কালিদাস একান্তই সৌন্দর্যসম্ভোগের কবি, এ মত লোকের মধ্যে প্রচলিত। সেইজন্য লৌকিক গল্পে-গুজবে কালিদাসের চরিত্র কলঙ্কে মাখানো। এই গল্পগুলি জনসাধারণ-কর্তৃক কালিদাসের কাব্য সমালোচনা। ইহা হইতে বুঝা যাইবে, জনসাধারণের প্রতি আর যে কোনো বিষয়ে আস্থা স্থাপন করা যাক, সাহিত্যবিচার সম্বন্ধে সেই অন্ধের উপরে অন্ধ নির্ভর করা চলে না।
মহাভারতে যে-একটা বিপুল কর্মের আন্দোলন দেখা যায় তাহার মধ্যে একটি বৃহৎ বৈরাগ্য স্থির অনিমেষভাবে রহিয়াছে। মহাভারতের কর্মেই কর্মের চরম প্রাপ্তি নহে। তাহার সমস্ত শৌর্যবীর্য, রাগদ্বেষ, হিংসা-প্রতিহিংসা, প্রয়াস ও সিদ্ধির মাঝখানে শ্মশান হইতে মহাপ্রস্থানের ভৈরবসংগীত বাজিয়া উঠিতেছে। রামায়ণেও তাহাই; পরিপূর্ণ আয়োজন ব্যর্থ হইয়া যায়, করায়ত্ত সিদ্ধি স্খলিত হইয়া পড়ে– সকলেরই পরিণামে পরিত্যাগ। অথচ এই ত্যাগে দুঃখে নিস্ফলতাতেই কর্মের মহত্ত্ব ও পৌরুষের প্রভাব রজতগিরির ন্যায় উজ্জ্বল অভ্রভেদী হইয়া উঠিয়াছে।
সেইরূপ কালিদাসের সৌন্দর্যচাঞ্চল্যের মাঝখানে ভোগবৈরাগ্য স্তব্ধ হইয়া আছে। মহাভারতকে যেমন একই কালে কর্ম ও বৈরাগ্যের কাব্য বলা যায়, তেমনি কালিদাসকেও একই কালে সৌন্দর্যভোগের এবং ভোগবিরতির কবি বলা যাইতে পারে। তাঁহার কাব্য সৌন্দর্যবিলাসেই শেষ হইয়া যায় না; তাহাকে অতিক্রম করিয়া তবে কবি ক্ষান্ত হইয়াছেন।
কালিদাস কোথায় থামিয়াছেন এবং কোথায় থামেন নাই, সেইটে এখনকার আদর্শের সহিত তুলনা করিয়া আলোচনা করিবার বিষয়। পথের কোনো-একটা অংশে থামিয়া তাঁহাকে বিচার করা যায় না, তাঁহার গম্যস্থান কোথায় তাহা দেখিতে হইবে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ধীবরের হাত হইতে আংটি পাইয়া যেখানে দুষ্মন্ত আপনার ভ্রম বুঝিতে পারিয়াছেন, সেইখানে ব্যর্থ পরিতাপের মধ্যে য়ুরোপীয় কবি শকুন্তলা নাটকের যবনিকা ফেলিতেন। শেষ অঙ্কে স্বর্গ হইতে ফিরিবার পথে দৈবক্রমে দুষ্মন্তের সহিত শকুন্তলার যে মিলন হইয়াছে তাহা য়ুরোপের নাট্যরীতি-অনুসারে অবশ্য ঘটনীয় নহে। কারণ, শকুন্তলা নাটকের আরম্ভে যে বীজবপন হইয়াছে এই বিচ্ছেদই তাহার চরম ফল। তাহার পরেও দুষ্মন্ত-শকুন্তলার পুনর্মিলন বাহ্য উপায়ে দৈবানুগ্রহে ঘটাইয়া তুলিতে হইয়াছে। নাটকের অন্তর্গত কোনো ঘটনাসূত্রে, দুষ্মন্ত-শকুন্তলার কোনো ব্যবহারে, এ মিলন ঘটিবার কোনো পথ ছিল না।
তেমনি, এখনকার কবি কুমারসম্ভবে হতমনোরথ পার্বতীর দুঃখ ও লজ্জার মধ্যে কাব্য শেষ করিতেন। অকালবসন্তে রক্তবর্ণ অশোককুঞ্জে মদনমথনের দীপ্ত দেবরোষাগ্নিচ্ছটায় নতমুখী লজ্জারুণা গিরিরাজকন্যা তাঁহার সমস্ত ব্যর্থ পুষ্পাভরণ বহিয়া পাঠকের ব্যথিত হৃদয়ের করুণ রক্তপদ্মের উপর আসিয়া দাঁড়াইতেন, অকৃতার্থ প্রেমের বেদনা তাঁহাকে চিরকালের জন্য ঘেরিয়া থাকিত। এখনকার সমালোচকের মতে এইখানেই কাব্যের উজ্জ্বলতম সূর্যাস্ত, তাহার পরে বিবাহের রাত্রি অত্যন্ত বর্ণচ্ছটাহীন।
বিবাহ প্রাত্যহিক সংসারের ভূমিকা; তাহা নিয়মবদ্ধ সমাজের অঙ্গ। বিবাহ এমন একটি পথ নির্দেশ করে যাহার লক্ষ্য একমাত্র ও সরল এবং যাহাতে প্রবল প্রবৃত্তি দস্যুতা করিতে প্রবল নিষেধ প্রাপ্ত হয়। সেইজন্য এখনকার কবিরা বিবাহব্যাপারকে তাঁহাদের কাব্যে বড়ো করিয়া দেখাইতে চান না। যে প্রেম উদ্দামবেগে নরনারীকে তাহার চারি দিকের সহস্র বন্ধন হইতে মুক্ত করিয়া দেয়, তাহাদিগকে সংসারের চিরকালের অভ্যস্ত পথ হইতে বাহির করিয়া লইয়া যায়, যে প্রেমের বলে নরনারী মনে করে তাহারা আপনাতেই আপনারা সম্পূর্ণ, মনে করে যে যদি সমস্ত সংসার বিমুখ হয় তবু তাহাদের ভয় নাই, অভাব নাই, যে প্রেমের উত্তেজনায় তাহারা ঘূর্ণবেগে বিচ্ছন্ন-বিক্ষিপ্ত গ্রহের মতো তাহাদের চারি দিক হইতে স্বতন্ত্র হইয়া নিজেদের মধ্যেই নিবিড় হইয়া উঠে, সেই প্রেমই প্রধানরূপে কাব্যের বিষয়।
কালিদাস অনাহূত প্রেমের সেই উন্মত্ত সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করেন নাই, তাহাকে তরুণলাবণ্যের উজ্জ্বল রঙেই আঁকিয়া তুলিয়াছেন। কিন্তু এই অত্যুজ্জ্বলতার মধ্যেই তিনি তাঁহার কাব্যকে শেষ করেন নাই। যে প্রশান্ত বিরলবর্ণ পরিণামের দিকে তিনি কাব্যকে লইয়া গিয়াছেন, সেইখানেই তাঁহার কাব্যের চরম কথা। মহাভারতের সমস্ত কর্ম যেমন মহাপ্রস্থানে শেষ হইয়াছে, তেমনি কুমারসম্ভবের সমস্ত প্রেমের বেগ মঙ্গলমিলনেই পরিসমাপ্ত।
কুমারসম্ভব এবং শকুন্তলাকে একত্র তুলনা না করিয়া থাকা যায় না। দুটিরই কাব্যবিষয় নিগূঢ়ভাবে এক। দুই কাব্যেই মদন যে মিলন সংসাধন করিতে চেষ্টা করিয়াছে তাহাতে দৈবশাপ লাগিয়াছে, সে মিলন অসম্পন্ন অসম্পূর্ণ হইয়া আপনার বিচিত্রকারুখচিত পরমসুন্দর বাসরশয্যার মধ্যে দৈবাহত হইয়া মরিয়াছে। তাহার পরে কঠিন দুঃখ ও দুঃসহ বিরহব্রত-দ্বারা যে মিলন সম্পন্ন হইয়াছে তাহার প্রকৃতি অন্যরূপ– তাহা সৌন্দর্যের সমস্ত বাহ্যাবরণ পরিত্যাগ করিয়া বিরলনির্মল বেশে কল্যাণের শুভ্রদীপ্তিতে কমনীয় হইয়া উঠিয়াছে।
স্পর্ধিত মদন যে মিলনের কর্তৃত্বভার লইয়াছিল তাহার আয়োজন প্রচুর। সমাজবেষ্টনের বাহিরে দুই তপোবনের মধ্যে অহেতুক আকস্মিক নবপ্রেমকে কবি যেমন কৌশলে তেমনি সমারোহে সুন্দর অবকাশ দান করিয়াছেন।
যতি কৃত্তিবাস তখন হিমালয়ের প্রস্থে বসিয়া তপস্যা করিতেছিলেন। শীতল বায়ু মৃগনাভির গন্ধ ও কিন্নরের গীতধ্বনি বহন করিয়া গঙ্গাপ্রবাহসিঞ্চিত দেবদারুশ্রেণীকে আন্দোলিত করিতেছিল। সেখানে হঠাৎ অকালবসন্তের সমাগম হইতেই দক্ষিণদিগ্ বধূ সদ্যঃপুস্পিত অশোকের নবপল্লবজাল মর্মরিত করিয়া আতপ্ত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। ভ্রমরযুগল এক কুসুমপ্রাত্রে মধু খাইতে লাগিল এবং কৃষ্ণসার মৃগ স্পর্শনিমীলিতাক্ষী হরিণীর গাত্র শৃঙ্গদ্বারা ঘর্ষণ করিল।
তপোবনে বসন্তসমাগম! তপস্যার সুকঠোর নিয়মসংযমের কঠিন বেষ্টন-মধ্যে হঠাৎ প্রকৃতির আত্মস্বরূপবিস্তার! প্রমোদবনের মধ্যে বসন্তের বাসন্তিকতা এমন আশ্চর্যরূপে দেখা দেয় না।
মহর্ষি কন্বের মালিনীতীরবর্তী আশ্রমেও এইরূপ। সেখানে হুত হোমের ধূমে তপোবনতরুর পল্লবসকল বিবর্ণ, সেখানে জলাশয়ের পথসকল মুনিদের সিক্তবল্কলক্ষরিত জলরেখায় অঙ্কিত এবং সেখানে বিশ্বস্ত মৃগসকল রথচক্রধ্বনি ও জ্যানির্ঘোষকে নির্ভয় কৌতূহলের সহিত শুনিতেছে। কিন্তু সেখান হইতেও প্রকৃতি দূরে পলায়ন করে নাই, সেখানেও কখন রুক্ষ বল্কলের নীচে হইতে শকুন্তলার নবযৌবন অলক্ষ্যে উদ্ভিন্ন হইয়া দৃঢ়পিনদ্ধ বন্ধনকে চারি দিক হইতে ঠেলিতেছিল। সেখানেও বায়ুকম্পিত পল্লবাঙ্গুলি-দ্বারা চ্যূতবৃক্ষ যে সংকেত করে তাহা সামমন্ত্রের সম্পূর্ণ অনুগত নহে এবং নবকুসুমযৌবনা নবমালিকা সহকারতরুকে বেষ্টন করিয়া প্রিয়মিলনের ঔৎসুক্য প্রচার করে।
চারি দিকে অকালবসন্তের অজস্র সমারোহ, তাহারই মাঝখানে গিরিরাজনন্দিনী কী মোহনবেশেই দেখা দিলেন। অশোক কর্ণিকারের পুষ্পভূষণে তিনি সজ্জিতা, অঙ্গে বালারুণবর্ণের বসন, কেসরমালার কাঞ্চী পুনঃপুনঃ স্রস্ত হইয়া পড়িতেছে, আর ভয়চঞ্চললোচনা গৌরী ক্ষণে ক্ষণে লীলাপদ্ম সঞ্চালন করিয়া দুরন্ত ভ্রমরগণকে নিবারণ করিতেছেন।
অন্য দিকে দেবদারুদ্রুমবেদিকার উপরে শার্দূলচর্মাসনে ধূর্জটি ভুজঙ্গপাশবদ্ধ জটাকলাপ এবং গ্রন্থিযুক্ত কৃষ্ণমৃগচর্ম ধারণ করিয়া ধ্যানস্তিমিতলোচনে অনুত্তরঙ্গ সমুদ্রের মতো আপনাকে আপনি নিরীক্ষণ করিতেছিলেন।
অস্থানে অকালবসন্তে মদন এই দুই বিসদৃশ পুরুষ-রমণীর মধ্যে মিলনসাধনের জন্য উদ্যত ছিলেন।
কণ্বাশ্রমেও সেইরূপ। কোথায় বল্কলবসনা তাপসকন্যা এবং কোথায় সসাগরা ধরণীর চক্রবর্তী অধীশ্বর! দেশ কাল পাত্রকে মুহূর্তের মধ্যে এমন করিয়া যে বিপর্যস্ত করিয়া দেয়, সেই মীনকেতনের যে কী শক্তি কালিদাস তাহা দেখাইয়াছেন।
কিন্তু কবি সেইখানেই থামেন নাই। এই শক্তির কাছেই তিনি তাঁহার কাব্যের সমস্ত রাজকর নিঃশেষ করিয়া দেন নাই। তিনি যেমন ইহার হঠাৎ জয়সংবাদ আনিয়াছেন তেমনি অন্য দুর্জয় শক্তি-দ্বারা পূর্ণতর চরম মিলন ঘটাইয়া তবে কাব্য বন্ধ করিয়াছেন। স্বর্গের দেবরাজের দ্বারা উৎসাহিত এবং বসন্তের মোহিনী শক্তির দ্বারা সহায়বান্ মদনকে কেবলমাত্র পরাস্ত করিয়া ছাড়েন নাই, তাহার স্থলে যাহাকে জয়ী করিয়াছেন তাহার সজ্জা নাই, সহায় নাই, তাহা তপস্যায় কৃশ, দুঃখে মলিন। স্বর্গের দেবরাজ তাহার কথা চিন্তাও করেন নাই।
যে প্রেমের কোনো বন্ধন নাই, কোনো নিয়ম নাই, যাহা অকস্মাৎ নরনারীকে অভিভূত করিয়া সংযমদুর্গের ভগ্নপ্রাকারের উপর আপনার জয়ধ্বজা নিখাত করে, কালিদাস তাহার শক্তি স্বীকার করিয়াছেন, কিন্তু তাহার কাছে আত্মসমর্পণ করেন নাই। তিনি দেখাইয়াছেন, যে অন্ধ প্রেমসম্ভোগ আমাদিগকে স্বাধিকারপ্রমত্ত করে তাহা ভর্তৃশাপের দ্বারা খণ্ডিত,ঋষিশাপের দ্বারা প্রতিহত ও দেবরোষের দ্বারা ভস্মসাৎ হইয়া থাকে। শকুন্তলার কাছে যখন আতিথ্যধর্ম কিছুই নহে, দুষ্মন্তই সমস্ত, তখন শকুন্তলার সে প্রেমে আর কল্যাণ রহিল না। যে উন্মত্ত প্রেম প্রিয়জনকে ছাড়া আর সমস্তই বিস্মৃত হয় তাহা সমস্ত বিশ্বনীতিকে আপনার প্রতিকূল করিয়া তোলে, সেইজন্যই সে প্রেম অল্প দিনের মধ্যেই দুর্ভর হইয়া উঠে, সকলের বিরুদ্ধে আপনাকে আপনি সে আর বহন করিয়া উঠিতে পারে না। যে আত্মসংবৃত প্রেম সমস্ত সংসারের অনুকূল, যাহা আপনার চারি দিকের ছোটো এবং বড়ো, আত্মীয় এবং পর, কাহাকেও ভোলে না, যাহা প্রিয়জনকে কেন্দ্রস্থলে রাখিয়া বিশ্বপরিধির মধ্যে নিজের মঙ্গলমাধুর্য বিকীর্ণ করে, তাহার ধ্রুবত্বে দেবে মানবে কেহ আঘাত করে না, আঘাত করিলেও সে তাহাতে বিচলিত হয় না। কিন্তু যাহা যতির তপোবনে তপোভঙ্গরূপে, গৃহীর গৃহপ্রাঙ্গণে সংসারধর্মের অকস্মাৎ পরাভবস্বরূপে আবির্ভূত হয়, তাহা ঝঞ্ঝার মতো অন্যকে নষ্ট করে বটে, কিন্তু নিজের বিনাশকেও নিজেই বহন করিয়া আনে।
পর্যাপ্তযৌবনপুঞ্জে অবনমিতা উমা সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতার ন্যায় আসিয়া গিরিশের পদপ্রান্তে লুণ্ঠিত হইয়া প্রমাণ করিলেন, তাঁহার কর্ণ হইতে পল্লব এবং অলক হইতে নবকর্ণিকার বিচ্যুত হইয়া পড়িয়া গেল। মন্দাকিনীর জলে যে পদ্ম ফুটিত, সেই পদ্মের বীজ রৌদ্রকিরণে শুষ্ক করিয়া নিজের হাতে গৌরী যে জপমালা গাঁথিয়াছিলেন সেই মালা তিনি তাঁহার তাম্ররুচি করে সন্ন্যাসীর হস্তে সমর্পণ করিলেন। হাতে হাতে ঠেকিয়া গেল। বিচলিতচিত্ত যোগী একবার উমার মুখে, উমার বিম্বাধরে তাঁহার তিন নেত্রকেই ব্যাপৃত করিয়া দিলেন। উমার শরীর তখন পুলকাকুল, দুই চক্ষু লজ্জায় পর্যস্ত এবং মুখ এক দিকে সাচীকৃত।
কিন্তু অপূর্ব সৌন্দর্যে অকস্মাৎ উদ্ভাসমান এই-যে হর্ষ দেবতা ইহাকে বিশ্বাস করিলেন না, সরোষে ইহাকে প্রত্যাখ্যান করিলেন। নিজের ললিতযৌবনের সৌন্দর্য অপমানিত হইল জানিয়া লজ্জাকুন্ঠিতা রমণী কোনোমতে গৃহে ফিরিয়া গেলেন।
কণ্বদুহিতাকেও একদিন তাঁহার যৌবনলাবণ্যের সমস্ত ঐশ্বর্যসম্পদ লইয়া অপমানিত হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। দুর্বাসার শাপ কবির রূপকমাত্র। দুষ্মন্ত-শকুন্তলার বন্ধহীন গোপন মিলন চিরকালের অভিশাপে অভিশপ্ত। উন্মত্ততার উজ্জ্বল উন্মেষ ক্ষণকালের জন্যই হয়; তাহার পরে অবসাদের, অপমানের, বিস্মৃতির অন্ধকার আসিয়া আক্রমণ করে। ইহা চিরকালের বিধান। কালে কালে দেশে দেশে অপমানিতা নারী “ব্যর্থং সমর্থ্য ললিতং বপুরাত্মনশ্চ’ আপনার ললিত দেহকান্তিকে ব্যর্থ জ্ঞান করিয়া, “শূন্যা জগাম ভবনাভিমুখী কথঞ্চিৎ’ শূন্যহৃদয়ে কোনোক্রমে গৃহের দিকে ফিরিয়াছে। ললিত দেহের সৌন্দর্যই নারীর পরম গৌরব, চরম সৌন্দর্য নাহে।
সেইজন্যই “নিনিন্দ রূপং হৃদয়েন পার্বতী’, পার্বতী রূপকে মনে মনে নিন্দা করিলেন। এবং “ইয়েষ সা কর্তুমবন্ধ্যরূপতাম্’, তিনি আপনারা রূপকে সফল করিতে ইচ্ছা করিলেন। রূপকে সফল করিতে হয় কী করিয়া? সাজে সজ্জায় বসনে অলংকারে? সে পরীক্ষা তো ব্যর্থ হইয়া গেছে।–
ইয়েষ সা কর্তুমবন্ধ্যরূপতাং
সমাধিমাস্থায় তপোভিরাত্মনঃ।
তিনি তপস্যাদ্বারা নিজের রূপকে অবন্ধ্য করিতে ইচ্ছা করিলেন। এবারে গৌরী তরুণার্করক্তিম বসনে শরীর মণ্ডিত করিলেন না, কর্ণে চুতপল্লব এবং অলকে নবকর্ণিকার পরিলেন না; তিনি কঠোর মৌঞ্জীমেখলা-দ্বারা অঙ্গে বল্কল বাঁধিলেন এবং ধ্যানাসনে বসিয়া দীর্ঘ অপাঙ্গে কালিমাপাত করিলেন। বসন্তসখা পঞ্চশর মদনকে পরিত্যাগ করিয়া কঠিন দুঃখকেই তিনি প্রেমের সহায় করিলেন।
শকুন্তলাও দিব্য আশ্রমে মদনের মাদকতাগ্লানিকে দুঃখতাপে দগ্ধ করিয়া কল্যাণী তাপসীর বেশে সার্থক প্রেমের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
যে ত্রিলোচন বসন্তপুষ্পাভরণা গৌরীকে এক মুহূর্তে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন তিনি দিবসের শশিলেখার ন্যায় কর্শিতা শ্লথলম্বিতপিঙ্গলজটাধারিণী তপস্বিনীর নিকট সংশয়রহিত সম্পূর্ণহৃদয়ে আপনাকে সমর্পণ করিলেন। লাবণ্যপরাক্রান্ত যৌবনকে পরাকৃত করিয়া পার্বতীর নিরাভরণা মনোময়ী কান্তি অমলা জ্যোতির্লেখার মতো উদিত হইল। প্রার্থিতকে সে সৌন্দর্য বিচলিত করিল না, চরিতার্থ করিয়া দিল। তাহার মধ্যে লজ্জা-আশঙ্কা আঘাত-আলোড়ন রহিল না; সেই সৌন্দর্যের বন্ধনকে আত্মা আদরে বরণ করিল; তাহার মধ্যে নিজের পরাজয় অনুভব করিল না।
এতদিন পরে–
ধর্মেণাপি পদং শর্বে
কারিতে পার্বতীং প্রতি।
পূর্বাপরাধভীতস্য
কামস্যোচ্ছ্বসিতং মনঃ॥
ধর্ম যখন মহাদেবের মনকে পাবর্তীর অভিমুখে আকর্ষণ করিলেন, তখন পূর্বাপরাধভীত কামের মন আশ্বাসে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল।
ধর্ম যেখানে দুই হৃদয়কে একত্র করে, সেখানে মদনের সহিত কাহারো কোনো বিরোধ নাই। সে যখন ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বাধাইতে চায়, তখনি বিপ্লব উপস্থিত হয়, তখনি প্রেমের মধ্যে ধ্রুবত্ব এবং সৌন্দর্যের মধ্যে শান্তি থাকে না। কিন্তু ধর্মের অধীনে তাহার যে নির্দিষ্ট স্থান আছে সেখান সেও পরিপূর্ণতার একটি অঙ্গস্বরূপ, সেখানে থাকিয়া সে সুষমা ভঙ্গ করে না। কারণ, ধর্মের অর্থই সামঞ্জস্য; এই সামঞ্জস্য সৌন্দর্যকেও রক্ষা করে, মঙ্গলকেও রক্ষা করে এবং সৌন্দর্য ও মঙ্গলকে অভেদ করিয়া উভয়কে একটি আনন্দময় সম্পূর্ণতা দান করে। সৌন্দর্য যেখানে ইন্দ্রিয়কে ছাড়াইয়া ভাবের মধ্যে গিয়া প্রবেশ করে সেখানে বাহ্যসৌন্দর্যের বিধান তাহাতে আর খাটে না। সেখানে তাহার আর ভূষণের প্রয়োজন কী? প্রেমের মন্ত্রবলে মন যে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে তাহাকে বাহ্যসৌন্দর্যের নিয়মে বিচার করাই চলে না। শিবের ন্যায় তপস্বী, গৌরীর ন্যায় কিশোরীর সঙ্গে বাহ্যসৌন্দর্যের নিয়মে ঠিক যেন সংগত হইতে পারেন না। শিব নিজেই ছদ্মবেশে সে কথা তপস্যারতা উমাকে জানাইয়াছেন। উমা উত্তর দিয়াছেন “মমাত্র ভাবৈকরসং মনঃ স্থিতম্’, আমার মন তাঁহাতেই ভাবৈকরস হইয়া অবস্থিতি করিতেছে। এ যে রস, এ ভাবের রস; সুতরাং ইহাতে আর কথা চলিতে পারে না। মন এখানে বাহিরের উপরে জয়ী; সে নিজের আনন্দকে নিজে সৃষ্টি করিতেছে। শম্ভুও একদিন বাহ্যসৌন্দর্যকে প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন; কিন্তু প্রেমের দৃষ্টি, মঙ্গলের দৃষ্টি, ধর্মের দৃষ্টির দ্বারা যে সৌন্দর্য দেখিলেন, তাহা তপস্যাকৃশ ও আভরণহীন হইলেও তাঁহাকে জয় করিল। কারণ, সে জয়ে তাঁহার নিজের মনই সহায়তা করিয়াছে, মনের কর্তৃত্ব তাহাতে নষ্ট হয় নাই।
ধর্ম যখন তাপস তপস্বিনীর মিলনসাধন করিল তখন স্বর্গমর্ত এই প্রেমের সাক্ষী ও সহায়-রূপে অবতীর্ণ হইল; এই প্রেমের আহ্বান সপ্তর্ষিবৃন্দকে স্পর্শ করিল; এই প্রেমের উৎসব লোকলোকান্তরে ব্যাপ্ত হইল। ইহার মধ্যে কোনো গূঢ় চক্রান্ত, অকালে বসন্তের আবির্ভাব ও গোপনে মদনের শরপাতন রহিল না। ইহার যে অম্লানমঙ্গলশ্রী তাহা সমস্ত সংসারের আনন্দের সামগ্রী। সমস্ত বিশ্ব এই শুভমিলনের নিমন্ত্রণে প্রসন্নমুখে যোগদান করিয়া ইহাকে সুসম্পন্ন করিয়া দিল।
সপ্তম সর্গে সেই বিশ্বব্যাপী উৎসব। এই বিবাহ-উৎসবেই কুমারসম্ভবের উপসংহার।
শান্তির মধ্যেই সৌন্দর্যের পূর্ণতা, বিরোধের মধ্যে নহে। কালিদাস তাঁহার কাব্যের রসপ্রবাহকে সেই স্বর্গমর্তব্যাপী সর্বাঙ্গসম্পন্ন শান্তির মধ্যে মিলিত করিয়া তাহাকে মহান পরিণাম দান করিয়াছেন, তাহাকে অর্ধপথে “ন যযৌ ন তস্থৌ’ করিয়া রাখিয়া দেন নাই। মাঝে তাহাকে যে একবার বিক্ষুব্ধ করিয়া দিয়াছেন সে কেবল এই পরিণত সৌন্দর্যের প্রশান্তিকে গাঢ়তর করিয়া দেখাইবার জন্য, ইহার স্থিরশুভ্র মঙ্গলমূর্তিকে বিচিত্রবেশী উদ্ভ্রান্ত সৌন্দর্যের তুলনায় উজ্জ্বল করিয়া তুলিবার জন্য।
মহেশ্বর যখন সপ্তর্ষিদের মধ্যে পতিব্রতা অরুন্ধতীকে দেখিলেন তখন তিনি পত্নীর সৌন্দর্য যে কী তাহা দেখিতে পাইলেন।
তদ্দর্শনাদভূৎ শম্ভোর্-
ভূয়ান্ দারার্থমাদরঃ।
ক্রিয়াণাং খলু ধর্ম্যাণাং
সৎপত্ন্যো মূলকারণম্॥
তাঁহাকে দেখিয়া শম্ভুর দারগ্রহণের জন্য অত্যন্ত আদর জন্মিল। সৎপত্নীই সমস্ত ধর্মকার্যের মূলকারণ। পতিব্রতার মুখচ্ছবিতে বিবাহিতা রমণীর যে গৌরবশ্রী অঙ্কিত আছে তাহা নিয়ত-আচরিত কল্যাণকর্মের স্থির সৌন্দর্য– শম্ভুর কল্পনানেত্রে সেই সৌন্দর্য যখন অরুন্ধতীর সৌম্যমূর্তি হইতে প্রতিফলিত হইয়া নববধূবেশিনী গৌরীর ললাট স্পর্শ করিল তখন শৈলসূতা যে লাবণ্য লাভ করিলেন অকালবসন্তের সমস্ত পুষ্পসম্ভার তাঁহাকে সে সৌন্দর্য দান করিতে পারে নাই।
বিবাহের দিনে গৌরী–
সা মঙ্গলস্নানবিশুদ্ধগাত্রী
গৃহীতপত্যুদ্গমনীয়বস্ত্রা।
নির্বৃত্তপর্জন্যজলাভিষেকা
প্রফুল্লকাশা বসুধের রেজে॥
মঙ্গলস্নানে নির্মলগাত্রী হইয়া যখন পতিমিলনের উপযুক্ত বসন পরিধান করিলেন তখন বর্ষার জলাভিষেকের অবসানে কাশকুসুমে প্রফুল্ল বসুধার ন্যায় বিরাজ করিতে লাগিলেন। এই-যে মঙ্গলকান্তি নির্মল শোভা, ইহার মধ্যে কী শান্তি, কী শ্রী, কী সম্পূর্ণতা! ইহার মধ্যে সমস্ত চেষ্টার অবসান, সমস্ত সজ্জার শেষ পরিণতি। ইহার মধ্যে ইন্দ্রসভার কোনো প্রয়াস নাই, মদনের কোনো মোহ নাই, বসন্তের কোনো আনুকূল্য নাই– এখন ইহা আপনার নির্মলতায় মঙ্গলতায় আপনি অক্ষুব্ধ, আপনি সম্পূর্ণ।
জননীপদ আমাদের দেশের নারীর প্রধান পদ; সন্তানের জন্ম আমাদের দেশে একটি পবিত্র মঙ্গলের ব্যাপার। সেইজন্য মনু রমণীদের সম্বন্ধে বলিয়াছেন–
প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
তাঁহারা সন্তানকে জন্ম দেন বলিয়া মহাভাগা, পূজনীয়া ও গৃহের দীপ্তিস্বরূপা। সমস্ত কুমারসম্ভব কাব্য কুমারজন্মরূপ মহৎব্যাপারের উপযুক্ত ভূমিকা। মদন গোপনে শর নিক্ষেপ করিয়া ধৈর্যবাঁধ ভাঙিয়া যে মিলন ঘটাইয়া থাকে তাহা পুত্রজন্মের যোগ্য নহে; সে মিলন পরস্পরকে কামনা করে, পুত্রকে কামনা করে না। এইজন্য কবি মদনকে ভস্মসাৎ করাইয়া গৌরীকে দিয়া তপশ্চরণ করাইয়াছেন। এইজন্য কবি প্রবৃত্তির চাঞ্চল্যস্থলে ধ্রুবনিষ্ঠার একাগ্রতা, সৌন্দর্যমোহের স্থলে কল্যাণের কমনীয়দ্যুতি এবং বসন্তবিহ্বল বনভূমির স্থলে আনন্দনিমগ্ন বিশ্বলোককে দাঁড় করাইয়াছেন, তবে কুমারজন্মের সূচনা হইয়াছে। কুমারজন্ম ব্যাপারটা কী, তাহাই বুঝাইতে কবি মদনকে দেবরোষানলে আহুতি দিয়া অনাথ রতিকে বিলাপ করাইয়াছেন।
শকুন্তলাতেও প্রথম অঙ্কে প্রেয়সীর সহিত দুষ্মন্তের ব্যর্থ প্রণয় ও শেষ অঙ্কে ভরতজননীর সঙ্গে তাঁহার সার্থক মিলন কবি অঙ্কিত করিয়াছেন।
প্রথম অঙ্ক চাঞ্চল্যে ঔজ্জ্বলে পূর্ণ; তাহাতে উদ্বেলযৌবনা ঋষিকন্যা, কৌতুকোচ্ছলিতা সখীদ্বয়, নবপুষ্পিতা বনতোষিণী,সৌরভভ্রান্ত মূঢ় ভ্রমর এবং তরু-অন্তরালবর্তী মুগ্ধ রাজা তপোবনের একটি নিভৃত প্রান্ত আশ্রয় করিয়া সৌন্দর্যমদমোদিত এক অপরূপ দৃশ্য উদ্ঘাটিত করিয়াছে। এই প্রমোদস্বর্গ হইতে দুষ্মন্তপ্রেয়সী অপমানে নির্বাসিত হইয়া গিয়াছেন, কিন্তু কল্যাণরূপিণী ভরতজননী যে দিব্যতরা তপোভূমিতে আশ্রয় লইয়াছেন সেখানকার দৃশ্য অন্যরূপ। সেখানে কিশোরী তাপসকন্যারা আলবালে জল সেচন করিতেছে না, লতাভগিনীকে স্নেহদৃষ্টিদ্বারা অভিষিক্ত করিতেছে না, কৃতকপুত্র মৃগশিশুকে নীবারমুষ্টিদ্বারা পালন করিতেছে না। সেখানে তরুলতাপুষ্পপল্লবের সমুদয় চাঞ্চল্য একটিমাত্র বালক অধিকার করিয়া বসিয়া আছে, সমস্ত বনভূমির কোল সে ভরিয়া রহিয়াছে; সেখানে সহকারশাখায় মুকুল ধরে কি না, নবমল্লিকার পুষ্পমঞ্জরী ফোটে কি না, সে কাহারো চক্ষেও পড়ে না। স্নেহব্যাকুল তাপসী মাতার দুরন্ত বালকটিকে লইয়া ব্যস্ত হইয়া রহিয়াছেন। প্রথম অঙ্কে শকুন্তলার সহিত পরিচয় হইবার পূর্বে দূর হইতে তাহার নবযৌবনের লাবণ্যলীলা দুষ্মন্তকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করিয়াছিল। শেষ অঙ্কে শকুন্তলার বালকটি শকুন্তলার সমস্ত লাবণ্যের স্থান অধিকার করিয়া লইয়া রাজার অন্তরতম হৃদয় আর্দ্র করিয়া দিল।
এমন সময়–
বসনে পরিধূসরে বসানা
নিয়মক্ষামমুখী ধৃতৈকবেণিঃ
মলিনধূসরবসনা, নিয়মচর্যায় শুষ্কমুখী, একবেণীধরা, বিরহব্রতচারিণী, শুদ্ধশীলা শকুন্তলা প্রবেশ করিলেন। এমন তপস্যার পরে অক্ষয়বরলাভ হইবে না? সুদীর্ঘব্রতচারণে প্রথম সমাগমের গ্লানি দগ্ধ হইয়া, পুত্রশোভায় পরমভূষিতা যে করুণকল্যাণচ্ছবি জননীমূর্তি বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে তাহাকে কে প্রত্যাখ্যান করিবে?
ধূর্জটির মধ্যে গৌরী কোনো অভাব, কোনো দৈন্য দেখিতে পান নাই। তিনি তাঁহাকে ভাবের চক্ষে দেখিয়াছিলেন, সে দৃষ্টিতে ধনরত্ন-রূপযৌবনের কোনো হিসাব ছিল না। শকুন্তলার প্রেম সুতীব্র অপমানের পরেও মিলনকালে দুষ্মন্তের কোনো অপরাধই লইল না, দুঃখিনীর দুই চক্ষু দিয়া কেবল জল পড়িতে লাগিল। যেখানে প্রেম নাই সেখানে অভাবের, দৈন্যের, কুরূপের সীমা নাই– যেখানে প্রেম নাই সেখানে পদে পদে অপরাধ। গৌরীর প্রেম যেমন নিজের সৌন্দর্যে সম্পদে সন্ন্যাসীকে সুন্দর ও ঈশ্বর করিয়া দেখিয়াছিল, শকুন্তলার প্রেমও সেইরূপ নিজের মঙ্গলদৃষ্টিতে দুষ্মন্তের সমস্ত অপরাধকে দূর করিয়া দেখিয়াছিল। যুবক-যুবতীর মোহমুগ্ধ প্রেমে এত ক্ষমা কোথায়? ভরতজননী যেমন পুত্রকে জঠরে ধারণ করিয়াছিলেন, সহিষ্ণুতাময়ী ক্ষমাকেও তেমনি শকুন্তলা তপোবনে বসিয়া আপনার অন্তরের মধ্যে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিয়াছিলেন। বালক ভরত দুষ্মন্তকে দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মা, এ কে আমাকে পুত্র বলিতেছে?’ শকুন্তলা উত্তর করিলেন, “বাছা, আপনার ভাগ্যকে জিজ্ঞাসা করো।’ ইহার মধ্যে অভিমান ছিল না; ইহার অর্থ এই যে, “যদি ভাগ্য প্রসন্ন হয় তবে ইহার উত্তর পাইবে’– বলিয়া রাজার প্রসন্নতার অপেক্ষা করিয়া রহিলেন। যেই বুঝিলেন দুষ্মন্ত তাঁহাকে অস্বীকার করিতেছেন না তখনি নিরভিমানা নারী বিগলিত চিত্তকে দুষ্মন্তের চরণে পূজাঞ্জলি দান করিলেন, নিজের ভাগ্য ছাড়া আর-কাহারো কোনো অপরাধ দেখিতে পাইলেন না। আত্মাভিমানের দ্বারা অন্যকে খণ্ডিত করিয়া দেখিলে তাহার দোষত্রুটি বড়ো হইয়া উঠে; ভাবের দ্বারা, প্রেমের দ্বারা সম্পূর্ণ করিয়া দেখিলে সে-সমস্ত কোথায় অদৃশ্য হইয়া যায়।
যেমন শ্লোকের এক চরণ সম্পূর্ণ মিলনের জন্য অন্য চরণের অপেক্ষা করে তেমনি দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রথম মিলন সম্পূর্ণতালাভের জন্য এই দ্বিতীয় মিলনের একান্ত আকাঙক্ষা রাখে। শকুন্তলার এত দুঃখকে নিষ্ফল করিয়া শূন্যে দুলাইয়া রাখা যায় না। যজ্ঞের আয়োজনে যদি কেবল অগ্নিই জ্বলে, কিন্তু তাহাতে অন্নপাক না হয়, তবে নিমন্ত্রিতদের কী দশা ঘটে? শকুন্তলার শেষ অঙ্ক, নাটকের বাহ্যরীতি-অনুসারে নহে, তদপেক্ষা গভীরতর নিয়মের প্রবর্তনায় উদ্ভূত হইয়াছে।
দেখা গেল, কুমারসম্ভব এবং শকুন্তলায় কাব্যের বিষয় একই। উভয় কাব্যেই কবি দেখাইয়াছেন, মোহে যাহা অকৃতার্থ মঙ্গলে তাহা পরিসমাপ্ত; দেখাইয়াছেন, ধর্ম যে সৌন্দর্যকে ধারণ করিয়া রাখে তাহাই ধ্রুব এবং প্রেমের শান্তসংযত কল্যাণরূপই শ্রেষ্ঠ রূপ; বন্ধনেই যথার্থ শ্রী এবং উচ্ছৃঙ্খলতায় সৌন্দর্যের আশু বিকৃতি। ভরতবর্ষের পুরাতন কবি প্রেমকেই প্রেমের চরম গৌরব বলিয়া স্বীকার করেন নাই, মঙ্গলকেই প্রেমের পরম লক্ষ্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। তাঁহার মতে নরনারীর প্রেম সুন্দর নহে, স্থায়ী নহে,যদি তাহা বন্ধ্য হয়, যদি তাহা আপনার মধ্যেই সংকীর্ণ হইয়া থাকে, কল্যাণকে জন্মদান না করে এবং সংসারে পুত্রকন্যা-অতিথিপ্রতিবেশীর মধ্যে বিচিত্রসৌভাগ্যরূপে ব্যাপ্ত হইয়া না যায়।
এক দিকে গৃহধর্মের কল্যাণবন্ধন, অন্য দিকে নির্লিপ্ত আত্মার বন্ধনমোচন, এই দুইই ভারতবর্ষের বিশেষ ভাব। সংসারমধ্যে ভারতবর্ষ বহু লোকের সহিত বহু সম্বন্ধে জড়িত, কাহাকেও সে পরিত্যাগ করিতে পারে না; তপস্যার আসনে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ একাকী। দুইয়ের মধ্যে যে সমন্বয়ের অভাব নাই, দুইয়ের মধ্যে যাতায়াতের পথ-আদান-প্রদানের সম্পর্ক আছে, কালিদাস তাঁহার শকুন্তলায় কুমারসম্ভবে তাহা দেখাইয়াছেন। তাঁহার তপোবনে যেমন সিংহশাবকে-নরশিশুতে খেলা করিতেছে তেমনি তাঁহার কাব্যতপোবনে যোগীয় ভাব,গৃহীর ভাব বিজড়িত হইয়াছে। মদন আসিয়া সেই সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল বলিয়া, কবি তাহার উপর বজ্রনিপাত করিয়া তপস্যার দ্বারা কল্যাণময় গৃহের সহিত অনাসক্ত তপোবনের সুপবিত্র সম্বন্ধ পুনর্বার স্থাপন করিয়াছেন। ঋষির আশ্রমভিত্তিতে তিনি গৃহের পত্তন করিয়াছেন এবং নরনারীর সম্বন্ধকে কামের হঠাৎ আক্রমণ হইতে উদ্ধার করিয়া তপঃপূত নির্মল যোগাসনের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। ভারতবর্ষীয় সংহিতায় নরনারীর সংযত সম্বন্ধ কঠিন অনুশাসনের আকারে আদিষ্ট, কালিদাসের কাব্যে তাহাই সৌন্দর্যের উপকরণে গঠিত। সেই সৌন্দর্য, শ্রী হ্রী এবং কল্যাণে উদ্ভাসমান; তাহা গভীরতার দিকে নিতান্ত একপরায়ণ এবং ব্যাপ্তির দিকে বিশ্বের আশ্রয়স্থল। তাহা ত্যাগের দ্বারা পরিপূর্ণ, দুঃখের দ্বারা চরিতার্থ এবং ধর্মের দ্বারা ধ্রুব। এই সৌন্দর্যে নরনারী দুর্নিবার দুরন্ত প্রেমের প্রলয়বেগে আপনাকে সংযত করিয়া মঙ্গলমহাসমুদ্রের মধ্যে পরমস্তব্ধতা লাভ করিয়াছে। এইজন্য তাহা বন্ধনবিহীন দুর্ধর্ষ প্রেমের অপেক্ষা মহান ও বিস্ময়কর।
পৌষ, ১৩০৮