1 of 2

কেয়ারটেকার

কেয়ারটেকার

পরেশ ক’দিন থেকে লক্ষ করছে হলঘরের উত্তর দিকের দেয়ালে যেন নোনা ধরেছে। ছোপ ছোপ অসুস্থ ফুলের মতো একরাশি দাগ দেয়ালে ভেসে উঠেছে। হয়তো আরও অনেক দাগ বিশাল পেন্টিং-এর নীচে চাপা পড়ে আছে। মৃগাঙ্কভূষণ রায় ছড়ি হাতে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন। ছবি বলেই হাসিটা অক্ষয় হয়ে আছে। সাহেব আর্টিস্টকে পঞ্চাশ বছর আগে এই ভাবে হাসি হাসি মুখেই সিটিং দিয়েছিলেন। এই ঘরেই তখন তার হাসির সময়। সারা সংসার তখন তাঁর সঙ্গে হাসছে। তাঁর বিশাল চা বাগান সেই সময় দার্জিলিং হিলসের গা বেয়ে থাকে থাকে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে। অর্থ, সম্পদ, প্রতিপত্তির উপর একটা পা তুলে দিয়ে তিনি তখন হাসছেন।

পরেশ সারা হলঘরের ধুলো ঝাড়তে পারে। ফ্ল্যানেল দিয়ে পিতলের কারুকাজ করা ফুলদানি, ছবির ফ্রেম চকচকে করতে পারে। ফেদার ডাস্টার দিয়ে গ্র্যান্ড পিয়ানোর উপর থেকে। পাউডারের সূক্ষ্ম প্রলেপের মতো ধুলো উড়িয়ে দিতে পারে। মৃগাঙ্কভূষণের শুভ্র দাঁত থেকে ঝুল সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু পঙ্খের কাজ করা উত্তরের দেয়াল থেকে বিশ্রী ছোপ কী করে সরাবে! যা ভিতর থেকে আসছে, অনবরত আসছে তাকে সে আটকায় কী করে! অল্প অল্প চুন গুড়ো হয়ে পুরু কার্পেটের উপর ঝরে পড়ছে। দেয়ালের ওই নোনা ছোপ পরেশের মনে তার নিজের পিঠ বেয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠে আসছে।

বয়স যখন তার পনেরো তখন থেকে সে এ বাড়িতে আছে। এখন পঁয়ষট্টি। যখন এসেছিলেন তখন তার নিজের জীবনে সকাল, এই সংসারের মধ্যাহ্ন। এরপর সে গোধূলি দেখেছে। রাত্রি এসেছে, পায়ে পায়ে। এখন বোধহয় মধ্যরাত। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘোরানো সিঁড়ির নীচে, কিংবা মালপত্র রাখার খুপরি ঘর থেকে প্রহরে শেয়াল ডাকছে। শহর কলকাতায় শেয়াল? না। শেয়াল তার মনে! এই বাড়িতে তার সুদীর্ঘ জীবনে সে অনেক শেয়ালের রজনী দেখেছে। সাদা। উর্দি পরে রঙিন গেলাসে রঙিন পানীয় পরিবেশন করতে করতে তার মনে হয়েছে সারসের ভোজ সভায় শেয়ালের বোকামি।

পুবের জানালা খুলে দিলে, সকালের রোদ কার্পেটে লুটিয়ে পড়ে উত্তরের দিকে কিছুটা গড়িয়ে আসে, তারপর চেয়ার আর পায়ায় জড়াজড়ি হয়ে একটা লোমশ বুড়ো কুকুরের মতো কার্পেটের উপর কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে চলে যায়। শেষ বেলার পশ্চিমের জানলা খুললে একটু রোদের জলাশয় তৈরি হয়। পুরোনো কার্পেট থেকে বয়সের গন্ধ ওঠে। কিছুটা রোদ খাওয়াতে পারলে যৌবন হয়তো ফিরে আসত। দেয়ালের ক্ষয় হয়তো আটকানো যেত।

ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে পরেশ মাঝে মাঝে বসে পড়ে। আগেকার মতো এক দমে কাজ করতে পারে না। অবশ্য কাজের আর আছে কী? এক সময় ছিল যখন এ বাড়িতে নিশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যেত না, আর এখন? এখন কাজ খুঁজে বের করতে হয়। পরেশ কাঁধের ঝাড়ন সোফার হাতলে নামিয়ে রাখল। মনে পড়ল আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এই চেয়ারে বাংলার লাটসাহেব বসেছিলেন আর ওই উলটো দিকেরটায় বসেছিলেন মৃগাঙ্কভূষণ। সারা ঘরে লোক থইথই করছে। মাথার উপর সবক’টা ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে। কী সব জমকালো পোশাক, সুগন্ধ। দিদিমণির বয়স তখন কত হবে? পরেশ মনে মনে হিসেব করল আঠারো থেকে কুড়ির মধ্যে। একেবারে সাদা পোশাক পরে ওই পিয়ানো বাজিয়ে দিদিমণি গান গেয়েছিলেন সে রাতে।

ঘরের কোণে গ্র্যান্ডফাদার ঘড়িটা মিঠে সুরে একবার বাজল। পরেশ অতীত থেকে বর্তমানে। ফিরে এল। সামনের দিকে তাকাল, তার দৃষ্টি হলঘর থেকে গড়িয়ে কার্পেট বেয়ে দরজা পেরিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি বেয়ে একটা বাঁক উঠলেই পরেশ দোতলায় উঠে যেত। টানা মার্বেল পাথর বাঁধানো চওড়া ঢাকা-বারান্দা পুব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। মেহগনি কাঠের বড় বড় দরজা লাগানো সারি সারি ঘর। একেবারে শেষের ঘরে এই বাড়ির শেষ উত্তরাধিকারিণী এখনও। বিছানায়। বিশাল খাটের তুলনায়, খাটো শরীর। কোঁচকানো চাদরের সমুদ্রে মোচার খোলা। মৃগাঙ্কভূষণের একমাত্র মেয়ে পদ্মিনী। পরেশ পদ্মিনীর কথা ভেবে একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। মা মরা মেয়েকে পরেশই মানুষ করেছে। কার্পেট মোড়া সিঁড়ি দিয়ে মৃগাঙ্কভূষণকে মধ্যরাতে শোবার ঘরে তুলে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জুতো খুলে দিয়ে, আলো নিভিয়ে দরজা ভেজিয়ে পরেশ দৌড়ে আসত পদ্মর ঘরে। কোনওদিন। দেখত ফুলের মতো ঘুমোচ্ছে, কোনওদিন দেখত জানালার কাছে চেয়ারে বসে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে আছে।

সেই পদ্ম আজ প্রৌঢ়া। বাতে পঙ্গু! বিছানা আর ঘর এরই মধ্যে জগৎ সীমাবদ্ধ। সাড়ে আটটা ন’টার মধ্যে পরেশ এক গেলাস গরম জল, চা আর হট ব্যাগ নিয়ে উপরে উঠবে। সাবধানে দরজা খুলে ট্রেটা টিপয়ের উপর রেখে, একটা ওয়াশ স্ট্যান্ড বিছানার কাছে টেনে আনবে। কোনও কোনও দিন কার্পেটের উপর থেকে গড়িয়ে যাওয়া কাচের গেলাস তুলে রাখতে হয়। শেষ পেগ এক চুমুকে শেষ করে পদ্মিনী এইভাবেই গেলাস ছুড়ে ফেলে দেয়। পদ্মিনী উঠবে।

কোনওদিন এক ডাকে। কোনওদিন ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে না। তখন পরেশ হাতির দাঁতের একটা পেপার কাটার নিয়ে পায়ের তলায় বারকতক সুড়সুড়ি দেয়। মোমের মতো পা আপেলের মতো রক্তাভ গোড়ালি।

বিছানায় বসে ওয়াশ স্ট্যান্ডে মুখ ধোবেন পদ্মিনী। তারপর এক কাপ চা খাবেন, লেবু আর অ্যাসপিরিন দিয়ে। টকটকে মুখে অসম্ভব খাড়া একটা নাক। টানা টানা প্রতিমার মতো চোখ, অসম্ভব একটা ব্যক্তিত্ব। পরেশ মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে পদ্মিনী যখন ছোট, যখন একসঙ্গে দুজনে খেলা করত তখন দুজনের মধ্যে ব্যক্তিত্বের এই ব্যবধান ছিল না। তারপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লাল রক্ত যখন নীল হয়ে আসতে লাগল, পরেশ আর তখন খেলার সাথী নয়। সম্পর্ক তখন প্রভু-ভৃত্যের।

পরেশ পেছন ফিরে তাকাল, মৃগাঙ্কভূষণ হাসছেন। পরেশ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। হাসিটা যেন নীরব ভৎসনা, যে সোফায় লাট-বেলাট বসতেন, যে সোফায় স্বাধীন ভারতের যত ভাগ্যবিধাতারা বসে গেছেন, সেই সোফায় পরেশ তুই! সাম্যবাদের চূড়ান্ত হয়ে গেল যে! এতটা কি ভালো! পদ্মিনী যখন চলতে ফিরতে পারতেন তখনও পরেশ কোনওদিন সোফায় বসার সাহস পেত না। কার্পেটে বসে হুকুম শুনত। ইদানীং সে নির্ভয়। বয়স আর অত্যাচার আর নীল রক্তের অভিশাপ তার শেষ প্রভুকে শক্ত দুটো হাতে যেন পাকিয়ে দিয়েছে। শেষ কতবছর আগে দৃপ্তভঙ্গিতে ওই সিঁড়ি দিয়ে পদ্মিনী ঘুরে ঘুরে পায়ে পায়ে নেমে এসেছে তার মনে নেই। এই ঘর সোফা এই কার্পেট এই আয়োজনের মধ্যে গত পঞ্চাশ বছর ঘুরতে ঘুরতে পরেশ মাঝে মাঝে নিজেকে প্রভু ভেবে ফেলে; কিন্তু সে সাময়িক, কোথা থেকে সেই পঞ্চাশ বছরের ভৃত্য এসে কান ধরে তাকে প্রভুর আসন থেকে তুলে দেয়।

হলঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে পরেশ দরজার কাছে এসে একবার থমকে দাঁড়াল। দরজার পাশে সেই ছবিটা। আর এক মৃগাঙ্কভূষণ। ১৯৪৭ সালের মৃগাঙ্কভূষণ! জনপ্রতিনিধি! মন্ত্রী মৃগাঙ্কভূষণ। উলটোদিকের দেয়ালের অয়েল পেন্টিংয়ের হাসি মুখে নেই। গম্ভীর সৌম্য মুখ। ব্রত উদযাপনের সংকল্প মুখে। পরেশ যেন অজস্র কণ্ঠের জয়ধ্বনি শুনতে পেল, অজস্র হাতের তালি। মৃগাঙ্কভুষণ আজ থেকে ২৮ বছর আগে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন যে বক্তৃতাকে উচ্ছ্বাস জানিয়ে একমাঠ মানুষ উল্লাসে উদ্দীপনায় ফেটে পড়েছিল, শব্দতরঙ্গে কান পাতলে পরেশ যেন এখনও স্পষ্ট শুনতে পায় জলোচ্ছ্বাসের কলরবের মতো। পরেশ কাঁধের ঝাড়ন নামিয়ে ছবির ফ্রেম আর কাচটা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দিল। সংসারে মৃগাঙ্কভূষণ এতবড় একটা উপস্থিতি ছিলেন যে তাঁর অনুপস্থিতিটা যেন মেনে নেওয়া যায় না, ফুলের গন্ধের মতো হাওয়ায় ভাসে, ছায়ার মতো লুটিয়ে থাকে। পরেশ বাড়ির কয়েকটা জায়গায় গেলে এখনও যেন চমকে ওঠে। মনে হয় আরশির সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছেন। টেবিলে বসে লিখছেন। কলমের ঠান্ডা শরীরে এখনও হাতের গরম। বাথরুম বন্ধ থাকলে মনে হয়, শাওয়ার খুলে স্নান করছেন। ওয়াশ-বেসিনের কাছে খাবার পর সামনে ঈষৎ ঝুঁকে উপরের পাটির বাঁধানো দাঁত পরিষ্কার করে চট করে মুখে পুরে দিচ্ছেন। খুট করে দাঁত সেট হয়ে যাবার শব্দ যেন এই মাত্র বেসিনের কাছ থেকে ভেসে এল। শোয়ার ঘরে গেলে মনে হয়, বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছেন বিশাল বুকের উপর আড়াআড়ি দুটো হাত, একটা পায়ের পাতার সঙ্গে আর একটা পায়ের পাতা জড়ানো। পরেশের জীবনে মৃগাঙ্কভূষণের পঞ্চাশ বছরের অস্তিত্ব যেন মুছে ফেলা যায় না। ফুলদানির ফুলের মতো মনের কোণে প্রতিষ্ঠিত।

কেটলিতে চায়ের পাতা ভেজালেই জলের ভাপের সঙ্গে দার্জিলিং চায়ের গন্ধ পরেশের নাকে এসে লাগে। এই গন্ধটা যেন পরেশের বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সাঁকো। জলে চা ভেজে। অতীতে পরেশের বর্তমান ভেজে। যে রাতে মৃগাঙ্কভূষণ শহরে ভুখা মিছিলের উপর গুলি চালাবার নির্দেশ দিলেন সে রাতের কথা পরেশ কোনওদিন ভুলতে পারবে না। সারা শহরে সান্ধ্য আইন। রাত প্রায় বারোটার সময় মৃগাঙ্কভূষণের বিশাল কালো গাড়ি এসে ঢুকল। ক্লান্ত মৃগাঙ্ক সিঁড়ির হাতল ধরে ধরে উপরে উঠে গেলেন। কিছুই খেলেন না সেই রাতে। ইদানীং পান করতেন না। সেদিন আবার দীর্ঘ কয়েক বছর পরে, বোতল আর গেলাসের খবর পড়ল। পরেশ সারা রাত বসে রইল ঘরের বাইরে। সারা রাত মৃগাঙ্ক পান করলেন। শেষ রাতে পরেশ শুনতে পেল মৃগাঙ্ক নিজের সঙ্গে কথা বলছেন, নিজেকে তিরষ্কার করছেন, কাকে যেন বোঝাতে চাইছেন, মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলছেন ষড়যন্ত্র।

মৃগাঙ্কর রাজনৈতিক জীবনের চাকা সেই রাত থেকেই যেন ঘুরে গেল। মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, আত্মবিশ্বাস খুলে পড়ে গেল। দীর্ঘ সময় উদাস দৃষ্টি মেলে ডেকচেয়ারে শুয়ে থাকতেন। দেখে মনে হত গতিশীল প্রচণ্ড একটা ইঞ্জিন যেন ক্রমশ স্তব্ধ হয়ে আসছে।

এর পরই সেই দিন, মৃগাঙ্ক নির্বাচনে হেরে গেলেন। যে কেন্দ্র থেকে তিনি এতকাল হাজার হাজার ভোটে জিতেছেন সেই কেন্দ্রে তাঁর হার হল খুবই অল্প ভোটে। তাঁর দল ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সারা শহর উল্লাসে, বাজি পুড়িয়ে চিৎকার করে মিছিল বের করে পুরোনো দিন, পুরোনো। নেতৃত্বকে বিদায় জানাল। মৃগাঙ্কভূষণ সে রাতে, খুব অল্প আহার করলেন, দু-চারটে লিখলেন, ডায়েরি লিখলেন, ফোনে অল্প দু-একজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর মাথার কাছে আলো জ্বেলে শুয়ে ছবির বই উলটোলেন। পরেশের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পও করলেন। সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, একেবারে সাধারণ মানুষ। ঘাটের অন্ধকার কোণে বাঁধা ডিঙি নৌকোর মতো স্থির, কর্মহীন।

অতবড় বিশাল মানুষটি, পরেশের চোখের সামনে দেখতে দেখতে কেমন বিবর্ণ, চাকচিক্যহীন হয়ে গেলেন। শীতের ডালের শুকনো পাতার মতো। কালো রঙের বিশাল গাড়ির পরিবর্তে এল ছোটো অস্টিন। গাড়িটা প্রায়ই গ্যারেজে পড়ে থাকত। আগে বাড়ি সবসময় গুণগ্রাহী, স্তাবক, পার্টির দলবলে জমজমাট থাকত। দেখতে দেখতে তারা কপূরের মতো উবে গেল। গোটাচারেক টেলিফোন মিনিটে মিনিটে বেজে উঠত। তারাও নীরব হয়ে গেল।

আগে প্রায় প্রতিদিনই গোটাকতক সভা সমিতিতে হয় প্রধান অতিথি না হয় সভাপতি হতে হত। ব্যস্ত ডায়েরির পাতা উলটে সময় দিতে হত। বহু জায়গায় দুঃখ জানিয়ে প্রত্যাখান পত্র পাঠাতে হত কিংবা বাণী পাঠিয়ে কাজ সারতে হত। ক্ষমতাচ্যুত হবার পর ব্যস্ততা নিমেষে কমে গেল। শেষে বহুদিন পরে কারা যেন একবার এসেছিলেন, শিশুউদ্যানের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ধরে নিয়ে যাবার জন্য। মৃগাঙ্কভূষণ হেসেছিলেন। করুণ হাসি। পরেশকে বলেছিলেন, তলোয়ারে মরচে পড়ে গেলে শিশুদের খেলার জিনিস হয়ে দাঁড়ায়।

দল ভাঙা কিছু প্রবীণ একবার এসেছিলেন, দল গড়ে নতুন স্বপ্ন দেখার প্রস্তাব নিয়ে। শীতের রোদে পিঠ রেখে লনে বসে সেই বৃদ্ধ শার্দুলের দল মৃগাঙ্কভূষণকে ঘণ্টাখানেক ধরে উত্যক্ত করে চলে গিয়েছিলেন। নতুন দলের উদীয়মান নেতারাও একবার এসেছিলেন তাঁদের নতুন দলে

আসবার প্রস্তাব নিয়ে। মৃগাঙ্কভূষণ রাজি হননি। বলেছিলেন, মোমবাতির পরমায়ু শেষ হয়ে। গেছে। নতুন রোশনাই আর সম্ভব হবে না। মৃগাঙ্কভূষণ নেতা ছিলেন না। দাপট ছিল, লোভ ছিল না।

পরেশ সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠেছে। হাতে ট্রে, গরমজল, লেবু, হট ব্যাগ। দশ বছর আগের সকাল আর আজকের সকালে অনেক তফাত। আগে জীবনের দিনগুলো লেবুর কোয়ার মতো টেনে টেনে ছাড়াতে হত।

বারান্দার একপাশে টবের পামগাছের পাতায় ধুলো জমেছে। সারি সারি ছবির কোনও কোনওটা কাত হয়ে আছে। আগে এরকম থাকত না। একটা হুক খালি। একটা ছবি ছিল এখন আর নেই। এই বাড়ির একমাত্র জামাই, পদ্মিনীর স্বামীর ছবি ছিল ওই হুকে।

দিদিমণির বিয়ে হয়েছিল। দু-বছরের বৈবাহিক জীবন ভুল বোঝাবুঝিতে শেষ হয়ে গেল। রাজনীতির হাওয়ায় প্রেম বোধহয় এমনি করেই শুকিয়ে যায়। জীবন থাকে ঠিকই তবে বিবর্ণ ঘাসের মতো। পদ্মিনী শুধু মৃগাঙ্কভূষণের মেয়ে ছিলেন না, প্রাইভেট সেক্রেটারিও ছিলেন। হয়তো এমন আশাও ছিল রাজনীতির মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলোর সামনে এসে একদিন দাঁড়াবেন। স্বপ্ন অনেকটা ঘুণ ধরা বাঁশের মতো, গুঁড়ো গুঁড়ো পাউডারের মতো নিঃশব্দে ঝরে যেতে থাকলে কিছুতেই থামানো যায় না।

বারান্দা ধরে এগিয়ে চলেছে পরেশ ধীর পায়ে। বাঁ দিকে ঘাড় ফেরালেই পরেশ দেখতে পাচ্ছে সবুজ লন। লনটা এখনও সবুজ আছে। আগের মতো তেমন মনে করে ছাঁটা না হলেও একেবারে

খাপছাড়া হয়ে যায়নি! মৃগাঙ্কভূষণের জীবনের শেষ দিনগুলো এই লনেই কেটেছে। লনের দিকে তাকালে পরেশ যেন এখনও দেখতে পায়, মৃগাঙ্কভূষণ ছড়ি হাতে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। চওড়া কাঁধে ঝুলছে ঢলঢল পাঞ্জাবি। বিশাল শরীরের কাঠামোটা ঠিকই ছিল, তেমনি ঋজু, সরল, উদ্বৃত্ত মাংস আর মেদ ঝরে গিয়েছিল। যখন হাঁটতেন, পা একটু টেনে টেনে ফেলতেন। আর্থারাইটিস। পদ্মিনী তাঁর একমাত্র বংশধর। উত্তরাধিকারিণী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *