খাদ্য রসিক

খাদ্য রসিক

জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকার সম্পাদক রজত মিত্র, সাহিত্যিক প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কোনোদিন, কুমিরের কাবাব অথবা বানরের ব্রেনকারি খেয়েছেন?’

প্রশ্নটা শুনে অবাক হয়ে গেল সাত্যকি। বহুল প্রচারিত এই বিখ্যাত বাণিজ্যিক পত্রিকাতে ফ্রিলান্সার হিসাবে কাজ করে সাত্যকি। নাটক-সিনেমা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসব নিয়ে লেখে, কখনোবা সংস্কৃতি জগতের সেলিব্রিটিদেরও ইন্টারভিউও করে এ কাগজের জন্য। তাই কখনো লেখা জমা দেবার জন্য, কখনো বা অ্যাসাইনমেন্ট পাবার জন্য তাকে ওই পত্রিকা অফিসে এসে সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হয়। তেমনই নতুন অ্যাসাইনমেন্টের আশায় এদিনও রজত মিত্রর কাছে এসেছে সাত্যকি। রজত মিত্র বেশ রাশভারী প্রকৃতির মানুষ, ঠাট্টা-মশকরা করাতো দূরের কথা, কাজের কথার বাইরে তাকে গল্পগুজব করতেও কোনোদিন দেখেনি সাত্যকি। তার মুখোমুখি বসার পর হঠাৎ এহেন প্রশ্ন শুনে বেশ হকচকিয়ে গেল সে। সাত্যকি তাকাল সম্পাদকের মুখের দিকে। না, তাঁর মুখে কোনো হাসি আভাস নেই। রজত মিত্রর মুখমণ্ডল একইরকম গম্ভীর।

সাত্যকিকে চুপ করে থাকতে দেখে রজত মিত্র প্রথমে বললেন, ‘বুঝেছি খাননি, আমিও খাইনি।’ এই কথা বলে তিনি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তাঁর দ্বিতীয় প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি রসিকলাল সেন, বলে কারও নাম শুনেছেন কোনোদিন?

সাত্যকি একটু ভেবে নিয়ে জবাব দিল, ‘না, স্যার, ঠিক মনে করতে পারছি না।’

সম্পাদক রুমাল দিয়ে তাঁর চশমার কাচটা মুছে নিয়ে বললেন, ‘না শোনারই কথা। হয়তো বা আমাদের পত্রিকার পুরানো পাঠকরা কেউ কেউ তাঁর নাম মনে রেখেছেন। এই রসিকলাল সেন নামের ভদ্রলোক ‘খাদ্য রসিক’ ছদ্মনামে তিরিশ বছর আগে লিখতেন। আমি তখন সবে ওই পত্রিকাতে চাকরি করতে ঢুকেছি। নানাধরনের খাবারের রেসিপি, বিশেষত আমিষ খাবার, আর তার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশের নানা অদ্ভুত খাবার খাওয়ার গল্পও তিনি লিখতেন। আপনাকে ভারতীয়দের চোখে যে অদ্ভুত দুটো খাবার খেয়েছেন কিনা প্রশ্ন করলাম, সেগুলো ওর লেখাতেই পড়েছিলাম। শুধু যারা রন্ধন শিল্পের ব্যাপারে আগ্রহী বা ভোজন রসিক তরারাই নন, মাঝে মাঝে ওই কুমিরের কাবাবের মতো অদ্ভুত খাবারের কথা লেখার জন্য অন্য পাঠকরাও আগ্রহ নিয়ে পড়ত খাদ্য রসিকের লেখা। নানা অজানা তথ্যও থাকত তাঁর লেখাতে। তবে তাঁর লেখা আজকালকার কিছু ফুড ব্লগারদের মতো ইন্টারনেটের তথ্য ঘেঁটে লেখা ছিল না, দেশ-বিদেশের নানা জায়গাতে ঘুরে বেড়াতেন তিনি, আর সে সব জায়গাতে নানা খাবার খেতেন, সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতেন, আমাদের পত্রিকায় লিখতেন। তবে পয়সার জন্য নয়, লিখতেন নিছকই শখের জন্য। তাঁর লেখাতে রান্নার খবরের সঙ্গে সঙ্গে বেশ একটা ভ্রমণ আর অ্যাডভেঞ্চারেরও স্বাদ ছিল।’— একটানা কথাগুলো বলে আসলেন সম্পাদক।’

তাঁর কথা শুনে সাত্যকি বলল, ‘ভদ্রলোক বেশ ইন্টারেস্টিং কারেকটার ছিলেন বলে মনে হচ্ছে!’ রজত মিত্র বললেন, ‘হ্যাঁ তা বলতে পারেন। এই অফিসে সে সময়কার সম্পাদকের কাছে আমি তাকে বেশ কয়েকবার আসতে দেখেছি। অভিজাত চেহারা, আঙুল ভরতি সোনার, হিরের আংটি। সে সময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। কিন্তু তারপর হঠাৎই একদিন আমাদের পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছিল তাঁর। না, কোনো ঝগড়াঝাঁটি, মনোমালিন্য হয়নি তাঁর সঙ্গে। বলতে গেলে একপ্রকার নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন তিনি। সে সময় পত্রিকা দপ্তর থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সন্ধান মেলেনি। তাঁর অন্তর্ধানের ব্যাপারে সে সময় অবশ্য একটা কানাঘুষো শোনা গেছিল। ভদ্রলোকের নাকি গ্যাম্বলিং অর্থাৎ জুয়ো, ঘোড়দৌড় এ সবের নেশা ছিল। কলকাতাতে নিয়মিত তিনি রেসের মাঠে যেতেন। কেউ কেউ বলেন জুয়ার নেশাতে নাকি শেষপর্যন্ত বিপুল অঙ্কর দেনা হয়ে গেছিল ভদ্রলোকের। আর সে কারণেই নাকি তিনি পাওনাদারদের এড়াতে, কলকাতার সঙ্গে। পরিচিতজনদের সঙ্গে সব সংস্রব ত্যাগ করে অজ্ঞাতবাসে চলে গেছিলেন। তবে এসব বক্তব্যের সত্যতা সম্বন্ধে আমার জানা নেই, এসবই সে সময় শোনা কানাঘুষো। এমনও হতে পারে তাঁর অন্তর্ধানের পিছনে এই কারণগুলো নিছকই গুজব ছিল।’

একথা বলে একটু থেমে এরপর সাত্যকিকে আসল কথাটা বললেন সম্পাদক—’আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে আমাদের ম্যাগাজিনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হতে চলেছে। সেই সংখ্যাতে আমি এমন কিছু লেখকের লেখা রাখতে চাইছি যাঁরা এক সময় এ কাগজে লিখতেন। যাঁদের লেখা বা নাম আমাদের পুরানো পাঠকদের কাছে নস্টালজিয়া। আপনি দু-দিনের জন্য কলকাতার বাইরে যেতে পারবেন? যদি আমি রসিকলাল বাবুর ঠিকানাটা আপনাকে জানাই তবে তাঁর থেকে একটা লেখা বা অনুলিখন অথবা একটা ইন্টারভিউ আনতে পারবেন? অফিস আপনার সব খরচ বহন করবে। আপনি যদি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর ব্যর্থ হন তবুও আপনার রাহা খরচ আর পারিশ্রমিক আমরা দেব।’ সম্পাদকের কথা শুনে সাত্যকি বলল, ‘অর্থাৎ ভদ্রলোকের সন্ধান মিলেছে! তিনি কোথায় থাকেন? আপনি যখন বলছেন তখন আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব কাজটা করার জন্য।’ সাত্যকি তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হওয়ায় মৃদু হাসি ফুটে উঠল সম্পাদকের গম্ভীর মুখে। টেবিলে রাখা পেপার ওয়েটটা তিনি আঙুল দিয়ে ঘেরাতে ঘোরাতে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ সন্ধান মিলেছে, এবং তা মিলেছে কিছুটা কাকতালিয়ভাবেই। মহীতোষ সমাদ্দারের নামের সঙ্গে তো আপনি নিশ্চয়ই পরিচিত? ইতিহাস গবেষক মহীতোষ সমাদ্দার? ওই যিনি আমাদের ম্যাগাজিনে পুরানো কলকাতা, বাংলার পুরনো জনপদ এসব নিয়ে লেখেন। আমাদের বহু পুরানো লেখক।’

সাত্যকি বলল, ‘হ্যাঁ, ওঁর লেখা আমি পড়েছি। পরিচয় না থাকলেও ও অফিসে আমি তাঁকে কয়েকবার দেখেছি, প্রবীণ মানুষ।’

রজত মিত্র বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই মহীতোষবাবুই ঘটনাচক্রে রসিকবাবুর সন্ধান এনেছেন। মহীতোষবাবু বর্তমানে বাংলার নদীঘাট নিয়ে একটা গবেষণধর্মী লেখার কাজ করছেন। আর তার জন্য বাংলার নানা জায়গার নদীঘাট দেখতে যাচ্ছেন। সপ্তাহ তিনেক আগে তিনি গেছিলেন বাঁকুড়া জেলার ছাতনা বলে এক জায়গাতে, দ্বারকেশ্বরের এক ঘাট দেখার জন্য। জায়গাটাতে ভদ্রলোক তার পরিচিত একজনের বাড়িতে রাত কাটিয়েছিলেন। বিকালবেলা নদীর পাড় বরাবর ঘুরতে বেরিয়েছিলেন মহীতোষ, হঠাৎই মহীতোষ দেখতে পান রাস্তার ধারে প্রাচীর ঘেরা পুরানো আমলের বাগানবাড়ির মতো বাড়ির গেটে সূর্যাস্তের সময় দাঁড়িয়ে আছেন রসিকলাল। মহীতোষবাবু আর রসিকবাবু এক সময় একই সাথে আমাদের কাগজে লিখতেন। তাদের দুজনের মধ্যে মৃদু সখ্যও ছিল। তা ছাড়া রসিকবাবুর শরীরে একটা শনাক্তকরণ চিহ্নও আছে। তার কপালের ডান দিকে একটা আঁচিল আছে। কাজেই কুড়ি বছর পরে হলেও তাকে চিনতে ভুল হয়নি মহীতোষের। তিনি তাঁর কাছে গেলে রসিকলাল তাকে চিনতেও পারেন। মহীতোষবাবু কদিন আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁর মুখ থেকেই ব্যাপারটা জানতে পারলাম।’—একটানা কথাগুলো বলে থামলেন সম্পাদক।

সাত্যকি বলল, ‘আমার হাতে কাজ তেমন নেই। আমি কালকেই রওনা দিতে পারি বাঁকুড়াতে। দ্বারকেশ্বর নদের নাম শুনেছি, কিন্তু দেখা হয়নি। এই সুযোগে সেটা দেখাও হয়ে যাবে। আপনি কি রসিকবাবুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে একটা আপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দেবেন? নইলে হয়তো আমি গিয়ে দেখলাম যে তিনি অন্য কোথাও বেরিয়ে গেছেন। যদিও আমি ওখানে গেলে হাতে দুটো দিন সময় নিয়েই যাব।’

সম্পাদক রজত মিত্র বললেন, ‘এখানেই একটা মুশকিল। মহীতোষবাবু তাঁর ফোন নম্বরটা চাইতে ভুলে গেছিলেন। সৌজন্যসূচক সামান্য কিছু কথা হয় তাদের দুজনের মধ্যে। তারপর রসিকলাল, মহীতোষকে বললেন তার তখন জরুরি কাজ আছে, মহীতোষ পরদিন সকালে এলে গল্প করা যাবে। এই বলে রসিকলাল বাড়ির ভিতরে চলে যান। পরদিন ভোরেই মহীতোষবাবুর কলকাতায় ফেরার তাড়া ছিল। কাজেই রসিকবাবুর বাড়ি যাওয়ার তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।’

একথা বলার পর একটু থেমে রজত মিত্র বললেন, ‘তবে মহীতোষবাবুর কাছ থেকে ও জায়গাতে যাবার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আমি কাগজে লিখে নিয়েছি, বাড়িটাতে পৌঁছতে আপনার অসুবিধা হয়ে বলে মনে হয় না। ছাতনা বাস স্ট্যান্ডে থাকার জায়গা পাবেন, সেখানে রাত্রীবাস করতে পারবেন। রসিকবাবুকে লেখার অনুরোধ জানিয়ে পত্রিকার পক্ষ থেকে একটা চিঠি দেব আপনার হাতে। তা ছাড়া ওনার কিছু পুরানো লেখার ফটোকপিও আপনাকে দেব। লেখাগুলো পড়ে নিলে ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে, তাঁকে ইমপ্রেসড করতে সুবিধা হবে আপনার।’

সম্পাদকের কথা শুনে সাত্যকি একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, যা দেবার তবে দিয়ে দিন। ভাবছি কাল সকালেই বাঁকুড়া যাবার বাস ধরব।’

সাত্যকি সকাল ন-টার বাস ধরেছিল ধর্মতলা থেকে। একদা পত্রিকাতে প্রকাশিত রসিকবাবুর লেখার কাটিংগুলো বাস যাত্রাতেই পড়ে ফেলল সাত্যকি। কত অদ্ভুত খাবারের কথা। কত অদ্ভুত জায়গার কথা লিখেছিলেন ভদ্রলোক। লেখাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা লেখা বেশ রোমাঞ্চকরও। লেখাগুলো পড়ে সাত্যকি যা বুঝতে পারল তাতে নানাধরনের খাবার চেয়ে দেখার জন্য প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছেন ভদ্রলোক! এমনকি বেশ কয়েকবার রসিকবাবুকে জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়েছে। ভদ্রলোক বেশ সাহসী, ডাকাবুকো ধরনের। লেখাগুলো পড়ার পর ভদ্রলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ব্যাপারে সাত্যকি বেশ উত্তেজনা বোধ করতে লাগল। যাত্রা পথে দুপুরবেলা বাস একবার একজায়গাতে দাঁড়াল যাত্রীদের মধ্যহ্নভোজ সারার জন্য। আর একবার বাসের টায়ার পাংচার হবার কারণে ঘণ্টা খানেক সময় নষ্ট হল। বাসটা শেষপর্যন্ত ধুকতে ধুকতে যখন ছাতনা পৌঁছল তখন বিকাল চারটে। সাত্যকিকে যে জায়গাতে যেতে হবে সে জায়গার নাম মহাপ্রসাদপুর। ছাতনা বাস স্ট্যান্ড থেকে মাইল সাতেকের দূরত্ব। বাস যায় না সেখানে। মোটর ভ্যান ভরসা। নামে শহর হলেও ছাতনাকে একটা বড়ো গঞ্জই বলা যায়। বাস স্ট্যান্ডের স্থানীয় লোকজনের মধ্যে কিছুটা গ্রামীণভাব মিশে আছে। বাস থেকে নেমে সাত্যকি চটপট বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া একটা হোটেলে গিয়ে যাত্রীবাসের ব্যাপারে কথাবার্তা সেরে নিল, যদি তাকে রাতে এ জায়গাতে থাকতে হয় সেজন্য। তারপর একটা দোকান থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে একটা মোটর ভ্যান ভাড়া করে গন্তব্যে রওনা হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাতনা বাস স্ট্যান্ড, শহর বা গঞ্জর কোলাহল ছাড়িয়ে মেঠো পথ ধরল মোটর ভ্যান। যাত্রাপথের দু-পাশ বেশ ফাঁকা। কোথাও পতিত জমি আবার কোথাও জঙ্গল। মাঝে মাঝে শুধু দু-একটা ঘর-বাড়ি বা লোকজন চোখে পড়ছে। শীতের বিকাল, আলো বেশ মরম, বাতাসে ঠান্ডা ভাব আছে। ধোঁয়া-ধুলোহীন পরিবেশে যেতে বেশ ভালোই লাগছিল সাত্যকির। সে ভ্যান চালককে প্রশ্ন করল ‘ও জায়গাতে কী কী আছে?’ লোকট জবাব দিল ‘তেমন কিছু দেখার নেই। দ্বারকেশ্বরের একটা পুরানো ঘাট আছে। তবে এ সময় জল ঘাট থেকে অনেক দূরে সরে যায়, বর্ষাতে আবার ঘাটের কাছে ফিরে আসে। কাছে নদের চরে একটা ছোটো শ্মশান আছে, সেখানে একটা কালী মন্দির আছে। আর একটা ভাঙা জমিদার বাড়ি আছে অনেক পুরানো আমলের। লোকজনও বেশি থাকে না ওদিকটাতে।’

পত্রিকা সম্পাদক সাত্যকিকে যে পথ নির্দেশ লেখা কাগজটা দিয়েছেন তাতেও ওই ভাঙা জমিদার বাড়ির উল্লেখ আছে। ঘাট থেকে ওই জমিদার বাড়ির দিকে এগোলেই বাড়িটা অতিক্রম করে কিছুটা দূরেই রসিকবাবুর বাড়ি। আধঘণ্টা মতো চলার পর দূরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে নদীতট দেখা গেল। তারপর এক সময় ভ্যান চালক তাকে নামিয়ে দিল ঘাটের সামনে। লোকটা ভাড়া বুঝে নিয়ে চলে যাবার পর সাত্যকি ভালো করে তাকাল চারপাশে। ঘাটটা বিশাল। চওড়া থাক থাক সিঁড়ি নেমে গেছে দ্বারকা নদের খাতে। তবে তার স্থানে স্থানে পলেস্তরা খসে গিয়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে। দেখেই বোঝা যায় ঘাটটা অনেক পুরানো। তবে নদের জল ঘাট থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। বেলা শেষের আলোতে জেগে আছে নদের দু-পাশের বিস্তীর্ণ বালুতট। সেই তট পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছিল একজন স্থানীয় মানুষ। হাতে ধরা খ্যাপলা জাল আর হাড়ি। সম্ভবত নদে মাছ ধরতে গিয়েছিল সে। সাত্যকি তাকে জমিদার বাড়িটা কোন দিকে জিজ্ঞেস করতেই সে আঙুল তুলে কিছু দূরে নদের পাড়ে একটা ভগ্নপ্রায় বিশাল বাড়ি দেখিয়ে দিল। সাত্যকি নদের পাড় বরাবর রাস্তা দিয়ে এগোল সেদিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে পৌঁছে গেল বাড়িটার কাছে। অস্তাচলগামী সূর্যের আলোতে বিষণ্ণভাবে ঝোপঝাড় জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বাড়িটা। বাড়ির দোতলার রেলিং খসে পড়েছে, জানলা-দরজাগুলোও অধিকাংশ কপাটহীন। বিশাল বিশাল প্রাচীন থামগুলো কোনোরকমে মহাকালের গ্রাম থেকে তখনও দাঁড় করিয়ে করিয়ে রেখেছে বাড়িটাকে। আরও কিছুটা এগোবার পর তার দূর থেকে চোখে পড়ল প্রাচীর ঘেরা বাগানবাড়ির মতো বাড়ি। সাত্যকি অনুমান করল সম্ভবত ওটাই রসিকবাবুর বাড়ি। সাত্যকি গিয়ে উপস্থিত হল বাড়িটার গেটের সামনে। কাঠের গেট, তার দু-পাশে দুটো বড়ো ঝাউগাছ আছে। কাঠের গেট আর ঝাউগাছ দুটো দেখেই সাত্যকি বুঝতে পারল, হ্যাঁ, ওটাই রসিকবাবুর বাড়ি। কারণ, সম্পাদক তার কাছে যে চিরকূটটা দিয়েছেন সেখানে রসিকবাবুর বাড়ির বিবরণে কাঠের গেট আর ঝাউগাছের উল্লেখ আছে। প্রাচীর ঘেরা জমিটার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। বাড়িটা একতলা হলেও বেশ বড়ো। সাত্যকি বাড়িটার দিকে তাকিয়ে অনুমান করল ও বাড়িটা পুরানো হলেও মাঝে মাঝে মেরামত করা হয়। বাড়িটার দরজা-জানলা সব বন্ধ। সামনের জমিটাতেও কোনো লোক দেখা যাচ্ছে না। একটু ইতস্তত করে কাঠের গেট খুলে জমিটার ভিতর প্রবেশ করল সাত্যকি। তারপর নানা ধরনের ছোটোখাটো গাছে ঘেরা জমিটা অতিক্রম করে উপস্থিত হল সদর দরজার সামনে। কাঠের দরজার গায়ে কলিংবেলের কোনো ব্যবস্থা নেই দেখে সাত্যকি কড়া নাড়তে নাড়তে বলল, ‘বাড়িতে কেউ আছেন?’

বার কয়েক কড়া নাড়ার পর মৃদু শব্দ করে দরজা খুলে দাঁড়ালেন এক ভদ্রলোক। পরনে পায়জামা-পাঞ্জাবি, গায়ে একটা শাল জড়ানো আছে। ভদ্রলোকের আনুমানিক বয়স সত্তরের কাছে হবে। পালিত কেশ। লম্বা লোকটার চেহারার গড়ন দেখে সাত্যকির অনুমান হল যৌবনে বেশ শক্ত-সমর্থ মানুষ ছিলেন ভদ্রলোক। অপরিচিত সাত্যকিকে দেখে তিনি মৃদু বিস্মিতভাবে বিরক্তি মেশানো গলাতে বললেন, ‘কী ব্যাপার? কাকে চাই?’

ভদ্রলোকের কপালের ডানদিকে যে একটা আঁচিল আছে তা সাত্যকির নজর এড়ায়নি। হ্যাঁ, এই ভদ্রলোকই রসিকলাল সেন! তাঁর প্রশ্নের জবাবে সাত্যকি হাত জোড় করে তাকে নমস্কার জানিয়ে বলল, ‘আপনিইতো রসিকবাবু। আমি সাত্যকি বসু। কলকাতা থেকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

সাত্যকির জবাব শুনে ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিই রসিকলাল সেন। আমার সঙ্গে অতদূর থেকে দেখা করতে এসেছেন কেন?’

সাত্যকি বলল, ‘আমি জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকা রংমহলের পক্ষ থেকে এনেছি। যে কাগজে আপনি এক সময় ‘খাদ্য রসিক’ নামে আপনি লিখতেন। এই পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক একটা বিশেষ অনুরোধ জানাবার জন্য আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন।’

সাত্যকির কথা শুনে এবার স্পষ্ট বিস্ময় ফুটে উঠল রসিকবাবুর মুখে। বিড়বিড় করে তিনি একবার স্বগোতক্তি করলেন ‘খাদ্য রসিক! রং মহল!’

তারপর তিনি সাত্যকিকে বললেন ‘সে তো অনেক পুরানো দিনের কথা! এত বছর পর আপনারা আমার ঠিকানা পেলেন কীভাবে? বহযুগ হয়ে গেল কলকাতার সঙ্গে বলতে গেলে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’

সাত্যকি মৃদু হেসে বলল, ‘সব বলছি আপনাকে। তবে যদি একটু বসে কথা বলা যায় তবে ভালো হয়।’

সাত্যকির প্রস্তাব শুনে রসিকলাল একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘ঠিক আছে। ভিতরে আসুন।’

বাইরে দ্বারকানদের বুকে সূর্য ডুবতে চলেছে। শীতের ছোটো বেলা, এরপরই চারপাশে কুয়াশা আর অন্ধকার নামতে শুরু করবে। রসিকলালের বাড়ির ভিতর প্রবেশ করল সাত্যকি। রসিকলালের বাড়ির ভিতরটা আধো অন্ধকার একটা করিডোর দিকে কয়েক পা এগিয়ে সাত্যকিকে নিয়ে পরদা ঠেলে একটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। মাঝারি আকৃতির একটা ঘর। লাল সিমেন্টের মেঝে, মাথার ওপর কড়িবরগার ছাদ। জানলা বন্ধ ঘরটাতে একটা ক্ষয়াটে বাতি জ্বলছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে সাবেক আমলের খাটের ওপর পরিপাটি বিছানা, ঘরের কোণে একটা আলমারিও আছে। আর ঘরের দেওয়ালের গায়ে যেখানে বাতি জ্বলছে তার ঠিক নীচেই একটা কাঠের টেবিল আর দুটো চেয়ার রয়েছে। ঘরটা দেখে সাত্যকির মনে হল এটা রসিকবাবুর শয়নকক্ষ হতে পারে। সাত্যকিকে নিয়ে রসিকলাল সেই টেবিলের সামনে গিয়ে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসলেন। টেবিলের ওপর রাখা আছে কিছু কাগজপত্র আর ওষুধপত্রর শিশি বাক্স এসব জিনিস।

সাত্যকি প্রথমে বলল ‘কিছুদিন আগে লেখক মহীতোষবাবু এখানে একটা কাব্যে এসে আপনার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। তিনি সম্পাদককে আপনার সন্ধান দিয়েছেন।’—এ কথা বলার পর সাত্যকি লেখার অনুরোধের সম্পাদকীয় চিঠিটা রসিকলালের হাতে তুলে দিলেন।

বেশ মনোযোগ দিয়ে রসিকবাবু চিঠিটা পড়ার পর বললেন, ‘কিন্তু আমিতো বহু যুগ আগে লেখা ছেড়ে দিয়েছি। তা ছাড়া এখানে চলে আসার পর আর কোথাও খাদ্য অন্বেষণে যাইওনি। বর্তমানে আমি অসুস্থও বটে।’

রসিকবাবুর কথা শুনে সাত্যকি বলল, ‘আপনি যদি অনুগ্রহ করে পুরানো দিনের কোনো অকথিত খাদ্য অন্বেষণের কাহিনি বলেন অথবা কোনো রেসিপি, তবে আপনার কথা শুনে তা আমি লিখে নিতে পারি। লেখার পরিশ্রম আপনাকে করতে হবে না। পত্রিকার পুরানো পাঠকরা আজও আপনার লেখা পড়তে চায়। আর নতুন পাঠকদেরও নিশ্চিত আপনার লেখা ভালো লাগবে।’

সাত্যকির কথা শুনে রসিকবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আপনি নিত্যে কোনোদিন আমার কোনো লেখা পড়েছেন? আপনার যা বয়স তাতে মনে হয় আপনার অক্ষর জ্ঞান হবার আগেই আমি লেখা ছেড়ে দিয়েছি।’ ভাগ্যিস পত্রিকা সম্পাদক লেখার কাটিংগুলো সাত্যকির পড়ার জন্য দিয়েছিলেন। সে ব্যাপারটাই সাত্যকিকে এবার বাঁচিয়ে দিল। সে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ অবশ্যই পড়েছি।’

‘যেমন?’ প্রশ্ন করলেন রসিকলাল।

সাত্যকি বলতে শুরু করল, ‘ওই যে আফ্রিকাতে একবার জলহস্তির মাংস খেতে গিয়ে উপজাতিদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। আবার তানজেনিয়ার এক মাসাই গ্রামে সিংহের ঝলসানো হার্ট খেয়েছিলেন!’ মৃদু হাসি ফুটে উঠল রসিকবাবুর ঠোঁটের কোণে। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ মাসাইদের বিশ্বাস, সিংহর কলিজা খেলে সিংহের মতো সাহস আর শক্তি সঞ্চয় হয় শরীরে।’

সাত্যকি বলল, ‘তারপর ওই যে গোল্ডেন মাশরুম খাবার জন্য আমাজনের রেন ফরেস্টে পাড়ি দেওয়া, সামনে থেকে অ্যানাকোন্ডা সাপকে শিকার ধরতে দেখা! এছাড়া আপনার লেখা নানা রেসিপি, ওই যেমন মধু দিয়ে ব্রোকোনির রোস্ট, কিংবা সার্ডিন মাছের বিরিয়ানির রেসিপি, সব লেখাইতো এক কথায় অনবদ্য!’

সাত্যকির কথা শুনে ধীরে ধীরে যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠত। সাত্যকির কথা শেষ হবার পর তিনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ, সে সব দিন ছিল বটে। খাবারের সন্ধানে কত জায়গাতে গেছি, কত কিছু খেয়েছি, কতরকম অভিজ্ঞতা! লেখার ব্যাপারটা ছিল আমার খুব ভালো লাগার জিনিস।’

সাত্যকি তাকে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, ‘তবে আপনি, লেখা ছেড়ে দিলেন কেন?’

কিন্তু তার আগেই দরজার পরদা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করল একজন লোক। তাঁর পরনে একটা কোট, মাথায় টুপি, পায়ে জুতো। তাঁর ডান হাতে একটা ব্যাগ আর বাঁ-হাতটা কোটের পকেটে ঢোকানো। ভদ্রলোকের ধবধবে সাদা ঝোলা গোঁফ আর চেহারা দেখে সাত্যকির মনে হল রসিকলালের সমবয়সি হবেন তিনি। সাত্যকি স্পষ্টই বুঝতে পারল তাকে দেখে ভদ্রলোকের চোখে বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল। ব্যাপারটা রসিকলালও অনুমান করতে পেরে বললেন, ‘এই ভদ্রলোকের নাম সাত্যকি বসু। আমি কলকাতার যে কাগজে এক সময় লিখতাম, সে কাগজ থেকে এসেছেন লেখার অনুরোধ নিয়ে। কদিন আগে এক লেখক এ জায়গাতে এসেছিলেন। বাড়ির সামনে দেখা হয়েছিল, তার থেকেই এত বছর পর ওরা আমার খোঁজ পেয়েছেন। তুমি আসবে বলে সদর দরজা খুলে রেখেছি।’ ভদ্রলোক এবার ভালো করে তাকালেন সাত্যকির দিকে। রসিকলাল এরপর আগন্তুকের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘ইনি আমার বন্ধু। এক সময় ওখানকার জমিদার মহাপ্রসাদ চৌধুরীর শেষ বংশধর বরদাপ্রসাদ চৌধুরী। এখানকার ঘাট, মন্দির, শ্মশান সবই ওদের প্রতিষ্ঠা করা।’

বরদাপ্রসাদের পরিচয় পেয়ে সাত্যকি নমস্কার জানান তাকে। প্রত্যুত্তরে তিনি মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বললেন, ‘নমস্কার’।

সাত্যকি মৃদু হেসে বলল, ‘জমিদার বাড়িটা দেখলাম। আপনি কি ওখানেই থাকেন?’

সাত্যকির প্রশ্নর জবাব বরদাচরনের পরিবর্তে রসিকলাল। তিনি বললেন, ‘ও বাড়িতো আর বাসযোগ্য নেই। এ অঞ্চলে আরও বেশ কয়েকটা পুরানো বাড়ি আছে ওদের। মন্দিরের কাছে একটা বাড়িতেও থাকে। এ বাড়িটাও একসময় ওদের বাগানবাড়ি হিসাবেই ব্যবহার যেত।’

সাত্যকির মনে হল বরদাপ্রসাদ তার সঙ্গে কথা বলতে খুব একটা সামগ্রী নন। কারণ তিনি তার সঙ্গে আর কোনো কথা না বলে রসিকলালকে বললেন, ‘দাও প্রেসক্রিপশনটা দাও। আজ সন্ধ্যায় আর আড্ডা হবে না। আমি কলকাতা যাচ্ছি। কাল রাতে ফিরব।’

তার কথা শুনে রসিকলাল টেবিলে রাখা একটা ডাক্তার প্রেসক্রিপশন তুলে নিয়ে বরদাপ্রসাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওষুধপত্র দিয়ে আমার এ রোগ আর সারবে বলে মনে হয় না। তবে ব্যথা কমার ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ অবশ্যই এনো। ঘুমের ওষুধ আর একটা মাত্র পড়ে আছে।’

বরদাপ্রসাদ প্রেসক্রিপশনের কাগজটা হাতে নিয়ে রসিকবাবুর কাছে জানতে চাইলেন ‘আর কিছু?’

রসিকলাল মৃদু চুপ করে থেকে বললেন, ‘কদিন ধরে যেটা আনতে বলছি, দ্যাখো না সেটা পাও কিনা?’

বরদাপ্রসাদ জবাবে বললেন, ‘না, সেটা জোগাড় করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ডাক্তার তোমাকে সহজপাচ্য খাবার খেতে বলেছেন।’

রসিকবাবু এবার যেন একটু করুণস্বরে বললেন ‘তবু একবার শেষবারের মতো চেষ্টা করে দ্যাখো। আমার কবে কী হয় কিছুই বলা যায় না।’

বরদাপ্রসাদ এবার তার কণ্ঠে একটু কাঠিন্য ফুটিয়ে বললেন, ‘কী হবে বা না হবে তা ভবিষ্যতে ডাক্তারবাবুরা বলবেন। বাড়ির বাহিরে বেরোবে না। আমি তখন আমি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ইনি চলে গেলে দরজা দিয়ে শুয়ে পোড়ো।’ —একথা বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ভদ্রলোক।’

রসিকবাবুর মুখে কেমন যেন একটা বিমর্ষভাব। সাত্যকি জানতে চাইল ‘আপনা কী অসুখ হয়েছে আপত্তি না থাকলে বলবেন?’

রসিকলাল জবাব দিলেন, ‘লিভার ক্যানসার ধরা পড়েছে। তবে ফার্স্ট স্টেজ।’

ব্যাপারটা জেনে সাত্যকির খারাপ লাগল। মুহূর্তের জন্য ঘরের মধ্যে যেন একটা বিষণ্ণতা নেমে এল। তবে এরপরই রসিকবাবু হেসে উঠে বললেন, ‘লিভার, পাকস্থলী ও সবের ওপর কম অত্যাচার তো করিনি। কী খেয়েছি আর না খেয়েছি। এখন ওরা পালটা প্রতিশোধ নিচ্ছে। খুব বেশি দিন আর বাঁচব বলে মনে হয় না। এমনও হতে পারে আর কয়েক মাস আয়ু আমার।’

সাত্যকি তাকে ভরসা দেবার জন্য বলল ‘এখন মেডিকেল সায়েন্স অনেক উন্নত হয়েছে। ভালো ডাক্তার দেখালে নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবেন।’

রসিকলাল বললেন, ‘আমার মন বলছে আমার আয়ু আর বেশি দিন নেই। রাতে খাবার পর আজকাল পেটে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। ব্যথা কমার ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে হয়।’

নিস্তব্ধ ঘর। রসিকলাল নিশ্চুপ। সাত্যকি ভাবতে লাগল এ অবস্থায় লেখার ব্যাপারে তাকে চাপাচাপি করা ঠিক হবে কিনা? এক সময় সে বলল, ‘লেখকের লেখা লেখককে অমরত্ব দেয়। বিশেষত আপনাদের মতো লেখকদের শক্তিশালী কলম। খাবার নিয়ে লেখাও যে সাহিত্য হতে পারে তা আপনার লেখা না পড়লে জানতেই পারতাম না।’

রসিকলাল বললেন, ‘সত্যি বলছেন?’

সাত্যকি জবাব দিল ‘হ্যাঁ, সত্যি। এত বছর পরও নিশ্চয়ই আপনার পাঠকরা আপনার লেখা পড়ে খুশি হবেন। নইলে আপনার লেখা পাবার জন্য সম্পাদক আপনার কাছে আমাকে পাঠাবেন কেন? নতুন পুরানো অন্য কত লেখকইতো আছে।’

সাত্যকির কথা শুনে ভদ্রলোকের মুখে জেগে থাকা বিষণ্ণতাটা যেন ধীরে ধীরে মুছে যেতে লাগল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি একটা লেখা দেব। তবে আপনার সম্পাদক যে লেখা ছাপবেন কিনা জানি না।’

কথাটা শুনে সাত্যকি উৎফুল্লভাবে বলল, ‘আপনার লেখা সম্পাদক ছাপবেন না তা হতেই পারে না। আপনার লেখার ষান্মাসিক হিসাবে সম্পাদক টাকাও পাঠিয়েছেন।’ এই বলে যে টাকার খামটা বার করে টেবিলের ওপর রাখল।’

রসিকবাবু খামটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সম্পাদককে আমার ধন্যবাদ জানাবেন। তবে আমি টাকার জন্য কোনোদিন লিখিনি। লিখেছি জীবনের স্বাদ-অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে আনন্দ পাবার ও দেবার জন্য।’

সাত্যকি বলল, ‘সত্যিক বিচিত্র অভিজ্ঞতা আপনার জীবনে! কত জায়গায় গেছেন খাবারের সন্ধানে! কত কিছু দেখেছেন, জেনেছেন! বাঁচার মতো বেঁচেছেন। জীবন এমনই হওয়া উচিত দৈর্ঘ্যর থেকে আকারে বড়ো।’

এ কথাটা শোনার রসিকবাবু কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইলেন সাত্যকির দিকে। তাঁকে এমনভাবে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কেমন যেন একটা অস্বস্তিবোধ হল সাত্যকির। সাত্যকি তাঁর উদ্দেশ্যে বলল ‘আমি কি কিছু ভুল বললাম?’

রসিকলাল বললেন, ‘না, ভুল বলেননি। সম্ভবত বড়ো সত্যি কথা বলেছেন। আপনার বলা কথাটাই ভাবছি। জীবনে কে কতদিন বাঁচল তাতে কী আসে যায়? কে কেমনভাবে বাঁচল, জীবনের স্বাদ, রূপ, গন্ধ, বর্ণ কতটা মৃত্যুর আগে চেয়ে দেখতে পেল সেটাই বড়ো কথা।’

এ কথা বলে তিনি আবারও বললেন; ‘হ্যাঁ, লেখা আমি দেব। সম্ভবত এটাই আমার শেষ লেখা।

এমন লেখা লিখব যেটা আমি আগে কোনোদিন লিখিনি, কেউ কোনোদিন সম্ভবত লেখেনি।’

সাত্যকি বলে উঠল, ‘আপনি নিজে লিখবেন? নাকি আপনি বলবেন, আমি লিখব?’

রসিকলাল জবাব দিলেন, ‘না আমিই লিখব। তারপর যেটা মুখ বন্ধ খামে আপনাকে দেব। শর্ত একটাই, সম্পাদকের হাতে পৌঁছোবার আগে সে খাম যেন অন্য কেউ না খোলেন । আপত্তি নেই তো?’

সাত্যকি বলল, ‘না, এতে আপত্তির কী আছে।’

সাত্যকি জানতে চাইল, ‘লেখাটা কবে দেবেন? আমি কাল এসে লেখাটা নিয়ে যেতে পারি।’

রসিকলাল বললেন, ‘আপনি এখানে কোথায় রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত করেছেন? কিসে এখানে এসেছেন?’

সাত্যকি জবাব দিল। কলকাতা থেকে বাসে এসেছি, তারপর বাস স্ট্যান্ড থেকে এ পর্যন্ত মোটর ভ্যান। বাস স্ট্যান্ডের কাছেই একটা হোটেলে কথা বলে এসেছি। ওখানে গেলে রাতে থাকতে দেবে।’

রসিকলাল কথাটা শুনে বললেন, ‘কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত ততটা পথ আপনি যাবেন। কীভাবে? রাতে এখান থেকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত যাবার যানবাহন না পাবার সম্ভাবনাই বেশি। স্থানীয় লোকেরা নিজেদের সাইকেল, বাইক ইত্যাদিতে যাওয়া আসা করেন।’

সাত্যকি এ ব্যাপারটা আগে ভেবে দেখেনি। সত্যিই সে অপরিচিত নির্জন জায়গাতে এতটা পথ ফিরবে কীভাবে? যে বলল ‘তবে কী করা যায় বলুনতো?’

রসিকলাল বললেন, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে এ বাড়িতেই রাতটা আপনি কাটাতে পারেন। গল্পগুজবও করা যাবে আপনার সঙ্গে। তারপর কাল সকালে আপনি আসার লেখাটা নিয়ে ফিরবেন। আশা করি রাতের মধ্যে লেখাটা শেষ করতে পারব। সমস্যা শুধু একটাই, আপনাকে আপ্যায়নের জন্য খাবার তেমন কিছু নেই। ডাক্তারের পরামর্শমতো ইদানীং আমি ফলের রস ইত্যাদি লিকুইড খাই।

সাত্যকির নিজের কাছে বিস্কুট-কেক-চিড়েভাজা আছে। একটা রাতের পক্ষে তা যথেষ্ট। কাজেই বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে সাত্যকি বলল, ‘আপনার যদি অসুবিধা না হয় তবে আপত্তি নেই।’

রসিকলাল হেসে বললেন, ‘না, অসুবিধা হবে না। বেশ কয়েকটা ঘর আছে এ বাড়িতে। আপনি থাকলে আমার ভালোই লাগবে। যাকে দেখলেন, ওই বরদাপ্রসাদ মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় গল্প করতে আসে আমার সঙ্গে।

তা ছাড়া আমার কথা বলার লোক নেই। ঘণ্টা খানেক গল্প করা যাবে আপনার সঙ্গে।

সাত্যকি এবার মুখ ফসকে বলেই ফেলল, ‘কলকাতা থেকে এত দূরে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গাতে আপনি পড়ে আছেন কেন?’

প্রশ্নটা শুনে রসিকবাবু কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘যে লেখাটা আমি লিখব। তার মধ্যেই এ প্রশ্নের উত্তর আছে। তবে তা এখন আপনাকে বলব না।’

সাত্যকি বলল, ‘ঠিক আছে বলতে হবে না। তবে বিভিন্ন খাবারের ব্যাপারে, তার অন্বেষণে অভিজ্ঞতার কথা যদি কিছু আমাকে বলেন?’

রসিকলাল হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ এ সব ব্যাপারে অনেক কথা আমার ভাড়ারে আছে।’

তিনি এরপর সাত্যকিকে বলতে বসলেন খাদ্য বিষয় নানা কাহিনি, তার অভিজ্ঞতার কথা। তার কথায় কখনো উঠে আসতে লাগল মোগল সম্রাটের রসুইখানাতে এক সময় কীভাবে মশলাদার কাবাব প্রস্তুত হত তার কথা, আবার চীন দেশে সুইফট পাখি নামের এক ধরনের পাখির বাসার সুপ খাওয়া হয় সে গল্প।

তিনি বলে যেতে লাগলেন খাদ্য অন্বেষণে তার নানা রোমাঞ্চকর অভিযানের কথাও। এই যেমন একবার ব্রাজিলে পিরানহা মাছের রোস্ট খেতে গিয়ে জেলে ডিঙি থেকে জাল পড়ে নিজেই আর একটু হলে পিরানহার খাদ্যে পরিণত হচ্ছিলেন যে কাহিনি। মশলার যে কতরকম প্রকারভেদ আছে তা রসিকলালের মুখ থেকে শুনে সাত্যকি আশ্চর্য হয়ে গেল। আরশোলা, কাঁকড়াবিছে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ নাকি শুকিয়ে গুড়ো করে রান্নার মশলা হিসাবে ব্যবহার করা হয়! আর সে সব মশলার নাকি বেশ চড়া দাম!

রসিকলাল গল্প বলে চললেন। বাহিরে রাত বেড়ে চলল। তাঁর গল্প শুনতে শুনতে ঘণ্টা তিনেক সময় যে কীভাবে কেটে গেল চন্দন তা বুঝতেই পারল না।

এক সময় সাত্যকি তাকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা আপনিতো এত দেশ ঘুরেছেন, এত কিছু খাবার খেয়েছেন, তার মধ্যে সব থেকে সুস্বাদু লেগেছে কোন খাবার?’

রসিকলাল তার কথায় কোনোকিছু জবাব দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই বাড়ির বাহিরে রাত্রির নিস্তদ্ধতা বিদীর্ণ করে এক অদ্ভুত জান্তব কোলাহল জেগে উঠল। ওই শব্দের আকস্মিকতার ঘরের মধ্যে বসেই সাত্যকি চমকে উঠে বলল ‘ও কিসের শব্দ!’

সাত্যকির প্রশ্ন শুনে রসিকলাল হেসে ধরলে বললেন, ‘আপনি শহুরে মানুষ তাই এ শব্দ চিনতে পারছেন না। এ হল শিয়ালের সম্মিলিত কলতান। দিনের বেলাতে পোড়ো জমিদার বাড়িতে লুকিয়ে থাকে ওরা। তারপর রাত নামলেও এ বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কাছেই দ্বারকানদের চরে যে ছোটো শ্মশান আছে সেদিকে যায়।’

শিয়ালের ডাক শুনে চমকে ওঠায় নিজে এবার বেশ লজ্জাবোধ করল সাত্যকি। রসিকলাল বলল, ‘জানেন আমি আফ্রিকাতে কতদিন আমার তাঁবুর বাহিরে দলবদ্ধ সিংহের ডাক শুনেছি। প্রথম প্রথম ভয় লাগত। তারপর যে ডাক যেন আমার কাছে ঘুম পাড়ানি গানের মতো লাগত। যে ডাক না শুনলে আমার ঘুমই আসত না!’

আলোচনার মোড় এবার অন্য গল্পে ঘুরে গেল। আরও বেশ কিছুক্ষণ ধরে রসিকলাল তার কথা বলার পর টেবিলে রাখা একটা অ্যালাম ঘড়িতে রাত দশটার ধাতব শব্দ শুরু হল। রসিকবাবু এবার টেবিল ক্লকের শব্দটা থামিয়ে বললেন, ‘বেশ রাত হল। এবার চলুন আপনাকে আপনার ঘরে পৌঁছেছেই। ভাবছি রাতের মধ্যেই লেখাটা শেষ করে ফেলব।’

রসিকলালের সঙ্গে সে ঘর ছেড়ে কাছেই একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল সাত্যকি। যে ঘরের আলো জ্বালালেন রসিকবাবু। তবে আলোর তেজ কম। ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একটা খাট, বিছানা-বালিশও আছে। রসিকবাবু ঘরটা দেখিয়ে বললেন, ‘কি চলবে তো?’

সাত্যকি বলল, ‘হ্যাঁ চলবে। তা ছাড়া মাত্র একরাতের তো ব্যাপার।’

রসিকলাল বললেন, ‘পাশেই বাথরুম, কলঘর। তেমন সমস্যা হবে না আপনার।’

এ কথা বলার পর তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি রাতে কখন ঘুমান?’

সাত্যকি জবাব দিল ‘আমার অনেক রাত পর্যন্ত জাগার অভ্যাস। রাত দেড়টা-দুটো পর্যন্ত লিখি, পড়াশোনা করি। তার আগে আমার ঘুম আসতে চায় না। সকালে উঠতে উঠতে বেলা আটটা বেজে যায়।’

রসিকবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি এবার আসি। কোনো প্রয়োজন হলে ডাকবেন।’ এই বলে ঘর ছাড়লেন তিনি।

এই রাতে রসিকবাবুকে সাত্যকির কী বা প্রয়োজন হতে পারে? তিনি চলে যাবার পর সাত্যকি প্রথমে তার ব্যাগ থেকে বিস্কুট, জলের বোতল, চাদর ইত্যাদি বার করে খাটে রাখল। শুকনো খাবার দিয়েই রাতের খাবার সারল সে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে কল ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এল। শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার সময় সে দেখল দরজার ছিটকিনি খারাপ। কাজেই দরজার পাল্লা এমনিই বন্ধ করে সাত্যকি চাদর মুড়ি দিয়ে সঙ্গে আনা একটা বই নিয়ে খাটের ওপর বসল। বইটা পড়তে শুরু করল সে। নিঝুম বাড়ি, কোথাও কোনো শব্দ নেই। মাঝে মাঝে শুধু বাইরে থেকে কখনো কখনো স্পষ্ট শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। ক্ষয়াটে আলোতে সাত্যকির বই পড়তে একটু সমস্যা হচ্ছিল ঠিকই। কিন্তু এ ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। রাত দেড়টা-দুটোর আগে কিছুতেই তার ঘুম আসে না। তা ছাড়া নতুন জায়গাতে গেলে তার ঘুম আসে না। একবার বেশ জোরে শিয়ালের কলতান কানে এল সাত্যকির। রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে দেখল বই পড়তে রাত বারোটা বাজে। প্রহর শেষে ডেকে উঠেছে শিয়ালের দল। ঠিক এই সময় সাত্যকি দরজার গায়ে টোকা দেবার সঙ্গে সঙ্গে রসিকবাবুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেল—’সাত্যকিবাবু, জেগে আছেন?’

সাত্যকি জবাব দিল, ‘হ্যাঁ জেগে আছি। আসুন, পাল্লা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলেন রসিকবাবু।

তার এক হাতে একটা খাম আর অন্য হাতে ধরা কমলা রঙের তরল পূর্ণ কাচের গ্লাস। সাত্যকি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রসিকবাবু তার সামনে এসে প্রথমে খামটা সাত্যকির হাতে ধরিয়ে বলল, ‘এই নিন আপনাদের লেখা। ঘণ্টা দুই সময়ের মধ্যেই লিখে ফেললাম। সময় নষ্ট করলাম না। আমার ব্যথা কখন বাড়ে তা কিছুই বলা যায় না।’

সাত্যকি খামটা ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। চওড়া সেলোটেপ দিয়ে খামের মুখটা ভালো করে আটকানো হয়েছে যাতে সেটা সহজে খোলা না যায়। খামের ওপর গোটা গোটা অক্ষরে সম্পাদক আর পত্রিকার নাম লেখা। খামটা হাতে নিয়ে দেখার পর সাত্যকি বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ জানাবার কোনো ভাষা নেই। এই অসুস্থতার মধ্যেও যে আপনি লেখাটা এত দ্রুত শেষ করে আমাকে দিলেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

কথাটা শুনে রসিকবাবুর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন ‘ছোটো হলেও লেখাটা ছাপা হলে পাঠকদের মধ্যে যে সাড়া ফেলবে তা আমি বলতে পারি। আর হ্যাঁ, এই খামে আপনার জন্যও একটা জিনিস আছে। সেটা কি আমি এখন বলব না। সম্পাদক যখন খামটা খুলবেন তখন জানতে পারবেন।’

সাত্যকি, রসিকবাবুর শেষ কথাটা শুনে সাত্যকি বেশ অবাক হলেও এ ব্যাপারে যে রসিকবাবুকে কোনো প্রশ্ন করল না। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাত্যকি খামটা তার ব্যাগের মধ্যে রাখল। রসিকবাবু এরপর তার দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘নিন, এটা শেষ করুন। কমলালেবুর রস। আমার জন্য বলবার সময় আপনার জন্য বললাম। যতই হোক আপনি আমার অতিথি, সামান্য কিছু হলেও আপনাকে খেতে দেওয়া আমার কর্তব্য। কিছুদিন আগে এলেও আমি আপনাকে নিজের হাতে রান্না করে নানা পদ খাওয়াতাম। কিন্তু এখন আর সে উপায় নেই।’

রসিকবাবুর অনুরোধে সাত্যকি চুমুক দিল তাতে। কমলালেবুর বেশ মিষ্টি রস। কয়েক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে সাত্যকি সেটা ফিরিয়ে দিল রসিকবাবুর হাতে।’

তিনি গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘এবার আপনি মন দিয়ে বই পড়ুন। আমি এবার যাই। রাত অনেক হল। শুভরাত্রি।’

সাত্যকিও শুভরাত্রি জানাল তাকে।

কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছে আবার ফিরে দাঁড়ালেন তিনি। সাত্যকির উদ্দেশ্যে রসিকবাবু বললেন, ‘আপনার বলা কথাটা কিন্তু আমার বেশ মনে ধরেছে। মানুষ কদিন বা কতক্ষণ বাঁচবে তা বড়ো কথা নয়। কিন্তু মৃত্যুর আগে যে এই পৃথিবীর রূপ-রস উপভোগ করল কিনা, তার রসনার নিবৃত্তি হল কিনা যেটাই আসল ব্যাপার।’

সাত্যকি হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, তা তো বটেই।’

রসিকবাবু এরপর আর কোনো কথা বললেন না। ঘরের বাইরে বেরিয়ে যাবার আগে দরজার পাল্লা বন্ধ করে গেলেন। তিনি চলে যাবার পর আবার বইয়ের পাতায় ডুব দিল সাত্যকি।

বইটা পড়ছিল সাত্যকি। একটা রহস্য উপন্যাসের উত্তেজনায় ক্লাইমেক্সে তখন সে প্রায় পৌঁছে গেছে। রসিকবাবু চলে যাবার পর মাত্র মিনিট পনেরো সময় কেটেছে। সাত্যকির হঠাৎ মনে হল বইয়ের অক্ষরগুলোকে যেন সে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে। তবে কি আলোর জোর কমে এল? ব্যাপারটা প্রথমে সে বুঝে উঠতে না পারলেও কিছুক্ষণের মধ্যে যেন ঘুমে জড়িয়ে আসতে লাগল তার চোখ। কিন্তু এমনতো হবার কথা নয়, এখনও তো রাত সাড়ে বারোটাও বাজেনি। তবে হয়তো সারাদিনের যাত্রাপথের ক্লান্তি, আর উৎকণ্ঠার অবসানে ঘুম নেমে আসছে তার চোখে। এক সময় আর বসে থাকতে পারল না সে। বই বন্ধ করে বাতি না নিভিয়ে সাত্যকি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল।

কিন্তু পরিপূর্ণ ঘুম আসা বলতে যা বোঝায় তা কিন্তু সাত্যকির এল না। যা এল তাকে বলা যেতে পারে একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব। সে যেন আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে আছে। সে অবস্থাতে বার কয়েক শিয়ালের ডাকও যেন তার কানে এল। রাত এগিয়ে চলল। সাত্যকির তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ভেসে উঠতে লাগল নানা অদ্ভুত দৃশ্য। কখনো তার মনে হল সে কোনো গহীন জঙ্গলে তাঁবুতে শুয়ে আছে, বাহিরে থেকে ভেসে আসছে সিংহের ডাক! কখনো সে দেখল কারা যেন বিশাল কড়াইতে হরিণ রাঁধছে, দুটো লোক একটা বিরাট শিলনোড়াতে কাঁকড়াবিছের মশলা গুঁড়ো করছে, কখনো বা সে দেখল সুইফট পাখির বাসার স্যুপ খাবে বলে একদল চীনা ম্যান তাকে গাছে চড়তে বলছে! রসিকবাবুর মুখে শোনা কাহিনিগুলোই নানাভাবে তার চোখে যেন ভাসতে লাগল! শেষপর্যন্ত তার চোখে একটা দৃশ্যের অবতারণা হল—একটা খাবার টেবিলে পাশাপাশি বসে সে আর রসিকবাবু। তাদের সামনে প্লেট-বোল কাঁটা চামচ এসব রাখা। টেবিলের ওপর রাখা একটা চিনামাটির পাত্র থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। তার থেকে হাতা দিয়ে স্যুপের মতো ঘন গরম খাবার সাত্যকির সামনে রাখা বোল বা বাটিতে আর নিজের বাটিতে ঢাললেন রসিকলাল। স্যুপটা দেখে আর তার গন্ধে সাত্যকির মনে হল সম্ভবত সেটা কোনো মাংসের স্যুপ হবে।

রসিকবাবু, তাকে বললেন, ‘নিন চামচ ওঠান, খাওয়া শুরু করুন।’

সাত্যকি জানতে চাইল, ‘এটা কী খাবার?’

রসিকলাল হেসে বললেন; আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন না যে কোন খাবার খেতে সব থেকে সুস্বাদু?

এটাই সেই খাবার। স্যুপ দিয়ে আজ শুরু করুন। এরপর কাবাব। রোস্ট খাওয়াব ও জিনিসের।

সাত্যকি আবারও প্রশ্ন করল, ‘বলুন না ওটা কিসের স্যুপ?’

রসিকবাবুও একই জবাব দিলেন, ‘পৃথিবীর সব থেকে সুস্বাদু খাবার ওটা।

ধোঁয়া ওঠা স্যুপের বাটিটা দেখে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল সাত্যকির। সরু সরু কয়েকটা মাংসের টুকরো উঁকি দিচ্ছে স্যুপের বাটি থেকে। সেগুলো কেমন যেন চেনা মনে হতে লাগল সাত্যকির।

রসিকবাবু আবারও তাকে তাড়া দিলেন, ‘নিল, ঠান্ডা হয়ে যাবার আগে শুরু করুন। একবার এর স্বাদ পেলে অন্য খাবার আর মুখে রোচবে না।’

সাত্যকির মনে এবার অন্য সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ডান হাতটা সে টেবিল থেকে সরিয়ে নিয়ে বুকের কাছে গুটিয়ে রসিকবাবুকে বলল, ‘আগে স্পষ্ট করে বলুন, এটা কিসের স্যুপ? তারপর খাচ্ছি।’

রসিকবাবু বললেন ‘একবার মুখে তুলল। তারপর বলছি। ঠিক আছে প্রথম চামচটা না হয় আমি আপনাকে হাতে ধরে খাইয়ে দিচ্ছি।’— এ কথা বলে সাত্যকির বাম পাশে বসে থাকা রসিকবাবু সাত্যকির বাম হাতের আঙুলগুলো খপ করে চেপে ধরলেন তা দিয়ে চামচ ধরাবার জন্য। সাত্যকি যেন এবার অনুমান করতে পারল স্যুপের পাত্রে ভাসতে থাকা টুকরোগুলো কী! সে আঙুল ছাড়াবার চেষ্টা করতে লাগল রসিকবাবুর হাত থেকে। ঠিক এই সময় তন্দ্রাছন্ন ভাবটা কেটে গিয়ে সাত্যকির স্বপ্নজাল ছিন্ন হল। কাকতালীয়ভাবেই হয়তো সেই মুহূর্তে সাত্যকি চোখ মেলল। কিন্তু তার মনে হল তখনও যেন তার বাম হাতের আঙুলগুলো কেউ চেপে ধরে আছে! চাদরের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সাত্যকি। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে তার খাটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন রসিকবাবু। একটু ঝুঁকে পড়ে তিনি চাদরের বাহিরে বার করা সাত্যকির বাম হাতের আঙুলগুলো চেপে ধরে আছেন। তাঁর মুখমণ্ডলে জেগে আছে কেমন একটা অদ্ভুত ভাব। রসিকবাবুর চোখ দুটো স্থিরভাবে চেয়ে আছে সাত্যকির আঙুলগুলোর দিকে। আঙুল ছেড়ে এরপর সাত্যকির কবজি চেপে ধরলেন রসিকবাবু। সাত্যকি বুঝে উঠতে পারছিল না কি করতে চাচ্ছেন রসিকলাল। কিন্তু এরপরই রসিকবাবুর অন্য হাতের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে হিম হয়ে গেল সাত্যকির শরীর। মুহূর্তের মধ্যে চোখ থেকে সাত্যকির সব ঘুমভাব মুছে গেল। রসিকলালের অন্য হাতে ধরা আছে একটা চপার-মাংস কাটার বড়ো ছুরি! তিনি বাঁ-হাত দিয়ে খাটের ওপর চেপে রেখেছেন সাত্যকির হাত। সাত্যকির আঙুল সমেত হাতের পাতা বিছানাতে ছড়ানো। রসিকবাবুর চপার ধরা ডান হাতটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে শুরু করেছে! এই মিটমিটে আলোতেও ঝিলিক দিচ্ছে ছুরির চওড়া ফলা!

সম্বিত ফিরে পেয়ে সাত্যকি এক ঝটকায় নিজের হাতটা টেনে নিয়ে চিৎকার করে উঠে বসল। ঠিক সেই মুহূর্তে রসিকলাল চপারটা নামিয়ে মানলেন সাত্যকির হাতের পাতা লক্ষ করে। মুহূর্তের জন্য সাত্যকির হাতটা বেঁচে গেল। খাটের উলটো দিকে লাফিয়ে নেমে পড়ল সাত্যকি। রসিকলাল অন্যপাশে চপার হাতে দাঁড়িয়ে। তাদের দুজনের মধ্যে শুধু পাঁচ হাত খাটের ব্যবধান। স্পষ্ট অপ্রকৃতস্থভাব ফুটে আছে রসিকবাবুর মুখমণ্ডলে। আতঙ্কিত সাত্যকি চিৎকার করে বলল, ‘আপনি এ কী করছেন রসিকবাবু!’

রসিকবাবু যেন স্বগোতক্তির স্বরেই বললেন, ‘জল ফুটে এসেছে, শব্দ শোনা যাচ্ছে। একটু শুধু একটু হলেই চলবে শেষবারের মতো। আমার খাবার আর খাবার, দুটোর প্রস্তুতিই সারা।’

সাত্যকি বলে উঠল ‘কী? কী চাইছেন আপনি?’

তিনি সাত্যকির কথার কোনো জবাব না দিয়ে খাটটা বেড় দিয়ে ধীর পায়ে ছুরি হাতে সাত্যকির কাছে এগোবার চেষ্টা করলেন। তাকে বাধা দেবার মতো কোনো অস্ত্র নেই সাত্যকির কাছে। রসিকলাল খাটটাকে বেড় দিয়ে সাত্যকির বেশ কাছে পৌঁছে গেল। সাত্যকি খাটের পাশে যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানেই রাখা ছিল তার বড়ো কিট ব্যাগটা। সেটা আত্মরক্ষার্থে উঠিয়ে নিল সাত্যকি। কোথায় যেন একটা দুম দুম শব্দ হচ্ছে! সত্যি ঘরের বাহিরে থেকে আসা কোনো শব্দ? নাকি নিজের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছে সাত্যকি।

রসিকলাল পৌঁছে গেলেন সাত্যকির হাত চারেক তফাতে। কয়েক মুহূর্তে ঘোলাটে চোখে সাত্যকির দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। সেই দুম দুম শব্দটা যেন আরও জোরে বাজছে সাত্যকির কানে। আর এরপরই রসিকলাল এক পা এগিয়ে এসে তার চপার ধরা হাতটা তুলল সাত্যকিকে আক্রমণ করার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে সাত্যকি আত্মরক্ষার শেষ চেষ্টা করে কিট ব্যাগটা সজোরে ছুড়ে মারল রসিকবাবুর দিকে। রসিকবাবুও ছুরিটা চালালেন তখনই। রসিকবাবুর ছুরি যেমন সাত্যকিকে স্পর্শ করল না তেমনই মাত্র কয়েক কেজি ওজনের কিট ব্যাগ রসিকবাবুকেও তেমন আঘাত হানতে পারল না। কিন্তু অন্য একটা ঘটনা ঘটল। কিট ব্যাগের নাইলনের স্ট্রাপের সঙ্গে ছড়িয়ে গেল রসিকবাবুর চপার ধরা হাতটা। তিনি সেটা খেলার চেষ্টা করতে লাগলেন। বাঁচারও সুযোগ আর নষ্ট করল না সাত্যকি। এগিয়ে গিয়ে সে সজোরে লাথ কষালো রসিকলালের কোমরে। রসিকলালের হাত থেকে খসে পড়ল ছুরি সমেত ব্যাগটা। আর তিনি ছিটকে পড়লেন দরজার কাছে। রসিকলালের চেহারা যতই শক্তসমর্থ থাকুক তার বয়স হয়েছে। তা ছাড়া তিনি অসুস্থও। সত্তর বছরের রসিকলালের পক্ষে তিরিশ বছরের যুবক সাত্যকির সপাটে লাথি খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিল না। তিনি মেঝেতে পড়ে যেতেই মাটি থেকে চপারটা তুলে নিয়ে দাঁড়াল সাত্যকি। মাটিতে পড়ে থাকা রসিকলাল বিস্ফোরিতভাবে তাকিয়ে আছেন সাত্যকির দিকে। সাত্যকিও তাকিয়ে তার দিকে। রসিকলাল দরজার সামনে এমনভাবে পড়ে আছেন যে তাকে না সরিয়ে ঘরের বাইরে বেরোল সম্ভব নয়। দুম দুম শব্দটা যেন তখন আরও আরও জোরে হচ্ছে! অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ করে এরপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন রসিকলাল। সাত্যকি তাকে বলল, ‘আমার সামনে থেকে সরে যান। আমাকে যেতে দিন।’ রসিকলাল তার উদ্দেশ্যে করুণ স্বরে বললেন, ‘নিশ্চয়ই যাবেন। কিন্তু দোহাই আপনার, খুব সামান্য হলেও চলবে। আমাকে দিন। আমি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে রেখেছি।’

এ কথা বলে তিনি আবার এগোতে লাগলেন সাত্যকির দিকে। সাত্যকি, রসিকবাবুকে ভয় দেখানোর জন্য চপারটা উঁচিয়ে ধরল। রসিকবাবুকে যে বলল, ‘যাব এক পা এগোলে এই ছুরিটা আমি আপনার ওপর চালাব। আর এরপরই বাড়ির সদর দরজার বাইরে থেকে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল—’রসিক, দরজা খোলো, দরজা খোল বলছি! পাগলামো কোরো না।’

সাত্যকি এবার বুঝতে পারল এতখন ধরে যে দুম দুম শব্দটা যে শুনছিল সেটা আসলে দরজা ধাক্কাবার শব্দ। অনেকক্ষণ ধরে সদর দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ!

বাইরের লোকটার হাকডাক এবার রসিকলালেরও কানে গেল। তিনি হতাশভাবে বললেন, ‘আর কিছু করার নেই, বরদা চলে এসেছে!’

দরজা ধাক্কানোর শব্দে আর বরদাপ্রসাদের কণ্ঠস্বর শুনে সাত্যকির সাহস কিছুটা বাড়ল। সে ছুরিটা উচিয়ে ধরে রসিকবাবুকে ধমকের স্বরে বলল ‘সরে যান সরে যান বলছি। আমাকে সদর দরজা খুলতে যেতে দিন।’

সাত্যকির এ কথা শোনার পর রসিকলাল আর সেখানে দাঁড়ালেন না। একটা করুণ আর্তনাদ করে দ্রুত ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। সাত্যকি শুনতে গেল বাড়ির ভিতর থেকে কোথাও যেন দড়াম করে দরজা বন্ধ করার শব্দ হল। সদর দরজার বাইরে থেকে বরদাপ্রসাদের ডাক আর দরজা ধাক্কাবার শব্দ আসছে। প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ছুরিটা বাগিয়ে ধরে সাত্যকি ঘর থেকে বাইরে বেরোল সদর দরজা খোলার জন্য। না, বাইরে রসিকবাবুকে সে দেখতে পেল না। সাত্যকি সাবধানে সদর দরজার দিকে এগোলো।

একটা অল্প ওয়াটের বাতি জ্বলছিল করিডোরে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে শেষপর্যন্ত সাত্যকি সদর দরজা খুলে ফেলল। বাইরে সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন বরদাপ্রসাদ। সাত্যকিকে দেখে বরদা মৃদু বিস্মিতভাবে বললেন ‘আপনি তবে যাননি! আপনারই চিৎকার তবে শুনছিলাম বাড়ির ভিতর থেকে!’

এ কথা বলার পরই তিনি সাত্যকির হাতে ধরা ছুরিটা দেখে কয়েকপা পিছিয়ে গেলেন।

সাত্যকি তাকে বলল ‘আপনি ভয় পাবেন না। আমি ঘুমাচ্ছিলাম। এই ছুরিটা দিয়ে রসিকবাবু আমাকে আক্রমণ করতে এসেছিলেন। ভাগ্যের জোরে বেঁচে আমি ছুরিটা তার থেকে কেড়ে নিয়েছি। উনি কি পাগল হয়ে গেছেন?’ বরদাপ্রসাদ বললেন ‘হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ওর এমন হয়। বেশ কয়েকবার অ্যাসাইলামেও দিতে হয়েছিল। কিন্তু সে এখন কোথায়? আপনি তাকে আঘাত করেননিতো?’

সাত্যকি বলল, ‘বাঁচবার জন্য তাকে একটা লাথি মারতে হয়েছিল। ব্যাস ও পর্যন্তই। ছুরিটা আমার হাতে চলে আসার পর, আর আপনার গলা শুনে আমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে তিনি সম্ভবত এ বাড়িরই কোনো ঘরে গিয়ে ঢুকেছেন।’

সাত্যকির কথা শুনে বরদাপ্রসাদ একটু আশ্বস্ত হয়ে বললেন, ‘দেখি সে কোন ঘরে আছে? আর আমার দিক থেকে আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমি রসিককে ঠান্ডা করে সব আপনাকে বুঝিয়ে বলছি।’ বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলেন বরদা। সাত্যকি অনুসরণ করল তাকে। প্রথমে রসিকবাবুর শয়নকক্ষের সামনে তারা উপস্থিত হল। দরজার ভেজানো পাল্লা ঠেলে ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখা গেল সে ঘরে তিনি নেই।’ সাত্যকি বলল ‘উনিই আমাকে থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। রাত বারোটা নাগাদ আমার ঘরে এসে মুখবন্ধ খামে লেখাটাও আমাকে দিলেন। তারপর গভীর রাতে ঘরে ঢুকে কেন এমন করলেন তা কিছুই বুঝতে পারছি না!’

বরদাপ্রসাদ ছোটো মন্তব্য করলেন ‘সবই ওর ভবিতব্য।’

সাত্যকিকে নিয়ে এরপর তিনি গিয়ে উপস্থিত হলেন বাড়ির অন্য একটা ঘরের সামনে। যে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। ঘরের ভিতর থেকে একটা ‘শোঁ শোঁ’ শব্দ ভেসে আসছে।

বন্ধ দরজার কাছে গিয়ে শব্দটা শুনে বরদা বললেন, ‘এটা ওবাড়িতে ওর প্রিয় ঘর—রান্না ঘর। ভিতর থেকে জল ফোটার শব্দ আসছে। সম্ভবত ও এঘরেই আছে।’

সৈকতের উদ্দেশ্যে চাপা স্বরে কথাগুলো বলে বরদাপ্রসাদ দরজায় ধাক্কা দিয়ে বললেন, ‘রসিক দরজা খোল, আমি এসেছি।’

কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে রসিকবাবু কোনো সাড়া দিলেন না।

বরদা এরপর দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বললেন, ‘তুমি ভয় পেওনা রসিক। আমি ভদ্রলোককে সব বুঝিয়ে বলব। তুমি অসুস্থ। উনি তোমার কোনো ক্ষতি করবেন না।’

ভদ্রলোক এ কথা বলার পরও জল ফোঁটার সেই শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া ঘর থেকে অন্য কোনো শব্দ শোনা গেল না! ঘরের গায়ে একটা জানলা আছে। তার পাল্লার জোরের ফাঁক দিয়ে একটা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে। সাত্যকি, বরদাপ্রসাদকে বলল, ‘দেখুন দেখি, জানলার পাল্লা দুটো মনে হয়ে খোলা আছে?’

তার কথা শুনে বরদা জানলার কাছে গিয়ে গরাদের ফাঁক দিয়ে পাল্লাতে ঠেলা দিলেন। ফাঁক হয়ে গেল পাল্লা। বরদা উঁকি দিলেন ঘরের ভিতর।

ঘরের ভিতর একটু তাকাবার পরই কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেল তার মুখ। সাত্যকিও এবার একটু এগিয়ে চোখ রাখল যে জানলাতে। রান্নাঘর যেমন হয় তেমনই ঘরটা। বিভিন্ন সেলফে। দেওয়ালের গায়ে রাখা আছে বিভিন্ন বাসন, রান্নার সামগ্রী। ঘরের এক পাশে উঁচু জায়গাতে একটা গ্যাস ওভানের ওপর রাখা পাত্রে শব্দ করে গরম জল ফুটছে। প্রথমে ও দৃশ্য দেখার পর ঘরের অন্য দিকে তাকাতেই সাত্যকি চমকে গেল। ঘরের এক কোণে কড়িকাঠ থেকে নাইলনের দড়ির ফাঁস ঝুলছে রসিকবাবুর দেহ! বিস্ফোরিত তাঁর চোখ। যে জিভ দিয়ে তিনি পৃথিবীর নানা খাদ্য চেখে দেখেছেন, খাদ্যরসিক রসিকলালের সেই জিভ প্রায় পুরোটাই মুখের বাইরে বেরিয়ে এসেছে! বিভৎস দৃশ্য! আত্মহত্যা করেছেন রসিকলাল।

বরদাপ্রসাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ওর লিভার ক্যানসারের ঘটনাটা কিন্তু সত্যি। ডাক্তার বলেছিল আয়ু আর মাস তিনেক। বাড়ির বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করাতেও রাজি ছিল না। কিন্তু ও এভাবে চলে যাবে ভাবিনি।

তিন যুগের সম্পর্কে আজ শেষ হল।’

সাত্যকি তাকে বলল ‘এখন কী করবেন? আমি বুঝতে পারিনি এমন ভয়ংকর ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ব! ব্যাপারটা যখন আত্মহত্যার তখন নিশ্চই থানা-পুলিশ হবে।’

বরদাপ্রসাদ বললেন, হ্যাঁ, পুলিশকে তো খবর দিতে হবেই। কিন্তু যেটা আমি করব ভোরের আলো ফুটলে আপনি চলে যাবার পর। আপনার এখানে আমার কথা পুলিশকে আমি জানাব না। কারণ আমি চাইনা যে সত্য আমি এতদিন গোপন করেছি তা পুলিশ বা স্থানীয় মানুষদের কাছে প্রকাশ হোক, রসিককে লোকে মৃত্যুর পর ঘৃণা করুক।’

সাত্যকি কিছুটা আশস্তবোধ করল বরদাপ্রসাদের কথা শুনে। থানা-পুলিশের জেরা-ঝামেলায় কে আর জড়াতে চায়! সে বলল ‘আপনি যে সত্যটা গোপন করার চেষ্টা করছেন তা আমি কিছুটা অনুমান করলেও সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়।’

তার কথার জবাবে বরদাপ্রসাদ বললেন, ‘রাত শেষ হতে এখনও অনেকটা সময় বাকি। চলুন আমরা একটা ঘরে বসে কথা বলি। ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে আপনার কাছে।’

রান্নাঘরের কাছ থেকে ফিরে সাত্যকিরা গিয়ে ঢুকল সেই ঘরে যেখানে সাত্যকির রাত্রিবাসের ব্যবস্থা হয়েছিল। দুজনে খাটে বসার পর একটু চুপ করে থেকে বরদাপ্রসাদ তার কথা শুরু করলেন—’রসিকের মুখে আপনি শুনেচেন যে আমি এখানকার এক সময়ের জমিদার মহাপ্রসাদের বংশধর। তিনি আমার ঊর্ধ্বতন পঞ্চম পুরুষ ছিলেন। তবে আসার সময়, যুবা বয়সে জমিদারির কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না এখানকার পোড়ো জমিদার বাড়ি আর এই বাগানবাড়ি ছাড়া। এ তল্লাট ছেড়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে আসি যৌবনে কলকাতা পাড়ি দেই। টাকা-কড়ি-ধনদৌলত পূর্বপুরুষদের থেকে কিছু না পেলেও উত্তরাধীকার সূত্রে একটা জিনিস রক্তের মধ্যে পেয়েছিলাম। তা হল জুয়া-ঘোড়দৌড় এসবের নেশা। বনেদি পরিবারের সন্তান রসিকের শুধু ভ্রমণ আর খাবার চাখার নেশাই ছিলো না, জুয়ার নেশাও ছিল। কলকাতার চীনা পাড়াতে এক জুয়ার আড্ডাতে আমাদের প্রথম পরিচয় হয়। দুজনের ধমনিতেই অভিজাত পরিবারের রক্ত তাই হয়তো অচিরে আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বর সম্পর্ক তৈরি হয়।’—একথা বলে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন বরদাপ্রসাদ। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘একদিন রসিক আমাকে বলল ‘চলো আমি তোমাদের পুরানো জমিদারি দেখতে যাব।’ তার কথামতো তাকে নিয়ে আমি একদিন এখানে এবাড়িতে এসে উপস্থিত হলাম। কদিন ধরে আমরা গল্পগুজব করে কাটাচ্ছিলাম। সে আমাকে নানা দেশ ভ্রমণের, নানা খাবারের গল্গ করত, আর আমি বলতাম এ জায়গার কথা। তখন বর্ষাকাল। সেদিন সকাল থেকেই মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। লণ্ঠনের আলোতে সন্ধ্যেবেলা গল্প করতে বসে আমি তাকে কথা প্রসঙ্গে বললাম, ‘আমার পূর্বপুরুষের ‘মহাপ্রসাদ’ নামের পিছনে একটা গল্প আছে। এ জমিদারির আমল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহাপ্রসাদের পিতা কালীকিঙ্কর। যৌবনে তিনি ডাকাত ছিলেন এবং সেই অর্থে তিনি জমিদারি কেনেন। কিন্তু দীর্ঘদিন কালিকিঙ্করের মহান কোনো সন্তান হচ্ছিল না তখন কালীকিঙ্কর সন্তান লাভের বায়নাতে দেবী কালীর কাছে নরবলি দিয়ে নরমাংস অর্থাৎ মহাপ্রসাদ উৎসর্গ করেন। আর তা খেয়ে দেবী সন্তুষ্ট হন আর তার আশীর্বাদে কালীকিঙ্করের পুত্র লাভ হয়। সে জন্য তিনি ছেলের নাম রাখেন মহাপ্রসাদ। একথা বলে আমি রসিককে মজার ছলেই বললাম, ‘তুমি এত ধরনের মাংস খেয়েছ কিন্তু মহাপ্রসাদ খেয়েছ কি? শুনেছি মানুষের মাংস নাকি সব থেকে সুস্বাদু হয়!’ আমার কথা শুনে রসিক বলল ‘আমিও তাই শুনেছি। কিন্তু খাবার সুযোগ ঘটেনি।’

তার কথা শুনে আমি তাকে মজার ছলে বললাম। ‘আমি সে সুযোগ তোমাকে করে দিতে পারি। কাছেই দ্বারকার চরে আমাদের পূর্বপুরুষদের একটা শ্মশান আছে। গ্রামের গরিবগুর্ব মানুষরা সেখানে মড়া পোড়াতে আসে। বর্ষাকালে অনেক সময় চিতা নিভে যায়। সৎকার সম্পূর্ণ না করেই ফিরে যায় শববাহকরা সেই নিভে যাওয়া চিতার মাংস টানাটানি করে শিয়ালের দল। দু-এক টুকরো তুমিও পেয়ে যেতে পারো। কথাটা শুনে রসিক বলল ‘তাই নাকি! আজ বিকালেইতো বাড়ির সামনে দিয়ে হরিধ্বনি দিতে দিতে কারা যেন মরদেহ নিয়ে গেল শুনলাম। তার পরই তো বৃষ্টি নামল। একবার দেখা যেতে পারে কিছু পাই কিনা?’ সত্যি কথা বলতে কী আমি আর রসিক তখন মদ্যপান করছিলাম। আমি ভাবলাম যে মদের ঘোরে কথাটা বলছে। যে যে সত্যি নরমাংস মুখে দিতে পারবে তা আমি বিশ্বাস করিনি। যাদের জুয়ার নেশা থাকে তাদের বাজি ধরারও অভ্যাস থাকে। আমি তাকে বললাম ‘তোমার সাথে একশো টাকা বাজি রইল, ও মাংস তুমি মুখে তুলতে পারবে না।’

রসিক বলল ‘চলো তবে দেখা যাক কে বাজি জেতে।’—এ পর্যন্ত বলে আবার থামলেন বরদাপ্রসাদ।

সাত্যকি জানতে চাইল ‘তারপর?’

বরদা বলতে শুরু করলেন, ‘আমরা তখন দুজনেই নেশার ঘোরে আছি। বাকি ধরার পরই ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে রওনা হলাম শ্মশানের দিকে। সে রাত আমার এখনও মনে আছে। টিপ টিপ করে তখনও বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশে চাঁদ থাকলেও তা মাঝে মাঝে ঢেকে যাচ্ছে চাঁদের আলোতে। শ্মশানে গিয়ে পৌঁছলাম আমরা। হয়তো একেই বলে নিয়তি। নির্জন শ্মশানে বৃষ্টিতে নিভে যাওয়া চিতায় একটা দেহের কিছু অংশ তখনও পড়েছিল। রসিক গিয়ে দাঁড়াল সেই চিতার সামনে। তারপর সেই দেহ থেকে একখণ্ড মাংস তুলে নিয়ে সোজা চালান করে দিল নিজের মুখে! সত্যি কথা বলতে কী, যৌবনে আমার সাহসও কম ছিল না, আমার দেহেও খুনে-ডাকাত কালীকিঙ্করের রক্ত আছে। কিন্তু বিশ্বাস করবেন না সে দৃশ্য দেখে আমিও আতঙ্কে শিউরে উঠলাম! রসিক চিবিয়ে চলেছে নরমাংস—মহাপ্রসাদ!

একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে আমরা দুজন এরপর বাড়ি ফিরলাম। সেদিন আর দুজনের মধ্যে কোনো কথা হল না। পরদিন সকালে উঠেই রসিক কেমন যেন ভুলভাল বকতে শুরু করল। নানা অসংলগ্ন কথাবার্তা। আমি অনুমান করলাম নেশার ঘোরে যে মানুষের মাংস খেলেও ব্যাপারটা তার মনে গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, তার মানসিক ভারসাম্যে আঘাত হেনেছে। যাই হোক দিন পাঁচেক পর সে আবার স্বাভাবিক হল। এবার আমাদের কলকাতায় ফিরতে হবে। কিন্তু রসিক বলল এই ভয়ংকর ঘটনার অভিঘাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। আমি যেন কলকাতা ফিরি ঠিক সময় সে ফিরবে। তার কথা শুনে আমি কলকাতায় ফিরলাম। কিন্তু সাত দিন গেল, পনেরো দিন গেল রসিক আর ফিরল না। দিন কুড়ি পর আমি আবার উপস্থিত হলাম ওখানে। দেখলাম রসিক এখানে দিব্যি আছে। তবে সে আমাকে এক অদ্ভুত ব্যাপার জানালো। সে বলল, সে এখানে বেশ কয়েক মাস থেকে যেতে চায়। সারা পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে যে ক্লান্ত। এই খোলা জল হাওয়াতে তার শরীর মন চাঙ্গা হবে। আমি আপত্তি করলাম না। এখানেই থাকতে শুরু করল সে। আমি মাঝে মাঝে এসে তার সাথে দেখা করে যেতাম, দু-এক দিন থেকে যেতাম এখানে। কিন্তু এভাবে মাস পাঁচেক চলার পরই রসিকের এখানে থাকার আসল কারণ, আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।’—কথাগুলো একটানা বলে থামলেন বরদাপ্রসাদ।

বাইরে থেকে আবার শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। রসিকলালের ছবিটা হাতে ধরে খাটে বসে মনোযোগ দিয়ে বরদাপ্রসাদের বলা অদ্ভুত কাহিনি শুনে চলেছে সাত্যকি। শিয়ালের ডাক আসার পর কাহিনির অন্তিম পর্ব শুরু করার আছে সাত্যকির হাতের ছুরিটার দিকে তাকিয়ে বরদা মৃদু হেসে বললেন, ‘ছুরিটা আপনি হাত থেকে পাশে নামিয়ে রাখতে পারেন। রসিক এখন মৃত। মৃত মানুষ কাউকে আক্রমণ করতে পারে না।’ তার কথা শুনে সাত্যকি মৃদু লজ্জা পেয়ে ছুরিটা খাটের একপাশে ছুড়ে ফেলে বলল—’আবার শুরু করুন।’ বরদাপ্রসাদ শুরু করলেন—’হ্যাঁ, যা বলতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই আমার কাছে একদিন রসিকের এখানে থাকার স্পষ্ট হয়ে গেল। এখন শীতকাল এখানে এসে দু-রাত কাটাচ্ছি আমি। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল আমার। কোথায় যেন একটা শব্দ হল। ঘরের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি সন্তর্পণে সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে রসিক। তার হাতে একটা ছোটো ব্যাগ। প্রচণ্ড কৌতূহল হল আমার মনে। আমিও এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার অলক্ষে অনুসরণ করলাম তাকে। সে সোজা গিয়ে উপস্থিত হল দ্বারকার চরে শ্মশানে। আমি পুরানো কালী মন্দিরের আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম তাকে। না সেদিন কোনো চিতা জ্বলছিল না। রসিক দ্বারকার চরে প্রথমে কিসের যেন খোঁজ করতে লাগল। তারপর এক জায়গায় বসে পড়ে সে তার সঙ্গের থলে থেকে ছুরি বার করে বালি মাটি খুঁড়তে লাগল। মাটির নীচ থেকে এরপর সে যা টেনে ওঠালো তা দেখে হাড় হীম হয়ে গেল আমার। শ্মশানেতো শুধু মৃতদেহই পোড়ানো হয় না, পাঁচ বয়সি পর্যন্ত বাচ্চাদের মৃতদেহ না পুড়িয়ে তা মাটিতে পুতে দেবারই নিয়ম। খেয়াল হল সকাল বেলাতেই এ বাড়ির সামনে দিয়ে পুঁটুলি বাঁধা বাচ্চার মৃতদেহ নিয়ে যেতে দেখেছিলাম কয়েকজনকে। আমার অনুমান সত্যি করে রসিক টেনে বার করল তেমনই এক শিশুর দেহ! তার শরীর থেকে একটা হাত ছিড়ে, ব্যাগে পুরে, বাকি দেহটাকে আবার মাটি চাপা দিয়ে ফেরার পথ ধরল রসিক। পরদিন আমি আর রসিক মুখোমুখি বসলাম। রসিক ব্যাপারটা স্বীকার করে বলল, তার পক্ষে আর ফেরা সম্ভব নয়। সে এখানেই থাকবে। তারপর থেকে এখানেই এত বছর রয়ে গেল সে।

এই হাড় হীম করা কাহিনি শুনে সাত্যকি বলে উঠল, ‘আপনি এই ভয়ংকর অভ্যাস থেকে ওকে নিরস্ত করেননি কেন? আপনার এ বাড়িতে ওকে থাকতে দিয়েছিলেন কেন?

প্রশ্ন শুনে দৌড় ভদ্রলোক কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে থাকার পর বললেন, ‘আমি প্রথমে ওকে বাঁধা দেবার চেষ্টা করেছিলাম। সে সময় জুয়াতে হেরে আমার বাজারে প্রচুর ধার হয়েছিল, সংসার চালানোও দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। রসিক যখন আমাকে বলল যে এখানে অজ্ঞাতবাসে থাকতে দেওয়ার বিনিময় সে আমার ধার পরিশোধ করবে আর ভবিষ্যতে আমার সংসার প্রতিপালনের দায়িত্ব নেবে তখন আমি আর তার প্রস্তাবে না করতে পারিনি। মিথ্যা বলব না, রসিক সে দায়িত্ব পালন করেছে। আমার পরিবার আজ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত। আমিও সেখানেই থাকি। তবে গত তিন চার মাস ধরে কাছেই একটা বাড়িতে এসে মাঝে মাঝে থেকে যাই রসিককে দেখাশোনার জন্য।’

এ কথা বলার পর একটু থেমে বরদাপ্রসাদ বললেন, ‘রসিককে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে অন্য একটা অসুবিধাও ছিল। লোকে বলে, কেউ যদি একবার এই মহাপ্রসাদ খাওয়া শুরু করে তার তা না পেলে নাকি পাগল হয়ে যায়। কথাটা মনে হয় সত্যি। ওই শ্মশান গত তিন চার বছর ধরে প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। সবাই অন্য শ্মাশানে ইলেকট্রিক চুল্লিতে শব দাহ করতে যায়। বাচ্চাদের দেহও কেউ কবর দিতে আসে না বললেই চলে। একবারতো দীর্ঘদিন ও মাংস খেতে না পেরে রসিক প্রায় সম্পূর্ণ পাগল হয়ে গেছিল। এক গ্রামবাসীকে বাড়িতে ডেকে ছুরি দিয়ে তার মাংস কাটতে চেয়েছিল! ঠিক যেভাবে আপনার হাত কাটতে চেয়েছিল। সেই লোকটা অবশ্য তাকে আক্রমণ করার আসল কারণ বুঝতে পারেনি। ওই সময় রসিককে বেশ কয়েকমাস একটা মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে, অ্যাসাইলামেও রাখতে হয় অন্য নাম পরিচয় দিয়ে। যেখান থেকে সুস্থ হয়ে ফেরে সে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে আবার তার নরমাংসর স্পৃহা মাথা চাড়া দিচ্ছিল।’

সাত্যকি কথাগুলো শুনে বলল, ‘বরাতজোরে আমি বেঁচে গেলাম আমার ঘুম ভেঙে গেল বেল! তা ছাড়া আপনিও এসে ঠিক সে সময় উপস্থিত হলেন। তবে আমার ধারণা তিনি আমার ফলের রসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিলেন আমাকে ঘুম পাড়াবার জন্য। নইলে কখনোই অমনভাবে আমার চোখ জড়িয়ে আসত না!’

বরদা বলল ‘হ্যাঁ, বরাতজোরে আপনার ক্ষতি হয়নি। আমি কলকাতা যাবার জন্য বাস স্ট্যান্ডে গেলাম। কিন্তু যে বাসে যাবার কথা সে বাস খারাপ হয়ে গেছে, মেরামতি হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর জানলাম সকাল আটটার আগে বাস চালু হবে না। বাড়ি ফিরে এলাম আমি। কিন্তু রাত্রে ঘুম আসছিল না। হঠাৎই আমার এ বাড়িতে আপনাকে দেখার কথা মনে পড়ল। আর সেই সাথে একটা আশঙ্কাও দানা বাধতে শুরু করল আমার মনে। কোনো কারণে আপনি এ বাড়িতে রাত্রিবাস করবেন নাতো? রসিক আপনাকে আক্রমণ করবে নাতো? শেষপর্যন্ত আমি আর শুয়ে থাকতে না পেড়ে বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে এলাম। দরজার সামনে এসেই শুনতে পেলাম বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ। তবে রসিকের কাছে আর একটা মাত্রই ঘুমের ওষুধ অবশিষ্ট ছিল, তা ছাড়া আপনার তরুণ বয়স। রক্তর জোর বেশি। না হলে হয়তো দুর্ঘটনাটা ঘটে যেত।’

সাত্যকির কাছে এবার সম্পূর্ণ ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল। সত্যি ভাগ্যক্রমে বড়ো বিপদ থেকে যে রক্ষা পেয়েছে। ঘড়ি দেখল সাত্যকি। আর ঘণ্টাখানেক বাদে ভোরের আলো ফুটবে। সে, বরদাপ্রসাদকে বলল, ‘আপনাকে ধন্যবাদ। ভোরের আলো ফুটলেই আমি এ জায়গা ছাড়ব।’

বরদা বললেন, ‘আপনি কি কাগজের অফিস বা অন্য কোথাও জানিয়েছেন যে আপনি এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন ও রসিকলালের সাথে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে?’

সাত্যকি বলল ‘না জানাইনি। ভেবেছিলাম কাজ হাসিল হলে জানাব।’

বরদাপ্রসাদ বললেন ‘রসিক আপনাকে যে খামটা দিয়েছিল সেটা কিন্তু খুলে দেখা প্রয়োজন। রসিকের মাথার ঠিক ছিল না। ও এমন কিছু লেখেনিতো যার ফলে ভবিষ্যতে আপনার আমার বিপদ হতে পারে? তা ছাড়া ওই খাম অন্যর হাতে পড়লে কিন্তু আত্মহত্যার দিন এখানে আপনার উপস্থিতি প্রমাণ হবে। বলাতো যায় না, কোথা থেকে কোন বিপদ নেমে আসে মানুষের ওপর!’

কথাটা ভুল বলেননি বরদাপ্রসাদ। তাই মাটিতে পড়ে থাকা ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে তার থেকে খামটা বার করল সাত্যকি। একটু ইতস্তত করে শেষপর্যন্ত খামের মুখটা ছিড়তেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এল হাতে লেখা চার পাতা কাগজ আর একটা ব্যাঙ্কের চেক বইয়ের পাতা। লেখা পাতাগুলোর একবার চোখ বোলাল সাত্যকি।

লেখার শিরোনাম—’মহাপ্রসাদ।’ পাতাগুলোতে লেখা আছে নরমাংসর বিভিন্ন রেসিপি! কোনো সুস্থ মানুষেরা পক্ষে এসব লেখা সম্ভব নয়। আর পত্রিকাতেও এ লেখা ছাপানো কোনো সম্পাদকের পক্ষেই সম্ভব নয়। ছাপালে নির্ঘাত জেল হবে। সাত্যকি দেখল চেকের পাতায় তার নাম লেখা, আর চেকের মূল্য তিন লাখ! কাগজ আর ব্যাঙ্ক চেকটা দেখার পর সাত্যকি সেগুলো তুলে দিল বরদা প্রসাদের হাতে।

তিনি সেগুলো দেখার পর, বিশেষত চেকের পাতাটা দেখার পর বিষণ্ণ হেসে বলল ‘রসিককে কিন্তু অবিবেচক বলা যাবে না। আপনাকেও মারতে চায়নি। বাম হাতের কটা আঙুলের জন্য সাধ্যমতো ক্ষতিপূরণেরও ব্যবস্থা করেছিল। তবে আমার ধারণা শরীর ও মনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ও আজ রাতেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নইলে মানুষের মাংসর রেসিপি ও তা খাওয়ার অভিজ্ঞতা লিখে কেউ তা অন্যর হাতে তুলে দেয় না। মৃত্যুর আগে যে শেষ বারের মতো পেতে চেয়েছিল মহাপ্রসাদের আস্বাদ।’

সাত্যকি বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়। কারণ ছুরি হাতে আমার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, আমার খাবার আর যাবার, দুটোরই প্রস্তুতি মারা। সম্ভবত যাবার জন্য তিনি রান্নাঘরের কড়িবরগা থেকে দড়িটা আগেই ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। ওই জন্য অত দ্রুত কাজটা করতে পারলেন।’

বরদাপ্রসাদ বললেন, ‘আশা করি এই লেখাগুলো আপনি আর সম্পাদকের হাতে তুলে দেবেন না, আর চেষ্টাও ভাঙাবেন না। তবে এগুলো নষ্ট করি?’

সাত্যকি বলল ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই করুন।

বরদাপ্রসাদ পকেট থেকে সিগারেট ধরাবার লাইটার বার করে কাগজগুলোতে আগুন ধরালেন। সাত্যকির চোখের সামনে ছাই হয়ে গেল চেকের পাতা আর বিখ্যাত খাদ্য রসিক, রসিকলালের শেষ লেখা। জিনিসগুলো ছাই হয়ে যাওয়াতে সাত্যকি আর বরদাপ্রসাদ দুজনেই যেন স্বস্তি পেল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল তারা। এক সময় বরদা বললেন, ‘চারটে বাজে। এবার ভোরের আলো ফুটবে। চলুন এবার আপনাকে বাইরে পৌঁছে দেই। হাঁটা শুরু করলে বাস স্ট্যান্ডে যাবার জন্য একটা কিছু পেয়ে যাবেন।’

সাত্যকি তার ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল ‘হ্যাঁ, চলুন। এ বাড়ির বাইরে যত তাড়াতাড়ি বেরোতে পারি। দূরে চলে যেতে পারি ততই ভালো।’

বরদাপ্রসাদ খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সাত্যকি এরপর পা বাড়াল দরজার দিকে। ঠিক এই মুহূর্তে বরদাপ্রসাদ খাট থেকে তুলে নিলেন ধারালো ভারী চপারটা। তারপর সেটা দিয়ে পিছন থেকে সজোরে আঘাত হানল সাত্যকির ঘাড়ে! মাটিতে ছিটকে পড়ল সাত্যকির দেহ। মাটিতে পড়ে কিছুক্ষণ ছটফট করে নিথর হয়ে গেল সাত্যকি। ধর থেকে মুণ্ডু প্রায় বিছিন্ন হয়ে যায় সাত্যকির রক্তস্নাত শরীরটার দিকে তাকিয়ে বরদাপ্রসাদ অদ্ভুত হেসে বললেন, ‘আমার কাহিনির একটা ভাষা শুধু আপনাকে বলা হয়নি। শুধু জুয়ার নেশা নয়, মহাপ্রসাদ খাওয়ার নেশা মনে হয় আমার রক্তেও ছিল উত্তরাধীকার সূত্রে। কালীকিঙ্কর শুধু মা-কালীকেই নরমাংস নিবেদন করেননি। তিনি নিজেও সেই মাংস ভক্ষণ করেছিলেন বলে শোনা যায়। হ্যাঁ, নিশ্চই আমার রক্তের মধ্যে লুকিয়েছিল ব্যাপারটা। নইলে আমিই বা কেন একদিন রসিকের অনুরোধে সব ভয়, ঘেন্নাকে ভুলে গিয়ে মহাপ্রসাদের স্বাদ গ্রহণ করলাম!’

বাইরে কোথায় যেন শেষবারের মতো শিয়ালের দল ডেকে উঠল। বরদাপ্রসাদ সগোতক্তির স্বরে বললেন—’আলো ফোটার আগেই দেহটা তুলে নিয়ে গিয়ে পোড়ো জমিদার বাড়িতে লুকিয়ে ফেলতে হবে। শিয়ালের দল তোরাও ভাগ পাবি। তবে রসিক যদি বেঁচে থাকত তবে দুই বন্ধু মিলে নানা পদ রান্না করে খাওয়া যেত। তবে স্যুপ রান্নাটা আমি জানি, রোস্টটাও পারি। একবার যে এই মাংস মুখে তুলেছে সেই শুধু জানে এ মাংসর স্বাদ কেমন, মানুষকে যা পাগল করে তোলে! সত্যিই এ মাংস মহাপ্রসাদ!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *