কাশীযাত্রা – 1769 – চতুৰ্দশ পৰ্ব
১
1769 খ্রিস্টাব্দ। সহস্রাব্দের ইতিহাসে এই বৎসরটি সুপরিচিত। কেন বুঝলে না? বাংলা সালটা উল্লেখ করলেই ধরতে পারবে। সেটা ১১৭৬ বঙ্গাব্দ। অর্থাৎ ভয়ঙ্করী ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’-এর সর্বনাশা কাল। মৃত্যুচিহ্নিত বৎসর। পুরাতন নথিপত্র তন্নতন্ন করে খুঁজেছি—কিন্তু এই মহামন্বন্তরের তথ্যনির্ভর কোনো ইতিহাস সংগ্রহ করতে পরিনি। কিছু পেয়েছি বঙ্কিম-পথে। কিন্তু তা উপন্যাসের উপাদান মাত্ৰ।
তা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর তো মান্ধাতার বাপের আমলের কথা। বুড়ো ইতিহাস সেসব কথা ভুলে যেতেই পারে। আমাদের যৌবনকালে স্বচক্ষে দেখা পঞ্চাশের মন্বন্তরেরই কিছু জানতে পেরেছি? কী করে সেটা হল Man-made Famine? পাইনি। সমকালীন কথাসাহিত্যিকেরা কিছুটা ঔপন্যাসিক সত্য জানিয়েছেন, কিছুটা ধরা আছে চিত্রশিল্পীদের ক্যানভাসে—জয়নাল আবেদিন, পূর্ণ চক্রবর্তী, খালেদ চৌধুরী, গোপাল ঘোষ। নন্দলাল আঁকলেন : ‘অন্নপূর্ণা যার ঘরে, সে কান্দে অন্নের তরে/এ বড় মায়ার পরমাদ।’ এ সর্বনাশের সামগ্রিক ঐতিহাসিক গবেষক কেউ এগিয়ে আসেননি।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরকালে রূপমঞ্জরী প্রায় পঞ্চবিংশতিবর্ষীয়া যুবতী। পিতৃবিদায়কালে সে ছিল চতুর্দশী। ফলে এর মাঝখানে একযুগ অতিক্রান্ত। এই পঞ্চবিংশতি বৎসর বয়সেই রূপমঞ্জরী স্বগ্রাম ত্যাগ করে কাশীধামে চলে যান। বাকি জীবনে গৌড়বঙ্গে আর ফিরে আসার সুযোগ পাননি। ফলে এই দ্বাদশ বৎসরের একটি চুম্বকসার এখানে দাখিল করা দরকার।
দামোদরের ধারে চণ্ডাল-শ্মশানে পিতৃদেবের দেহ ভস্মীভূত হল। চিতা যখন নির্বাপিত হল তখন রোহিণী নক্ষত্র মহাকাশের খ-বিন্দুতে। সূর্য যেহেতু এখন তুলারাশিতে তাই বলা যায় এখন মধ্যরাত্রি।
বড় উত্তাপ, বড় জ্বালা, বড় দহন! দীর্ঘদিন তা সহ্য করে এসেছেন। ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের সারাটা জীবন ধরে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে, ভারত-গরুড়ের দু-দুটি পক্ষ : নারীসমাজ আর জল-অচল জাত। এ দুটি পক্ষ শাতন করলে এই মহাবিহঙ্গ কোনোদিনই মহাকাশে উড়তে পারবে না। কেউ সে কথায় কর্ণপাত করেনি। এতদিনে সে-জ্বালা মিটল। কলসিতে করে ঘড়া ঘড়া জল এনে ওই জল-অচল প্রিয়বন্ধুরা তাদের অতিপ্রিয় মানুষটার প্রতি বন্ধুকৃত্য করল। ভীমা বাগদি নেই। মরেছে। ওই সমাজপতিদের নেপথ্য ন্যক্কারজনক পন্থায়। না হলে সে হয়তো চিতার উপর আছাড় খেয়ে বলত : ‘বাবা ঠাউর! তুমি চলি গেলে মোরা ডাঁড়াব কুথা?”
দামোদরে ডুবে মরেছে তার ভাইপোটাও : ঈশেন! আর্জান-সর্দার!
একটি বটপত্রের ঠোঙায় রূপেন্দ্রের উত্তপ্ত অস্থিটুকু নিয়ে এগিয়ে এল শ্মশানচণ্ডাল। রূপমঞ্জরীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললে, ‘এইডে দামোদরে দে-আয়, মা! বাবাঠাউর শান্ত হবেনে!”
অঞ্জলিবদ্ধ হাতটি প্রসারিত করে এগিয়ে এল ঘাটের দিকে। জলে নিক্ষেপ করল না কিন্তু। এগিয়েই গেল ক্রমাগত। ধীরে ধীরে দামোদরের গর্ভে। তিন ডুব দিয়ে ফিরে এল যখন, তখন তার মুষ্টিতে বটপত্রটি নেই
ডাঙায় উঠেই হঠাৎ সচেতন হল। বিকচিত হল ওর স্বভাবজাত নারীসত্তা। খেয়াল হল, সে একবস্ত্রা এবং সিক্তবসনা। ঘাটে তখনো সারা গ্রাম অপেক্ষা করছে। সকলেরই দৃষ্টি ওর দিকে।
হঠাৎ নজর হল সোপানশ্রেণি বেয়ে নগ্নপদে নেমে আসছেন তারাপ্রসন্ন। স্নানান্তে যে বস্ত্র পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে একথা মনে ছিল না রূপমঞ্জরীর। কিন্তু ভোলেননি তারাপ্রসন্ন। তিনি ওর দিকে একটি সাদা থান বাড়িয়ে ধরে বলেন, ‘স্ত্রীলোকদের বস্ত্র-পরিবর্তন-কক্ষে গিয়ে ভিজে শাড়িটি ছেড়ে আয়! ওটা ওখানেই থাকবে। শ্মশানচণ্ডালের প্রাপ্য।’
শাড়িটা পালটে যখন ফিরে এল, তখন উনি বললেন, ‘এবার ওই পালকিতে উঠে বস। পুঁটুরানী ওখানে অপেক্ষা করছে।’
পিতৃহীন শূন্য ভিটেয় ফিরে এল। তখনো কিন্তু গ্রাম্যমহিলার দল ওর প্রতীক্ষায় বসে আছেন। আশ্চর্য! আকাশ-প্রদীপটা তখনো নিভে যায়নি। কে আজ জ্বালাল ওটা? কে তেল ভরে দিল বারেবারে? হটী জানে না। আকাশ-পিদিমটা যখন তৈরি করেছিল তখন স্বপ্নেও ভাবেনি যে, ওর এমন একটা ব্যবহার হবে। রূপেন্দ্রের পূর্বপুরুষ নয়, রূপেন্দ্রকেই পথ দেখাতে প্রদীপটা এভাবে প্রতীক্ষা করবে।
সে রাতের বাকিটুকু কে কোথায় কাটাল হিসাব নাই। কেঁদে-কেঁদে সবাই ক্লান্ত—তারাজ্যেঠি, শোভাপিসি, মীনু-খুড়িমার মা আর পিতৃহারা অভাগিনী
পরদিন সকালে ওকে আড়ালে ডেকে নিয়ে তারাপ্রসন্ন বললেন, রূপেন্দ্রর আদ্যশ্রাদ্ধ বোধহয় করতে দেবেন না ওঁরা, তাছাড়া ওর শ্রাদ্ধাধিকারীও তো কেউ নেই। তুই চতুর্থী পালন কর শুধু। আমি সব-ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। কী কী উপকরণ লাগবে বল।
—উপকরণ তো মাত্র তিনটি—তিল, তুলসী আর গঙ্গাজল। তা আমার ঘরে আছে। আর ব্যবস্থা কী করবেন? পুরোহিতের প্রয়োজন হবে না। হয়তো কেউ রাজি হবেন না। মন্ত্র তো মাত্র একটি : ইদং মে শ্রাদ্ধম্’! তবে আমি দ্বাদশটি অব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ করব।
—দ্বাদশটি অব্রাহ্মণ!
—না, না। আপনাকে জোগাড় করতে হবে না। আমি শুধু শ্মশান-বন্ধুদের কৃতজ্ঞতা জানাব। ওদের কারও তো জাত-যাবার ভয় নেই। শুধু কাঁচা ফলার। আমি জীবনদাকে দিয়ে আনিয়ে নেব।
—না, না। জীবন কেন? আমিই পাঠিয়ে দেব সবকিছু। কী কী পাঠাব বল?
না জেঠু! সোঞাই হাট থেকে কেনা কোনো কিছুতে শ্মশান-বন্ধুদের আপ্যায়ন করলে বাবার স্বর্গত আত্মার তৃপ্তি হবে না। তাঁর আত্মার নিশ্চয় স্মরণে আছে যে, সমাজপতিদের বিধানে তাঁর ‘প্রাচ্চিত্তির’ হয়নি।
ওই পণ্ডিতার মুখে এই প্রাকৃত শব্দটা শুনে তারাপ্রসন্ন বুঝতে পারেন, শোকসন্তপ্তার অন্তরের নিরুদ্ধ ক্ষোভ। তিনি বললেন, যা ভাল বুঝিস করিস। কিন্তু এই ফাঁকা বাড়িতে তোর বয়সী মেয়ের তো একা-একা থাকা ঠিক নয়। নিরাপদও নয়। শিবনাথ রাতে শয়ন করতে এলেও নানা কথা উঠতে পারে।
—জানি। এইমাত্র শোভাপিসিও ওই কথা বলেছিলেন। তিনি রোজ রাত্রে আমার কাছে এসে থাকতে চেয়েছিলেন। আমি স্বীকৃতা হয়নি। তা হয় না।
—কেন হয় না? কেন হবে না? শোভা আর পুঁটু যদি পালাপালি করে…
—না! আমার দুর্দৈব আমাকেই সইতে হবে। এ নিয়ে সমাজপতিদের নতুন করে আঘাত হানার সুযোগ আমি দেব না। আমারও তো ‘প্রাচ্চিত্তির’ হয়নি। আমি তো সামাজিক বিধান অগ্রাহ্য করে ‘চিতাভ্রষ্টা’। বাবামশায়ের শেষযাত্রায় কাউকে কাঁধ দিতে দেওয়া হল না। এ ভিটেয় কেউ রাত কাটালে তাকেও জাতিচ্যুত করা হবে। আপনি একা তা ঠেকাতে পারবেন না জেঠু! আমার জন্যে আর কাউকে বিড়ম্বিত হতে দেব না।
তারাপ্রসন্ন অধোবদনে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর যেন হঠাৎ সিদ্ধান্তে এলেন। বলেন, তুই আমার বাড়িতে চল! দেখি, কে আমাকে জাতিচ্যুত করে! আমি এইসব বর্বর সামাজিক অনুশাসন মানি না।
এতক্ষণ স্থির ছিল। এবার আর পারল না। হঠাৎ ওর দু-চোখ ভরে এল জলে। নতনয়নে অস্ফুটে বললে, এ কথাটা সেদিন কেন বলেননি, জেঠু?
—কোনদিন?
রূপমঞ্জরী জবাব দিল না। অধোবদনই রইল। টপটপ করে দু-ফোঁটা জল এতক্ষণে ঝরে পড়ল ওর চোখ থেকে! তারাপ্রসন্ন নিদারুণ লজ্জা পেলেন ওঁর প্রশ্নের জন্য। তা ঠিক! ওই কথাটা যদি সেদিন বলবার হিম্মৎ তাঁর থাকত, তাহলে শুভপ্রসন্ন সংসার ত্যাগ করে যেত না। তারাসুন্দরী মুক হয়ে যেতেন না। আর এই একফোঁটা মেয়েটা সসম্মানে ভাদুড়িবাড়িতে গিয়ে উঠত। অনাথা আশ্রিতার পরিচয়ে নয়। স্বমর্যাদায়। উন্নতশিরে। নিজের শ্বশুরালয়ে।
অনেকক্ষণ নীরব থেকে বলেন, মিশিরকে বরং পাঠিয়ে দেব। তোর বাড়ির সামনে বসে পাহারা দেবে।
—না! তাতেও আমি রাজি নই! আমি বাবামশায়ের পুত্রসন্তান হয়ে জন্মাইনি। আমি ‘আত্মদীপ’ হতে পারিনি। এটাই কি আমার অপরাধ? আমি একাই থাকব। আপনি বরং একটা কাজ করুন, জেঠু। মা আনন্দময়ীর মন্দিরের ভিতরে, পিছন দিকের প্রাচীরে কীলক থেকে যে খাঁড়াখানা ঝুলছে, ওইটা মিশিরজির হাত দিয়ে আমাকে পাঠিয়ে দিন। লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যে। সবাই জানুক—গভীর রাত্রে অনধিকারী কেউ অন্যায়ভাবে এ ভিটেয় মাথা গলালে তাকে খর্পরধারিণীর সম্মুখীন হতে হবে।
তারাপ্রসন্নের বাক্যস্ফুর্তি হল না। তাঁর মনে পড়ে গেল ভারতচন্দ্রের একটি অনবদ্য পংক্তি : “এ তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়।”
২
রূপমঞ্জরীকে কিন্তু একাকী তার ভিটেয় রাত্রিবাস করতে হয়নি।
সেদিন সন্ধ্যাতেই এসে উপস্থিত হলেন ‘একমুঠিবাবা’। তিনি মুক্তপুরুষ। সামাজিক বিধানের ঊর্ধ্বে। সমাজপতিদের অঙ্গুলিহেলনে ভ্রূক্ষেপ করেন না। তাঁর বিচিত্র আধা-হিন্দি আধা-বঙ্গভাষে যা বললেন তা সদ্য শ্বশুরালয়ে নবাগতা নববধূর দিদিশাশুড়ির অনুকরণে—
“আমারে টুক শুতে দিবি, নাতবৌ? আমার শোবার কুন ঠাঁই নাই রে!”
একমুঠিবাবা তাঁর তিনকুড়ি বছর বয়সে জীবনযাত্রাটার ছকটাই পালটে ফেললেন। তেল-সিঁদুর-মাখা বাঁধানো বটগাছতলার সাবেক ডেরাটা গুটিয়ে ফেলে কম্বল বিছালেন একবগ্গা-ঠাকুরের দাওয়ায়। তিনি স্থির করেছেন—দৈনিক একমুঠি ভিক্ষাও আর চাইবেন না কারও কাছে। শেষ বয়সে চাকরি করবেন। হ্যাঁ, পাহারাদারের চাকরি। ‘জাগতে রহো’ মন্ত্রে দীক্ষিত চৌকিদারের বৃত্তি। পারিশ্রমিক? হ্যাঁ, নেবেন না কেন? নেবেন! ওই একমুঠো চালের হবিষ্যান্ন। দিনান্তে একবার।
খড়্গটি ৺আনন্দময়ী মায়ের মন্দির থেকে এ ভিটেতে আদৌ পাঠাতে হয়নি। লোহার চিমটেটাই যথেষ্ট। তেমন-তেমন ক্ষেত্রে শিউজীর ত্রিশূলটা তো রইলই!
৩
কর্মবীর নন্দ চাটুজ্জে-মহাশয়ের অষ্টপ্রহর নানান কর্মচক্রে ঘননিবদ্ধ। সপ্তাহের সাতটি দিনই। শয্যা ত্যাগ করেন ব্রাহ্মমুহূর্তে। শয্যাসঙ্গিনী ছোট-খুড়ি তখন ভোঁসভোঁস করে ঘুমোয়। বড় আর মেজকে ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা অবসরপ্রাপ্তা। ধর্মকর্ম নিয়ে থাকেন। ছোট-খুড়ি দেড়কুড়ি পাড়ি দিয়েছেন। তিনি ৺মা কালীর ইচ্ছায় সন্তান উৎপাদনক্ষমা নন। না হলে এই দশ বছরে কর্তাকে অন্তত একটি সন্তানের মুখ দেখাতেন—খোকা-খুকু যাই হোক। হয়নি। ফলে, দেড়-কুড়ি বছর বয়সেও তাঁর ‘গতরে’ ঢিল ধরেনি। কিন্তু ওই এক রোগ। মহিষের মতো ভোঁসভোঁস ঘুম। তাও নীরবে নয়। সগর্জনে!
প্রাতঃকৃত্যাদি সেরে নন্দ পূজাঘরে চলে যান আহ্নিক সারতে। সেখানে প্রতিদিন প্রতীক্ষায় থাকে শ্যামা। শিবু কর্মকারের কিশোরী মেয়েটি। চতুর্দশী। তবে সেই অলক্ষ্য দেবদেবীর বদান্যতায় বয়স অনুপাতে তার দেহ কিছু পুষ্ট। সার্থকনামা কিশোরী। শ্যামাঙ্গিনী। বুড়ো-কর্তার জন্য পূজার ফুল তুলে সাজি-হাতে সে নিশ্চুপ প্রতীক্ষা করে রুদ্ধদ্বার মন্দিরের বাহিরে। কর্তামশাই এগিয়ে এলেই সাজিটি নামিয়ে রাখে মন্দির-চাতালে। স্পর্শ বাঁচিয়ে তা তুলে নেন নন্দ। কর্মকারতনয়া জল-অচল নয়। তার ছায়া মাড়ালে স্নান করতে হয় না। কর্তা ফুলের উপর গঙ্গাজল ছিটিয়ে সেটি হাতে নেন। দাদু-নাতনি সম্পর্ক। তাই কিছু রঙ্গরসিকতাও চলে।
নন্দ বলেন, এ কী রে? বেল-জুঁই-গন্ধরাজ এনেছিস, অপরাজিতা তো আনিসনি আজ? শ্যামামায়ের যে সেটাই সবচেয়ে প্রিয়।
শ্যামা নতনয়নে বলে, পাইনি, দাদু। ফোটেনি!
–কেন? রেল-জুঁইয়ের মতো রংটা ফর্সা নয় বলে? গন্ধ নেই বলে?
শ্যামা জবাব দেয় না। বুড়োকর্তা বলে চলেন, তোর গায়ের রঙও তো ওই শ্যামামায়ের মতো, অপরাজিতার মতো। তুই তো দিন দিন দিব্যি ফুটে উঠছিস!
মরমে মরে যায় শ্যামা। মুখটা নেমে যায় বুকের উপত্যকায়!
—তা হ্যাঁ রে, শ্যামা—অপরাজিতা ফুলের কাছে কি মুগ্ধ ভ্রমরের দল আসে না? পীরিত করতে? টুক চেখে দেখতে—ওর বুকেও মধু জমে আছে কি না পরখ করতে? তোর কী অভিজ্ঞতা?
শ্যামা দু-হাতে মুখটা ঢাকে। কর্তামশাই ওর সেই লাজে রাঙা মুখটা দেখে তৃপ্ত হন নিজের রসিকতায়।
পূজা-আহ্নিক সারতে একদণ্ড যায়। তারপর বার হয়ে এসে চলে যান স্নানাগার সংলগ্ন তৈলমর্দন-কক্ষে। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় নষ্ট হয়। অবশ্য সবটাই নষ্ট হয় না। আগে দামোদরে যেতেন অবগাহন স্নানে। তিন-কুড়ি পাড়ি দেবার পর এখন তোলা-জলেই স্নান সারতে হয়। এতদিন তৈলমর্দন করাতে আসত শচীপতি প্ৰামাণিক। ইদানীং তাকে ও-কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। পরামানিকের হাতের তালু বড় কর্কশ। সে শুধু ক্ষৌরি করেই ছুটি পায় আজকাল। শচীপতি শুধু নাপিত নয়, সে বাস্তবে ওঁর গোপন গুপ্তচর। সোঞাই গাঁয়ের অনেক বাড়িতে তার যাতায়াত। তাই অনেক বাড়ির কেচ্ছা-কাহিনির টাটকা খবর রাখে। সেগুলি গোপনে নিবেদন করে কর্তামশাইকে।
শচীপতি ক্ষৌরি করে বিদায় হলে আসে মোক্ষদা। নন্দর এক আশ্রিতা। বালবিধবা তৈলমর্দনের দায়িত্বটা ইদানীং তাকেই দেওয়া হয়েছে। আহা মরি সুন্দরী কিছু নয়, তবে হাতের তালুটা নরম। কর্তা একটি অঙ্গমার্জনবস্ত্র মাজায় জড়িয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকেন শ্বেতপাথরের মেঝেতে। মোক্ষদা প্রথমে গরম জলের সেঁক দেয়। বাতের ব্যাথায় বড় উপকারী। হাঁটুতে, জানুতে, জানুসন্ধির কাছাকাছি পর্যন্ত। মোক্ষদা নির্বিকার। তারপর কর্তামশাইকে তৈলমর্দন করতে হয়। বুকে, পিঠে, উরুতে।
স্নানান্তে বালভোগ। মা কালীর প্রসাদ। সেটি পরিবেশন করেন মেজগিন্নি। এ দায়িত্বটুকু তাঁর। স্বামীসেবার প্রান্তিক অধিকার। কর্তা প্রাতরাশ সমাপনান্তে গিয়ে বসেন বারমহলে। ব্যবসার খাতাপত্র দেখতে। প্রয়োজনে নানান স্থানে স্বাক্ষর ও পাঞ্জাছাপ দিতে হয়। এতদিন কাগজপত্র এগিয়ে দেবার কাজটার দায়িত্ব ছিল খাজাঞ্চির। ইদানীং বড়খোকার।
মধ্যাহ্ন-আহার পরিবেশনের দায়িত্ব ষোড়শীর অর্থাৎ বড়খুড়িমার। রন্ধন কার্যটার দায়িত্বে বামুনদিদি। কিন্তু কর্তার আহার্য-থালিকার সম্মুখে পাঙ্খাহাতে বসে থাকার অধিকার তাঁর প্রথমা পত্নীর। পাকাচুলে সিঁদুর পরে পট্টবস্ত্র-পরিহিতা সীমন্তিনীর এটুকুই স্বামীসেবার শেষ অধিকার।
দ্বিপ্রহরে কিছু যোগনিদ্রা। অপরাহ্ণে আবার গিয়ে বসেন বারমহলে। গ্রামের ইতর-ভদ্র আসেন। ঘরের বাইরে অপেক্ষা করেন। বড়খোকা তাঁদের একে একে ঘরের ভিতরে যাবার ছাড়পত্র দেয়। উনি শোনেন তাঁদের অভাব-অভিযোগের কথা। শরিকি বিবাদের নিষ্পত্তি করেন। খুড়োর বিরুদ্ধে ভ্রাতুষ্পুত্রের অভিযোগ, পুত্রবধূর বিরুদ্ধে শ্বশুরমশায়ের ফরিয়াদ। মন দিয়ে শোনেন। বিধান দেন। এককালে গাঁয়ের মানুষ এ জন্য বড়বাড়িতে যেত। কিন্তু এখন তো জমিদারমশাই একেবারে উদাসীন। তাই এই সামাজিক দায়িত্বের ষোলো-আনা বর্তেছে নন্দখুড়োর স্কন্ধে। কী আর করা যাবে? সমাজপতি হলে সামাজিক নানান ঝামেলা সইতে হবে বইকি।
এরপর বসে গ্রামপঞ্চায়েতের মজলিশ। আসেন অন্যান্য সমাজপতি—শিরোমণি, তারিণী ঘোষাল, কালিচরণ, শম্ভু দত্ত ইত্যাদি। সে আসরে মাঝে-মাঝে ধর্মতত্ত্বও আলোচিত হয়। সনাতন ব্রাহ্মণ্যধর্মের নানান উপকথা, অনুশাসন, উদাহরণ। সমাজপতির অন্বয়ব্যাখ্যা।
সেদিন কে একজন বেমক্কা প্রশ্ন করে বসল, আচ্ছা, মহাভারতের সবসেরা চরিত্র কোনটি?
শিরোমণি আগ বাড়িয়ে বলেন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ!
—আহা তিনি তো ভগবান! আমি মানুষদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তাই জানতে চাইছি। শিরোমণি বলেন, সেক্ষেত্রে বলব, কৃষ্ণসখা গাণ্ডীবী!
—আপনি কী বলেন, ঘোষালদা?
—আমার মতে গঙ্গাপুত্ৰ পিতামহ ভীষ্ম!
নন্দ হো-হো করে হেসে ওঠেন, এটা কী বললে ঘোষাল? ভীষ্ম? রামঃ! স্ত্রৈণ বাপের ল্যাকলাকানি দেখে যে অমন কাছাখোলা হয়ে যায়? তার তো বিয়ে করার হিম্মৎই হল না জীবনভর।
—তাহলে আপনার মতে শ্রেষ্ঠ চরিত্র কোনটি? কে শ্রেষ্ঠ পুরুষ?
যুক্তকর কপালে স্পর্শ করিয়ে নন্দ বলেন, নিঃসন্দেহে ব্যাসদেব! দেখ, লোকটার হিম্মৎ! ব্রহ্মচারী মানুষ—মানে ওই ‘ঊর্ধ্বরেতা’ বলতে যা বোঝায়। কিন্তু দৈবক্রমে তিন-তিনটি পুত্রবধূকে পেয়ে গেলেন কব্জার ভিতর! একটি অবশ্য পাঁকাল মাছের মতো পিছলে গেল। বাকি দুটিকে পরপর দু-রাত্রে পুত্রবতী করে তুললেন। অথচ স্ত্রী-সংসর্গের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তাঁর! উপরন্তু বিদুর-জননীকে। পর-পর তেরাত্রিতে তিনটি যুবতীকে সন্তানবতী করে ফেললেন! মহাপুরুষ যাকে বলে!
শিরোমণি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের বহু স্তবস্তুতি শুনেছেন। কিন্তু এমন বিচিত্র ব্যাখ্যা কোনো পণ্ডিতের মুখে শোনেননি।
নন্দখুড়ো একনাগাড়ে বলেই চলেন, বলি, তোমরা শাস্তর-বাক্য মানো তো? শাস্তর বলছেন, “নাল্পে সুখম্ হস্তী/ভূমৈব সুখম্।।” অর্থাৎ কিনা, হস্তী কদাচ স্বল্পাহারী হয় না। তাকে ভরপেট খাইয়ে রাজপথে ছেড়ে দাও—দেখবে সে হেলতে-দুলতে চলেছে আপনমনে। কিন্তু যেই তার নজরে পড়বে আশপাশের কোনো গেরস্ত-বাড়িতে ডবগা কলাগাছ মাথা তুলেছে, কচি কলাপাতা বাতাসে দুলে-দুলে ওকে ডাকছে, অমনি সে থমকে থেমে যাবে। সড়াৎ করে শুঁড় বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরবে কলাগাছটির কোমর। তাকে সমূলে উৎপাটন করে কচড়-মচড় করে চিবিয়ে শেষ করবে।
‘নাল্পে সুখম্ হস্তী’ শ্লোকের এই সরল ও সরস ব্যাখ্যা শুনে শিরোমণির চোয়ালের নিম্নাংশ ঝুলে পড়েছিল। তবে নাকি তিনি নন্দদাদার একান্ত ভক্ত, তাই রা-কাটেননি।
সন্ধ্যা সমাগমে সন্ধ্যাহ্নিক। গায়ত্রী মন্ত্র একশ আটবার। আরও কিছু অর্থহীন অং-বং-চং! তারপর শয়নের ব্যবস্থা। নৈশাহারের আয়োজন সেখানে। ছোটখুড়িমার একান্ত তত্ত্বাবধানে। এবার আর অন্ন নয়। ঘৃতপক্ক লোচিকা। তৎসহ মহাপ্রসাদ। পরমান্ন বা মিষ্টান্ন সেবা শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। কারণ? কারণ, কারণবারির সঙ্গে মিষ্টান্নের সহবাস শাস্ত্রবিরুদ্ধ। রাঢ়ী-বারিন্দিরের মতো।
এটা তো গেল ওঁর প্রকাশ্য নিত্যকর্মপদ্ধতির ফিরিস্তি। কিন্তু ওই বৃদ্ধের বুকে যে এক দীর্ঘদিনের বেদনাময় স্মৃতি লুকিয়ে আছে, এ-খবরটা কেউ কি রাখে? কিছুটা আন্দাজ করেছিল সরি—মানে ষোড়শী—ওঁর বড়বউ। সে কিছু বাঁকা প্রশ্নও করেছিল তাই নিয়ে। সেই পাপেই কর্তামশাই দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করেন। ষোড়শী বস্তুত অন্দরমহলে নির্বাসিতা হয়ে যায় বাকি জীবনভর। সে কাহিনিটি বড় করুণ। বড় বেদনার :
নন্দের পিতৃবিয়োগ হয় কৈশোরকালে। এতবড় ব্যবসা আর তেজারতি কারবার তাঁকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন ওঁর মামা তালুকদারমশাই। তিনিই নন্দের প্রথম বিবাহের সম্বন্ধ করেন। জ্যেষ্ঠা বধূমাতাকে নির্বাচন করে ঘরে আনেন।
নন্দের বয়স তখন সতেরো। বধূটি বালিকামাত্ৰ : একাদশ।
এখনো মনে পড়ে যায় বাসরঘরের কৌতুককথা। মাথায় টায়রা, নাকে নোলক ঝুলিয়ে বালিকাবধূ বসে আছে পাশে। এক-গা গহনা পরে। বেনারসীর একটা পুঁটুলি। বাইরে সানাই বাজছে। ভেসে আসছে কোলাহল। এক দিদিশাশুড়ি ওদের দুজনকে নিয়ে কড়ি খেলাচ্ছেন। বিচিত্রবর্ণা প্রজাপতির মতো একঝাঁক সুন্দরী ঘিরে আছে বাসর। ঠানদি নাতনির তরফে কড়িগুলি লুকিয়ে রাখছেন। কখনো নববধূর আঁচল-আড়ালে, কখনো হাঁটুর তলদেশে। নন্দকে তা খুঁজে খুঁজে বার করে আনতে হচ্ছিল। কোথাও কিছু নেই একটি যুবতী বলে ওঠে, ‘আপনি খেলা ভুলে গেছেন, ঠানদি। আপনি সরে বসুন। আমি খেলাচ্ছি। দেখি, জামাইয়ের কতটা হিম্মৎ!”
দ্যাখ-না-দ্যাখ একমুঠি কড়ি তুলে নিয়ে সে ফেলে দিল নববধূর বক্ষাবরণের অন্তরালে। একাদশবর্ষীয়ার পক্ষে সে রেশমী বস্ত্রখণ্ডের প্রয়োজন আদৌ আছে কি না নন্দ জানে না। কিন্তু সর্বসমক্ষে সেই গোপন বস্ত্রান্তরালে হস্তসঞ্চালনেও সঙ্কোচ হয়। নন্দ বলেছিল, হার মানছি! আমি খুঁজে দিতে পারব না!
খিলখিল করে হেসে উঠেছিল সেই প্রগল্ভা যুবতী। বলে, পারব না বললে আমরা মানব কেন, ভাই? খুঁজে বার করতেই হবে!
সমস্যার সমাধান হয়ে গেল বালিকাবধূর সহায়তায়। সে নিজেই কড়িগুলি বার করে দিল। নন্দ তাকিয়ে দেখল মেয়েটির দিকে। ওর চেয়ে বছর তিনেকের বড়ই হবে। তার অঙ্গে কোনো আভরণ নাই। তবে অনঙ্গদেব অলঙ্কারের অভাব পুরিয়ে দিয়েছেন তাঁর অকৃপণ দানে।
কুন্দফুলের মতো সুন্দর মুখ। গৌরবর্ণা, বিনা কাজলেই কাজল-কালো দুটি খঞ্জন- নয়ন। কৌতুকপ্রিয়া। চঞ্চলা, অভাগিনী।
শুনল, তার নাম সদু—সৌদামিনী—ষোড়শীর দিদি। বালবিধবা। অপাঙ্গে দৃষ্টি হেনে সে বললে, তুমি কোনও কাজের নও, জামাইভাই! এত সহজেই হার মেনে নিলে?
নন্দ সাহস পেয়ে বলেছিল, আপনার বর হার মানেনি?
—মোটেই না! সে ঠিক খুঁজে খুঁজে বার করেছিল। আমি তো আর এই ছুট্কির মতো বোকা ছিলাম না যে, নিজেই বার করে দেব?
নন্দ ফস্ করে বলে, তখন আপনার বয়স কত?
—সে খোঁজে তোমার কী দরকার গো? যা জিগ্যেস করি তার জবাব দাও দিনি। কড়ি তো খুঁজে বার করতে পার না। তা, পুতুল বানাতে পার?
—পুতুল? মাটির পুতুল?
—কী দিয়ে বানাতে হবে সেটা তো কারিগর জানে! আমি তার কী জানি?
ঘরসুদ্ধ সবাই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। নন্দ বুঝতে পারে তির্যক রসিকতার গূঢ়ার্থ। বলে, পারি, তবে কিছুটা সময় লাগবে। এসব তাড়াহুড়ার কাজ নয়।
—বটে! তা কতটা সময় লাগবে গো, কারিগর?
আর একজন তরুণী সীমন্তিনী জানতে চায়, কী পুতুল বানাবে গো? খোকা না খুকু?
নন্দ বলেছিল, কী জানেন দিদি, পুতুল কখনো একাহাতে বানানো যায় না! আপনাদের বোন সাহায্য করলেই বানিয়ে ফেলব।
সৌদামিনী বলেছিল, জামাই তো ভারি মুখফোঁড়। এক্কেরে বেহায়া!
৪
সে-কালীন আইনে ফুলশয্যা হয়েছিল পাক্কা পাঁচ বছর পরে। নন্দ তখন বাইশ, নববধূ সার্থকনামা : ষোড়শী। দ্বিরাগমনে ও ফিরে গেল শ্বশুরবাড়ি। ফুলে-ফুলে ঢাকা পালঙ্ক। আজও সানাই বাজছে বাড়ির বাহিরে। অলঙ্কারে সর্বাঙ্গে আবৃত করে সেই ফুলশেযের উপর আলতারাঙা পা ঝুলিয়ে বসেছিল নববধূ। আজও তাকে ঘিরে একঝাঁক প্রজাপতি। তাদের অতি প্রিয় একজনের নারীজন্ম আজ রাতে সার্থক হতে চলেছে। নানান কৌতুক, রঙ্গ-রসিকতা। সৌদামিনী দুটি গোড়ের মালা হাতে আগিয়ে আসে। বর ও বধুর হাতে দিয়ে বলে, এবার তোমরা মালা-বদল কর। আমরা নয়ন সার্থক করি।
নন্দ বলে, মালা-বদল তো পাঁচ বছর আগেই হয়েছে।
—তা হয়েছে। আজ রাত্রে তো শুধু মালাবদল’ নয়, ‘পালাবদল’ও হবে। সেটা তো দেখতে দেবে না। তাই মালাবদল দেখেই আমরা খুশিমনে সবাই চলে যাব। কী বলিস রে তোরা?
আর একটি প্রগল্ভা বলে ওঠে, তা কেন? জামাইদাদা আমাদের গান শোনাবে। তারপর আমরা বিদেয় হব।
নন্দ বলেছিল, মাপ করবেন। গান আমি জানি না।
সৌদামিনী তৎক্ষণাৎ বলেছিল, তবে কী জান? তুমি একটা অকম্মার ধাড়ি। একাহাতে পুতুল বানাতে পার না, আবার গানও গাইতে জান না?
সেই ফুলশয্যা রাত্রির কথা ভুলতে পারেননি নন্দ। সেই প্রথম একটি পূর্ণযৌবনা নারীদেহের দখল পেলেন একান্ত নির্জনে। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য নতুন জামাইয়ের-তার জীবনসঙ্গিনী অতিমাত্রায় ব্রীড়াবনতা। শম্বুকবৃত্তির লাজুক। ষোলোটি বসন্ত চোখ মেলে দেখেছে, অথচ এখনো তার যৌবনের স্বাভাবিক কামনা-বাসনা উদগ্র হয়ে ওঠেনি। কথা বলছে, হাসছেও, রঙ্গ-রসিকতাতে যোগদানও করছে—কিন্তু গায়ে হাত ছোঁয়ালেই সে আড়ষ্ট হয়ে উঠছে : না! না! না!
এ কী বিড়ম্বনা! মুখে-মুখে একটা চুমু পর্যন্ত খেতে দিল না সারারাতের মধ্যে! নন্দর ইচ্ছে করছিল ঠাস করে ওর গালে একটা চড় মেরে বলতে : তবে বিয়ে করলি কেন রে হারামজাদি! নেকী!
বলেনি। বুঝে নিয়েছিল সবুরে মেওয়া একদিন ফলবেই!
রাত ভোর হল। শোনা গেল পাখির কলতান। নববধু তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। অথচ সারারাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি নন্দ! এ কী আতান্তরী!
রাত ভোর হতেই আবার হুড়মুড় করে ফিরে এল প্রজাপতির ঝাঁক। ষোড়শী ধড়মড় করে উঠে বসল। ছুটে পালিয়ে গেল অন্য ঘরে। সংলগ্ন স্নানাগারে মুখ প্রক্ষালন করে ফিরে এসে নির্জন ঘরে পালঙ্কের উপর উঠে বসল নন্দ। ফিরে এল সৌদামিনী। তার এক হাতে কাঁসার থালায় ঘৃতপক্ক লোচিকা আর নানান মিষ্টান্ন। অপর হস্তে তরমুজের সরবত। পাথরের মেঝেয় আসন পেতে সে আহ্বান জানাল নন্দকে। নন্দ বলে, আপনি খেয়েছেন?
—তাই কি পারি? নতুন জামাইকে অভুক্ত রেখে? কিন্তু কই আমার শয্যাতুলুনি তো দিলে না ভাই?
—শয্যা তুললেন কোথায়? কাল সন্ধ্যারাতে পালঙ্ক যেমন ছিল তেমনই তো আছে!
—ন্যাকামি কর না, নন্দ! আমি কি অন্ধ? সন্ধ্যারাতে চাদরটা ছিল টান-টান। এখন কুঁচকে একশা! সন্ধ্যাবেলায় দেখেছিলাম টাটকা ফুল-বেল, জুঁই, করবী, বকুল! আর এখন? দলিত-মথিত! বল, মিছে কথা বলছি?
—এ প্রশ্নের জবাব আপনার বোনের কাছে জেনে নেবেন! আমি তো কোনো প্রভেদ বুঝছি না।
তারপর এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে নিম্নস্বরে বলে, আপনার বোনকে এত কিছু শিখিয়েছেন আর এটুকু শিখিয়ে দেননি যে, বর ফুলশয্যার রাত্রে…
—রাত্রে?
—চুমু খায়!
ম্লান হয়ে গেল সৌদামিনী। অবাকও। বলল, সত্যি?
নন্দ বিদ্যুৎবেগে ওর দক্ষিণ বাহুমূল চেপে ধরে দৃঢ়মুষ্টিতে। বলে, এই আপনার গা-ছুঁয়ে বলছি।
কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। বললে, হাত ছাড়। কারা যেন আসছেন!
নন্দ সংযত হয়ে বসে। তখনি ঘরে প্রবেশ করলেন আরও কয়েকজন আত্মীয়া। কে একজন বললেন, ওকে একা কেন খেতে দিয়েছিস সদু? এখন যে ‘জোড়’-এ খেতে হয়। এ ওকে খাইয়ে দেয়।
সৌদামিনী কেমন যেন শিউরে উঠেছিল নন্দের দৃঢ়মুষ্টির নিষ্পেষণে। এতক্ষণে সামলেছে। বললে, সে কি ঘুম থেকে উঠেছে ঠানদি? ও ঘরে গিয়ে আবার ঘুমুতে শুরু করেছে।
ঠানদি বলেন, তা ওর কী দোষ? দোষ তো জামাইদাদার! দেখ না, ফুলশেযের পালংটা এক্কেরে তছনছ করে ছেড়েছে। সারারাত বোধহয় ঘুমুতে দ্যায়নি নাতনিটারে!
বেলা বাড়ছে। অনেকে এলেন নতুন জামাই দেখতে। পর্যায়ক্রমে তাঁদের প্রণাম করতে হল। তারপর আগন্তুকদের ভিড় কিছুটা পাতলা হল। ষোড়শীর দেখা নেই। সৌদামিনী আবার এল ডাকতে, চল নন্দভাই, ছানটা করে নেবে এবার।
—দামোদরে?
—না। প্রথম দিন তোলা-জলেই ছান করতে হয়। ছানঘরে হাণ্ডায় জল ভরা আছে। এস আমার পিছু পিছু
প্রাসাদের একান্তে বাগানের ধারে স্নানঘর। সচরাচর মহিলারাই ব্যবহার করেন। পুরুষেরা যায় দামোদরে, অবগাহন স্নানে। তবে আজ নাকি একটা বিশেষ দিন। তাই এই ব্যবস্থা। সুগন্ধী শীতল সলিলে স্নান। একজন ভৃত্য শ্রেণির লোক ইতিপূর্বেই বস্ত্ৰ এবং অঙ্গমার্জনবস্ত্র ইত্যাদি সাজিয়ে রেখে গেছে। নন্দ এগিয়ে যায় সদুর পিছন পিছন জায়গাটা অপেক্ষাকৃত নির্জন। কাঁঠালতলার একান্তে। স্নানঘরের মাথা খোলা, পাথরের মেঝে, কাঠের পাল্লা। দরজার কাছাকাছি এসে সদু সরে দাঁড়াল। বললে, ওই হাণ্ডাটায় গোলাপজল মেশানো আছে, আর এইটায় সাদা জল। আগে সাদা জলে ছান করে তারপর গোলাপজল গায়ে ঢালবে। তাহলে সুগন্ধ হবে। নতুন জামাইয়ের একটা সৌরভ থাকা চাই!
হঠাৎ মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি চাপল নন্দর। প্রশ্ন করে, কোনটায় সাদা জল? ঠিক বুঝতে পারলাম না।
—সরো। দেখিয়ে দিই।
নন্দ পাশ দিল। সৌদামিনী স্পর্শ বাঁচিয়ে প্রবেশ করলে স্নানঘরে। হাণ্ডায় হাত দিয়ে বললে, এইটেয় গোলাপজল, আর এইটেয় সাদা জল। এবার বুঝলে হস্তিমূর্খ?
কিন্তু চোখাচোখি হতেই তার মুখ শুকাল। নজর হল, নন্দ নিঃশব্দে স্নানঘরের পাল্লাটা ভিতর থেকে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষুদ্র কক্ষে ওরা দুজন বন্দি-বন্দিনী!
—একী করছ? তুমি…তুমি….আমাকে….
চাপাগলায় নন্দ বলে, সারারাত তৃষ্ণায় বুক ফেটে গেছে সদু! আগে আমার তেষ্টাটা মিটিয়ে দাও, লক্ষ্মিটি!
—মানে? এ কী বলছ তুমি?
ততক্ষণে দুই দৃঢ়মুষ্টিতে নন্দ ধরে ফেলেছে সৌদামিনীর দুই বাহুমূল। টেনে নিয়েছে তাকে নগ্ন বক্ষে। ওই বিধবার যৌবনপুষ্ট ঊর্ধ্বাঙ্গ ওর কবাটবক্ষে নিষ্পেষিত হচ্ছে—মিলনবঞ্চিতা যুবতীর যৌবনের উপেক্ষিত যুগ্মজয়স্তম্ভ। প্রথমটা সে অবাক হয়েছিল। পরক্ষণেই তার কী একটা পরিবর্তন হল! নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল নতুন জামাইয়ের নিরাবরণ পৃষ্ঠদেশ। সদ্যপ্রস্ফুটিত কুসুমকলির মতো উন্মুক্ত হয়ে গেল তার চুম্বনভূষিত অধরোষ্ঠ! নিবিড় চুম্বন! সৌদামিনী স্বেচ্ছায় শুধু দিল না। সেও পান করল। নন্দর তৃষ্ণা তো মাত্র একটি রাত্রের। আর ওর? সাত বছরের তৃষ্ণা সেই আবাগি যে এতদিন বুকে বহে বেড়াচ্ছে। আবৈধব্যকাল!
৫
ফুলশয্যার পর আরও তিনটি রাত ছিল শ্বশুরালয়ে।
দ্বিতীয় দিন সকালে সৌদামিনী যথারীতি নিয়ে এল প্রাতরাশ। আসন পেতে ওকে বসতে আহ্বান করল। কালকের বিচিত্র অভিজ্ঞতার আভাসমাত্র নেই। নন্দ মুখ ফিরিয়ে রইল। জবাব দিল না।
—কী হল? ছুট্কি কি এখনো স্বাভাবিক হয়নি?
—ও একটা মনের অসুখে ভুগছে। আমি ওকে নিয়ে যাব না। একাই ফিরে যাব। আবার বিয়ে করব আমি।
বেদনার্ত হয়ে উঠল সৌদামিনীর মুখ। বলে, ছিঃ! ও-কথা বলতে নেই। এ তো দু-চার দিনের ব্যাপার। আমি আজ সকালে ওকে অনেক বুঝিয়েছি। মাকেও বলেছি। তিনি খুব বকাবকি করেছেন। একটু ধৈর্য ধর, ভাই!
নন্দ বললে, খাবার ফিরিয়ে নিয়ে যান। আমার ক্ষিদে নেই। খাব না।
সৌদামিনী এসে বসল পালঙ্কে। যথেষ্ট দূরত্ব রেখে। সঙ্কোচ করল না। খোলাখুলি নিম্নকণ্ঠে প্রশ্ন করল, কাল রাতে চুমু খেতে দেয়নি?
—না! ও ঘুমিয়ে পড়ার পর ওর পিঠের দিকে কাঁচুলির ফাঁসটা আলগা করে দিতে গিয়েছিলাম। ও তড়াক করে উঠে বললে, এমন অসভ্যতা করলে আমি ও ঘরে গিয়ে শোব।
সৌদামিনীর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। নিম্নস্বরে বললে, বুঝতে পারছি তোমার অবস্থাটা। ওর মনটা এখনো কাঁচা। কারও কারও দেরিতে হয়। একটু ধৈর্য ধর ভাই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
—আপনার ফুলশয্যা হয়েছিল কত বছর বয়েসে?
–পনেরো। তোমার ভায়রা-ভাইয়ের বয়স তখন উনিশ।
—আপনি দাদাকে চুমু খেতে দেননি, ফুলশয্যার রাত্রে?
ম্লান হাসল সৌদামিনী। বললে, তার কথা থাক। আমার তো কোনো মনের অসুখ ছিল না। ছুট্কিও ভাল হয়ে যাবে, স্বাভাবিক হয়ে যাবে। স্ত্রীর অসুখে স্বামী কি সেবা করে না?
—কে আমার স্ত্রী? ওই কাঠের পুতুলটা?
—না, না! কাঠের পুতুল নয়। আমরা ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে….
—আমি আর একটা রাত দেখব। ওর যদি কোনো পরিবর্তন না হয়, ওকে রেখে ফিরে যাব। আপনারা ওকে কোনো আশ্রম-টাশ্রমে ভর্তি করে দেবেন।
শাশুড়ি আর দিদিশাশুড়ি এসে পড়ায় আলোচনায় ছেদ পড়ল।
তৃতীয় রাত্রেও সেই একই অভিজ্ঞতা। সরি তার বাল্য-কৈশোরের অনেক গল্প শোনাল। তার ‘গঙ্গাজলে’র কথা। খুব বন্ধুত্ব ছিল সই-এর সঙ্গে। এখন শ্বশুরবাড়িতে থাকে। তার একটি ফুটফুটে খোকাও হয়েছে। ছেলেবেলায় একটা বিড়াল পুষেছিল—মুন্নি। মারা গেছে সেটা। নন্দও তার বাল্য-কৈশোরের নানান কাহিনি শুনিয়েছে। কিন্তু দৈহিক সান্নিধ্যে আসার প্রচেষ্টামাত্র নববধূ কঠোর হয়ে গেছে। নন্দ রাগ করে বলেছিল, তোমার বাবাকে বল, নামটা তিনি ভুল দিয়েছিলেন। তোমার নাম ‘ষোড়শী’ নয়। শীতলা!
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল নববধূ। কথা বলতে পারেনি।
রাত্রি গভীর হল। দ্বিতীয়বার শিবাধ্বনিও হয়েছে। পাহারাদার হেঁকে গেছে : ‘জাগ্তে রহো’। নন্দ জেগেই আছে, যদিও তার শয্যাসঙ্গিনী অঘোর ঘুমে অচেতন। হঠাৎ মৃদু করাঘাত হল দ্বারে।
নন্দ চমকে উঠে বসে। মশারি সরিয়ে ধীরপদে এগিয়ে আসে দোরের কাছে। সন্তর্পণে নিচু গলায় বলে, কে?
—আমি। দোর খোলো।
নিঃশব্দে অর্গলমোচন করে বলে, কী ব্যাপার? এত রাতে?
—তোমাদের বালিশের পাশে হাতপাখাটা রাখতে ভুলে গেছিলাম। নাও, এটা ধর।
পাখাসমেত ওর নিরাভরণ হাতটা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে ফেলল নন্দ।
—ছুট্কি?
—অঘোর ঘুমে অচেতন!
—আজও কি সে তোমাকে….
—এ রক্তমাংসের জীব নয়। স্রেফ চ্যালাকাঠ!
সদুর দীর্ঘশ্বাস পড়ে। নিম্নস্বরে বলে, হাতটা ছেড়ে দাও লক্ষ্মিটি। ওর যদি ঘুমটা ভেঙে যায়?
নন্দ মুখটা নামিয়ে আনার উপক্রম করতেই বাধা দিয়ে বলে, এই না। এখানে না।
—তবে কোথায়?
—ঘরের বাইরে এস। দোরটা টেনে দাও। কিন্তু স্রেফ একটা আলতো চুমু। তার বেশি কিছু চাইবে না।
আকাশে শুক্লা একাদশীর চাঁদ পশ্চিমে ঢলেছে, বারান্দাটা আলো-আঁধারি। সৌদামিনী গজগমনে সামনে চলতে থাকে। নন্দ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ওর কর্ণমূলে বলল, বাঃ তুমি তো বেশ! কথা দিয়ে কথা রাখছ না?
অগ্রবর্তিনী তার অধরোষ্ঠে তর্জনী স্পর্শ করে। ইঙ্গিতে যেন ওকে বলছে অনুসরণ করতে। নন্দ বোঝে, ওটা ছিল শুধু মুখের কথা! আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে ওই অভিসারিকা হয়তো একক শয্যায় ছটফট করেছে। হাতপাখা দিতে আসা একটা অজুহাতমাত্র।
নিজের শয়নকক্ষে নন্দকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। সন্তর্পণে অর্গলবদ্ধ করে দরজাটা। খোলা জানলা দিয়ে একমুঠো জ্যোৎস্না এসে লুটোপুটি খাচ্ছে ওর বিছানায়। নজর হল সেখানে একটি শিশু। ঘুমে অচেতন। সদু তাকে সাবধানে ওপাশে সরিয়ে বললে, স্রেফ একটি চুমু কিন্তু। আর কিছু চাইবে না। কথা দিয়েছিলে তুমি।
নন্দ ওর কর্ণমূলে বলে, বাজে কথা বোলো না। ও-কথা আমি আদৌ বলিনি।
বলতে বলতে ওকে টেনে নেয় বুকে। আবেশে অভিসারিকার চোখ দুটি মুদে আসে। চুম্বনরত অবস্থাতেই দুজনে বসে পড়ে পালঙ্কে। সৌদামিনী হাত বাড়িয়ে শিশুটিকে ওপাশে ফিরিয়ে কিছুটা জায়গা করে নেয়। আধো-জ্যোৎস্নায় নন্দর হাতটা চলে যায় ওর নাভিমূলের দিকে। নীবিবন্ধের গ্রন্থিতে হাত পড়তেই সৌদামিনী বলে, এই অসভ্য! ওটা কী হচ্ছে?
বলে বটে তবে বেশ বোঝা যায় যে, সেটাও ওর মৌখিক ছদ্ম-আপত্তি।.যেন ঘৃতনিক্ষেপে অগ্নি-নির্বাপণের প্রয়াস।
অতর্কিতে যেন ঘনিয়ে এল কালবৈশাখীর ভীমতাণ্ডব! ঝড়ের আন্দোলনে আশঙ্কা হচ্ছিল বুঝি উন্মূলিত হবে তরুণী তরুটি। হল না। শিকড়জাল বিস্তার করে সে সবলে আঁকড়ে থাকল। ক্রমে প্রভঞ্জনের বেগ হল স্তিমিত। শুরু হল বর্ষণ। থামল তাও। আকাশ আর ধরণী যেন একই খণ্ডমুহূর্তে পূর্ণাহুতি দিল আনন্দযজ্ঞে! কিছুক্ষণ দুজনেই পড়ে রইল আলিঙ্গনাবস্থায়। তারপর পৃথিবী যেন আকাশকে বললে, অনেক তো হল, এবার ছেড়ে দাও, লক্ষ্মিটি!
ত্রস্তপদে সাবধানে অনুসরণ করে নন্দ ফিরে এল নিজ শয়নকক্ষে। যে কক্ষে নববধূ ঘোর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। দ্বারপ্রান্তে সৌদামিনী ওর বাহুমূল চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে ওঠে, ইতিমধ্যে ছুট্কির যদি ঘুম ভেঙে গিয়ে থাকে?
নন্দও নিম্নকণ্ঠে জবাবে বলে, ওকে বলব প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেছিলাম।
মুখে আঁচলচাপা দিয়ে কৌতুকময়ী বলে, সেটা মিছে কথাও হবে না। পুরুষসিংহ তো এভাবেই প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দিতে ছুটে যায়। যায় না?
*
পরদিন সৌদামিনীকে দেখে কে বলবে পূর্বযামিনীতে তার দামিনীর দমক! নন্দ জনান্তিকে বলে, দিদি, আপনিও চলুন না আমাদের সঙ্গে? মাকে বলুন, এক সপ্তাহের জন্য সোঞাই যাচ্ছেন। বোনটিকে তালিম দিতে। আমি নিজেই আবার আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব। দিবাভাগে নির্জনেও সে ওকে ‘দিদি’ ডাকে। ‘আপনি’ বলে কথা বলে। সাবধানের মার নেই!
সৌদামিনী বলে, তা হয় না ভাই। সেটা খুব বিসদৃশ দেখাবে।
–দেখাবে না। ওঁরা তো জানেনই যে, সরি ঠিক স্বাভাবিক নয়।
—ওঁরা রাজি হলেও আমি রাজি নই।
একটু আহত হল যেন। বলে, আমি কি অজান্তে কোনো অপরাধ করে বসেছি?
—না! বোঝ না কেন? আমি যে নিজেই জ্বলে-পুড়ে মরছি তা বুঝতে পারনি কাল রাতে?
—তাহলে?
—আমাকে কাছে পেলে তুমি ওই হতভাগী কাঠের পুতুলটার দিকে ফিরেও চাইবে না।
নন্দ বোঝে, ও শুধু রমণপটিয়সীই নয়, দারুণ বুদ্ধিমতী। বলে, তাহলে আবার কবে আমাদের দেখা হবে?
—মাসতিনেক পরে। আমি নিজেই যাব। বোনের তত্ত্বতালাশ নিতে। যদি তুমি কথা দাও এই তিন মাসের মধ্যে অধৈর্য হয়ে টোপর কিনতে ছুটবে না।
—কথা দিলাম। আপনিও দিলেন কিন্তু। আষাঢ় মাসের মধ্যে যদি আপনার দেখা না পাই, তাহলে সত্যিই আমি টোপর কিনতে ছুটব। সেক্ষেত্রে দোষটা হবে আপনার
—কথা দিলাম। শাস্তি : তিন মাসের কারাযন্ত্রণা।
—কার? আপনার না আমার?
—বুঝ লোক যে জান সন্ধান!’
নন্দ বোঝে। বোঝে যে, তার ভায়রাভাই নববধূকে অন্তত ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ টা পড়ে শুনিয়েছে। কারণ সৌদামিনী অন্যান্য কাজে যতই পটু হোক—অক্ষর-পরিচয়হীনা। নন্দের পড়াশুনা যদিও কম, তবু বিদ্যাসুন্দরটা সে বারেবারে পড়েছে।
*
তিনমাস পরে সৌদামিনী তার এক খুড়তুতো ভাইকে সঙ্গে করে সত্যই এসে হাজির। সোঞাই গাঁয়ে। ততদিনে অবশ্য সরি পোষ মেনেছে। প্রতি রাত্রেই তৃপ্ত করছে তার বরকে। সৌদামিনীকে পেয়ে সরি উচ্ছ্বসিত। নন্দ ততোধিক! খুড়তুতো ভাইটি একটি চতুষ্পাঠীর ছাত্র। দিনচারেক সোঞাই গাঁয়ে আপ্যায়িত হয়ে নিজের অশ্বপৃষ্ঠে স্বগ্রামে প্রত্যাবর্তন করেছিল। কথা হল, জামাই কিছুদিন পরে স্বয়ং সৌদামিনীকে তার পিত্রালয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
সরি তার দিদিকে সারাদিন আগলে রাখে। স্বামীগরবিনী ক্রমাগত বকবক করে তার অনাবিল আনন্দের বিবরণ দেয়। অসপত্ন অধিকারে সে লাভ করেছে একটি যুবকের একান্ত প্রেম। সচ্ছল পরিবার। কোনো দিকে কোনো অভাব নেই। স্বামীর কোনো বদ নেশা নেই। বাইজি নেই, বাগানবাড়ি নেই। সন্ধ্যার পর একটু মাকালীর চরণামৃত পান করে, এই যা। তিন-তিনটি দিন কেটে গেল, জনান্তিকে সৌদামিনীকে একবারও পেল না।
তারপর একদিন সুযোগ এল। বেলা দ্বিপ্রহর। সরি স্নানঘরে। সৌদামিনী এল নির্জন কক্ষে একান্ত সাক্ষাতে। নন্দ ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। বাধা দিল সৌদামিনী : এখন ওসব নয়!
—মানে? এতদিন পরে দেখা! এমন করছ কেন?
শোন নন্দ! তোমার কাছে ছুটে এসেছি অত্যন্ত বিপদে পড়ে। পারলে তুমিই আমাকে বাঁচা–তে পারবে!
—বিপদ! কী বিপদ?
—আমি…আমি…কীভাবে কথাটা বলি?
নন্দ ওর হাতটা ধরে বলল, এমন করছ কেন সদু! কী হয়েছে?
—আমি ‘মা’ হতে বসেছি!
—মা!!
বজ্রাহত হয়ে গেল নন্দ! বলে, কী করে বুঝলে?
—যেমন করে সবাই বোঝে! দু-মাস আমার মাসিক বন্ধ। ইদানীং গা-ও গুলাতে শুরু করেছে। সেজন্যেই ছুটে এসেছি তোমার কাছে। যা হয় একটা ব্যবস্থা কর ভাই। না হলে আমার গলায় দড়ি দিতে হবে!
—না, না, সে কী কথা! আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি! ভাবনার কী আছে? আমি তো বেঁচে আছি। আমার বিশ্বস্ত একজন গুনিন আছে। এ কাজে দড়। একটা শিকড় এনে দিচ্ছি। বেটে খেতে হবে। তিন দিনেই খালাস হয়ে যাবে!
—জানাজানি হয়ে যাবে না তো?
—পাগল! কাকপক্ষীতে টের পাবে না।
—আমার…আমার শরীরে কোনো ক্ষতি হবে না তো?
—দিন-তিনেক স্রাব-ট্রাব হবে। সে তো মেয়েদের হয়েই থাকে আকছার
—ছুট্কি কিছু আন্দাজ করবে না তো?
—কেমন করে করবে? সে কি জানে যে তার বর লুকিয়ে-লুকিয়ে তোমার মধু খায়! শোন, আজ রাত্রে সরি ঘুমিয়ে পড়লে তোমার ঘরে যাব। ঠিক মধ্যরাত্রে। বড় বাড়ির পেটা ঘণ্টায় মাঝরাতের বারোটার ঘণ্টা বাজা থামলেই। তুমি জেগে থেক। আর দরজাটা খুলে রেখ। ভয় নেই, আর কোনো চোর মধু খেতে তোমার ঘরে ঢুকবে না।
সৌদামিনী রাজি হল না। বললে, না! এ হাঙ্গামা মিটুক, তারপর ওসব কথা চিন্তা করা যাবে।
—আমার যে আর ধৈর্য মানছে না সদু!
সৌদামিনী কঠোর দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে দেখল। বললে, বোঝ না কেন? তুমি তো ঘরের কোণে প্রতি রাত্রেই ভরাপাত্রটা পাচ্ছ। আর আমি? কিন্তু আর নয়। ছুট্কি হয়তো এখনি এসে পড়বে। তা কখন শিকড়টা এনে দেবে?
–না, শিকড় বাটতে হবে না তোমাকে। আমি নিজেই দুটো বড়ি তৈরি করে নিয়ে আসব। রাত্রে আহারাদির পর বড়ি দুটো গিলে ফেল। ব্যস। পরদিন সকাল থেকেই স্রাব শুরু হয়ে যাবে। একরাত্রেই খালাস।
৬
তাই হয়েছিল সৌদামিনীর। একরাত্রেই খালাস।
সে কোনো স্বীকৃতিপত্র লিখে যায়নি। কেন এমনভাবে কাউকে কিছু না বলে আত্মহত্যা করল! কেউ জানতেও পারেনি। আন্দাজও নয়। শুধু কিছুটা আঁচ করেছিল সরি। নন্দের আছাড়ি-পিছাড়ি মেকি-কান্না দেখে। এ বাড়িতে অমন তীব্র বিষ দিদি কোথায় পেল? কেমন করে পেতে পারে? কে জানে, কোনও অসতর্ক মুহূর্তে সে হয়তো কিছু অশোভন দৃশ্যও দেখতে পেয়েছিল। দুরন্ত ক্রোধে সে সরাসরি কৈফিয়ত দাবি করেছিল তার স্বামীর কাছে।
সেই পাপেই তার অসপত্ন অধিকারটা ঘুচে গেল।
নন্দ দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ করলেন। এলেন সুয়োরানী। বিতাড়িত হলেন দুয়োরানী। রাজবাড়ি থেকে নয়। হৃদয়সিংহাসন থেকে
এমন যে প্রবল প্রতাপান্বিত সমাজপতি, তিনিও তিন-কুড়ি-পাড়ি দেওয়া বয়সে পড়ে গেলেন মহা-আতান্তরিতে। ওই একফোঁটা মেয়েটার কাছে।
শত্রুনিধন ওঁর রক্তে। আজীবন নির্মম হস্তে সরিয়ে দিয়ে এসেছেন পথের কাঁটা।
একেবারে প্রথম যৌবনে সেই মাগিটা। কী যেন নাম? এখন আর মনে পড়ে না। ওই যে গো—বড় বৌয়ের দিদি। ওঁর ভদ্রাসনে এসে দ্যাখ-না- দ্যাখ বিষ খেয়ে মরল। কেন রে বাপু? দুনিয়ায় কি মরার জন্য জুৎসই ঠাঁই পেলিনে? লোকে বলে, তার নাকি ‘পেট’ হয়েছিল। হবেও বা। ওসব ছেঁদো কথায় কান দিতে নেই। রাধামাধব! কালী-তারা-বেহ্মময়ী!
তারপর ধর গিয়ে ওই দুই বাগদির পো! কী দুজ্জয় সাহস! সমাজপতিকে প্রকাশ্যে যা-নয়-তাই বলে বসল! ধৰ্ম্মের কল বাতাসে নড়ে। খুড়োটা ফৌৎ হল গুলি খেয়ে। আর ভাইপোটা ডুবে মল দামোদরে। ওই একবগ্গাটা কী পাষণ্ড! বলে কি না মহাপ্রসাদ খাই না। কেন? না পাঁঠাটা যে উচ্ছৃণ্ড্য করা। ‘বৃথামাংস’ এনে দাও, কবজি ডুবিয়ে সাঁটব। দুগ্গার ছোট গিন্নি—সম্পর্কে তোর খুড়িমা হয়—তার সঙ্গে এমন পীরিত করলি যে আবাগিটা শেষমেশ গলায় দড়ি দিল। ছ্যা ছ্যা ছ্যা! তারপর ধর গিয়ে তক্কপঞ্চাননের ভাগ্নে-বৌটা! তাঁরে নির্লজ্জের মতো নিয়ে এসে তুললি তোর ফাঁকা ছামুতে। মতলবখানা কেউ বোঝে না? কুলীন বামুন তুই। হিম্মৎ থাকে তো দু-তিনটি কন্যাদায়গ্রস্তকে উদ্ধার কর না! সে মুরোদ নেই। ইদিকে বিধবা ডব্কা বৌঠানরে ময়না পোষা! কিন্তু পারলি? পঞ্চানন-ঠাকুর এ-অসৈরণ সইল? তোর নাকে ঝামা ঘষে ঘরের বউ ঘরে তুলল না? সেই একবগ্গার এন্তেকালটা তোমরা একবার বিবেচনা করে দেখ, বাবাসকল! কুলীন বামুনের মড়া বয়ে নিয়ে গেল দুলে-বাগ্দি-চাঁড়ালে! পুড়িয়ে ছাই করল জল-অচলদের শ্মশানে! মায় ছেরাদ্দটা পর্যন্ত হল না।
এসব গৌরবের দাবি তিনি করেন না। তিনি সমাজপতি! এসব ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকতে হয়। সবই মায়ের ইচ্ছে!
কিন্তু এবার? এই শেষ-কিস্তিটা কিছুতেই ঠেকাতে পারছেন না! ওই একবগ্গার হাড়হাবাতে মেয়েটা! ভাঙবে তবু মচকাবে না। কিছুতেই ওটাকে কব্জা করা যাচ্ছে না। সে নাকি এখন মাথা খাড়া রেখে এবাড়ি ওবাড়ি চিকিচ্ছে করে বেড়াচ্ছে, সঙ্গে সবসময় কালপুরুষের মতো তার এক দেহরক্ষী। তিনকুড়ি-পাড়ি দেওয়া একটা যমদূত। হাতে ত্রিশূল! তার মায়েরে কেউ কিছু বললে দ্যাখ-না- দ্যাখ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে!
৭
তিন-তিনটে আমন্ত্রণ এসেছিল রূপমঞ্জরীর। তিনটিই সে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
প্রথমত, বড়বাড়ির ভাদুড়ি-জেঠু। প্রচণ্ড অভিমানে তাঁকে সে হঠাৎ বলে বসেছিল, ‘সেদিন কেন কথাটা বলতে পারেননি জেঠু?’
তবে জেঠিমার প্রতি তার কোনো অভিমান নেই। প্রায় প্রতিদিন গিয়ে তাঁর কাছে বসে। গল্প করে যতটা, শোনে তার চেয়ে বেশি। মৌনতা ভঙ্গের পর উনি বোধহয় পুষিয়ে নিচ্ছেন। তাঁর শূন্য বুকে টেনে নিতে চান মামণিকে। এখন তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কেমন করে হল?
গল্পে শুনেছি, একটি তরুণীর দুই বাহু নাকি বেমক্কা আটকে যায় আড়ামুড়ি ভাঙতে গিয়ে। স্কন্ধাস্থির কী-একটা স্থানচ্যুতিতে সে হাতদুটি আর নামাতে পারছিল না। বিচক্ষণ চিকিৎসক অদ্ভুত পদ্ধতিতে তাকে নিরাময় করেছিলেন। সর্বসমক্ষে তার বস্ত্রাকর্ষণ করে। মর্মান্তিক প্রয়োজনে মেয়েটির দুটি হাত নেমে আসে—শাড়ির প্রান্ত আঁকড়ে ধরতে। বৃদ্ধ চিকিৎসক করজোড়ে মেয়েটিকে বলেছিলেন, মা রে! বুড়ো ছেলেটাকে মাপ করে দে! এছাড়া তোকে সারিয়ে তুলতে পারতাম না।
তারাসুন্দরীর অবস্থাও সেইরকম। কালবৈশাখীর প্রচণ্ড ঝঞ্ঝায় অতর্কিত বজ্রপাতে তিনি মূক হয়ে গিয়েছিলেন। ধন্বন্তরি ঠিকই বুঝেছিলেন—ওঁর বোধশক্তি হারিয়ে যায়নি। সব বুঝতেন, কিন্তু কেঁদে মনটা হালকা করতে পারতেন না। মস্তিষ্কের স্নায়ুজটিলতায় শুধু বাকশক্তি হারিয়ে গিয়েছিল। আবার এক অতর্কিত বজ্রপাতে সেই স্নায়ুগ্রন্থির জটিলতা দূরীভূত হয়ে গেল। সর্বসমক্ষে বিবস্ত্রা হওয়ার বিড়ম্বনা প্রতিহত করতে যেভাবে সেই মেয়েটি দু-হাতে চেপে ধরেছিল তার লাজবস্ত্র। ঠিক তেমনি এক মর্মান্তিক প্রয়োজনে তারাসুন্দরী একদিন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন পুঁটুরানীর হাত থেকে লক্ষ্মীর শঙ্খটা। ভাদুড়িমশাই ফিরে এলে স্বাভবিকভাবেই প্রশ্ন করেছিলেন, ওরা কি মামণিকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল?
তারাপ্রসন্ন তৃপ্তির হাসি হেসে বলেছিলেন, না! পারেনি! ভীমা-ঈশেন ওকে রক্ষা করেছে।
তারপরেই অবাক হয়ে বলেন, এ কী! তুমি কথা কইছ?
তারাসুন্দরীও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তাই তো দেখছি!
দ্বিতীয় আমন্ত্রণটি এসেছিল নিতান্ত অপ্রত্যাশিত এক পল্লীপ্রান্তের জমিদারবাড়ি থেকে। তুলসীর চিঠি :
‘মামণি! আমাকে মনে পড়ে? আমি এখন এ-বাড়িতে আছি। মজুমদার পরিবারের ছোটবউ। তোদের সব খবর পেয়েছি। বাবামশায়ের কাছে। তুই আমার কাছে চলে আয়। এঁরা তোকে মাথায় করে রাখবেন। কথা দিয়েছেন। আমারও বুকটা জুড়োবে।
পত্রবাহক মারফত জানিয়ে দিস কবে তোকে আনতে লোক পাঠাব।’
পত্রবাহকের মাধ্যমেই রূপমঞ্জরী জবাব দিয়েছিল :
“আপনাকে কি ভুলতে পারি, মামণি? মাকে চোখে দেখিনি। আপনিই তো আমার মা। আপনার বুকে ফিরে যেতে পারলে আমার সব জ্বালা জুড়িয়ে যেত। কিন্তু তা হবার নয়। বাবামশাইয়ের অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে।…বাবামশায়ের কাছে শুনেছিলাম আপনি বিশেষ প্রয়োজনে একবার সোঞাই গাঁয়ে আসবেন। সেই যখন আমার ভাই বা বোন আসবে আপনার কোল জুড়ে। বাবা নেই। কিন্তু আপনার মামণি তো আছে। এতদিনে সেও এক খুদে ধন্বন্তরি হয়ে উঠেছে। এ পর্যন্ত এ গাঁয়ে আপনার মামণি তেইশটি প্রসূতির হাতে তুলে দিতে পেরেছে তেইশটি খোকা-খুকু। শতকরা শতভাগ! আপনি যদি না আসতে পারেন, আমাকে খবর পাঠাবেন। আমি নিজেই চলে যাব।
ইতি আপনার মামণি।
তৃতীয় আমন্ত্রণপত্রটি এসেছিল এক স্বনামধন্য পণ্ডিতের কাছ থেকে। ত্রিবেণীর ক্ষণজন্মা পঞ্চানন ঠাকুর। প্রিয় ছাত্রের দেহান্তে তার অনাথা মেয়েটিকে আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন। তাঁকেও শতকোটি প্রণাম জানিয়ে অভিমানিনী দৃঢ়তার সঙ্গে সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিল। জানিয়ে দিয়েছিল সে স্বগ্রামে থেকে পিতার অসমাপ্ত কাজটি করে যাবে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। আরও জানিয়েছিল, আর্থিক সঙ্গতি কিছুটা বৃদ্ধি পেলে সে ‘ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যালয় টিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চায়।
*
একমুঠিবাবা এখন একেবারে অন্য মানুষ। ভিক্ষায় বার হন না। সারাদিন ঘুমান। সারারাত জাগেন। সো নিশা পশ্যতো মুনেঃ’। পাহারা দেন। তাঁর ত্রিশূলের ভয়ে এ পাড়ায় কেউ আসে না। এছাড়া সুরভির জাবনা মেখে দেন। গো-মাতার সেবা করেন। দুগ্ধ-দোহনের দায়িত্বটাও গ্রহণ করেছেন। সৈনগুপ্তকে দানাপানি দেওয়ার দায়িত্বটাও। মা ভবানীকি ওয়াক্ত কঁহা?
হটীর ডাক আসে এ-বাড়ি সে-বাড়ি থেকে। এ-পাড়া ও-পাড়া থেকে। কাছাকাছি হলে পদব্রজেই পাড়ি দেয়। সঙ্গে যান ত্রিশূলপাণি একমুঠিবাবা। একটু দুরে হলে পালকিতে যেতে হয়। সেটা জেঠিমার অনুরোধে ব্যবহার করতে হয়। তখন অশ্বপৃষ্ঠে অনুগমন করেন একমুঠিবাবা।
শূলপাণি সন্ন্যাসীর জীবনে তিন-তিনটি বাঁক। তাঁর প্রকৃত পরিচয় এবং পূর্ব ইতিহাস কেউ জানে না। এই তিন-কুড়ি বয়সে পৌঁছে তা অকুণ্ঠভাষে শুনিয়েছেন তাঁর পাতানো ৺মা-ভবানীকে। হটী, রূপমঞ্জরী মামণি—কোনো নামই তাঁর মনপসন্দ হয়নি। তাঁর ছানিপড়া দৃষ্টিতে ওই একফোঁটা মেয়েটি : সাক্ষাৎ ৺মা-ভবানী।
একমুঠিবাবা বিহার বা উত্তরপ্রদেশের মানুষ নন। তাঁর আদি নিবাস মহারাষ্ট্র। বাস্তবে তিনি : বর্গী!
নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। ওঁদের বৃত্তি ছিল—যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপন। বাবামশাই ছিলেন গ্রামের পণ্ডিতজী। কিন্তু তিনি স্বল্পায়ু। একমুঠিবাবার পিতৃদত্ত নাম শান্তো—অর্থাৎ শম্ভুদেব। মানুষ হয়েছেন তাঁর পিতামহের কাছে। পিতামহের নামটি তাঁর স্মরণে নেই। উনি তাঁকে বলতেন : দাদাজী কণ্বদেও। শিবাজী মহারাজের অনুকরণে। তাঁর আদর্শেই জীবনের প্রথম গতিমুখ পরিবর্তন।
দাদাজী তাঁর জমানায় যোগ দিয়েছিলেন স্বয়ং শিবাজী মহারাজের সৈন্যদলে। শিবাজীর দেহাবসানের পর ফিরে আসেন গ্রামে। আঁকড়ে ধরেন পিতৃহীন শাস্তোকে। শান্তোর লেখাপড়ায় মন ছিল না। দিবারাত্রি দাদাজীর কাছে ‘কিস্সা’ শোনে—কীভাবে শিবাজী মহারাজ আফজল খাঁ অথবা শায়েস্তা খাঁকে শায়েস্তা করেছিলেন। কীভাবে মিঠাইয়ের ঝুড়িতে আত্মগোপন করে আলমগীরের কারাগার থেকে মুক্তি পান। দাদাজীর দেহান্তকালে শান্তো কৈশোর অতিক্রম করে তারুণ্যের সিংহদ্বারে উপনীত। দাদাজীকে নর্মদাতীরে দাহ করে শান্তো গৃহত্যাগ করল। সন্ন্যাস নিতে নয়—পেশোয়ার অধীনে সৈন্যদলে যোগ দিতে। তখন তরুণের স্বপ্ন ছিল—ভূলুণ্ঠিত ভাগোয়া ঝাণ্ডাকে আবার সুপ্রতিষ্ঠিত করার। ভবানীমাতার পূজায় প্রয়োজন হলে বুকের রক্ত অঞ্জলি দেওয়া।
চৌথ-আদায়ের দাবি নিয়ে ভাস্কর পণ্ডিত যখন এলেন বঙ্গভূমে তখন তরুণ শাম্ভোজীও এলেন তাঁদের সঙ্গে। আশা করেছিলেন, সম্মুখ যুদ্ধে যবন নিধন করে গৌড়বঙ্গে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন ‘ভাগোয়া-ঝাণ্ডা’। কিন্তু মোহভঙ্গ হল অচিরে। পণ্ডিতজীর সৈন্যদল বাস্তবে লুঠেরা। কোথায় নবাবের সৈন্যদলের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, তা নয়, ক্রমাগত গ্রামের পর গ্রাম ওরা লুট করে চলে। সে কী অকথ্য অত্যাচার! কী বীভৎস দৃশ্য! মানুষকে ওরা মানুষ বলে গণ্য করত না। বালক থেকে বৃদ্ধের শিরশ্ছেদ করে মুণ্ড নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলত! যৌথ বলাৎকারে গ্রাম্য রমণীকুলকে চরম বেইজ্জৎ করত। প্রতিবাদ করেছিল শাস্তো। তা থেকে বচসা। শেষে ওকে বধ করতে ছুটে আসে তিন-চারজন বর্গী সৈন্য। শাস্ত্রো মারাত্মকভাবে আহত হয়, তবে প্রতিপক্ষের দুজনের শিরশ্ছেদ এবং একজনকে মারাত্মকভাবে আহত করার পর।
ফৌজ ছেড়ে পালায়। ফেরারী আসামী। বর্গী সৈন্য ওর তল্লাশে পশ্চাদ্ধাবন করে। শাস্তো ওষ্ঠলোম ও শ্মশ্রুর বৃদ্ধিতে মন দেয়। জটাজুটধারী সন্ন্যাসী সাজে। তাকে তখন বাঘ ও সিংহ দু’দিক থেকে তাড়া করেছে। নবাবী সৈন্য তাকে চিহ্নিত করেছে বর্গী হিসাবে, আর পেশোয়ার দৃষ্টিতে সে ফেরারী আসামী।
শাম্ভোজীর জীবনে এল দ্বিতীয়বার গতিমুখ পরিবর্তনের জমানা। ‘ভাগোয়া-ঝাণ্ডা’ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নটা ক্রমে ঝাপসা হয়ে এল। বিন্দুবৎ হয়ে গেল। শেষে ‘না’ হয়ে গেল।
নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণসন্তান তাঁর ক্ষত্রিয় বৃত্তি ত্যাগ করে হয়ে গেলেন কৌপীনধারী সন্ন্যাসী—একমুঠিবাবা। দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন ভ্রাম্যমাণ ভিক্ষাজীবী। গৃহস্থবাড়িতে গিয়ে হাঁকাড় পাড়েন : ‘জয় শিবশন্তো! জয় ভবানী-মাতা!’ দৈনিক একমুঠি ভিক্ষা। তার বেশি গ্রহণ করেন না—কিউকি কল তো ফিন নিকানা হ্যায় না?’ ঘুরতে-ঘুরতে একদিন এসে পৌঁছালেন এই সোঞাই গ্রামে। দামোদরতীরের এই ছায়া সুনিবিড় শান্ত পল্লীপ্রান্তে। জায়গাটা পছন্দ হয়ে গেল। ভূস্বামী ব্রজেন্দ্রনারায়ণ ভাদুড়ী সজ্জন। সাচ্চা ব্রাহ্মণ। তেঁতুলবটের ছায়ায় পাকাপাকিভাবে ডেরাডাণ্ডা গাড়লেন। ইচ্ছা ছিল এখানেই দুনিয়াদারী খতম করবেন। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণবংশের সন্তান কৈশোরে গ্রহণ করেছিলেন ক্ষাত্রধর্ম—হয়েছিলেন ভাস্কর পণ্ডিতের দক্ষিণহস্ত! কিন্তু বর্গী সৈন্যর অবক্ষয় দেখে, পৈশাচিক অত্যাচার প্রত্যক্ষ করে পরিবর্তিত হয়ে গেলেন সংসারত্যাগী কৌপীনধারীতে।
কিন্তু মা-ভবানীর তা ইচ্ছা নয়। সারা জীবন খুঁজেছেন শিবাজী মহারাজের ইষ্টদেবীকে। সাক্ষাৎ পাননি। ব্রজেন্দ্রনারায়ণ প্রয়াত হলেন। তারপর সোঞাই গাঁয়ে ও এসে পৌঁছাল লোভী অত্যাচারী সমাজপতিদের অবক্ষয়ী চিন্তাধারা। শিবাজী মহারাজের প্রয়াণে যেমন অবক্ষয় নেমে এসেছিল স্বার্থসর্বস্ব পেশোয়ার সৈন্যদলে। আবার একটি মর্মান্তিক আঘাতে জীবনের লক্ষ্যমুখ পরিবর্তিত হয়ে গেল। যেদিন দেখলেন সোঞাই গাঁয়ের সমাজপতিদের অত্যাচারে নিষ্ঠাবান ধন্বন্তরি-বাবাকে দাহ করল চণ্ডালের দল। রুখে দাঁড়ালেন দাদাজী কণ্বদেও-এর মন্ত্রশিষ্য। অকস্মাৎ দেখতে পেলেন : ওঁর ছানিপড়া দৃষ্টির সম্মুখে এতদিনে আবির্ভূতা হয়েছেন সেই আজীবন ধরা-না-দেওয়া ৺ভবানী মাতা! একটি কিশোরীর বেশে। সে অনর্গল দেবভাষায় কথা বলতে পারে! সে পিতৃহীনা। তবু পিতৃকুলের সাতপুরুষের ভিটা ত্যাগ করে সে জমিদারবাড়ির আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করল।
সঙ্কল্প পরিবর্তিত হল আবার। ছিলেন সন্ন্যাসী, হলেন গৃহস্থ। মৃগশিশুর প্রেমে ভরতমুনির মতো এখন তিনি দুগ্ধ দোহন করেন। অশ্বের দানাপানি জোগান দেন। আর ৺মা-ভবানী যখন আর্তদের সেবায় নিষ্ক্রান্ত হন তখন অশ্বপৃষ্ঠে তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছেন, অনুভব করেছেন—এই সোঞাই গাঁয়ে ‘বিড্রাহে’র দল তাঁর মা-ভবানীকে অপমান করতে চায়, নির্যাতন করতে চায়। ঠিক যেমন করত তাঁর যৌবনের বর্গী সঙ্গী-সাথীরা।
৮
১১৭৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখের মাঝামাঝি। আজ পুণ্যাহ—অক্ষয় তৃতীয়া। ‘বৈশাখে মাসি মেষরাশিস্থে ভাস্করে শুক্লে পক্ষে তৃতীয়াং তিথৌ’। যাবনিক বিচারে 1766। আমাদের কাহিনির নায়িকা তখন ত্রয়োবিংশতি বর্ষীয়া পূর্ণযুবতী। এখন তিনি শুধু সোঞাই গ্রামেরই নয়, পঞ্চগ্রামের সুপ্রতিষ্ঠিতা ধন্বন্তরি-মাতা। অনেকেই ইদানীং তাঁর সেবকের ভাষায় তাঁকে ডাকে ‘ভবানী-মা’। একমুঠিবাবা আরও বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন; কিন্তু আজন্ম-ব্রহ্মচারী নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের শরীরে জরা দত্তস্ফুট করতে পারেনি। বছরখানেক আগেও দেখা গেছে তিনি অক্লেশে পায়ে রজ্জুবন্ধন করে নারিকেল গাছে ডাব পাড়তে উঠে যাচ্ছেন ‘কিউকি আজ একাদশী হ্যায় না? ভবানী-মা সির্ফ পিয়েঙ্গি, কুছ খায়েঙ্গি নহী!’
বৎসরে এই একটি দিন নন্দ চাটুজ্জে মশাই দামোদরের জলে অবগাহন স্নান করেন। জনশ্রুতি—শাস্ত্রেও কোথাও লেখাটেখা আছে নিশ্চয়—এ দিন দামোদরের জল গঙ্গোদকের মতো পবিত্র হয়ে ওঠে।
প্রাতঃকালীন আহ্নিক সমাপনান্তে নন্দ এসেছেন স্নানাগার সংলগ্ন তৈলমর্দন-কক্ষে। কটিদেশে অঙ্গমার্জন বস্ত্র জড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়েছেন, শ্বেতপাথরের মেঝেতে। মোক্ষদা তাঁকে তৈলমর্দন করে দিচ্ছিল।
মোক্ষদা ব্রাহ্মণ-কন্যা। ওঁর অতি দূর সম্পর্কের এক জ্ঞাতিভ্রাতা নগেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারীর বিধবা। ওঁর আশ্রিতা হয়ে আছে আজ বছরকয়েক। বাড়ির সবাই তাঁকে ডাকে ‘বামুনদি’। কারণ রন্ধনশালার দায়িত্বটা তাঁর। তবে নন্দ তাঁকে নাম ধরেই ডেকে থাকেন। বামুনদির রান্নার হাতটি বড় মিঠে। শুধু কি তাই? তাঁর হাতের তালুও খুব পেলব। তৈলমর্দনও একটি চারুশিল্প। কর্তামশাইকে সে এমন সুচারুভাবে মালিশ করে যে, তাঁর নিদ্রাবেশ এসে যায়। বামুনদির বয়স দেড়কুড়ি। ছোট গিন্নিমার প্রায় সমবয়সী। সাদা থান। আভরণহীন তথা মেদহীন দেহ। শুধু কণ্ঠে একটি রুদ্রাক্ষের মালা। কর্তামশাই যদিচ বহু দূর সম্পর্ক ধরে ভাসুর, তবু অবগুণ্ঠনবতী তাঁর সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বাক্যালাপ করে থাকেন। তৈলমর্দন করতে করতে নানান সুখ-দুঃখের কথা হয়।
সেদিন কী যে হল, কর্তা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, মোক্ষদা, তোমার বে হইছিল কত বছর বয়সে?
মোক্ষদা বলে, তা কি আর মনে আছে কত্তামশাই? তবে আমি তখন বোধহয় রানীর বয়সী।
রানী ওঁর নাতনি। বড়খোকার প্রথম পক্ষের প্রথম সন্তান। বছর নয়-দশ। কর্তা পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন, আর শাঁখা-সিঁদুর মুছল কত বছর বয়সে?
—তখন আমি শ্যামার চেয়েও বছরআষ্টেকের বড় হব, মনে লাগে।
শ্যামা ওঁর মালিনী। সে চতুর্দশী। তার মানে, আন্দাজ বাইশ বৎসর।
—তাহলে সবাই তোমারে ‘বালবিধবা’ বলে কেন? শাঁখা-সিঁদুর যেদিন ঘোচে সেদিন তো তুমি দিব্যি ডাগর গো! এককুড়ি-দুই!
বামুনদিদি বলে আজ্ঞে না, ‘বালবিধবা’ হওয়া ঠিক নয়। পাঁচ-ছয়টা বছর তো ছিলাম শ্বশুরবাড়িতে। শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে।
—এই পাঁচ-ছয়টা বছরে নগেনকে একটা খোকার মুখ দেখাতে পারলে না? একটা ছেলে অথবা মেয়ে থাকলে তোমারও জীবন আজ দুঃসহ হয়ে উঠত না। তাই না?
বামুনদিদি জবাব দিল না। কী জবাব দেবে? এ তো স্বতঃসিদ্ধ। এ ইচ্ছা তো পূরণ হল না।
কর্তার কিন্তু কৌতূহল মেটেনি। বলেন, নগেনের তো তুমি তৃতীয়পক্ষ? তাই নয়? সতীনের সংসার ছিল না তোমার?
—আজ্ঞে না। বড়দি প্রথম সন্তান হতে গিয়েই গঙ্গালাভ করেন। ছোড়দির দুটি সন্তান হয়েছেল। তাঁর দেহান্তের অনেক পরে উনি আমারে ‘বে’ করেন।
হবিষা কৃষ্ণবর্মের কৌতূহল আরও বৃদ্ধি পায়। নগেনভায়ার আগের দুই পক্ষই ফলবতী। মোক্ষদার কেন হল না? নিজ স্বীকৃতিমতে সে তো পাঁচ-ছয় বছর স্বামীসহবাস করেছে? তা হলে? মোক্ষদা কি ওঁর ছোট গিন্নির মতো ‘বাঁজা’? কথাটা তো এতদিন খেয়াল হয়নি!
লজ্জা-শরম ত্যাগ করে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসেন, নগেন কি তোমারে নিয়ে শুতো না? তুমি সঙ্কোচ কোরো না মোক্ষদা। সুখ-দুঃখের কতা মন খুলে কাউকে কইতে পারলে মনটা হালকা হয়।
মোক্ষদা এ-কথার জবাবে বললে, এবার আপনি উবুড় হন কত্তাদাদা! আপনার পিঠে টুক তেল দোব।
—তা না হয় শুচ্ছি। কিন্তু আমার কতার জবাবটা এড়িয়ে গেলে কেন?
–এড়িয়ে যাব কেনে? আমি তখন তাঁর একমাত্তর বউ। আমারে নে শোবেন না? এটা কি একটা কতা হল?
কর্তা উবুড় হলেন। মনটা কিন্তু চিৎ হয়েই রইল। কার্য-কারণ-সূত্রগুলি বিশ্লেষণযোগ্য। মোক্ষদা পাঁচ-ছয়টা বছর স্বামীর শয্যায় শয়ন করেছে। তখন তার ভরা যৌবন। তার স্বামী সন্তান-উৎপাদনক্ষম! পাঁচ-ছয় বছরে নগেনটা ওকে নিশ্চয় পাঁচশবার আশীর্বাদ করেছে। তার একমাত্র অনুসিদ্ধান্ত : ওই মধ্যযৌবনা রমণী সন্তানোৎপাদনক্ষমা নয়। নন্দ ঘরপোড়া গরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়! বড় গিন্নির দিদি—সেই কী-যেন-নাম রমণপটিয়সী—একরাত্রেই মুঞ্জরিত হয়ে উঠেছিল। এবার সে ভয় আদৌ নেই! এ মাগী ওঁর ছোট-গিন্নির মতো বাঁজা! নির্ঘাৎ! এ তো দারুণ বার্তা!
ওঁর মনোজগতে উদয় হল ‘শাস্তর’ বাক্য : নাল্পে সুখম্ হস্তী!
আশ্চর্য! প্রতিবেশীর বাগানে নয়, তাঁর নিজস্ব উদ্যানেই গজিয়েছে এমন ডাঁটোখাটো কলাগাছ। কচি কলাপাতা দুলিয়ে দুলিয়ে এতদিন ধরে ডেকেছে : আয়, আয়! ওর হাতের তালু নরম। হয়তো বাকি শরীরও। তাই উবুড় হয়ে চোখ বুজে চিন্তা করতে থাকেন। ওই ত্রিংশতিবর্ষীয়া নিঃসন্তানা যে পীবরবক্ষা তা অনুমানযোগ্য। এতদিন ওকে ভাল করে নজরই করেননি। উবুড় অবস্থাতেই প্রশ্ন করেন, তোমার কি তিনকুলে কেউ নেই, মোক্ষদা?
ঊরুদ্বয়ে তৈলমর্দনরতা বললে, তা কেন থাকবেনি? সতীনপো এই সমারে ভাতকাপড়ের যোগান দিবে না বলেই না আপনার ঠেঞে গতর খাটতি আসা?
গতর! গতর খাটার তো কতই রকমফের! তৈলমর্দনের কাজে বহাল করার সময় বামুনদিদির মাস-মাহিনার বৃদ্ধি হয়েছিল। ‘কতা’য় বলে, ‘ফ্যালো কড়ি মাখো তেল।’ ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হচ্ছে!
বলেন, ঁমা-ষষ্ঠীর থানে ঢিল বেঁধেছিলে?
—না!
—কেন গো? ওসব মানো না? নাকি খোকা-খুকু চাইতে না?
বামুনদিদি একটু বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, ছাড়ান দ্যান না কত্তা। ও-সব ছেঁদো-কথায় কি দরকার?
একদিনে বেশি কৌতূহল দেখানো ঠিক নয়। সবুরে মেওয়া ফলে। তাই বলেন, তোমার যদি কোনো শখ-আহ্লাদ থাকে আমারে বল। কেমন? আমি কিনে দেব নে। কারেও বলবেনি কে কিনে দিল।
মোক্ষদা বলে, আমি বেধবা মনিষ্যি। আমার আবার শখ-আহ্লাদ কী?
—না, তাই বলছিলাম। শাড়ি-গয়না ছাড়াও তো মানুষের শখ-আহ্লাদ থাকে!
মোক্ষদা এবার একটু উৎসাহ পায়। বলে, তা যদি বলেন কত্তা, তাহলে বলি আমারে এট্টা ছোট্ট মাটির ‘গুপাল’ আন্যে দিবেন? এই অ্যাত্তটুকুন!
পিঠের দিকে থাকায় ওর মনোমতো গোপালের মাপটা দেখতে পেলেন না। বলেন, ঠাকুর-ঠুকুরে মনে দেওয়া ভাল। আন্যে দেব নে। কালীঘাটের পট, মাটির কালীমূর্তি, রাধাকেষ্ট…
—না, না, তেনারা মাতায় থাকুন। আমার চাই ছোট্ট একটি নাড়ুগোপাল।
ব্যাপারটা তাহলে কী দাঁড়ালো? সন্তান-কামনায় সব সীমন্তিনীই মা-ষষ্ঠীর থানে ঢিল বাঁধে। ও তা বাঁধেনি। আবার একবগ্গার মতো গোঁয়ার-গোবিন্দও নয়। নিজেই বলছে, পূজার জন্য একটা গোপালের মূর্তি লাভের বাসনা আছে ওর অন্তরে। দুরন্ত কৌতূহলে ওই শাস্ত্রবাক্যটা আর স্মরণে রইল না—’সবুরে মেওয়া ফলে।’ বেমক্কা আবার ফিরে আসেন একই প্রসঙ্গে, ব্যাপারটা কী রে মোক্ষদা? পাঁচ-ছয় বছরে তোর কোলজুড়ে কোনো সোনার চাঁদ এলনি, অথচ তুই ৺মা-ষষ্ঠীর থানে ঢিলও বাঁধলিনি। কেন?
কর্তা যে ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’-এর নৈকট্যে এসেছেন সেটাও খেয়াল করল কি না বোঝা গেল না। সলজ্জে বললে, সেসব সরমের কতায় আপনের এত কৌতূহল কেনে?
—না, মানে তুই তো শুভার চেয়েও বয়সে ছোট। শুভারে দেখেছিস তো? বড়খোকার দিদি! এ সংসারে জন্মালে তোরেও আমি ন্যাংটোপোঁদে কোলে করে ঠাকুর দেখিয়ে আনতাম!
মোক্ষদা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হেসে ওঠে। বলে, আপনের মুকের কোনো আড় নেই!
—ওমা! অন্যায্য কতা কী বললাম? আম্মো তো ছেলেবেলায় মাজায় ঘুন্সি বেঁধে ন্যাংটোপোঁদে বাপ-দাদার কোলে চেপেচি! আমার কাছে তোর আবার শরম কী?
মোক্ষদা আর আত্মসংবরণ করতে পারল না। ওই সহানুভূতিশীল বাপের বয়সী কর্তামশায়ের কাছে খুলে বলে তার গোপন বেদনার ইতিকথা : আমার যখন দ্বিরাগমন হয় তদ্দিনে তিনি এক্কেরে বুড়িয়ে গেছেন। আমারে ‘মা’ করার ক্ষ্যামতাই ছিল না তাঁইর!
নন্দর মনে হল পৃষ্ঠদেশে যে কোমল হস্তস্পর্শ ওটা একটা হিলহিলে কালনাগিনীর! সর্বনাশ! কী কাণ্ড হতে যাচ্ছিল! ওই তৈলমর্দনকারিণীর রজোদর্শন হয়েছে চোদ্দ-পনেরো বছর বয়সে, অথচ বাকি বিশ বছরে ধ্বজদর্শন হয়নি! উর্বরা ভূখণ্ড আকাশপানে মুখ তুলে প্রতীক্ষা করছে। কখন একটি অচিন পাখি—কাক-বক-চিল যাই হোক—সন্তানপ্রত্যাশীর উর্বর ভূখণ্ডে একটি ফলের বীজ নিক্ষেপ করবে কালকাশুন্দি-ঘেঁটু-ভ্যারেণ্ডা যাই হোক! কালীঘাটের পট, রাধাকৃষ্ণের মূর্তিতে ওর মন ভরে না—তৃষিত চাতকের মতো ওর মনোবাসনা : একটি কোলজুড়ানো ‘গুপাল’! এই অ্যাত্তটুকুন!
কালী-তারা-মোক্ষদে! ভবযন্তনা থিকে আমারে মোক্ষ দে মা! খুব কানঘেঁষে বেঁচে গেছেন!
মোক্ষদা বলে, এবার এট্টু বাবু হয়ে বসেন। মাথায় গন্দতেল দিয়ে দি। বেশ ভুরভুরে গন্ধ হবে।
কর্তা বলেন, না-রে মোক্ষদা! গন্ধতেলটা আমি নিজেই মেখে নেব নে। তোরে ছুটি দে-দিলাম, মোক্ষদা-মা!
ওঁর মনে পড়ে গেল আর একটি শাস্তর-বাক্য’। ‘সমোস্কৃত’ মন্তরটা মনে নাই, তবে বাচ্যার্থটা এই প্রকার :
মুণ্ডিতমস্তক মূর্খও বিশ্ববৃক্ষতলে কদাচ পুনরাগমন করে না!
এই বামুনদিদিও যদি ওঁর ভিটেয় বেমক্কা আত্মহত্যা করে বসে, ওই অ্যাত্তটুকুন গুপালকে পেটকোঁচড়ে নিয়ে, তবে উনি পড়ে যাবেন গভীর গাড্ডায়। মহা আতান্তরিতে!
৯
দামোদরে অবগাহনাত্তে পালকি চেপে যখন ভিটেয় ফিরে এলেন, তখন মধ্যাহ্ন। হঠাৎ নজর হল, দেউড়ির পাশে নামানো আছে আর একটি পালকি। দেখেই চিনতে পারেন। বড়বাড়ির। তারাপ্রসন্ন আসেননি। তিনি পদব্রজে অথবা অশ্বারোহণে ভ্রমণ করেন। তাহলে কে? তারাসুন্দরী না পুঁটুরানী? বৈশাখের এই খর-মধ্যাহ্নে কেন এসেছেন?
দেউড়ি পার হয়ে ভদ্রাসনের দিকে অগ্রসর হতেই নজর হল অন্দরমহল থেকে বার হয়ে আসছে বড়খোকা। তার পিছন-পিছন এক শুভ্রবসনা অনবগুণ্ঠিতা যুবতী। তারাসুন্দরী বা পুঁটুরানী নয়। তাহলে কে? হঠাৎ থমকে থেমে পড়েন। একই অবস্থা বড়খোকার। বাবামশাই যে এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন তা বোধহয় সে আন্দাজ করেনি। চোখাচোখি হতেই নন্দ তাকে প্রশ্ন করেন, ওটি কে? একবগ্গা বাঁড়ুজ্জের সেই মেয়েটা নয়?
বড়খোকার বাক্যস্ফূর্তি হল না। তার পাশ থেকে রূপমঞ্জরী এগিয়ে আসে। বড়খোকাকেই প্রশ্ন করে, উনি আপনার বাবা—সেই কি-যেন-নাম চাটুজ্জেমশাই না?
এবারও বাক্যস্ফূর্তি হল না বড়খোকার। নন্দই বলে ওঠেন, তুমি যে আমারে চিনতেই পারছ না হটী! ‘কী-যেন-নাম’ নয়, আমার নাম শ্রীনন্দলাল চট্টোপাধ্যায়।
রূপমঞ্জরী বললে, আমার বাবার নাম ‘একবগ্গা বাঁড়ুজ্জে’ নয়—’রূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়!’পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ান। আমাকে যেতে দিন।
—দাঁড়াও! আমার বিনা অনুমতিতে আমার ভদ্রাসনে মাতা গলিয়েছিলে কেন? রূপমঞ্জরী প্রতিপ্রশ্ন করে, হেত্বর্থে পঞ্চমী বিভক্তি কাকে বলে জানেন? ‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাত্’?
আপাদমস্তক জ্বলে গেল সমাজপতির। রূঢ়স্বরে বলেন, বেশি পণ্ডিত্যেমো দেখাবার চেষ্টা কর না। যা জানতে চেয়েছি তার জবাব দাও।
—তাই তো দিলাম। হেত্বর্থে পঞ্চমী। কারও ভদ্রাসন থেকে যখন চিকিৎসক বহির্গত হয়ে আসেন তখন বুঝে নিতে হয় অন্দরমহলে কেউ অসুস্থা হয়ে পড়েছেন।
—অসুস্থা! কে?—এ প্রশ্নটা বড়খোকার দিকে ফিরে।
এবারও সে নিরুত্তর। হটীই জবাব দিল, যেই হোন। তিনি ভাল আছেন। গৃহস্বামী হিসাবে আপনার চিন্তিত হবার কোনো কারণ নাই। আমি যথাবিহিত নিরাময়ের ব্যবস্থা করেছি। পথ ছাড়ুন।
—না! চিকিৎসা করতে যখন এসেছিলে তখন তোমার কিছু বৈদ্যবিদায় প্রাপ্য, সেটা…
—না! চাটুজ্জেমশাই। বৈদ্যকে আপনি আহ্বান করেননি। আপনাকে সেজন্য ব্যস্ত হতে হবে না। যিনি ডেকেছেন, তিনি বুঝবেন।
—তা হবে না। আমি এ সংসারের কর্তা। বৈদ্যবিদায় আমার হাত থেকেই তোমাকে গ্রহণ করতে হবে।
—কর্তা? কেমনতর গৃহকর্তা? আপনি তো সংবাদই রাখেন না সংসারে কে অসুস্থা হয়ে পড়েছেন! কেন বৈদ্যের প্রয়োজন হল!
নন্দ পুনরায় বড়খোকার দিকে দৃকপাত করেন। এবারও সে কোনো কথা বলে না। অধোবদনে দাঁড়িয়েই থাকে। রূপমঞ্জরী পুনরায় বলে, অসুস্থা নন, স্বাভাবিক ঘটনাপরম্পরা। আপনার কনিষ্ঠা পুত্রবধূ সন্তানসম্ভবা। এটা চতুর্থ মাস। জ্যৈষ্ঠ মাসে পঞ্চামৃতের ব্যবস্থা করবেন। চিন্তার কোনো কারণ নেই।
আশ্বস্ত হলেন নন্দ। বড়খোকার দ্বিতীয়া স্ত্রীর এটাই তাহলে প্রথম গর্ভলক্ষণ। বললেন, আমাকে না জানিয়ে তোমাকে আহ্বান করা ওর অন্যায় হয়েছে। আমাদের সংসারে রাসু-দাই চিরকাল প্রসূতিদের দেখভাল করেছে। তবু তুমি যখন বিনা অনুমতিতে তাকে পরীক্ষা করে দেখে গেছ, তখন আমার কাছে বৈদ্যবিদায় তোমাকে নিতেই হবে। বল, কী এনে দেবে?
—আমি তো ইতিপূর্বেই জানিয়েছি চাটুজ্জেমশাই, আপনার কাছ থেকে কোনো বৈদ্যবিদায় আমি গ্রহণ করব না। চিকিৎসকের ধর্ম পালন করতেই আপনার ভদ্রাসনে পদার্পণ করেছি, না হলে আমি এ-বাড়ির চৌকাঠ মাড়াতাম না।
—বটে! সেক্ষেত্রে অনধিকারী হিসাবে প্রবেশ করায় তোমার বিরুদ্ধে যদি আমি কাজিসাহেবের আদালতে শিকায়েত করি?
—সেটা আপনার অধিকারভুক্ত। সেক্ষেত্রে কিন্তু আপনার পুত্রের বিরুদ্ধেও শিকায়েত করতে হবে। এটা কি আপনি তলিয়ে দেখেছেন? আমি বিনা-আহ্বানে স্বেচ্ছায় আসিনি।
—আর নালিশ না করে আমি যদি একটি চড়ে তোমার মুণ্ডুটা উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিই?
হটীর চোখদুটি ধক করে জ্বলে উঠল। শান্তস্বরে বললে, সেক্ষেত্রে আপনার মুণ্ডুটাও উল্টোদিকে ঘুরে যাবে চাটুজ্জেমশাই!
নন্দ উন্মত্ত মহিষের মতো ওর দিকে একপদ অগ্রসর হতেই রূপমঞ্জরী দেউড়ি দিকে ফিরে হাঁক পাড়ে, বাবা!
মুহূর্তমধ্যে প্রতিধ্বনি শোনা গেল, মা?
নন্দ পাশ ফিরে দেখেন, অন্তরীক্ষ থেকে অকস্মাৎ আবির্ভূত হয়েছেন এক জটাজুটধারী ভীমকায় সন্ন্যাসী। তাঁর দক্ষিণহস্তে ত্রিশূল।
নন্দও হাঁকাড় পাড়েন, ব্রিজলাল! মহাদেও প্রসাদ!
দেউড়ি থেকে দুজন প্রহরী তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে। তাদের কটিদেশে তরবারি। হস্তে দীর্ঘ যষ্টি।
সন্ন্যাসী একে একে সকলের দিকে তাকিয়ে দেখেন, মুখে শুধু বলেন, তো?
নন্দ বলেন ‘তো?’ মানে?
—আপনে দো সিপাহী কো বোলায়া। বহু হাজির ভি হো চুকা। অব্ উন্ দোনোকো তো হুকুম দেনা চাহিয়ে! না কি রে ব্রিজলাল ঔর মহাদেও?
ওরা দুজনে জবাব দিল না। সন্ন্যাসীকে করজোড়ে প্রণাম জানাল।
নীরবতা ভঙ্গ করল হটী : চলুন বাবা! আমাকে আরও দু’বাড়িতে রোগী দেখতে যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
—তো আইয়ে মা!
রূপমঞ্জরী ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল পালকির দিকে। সন্ন্যাসীও তার অনুগমন করলেন। তারপর হঠাৎ কী মনে হল তাঁর। ফিরে এসে দাঁড়ালেন নন্দ চাটুজ্জের মুখোমুখি। বললেন, বাবুজি! এক বাত বাতাউ?
এবার নন্দেরই বাক্যস্ফূর্তি হল না। অনুমতির অপেক্ষা না করে প্রাক্তন বর্গী সর্দার বজ্রগম্ভীরস্বরে বললেন, মহিলায়োঁকে সাথ সোচ্ সমঝকে বাতচিৎ করনা হি তমিজ হ্যায়! ইয়াদ রখা!
ধীরপথে ফিরে গেলেন। অশ্বারোহণ করে আকাশপানে মুখ তুলে হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন—জয় শিবো শন্তো! জয় ভবানীমাতা”।
ব্রিজলাল আর মহাদেওপ্রসাদ তখনো যুক্তকরে প্রণামরত।
গাছ-গাছালিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল মাতৃবন্দনা : জয় ভবানীমাতা
নন্দ অস্থিতে-অস্থিতে প্রণিধান করেন আজ এই পুণ্যাহে সমাজপতিকে শেষকিস্তির চালে মাৎ করে দিয়ে গেল একবগ্গার ওই একফোঁটা মেয়েটা!
১০
লাটাইয়ের সুতো অনেকটাই গুটিয়ে আনা গেছে। বাকি আছে মাত্র পাঁচ বছর। তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়, বিশ বছর আগে প্রথম খণ্ডটা যখন লিখতে বসেছিলাম তখন কাহিনি শুরু হয়েছিল 1774 খ্রিস্টাব্দে। তখন হটী বিদ্যালঙ্কারের বয়স ত্রিশ-একত্রিশ। সেই যখন কাশীনরেশ তাঁকে তার আশ্রমে গৃহবন্দি করে রেখেছিল উনিশ দিনের মেয়াদে। সেটা ছিল 1774-এর চৈত্রমাস। আমরা এখন এসে পৌঁছেছি 1769 খ্রিস্টাব্দে। যখন হটী ঘোষাল ভিষগাচার্যার বয়স ছাব্বিশ
ইংরেজি 1769 খ্রিস্টাব্দটা হচ্ছে বাংলা ১১৭৬ সন। অর্থাৎ ছিয়াত্তরের মহামন্বন্তরের দুর্বৎসর। পর পর দু’ বছর হল অনাবৃষ্টি। তার চেয়ে বেশি হল শাসকবর্গের অনাসৃষ্টি : মীরজাফরের কুশাসন। রেজা খাঁ আর দেবীলালের প্রজাপীড়ন। মীরজাফর গদির লোভে ইংরেজ কোম্পানিকে যে পরিমাণ খাজনা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা গৌড়বঙ্গ আধপেটা খেয়েও জোগান দিতে পারত না। পারল না। ধেয়ে এল মহামন্বন্তর! গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেল। বর্গীর আক্রমণে রাঢ়বঙ্গের মানুষজন দলে দলে পাড়ি জমিয়েছিল পুবমুখো। এবার চলল পশ্চিমমুখো। বিহার, যুক্তপ্রদেশ, দিল্লির দিকে। জনশ্রুতি সেখানে কিছু বৃষ্টি হয়েছে। হয়তো ফসল ফলেছে।
সোঞাই গ্রামে বারো-চৌদ্দ আনা ভদ্রাসনে সন্ধ্যাদীপ জ্বলে না। কেউ নেই। হয় মরেছে, নয় পালিয়েছে। ফুল্লরা গ্রামে একঘর লোক নেই। মোল্লাহাটির মসজিদে কেউ আজান দেয় না। সোঞাই গাঁয়ে গাঙ্গুলীবাড়ি, চাটুজ্জেপাড়া, কায়স্থপাড়া শূন্য। বড়বাড়ির সবাই আগের অজন্মার বছরেই চলে গিয়েছেন কাশীধামে। শুধু জমিদারমশাই বাদে। তারাসুন্দরী হটীকে পীড়াপীড়ি করেছিলেন। কিন্তু স্বীকৃতা হয়নি সে। তারপর এই বছরে গ্রাম আরও জনশূন্য হয়ে পড়েছে। শেষে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে সদ্যোমৃতকে শ্মশানে নিয়ে যাবার লোক পাওয়া যায় না।
একমুঠিবাবা দেহ রাখলেন মাঘ মাসে। শেষ সময়েও সজ্ঞানে ছিলেন। মুক্তিলাভের পূর্বে তিনি তাঁর ভবানী-মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র পার্থিব সম্পদটি। বলেন, ইয়ে রাখ্ দে মাঈ! দুনিয়ামে বহুৎসে বিরাহ হয়!
হটীর মনে পড়েছিল বাবামশাই একবার বলেছিলেন ওই অপ্রচলিত শব্দটি শ্রীমদ্ভাগবতের দ্বিতীয় স্কন্ধের তৃতীয় অধ্যায়ে আছে। শুভদা বলে দিয়েছিল, তার অর্থ বিষ্ঠাভোগী শূকর। একমুঠিবাবার স্নেহের দান সে শ্রদ্ধাভরে গ্রহণ করেছিল। সন্ন্যাসীর দাহ হয় না। তাঁকে সমাধিস্থ করা হল ওদের বাস্তুভিটার প্রাঙ্গণে। ব্রিজলাল, মহাদেও প্রসাদ প্রভৃতিরা সে-ব্যবস্থা করে দিল। হটী ওঁর সমাধির শিয়রে একটি শ্বেতকরবীর চারা রোপণ করে দিল।
মন্বন্তর ক্রমে ভীষণাকৃতি হয়ে উঠছে। গ্রামে একটিই পরিবারের কর্তা আছেন, যিনি এই মহামারীর মুখোমুখি হবার হিম্মৎ রাখেন। নন্দ চাটুজ্জেমশাই। তিনি অতি বিচক্ষণ সংসারী। দুই বৎসর ধরে তাঁর ধনভাণ্ডার শূন্য করে শস্যভাণ্ডার পূর্ণ করেছেন। সিপাহি-বরকন্দাজের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। যদিও পঞ্চাশের মন্বন্তরের মতো পৌনে দু-শ’ বছর পূর্বেও নিরন্ন মানুষ মহাজনের গদি লুট করেনি।
তারাপ্রসন্ন আবার এলেন। তাঁর মামণির কাছে দরবার করতে।
—শোন মামণি! কাল ভোররাত্রে একটা বজরা রওনা হবে ৺কাশীধামের দিকে। আমি তোকে আদেশ করছি মা, এই শেষ সুযোগ। তুই কাশীতে চলে যা।
—আপনি?
—আমি কেমন করে যাব? ৺আনন্দময়ী মায়ের নিত্যসেবা আছে না?
—আমারও তো আছে, জেঠু, সোঞাই মায়ের নিত্যসেবা।
তারাপ্রসন্ন বলেন, তোকে আজ এই অনুরোধ করতে এসেছি একটি বিশেষ কারণে। তোর স্বার্থে নয়, আমার স্বার্থে। শোন বুঝিয়ে বলি :
ব্রজসুন্দরী ৺কাশীধামের চৌষট্টিযোগিনী ঘাটের বাড়িতে আজও জীবিতা। কিন্তু সম্প্রতি তিনি উত্থানশক্তিরহিতা। দুর্ভাগ্যক্রমে তার পূর্বেই দীর্ঘদিনের জন্য বাড়ির আর সবাই—তারাসুন্দরী, পুঁটুরানীরা—এক যাত্রীদলের সঙ্গে তীর্থদর্শনে যাত্রা করেছে- মথুরা, বৃন্দাবন, কুরুক্ষেত্র, হরিদ্বার, হয়তো-বা কেদার-বদ্রী গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী।
হটী রাজি হল। ব্রজসুন্দরীকে সে স্বচক্ষে দেখেনি, শুধু গল্পই শুনেছে বাবামশায়ের কাছে। তিনিই এ অঞ্চলের—হয়তো গোটা বর্ধমানভূমির—প্রথম সংস্কৃতভাষাজ্ঞানী পণ্ডিতা। বললে, তাই যাব, জেঠু। আপনি তাহলে বাবামশায়ের এই পুঁথিগুলি আপনার সংকলনে রাখুন। যদি কখনো ফিরে আসি তাহলে আবার পাব।
তারাপ্রসন্ন বলেন, তা না হয় রাখছি। কিন্তু তোর বিবাহের যৌতুক তো আমার কাছে গচ্ছিত রাখা আছে! তার কী হবে?
হটী বলেছিল, আপনার কাছেই থাক। যদি ফিরে আসতে না পারি তবে সৎকাজে তা ব্যয় করবেন। মহামন্বন্তর যত ভয়াবহই হোক, তবু কিছু মানুষ তা পাড়ি দেবেই। তারা আবার ফিরে আসবে। তখন হয়তো স্বর্ণের বিনিময়ে তণ্ডুলও হাটে ক্রয় করা সম্ভব হবে। সেটাই হবে স্বর্ণালঙ্কারের যথাযোগ্য ব্যবহার।
১১
পরদিন সূর্যোদয়ের পূর্বেই বজরাটা রওনা হল। জনাত্রিশেক যাত্রী। অধিকাংশই স্ত্রীলোক ও নাবালক। মাঝি-মাল্লা ব্যতিরেকে দু-তিনজন সশস্ত্র পাইকও আছে। ইদানীং যেহেতু চাষবাস বন্ধ, তাই নদীবক্ষে দস্যুদলের অত্যাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। হটী ওদের মধ্যে পরিচিত কাউকে দেখতে পেল না, অথচ অনেকেই তাকে শনাক্ত করল ভবানী-মা হিসাবে। নিজেরাই সড়ে-নড়ে ওর ঠাঁই করে দিল। ওর সঙ্গে একটি পুঁটলিতে কিছু থানকাপড়, দু-একটি প্রিয় পুঁথি; একটি পুলিন্দায় কিছু জরুরি ঔষধপত্র আর একমুঠিবাবার সেই বিরাহ-বিতাড়নের ত্রিশূলটা।
বজরা চলল প্রথমে দক্ষিণ-পুবমুখো। পার হল অনেক বড় বড় গঞ্জ, শহর। সব যেন শূন্য খাঁ-খাঁ। লোকজনের সাক্ষাৎই মেলে না। হয় মরেছে, নয় পালিয়েছে। বজরা মাঝে মাঝে চড়ায় ভেড়ে অথবা ঘাটে। যাত্রীরা পাথুরে উনানে কাঠকুঠো জ্বেলে রন্ধন করে। সঞ্চয় ক্রমশ কমে আসছে। আশা আছে, রাজমহলের কাছাকাছি পৌঁছে অর্থের বিনিময়ে তণ্ডুল ক্রয় করা যাবে। সেই ভরসাতেই ওরা আধপেটা খায়। আরও মাসখানেক পাড়ি না দিলে কোনও হাটে-বাজারে তণ্ডুল ক্রয় করা যাবে না। মাঝি-মাল্লারা ভবানী-মায়ের জন্য ফল-পাকুড় এনে দেয়। মাঝে-মাঝে সে বামুনদিদিদের রান্না করা অন্নও গ্রহণ করে। তাঁদের রন্ধনকার্যে সাহায্য করে। রায়গিন্নি সান্ত্বনা দেন, বৃহৎকাষ্ঠে দোষ নাই।
হটী হাসে। এসব কুসংস্কার তার নেই। ফলে অসুবিধা হয় না।
গঙ্গায় উপনীত হয়ে বজরা উত্তরমুখী হল। নবদ্বীপ অতিক্রমণের কিছু পরে পশ্চিমমুখী। তারপর একরাত্রে হল ভয়াবহ জলদস্যুদের অতর্কিত আক্ৰমণ!
মধ্যরাত্রে নিদ্রাভঙ্গের পর হঠাৎ দেখতে পেল—যাত্রীদল প্রাণভয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। আর একদল মশালধারী দস্যু তাদের সর্বস্ব অপহরণ করছে। হটী হাত বাড়িয়ে তার ত্রিশূলটার নাগাল পেতে গেল। সেটা স্বস্থানে নাই। কোনো দস্যু মশালের আলোয় সেটাকে দেখতে পেয়ে সর্বপ্রথমেই আত্মসাৎ করেছে। রিক্তহস্তেই প্রতিবাদ গড়ে তুলতে চাইল রূপমঞ্জরী। কিন্তু সফল হল না। এক ভীমদর্শন দস্যু সর্দারের যষ্টির আঘাতে সংজ্ঞাহীনা হয়ে লুটিয়ে পড়ল বজরার পাটাতনের ওপর।
*
জ্ঞান হল প্রায় আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে। দস্যুরা ওদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করেছিল বটে, অহেতুক প্রাণহানি করেনি। যারা সন্তরণে অভ্যস্ত তাদের অনেকেই গঙ্গায় ঝাঁপ খেয়ে পড়েছে। যারা সাঁতার জানে না, তারা শুধু থরহরি কাঁপতে থাকে। পাইক ছ’জন প্রতিরোধ করার চেষ্টায় প্রাণ দেয়, অথবা আহত অবস্থায় গঙ্গায় ঝাঁপ খায়। তাদের মধ্যে কয়জন বেঁচে গেছে তার হিসাব নেই।
জ্ঞান হয়ে দেখল, সে একটি বজরায় শায়িতা। ছোট্ট একফালি কামরা। একটি মধ্যবয়সী মহিলা ওর মাথায় জলপটি বদলে দিচ্ছেন। ওর মাথায় আহত স্থানটি বস্ত্রখণ্ডে আবৃত। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এ বজরাটি দস্যু সর্দারের। মহিলাটি জানতে চায়, দর্দ হ্যয় ক্যা?
হটী নেতিবাচক শিরঃসঞ্চালন করে। মহিলাটি ওকে কী যেন একটা পানীয় গ্রহণ করতে বলেন। সম্ভবত ‘নিম্বুপানি’। সেটা পান করে ও কিছু সুস্থ বোধ করে। জানতে চায়, আমাদের দলের আর সবাই কোথায়?
স্ত্রীলাকটি ঠেট হিন্দিতে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেন যে, তারা বিশ ক্রোশ ভাঁটিতে তাদের বজরায় পড়ে আছে। তাদের মধ্যে কতজন ‘জিন্দা’ আর কতজন ‘গুজর গ্যয়া’ এ সংবাদ তিনি জানেন না। উপসংহার হিসাবে বলেন, সবাই অবশ্য শেষমেশ মরবেই। অনাহারে। কারণ জলদস্যুরা তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে এনেছে। আহার্য বা তণ্ডুল সে জলযানে নাই।
—আমার মতো আর কয়জনকে এভাবে তুলে এনেছে?
—ঔর কোই নেহি। সিরেফ আকেলি তু।
তারপর সে নিজেই প্রশ্ন করে, জানতি হো কৈসে তু বঁচ গয়ী?
হটী নিস্পন্দ তাকিয়ে থাকে। মহিলাটি তার বিচিত্রভাষে বুঝিয়ে বলে, তোকে ‘জান’ দিয়েছে তেরি জওয়ানি ঔর খুবসুরতি।
হটী জানতে চায়, তুমি কে? দস্যুসর্দারের ঘরওয়ালি?
মেয়েটি ম্লান হাসল। তার ভাষায় যা বলল তার অর্থ : লোকটার ঘরই নেই, এই নৌকাই তার আশ্রয়। তা ঘরওয়ালি থাকবে কেমন করে? ম্যয় হুঁ সর্দারকী রখেল।
‘রখেল’! তার অর্থ কী? প্রশ্ন করায় মহিলাটি বললে, তু ন হি জানতি ক্যা? হিম্মৎবালে আদমি খুবসুরৎ রখেল পালতে হাঁয়!
বুঝিয়ে বলে, ‘রখেলকে সাদি করা যায় না। লেকিন সুহাগমে কে।ই কমি নেহি। যদিও তার জন্য সোনেকি জঞ্জিরের ইন্তাজামও থাকে। তারপর তার নিজের দেহের দিকে ইঙ্গিত করে বলে, দেখতেই তো পাচ্ছিস, ম্যয় বুড্ডি বন্ গয়ী।
এখন তার বাতিল হবার জমানা। সে এবার ধরম্-করমমে মন বসাবে। হটীকে আশ্বাস দেয়, তার এখন দশ-বিশ বছর কোনও অসুবিধা হবে না—যবতক্ ওর জওয়ানি আর খুবসুরতি অটুট থাকবে।
কী মর্মান্তিক দুর্ভাগিনী আমাদের কাহিনির নায়িকা : জন্মমুহূর্তেই হারিয়েছিল গর্ভধারিণীকে। শিশুকাল বিদায় নেবার আগে বিদায় নিল মায়ের বিকল্প মামণি; বাল্যকাল শেষ হবার আগে মামণির বিকল্প সোনা-মা! পেয়েছিল এক ক্ষণজন্মা ব্রাহ্মণকে পিতা হিসাবে। লাখে-একটা অমন মানুষ হয় না। বালবিধবা হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে দাহ করে এল চণ্ডাল-শ্মশানে। ‘প্রেম’ এসেছিল নিঃশব্দচরণে। ওর খেলার সাথীর হাত ধরে। রূপমঞ্জরী কৈশোরের ঊষালগ্নেই হয়ে গিয়েছিল : মঞ্জু। নিষ্ঠুর নিয়তির সেটা সহ্য হল না। ওর জীবনের প্রথম প্রেম বিবাগী হয়ে মানস সরোবরে যাত্রা করল। তবু সে হার মানেনি। আয়ুর্বেদশাস্ত্র আয়ত্ত করে স্বামী-স্ত্রী মিলে খুলে বসতে চেয়েছিল একটি আরোগ্য-নিকেতন। সে স্বপ্ন মুছে গেল বজ্রাঘাতে। ওর হাতে রইল স্পর্শ-বাঁচানো একটি ভাদ্রের ফোটা-কদমের সুখস্মৃতি।
কিন্তু আমার কী অপরাধ? আমি কী করতে পারি? এটাই যে কথাকোবিদের নিয়তি! স্বয়ং আদিকবির নায়িকাও তো ছিল জনমদুখিনী! সেওতো সবকিছু পেয়েও হারিয়েছিল তার বেশি! নিয়তির নিষ্ঠুর কশাঘাতে তাকেও তো একদিন বলতে হয়েছিল : মা ধরণী! দ্বিধা হও!
আদিকবির খাগের কলমেও কি মাঝে মাঝে কালি শুকিয়ে যেত? তাঁর তালপাতার পৃষ্ঠাও কি আমার পাণ্ডুলিপির মতো টপটপ করে ঝরে-পড়া চোখের জলে যেত ভিজে?
১২
ক্রমে কিছুটা ঘনিষ্ঠতা হল। সর্দারের বয়স্থা রখেলের নাম রুক্মিনী। ব্রাহ্মণ-কন্যা।
আদি নিবাস রাজস্থান। মানুষ হয়েছে গৌড়বঙ্গে। মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি জিয়াগঞ্জে। ওর পিতা ছিলেন ফতেচাঁদ বা জগৎ শেঠ-এর প্রিয় পাত্র। বিবাহ হয়েছিল ওই জিয়াগঞ্জেই। আট বছর বয়সে। শাস্ত্র মেনে : ‘অষ্টম বর্ষে তু ভবেৎ গৌরী।’ ‘গহনা’, অর্থাৎ দ্বিরাগমন হয় ষোড়শ বর্ষে। সাত বছর বজায় ছিল তার শাঁখা-সিঁদুর। তা যখন ঘুচল তখন শ্বশুরকুল আয়োজন করলেন শাস্ত্রসম্মত সহমরণের। রুক্মিনীর দুই সতীন ছিলেন, কিন্তু তাঁরা সন্তানবতী এবং সংসারে প্রতিষ্ঠিতা। এই নিঃসস্তানা নবাগতাকেই প্রদান করা হল স্বামীর চিতায় উঠে বসার অধিকার। এরপর সবকথা ওর ঠিক ঠিক মনে পড়ে না। কী-একটা সরবৎ ওকে খাইয়ে দেওয়া হয়। ওর সবকিছু গুলিয়ে যায়। মাথার ভিতর টলমল করতে থাকে। বাকিটা শুনেছে সর্দারের কাছে। সর্দার তখন জিয়াগঞ্জের ঘাটে তার দস্যুদল নিয়ে ছক কষছে : কোন্ শেঠের গদিতে ডাকাতি করতে গেলে বিপদের আশঙ্কা কম, লভ্যাংশ বেশি। হঠাৎ ঘাটে একটা সোরগোল শুনে সদলবলে সে কৌতূহলী হয়ে সতীদাহ দেখতে আসে।
ধুতুরামিশ্রিত সরবৎ পান করে রুক্মিনীর মাথায় যেমন চক্কর দিয়েছিল, এই একবস্ত্রা ত্রয়োবিংশতি বর্ষীয়াকে স্নানরতা অবস্থায় দেখে সর্দারের মাথাতেও তেমনি চক্কর দিয়ে উঠল। ওরা সদলবলে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুকমিনীর শ্বশুরের পাইক-বরকন্দাজের উপর। কোন্ পক্ষে কতজন হতাহত হয়েছিল সেটা হিসাবের বাইরে। রুক্মিনীকে জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করতে হয়নি। তারপর সে দীর্ঘদিন আছে সর্দারের ‘রখেল’ হিসাবে। মাঝে কিছুদিন সে কাশীর এক বাইজির আশ্রয়েও ছিল। ওর কোন সন্তান নেই, খেদও নেই। সর্দারকে ও ভালবাসে। সর্দারও ওকে। এখন ওর জওয়ানি খতম হয়েছে। সে খুশি মনেই তার বাইজি-বহিনের আশ্রয়ে ফিরে যাবে। বাকি জীবন ভজন গাইবে।
হটী জানতে চেয়েছিল, ও তোমাকে সাদি করল না কেন?
—ও মা! তা কী করে করবে? ও তো নিচু জাত। জল-অচল। আর আমি বামুনের বিধবা! সাদি কেমন করে হবে?
হটী রুখে ওঠে, এ তো আজব কথা! ব্রাহ্মণের বিধবাকে ‘রখেল’ রাখা যাবে অথচ বিবাহ করা যাবে না?
—পণ্ডিতজী তো তাই বলেছিলেন। কোনও শাস্ত্রে নাকি বলা নেই ‘রখেল’ পোষার সময় জাতবিচার করা হবে কি হবে না।
হটী নিজেও কিছু শাস্ত্র-টাস্ত্র পড়েছে। ওরও মনে পড়ল না মনুসংহিতায় বা গৃহ্যসূত্রে উপপত্নী নির্বাচনের সময় জাতি, গোত্র, কৌম ইত্যাদির বিচার করতে হবে কিনা। পুরুষ-স্ত্রীর জন্মপত্রিকা বা কোষ্ঠিবিচার আদৌ নির্ণেয় কি না।
রুক্মিনী ওকে আশ্বস্ত করেছে—সর্দারের কোনো বিকৃত রুচি নাই। একটু নেশাভাঙ করে, এই যা। কামবিকার নাই! স্বাভাবিক সুরতেচ্ছা।
বজরা এসে পৌঁছেছে বিহার রাজ্যে। পার হল রাজমহল। তারপর আরও গুটিকয়েক গঞ্জ। এখানে লোকালয় জনমানবশূন্য নয়। সকালের দিকে ঘাটে স্নানার্থীদের ভিড়। পালোয়ানেরা ডন-বৈঠক দেয়। পণ্ডিতজীরা জলমগ্ন অবস্থায় গঙ্গাজলে গঙ্গাকেই অঞ্জলি দেন। পাণ্ডাজি গোলপাতার ছাউনিতে স্নানার্থীদের জামাকাপড় পাহারা দেয়। বাচ্চারা ঝাঁপাই জোড়ে। বধূরা টুপটুপ ডুব দেয়। পানকৌড়ির মতো।
রুক্মিনী এখন কাজে ব্যস্ত। রান্নার দায়িত্বটা তার। বজরার সঙ্গে চলেছে আরও তিনটি ছিপ-নৌকা। দৈনিক বিশ-পঁচিশজন দস্যুর আহার্য প্রস্তুত করতে হয়। হটী গৃহবন্দিনী। কামরার বাইরে আসার হুকুম নাই। সর্বক্ষণ এক সশস্ত্র প্রহরী ওর দরজার সম্মুখে পাহারায় থাকে। ওর কক্ষ-সংলগ্ন স্নানাগার ও শৌচাগার আছে। ওর আহার্য প্রতিদিন নিয়ে আসে একটি বালক। সাত-আট বছর বয়স। নাম : রতনলাল। সর্দারের একমাত্র মাতৃহীন সন্তান। মানুষ হচ্ছে তার বিমাতা-প্রতিম রুক্মনীর দেখভালে। হটীর সঙ্গে তারও খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। ছেলেটি বাংলাভাষা একেবারেই বোঝে না। তবে একমুঠিবাবার দয়ায় হটী কাজ-চলা মতো হিন্দি বলতে পারে। রতন প্রায়ই এসে বসে তার ‘মৌসি’র কাছে। গল্প শোনে—ধ্রুব, একলব্য, প্রহ্লাদ, লবকুশের কাহিনি। এদের কাউকেই রতনলাল এতদিন চিনত না।
রুক্মিনীকে হটী এখন ‘দিদি’ ডাকে। বয়সে সে দশ-পনের বছরের বড়। একদিন সে জনান্তিকে রুক্মিনীকে বললে, একটা কথা বুঝিয়ে বল তো, দিদি। আমি আজ দশ-পনের দিন এ বজরায় আছি, কিন্তু সর্দার তো একরাত্রিতেও এল না আমার গায়ে হাত দিতে। কেন?
রুক্মিনী বললে, হয়তো বজরার এই ছোট্ট ঘরখানা তার মনপসন্দ নয়। কাশীধামের উল্টোদিকে রামনগরের কাছাকাছি আমাদের একটা গোপন আস্তানা আছে। সেখানে পৌঁছে তোকে নথ পরাবে।
—নথ পরাবে’! তার মানে?
—’সাদি’র পরে প্রথম রাতটাকে যেমন বলে ‘ফুলশ্যে’, রখেল পোষারও তেমনি একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার আছে। খানাপিনা হয়। গানা-বজানাও চলে। সে রাত্রে মরদ তার পোষা ময়নাকে একটা সোনার টানা-নথ পরিয়ে দেয়। তার মানে, আনুষ্ঠানিকভাবে ওই স্ত্রীলোকটিকে সে তার ‘রখেল’ হিসাবে স্বীকার করে নিল।
রূপমঞ্জরী অনেকক্ষণ নীরবে কী যেন ভাবল। তারপর বলে, দিদি, তুমি আমাকে একটা জিনিস এনে দেবে?
—কী? বল?
—একটা পিতলের কলসি!
—মতলব?
—আমি ভাল সাঁতার জানি। প্রহরীটার চোখ এড়িয়ে কোন রাত্রে গঙ্গায় ঝাঁপ খেলেও ডুবে মরতে পারব না। দড়ি লাগবে না। শাড়ি আমার কাছেই আছে। কেউ কিছু টের পাবে না। তোমাকে সন্দেহ করবে না। ঘরে একটা জলভরা কলসি রেখে গেলেই…
রুক্মিনী কথার জবাব দেয় না। নিঃশব্দে উঠে চলে যায়।
পরদিন সে আবার ফিরে আসে। জানতে চায়, সর্দারের উপপত্নী হিসাবে জীবন অতিবাহিত করতে সে কেন রাজি নয়। রূপমঞ্জরী বলল, সে আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। আত্মহত্যা আমাকে করতেই হবে। এখানে সুযোগ নেই। কাশীতে পৌঁছে নিশ্চয় তা পেয়ে যাব। কেউ যদি আত্মহত্যা করতে বদ্ধপরিকর হয় তাহলে তাকে রোখা যায় না। আমি চাইছি ও আমার ধর্মনষ্ট করার আগেই তা করতে। কাল সে জন্যই আমি তোমার সাহায্য চেয়েছিলাম।
রুক্মিনী বলল, তুই যা চাইছিস তা আমি তোকে দিতে পারব না। সেটা আমার পক্ষে নিমকহারামি হয়ে যাবে। ও লোকটা আমার জান দিয়েছে। দীর্ঘদিন দুনিয়াদারী করার সুযোগ দিয়েছে। সুখেও রেখেছিল। আমার জওয়ানি হারিয়ে যাওয়াটা আমার হাতে নেই, তা বলে তাকে আমি দোষী করতে পারি না। কিন্তু তোকে আমি বাঁচাতে পারি। যদি তুই সচ্ সচ্ আমার সব কথার জবাব দিস। কেন জানতে চাইছি তা জিগ্যেস করবি না।
আশার একটা ক্ষীণ আলোকবর্তিকা দেখতে পেল রূপমঞ্জরী। বললে, মিছে কথা আমি বলি না, দিদি। বলব না। কী জানতে চাও বল?
—তুই বামুনের বিধবা একথা আগেই বলেছিস। তোর সাদি হয়েছিল কত বছর বয়সে?
—এগারো।
—আর গাওনা?
—না। দ্বিরাগমন আমার হয়নি। তার আগেই আমি বিধবা হয়ে যাই।
—তার মানে ফুলশয্যা হয়নি? সোয়ামির সঙ্গে একটা রাতও কাটাসনি?
—সে তো বটেই!
—আর কোনো পুরুষের সাথে?
—মানে?
—ন্যাকামি করিস না! এর মানে বোঝা কি এতই শক্ত? যা জিগ্যেস করছি, সাফ সাফ বাতা দে! তুই কি জিন্দেগিভর কখনো কোনও পুরুষের সঙ্গে এক বিছানায় রাত কাটাসনি?
—এসব কথা জানতে চাইছ কেন?
—না বলতে চাস, বলিস না। তোর জীবনের গোপনকথা আমারই বা জেনে কী লাভ? তোর ‘ভালাই’-এর জন্যই জানতে চাইছি। আমি যা জানতে চেয়েছি—তা যদি সত্যি হয়—পুরুষ-সংসর্গ যদি তোর এই এককুড়ি-পাঁচ বছর বয়সে একবারও না হয়ে থাকে তাহলে আমি তোকে হয়তো বাঁচাতে পারব। তোকে সর্দারের ‘রখেল’ হয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে না। তোকে ও ছেড়ে দেবে। যেখানে চাস তোকে নামিয়ে দেবে। কিছু অর্থও দেবে।
রূপমঞ্জরী অবাক হয়ে যায়। কার্য-কারণ সম্পর্ক বুঝতে পারে না। আশায় উদ্দীপনায় উজ্জ্বল হয়ে বলে, হ্যাঁ দিদি! তুমি যা বললে তাই ঠিক। জীবনে আমি কখনো কোনো পুরুষের সঙ্গে এক বিছানায় শুইনি। ফুলশয্যার রাত্রিটা আমার জীবনে আসেইনি। বাকি জীবনেও কোনো পুরুষের সঙ্গে আমার সহবাস হয়নি।
—কোনও দাই-এর সাহায্যে আমরা কিন্তু পরীক্ষা করে নেব। সচ্ বলছিস?
রূপমঞ্জরী রুখে ওঠে, এ কথার জবাব আগেই দিয়েছি দিদি, আমি মিছে কথা বলি না।
রুক্মিনী তখন ওকে জানাল এক গূঢ় বার্তা। দশদিন এ বজরাতে যদিও ওই সুন্দরী মেয়েটি বাস করছে তবু সর্দার তার দেহটা উপভোগ করতে আসেনি—তার হেতু সম্পূর্ণ অন্যরকম। সর্দারের এক গুরুজী আছেন। কাশীতে তাঁর আশ্রম। মহা নিষ্ঠাবান তান্ত্রিক। তিনি বহুদিন পূর্বে সর্দারকে জানিয়েছিলেন এক অক্ষতযোনি ব্রাহ্মণকন্যার নিতান্ত প্রয়োজন তাঁর। তন্ত্রসাধনার এক কঠিন মার্গের শেষ পর্যায়ে অমন একটি কন্যাকে তাঁর সাধনসঙ্গিনী করতে হবে। সাধিকা ব্রাহ্মণকন্যা হওয়া চাই। তার অঙ্গহানি থাকলে চলবে না। বয়ঃক্রম ন্যূনতম ষোড়শ, ঊর্ধ্বতম ত্রিশ। আর তার আবশ্যিক আর একটি গুণ থাকা চাই—তাকে অক্ষতযোনি হতে হবে। সেক্ষেত্রে তান্ত্রিক গুরুমহারাজ সাধনায় চরম সিদ্ধিলাভ করবেন। তিনি বাকসিদ্ধ হয়ে যাবেন এবং সর্দারকে অস্ত্রসিদ্ধ করে দিতে পারবেন। অর্থাৎ কোনো অস্ত্রই সর্দারের দেহে তখন আর বিদ্ধ হবে না। তরোয়াল বা ভল্ল প্রতিহত হয়ে ফিরে আসবে।
সর্দার দীর্ঘদিন সন্ধান করে ফিরেছে। ‘অস্ত্রসিদ্ধ’ হবার বাসনাটা তার উদগ্র কিন্তু অমন একটি যুৎসই রমণীরত্বের সন্ধান পায়নি। রূপমঞ্জরীকে পরীক্ষা করে যদি সর্দারের বিশ্বস্ত ধাত্রী সিদ্ধান্তে আসে যে এই মেয়েটির দেহে কোনও পুরুষ-সংসর্গের প্রমাণ নাই, তাহলে তাকে ও আদৌ ‘রখেল’ হিসাবে রাখবে না। গুরুদেবকে এই দুর্লভ উপহারটি ভেট দেবে। সেই সূত্রে গুরুদেবের সাধনসঙ্গিনী হয়ে যাবেন ওর মাতাজী। গুরুদেব পরিবর্তে ওকে ‘অস্ত্রসিদ্ধ’ করে দেবেন। বাকি জিন্দেগিভর কোনও হারামজাদা ওকে বর্ণায় বিদ্ধ করতে পারবে না, তরোয়ালের কোপেও কাবু করতে পারবে না। দস্যুসর্দারের দৃষ্টিভঙ্গিতে এ প্রাপ্তি এক রমণীরত্নকে ‘রখেল’ রাখতে পারার চেয়েও অনেক অনেক বেশি মূল্যবান।
রুক্মিনী ওকে বোঝাল, তান্ত্রিক ওকে কোনো এক অমাবস্যা রাত্রে একরাত্রের জন্যই সাধনসঙ্গিনী করতে চান। তারপর তার ছুটি। সেই একটি রাত্রে সাধনসঙ্গিনীকে ঠিক কী কী করতে হবে তা অবশ্য রুক্মিনী জানে না। আন্দাজ করে, তার অক্ষত নারীত্বকে পূর্ণাহুতি দিতে হবে।
‘মৎস্য-মাংস-মদ্য-মুদ্রা’ ইত্যাদি সাধনসঙ্গিনী হিসাবে গ্রহণ করতে হবে কিনা জানা নেই। তবে শেষ ‘ম’-কারটা যখন অনিবার্য তখন একরাত্রের জন্য কি বিধবার পক্ষে বাকি চারটি অকিঞ্চিৎকর ‘ম’-কার গ্রহণে কিছু আপত্তি থাকতে পারে?
রূপমঞ্জরী নতনেত্রে বললে, আমি স্বীকৃত।
—আমি জানতাম। তুই রাজি হয়ে যাবি। সিরফ এক রাতের যন্ত্রণা। যন্ত্রণাও ঠিক নয়। শুনেছি, মন্ত্র, দারু আর মাংসের প্রভাবে উত্তেজনা এমন চরম হয়ে ওঠে যে, সাধিকা সক্রিয় অংশ নেয় শেষ মৈথুনপর্বে! এমনকি কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাধিকা আমাকে গোপনে জানিয়েছে যে, প্রথম পুরুষ-সংসর্গের যে যন্ত্রণাটা স্বাভাবিকভাবে হয়, চক্রের সাধনমার্গে তাও হয় না। মদ্যপ্রভাবে সব কিছুই ভাল লাগে সাধিকার। প্রথম সংসর্গেই চরম পুলক লাভ করে সাধনসঙ্গী আর সঙ্গিনী।
—তাহলে আর আপত্তি কিসের? আমি রাজি।
নিশ্চিন্ত হল রুক্মিনী—রূপমঞ্জরী একরাতের জন্য সেই অপরিচিত তান্ত্রিক সাধুবাবার কাছে তার নারীত্বের অর্ঘ্য উজাড় করে দিতে রাজি।
রুক্মিনী তিলমাত্র আন্দাজ করেনি, রূপমঞ্জরীর অন্তরে তখন জাগ্রত হয়েছিল একটি নীতিবাক্য : ‘অশুভস্য কালহরণম্’
সে অস্বীকৃতা হলে সর্দার হয়তো সে রাতেই বন্যমহিষের মতো ওর ধর্মনষ্ট করতে তেড়ে আসবে। মদের ভাণ্ডটি হাতে করে!
অন্তত মাসখানেকের জন্য সে সম্পূর্ণ নিরাপদ। ওই মূর্খ সংস্কারাচ্ছন্ন দস্যুসর্দার সুন্দরী যুবতীর একটা নিরাবরণ দেহের অপেক্ষা ‘অস্ত্রসিদ্ধ’ হওয়ার অলীক স্বপ্নে আপাতত বিহ্বল।
১৩
কিন্তু এ কী ব্যাপার? মহানগরী পাটলিপুত্রের কাছাকাছি এসে বজরাটাকে একটা আঘাটায় নোঙর করা হয়েছে। তারপর পুরো পাঁচদিন সে নোঙর তুলল না। কেন? বজরার অনুষঙ্গী ছিপ নৌকাগুলি ক্রমাগত শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। বজরায় সংগৃহীত হচ্ছে রসদ। এ জলযানটা যে দস্যুসর্দারের তা হয়তো জানে নগর-কোট্টাল। তাই সেটাকে একটা খাড়ি-পথে গাছ-গাছালির অন্তরালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু রসদ সংগ্রহ করতে পাঁচদিন লাগবে কেন? রুকমিনী ক’দিন আসছে না। রতনলাল ও নয়। পাহারাদার অবশ্য নিরন্তর পাহারা দিচ্ছে। তাকে প্রশ্ন করেছিল, সদুত্তর পায়নি। দ্বিতীয় দিন জানতে চাওয়ায় তিরস্কৃত হয়েছে।
বজরাটা প্রায় নির্জন। সবাই ছিপে চেপে শহর দেখতে গেছে। সর্দার যায়নি। তার নামে হুলিয়া আছে। রুক্মিনী অথবা রতনলালও শহর দেখতে গেছে হয়তো। কারণ তাদের দেখা মিলছে না।
এই গোপন আস্তানায় বজরাটা নোঙর করার পরদিন ঘটনাচক্রে সর্দারকে দেখতে পেল। অতি প্রত্যুষে। পুবের আকাশটা সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে। সর্দার তার নির্দিষ্ট শয়নকক্ষ থেকে নির্গত হয়ে এল। দাঁড়াল বজরার ফাঁকা ছাদে। দশাসই জোয়ান। যেন মহিষাসুর। মাথায় লালশালুর ফেট্টি। একমুখ গোঁফদাড়ি। গলায় একটা রুদ্রাক্ষের মালা। কিন্তু লোকটা কী করছে? মনে হল একটা চটের থলি থেকে কী একটা পাখিকে বার করে আনল। পাখিটা উড়তে পারে না। দেখতে কবুতরের মতো। কিন্তু গমনভঙ্গিমা কবুতরসুলভ নয়। কাঠের পাটাতনে সেটা জোড়া পায়ে হাঁটছে। লাফিয়ে লাফিয়ে। সর্দার তাকে হাতে তুলে নিয়ে কিছু শস্য খাওয়াল। বোধহয় ভুট্টার দানা। তারপর—রূপমঞ্জরীর মনে হল, পাখিটার কানে-কানে কী যেন মন্ত্র পড়ল। কী নিষ্ঠুর! পরমুহূর্তেই পাখিটাকে ছুঁড়ে দিল গঙ্গার দিকে। সেটা কিন্তু জলে পড়ল না। মন্ত্রবলে সেটা উড়তে শিখে গেছে। চক্রাকারে পাখিটা পাক খেতে থাকে। অনেক-অনেক উঁচুতে। এবার সর্দার তাকে ডাকল—আ-আ-আ-আ!
পাখিটা—না, ওটা কবুতরই—ঘুরতে ঘুরতে এসে বসল ওর কাঁধে। সর্দার তাকে আদর করল। তার পায়ে সূক্ষ্ম রেশমিসুতোয় লেখা কী একটা ভূর্জপত্রের টুকরো বেঁধে দিয়ে নৌকার পাটাতনে নামিয়ে দিল। এখন আর সে জোড়া পায়ে হাঁটছে না। সর্দার তার পুলিন্দা থেকে বার করে আনে একটি বিরাট শঙ্খ। ঊর্ধ্বমুখে শঙ্খধ্বনি করে ওঠে। ততক্ষণে সূর্যদেব দেখা দিয়েছেন পূর্ব গগনে। যেন তাঁরই আবাহনী মন্ত্র। বনেবনান্তরে সেই শঙ্খধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।
তৎক্ষণাৎ পারাবতটি উঠে যায় আকাশে। একটা বিরাট চক্কর দিয়ে সে রওনা হয়ে পড়ে সূর্যের বিপরীতে। পশ্চিমমুখো। পাখিটা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ছোট হতে-হতে বিন্দুবৎ হয়ে গেল। তারপর মেঘের আড়ালে কোথায় মিলিয়ে গেল।
হুটী অবাক হয়ে যায়। এর তাৎপর্য কী? পাখিটা মনে হল কবুতর। শুনেছে কবুতরকে রণ-সেনাপতিরা সংবাদবহ রূপে আকাশে উড়িয়ে দেয়। এ লোকটা যেন রামগিরি পর্বতের সেই বিরহী যক্ষ। কিন্তু সে তো বিপত্নীক। তার ‘রখেল’ তো নিত্য তার অঙ্কশায়িনী! তাহলে? সে কোন্ অজানা অলকায় প্রেরণ করল তার দূত? কবুতরটার কানে-কানে অত অল্প সময়ে কী মন্ত্রোচ্চারণে সে বলে দিল কোথায় কোন পথে তাকে পাঠানো হল : ‘মার্গং তাবনু চ কথয়তত্ত্বৎপ্রয়াণানুরূপং’! না হয় মেনে নেওয়া গেল, কবুতরটা সে খবর জানে। জানে অর্থাৎ কোথায়, কোন্ অলকাপুরীতে ওই দস্যুসর্দারের বিরহিণী যক্ষিণীর বাস। ধরে নেওয়া যাক, সে পথের নির্দেশ ওর নখদর্পণে। বেশ, পৌঁছাল। কিন্তু কী বার্তা সে শোনাবে প্রাপককে? ‘সন্দেশং মে তদনু টুকু তো কবুতরকে শিখিয়ে দেওয়া হল না? তাহলে?
এ ব্যাসকূট-অনুপপত্তির সমাধান হল না আদৌ!
ক’দিন ধরে না আসছে রুক্মিনী, না রতনলাল। সারারাত ও বিছানায় ছটফট করে। তৃতীয় দিন দেখল আবার এক অদ্ভুত দৃশ্য। সেই অতি প্রত্যুষে, যখন “ঊষো যাতি স্বসরস্য পত্নী” (ঊষা সূর্যদেবের অগ্রবর্তিনীরূপে আবির্ভূতা হন)। সর্দার বার হয়ে এল ছাদে। মাথায় লালশালুর পট্টি। ঊর্ধ্বাঙ্গ নিরাবরণ। আকাশের দিকে মুখ করে ডাক দিল : আ–বা–বাবা। দেখা গেল মেঘের অন্তরাল থেকে পাক খেতে খেতে নেমে এল সেই কবুতরটি। সর্দার তাকে দু-হাতে লুফে নিল। তাকে চুম্বন করে প্রবেশ করল তার একান্তকক্ষে।
হটীর লক্ষ্য হল তারপরেই কেমন যেন স্তব্ধতা ঘনিয়ে আসতে থাকে বজরায়। একে একে ছিপগুলি ফিরে এল। বজরায় এখন অনেক লোক। কিন্তু কোনো কোলাহল নেই। পরস্পরের সঙ্গে ওরা কথা বলছে নিম্নকণ্ঠে। কী যেন একটা দুঃসংবাদে জলযানটি ভারি হয়ে উঠেছে।
দ্বিপ্রহরে ওর আহার্য-থালিকা নিয়ে উপস্থিত হল সেই প্রহরীটি। যে এ কয়দিন প্রত্যহ খাদ্য সরবরাহ করছে। হটী প্রত্যাখ্যান করল। স্পষ্টভাবে জানাল, রুক্মিনীদিদি অথবা রতনলাল এসে যদি তার সঙ্গে দেখা না করে তবে অনশনে সে দেহত্যাগ করবে। লোকটা এবার আর কোনো কটুকথা বলল না। প্রতিবাদও নয়। সেও যেন কী একটা দুঃসহ বেদনার ভার বহে বেড়াচ্ছে।
একটু পরেই খাবারের থালাটা হাতে নিয়ে এসে উপস্থিত হল রুক্মিনী।
—এসব কী শুরু করেছিস তুই?
—আমার কাছ থেকে তোমরা কী একটা দুঃসংবাদ লুকোবার চেষ্টা করছ! কী সেটা? কেন তুমি আমার কাছে আসছ না? কেন রতনকে আসতে দিচ্ছ না? আমি কী অপরাধ করেছি?
কোথাও কিছু নেই, ঝরঝর কর কেঁদে ফেলল রুক্মনী!
—কী হয়েছে দিদি?
কান্নার মধ্যেই অবরুদ্ধ কণ্ঠে রুক্মিনী দুঃসংবাদটা জানাল :
রতন আজ সপ্তাহকাল মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত। বজরাটি পাটলিপুত্রে অচল হয়ে জলে ভাসছে সেই কারণেই। পাটনা থেকে একজন বিচক্ষণ কবিরাজ গোপনে এসে প্রতিদিন রতনের চিকিৎসার ব্যবস্থাদি করে যাচ্ছেন। তিনি জানেন সর্দার ফেরারী আসামী। সে জন্য দ্বিগুণ বৈদ্যবিদায় দিতে হচ্ছে তাঁকে। অবস্থা দিন দিন ঘোরালো হয়ে ওঠায় সর্দার তার পারাবতদূত মারফৎ কাশীস্থ তান্ত্রিক গুরুমহারাজকে তার প্রচণ্ড বিপদের কথা জানায়। বৈদ্যমহাশয় পূর্বদিন শেষ নিদান হেঁকেছেন—এ ব্যামো শিবের অসাধ্য’! এদিকে আজই গুরুদেবের নিদারুণ বার্তাটি নিয়ে ফিরে এসেছে কবুতর-দূত। তান্ত্রিক মহাসন্ন্যাসী গণনা করে তাঁর শিষ্যকে জানিয়েছেন : শান্তি-স্বস্ত্যয়নে এ অনিবার্য দুর্দৈব নিরাকরণ করা অসম্ভব। রতনের আয়ু আর মাত্র অহোরাত্র! কারণ রতনকে কোন দুরাত্মা পিশাচসিদ্ধ মন্ত্রবলে যমালয়ে প্রেরণে উদ্যোগী হয়েছে। সম্ভবত সেই পিশাচসিদ্ধ পামরটি সর্দারের হস্তে ইতিপূর্বে নিগৃহীত হয়েছে। সে মন্ত্রবলে এইভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে। এ আধিব্যাধি : শিবের অসাধ্য! পাটনার মহাশ্মশানেই দাহকার্য করা বিধেয়।
হটী স্তম্ভিত হয়ে গেল। আশ্চর্য! তার চক্ষুদুটি এই নিদারুণ সংবাদে অশ্রুসজল হয়ে উঠল না। নিমীলিতনেত্রে সে কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে রইল। তারপর কোথাও কিছু নেই, সে হুঙ্কার দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। প্রচণ্ডভাবে মাথা দোলাতে থাকে। তার উন্মুক্ত কেশপাশ বৃহদাকার চামরের মতো দুলতে থাকে। রুক্মিনী অভিজ্ঞ। বুঝতে পারে, হটীর ‘ভর’ হয়েছে! সেও উঠে দাঁড়ায়। হটী মাথা ঝাঁকানো বন্ধ করে উচ্চৈঃস্বরে কী একটা সংস্কৃত-মন্ত্র আওড়াতে থাকে। রুক্মিনী ভয় পেয়ে বলে, কা হুয়ারে বহিনজী? তু ক্যা মাংতি হো?
—বহু মুরকো বোলাও!
—কৌন্ মুরখ্?
—তেরে সর্দার কো! তুরন্ত!
সোরগোল শুনে সবাই ছুটে এসেছে। সর্দারও। হটী তার নাসিকাগ্রে তর্জনীটা তুলে কালিকাপুরাণ থেকে আট-দশটি শ্লোক গড়গড় করে আওড়ে গেল। অতবড় দশাসই সর্দার কেমন যেন বিহ্বল হয়ে পড়ে। জোড়হস্তে বলে, তু ক্যা মাংতি রে, মা?
হটী নৌকার পাটাতনে লুটিয়ে পড়ে। আছাড়ি-পিছাড়ি খায়। কিছুক্ষণ পাটাতনে মুখ ঘষে উঠে বসে। অনেকটা যেন স্বাভাবিক হয়। তার বাহ্যজ্ঞান ফিরে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে আধাহিন্দি-আধাবাংলায় বলে, সর্দার! আমি ডাকিনীবিদ্যা সিদ্ধা! তোর ছাওয়ালটাকে যে পিশাচ কব্জা করেছে তাকে বিতাড়ন করার মন্ত্র আমি জানি। তাকে এই মুহূর্তেই কব্জা করতে পারি। তুই আমাকে রতনের কাছে নিয়ে চল! মায় অভি বহ্ শয়তানকো গর্দন পকড়কে নিকাল দুঙ্গি।
সর্দার তৎক্ষণাৎ হটীকে নিয়ে গেল শয্যাসীন বালকটির কক্ষে।
হটী কিছু অনুপান ভিক্ষা করল : একটি খোলা পানপাতা, একটু সিঁদুর, সরিষার তৈল আর গঙ্গাজলনিষিক্ত তণ্ডুল। প্রথমেই বালকের শয্যাটির চতুর্দিকে ছিটিয়ে দিল পানপাতা থেকে তৈলসিন্দুর-রঞ্জিত তণ্ডুলকণা মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে। তারপর রুক্মিনীর দিকে ফিরে বললে, সম্ঝি? মায় ক্যা করতি?
রুক্মিনী নেতিবাচক মস্তক সঞ্চালন করে। হটী বললে, ‘দেহবন্ধন’! অব্ বহ্ বদমাস পিশাচ রতনকো ছুঁনে নহি সকেগা!
বসল বালকের মাথার কাছে। দীর্ঘক্ষণ তার নাড়ির গতি লক্ষ্য করল। তারপর জানতে চাইল, তাকে যখন অপহরণ করে আনা হয়, তখন একটি পুলিন্দায় ডাকিনীবিদ্যার কিছু সাজসরঞ্জাম ছিল। সেগুলি কোথায়?
তৎক্ষণাৎ সর্দারের আদেশে একজন জলদস্যু নিয়ে এল তার ঔষধের পুলিন্দা। হটী তা থেকে বাহির করল তার খল-নুড়ি, মধুপর্কের আধার আর কিছু ঔষধচূর্ণ। খেল’-এ ঔষধটিকা অর্পণ করে, মধুমিশ্রিত সেই ঔষধটি নুড়ি দ্বারা পেষণ করতে থাকে।
রতনের জ্ঞান নেই। চোখ দুটি নিমীলিত। দাঁতে-দাঁত লেগে আছে। বিগত অহোরাত্রে তাকে কিছু আহার বা পান করানো যায়নি। মৃত্যুপথযাত্রী আছে নির্জলা উপবাসে।
ঔষধ প্রস্তুত শেষ হলে রতনের মুখটা জোর করে উন্মুক্ত করাল। তার জিহ্বায় সেই মধুমিশ্রিত ঔষধটি লেপন করে দিল। আবার বসল তার নাড়ি ধরে। চতুর্দিকে ঘিরে আছে নির্বাক জলদস্যুর দল। অর্থদণ্ড পরে নিশ্চেতন বালক ধীরে ধীরে তার চোখ দুটি খোলে। সে-দৃষ্টি কুয়াশাচ্ছন্ন। প্রত্যক্ষকে উপলব্ধি করায় অসমর্থ। তার ঠোঁট দুটি ফাঁক করে হটী কয়েক ফোঁটা গঙ্গোদক ঢেলে দিল। জিহ্বা শীতল হল। তারপর ধীরে ধীরে ওর কণ্ঠনালিতে জল ঢেলে দিতে থাকে। অধিকাংশই ওষ্ঠাধরের ফাঁক দিয়ে বার হয়ে এল বটে কিন্তু কিছুটা কণ্ঠনালীতে প্রবেশও করল। হেত্বর্থে পঞ্চমী। গলকণ্ঠের ‘সঞ্চালনাৎ’! আবার প্রয়োগ করল একদাগ ঔষধ। রতনের চক্ষুদ্বয় পুনরায় নিমীলিত হয়ে গেল। কিন্তু পুনরায় একদণ্ড পরে রতন তাকিয়ে দেখে। এবার সে-দৃষ্টি উন্মাদের ঘোলাটে চাহনি নয়। রূপমঞ্জরী তার উপর ঝুঁকে পড়ে বলে, ক্যা রে রতন? মুঝে পহচান্তে হো ক্যা?
বালক হাসে। অস্ফুটে বলে : মৌসি!
রূপমঞ্জরী ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে। শিরশ্ছম্বন করে বলে, ডরো মৎ, বেটা! আরামসে নিঁদ্ যাও।
শয্যা থেকে নেমে দাঁড়ায়। সর্দারের দিকে ফেরে। বলে, বহ্ পিশাচ ভাগ গয়া! ডরো মৎ। অব্ তুম নাও ছোড় সতে হো। শিউজীকে পাশ কাশীধাম চলো।
রুক্মিনীর দিকে ফিরে হিন্দিতে বলে, কিছুক্ষণ বাদে-বাদে ওকে গঙ্গাপানি পিলাতে বলো। ওর শরীরে জলীয় অংশ ‘কমি’ হয়ে গেছে।
—খানেকে বারেমে ক্যা দু?
—পহলে নিম্বুপানি। পিছে ডাব-পানি। উস্কো পিছে দুধ পিলানা। খ্যয়ের যবতক ম্যয় হুকুম নহি দেতি তত্তক মৎ পিলানা।
অর্ধদণ্ড পূর্বে যে ছিল বন্দিনী, এখন সে পরিত্রাতা। মাথা খাড়া রেখেই সে ধীরপদে ফিরে গেল তার বন্দি-কুটুরিতে। পিছন পিছন জলযানের দোর্দণ্ড প্রতাপ মালিক চলেছে জোড়হস্তে। তার পশ্চাদনুসরণ করছে দস্যুসর্দারের ‘রখেল’।
বন্দিশালার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়ে হটী ধমকে ওঠে, অব্ ক্যা মাংতে হো?
হঠাৎ ওর সম্মুখে নতজানু হল দশাসই মহিষাসুরটা। করজোড়ে নিম্নস্বরে সে যে নিবেদনটি পেশ করল তাতে স্তম্ভিতা হয়ে গেল রূপমঞ্জরী। বক্তব্যের বাচ্যার্থে নয়, তার ভাষাবৈশিষ্ট্যে।
—তরে মুই পেরথমে চিত্তে লারছি, মা-ঠাইরান!
পরিষ্কার রাঢ়বঙ্গের গ্রাম্যভাষা। ওই বিহারী দস্যুসর্দার এ-ভাষা শিখল কোথায়?
—হমার ভরম হই গেল! অ্যাই বুড়া ছামড়াডারে মাফ করি দে, মা
—তুমি বাঙালি?
—হঁ রে মা! মুই বাংগালিই আছি।
—আবার ‘আছি’ কেন? বল, ‘আমি বাঙালিই’।
লালশালুর পাগড়িটা মাথা থেকে খোলে। অশ্রুসজল চোখ দুটি মুছে নিয়ে বলে, হ রে মা। বহুৎ রোজ তো দ্যাশের ভাষা কই নাই। তাই ভুইল্যা গ্যাছি। গাঁয়ের মনিষ্যি জানে, মুই দামোদরে ডুব্যা মরছি।
—দামোদর! দামোদরের ধারে ছিল তোমার ভিটে? কোন গ্রাম?
—নামটো বুইললে তু কি পহছান্তে পারবি? মোর গাঁয়ের নামটো ছেল সোঞাই!
সমস্ত দেহের রোমকূপ ভাদ্রের ফোটাকদমের মতো কণ্টকিত হয়ে উঠল : সোঞাই! সোঞাই! সোঞাই!!
নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, সর্দার! তোমার গাঁয়ের এক বামুনের নাম শুনেছ? চিনতে তাঁকে? ধন্বন্তরি কবিরাজ? একবগ্গা ঠাকুর?
এবার স্তম্ভিত হবার পালা মহিষাসুরের। কোনোক্রমে বলে, হুঁ রে মা। তাঁরে চিন্তাম। শুন্ছি তাঁই সগ্যে গেছেন।
—কিন্তু কীভাবে তিনি দেহ রাখলেন তা জান?
—হ। সিডাও শুনছি। বেষ্টাবায়েনের ছামড়ডারে বাঁচাইতে। তা তু ইসব কুথা শুনলি?
—সেই একবগ্গাবাবার একটি মেয়ে ছিল। তাকে মনে পড়ে?
—না, তাঁরে মুই চখে দেখি নাই। তয় তাঁইর কথা শুনছি।
—কী শুনেছ?
—তারে পুড়ায়ে মারতি চাইছিল তিজলহাটির এক হারামজাদা বামুন…
—যাঁর মাথা থেকে শামলাটা তীরবিদ্ধ করে তুমি পথের ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছিলে তাই তো?
স্তম্ভিত দস্যুসর্দার এতক্ষণে বজ্ৰাহত!
—কী হল? মনে পড়ছে না? তর খুড়া তোরে বুইল্যে অই শামলাটো ভুঁয়ে নামায়ে দে, বাবা ঈশেন! তয় খুব হুঁশিয়ার! চক্ষুরত্ন দুটি যান বাঁচা যায়। মনে পড়ে?
দস্যুসর্দার ঈশেন বাগদি লুটিয়ে পড়ল মা-ভবানীর চরণমূলে!
*
বাবামশাই বলতেন : ‘সত্য সর্বদাই শিব ও সুন্দরের সহিত সম্পৃক্ত’।—তথ্য ততক্ষণই সত্য যতক্ষণ সে সত্য-শিব-সুন্দরের দিশারী। নচেৎ নয়। তাই তিনি গ্রাম্য গুনিনদের অনায়াসে বলতেন, মা-মনসার স্বপ্নাদেশের কথা। নাগদংশনে বন্ধন দেবার কায়দা শিখিয়ে দিতেন।
রূপমঞ্জরীও তার উপস্থিতবুদ্ধিতে বুঝে নিয়েছিল—কীভাবে ওই বালকটির চিকিৎসার অধিকার সে লাভ করতে পারে। ডাকিনীবিদ্যা-পটিয়সীর ভূমিকায় নির্দ্বিধায় অভিনয় করে বালকটির প্রাণরক্ষা করেছে। তথাকথিত মিথ্যার মাধ্যমে। সেই সত্যনিষ্ঠার ফলাফল তৎক্ষণাৎ পেয়ে গেল। পূর্বমুহূর্তে যে ছিল বন্দিনী—তান্ত্রিক-সন্ন্যাসীর সাধনসঙ্গিনী হওয়ার সৌভাগ্যের জন্য যাকে জিইয়ে রাখা হয়েছিল, সে পরমুহূর্তেই হয়ে গেল দস্যুসর্দারের : মা!
১৪
আমরা আবার ফিরে এসেছি সেই ‘আমড়াতলার মোড়ে।’ 1774 খ্রিস্টাব্দে, সেই যখন দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবের চতুষ্পাঠীতে আমাদের নায়িকা হটী বিদ্যালঙ্কার আশ্রম-গৃহাবরোধে বন্দিনী। ঊনিশ দিনের মেয়াদ। কাশীনরেশের সিংহাসন দখল করে তখন পুরন্দর ক্ষেত্রী শাসনদণ্ড হাতে নিয়েছে। স্ত্রীশিক্ষাদানের মতো জঘন্য সামাজিক অপরাধে হটী বিদ্যালঙ্কারের প্রতি কঠোর শাস্তিবিধান করা হয়েছে।
আমরা ফিরে এসেছি সেই প্রথম খণ্ডের প্রারম্ভ দিবসে। পূর্বদিন মর্মাহত দ্বারকেশ্বর দুরন্ত অভিমানে একবস্ত্রে আশ্রম ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন হরিদ্বারের পথে আদরিণী পালিকা কন্যাকে কোনও সংবাদ না দিয়েই। হরিদ্বারের পূর্ণকুম্ভে স্নান করলে হয়তো তাঁর কন্যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে। কী পাপ? হটী বলেছিলেন, “নিজ বিবেকের বকযন্ত্রে তিনি যাচাই করে নিতে চান যাবতীয় হিন্দুশাস্ত্রের নির্দেশ—এমনকি বৈদিক অনুশাসন পর্যন্ত!” তার পূর্বদিন ওঁরা দুজনে—গুরু ও শিষ্যা—নৌকাযোগে গিয়েছিলেন গঙ্গার পরপারে, ব্যাসকাশীতে। অচল ৺বিশ্বনাথের রাজ্য ছেড়ে শরণ নিয়েছিলেন সচল বিশ্বনাথের পদপ্রান্তে। তিনি কী যেন একটা তির্যক ইঙ্গিত ও করেছিলেন। তার অর্থগ্রহণ হয়নি মহাপণ্ডিতের। কিন্তু মনে হয় সামান্য বোধের উন্মেষ হয়েছিল তাঁর পালিতা কন্যার। সময় অত্যন্ত অল্প। উনিশটি দিবসের ভিতর তিন-চারটি দিন এভাবেই কেটে গেছে। বিদ্যালঙ্কার মুক্তিপথের কোনও সন্ধানই পাননি।
সেরাত্রে তা পেলেন। কী অর্থ ওই দুটি নির্দেশের? জীবাত্মাকে মুক্ত-আকাশে মুক্তি দিতে হয়, পরমাত্মার দিকে জীবাত্মার অভিযান। কী অর্থ ওই তির্যক ভর্ৎসনার : ‘ঔরৎ হয়ে তুই শাঁখ বাজাতে ভুলেছিস?”
পরদিন অতি প্রত্যুষে গাত্রোত্থান করলেন। ঈশেন-সর্দারের উপহার দেওয়া কবুতরটিকে হাতে করে বার হয়ে এলেন প্রাঙ্গণে। প্রতিদিনই আনেন। তাকে ভুট্টার দানা খাওয়ান। পলায়নের আশঙ্কা নাই। ও হাঁটতে পারে না। জোড়া-পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে আশ্রম প্রাঙ্গণে ঘোরাফেরা করে। বিদ্যালঙ্কারের স্মরণ হল কীভাবে তিনি এই উপহারটি লাভ করেন। এইটি আর সেই বিচিত্র শঙ্খটি।
কাশীর কোনও ঘাটে বজরাটা ভেড়েনি। কাশী-কোতোয়ালের প্রহরীরা ওই বজরাটাকে বিশেষভাবে চেনে। তাই কাশীর এক ক্রোশ দূরে গঙ্গার একটি খাঁড়িতে বজরাটাকে নোঙর করা হয়েছে। এক মধ্যরাত্রে ঈশেন তার মা-জননীকে নিয়ে রওনা হয়েছিল বেণীমাধবের গুহার দিকে। দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে।
শুক্লা অষ্টমী তিথি। নির্মেঘ আকাশে চন্দ্রদেব প্রায় মধ্যগগনে। সকৌতুকে চন্দ্ৰ দেখছেন একটি ছিপ-নৌকা প্রায় নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। ঘাট জনহীন। কিছু মানুষ অবশ্য পাষাণ সোপানে গভীর নিদ্রাগত। ওরা অনিকেত। ভিক্ষাজীবী। আছেন কিছু জটাজুটধারী সন্ন্যাসীও।
নৌকায় তিনজন আরোহী। দুজন পুরুষ ও একটি স্ত্রীলোক। ঈশেন সর্দার তার এক সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে চলেছে তার মা-জননীকে দশাশ্বমেধে পৌঁছে দিতে। চৌষট্টি-যোগিনী ঘাটে সোঞাই গাঁয়ের জমিদার ব্রজেন্দ্রনারায়ণ ভাদুড়ীর সোপানটি তার অপরিচিত নয়। কিন্তু সেখানে সে তার মা-জননীকে পৌঁছে দিতে পারবে না। কাশীধামের নগর-কোতোয়ালের প্রহরীদলের কাছে ঈশেন অপরিচিত নয়। দস্যুসর্দার হিসাবে সে সুচিহ্নিত। তার মাথার উপর মোটা ইনাম ঘোষণা করা আছে। হঠাৎ ঈশেনের নজর হল দূর থেকে দু-তিনটি ছিপ্নৌকা তীরবেগে ওদের নৌকার দিকে এগিয়ে আসছে। ঈশেনের দৃষ্টি অতি সজাগ। নিশাচর বৃত্তি গ্রহণ করার পর সে চিতাবাঘের মতো অন্ধকারেও দেখতে পায়। তার সঙ্গীকে ঠেট্ হিন্দিতে নিচুগলায় বলে ওঠে, যদুলাল! হারামজাদাগুলো আমাদের তল্লাস করতেই এগিয়ে আসছে রে। কোতোয়ালের প্রহরী-নৌকা!
—তব্ ক্যা করু?
—তোকে ওরা চিনবে না। তুই মা-কে দশাশ্বমেধে নামিয়ে দিবি। রাত ভোর হলে মা নিজেই খুঁজে খুঁজে চৌষট্টিঘাটে চলে যাবেন।
—ঔর তুম?
—আমি টুপ করে এখনি গঙ্গায় নেমে যাব। সাঁতরে ফিরে যাব বজরায়। ওরা দলে ভারি। এ ছাড়া আর পালাবার পথ নেই।
সর্দারের নির্দেশ মতো যদুলাল রূপমঞ্জরীকে নামিয়ে দিয়েছিল দশাশ্বমেধ ঘাটে। প্রহরীরা যদুলালের ছিপ তল্লাসী করে কিছুই পায়নি। বিদায় নেবার আগে মা-জননীকে গড় করে যদুলাল ওঁর দিকে বাড়িয়ে ধরেছিল একটি পুঁটুলি। তাতে কী আছে যদুলাল জানত না। হটীও তা হাড়ে দেখেননি। সেই পুঁটুলিটি বুকে জড়িয়ে ধরে রাত্রি প্রভাতের জন্য বসেছিলেন দশাশ্বমেধঘাটে।
তারপর কীভাবে দ্বারকেশ্বর তাঁর সন্ধান পান তা আমরা বিশবছর আগেই জেনেছি।
১৫
কবুতরটি জোড়াপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রাঙ্গণ পরিক্রমা করছে। কেন? ও উড়তেই বা পারে না কেন? পাখিটাকে সযত্নে হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। দেখলেন, ওর দুটি পায়ে সূক্ষ্ম মসলিন-সুতোর শৃঙ্খল, দুটি ডানাতেও। তাই ও হাঁটতে পারে না। উড়তেও পারে না। আহা রে! তাই ও বন্দি—ঠিক হটী যেমন বন্দিনী। তখনই মনে পড়ে গেল মহাপুরুষের নির্দেশ : ‘জীবাত্মাকে বন্দি রাখতে নেই। মুক্ত নীলাকাশে, পরমাত্মার দিকে অভিযাত্রায় তার জন্মগত অধিকার! ক্যা রে বেটি? সমঝি?
না। সেদিন সবটা বুঝতে পারেননি। আজ পারলেন। ঈশেন কেন ওঁকে উপহার দিয়েছিল এই কবুতরটি। এ হচ্ছে মুক্তিদূত। ঈশেন হয়তো ওঁকে সবকথা বুঝিয়ে বলার সময় পায়নি। কিন্তু তীক্ষ্ণধী বিদ্যালঙ্কার কার্য-কারণ-সূত্রগুলি সহজেই প্রণিধান করলেন। ওই পারাবত-দূতের মাধ্যমেই সংবাদ পাঠাতে হবে ঈশেন সর্দারকে। কিন্তু ঈশেন তো অক্ষর-পরিচয়হীন! কী করে সে বুঝবে? তা হোক দূতকে প্রেরণ করলে কবুতরটি অনায়াসে রামনগরে ঈশেনের গুপ্ত আবাসে ফিরে যাবে। সেখানে কেউ-না-কেউ বুঝবেই। তিনি একটি ছোট্ট ভূর্জপত্রে তাঁর বিপদের কথা লিখে রেশমসূত্রে আবদ্ধ করেছিলেন দূতের পায়ে। তাকে কিছু ভুট্টাদানা খাইয়ে আদর করলেন। নিক্ষেপ করলেন মুক্ত নীলাকাশের দিকে।
আশ্রমের উপর পাখিটি বামাবর্তে ক্রমাগত পাক খেতে থাকে। কী বিপদ! ও রামনগরের দিকে উড়ে যাচ্ছে না কেন? তখনই স্মরণ হল সেদিনের কথা দস্যুসর্দারের সেই বিচিত্র আচরণ। দূত তার মালিকের আদেশের প্রতীক্ষায় ক্রমাগত পাক খাচ্ছে।
বিদ্যালঙ্কার তাঁর দক্ষিণ তালুটা মুখের কাছে এনে বিচিত্র ধ্বনিতে ডেকে ওঠেন : আ—আ—আহ্!
পাক খেতে খেতে পক্ষিদূত ফিরে এসে বসল তাঁর কাঁধে।
উনি এবার সেই বৃহৎ শঙ্খটি হাতে তুলে নিয়ে শঙ্খধ্বনি করলেন। আশ্রমের গাছ- গাছালিতে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সেই আর্তবার্তা : ‘ঈশেন, আমার বড় বিপদ বাবা! কবুতর-দূত মুহূর্ত মধ্যে উঠে গেল আকাশে। দক্ষিণাবর্তে আকাশে একটি পাক খেয়ে ‘সূর্যসিদ্ধান্ত মতে’ সে রওনা হয়ে গেল রামনগরের দিকে। জীবাত্মা যেন পরমাত্মার সন্ধানে অভিযাত্রী।
সেদিনই সন্ধ্যায় ফিরে এল সংবাদবহ-বিহঙ্গ। সোজা নেমে এল আশ্রম প্রাঙ্গণে। বিদ্যালঙ্কার ছুটে এলেন। আবার আদর করলেন তাঁর মুক্তিদূতকে। তার পায়ে রেশমরজ্জুতে অনুবিদ্ধ একটি সংক্ষিপ্ত বার্তা : ‘মা ভৈঃ! শ্রীচরণাশ্রিত বজ্রধর সিংহ।’
বজ্রধর সিংহ! কে তিনি? ডেকে পাঠালেন রমারঞ্জনকে।
রমারঞ্জন চিনতে পারল। বললে, হ্যাঁ! তাঁকে তো সমস্ত কাশীধাম চেনে। তিনি ছিলেন প্রয়াত কাশীনরেশের জ্ঞাতিভ্রাতা। সে-আমলে তিনিই ছিলেন কাশীরাজ-সৈন্যদলের সেনাপতি। পুরন্দর গদি দখল করার পর তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছিল। পারেনি। শুনেছি, তিনি বিহাররাজ্যে রোহিতাশ্ব দুর্গে থাকেন। তবে জনশ্রুতি তিনি সৈন্য-সংগ্রহ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর কথা কেন জানতে চাইছেন দিদি?
বিদ্যালঙ্কার ইতস্তত করলেন না। দীর্ঘসময় ধরে তিনি রমারঞ্জনকে বুঝিয়ে বলেন, তিনি কীভাবে ওই বজ্রধরের কাছ থেকে একটি ‘মা ভৈঃ’ সঙ্কেত পেয়েছেন।
রমারঞ্জন নিদারুণ উল্লসিত হয়ে ওঠে। সে ঈশান সর্দারের নামও শুনেছে—গঙ্গাবক্ষে সর্বকুখ্যাত জলদস্যু-কাশী থেকে নবদ্বীপের একচ্ছত্র যমরাজ বলে। বজ্রধর যদি ঈশান সর্দারের সঙ্গে সংযুক্তভাবে কাশীধামের দুর্গ আক্রমণ করেন তাহলে পুরন্দরকে পরাজিত করা অসম্ভব হবে না। কারণ কাশীরাজের সৈন্যশিবিরে বিক্ষোভ এখন চরমে। ওই অত্যাচারীর শাসনের অবসান সবাই চাইছে। সবাই তা বুঝছে। একমাত্র বিলাসে আকণ্ঠ নিমগ্ন পুরন্দর ছাড়া।
১৬
কাহিনির বিস্তার নিষ্প্রয়োজন।
দীর্ঘদিন ধরে বজ্রধর বিহারের রোহিতাশ্ব দুর্গে সৈন্য সমাবেশ করছিলেন। কাশীরাজ্যের প্রতিটি সংবাদ তাঁর নখদর্পণে। পুরন্দর হটী বিদ্যালঙ্কারের উপর যে পৈশাচিক নির্যাতনের হুকুমনামা জারি করেছে তাও তাঁর অজানা নয়। বজ্রধরের মনে হল : এইটাই সুবর্ণসুযোগ। সমস্ত কাশীরাজ্য বিক্ষুব্ধ। এমনকি যারা ইতিপূর্বে বিদ্যালঙ্কারের বিরুদ্ধে রাজসরকারের শিকায়েত করেছিল তারাও অনুশোচনায় অধোবদন। এই বর্বর শাস্তিবিধানের সংবাদে তারাও মর্মাহত। বজ্রধর তাই বিহার থেকে সসৈন্য এসেছিলেন রামনগরের দুর্গে, ঈশান সর্দারের সন্ধানে। ঈশানের অনুচর-সংখ্যা অল্প, কিন্তু তারা নির্ভীক, নির্ভরশীল এবং দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। এমনই এক ব্রাহ্মমুহূর্তে দৈববাণীর মতো উপস্থিত হল পারাবত-দূত।
একযোগে কাশীরাজের দুর্গ আক্রমণ করলেন বজ্রধর আর ঈশান-সর্দার। কাশীরাজের সৈন্যদল প্রতিরোধের কোনো প্রচেষ্টাই করল না। বরং সসম্মানে স্বাগত জানাল তাদের প্রাক্তন সেনাপতিকে।
বজ্রধর তাঁর তরবারি কোষমুক্ত করে রাজমাতার চরণপ্রান্তে নামিয়ে দিয়ে সবিনয়ে বললেন, আমাকে আদেশ দিন মাতা। কী আমার করণীয়?
রাজমাতা বললেন, আমি তো তোমাকে কোনো আদেশ দেব না। সেটা দেবেন রাজকুলগুরু। আমি শুধু আশীর্বাদ করব তোমাকে। তুমি স্বর্গত মহারাজের প্রতি তোমার আনুগত্য প্রকাশ করেছ। তাঁর বংশধরের জীবনপথের কণ্টক উন্মোচিত করতে এসেছ। আমি বাবা বিশ্বনাথের কাছে প্রার্থনা করব তোমার শতায়ু। তুমি চিরজীবী হও।
কিন্তু নাটকের খলনায়ককে রাজপ্রাসাদে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
কে একজন বললে, বহ্ কঁহি ছিপকে বৈঠা হায়!
ঈশেন বলে, নেহীরে ইয়ার! ছিপকে নহী। ম্যয় জানতা হুঁ বহু বেতমিজ বদমাস কাঁহা মজাক উড়াতা হ্যয়। হুকুম দিজিয়ে সেনাপতিজি, ম্যায় কাম ফতে করু!
জনাআষ্টেক বন্দুকধারী অশ্বারোহী অনুগামীকে নিয়ে সে বিদ্যুতগতিতে ছুটে চলল অসিঘাটের বাগানবাড়িতে। যে প্রমোদভবনে গদি-আসীন পুরন্দর সান্ধ্য-বিলাসে সুরাপান করে থাকে। দস্যুসর্দার হবার পূর্বযুগে ঈশেন ছিল কাশীসৈন্যদলের পাঁচহাজারি মনসবদার। তাই মধ্যরাত্রে জলসাঘরটা খুঁজে পেতে তার বিলম্ব হল না।
এমন দুর্যোগ রজনীতে প্রতিটি গৃহস্থই রুদ্ধদ্বার উৎকণ্ঠায় রাত্রি প্রভাতের প্রতীক্ষা করে। পথ আজ জনমানবশূন্য। শুধু বিশ্বনাথের মন্দিরের দিক থেকে ভেসে আসছে শয়নারতির শঙ্খঘণ্টা ধ্বনি। কাশীর অবস্থান বাবা বিশ্বনাথের ত্রিশূলশীর্ষে। সেখানে ভূমিকম্প হয় না। রাজরক্তে রাজপথ কর্দমাক্ত হতে পারে। কিন্তু বাবার শয়নারতিতে ছেদ পড়ে না।
রাত্রির তৃতীয় যাম শুরু হয়েছে। চৈত্রশেষের শুক্লা একাদশী। অশ্বারোহী সৈন্য কয়জনকে অন্তরালে লুক্কাইত রেখে নাঙ্গা তরোয়াল হাতে এগিয়ে এল নির্ভীক দস্যুসর্দার। প্রমোদভবনের সম্মুখে একটি বিশাল লৌহফটক। তার ওপাশে ফুলের বাগান। পাথর-বাঁধানো পথ এসে থমকে থেমেছে লোহার-গরাদ দেওয়া ফটকে। ঈশান অকুতোভয়ে একলা এসে দাঁড়ালো সেই লৌহ-ফটকের সম্মুখে। গেটটা তালাবন্ধ। ঈশেন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রথমেই নজর করে দেখল প্রাসাদ-শীর্ষে ইন্দ্রকোষের ছিদ্রপথের দিকে। সেখানে কোনও ধানুকী বা আগ্নেয়াস্ত্রধারী আছে কিনা সমঝে নিতে। না, নেই। এটা দুর্গ নয়, ‘প্রমোদভবন’। তাই প্রতিরোধের নিশ্ছিদ্র আয়োজন নজরে পড়ল না। হর্ম্যশীর্ষ থেকে ভেসে আসছে বাইজির সুরেলা ঠুংরি : ‘বাজুবন্ধ খুলু-খুলু যায়’। সারেঙ্গির টান আর তবলচির লহরা।
ঢালাই-লোহার গরাদ দুই হাতে চেপে ধরে ঈশেন বজ্রগম্ভীর স্বরে হাঁকাড় পাড়ে : কোই হ্যয়?
‘হ্যয়’ তো বটেই। মহারাজ পুরন্দরের দেহরক্ষী রামলগন কাহার আছে পাহারায়। দুর্ধর্ষ লাঠিয়াল সে। তরবারি চালনাতেও অতিশয় দক্ষ। তারই ওপর প্রমোদভবনের সুরক্ষার দায়িত্ব।
প্রমোদ-ভবনের সদর দ্বার খুলে গেল। উদ্যানে নেমে এল হাতিয়ারবন্দ রামলগন সর্দার! সে যেন প্রতিধ্বনি করে ওঠে, কৌন চিল্লাতা হ্যয় রে?
ঈশেন শক্তহাতে চেপে ধরল জিঞ্জিরবদ্ধ লৌহফটকের গরাদ।
গর্জন করে ওঠে : তেরি বাপরে রামলগন! পচত্তে নহি হো ক্যা?
রামলগন যেন ভূত দেখল : উস্তাদ! তুম?
ঈশেন ঠেট্ হিন্দিতে বললে, চিনতে পেরেছিস্ দেখছি? এখন বল : কী করবি? লড়বি? না কি তোর গুরুদক্ষিণা দিবি?
রামলগন লাঠি আর তলোয়ার খেলা শিখেছিল ঈশেন-সর্দারের কাছেই। ঈশেন যখন ছিল কাশীরাজের সৈন্যদলে পাঁচহাজারি মনসবদার। পূর্বতন কাশীনরেশের আমলে।
ইতিমধ্যে অন্তরাল থেকে বাহির হয়ে এসেছে বন্দুকধারী অশ্বারোহীর দল। লৌহগরাদের ফাঁক দিয়ে বন্দুকের গুলি অনায়াসে রামলগনকে বিদ্ধ করতে পারে। রামলগন সেটা জানে। তাই বলে, উস্তাদ! আমি তো কোনো পাপ করিনি। তুমি কেন এসেছ আমার নোকরি খতম করতে?
ঈশেন অট্টহাস্য করে ওঠে : তুই হারামজাদা জন্ম-নোকর! তোর নোকরি খায় কোন্ শালা? লেকিন কী করবি বল? লড়বি? না গুলি খেয়ে মরবি?
রামলগন এদিকে-ওদিক দেখে নিয়ে নিম্নকণ্ঠে বললে, ফটক খোল্ দুঙ্গা। লেকিন এক শর্ত হ্যয়!
—শর্ত? কী শর্ত বল? কী ইনাম চাস?
—ইনাম নেহী! পহিলা মওকা।
—পহিলা মওকা? কিসের রে?
আজব শর্ত! রামলগন বিনা প্রতিরোধে ওদের ভিতরে আসতে দেবে, কিন্তু একটি শর্তে! পুরন্দরের স্কন্ধ থেকে রাজমুকুট-শোভিত মুণ্ডটা নামিয়ে আনার প্রথম সুযোগ যেন তাকে দেওয়া হয়।
ঈশেন পুনরায় অট্টহাস্য করে বলে, মালি!
খুলে গেল লৌহফটক। বিনা রক্তপাতে।
তবে অনিবার্য রক্তপাতটা রোধ করা গেল না। কাশীধামের যাবতীয় জঞ্জাল নিক্ষিপ্ত হয় ওই পূত গঙ্গাজলেই। কদিন পরে যে গঙ্গোদকে নিক্ষিপ্ত হবার কথা একটি ধর্ষিতা রমণীর খণ্ডিত মৃতদেহ সেখানে আজ নিক্ষিপ্ত হল গদি-দখলকারীর ছিন্ন মুণ্ডটি!
জাহ্নবীর পূত সলিল সেই উষ্ণ রাজরক্তে উত্তপ্ত হয়ে উঠল না আদৌ। সর্বংসহা মা-গঙ্গা অনায়াসে গ্রহণ করলেন সেই আবর্জনার ভার।
‘—কা শীতলবাহিনী গঙ্গাঃ?”
‘—কাশীতলবাহিনী গঙ্গাঃ!’
১৭
নববর্ষের পূণ্যাহে কাশীরাজ্যের সিংহাসন অলঙ্কৃত করলেন স্বর্গত কাশীনরেশের নাবালক পুত্র শ্রীমান মহারাজ কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ সিংহ। দক্ষিণে তাঁর অভিভাবক রাজকুলগুরু, বামে সদ্যনিযুক্ত প্রাক্তন সেনাপতি। মহা আড়ম্বরে অভিষেক হয়ে গেল। সেদিন আপামর কাশীবাসী রাজবাড়িতে পাত পাড়ল। পণ্ডিতদের যথাবিধি সম্মান-মর্যাদা প্রদান করা হল। হটী বিদ্যালঙ্কারকে জনান্তিকে ডেকে নিয়ে রাজমাতা বলেন, আপনাকে কী বৈদ্যবিদায় দেব বলুন?
—বৈদ্যবিদায়! আমি তো কারও চিকিৎসা করিনি।
—করেছেন। আমার পুত্রটির। সে তো কী যেন একটা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিল। ‘কংসব্যাধি’ কি ‘শকুনিব্যাধি’ তা আপনিই জানেন।
হটী বললেন, আমার বহুদিনের বাসনা কাশীধামে একটি মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা*–
[* এইখানে সম্ভবত কথাকোবিদকে কল্পনার রাশ টানতে হবে। বর্ধমানের সোঞাই গ্রামে অথবা কাশীধামে বক্ষ্যমাণ কাহিনিকালে কোনও বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নজির খুঁজে পাইনি। গল্পের গোমাতা একবার বৃক্ষারোহণ করলে পাঠিকা পাঠক তা ক্ষমা-ঘেন্না করে মেনে নেন। বারবার নয়।
আধুনিক যুগে, যতদূর জানি, ভারতবর্ষে অষ্টাদশ শতাব্দিতে তেমন কোনো বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সম্ভবত তা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 1849 খ্রিস্টাব্দে—হটী বিদ্যালঙ্কারের মহাপ্রয়াণের তিন-চার দশক পরে। মূল হোতা সংযুক্তভাবে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং মহামতি জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। তাঁদের আন্তরিক সহায়ক ছিলেন রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রামগোপাল ঘোষ, এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কার। প্রথম ছাত্রীদ্বয় : ভুবনমালা ও কুন্দমালা। মদনমোহনের দুই আত্মজা। কোনও গবেষকমনা পাঠিকা যদি এই বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাশ্বর্তী কোনো বালিকা বিদ্যালয়ের সন্ধান অধম লেখককে জানাতে পারেন তাহলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে এ তথ্য গ্রন্থে সন্নিবেশিত করব। ইতিহাস বলছে 1857 খ্রিস্টাব্দে—অর্থাৎ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের বৎসর—বিদ্যাসাগরমশাই আটটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। হুগলি জেলায় সাতটি আর বর্ধমানে একটি।]
১৮
বেশ কয়েক বছর পরের কথা।
সূর্য ওঠে, অস্ত যায়। ষড়ঋতু তার চক্রাবর্তন ছন্দ মেলে আসে-যায়, মা-গঙ্গার জলধারা নিরবচ্ছিন্ন-ধারায় সমুদ্রাভিসারী। তার ছলাৎ-ছল ছলাৎ-ছল সঙ্গীত সমে এসে থামে না। থামতে জানে না।
সূর্য এখন কন্যারাশিতে। হিমালয়-দুহিতা আবার মর্ত্যে আগমনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাই আকাশে গড়ে উঠেছে তুলো-পেঁজা মেঘের তোরণ। গঙ্গার দুই তীরে অযুত-নিযুত কাশগুচ্ছ মায়ের আগমন প্রত্যাশায় শুভ্র চামর দুলিয়ে চলেছে। শেফালিগাছ প্রতিদিন সকালে মাঠে বিছিয়ে দেয় কমলারঙের পাড় বসানো শ্বেতশুভ্র জাজিম।
কাশীধামে তখনও দশভুজার অকালবোধন চালু হয়নি। দুর্গাবাড়িতে হত নবরাত্রির উৎসব। পিতৃপক্ষের পরের পক্ষকালে। শ্যামাপূজার অমারাত্রে অসি থেকে বরুণার হর্ম্যশীর্ষে জ্বলজ্বল করে জ্বলত প্রদীপমালার শতনরী।
দ্বারকেশ্বর-বিদ্যাপীঠে এখনও পূজাবকাশের কর্মবিরতি হয়নি। হটী বিদ্যালঙ্কার এখন আর চতুষ্পাঠীর উপাধ্যায়া নন। নিজের পর্ণকুটিরে একান্ত সাধনায় আত্মনিমগ্না। জরা এখনও তাঁকে আক্রমণ করেনি। স্বপাক রন্ধন এখনও করেন। দু-চারজন উচ্চশ্রেণির বিদ্যার্থী মাঝে মাঝে আসেন। তাঁরা ব্যাকরণ, কাব্য, ন্যায়ের সোপানাবলি অতিক্রম করে উপনিষদ অথবা বেদের দুয়ে রাজ্যে প্রবেশেচ্ছু। তাঁরাই আসেন কখনো-সখনো তাঁদের অনুপপত্তি নিরাকরণ-মানসে। ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকজন নবীন পণ্ডিতও উপাধ্যায়রূপে যোগদান করেছেন এই চতুষ্পাঠীতে। রাজানুগ্রহে কিছু পাঠমণ্ডপও সংযোজিত হয়েছে।
সেদিন একপ্রহর বেলায় পণ্ডিত রমারঞ্জন ভট্টশালী একটি বৃক্ষচ্ছায়ার মুক্ত মণ্ডপে কয়েকজন ছাত্রকে ব্যাকরণের পাঠ দিচ্ছিলেন। সহসা তাঁর লক্ষ্য হল চতুষ্পাঠীর বাহিরদ্বারে একজন বৃদ্ধ সাধু আবির্ভূত হয়েছেন। জটাজুটধারী কৌপীনসার সন্ন্যাসী। স্কন্ধে একটি কম্বল, হস্তে দীর্ঘ যষ্টি। তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো চারিদিকে তাকিয়ে কী-যেন খুঁজছেন। ভট্টশালী জনৈক ছাত্রকে বললেন, বহির্দ্বারে একজন সন্ন্যাসী এসেছেন। ওঁকে সাদরে আশ্রমের ভিতরে নিয়ে এস।
ছাত্রটি গাত্রোত্থানের উপক্রম করতেই তাকে বাধা দিয়ে পুনরায় বলেন, না থাক। আমি নিজেই দেখছি।
প্রবেশদ্বারের সন্নিকটে এসে ভট্টশালী স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
—আপনি?
—হ্যাঁ রমারঞ্জন। স্বপ্নো নু মায়া নু মতিভ্ৰমো নু ক্লিষ্টং নু তাবৎফলমেব পুণ্যম্।
—কোথা থেকে আসছেন এখন? কবে এলেন?
—উত্তরখণ্ড পরিক্রমা সমাপ্ত করে সর্বতীর্থসার কাশীধামে ফিরে এসেছি আজই। দেখতে এসেছিলাম আমার সাধনধামের ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু এ কী দেখছি! কেমন করে এমনটা হল?
রমারঞ্জন গুরুর পদধূলি গ্রহণ করে বলেন, যাঁর কৃপায় মূক বাচাল হয়, পঙ্গু গিরিলঙ্ঘন করে। বাবা বিশ্বনাথের দয়ায়!
—পুরন্দর?
—যমালয়ে। এখন কাশীরাজ হচ্ছেন শ্রীমান মহারাজ কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ রায়। তাঁর সব কথাই বলব। কিন্তু তার পূর্বে আপনি ভিতরে এসে বসুন। আমাকে পদপ্রক্ষালন করতে দিন—
বৃদ্ধ সন্ন্যাসী অকস্মাৎ ভট্টশালীর দুই বাহুমূল দৃঢ়মুষ্টিতে গ্রহণ করে অস্ফুটে বলেন, আমার মা?
দূর থেকে লক্ষ্য করছিলেন বিদ্যালঙ্কার। তিনি দ্রুতপদে অগ্রসর হয়ে এসে বৃদ্ধের কর্দমাক্ত চরণে নামিয়ে রাখেন তাঁর অনবগুণ্ঠিত মস্তক।
উত্তেজিত বৃদ্ধ এবার তাঁর দুই বাহুমূল ধরে বলেন, তুই…তুই বেঁচে আছিস? হটী প্রত্যুত্তর করতে পারলেন না। তাঁর দুইগণ্ডে প্রবাহিত হচ্ছে দীর্ঘদিনের নিরুদ্ধ অভিমান। আনন্দে, শ্রদ্ধায়, উত্তেজনায়।
—কিন্তু কেমন করে বেঁচে আছিস তুই?
আবার একই প্রত্যুত্তর করলেন ভট্টশালী : বাবা বিশ্বনাথের দয়ায়, বাবা
বৃদ্ধ এগিয়ে এসে বসলেন গোলকচাঁপা গাছের বাঁধানো চত্বরে।
ইতিমধ্যে এই চমকপ্রদ সুসংবাদটা ছড়িয়ে পড়েছে আশ্রমে। ছাত্রের দল—অনেকে শুধু তাঁর নামই শুনেছে, প্রত্যক্ষ করেনি—সার বেঁধে এসে আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতাকে প্রণাম করে চলেছে।
বিশ্রাম গ্রহণের পর বিদ্যার্ণবকে রমারঞ্জন সংক্ষেপে জানিয়ে দিলেন তাঁর অনুপস্থিতকালের ঘটনাবলি। অতি সংক্ষেপে। দীর্ঘদিনের প্রশ্নটার প্রত্যুত্তর পেলেন তিনি। কেন সচল বিশ্বনাথ বলেছিলেন জীবাত্মাকে পরমাত্মার দিকে প্রেরণ করাই সাধনার মূলকৃত্য। কেন শঙ্খধ্বনির বিষয়ে তাঁর পালিতা কন্যা তিরস্কৃত হয়েছিল।
নিজের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাও বললেন। হরিদ্বারে পূর্ণকুম্ভে স্নানান্তে তিনি এতদিন সমগ্র উত্তরখণ্ড পরিক্রমা সমাপ্ত করেছেন : কেদার-বদ্রী, তুঙ্গনাথ, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, এমন কি একবস্ত্রে অমরনাথ!
১৯
পুরন্দরের অপসারণে কাশীধাম নবজীবন লাভ করেছিল।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা হল ঈশেন বাগদির।
কলিঙ্গ যুদ্ধের অবসানে যেন সম্রাট অশোক। ঈশেন বাগদি রাতারাতি ‘চণ্ডেশান’ থেকে রূপান্তরিত হয়ে গেল ‘ধর্মেশানে’! মারদাঙ্গা সে সারাটা জীবন করেছে। রক্তপাত-দর্শনে বিচলিত হবার মতো মানুষ সে নয়। তবু একটা বাস্তব ঘটনা-পরম্পরায় তার আন্তরগভীরে ঘটে গেল মহাবিপ্লব। কিন্তু এমনটা তো বারে বারে ঘটেছে ইতিহাসে। ‘বেলা যে যায়! বানায় আগুন দে’–এই কথাগুলো কি লালাবাবু জীবনে সেই প্রথম শুনলেন?
বজ্রধর সৈন্যাপত্য গ্রহণ করে ঈশান কৈবর্তকে দশহাজারি মনসবদার করতে চেয়েছিলেন। ঈশেন সবিনয়ে সেই মহাসম্মান প্রত্যাখ্যান করে। সে আর বাকি জীবনে লড়াই-কাজিয়ার মধ্যে থাকতে চায় না। সে এবার পরকালের চিন্তা করতে ইচ্ছুক। ধর্মকর্মে মন দিতে চায়।
এইখানে বোধকরি একটা কৈফিয়ত দেওয়া প্রয়োজন। লোকটাকে আমরা কখনও বলছি ‘ঈশান কৈবর্ত’ আবার কখনও ‘ঈশেন বাগ্দি’। দুটো পরস্পরবিরোধী নামরূপ। বাস্তবে জন্মগতভাবে ঈশেন ছিল বাগদির পো। ওর বাপ-খুড়োর পেশা ছিল দস্যুবৃত্তি। সেটা নবাব সুজাউদ্দিন (1727-39) অথবা সরফরাজ খাঁর (1739-40 ) জমানা। তারপর সুবে বাংলার শাসন অধিকার লাভ করেন নবাব আলিবর্দী। গিরিয়ার যুদ্ধে (1740) সরফরাজ খাঁকে পরাজিত ও নিহত করে। তার দুই বৎসরের মধ্যেই শুরু হল বর্গীর হাঙ্গামা। লুণ্ঠিত হল মুর্শিদাবাদ। তিলতিল করে গৌড়বঙ্গে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলেন আলিবর্দী। দমন করলেন মারাঠা দস্যুদের। নিহত হলেন ভাস্কর পণ্ডিত। বর্গীদলনেতা।
আলিবর্দী ছিলেন একপত্নিক, ইন্দ্রিয়-সংযমী, অপ্রমত্ত এবং একমাত্র নবাব যিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য দেখতেন না। দুইটি সম্প্রদায়কে একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছেন প্রায় আকবরী-ঐকান্তিকতায়। বাংলার ভূম্যধিকারীদের ডেকে তিনি অনুরোধ করলেন প্রত্যেকে যেন নিজ নিজ এলাকায় দস্যুদলের অবাধ-লুণ্ঠন বন্ধ করেন। বর্গী দস্যুদের হাত থেকে বঙ্গদেশকে রক্ষা করতে একদল দুঃসাহসিক মানুষকে বেপরোয়া হবার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তারা ভল্ল, বর্শা, কৃপাণ ও তীরধনুক লাভ করেছিল—ঠিক যেমন অধুনাকালে গদিলাভের পূর্বকালে দেশশাসক গোষ্ঠি ‘ক্যাডারদলকে’ অস্ত্রধারী ও বেপরোয়া হবার সুযোগ দেয়।
সোঞাই গ্রামের জমিদার ব্রজেন্দ্রনারায়ণ ভাদুড়ী নবাবের নির্দেশ অনুসারে ডেকে পাঠালেন তাঁর বাগ্দিদলের সর্দার ভীমা বাগ্দিকে। ঈশেন তখন বালকমাত্র। তার পিতৃবিয়োগ হয়েছিল শৈশবেই। ভীমাই তার অভিভাবক। তার আদর্শ।
ব্রজেন্দ্রনারায়ণ জনান্তিকে ডেকে নিয়ে ভীমাকে বলেছিলেন, ভীমা! এতদিন যা করেছিস তা করেছিস। আমি সেসব পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে চাই না। কিন্তু এখন থেকে তোদের জাতব্যবসাটা পালটাতে হবে, বাবা। আমি তোদের সবাইকে কিছু নিষ্কর চাষের জমি দিচ্ছি। একজোড়া হেলে-গরু, লাঙল আর প্রথম বছরের বীজ ধান। কিন্তু তোকে প্রতিদানে একটা কাজ করতে হবে, ভীমা। আনন্দময়ী মায়ের চৌকাঠ ছুঁয়ে বাগদি-পাড়ার তরফে জবান দিতে হবে ওসব কাজ তোরা আর করবি না।
—কুন সব কাজ, দ্যাবতা?
—তা তুইও জানিস, আমিও জানি! ভেবে দেখ।
ভীমা নতমস্তকে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর হাত দুটি জোড় করে বললে, মোরা জেতে বাগ্দি। হালচাষের কিছুটি জানি না দ্যাবতা। দু-একজন অভাবে পড়ি মুনিষ খাটে। এই পয্যন্ত
—তার মানে তোরা দস্যুগিরি ছাড়বি না?
দুই হাতে দুই কর্ণমূল স্পর্শ করে ভীমা বলেছিল, অমন কতাটা কয়েন না দ্যাবতা! আপনি মোরে একখান নাও দাও, আর ওই মাছমারাদের জাল। মুই কৈবর্তের বিত্তি
নেব-অনে।
কৈবর্তরা হল মৎস্যজীবী। জেলে। ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের নিক্তিতে তাদের জাত একধাপ উপরে। জাতপাত সোপানশ্রেণির। বাগদির ছায়া ব্রাহ্মণ মাড়ালে তাঁর অবগাহন-স্নান আবশ্যিক। কিন্তু জল-অচল কৈবর্তের ছায়া অসতর্কভাবে মাড়িয়ে ফেললে স্নান করতে হয় না। শ্রীচরণযুগল ধৌত করলেই পাপস্খালন হয়।
ভীমা রাতারাতি হয়ে গেল ‘মাছমারা’ কৈবর্ত। ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা—তোমরা তো জানই—উদারমনা। হাটে এসে তাঁরা যখন টাটকা মাছ খরিদ করতেন তখন জানতে চাইতেন না, কোন্ মাছটা কৈবর্তের জালে ধরা পড়েছে আর কোন্টা দুলে-বাগদি-চাঁড়ালের।
ফলে ঈশেনের কৈশোর অতিবাহিত হয়েছে মাছমারাদের সংস্পর্শে। ওই বয়সেই সে বুঝতে শিখেছিল বাগদির তুলনায় কৈবর্তরা উঁচু জাত। তাই কাশীধামে এসে কাশীরাজের ফৌজে নাম লেখাবার সময় নিজের পরিচয় দেয় ‘ঈশেন কৈবর্ত’!
পিতৃহীন কিশোরের কাছে খুড়োই ছিল তার বাবা। তার গুরু। তার কাছেই শেখে লাঠিখেলা, তলোয়ার চালানো আর ধনুর্বিদ্যা। শেষবিদ্যায় সে হয়ে গেল ‘গুরু-মারা-চেলা’। কৈবর্ত পাড়ার ‘আর্জান-সর্দার’, অর্থাৎ অর্জুনতুল্য ধনুর্ধর।
ভীমাই ওর বিবাহ দেয়। একটিমাত্র পুত্র সন্তানকে রেখে ঈশেনের সহধর্মিণী ৺দামোদর লাভ করে। ঈশেন আর পুনর্বিবাহ করেনি।
জীবনে তিনতিনটি সদ্যবিধবাকে চিতাভ্রষ্টা হতে সাহায্য করেছে। সহমরণের দহন- সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতা করেছে। সবার আগে বেষ্টাবায়েনের বিধবা : যন্না। দ্বিতীয় হচ্ছে জিয়াগঞ্জের শ্মশানঘাটে রুক্মিনী। আর সবার শেষে একবগ্গা-ঠাউরের ‘মাইয়াডা’। খুড়ার হুকুমে যার খুড়শ্বশুরের শামলাটারে তীরবিদ্ধ করে ভুঁইয়ে নামিয়ে দিয়েছিল।
এক-জমানা আগে ওর খুড়ো যে-কথা বলেছিল জমিদারমশাইকে ঈশেনও ঠিক সে-কথাই বললে সেনাপতি বজ্রধর সিংহকে। সে মনসবদারের লোভনীয় পদের প্রত্যাশী নয়। খুন-জখম, মারদাঙ্গা জীবনভর করেছে। আর করবে না। তাকে একখানি মাছমারা-নৌকা আর মাছধরার জাল দেওয়ার হুকুম হোক। ও মানুষের বদলে মাছ মেরেই দু-কুড়ি-সাতের খেলাটা শেষ করবে। ও জাত-কৈবর্ত! সে বৃত্তিতে ওর অসুবিধা হবে না। নেহাৎ যদি মাছেদের ধড়ফড়ানি দেখে বৈরাগ্য আসে তখন সে গঙ্গাবক্ষে যাত্রীবাহী নৌকার মাঝি হয়ে যাবে।
রুক্মিনী ইতিপূর্বেই ওকে ত্যাগ করে চলে গেছে। সে খুশি মনে গেল, নাকি অভিমান করে—এ জটিল তত্ত্বটা অব্যর্থসন্ধানী ঈশেন ঠাওর করে উঠতে পারেনি। যাবার সময় তার মরদকে সন্তানপালনের দায়িত্ব থেকেও মুক্তি দিয়ে গেছে। রতনকে সঙ্গে নিয়ে গেছে।
আরও একটি মর্মান্তিক হেতু হয়তো ঈশেনের এই নির্বেদের পশ্চাৎপটে কাজ করে থাকবে। ঘটনাচক্রে ঈশেন প্রণিধান করেছে তার তথাকথিত গুরু সেই তান্ত্রিক কাপালিক ছিল ইন্দ্রিয়াসক্ত—তাকে অস্ত্রসিদ্ধিলাভের লোভ দেখিয়ে একটি যুবতী নারী সংগ্রহে আগ্রহী করে তুলেছিল।
মোট কথা ঈশেন বর্তমানে মুক্ত-পুরুষ। রাজসরকার থেকে একটি নৌকা গ্রহণ করে সে মৎস্যশিকারীর ভূমিকায় জীবন যাপন করে। কিন্তু তাতেও ওর মন ভরল না। পাপবোধে সে ভারাক্রান্ত।
একদিন ঈশেন এসে ধর্না দিল তার মা-জননীর আশ্রমে।
বিদ্যালঙ্কার তাকে সাদরে আহ্বান করে বসালেন। প্রসাদী ফল-মিষ্টান্ন দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করে কুশল জিজ্ঞাসা করলেন। ঈশেন তার সমস্যার কথা অপকটে ব্যক্ত করল। সারাজীবন সে নানা পাপ করেছে। এখন তার অন্তরে জমেছে গ্লানি। সে এখন প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। মানে ‘প্রাচ্চিত্তির’। কাশীতে সন্ন্যাসীর অভাব নেই, কিন্তু তার সঞ্চিত পাপের গ্লানির কথা সে তাঁদের মন খুলে বলতে পারে না। তাই তার মা-জননীর দ্বারস্থ হয়েছে। তার পাপের কথা মা-জননী সবই জানেন। বললে, আমারে টুক দয়া কর মা। মন্তর দে। আমি পূজা-আর্চা লয়্যা থাকব অনে।
হটী বললেন, এ তো ভালো কথা ঈশেন। কিন্তু আমি তো কাউকে মন্ত্র দিই না। ভগবান যখন তোমাকে সুমতি দিয়েছেন তখন উপযুক্ত গুরুও জুটিয়ে দেবেন। গুরুর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্যও সাধনা দরকার।
কথাগুলি ঈশেনের বোধগম্য হল না। বললে, তুর কথাডা বুঝলাম না, মুই।
—শোন, বুঝিয়ে বলি। জমি ‘তর’ না হলে তাতে বীজ ছড়িয়ে কী লাভ? তোর মনের জমি এতদিন ছিল চোত-বোশেকের রোদে ফাটা-ফাটা। দু-এক পশলা বৃষ্টি হতে দে। জমি নরম হলেই দেখবি গুরু আপনি এসে ধরা দেবেন। তাঁকে দেখেই চিনতে পারবি।
ঈশেন আকুলভাবে জানতে চায়, অখন কুন দেবতাকে ডাকব?
—যাঁকে তোর মন চায়। শিব, কালী, রাধাকৃষ্ণ, যাঁকে মন চাইবে।
—কিন্তু আমার প্রাচ্চিত্তির কেমন কইর্যা হবে মা?
হটী বলেন, যে কোনও দেবদেবীই তোমাকে তরাতে পারবেন। তোমার প্রায়শ্চিত্তের বিধান দেবেন। শোন ঈশেন, তুমি যদি গঙ্গাস্নান করতে চাও তাহলে যে-কোন ঘাটে তা করতে পার। দশাশ্বমেধ, চৌষট্টিযোগিনী, চৈৎ সিং-এর ঘাট। যে-কোনও ঘাটেই ডুব দাও গঙ্গাস্নানের পুণ্য তোমার হবেই। শুধু খেয়াল রাখতে হবে মানুষজনের ক্ষতি হয় এমন কাজ করবে না। কাউকে ঠকাবে না। ধর্মে মতি রাখবে। তাহলেই গুরুর সন্ধান পেয়ে যাবে। তিনিই তোমার প্রায়শ্চিত্তের বিধান দিয়ে দেবেন!
ঈশেন ফস্ করে প্রশ্ন করে বসে, তরে কে মন্তর দিয়েল?
—কই আর দিলেন? তোমাকে আমি আজ যেকথা বলছি, আমাকে একদিন তিনি ঠিক সেই কথাই বলেছিলেন। বলেছিলেন, তোর মনের জমি এখনও ‘তর’ হয়নি।
ঈশেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। মা-জননীরও তাইলে একই সমিস্যে!
২০
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, এমন কি শতাব্দিও ফুরিয়ে গেল। ঊনবিংশ শতাব্দির ঊষা মুহূর্ত। ইউরোপ-খণ্ডে এখন ফরাসি ভাগ্যান্বেষী নেপোলিয়ান বোনাপার্টির দোর্দণ্ডপ্রতাপ। সে খবর এসে পৌঁছায়নি এই কাশীধামে। এখানে উত্তরবাহিনী ভাগীরথী চিরকালের মতো সমুদ্রসঙ্গমের প্রত্যাশায় একমুখী। দুনিয়া বদলে যায়। মহাদেবের ত্রিশূলপ্রান্তে অবস্থিত কাশীতলবাহিনী এই শীতলবাহিনী গঙ্গার রূপ অপরিবর্তিত। গঙ্গাঘাটে ভাসতে থাকে সারি সারি নৌকা, সূর্যোদয় মুহূর্তে সমবেত হয় স্নানার্থীরা, স্নানান্তে ঘাটোয়াল-পণ্ডিতজি তাদের ললাটে অঙ্কিত করেন চন্দনছাপ, ছেলে-ছোকরার দল ঝাঁপাই জোড়ে আর মণিকর্ণিকার ঘাটে অনির্বাণ শিখায় ঊর্ধ্ববাহু অগ্নিদেব অযুত-নিযুত কাশীবাসীদের স্বর্গধামের পথ দেখান। অনাদিকাল, বোধকরি অনন্তকাল ধরে যা চলবে।
গোটা ভারতখণ্ডের মতো কাশীধামের সেই ট্র্যাডিশন’ সমানে চলেছে।
‘রূপমঞ্জরী’ নামটা হারিয়ে গেছে। ও নামে তাঁকে সম্বোধন করবার মতো মানুষ আর কই? সাধারণের কাছে ওঁর অভিধা : মা-জননী; পণ্ডিতেরা ওঁর প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন : বিদ্যালঙ্কার-মা।
বিদ্যালঙ্কার এখন একষষ্টিতমা প্রৌঢ়া।
দ্বারকেশ্বর ৺গঙ্গালাভ করেছেন। কার্যত এখন বিদ্যালঙ্কারই আশ্রমের সর্বাধ্যক্ষা। তবে চতুষ্পাঠীতে আজকাল তিনি নিজে যান না। সে দায়িত্ব রমারঞ্জন ভট্টশালীর। বিদ্যালংকার তাঁর ক্ষুদ্র-কক্ষে নিজের সাধনকার্যে আত্মনিমগ্না। দৃষ্টিশক্তি এখনও অটুট, ফলে অধ্যাপনা ত্যাগ করলেও অধ্যয়ন আছে অব্যাহত। কিন্তু ইদানীং তাঁরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সাধনকক্ষের ধ্যানে যেন স্বস্তি পান না। কী লাভ এই যোগসাধনায়? আত্মার মুক্তি? পরমেশ্বরে বিলীন হওয়াই কি মনুষ্যধর্মের কৃত্য? শাক্যসিংহ তো যৌবনেই বুদ্ধত্ব লাভ করেছিলেন, তাহলে তার পরে দীর্ঘ পাঁচ-দশক কেন তিনি দেহরক্ষা করেননি? অবলোকিতেশ্বর পদ্মপাণি তো যৌবনকালেই ‘নির্বাণ’-এর সুযোগ পেয়েছিলেন, তাহলে কেন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে জীবসেবায় এই প্রপঞ্চম জগতের দুঃখ-দুর্দশার ভিতর পড়ে থাকলেন? ওঁর পিতৃদেবও তো জ্ঞানমার্গের চরম সিদ্ধি লাভ করার পরে কর্মযোগে চণ্ডাল-চিতায় দেহরক্ষা করলেন। বিদ্যালঙ্কারও তেমনি যুগল জলযানে চরণ স্থাপন করে সংসার-সমুদ্রের যাত্রী : জ্ঞান ও কর্ম!
প্রচণ্ড আক্ষেপ রয়ে গেল জীবনে—ব্রজসুন্দরী মহিলা বিদ্যালয়’কে পুনর্জীবন দান করতে পারলেন না। না সোঞাই গ্রামে, না কাশীধামে। অর্থাভাবে নয়, শিক্ষিত মানুষের কূপমণ্ডুকতায়। কাশীবাসী কোনো গৃহস্থ কোনো বালিকা বা কিশোরীকে তাঁর বিদ্যাশ্রমে প্রেরণে স্বীকৃত হলেন না। অক্ষর পরিচয় যে অকালবৈধব্যের দিশারী। স্বয়ং বিদ্যালঙ্কারই তো প্রত্যক্ষ উদাহরণ!
ইদানীং অবশ্য তাঁকে একাকী অন্তেবাসীর জীবন যাপন করতে হয় না। একটি তরুণী সেবাব্রতা জুটেছে তাঁর : রোহিণী।
রোহিণী ব্রাহ্মণকন্যা। অষ্টাদশী। শৈশবেই মাতৃপিতৃহীনা। মানুষ হচ্ছিল তার খুড়ামশায়ের ভদ্রাসনে। এমনই দুর্ভাগ্য, খুড়ামশাই পুত্রসন্তান-বঞ্চিত। তাঁর তিন-তিনটি কন্যাসন্তান। তিনজনই রোহিণীর অনুজা। বেশ চলছিল—খুড়ামশায়ের ব্রাহ্মণী ৺গঙ্গালাভ করার পর রোহিণীই তাদের কোলে-পিঠে মানুষ করেছে। কিন্তু ঈশ্বরের কী অবিচার! দুর্বিনীতা মেয়েটি খুড়ামশায়ের দুর্দশার কথা বিবেচনা করল না। দেহে-মনে অচিরেই অরক্ষণীয়া হয়ে উঠল। সমাজপতিদের তাড়নায় এক মৃত্যুপথযাত্রী কুলীন বৃদ্ধের সঙ্গে তার উদ্বাহনের আয়োজন করলেন। ‘উদ্বাহন’ অর্থে ‘উদ্বন্ধন’। হবু জামাতাবাবাজি ধনী, তাঁর তিন-তিনটি গৃহিণী বর্তমান। তিনজনই সন্তানবতী ও কুলীন ব্রাহ্মণের সংসারে তিনটি স্তম্ভ। চতুর্থটিকে উদ্ধার করতে রাজি হয়েছেন তাঁর সঙ্গী হবার জন্য। সহমরণে যাবার সৌভাগ্যলাভের উদ্দেশ্যে।
বিদ্যালংকার এই সংবাদ পেয়ে রমারঞ্জনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন কিছু ব্যবস্থা করার। রমারঞ্জন আশ্রমের ছাত্রদলকে নিয়ে কন্যাপক্ষের ভদ্রাসনে হানা দেন। বস্তুত মেয়েটিকে ছিনিয়ে আনা হয়। কাশীর সমাজপতিরা বিদ্যালঙ্কারের বিধান অস্বীকার করতে পারেননি।
রোহিণী আশ্রয় পেল আশ্রমে। কিন্তু কিছুতেই সে অক্ষরপরিচিতা হতে স্বীকৃতা হল না। হটী বিদ্যালঙ্কার যেমন স্বভাবগতভাবে জ্ঞানযোগী অথবা কর্মযোগী এই হতভাগিনী তেমনি জন্মগতভাবে সেবাব্রতী। এতদিন সে শিবরাত্রি করেছে, ইতুপূজা করেছে, পুণ্যিপুকুর করেছে—কোনও সাকার দেবদেবীর সাক্ষাৎ পায়নি। এখন সুযোগ পেয়ে সে আঁকড়ে ধরেছে তার দিদাকে। তার বিশ্বাস ওঁকে সেবা করেই সে ‘তরে যাবে।
২১
বিদ্যালঙ্কার আজকাল প্রায়ই আশ্রমপ্রান্তে সেই গোলকচাঁপা গাছটির তলায় এসে বসেন। নির্জনে বসে—না, ধ্যান করেন না—ফেলে-আসা গ্রাম্য জীবনের স্মৃতিচারণে মগ্ন হয়ে যেতেন। কী বিচিত্র-বিষণ্ণ তাঁর বাল্য-কৈশোর-যৌবনের খণ্ডচিত্রগুলি। ওঁর মানসপটে ফুটে উঠত দামোদর-তীরের সেই ছোট গ্রামখানির নানারূপের রূপকথা।
ঋতুতে-ঋতুতে হয় দামোদরের সাজবদল। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে শীর্ণা দামোদর হাঁটুজল-সর্বস্ব। তখন অনায়াসে পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গোগাড়ি। তখন টিট্টিভ, শামুকখোর, আর চখাচখির দল নিরুদ্দেশ হয়ে যায়—দূরের কোনও বিলে। বালি-চিক-চিক জল আঁকাবাঁকা পথে লুকোচুরি খেলে কিশোরী-বালিকার মতো। এদিকে তাকালে নজরে পড়ে নাড়া-মুড়ো-মোড়া দিগন্ত-অনুসারী ধূ-ধূ ধানের খেত। মাঝে-মাঝে ব্রহ্মডাঙার ঊষর তেপান্তরের মাঠ। রৌদ্রতাপে বায়ুস্তর বিসর্পিল ভঙ্গিতে আকাশপানে উঠতে থাকে। প্রকৃতি তখন গাজনের রুক্ষজটা সন্ন্যাসী। রিক্তপত্র বৃক্ষরাজির যেন বিধবার বেশ। খর-মধ্যাহ্নে ক্লান্ত ঘুঘুর একটানা ঝিম ধরা ডাক অথবা তৃষ্ণার্ত বিহঙ্গের কাতর আর্তনাদ——ফ-টি-ক-জল!
তারপর একদিন শেষ হয় গাজনের পালা। তাপদগ্ধ এক অপরাহ্ণে ঈশান-কোণ থেকে ধেয়ে আসত উন্মাদিনী কালবৈশাখী। শিহরিত হত পিপাসার্ত পাদপ। উন্মাদিনীর ভৈরবী নৃত্যের তালে তালে তারা মাথা দোলাত—যেন মদনানন্দে স্বামী সুখবঞ্চিতা বধূর অপ্রত্যাশিত মিলনসুখ। থামত ঝড়। বর্ষণসিক্ত প্রকৃতি রতিক্লান্তার আশ্লেষশয়নে তখন সুসুপ্ত।
দামোদর তখনও দুইপারের বন্ধনে বন্দি নয়। বর্ষাগমে ফেনিল আক্রোশে সে কুল ছাপাতো অনায়াসে। অচিরেই উপচে পড়ত গৈরিক জল—গ্রামে-গঞ্জে তাপদগ্ধ-কৃষিক্ষেত্রে। সারা গ্রামে তখন জল-ছপ-ছপ দুর্দৈব।
শেষ হত বর্ষা। সরে যেত প্লাবনের খ্যাপা ঘোলামি। মেঘবালিকাদেরও হত সাজবদল। নীলাম্বরীরা সরে যেত নেপথ্যে। আশ্বিনের আকাশে দেখা দিত তুলো-পেঁজা মেঘের তোরণ গিরিতনয়ার আহ্বানে। বৈরাগীর দল গুবগুবি বাজিয়ে শৈলসূতাকে শোনাত আগমনী-গান। তারপর আসত শিশিরস্নাত হেমন্ত, পৌষালি হিমের হাওয়া। সব শেষে আবার বসন্ত। প্রকৃতি সাজত মিলনোৎসবে
রূপমঞ্জরী প্রকৃতির এই রূপপরিবর্তন অনুভব করতেন দেহে-মনে। পিতৃদেবের বুদ্ধিপ্রদীপ্ত সৌর-ভাস্বরতার সঙ্গে মিশে যেত অনুভূতিস্নিগ্ধ কোমলমধুর কবিমানস। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠতেন তিনি।
কোথায় হারিয়ে গেল সেই সব আনন্দকোলাহল মুখরিত দিনগুলি?
গোলকচাপা গাছের তলায় বসে সেকথা ভাবতেন প্রৌঢ়া বিদ্যালঙ্কার :
দুর্গাপূজার মণ্ডপে শুভদার সঙ্গে খুনসুটি, রং দোলে ফাগ-আবিরে আবিল হুটোপুটি, দীপান্বিতার রাত্রে তারাবাতির ফুলঝুরি।
তারপর ওঁর কিশোরীর স্বপ্নে হঠাৎ এল একটা বিরাট পরিবর্তন। ক্ষণস্থায়ী কিন্তু অবিস্মরণীয়। ঝরা কদম ফুলের ক্ষণিক সুবাস যেন।
২২
কাশীধামের আশ্রম। বিদ্যালঙ্কার এখন তিন-কুড়ি মাত করেছেন—যষ্টিহীন ষষ্ঠী। শীতের অপরাহ্ণ। কাশীর শীত। বিদ্যালঙ্কার রোহিণীকে নিয়ে বসেছেন—তার চুল বেঁধে দিতে। তাঁর নিজের কেশরাজি কদমছাঁটের। যেকালে অধ্যাপনা করতেন তাঁর ছিল শিখাসর্বস্ব মুণ্ডিতমস্তক। ইদানীং আর মাথা কামান না। চুলগুলি ক্রমে হয়েছিল কদমছাঁট। এখন প্রায় কাঁধ সই-সই। কিন্তু রোহিণীর চুল দীর্ঘায়ত।
—হ্যাঁরে তুই কি চুলে তেল-টেল দিস না?
—আস্তে দিদা, আস্তে! চুলে লাগছে।
—লাগবেই তো। এত রুক্ষ হয়ে গেল কেন? চুল আঁচড়াস না বুঝি?
—আমিও যে তোমার মতো ‘চিতাছুট’, দিদা! একরকম বিধবাই।
–ষাট-বালাই! তোর তো বিয়েই হয়নি। তুই কেন বিধবা হবি?
তেল দিয়ে কঙ্কতিকা-শাসনে ওর ঘন কালো কেশগুচ্ছকে আয়ত্তে আনতে থাকেন। যেন এ-কাজই এ-কাজই
জীবন—মেয়ের, করেছেন সারাটা জীবন—মেয়ের, পুত্রবধূর, নাতনি-নাতবৌদের। দিদা বসে আছেন পিছনে। তাঁর মুখখানা দেখা যাচ্ছে না। এই সুযোগে রোহিণী জানতে চায়, আচ্ছা দিদা, বরের মুখখানা তোমার মনে আছে?
—তা থাকবে না কেন? এত এত সংস্কৃতমন্ত্র মনে থাকে, আর একটা মানুষের মুখের আদল ভুলে যাব?
—না, তাই বলছিলাম। তোমার তো বে হইছিল ন’বছর বয়সে, দ্বিরাগমন তো হয়ইনি। তাই না? শুভদৃষ্টির এক-লহমার স্মৃতি।
—তা কেন? উনি তো আমাদের বাড়িতে দু-একবার এসেছেন। তখন দেখেছি তাঁকে।
—কখনো কথা কয়েছ?
—তোর এত কৌতূহল কেন রে?
—বাঃ! জানতে ইচ্ছে করে না বুঝি? বল না? কথা কয়েছ দাদুর সঙ্গে?
হটী হাসলেন। রোহিণী অষ্টাদশী। কিন্তু অক্ষর-পরিচয়হীনা। সংস্কৃত কাব্য কিছুই পড়েনি। হয়তো যাত্রায় বা পালাগানে কিছু প্রেমের দৃশ্য দেখে থাকবে। তার বেশি নয়।
—কই, বললে না? কখনো কথা কয়েচ দাদুর সঙ্গে? নির্জনে?
—হ্যাঁ, বলেছি বৈকি।
—আড়ালে পেয়ে দাদু কখনো তোমাকে ধরে চুমু খেয়েছে?
বিদ্যালঙ্কার ঠক করে চিরুনির এক বাড়ি বসিয়ে দিলেন প্রগল্ভা মেয়েটির মাথায় : তোর আস্পর্ধা তো কম নয়! এই কথা কি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে হয়?
—কেন হবে না! ওদের কাছে তুমি পেল্লায় এক কেওকেটা। কিন্তু আমার কাছে তো তুমি স্রেফ : দিদা!
কথোপকথনে বাধা পড়ল। বাইরে থেকে শোনা গেল রমারঞ্জনের কণ্ঠস্বর : দিদি?
—কে? রমারঞ্জন? এস। ভিতরে এস। কী ব্যাপার?
—না। ভিতরে আসব না। একটা কথা জানাতে এসেছি। আপনার সঙ্গে দেখা করতে কয়েকজন এসেছেন। আমি তাঁদের মণ্ডপে বসিয়েছি। আপনাকেই একটু বাইরে আসতে হবে।
গায়ের উপর থান-আঁচলটা টেনে দিয়ে বিদ্যালঙ্কার গৃহের বাইরে এলেন। বলেন, আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন? কে?
—কাশীধামের পণ্ডিতসমাজের তরফে কয়েকজন।
—আমার কাছে কেন? আমি তো কাশীর পণ্ডিতসমাজের কেউ নই এখন।
—তা জানি না, দিদি। পাঁচসাত জন বিশিষ্ট মহোপাধ্যায়।
—ঠিক আছে। ওঁদের বসাও। আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর। আমি এখনি আসছি। রমারঞ্জন গ্রীবাভঙ্গিতে সম্মতি জানিয়ে প্রস্থান করলেন।
—আমাকে উত্তরীয়টা এনে দে তো রোহিণী।—ও কী, তোর কী হল?
বিদ্যালঙ্কারের নজর হল রোহিণী তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়েছে। দেওয়াল-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। বলে, ওঁরা আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছেন, দিদা!
—ধরে নিয়ে যেতে! কেন রে? তুই কী করেছিস?
—খুড়ামশায়ের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছি! জান না?
বিদ্যালঙ্কার আরার হাসলেন। বলেন, কী পাগলি রে তুই! তুই কেন পালিয়ে আসবি? আমিই তো তোকে এখানে নিয়ে এসেছি।
—কিন্তু….কিন্তু খুড়ামশাই-ই তো আমার অভিভাবক।
—না রে, রোহিণী। তোর অভিভাবক একমাত্র বাবা বিশ্বনাথ। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোকে ধরে নিয়ে যাবার ক্ষমতা কারও নেই। তুই আমার আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিস। ভয় কি?
রোহিণী মাথা ঝাঁকায়, কিন্তু ওঁরা যে পাঁচ-সাতজন!
আবার হাসলেন বিদ্যালঙ্কার। বলেন, বাহুবলের যুক্তি? তাও খাটবে না আমার আশ্রমে। ওঁরা তো মাত্র পাঁচ-সাতজন, নিরস্ত্র ব্রাহ্মণ পণ্ডিত! কেন? জানিস না—জলদস্যুরা সংখ্যায় ছিল বিশ-পঁচিশ জন। তুই নিজে থেকে যেতে না চাইলে কারও সাধ্য হবে না জোর করে তোকে তুলে নিয়ে যেতে।
—কিন্তু তুমি তো সেদিন আমাকে জোর করেই তুলে এনেছিলে।
—না। সেদিন তোর আন্তরিক ইচ্ছাটা ছিল আমার সবচেয়ে বড় শক্তি। তুই নিজেই সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলি। খুড়ামশাই তোকে এক থুখড়ো বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছিল। তুই রাজি হসনি—তাই না? আমি তোকে সাহায্য করেছিলাম মাত্র। তুই নির্ভয়ে থাক। আমার ঘর ছেড়ে বার হস না। আমি দেখছি—
চতুষ্পাঠীর বড় মণ্ডপে অতিথিরা আসন পেতেছেন। তাঁরা প্রতীক্ষারত। বিদ্যালঙ্কার উত্তরীয়টা গায়ে জড়িয়ে যুক্তকরে এসে উপস্থিত হলেন। অনেকে উঠে দাঁড়ালেন। বিদ্যালঙ্কার সকলকে সমবেতভাবে নমস্কার করলেন। অগ্রসর হয়ে এসে মহোপাধ্যায় রতনলাল ব্রহ্মচারীর পদস্পর্শ করে প্রণাম করলেন। রতনলাল কাশীধামের একজন প্রধান উপাধ্যায়। অশীতিপর বৃদ্ধ। হটী বিদ্যালঙ্কার যখন কাশীতে চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করে অধ্যাপনা শুরু করেন তখন স্ত্রীলোকের অধ্যাপন-অধিকার হিন্দুশাস্ত্রে স্বীকৃত কি না, এই বিষয়ে একটি তর্কসভার আয়োজন হয়। একপক্ষে হটী বিদ্যালঙ্কার। অপরপক্ষে কাশীধামের নব্য পঞ্চপণ্ডিত। সে তর্কসভায় পঞ্চপণ্ডিতকে পরাজিত করে হটী বিদ্যালঙ্কার নারীর বেদাভ্যাস ও অধ্যাপনা বৃত্তির স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। সে আজ প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। সেসব অতীত কথা প্রথমখণ্ডেই বর্ণিত হয়েছে। ব্রহ্মচারী রতনলাল সে সভার অন্যতম বিচারক ছিলেন। তিনি বললেন, বস মা-জননী তোমার কাছে আমরা এসেছি একটি আর্জি নিয়ে। শোন, বুঝিয়ে বলি।
বিদ্যালঙ্কার উপবেশন করলেন। ব্রহ্মচারী বললেন, উত্তরখণ্ডের এক মহাপণ্ডিত কাশীনরেশের নিকট কাশীধামে দশবিঘা ভূখণ্ড দেবোত্তর-হিসাবে যাচ্ঞা করেছেন। দুর্গাবাড়ি মন্দিরের কাছাকাছি। সেখানে তিনি একটি আশ্রমপ্রতিষ্ঠায় ইচ্ছুক। শ্ৰীমন মহারাজ সেই পণ্ডিতকে জানিয়েছেন যে, ওই ভূখণ্ড দেবোত্তর হিসাবে প্রদান করতে তাঁর কোনো আপত্তি নাই। তবে দানকার্যটা হতে হবে কাশীর পণ্ডিতসমাজের সম্মতি-সাপেক্ষে। কাশীনরেশ সেই আবেদনপত্র এবং তার প্রত্যুত্তরের অনুলিপি আমাদের প্রেরণ করে আমাদের অভিমত জানতে চেয়েছেন।
বিদ্যালঙ্কার বলেন, দেখুন আচার্যদেব! কাশীনরেশ আপনাদের মতামত প্রার্থনা করেছেন—কাশী-পণ্ডিত-সমাজের। আমি সেই সমাজের অনুবর্তী হলেও আপনাদের কর্মপরিষদের সদস্যা নাই। বস্তুত আমি বর্তমানে নিতান্তই একান্তবাসিনী। অধ্যাপনাও করি না। ফলে এ বিষয়ে আমার মতামতের তো কোনো মূল্য নেই। আপনারা আপনাদের মতামত কাশীনরেশকে জানাবেন, আমার মতামত প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
—ঠিক কথা। আইনসম্মত কথা বলেছ তুমি। কিন্তু একটি ব্যত্যয় উপস্থিত হয়েছে। তাই আমরা সবাই তোমার দ্বারস্থ হয়েছি। বস্তুত আমরা এসেছি মহামহোপাধ্যায়ের নির্দেশানুসারে।
—মহামহোপাধ্যায়?
—কাশীধামের সর্বাগ্রগণ্য মহামহোপাধ্যায় রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন।
নামটি শ্রবণ্মাত্র বিদ্যালঙ্কার যুক্তকর ললাটে স্পর্শ করালেন।
সর্বাগ্রগণ্য মহামহোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে। সর্ববিখ্যাত নন তা বলে। যেমন গৌড়বঙ্গে সর্ববিখ্যাত পণ্ডিত ত্রিবেণীর পঞ্চানন-ঠাকুর অথচ সর্বাগ্রগণ্য হচ্ছেন অরণ্যচারী বুনো রামনাথ। কাশীবাসী রামপ্রসাদ ওই বুনো রামনাথের মতোই বঙ্গ সংস্কৃতির ইতিহাসে উপেক্ষিত এক ক্ষণজন্মা।
বাঁশবেড়িয়া বিদ্যাসমাজের ভট্টাচার্যবংশীয় এই পণ্ডিত যৌবনেই কাশীবাসী হয়েছিলেন। তিনিও জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের মতো অতি দীর্ঘজীবী (1709-1814 )। তাঁর যখন বিরাশি বৎসর বয়স তখন (1791) কাশীধামে প্রথম একটি সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই বয়সেই তিনি ওই মহাবিদ্যালয়ে ন্যায়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। বিশ্বাস করা কঠিন যে তারপর দীর্ঘ বাইশ বৎসর তিনি সেখানে অধ্যাপনা করেন। মৃত্যুর পূর্ববৎসর পঞ্চাশ টাকা পেনশন নিয়ে অবসর গ্রহণ করেন। আমাদের কাহিনির কালে তাঁর বয়স একশ তিন। বাঁশবেড়িয়ায় প্রতিষ্ঠিত ওই পণ্ডিতের শিবমন্দিরটি বর্তমানেও বর্তমান।
বিদ্যালঙ্কার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, তা বাবা হঠাৎ আপনাদের আমার কাছে পাঠালেন কেন? আমি কে? আমি কী?
—তা একমাত্র তিনিই বলতে পারেন। এখন বল, তোমার কি সম্মতি আছে?
–কেন? আপনাদের কি নাই?
—এ প্রশ্ন অবান্তর। তুমি তো নিজেই বলছ যে, কাশীধামের পণ্ডিত-সমাজের অনুবর্তী হলেও তুমি এর সদস্যা নও। আমরা দূত—স্বভাবতই অবধ্য। তোমার মতামতটা জানতে এসেছি মাত্র।
ভ্রূকুঞ্চন হল বিদ্যালঙ্কারের। বললেন, তা যদি বলেন, তবে বলব আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার এতে কোনো আপত্তি নাই। উত্তরখণ্ডের পণ্ডিত তো দেবোত্তর ভূখণ্ড প্রার্থনা করেছেন। একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা মানসে। তাতে আপত্তি হবে কেন? কোন্ দেবতার মন্দির?
—না, কোনো দেবদেবীর মন্দির সম্ভবত সেখানে প্রতিষ্ঠা করা হবে না। কারণ প্রার্থী যোশীমঠের বর্তমান শঙ্করাচার্য। ওঁরা তো দেবদেবীতে বিশ্বাস করেন না। নিরাকার ব্রহ্ম ওঁদের উপাস্য।
—তা হোক না। তাঁরা নিরীশ্বরবাদী নন। ঈশ্বরকে স্বীকার করেন। ঈশ্বর সম্বন্ধে যে যুগাবতার সম্পূর্ণ নীরব, তাঁকেও তো তৎকালীন কাশীনরেশ দেবোত্তর সম্পত্তি প্রদান করেছিলেন—কাশীধামের উপকণ্ঠেই। সারনাথ মৃগদাবে তাঁর আশ্রম আজও আছে। ধামেক স্তূপও আছে। দেবদেবীর কোনো মূর্তি সে স্তূপে নাই।
—আড়াই হাজার বছর পূর্বে কাশীধামে বিশ্বনাথের মন্দির ছিল। শ্রীকৃষ্ণের নবম অবতারও তখন বর্তমান। কিন্তু কাশীনরেশ কি ছিলেন তখন? তিনি কি অনুমতি দিয়েছিলেন বুদ্ধদেবকে বা তাঁর কোনো শিষ্যকে? সারনাথ মৃগদাবে একটি সংঘারাম প্রতিষ্ঠা করতে?
—অনুমতি দিয়েছিলেন কি না তা বলতে পারব না। কিন্তু কাশীনরেশ সে সময়ে নিশ্চয় ছিলেন। তার শাস্ত্রীয় প্রমাণ আছে।
—কী প্রমাণ, বিদ্যালঙ্কার?
—একাধিক বৌদ্ধজাতকে কাশীধামের উল্লেখ আছে—ষড়দন্তজাতক শিবিজাতক প্রভৃতি। আর জাতক-কাহিনিগুলি বুদ্ধপূর্ব যুগের—এটাই প্রমাণ।
—বুঝলাম। কিন্তু বুদ্ধদেব জগতের দুঃখকষ্টকে অস্বীকার করেননি। জীবে দয়া করার কথা বলেছেন। ‘জগৎ মিথ্যা’ একথা বলেননি। তিনি জগদীশ্বরের দশাবতারেরর নবম অবতার।
বিদ্যালঙ্কার বললেন, ‘আপনি মহাপণ্ডিত। আপনার সঙ্গে তর্ক করা আমার শোভা পায় না; কিন্তু যেহেতু আপনি দু-বার ওকথা বললেন, তাই প্রতিপ্রশ্ন করছি : শাক্যসিংহ যে শ্রীকৃষ্ণের নবম অবতার, এই তথ্যটার প্রমাণ কী?”
—শঙ্করাচার্যকৃত দশাবতার-স্তোত্র।
—আপনি আদি শঙ্করাচার্যের অতবড় দশাবতার-স্তোত্রকে প্রামাণ্য মনে করেন, অথচ তাঁর ওই শ্লোকার্ধটি মানেন না : ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা?’ সেই আদিশঙ্করের ধর্মমত প্রচার করছেন যোশীমঠের বর্তমান যে শঙ্করাচার্য তাঁকে সূচ্যগ্র মেদিনী দানের সুপারিশে আপনাদের আপত্তি?
তৎক্ষণাৎ আসনত্যাগ করে দণ্ডায়মান হলেন অশীতিপর বৃদ্ধ। বললেন, আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করতে আসিনি, বিদ্যালঙ্কার। আমি তোমার অভিমতটুকু শুধু সংগ্রহ করতে এসেছিলাম। তা জেনেছি। ধন্যবাদ!
তৎক্ষণাৎ করজোড়ে উঠে দাঁড়ালেন বিদ্যালঙ্কারও। বলেন, আপনি আমার উপর রুষ্ট হয়েছেন, আচার্যদেব। আমার কথায় আহত হয়েছেন; কিন্তু আমি তো আপনাকে….
বাক্যটা সমাপ্ত হয় না। তার পূর্বেই ব্রহ্মচারী বলে ওঠেন, না, মা! তোমার উপর রুষ্ট হব কেন? সে অধিকারও তো আমার নাই। আমি দূত মাত্র। বিদ্যারত্নও তোমার উপর রুষ্ট হননি। তিনি এ আশ্রম ত্যাগ করে গিয়েছিলেন দুরন্ত অভিমানে।
নতমস্তকে এ তিরস্কার গ্রহণ করলেন হটী বিদ্যালঙ্কার।
২৩
এ কয়দিন প্রচণ্ড মনঃকষ্টে কেমন যেন দুর্মনস্যায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন।
কী প্রয়োজন ছিল এভাবে ওঁদের স্বমতে আনার? ওঁরা সবাই আবাল্য সংস্কারে নিমগ্ন হয়ে আছেন। শাক্যসিংহের নির্দেশে ‘আত্মদীপ’ হতে পারেন না—অনন্যশরণ’ হতে অশক্ত। শাস্ত্রোক্ত নির্দেশে ওঁরা নিজ-নিজ বিবেককে লৌকিক ধর্মের যূপকাষ্ঠে বলিদান করেছেন। মহাপণ্ডিত রতনলাল ব্রহ্মচারীকে আঘাত দেবার কোনো ইচ্ছা আদৌ ছিল না তাঁর। হয়তো ‘সূচ্যগ্র-মেদিনী’ শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। যুক্তির ক্ষুরধার পথে ওঁদের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যই ছিল শুধু। ওঁর আশ্রমের প্রধান আচার্য দ্বারকেশ্বর বিদ্যার্ণবকেও একদিন এ-কথা বোঝাতে চেয়েছিলেন। পারেননি। রতনলাল ব্রহ্মচারীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। ওঁরা আজন্মকালের শিক্ষায় স্মার্ত পণ্ডিতদের উদ্ধৃত শ্লোকে নিজ-নিজ বিবেককে বর্জন করেছেন। কিন্তু ওঁর পিতৃদেবও তো ছিলেন অসাধারণ পণ্ডিত। সমস্ত শাস্ত্র ছিল তাঁর অধিকারে। কিন্তু কৈশোরকালে রূপমঞ্জরী যখন বলেছিল : ‘তোমরা দুজনেই ভুল করছ, বাবা—তুমি আর শুভদা!’—তখন তিনি তো রতনলাল ব্রহ্মচারীর মতো স্থানত্যাগ করেননি। অথবা বিদ্যার্ণবের মতো আশ্রমত্যাগ। মুহূর্তমধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন কিশোরী কন্যার যুক্তি। বলেছিলেন, “তুই ঠিক কথাই বলেছিস, মা!
সেই অতীতকালের কথা স্মৃতিপথে উদয় হতেই মনে পড়ে গেল গ্রামের কথা। বিস্মৃতপ্রায় বাল্যের কথা। কৈশোরের স্মৃতিকথা।
কী আনন্দঘন ছিল সেসব দিন! গাছ-গাছালি-ছাওয়া শান্ত একটি ঝিমন্ত গ্রাম। একবগ্গাঠাকুরের বালিকা কন্যাটিকে সবাই কত স্নেহ করত, আদর করত। সোনা-মা ওর মাথায় কাকপুচ্ছ বেণী বেঁধে দিতেন। গাছ-কোমর শাড়ি জড়িয়ে সে নাচতে নাচতে চলে যেত বড়বাড়ি—শুভদাদের বাড়িতে। শুভদা! তার বাল্যসঙ্গী! দুরন্ত অভিমানে যে ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিল। একসঙ্গে বেড়ে উঠেছিল ওরা-ভাইবোনের মতো। তারপর কী যেন হয়ে গেল! কৈশোরকালে দুজনের মনেই এসেছিল একটা অদ্ভুত পরিবর্তন। দুজনেই দুজনকে কাছে পেতে চাইত—কিন্তু সে যেন অন্যরকম কাছে-পাওয়ার ইচ্ছা।
কিন্তু সে-কথা ওরা কেউ মন খুলে বলেনি, পরস্পরের কাছে স্বীকার করেনি। হয়তো অন্য ধরনের পরিণতি হত ওদের বাল্যপ্রেমের। হল না। রাঢ়ী-বারেন্দ্রর অশাস্ত্রীয় মিলনের বাধায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেঁকে বসলেন তারাপ্রসন্ন। আঘাত তিনিও কম পাননি—কিন্তু সামাজিক কুসংস্কারকে অস্বীকার করে উঠতে পারেননি। হয়তো সেই গোঁড়ামির ফলে ঈশ্বর তাঁকে দিলেন মর্মান্তিক শাস্তি। একবস্ত্রে শুভদা গৃহত্যাগ করে গেল। জেঠামশাই হয়ে গেলেন প্রায় উন্মাদ। জেঠিমা মূক।
রূপমঞ্জরীর মনে পড়ে—এই পর্যায়ে আরও একটা প্রবল পরিবর্তন এসেছিল তার জীবনে। শুভদাকে সে ভোলেনি, ভুলতে পারে না, ভোলা অসম্ভব! কিন্তু বর্তমানের দাবিও অমোঘ—অতীতকে আঁকড়ে ধরে প্রত্যক্ষ বর্তমানকে অস্বীকার করা যায় না—বিশেষত কৈশোর-যৌবনের সেই ক্রান্তিকালে। সেই আধো-জানা আধো-অজানা অবাকমানা দিনগুলোয়।
রূপমঞ্জরীর যৌবনের মৌবনে এল এক নতুন ভ্রমর। মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেনি কিশোরী সীমন্তিনী। দু-হাত পেতে গ্রহণ করেছিল তার সামান্য উপহার—যা হয়ে উঠেছিল ওর জীবনে অসামান্য—ঝড়ে-ঝরা একটি বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল।
নিষ্ঠুর নিয়তির তাও সহ্য হল না। নিয়তিরই বা কী দোষ? এ যে শাস্ত্রীয় বিধান! শোননি, সেই ‘তট-তট-তোতয়’ পুঁথিতে দেবনাগরী হরফে লেখা ‘অং-বং-চং’ মন্তরটা—’স্ত্রীলোক অক্ষর-পরিচয়ের উদ্যোগ করিলে তাহার অনিবার্য ললাটলিখন : অকালবৈধব্য!’
ঘুচে গেল বালিকাবধূর শাঁখাসিঁদুর রাঙাশাড়ি। তবু হার মানেনি। স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে যদি না-ই হয়—পিতাপুত্রী প্রতিষ্ঠা করবে সোঞাই-গ্রামে এক আরোগ্য নিকেতন! তার সঙ্গে আয়ুর্বেদ মহাবিদ্যালয়। গৌড়বঙ্গের বিভিন্ন সংস্কৃতিকেন্দ্র থেকে ছুটে আসবে মেধাবী ছাত্ররা—সাংখ্য-বেদান্ত চর্চা অনেক হয়েছে, অনেকে এখনো করছেন—ওরা তাই জীবের ‘মুক্তিকামী’ নয়, ‘নিরোগকামী’! ব্রহ্ম সত্য কি না জানা নেই প্রত্যক্ষজ্ঞানে, কিন্তু জগত যে মিথ্যা নয় তা ওরা মর্মে-মর্মে অনুভব করেছে। দৈহিক নিপীড়নে কাতর আত্মীয়-পরিজনের রোগযন্ত্রণা। নাগদংশনে নীল হয়ে যাওয়া বালক। মারীগুটিকায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া লগ্নভ্রষ্টা বিয়ের কনে। কিন্তু সে স্বপ্নও পূরণ হল না। অন্ত্যজ-পরিবারের একটি শিশুকে নাগদংশন থেকে রক্ষা করার ‘পাপে’ প্রাণ দিলেন কিশোরী কন্যার প্রাণপুরুষ : পিতৃদেব।
আঘাত! আঘাত! আঘাত! তবু ভেঙে পড়েনি রূপমঞ্জরী, সে জ্যাঠাইমা-দিদার সেবা করতে রওনা হয়েছিল বাবা ৺বিশ্বনাথের শরণ নিতে। নিয়তি কিন্তু পিছু ছাড়েনি তখনো। বন্দিনী হয়ে পড়ল দস্যুসর্দারের বজরায়। তবু সে হার মানেনি। দসাসর্দারের ‘বালকপুত্রের প্রাণরক্ষা করে আবার হয়ে উঠল ‘মাতাজী’!
না, ভাগ্যদেবতাকে দোষারোপ করতে পারে না। বারে বারে তাকে প্রচণ্ড বিপদের সম্মুখীন করা সত্ত্বেও বরাবর তাকে রক্ষা করে গেছেন তিনি। দস্যুসর্দার যদি ঈশান না হত তাহলে কি সে আদৌ পৌঁছাতে পারত ৺কাশীধামে?—বিদ্যার্ণবের সস্নেহ সম্পুটে? আবার হয়ে উঠতে পারত আশ্রম-মাতাজী?
এইসব ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিকথাই তন্ময় হয়ে ভাবছিলেন। আশ্রমপ্রান্তের সেই নির্জন গোলকচাঁপা গাছটার তলায় বসে। হঠাৎ আবার আবির্ভাব ঘটল রমারঞ্জনের, দিদি! একবার এদিকে আসতে হবে। মহামহোপাধ্যায় স্বয়ং এসেছেন আপনার সাক্ষাতে।
স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বিদ্যালঙ্কার : মহামহোপাধ্যায়?
হ্যাঁ, তিনিই। রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন স্বয়ং! কাশীধামের সর্বাগ্রগণ্য পণ্ডিতপ্রবর! তিনি তো ওঁকে অনায়াসে ডেকে পাঠাতে পারতেন।
তড়িঘড়ি ছুটে এলেন সেই অতিবৃদ্ধের সন্নিকটে।
—এ কী! আপনি আমাকে ডেকে পাঠালেন না কেন?
নিদত্ত হাসি হাসলেন বৃদ্ধ। বলেন, অনেকদিন যে তোকে দেখিনি, মা…
—তাই তো বলছি। আমাকে চোখের দেখা দেখতে চান তো ডাক দিলেই পারতেন?
—তাই কি পারি রে? বলিরাজকে কি বামনাবতার ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর পর্ণকুটীরে? আমি যে আজ ত্রিপদ ভূমির প্রার্থী। আর ‘চোখের দেখার’ কথা বলছিস? সে শক্তি আর আমার নেই রে বেটি। চোখের সমুখে এখন সব আঁধার—নীরন্ধ্র অমারাত্রি!
—সে কি! আপনি তো এখনো অবসর গ্রহণ করেননি?
—না। ওরা ছাড়েনি আমাকে।
বিস্ময়কর তথ্য! আদ্যন্ত ঐতিহাসিক সত্য। লেখকের কল্পনা নয়। কয়েক বৎসর তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ। হটী বিদ্যালঙ্কারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন চৌদোলায় চেপে। সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় আজও তাঁকে মুক্তি দেয়নি। চৌদোলায় চেপে একশত বৎসর পাড়ি দেওয়া অতিবৃদ্ধ মহাবিদ্যালয়ে আসেন। কারও হাত ধরে গিয়ে উপবিষ্ট হন নিজের নির্দিষ্ট কক্ষে। তখন একে একে এগিয়ে আসতেন মহাবিদ্যালয়ের গুটিকয় ছাত্র—যাঁরা ক্ষুরস্যধারা ন্যায়ের উচ্চমার্গে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছেন। জটিল ন্যায়সূত্রের অনুপপত্তি নিরাকরণমানসে। ভূর্জপত্রে লিখিত পুঁথি উনি দেখতে পান না, কিন্তু মস্তিষ্কের রন্ধ্রে স্মৃতিমঞ্জুষায় সজ্জিত পংক্তিগুলি বিস্মৃত হননি। অনর্গল তা শুনিয়ে দিতেন, ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন। প্রতিটি ব্যাসকূটের গ্রন্থিচ্ছেদন করে যেতেন।
—বলুন বাবা। কীভাবে আপনার সেবা করতে পারি?
—না, মা। খাদ্যপানীয়ে আমার কিছু বাধা আছে। বলতে পারিস : সংস্কার! তবে আজ আমাকে আপ্যায়ন করতে পারিস আমার মনের সংশয় নিরাকরণ করে।
বিদ্যালঙ্কার বোঝেন এ শুধু বাক্প্রয়োগের কারিগরী, মহামহোপাধ্যায় এসেছেন ওই প্রতর্ক প্রসঙ্গেই—সেদিন যেকথা অসমাপ্ত রেখে রতনলাল ব্রহ্মচারী উঠে চলে গিয়েছিলেন। বিদ্যালঙ্কার কোনো প্রশ্ন করলেন না। প্রতীক্ষা করলেন।
বৃদ্ধ বলেন, রতনলালের কাছে শুনলাম, কাশীধামে অদ্বৈত বেদান্ত মঠ প্রতিষ্ঠায় তোর নাকি কোনো আপত্তি নাই। এ কথা সত্য?
—হ্যাঁ, বাবা। কেন? আপনার কি কোনো আপত্তি আছে?
—আমার কথা পরে। তার পূর্বে তোর মতামতটা বুঝে নিই।
—আজ্ঞে না। এ প্রস্তাবে আমার কোনো আপত্তি নাই। ভারতবর্ষ এক সর্বংসহা মহাদেশ। এখানে সকল ধর্মমতই স্বাগত। আমরা তো অনায়াসে গ্রহণ করেছি শাক্যসিংহ, বর্ধমান-মহাবীর, জরথুষ্ট্র, যীশুখ্রিস্ট এবং হজরত মহম্মদের ধর্মমত। একমাত্র শঙ্করাচার্যকেই বা প্রত্যাখ্যান করব কেন?
—আমি ভারতবর্ষের কথা বলছি না, মা। বলছি কাশীধামের কথা।
—সেই কাশীধামও ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত।
—না, মা। আমাদের বিশ্বাস কাশীধাম ভারত-ভূখণ্ডের বাহিরে। বাবা বিশ্বনাথের ত্রিশূলপ্রান্তে তার অবস্থান।
—বেশ। তাই যদি হয় তবে সেই ত্রিশূলপ্রান্তে তো ঠাঁই হয়েছে গির্জার, মসজিদের, ধামেক স্তূপের। অদ্বৈতবেদান্তর মঠ প্রতিষ্ঠাতেই শুধু বাধা দেব কেন?
—আসছি সে প্রসঙ্গে। তার পূর্বে আমাকে বুঝিয়ে বল তো মা—আদি শঙ্করাচার্য সহস্রাব্দপূর্বে সে কাজটি কেন করে যাননি? ভারত ভূখণ্ডের চারপ্রান্তে তিনি চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করে গেলেন, কিন্তু কেন পরিহার করলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের সর্বশ্রেষ্ঠ পীঠ : কাশীধামকে?
বিদ্যালঙ্কার একটু চিন্তা করে বললেন, সম্ভবত আদি শঙ্করাচার্য চতুর্বেদ অবলম্বনে ভারতের চারপ্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। গোবর্ধনমঠে : ঋক্, সারদামঠে : সাম, শৃঙ্গেরীমঠে : যজুঃ, এবং যোশীমঠে : অথ
—তাই যদি হয় তবু তিনি তো অনায়াসে রামেশ্বর বা দ্বারকাকে পরিত্যাগ করে তালিকায় কাশীধামকে রাখতে পারতেন!
বিদ্যালঙ্কার পুনরায় চিন্তা করে বলেন, এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। আপনি আমাকে বুঝিয়ে বলুন?
তর্কপঞ্চানন অন্ধের দৃষ্টি মেলে বোঝাতে থাকেন :
আদি শঙ্করাচার্য ভারত-ভূখণ্ডের চার প্রান্তে চারটি মঠ বা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। অদ্বৈত বৈদান্তিক সূত্রে ভারতকে বাঁধতে চেয়েছিলেন।
উত্তরে : বদরীকাশ্রমের প্রবেশদ্বারে যোশীমঠ। বেদ : অথর্ব। দেব : নারায়ণ; দেবী : পুন্নগাধী। তীৰ্থসলিল : অলকানন্দা। ভৌগোলিক সীমানা : উত্তরখণ্ড—অর্থাৎ কুরু, পাঞ্চাল, কাশ্মীর, কম্বোজ ও আর্যাবর্তের উত্তরাপথ। এই উত্তরখণ্ড আশ্রমে মহাবাক্য : ‘অয়মাত্মা ব্ৰহ্ম’ মন্ত্ৰ।
দক্ষিণে : শৃঙ্গেরীমঠ : রামেশ্বরমে। বেদ : যজুঃ। দেব : না, রামেশ্বর বা শিব নন, আদিবরাহ; দেবী : কামাখ্যা। তীর্থসলিল : তুঙ্গভদ্রা। ভৌগোলিক সীমানা : দক্ষিণখণ্ড—অর্থাৎ অন্ধ্র, দ্রাবিড়, কর্ণাটক, কেরল ও মহারাষ্ট্র। দক্ষিণ খণ্ডের মহাবাক্য : ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’।
পূর্বে : গোবর্ধনমঠ : শ্রীক্ষেত্রে। বেদ : ঋক্। দেব : জগন্নাথ; দেবী : বিমলা। তীৰ্থসলিল : মহোদধি। ভৌগোলিক সীমানা : পূর্বখণ্ড অর্থাৎ বঙ্গ, কলিঙ্গ, মগধ। মহাবাক্য : ‘প্রজ্ঞানামানন্দং ব্ৰহ্ম।’
পশ্চিমে : সারদামঠ : দ্বারকায়। বেদ : সাম। দেব : না, শ্রীকৃষ্ণ নন, সিদ্ধেশ্বর; দেবী ভদ্রকালী। ভৌগোলিক সীমানা : পশ্চিমখণ্ড অর্থাৎ সিন্ধু, সৌরাষ্ট্র, রাজপুতানা, কাথিয়াবাড়। মহাবাক্য : ‘তত্ত্বমসি’ মন্ত্ৰ।
সমস্ত বিবরণ শ্রবণান্তে আমাদের মনে অনেকগুলি প্রশ্ন জাগে! প্রথম কথা : নির্বাচিত চারটি ধামে সহস্রাব্দ-চিহ্নিত দেবদেবীদের কেন উৎখাত করা হল, একমাত্র শ্রীক্ষেত্র ব্যতিরেকে? বদরীকাশ্রমে বদরীবিশালকে স্থানচ্যুত করে কেন আবির্ভূত হলেন ‘নারায়ণ’? উভয়েই সমার্থক, তবু নামটি কেন পরিবর্তন করা হল? আর কেনই বা লক্ষ্মী অথবা নারায়ণীকে পরিত্যাগ করে তাঁর দেবী হলেন ‘পুন্নগাধী’? বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্মে ‘পুন্নগাধীর কী মহিমা? আবার রামেশ্বরমে শিবকে, অর্থাৎ রামেশ্বরকে অপসারিত করে কেন প্রতিষ্ঠিত হলেন : ‘আদিবরাহ’? কেন নয় শঙ্করাচার্য সৃষ্ট দশাবতার স্তোত্রের আদি অবতার : ‘আদি মৎস্য’? আবার দেখা যাচ্ছে সেই আদি- বরাহের পাশে এসে উপস্থিত হয়েছেন সুদূর পূর্বভারত থেকে মা কামাখ্যা! এ সকল প্রশ্নের সমাধান আমরা জানি না। শুধু অনুমান করা যায়—দেবদেবীর ভিতর ‘পুরুষ-প্রকৃতি’ সহাবস্থান আদি শঙ্করাচার্য অনুমোদন করেননি। আবার বলি : একমাত্র ব্যতিক্রম শ্রীক্ষেত্রধাম। কিন্তু সেখানে যে দেবদেবী আছেন তাঁরা ‘পুরুষ-প্রকৃতি’ নন : ভ্রাতা-ভগিনী!
দ্বিতীয় প্রশ্ন : যোশীমঠ—যে মহাপথে আর্যরা ভারত-ভূখণ্ডে প্রথম প্রবেশ করেছিলেন, সেখানে কেন আদি বেদ ঋক্ নির্বাচিত হল না? এ প্রশ্নের একটি সম্ভাব্য সমাধান এ ভাবে পাওয়া যেতে পারে : হিমালয় হচ্ছে ওষধির আকর এবং অথর্ববেদের চর্চা ওষধিনির্ভর। হয়তো সেই হেতুতেই বদরিনাথাশ্রম সন্নিকট যোশীমঠে শঙ্করাচার্য অথর্ববেদের উপর একটি তর্কসভার আয়োজন করেছিলেন এবং সে প্রতর্কে যিনি শ্রেষ্ঠ আয়ুর্বেদাচার্য রূপে চিহ্নিত হলেন তাঁকেই নির্বাচিত করা হল প্রথম মঠাধ্যক্ষ হিসাবে : তোটকাচার্য।
তৎসত্ত্বেও একটি অনুপপত্তি থেকে গেল না কি? ‘ওষধির প্রয়োজন তো আর্তের—রোগাক্রান্ত নরনারীর। তাঁদের সেবাযত্নের কী প্রয়োজন? তাঁরা তো মায়া? ‘জগৎ’ তো মিথ্যা!
এই প্রতর্কের সমাধান হতে পারে একমাত্র এ ভাবে : ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা মহাবাক্য শুধু মুক্তিকামী সন্ন্যাসীর। আপামর জনসাধারণের আধিব্যাধি দূরীকরণে আদি শঙ্করাচার্য এটি করেছিলেন।
তৃতীয় প্রশ্ন : ভারত-ভূখণ্ডের চারপ্রান্তে চারটি মঠ স্থাপন করেই কেন সন্তষ্ট হলেন আদি পরিকল্পনাকার? মধ্যভারতের দুটি মহাতীর্থকে কেন পরিহার করা হল—যেখানে ব্রাহ্মণ্যধর্মের দুটি প্রধান শাখা সুপ্রতিষ্ঠিত : কাশীধাম এবং বৃন্দাবন? শিবপার্বতী ও রাধাকৃষ্ণের লীলাভূমিদ্বয়? চতুর্বেদের অতিরিক্ত পঞ্চমবেদের অনুপস্থিতির কারণ—এটা সম্ভবপর নয়। আর তাই যদি হয় তাহলে কাঞ্চিমঠ গড়ে উঠল কেমন করে? হটী বিদ্যালঙ্কার প্রশ্ন করে ওঠেন, এ প্রশ্নের কোনো সমাধান আপনি পাননি?
—অনুমাননির্ভর সমাধান পেয়েছি। শাস্ত্রের অনুমোদন খুঁজে পাইনি।
—আপনার সেই অনুমান-নির্ভর সমাধানটি কী?
—আমার ধারণা যুগাবতার আদি শঙ্করাচার্য এটি করেছিলেন—মাতা উভয়ভারতীর ইচ্ছানুসারে। বলা যায় : মাতৃআজ্ঞায়!
বিদ্যালঙ্কার প্রশ্নভরা দুটি নয়ন মেলে প্রতীক্ষা করেন। রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন তাঁর ধারণা অনুসারে এ অসঙ্গতির ব্যাখ্যা দিয়ে চলেন :
সমগ্র আর্যাবর্ত পরিক্রমা সমাপ্ত করে, প্রতিটি ধর্মমতের শীর্ষস্থানীয় আচার্যদের একে একে পরাস্ত করে, আদি শঙ্করাচার্য এসে উপস্থিত হলেন পূর্বভারতে : গৌড়বঙ্গে। অদ্বৈতবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে মীমাংসা দর্শনের মোকাবিলা করা অপরিহার্য। বেদের কর্মকাণ্ডের উপর স্থাপিত মীমাংসা-দর্শনের শ্রেষ্ঠ মীমাংসক আচার্য কুমারিল ভট্ট তখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী পণ্ডিত। আচার্যের অভিপ্রায় শ্রবণ করে কুমারিল বলেন যে, তিনি আর কোনো তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে অনিচ্ছুক। তবে শঙ্করের নিরাশ হবার কারণ নেই। কারণ তাঁর শ্রেষ্ঠ শিষ্য আচার্য মণ্ডন মিশ্রকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করলেই হবে। তাহলেই কুমারিল ভট্ট স্বীকার করে নেবেন : সাধনমার্গে অদ্বৈত-মতবাদই শ্রেষ্ঠ।
আচার্য শঙ্কর এসে উপনীত হলেন মণ্ডন মিশ্রের আশ্রমে। মণ্ডন তখনো সন্ন্যাস অবলম্বন করেননি। সহধর্মিণী মহাপণ্ডিতা উভয়ভারতীয় সঙ্গে একত্রে একটি আশ্রম পরিচালনা করেন। আচার্য কুমারিলের অনুজ্ঞাক্রমে তিনি স্বীকৃত হলেন তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে। বেদব্যাসের উত্তর-মীমাংসা (অদ্বৈতবাদ) বনাম জৈমিনির পূর্ব- মীমাংসা-দর্শন। কিন্তু বিচারক কে হবেন? উভয় দর্শনের উপর অধিকারী এমন পণ্ডিত কোথায় পাওয়া যাবে? যিনি এই জ্ঞানমার্গের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনায় মধ্যস্থ হতে সক্ষম? শঙ্করই এ প্রশ্নের সমাধান করে দিলেন। বলেন, আমি আপনার সহধর্মিণীর প্রগাঢ় জ্ঞানের বিষয়ে অবহিত। তিনি যদি স্বীকৃতা হন তাহলে তাঁকেই আমি বিচারক বলে মেন নেব।
উভয়ভারতী সবিনয়ে স্বীকৃতা হলেন।
শঙ্করাচার্য তখন বলেন, কিন্তু একটি শর্ত আছে, মা!
—কী শর্ত?
—বিচারান্তে যদি প্রতিষ্ঠিত হয় যে পূর্ব-মীমাংসা-দর্শনই শ্রেষ্ঠপন্থা তাহলে আমি আমার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করব—ভারতের চারপ্রান্তে চারিটি মঠ প্রতিষ্ঠিত হবে না। উপরন্তু আমি আচার্য মণ্ডন মিশ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রবেশ করব!
উভয়ভারতী প্রশ্ন করেন, আর যদি বিচারান্তে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, অদ্বৈতবাদই শ্রেষ্ঠ?
–সেক্ষেত্রে আচার্য মণ্ডন মিশ্র আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করবেন। সন্ন্যাস গ্রহণ করে এই আশ্রম ত্যাগ করে আমার অনুগামী হবেন।
মণ্ডন মিশ্র বললেন, আমি এ শর্তে স্বীকৃত।
শঙ্করাচার্য বিচারকের দিকে দৃকপাত করে বললেন : আপনি?
উভয়ভারতী বজ্রগর্ভ হয়ে উভয়ের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। এবার শুধু বললেন, শর্তারোপের অধিকার উভয় পক্ষেরই থাকে। তা গ্রহণ-বর্জনের অধিকারও থাকে প্রতিপক্ষের। বিচারকের তো কোনো ভূমিকা নাই।
শুরু হল বিচার। সভায় উপস্থিত হয়েছেন উভয় মীমাংসা-দর্শনের বহু আচার্য এবং আচার্য শঙ্করের একাধিক অনুগামী। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। ক্রমে তর্কের বিষয়বস্তু এমনই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপ পরিগ্রহ করল যে তা শ্রোতৃবর্গের অধিকার সীমা অতিক্রম করে গেল। কে জিতছেন, কে হারছেন—কেউ বুঝতে পারলেন না।
একসময়ে বিচার শেষ হল। শ্রোতৃবৃন্দের কাছে জয়-পরাজয়ের কোনো সমাধান হয়নি। আচার্য শঙ্কর বিচারকের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার আপনি বলুন মা, কোন মত জয়লাভ করেছে?
উভয়ভারতী নিমীলিত নেত্রে পদ্মাসনে উপবিষ্টা ছিলেন। অস্ফুটে বললেন, ‘অদ্বৈতবেদান্ত’ মত!
সমস্ত সভা হায়-হায় করে উঠল। সভাস্থ পণ্ডিতদের অনেকেরই গুরু হচ্ছেন আচার্য মণ্ডন মিশ্র। এ সিদ্ধান্তবলে তাঁকে তদ্দণ্ডেই সন্ন্যাসগ্রহণ করতে হবে। আশ্ৰম ত্যাগ করে আচার্য শঙ্করের অনুগামী হতে হবে।
শঙ্করাচার্য আসন ত্যাগের উপক্রম করতেই উভয়ভারতী বাধা দিলেন। বললেন, আচার্যদেব! আপনি এ আশ্রমের প্রধান আচার্য মণ্ডন মিশ্রকে অর্ধ-অংশে পরাজিত করেছেন মাত্র! আমি তাঁর অর্ধাঙ্গিনী। আমাকেও পরাজিত না করে আপনি তো বিজয়ী হতে পারেন না?
স্মিত হাসলেন আচার্য শঙ্কর। বললেন, এই কথা? তথাস্তু! আপনার সঙ্গেও আমি তর্ক বিচারে প্রস্তুত। কিন্তু কে হবেন বিচারক?
—আপনার অনুগামী সন্ন্যাসীদের মধ্যে যে কোনো একজনকে আপনি নির্বাচন করুন। আমি তাঁকেই বিচারক হিসাবে স্বীকার করে নেব।
—ভাল কথা। বিচারক নির্বাচনের অধিকার আপনি আমাকে দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে বিচার্য বিষয় নির্বাচনের অধিকার আমিই আপনাকে দিলাম। বলুন মা, কোন শাস্ত্রবিষয়ে আমাদের এই প্রতর্ক হবে?
উভয়ভারতী তৎক্ষণাৎ বলেন, মহামুনি বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্র।
আচার্য শঙ্কর প্রমাদ গণলেন। সলজ্জে বলেন, মা! আমি যে বাল্যেই সন্ন্যাস গ্রহণ করেছি। চিরব্রহ্মচারী। কামশাস্ত্র বিষয়ে আমি যে নিতান্ত অনভিজ্ঞ!
উভয়ভারতী প্রত্যুত্তর করলেন, মহাভাগ! আপনার সম্মুখে এখন তিনটি পথ উন্মুক্ত। হয় প্রমাণ করুন : মহামুনি বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্র অর্বাচীন, প্রক্ষিপ্ত; তা শাস্ত্রই নয়! অথবা আপনার স্বীকৃতি প্রত্যাহার করুন যে, আমি তর্কের জন্য ইচ্ছামতো শাস্ত্র নির্বাচন করতে পারব। তৃতীয়ত, আপনি স্বীকার করতে পারেন যে, আপনি সবশাস্ত্রবিদ্যাবিশারদ নন—অর্থাৎ স্বেচ্ছায় পরাজয় মেনে নিচ্ছেন।
রামপ্রসাদ তর্কপঞ্চাননের মতে : এরপর শঙ্করাচার্যের জীবনীতে কিছু কপোলকল্পিত অলৌকিক কাহিনির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। বলা হয়েছে এই পর্যায়ে তর্ক অসমাপ্ত রেখে আচার্য শঙ্কর একমাস সময় প্রার্থনা করেন। তারপর অমরুক নামের একজন মৃত রাজার শরীরে প্রবেশ করেন। তাকে পুনর্জীবিত করে রাজপ্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করেন। মহিষীদের সঙ্গে সহবাস করে, কামশাস্ত্রবিশারদ হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন উভয়ভারতীর আশ্রমে। উভয়ভারতী বিনাতর্কে পরাজয় স্বীকার করেন। সম্ভবত তিনি বুঝতে পারেন শঙ্কর ‘ঈশ্বরপ্রেরিত আচার্য ও যুগমানবরূপে তাঁর আবির্ভাব’।
তর্কপঞ্চাননের মতে এই উপকাহিনিটি প্রক্ষিপ্ত। পরবর্তীকালের সংযোজন। কারণ শঙ্করাচার্য আজীবন ঊর্ধ্বরেতা ব্রহ্মচারী ছিলেন এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। তদ্ভিন্ন প্রতিটি নরদেহধারী ধর্মপ্রচারক বা যুগাবতার প্রাকৃতিক নিয়ম (Cosmic Laws) বা ‘ঋতম্’কে অস্বীকার করতে পারেন না। মৃতদেহে প্রাণসঞ্চারের অধিকার কোনো নরদেহধারীর নাই!
বিদ্যালঙ্কার বলেন, তাহলে এই খণ্ডকাহিনির কী উপসংহার? এবং কোন্ সূত্রে আপনি সেই উপসংহারে আসছেন?
—বলছি। প্রথমে বলি, আমার কী বিশ্বাস। আমার মতে পরবর্তী ঘটনা এই জাতের হয়েছিল :
আদি শঙ্করাচার্য তিনটি বিকল্প পথের কোনোটিকেই স্বীকার করে নিতে পারেন না। বলতে পারেন না যে মহামুনি বাৎস্যায়নের ‘কামশাস্ত্র’ একটি প্রক্ষিপ্ত রচনা। তেমনি প্রত্যাহার করে নিতে পারেননা তাঁর প্রতিশ্রুতি : উভয়ভারতীকে বিচার্য শাস্ত্রের নির্বাচন-অধিকার দানের কথা। আর যেটি তাঁর জীবনের ব্রত—ভারতে চার-চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করে অদ্বৈত বেদান্তের প্রতিষ্ঠা—সেটিকে পরিত্যাগ করা তো আত্মহত্যা!
উভয়ভারতী বললেন, আপনি যদি অনুমতি করেন তাহলে আমি এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের সমাধান দিতে পারি-
—বলুন, মা!
—প্রথম কথা, আপনি আমার স্বামীকে তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করেছেন। ফলে, পূর্বশর্তানুসারে তিনি এই মুহূর্তেই সন্ন্যাস গ্রহণ করে আশ্রমত্যাগ করে যাবেন। দ্বিতীয় কথা : আপনি কামশাস্ত্র বিষয়ে আমার সঙ্গে প্রতর্কে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃত। যেহেতু গার্হস্থ্যধর্মের প্রামাণ্যশাস্ত্র সম্বন্ধে আপনি অনবহিত। এক্ষেত্রে আমি বলব যে, আপনি ভারত-ভূখণ্ডে আপনার ইচ্ছামতো চারটি অদ্বৈত-বেদান্তের মঠ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, কিন্তু আপনার অনুশাসন শুধুমাত্র সংসারত্যাগী দশনামী সন্ন্যাসীদের ভিতরেই প্রযোজ্য হবে। কোনো গৃহস্থের জীবন-যাপনরীতির উপর আপনাদের অনুশাসন কার্যকরী করা চলবে না।
শঙ্করাচার্য নীরবে এই সমাধান সম্বন্ধে চিন্তা করতে থাকেন।
উভয়ভারতী পুনরায় বলেন, আপনি বিবেচনা করে দেখুন মহর্ষি : আপনার সিদ্ধান্ত যদি সমগ্র ভারত নির্বিচারে গ্রহণ করে তাহলে শতাব্দীকালের মধ্যে ভারতবর্ষে মনুষ্যপ্রজাতি অবলুপ্ত হয়ে যাবে। থাকবে শুধু মনুষ্যেতর প্রাণী—শ্বাপদসঙ্কুল সে অরণ্য অনিবার্যভাবে প্রাগমানবযুগে প্রত্যাবর্তন করবে। কারণ অন্যান্য জীবনে আপনি আপনার মূল তত্ত্ব—’ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা’ এ মত গ্রহণ করাতে পারবেন না। বিবেচনা করে দেখুন, মহাভাগ! ‘ব্রহ্ম সত্য’ এ মন্ত্র আছে শুধু আপনার মননে, আপনার ধীশক্তিতে, ধ্যানে। “জগৎ’ মিথ্যাই হোক আর মায়াই হোক—সে মিথ্যা বা মায়া সৃজন করেছেন সেই ব্রহ্মই। নয় কি? এ ‘মায়া দোলা’ তাঁরই—জীবের সৃষ্ট নয়। পূর্বমীমাংসা দর্শনের চতুরাশ্রম পথেই শুধু মানবপ্রজাতি বিবর্তনপথে অগ্রসর হতে পারবে। অন্যথায় আপনার চতুরাশ্রম শতাব্দীকাল পরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে—ভবিষ্যৎ শঙ্করাচার্যের অভাবে।
শঙ্কর বললেন, আপনাকে আমি মাতৃ-সম্বোধন করেছি। এ আমার মাতৃ-অনুজ্ঞা। তাই হবে—ভারতবর্ষের চারটি প্রত্যন্তদেশে আমি আমার আশ্রম প্রতিষ্ঠা করব! মধ্যভারত থাকবে পূর্ব-মীমাংসা-দর্শনের এক্তিয়ারে।
এজন্যই সেই মহাপণ্ডিত বৃন্দাবনে বা কাশীধামে তাঁর অদ্বৈত বেদান্তের মঠ প্রতিষ্ঠা করেননি। এটাই আমার বিশ্বাস। এটাই আমার সমাধান।
বিদ্যালঙ্কার এতক্ষণে বলেন, আপনি আমাকে কী আদেশ দিচ্ছেন?
—হয় আমার এ মতকে খণ্ডন করে দেখাও : কী হেতুতে আদি শঙ্করাচার্য বৃন্দাবনে বা কাশীধামে তাঁর মঠ প্রতিষ্ঠা করেননি। কেন তিনি ‘আদি-বরাহ’কে পর্যন্ত মঠের মূল দেবতা হিসাবে স্বীকার করেছেন? তদানীন্তন ভারতের সর্বাধিক ভক্তের উপাস্য ‘শিবপার্বতী’ এবং ‘রাধাকৃষ্ণ’কে কেন পরিহার করেছিলেন। কিংবা স্বীকার করে নাও—বৃন্দাবন বা কাশীধামে অদ্বৈত বেদান্তের মঠ প্রতিষ্ঠা না করে আদি শঙ্করাচার্য কিছু ভুল করেছিলেন, যে ভুল যোশীমঠের বর্তমান শঙ্করাচার্য সংশোধন-মানসে কাশীনরেশের নিকট কিছু ভূখণ্ড দাবি করেছেন।
নতমস্তকে হটী বিদ্যালঙ্কার অনেকক্ষণ চিন্তা করে অবশেষে বললেন, আমি আপনার সিদ্ধান্ত সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করছি আচার্যদেব।
—কিন্তু যোশীমঠের শঙ্করাচার্য একজন সম্মানীয় সন্ন্যাসী। তাঁকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা অসৌজন্যমূলক এবং অভদ্রতা হবে। তাই আমাদের ইচ্ছা তাঁকে কাশীধামে আমন্ত্রণ করা। কোনো তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে নয়। ঘরোয়া আলোচনায়। যে প্রশ্নগুলি আমি এতক্ষণ পেশ করেছি সেগুলিই আমরা রাখব তাঁর সম্মুখে। তিনি আমাদের বুঝিয়ে বলবেন—কী কারণে সহস্র বৎসর পূর্বে আদি শঙ্করাচার্য ভারতের চতুষ্প্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হয়েছিলেন। কেন অদ্বৈত বেদান্তের মঠের অনুশাসন শুধুমাত্র দশনামী সন্ন্যাসীদের মধ্যেই সীমিত। গৃহীদের ভিতর নয়।
—আমার মনে হয় আপনি যা বললেন, সেটাই সবচেয়ে ভালো হবে।
—সেক্ষেত্রে কাশীধামের পণ্ডিতসমাজ যদি তোমাকেই সে দায়িত্ব প্রদান করতে চায় তাতে তোমার কীসের অপত্তি?
বিদ্যালঙ্কার ইতস্তত করে বলেন : আমি কেন? আমি তো ইদানীং কোনো তর্কসভায় যোগদান করি না।
—আমি জানি। ধরে নাও এটা আমার ইচ্ছা।
—আপনার ইচ্ছাই’ যে আমার কাছে ‘আদেশ’।
—তুমি তো কোনো তর্কে অবতীর্ণ হচ্ছ না। এটা তর্কসভা নয়।
নতমস্তকে বিদ্যালঙ্কার বলেন, তাই হবে, বাবা।
বৃদ্ধ হেসে বলেন,-বিদ্যার্ণব তোকে ‘বিদালঙ্কার’ উপাধি দিয়েছিল। সেটাও তার ভুল হয়েছিল। তোর উপাধি হওয়া উচিত : ‘উভয়ভারতী!’
*
প্রাককথন
সপ্তদশ শতকে এক প্রজন্মের ব্যবধানে আবির্ভূত হয়েছিলেন বাঙলার দুই বিদুষী—হটু ও হটি বিদ্যালঙ্কার। এঁদের জীবনের নির্যাসেই সৃষ্ট লেখকের মানসকন্যা ‘রূপমঞ্জরী। বর্ধমান জেলার সোঞাই গ্রামের ভেষগাচার্য রূপেন্দ্রনাথ ও কুসুমমঞ্জরীর ঘরে জন্ম তাঁর। পূর্বসূরী রূপেন্দ্র ও কুসুমমঞ্জরীর জীবনের গল্প নিয়েই প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড
শেষখণ্ডের (ধারাবাহিক নবকল্লোল ১৪১১, বৈশাখ-ফাল্গুন সংখ্যা) লেখায় দেখতে পাই মাতৃহীন রূপমঞ্জরী রূপেন্দ্রের সাহচর্যে বড় হচ্ছেন। বেদজ্ঞ পিতৃদেব রূপেন্দ্রের গৃহে আসে নানান বিদ্যার্থী, জমিদারপুত্র শুভপ্রসন্নও। রূপমঞ্জরীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব এবং ক্রমে প্রেমের প্রথম মুকুল অঙ্কুরেই নিষ্পেষিত হয়। কারণ ভিন্ন শ্রেণীর পরিণয় সমাজসিদ্ধ নয়। জমিদার তারাপ্রসন্ন ভাদুড়ী বন্দ্যোবাড়ুয্যে রূপেন্দ্রের কন্যাদান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
অভিমানাহত শুভপ্রসন্ন গৃহত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হন। রূপমঞ্জরীর বিবাহ হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামের সৌম্যসুন্দরের সঙ্গে। নব বরবধূ পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত হয়, কিন্তু এক অত্যাশ্চর্য দুর্ঘটনায় সৌম্যসুন্দরের অকালমৃত্যু ঘটে।
শ্বশুরালয় থেকে বরকন্দাজ আসে সালঙ্কারা রূপমঞ্জরীকে তুলে নিয়ে যেতে। সে যে এখন তাদের সম্পত্তি। সহমরণের পুণ্যব্রত থেকে তো বধূকে বঞ্চিত করা চলে না!
মূর্ছিতা রূপমঞ্জরী ও প্রস্তরবৎ পিতা রূপেন্দ্রকে অবশেষে রক্ষা করে জল-অচল, কৃতজ্ঞ লাঠিয়ালের দল।
গল্পের অধিক বিস্তার নিষ্প্রয়োজন। শেষ সংখ্যায় দেখছি রূপমঞ্জরী কাশীর পণ্ডিতমহলে সুপ্রতিষ্ঠিতা। ‘বিদ্যালঙ্কার’ উপাধিতে সম্মানিতা।
এখন যোশীমঠের এক মহাপণ্ডিত সন্ন্যাসী কাশীধামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠায় ইচ্ছুক হন যা উপস্থিত ‘কাশীর পণ্ডিতসমাজের সম্মতিসাপেক্ষ। তাঁরা বিদ্যালঙ্কারের প্রতি এ দায়িত্ব অর্পণ করেন ও তর্কযুদ্ধে তাঁদের প্রতিভূ নিযুক্ত করেন।
বিদ্যালঙ্কার ইতস্তত করে বলেন-আমি কেন? আমি তো ইদানীং কোনো তর্কসভায় যোগদান করি না।
—আমি জানি, ধরে নাও এটা আমাদের ইচ্ছা।
নতমস্তকে বিদ্যালঙ্কার বলেন, তাই হবে বাবা।
বৃদ্ধ (তর্কপঞ্চানন) হেসে বলেন, বিদ্যার্ণব তোকে ‘বিদ্যালঙ্কার’ উপাধি দিয়েছিল, সেটাও তার ভুল হয়েছিল। তোর উপাধি হওয়া উচিত ‘উভয়ভারতী!