কুম্ভকর্ণের ঘুম
সাংঘাতিক ঘুম-কাতুরে কাউকে অনেক চেষ্টা করে সহজে জাগাতে না পারলে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয় সাধারণভাবে। আবার কেউ যদি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে রাখে এবং দীর্ঘসময় পর বুঝতে পেরে তৎপর হয়ে ওঠে তবে বলা হয়ে থাকে— ‘কুম্ভকর্ণের নিদ্রা ভঙ্গ হলো।’
বিশ্রবা মুনির ঔরসে রাক্ষসরাজ সুমালীর কন্যা কৈকসীর (নিকষা) গর্ভে জন্ম হয় রাবণ, কুম্ভকর্ণ, শূর্পণখা ও বিভীষণের। জন্মগ্রহণের পরপরই প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত কুম্ভকর্ণ সহস্র প্রজা ভক্ষণ করে ফেলেন। এজন্য দেবরাজ ইন্দ্ৰ তাকে বজ্রাঘাত করেন। অত্যন্ত দীর্ঘ, মহাবলশালী ও দুর্দান্ত প্রকৃতির ছিলেন কুম্ভকৰ্ণ।
ভাইদের সাথে মিলিত হয়ে কুম্ভকর্ণ গোকর্ণ আশ্রমে উগ্র তপস্যা করে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করেন এবং অমরত্বের বর চান। এখানে উল্লেখ্য যে, গোকর্ণ তীর্থ মালবদেশের প্রান্তসীমায় (অবন্তিদেশ বা আধুনিক মালওয়া) অবস্থিত। যাহোক, ব্ৰহ্মা কুম্ভকর্ণকে বর দিতে উদ্যত হচ্ছেন, এমন সময় দেবতারা ভীত হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মাও কৌশলে অদৃশ্য হন কুম্ভকর্ণকে বর না দিয়েই।
দেবতারা ব্রহ্মাকে জানান যে, কুম্ভকর্ণ সাতজন অপ্সরা, ইন্দ্রের দশজন অনুচর এবং অনেক ঋষি ও মানুষের প্রাণনাশ (ভক্ষণ) করেছেন। ব্রহ্মার কাছে অমরত্বের বর পেলে কুম্ভকর্ণ ত্রিভুবন গ্রাস করবেন। আবার অন্যদিকে কুম্ভকর্ণের কঠোর তপস্যায় পৃথিবী এমন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যেন আগুনে পুড়ে সমস্ত পৃথিবী ভস্ম হয়ে যাবে। ব্রহ্মা পড়লেন উভয় সঙ্কটে।
অনেক ভেবেচিন্তে ব্রহ্মা তার স্ত্রী সরস্বতীকে কুম্ভকর্ণের কণ্ঠে স্থান গ্রহণ করতে বললেন। সেইসাথে ব্রহ্মা সরস্বতীকে একথাও বললেন যে, কুম্ভকৰ্ণ আবার যখন বর প্রার্থনা করবেন তখন যেন সরস্বতীই কুম্ভকর্ণের কথা পরিবর্তন করে সুবিধামতো উত্তর দেন। তারপর ব্রহ্মা একসময় কুম্ভকর্ণের প্রার্থনা জানতে চান। কুম্ভকর্ণের সরস্বতী-নিয়ন্ত্রিত কণ্ঠ হতে উত্তর আসে—’অনন্ত জীবনের পরিবর্তে অনন্ত নিদ্ৰা চাই।’ ব্রহ্মা খুশি হয়ে সেই বর দিয়ে দিলেন কুম্ভকর্ণকে। অতঃপর অদৃশ্য হলেন তিনি।
ব্রহ্মা চলে যাবার পর হঠাৎ এক সময় চৈতন্য লাভ হলো কুম্ভকর্ণের। বুঝতে পারলেন দেবদেবীর চালাকি। কিন্তু কী আর করা যায়। আবার ব্রহ্মার কাছে দেন-দরবার, অনুনয়-বিনয়। আবার সেই সরস্বতীচালিত কণ্ঠের প্রার্থনা—’আমি যেন ছয়মাস কাল একটানা নিদ্রাসুখ ভোগ করে একদিন মাত্র ভোজন করতে পারি।’ ব্রহ্মা সঙ্গে সঙ্গে তথাস্তু বলে আরো বললেন— ‘কিন্তু যদি কেউ অকালে তোমার নিদ্রাভঙ্গ করে, তা হলে তোমার নিশ্চিত মরণ।
কুম্ভকর্ণ ফিরে গেলেন লঙ্কায়। তার বিয়ে হলো দৈত্যরাজ বলির দৌহিত্রী বজ্রজ্বালার সাথে। উল্লেখ্য যে, অসুর সম্রাট হিরণ্যকশিপু হলেন কশ্যপ-দিতির পুত্র। হিরণ্যকশিপু ও তার স্ত্রী কয়াধুর পুত্র ভক্ত প্রহলাদ। প্রহ্লাদপুত্ৰ বিরোচন। বিরোচন-সুরুচির পুত্র বলি। রাবণ বজ্রজ্বালাকে হরণ করে কুম্ভকর্ণের সাথে তার বিয়ে দেন। কুম্ভকর্ণের জন্য রাবণ দুই যোজন লম্বা ও এক যোজন চওড়া বিচিত্র ভবন তৈরি করে দেন। ছয় মাস পর নিদ্রাভঙ্গের পরবর্তী খানাপিনার আয়োজনও তেমনি জাঁকজমকপূর্ণ রাখা হয়। যোজনের পরিমাণ বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রকম থাকলেও সাধারণ হিসেবে কুম্ভকর্ণের ঘুমের ভবন ছিল লম্বায় প্রায় ৩২ মাইল এবং প্রস্থে প্রায় ১৬ মাইল।
রাম-রাবণের যুদ্ধে একে একে লঙ্কার বীরদের নিহত হবার কারণে প্রায় সেনাপতিশূন্য হয়ে পড়েছিল রাবণ-বাহিনী। অনন্যোপায় রাবণ দুর্দান্ত বীর কুম্ভকর্ণকে যুদ্ধে পাঠাতে মনস্থির করলেন। অসংখ্য অনুচর ও হাতি পাঠিয়ে বহু চেষ্টার পর অসময়ে ঘুম ভাঙ্গানো হলো কুম্ভকর্ণের। অকালে ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য তিনি বড় ভাই রাবণকে তিরস্কার করলেও সসৈন্যে রামের বিরুদ্ধে বীরদর্পে যুদ্ধযাত্রা করেন। রামের বাহিনীকে রীতিমতো বিপর্যস্ত করে অবশেষে রামের নিক্ষিপ্ত বায়ব্যাস্ত্র, ঐন্দ্রাস্ত্র ও অর্ধচন্দ্র বাণে নিহত হলেন কুম্ভকৰ্ণ।
কুম্ভকর্ণ শক্তিমান বীর ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার ঘুমের কারণে অন্তর্নিহিত শক্তি প্রায় অকেজো হয়েছিল। এজন্য কোনো মানুষ কাজের উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও যখন অযথা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থেকে নিষ্কর্মা হয়ে থাকে অথবা তাকে সহসা জাগানো যায় না, সে ক্ষেত্রে আমরা কুম্ভকর্ণের ঘুম প্রবাদটি প্রযুক্ত করে থাকি।