাক মুশকিলে পড়িয়া বলিল, ‘এ ত বড় মুশকিল রে বাবু। আমি ত থাকতে আসি নি, আমি শুধু দেখতে এসেছিলাম।’
কিন্তু প্রহরীর মুখ ততক্ষণে গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছে। মাল্লা যতই যাইতে চাহিতেছে, বাঘ ততই বিরক্ত হইতেছে। শেষে চটিয়া গিয়া এক থাপ্পড় বসাইয়া দিলেই ত মাল্লার দফা নিকাশ হইয়া যায়! এই সময়ে এক বুদ্ধি জুটিল। খাঁচাটাতে দুই কামরা। বাহিরটাতে বাঘ সকল লোকের সামনে তামাশা দেখায়, ভিতরেরটাতে বসিয়া সে আহার করে। মাঝখানে দরজা আছে, বাহির হইতেই তাহা খোলা ও বন্ধ করা যায়। এই ভিতরের কামরায় বড় এক টকুরো মাংস ঢুকাইয়া দেওয়া হইল, আর বাঘ অমনি বন্ধুকে ভুলিয়া খাইবার ঘরে ঢুকিল। চতুর প্রহরী তৎক্ষণাৎ মাঝকানের দরজা বন্ধ করিয়া দিল। জ্যাকও সুযোগ বুঝিয়া তাহার পথ ধরিল।