কাসা গ্রান্দে
ম্যারিজোনাতে এসেছি। আগে যদিও দেখেছি, তবু আবার যেতেই হবে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। যত দেখি তত অবাক লাগে। কিন্তু তার বাইরেও তো অ্যারিজোনার মরুভূমির বুকে অনেক কিছু দ্রষ্টব্য রয়েছে—প্রাচীন বাসিন্দাদের চিহ্ন ছড়ানো চতুর্দিকে। হার্ড মিউজিয়ামে গিয়ে দুটো ভিডিও টেপ দেখেছি, দুটি নেটিভ আমেরিকান সম্প্রদায়ের। আমরা যাদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ বলি এবং আমেরিকায় যাদের শুধু ‘ইন্ডিয়ান’ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে এতদিন। সদ্যপ্রাপ্ত এই ‘নেটিভ আমেরিকান’, খেতাব তাদের যথার্থ পরিচিতি। অ্যারিজোনার এই অঞ্চলে একদা সবুজ গাছপালায় ভরা অরণ্যানী ছিল। নদী বইত, শস্য ফলত। আস্তে আস্তে মরুভূমি এগিয়ে এল, মানুষরা সরতে সরতে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। প্রথমে প্রকৃতির রোষ, তারপর সাদা মানুষের আক্রমণ—স্থানীয় আদিবাসীদের স্থানচ্যুত করেছে বারবার। নেটিভ আমেরিকানদের এখন বেড়াবন্দী করে খাটালে রাখার মতো জিইয়ে রাখা হয় ‘ইন্ডিয়ান রেজার্ভেশন্স’ নামক সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সংরক্ষিত অঞ্চলে। সেখানে তারা মদ-গাঁজা-তামাক খেয়ে নেশাভা করে, আর জুয়া খেলে সময় কাটায়। অ্যারিজোনাতে দেখলাম ইন্ডিয়ানদের জন্যই বেশ কয়েকটি বড় বড় ‘ক্যাসিনো’ বানিয়ে দিয়েছেন সরকার, সেখান থেকে তাদের আয় ও ব্যয় দুটোই চলছে। আমেরিকাতে ঘুরে মাঝে মাঝেই এই নেটিভ আমেরিকানদের মুখোমুখি হয়েছি গত সাতচল্লিশ বছরে—আগের চেয়ে মনে হয় আধুনিককালে তাদের অবস্থা একটু ভালোর দিকে। আগে আরও বেশি অবহেলিত, আরও বেশি আত্মবিধ্বংসী জীবন ছিল তাদের এই সংরক্ষিত খোঁয়াড়গুলিতে। যারা বেরিয়ে এসেছে, মূলস্রোতে মিশেছে, তারাই বেঁচে গেছে। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতিটুকু বাঁচিয়ে রেখেও উন্নতির মুখ দেখা খুব বেশি নেটিভ মার্কিনী আদিবাসীর জীবনে এখনও সম্ভবপর হয়নি বলেই মনে হয়।
ফিনিক্সে, ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনাতে আমার নিমন্ত্রণ ছিল মোট দশদিনের। তারই ফাঁকে ফাঁকে একদিন ঘুরে এলাম সেডোনা আর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। সেডোনার লালপাথরের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য, ঠিক মন্দিরের মতো। আর বিচিত্র গণেশে গণেশে ভর্তি! শিবলিঙ্গের তো কথাই নেই। যে-কোনও প্রাকৃতিক গুহাতেই কিন্তু অন্তত একটি না একটি শিবমূর্তি আছেই। এবং গণেশের রূপও দেখা যায়, যদি দেখার চোখটা থাকে। এখানে খোলা মরুভূমির বুকে ছুটে যাওয়া তীব্র গরম বাতাস বছরের পর বছর লাল পাহাড় কেটে কেটে মন্দিরের মতো আকৃতি তৈরি করেছে। অসীম আর নন্দিতা চৌধুরির সঙ্গে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যাবার পথে সেডোনাতে থেমে লাঞ্চ করলাম। কত যে আমরা গণেশমূর্তি, এমনকী দশভুজাও আবিষ্কার করে ফেলেছি সেখানে, সেই বিক্ষত পাথরের কেরামতিতে! পরেরবার গিয়ে হয়ত আর তাদের খুঁজে পাব না। বেঠিকানা দেবদেবী তো ওঁরা সবাই। ওইদিকেই একটি বড় দ্রষ্টব্য, প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নভূমি আছে, সেদিন আর যাওয়া হল না। প্রাচীন নেটিভ আমেরিকানদের সভ্যতা-সংস্কৃতির বহু নিদর্শন আছে সেখানে। কিন্তু সেখানে থামার সময় নেই আজ।
ফিনিক্সের বিখ্যাত হার্ড মিউজিয়াম নেটিভ আমেরিকান সংস্কৃতির যাদুঘর। সেখানে ঘুরেছি আমাদের বন্ধু জয়ন্ত সেন, মঞ্জীরা দত্ত আর সুচিত্রা রায়ের সঙ্গে—কী করে যাদুঘরে বেড়ালাম? পা-ব্যথায় হাঁটতে পারি না এদিকে? কেন, চক্র-আসনে সমাসীন হয়ে। রাজার মতো! শ্রাবস্তী হুইলচেয়ার ঠেলায় এক্সপার্ট হয়ে গেছে। আমেরিকার এই একটি গুণকীর্তন করতেই হবে—সমস্ত পাবলিক ইন্টারেস্টের জায়গা, সেটা থিয়েটারই হোক বা যাদুঘর, লাইব্রেরিই হোক বা চিড়িয়াখানা—সবই হুইলচেয়ার-অ্যাকসেসিবল। এবং টিকিট কাটার সময়েই হুইলচেয়ার চেয়ে (সাধারণত বিনামূল্যে) নেওয়া যায়। অতএব কি স্মিথসোনিয়ামের বিভিন্ন যাদুঘরে ঘুরে বেড়ানো, চাঁদের যাত্রী সেই অ্যাপোলো-১১টি দেখা, কি, হার্ড মিউজিয়ামে ঘুরে ঘুরে নেটিভ আমেরিকানদের শিল্পকর্ম, জীবনযাপনের কীর্তিকলাপ প্রত্যক্ষ করা, সবই সম্ভব হয় আমার মতো আপাতত প্রতিবন্ধী যাত্রীর পক্ষে। হার্ড মিউজিয়ামেই জেনেছি, ফিনিক্সের বেশ কাছাকাছিই আরও একটি প্রত্নভূমি আছে, সেখানে প্রাচীন এক মাটির প্রাসাদ আছে হোহোকাম ইন্ডিয়ানদের তৈরি করা। আমি আগে নিউ মেক্সিকোতে সান্টা ফে ও তাওসে এরকম মাটির বাড়ি দেখেছি, তাদের এদেশি নাম, আডোবে (Adobe)। এখানকার মাটির বাড়িটি কেমন, দেখতে উৎসাহ হল। শ্রাবস্তীর এটা প্রথম মার্কিনী যাত্রা। সে-বেটি তো কিছুই দেখেনি। যা দেখছে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিপুল বিস্তার। গম্ভীর শোভা ‘গভীরতা দেখে সে স্তম্ভিত। সেডোনার লালপাথরের প্রাকৃতিক ভাস্কর্য দেখে উল্লসিত। এখন দেখা যাক নেটিভ আমেরিকানদের এই ‘প্রাগৈতিহাসিক ভগ্নস্তূপ’ (Prehistoric ruins of Casa Grande) দেখে তার কী মনে হয়। আমাকে নিয়ে যেতে আগ্রহী হলেন এক বাঙালি গৃহবধূ, শর্মিলা। তিনি আপাতত বাচ্চাদের দেখাশোনা করছেন বলে চাকরি করছেন না। হাতে সময় আছে।
শর্মিলা এসে সকালবেলাতে আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। রোদ্দুর চড়া হবার আগে আগেই পৌঁছতে ইচ্ছে। কাসা গ্রান্দের প্রসিদ্ধ ভগ্নস্তূপটি ধু-ধু মরুভূমির বুকের মধ্যে। বড্ড গরম হবে—রোদ্দুরের মধ্যে দেখতে হবে তো ঘুরে ঘুরে। যেতেও অনেকক্ষণ, আসতেও অনেকক্ষণ, রোদ্দুরেই যাতায়াত। আমাদের গৃহকর্ত্রী, শ্রীমতী নন্দা দত্ত আমাদের হাতেমুখে রোদ আটকানোর ক্রিম মাখিয়ে দিলেন, সঙ্গে জলের বোতল দিয়ে দিলেন বেশি করে। আমার মেয়ে নন্দনা বিশাল দুটো রোদচশমা দিয়ে দিয়েছে সঙ্গে, অ্যারিজোনার তীক্ষ্ণ রোদ্দুরে চোখ যাতে আরও ধ্বংস না হয়। আমি আর শ্রাবস্তী, বগলে জলের বোতল, চোখে কালো চশমা-আমরা মরু বিজয়ে বেরোচ্ছি।
শর্মিলা খুব চমৎকার গাইড। সুন্দর করে পথটি চিনিয়ে দিতে দিতে এনে ফেললেন কাসা গ্রান্দে-তে। ইস্পানি ভাষায় মানে, বড় বাড়ি। বাড়িটি, যতটা দেখতে পাচ্ছি, এমনকিছুই বড় নয়। তবে হ্যাঁ, কুটির তো নয়-তিন-চার তলা বাড়ি ছিল এককালে, বড়ই। সম্ভবত গ্রামের শস্যের ভাণ্ডার ছিল এর মধ্যে। এখন ছাদ নেই, দেওয়ালই শুধু দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা। ঘরের মানচিত্র চেনা যায় তা থেকে। গাড়ি থেকে নেমে যেখানে আশ্রয় নিলাম, তার প্রথমেই দোকান। তার গায়ে যাদুঘর, এখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া বাসনকোসন, অস্ত্রশস্ত্র, কাপড়-চোপড়, গয়নাগাটি, আর কিছু ছবি রাখা আছে। আর আছে অতি সুন্দর একটি ভিডিও-শো। নেটিভ আমেরিকান হোহোকাম সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি ইতিহাস বলছেন, আগে এখানটা কেমন ছিল। সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যও তেমনই হয়ে উঠছে। সেখানে জনবসতি কেমন ছিল, তাদের জীবনযাত্রা কেমন ছিল, তারপর কীভাবে একদিন মরুভূমি এসে গ্রাস করে নিল জনপদ। এই শো-টি সত্যি মনোগ্রাহী। তারপর ভাঙা দেউলে যাত্রা করলেন শর্মিলা। সঙ্গে শ্রাবস্তী।
আমি ছায়াতে বসে থাকি কাছাকাছি। সেগুয়েরো নামের উঁচু উঁচু মনসাগাছেরা আকাশে দু-হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেন দানব–আমার চেয়ে অন্তত তিন-চার গুণ দীর্ঘতর সেই কাঁটাগাছেরা, তার মধ্যে কাঠঠোকরা পাখির মতো একরকম পাখি ঠুকরে ঠুকরে ফুটো করে কী সুন্দর বাসা বাঁধছে, দেখলাম। পোকা খাওয়ার জন্য নয়, ডিম পাড়বার জন্যই গর্ত খুঁড়ছে। এখানে তো এরাই বৃক্ষ। ফল দেয়। আশ্রয় দেয়। আরও নানারকমের ফণিমনসার ঝোপ আছে-তাতে সুন্দর লাল টুকটুকে ফুল ফুটে আছে। ঝাড়লণ্ঠনের মত দেখাচ্ছে। আমাদের দেশের গেল ফণিমনসাতেও খুব সুন্দর হলুদ রঙের বড় বড় ফুল ফোটে। এখানে সেই বিখ্যাত ফণিমনসার গাছটিও দেখলাম, যেটি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম মেক্সিকেতে। ঠিক কেয়াঝোপের মতো দেখতে ঝাড়টি-মোটা মোটা লম্বা লম্বা পাতা, তার ধারে ধারে কাঁটার লাইন—ওই পাতা থেকে রস নিয়ে টাকিলা মদ হয়, ওই পাতা থেকে সুতো কেটে সুতো হয়। ও থেকে জলও পাওয়া যায়, একরকম আটাও তৈরি করা যায় ওই পাতার আঠা শুকিয়ে গুঁড়ো করে—কিন্তু গাছটির নাম আমার মনে ছিল না। এখানে আবার সেই গাছ দেখে আমার উত্তেজনা, আনন্দের অবধি ছিল না। দ্বাররক্ষীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, হ্যাঁ, এই সেই একাই-একশো গাছ। মরুভূমির বাসিন্দাদের হুজুর মা-বাপ। কিন্তু ছি ছি—নামটা যে আবার ভুলে গেছি? Agave কি? মেক্সিকো এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। অ্যারিজোনার শহরে বাড়ি বাড়ি ঘরের কাজকর্ম করতে যাঁরা আসেন, তাঁরা সবাই হয় মেক্সিকান, নয় আদিবাসী মার্কিনী রমণী। আর বাগানের কাজকর্ম করেন তাঁদেরই সম্প্রদায়ের পুরুষরা। শিক্ষায় তাঁরা অগ্রসর হননি, গায়ে-গতরে খেটে তাঁদের দিন চলে। ফিনিক্সে অবশ্য মেক্সিকানদের চেয়ে আদিবাসী আমেরিকান কর্মীই বেশি। তাঁদের চেহারা অনেকটা আমাদের পাহাড়িদের মতো, কিন্তু শরীরের গড়ন বড়সড়। চোখ সরু, কিন্তু নাক বোঁচা নয়। রং তামাটে। দেখলে চেনা যায় যে এঁরা সাদামানুষের জাতভাই নন। কৃষ্ণাঙ্গদেরও কেউ নন। এঁদেরই জমিজমা, এঁদেরই মাতৃভূমি কেড়ে নিয়ে আজকের আমেরিকার বোলবোলাও। এই অঞ্চলে স্প্যানিশ প্রভাবই বেশি, বাড়িঘরে স্প্যানিশ আর্কিটেকচারের চিহ্ন, রাস্তার নামে, শহরের নামে হয় স্প্যানিশ, নয় আদিবাসী মার্কিনী প্রভাব সুস্পষ্ট। এখানে চার্চগুলিকেও দেখতে স্প্যানিশ চার্চের মতো। সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াতেও তাই।
আমি বসে বসে ওঁদের টুপি পরা মাথাগুলো মিলিয়ে যেতে দেখি কাসা গ্রান্দের ভাঙা দেওয়ালের পিছনে। ওঃ খুলিফাটা রোদ্দুর একেই বলে। নন্দার জল খুব কাজে লাগছে আমাদের। এই অঞ্চলটির নাম, কুলিজ। আজকের টেম্পারেচার ১০২° ফারেনহাইট মাত্র, বেশি নয়, তবু মনে হচ্ছে যেন ১২০°, যদিও আমি বসে আছি ছায়াতে। বসে বসে ভাবতে চেষ্টা করছি টোলি হিলারম্যান কেমন করে এইসব অঞ্চলকে নিয়েই অমন সব থ্রিলার লিখলেন! সামনের বিস্তীর্ণ শুকনো মাটির দিকে তাকিয়ে কল্পনা করতে চেষ্টা করি, এখানেই ছিল একদিন হোহোকাম ইন্ডিয়ানদের বসতি। পাশেই বইত গিলানদী। ভোর থেকেই গ্রামের কাজকর্ম শুরু হয়ে যেত। পুরুষরা কাজ করতে যেত গমের খেতে, মেয়েরা জল আনত, শস্য ঝাড়ত, জাঁতা পিষত, রান্না করত—হ্যাঁ, এরকমই ভাগাভাগি ছিল কাজের। এখানে একদিন অরণ্য ছিল পালোভের্দে, মেসকিট, আর লোহাকাঠের গাছ ছিল প্রচুর। আর মেসটি গাছ তো এদের মায়ের মত। তার ছায়া, তার ফুল, ফল, কাঠ, শুকনো পাতা, সবই কাজে লাগত হোহোকামদের। অদূরেই মুরুভূমিতে ছিল এই সেগুয়েরা মনসাগাছ—যার লাল টুকটুকে ফল যখন পেকে ফেটে যায়, মনে হয় সারা গাছটি বুঝি লাল ফুলে ভরে আছে। সেগুয়েরার ফল, তার শাঁস, আদিবাসীদের প্রিয় খাদ্য। জলের ধারে নানারকমের ঘাসবন ছিল, শরবনের মতো—তা থেকে ওরা ঝুড়ি বুনত, আসন বুনত, মাদুর বুনত। এখানে লাউ ফলাত ওরা—সেই কচি লাউ খেত, আর বুড়ো লাউয়ের খোল শুকিয়ে পাত্র বানাত, আর ঝুমঝুমি বানাত বাচ্চাদের। এখানকার যাদুঘরে আছে সেই পাত্র, সেই ঝুমঝুমি। আছে ছবি আঁকা লাল-কালো মাটির বাটি, হাঁড়ি, কুঁজো। আছে শিশুর বেতের দোলনা। রঙিন চুড়ি, মালা। সেগুলো নাকি সেগুয়েরার আঠা দিয়ে তৈরি। এখানে যে একদা গমখেত, ঘাসবন, গাছপালা ছিল, এটা কল্পনা করতে বেশ কষ্ট হচ্ছে কিন্তু। অথচ খুব বেশিদিনের কথা নয়। এদের ‘প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা’র সংজ্ঞা তো আমাদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। ছশোবছর আগে বর্তমান সাদা আমেরিকার অস্তিত্ব ছিল না, ‘ইতিহাস’ সৃষ্টি হয়নি। ঠিকই। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে, মানবসভ্যতার ইতিহাসে ছশোবছর নামমাত্র। সে তো এই সেদিনের কথা, নস্যি!
শ্রাবস্তী আর শর্মিলা ফিরে এল পায়ে-চলা পথে কাসা গ্রান্দে পরিদর্শন সেরে। পরিক্রমার পর দুজনেরই মুখ লাল টুকটুকে—ঘেমে ভিজে উঠেছে দুজনেই।—’জল খাও, জ্বল খাও! ছায়ায় বসো, ছায়ায় বসো!’ এখানে গাড়ি থেকে নেমে অবধি শুনতে পাচ্ছি অত্যন্ত সুন্দর এক বাঁশির সুর—কাসা গ্রান্দের মাঠঘাট আর ভাঙা কুঠিবাড়ি ভাসিয়ে ঢেউ খেলছে যাদুমাখা ইন্ডিয়ানদের বাঁশির মেঠো সুর। বড্ড মোহময়, বড্ড একলা-করে-দেওয়া সুর। কান্না পায়। কেম্ব্রিজের হার্ভার্ড স্কোয়্যারে প্রথম শুনেছিলাম এই সুর, অনেক বছর আগে। একজন নেটিভ আমেরিকানের হাতে ছিল অদ্ভুতদর্শন, হাতের পাতার মতো চ্যাটাল, ছোট, চ্যাপ্টা একটা পাঁচনলী বাঁশি—তাতেই বাজাচ্ছিল প্রাণকাঁদানো সুর। হার্ভার্ড স্কোয়্যারে উইকএন্ডের সন্ধেবেলা অনেকরকমের খেল দেখা যায়। ম্যাজিক, গানবাজনা, কত কী! তারই মধ্যে এই বাঁশির সুর ছিল এক্কেবারে আলাদা। অনেকদিন আমার মাথার ভেতরে ঘুরেছিল। আজ কাসা গ্রান্দে-তে মধ্যদিনের রোদে সেই সুর আবার ভেসে এসেছে। কিন্তু এ বাঁশির তো এটাই নিজস্ব জায়গা। হার্ভার্ড স্কোয়্যারে ও ছিল বড্ড বেমানান। এখানে এ সুরটি প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে। ‘ঘরটর, দেওয়াল-টেওয়াল, সিঁড়ি প্রণালী, শস্যের ভাঁড়ারঘর—সব দেখে এলাম’—শ্রাবস্তী বলল। ‘এমন কিছুই নয়। এত আহামরি করার কী আছে? এই মাটির বাড়ির আর্কিটেক্ট যখন বড় বাড়ি বানাচ্ছেন, তখন তো মোগলরা ওখানে রাজত্ব করছে। দূর! ভারতবর্ষ থেকে এখানে এসে প্রাগৈতিহাসিক বস্তু দেখতে আসার মানে হয়?’
এই প্রথম শ্রাবস্তী অবাক হল না। অথচ আমেরিকাতে এটা সত্যিই প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার। ঘরটার মাথায় আবার মস্ত উঁচু করে একটা ছাদ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে রোদে-জলে ওটি আরও ধ্বংস হয়ে যেতে না পারে। ছাদটা একটা এরোপ্লেনের গ্যারাজের মতো উঁচু। বাড়িটিকে আলগোছে রক্ষা করছে, কোথাও ছুঁয়ে ফেলেনি। আমার মনে হল এটা আমাদের পাথরের মূর্তিদের বেনারসি শাড়ি পরিয়ে দেবার মতো বেখাপ্পা। বড্ড বেমানান দেখাচ্ছে কিন্তু। মাঠের মধ্যে এরকম একটা ভগ্নস্তূপ খোলা আকাশের নীচেই মানায় ভালো। সে যাই হোক, প্রশ্নটা এখানে তো নন্দনতত্ত্বের নয়, সংরক্ষণের। আমরা তো প্রয়োজনে বাঁদুরে টুপিও পরি।
হোহোকাম আদিবাসীরা চাষিবাসী সভ্য মানুষ ছিল। গিলানদী থেকে জলের জন্য খাল কেটেছিল, বাঁধও দিয়েছিল, বল খেলার মাঠও ছিল তাদের। বিভিন্ন প্রাঙ্গণে ভাগ করা তাদের গ্রাম। প্রাঙ্গণের দেওয়ালের গায়ে ছিল তাদের মাটির বাড়িগুলি। এই বাড়িটার মতোই সেগুলিও সম্ভবত তেতলা বাড়িই ছিল। এই কাসা গ্রান্দে বাড়িটা যে ঠিক কী ছিল সেটা নিয়ে ধন্দ মেটেনি এখনও। সরকারি ভবন ছিল কি? কেউ বলে এটা ছিল শস্যাগার। আবার কেউ কেউ বলে, না, এটা ছিল একটা প্রাগৈতিহাসিক অবজার্ভেটরি-জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা হত এখানে। দেওয়ালে এমনই কতগুলি গর্ত করা আছে, যেখান থেকে সারাবছরের বিভিন্ন সময়ের সূর্যোদয় এবং চন্দ্রোদয়ের হিসেব কষা যায়। হতে পারে যে হোহোকামেরা এই বাড়িটাকে একটা ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যবহার করত—কিন্তু এমন বিশদ ক্যালেন্ডার দিয়ে তাদের কী কাজ ছিল? তার উত্তর মেলেনি।
১৩০০ শতকের পর বেশিদিন এখানে বসবাস করেনি হোহোকাম সম্প্রদায়। কেন তারা চলে গেল জানা যায়নি, তবে প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে মনে হয় এখানে যেমন বারবার বন্যা হত, তেমনই খরাও আসত বারবার। হোহোকামরা শেষপর্যন্ত সামলে উঁঠতে পারেনি। মাটির তলার জলের স্তর এখানে এত দ্রুত নেমে গেছে যে অরণ্যানী ক্রমশ … মরুতে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রচুর শুকনো, মৃত মেসকিট গাছ মিলেছে। জলাভাবেই তাদের মৃত্যু ঘটেছিল। মানুষও টিকে থাকতে পারেনি।
মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে কাসা গ্রান্দে থেকে ফেরার পথ ধরলাম আমরা। ভীষণ খিদে পেয়েছে তিনজনেরই। আপাতত ধু-ধু মরু, যেদিক পানে চাই, কোনওখানে জনমানব নাই। ফিরতি পথে দেবদূতের মত একটা টাকো-বেল-এর দোকান দেখ গেল। মেক্সিকান ফাস্ট ফুডের চেন এটা। এই দোকানে ড্রাইভ-ইন-উইন্ডো আছে—জানলার কাছে গাড়ি থামাল শর্মিলা। প্রত্যেকের দুটো করে স্পাইসি চিকেন বুরিটো অর্ডার করল, আর কোক। এক জানলায় অর্ডার প্লেস করতে হয়, আরেক জানলা থেকে তুলে নিতে হয় ঠোঙায় ভরা গরম খাদ্য। তৃতীয় জানলা থেকে তুলে নিই কাগজের গেলাসে বরফ ঠাসা ঠান্ডা কোক। গাড়ি চলল ফিনিক্সের পথে। বাইরে দুর্ধর্ষ রোদ, মরুভূমির আগুনে গরম বাতাস বইছে। গাড়ির ভেতরে ঠান্ডায় বসে কোক আর বুরিটো (ঠিক যেন পরোটা-মাংসের রোল) খেতে খেতে আমরা কাসা গ্রান্দে ছেড়ে আমাদের ছোট বাড়ির দিকে ছুটি।
প্রকাশ : ‘ভ্রমণ’ আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০০৬