কালনীর কূলে

কালনীর কূলে
প্রথম প্রকাশ – নভেম্বর ২০০১
উৎসর্গ – শাহ নূরজালাল

.

১.

বিসমিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ
প্রশংসা আল্লার
এ বিশ্বের মালিক মৌলা
সে বিনে আর কেবা কার ॥

সেই সে পবিত্রজনে
স্মরণ করি দিল-ইমানে
নুরনবি পাক্‌পাঞ্জাতনে
দরুদ সালাম হাজারবার ॥

নবি ওলি পির গয়গাম্বার
আউলিয়া আম্বিয়া আল্লার
সবার কাছে সালাম আমার
আমি বান্দা গুনাগার ॥

পির মুর্শিদের চরণ ধরে
পিতামাতা ওস্তাদেরে
শ্রদ্ধাভক্তি সহকারে
স্মরণ করি বারেবারে ॥

এই দুনিয়া মায়ায় ঘেরা
অল্প কয়দিন ঘোরাফেরা
যেদিন চলে গেল তারা
খুঁজলে খবর মিলে না আর ॥

মৌলাজির পাকদরবারে
শিষ্য-ভক্ত সহকারে
পানা চাহি করজোড়ে
আমি কাঙাল গুনাগার ॥

আবদুল করিম দীনহীনে
ভরসা রেখেছে মনে
একুল-সেকুল দু-জাহানে
পাইতে রহমত-দিদার ॥

.

২.

ওহে সর্বশক্তি, দাও আমারে মুক্তি
নাই ভাবভক্তি আমি গুনাগার ॥

ভক্তিভরে যেজন তোমারে করে স্মরণ
পুরাও তার আকিঞ্চন, তুমি হও তার
ডাকি সকাতরে দয়া করো আমারে
এ ভবসাগরে করে দাও পার ॥

বিশ্বব্যাপিয়া রয়েছ ছাপিয়া
পাই না খুঁজিয়া তোমার দিদার
প্রতি ঘটে ঘটে তব ধ্বনি ওঠে
হাটে মাঠে ঘাটে শুনি সে ঝংকার ॥

আমি অতি মূঢ়মতি, দয়া কর আমার প্রতি
তুমি যে বিশ্বপতি দয়ার ভাণ্ডার
তব স্নেহভরে আলো-আঁধারে
এ বিশ্বজুড়ে জীব ঘোরে অনিবার ॥

বাউল আবদুল করিম বলে, আশা না পুরাইলে
আশাতে প্রাণ গেলে কলংক তোমার
পাইলে তব দরশন পোরে মম আকিঞ্চন
এই মাত্র নিবেদন চরণে তোমার ॥

.

৩.

আল্লাহ গাফুরুর রাহিম নামে ডাকি তোমারে
ক্ষমা করো তুমি আমারে।
ভুল করেছি পদে পদে দরবারে
ক্ষমা করো তুমি আমারে ॥

রিপুর বশে কত করেছি গুনা
কবিরা সগিরা আর জানা-অজানা
করজোড়ে চাহি ফানা নতশিরে–
ক্ষমা করোল তুমি আমারে ॥

দয়া করে তুমি নিজে বলিলা
লা তান্নাতু মির রহমতুল্লা
আশ্বাসবাণী দিলা সবারে–
ক্ষমা করো তুমি আমারে ॥

ইন্নাল্লাহা মাআসোবিরিন রয়েছে বাণী
সবুরেতে মেওয়া ফলে অন্তরে জানি
আবদুল করিম সেই বাণী বিশ্বাস করে–
ক্ষমা করো তুমি আমারে ॥

.

৪.

দয়াল তুমি রাহমান রাহিম
দয়া করো ক্ষমা করো
তুমি আহকামুল হাকিম ॥

পড়িয়া এই ভবের ধাঁধায়
জীবন আমার বিফলে যায়
তুমি বিনা আমি অসহায়
এই ভবে হলেম এতিম ॥

তালাচাবি তোমার কাছে
আমার বলতে কী ধন আছে
তোমার খাইয়া জীবন বাঁচে
আমি যে চির খাদিম ॥

রাখো চরণ ছায়াতলে
দিও না দূরে ঠেলে
তুমি দয়াল আপন হলে
আর কিছু চায় না করিম ॥

.

৫.

বিশ্বপতি খোদা তোমার
মহিমা অপার
রাখো-মারো ভাঙো-গড়ো তুমি বিনে কেবা কার ॥

সবাই দেখি যার-তার ভাবে
এ জগতের সৃষ্ট জীবে
নামের মহিমা সবে
গাইতেছে অনিবার ॥

নামের ধ্বনি সর্বস্থানে ওঠে
বিরাজ করো প্রতি ঘটে
কুদরতে বুদ্ধি না খাটে
ভাবিলে নাই কূলকিনার ॥

স্বর্গ-মর্ত-আকাশ-পাতালে
আলো-আঁধারে কি অনল-অনিলে
কুল্লেশাইন মোহিত তুমি
অখণ্ড মণ্ডলাকার ॥

মন মজাও হে তোমার প্রেমে
নাম যে স্মরি দমে দমে
কয় বাউল আবদুর করিমে
ঘোচাও মনের অন্ধকার ॥

.

৬.

দয়াল নাম শুনিয়া
আশায় আছি চাইয়া
দয়ার বলে নেও না কোলে
কাঙাল জানিয়া ॥

জমি বাড়ি টাকা কড়ি
এই সমস্ত লইয়া
কামিনী-কাঞ্চনের নেশায়
আছি বন্দি হইয়া ॥

জালে বন্দি মীন বাঁচবে কয়দিন
জল গেলে শুকাইয়া
বেলা গেলে সন্ধ্যা হলে
আঁধার যাবে হইয়া ॥

ভাই-বন্ধুগণ কেউ নয় আপন
দেখি যে ভাবিয়া
সবাই একদিন যাইতে হবে
এই সমস্ত থইয়া ॥

আমি-বা কার কেবা আমার
পাই না যে খুঁজিয়া
করিম কাঁদে ঠেকছি ফাঁদে
আগে না বুঝিয়া ॥

.

৭.

দয়া করো দয়াল তোমার দয়ার বলে
কী দিয়া সেবিবে চরণ কাঙালে
জীবন-সাফল্য তোমায় পাইলে–
কী দিয়া সেবিবে চরণ কাঙারে ॥

কত ধনী-মানী জ্ঞানী-গুণী তোমার আশায়
বাদশাহি ছাড়িয়া কেহ জঙ্গলায়
পাইতে তোমায় জীবন-যৌবন দিয়াছে ঢেলে–
কী দিয়া সেবিবে চরণ কাঙালে ॥

রাবেয়া সঁপিয়া দিলেন দেহ-প্রাণ-মন
বলকের ইব্রাহিম ছাড়েন সিংহাসন
ওয়াসকরনি প্রেমিক সুজন জঙ্গলে–
কী দিয়া সেবিবে চরণ কাঙালে ॥

আবদুল করিম বলে তোমার আশা করে
ফরিদ উদ্দিন ছয়ত্রিশ বৎসর অনাহারে
মনসুর শুল্লিতে চড়ে হক নাম বলে–
কী দিয়া সেবিবে চরণ কাঙালে ॥

.

৮.

জন্মিয়া শুনেছি ভবে তুমি আছ
তুমি চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা
আকাশ বাতাস সৃজিয়াছ ॥

এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড গড়ে
জীবসমষ্টি সৃষ্টি করে
প্রাণের প্রাণ হয়ে পরে
মিছরিতে মিঠা সেজেছ ॥

ছয় রিপুর যন্ত্রণায় পড়ে
ঘুরছে জীব এই সংসারে
ধর্মাধর্ম বিচার করে
কয়জনকে সে-জ্ঞান দিয়াছ ॥

মসজিদ-মন্দির-গির্জাঘরে
কেউ খোঁজে জঙ্গল-পাহাড়ে
আবদুল করিম বিশ্বাস করে
আমাতে তুমি রয়েছ ॥

.

৯.

এ জগতে ডাকে তোমায়
কত ভাবে কত জনে
কেহ ডাকে তন্ত্রেমন্ত্রে
কেহ ডাকে আকুল প্রাণে ॥

তুমি বলেছ নাকি
যে ডাকে তার কাছে থাকি
তাই তো এত ডাকাডাকি
নইলে ডাকবে কী কারণে ॥

বসিয়া ধর্মশালাতে
ডাকে যার যে বিধানমতে
সাড়া দাও কার ডাকেতে
সেই খবর কেউ না জানে ॥

এই যে দুনিয়াদারি
কেউ ভেবেছে স্বর্গপুরী
হয়ে তোমার প্রেমভিখারি
ঘর ছেড়ে কেউ গেল বনে ॥

হয়ে তোমার প্রেমরোগী
যে হয়েছে সর্বত্যাগী
আছ তুমি তাহার লাগি
আবদুল করিম পাই কেমনে ॥

.

১০.

তোমার খেলা বুঝে উঠা ভার
খেলা কী চমৎকার
তোমার খেলা বুঝে উঠা ভার।
অন্তর্যামী আছ তুমি
এই বিশ্ব ভুলের ভূমি
আমি নয় তুমি সর্বসার–
খেলা কী চমৎকার ॥

তোমার ইচ্ছায় এ সংসারে
সৃজিলে আদম-হাওয়ারে
বসাইতে এই ভবের বাজার।
আদম গড়া হলে পরে
আদমকে সজিদা করে
ফেরেস্তাগণ হুকুমে তোমার ॥

লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু জানি
তোমাকে মুনিব মানি
আদম হলো মাটির তৈয়ার।
মকরম এই বির্তক করে
রইল সে দূরে সরে
লান্নতের তক্ত গলে তার ॥

আদমের কালবে ছিলা
ফেরেস্তার সজিদা নিলা
বুঝিয়া মকরম গুনাগার।
সব ফেরেস্তার মাস্টার
ছিল হিংসার ফলে লান্নত নিল
করিম বলে করে অহংকার ॥

.

১১.

ডাকলে দয়া করো বলে
সকলের জানা
তাই তো এত ডাকাডাকি
সবাই চায় তোমার করুণা ॥

মকরম তোমার ভক্ত ছিল
ফেরেস্তার মাস্টারি নিল
একটি কথায় গোল বাঁধিল
রেহাই দিলায় না ॥

হুসেনকে কারবালাতে
নিদারুণ পিপাসাতে
এক বিন্দু পানি দিতে
কে করলো মানা ॥

নাম দিয়াছ দয়াল বলে
শিশু মরে মায়ের কোলে
পাষাণে মাথা ভাঙ্গিলে
দয়া করো না ॥

গরিব কাঙাল দুঃখীজনে
দয়া মাগে নিশিদিনে
দুঃখ বাড়ে দিনে-দিনে
মিছে ভাবনা ॥

দয়া যদি না করিবে
দয়াল নাম তোর মুছে যাবে
নইলে পাপী উদ্ধার পাবে
কিসের ভাবনা ॥

কোনো দিন তোমার দয়ায়
পাপী যদি উদ্ধার পায়
আবদুল করিম বলে তোমায়
পুরবে আমার মনোবাসনা ॥

.

১২.

দয়াল বলে ডাকে তোমায় কাঙালে
মুক্ত করে দাও গো দয়াল
বন্দি আছি মায়াজালে ॥

তুমি যে হও জগৎস্বামী
তুমি সবার অন্তর্যামী
এই আবেদন করি আমি
পাই যেন অন্তিমকালে ॥

যখন যে বিপদে পড়ে
তার ভাষায় সে স্মরণ করে
প্রাণ খুলে যে বলতে পারে
নিজের ভাষায় বলিলে ॥

বিফলে জীবন চলে যায়
উদ্ধারিয়া লও গো আমায়
বাংলাভাষাতে তোমায়
বলে করিম বাঙালে ॥

১৩.

আমি কী করিব রে
প্রাণনাথ তুমি বিনে
সোনার অঙ্গ পুড়ে আঙ্গার
হলো দিনে-দিনে রে
প্রাণনাথ তুমি বিনে ॥

আসা-যাওয়া সার হয়েছে
নিয়তির বিধানে
জন্ম-জরা-যমযাতনা
সব তোমার অধীনে রে
প্রাণনাথ তুমি বিনে ॥

আশেক যারা জানে তারা
মন দিয়া মন কিনে
প্রেমসাগরে বাইলে বঁড়শি
ধরে রসের মীনে রে
প্রাণনাথ তুমি বিনে ॥

চির-অপরাধী আমি
বাঁধা আছি ঋণে
তোমার কাছে ক্ষমা চাহে
করিম দীনহীনে রে
প্রাণনাথ তুমি বিনে ॥

.

১৪.

নবির ভেদ কে জানতে পারে
জানি মনপ্রাণে এ তিনভুবনে
নবির সমান খোদায় কেউরে না করে ॥

আপে সাঁই নিরঞ্জন প্রেমেরই কারণ
নবিকে করলেন সৃজন আপনার নুরে
আপে পরোয়ারে আদর করে
দোস্ত বলে ডাকলেন যারে ॥

সেতারার ছিলেন সাজ হজরত আলী মাথার তাজ
দুই ইমাম কানের দুল-দুল ছিলেন দু-ধারে
মা জহুরা গলার হার ছিলেন কী বাহার
ছিলেন নবি আরশ-উপরে ॥

সাজরাতুল একিনে অতিশয় গোপনে
ছিলেন নবিজি ময়ুর-আকারে
সামনে আয়না ধরে পা রাব্বানা
রুহুগণের সৃজন করে ॥

আওয়ালে আহাদ দুওমে আহাম্মদ
ছিয়মে মোহাম্মদ নামটি ধরে
আবদুল করিম বলে এ ভূমণ্ডলে
প্রকাশ হলেন নবি মক্কা শহরে ॥

.

১৫.

সর্বধনে ধনী তুমি
আমি যে কাঙাল
আউলিয়া শাহজালাল ॥

পাক নুরেতে নুরনবি
সেই নুরে তোমার ছবি
প্রশংসা কী বলবে কবি
ভাবিয়া বেহাল—
আউলিয়া শাহজালাল ॥

ছিলা তুমি ইয়ামনি
অমূল্য পরশমণি
তুমি যে রহমতের খনি
কুদরত কামাল—
আউলিয়া শাহজালাল ॥

এ দেশবাসীর ভাগ্য ভালো
আঁধারে পাইল আলো
ভক্তগণে লুটে নিল
প্রেম ভাণ্ডারের মাল—
আউলিয়া শাহজালাল ॥

পাগল আবদুল করিম বলে
আশায় জীবন গেল চলে
দয়ালের দয়া হলে
ভয় কী একাল-সেকাল—
আউলিয়া শাহজালাল ॥

.

১৬.

ইয়ামন হতে আইলায় দয়াল
শাহজালাল আউলিয়া
যুগের আঁধার মাঝে
নুরের আলো জ্বালাইয়া ॥

আউলিয়া পরশ জানি
নায়েবে রাসুল মানি
আশেকের শিরোমণি
তুমি গুণে গুণিয়া ॥

প্রেমিকজনে প্রেমখেলায়
আমি আছি ভবজ্বালায়
উদ্ধারিয়া লও না আমায়
প্রেমের নৌকায় তুলিয়া ॥

আশেক-প্রেমিক-ভক্তগণে
শান্তি পায় গুণগানে
আবদুল করিম দীনহীনে
কাঁদে জনম ভরিয়া ॥

.

১৭.

শাহজালাল ইয়ামনি ওলির দরবারে
কত রঙের মানুষ আসে প্রেমের বাজারে ॥

বাসনা-কামনা নিয়া রোগী-ভোগী সব মিলিয়া
দয়া চায় হাত তুলিয়া, সকাতরে ॥

ভালো মানুষ আসে যারা ভালো ভালো পোষাক পরা
আতর-গোলাপ ছিটায় তারা জিয়ারত করে ॥

ফকির যারা নাম ধরেছে অন্য এক ভাবে পড়েছে
কেউ গায় কেউ নাচে কেউ জিকির পড়ে ॥

আরেক দল ফকিরের ধারা গান করেন যন্ত্র ছাড়া
পাক-পবিত্র হয়ে তারা বসেন উপরে ॥

আমি সবার কাছে যাই, আমি সবার করিম ভাই
আমার কোনো বিভেদ নাই আমার বিচারে ॥

.

১৮.

ওগো শাহপরান আউলিয়া
এই দেশে আসিলায়
কী ধন সঙ্গে নিয়া ॥

কী ধন দিতে কী ধন নিতে
কী মনে ভাবিয়া
জন্মস্থান ছেড়ে আইলায়
সর্বত্যাগী হইয়া ॥

মজাররদে ওলি তুমি
তুমি গুণে গুণিয়া
দুই কুলের বাদশাহ হলে
কোন পরশ পাইয়া ॥

প্রেমিক ভক্ত আশেক যারা
তোমার নাম শুনিয়া
দরগা জিয়ারতে আসে
দেওয়ানা হইয়া ॥

না দেখিয়া না চিনিয়া
মনে আশা নিয়া
ভক্তগণ কাঁদে তোমার
দরবারে বসিয়া ॥

করিম বলে আছ তুমি
লা-মউত হইয়া
দাও তোমার রহমতের ছায়া
কাঙাল জানিয়া ॥

.

১৯.

ওগো আল্লার ওলি শাহপরান
দয়াল বলে ভক্ত সবাই
গায় যে তোমার গুণগান—
আল্লাহর ওলি শাহপরান ॥

শাহজালালের সঙ্গী হলে
মুখে আল্লা-আল্লা বলে
সিলেটে আসিলে চলে
ছেড়ে দিয়ে জন্মস্থান–
আল্লার ওলি শাহপরান ॥

ভোগী নয় ত্যাগী জানি
তাই তো দিল-ইমানে মানি
দূর করে দাও পেরেশানি
করো তোমার দয়া দান–
আল্লাহর ওলি শাহ পরান ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
দয়াল তোমার দয়া হলে
ইহকাল-পরকালে
পাইব রহমত আসান–
আল্লার ওলি শাহপরান ॥

.

২০.

খাজা তোমার নামের ধ্বনি
জগৎ জুড়ে শুনতে পাই
সবাই তোমায় ভালোবাসে
হিন্দু-মুসলিম প্রভেদ নাই ॥

চিশতিয়া তরিকা তোমার
আজমিরে রয়েছে মাজার
ভক্তগণের প্রেমের বাজার
প্রেমসাগরে খেলে লাই ॥

হয়ে তোমার প্রেমে পাগল
আশেকে গায় প্রেমের গজল
আছে এতে আসল-নকল
ভক্তি বিনা মুক্তি নাই ॥

পড়ে ছয় রিপুর কবলে
এ জনম গেল বিফলে
বাউল আবদুল করিম বলে
আমি তোমার দয়া চাই ॥

.

২১.

পিরানে পির আমার
আব্বাস ক্বারি নাম যাঁহার
হাজারো সালাম আমার
সেই চরণে ॥

চরমহল্লা সাধকপুর
ভক্তজনের মনচোর
কাটিয়া মায়ার ডোর
রইলেন গোপনে ॥

আউলিয়া-সরদার করে
ভেজিলেন পরোয়ারে
স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে
দিল-ইমানে ॥

পদছায়া যে পাইবে
সর্বধনে ধনী হবে
অনায়াসে তরে যাবে
জিয়ন মরণে ॥

আমি কাঙাল দীনহীন
আমায় না বাসিও ভিন
ভাব ভক্তির নাহি চিন
পাব কেমনে ॥

ধন্য মৌলা আব্বাস ক্বারি
প্রেমবাগান তৈয়ার করি
ফুল ফুটাইলেন সারি সারি
সেই বাগানে ॥

আশেক ভ্রমরা যারা
মধুপানে লিপ্ত তারা
হয়ে আমি সর্বহারা
বাঁচি কেমনে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
দয়াময় নাম সম্বলে
অকূলে কূল পাব বলে
ভরসা মনে ॥

ধরছি পাড়ি একেলা
আকাশে নাই রে বেলা
ভরসা মুর্শিদ মৌলা
এই নিদানে ॥

.

২২.

প্রাণের প্রাণ মুর্শিদ আমার
মৌলা বক্স নাম যাহার
চরণেতে জানাই আমি
সালাম হাজার হাজার ॥

যুগের শেষে এসে যখন
জন্ম নিলেন এ ধরায়
জেলা হয় সুনামগঞ্জ
জন্মস্থান হয় উকারগাঁয়
শরিয়তে পায়বন্দ ছিলেন
তরিকতের রাহাদার
সুফি সাধক ছিলেন
মারিফত করে বিচার ॥

শিষ্য ভক্ত আশেকগণ
সবারে করে কাঙাল
তেরোশো আটান্ন সনে
করলেন তিনি ইন্তেকাল
নূরের বাতি নিভে যেদিন
হয়ে গেল অন্ধকার
আষাঢ় মাসের নয় তারিখ
ছিল সেদিন রবিবার ॥

ভক্তবৃন্দ আছে কত
করে সদা গুণগান
খাঁটি প্রেমের প্রেমিক যারা
তাদের জন্য বর্তমান
বাউল আবদুল করিম বলে
ইজ্জতে আশেক সবার
ইহকাল পরকালে
পাইতে রহমত দিদার ॥

.

২৩.

মরি হায় হায় রে গুণগান গাই
মৌলা বক্স মুন্সি সাহেবের
গুণের সীমা নাই–
মরি হায় হায় রে ॥

ধন্য মৌলা বক্স মুন্সি
উকারগ্রামে বাড়ি
কলির যুগে করে গেলেন
আশ্চর্য ফকিরি—
মরি হায় হায় রে ॥

শরিয়তে পায়বন্দ ছিলেন
মারিফতে রাজা
কীভাবে কী করে গেলেন
যায় না কিছু বোঝা–
মরি হায় হায় রে ॥

ভক্তবৃন্দ আছে যারা
গুণগান করে
উরুস মোবারক হয়
বৎসরে বৎসরে–
মরি হায় হায় রে ॥

চরণেতে জানাই আমি
হাজারো সালাম
বাউল আবদুল করিম যার
চরণের গোলাম–
মরি হায় হায় রে ॥

২৪.

আউলিয়া ইব্রাহিম মস্তান
মোকাম শ্রীপুর
ভক্ত হলে কাছে মিলে
নইলে বহুদূর ॥

না জানি কী ভেবেছিলেন
ঘরবাড়ি ছাড়িয়া দিলেন
বন-জঙ্গল কত ঘুরিলেন
কাটিয়া মায়ার ডোর ॥

প্রেমের মালা দিয়া গলে
আধ্যাত্মিক সাধনার বলে
রঙবেরঙের খেলা খেলে
ভক্তজনের মনচোর ॥

অটল পুরুষ মহামতি
পির বলে রয়েছে খ্যাতি
চেহারায় চান্দের জ্যোতি
পেশানিতে ভাসে নুর ॥

মনে সদা এই আকিঞ্চন
পাইতে সে রাঙা চরণ
স্বরূপে হইলে মিলন
দুঃখের নিশি হবে ভোর ॥

পির মুর্শিদের আশ্রয় নিলে
অকূলেতে কূল মিলে
বাউল আবদুল করিম বলে
আমি হই এক দিনমজুর ॥

.

২৫.

তোরা আও আও রে
আশেক ভক্ত ভাই
ইব্রাহিম মস্তান সাহেবের
গুণগান গাই ॥

বিশ্বনাথ থানায় বাড়ি
শ্রীপুরে বাসা
পশ্চিম দিকে হাসন রাজার
রঙের রামপাশা ॥

হাসন রাজা ছিলেন একজন
মরমি কবি
ইব্রাহিম মস্তান হলেন
মারিফতের ছবি ॥

চেহারায় নুরের জ্যোতি
দেখতে মনোহর
বনজঙ্গলে ঘুরলেন কত
ছেড়ে বাড়ি ঘর ॥

কী চাহিলেন কী পাইলেন
এই ভাবনা করি
কলির যুগে করে গেলেন
আশ্চর্য ফকিরি ॥

ইব্রাহিম মস্তান হলেন
মজাররদে ওলি
জামানা আখেরি রে ভাই
এসেছে ঘোর কলি ॥

মুর্শিদ মৌলা বক্স মুন্সি
দিল-ইমানে জানি
ইব্রাহিম মস্তান সাহেবকে
পির বলিয়া মানি ॥

ভক্তবৃন্দ আছে যারা
গুণগান করে
উরস মোবারক হয়
বৎসরে বৎসরে ॥

আমি রইলাম অন্ধকারে
তারা পাইল আলো
বাউল আবদুল করিম বলে
ভাগ্য যাদের ভালো ॥

.

২৬

মুর্শিদের কাছে আমি কেন যাই
কার কাছে কী বলিব
কেন তার গুণগান গাই ॥

আমি হলেম চিররোগী
ভব-ব্যাধিতে ভুগি
হয়েছি দোষের ভাগী
কত মন্দ শুনি তাই।
মুর্শিদের আশ্রয় নিলে
মনপ্রাণ বিকাইয়া দিলে
ভবব্যাধির ঔষধ মিলে
এছাড়া আর উপায় নাই ॥

মুর্শিদ আঁধারের বাতি
ভক্তজনের চিরসাথি
ঔষধ হোমিওপ্যাথি
খাইলে রয় না রোগ বালাই
অভক্ত তার কাছে যায় না
তাই তো সে সন্ধান পায় না
দয়াল সে-জন পয়সা চায় না
বিনামূল্যে ঔষধ পাই ॥

ঔষধ নয় সুধা যাচে
সুধা মিলে প্রেমের গাছে
ভক্তজন খেয়ে বাঁচে
অভক্তের কপালে ছাই।
সর্বহারা হয়ে পরে
আবদুল করিম চিন্তা করে
মুর্শিদের চরণ ধরে
স্বরূপে রূপ দেখতে চাই ॥

.

২৭

মুর্শিদের প্রেমবাজারে
কে যাবে রে আয়
যেতে যদি হয় বিলম্ব নয়
চল যাই সকালবেলায় ॥

মনে মনে যোগ পড়িলে
সময়ে রাস্তা ধরিলে
সুজনের সঙ্গ করিলে
সুবাতাসে প্রাণ জুড়ায় ॥

সেই বাজারে যারা যাবে
মন্ত্র নয় মন্ত্রণা পাবে
বেচা-কেনা ভাবে-ভাবে
বিনা মূল্যে মাল বিকায় ॥

পঞ্চরসের রসিক হলে
মিশে যায় পাগলের দলে
বাউল আবদুল করিম বলে
আমার দিন বিফলে যায় ॥

.

২৮

লাইলাহা ইল্লাল্লাহ মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ
নামের মালা জপ না
ঐ নাম করো সার, ঘুচিবে আঁধার
সময় গেলে আর হবে না ॥

স্বরূপে সাধন, শুদ্ধ করো মন
মুর্শিদের চরণ ভজ না।
দমের কোঠায় দিয়া তালা
ঐ নাম জপ নিরালা
ত্রিতাপ জ্বালা রবে না ॥

নামে আছে প্রেমসুধা
খাইলে রয় না ভবক্ষুধা
আপন হতে খোদা জুদা ভেব না
পরশে পরশ মিলে হয় সরস
ক্বালবে আরশ মক্কা মদিনা ॥

বন্দি হয়ে মায়াজালে
জীবন গেল বিফলে
প্রেমসাগরের অতল জলে ডুব দিলে না
খুঁজলে পাবে দেখা কোথায় প্রাণসখা
আবদুল করিম বোকা, বোঝে না ॥

.

২৯.

দমে দমে পড় জিকির
লাইলাহা ইল্লাল্লাহ
নাম ছাড়া দম ছাড় যদি
ঠেকবে হিসাবের বেলা ॥

একুল সেকুল দুজাহানে
তরে যাবে নামের গুণে
টের পেয়েছে আশেকগণে
কোন কলে খেলে মৌলা ॥

মুর্শিদের আওয়াজের বলে
বালকের ক্বলব খোলে
দমের কোঠায় চাবি দিলে
দেখবে রে নুরের খেলা ॥

বন্দি হয়ে মায়াজালে
ভবের জনম যায় বিফলে
বাউল আবদুল করিম বলে
ভরসা মুর্শিদ মৌলা ॥

.

৩০

আল্লাহর নাম লইলাম না রে
ও মন ভুলে পড়ে
ও নাম লইলাম না লইলাম না
লইলাম না রে ॥

আল্লাহ আল্লাহ বল মন রে
আল্লাহ কর সার
নামের গুণে হইতে চাই
ভবসিন্ধু পার ॥

তনের মাঝে আল্লা-নবি
নাহি হয় ভিন
সময় থাকিতে মন
তুই তোরে চিন ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
মন পবিত্র করো
এক নামে তরিয়া যাইতাম
কিবা ছোটো-বড় ॥

.

৩১

প্রাণনাথ হে
মনপ্রাণ তোমারে দিলাম না।
ভবমায়ায় ভুলে আমি
তোমার খবর নিলাম না–
মনপ্রাণ তোমারে দিলাম না ॥

শিশুকালে ছিলাম ভালো
আদরে মায়ের কোলে
যৌবনে মায়ার বাঁধনে
পড়িয়াছি গোলমালে
ভবসাগরের অতল জলে
কূল-কিনারা মিলে না ॥

তুমি স্রষ্টা তোমার সৃষ্টি
তুমি তো জগতের মূল
তুমি যারে করো দয়া
অকূলে তার মিলে কূল
দরবারে করে থাকি ভুল
করো তুমি মার্জনা ॥

বেলা গেল সন্ধ্যা হলো
পড়িয়াছি বিপাকে
জাহাজ নৌকা ঐ নদীতে
ডুবেছে লাখে লাখে
পড়ে নদীর ঘূর্ণিপাকে
ডুবলে কেউ আর ভাসে না ॥

দয়াময় নামটি তোমার
রয়েছে জগৎ জুড়ি
বাউল আবদুল করিম তোমার
স্নেহ-দয়ার ভিখারি
বাঁচি কিবা ডুবে মরি
তোমায় যেন ভুলি না ॥

.

৩২

কাঙালের বন্ধু রে
কাঙাল জেনে দয়া কর মোরে
আশায় নিরাশ করিও না
বলি করজোড়ে ॥

আকাশে নয় পাতালে নয়
নহে তুমি দূরে
স্বরূপেতে আছ জানি
ভক্তের অন্তরে ॥

কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ
সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে
ভাণ্ডারের ধন করে হরণ
নিল মদনা চোরে ॥

কামসাগরে ছাড়লাম তরী
যৌবনের আষাঢ়ে
রিপুর বশে বশী হয়ে
পড়লাম ঘোর আঁধারে ॥

সঙ্গীহারা অধর্মরা
কে রাখবে আদরে
কালনী নদীর তীরে করিম
আছে কুঁড়েঘরে ॥

.

৩৩

নাম সম্বলে ছাড়লাম তরী
কূল দাও কি ডুবিয়া মরি ॥

তুমি কাঁদাও তুমি হাসাও
তুমি ডুবাও তুমি ভাসাও
তুমি মার তুমি বাঁচাও
ভাঙাগড়া সব তোমারই ॥

পড়ে দয়াল ঘোর বিপদে
ভার দিয়াছি তোমার পদে
পাড়ি দাও নির্বিবাদে
তুমি নিজে হও কাণ্ডারি ॥

আবদুল করিম ভাবছে এবার
মিছে কেবল আমার আমার
নৌকা তোমার পুঁজি তোমার
আমি তোমার সব তোমারই ॥

.

৩৪

ডাকছে কাঙাল ওগো দয়াল
কেমন করে যাই ওপারে
আর কতদিন থাকবো দয়াল
এই ভব কারাগারে ॥

আমি বা কার কেবা আমার
আপন আমি বলবো কারে
কত আমি চলে গেল
খুঁজলে কি আর মিলে তারে ॥

গেলে কেউ ফিরে আসে না
ডুবলে তরী আর ভাসে না
সুখ-দুঃখে কাঁদে-হাসে না
কেউ কি তারে রাখতে পারে ॥

সম্পর্ক সব ছেড়ে দিয়া
যায় যে চির বিদায় নিয়া
আবদুল করিম কয় ভাবিয়া
স্মৃতি থাকে এই সংসারে ॥

.

৩৫

কও গো দয়াল
এখন আমার কী গতি
বেলা গেল সন্ধ্যা হলো
কেউ নাই মোর সঙ্গের সাথি ॥

একাকী চলেছি পথে
সামনে আঁধার রাতি
নির্ধনের ধন পরশরতন
তুমি আঁধারের বাতি ॥

কেউ বলে দয়াল দাতা
কেউ বলে জগৎপতি
করিম বলে তুমি আমার
দেহরথের সারথি ॥

.

৩৬

অকূলে পড়িয়া ডাকি
ওগো দয়াময়
তোমার আশা নাম ভরসা
আমার যে আর কিছু নয় ॥

পড়ে আছি ঘোর আঁধারে
আর আমি ডাকিব কারে
তুমি থাকতে ভবপারে
কাঙালের কিসের ভয় ॥

দয়াময় নামটি ধরো
বাঁচাও মারো ভাঙো গড়ো
সকলই যে তুমি করো
সৃষ্টি এবং স্থিতি-লয় ॥

দয়া করো বলে তুমি
দয়াল বলে ডাকি আমি
তুমি যে জগৎস্বামী
তুমি দয়াল বিশ্বময় ॥

মহা অপরাধী আমি
বলব কী সব জানো তুমি
তুমি সবার অন্তর্যামী
বাউল আবদুল করিম কয় ॥

.

৩৭

আল্লার বাড়ি মক্কাশরিফ
বোঝে না মন পাগলে
ব্যক্তি নয় সে শক্তি বটে
আছে আকাশ-পাতালে ॥

খোদে খোদা প্রতি ঘটে
আল্লা আছে বিশ্বময়
ক্বালবে মোমিন আর্শে আল্লা
হাদিসে তার প্রমাণ রয়
কী করে পাই তার পরিচয়
নিজে শুদ্ধ না হলে ॥

আল্লা-নবি কী বলেছেন
এই হলো আসল বিষয়
শা-রগ হতে আরও কাছে
বলছেন আল্লা দয়াময়
তাহলে সবার মধ্যে রয়
বিচার করো আসলে ॥

সে যে হয় দয়াল দাতা
নাম রাহমানুর রাহিম
কাঙালকে করেন দয়া
আমি গুনাগার আজিম
বলে বাউল আবদুল করিম
বন্দি আছি মায়াজালে ॥

.

৩৮

আসল কাজে ফাঁকি দিয়া রে
মন তুই আর চলিবে কতদিন
শোধ হলো না মহাজনের ঋণ ॥

মন রে, ভবের বাজারে আইয়া
ছয় রিপুর সঙ্গ পাইয়া রে
কামিনী কাঞ্চন চাইয়া রে
মন তোর আপনজন বাসিলে ভিন ॥

মন রে, চিন্তা করে দেখতে হবে
কেউ তো রইল না ভবে রে
একা একদিন যাইতে হবে রে
মন তোর সঙ্গী নাই কেউ যাবার দিন ॥

মন রে, বাউল আবদুল করিম ভাবে
কেন বা আসিলাম ভবে রে
ভবের জনম বিফল যাবে রে
আমার মনপাগলা বড় কঠিন ॥

.

৩৯

মন পাগলা তুই লোকসমাজে
লুকি দিয়ে থাক
মনমানুষ তোর মনমাঝে
আছে রে নির্বাক ॥

মনে মনে করো ভাবনা
সঙ্গী বিবেক বিবেচনা
মন না দিলে মন মিলে না
দিয়ে হাজার লাখ ॥

লাগে না তো ডাকাডাকি
তোর সঙ্গে তার মাখামাখি
পিঞ্জিরাতে প্রেমের পাখি
যত্ন করে রাখ ॥

অন্তর্যামী আছে যেজন
সে জানে তোর অন্তর কেমন
চায় না বাহিরের আবরণ
বাহিরের পোষাক ॥

স্মরণে চরণ মিলে
বাউল আবদুল করিম বলে
আশেক হলে মাশুক মিলে
ডাকে নাই যার ফাঁক ॥

.

৪০

ভবসাগরের নাইয়া
মিছা গৌরব করো রে
পরার ধন লইয়া।
একদিন তোমার যাইতে হবে।
এই সমস্ত থইয়া রে
পরার ধন লইয়া ॥

পরার ঘরে বসত করো
পরার অধীন হইয়া
আপনি মরিয়া যাইবায়
এই ভব ছাড়িয়া রে
পরার ধন লইয়া ॥

কী ধন লইয়া আইলায় ভবে
কী ধন যাইবায় লইয়া
ভবে আইয়া ভুলিয়া রইলায়
ভবের মায়া পাইয়া রে
পরার ধন লইয়া ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
মনেতে ভাবিয়া
মন্ত্র না জানিয়া ঠেকলাম
কালসাপিনী লইয়া রে
পরার ধন লইয়া ॥

মামাঝি তোর মানবতরী
ভবসাগরে ভেসে যায়
বেলা গেলে সন্ধ্যা হলে
পাড়ি দেওয়া হবে দায় ॥

যারা সুজন বেপারি
সুসময়ে ধরে পাড়ি
দয়াল নামে গেয়ে সারি
অনুরাগের বৈঠা বায় ॥

ভবসাগরের পাকে পড়ে
কেউ বাঁচে কেউ ডুবে মরে
ভক্তজনে আশা করে
অকূল কূল পাইতে চায় ॥

সামনে আঁধার রাতি
কেউ নহে কার সঙ্গের সাথি
মুর্শিদ ইমানের বাতি
যেজনে সেই পরশ পায় ॥

.

৪২

ও মনমাঝি রে
অকূল সাগরে তোমার নাও
অকূলেতে কূল মিলিবে
মুর্শিদ যদি পাও ॥

ছয় রিপুকে বাধ্য করে
প্রেমের বৈঠা বাও
ভাঙা তরী বিপদ ভারি
সাবধানে চালাও ॥

ভালো-মন্দ বলুক লোকে
করিও না রাও
করিম বলে প্রাণ সঁপে দাও
মুর্শিদের পাও ॥

.

৪৩

মন মুসল্লি ভাই
শরিয়তে আছ তুমি
তরিকতে নাই
তরিকতে নাই
তুমি হকিকতে নাই ॥

হকিকতের হক বিচারে
মন পবিত্র হলে পরে
দেখতে পাবে আপন ঘরে
আল্লা আলেক সাই ॥

হও যদি খাঁটি মুসলমান
বাহির-ভিতর করো সমান
যে হবে মুনাফিক নাদান
নরকে তার হবে ঠাঁই ॥

আসা-যাওয়া করে দমে
দিনে দিনে আয় কমে
কয় বাউল আবদুল করিমে
মরণকালে চরণ চাই ॥

.

৪৪

হিংসাখোরগণ বলে এখন
আবদুল করিম নেশাখোর
ধর্মকর্মের ধার ধারে না
গানবাজনাতে রয় বিভোর ॥

হিংসা অহংকার করা
মোমিনের কর্তব্য নয়
আদমকে হিংসা করিয়া
মকরম আবেদ শয়তান হয়
বুঝিতে হয় আসল বিষয়
হিংসা নিন্দা করে দূর ॥

হিংসাখোরগণ ধার্মিক নয়
করে দেখো সুবিচার
অহিংসা পরম ধর্ম
জ্ঞানী বলেন বারেবার
আল্লা-রাসুলের বাজার
কেউ ধনী কেউ দিনমজুর ॥

মসজিদকে খোদার ঘর বলি
মন্দির ভগবানের ঘর
আসলে খোদার আরশ
হয় মোমিনের অন্তর
যে করে তার নিজের খবর
আমি বলি সে চতুর ॥

মানুষের সঙ্গ করিলে
মানুষ তখন মানুষ হয়
জন্ম-জরা-যমযাতনা
থাকে না তার কোনো ভয়
বাউল আবদুল করিমে কয়
নয়ন রাখো মাশুকপুর ॥

.

৪৫

এয়ার কন্ডিশন মেশিন আছে
মায়ের কাছে
মাইয়ায় কেউরে হাসায়
কেউরে কাঁদায়
কলের পুতুল কলে নাচে ॥

চুম্বকে করে আকর্ষণ
পুরুষের ধন করে হরণ
শীত-গরম করে নিয়ন্ত্রণ
মানুষ তৈয়ার করিতেছে ॥

স্রষ্টার যে সৃষ্টিধারা
এই ভবে আসিল যারা
মায়ের গর্ভে সবাই গড়া
এতে কি আর দ্বিমত আছে ॥

মাইয়াতে রয়েছে শান্তি
ঠিক করে নেও ভাবকান্তি
দূর হলো যার ভুল-ভ্রান্তি
আঁধারে আলো জ্বলেছে ॥

ব্যভিচার করবে যারা
জবাবদিহি হবে তারা
আবদুল করিম বুদ্ধিহারা
কী হবে তাই ভাবিতেছে ॥

.

৪৬

আগে বাইদ্যার সঙ্গ না করে
কালসাপিনী ধরতে গেলাম
সাহসের জোরে
ফণা ধরলো ছোবল মারলো
বিষে অঙ্গ কেমন করে ॥

ওঝা বৈদ্যের কাছে গেলাম
কত শতবার
কিছুতেই আর শান্তি হয় না
দিল বেকারার
ডাক শোনে না মন্ত্র মানে না
ঝাড়লে বিষ উজান ধরে ॥

বাইদ্যা যারা জানে তারা
সাপ ধরিবার কল
বাঁশির গানে ডেকে আনে
বাঁশিতে কৌশল
সাপিনী দেখিলে তারে
অমনি মাথা নত করে ॥

পঞ্চরসে মাখা যেজন
শুদ্ধ শান্ত হয়
কালসাপিনী দংশিলে
তার মরণের নাই ভয়
সে জানে সুধা কোথায় রয়
খেয়ে যায় অমরপুরে ॥

মায়াবিনী কালসাপিনী
এই করিম বলে
মহামন্ত্র না জানিলে
দংশে কপালে
গুরুবস্তু ঠিক থাকিলে
সেজন সাপ ধরতে পারে ॥

.

৪৭

সাহস বিনা হয় না কখনো
প্রেম-পিরিতি
প্রেমে মন দিলাম প্রাণ দিলাম
করতে হয় এই প্রতিশ্রুতি।

প্রেমিকের নাই আশয়-বিষয়
করে না কুলমানের ভয়
তার ভাবে সে রয় সব সময়
জ্ঞান থইয়া পাগলের মতি ॥

প্রেমভাবে যে যারে চায়
লক্ষ্য স্থির হইলে সেথায়
আপনাকে হারিয়ে যায়
দেখিলে সেই রূপজ্যোতি ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটিলে
ভাসিতে হয় নয়নজলে
কেউ হয় না এই দুঃখের সাথি ॥

.

৪৮

ঘৃণা লজ্জা ভয় থাকিতে
প্রেম হবে না
যে করে আত্মসমর্পণ
তার প্রেমে আর গোল বাধে না ॥

প্রেমের বাতাস লাগে যার গায়
দেখলে তারে চেনা যায়
প্রমাণ দেয় ভাবভঙিমায়
আত্মসুখের ধার ধারে না ॥

পঞ্চরসে মাখা যেজন
রসিক সুজন সে মহাজন
অন্তরে তার পরশরতন
সে করে স্বরূপ সাধনা ॥

শুদ্ধপ্রেম যার ভাগ্যে ঘটে
আঁধারে তার চন্দ্র ওঠে
আবদুল করিম প্রেমের হাটে
সময়ে যাইতে পারল না ॥

.

৪৯

কেউ বলে দুনিয়া দোজখ
কেউ বলে রঙের বাজার
কোনো কিছু বলতে চায় না
যে বুঝেছে সারাসার ॥

এ সংসারের ভোজবাজি
বোঝে না মন বড় পাজি
আসল কাজে হয় না রাজি
বুঝাইলে বোঝে না আর ॥

এই ভবে আসিল যত
আসলে কেউ রইল না তো
আসা-যাওয়া অবিরত
যাবার বেলা কেউ নয় কার ॥

মহামানব আসলেন যারা
আসলে সর্বহারা
ভোগী নয় ত্যাগী তারা
নবি ওলি পয়গাম্বার ॥

কী হইবে শেষের দিনে
সদা এই ভাবনা মনে
আবদুল করিম দীনহীনে
ভাবিতেছি অনিবার ॥

.

৫০

এলিম শিখলে আলেম হয় না
আমল না হলে
দেহমন পবিত্র হলে
ইমানের বাতি জ্বলে ॥

শুনি জ্ঞানী-গুণীর বচন
চরিত্র পবিত্র ভূষণ
নিজে হলে সংশোধন
মন তখন পথে চলে ॥

লম্বা দাড়ি টুপি পিরহানে
আল্লা-নবির গুণগানে
মনে যদি অহংকার আনে
সব যাবে রসাতলে ॥

আসছ ভবে যাইতে হবে
চিরদিন কি ভবে রবে
সুখ-দুঃখ ভোগ করিবে
আপনার কর্মফলে ॥

কাম ক্রোধ লোভ মোহ আর
ছাড়িলে হিংসা অহংকার
ঘুচে যাবে মনের আঁধার
বাউল করিম বলে ॥

.

৫১

আমি গান গাইতে পারি না
গানে মিলে প্রাণের সন্ধান
গান গাওয়া মোর হলো না ॥

জানি না ভাব-কান্তি
গাইতে পারি না সে গান
যে গান গাইলে মিলে
আঁধারে আলো সন্ধান
গান গাইলেন লালন রাধারমণ
হাসন রাজা দেওয়ানা ॥

আরকুম শাহ ফকির শিতালং
বলেছেন মারফতি গাও
সৈয়দ শাহনুরের গানে
শুকনাতে দৌড়াইলেন নাও
করিম বলে প্রাণ খুলে গাও
গাইতে যার বাসনা ॥

.

৫২

মানবতত্ত্বের কী মাহাত্ম্য
বোঝে কয়জনে
মানবতত্ত্ব প্রকাশিল
অতি সন্ধানে ॥

বোঝা যায় না মানবলীলা
কী ভেদে করেছে খেলা
খুলেছে যার প্রেমের তালা
সে জানে মনে ॥

আপনাকে ভালোবাসি
বিশ্বাস করে হও সাহসী
আপন ঘরে মক্কা-কাশী
আছে গোপনে ॥

করিম বলে ও পাগল মন
আপন ঘরে চৌদ্দ ভুবন
চোখ থইয়া তুই অন্ধ যখন
দেখবে কেমনে ॥

.

৫৩

আমি আছি আমার মাঝে
আমি করি আমার খবর
আমি থাকলে সোনার সংসার
আমি গেলে শূন্য বাসর ॥

এ জগতে আমি মূল
এছাড়া মিটে না গোল
আমি বৃক্ষ আমি ফুল
আমি মধু আমি ভ্রমর ॥

আমি আঁধার আমি আলোক
আমি আশেক আমি মাশুক
যে বোঝে না সে বুঝুক
কেবা আপন কেবা রে পর ॥

আমি আছি আমার বেশে
বসত করি মাটির দেশে
আমি আমায় ভালোবেসে
বাতাসে বাঁধিয়াছি ঘর ॥

বসে আছি আপন ঘরে
খুঁজতে যাই না অন্য কারে
করিম বলে মরা মরে
আমি নিত্য আমি অমর ॥

.

৫৪

আমি তুমি, তুমি আমি
অন্তর্যামী অন্তরেতে
অনুমানে দূরে জেনে
দিন গেল মোর পাগলামিতে ॥

স্বরূপে রূপ মিশাইয়া
মীমের পর্দায় ঢাকনি দিয়া
রঙ মাখিয়া সঙ সাজিয়া
আছ তুমি এ ধরাতে ॥

তুমি গেলে আমার মরণ
তা যদি হলো না বারণ
আমি জীব তুমি জীবন
আসা যাওয়া একই সাথে ॥

কিসের আমি কিসের আমার
তুমি বিনে কে আছে আর
যা আছে সকলই তোমার
তালাচাবি তোমার হাতে ॥

আবদুল করিম ভাবিতেছি
তুমি আমি একই আছি
ভূতের বেগার খাটিতেছি
পড়েছি গোলকধাঁধাতে ॥

.

৫৫

আমি বলি আমার আমার
আমার কেহ নয়
আমি আমার হলেম না তো
পর কি আপন হয় ॥

আসা-যাওয়া একা একা
ভববাসে কয়দিন থাকা
কে কার পাইবে দেখা
 দেহ যখন হইবে লয় ॥

জন্ম জরা যম যাতনা
এছাড়া তো কেউ দেখি না
আজ আছি কাল থাকব কি না
এই তো মনে ভয় ॥

আসা-যাওয়া কী কারণে
ভাবি কোন বিধির বিধানে
আবদুল করিম মনে মনে
ভাবে সব সময় ॥

.

৫৬

ধনে হীন মানে হীন আমি
আপনজনে বাসে ভিন
শোধ হলো না মহাজনের ঋণ ॥

জন্ম নিলাম মানবকুলে
আছি ভবমায়ায় ভুলে
দিনে দিনে তনু হইল হীন।
জানেন আল্লাহ রাসুলে
কী হবে হিসাবের দিন–
শোধ হলো না মহাজনের ঋণ ॥

পিতামাতার কাছে ঋণী
মন জানে আর আমি জানি
আর জানেন এলাহি আলমিন।
মনমানুষের কাছে ঋণী
ভাবি যারে নিশিদিন–
শোধ হলো না মহাজনের ঋণ ॥

এই ভবমায়ার বাঁধনে
বাড়ে দুঃখ দিনে দিনে
এখন আছি জালে বন্দি মীন।
জল শুকাইলে যাব চলে
বলে করিম দীনহীন–
শোধ হলো না মহাজনের ঋণ ॥

.

৫৭

আমি তো জানি না আমার
এখন কী হবে
বেলা গেল সন্ধ্যা হলো
ভাবি নীরবে

জীবন পাই মায়ের গর্ভেতে
একবিন্দু পানি হতে
আসিলাম এই জগতে
যাইব কবে ॥

বন্দি হলেম মায়াজালে
গাই গান তাল-বেতালে
বোঝে না মনমাতালে
ঠেকলাম স্বভাবে ॥

এ জনম গেল বিফলে
জীবনলীলা সাঙ্গ হলে
করিম বলে যাব চলে
কোলে কি লবে ॥

.

৫৮

আজ আছি কাল থাকব কি না
ভাবি সব সময়
মিছে বলি আমার-আমার
আমার বলতে কিছুই নয় ॥

নিয়তির বিধান মতে
আসা-যাওয়া এই জগতে
মন চলে না শুদ্ধ পথে
তাই তো হয়েছে সংশয় ॥

ভাঙা-গড়ার খেলা বিধির
কেউ বাদশা কেউ যে ফকির
কোনো কিছুই থাকে না স্থির
কালে পরিবর্তন হয় ॥

করিম বলে মনের হেলায়
জীবন গেল ভবের খেলায়
কী করিব যাবার বেলায়
সামনে মহা-প্রলয় ॥

.

৫৯

ভবের জনম বিফল গেল
মিটলো না প্রেমপিপাসা
ভালো-মন্দের ধার ধারি না
লোকে বলে কুলনাশা ॥

মন চলে না ধর্মপথে
পারলাম না স্বভাব নিতে
কাম ক্রোধ লোভ হিংসাতে
মন হয়েছে বেদিশা ॥

মুর্শিদ চান্দের প্রেমবাজারে
যে জনে মাল খরিদ করে
থাকে না সে অন্ধকারে
পূর্ণ হয় মনের আশা ॥

সমাপ্ত হলে জীবনের
উপায় নাই শেষের দিনের
দীনহীন আবদুল করিমের
দয়াল নামটি ভরসা ॥

.

৬০

মাটির পিঞ্জিরায় সোনার ময়না রে
তোমারে পুষিলাম কত আদরে।
তুমি আমার আমি তোমার এই আশা করে–
তোমারে পুষিলাম কত আদরে ॥

কেন এই পিঞ্জিরাতে তোমার বসতি
কেন পিঞ্জিরার সনে তোমার পিরিতি
আসা-যাওয়া দিবারাতি ঘরে বাহিরে–
তোমারে পুষিলাম কত আদরে ॥

তোমার ভাবনা আমি ভাবি নিশিদিন
দিনে দিনে পিঞ্জিরা মোর হইল মলিন
পিঞ্জিরা ছাড়িয়া একদিন যাইবে উড়ে–
তোমারে পুষিলাম কত আদরে ॥

আবদুর করিম বলে ময়না তোমারে বলি
তুমি গেলে হবে সাধের পিঞ্জিরা খালি
কে শুনাবে মধুর বুলি বল আমারে–
তোমারে পুষিলাম কত আদরে ॥

.

৬১

গাড়ি চলে না, চলে না
চলে না রে
গাড়ি চলে না ॥

চড়িয়া মানবগাড়ি
যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি
মধ্য পথে ঠেকলো গাড়ি
উপায়-বুদ্ধি মিলে না ॥

মহাজনে যত্ন করে
পেট্রল দিল টেংকি ভরে
গাড়ি চালায় মনড্রাইভারে
ভালো-মন্দ বোঝে না ॥

গাড়িতে পেসিঞ্জারে
অযথা গণ্ডগোল করে
হেন্ডিম্যান কন্টেকটারে
কেউর কথা কেউ শোনে না ॥

পার্সগুলো সব ক্ষয় হয়েছে
ইঞ্জিনে ময়লা জমেছে
ডায়নমা বিকল হয়েছে
লাইটগুলো ঠিক জ্বলে না ॥

ইঞ্জিনে ব্যতিক্রম করে
কন্ডিশন ভালো নয় রে
কখন জানি ব্রেকফেইল করে
ঘটায় কোন দুর্ঘটনা ॥

আবদুল করিম ভাবছে এবার
কন্ডেম গাড়ি কী করবো আর
সামনে বিষম অন্ধকার
করতেছি তাই ভাবনা ॥

.

৬২

দুঃখ কার কাছে জানাই
বিচ্ছেদের আগুনে অঙ্গ
পুড়ে হলো ছাই
পাইলে তারে প্রেমসাগরে
খেলতাম প্রেমের লাই॥

আপন জেনে প্রাণবন্ধুরে
বুকে দিলা ঠাঁই
দেখিলে জীবন বাঁচে
নইলে মরে যাই ॥

শুইলে স্বপনে দেখি
জাগিয়া না পাই
উদাসিনী হয়ে তখন
প্রাণবন্ধুর গান গাই ॥

জীবের জীবন পরশরতন
প্রাণবন্ধু কানাই
করিম বলে না পাইলে
বাঁচার উপায় নাই ॥

.

৬৩

আমি সাধ করে পরেছি গলে
শ্যামকলঙ্কের মালা
যায় যাবে কুলমান যাবে
প্রাণ গেলেও ভালা গো সখি–
শ্যাম কলঙ্কের মালা ॥

সেও পাগল, করেও পাগল
পাগলামি তার খেলা
তার কারণে দুই নয়নে
বহে নদী-নালা গো সখি–
শ্যাম কলঙ্কের মালা ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
শোনো গো সরলা
সে বিনে আর কে খুলিবে
প্রেমবাক্সের তালা গো সখি–
শ্যাম কলঙ্কের মালা ॥

.

৬৪

বড় সাধ করে গো সখি
পিরিত করেছি
আমি একূল সেকূল
দুই কূল ছেড়ে
প্রেমসাগরে ভেসেছি ॥

প্রেমসাগরের অতল জলে
বাও-বাতাসে ঢেউ খেলে গো
প্রাণবন্ধের নাম সম্বলে
হাইল ধরিয়া বসেছি ॥

সখি আমার চাওয়া-পাওয়া
সুখের ঘরে শূন্য দেওয়া গো
আমার শুধু নৌকা বাওয়া
যতদিন বেঁচে আছি ॥

বন্ধে যারে দয়া করে
অকূলে কূল দিতে পারে গো
করিম বলে প্রাণবন্ধুরে
পাই যদি প্রাণে বাঁচি ॥

.

৬৫

আমার মনের দুঃখ যত গো
সখি প্রাণবন্ধে জানে
প্রাণবন্ধুর বিচ্ছেদে আমার
দুঃখ বয়ে আনে গো
সখি প্রাণবন্ধে জানে ॥

কুলনাশা বাঁশির ধ্বনি
আসে যখন কানে
উদাসিনী করে মোরে
বন্ধুর বাঁশির গানে গো
সখি প্রাণবন্ধে জানে ॥

বিচ্ছেদ জ্বালা বড় জ্বালা
সয় না আমার প্রাণে
করিম বলে বন্ধু পাইলে
কাজ নাই কুলমানে গো
সখি প্রাণবন্ধে জানে ॥

.

৬৬

পিরিতি করিয়া বন্ধে
ছাড়িয়া গেল
আগে তো জানি না বন্ধের
মনে কী ছিল ॥

শুনো ওগো সহচরী
ধৈর্য না ধরিতে পারি
না দেখিলে প্রাণে মরি
উপায় কী বলো ॥

প্রেম কী হয় যথাতথা
প্রেম করা কি মুখের কথা
প্রেমে যে দারুণ ব্যথা
অন্তরে দিল ॥

পূর্বকথা মনে আছে
সেদিন আজ চলে গেছে
চিরদিন থাকিবে কাছে
এই আশা ছিল ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
প্রাণ জ্বলে বিচ্ছেদানলে
প্রাণবন্ধু যাবার কালে
সঙ্গে না নিল ॥

.

৬৭

আসি বলে গেল বন্ধু আইল না
যাইবার কালে সোনা বন্ধে
নয়ন তুলে চাইল না ॥

আসবে বলে আসায় রইলাম
আশাতে নিরাশা হইলাম
বাটাতে পান সাজাই থইলাম
বন্ধু এসে খাইল না ॥

সুজন বন্ধুরে চাইলাম
মনে বড় ব্যথা পাইলাম
আমি শুধু তার গান গাইলাম
সে আমার গান গাইল না ॥

ভুলবো তারে কেমন করে
এই আশাতে যাব মরে
আসে যদি মরণ-পরে
করিমে তো পাইল না ॥

.

৬৮

প্রাণবন্ধু বিনে গো
সখি দুঃখ এল মনে
কুলমান নিল দুঃখ দিল
আমার প্রাণধনে গো
সখি দুঃখ এল মনে ॥

ফাঁকি দিয়া মন নিয়া
লুকাইয়া কোন বনে
রইল হাসি গলে ফাঁসি
প্রেম করে তার সনে গো
সখি দুঃখ এল মনে ॥

কথা দিয়াছিল বন্ধে
ভুলবে না জীবনে
তাই তো তারে মনে পড়ে
শয়নে-স্বপনে গো
সখি দুঃখ এল মনে ॥

প্রেমরতন অমূল্য ধন
করতে হয় যতনে
করিম বলে সুফল ফলে
সুজনে-সুজনে গো
সখি দুঃখ এল মনে ॥

.

৬৯

বলো সখি প্রাণপাখি
কোন দেশে রইল
এ জীবনে ভুলিবে না
আমারে কইল ॥

প্রেম করে গেল ছাড়িয়া
মন-প্রাণ নিল কাড়িয়া
আমারে প্রাণে মারিয়া
কার সঙ্গ লইল ॥

লাগলো গলে প্রেমের ফাঁসি
জগতে রইল হাসি
করে আমায় কুলবিনাশী
নিদারুণ হইল ॥

আশায় জীবন হলো গত
আশা পূর্ণ হইল না তো
প্রেম করিয়া আবদুল করিম
কত দুঃখ সইল ॥

.

৭০

পিরিত করা প্রাণে মরা গো
সখি আগে আমি জানি না
প্রেম করা যে এই লাঞ্ছনা ॥

সখি গো, বলিতে পারি না মুখে
যে-দুঃখ মোর পোড়া বুকে গো
আঁধার দেখি দিবালোকে গো
সখি ঘুমাইলে ঘুম আসে না–
প্রেম করা যে এই লাঞ্ছনা ॥

সখি গো, প্রেম করিলে শান্তি মিলে
বলে তাহা কোন পাগলে গো
বিনা কাষ্ঠে আগুন জ্বলে গো
সখি নিভাইলেও নিভে না–
প্রেম করা যে এই লাঞ্ছনা ॥

সখি গো, নদীর জোয়ারভাটা দিলে
ফিরে আসে কালে কালে গো
যৌবন-জোয়ার একবার গেলে গো
সখি জীবনে আর আসে না–
প্রেম করা যে এই লাঞ্ছনা ॥

সখি গো, বাউল আবদুল করিম বলে
প্রেমের মালা দিয়া গলে গো
প্রাণবন্ধুরে পাব বলে গো
আমি করি কত আরাধনা–
প্রেম করা যে এই লাঞ্ছনা ॥

.

৭১

পিরিতে শান্তি মিলে না
মন মিলে মানুষ মিলে
সময় মিলে না ॥

প্রেমিক যারা জিতে মরা
আসলে সর্বস্বহারা
যে যারে চায় তারে ছাড়া
প্রাণে বাঁচে না ॥

পিরিত করে মন-উল্লাসে
ঠেকলো যেজন ভালোবেসে
কালনাগে দংশিলে বিষে
মন্ত্র মানে না
শুনো ওগো প্রাণসজনী
কী সুখে যায় দিন-রজনী
মন জানে আর আমি জানি
অন্যে জানে না ॥

এখন শুনি লোকে বলে
দুঃখের পরে শান্তি মিলে
মানে না তো মনপাগলে
লোকের সান্ত্বনা ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
ভাবিয়া আপন দিলে
পিরিতে বিচ্ছেদ না হলে
পরীক্ষা হয় না ॥

.

৭২

বন্ধুহারা জিতে মরা মনপ্রাণ উতলা
কেমন করে ঘরে রই একেলা ॥

সখি গো থাকি আমি পরার ঘরে
কত মন জুগাইলাম তারে
গলে লইলাম কলঙ্কের মালা
শাশুড়ি ননদি বাদি এই যন্ত্রণায় সদায় কাঁদি
বন্ধে আরও দিলো দ্বিগুণ জ্বালা–
কেমন করে ঘরে রই একেলা ॥

সখি গো, প্রেম করা বড় জ্বালা।
না করছে-জন আছে ভালা
যে করছে তার সোনার অঙ্গ কালা
যে জন প্রেমের ভাও জানে না
তার সঙ্গে প্রেম করিও না
মরছি মরছি আমি মরছি ভালা–
কেমন করে ঘরে রই একেলা ॥

সখি গো, আসতো বন্ধু কইতাম কথা
যাইত আমার মনোব্যথা
মাথায় লইতাম তার চরণের ধূলা
আবদুল করিম কয় ভাবিয়া
আসিবে শ্যাম কালিয়া
কইতাম দুঃখ পাইলে নিরালা–
কেমন করে ঘরে রই একেলা ॥

.

৭৩

বাঁচিব কেমনে গো
সখি প্রাণবন্ধুরে ছাড়া
আহার নিদ্রা লয় না মনে
নয়নে বয় ধারা গো–
সখি প্রাণবন্ধুরে ছাড়া ॥

বন্ধু আমার আশার আলো
বন্ধু নয়নতারা
উদাসিনী মন যে আমার
থাকে পাগলপাড়া গো–
সখি প্রাণবন্ধুরে ছাড়া ॥

আমার মতো কর্মপোড়া
বন্ধু-শোকী যারা
পাইলে চরণ দুঃখ বারণ
চিরসুখী তারা গো
সখি প্রাণবন্ধুরে ছাড়া ॥

প্রেমের নেশায় বন্ধুর আশায়
হইলাম সর্বহারা
না আসিলে বন্ধু বলে
করিম যাবে মারা গো–
সখি প্রাণবন্ধুরে ছাড়া ॥

.

৭৪

ওগো প্রাণ-সই
বন্ধু বিনে মনের বেদনা কারে কই
যার লাগি কলঙ্কের ডালা
হাতে তুলে মাথায় লই–
বন্ধু বিনে মনের বেদন কারে কই ॥

বাঁচে না প্রাণ তারে ছাড়া
হয়েছি পাগলের ধারা
প্রেম করিয়া সর্বহারা
কুল ছেড়ে কলঙ্কী হই–
বন্ধু বিনে মনের বেদন কারে কই ॥

আমায় ছেড়ে গেল দূরে
থাকে বন্ধু মধুপুরে
আশা দিয়া বন্ধে মোরে
গাছে তুলে নিল মই–
বন্ধু বিনে মনের বেদন কারে কই ॥

আহার-নিদ্রা লয় না মনে
ভাবি তারে নিশিদিনে
বলে করিম দীনহীনে
কেমন করে বেঁচে রই–
বন্ধু বিনে মনের বেদন কারে কই ॥

.

৭৫

আর কতদিন গাইব গো সখি
প্রাণবন্ধুর গান
প্রেমের নেশায় বন্ধুর আশায়
যৌবন হলো অবসান ॥

সখি আমি একা ছিলাম
প্রাণবন্ধুর সঙ্গ নিলাম
ছেড়ে দিলাম জাতিকুলমান
আপন জেনে প্রাণবন্ধুরে
সোনার যৌবন করলাম দান ॥

কাছে নিল ভালোবেসে
এখন থাকে দূর বিদেশে
পাগল বেশে কাঁদে মনপ্রাণ
দেখা দেয় না খবর নেয় না
করিয়াছে অভিমান ॥

সে যদি না করে স্মরণ
পাই না যদি যুগল চরণ
বাঁচন-মরণ দুইই এক সমান
আবদুল করিম অন্ধকারে
প্রাণবন্ধু আকাশের চান ॥

.

৭৬

বন্ধু তো আইল না গো
সখি দুঃখ বলবো কারে
পিরিত করে বন্ধে মোরে
কোন বিচারে ছাড়ে গো–
সখি দুঃখ বলবো কারে ॥

জেনে আপন জীবন-যৌবন
দিলাম আমি যারে
দুঃখ দিল ছেড়ে গেল
যৌবনের আষাঢ়ে গো–
সখি দুঃখ বলবো কারে ॥

কইতে নারি সইতে নারি
যাই না কারো ধারে
কেউ নাই আমার কই যাব আর
বন্ধে যদি মারে গো–
সখি দুঃখ বলবো কারে ॥

আশায় আছি মরি বাঁচি
সার করেছি তারে
করিম বলে দয়া হলে
কোলে নিতে পারে গো–
সখি দুঃখ বলবো কারে ॥

.

৭৭

জীবন-অন্ত কালে গো সখি
আসিল না কালা
আপন বলে নিলাম গলে
শ্যামকলঙ্কের মালা গো–
সখি আসিল না কালা ॥

বন্ধু বিনে দুই নয়নে
বহে নদী-নালা
শাশুড়ি ননদি বাদি
জ্বালার উপর জ্বালা গো–
সখি আসিল না কালা ॥

কার কাছে কী বলিব
ভাবি যে নিরালা
কুল ছাড়িলাম মাথায় নিলাম
শ্যামকলঙ্কের ডালা গো–
সখি আসিল না কালা ॥

করিম বলে কে খুলিবে
মন-বাক্সের তালা
ভাবি মনে নাম স্মরণে
মরণ হলে ভালা গো–
সখি আসিল না কালা ॥

.

৭৮

কও রে পথিক ভাই
তুমি নি দেখেছ আমার
প্রাণবন্ধু কানাই;
যার লাগিয়া পাগল হইয়া
কাঁদিয়া বেড়াই ॥

ভাই রে ভাই, হাতে বাঁশি মাথে চূড়া
পীতবসন পরা
নয়নে প্রেমের রেখা
মুনির মন হরা;
কী দিব রূপের তুলনা
ত্রিভুবনে নাই
রূপ দেখিয়া পাগল হইয়া
কুলে দিলাম ছাই ॥

ভাই রে ভাই, দেখে থাকলে কও রে
বন্ধু কোন দেশেতে আছে
কার ভালোবাসায় বন্ধু
ভুলিয়া রয়েছে;
দেখিলে জীবন বাঁচে
নইলে মরে যাই
অভাগিনী পোড়া প্রাণী
কী দিয়া জুড়াই ॥

ভাই রে ভাই, বন্ধু আমার ছেড়ে গেল
বাম হইল বিধি
আপন কর্মদোষে হারা
হলেম গুণনিধি;
পাগল আবদুর করিম বলে
ভেবে তনু ছাই
বন্ধু বিনে এক ভুবনে
আমার কেহ নাই ॥

.

৭৯

কালো রূপ দেখিতে চমৎকার
কী দিব রূপের তুলনা
নাই কিছু জগৎ মাঝার ॥

যে চায় কালো রূপের পানে
মনপ্রাণ সহিতে টানে গো
ভুলতে পারে না জীবনে
করে সদা হাহাকার ॥

মুছলে ছবি মিটে না তো
হৃদয়ে আছে ক্ষত গো
পোড়া প্রাণে দুঃখ যত
রূপ দেখলে থাকে না আর ॥

কালো আমার মাথার বেণি
কালো আমার চোখের মণি গো
করিম বলে কালো জানি
যে আমার কলিজার সার ॥

.

৮১

কালার প্রেমের কেন পাগল হইলাম
সহে না জ্বালা আমি কুলবালা
কলঙ্কের ডালা মাথায় লইলাম ॥

বাজায় শ্যামে বাঁশি মন করে উদাসী
নয়নজলে ভাসি বলে রাধা নাম।
প্রাণে বাঁচা দায় করি কী উপায়
সুখের আশায় কত দুঃখ সইলাম ॥

সদা যায়-আসে নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে,
নয়নে ভাসে প্রেমময় শ্যাম।
সে নহে তো কঠিন পাব তারে একদিন
করিম দীনহীন আশায় রইলাম ॥

.

৮১

দারুণ পিরিতি বিষম ডাকাতি
কালার পিরিতি যে বা করে রে
তুষেরই আগুন অঞ্চলে বাঁধিয়া
জ্বলিয়া পুড়িয়া মরে রে ॥

দেখিয়া ইউসুফের ছবি পাগল জ্বলেখা বিবি
কাঁদিয়াছিল সারা জনমভরে
ইউসুফের আশায় সর্বস্ব হারায়
অবশেষে রাস্তায় রইল পড়ে ॥

ফরহাদ পাগলের বেশে শিরিরে ভালোবেসে
পাহাড় কাটিয়া রাস্তা করে
শিরির নাম লইয়া গেল সে মরিয়া
আপন কুড়ালি মাথায় মেরে ॥

লাইলির পিরিতে এত কষ্ট জগতে
সংসার ত্যাগি মজনু জঙ্গলায় ঘোরে
চণ্ডীদাসে বঁড়শি বায় রজকিনীর আশায়
বার বৎসর কাটাইল নদীর কিনারে ॥

পিরিতি শান্তি পিরিতি দুর্গতি
কুলনাশা পিরিতি যে জনে করে
আবদুল করিমের মন সদায় করে উচাটন
পিরিতি অমূল্য ধন, হইল না রে ॥

.

৮২

কী জাদু করিয়া বন্ধে
মায়া লাগাইছে
পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে ॥

বসে ভাবি নিরালা
আগে তো জানি না
বন্ধের পিরিতের জ্বালা
যেমন ইট-বাট্টায় দিয়া কয়লা
আগুন জ্বালাইছে–
দেওয়ানা বানাইছে ॥

কী বলিব আর
বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে
কলিজা আঙ্গার
প্রাণবন্ধুর পিরিতে আমার
কুলমান গেছে–
দেওয়ানা বানাইছে ॥

আবদুল করিম গায়
ভুলিতে পারি না আমার
মনে যারে চায়
কুলনাশা পিরিতের নেশায়
পাগল করেছে–
দেওয়ানা বানাইছে ॥

.

৮৩

প্রাণবন্ধুর পিরিতে আমার মন উদাসী
মন উদাসী, গলে পিরিতের ফাঁসি
আমি হয়েছি দোষী ॥

প্রেমের বাজারে প্রেম বিকায় ঘরে ঘরে
ন্যায়মূল্যে খরিদ করে খরিদ্দারে।
প্রেমিক যারা প্রেম কিনে গো তারা
আগ বাজারে যায় যারা প্রেমবিলাসী ॥

বাজারে গেলাম ভাও জানতে চাইলাম
ভাগ্যগুণে সরল এক মহাজন পাইলাম।
একটাকা মণ প্রেম বিরাশির ওজন
এক মণ কিনে যে জন একসের পায় বেশি ॥

কইতে লাগে ভয় সহজে কী হয়
প্রাণবন্ধুর পিরিতি করা মুখের কথা নয়।
হয়ে প্রেমের আসামী কত দেশ-বিদেশ ভ্রমি
সাধে কি হয়েছি আমি কুলবিনাশী ॥

করিমের মন করে উচাটন
ভাবে সদায় পাবো কোথায় বন্ধুর দরশন।
যার মনে যাহা চায় তা বলুক না আমায়
আমি আমার প্রাণবন্ধুরে ভালোবাসি ॥

.

৮৪

মনপ্রাণ দিয়াছি সোনা বন্ধুরে
বলে বলুক লোকে মন্দ
যার যত মনে ধরে ॥

যেদিন হতে প্রেম করেছি
কুলমান ছেড়ে দিয়েছি
মনে মনে ভাবিতেছি
বন্ধে জানি কী করে ॥

ধর্ম কর্ম সবই ছাড়া
হয়েছি পাগলের ধারা
বন্ধু বিনে মন মনুরা
থাকতে চায় না পিঞ্জরে ॥

আর কোনো বাসনা নাই
শুধু প্রাণবন্ধুরে চাই
দুঃখ নাই যদি মরে যাই
ডুবে প্রেমের সাগরে ॥

আবদুল করিম মহাপাপী
ওই নামের তসবি জপি
সে যে হয়ে বহুরূপী
বিরাজে এই সংসারে ॥

.

৮৫

যে দুঃখ মোর মনে
বন্ধে তাহা জানে
আপন বন্ধে দিল দুঃখ
মন বেঁধে পাষাণে–
বন্ধে তাহা জানে ॥

নয়ন নিল রূপবাণে
মন নিল তার গানে
মন নিল তার গানে
কুল ছেড়ে কলঙ্কী হইলাম
যৌবন দিলাম দানে–
বন্ধে তাহা জানে ॥

মন বাঁধা তার প্রেমডোরে
দিবানিশি টানে
দিবানিশি টানে
প্রাণবন্ধুর বিচ্ছেদ জ্বালা
সয় না আমার প্রাণে–
বন্ধে তাহা জানে ॥

আর কিছু নাই বন্ধুরে চাই
কাজ নাই কুলমানে
কাজ নাই কুলমানে
করিম বলে গাইব গান
প্রাণবন্ধুর শানে–
বন্ধে তাহা জানে ॥

.

৮৬

সোনার অঙ্গ পুড়ে আঙ্গার
হইল যার লাগিয়া গো
কই রইল গো নিষ্ঠুর কালিয়া ॥

কুমারে যে বাসন পোড়ে সই গো
পইনে সাজাইয়া
ভিতরে তার আগুন দিয়া সই গো
কুমার রয় সরিয়া গো ॥

যে দুঃখ অন্তরে সই গো
রেখেছি ভরিয়া
বুক চিরে দেখাইবার হইলে আমি
দেখাইতাম চিরিয়া গো ॥

আসি বলে চলে গেল সে আর
আইল না ফিরিয়া
বাউল আবদুল করিম কাঁদে এখন
আশাপথে চাইয়া গো ॥

.

৮৭

কও সজনী গুণমণি
কার কুঞ্জে রইল
আমার কুঞ্জে আসবে বলে
আমারে কইল ॥

আসবে বলে আশায় রইলাম
ফুলবিছানা সাজাইলাম
আশাতে নিরাশা হইলাম
নিশি শেষ হইল ॥

জ্বালাইয়া মোমের বাতি
জাগিয়া পুহাইলাম রাতি
আসিল না প্রাণের সাথি
উপায় কী বল ॥

করিম বলে কী করব আর
পুড়িয়া হইলাম আঙ্গার
বিচ্ছেদের আগুনে আমার
অঙ্গ ধইল ॥

.

৮৮

ও সখিগণ বল এখন
করি কী উপায়
বন্ধুবিনে প্রাণপাখি
উড়ে যেতে চায় ॥

না জেনে প্রাণবন্ধুর সঙ্গে
প্রেম করিলাম মনোরঙ্গে
কলঙ্কের দাগ লাগল অঙ্গে
মোছা নাহি যায় ॥

কত ভালোবেসেছিল
মন-প্রাণ কাড়িয়া নিল
আপন হয়ে দুঃখ দিল
বন্ধু শ্যামরায় ॥

জানি না কী হবে শেষে
মন কান্দে পাগলের বেশে
কলঙ্কিনী দেশ বিদেশে
লোকে মন্দ গায় ॥

বন্ধুর কথা মনে হলে
বুক ভাসে নয়নজলে
করিম বলে না পাইলে
প্রাণে বাঁচা দায় ॥

.

৮৯

প্রাণবন্ধু আসিতে গো
সখি আর কতদিন বাকি
চাতকপাখির মতো আমি
আশায় চেয়ে থাকি গো–
সখি আর কতদিন বাকি ॥

ভালোবেসে দুঃখ দেওয়া
ভালো হলো নাকি।
পাগল মনকে আর কতদিন
প্রবোধ দিয়ে রাখি গো–
সখি আর কতদিন বাকি ॥

নিবিড় রাতে কেউ নয় সাথে
একা যখন থাকি
কত কথা মনে পড়ে
ঝরে দুটি আঁখি গো–
সখি আর কতদিন বাকি ॥

আসবে ঘরে আশা করে
দিবানিশি ডাকি
করিম বলে দয়া হলেও
আসবে প্রাণপাখি গো–
সখি আর কতদিন বাকি ॥

.

৯০

শোনো গো সজনী ভাবি দিন-রজনী
মনে তো বোঝে না বন্ধু ছাড়া
বিনে প্রাণপাখি কেমনে থাকি
ঝরে দুই আঁখি বহে ধারা ॥

ভালোবেসেছিল মন প্রাণ নিল
পরে ঠেলিয়া দিল পাগলপাড়া
তার আশায় রয়েছি কত দুঃখ সয়েছি
আমি যে হয়েছি প্রেমের মরা ॥

মনে ভাবি তাই আমার কেহ নাই
ছেড়ে গেল সবাই আপন যারা
প্রাণ বন্ধে বাসে ভিন আসিল দুর্দিন
করিম দীনহীন সর্বহারা ॥

.

৯১

প্রাণসখি গো
মনে চায় বন্ধুরে দেখিতে।
মন যারে চায় তারে ছাড়া
পারি না আর থাকিতে–
মনে চায় বন্ধুরে দেখিতে ॥

সে বিনে আমি অবলা
সহিতে পারি না জ্বালা
পাই না বন্ধের চরণধুলা
আমার অঙ্গে মাখিতে–
মনে চায় বন্ধুরে দেখিতে ॥

মন পাগল পিরিতের নেশায়
কতকাল কাঁদিবে আশায়
প্রাণপাখি উড়ে যেতে চায়
পারি না গো রাখিতে–
মনে চায় বন্ধুরে দেখিতে ॥

আবদুল করিম কয় সখিরে
সদায় আমার মনে পড়ে
নয়নের জল কাজল করে
বন্ধুর ছবি আঁকিতে
মনে চায় বন্ধুরে দেখিতে ॥

.

৯২

বলো সখি প্রাণপাখি

কার কুঞ্জে রইল
এ জীবনে ভুলিবে না
আমারে কইল ॥

এখন সে গেল ছাড়িয়া
মনপ্রাণ নিল কাড়িয়া
আমারে প্রাণে মারিয়া
কার সঙ্গ লইল ॥

প্রেম করিয়া কত জনে
দুঃখ ব্যথা পেয়ে মনে
ঘর ছেড়ে কেউ গেল বনে
দুঃখ সইল ॥

সে যে হয় দয়ার সিন্ধু
করিম চায় এক বিন্দু
কী দোষ প্রাণবন্ধু
নিদারুণ হইল ॥

.

৯৩

কী করি অবলা
সয় না প্রেমজ্বালা
প্রাণবন্ধুর বিচ্ছেদানলে
সোনার অঙ্গ কালা–
সয় না প্রেমজ্বালা ॥

নাম ধরিয়া বাজায় বাঁশি
বন্ধু চিকনকালা, বন্ধু চিকনকালা
ধৈর্য ধরে থাকি ঘরে
মন করে উতলা–
সয় না প্রেমজ্বালা ॥

সাধ করে পরেছি গলে
শ্যামনামের মালা, শ্যামনামের মালা
সাধ করে নিয়েছি মাথে
শ্যামকলঙ্কের ডালা–
সয় না প্রেমজ্বালা ॥

নিশিশেষে একা বসে
ভাবি যে নিরালা, ভাবি যে নিরালা
বন্ধুবিনে দুই নয়নে
বহে নদী নালা–
সয় না প্রেমজ্বালা ॥

করিম বলে রাখব গলে
বন্ধু গলার মালা, বন্ধু গলার মালা
আসলে কালা ঘুচবে জ্বালা
খুলবে প্রেমের তালা–
সয় না প্রেমজ্বালা ॥

.

৯৪

কেমনে ভুলিল বন্ধে আমারে
আমি তো ভুলি না গো তারে
বন্ধে যারে দয়া করে গো
তার শুকনা গাছে ফল ধরে–
আমি তো ভুলি না গো তারে ॥

সখি গো, বন্ধু যদি আপন হইত
দরদি হইয়া রইতো গো
সুখ দুঃখের গান শুনিত গো
তারে রাখিতাম আদর করে–
আমি তো ভুলি না গো তারে ॥

সখি গো, যে জন হয় পিরিতের মরা
লাজ-লজ্জা কুলমানহারা গো
জ্ঞান থইয়া পাগলের ধারা গো
তার অন্তরে ঘুণে ধরে–
আমি তো ভুলি না গো তারে ॥

সখি গো, বাউল আবদুল করিম বলে
ঠেকছি বন্ধের মায়ায় ভুলে গো
বোঝে না তো মনপাগলে গো
আমি বোঝাবো কেমন করে–
আমি তো ভুলি না গো তারে ॥

.

৯৫

এইভাবে আর
বেঁচে থাকব কতদিন
আমি যারে ভালোবাসি
সে আমারে বাসে ভিন ॥

ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে
চোর ঢুকিল মনের ঘরে
দিবানিশি চিন্তা করে
শক্তিহীন অঙ্গ মলিন ॥

আছি শুধু ধৈর্য ধরে
কখন জানি যাব মরে
বেঁচে থাকব কেমন করে
জল বিনে কি বাঁচে মীন ॥

এই ভাবনা নিশিদিনে
বাধা আছি প্রেমঋণে
বলে করিম দীনহীনে
কী দিয়ে শোধিব ঋণ ॥

.

৯৬

আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
আমারে কেউ ছুঁইও না গো সজনী ॥

প্রেম করে প্রাণবন্ধুর সনে
যে-দুঃখ পেয়েছি মনে
আমার কেঁদে যায় দিন-রজনী।

প্রেম করা যে স্বর্গের খেলা
বিচ্ছেদে হয় নরকজ্বালা
আমার মন জানে, আমি জানি ॥

সখি গো, উপায় বলো না
এ জীবনে দূর হলো না
বাউল করিমের পেরেশানি ॥

.

৯৭

রঙের দুনিয়া তোরে চাই না
দিবানিশি ভাবি যারে
তারে যদি পাই না ॥

বন্ধুর প্রেমে পাগলিনী
শান্তি নাই দিন-রজনী
কুলহারা কলঙ্কিনী
কারো কাছে যাই না ॥

প্রাণবন্ধুর সঙ্গ নিলাম
ভালোবেসে মনও দিলাম
পূর্বে যাহা ভেবেছিলাম
এখন ভাবি তাই না ॥

আসি বলে গেল চলে
ভাসি সদা নয়নজলে
বাউল আবদুল করিম বলে
রঙের গান আর গাই না ॥

.

৯৮

রাই তোমারে বুঝাব কত
থাকবে যদি সুখে ভুলে যাও শ্যামকে
কেন হয়েছ রাই পাগলের মতো।

ব্রজের যত গোপীগণ যোগায় সকলের মন
তোমারই কৃষ্ণধন অবিরত
হইত না বাদি আপন হইত যদি
কাছে থেকে নিরবধি সাধ মিটাইত ॥

প্রথম যৌবনকালে বসে কদমডালে
রাধা রাধা বলে বাঁশি বাজাইত
প্রেমেরই বাজার ভাঙ্গিল এবার
আসবে কী আর, যৌবন সমাপ্ত ॥

থাকিলে সুসময় শত্রুও মিত্র হয়
আনন্দ উদয় হয় শত শত
আসিলে কু-সময় কেহ কারো নয়
আবদুল করিম কয়, এই পর্যন্ত ॥

.

৯৯

ভ্রমরা রে, গুন গুন স্বরে গান গাও
খোঁজো যারে পাইলে তারে
পরান জুড়াও রে–
গুন গুন স্বরে গান গাও ॥

মধুর গান গাও রে ভ্রমর
ফুলের মধু খাও
তোমার স্বরে আকুল করে
উদাসী বানাও রে ॥

করে গুন গুন বুকের আগুন
দ্বিগুণ জ্বালাও
এই মধুর গান গেয়ে তুমি
কারে বা শোনাও রে ॥

আমি যারে চাই রে ভ্রমর
তারে যদি পাও
আমার খবর কও না যদি
আমার মাথা খাও রে ॥

আমার দুঃখের খবর আমার
বন্ধুরে জানাও
করিম বলে তোমার মতো
আমারে বানাও রে ॥

.

১০০

আমি তোমায় বন্ধু বলে ডাকব
রাখো-মারো যাই করো
তোমার আশায় থাকব ॥

পাই যদি হে ব্রজের নন্দন
কেটে যাবে ভববন্ধন ও রে
লোকের নিন্দন আগর-চন্দন
সাধ করৈ গায় মাখব ॥

না পাই যদি যাব মরে
পাইলে রাখব মনের ঘরে ও রে
নয়নের জল কাজল করে
তোমার ছবি আঁকব ॥

থাকবে কাছে ইচ্ছে হলে
যাইতে চাইলে যাবে চলে ও রে
বাউল আবদুল করিম বলে
কেমন করে রাখব ॥

.

১০১

মনে তোরে চায় রে বন্ধু
প্রাণে তোরে চায়
অবলা রাধার কুঞ্জে
আয় রে বন্ধু আয় ॥

আগে কত আশা দিলে
মন-প্রাণ কাড়িয়া নিলে
তখন তুমি বলেছিলে
ছাড়বে না আমায় ॥

যে দিন হতে তোমা হারা
হয়েছি পাগলের ধারা
বসত করি পাগলপাড়া
লোকে মন্দ গায় ॥

বাঁধা তোমার প্রেমঋণে
এই ভাবনা নিশিদিনে
বাঁচে না প্রাণ তুমি বিনে
হলেম নিরুপায় ॥

বন্ধু তুমি আমার হলে
কুলমান ভাসাইয়া জলে
দিব মালা তোমার গলে
ধরব তোমার পায় ॥

চরণে মিনতি করি
দেখা দাও, দেখিয়া মরি
কেমন করে ধৈর্য ধরি
লোম অসহায় ॥

করিম কয় তোমার মন সাদা
আমি কলঙ্কিনী রাধা
প্রাণটি তোমার কাছে বাঁধা
তাই তো ভোলা দায় ॥

.

১০২

আমি তোমারে ভালোবাসি রে
বন্ধু ভিন্ন বাসো কোন প্রাণে
 আমার বাড়ি আইলায় না কেনে ॥

বন্ধু রে, সাজাইয়া ফুলবিছানা
ঘরে-বাইরে আনাগোনা রে
দুঃখের নিশি প্রভাত হয় না রে বন্ধু
তোমার দরশন বিনে–
আমার বাড়ি আইলায় না কেনে ॥

বন্ধু রে, আশা-পথে চেয়ে থাকি
তোমার রূপ নয়নে রাখি রে
তুমি বিনে পাগল আঁখি রে বন্ধু
ধারা বয় নিশিদিনে–
আমার বাড়ি আইলায় না কেনে ॥

বন্ধু রে, মাশুকের ভেদ আশেক বোঝে
যে যার পিরিতে মজে রে
মন সদায় তোমারে খোঁজে রে বন্ধু
আমার মনবৃন্দাবনে–
আমার বাড়ি আইলায় না কেনে ॥

বন্ধু রে, খুঁজে খুঁজে তোমার নেশায়
জীবন গেল আশায়-আশায় রে
আবদুল করিম বলে তোমায় রে বন্ধু
পাব কি আর মরণে–
আমার বাড়ি আইলায় না কেনে ॥

.

১০৩

প্রাণনাথ,
ছাড়িয়া যাইও না মোরে রে ॥

কথা রাখো কাছে থাকো
যাইও না রে দূরে
বন্ধু রে, দূরে গেলে পরান আমার
ছটফট ছটফট করে রে ॥

তুমি আমার কাছে থাকো
এই আমার বাসনা
বন্ধু রে, মন যারে চায় তারে ছাড়া
মনে তো বোঝে না রে ॥

তোমার প্রেমে হইলাম আমি
মিছা দোষের ভাগী
বন্ধু রে, তোমারে না পাইলে আমি
বিনা রোগে রোগীরে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
কী বলিব বেশি
বন্ধু রে, মনে চায় দেখিতে তোমার
সোনামুখের হাসি রে ॥

.

১০৪

বন্ধু দরদিয়া রে
আমি তোমায় চাই রে বন্ধু
আর আমার দরদি নাই রে ॥

না জেনে করেছি কর্ম
দোষ দিব আর কারে
সর্পের গায়ে হাত দিয়াছি
বিষে তনু ঝরে রে
আর আমার দরদি নাই রে ॥

আমার বুকে আগুন বন্ধু
তোমার বুকে পানি
দুই দেশে দুইজনার বাস
কে নিভায় আগুনিরে
আর আমার দরদি নাই রে ॥

জন্মাবধি কর্মপোড়া
ভাগ্যে না লয় জোড়া
করিমরে করবায় নাকি
দেশের বাতাস ছাড়া রে
আর আমার দরদি নাই রে ॥

.

১০৫

বন্ধুয়া রে, কী দোষে ছাড়িতে চাও মোরে
তুমি কি জানো না আমি
ভালোবাসি কারে রে–
কী দোষে ছাড়িতে চাও মোরে ॥

ধন দিলাম প্রাণ দিলাম
যৌবন করলাম দান
তোর পিরিতে চাইলাম না রে
লাজ কুলমান
আমার বলতে যাহা ছিল
সব দিলাম তোমারে
এখন আমার কলঙ্কের গান
গায় ঘরে ঘরে রে–
কী দোষে ছাড়িতে চাও মোরে ॥

আমি যে তোমার রে বন্ধু
তুমি বন্ধু কার
তোমার লাগি কাঁদে রে বন্ধু
প্রাণপাখি আমার
শুইলে না আসে নিদ্রা
পরান ছটফট করে
হাত বান্ধা যায় পাও বান্ধা যায়
মন বানব কী করে রে–
কী দোষে ছাড়িতে চাও মোরে ॥

আশায়-আশায় জনম গেল
প্রেম করে কুলুটা
সোনালি যৌবন রে আমার
পড়ে গেল ভাটা
গুল দিয়া তো কূল পাইলাম না
ভাসিলাম সাগরে
করিম পাগলার আর কে আছে
কে নিবে সে-পারে রে–
কী দোষে ছাড়িতে চাও মোরে ॥

.

১০৬

আমি জ্বালায় জ্বলিয়া মরি রে বন্ধুয়া
আমি জ্বালায় জুলিয়া মরি রে ॥

ত্যাজিয়া কুলমান
তোমাকে সঁপেছি প্রাণ রে বন্ধুয়া
আমার প্রাণ দিয়া
তোমারে শুধু চাই রে বন্ধুয়া ॥

ছেড়ে যদি যাইবায় তুমি
এই মিনতি করি আমি রে বন্ধুয়া
ভুলিও না তোমার হাতে
ধরি রে বন্ধুয়া ॥

তুমি যাইবায় দূরদেশে
মুই নারী পাগলের বেশে রে বন্ধুয়া
বল আমি ধৈর্য কিসে
ধরি রে বন্ধুয়া ॥

মাথায় হাত রাখিয়া বলো
তুমি যদি আমায় ভালো রে বন্ধুয়া
করিম তার আগে যেন
মরি রে বন্ধুয়া ॥

.

১০৭

কার কাছে দাঁড়াব আমি বলো না
আমার বলতে তুমি বিনা
আর যে কিছু রইল না
কার কাছে দাঁড়াব আমি বলো না ॥

আমি তোমার আশা করি
দেখলে বাঁচি নইলে মরি
বন্ধু তোমার চরণ ধরি
করিও না ছলনা ॥

তোমার প্রেমে সর্বহারা
বসত করি পাগলপাড়া
হয়েছি পাগলের ধারা
মুই অভাগী ললনা ॥

আপন ঘরে আছে বাদি
এই যন্ত্রণায় সদায় কাঁদি
আমি মহা অপরাধী
তাই তো দয়া হলো না ॥

করিম বলে ইহলোকে
এই দুঃখ রইল বুকে
তোমায় নিয়ে থাকব সুখে
সে দিন আমার এল না ॥

.

১০৮

বন্ধুয়া রে, কোন প্রাণে ছাড়িতে চাও বলো।
তোমার লাগি কলঙ্ক-নাম জগতে হইল
কোন প্রাণে ছাড়িতে চাও বলো ॥

আপন ঘরে ছয়জন বাদি সর্বদা বিবাদ
তোমারে দেখিব বলে পোড়া মনে সাধ
তুমি আমার আকাশের চাঁদ লোকে বলে কালো
কোন প্রাণে ছাড়িতে চাও বলো ॥

যার প্রেমে যে হয় রে পাগল রূপ দেখিয়া চোখে
আপন মনে ভালো জেনে স্থান দেয় যারে বুকে
দোষী কউক জগতের লোকে তার জন্যে সে ভালো
কোন প্রাণে ছাড়িতে চাও বলো ॥

বুকের দুঃখ রেখে বুকে ভাসি নয়নজলে
কইতাম মনের দুঃখ পাইলে নিরলে
বাউল আবদুল করিম বলে কত আশা ছিল
কোন প্রাণে ছাড়িতে চাও বলো ॥

.

১০৯

পিরিতের ফল রে বন্ধু বুঝিলাম এখন
আগে তো জানি না আমি
প্রেম করলাম যখন রে
বন্ধু বুঝিলাম এখন ॥

পড়ে তোমার প্রেমের ফান্দে
মন কান্দে প্রাণ কান্দে
প্রেম করিলাম মনানন্দে
জানিয়া আপন রে বন্ধু
বুঝিলাম এখন ॥

তুমি হও জগৎস্বামী
তুমি সবার অন্তর্যামী
অন্য কিছু চাই না আমি
চাই তোমার চরণ রে
বন্ধু বুঝিলাম এখন ॥

আমি চির-অপরাধী
তাই তো তোমার কাছে কাঁদি
আপন ঘরে ছয়জন বাদি
করে জ্বালাতন রে বন্ধু
বুঝিলাম এখন ॥

তোমার বিচ্ছেদ-অনলে
বুক ভাসে নয়নজলে
বাউল আবদুল করিম বলে
সামনে মরণ রে বন্ধু
বুঝিলাম এখন ॥

.

১১০

তুমি বোঝো না রে বন্ধু
বোঝে না ব্যথিতের বেদনা
কুলমান নাশিলাম সাগরে ভাসিলাম
যে সাগরের কুলকিনারা মিলে না ॥

আপন হবে বলে ভালোবেসেছিলে
এত দুঃখ দিবে আগে জানি না
পিরিতি করেছি পরানে মরেছি
তুমি যদি ভোলো আমি ভুলি না ॥

বসন্তকালে কমলকলি ফুটিলে
কালো ভ্রমরা যদি আসে না
মধু না থাকিলে ভ্রমরা আসিলে
মধু ছাড়া ফুলে ভ্রমর বসে না ॥

বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে নিশিদিনে
মনে জানে অন্যে তাহা জানে না
বুকে আগুন নিয়া কত থাকি সইয়া
এই আগুন জল দিলে তো নিভে না ॥

সজল নয়নে নিশি জাগরণে
আকুল পরাণে করি ভাবনা
কী সুখে আছি, মরি কি বাঁচি
পাষাণ মনে কি তোমার পড়ে না ॥

তোমারই আশায় মরি পিপাসায়
সে পিপাসা তুমি বিনা মিটে না
আবদুল করিম বলে আশাতে রাখিলে
আপন বলে কোলে তুলে নিলে না ॥

.

১১১

প্রাণবন্ধু কালা
সহিতে না পারি তোমার
বিরহের জ্বালা ॥

বন্ধু রে, তুমি যে পরমপুরুষ
আমি কুলবালা
সাধ করে পরেছি গলে
কলঙ্কের মালা ॥

বন্ধু রে, ভাবিয়া সোনার তনু
হয়ে গেল কালা
ভাবি মনে দুই নয়নে
বহে নদী-নালা ॥

বন্ধু রে, বাউল আবদুল করিম ভাবে
বসিয়া নিরালা
তোমার কাছে চাবি বন্ধু
আমার কাছে তালা ॥

.

১১২

পিরিতি করিয়া সোনা বন্ধু রে
মিছা দোষী আমি সংসারে
তুমি বিনে মনের বেদন জানাব কারে
মিছা দোষী আমি সংসারে ॥

তুমি যদি হলে না মোর যৌবনের সাথি
বলো তবে তোমার সনে কিসের পিরিতি
এই ভাবনা দিবারাতি অন্তরে–
মিছা দোষী আমি সংসারে

তোমার লাগি অন্তরে যে আগুন জ্বলে
কে জানে কার মনের খবর না কহিলে
যার যা ইচ্ছা তাই বলে আমারে–
মিছা দোষী আমি সংসারে ॥

করিম বলে দুঃখ দিলে কী করিব
আমি তোমারে বন্ধু ভালোবাসিব
নাম নিয়া ডুবে মরিব, দুঃখ নাই রে–
মিছা দোষী আমি সংসারে ॥

.

১১৩

আমারে বন্ধু তুমি মনে রাখিও
বুকে বুক লাগাইয়া মায়া দিও ॥

তুমি আমারে বন্ধু ভোলো যদি
আমি বুঝিব আমার বিধি বাদি
তুমি আমার গুণনিধি
গোপনে আইও ॥

চোখ মুদিলে চিত্রপটে রূপ দেখা যায়
আঁধারে আলো তুমি তাই তো মনে চায়
কেউ না থাকিলে তুমি
আমার হইও ॥

বারে বারে তোমারে আর বলিব কত
সামনে আসিবে বন্ধু সুখবসন্ত
দেখা দিয়া জন্মের মতো
শান্তি দিও ॥

তোমার কাছে কী আর বলিব আমি
আমি জানি তুমি অন্তর্যামী
করিম বলে দোষ করিলে
ক্ষমা করিও ॥

.

১১৪

আমি নি তোমার রে তুমি নি আমার রে
বন্ধুয়া রে কও কও কও চাই শুনি
তিলেকমাত্র না দেখিলে বাঁচে না পরানি রে
বন্ধুয়া রে কও কও কও চাই শুনি ॥

আমি তোমার চিরদাসী আমার মনে জানি
দুঃখিনী দাসীর কথা তোমার মনে পড়ে নি রে ॥

যে দিন হতে তোমার প্রেমে সঁপেছি পরানি
সে দিন হতে বারণ হয় না দুই নয়নের পানি রে ॥

তোমার প্রেমে এ জগতে কত মন্দ শুনি
তোমার কথা মনে করে সব করে দেই পানি রে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে আর কিছু না জানি
জগৎ জুড়ে শুনি তোমার দয়াল নামের ধ্বনি রে ॥

.

১১৫

তোমার প্রেমে মন হলো উদাসী
গো রাই রূপসী
তোমার প্রেমে মন হলো উদাসী
মনে জানে প্রাণে জানে
যে দিন দেখলাম নয়নে
সে দিন হতে তোমায় ভালোবাসি
গো রাই রূপসী ॥

তোমার সঙ্গে প্রেম করিয়া
প্রেমের ফাঁদে পড়িয়া
নাম ধরিয়া বাজাই মোহন বাঁশি।
তোমার কথা মনে হলে
অন্তরে আগুন জ্বলে
লাগল গলে তোমার প্রেমের ফাঁসি
গো রাই রূপসী ॥

আমি কালো তুমি ভালো
ভালো তোমার রূপের আলো
দ্বিগুণ ভালো তোমার মুখের হাসি।
তুমি বিনা মন মানে না
আমি আর কিছু জানি না
তোমার প্রেমে জাতিকুল বিনাশি
গো রাই রূপসী ॥

আমি আশেক তুমি মাশুক
যার যা ইচ্ছা লোকে বলুক
ভাবে ভাবুক আমি যে প্রত্যাশী।
যে দিন হতে তোমা হারা
হয়েছি পাগলের ধারা
সর্বহারা করিম হয় সন্ন্যাসী
গো রাই রূপসী ॥

.

১১৬

ওগো পিয়ারি
মন কেন মোর করিলে চুরি
তুমি প্রেমধনে ধনী
আমি হলেম ভিখারি
মন কেন মোর করিলে চুরি ॥

নয়ন বাকা ভঙ্গি বাঁকা
বাঁকা তোমার মুখের হাসি
তোমার সঙ্গে তুলনা হয় না
আকাশের রবি-শশী।
তুমি বিনা প্রাণ বাঁচে না
কী করে ধৈর্য ধরি
মন কেন মোর করিলে চুরি ॥

চাতক বাঁচে মেঘের জলে
জল ছাড়া বাঁচে না মীন
আশেক বাঁচে কেমন করে
মাশুক যদি বাসে ভিন।
সোনার অঙ্গ হলো মলিন
চিত্তে লয় না ঘর-বাড়ি
মন কেন মোর করিলে চুরি ॥

অন্তরে বিচ্ছেদের আগুন
জল ঢালিলে নিভে না
কী করিব কোথায় যাব
উপায় বুদ্ধি মিলে না।
করিমের মনের বেদনা
কার কাছে প্রকাশ করি
মন কেন মোর করিলে চুরি ॥

.

১১৭

সরল তুমি নাম যে তোমার সরলা
শান্ত অতি শুদ্ধমতি
সবাই বলে মন ভালা ॥

দেখলে শ্ৰদ্ধা হয় অন্তরে
কত ছেলে ভক্তিভরে
মা বলে সম্বোধন করে
নিতে চায় চরণধুলা ॥

জানি না কী কর্মফলে
তুমি সঙ্গিনী হলে
হঠাৎ করে গেলে চলে
আমায় ফেলে একেলা ॥

বাঁধা আছি প্রেমঋণে
ভাবি সদা নিশিদিনে
বাঁচে না প্রাণ তুমি বিনে
সাহে না বিচ্ছেদজ্বালা ॥

দয়ালের দয়ার বলে
জন্ম তোমার শুদ্ধজলে
সরল বলে তাই তো হলে
করিমের গলার মালা ॥

.

১১৮

আর জ্বালা সয় না গো সরলা
আমি তুমি দুজন ছিলাম
এখন আমি একেলা ॥

দুনিয়া কঠিন ঠাঁই
দুঃখ কইবার জায়গা নাই গো
মনের দুঃখ কারে জানাই
বসে কাঁদি নিরালা ॥

দুঃখে আমার জীবন গড়া
সইলাম দুঃখ জনম ভরা গো
হইলাম সর্বস্বহারা
এখন যে আর নাই বেলা ॥

আর কত সয় কোমল প্রাণে
আর কতকাল ঘুরব বনে গো
আর কতদিন দুই নয়নে
বহাব নদী-নালা ॥

তুমি চলে গেলে দূরে
প্রাণপাখি যাইতে চায় উড়ে গো
যে-পাখিরে জনম ভরে
খাওয়াইলাম দুগ্ধ-কলা ॥

বলে করিম দীনহীনে
কত কথা উঠে মনে গো
তুমি বিনে এ জীবনে
ভাঙ্গিল ভবের খেলা ॥

.

১১৯

প্রাণে আর সহে না দারুণ জ্বালা
মরণ ভালা
প্রাণে আর সহে না দারুণ জ্বালা ॥

প্রেমফুলের গন্ধে
ঠেকিয়াছি ফান্দে
গলে পড়েছি প্রেমমালা
মরণ ভালা ॥

আহারও না চায় গো মনে
নিদ্ৰা নাই দুই নয়নে
শয়নে স্বপনে যায় না ভোলা
বুঝাইলে না বোঝে মনে
জ্বলে মরি প্রেমাগুনে
অদর্শনে মন প্রাণ উতালা
মরণ ভালা ॥

কোকিল মত্ত মধুর গানে
ভ্রমর মত্ত মধুপানে
আমি কাঁদি বসিয়া নিরালা
দিয়া তুমি প্রেম-আলিঙ্গন
শান্ত করো পোড়া মন
সরল তুমি নাম তোমার
সরলা মরণ ভালা ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
গনার দিন ফুরাইয়া গেলে
যাব চলে আমি যে একেলা
ভাই বন্ধু পিতা মাতায়
কী করিবে ভবের মায়ায়
দমের কোঠায় লাগবে যে দিন
তালা মরণ ভালা ॥

.

১২০

ও নদী রে,
তোর খেলা দেখিব কত আর
এপার ভাঙো ওপার গড়ো
উদ্দেশ্য কী হয় তোমার ॥

কত কষ্টে তোমার কূলে
বান্ধে মানুষ বাড়িঘর
কোনদিন যে ভাঙিয়া নিবায়
জানে না খবর
কালবৈশাখে দেখিতে পাই
দুরন্ত গতি তোমার ॥

ভাঙো গড়ো হাসাও কাঁদাও
আছে তোমার শক্তি-বল
অকালে ডুবাও যে কত
কৃষকের ফসল
দেখি তোমায় বড় চঞ্চল
আসিলে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় ॥

বরাক নামে সিলেট এসে
চলেছ দুই নাম ধরে
কুশিয়ারা দিশেহারা
কখন কী করে
বসে কালনী নদীর তীরে
ভাবছে করিম অনিবার ॥

.

১২১

এবার ফসল ভালো দেখা যায়-বা চাচাজি
এবার ফসল ভালো দেখা যায়
ফাল্গুনে বর্ষিল মেঘ
জমি যাহা চায়-বা চাচাজি ॥

ফসলের নমুনা দেখলে
পেটের ভুক পালায়
ধনী-গরিব সকলের মনে
ভরসা জাগায়-বা চাচাজি ॥

শিলাবৃষ্টি অকাল বন্যায়
বারে-বার চাতায়
রাইত হইলে ঘুমে ধরে না
নানান চিন্তায়-বা চাচাজি ॥

ইরি বোরো ফসল করি
ভাটি এলাকায়
এক ফসল বিনে আমাদের
নাই অন্য উপায়-বা চাচাজি ॥

করিম বলে দোয়া করিও
আল্লায় যেন বাঁচায়
যেতা করিয়া গিরস্তি করছি
কইবার কথা নায়-বা চাচাজি ॥

.

১২২

ছেলেমেয়ে আছ যারা
শিক্ষা-দীক্ষার প্রয়োজন
আসলে ভুল করিও না
ধরো উস্তাদের চরণ ॥

যারা এই সোনার বাংলায়
গরিবকুলে জন্ম নিলায়
যেভাবে বেঁচে থাকা যায়
সময়ে চেষ্টা করণ ॥

দেশ যখন স্বাধীন হলো তাই
সবাই বেঁচে থাকতে চাই
দিনমজুরের মজুরি নাই
উপায় কী বল এখন ॥

বিপন্ন লোক যারা আছে
দুঃখ-কষ্ট করে বাঁচে
ধনী যারা রঙ্গে নাচে
গরিব কাঙালের মরণ ॥

ক্ষুধায় খাদ্য মিলে না যার
রোগ হলে নাই ঔষধ ডাক্তার
বেঁচে থাকার উপায় নাই আর
ভাবি মনে সর্বক্ষণ ॥

ধরল না ফল আশার গাছে
এই দুঃখ বলবো কার কাছে
আবদুল করিম বেঁচে আছে
সুখ-দুঃখ করে বরণ ॥

.

১২৩

ওসমানীর স্মৃতিচিহ্ন
ওই ওসমানী উদ্যান
যেখানে হয় বিজয়মেলা
গাই তখন বিজয়ের গান ॥

সেনাপতি আতাউল গনি
আছে যার নামের ধ্বনি
ডাকনাম ছিল ওসমানী
সিলেটের কৃতী সন্তান ॥

এই সোনার বাংলায় যখন
আসে পাকসেনার আক্রমণ
সাধারণ লোক ভাবে তখন
কী করে বাঁচিবে প্রাণ ॥

শেখ মুজিব ঘোষণা দিলেন
ওসমানী দায়িত্ব নিলেন
মুক্তিবাহিনী হলেন
মিলে হিন্দু-মুসলমান ॥

ওসমানীর নেতৃত্বে তাই
চলিল পাল্টা লড়াই
বলিতে মনে ব্যথা পাই
গেল লক্ষ লক্ষ প্রাণ ॥

করিম বলে, সাহস করে
বীরবাঙালি অস্ত্র ধরে
দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধ পরে
উড়িল বিজয়নিশান ॥

.

১২৪

রোজার পরে আইল
খুশির ঈদের দিন
যে-রোজার বদলা দিতে
আল্লাহ নিজে রয় জামিন ॥

রোজা রেখে সাচ্চা দিলে
ইমান বিশ্বাসের বলে
শিশু যেমন মায়ের কোলে
জনম নিল নবীন ॥

ধুয়ে মুছে মনের কালি
মুখে আল্লাহ আল্লাহ বলি
একে অন্যে গলাগলি
কেউ কারে বাসে না ভিন ॥

বাদ-বিসম্বাদ সবাই ভুলে
আল্লাহু আকবর বলে
দাঁড়াইল এক সামিলে
ভেদ নাই ধনী-দীনহীন ॥

ইসলামে সৌন্দর্য কত
ভেসে উঠলো ছবির মতো
ধনীর কাছে আহ্লাদিত
অসহায় এতিম মিসকিন ॥

যা চেয়েছেন আল্লাহ-নবি
আজ ভেসেছে সেই ছবি
আমলনামায় লেখা হবি
কে কঠিন কে মোমিন ॥

যে আনন্দ আজ দেখা যায়
যে শান্তির বাতাস লাগে গায়
আবদুল করিম তাহাই চায়
খুশি হউক আসমান-জমিন ॥

.

১২৫

ঈদের দিন আসিল রে
রমজানের রোজার পরে
একে অন্যে ঈদ মোবারক
জানায় ঘরে ঘরে রে–
রমজানের রোজার পরে ॥

রোজা-নামাজ আল্লার হুকুম
বান্দার উপরে
একমাস রোজা রাখতে হয়
বৎসরে বৎসরে রে–
রমজানের রোজার পরে ॥

রোজা হয় আত্মসংযম
বুঝতে যেজন পারে
মনের ময়লা দূর করিয়া
পাকপবিত্র করে রে–
রমজানের রোজার পরে ॥

নূতন মন নূতন মিলন
এক বৎসরের পরে
ভালোবাসা মিলামিশা
পবিত্র অন্তরে রে–
রমজানের রোজার পরে ॥

দান-খয়রাত লিল্লা যাকাত
ফিতরা আদায় করে
ভবের সম্পদ ধন দৌলত
আল্লাহ দিলা যারে রে–
রমজানের রোজার পরে ॥

যে-জনে দয়া করে
এতিমের উপরে
করিম বলে আল্লাহ পাকে
তারে দয়া করে রে–
রমজানের রোজার পরে ॥

.

১২৬

শোনেন জনগণ
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন
ধনী-গরিব নারী-পুরুষ
ভোট আছে যার ভোট দেওন
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন ॥

জনগণের রায় মানিবেন
এই প্রতিজ্ঞা করিয়া
দাঁড়াইলেন প্রার্থীগণ
বাংলাদেশ জুড়িয়া
আইন শৃঙ্খলার ভিতর দিয়া
জনমত যাচাই করণ–
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন ॥

ভোটের জন্য যাবেন এখন
গরিব কাঙালের কাছে
গরিবদের কিছুই নাই
তবে তাদের ভোট আছে
দুঃখ কষ্ট করে বাঁচে
সয় যে কত জ্বালাতন–
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন ॥

প্রার্থীদের সমর্থকরা
বন্ধু-বান্ধব মিলিয়া
জনগণের কাছে যাবেন
যার-তার বক্তব্য নিয়া
চেষ্টা করবেন প্রাণ খুলিয়া
দিবারাত্র সর্বক্ষণ–
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন ॥

মজুরকে মজুরি দিয়া
মিছিলে নিবেন এখন
দেখাইতে জনগণকে
কার ভোটার কতজন
এলাকা করিয়া ভ্রমণ
চা-পান চুরট খাওন
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন ॥

গরিব কাঙালকে কাছে
বসাইবেন হাত ধরে
মনে সান্ত্বনা দিবেন
আদর যত্ন করে
দেখা যায় ভোটের পরে
হয় কত পরিবর্তন–
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
ভোট দাও যারে মনে চায়
ভুলিও না প্রলোভনে
টাউট দালালের কথায়
ভালো লোকে ভোট যেন পায়
এই আমাদের প্রয়োজন–
আসিল ইউনিয়ন নির্বাচন ॥

.

১২৭

মশারি নাই সুযোগ পাইল
নিদারুণ মশায়
দুই নয়নে ঘুম আসে না
সারা রাইত ভরা কামড়ায় ॥

নিষেধ করি বারে বারে
মশা তোরা আইছ না ঘরে
তবু আইয়া কানের ধারে
গান গায় হারমুনি বাজায় ॥

পাগলা মশার কামড় খাইয়া
অনেকের হয় ম্যালেরিয়া
কুইনাইন ইনজেকশন লইয়া
দিনরাত্র মাথা ঘোরায় ॥

সারা রাইত মশার কামড়ে
পুয়াপুরি চাইট্টাইয়া মরে ॥
আবদুল করিম চিন্তা করে
কই যাই মশার যন্ত্রণায় ॥

.

১২৮

কেন করিব জন্ম নিয়ন্ত্রণ
কর্তার ইচ্ছা কর্ম চলে
তার ইচ্ছায় জন্ম-মরণ ॥

সৃষ্টি যাহার পালন তাহার
সবারে যোগাবে আহার
তার উপরে ক্ষমতা কার
কী করতে পারে কোনজন ॥

আকাশ পাতাল বসুন্ধরা
চন্দ্রসূর্য গ্রহতারা
তার ইচ্ছায় সমস্ত গড়া
সে নিজেই জীবের জীবন ॥

দুটি সন্তান জন্মের পরে
স্ত্রীকে যদি বন্ধ্যা করে
দুটি সন্তান যদি মরে
কে করতে পারবে পূরণ ॥

শিক্ষা দীক্ষা খাওয়া পরার
জীবনের নিরাপত্তার
দায়িত্বে যে আছে আমার
চলব তার ইচ্ছা মতন ॥

এই সৃষ্টি-জগৎ আসলে
নিয়তির বিধানে বলে
শুদ্ধ জ্ঞান বিবেকের বলে
ভেবে দেখো ওরে মন ॥

বাউল আবদুল করিমে গায়
বিবেকহীন লোভ লালসায়
কত রঙ দেখালো আমায়
ভাবি তাহা অনুক্ষণ ॥

.

১২৯

দিবানিশি শুনি গো
জন্ম নিয়ন্ত্রণের গান
কথা ধরো বিচার করো
নিজের লাভ লোকসান গো
জন্মনিয়ন্ত্রণের গান ॥

যে-পরিমাণ খাদ্যের দরকার
দেশে তাহা নাই
ঋণ করিয়া আনিতে হয়
যেখানে যা পাই
পরনির্ভরশীল হওয়া
বড় অপমান গো
জন্মনিয়ন্ত্রণের গান ॥

আসল কথার বিচার করো
মিলিয়া সকলে
ভাবিয়া কাজ করিতে হয়
জ্ঞানী গেছেন বলে
হিসাব করে কর্ম করা
জ্ঞানীর এই বিধান গো
জন্মনিয়ন্ত্রণের গান ॥

ভালো কথা নিজে বোঝো
অন্যেরে বোঝাও
জনসংখ্যা রোধ করো
আর উৎপাদন বাড়াও
নিজে বাঁচো দেশকে বাঁচাও
বাড়াও দেশের মান গো
জন্মনিয়ন্ত্রণের গান ॥

দেশের সমস্যার মধ্যে
দুর্নীতি প্রধান
দুর্নীতি থাকলে সমস্যার
নাই সমাধান
করিম বলে সময় থাকতে
হও সাবধান গো
জন্মনিয়ন্ত্রণের গান ॥

.

১৩০

শোনেন বন্ধুগণ
করা ভালো জন্মনিয়ন্ত্রণ
ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হইবে
করিলে নিয়ম পালন
করা ভালো জন্মনিয়ন্ত্রণ ॥

জনসংখ্যা বাড়িতেছে
জমি কিন্তু বাড়ে না
ভবিষ্যতে কী হইবে
কর না বিবেচনা
ভালো-মন্দ যে বোঝে না
পাছে পাবে জ্বালাতন ॥

বিচার করে দেখো সবাই
যে চলে হিসাব ছাড়া
অধিক সন্তান জন্মাইয়া
হয়েছে দিশেহারা
শিক্ষা-দীক্ষা খাওয়া-পরা
চলে না ভরণপোষণ ॥

ভয় লেগেছে ময়নার বাপের
দুঃখ কষ্ট দেখিয়া
আসলে জমি নাই
তিন ছেলে তার ছয় মাইয়া
ঘোরে এখন পাগল হইয়া
সদায় অভাব অনটন ॥

পুবের বাড়ির মন্তাজ ভাই
কী সুন্দর মৌজে চলে
অল্প কিছু জমি আছে
এক মেয়ে আর এক ছেলে
এই দুইজন পড়ে ইশকুলে
আনন্দে রয় সর্বক্ষণ ॥

শান্তিতে থাকিবে যদি
শান্তিকামী দুনিয়ায়
হিসাব করে সংসার বাড়াও
বাউল আবদুল করিম গায়
ক্ষেত কামার কলকারখানায়
বাড়াও দেশের উৎপাদন ॥

.

১৩১

সোনার মানুষ বলি তারে
ভবিষ্যৎ চিন্তা করে
যে-জনে তার সংসার গড়ে ॥

হয় যদি ছোটো পরিবার
খাইতে শুইতে বেশ ভালো তার
তারে কয় সুখী পরিবার
দেখো বিচার করে
ছেলে মেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায়
মানুষ করতে পারে
স্বামী-স্ত্রীতে মিল মহব্বত
থাকে সারা জনমভরে ॥

অধিক সন্তানাদি যার
হয় যদি বড় পরিবার
গরিব হলে উপায় নাই আর
অসুবিধায় পড়ে
আগে জন্ম দিয়ে পাছে
হা-হুতাশে মরে
শিক্ষা-দীক্ষা দূরের কথা
পেটের চিন্তায় পাগল করে ॥

হয় যদি মেয়ে বেশি
তার গলে লাগে ফাঁসি
বিবাহে দর কষাকষি
সময়ে সব করে
মটর সাইকেল টেলিভিশন
দাবি তুলে ধরে
দিতে হয় নগদ টাকা
নইলে পাত্র মিলে না রে ॥

মেয়ে বিয়ে দেওয়ার বেলায়
গরিব বড় ব্যথা পায়
তখন মেয়ের পিতা-মাতায়
দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে
যৌতুকের মাল দেওয়ার জন্য
জমি বিক্রি করে
করিম বলে ঋণ করিলে
যমে কি আর বাড়ি ছাড়ে ॥

.

১৩২

বড় ভাবী গো ভাইসাবরে
বুঝাইয়া কইও চাই
আমি তানরে কী বলিব
তাইন যে আমার বড় ভাই ॥

রেডিও টেলিভিশন আর
পত্রপত্রিকায়
নিজে কি বোঝো না গো ভাবী
কোন কথা বোঝায়
চল নিজের বিবেচনায়
নইলে যে আর উপায় নাই ॥

 এক দুই করে আটটি সন্তান
জনম দিয়াছ
চিন্তা করে দেখো গো ভাবী
কী ভেজাল বাড়াইছ
এখনও যে রঙ্গে নাচো
ভাব দেখে আমি ডরাই ॥

বাউল আবদুল করিম ভাবে
বসে নিরালায়
দিনের রোজে দিন পোষে না
কী করি উপায়
মনে ভাবি এই যন্ত্রণায়
দেশ ছেড়ে পলাইয়া যাই ॥

.

১৩৩

কষ্ট করে আছি এখন বাইচ্চা
সাধের জীবন বিফল গেল
পরার তালে নাইচ্চা ॥

এমন যদি আগে জানতাম
হিসাব নিকাশ করে চলতাম
জ্ঞান থইয়া কি পাগল হইতাম
নেংটি মারতাম খেইচ্চা ॥

রসের গাছে রস মিলে না
রসরাজ আর কেউ বলে না
রঙ্গিলা দালানখানা
পড়িতেছে ধইচ্চা ॥

ভবসাগর পাড়ি দিতে
আবদুল করিম ঠেকছে পথে
পারি না নৌকা বাঁচাইতে
দুই হাতে জল সেইচ্চা ॥

.

১৩৪

কারে কী বলিব আমি
ঠেকছি নিজের আক্কলে
টেকা-পয়সা না জমাইয়া
বিয়া করে কোন বেয়াক্কলে ॥

ভাইবন্ধু সব মিলিয়া
আমারে করাইলা বিয়া
আমার গলায় ফাঁসি দিয়া
হাসে তারা সক্কলে ॥

দশ বৎসর হয় করলাম বিয়া
এক ছেলে ছয় মাইয়া
আমারে ঘিরিল আইয়া
দারুণ ভবের জঞ্জালে ॥

লাভ করিতে গেল আসল
এখন ভাবনা কেবল
আবদুল করিম ঘোর পাগল
ভালো ছিল এককালে ॥

.

১৩৫

আমরা দুইজন সুখী মোদের
এক ছেলে এক মাইয়া
মাবুদ আল্লার দয়ার বলে
আছি জান বাঁচাইয়া ॥

করলেন যারা বিয়ে শাদি
সুখের সংসার খোঁজো
যদি বুঝে নেও ভেদবিধি
জ্ঞানীর আশ্রয় নিয়া ॥

অধিক সন্তান জন্ম দিলে
পড়িয়া ভবের ভেজালে
দিন যাইত বিষম গোলমালে
দেখি যে ভাবিয়া ॥

বেদাই ভাই নয়জনের বাপ
এখন গায় পাগলের প্রলাপ
আমরা করি রস-আলাপ
দুই জনে বসিয়া ॥

আবদুল করিম বলে আমার
আসলে ছোট পরিবার
তবু চলে না সংসার
দুই বেলা ভাত খাইয়া ॥

.

১৩৬

স্বাধীন বাংলার ইতিহাস

দুঃখ বলব কারে
মনের দুঃখ বলব কারে
বাঁচতে চাই বাঁচার উপায় নাই
দিনে দিনে দুঃখ বাড়ে ॥

ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যখন
আসে স্বদেশী আন্দোলন
ভারতবাসী সবাই তখন
একই দাবি করে।
ব্রিটিশ যাইবে যখন
ভারতবর্ষ ছেড়ে
সবাই তখন সুখে রবে
এই আশা সবার অন্তরে ॥

পূর্ব থেকেই দেশপ্রেমিকগণ
করে এই মুক্তি-আন্দোলন
অনেকে দিয়েছে জীবন
ন্যায্য দাবি করে
আসিল গণ-আন্দোলন
প্রতি ঘরে ঘরে
জনগণ চায় না যখন
সে কি আর থাকতে পারে ॥

তখন উঠিল শ্লোগান
লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান
শোষক তার শোষণের সন্ধান
সু-কৌশলে করে
ভারতের বাঙালি তখন
ধর্মের ভাওতায় পড়ে
কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান
একে অন্যেরে মারে ॥

আসল কথা ছেড়ে দিয়া
দ্বন্দ্ব আসে ধর্ম নিয়া
বাঙালি ধোঁকায় পড়িয়া
পথ ভুলিয়া মরে
স্বার্থপর শোষকদের
শোষণের ফাঁদে পড়ে
ধর্ম নিয়ে মারামারি
ভারতকে বিভক্ত করে ॥

পাইলাম পূর্ব পাকিস্তান
হইলাম খাঁটি মুসলমান
হলো না শান্তি বিধান
পড়লাম বিষম ফেরে
গত হলো তের বৎসর
স্বাধীনতার পরে
বাঙালিদের তখন
শোষণ-নির্যাতন করে ॥

বাঙালি মজুর-চাষা
বাংলা তাদের মূল ভরসা
উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা
বলে গায়ের জোরে।
মুখের বোল কেড়ে নিতে চায়
মানতে কি আর পারে
ছাত্রগণ তারা তখন
ভাষার জন্য লড়াই করে ॥

স্বাধীন দেশেতে যখন
আসে সামরিক শাসন
জনগণ ভাবে তখন
কী হবে তার পরে।
এই অবস্থায় দশটি বছর
রইল ধৈর্য ধরে
ভয়ে তখন কাপে অন্তর
কখন জানি কী যে করে ॥

আইয়ূব চলে গেল যখন
হলো ইয়াহিয়ার আগমন
রাতের আঁধারে তখন
দেশ আক্রমণ করে
বুদ্ধিজীবীগণকে প্রথম
সন্ধান করে মারে
দেশবাসী তারা তখন
পড়িল ঘোর আঁধারে ॥

বাংলার দালাল রাজাকার
করেছিল কী ব্যবহার
তাহাদের কথা আমার
আজো মনে পড়ে
বাংলার দুর্দিনে
এই দালাল রাজাকারে
ইসলামের দোহাই দিয়া
শত্রুকে সমর্থন করে ॥

শেখ মুজিব ঘোষণা দিলেন
বাঙালি অস্ত্র ধরিলেন
ওসমানী দায়িত্ব নিলেন
মুজিব কারাগারে।
নজরুল-তাজউদ্দিন ছিলেন
দেশের ভিতরে
দেশপ্রেমিকগণ নিয়ে তখন
মুজিবনগর সরকার গড়ে ॥

বিভিন্ন দলনেতা
সবার মুখে একই কথা
অন্তরে দিল ব্যথা
দালাল রাজাকারে।
চলিল পাল্টা লড়াই
মরণের ভয় ছেড়ে
হানাদার বাহিনী তখন
লাখো লাখো মানুষ মারে ॥

দেখামাত্র গুলি চালায়
বাড়ি ঘরে আগুন জ্বালায়
দেশের মানুষ নিরুপায়
হলেন একেবারে।
অনেকেই চলে গেলেন
দেশের বাহিরে
দেশের ভিতরে যারা
পড়লেন নিরাশার আঁধারে ॥

সাধারণ জনগণ
নিরাশা-দূরাশায় তখন
ভাবিতেছে হবে মরণ
বাঁচিবে কী করে।
হানাদার বাহিনী আর
দালাল রাজাকার
ধনরত্ন লুট করে নেয়
মা-বোনদের ইজ্জত মারে ॥

ওসমানীর নেতৃত্বে তাই
চলিল পাল্টা লড়াই
এছাড়া যে উপায় নাই
বাঁচিবে কী করে।
জন্মিলে মরণ আছে
ভেবে তা অন্তরে
হিন্দু-মুসলিম নারী-পুরুষ
সবাই তখন অস্ত্র ধরে ॥

ভারতের সৈন্যগণ
করে ন্যায়ের সমর্থন
এক সঙ্গে মিলে যখন
আক্রমণ করে
হানাদার বাহিনী তখন
অসুবিধায় পড়ে
মিত্রবাহিনীর কাছে
আত্মসমর্পণ করে ॥

উড়িল বিজয় নিশান
সবাই গায় বিজয়ের গান
মিলিয়া হিন্দু-মুসলমান
গায় যে একই স্বরে।
আসিল স্বাধীনতা
নয়মাসে যুদ্ধের পরে
হিন্দু-মুসলিমের একতা
আবার আসিল ফিরে ॥

স্বাধীন দেশেতে এবার
গড়িলেন নতুন সরকার
শেখ মুজিবকে ক্ষমতার
অধিকারী করে।
জানি না কী ভেবেছিলেন
কী ছিল অন্তরে
সমস্ত খুনিদেরে
দিলেন তখন ক্ষমা করে ॥

সন্তানাদি মরে যার
পিতামাতা দাবিদার
খুনিদের খুনের বিচার
আইনে তাহা করে।
দুঃখ কষ্টে চার বৎসর
গত হলো পরে
শত্রুগণ তারা তখন
শেখ মুজিবকে হত্যা করে ॥

সবংশে নিধন করিল
কারেও না ছেড়ে দিল
আপন কর্ম সেরে নিল
শোষক স্বৈরাচারে।
মুক্তিকামী ছিলেন যারা
পড়িলেন আঁধারে
বাঙালি নয় বাংলাদেশী
নামকে পরিবর্তন করে ॥

চলিল স্বৈরশাসন
কত কথা হয় যে স্মরণ
গরিব কাঙালের মরণ
দুঃখ কষ্ট করে।
ভাঙাগড়া দেখলাম কত
মনে তাহা পড়ে
শোষক শয়তান বড় নাদান
কত রঙ সে ধরতে পারে ॥

আসিলেন শেখ হাসিনা
সবার নয় চিনা-জানা
মুজিবের মেয়ে কি না
তাইতো শ্রদ্ধা করে।
ভাবিলেন মুজিব আবার
আসিয়াছেন ফিরে
মানুষ যে মরে যায়
স্মৃতি থাকে এই সংসারে ॥

হাসিনা আসিলেন যখন
আসিল গণ-জাগরণ
মুক্তিকামী সবাই তখন
সমর্থন করে।
অসহযোগ আন্দোলন
গড়ে নিলেন পরে
ন্যায়নিষ্ঠভাবে তখন
নির্বাচনে জয়লাভ করে ॥

হাসিনার নেতৃত্বে তাই
আজ যখন ক্ষমতা পাই
আমাদের দাবি জানাই
একুশ বৎসর পরে।
দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি
লোভ লালসা ছেড়ে
শোষকমুক্ত সমাজ গড়ো
সবাই যাতে বাঁচতে পারে ॥

রক্তের বিনিময়ে তাই
দেশের স্বাধীনতা পাই
অর্থনৈতিক মুক্তি চাই
বলি বারে-বারে।
এখন আওয়ামী লীগ সরকার
দেশকে শাসন করে
হয় যদি শোষণ নির্যাতন
দোষ দিবে শেখ হাসিনারে ॥

দেশের বিপন্ন যারা
আসলে সর্বহারা
অনাহারে যাবে মারা
বাঁচিবে কী করে।
স্বজনপ্রীতি ঘুষ-দুর্নীতি
চলছে ঘরে ঘরে
গরিব বাঁচার উপায় নাই আর
সবলে দুর্বলকে মারে ॥

আমরা মজুর-চাষি
দেশকে যদি ভালোবাসি
সবার মুখে ফুটবে হাসি
দুঃখ যাবে দূরে।
শোষণ-নির্যাতন শুধু
শোষক দলে করে
কৃষক-মজুর এক হয়ে যাও
রবে না আর অন্ধকারে ॥

এই আমার শেষ নিবেদন
মনে ভাবি সর্বক্ষণ
পিঞ্জিরা ছাড়িয়া কখন
পাখি যাবে উড়ে।
মিছে সংসার কেউ নহে কার
থাকতে কি কেউ পারে
করিম বলে সন্ধ্যা হলে
পড়িবে ঘোর আঁধারে ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *