কালবেলা – ১ (মাসুদ রানা)

এক

ক্লিফডেন, আয়ারল্যাণ্ড।

আঠারো শ’ ছিচল্লিশ সালের মে মাসের সাতাশ তারিখ।

সাগরের নোনা হাওয়ার তোড়ে ভাসতে ভাসতে বিদায় নিয়ে চলে গেছে কালো মেঘের ভেলা। দুপুরে নীল আকাশে ঝলমল করছে সূর্য। সোনালি রোদে চিকচিক করছে বৃষ্টিস্নাত সবুজ ফসলের মাঠ। দু’দিকের কাঠের বেড়ার মাঝে সরু পথে এগিয়ে চলেছে দুই অশ্বারোহী। আশপাশে কেউ নেই, নইলে হয়তো বুঝতে পারত এরা গ্রামের মানুষ নয়।

প্রথমজনের কাঁধ খুব চওড়া, বয়স হবে বড়জোর পঁচিশ চেপেছে বিশাল এক বাদামি স্ট্যালিয়নের পিঠে। দখলদার ইংরেজদের আইন অনুযায়ী এমন তাগড়া ঘোড়া কিনে নিতে পারবে না ক্যাথোলিক আইরিশেরা, কারণ তাদেরকে ব্যয় করার জন্যে অধিকার দেয়া হয়েছে মাত্র পাঁচ পাউণ্ড।

যুবকের সঙ্গী খর্বকায় ও বয়স্ক, চোখে গোল আইগ্লাস পথচলায় খুব অনভ্যস্ত। চরম অস্বস্তি বোধ করছে ঘোড়ায় চেপে। কেউ তাকে দেখলে হয়তো ভেবে নেবে, এ-লোক বোধহয় ইংল্যাণ্ডের অভিজাত কোন স্কুলের প্রধান-শিক্ষক।

ফেলে আসা পথে এদেরকে যারা দেখেছে, তাদের জানার কথা নয়, ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর এক গোপন পরিকল্পনা নিয়ে এখানে এসেছে এরা। গত কয়েক বছর ধরে জটিল গবেষণা শেষ করে এবার সেটার ফলাফল প্রয়োগ করবে এ-দেশে।

পরস্পরের পরিচিত হলেও নীরবে এগিয়ে চলেছে তারা। স্যাডলে বসে কোমর ধরে গেছে প্রৌঢ়ের। একটু পর পর কোট থেকে বের করে দেখে নিচ্ছে ঘড়ি। মনের ভেতরে কাজ করছে সুগভীর এক ভয়: কেউ না কেউ পিছু নিয়েছে! কথা বলতে গিয়েও সেটা গিলে নিচ্ছে সে। বারবার করে ভাবছে: ‘অ্যাঙ্গাস, আমার খুব খারাপ লাগছে। আমরা বোধহয় মস্তবড় এক পাপে জড়িয়ে গেছি!’

যদিও প্রৌঢ় কিছু বললেই মুখের ওপরে হেসে যুবক বলে দেবে: আপনি তো সব বুঝেই নেমেছেন! এখন পিছিয়ে গেলে হবে?

জীর্ণ বেড়ার গায়ে চওড়া এক গেটের সামনে থেমে চট্‌ করে এদিক-ওদিক দেখে নিল যুবক। নিচু স্বরে বলল, ‘তা হলে কাজটা এখানেই সেরে নিই।’

ঘোড়া থেকে নেমে পড়ল তারা। বেড়ার সঙ্গে দড়ি বেঁধে দেয়ায় তাজা ঘাসে মুখ ডোবাল ঘোড়াদুটো। স্ট্যালিয়নের স্যাডল ব্যাগ খুলে কাপড় দিয়ে মোড়ানো লম্বাটে এক কাঠের বাক্স নিল যুবক। ওটা ধরিয়ে দিল প্রৌঢ়ের হাতে। চোরের মত চারপাশে তাকাল তারা। গেট টপকে ফসলের মাঠে নেমে পড়ল যুবক। হাত বাড়িয়ে সঙ্গীর কাছ থেকে বুঝে নিল কাঠের বাক্স। প্রৌঢ় ভাবতে শুরু করেছে: ‘বড্ড ভুল করেছি! এখন আর কিছুই করার নেই!’ সাবধানে গেট ডিঙিয়ে খেতের- ভেতরে নেমে এল সে।

কাপড় দিয়ে মোড়ানো কাঠের বাক্স ডানহাতে নিয়ে হেঁটে চলেছে যুবক। চারপাশে গাঢ় সবুজ পাতার অসংখ্য ছোট গাছ। আইরিশ গরীব বর্গাচাষীরা বলে: এসব অলস বিছানা। এ-দেশে যেদিকে চোখ যাবে, বেশিরভাগ খেতে এই একই গাছ। সরু শাখায় কালচে-সবুজ পাতা, খুদে বেগুনি ফুল।

খেতের মাঝে গিয়ে থমকে দাঁড়াল যুবক ও তার সঙ্গী। হাঁটতে গিয়ে হাঁফ লেগে গেছে প্রৌঢ়ের। পথে কাউকে না দেখে স্বস্তি বোধ করছে যুবক। সাগরের ঢেউয়ের মৃদু স্ শব্দ ছাড়া চারপাশে আর কোন আওয়াজ নেই।

‘ঠিক আছে, এবার কাজটা শেষ করি,’ বলল যুবক।

দেরি না করে ফসলের মাঠে বসে পড়ল তারা। এখন আর পথ থেকে তাদেরকে দেখতে পাবে না কেউ। ওপরের কাপড় সরিয়ে সাবধানে মাটিতে বাক্সটা রাখল যুবক। ওটার ঢাকনি খুলে নিতেই পাশ থেকে প্রৌঢ় দেখতে পেল, ভেতরে লাল ভেলভেটের খোপে কয়েক সারিতে আছে কাঁচের ছোট কিছু বোতল। প্রতিটির ভেতরে আছে কয়েক ফোঁটা বাদামি তরল।

যাতে ভেঙে না যায়, তাই সতর্ক হাতে ভেলভেটের খোপ থেকে সরু এক শিশি নিল যুবক। খুলল ওটার মুখের কর্ক। নাক থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে শিশি। আঠাল তরল থেকে ভেসে আসছে ভয়ানক বিশ্রী এক দুর্গন্ধ।

ভুরু কুঁচকে ওদিকে চেয়ে রইল প্রৌঢ়।

যুবকটি শিশির ভেতরের তরল একটা গাছের গোড়ায় ঢেলে দিতেই, কয়েক সেকেণ্ডে সেটা শুষে নিল বৃষ্টিভেজা মাটি।

আপাতত শেষ হয়েছে তাদের কাজ। কর্ক এঁটে বাক্সের ভেতরে শিশি রেখে দিল যুবক। ঢাকনি বন্ধ করে কাপড়ে মুড়িয়ে নিল বাক্স। গাছগুলোর দিকে তাকাল সন্তুষ্টির চোখে। ওদিকে তিক্ত হয়ে গেছে প্রৌঢ়ের মন। যুবক পথের দিকে এগোতেই আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল সে। চোখ সরাতে পারল না ভেজা মাটি থেকে। একটু আগে ওখানে ঢেলে দেয়া হয়েছে আঠাল সেই তরল।’

এবার কী ঘটবে, সেটা ভেবে দরদর করে ঘামতে লাগল প্রৌঢ়। দুপুরের তপ্ত রোদেও শিরশির করছে তার মেরুদণ্ড। থরথর করে কাঁপছে দু’হাত। বিড়বিড় করে বলল প্রৌঢ়, ‘তো শুরু হলো! অ্যাঙ্গাস, প্রার্থনা করো, আমাদেরকে যেন ক্ষমা করে দেন ঈশ্বর!’

‘আপনি বেশি কথা বলেন, আর্চিবল্ড,’ বলল যুবক, ‘ফিরে চলুন। এখনও বহু কাজ বাকি রয়ে গেছে।’

নীরবে নড়বড়ে গেটের দিকে হেঁটে চলল তারা।

দুই

‘বর্তমান সময়। ফ্রান্সের নরম্যাণ্ডি।

উপকূলীয় বনভূমি ঘেঁষে রানা এজেন্সির দোতলা দালান। বছর চারেক আগেও ব্যস্ত ছিল ওটার নিচতলার ঘরগুলো। অবশ্য এখন কিচেন ছাড়া সব দরজাই থাকে তালাবদ্ধ। করোনাকালীন সময় দেশে ফিরে গেছে এজেন্সির ছেলে- মেয়েরা। এদিকে বিসিআই চিফের অনুমতি ছিল না বলে ইউরোপে রয়ে যেতে হয়েছে মাসুদ রানাকে। মহামারির প্রকোপ হ্রাস পেলেও রাশা ও ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্যে গোটা দুনিয়া জুড়ে এখন চলছে ভয়ঙ্কর মন্দা। বড়সব কোম্পানি চাকরি থেকে ছাঁটাই করছে হাজারে হাজারে কর্মকর্তা ও কর্মচারী। যথেষ্ট টাকা নেই এখন সাধারণ মানুষের হাতে। ফলে দিনের পর দিন ক্লায়েন্টের দেখা নেই রানা এজেন্সিতে নতুন করে চালু করা যায়নি বেশিরভাগ শাখা। আবারও অফিস খুলতে পারলে নরম্যান্ডির শাখার চিফ হিসেবে যোগ দেবে রানার বন্ধু, তুখোড় গোয়েন্দা জনি ওয়াকার। গত ক’মাস আগে দেশে ফিরতে শেষ অপারেটিভ রামিন রেজা।

মাঝে দু’মাস বাদ দিলে প্রায় বছর চারেক হলো নরম্যাণ্ডির শাখার ওপরতলার ছোট্ট এক ফ্ল্যাটে বাস করছে রানা। এখন মর্গে গাঢ় কালো কফি হাতে নিয়ে বসে আছে লিভিংরুমের সোফায়। বিসিআই-এর দুর্দান্ত এক ভয়ঙ্কর অ্যাসাইনমেন্টের কথা ভেবে ওর বুক চিরে বেরোল কাঁপা দীর্ঘশ্বাস। ভাবল: হেমন্তে যেভাবে গাছ থেকে খসে পড়ে শুকনো সব পাতা, তেমনি করে ও জীবন থেকেও চলে যাচ্ছে এক এক করে দিনগুলো, বদলে তারী হচ্ছে দুঃসহ অবহেলার স্মৃতির আবর্জনা। আনমনে মাথা নাড়ল রানা। নিজেকে মনে মনে জিজ্ঞেস করল: আর কখনও কি ফিরবে চমৎকার শ্বাসরুদ্ধকর সে-দিনগুলো?

ক্রিং ক্রিং শব্দে ল্যাণ্ডফোন বেজে উঠতেই কফির মগ বামহাতে নিয়ে ডানহাতে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল বিমর্ষ রানা। ‘হ্যালো, মাসুদ রানা বলছি।’

‘রানা, তুই কি জেনেবুঝে এসব করছিস?’

প্রিয় বন্ধু সৈাহেলের কথা শুনে জবাব দিতে গিয়ে একটু থমকে গেল রানা। তারপর হালকা সুরে বলল, ‘কেন রে, ডাক্তারের চূড়ান্ত রিপোর্ট হাতে পেয়ে খুব রেগে গেছেন বস?’

চুপ করে আছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স-এর চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সোহেল আহমেদ। বন্ধুর চাপা দীর্ঘশ্বাস শুনে কৈফিয়তের সুরে রানা বলল, ‘আসলে বছরের পর বছর কোন কাজ নেই! এদিকে ফেরারও অনুমতি নেই…’ মিইয়ে গেল ওর কণ্ঠ।

‘ভাল করেই জানি, বাংলাদেশকে কতটা ভালবাসিস তুই,’ বলল সোহেল, ‘কিন্তু, সেজন্যে তোর তো উচিত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে নিজেকে তৈরি রাখা।’

বন্ধুর অনুযোগ শুনে দ্বিধাহীনভাবে বলল রানা, ‘আমি তো লড়াইয়ের জন্যে তৈরিই ছিলাম, রে! কিন্তু বস মানা করে দিলেন দেশে ফিরতে। তাই করোনাকালীন দুর্যোগের সময়ে চাইলেও মিলিটারি, বিজিবি, পুলিশ বা আনসারদের পাশে থাকতে পারিনি।’

‘তুই কিন্তু কথা বলছিস আবেগ থেকে,’ বলল সোহেল। ‘ভাল করেই জানিস, দেশের বিরুদ্ধে কোথাও কোন ষড়যন্ত্র হলে যে-কোন সময়ে তোর ডাক পড়ত। আর হঠাৎ করে বিপদ হবে না সেটা বলতে পারে না কেউ। তাই বস তোকে বলেছিলেন ইউরোপে রয়ে যেতে।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘সাত মাস আগে ছিলি বিশ্বের পাঁচ দুর্ধর্ষ গুপ্তচরের একজন,’ বলল সোহেল। ‘অনেকে বলত তুই-ই সেরা। অথচ, এখন হয়ে গেছিস গভীর সাগরের শামুকের মত স্লো। একটা মেয়ে যতই সুন্দরী হোক; যতই তার এক শ’ রকমের গুণ থাকুক, তাকে না পেলে নিজেকে শেষ করে দিবি তুই?

কফির মগে চুমুক দিয়ে রানার মনের পর্দায় ভাসল মস্ত ঘরের পেছনে সেক্রেটারিয়াল টেবিল। চেয়ারে পিঠ টান করে বাঘের মত বসে আছেন মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। কুঁচকে গেছে তাঁর কাঁচা-পাকা ভুরু। হাভানা চুরুটের আঁকাবাঁকা নীলচে ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে ছাতের দিকে। কঠোর চোখে ওকে দেখছেন তিনি।

‘জেসিকা আর আমার ব্যাপারে সবই জেনে গেছেন বুড়ো, না রে, সোহেল?’ আনমনে ঢোক গিলল রানা।

‘তোর ডাক্তারি পরীক্ষার ফলাফল জেনে জেনিকা আর ওর নতুন প্রেমিক-কাম-স্বামীর ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন আমরাও বুঝেছি, মেয়েটার করা অপমানটা ছিল তোর জন্যে খুব আকস্মিক। তবে তুই তো আমাদেরকে আগেই সব বলতে পারতি। আমরা দেখতাম কী করা যায়। অন্তত তোর পাশে তো থাকতে পারতাম!’

তিক্ত হাসল রানা। ‘সারপ্রাইয দেব বলে কিছুই বলিনি। বিয়ের একসপ্তাহ আগে তোদের জন্যে পাঠিয়ে দিতাম বিমানের টিকেট। সেসব কিনেও ফেলেছিলাম।’

বিয়ের বিষয়ে পরে রানার কাছ থেকে সবই জেনে নিয়েছে সোহেল। রানাকে বিয়ে করতে নিজেই ব্যস্ত হয়ে ওঠে জেসিকা থমসন। বিয়ের দেড়সপ্তাহ আগে স্কটল্যাণ্ডে তার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল রানার। কিন্তু যেদিন রওনা হবে, সেই সকালে এল একটি ই-মেইল। তাতে জেসিকা লিখেছে: ‘আমি সত্যিই দুঃখিত, রানা। আমাদের অনুচিত হবে হুট করে বিয়ে করা। একটু দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছি, তোমার প্রতি যে অদ্ভুত আকর্ষণ আমার মনে ছিল, ওটা আসলে স্রেফ সাময়িক মোহ। এ-ও জেনেছি, কখনও তোমাকে অন্তর থেকে ভালবাসিনি। আর সেটা আরও বেশি করে বুঝেছি হ্যারি ও’রাইলির সঙ্গে পরিচয় হওয়ায়।

‘দু’মাস আগে আমাদের পুলিশ স্টেশনে যোগ দিয়েছে ও। ওর সঙ্গে সময় কাটিয়ে এটা বুঝেছি, স্বামী হিসেবে কাউকে গ্রহণ করতে হলে, আমার উচিত হবে ওকেই বিয়ে করা। তোমার আর আমার বিয়ে হলে আমরা কেউই সুখী হতাম না। তুমি যেমন পারতে না স্কটল্যাণ্ডের সমাজে মিশে যেতে, তেমনি তোমাদের দেশে গিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়াও আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। আমরা আসলে একেবারেই আলাদা দুই সমাজের মানুষ।

‘তাই এটাই কি ভাল হলো না, আজ থেকে আলাদা হচ্ছে আমাদের দু’জনের দুই পথ?

‘রানা, পারলে ক্ষমা করে দিয়ো আমাকে।

‘চিরকাল তোমাকে সত্যিকারের ভাল একজন বন্ধু বলেই জানব। আশা করি এই মেসেজ পাওয়ার পর কষ্ট করে আর স্কটল্যাণ্ডে আসবে না।

‘আজকেই দুপুরে গ্রামের চার্চে হ্যারি ও তাহার বিয়ে। আবারও অনুরোধ করছি: আমায় ক্ষমা কোরো। চিরকাল তোমার বান্ধবী জেসিকা হয়েই থাকতে চাই।

‘অ্যাটাচমেন্টে হ্যারি ও আমার ছবি দিলাম। তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে, দুনিয়ায় হ্যারি আর আমি এনেছি স্রেফ পরস্পরের জন্যে।

‘অনেক ভাল থেকো, রানা।’

জেসিকার চিঠিটা পড়ে প্রিয় বন্ধু রানার অপমানের মাত্রা বুঝে তিক্ত হয়ে গিয়েছিল সোহেলের অন্তর। রানা আর স্কটল্যাণ্ডে যায়নি। যোগাযোগও করেনি মেয়েটার সঙ্গে। নরম্যাণ্ডির রানা এজেন্সির অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে লণ্ডনে। কিন্তু সেখানেও ছিল না কোন কাজ। আর তখন থেকেই পদে পদে নিজেকে অবহেলা করেছে রানা। হাতে কাজ নেই বলে বেঁচে থাকার সামান্য আগ্রহটাও হারিয়ে ফেলেছে।

‘আমি তোকে খুব ভাল করে চিনি, রানা। জেসিকার জন্যে নয়, ভাল কোন অ্যাসাইনমেন্ট না পেয়ে হতাশ হয়ে গেছিস তুই। ডাক্তাররা তাঁদের রিপোর্টে জানিয়ে দিয়েছেন, গত ছয়মাস ব্যায়াম না করে, নানান অনিয়মের মাধ্যমে নিজেকে ক্ষয় করে দিয়েছিস।’

চুপ করে থাকল রানা।

‘আগেও দু’একবার আনফিট হয়েছিস, বলল সোহেল, ভেবে দেখ ইতালির কথা। মাফিয়া বেজন্মা কুকুরগুলো কিশোরী মেয়ে লুবনাকে ধর্ষণের পর খুন করলে, প্রতিশোধ নিতে নতুন করে গড়ে নিয়েছিলি নিজেকে। পরের কাহিনী গোটা দুনিয়া জানে। আগেও কঠোর পরিশ্রম করে প্রমাণ করে দিয়েছিস, তুই যোগ্যদের চেয়েও অনেক যোগ্য। অবশ্য ডাক্তারেরা এবার তোর শারীরিক ও মানসিক যে রিপোর্ট চিফের হাতে তুলে দিয়েছেন, তাতে হতবাক হয়ে গেছেন তিনি।’

কফির মগে চুমুক দিল রানা। মুখে কোন রা নেই।

‘ডাক্তারেরা বলেছেন তোর দৈহিক ও মানসিক কণ্ডিশন খুব খারাপ। আর সেজন্যেই বাধ্য হয়ে তোকে পুরো একবছরের জন্যে ছুটি দিয়েছেন চিফ। আমাকে বলেছেন, রানাকে বলবে, আগামী বছর সেপ্টেম্বর মাসের ভেতরে কমপ্লিটলি রিকভার না করলে ‘ওকে অবশ্যই যেতে হবে অবসরে।’’

‘তুই আসলে আমাকে কী করতে বলিস, সোহেল? বেসুরো স্বরে বলল রানা। কাজ নেই বলে দিনের পর দিন অলস জীবন পার করেছি। তুই কি আমাকে শুধু বাঁচার জন্যে বাঁচতে বলিস?’

‘তুই বরং এক কাজ কর, প্যারিসে যা,’ বলল সোহেল। কথাটা শুনে তিক্ত হাসল রানা। ‘ওখানে গিয়ে কী হবে?’

‘সৈয়দ আলী জাকিরের কথা তোর মনে আছে? ওই যে, হালকা-পাতলা লোকটা? আমাদের এজেন্টরা ইউরোপে কোন বিপদে পড়লে দরকারি কাগজপত্র বা যন্ত্রপাতি ওর কাছে পৌঁছে দিয়ে উধাও হতো? আর পরে জাকিরের কাছ থেকে সব আমরা সংগ্রহ করে নিতাম?’

‘হ্যাঁ, চিনি। হাসিখুশি মানুষ। অন্তর থেকে আমাদের দেশটাকে ভালবাসে।’

‘ঠিকই বলেছিস। আর সেই সৈয়দ আলী জাকির এখন আছে মস্ত বিপদে।’

‘খুলে বল, কী ধরনের বিপদে পড়েছে সে।’

‘প্যারিসে তোর অ্যাপার্টমেন্টের কাছেই ওর দোকান।’

‘হ্যাঁ, মনে আছে।’

‘ওখানে গেলেই বুঝবি, গোটা এলাকা দখল করে নিয়েছে একদল রোমানিয়ান মস্তান। যেহেতু সে-এলাকায় ভিনদেশিরা সংখ্যায় বেশি, তাই তাদের কাছ থেকে নালিশ গেলেও রোমানিয়ানদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ খেয়ে মোটেও গা করছে না প্যারিসের পুলিশ। সৈয়দ জাকিরকে হুমকি দিয়েছে রোমানিয়ানেরা। দোকান চালু রাখতে হলে প্রতিমাসে তাদেরকে দিতে হবে দু’হাজার ইউরো। শুধু তা-ই নয়, দোকান ছেড়ে পালিয়ে গেলেও ধরে এনে ওর মাথা ফাটাবে তারা। তখন একলাখ ইউরো না পেলে ওর বউ আর মেয়েটাকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে গুম করবে লাশ। এদিকে আপাতত ফ্রান্সে তুই ছাড়া বিসিআই এজেণ্ট বলতে কেউ নেই। এবার আমার কথা বুঝলি, রানা? এ-বিপদে জাকিরকে সাহায্য করতে পারবে না বিসিআই। যেটা তুই চাইলে হয়তো পারবি। আমরা জানি, তুই ডাক্তারী রিপোর্ট অনুযায়ী টোটালি আনফিট। কিন্তু একটু আগে বা বললেন, তুই যদি পারিস, তো সৈয়দ আলী, জাকিরের পাশে যেন দাঁড়াস।’

প্রথম পরিচয়ে ইলিশ পোলাও খাওয়াবে বলে রানাকে জোর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল নিরীহ বাঙালি দোকানি। জাকিরের পিচ্চি মেয়েটার মিষ্টি মুখটা ভেসে উঠল রানার চোখের তারায়। লাজুক মেয়ে সীমা শাহানা। দেখতে হয়েছে বাবার মত। ঝুপ করে বসে পা ছুঁয়ে সালাম করেছিল রানাকে। নিজেই লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল রানা। হেসে ফেলে বলেছিল, ‘আরে, আমি তো এত বুড়ো নই যে পা ধরে ‘সালাম করতে হবে!’ পিচ্চির হাতে দিয়েছিল বড় একবাক্স কিটক্যাট চকোলেট।

রাতের খাবারের পর চকোলেটের চারভাগের একভাগ আবার আদর করে ওকেই খাইয়ে দিয়েছিল সীমা। ওর সহজ কথা: ‘তুমি চকোলেটের ভাগ পাবে না, তা-ই কি হয়? আমরা তো এখন বাড়িতে চারজন। তাই সবাই সমান ভাগে ভাগ করে নেব।’

সোহেলের কথায় বাস্তবে ফিরে এল রানা।

শোন, জাকিরের কাছ থেকে জেনেছি, আজ শেষবারের মত বিকেলে রোমানিয়ানেরা ওর কাছ থেকে টাকা নিতে আসবে। যেহেতু ওর কাছে দেয়ার মত টাকা নেই, তাই এবার কী হবে সেটা তো বুঝতেই পারছিস। পিটিয়ে ওর হাড়গোড় ভাঙবে তারা। বাকি জীবনের জন্যে পঙ্গু হবে জাকির। আর এরপর ওর বউ-বাচ্চা…

‘সোহেল, তুই ভাবিস না, আজ দুপুরের আগেই পৌঁছে যাব প্যারিসে, শুকনো গলায় বলল রানা। বুকের ভেতরে উথলে উঠেছে অভিমান। ‘আমাকে তো চিরকালের জন্যে বিদায় করেই দিলেন বস। এখন থেকে তো আর আমাকে কোন দায়িত্ব দেয়া হবে না। আর একটা কাজ এবার হাতে পেলাম।’

‘দেখ, রানা, দোস্ত, ছুটিতে নিজেকে গুছিয়ে নে,’ মিনতির সুরে বলল সোহেল। ‘জানি, তুই পারবি। মনে রাখিস, তুই একা নস্। কোন বিপদ হলে বলবি। আমরা বেঁচে থাকলে ঠিকই হাজির হব।’

‘তা জানি, দোস্ত,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা।

‘জাকিরের বিপদ কেটে গেলে কোথায় যাবি ভাবছিস তুই?’

ক’বছর আগে আয়ারল্যাণ্ডে চাচার বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি,’ বলল রানা।

‘মনে আছে,’ সায় দিল সোহেল, ‘সে-টাকা জমা দিয়েছিস বিসিআই-এর প্রভিডেন্ট ফাণ্ডে। যাতে অবসর নেয়ার পর বয়স্ক কর্মচারীদেরকে দেয়া যায় বড় অঙ্কের টাকা।’

‘কিছুদিন ধরে খুব মনে পড়ছে বাড়িটার কথা। কৈশোরে বাবা-মা-চাচা-ফুফুসহ ক’বার ওখানে থেকেছি। যদি সুযোগ হয়, আরেকবার ঘুরে আসব ওদিক থেকে।’

‘ঠিক আছে, বলল সোহেল, ‘তবে যেখানেই যাস্, নিজের যত্ন নিবি। বন্ধ করবি বেসামাল, অনিয়ম। আমরা তোর জন্যে খুব দুশ্চিন্তায় আছি রে, দোস্ত। চাই না আমাদের প্রিয় সুপার হিরো চিরকালের জন্যে বিস্মৃত হোক বিসিআই থেকে।’ চুপ হয়ে গেল সোহেল। ক’সেকেণ্ড পর বলল, ‘আরেকটা কথা, রানা, এবার কিন্তু খুব মন দিয়ে শুনবি। আমাদের বুড়ো আমাকে গম্ভীর চোখে দেখে নিয়ে আজ বলেছেন: ‘জীবনের সেরা সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেলে, মনে করি না যে আমার আর বিসিআই-এ রয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন আছে। কাজেই কিছু দিনের ভেতরে আমি বোধহয় অবসর নেব।’’

সোহেলের কথা তীরের মত বিঁধেছে রানার বুকে। ওর বন্ধু জানল না, রিসিভারের দিকে চেয়ে বিসিআই-এর সেরা এজেন্টের দুই চোখ বেয়ে নেমেছে অশ্রু।

‘তুই ভাল করেই জানিস তোকে কতটা ভালবাসেন বস, বলল সোহেল। ‘মানুষটা হয়তো সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছেন। তাঁকে এত কষ্ট দিসনে, রানা। ভাল থাকিস, দোস্ত।’

ফোনের লাইন কেটে যেতেই কফির মগ টেবিলে নামিয়ে রাখল রানা। একবার দেখল হাতঘড়ি।

সৈয়দ আলী জাকিরের পাশে থাকতে হলে দুপুরের আগেই ওকে পৌঁছে যেতে হবে প্যারিসে।

তিন

পুরনো সীসার মত কালো হয়ে গেছে প্যারিসের আকাশ। বিষণ্ণ বিকেলে থেমে থেমে ঝরছে টিপটিপ ইলশে-গুঁড়ি। নিজের ফ্ল্যাট থেকে কয়েক শ’ গজ দূরে পথের ধারে টয়োটা ফোররানার টিআরডি অফ-রোড প্রিমিয়াম গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে রানা। আপাতত আর কেউ নেই রাজপথে। ফুটপাথে কী যেন খুঁটে খাচ্ছে শত শত সাদা-কালো কবুতর।

যে-কোন সময়ে জাকিরের সঙ্গে দেখা করতে দোকানে আসবে রোমানিয়ানেরা। এবং তারা হাজির হবে বলেই আগেভাগে দোকানির সঙ্গে ফোনে আলাপ করে নিয়েছে রানা। মনে মনে শপথ করেছে: ‘মস্তাননেতা অ্যালেকয্যাণ্ড্রুকে এক পয়সাও আপনার দিতে হবে না, জাকির।

পাঁচ মিনিট পর দূরের বাঁক ঘুরে এল ধূসর এক পুরনো মার্সিডিয বেনয্। কড়া ব্রেক কষে থামল জাকিরের গ্রোসারি দোকানের সামনে। বিশ গজ দূরে টয়োটা ফোররানার টিআরডি অফ-রোড প্রিমিয়ামের ড্রাইভিং সিট থেকে অপলক চোখে চেয়ে রইল রানা। ধুপ্ শব্দে খুলে গেছে মার্সিডিযের দরজা। গাড়ি থেকে নেমে সশব্দে দরজা বন্ধ করল দু’জন যুবক। ফুটপাথে উঠে কঠোর চোখে দেখে নিল চারপাশ।

রানা বুঝে গেল, এরা রোমানিয়ান দলের মস্তান। বয়স। পঁচিশ থেকে সাতাশ। একজনের মাথার চুল কালো। রোদে পোড়া কালচে চেহারা। পূর্বপুরুষ জিপসি। অন্যজনের শিরায় আছে স্লাভিক রক্ত। ঘোড়ার মত লম্বাটে মুখ। মাথার চুল সোনালি। দু’জাতির মানুষ না হলে যে-কেউ ভাবত, একই বাবার ঔরসে জন্ম নিয়েছে এরা। দৈর্ঘ্যে হবে সাড়ে ছয় ফুট। ভারী শরীর। চেহারা জানিয়ে দিচ্ছে, ছোটবেলা থেকে চুরি করতে করতে এখন তারা হয়ে গেছে ডাকাত। পরনে কালো চামড়ার জ্যাকেট ও নীল জিন্স। পায়ে বিশাল বুট। আরেকটু বড় হলে নূহ নবীর নৌকার সাইযের বলে ধরে নিত রানা।

গটমট শব্দে জাকিরের দোকানে গিয়ে ঢুকল তারা।

অ্যালেকয্যাণ্ড্রুর চ্যালারা বেধড়কভাবে পেটাবে জাকিরকে ভাঙচুর করবে দোকান। জাকিরের হাত-পা ভেঙে রক্তারক্তি করে বিদায় নেবে। অন্যান্য দোকানের মালিক বা কর্মচারীরা ভুলেও প্রতিবাদ করতে আসবে না। কারণ সবার বুকে আতঙ্কের স্রোত তৈরি করেছে রোমানিয়ান মস্তানেরা।

পাশের সিট থেকে ব্যাগ নিয়ে ড্রাইভিং দরজা খুলে নেমে পড়ল রানা। বিড়বিড় করে বলল, ‘দেখা যাক!’

ফুটপাথে উঠে গম্ভীর মুখে জাকিরের দোকানে ঢুকে পড়ল রানা। প্যারিসের এদিকে ফিরে বিস্মিত হয়েছে ও। ক’মাস আগেও ঝকঝকে পরিষ্কার ছিল দোকানগুলোর কাঁচ। এখন সেখানে নোংরা সব উক্তি। কিছু দোকানের ভাঙা কাঁচের জায়গায় আছে পাতলা বোর্ড। শেষ হয়ে গেছে স্থানীয় দোকানিদের জমজমাট ব্যবসা। একটু দূরে পুরনো বইয়ের যে দোকান, ওটা আর নেই। পেস্ট্রির লাল রঙের দোকানটাও উঠে গেছে। ক’মাস আগে ওখানে গিজগিজ করত খদ্দের।

এটা প্যারিসের পশ এলাকা নয়, তবে আগে এখানে ছিল মানুষের প্রাণের ছোঁয়া। ভয়ঙ্কর কালো কোন ছায়া যেন এখন ঢেকে দিয়েছে চারপাশ। ফোনে জাকিরের কাছে জানতে চেয়েছিল রানা, ‘এদিকের এই অবস্থা কীভাবে হলো?’

কয়েক মাস আগে এল রোমানিয়ান মস্তানেরা,’ বলেছে জাকির। ‘তারা এলাকা দখল করে নেয়ায় পড়ে গেল ব্যবসা । আমরা হয়ে গেলাম খুব অসহায়।। আজকাল এদিকে আসে না কেউ। তাই কেনা কাটা সবই প্রায় বন্ধ। ফাঁকা পড়ে থাকে সামনের রাস্তা। 

‘আপনারা পুলিশে জানালেও তারা কোন ব্যবস্থা নেয়নি?’

‘না। পুলিশে নালিশ দিয়েছিল দুই ব্যবসায়ী। তাদের পা ভেঙে দিয়েছে মাস্তানেরা। একবার এদিকে আসেনি পুলিশ। রোমানিয়ানদের নেতা মনে করে সে আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট।’ 

‘তা-ই?’ 

‘জী। চাাঁদা তুলছে সব দোকান থেকে। অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিলে বা বিক্রি করা হলে মালিকের কাছ থেকে আদায় করে বহু টাকা। রানাকে করুণ সুরে বলেছে জাকির, ‘আমার টাকা নেই যে প্রতিমাসে এত টাকা দেব। ওদিকে দোকান ছেড়ে দিলে আগেই দিতে হবে একলাখ ইউরো। নইলে পিটিয়ে আমার হাড়গোড় ভাঙবে। বলেছে: তাতেই সার শেষ নয়-আমার স্ত্রী ও মেয়েটাকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে মেরে ফেলবে।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফোনে বলেছে রানা, ‘আপনি একদম ভাববেন না। ওদের দলনেতাকে ফোনে জানিয়ে দিন, বিকেলে এসে তারা যেন টাকা নিয়ে যায়।’ 

‘কিন্তু টাকা না পেলে তো আমাকে খুন করবে!’ 

‘কিছুই করবে না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলেছে রানা। ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। ঠিক সময়ে দেখা হবে আপনার সঙ্গে।’ এরপর কল কেটে দিয়েছে রানা। অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের নিচের গ্যারাজ থেকে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে দূরের এক হার্ডওয়্যার স্টোরে। ওখান থেকে কিনে নিয়েছে দরকারি কিছু জিনিস। ব্যাগ হাতে আবারও উঠেছে গাড়িতে। সোজা ফিরে এসেছে জাকিরের দোকানের সামনে। তখন থেকে ধৈর্য ধরে বসে আছে রোমানিয়ানদের জন্যে। এরপর জাকিরের দোকানে দুই মস্তান ঢুকে পড়তেই কাজে নেমে পড়েছে রানা।

কাউন্টারে থেমে জাকিরের মুখোমুখি হয়েছে দুই দানব । দোকানে নেই কোন খদ্দের। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ছোটখাটো আকারের বাঙালি দোকানি। রানাকে ঢুকতে দেখে আরও ফিকে হয়ে গেল তার মুখের বাদামি ত্বক। 

দোকানে দরজার সামনে ছাত থেকে ঝুলছে কয়েকটা ঝুনঝুনি। রানার কপালে লেগে টুংটাং শব্দ করল ওগুলো। চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ল দুই রোমানিয়ান। মরা মাছের মত ঘোলাটে চোখে তারা দেখল রানাকে। দৃষ্টি যেন নীরবে বলছে : ‘শালা তুই ভাগ! নইলে পিটিয়ে মেরে ফেলব!’

দুই মস্তান ভেবে নিয়েছে, ভিনদেশি যুবককে যথেষ্ট সতর্ক করে দিয়েছে তারা। এখন নিষ্পলক চোখে দেখছে, ঘুরে দরকার দিকে চলছে বাদামি রঙের যুবক। কিন্তু বেরিয়ে না গিয়ে দু’হাতে সে ঘুরিয়ে দিল দোকানের ঝুলন্ত সবুজ সাইনবোর্ড। এখন বাইরে ওটার লাল অংশ দেখাচ্ছে : স্টোর ক্লোয্‌ড্‌।  

ভেতর থেকে দরজা লক করল বাঙালি যুবক। ঘুরে দুই মস্তানের দিকে চেয়ে আন্তরিক হাসল। কঠোর চোখে তাকে দেখছে রোমানিয়ানেরা। দু’হাত ভাঁজ করেছে বুকে। কুঁচকে গেছে দুই ভুরু। তাদেরকে কিছু না বলে ফ্রেঞ্চ ভাষায় বলল রানা; ‘এরা আর কখনও আপনাকে বিরক্ত করবে না, জাকির। 

‘অ্যাই, শালা, কে তুই?’ ঘেউ করে উঠল স্লাভিক । নাম আমার মাসুদ রানা,’ সহজ সুরে বলল বিসিআই এজেণ্ট। ‘তোর নামটা কী?’ 

‘তোকে একটা সুযোগ দিচ্ছি, বাঁচতে চাইলে লেজ তুলে পালিয়ে যা,’ ধমকে উঠল স্লাভিক। ‘নইলে খুন হবি আমার হাতে!’

‘আমার কিন্তু মনে হয়, তুই নিজেই পড়ে গেছিস মস্ত বিপদে,’ সতর্ক করল রানা।

পরস্পরকে দেখে নিল দুই রোমানিয়ান। হাসতে হাসতে মাথা নাড়ল কালচে যুবক। তার ভাব দেখে রানার মনে হলো, ভীষণ বিস্মিত হয়েছে সে। স্লাভিক যুবক এখন আগের মত আত্মবিশ্বাসী নয়। বন্ধুর চেয়ে চালাক সে। চাপা স্বরে বলল, ‘তা-ই? আমরা কিছু করলে তখন তুই কী করবি?’

‘আমার কাছে কিন্তু ভয়ঙ্কর অস্ত্র আছে,’ বলে কাঁধ থেকে নিয়ে মেঝেতে ব্যাগ রাখল রানা। ওটার ভেতর থেকে বের করল দুপুরে হার্ডওয়্যার স্টোর থেকে কেনা স্টেল্ গান। ওটার স্প্রিং-লোডেড মেকানিযমের সঙ্গে আছে স্টিলের ছোট এক বাক্স। বাড়ির নানান কাজে লাগে ভেতরের স্টেল্।

রানাকে কঠোর চোখে দেখছে দুই রোমানিয়ান। স্লাভিক যুবকের দিকে স্টেল্ গান তাক করে হ্যাণ্ডেলে চাপ দিল রানা। অস্পষ্ট ক্ল্যাক শব্দে ছোট একটা স্টিলের স্টেল্ ছিটকে গিয়ে লাগল মস্তানের জ্যাকেটের বুকে। টুপ করে মেঝেতে পড়ল পাতলা ধাতব পাত।

তাদেরকে চরম বেইজ্জত করা হয়েছে ধরে নিয়ে রানার দিকে এগোল দুই রোমানিয়ান। অবশ্য তারা হামলা করবে সেজন্যে বসে নেই রানা। দু’সেকেণ্ডে চলে গেছে তাদের আড়াই ফুটের মধ্যে। পরক্ষণে ফুটবলের ফ্রিকিকের মত টানা এক লাথি ঝেড়ে দিল ডানদিকের মস্তানের অণ্ডকোষে।

‘ওরেব্বাপ রে!’ হাহাকার করে দু’হাতে গোপনাঙ্গ চেপে ধরে ঝুঁকে গেল স্লাভিক লোকটা। ক্ষণিকের জন্যে থমকে গেছে তার সঙ্গী। এ-সুযোগে ভারসাম্য ফিরে পেয়ে কোমর ঘুরিয়ে তার বুকে জোরাল এক লাথি বসাল রানা। হুড়মুড় করে পিছিয়ে চিত হয়ে মেঝেতে পড়ল জিপসি যুবক। এদিকে কুঁজো হয়ে আপেলের মত লালচে মুখে হাঁসফাঁস করছে স্লাভিক। সে কিছু বোঝার আগেই একপাশে সরে কনুই দিয়ে তার কণ্ঠনালীতে খচ করে খোঁচা দিল বানা।

মেঝেতে সঙ্গীর পাশে হুড়মুড় করে পড়ল স্লাভিক। পরের সেকেণ্ডে নাচের ভঙ্গিতে এগোল রানা। দুই মস্তানের মাথার পাশে খটাস্-খটাস্ শব্দে লাগল বুটের শক্ত ডগার মাঝারি দুটো লাথি। নতুন করে কিছু বোঝার আগেই নীরবে জ্ঞান হারাল দুই রোমানিয়ান।

লড়াই শেষ হয়েছে মাত্র নয় সেকেণ্ডে!

‘হায়, খোদা!’ বিস্মিত চোখে দুই মস্তানকে দেখল জাকির। বিচলিত হয়ে কচলাচ্ছে দু’হাত। বিড়বিড় করে বলল, ‘এবার সত্যিই আমি শেষ!’

চুপচাপ নিজের ব্যাগ থেকে কাঁচি, বড় এক রোল টেপ ও মার্কার পেন নিল রানা। বেহুঁশ মস্তানদের দুই কবজি, গোড়ালি ও হাঁটুদুটো টেপ দিয়ে মুড়িয়ে দিল। টেপ ব্যবহার করে আটকে দিল তাদের মুখ। কাজ শেষ হতেই জাকিরের দিকে হাত বাড়াল রানা। ‘একটা কাগজ দেখি।’

ক্যাশবুক থেকে পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ওর হাতে দিল জাকির। কাঁচি দিয়ে কাগজটা দু’ভাগ করল রানা। এক অংশে মার্কার পেন দিয়ে লিখল: ‘সাবধান!’ অন্য অংশে লিখল মস্তানদের নেতা অ্যালেকয্যাণ্ড্রুর নাম। এরপর রানা যা করল, তাতে নির্বোধ না হলে যে-কেউ বুঝবে ওর বক্তব্য খুবই সহজ।

স্টেপ গানের ক্লিপ অনায়াসে ভেদ করে প্লাস্টার বা কাঠ। ডানদিকের অচেতন যুবকের কপালে কাগজ সেঁটে ধরে অন্যহাতে স্টেপ গানের হাতলে চাপ দিল রানা। ক্ল্যাক শব্দে যুবকের কপালের হাড়ে গেঁথে গেল তীক্ষ্ণধার স্টেপ্‌ল্। পরে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে উপড়ে নিতে হবে ওটা। বামদিকের মস্তানের কপালে জুটল তাদের দলনেতার নাম।

রানার কাণ্ড দেখে হাঁ হয়ে গেছে জাকির। মাথা নেড়ে বলল, ‘আপনি কিন্তু এই কাজ করতে পারেন না!’

‘কে বলল পারি না?’ হাসল রানা, ‘করে তো দেখালাম!’

এবার ওরা আমার স্ত্রী, মেয়ে আর আমাকে খুন করবে।’

‘কিছুই করবে না,’ বলল রানা, ‘এরা সত্যিকারের কাপুরুষ। আজকের পর আর কখনও আপনাকে বিরক্ত করবে না।

কয়েক মিনিটের জন্যে বাইরে যাচ্ছে, জাকিরকে জানাল রানা। ও চলে গেলে যেন সামনের দরজা বন্ধ করে দেয় সে। বদলে খুলে রাখবে পেছনের দরজা।

দরজা খুলে দৃঢ়পায়ে পথে বেরিয়ে গেল রানা। পাঁচ মিনিট পর দোকানের পেছনের গলিতে এসে থামল ওর গাড়ি। ভ্যান ওখানে রেখে দোকানে মালামাল সরবরাহ করে পাইকারী বিক্রেতারা। গাড়ি থেকে নেমে রানা দেখল, দরজার কাছে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জাকির। তাকে কিছুই না বলে দোকানে ঢুকল রানা। একে একে ছেঁচড়ে অচেতন দুই মস্তানকে নিল গলির ভেতরে। গাড়ির পেছনের ডালা খুলে একে একে ময়দার ভারী বস্তার মত দুই যুবককে ভরল ট্রাঙ্কে। ধুপ করে বন্ধ করল ডালা।

‘ঠিক আছে, এবার অ্যালেকয্যার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার দিন।’ জাকিরকে বলল রানা।

দশ মিনিট পর সরু এক গলিতে ঢুকল ফোররানার টিআরডি অফ-রোড প্রিমিয়াম গাড়ি। দু’পাশে আবর্জনায় ভরা কিছু . গার্বেজ ক্যান। বিশ্রী দুর্গন্ধ চারপাশে। দু’দিকের দেয়ালে নোংরা গালি ও কুৎসিত বাক্য লেখা। গলির শেষে চৌকো আঙিনার বামে দোতলা বাড়ির কথা বলেছে জাকির। ওখানে বাস করে অ্যালেকয্যাণ্ড্রু ও তার স্যাঙাতেরা। আঙিনার অন্যান্য বাড়ি বহু বছরের পুরনো। আগে অ্যালেকয্যাণ্ড্রুর আস্তানা ব্যবহার করা হতো পতিতালয় হিসেবে। এখনও আছে রঙিন সাইনবোর্ড। পুরু বোর্ডে গজাল মেরে বন্ধ করা হয়েছে নিচতলার জানালা। দোতলার ধুলোভরা জানালায় ঝুলছে খয়েরি পর্দা। বাতি জ্বলছে না কোন ঘরে। কোথাও কারও কোন নড়াচড়া নেই। অবশ্য কেউ না কেউ আছে। বাড়ির উঠনে রুপালি নতুন মার্সিডিয। ওটার পেছনে কালো ল্যাণ্ড ক্রুযার। ইঁদুরের মত ইতর হলেও নতুন গাড়ি ব্যবহার করে অ্যালেকয্যাণ্ড্রু, যাতে তাড়া খেলে দেরি না করে ভেগে যেতে পারে।

অফ-রোড প্রিমিয়াম আঙিনায় রেখে ব্যাগ হাতে নামল রানা। আপাতত গলিতে মানুষ বলতে আছে এক আফ্রিকান তরুণ। দরকারি কিছু পায় কি না সেটা দেখছে গার্বেজ ক্যান ঘেঁটে। বোধহয় সে ড্রাগ অ্যাডিক্ট। অ্যালেকয্যাণ্ড্রুর বাড়ির উল্টোদিকে পুরনো এক ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে এল ব্যাণ্ডের বেসুরো বিকট গান। যে-কারও মাথা ধরিয়ে দেবে বিশ্রী আওয়াজ। দূরে কোথাও ঘেউ-ঘেউ করছে মেজাজী এক কুকুর। গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল পিচ্চি এক মেয়ে। সঙ্গে সঙ্গে চিলচিৎকার জুড়ল এক দম্পতি। এবার নাকি মেয়ের ডায়াপার বদলে দেবে অন্যজন। কয়েক ফুট দূর থেকে আরও কিছু আওয়াজ শুনতে পেল রানা। ওর গাড়ির পেছনে জ্ঞান ফিরতেই গোঙাতে শুরু করেছে দুই মস্তান। মুক্তি চাই তাদের। এরা দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, সেটা আশা করছে রানা।

গাড়ির দরজা লক করে একটু দূরে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সিঁড়িঘরে গিয়ে ঢুকল ও। দরজার আড়ালে থেমে মোবাইল ফোনে কল দিল অ্যালেকয্যাণ্ড্রুকে। তিনবার রিং বাজার পর ধরা হলো ফোন। ঘড়ঘড়ে ভারী কণ্ঠ বলল, ‘কী, কী চাই?’

‘তুমি আমায় চেনো না, তবে তোমাকে আমি চিনি,’ বলল রানা। ‘জানালা দিয়ে নিচে তাকাও। বাইরে তোমার জন্যে দুটো উপহার এনে রেখেছি।

অ্যালেকয্যাণ্ড্রু কিছু বলার আগেই ফোন রেখে দিল রানা। উঁকি দিয়ে দেখল সরে গেছে উল্টোদিকের বাড়ির জানালার খয়েরি এক পর্দী। ধুলোভরা কাঁচের ওদিক থেকে নিচে তাকাল কেউ। এবার বোধহয় ক’জন স্যাঙাত নিয়ে নেমে আসবে লোকটা। তাতে চট করে গরম হয়ে উঠবে পরিবেশ।

রানা ওদেরকে বুঝিয়ে দেবে, তকাল যা করেছে, ভবিষ্যতে যেন তা আর না করে তারা। এরপর কাজ শেষ করে চটজলদি বিদায় নেবে, কারণ অ্যালেকয্যাণ্ড্রুকে বাঁচাতে এসব বাড়ির ড্রাগখোর কেউ না কেউ ফোন দেবে পুলিশে।

অ্যালেকয্যাণ্ড্রুর বাড়ির দিকে চেয়ে রইল রানা। তারই ফাঁকে ফোন দিল সোহেলকে। প্রথমবার রিং হতেই ওদিক থেকে ফোন ধরল ওর বন্ধু। ‘কিছু বলবি, রানা?’

‘কাজে নেমেছি,’ বলল রানা। ‘বসকে বলিস, আর কোন বিপদ হবে না জাকিরের।

‘ঠিক আছে। তুই সাবধানে থাকিস।’

বস কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতে গিয়েও কল কেটে দিল রানা। উল্টোদিকের বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে দু’জন লোক। রানার গাড়ির কাছে গিয়ে থামল তারা। তাদের একজন নির্দ্বিধায় অ্যালেকয্যাণ্ড্রু। যদিও তার নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারেনি জাকির।

লোকটার বামভুরু থেকে থুতনি পর্যন্ত কুৎসিত এক শুকনো গভীর ক্ষতচিহ্ন। বিশ্রীভাবে বাঁকা হয়েছে ঠোঁটের বামদিক। মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল নেমেছে চওড়া কাঁধে। দৈর্ঘ্যে সে ছয়ফুট সাত ইঞ্চি। পাশের সাতফুটি দানব বোধহয় তার ডানহাত। শক্তমুঠোয় স্টেইনলেস স্টিলের নাইন এমএম চৌরাস পিস্তলের বাঁট ধরেছে অ্যালেকয্যাণ্ড্রু!

বাড়ির সিঁড়িঘর থেকে তাদের ওপরে চোখ রাখল রানা। অফ-রোড প্রিমিয়ামে কেউ নেই দেখে চারপাশে তাকাল তারা! আবারও তাদের চোখ ফিরে এল রানার গাড়ির ওপর। বোধহয় শুনতে পেয়েছে পেছনের দিকে গোঙানির আওয়াজ।

সঙ্গীকে গাড়ির পেছন ডালা খুলতে বলে এক পা পিছিয়ে গেল অ্যালেকয্যাণ্ড্রু। পিতল দিয়ে কাভার করেছে স্যাঙাৎকে। ধুপ শব্দে অফ-রোড প্রিমিয়ামের পেছন ডালা খুলল দানব। একই সময়ে ভেতা। চোখ বোলাল তারা। বন্দিদের স্টেল্ করা কপালে হুঁশিয়ারী বার্তা দেখে সরু হলো তাদের চোখ।

এদিকে নিঃশব্দে সিঁড়িঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে রানা। ব্যাগ থেকে নিয়েছে রাবারের হ্যাণ্ডেলওয়ালা ক্ল হ্যামার। মাত্র তিন সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল দুই যুবকের পেছনে। নিজের নাম জাহির করতে গেল না রানা। যুদ্ধে জেতার প্রথম শর্ত হচ্ছে: যার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, তাকে আক্রমণ করো।

সাঁই করে অ্যালেকয্যাণ্ড্রুর মাথার পাশে হাতুড়ি চালাল রানা। ভাল করেই জানে, আঘাতটা হতে হবে মাপা হাতে, নইলে ভচ্ করে হাড় ভেঙে গেলে বেরিয়ে আসবে ধূসর মগজ।

কাউকে খুন করতে এখানে আসেনি রানা। মাথায় মারাত্মক বাড়ি খেয়ে গোড়া-কাটা কলাগাছের মত ধড়াস করে সিমেন্টের চাতালে পড়ল অ্যালেকয্যাণ্ড্রু। বিস্ময় নিয়ে রানার দিকে আধপাক ঘুরল তার স্যাঙাত। ফলে হাতুড়ির ঘা লাগল দানবের চোয়ালের উঁচু হাড়ে। টু শব্দ না করে ওস্তাদের পাশে ভূমিশয্যা নিল দানব। জ্ঞান নেই কারও।

‘দুঃখজনক, তোমাদের সঙ্গে দরকারি অস্ত্র নেই,’ বিড়বিড় করল রানা।

চারপাশের বাড়ির জানালায় দেখা দিয়েছে কনো কিছু মুখ। তাদেরকে পাত্তা দিল না রানা। অ্যালেকয্যাণ্ড্রুর পিস্তলটা পেলে হয়তো নিজের ওপরে আইনি গজব ডেকে আনবে কোন ছোকরা। তাই টোরাসটা সংগ্রহ করল ও। কোমরের বেল্টে অস্ত্রটা গুঁজে নেমে পড়ল কাজে। গাড়ির ভেতরের দুই মস্তানের মাথায় হাতুড়ির ছোট দুটো টোকা দিল। তাতে আবার জ্ঞান হারাল তারা। একে একে তাদেরকে গাড়ি থেকে বের করে পেভমেন্টে শুইয়ে দিল রানা। অ্যালেকয্যাণ্ড্রুর জ্যাকেটের কলার চেপে ধরে তুলে বসাল তাকে। টেনে নিয়ে গিয়ে রাখল অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের দেয়ালের ধারে। লোকটার কদর্য গালে কষে ক’টা চড় দিতেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাল সে। ঘোলা চোখে এদিক-ওদিক চেয়ে কী যেন বলতে গেল। কিন্তু তখনই রানার বুটের ডগা খোঁচা দিল তার অণ্ডকোষে।

‘সত্যিই তোমার কপাল অনেক ভাল,’ বলল রানা। ‘যারা মহিলা বা বাচ্চাদের ক্ষতি করে, এমনিতে আমি তাদের বিচি কেটে নিই। তবে আজ কেন যেন হাতে রক্ত লাগাতে ইচ্ছে করছে না। ব্যথায় গোঁ-গোঁ করছে অ্যালেকয্যাণ্ড্রু। তার গালে কষে দুটো চড় মেরে বলল রানা, ‘ঠিক আছে, এবার মন দিয়ে শোনো। দ্বিতীয়বার সতর্ক করব না। তুমি তোমার দলবল নিয়ে এই এলাকা থেকে সরে যাবে। সুস্থ হওয়ার পর যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছ, সবই ফেরত দেবে। বাড়তি কিছু টাকাও দেবে তাদের হাতে। এক এক করে সবার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেবে। আর কখনও এদিকে যেন দেখতে না পাই। নইলে আবারও খুঁজে নেব তোমাকে। আর তখন কচাৎ করে কেটে নেব তোমার দুই আণ্ডা। আমার কথা ভালভাবে বোঝা গেছে? তুমি এখনও বেঁচে আছ, কারণ তোমাকে খুব খারাপ মানুষ বলে মনে হয়নি আমার। এতক্ষণ কী বলেছি, এবার সেগুলো গড়গড় করে বলো।’

ব্যথায় গাল কুঁচকে বিড়বিড় করে রানার বক্তব্য নিজেও আউড়ে গেল অ্যালেকয্যাণ্ড্রু। একটা কথাও বাদ পড়ল না।

‘বাহ্!’ বলল রানা, ‘তুমি তো দেখি দারুণ মুখস্থ করো! ঠিক আছে, এবার তা হলে ঘুমিয়ে পড়বে। আবার যখন জেগে উঠবে, শুরু হবে তোমার জন্যে একদম নতুন এক জীবন!’ হাতুড়ির চ্যাপটা দিক দিয়ে যুবকের মাথায় ছোট একটা ঘা দিল রানা। অক্ষিকোটরের ভেতরে উল্টে গেল অ্যালেকয্যাণ্ড্রুর চোখের দুই মণি।

ব্যাগ থেকে কাঁচি নিয়ে লোকটার ঝাঁকড়া চুল কচকচ করে কাটল রানা। খুলির কাছে রইল দাড়ির মত খোঁচা-খোঁচা কিছু চুল। একটু পর তার তিন অচেতন স্যাঙাতের মাথার চুলের একই হাল হলো কাঁচির প্রবল আক্রমণে। জ্ঞান ফিরলে আয়না দেখে এরা বুঝবে, চরম বেইজ্জত করা হয়েছে তাদেরকে!

অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে প্রশংসা করছে কেউ কেউ অন্যদের চোখে চরম হতাশা। বাদামি যুবক এসে সর্বনাশ করে দিয়েছে স্থানীয় ড্রাগ ডিলারের। তাদেরই কেউ ফোন করেছে পুলিশে। দূর থেকে এল সাইরেনের বিলাপের আওয়াজ।

দেয়ালে ঠেস দিয়ে চার অচেতন মস্তানকে বসাল রানা। বুটের হিলের আঘাতে এক এক করে ভাঙল তাদের কবজি ও গোড়ালির হাড়। বহুকাল হাসপাতালে থাকতে হবে তাদেরকে’। ব্যাগ থেকে নিয়ে কৌটার তরল হলদে রঙ ঢেলে দিল মস্তানদের মুখ, বুক ও পেটে। এই রঙটাকে কাপুরুষতার প্রতীক বলে মনে করে মানুষ। সুতরাং আপাতত কোথাও মুখ দেখাবে না এরা।

জ্ঞানহারা চার মস্তানকে শেষবার দেখে নিয়ে অফ-রোড গাড়িতে উঠল রানা। গলি থেকে বেরিয়ে কয়েক মিনিটে চলে গেল নিজের ফ্ল্যাটবাড়ির কাছে। যেহেতু আপাতত কোন বিপদ হবে না জাকিরের, সেজন্যে স্থির করেছে এবার চলে যাবে আয়ারল্যাণ্ডে।

চার

বর্তমান সময়। আগস্ট মাস।

আকাশ থেকে সোনালি আগুন যেন ঢেলে চলেছে খেপে ওঠা সূয্যিমামা। জায়গাটা টুলসা শহরের পঁচিশ মাইল দূরে উলোগাহ্ লেকের তীরে। সরু আঁকাবাঁকা পথে থেমে গেল রুপালি এক রোল্স রয়েস। ওটার একমাত্র যাত্রী জ্যাকুলিন সিলভেস্টার বড় করে শ্বাস ফেলল। ‘যাক, পৌঁছে গেছি!’

গাড়ি থেকে নেমে পেছন দরজা খুলে দিল দক্ষ শোফার। ‘ধন্যবাদ, বব,’ বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল জ্যাকি। সিট থেকে নিয়ে কাঁধে তুলল ছোট্ট ব্যাকপ্যাক।

‘উইকেও সুন্দর কাটুক, মিস সিলভেস্টার,’ জবাবে হেসে বলল শোফার বব। ‘আমার ফোন নম্বর মনে আছে তো? ফিরতে চাইলে জানাবেন। চট্ করে এসে নিয়ে যাব।’ গাড়ির পেছনের দরজা আটকে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে উঠল সে। রোদ্ রয়েস গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরতি পথে চলে গেল।

সামনে অপূর্ব সুন্দর কটেজটা দেখে খুশি হয়ে উঠল, জ্যাকি। আনমনে ভাবল: লিণ্ডা কনারের মত ধনীরা আসলেই থাকেন সমাজের অনেক ওপরের স্তরে। আর ওর কী কপাল, দাতব্য-কর্মী হয়েও বিলাসবহুল এই কটেজ সামনের দু’দিনের জন্যে ওকে ছেড়ে দিয়েছেন ভদ্রমহিলা।

ভয়ঙ্কর ঝড় তৈরি করার জন্যে বদনাম আছে ওকলাহোমার উত্তরদিকের। আর সে সময়ে প্রলয়ঙ্করী হয়ে ওঠে উলোগাহ লেক। সেজন্যে চেরোকি ইণ্ডিয়ান ভাষায় ওটাকে বলে আঁধার মেঘ। অবশ্য আজ পরিবেশ সত্যিই চমৎকার। আয়নার মত পড়ে আছে নিখর বিশাল লেক। ছোট্ট জেটিতে বোটহাউসের জানালায় ঠিকরে সোনালি রোদ গিয়ে পড়েছে কালো অতল জলে। মনোরম কটেজের সামনে চওড়া বারান্দায় দামি রকিং-চেয়ার। বারান্দার ছাত থেকে নেমেছে পুরনো আমলের সুন্দর একটি লণ্ঠন। ড্রাইভার বব বিদায় নেয়ায় একমাইলের ভেতরে এখন আর কেউ নেই। নিজেকে কেমন যেন একা লাগল জ্যাকির।

আজ শুক্রবার। গোটা সপ্তাহ ওর কেটেছে খুব ব্যস্ততায়। তাই আগামী দু’দিন বিশ্রাম পাবে ভেবে খুশি হয়ে উঠল জ্যাকি। বারান্দায় পা রেখে দরজার পাশে কিপ্যাড প্যানেলে অ্যালার্ম কোড এন্ট্রি করে ঢুকে পড়ল কটেজের ভেতরে। .

কটেজটা ছোট হলেও তোমার হয়তো খুব অসুবিধে হবে না, মৃদু হেসে বলেছেন লিঙা। অথচ তাঁর বিলাসবহুল কটেজ আসলে টুলসা ক্রসবি হাইট্স-এ ভাড়া করা জ্যাকির বাড়ির ছয়গুণ বড়। কটেজের ভেতরে দামি আসবাবপত্র। ওক আর ওয়ালনাট কাঠের মেঝে ও দেয়াল ভার্নিশ করা। যিনি তৈরি করেছেন কটেজের ডিযাইন, সেই আর্কিটেক্ট বোধহয় এ- কাজের জন্যে পারিশ্রমিক নিয়েছেন অন্তত একলাখ ডলার।

নিচতলার মাঝে বৃত্তাকার বড় এক অংশের ছাত তিনতলা সমান উঁচু। দোতলার কাঠের গ্যালারি থেকে নিচে দেখা যাবে গোটা লিভিং স্পেস। কটেজের প্রতিটি জিনিস ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক। নিচে দুটো বেডরুম, ওপরেও তা-ই। পাঁচ মিনিটে নিচের বেডরুম দেখে নিয়ে ব্যাকপ্যাক হাতে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল জ্যাকি। ভোরে খোলা জানালা দিয়ে সূর্যোদয় দেখবে বলে বেছে নিল পুবের বেডরুম। বিছানায় ব্যাকপ্যাক রেখে হাইহিল খুলে পরল রানিং শু। নেমে এল নিচতলায়। ওর মনে আছে মিসেস কনারের বলা কথা: জঙ্গলে যেসব ট্র্যাক গেছে, চাইলে ওদিক থেকেও ঘুরে আসতে পারো।

প্রতিবছর বড়লোকদের কাছ থেকে এতিম শিশুদের জন্যে টাকা সংগ্রহ করে রোয বাড ট্রাস্ট। ওটার চিরস্থায়ী সভাপতি লিণ্ডা কনার। আর তাঁরই ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করে জ্যাকি। এ-বছরও নভেম্বর মাসে ওদের সংগঠন থেকে আয়োজন করা হবে রুন্ট ৬৬ ম্যারাথন। এবার সেই দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার জন্যে কয়েক মাস ধরে নিজেকে গড়ে তুলছে জ্যাকি।

কটেজের সামনের দরজা লক করে লেকতীরের বনভূমির ট্র্যাকে জগিং করতে লাগল ও। গাছের ঘন পাতার ফোকর গলে মাটিতে নেমে এসেছে নানান আকারের রোদ। আনমনে ভাবছে জ্যাকি, গত দু’বছরে লিঙার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সুন্দর এক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওর। আর সেজন্যেই বুঝতে পেরেছে, পারিবারিক জীবনে মোটেই সুখীন মানুষটি।

অবশ্য বড়লোকদের ব্যাপার, আদতেই আলাদা। টুলসা শহরের উত্তরদিকে বিশাল এক ম্যানশনে বাস করেন লিণ্ডা ও তাঁর স্বামী। প্রায়ই দেখা যায় ব্যবসার কাজে দিনের পর দিন বাড়ি ফেরেন না অ্যারন কনার। তাঁর বদলে হৃদয়বান কোন পুরুষকে জীবনে পেলে বোধহয় হাজারগুণ সুখী হতেন লিণ্ডা।

আচ্ছা, আমি নিজেই কি সুখী? নিজেকে জিজ্ঞেস করল জ্যাকি। ওর মনে পড়ল কলেজের সুন্দর দিনগুলোর কথা। প্রথমবর্ষে একইসঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত জনি স্মিথ। পাশের সিটে বসত। কিছুদিনের ভেতরে ওরা হয়ে গেল ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সখ্য একসময় হয়ে গেল পরস্পরের প্রতি গভীর ভালবাসা। নিয়মিত সাক্ষাৎ না হলে দম আটকে আসত ওদের।

এভাবে পেরোল দুটো বছর।

ওরা স্থির করেছিল কলেজের লেখাপড়া শেষ করে চাকরি পেলেই দেরি না করে বিয়ে করবে।

কিন্তু চতুর্থ বছরে হঠাৎ করে বদলে গেল সব সমীকরণ।

সামনে বরফে ছাওয়া ক্রিসমাস। বাবা-মার সঙ্গে খালার বাড়িতে লস এঞ্জেলেসে যাবে জনি। বিমানবন্দরে এগিয়ে দিতে গেলে হেসে জ্যাকিকে বলেছিল, ‘এয়ারপোর্টে নেমেই কল দেব।’

কিন্তু আর কখনও ফোন করল না জনি।

লস এঞ্জেলেস বিমানবন্দরের ষাট কিলোমিটার দূরের বরফে ভরা এক মাঠে ক্র্যাশ করল ওদের বিমান।

রাতে ইন্টারনেট নিউয পোর্টালে খবরটা জেনে চমকে গেল জ্যাকি। ভাবল: ঈশ্বর নিশ্চয়ই এত নিষ্ঠুর নন যে এভাবে ওর কাছ থেকে কেড়ে নেবেন জনিকে।

সারারাত আর ঘুমাতে পারল না জ্যাকি।

পরদিন পত্রিকা মারফত জানল, সেই বিমান দুর্ঘটনায় বাঁচতে পারেনি কেউ। জ্যাকির মনে হয়েছিল, মাথার ওপরে ভেঙে পড়েছে গোটা আকাশ। পায়ের তলা থেকে সরে গেছে জমিন। সাঁই-সাঁই করে নেমে যাচ্ছে ও কোথায় যেন!

সকালে ওর শুকনো মুখ দেখে বাবা বলল, ‘কী হয়েছে রে, মা?’

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল জ্যাকি।

ওকে বুকে টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ পর বাবা বলল, ‘পৃথিবীটা খুব কষ্টের জায়গা, না রে, মা?’

একটা কথাও বলতে পারেনি জ্যাকি। মনে পড়েছিল বাবার প্রতি মায়ের চরম অবহেলা ও অনৈতিক আচরণ। বাবাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরেছিল জ্যাকি।

নিজের ঘরে ফিরে কাঁদতে কাঁদতে বুঝেছিল, দুনিয়ায় বাবা ছাড়া আসলেই ওর আর কেউ নেই!

কলেজে ক’জন যুবক চাইল ঘনিষ্ঠ হতে। তবে তাদের দিকে ফিরেও দেখেনি জ্যাকি। আজও ওর মন জুড়ে আছে জনির কুচকুচে কালো মণিদুটো, যেখানে ফুটত গভীর মায়া, একরাশ কৌতুক ও গভীর প্রণয়ের অনুরাগ। জনি কখনও হয়ে উঠত খুব গম্ভীর, যেন দুনিয়াটাকে দেখছে বহু দূর থেকে। ওর মত রহস্যময় ও বিবেচক আর কাউকে কখনও দেখেনি জ্যাকি।

বহুক্ষণ হলো লেকতীরে জগিং করছে জ্যাকি। সূর্যাস্তের একটু আগে আবার ফিরল কটেজে। শাওয়ার নিয়ে নতুন পোশাক পরে বেডরুমে বসে ভাবল, রাতে ডিনারে নেবে সামান্য খাবার। লিণ্ডা অবশ্য বলেছেন, ফ্রিয়ে যা আছে, নিতে যেন দ্বিধা না করে। সাইড কেবিনেটে আছে নানান ড্রিঙ্কের বোতল। যা খুশি নিতে পারে।

ফ্রি থেকে গ্রিড্ টিউনা, ভেজিটেবল সালাদ ও চাইনিয নুডল্স্ নিয়ে মাইক্রো আভেনে গরম করল জ্যাকি। দশ মিনিটে সেরে নিল রাতের খাবার। পরের দু’ঘণ্টা পার করল রোমাঞ্চকর এক থ্রিলার বই পড়ে। ওটা শেষ হওয়ায় নেমে এল নিচতলায়। লিণ্ডা বলেছেন কীভাবে চালু করতে হবে বাড়ির অ্যালার্ম সিস্টেম। নিয়মমত দরজা লক করে ওপরের বেডরুমে ফিরে শুয়ে পড়ল জ্যাকি। জানালা দিয়ে দেখল বনভূমি ভাসিয়ে নিচ্ছে দুধসাদা ধবধবে জ্যোৎস্না। লেকের তীরে মৃদু ছলাৎ-ছলাৎ শব্দে ভাঙছে ছোট ঢেউ। কিছুক্ষণ জ্যোৎস্না দেখে আর ঢেউয়ের শব্দ শুনে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল জ্যাকি।

মধুর স্বপ্নে বিভোর হয়ে কত সময় পার করে দিয়েছে জানে না, হঠাৎ করে ওর ঘুম ভাঙল গলার আওয়াজে। বাইরে রোদের বদলে ঘুটঘুটে আঁধার। চট করে বেডসাইড টেবিলে রাখা ঘড়ি দেখে নিল জ্যাকি। এখন বাজে রাত একটা চুয়ান্ন মিনিট। বাড়িতে ডাকাত পড়েছে ভেবে হঠাৎ করে সতর্ক হয়ে উঠল ও। বিছানায় উঠে বসে টের পেল, ধকধক করছে ওর বুকের ভেতরটা। ভুল শুনেছে কি না সেটা বোঝার জন্যে কান পাতল।

না, ওই তো নিচতলায় পুরুষমানুষের গলার আওয়াজ!

ভয় পেলেও নিজেকে সামলে নিল জ্যাকি। বিছানা ছেড়ে নেমে ব্যাকপ্যাক হাতড়ে বের করল সিগ সাওয়ার পি৩২০ মডেলের পিস্তলটা। ওর বাবা ছিল ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি গার্ড। মারা যাওয়ার আগে মাত্র দুটো জিনিস মেয়েকে দিয়ে যেতে পেরেছে। তার ভেতর একটা হচ্ছে এই নাইন এমএম পিস্তল। মানুষটা চাইত স্বাবলম্বী হবে তার মেয়ে। তাই কিশোরী বয়সে ওকে ট্রেনিং দিয়েছে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে পিস্তল। বাবার কথাগুলো গেঁথে গিয়েছিল ওর মনে, তাই আমেরিকার বুনো সমাজে কখনও লোডেড পিস্তল ছাড়া বাইরে বেরোয় না।

সিগ সাওয়ার হাতে নিঃশব্দে বেডরুম ত্যাগ করে চলে এল গ্যালারিতে। আঁধারে কাঠের রেইলিং ঘেঁষে নিচে তাকাল। ঢিবঢিব করছে ওর বুক। মনে হচ্ছে, হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ ওকে ধরিয়ে দেবে ডাকাতদের কাছে!

নিচতলায় বৃত্তাকার লিভিং স্পেসে জ্বলছে উজ্জ্বল বাতি। ছায়া থেকে নিচের সবকিছু দেখছে জ্যাকি। নিচে আছে চারজন লোক। তাদের একজনের পিঠ জ্যাকির দিকে। লম্বা লোক সে। চওড়া কাঁধ। মাথার চুল রুপালি। পরনে স্পোর্টস্ জ্যাকেট ও জিন্স। পায়ে উডল্যাণ্ড শু। দ্বিতীয় ও তৃতীয়জন আছে জানালার কাছে। তাদের বয়স হবে সাতাশ। চিতার মত সুঠাম শরীর। চেহারা খুব গম্ভীর। একজনের কালো চুল আর্মি ছাঁট দেয়া। অন্যজনের পনিটেইল করা চুল সোনালি। দু’জনের পরনে টি-শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট।

চতুর্থজন বেঁটে ও মোটা। কালো চুল কোঁকড়া। গালে চাপ দাড়ি। গদিওয়ালা দামি এক আর্মচেয়ারে বসেছে সে।

নিচে কী হচ্ছে জানা নেই জ্যাকির। তবে এরা কীভাবে ডিঅ্যাকটিভেট করল অ্যালার্ম সিস্টেম, সেটা ভেবে পেল না ও। অবশ্য এরা ডাকাত হলে এত নিশ্চিন্তে থাকতে পারত না।

রুপালি চুলের লোকটার হাতে ক্রিস্টালের স্বচ্ছ গ্লাস। ওটার ভেতরে সাইড কেবিনেট থেকে নেয়া সোনালি তরল। হঠাৎ করে সে ঘুরে যেতেই স্বস্তি বোধ করল জ্যাকি। পিস্তলের বাঁটে আলগা হলো ওর আঙুল। ভদ্রলোক লিপ্তার স্বামী। ভিড়ের ভেতরেও তাঁকে চিনবে ও। বোধহয় অন্যদের সঙ্গে ব্যবসার আলাপ করতে এখানে এসেছেন।

হঠাৎ লজ্জায় লালচে হলো জ্যাকির দু’গাল। ভদ্রলোক যদি এখন জানেন, ও এসে উঠেছে এ-কটেজে, তো না জানি কী ভাববেন তিনি! এটা পরিষ্কার, ওকে যে এখানে থাকতে দিয়েছেন লিণ্ডা, সেটা স্বামীকে বলেননি তিনি। হয়তো রেগে উঠবেন ভদ্রলোক। দুর্ব্যবহারও করতে পারেন!

ব্রিত বোধ করছে জ্যাকি। এটা বুঝে গেল, চাইলেও কটেজে লুকিয়ে থাকতে পারবে না। সুতরাং ওর বোধহয় এখন উচিত নিজের উপস্থিতি জানিয়ে দেয়া। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে মুখ খুলতে গেল জ্যাকি, কিন্তু তখনই হঠাৎ করে পাল্টে গেল নিচের পরিবেশ।

টেবিলে মদের গ্লাস রাখলেন লিণ্ডার স্বামী অ্যারন কনার। হাতের ইশারায় ডাকলেন জানালার কাছের দুই যুবককে। দেরি না করে চেয়ারে বসা দাড়িওয়ালা লোকটার পাশে এসে থামল তারা। মধ্যবয়স্ক মানুষটা কিছু বোঝার আগেই কনুই ধরে তাকে আর্মচেয়ার থেকে টেনে তুলল। পিঠে জোর ধাক্কা দিয়ে কার্পেটের ওপরে লোকটাকে ফেলে দিল তারা। এবার ঘটল আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা। দুই যুবকের হাতে উঠে এল পুলিশের ব্যবহৃত স্টিলের ব্যাটন। কবজির মোচড়ে হয়ে গেছে টেলিস্কোপের মত লম্বা। পরক্ষণে মুষলধারে ধাতব লাঠির বাড়ি নামল মধ্যবয়স্ক লোকটার ঘাড় ও পিঠের ওপর।

নির্মমতা দেখে লিণ্ডার স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা হারাল জ্যাকি।

‘এখানে নয়,’ শান্ত স্বরে বলল অ্যারন কনার, ‘বাইরে নাও, বার্ব।’

অবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে রইল জ্যাকি।

রক্তাক্ত মানুষটাকে ছেঁচড়ে দরজা পার করিয়ে চাঁদের আলোয় ভরা বারান্দায় নিল দুই যুবক।

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে গেল বয়স্ক লোকটা।

আর তখনই ঘটল আরও আতঙ্কজনক ঘটনা।

আরেকটু হলে জ্যাকির মুখ চিরে বেরোত আর্তনাদ। হোলস্টার থেকে কালো এক পিস্তল বের করল ক্রু-কাট চুলের যুবক। পর পর দুই গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠল কটেজ। প্রথম গুলিতে ফুটো হয়েছে প্রৌঢ়ের বাম হাঁটুর বাটি। পরের বুলেট চুরমার করেছে ডানহাঁটু। গুলির প্রতিধ্বনি মিলিয়ে গেলেও নির্জন এলাকার চারদিকে ছড়িয়ে গেল লোকটার করুণ আর্তচিৎকার।

সহজ চোখে তাকে দেখছে অ্যারন কনার।

জ্যাকি ভাবল, সত্যিই কি এই লোক ওর বসের স্বামী? এসব কি সত্যিই ঘটছে?

কাউকে বললেও তো বিশ্বাস করবে না ওর কথা!

অবশ্য…

বেডরুমে ঢুকে স্মার্টফোন নিয়ে আবার গ্যালারিতে ফিরল জ্যাকি। কাঁপছে দু’হাত। দ্বিতীয় চেষ্টায় চালু করল ভিডিয়ো। বুঝে গেছে, খুনিগুলো যদি টের পায় ভিডিয়ো করা হচ্ছে, তো দেরি করবে না ওকে খুন করতে।

হামাগুড়ি দিয়ে সরে যেতে চাইছে আহত লোকটা। প্রচণ্ড ব্যথা ও আতঙ্কে ফুঁপিয়ে উঠছে। শান্ত চোখে তাকে দেখছে অ্যারন কনার। প্রৌঢ় যেন আহত এক তেলাপোকা!

কনারের ইশারায় বেচারার পাশে গিয়ে থামল পনিটেইল করা যুবক। পিস্তল তুলল প্রৌঢ়ের ডানহাতের আঙুলের দিকে। পরক্ষণে লাফ দিল যুবকের হাতের অস্ত্র। গুলি লাগতেই বেড়ে গেল আহত প্রৌঢ়ের আর্তনাদ।

মজা পেয়ে হাসছে অন্য তিনজন। লোকটার উরুতে গুলি করল দ্বিতীয় যুবক। পরক্ষণে দুই গুলিতে উড়িয়ে দিল বামহাতের সব আঙুল।

টানা আর্তচিৎকার ছাড়ছে বয়স্ক লোকটা।

কাঁপা হাতে ছোট্ট স্মার্টফোন ধরে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে জ্যাকি।

‘ধর, শুয়োরটার চিৎকার শুনে বিরক্ত হয়ে গেছি,’ বলল অ্যারন কনার। জ্যাকেট সরিয়ে হোলস্টার থেকে নিল দীর্ঘ নলের এক রিভলভার। চাঁদের আলোয় আয়নার মত চকচক করছে ওটা। হ্যামার তুলে দাড়িওয়ালার মাথার পেছনে অস্ত্রের নল তাক করে টিপে দিল ট্রিগার।

অন্যদুই অস্ত্রের চেয়েও জোরে গর্জন ছাড়ল রিভলভার। হামাগুড়ি দিতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল দাড়িওয়ালা। রক্তে ভেসে গেল মুখের একপাশ। মুচড়ে উঠে স্থির হয়েছে তার দেহ।

বুনো পশ্চিমের কাউবয়দের মত করে রিভলভারটা চরকির মত ঘুরিয়ে হোলস্টারে রেখে দিল অ্যারন কনার সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘ভ্যানে তোলো হারামজাদাকে। পরে টুকরো করে মাংসগুলো কুকুর দিয়ে খাইয়ে দেবে।

‘ওকে বস,’ একইসঙ্গে বলল দুই যুবক।

‘যাহ্, হারামজাদার রক্ত লেগে গেছে আমার জুতোয়।’

‘সরি, বস,’ বলল পনিটেইল।

‘সমস্যা নেই,’ কাঁধ ঝাঁকাল কনার। ‘ধুয়ে নিলেই হবে।’

একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে ভয়ে কাঁপছে জ্যাকি। দু’হাত-পা ধরে লাশটাকে তুলল দুই যুবক। রাখল গিয়ে জঙ্গলের ধারে ভ্যানের কাছে। খুনিরা কটেজ ছেড়ে বেরোতেই জ্যাকি বুঝে গেছে, এখনই মোক্ষম সময়। দেরি না করে পালিয়ে যেতে হবে ওকে। স্মার্টফোন অফ করে একছুটে গিয়ে ঢুকল বেডরুমে। ঘরে টুকটাক জিনিস রয়ে গেছে। তবে এখন আর সময় নেই সেসব গুছিয়ে নেয়ার। ব্যাকপ্যাকে ফোন রেখে ছোঁ দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এল বেডরুম থেকে।

কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে ছুটে নেমে এল নিচতলায়, হাতে ঝুলছে পিস্তল। উজ্জ্বল আলো জ্বলছে লিভিং স্পেসে। নিজেকে উলঙ্গ বলে মনে হলো জ্যাকির। এইমাত্র কটেজের দিকে ঘুরে চেয়েছে তিন খুনির একজন। যে-কোন সময়ে হয়তো ধরা পড়বে ও। আর সেটা হলে কী ঘটবে, ভাল করেই বুঝতে পারছে।

বারান্দায় থকথকে রক্ত দেখে বমি এল জ্যাকির নিজেকে সান্ত্বনা দিল: পার হতে হবে মাত্র কয়েক ফুট, তারপর পালিয়ে যেতে পারবে জঙ্গলের ভেতরে। দমকা হাওয়ায় পড়া বাঁশ পাতার মত কাঁপছে ওর দু’পা। ভয়ে যে- কোন সময়ে হারাবে চেতনা।

দু’পা ফাঁক করে জঙ্গলের এক গাছের গায়ে ছ্যার ছ্যার করে প্রস্রাব করছে লিণ্ডার স্বামী। বামহাত রেখেছে কোমরে। ঠোঁট গোল করে শিস দিচ্ছে খুশিমনে। সুযোগ বুঝে বারান্দা পেরিয়ে একছুটে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল জ্যাকি। অ্যারন কনার আছে মাত্র বিশ ফুট দূরে। জ্যাকি পরিষ্কার শুনল মূত্রত্যাগের আওয়াজ। ওদিকে রুপালি ভ্যানের কাছে নিচু গলায় আলাপ জুড়েছে কনারের স্যাঙাতেরা। একটু পর আবার ফিরে এল কটেজের দিকে

ভয় পেয়ে ঘন এক ঝোপে ঢুকল জ্যাকি। নড়াচড়া করলে ধরা পড়বে ভেবে আটকে রেখেছে শ্বাস। ওর মাত্র দেড়ফুট দূর দিয়ে গেল পনিটেইল করা যুবক। তার মুখের চুইংগামের মিন্টের গন্ধ নাকে এল জ্যাকির।

ঝোপ পেরোতে গিয়ে হঠাৎ করেই থেমে গেছে যুবক। বোধহয় বুনো জন্তুর মত কাজ করে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ঝোপের ভেতরে বসে জ্যাকি দেখল, চাঁদের আলো পড়েছে যুবকের মুখের একপাশে। অন্যদিকে কটেজের হলদে আলো। বুনো জানোয়ারের মত চকচক করছে তার দু’চোখ

‘কী হলো, টনি?’ জানতে চাইল দ্বিতীয়জন।

পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে টনি /স্ক্যালেস। এখন চাইলে হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁয়ে দিতে পারবে জ্যাকি।

‘না, কিছু না, বার্ব,’ আবারও কটেজের দিকে চলল স্ক্যালেস।

প্যান্টের চেইন আটকে কটেজের সামনে গিয়ে থামল অ্যারন কনার। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘রক্তে ভেসে গেছে বারান্দার মেঝে!

তার কথা শুনে পরস্পরের দিকে চেয়ে হাসল দুই যুবক। বসের পিছু নিয়ে আবারও ঢুকে পড়ল কটেজে।

ঝোপ ছেড়ে বেরিয়ে ভীত হরিণীর মত জঙ্গলের দূর থেকে দূরে ছুটল জ্যাকি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *