চারপাশে তাকিয়ে বেশ ভালোই লাগছিল বীরেশ্বরবাবুর। যেদিকে চোখ যায় ফাঁকা মাঠ। ধান কাটা হয়ে গেছে। কোথাও আবার সবুজের সমারোহ, অথবা রাস্তার পাশে পুকুর বা নয়ন জুলির পাড়ে গাছের ডালে বসে আছে মাছরাঙা অথবা কোঁচ বক। যে দৃশ্য কলকাতা শহরে চোখ পড়ে না। ছোট ছোট বসতি বা গ্রামও চোখে পড়ছে মাঝে মাঝে। রাস্তার মোড়ে শীতের দুপুরে পিঠে রোদ লাগিয়ে তাস খেলছে কিংবা আড্ডা দিচ্ছে লোকজন। রাস্তার গায়ে অনেকসময় বিরাট টিনের ছাউনিঅলা গোডাউনের মতো কাঠামো বা প্রাচীর ঘেরা ফার্মহাউসের মতো জায়গা নজরে পড়ছে। কলকাতার অনেকেই আজকাল এসব জায়গাতে কিছুটা সস্তায় জমি কিনে গুদাম, ফার্মহাউস বা পিকনিক স্পট বানাচ্ছে বলে শুনেছেন বীরেশ্বরবাবু।
কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে প্রথমে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে, তারপর ব্যারাকপুর হয়ে সোজা রাস্তা ধরেছেন তিনি। যেতে হবে শ্যামনগরের কাছে, এ রাস্তার গায়ে কেউটিয়া নামের এক জায়গাতে।
বীরেশ্বরবাবু নিয়মিত অবশ্য আসেন না, কিন্তু রাস্তা সম্পূর্ণ অচেনা নয়। এ রাস্তা দিয়ে গাড়ি নিয়ে বার কয়েক নৈহাটি, কাঁচরাপাড়া, কল্যানীতে তিনি গেছেন বইয়ের ক্যানভাসিং বা মাল সাপ্লাই দিতে। বীরেশ্বরাবুর বাড়ি হেঁদুয়াতে ও তার পাঠ্যপুস্তক আর স্টেশনারি বইয়ের দোকান আছে কলেজ পাড়াতে। খাওয়া সেরে দুপুরবেলাতে গাড়ি নিয়ে একাই বেরিয়েছেন বীরেশ্বরবাবু। ধীরে—সুস্থেই গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। গন্তব্যে পৌঁছনোর খুব একটা তাড়া নেই তার।
আসলে বীরেশ্বরবাবু তার ব্যবসার প্রয়োজনে এদিকে রওনা হননি। রওনা হয়েছেন অন্য প্রয়োজনে। বহুদিন ধরে বীরেশ্বরবাবুর ইচ্ছে একটা কুকুর পোষার। ছেলেবেলায় একসময় ভুলু নামের একটা নেড়ি কুকুর অর্থাৎ স্ট্রিট—ডগ ছিল তাঁর। সারমেয়প্রেমটা হয়তো সেই সময় থেকেই তার মনে বাসা বেঁধেছিল। বড় হয়ে নিজে রোজগার শুরু করার পর মাঝে মাঝেই তাঁর মনে হতো, একটা ভালো জাতের কুকুর কিনবেন। কিন্তু ব্যবসার চাপে কিনব কিনব করেও আর কেনা হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু এরমধ্যে একদিন বাড়ি ফিরে তিনি টেলিভিশনের একটা চ্যানেলে একটা ইংরেজি সিনেমা দেখেছেন ডোবারম্যান কুকুরদের নিয়ে। আর সেই হলিউড মুভিটা দেখার পরই বীরেশ্বরবাবুর মনের সুপ্ত ইচ্ছেটা আবার প্রবল ভাবে চাগাড় দিয়ে উঠেছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একটা কুকুরের বাচ্চা কিনবেন, এবং ডোবারম্যানের বাচ্চাই কিনবেন।
পুরোনো দিনের বিরাট বাড়ি বীরেশ্বরবাবুর। একতলা, দোতলা মিলিয়ে বেশ অনেককটা ঘর। পুরোনো চাকর আর বীরেশ্বরবাবু ছাড়া আর কোনও লোক নেই সে বাড়িতে। সংসার পাতেননি তিনি। আর এই প্রৌঢ় বয়সে নতুন করে সংসার পাতার ব্যাপারও নেই। কাজেই কুকুর পোষার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হবে না। শুধু শখ নয়, কুকুর কেনার পিছনের দুটো যুক্তিও কাজ করছে বীরেশ্বরবাবুর মনে। বীরেশ্বরবাবু ব্যবসা, দোকানের কাজে রোজ সকাল ন’টাতে বাড়ি ছেড়ে বেরোন, আর ফেরেন রাত ন’টাতে। চাকর ভুজঙ্গকেও মাঝে মাঝে দোকানবাজারে যাবার জন্য বাড়ি খালি রেখে বেরোতে হয়। কুকুর থাকলে সে পাহারাদারের কাজ করতে পারবে। ডোবারম্যান বলে কথা! চোর—ডাকাত সহজে বাড়ির কাছে ঘেঁষবে না। আর দ্বিতীয়ত, বীরেশ্বরবাবু একটা ম্যাগাজিনে পড়েছিলেন যে, বাড়িতে পোষ্য কুকুর থাকলে নাকি তাদের সঙ্গে থাকলে উচ্চরক্তচাপ বা হাইব্লাডপ্রেশার কমে। বীরেশ্বরবাবু নিজে উচ্চরক্তচাপের রোগী। সারমেয়র সান্নিধ্যে সেটা যদি কমে তবে মন্দ কি!
কিন্তু কোথা থেকে কুকুর কিনবেন বীরেশ্বরবাবু? তাঁর দোকানে ভবানীবাবু নামের এক খদ্দের আসেন। ভদ্রলোকের একটা ছোট স্প্যানিয়ল কুকুর আছে, কথা প্রসঙ্গে একবার শুনেছিলেন বীরেশ্বরবাবু। কুকুর কেনার ব্যাপারে তার কাছে বীরেশ্বরবাবু পরামর্শ চাইতে তিনি বলেছিলেন—’গ্যালিফ স্ট্রিটের হাট থেকে বা নিউমার্কেট থেকে না কেনাই ভালো। বিক্রেতা বা দালালদের কমিশনের কারণে চড়া দাম পড়ে, অনেকসময় তারা রোগগ্রস্তও হয়। আপনি একটা কাজ করুন, রবিবারের বিজ্ঞাপনের পাতাতে প্রায়শই কুকুর মালিকরা কুকুর বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন। তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে কুকুর কিনুন। তাতে দামেও কম পড়বে, আর কুকুরের কোনো ত্রুটি থাকলে কুকুরের মালিককে গিয়ে ধরতেও পারবেন।’
ভবানীবাবুর কথা শুনে পরদিন সকালে, ঠিক এক সপ্তাহ আগের একগাদা দৈনিক সংবাদপত্র কিনে এবং তার মধ্যে ঘেঁটে একটা বিজ্ঞাপন পেয়েছিলেন বীরেশ্বরবাবু। হ্যাঁ, ডোবারম্যান কুকুরের বাচ্চা বিক্রির বিজ্ঞাপন। একটা ল্যান্ডফোনের নম্বর দেওয়া ছিল তাতে। বিজ্ঞাপনের সেই নম্বর দেখে বীরেশ্বরবাবু ফোন করেছিলেন বিজ্ঞাপনদাতাকে। তিনি অবাঙালি। নাম নরেশ তিওয়ারি। ভদ্রলোক ইমপোর্ট—এক্সপোর্টের ব্যবসা করেন। তিনি বীরেশ্বরবাবুকে জানিয়েছিলেন, শহরের বাইরে কল্যানী—ব্যারাকপুর এক্সপ্রেসওয়ের গায়ে তাঁর একটা ফার্মহাউস আছে। কুকুরের বাচ্চাগুলো মা সমেত সেখানেই আছে। বীরেশ্বরবাবু যদি অগ্রহী থাকেন তবে আগামী রবিবার অর্থাৎ এদিন বিকাল চারটে নাগাদ যেন তার ফার্মহাউসে পৌঁছে যান। নরেশ তিওয়ারি থাকবেন সেখানে। বাচ্চা পছন্দ হলে তারপর দামদর নিয়ে কথা হবে। ফার্মহাউসটা চিনতে অসুবিধা হবে না। রাস্তার গায়েই সেটা। ‘তিওয়ারি এন্ড কোং’ বলে একটা সাইনবোর্ডও আছে। সেখানে যাবার জন্যই যাত্রা করেছেন বীরেশ্বরবাবু। সঙ্গে একটা বড় খাঁচার মতো বাক্স এনেছেন। বাচ্চা আর দামদর পছন্দ হলে আজই তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন তিনি।
২
কলকাতা ছাড়লেই ধোঁয়া—দূষণ থেকে মুক্ত হয়ে মনটা কেমন যেন ভালো হয়ে যায়। তার ওপর চারপাশে এমন সুন্দর উন্মুক্ত প্রকৃতি! তা দেখতে দেখতে ধীরেসুস্থে চারদিকের সৌন্দর্য অনুভব করতে করতে একসময় বীরেশ্বরবাবু সেই জায়গার কাছাকাছি পৌঁছে গেলেন। একটা বড় মোড় পড়ল প্রথমে। সেখানে গাড়িটা একটু থামিয়ে একজন পথচারীকে জিগ্যেস করতেই সে জানাল, আর একটু এগোলে সামনেই ‘কেউটিয়া’, সেই মতো এগোলেন বীরেশ্বরবাবু। লোকটার কথামতো মাইলখানেক এগোতেই রাস্তার কিছুটা তফাতে ডান হাতে উঁচু প্রাচীর ঘেরা ফার্মহাউসটা চোখে পড়ল বীরেশ্বরবাবুর। হ্যাঁ, লোহার পাত বসানো বিরাট গেটের মাথায় লেখা আছে, ‘তিওয়ারি এন্ড কোং কেউটিয়া।’ ভিতরে একটা টিনের ছাদঅলা গোডাউন মতো বড় জায়গা আছে। তার ছাদের অংশটা বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। ফার্মহাউসটার চারদিকে প্রচুর ফাঁকা জমি। ফাঁকা মাঠের মধ্যে একলা দাঁড়িয়ে আছে তিওয়ারির ফার্ম হাউস।
বীরেশ্বরবাবু ঘড়ি দেখলেন। হ্যাঁ, চারটে বাজতে চলেছে। বেলা দুটোর পর রওনা দিয়েছিলেন তিনি। ঘণ্টা দেড়েক মতো তার সময় লেগেছে পৌঁছতে। মিনিট দশেক সময় কাটিয়ে ঠিক চারটে বাজতেই গাড়িটাকে পিচ রাস্তা থেকে নামিয়ে গেটের সামনে নিয়ে গিয়ে হর্ন বাজালেন।
বারকয়েক হর্ন বাজাবার পর গেটটা ভিতর থেকে খুলে গেল। মাঝবয়সি শীর্ণকায় একজন লোক দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। বীরেশ্বরবাবু গাড়ি থেকে নামলেন। লোকটা বীরেশ্বরবাবুকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল, ‘আমার নাম বনমালী, এখানকার কেয়ারটেকার। আপনি কোথা থেকে আসছেন? কী ব্যাপারে এসেছেন?’
বীরেশ্বর বললেন, ‘আমার নাম বীরেশ্বর দাশ। কলকাতা থেকে আসছি। তিওয়ারি সাব আছেন? তার সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছিল ডোবারম্যান কুকুরের বাচ্চার ব্যাপারে। তিনি আজ এই সময় আমাকে আসতে বলেছিলেন।’
বীরেশ্বরবাবুর কথা শুনে বনমালী বলল, ‘হ্যাঁ, আরও দু—তিনজন লোক এসেছিলেন সেই কারণেই। কিন্তু মালিকের এখানে থাকার কথা থাকলেও ব্যবসার জরুরি কাজে আটকে গেছেন। তিনি আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন, ফিরতে ফিরতে তাঁর রাত ন’টা বেজে যাবে।’
বনমালীর কথা শুনে বেশ আশাহত হলেন বীরেশ্বরবাবু। রাত ন’টা মানে তো তাকে পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। তার ওপর আবার শীতের রাত। অত রাত পর্যন্ত কীভাবে থাকবেন তিনি! এতটা পথ আসা কি তবে বিফলে গেল?’
বীরেশ্বরবাবুর মনের ভাব বুঝতে পেরেই সম্ভবত বনমালী বলল, ‘তবে আপনি কুকুরছানাগুলো দেখে যেতে পারেন। পছন্দ হলে মালিকের সঙ্গে টেলিফোনে বা এখানে এসে কথা বলে দামদর করে নিয়ে যাবেন।’
কথাটা শুলে মৃদু আশ্বস্ত হলেন বীরেশ্বরবাবু। বললেন, ‘চলো দেখি?’
লোকটার পিছন পিছন বিরাট লোহার দরজার ফাঁক গলে বীরেশ্বরবাবু ভিতরে প্রবেশ করলেন। ভিতরে বিরাট জমিটার ঠিক মাঝখানে টিনের দেওয়াল আর টিনের ছাদঅলা গোডাউনের মতো বাড়িটা দাঁড়িয়ে। প্রাচীরের ভিতর বেশ কিছু গাছ এমনকী একটা গ্রিনহাউস চোখে পড়লেও, চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বড় বড় যন্ত্রাংশ, প্যাকিং বাক্স ইত্যাদি দেখে বীরেশ্বরবাবু অনুমান করলেন এ জায়গা ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই বেশি ব্যবহৃত হয়। বনমালী বীরেশ্বরবাবুকে নিয়ে কিছুটা এগিয়ে প্রবেশ করল সেই বিশাল টিনের বাড়িটার ভিতর। তারা ভিতরে পা রাখতেই গোডাউনের শেষ মাথা থেকে একটা কুকুর ডাকতে শুরু করল। অনেকটা ধমকের স্বরে ডাক। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বার্কিং।’ ডোবারম্যানের ডাক।
বনমালী নামের লোকটা বলল, ‘ওদের ঘ্রাণ শক্তি আর কান কি তীক্ষ্ম দেখেছেন! ডোবারম্যান বলে কথা! ও কিন্তু আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু ঠিক বুঝতে পেরেছে গুদামে অচেনা কেউ ঢুকেছে! ওই গুদাম পাহারা দেবার জন্যই ওকে এখানে আনা হয়েছিল।’
বীরেশ্বরবাবু বেশ খুশি হলেন কথাটা শুনে। ‘হ্যাঁ, এমন একটা কুকুরইতো তার দরকার। তেজী, পাহারাদার ডোবারম্যান কুকুর। প্যাকিংবাক্স আর যন্ত্রপাতির ফাঁক গলে বীরেশ্বরবাবু যত গুদামের শেষ প্রান্তের দিকে এগোতে লাগলেন, ততো সে গর্জন বাড়তে লাগল। আর যে শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল উঁচু টিনের চালে গমগম শব্দে। অবশেষে গুদামের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলেন তিনি। বড় বড় প্যাকিং বাক্সর আড়ালে জালে ঘেরা বেশ খানিকটা কুকুর রাখার জায়গা বা কেনেল। একটা মিশিমিশে কালো ডোবারম্যান দাঁড়িয়ে ডাকছে তার ভিতর। তারা কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রাণীটা প্রথমে প্রচণ্ড গর্জন করে জালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার সেই মূর্তি দেখে মৃদু ভয়ও পেয়ে গেলেন বীরেশ্বরবাবু। তবে বনমালী বেশ কয়েকবার ‘লুসি লুসি’ বলে ডাকতেই ধীরে ধীরে সে শান্ত হয়ে গেল। বনমালী বলল ‘ভয় পাবেন না। আসলে বাচ্চাকে বাঁচাবার জন্য সব মায়েরাই সতর্ক থাকে। নতুন লোককে দেখতে পেয়ে ও সতর্ক করল।’
জালে ঘেরা জায়গাটার ভিতর ভালো করে তাকিয়ে এবার বাচ্চাগুলোকে দেখতে পেলেন বীরেশ্বরবাবু। জাল ঘেরা জায়গার ভিতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে তারা। চারটে বেশ বড় আকারের বাচ্চা। তিনটে বাদামি রঙের আর একটা তার মার মতো মিশমিশে কালো। বনমালী বলল, ‘বাদামি তিনটে বাচ্চা মেয়ে, আর কালোটা ছেলে।’
এ কথা বলার পর জালে ঘেরা জায়গাটার দরজার শিকল বাইরে থেকে খুলে ভিতরে প্রবেশ করল বনমালী। বড় কুকুরটা এগিয়ে এল তার কাছে। বনমালী তার মাথায় কয়েকবার আদর করে হাত বোলাবার পর কালো বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে খাঁচার দরজা বন্ধ করে বীরেশ্বরবাবুর সামনে দাঁড়াল। বেশ নাদুস—নুদুস বাচ্চাটা। তার বোনেদের মতো আকারেও বেশ বড়। বনমালী বলল, ‘কেমন দেখছেন?’
বীরেশ্বরবাবু জবাব দিলেন ‘ভালো কিন্তু বাচ্চাগুলো দেখেছি বেশ খানিকটা বড় হয়ে গেছে! ঠিক পোষ মানবে তো?’
বনমালী বলল, ‘নিশ্চয়ই মানবে আদর আর খাবার পেলে। ওর মা, এর থেকেও বড় বয়সে এখানে এসেছিল। আমি পোষ মানিয়েছি। আসলে মালিক প্রথমে ভেবেছিলেন যে বাচ্চাগুলোকে বিক্রি করবেন না। মালিকের আরও অনেকগুলো গুদাম আছে। বাচ্চাগুলোকে বড় করে এদের মার মতো সে সব জায়গাতে পাহারার কাজে লাগাবেন। তাই তিনি আরও ছোট বয়সে বাচ্চাগুলো বিক্রি করেননি। কিন্তু পরে তিনি মত বদলেছেন। কারণ, ওসব গুদামে কুকুর পরিচর্যার মতো লোক নেই। এক দিক থেকে ভালো। ওরা এখন আর শুধু মায়ের দুধের ওপর নির্ভরশীল নয়। লুসির দুধও বন্ধ হয়ে এসেছে। আপনার খাওয়াতে অসুবিধা হবে না।’ একথা বলার পর বনমালী বললেন, ‘একবার হাত দিন ওর গায়ে। কিছু হবে না।’
বীরেশ্বরবাবু যেই বাচ্চাটাকে ছুঁতে গেলেন ওমনি প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল লুসি। বীরেশ্বরবাবু চমকে উঠে হাতটা নামিয়ে নিলেন। বনমালী বলল, ‘নিন এবার হাত দিন। বললাম না সব মা’ই তার বাচ্চার খাবার আর সুরক্ষার কথা ভাবে।’
বীরেশ্বরবাবু এবার হাত দিলেন বাচ্চাটার গায়ে আর মাথায় আদরের স্পর্শ পেয়ে বাচ্চাটা তার লালটুকটুকে জিভ বার করে বীরেশ্বরবাবুর আঙুলটা একবার চেটে দিল। বেশ খুশি হলেন বীরেশ্বরবাবু। তিনি বললেন, ‘বেশ পছন্দ হয়েছে বাচ্চাটা। তোমার মালিকের সঙ্গে কথা বলে দেখি। দামদর পোষালে, তিনি রাজি থাকলে সামনের রবিবার ওকে নিয়ে যাব। তার মাঝে আর সময় পাব না। তোমার মালিককে তখন ফোনে পাব কি?’
বনমালী বলল, যে ল্যান্ডলাইন নাম্বারটা কাগজে ছিল সেটা এখানকার। রাত ন’টার পর ফোন করবেন, পেয়ে যাবেন।’
‘মোবাইল নম্বর?’
‘ওটা আপনি মালিককে ফোন করে জেনে নেবেন। অনেকে অকাজে ফোন করে বিরক্ত করে বলে আমার সেই নম্বর দেওয়া নিষেধ।’ একটু ইতস্তত করে বলল বনমালী।
তার অসুবিধার কথা বুঝতে পেরে বীরেশ্বরবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে রাত ন’টায় আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে নেব।’
বনমালী এরপর বাচ্চাটাকে খাঁচার ভিতর ঢুকিয়ে তার দরজা বন্ধ করল।
বাচ্চা দেখা হয়ে গেছে বীরেশ্বরবাবুর। এবার তাকে ফিরতে হবে। তাক নিয়ে বনমালী এগোলে গুদামের বাইরে যাবার জন্য।
বীরেশ্বর বললেন, ‘তোমার মালিক এখানে থাকলে ভালো হত। হয়তো আজই সব কাজ মিটে যেত। কলকাতা থেকে অনেকটা দূরে এ জায়গা।’
কথাটা শুনে বনমালী বলল, ‘হ্যাঁ, আসলে মালিকের অনেক বড় ব্যবসা। খুব ব্যস্ত থাকেন। অনেকসময় তার কলকাতার বাড়ি থেকে বেরিয়ে হঠাৎই হয়তো ব্যবসার কাজে বিদেশ চলে গেলেন। আট—দশ দিন হয়তো বাড়ি ফিরতে পারলেন না।’
ও কথা বলার পর সে বীরেশ্বরবাবুকে প্রশ্ন করল, ‘স্যার কি এখন কলকাতা ফিরে যাবেন?’
‘হ্যাঁ, কেন?’
বনমালী একটু হাত কচলে বলল, ‘স্যার যদি আমাকে সঙ্গে করে কলকাতাতে নামিয়ে দেন তবে ভালো হয়। আসলে শিয়ালদা স্টেশন থেকে রাতের ট্রেন ধরে বর্ধমানে আমি দেশের বাড়ি যাব। ওখানে আমার পরিবার আছে। আজ আর কেউ কুকুর দেখতে আসবে না। পাঁচ—ছ—দিন পরে আবার এখানে ফিরব।’
গাড়িতে একাই ফিরবেন বীরেশ্বরবাবু। লোকটাকে নিতে সমস্যা নেই। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, চলো।’
মিনিটখানেকের মধ্যেই সেই গোডাউন, ফার্মহাউস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল দু—জনে। গেটে তালা লাগিয়ে বীরেশ্বরবাবুর সঙ্গে তার গাড়িতে চেপে বসল বনমালী। বীরেশ্বরবাবু কলকাতা ফেরার জন্য রওনা হলেন।
গাড়ি চালাতে চালাতে বীরেশ্বরবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি ওখানে একলাই থাকো?’
সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, স্যার। তবে কখনও কখনও মালিক এসে থাকেন। গুদামের পিছনে একটা ছোট বাড়ি আছে। সেখানে এসি বসানো ঘর আছে মালিকের থাকার জন্য।’
বীরেশ্বরবাবু বললেন, ‘অত বড় ফাঁকা জায়গাতে একলা থাকতে অসুবিধা হয় না? কাছেপিঠে কোনো লোকজন ঘরবাড়িও তো দেখলাম না!’
বনমালী জাবাব দিল, ‘হ্যাঁ, কথা বলার লোক নেই। কুকুরগুলোকে নিয়ে কোনোমতে সময় কেটে যায়। কাটাতেই হয়। না, কাটালে খাবইবা কি? ওই কুকুরগুলো হোক বা মানুষ হোক, সবথেকে বড় কথা হল পেটের ‘খিদে’। পশু হোক বা মানুষ ওই খিদের জন্য সব কিছু করতে পারে। পরিবারে অনেকগুলো পেট আছে। চাকরি না করলে নিজে খাব কী? তাদের খাওয়াব কী?’
বীরেশ্বরবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক কথা। খিদে বড় বালাই। তার জন্য সবাই সব কিছু করে। তুমি যে—কদিন থাকবে না, এ—কদিন ওদের খেতে দেবে কে? দেখভাল করবে কে? বাচ্চাগুলো কী খায়?’
সে বলল, ‘মালিক এসে দিন সাতেক থাকবেন এখানে। গুদাম থেকে কিছু মাল বাইরে যাবার কথা আছে। মালিকের ড্রাইভার ওদের খেতে দেবে। বাচ্চাগুলো সবই খেতে শিখেছে। দুধতো যে—কোনও বয়সি কুকুরই খায়। রুটি, সিদ্ধ করা অল্প অলুদ দেওয়া মাংস—মাছ সবই দিতে পারেন। কুকুরের ডাক্তারের কাছে পরামর্শ নিলেই তিনি খাবার—ওষুধপত্রর কথা বলে দেবেন।’
এ কথা বলার পর বনমালী বলল, ‘লুসি’ মানে বড় কুকুরটাকে প্রথম আনার পর তার খাবার নিয়ে প্রচণ্ড সমস্যা হয়েছিল।’
‘কেন?’ স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে জানতে চাইলেন বীরেশ্বরবাবু।
বনমালী উত্তর দিল, ‘লুসিকে মালিক বিদেশ থেকে এনেছিলেন। সেখানে ওকে কাঁচা মাংস খাওয়ানো হতো। কাঁচা মাংস খাওয়ালে কুকুর হিংস্র হয়ে ওঠে। ওদেশে মিলিটারি অথবা পুলিশের পাহারাদার কুকুর ছিল লুসির বাবা—মা। এখানে এসে তো কাঁচা মাংস ছাড়া প্রথমে কিছু খেতেই চাইত না লুসি। অনেক কষ্টে অভ্যাস পরিবর্তন করতে হয় আমাকে। কাঁচা মাংস স্বাদ বড় মারাত্মক। কুকুরকে কখনও কাঁচা মাংস খেতে দেবেন না।’
বনমালীর কথা শুনে কুকুরগুলোর পেডিগ্রিও মোটামুটি জানা হয়ে গেল বীরেশ্বরবাবুর। তিনি বললেন, ‘আচ্ছা। আমি নিলে ওই ছেলে বাচ্চাটাই নেব।’
বনমালী বলল, ‘হ্যাঁ, ওটাই নেবেন। কালোটাই সেরা। সত্যি কথা বলতে কী আমার নিজেরই বেশ মায়া পড়ে গেছে ওর ওপর। কুকুর কেনার আর খাওয়ানোর ক্ষমতা থাকলে আমি ওকে নিজের কাছেই রাখতাম। নিজের যদি পেট চলত তবে কি এতদূরে পড়ে থাকতাম?’
বীরেশ্বরবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল একটা ব্যাপার। তিনি বললেন, ‘আর যারা কুকুর দেখতে এলেন তারা কেউ পছন্দ করে রাখেননিতো কালো বাচ্চাটা?’
বনমালী হেসে বলল, ‘বাচ্চা দেখতে এলেও তারা কেউ কেনার পার্টি নয়। একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন তার স্ত্রীকে নিয়ে। ভদ্রমহিলা লুসির ডাক শুনে এমন ভয় পেলেন যে; তখনই তার স্বামীকে জানিয়েছিলেন যে, এ ধরনের ভয়ঙ্কর প্রাণী তিনি কিছুতেই বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না। আর দ্বিতীয় যে পাটির্টি এসেছিল সে মতলববাজ। অতি সামান্য পয়সাতে বাচ্চা হাতানোর মতলবে। মালিক নিশ্চিত তাকে বাচ্চা দেবেন না।’
কুকুরের বাচ্চা আর তাদের প্রতিপালন সম্পর্কে এরপর ফেরার পথে নানা তথ্য সংগ্রহ করলেন বীরেশ্বরবাবু। শিয়ালাদা স্টেশনের কাছেই এক জায়গাতে বনমালীকে নামালেন তিনি। এই নিম্নবিত্ত মানুষটার সঙ্গে বীরেশ্বরবাবুর কথা বলে বেশ ভালো লেগেছে। তাই তাকে নামাবার সময় পকেট থেকে একটা দুশো টাকার নোট বার করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘এটা তুমি রাখো ভাই। বাড়ির জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও।’
খুশি মনে টাকাটা নিল বনমালী। তারপর বলল, ‘রবিবার এলে দেখা হবে। কালোবাচ্চাটা নেবেন। আমিও ওটা দেবার জন্য মালিককে বলব। যাতে উনি ওটা আপনাকেই বিক্রি করেন।’ কথাগুলো বলে গাড়ি থেকে নেমে জনঅরণ্যে হারিয়ে গেল বনমানলী। বীরেশ্বরবাবুও বাড়ি ফিরে এলেন।
রাত ন’টার পর কুকুর—মালিক তিওয়ারিকে বেশ কয়েকবার ফোনে ধরার চেষ্টা করলেন বীরেশ্বরবাবু। কিন্তু রিং হয়ে গেল। টেলিফোন কেউ ধরল না।
৩
বীরেশ্বরবাবুকে তাঁর ব্যবসার কাজ একাই সামলাতে হয়। দোকান চালানো, অর্ডার ধরা, অর্ডার সাপ্লাইয়ের জন্য নানা জায়গাতে দৌড় ঝাঁপ। রবিবার ছাড়া সারাদিন অন্য কোনও কাজের, বিশ্রামের ফুরসতই পান না তিনি। আর এ সপ্তাহে কাজের প্রচুর চাপও ছিল তার। তবু তারই মধ্যে তিনি গত রবিবারের পর আরও তিন দিন বিভিন্ন সময় টেলিফোন করেছিলেন সেই কুকুর মালিককে। কিন্তু কোনওবারই তিনি তার নাগাল পাননি।
ডোবারম্যানের কালো বাচ্চাটাকে আসলে বেশ পছন্দ হয়েছে বীরেশ্বরবাবুর। রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমের আগে তার রোজ মনে পড়ে সেই বাচ্চাটার কথা। কী সুন্দর বাচ্চাটা! আর তার মা—টাও কী তেজি! বড় হয়ে ছেলেও নিশ্চই মায়ের মতনই হবে। কাজের চাপে দেখতে দেখতে সপ্তাহ ঘুরে গেল। আর এক রোববার চলে এল।
রোববার সকালে উঠে বীরেশ্বরবাবু ভাবলেন, শেষ একবার ফোন করে দেখা যাক ভদ্রলোককে। তাকে যদি না পাওয়া যায় তবে অন্য কোথাও বাচ্চার খোঁজ করবেন তিনি। কাগজে এদিনও অন্য একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে ডোবারম্যানের বাচ্চা বিক্রির ব্যাপারে। তিওয়ারীকে ফোনে না পাওয়া গেলে সেই নম্বরে ফোন করবেন তিনি। রবিবারটা তিনি নষ্ট হতে দেবেন না। আজ তিনি যে ভাবেই হোক একটা ডোবারম্যানের বাচ্চা ঘরে আনার চেষ্টা করবেন। এ কথা ভেবে নিয়ে বেলা ন’টা নাগাদ তিনি ফোন করলেন তিওয়ারির নম্বরে।
এবারে কিন্তু রিং হবার পর ফোন তুলে কেউ একজন বলল, ‘কে বলছেন?’
বীরেশ্বরবাবু জবাব দিলেন ‘আমি বীরেশ্বর দাশ বলছি কলকাতা থেকে। তিওয়ারি সাহেব আছেন? তার সঙ্গে আমার দরকার ছিল কুকুর কেনার ব্যাপারে।’
সঙ্গে সঙ্গে ওপাশের কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ‘আমি বনমালী বলছি স্যার, আজকে এসে আপনার কুকুরের বাচ্চাটা নিয়ে যান।’
বীরেশ্বরবাবু বললেন, ‘কখন যাব?’
বনমালী জবাব দিল, ‘সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আসুন। তার আগে এলে হবে না। আর হ্যাঁ, আসার সময় অবশ্যই এক বোতল দুধ আনবেন সঙ্গে করে।’
বীরেশ্বরবাবু জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার মালিক ফিরেছেন? তিনি কি দাম নেবেন?’
বনমালী বলল ‘ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। যখন বললাম তখন আসুন। পরদিন এলে কিন্তু আর ওকে পাবেন না।’—এই বলে সে লাইন কেটে দিল।
বীরেশ্বরবাবু বিশদ ভাবে ব্যাপারটা জানার জন্য আবারও ফোন করে দেখলেন শুধু একটা যান্ত্রিক শব্দ হচ্ছে। সম্ভবত ল্যান্ড ফোনের ক্রেডেলটা পাশে নামিয়ে রেখেছে বনমালী।
একটু ভেবে নিয়ে বীরেশ্বরবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি যাবেন। বাচ্চাটাকে যখন পছন্দ হয়েইছে তখন সেটা কিনে নিয়ে রাত দশটার মধ্যে ফিরে আসবেন বাড়িতে। সেই ভাবন মতো সারা দিন বাড়িতে কাটিয়ে দিনের শেষে বেলা পাঁচটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে নিলেন বনমালীর কথা মতো একটা দুধের বোতল আর টাকা—খাঁচা ইত্যাদি জিনিস।
ডিসেম্বর মাস, শীতের বেলা। সাড়ে পাঁচটাতেই অন্ধকার নামে। বীরেশ্বরবাবু কলকাতা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এক্সপ্রেস ওয়েতে উঠতে না উঠতেই অন্ধকার নেমে এল। তবে চেনা রাস্তা। গাড়ির হেডলাইটের আলোতে এগিয়ে চললেন তিনি। ঠিক সাতটা নাগাদই তিনি পৌঁছে গেলেন নির্দিষ্ট স্থানে। চারপাশের মাঠে গাঢ় কুয়াশার চাদর। ঠান্ডাও বেশ। কেউ কোথাও নেই। আর তারই মাঝে ক্ষীণ চাঁদের আলোতে কেমন যেন ভূতুড়ে অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীর ঘেরা গোডাউনটা। বন্ধ লোহার ফটকের সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে বেশ কয়েকবার হর্ন বাজাতেই মৃদু ধাতব শব্দ তুলে দরজাটা খুলে গেল। ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে গাড়ির কাছে এগিয়ে এল বনমালী। সে প্রথমেই, বীরেশ্বরবাবুকে প্রশ্ন করল ‘দুধটা এনেছেন স্যার?’
বীরেশ্বরবাবু গাড়ি থেকে নেমে দুধের বোতলটা তার হাতে ধরিয়ে বললেন, ‘এই যে দুধ।’
বনমালী সেটা এবং বীরেশ্বরবাবুকে সঙ্গে নিয়ে কম্পাউন্ডে প্রবেশ করল। ভিতরের চারদিকটাও কুয়াশাতে মাখামাখি। শুধু গোডাউনের ভিতর থেকে একটা ক্ষীণ আলো বাইরে আসছে। বনমালী, বীরেশ্বরবাবুকে নিয়ে এগোল সেদিকে। কয়েক পা এগোতেই কেমন যেন একটা পচা গন্ধ এসে লাগল বীরেশ্বরবাবুর নাকে। গন্ধটা কিন্তু তার পিছু ছাড়ল না। গোডাউনের ভিতরে প্রবেশ করার পরও সেটা তার নাকে লাগতে লাগল। এদিন কিন্তু গোডাউনের ঢুকতেই লুসির চিৎকার শোনা গেল না। গোডাউনের ভিতর কয়েক পা এগিয়েই মাথার ওপর থেকে ঝুলন্ত ফ্যাকাশে একটা বাতি ঝুলছে। গোডাউনের শেষ প্রান্তে ক্যানেলের দিকে না নিয়ে গিয়ে সেই বাতিটার নীচেই বীরেশ্বরবাবুকে দাঁড় করাল বনমালী। দুধের বোতল মাটিতে নামিয়ে রাখল ও বীরেশ্বরবাবু জানতে চাইলেন, ‘তোমার মালিক কোথায়?’
বনমালী জবাব দিল, তিনি এখানে নেই। বিদেশে আছেন। ফেরার ঠিক নেই। টেলিফোনের লাইন পাওয়াও খুব সমস্যা। তবে বিদেশ থেকে বৃহস্পতিবার সকালে তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন, ওদিন রাতেই আমি তড়িঘড়ি এখানে চলে এলাম।’—এ কথা বলে সে জায়গাতে বীরেশ্বরবাবু দাঁড় করিয়ে রেখে বনমালী কোথায় যেন চলে গেল প্যাকিং বাক্সর আড়ালে। মাথার ওপরের ঝুলন্ত হলদেটে আলো বিশাল গোডাউনের সর্বত্র পৌঁছচ্ছে না। বিশেষত যেদিকে ঘরের মতো খাঁচাটা আছে যেদিকে ডুবে আছে জমাট বাঁধা অন্ধকারে। লুসি নামের মা কুকুরটা নেই নাকি? সে ডাকছে না কেন?’ আর সেদিক থেকেই কিছুক্ষণের মধ্যে কুকুরের বাচ্চাটাকে কোলে করে বনমালী ফিরে এল। তার এক হাতে কলাই করা থালাও আছে। ডোবারম্যানের বাচ্চাটাকে মাটিতে নামিয়ে তার সামনে থালাতে দুধ ঢালতেই বাচ্চাটা চোঁ চোঁ করে দুধ চাটতে লাগল। ক্ষয়াটে আলোতে তিনি যতটুকু খেয়াল করলেন তাতে গত দিনের তুলনায় বাচ্চাটাকে বেশ শীর্ণ মনে হল। তাই বীরেশ্বরবাবু জানতে চাইলেন, কেমন যেন একটু রোগা দেখাচ্ছে বাচ্চাটাকে।’
বনমালী জবাব দিল। ‘হ্যাঁ, তা একটু হয়েছে।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুধটা শেষ করে ফেলল বাচ্চাটা। বনমালী বলল ‘যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। এতটা পথ যাবে। বাড়িতে গিয়ে আবার খেতে দেবেন।’
বীরেশ্বরবাবু বললেন, ‘তা তো বুঝলাম, কিন্তু টাকা—পয়সার ব্যাপারটা এবার বলো? মালিক কী দাম বলেছেন? তাকে অবাক করে দিয়ে বনমালী বলল, ‘টাকা দিতে হবে না। এমনি নিয়ে যান।
বীরেশ্বরবাবু বললেন, ‘এমনি নিয়ে যান মানে? সে আবার হয় নাকি?’
বনমালী বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এমনিতেই নিয়ে যান। মালিক বলেছেন তিনি খুব ব্যস্ত, কুকুর নিয়ে আর মাথা ঘামাতে পারবেন না। এই গোডাউন ভেঙে কালকের থেকেই এখানে রিসর্ট বানাবার কাজ শুরু হবে। তার আগেই কুকুরগুলোকে বিদায় করতে হবে। এ ব্যাপারে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেবার ভার তিনি আমাকেই দিয়েছেন।’
বীরেশ্বরবাবু বললেন, ‘তবে তোমাকে কত টাকা দিতে হবে বলো?’
বনমালী কথাটা শুনে মৃদু হেসে বলল, ‘টাকাতো আপনি সেদিন আমাকে এমনিতেই দিয়েছেন বিনা কারণেই। আজ আর দিতে হবে না।’
বীরেশ্বরবাবু বললেন, ‘সে তো মাত্র দুশো টাকা। কিন্তু আমি যতটুকু খবর নিয়েছি তাতে এ কুকুরের দাম কমপক্ষে আট—দশ হাজার। সে টাকাটা তুমি নাও।’
বনমালী বলল, ‘আপনি ভালো মানুষ। দুশো টাকাই বা বিনা কারণে এ যুগে কে কাকে দেয়! আপনি দিয়েছিলেন। আপনাকে আমি বলেছিলাম না যে আমি এ বাচ্চাটাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। ক্ষমতা থাকলে নিজে ওকে পুষতাম। আপনার কাছে থাকলে ও যত্নে থাকবে। অন্তত ভরপেট খেতে পাবে। খিদে বড় মারাত্মক জিনিস। সে মানুষ হোক বা অবলাপ্রাণী সবার কাছেই।’
এ কথা বলে, বীরেশ্বরবাবুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাচ্চাটাকে তার কোলে তুলে দিল বনমালী।
বীরেশ্বরবাবু তবুও মৃদু প্রতিবাদের চেষ্টা করে বললেন, ‘না, এটা, ঠিক হচ্ছে না। কিছু টাকা অন্তত তুমি রাখো।’
বনমালী বলল, ‘না, এখন না, ঠিকানাটা আপনি বলুন। প্রয়োজন হলে আপনার বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসব।’
বীরেশ্বরবাবু বললেন, ‘আমার নামতো তুমি জানোই। হেদুয়া পার্কের ঠিক পিছনেই পুরোনো দিনের লাল রঙের দোতলা বাড়ি কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে।’
বনমালী হেসে বলল, ‘আচ্ছা, এবার, বাড়িতে গিয়ে ওকে আবার খেতে দেবেন কিন্তু।’
গোডাউনের বাইরে বেরিয়ে কুয়াশার মধ্যে গেটের দিকে এগোল তারা দুজন। বাতাসে সেই পচা গন্ধটা আছে। আর তার সঙ্গে একটা আঁশটে গন্ধও নাকে লাগতে লাগল বীরেশ্বরবাবুর। প্রায় তারা গেটের কাছে পৌঁছে গেছেন। হঠাৎ একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে বীরেশ্বরবাবু দেখলেন তাদের কিছুটা তফাতে কুয়াশার ভিতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে লুসি। চোখ দুটো জ্বলছে তার। সে তাকিয়ে আছে বীরেশ্বরবাবুর দিকে। তার পিছনে তার অন্য বাচ্চাগুলোও আছে। কুকুরটা তাকে আক্রমণ করবে না তো? ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রথমে বীরেশ্বরবাবুকে বললেন, ‘আমি আছি, আপনার ভয় নেই। খুব খিদে ওদের, খাবারের জন্য এসেছে।’— একথা বলার পর সে কুকুরগুলোর উদ্দেশ্যে বলল, ‘যা ফিরে যা, আমি এখনই যাচ্ছি খাবার দেবার জন্য।’
তার কথা শুনে ধীরে ধীরে গোডাউনের দিকে কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেল বাচ্চা সমেত লুসি নামের প্রকাণ্ড কুকুরটা। বনমালীকে নিয়ে কুকুরের বাচ্চা কোলে গেটের বাইরে বেরিয়ে এলেন বীরেশ্বরবাবু। গাড়ির দরজা খুলে বাচ্চাটাকে খাঁচায় পুরে তিনি বনমালীকে বললেন, ‘তোমাকে যে কীভাবে ধন্যবাদ দেব তা জানি না।’ খাঁচার ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে বাচ্চাটার মাথায় একবার আদর করে বিষণ্ণভাবে বনমালী বলল, ‘আমাকে ধন্যবাদ দিতে হবে না। শুধু বাচ্চাটাকে ভালো করে খেতে দেবেন। আর হ্যাঁ, তবে মনে রাখবেন, কাঁচা মাংস কিন্তু কখনই খেতে দেবেন না।’
‘আচ্ছা, বলে বনমালীর থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন স্টার্ট করলেন বীরেশ্বর। বনমালী গেটের ভিতরে ঢুকে কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গেল। কুকুরের বাচ্চাটা নিয়ে কলকাতার দিকে রওনা হলেন বীরেশ্বরবাবু। গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি ভাবতে লাগলেন বাচ্চাটার কি নামকরণ করা যায়?
৪
নামকরণ, ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হলেও আসলে তা গোলমেলে ব্যাপার। কোনও একটা নাম প্রথমে ভালো লাগলেই আবার পরক্ষণেই মনে হয়, এটা ঠিক পছন্দের লাগছে না। তবে পরদিন রাতেই ঘটনাচক্রে বাচ্চাটার একটা জুৎসই আনকমন নাম ঠিক করে ফেললেন বীরেশ্বরবাবু। একরাত একদিনের মধ্যেই বীরেশ্বরবাবুর বাড়িতে বেশ মানিয়ে নিয়েছে বাচ্চাটা। সকালে কাজে বেরোবার আগে পর্যন্ত তার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করেছে কুকুরটা। কাজ থেকে রাতে বাড়ি ফেরার পরও তাই। রাতে বাড়ি ফিরে যখন তিনি খেতে বসলেন এখন কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে কুকুরের বাচ্চাটা চেয়ে রইল বীরেশ্বরবাবুর দিকে। তা দেখে বীরেশ্বরবাবু তার চাকরকে জিগ্যেস করলেন, ‘ওকে সারাদিন ভালো করে খেতে দিয়েছিস তো?’ ভুজঙ্গর কথা বলার মধ্যে মাঝে মাঝে কেতা করে তার সাধ্য মতো ইংরাজি শব্দ বলার অভ্যাস আছে। সে বলল, ‘হ্যাঁ, দাদাবাবু, দিয়েছি। তবে ও কেমন যেন একটু ‘হাংরি’ ধরনের, যা দিচ্ছি সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নিচ্ছে!’
‘হাংরি’ শবটা শুনে বীরেশ্বরবাবুর মনে হল, ‘আর এই ‘হাংরি নামইতো দেওয়া যায়! বেশ আনকমন নাম হবে!’ কথাটা ভেবে নিয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বীরেশ্বরবাবু দুবার ‘হাংরি, হাংরি’ বলে ডাকতেই সে এগিয়ে এসে বীরেশ্বরবাবুর গায়ে মাথা ঘষতে লাগল। বাচ্চাটার নাম হল— ‘হাংরি’— ক্ষুধার্ত।
মঙ্গলবার সকালে উঠে, চা, বিস্কুট আর খবরের কাগজ নিয়ে বসলেন বীরেশ্বরবাবু। যদিও ভোরে ওঠার পরই তাকে খাবার দেওয়া হয়েছে তবুও হাংরি বীরেশ্বরবাবুর পায়ের কাছে এসে ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে তাকাল প্লেটে রাখা বিস্কুটের দিকে। তা দেখে তিনি তার দিকে একটা বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে মনে মনে হেসে বললেন, ‘তোর হাংরি নাম সার্থক!’ দু—রাতেই বীরেশ্বরবাবু বেশ ভালোবেসে ফেলেছেন হাংরিকে। কড়মড় করে বিস্কুট খেতে লাগল হাংরি আর বীরেশ্বরবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে মনোনিবেশ করলেন সংবাদপত্রের পাতাতে। হঠাৎ—ই দ্বিতীয় পাতাতে একটা অদ্ভুত খবরে চোখ আটকে গেল বীরেশ্বরবাবুর। খবরের শিরোনাম লেখা— ‘কুকুর ছিঁড়ে খেল মানুষকে।’ বীরেশ্বরবাবু দ্রুত খবরটা পড়তে শুরু করলেন—
‘নিজস্ব সংবাদদাতা : সোমবার সকালে একদল ঠিকা শ্রমিক উত্তর চব্বিশ পরগনার কেউটিয়া গ্রামের এক গোডাউনে কাজ করতে গিয়ে একজন লোকের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। ওই গোডাউনে প্রতিপালিত একটি ডোবারম্যান কুকুর আর তার বাচ্চারা সেই হতভাগ্য ব্যক্তিকে মেরে তার মাংস খেয়েছে। মৃতপ্রায় সেই ডোবারম্যান কুকুর আর তার বাচ্চাদেরও সন্ধান মিলেছে গোডাউনেই।
পুলিশ অনুসন্ধান করে যা জানতে পেরেছে তা হল, ‘মৃতের নাম বনমালী দাস। বাড়ি বর্ধমান। গত রবিবারের আগের রবিবার সে বর্ধমানের বাড়িতে ফিরেছিল। সেদিনই গোডাউনের মালিক কলকাতার বাসিন্দা নরেশ তিওয়ারির ওই গোডাউনের ফেরার কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়িক কাজে তাকে হঠাৎ বিদেশে চলে যেতে হয়। বিদেশ থেকে কেয়ারটেকার বনমালীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চারদিন লেগে যায়। মালিকের নির্দেশে বৃহস্পতিবার রাতেই তিনি ওই গোডাউনে ফিরে যান। কুকুরগুলোর দেখভাল তিনিই করতেন। পুলিশের অনুমান, গোডাউনের ভিতর বনমালী কেনেলের দরজা খুলতেই পাঁচদিন অভুক্ত থাকার কারণে হিংস্র, ক্ষুধার্ত হয়ে থাকা বিরাট মা—ডোবারম্যান কুকুরটা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটি ছিড়ে হত্যা করে তাকে। তারপর বাচ্চাদের নিয়ে খেতে শুরু করে হড়তভাগ্য ব্যক্তির মাংস। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টও সমর্থন করছে পুলিশের বয়ান। মৃতদেহ পরীক্ষা করে তারা জানিয়েছেন যে, অন্তত দিন তিন—চারদিন আগে মৃত্যু হয়েছে লোকটার। তবে কুকুরটার চারটে বাচ্চার মধ্যে একটা বাচ্চার কোনও খোঁজ মেলেনি।’ খবরটা পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বীরেশ্বরবাবু। খবরটা ভয়ংকর তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার থেকেও মাথা গুলিয়ে দেওয়া অন্য একটা প্রশ্ন! যদি বৃহস্পতিবার বনমালীর মৃত্যু হয়ে থাকে তবে রবিবার রাতে সে কী ভাবে বাচ্চাটা তার হাতে তুলে দিল??? বীরেশ্বরবাবু হতভম্ভর মতো তাকালেন হাংরির দিকে। সেও তাকিয়ে আছে বীরেশ্বরবাবুর দিকে। তার ভাবটা এমন— ‘আমি সব জানি।’
না, বীরেশ্বরবাবু হাংরিকে অন্য কোথাও সরিয়ে দেননি। তার বেশ মায়া পড়ে গেছিল হাংরির ওপর। হাংরি এখন পূর্ণাঙ্গ একটা ডোবারম্যান। শক্ত সমর্থ বিরাট একটা কুকুর। বীরেশ্বরবাবুর একান্ত অনুগতও। শুধু একদিন নিজের নখ ব্লেড দিয়ে কাটার সময় আঙুল কেটে বীরেশ্বরবাবুর দু—ফোঁটা রক্ত পড়েছিল মাটিতে। আর সেই রক্তর ফোঁটার দিকে কেমন যেন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল হাংরি। ব্যাপারটা অবশ্য বীরেশ্বরবাবুর মনের ভুলও হতে পারে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মেঝে থেকে ধুয়ে মুছে ফেলেছিলেন রক্ত। হাজার হোক জীবনে একবার হলেও তো হাংরি কাঁচা মাংস আর মানুষের রক্তর স্বাদ পেয়েছিল। বনমালীর কথামতো কোনওদিন হাংরিকে কাঁচামাংস খেতে দেন না বীরেশ্বরবাবু। তবে হাংরির খিদেটা একটু বেশি।