1 of 3

কালনেমির লঙ্কাভাগ

কালনেমির লঙ্কাভাগ

প্রবাদটির অর্থ হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত আশা করে নিরাশ হওয়া। যা ঘটার সম্ভাবনা নেই এমন ঘটনা ঘটবে বলে আশা করা। অথবা কাজে নামার আগেই লাভের হিসেব করা।

লঙ্কার রাজা রাবণের মামার নাম কালনেমি। রাক্ষসরাজ সুমালীর ঔরসে গন্ধর্বকন্যা কেতুমতীর গর্ভে জন্ম কালনেমি ও রাবণমাতা কৈকসী বা নিকষার। নিকষার গর্ভে বিশ্রবা মুনির ঔরসে জন্ম রাবণ, কুম্ভকর্ণ, শূর্পণখা ও বিভীষণের। রাক্ষস অর্থে এখানে মানুষখেকো রাক্ষস নয়; বরং তারা সাধারণ মানুষের রক্ষাকর্তা হিসেবে সৃষ্ট। তারা ছিল মূলত জলভূমির রক্ষাকর্তা। শাস্ত্রে তাই বলে।

দক্ষের দুই কন্যা দিতি ও অদিতি। তাদের বিয়ে হয়েছিল কাশ্যপ মুনির সাথে। অদিতির গর্ভে দেবতারা এবং দিতির গর্ভে দানবরা জন্মগ্রহণ করে। দিতির গর্ভজাত সন্তানেরা দৈত্য নামে পরিচিত। দিতির একজন পুত্রের নাম ময়দানব। দেবতাদের ঘরবাড়ি, অলঙ্কার, অস্ত্রশস্ত্র বানাতেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। সেরূপ অসুর, দানব তথা সাধারণ সমাজের শিল্পী ছিলেন ময়দানব। ময়দানব রাবণের শ্বশুর অর্থাৎ মন্দোদরীর বাবা।

ময়দানব তৈরি করেছিলেন শক্তিশেল নামক ভয়ঙ্কর এবং বিশাল এক অব্যর্থ অস্ত্র। অষ্টঘণ্টাযুক্ত, বজ্রনিনাদী, মহাবেগবান এবং সর্পজিহ্বার মতো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরণকারী মারাত্মক এই অস্ত্রটি লাভ করেছিলেন রাবণ। লঙ্কার যুদ্ধকালে রাবণপুত্র মেঘনাদকে (ইন্দ্রজিৎ) বধ করেন লক্ষ্মণ। শোকাতুর রাবণ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য লক্ষ্মণের প্রতি নিক্ষেপ করেন ভয়ঙ্কর শক্তিশেল অস্ত্র। মৃতপ্রায় লক্ষ্মণকে বাঁচাতে বানর সেনার সুদক্ষ শল্য-চিকিৎসক সুষেণ (কিষ্কিন্ধ্যাবাসী বানর দলপতি, তিনি তারার বাবা তথা বানররাজ বালির শ্বশুর) হনুমানকে পাঠালেন হিমালয়ের স্বর্ণময় ঋষভপর্বত ও কৈলাসপর্বতের মধ্যস্থিত দীপ্তিমান ঔষধি পর্বত গন্ধমাদনে।

মৃতপ্রায় অচেতন লক্ষ্মণকে বাঁচাতে গন্ধমাদন পর্বতে ছুটলেন হনুমান। ঐ পর্বতের দক্ষিণ শিখর থেকে আনতে হবে বিশল্যকরণী, সুবর্ণকরণী, মৃতসঞ্জীবনী ও সন্ধানী—এই চার প্রকার ভেষজ গাছ। রাক্ষসরাজ রাবণ হনুমানের রওনা হবার খবর পেয়ে তাকে হত্যা করতে মামা কালনেমিকে নিয়োজিত করেন। সেইসাথে রাবণ এ অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন যে, হনুমানকে হত্যা করতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ কালনেমি পাবেন লঙ্কারাজ্যের অর্ধেক ভাগ।

হনুমানকে হত্যার পরিকল্পনা করার আগেই কালনেমি মনে মনে পরিকল্পনা করতে থাকে লঙ্কার কোন্ অর্ধাংশ সে নিবে। তার ভাবনার মধ্যে শুধু লঙ্কাভাগের পরিকল্পনা। কিন্তু হনুমানের মতো বীরের (হনুমান বা বানর হিসেবে রামায়ণে বর্ণিত হলেও এরা শক্তিশালী মানবগোষ্ঠী) সাথে যুদ্ধে কালনেমির কেমন দুর্দশা ঘটতে পারে সে চিন্তা তার মাথায় আসেনি। তার ভাবনায় শুধু লঙ্কার অর্ধেক রাজত্ব লাভের সুখস্বপ্ন।

কালনেমির কৌশল বুঝে গেলেন হনুমান। তাকে গন্ধমাদনের কাছ থেকে ধরে সজোরে শূন্যে নিক্ষেপ করা হলো। নিক্ষিপ্ত কালনেমির দেহ তীরবেগে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়লো রাবণের সিংহাসনে।

মাত্রাতিরিক্ত আশা করে লাভের অঙ্ক হিসেব করার বিষয়ে আমাদের দেশে কালনেমির লঙ্কাভাগের প্রবাদকথা এসে যায়। অসম্ভব ও অসাধ্য বিষয় গণ্য না করে সহজ সমাধানে নিজের লাভ হিসেব করা মানুষ এখনো এদেশে বিরল নয়। কালনেমির কর্মকাণ্ডকে বলা যায়—Counting the chickens before they are hatched.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *