কালঘুম

তিন গোয়েন্দা ভলিউম ১১৪/২ – কালঘুম – শামসুদ্দীন নওয়াব – সেবা প্রকাশনী – প্রথম প্রকাশ : ২০১০

[টিপু কিবরিয়া রচিত ‘ঘুমালে বিপদ’ কাহিনিটি তিন গোয়েন্দায় রূপান্তর করেছেন শামসুদ্দীন নওয়াব]

কিশোর জোর এক চটাশ! শব্দের সঙ্গে কাৎরে উঠতেই চমকে গেল মুসা। ভ্রূ কুঁচকে তাকাল ওর দিকে। কী হলো?

চেহারা বিকৃত করে খসড়-খসড় শব্দে গোড়ালি চুলকাল কিশোর। বলল,

নমরুদের বিপক্ষের সৈন্যরা জ্বালাচ্ছে বড়।

কুঁচকে উঠল মুসার। বুঝতে পারেনি। কারা?

মশা!

মশা? বিস্মিত হলো মুসা। মশা কামড়ালে অমন চেঁচিয়ে উঠতে হবে? আমি তো মশাকে পাত্তাই দিই না!

বিড়বিড় করে বলল কিশোর, পাত্তা ঠিকই দাও, কিন্তু এখন স্বীকার করবে না। বন্ধুর দিকে তাকাল। নাও, চাল দাও।

বোর্ডের দিকে হতাশ চোখে তাকাল মুসা। কালো নিয়ে খেলছে, অবস্থা। কাহিল। কোনটা চালবে বুঝতে পারছে না। হাতি, নৌকা, ঘোড়া সব একটা করে আছে। সৈন্য মোটে তিনটে আছে, আর সব ফরসা করে দিয়েছে। কিশোর। অথচ ও নিজে কিশোরকে তেমন বাগেই পায়নি। একটা ঘোড়া, একটা হাতি আর দুটো সৈন্য খেয়েছে কেবল।

ওর রাজাকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে কিশোর। ঠুটো জগন্নাথের মত অবস্থা রাজার, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। একটু ভুল করে বসলেই বারোটা বাজিয়ে দেবে কিশোর। মাত হয়ে যাবে ও।

দাবা চমৎকার খেলে কিশোর। ওদের পাড়ার অনেকের মধ্যে ও সেরা, কেউ কখনও হারাতে পারেনি। মুসা প্রায়ই চেষ্টা করে সে-রেকর্ড ভাঙার, সময় পেলেই ওকে ধরে নিয়ে আসে ওদের বাড়িতে।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। মুসার রেকর্ড ভাঙার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল, আজও। এরইমধ্যে কম করে হলেও অন্তত পঞ্চাশবার হেরেছে ও। আজও সেই অবস্থা। মুসার ধারণা কিশোরের জটিল মাথায় কুটিল ষড়যন্ত্র চলছে ওকে ফাসাবার। সুযোগ খুঁজছে ও। পেলেই গা করে চেপে ধরবে।

একটা বদ স্বভাবও আছে তিন গোয়েন্দা প্রধানের। খেলার সময় প্রতিপক্ষকে চাল দেয়ার আগে ঠিকমত চিন্তা ভাবনার সুযোগ দেয় না। নিজের চালের সময় মিনিটের পর মিনিট মাথা খাটায়, অথচ প্রতিপক্ষকে এক মিনিট ভাবতে দেখলেই আপত্তি তোলে। সব সময়।

হয়তো ওর সন্দেহ প্রতিপক্ষকে বেশি চিন্তার সুযোগ দিলে ও হেরে যাবে। আসলে কিন্তু তা নয়। কিশোরকে প্রায় কখনোই হারতে দেখেনি ওরা কেউ। তবু ওই বদকম্মটা করাই চাই। এই যেমন এখন মশার কথা তুলে বাগড়া দিল, এরপর আবার কী করে বসে কে জানে!

কী হলো, চাল দাও! তাড়া লাগাল কিশোর। ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটাই চালল মুসা। আড়াই ঘর চাল দিয়ে ওটাকে মন্ত্রীর সহজ টোপে পরিণত করল।

যদি ওটা খেয়েই বসে, তা হলে খবর আছে কিশোরের। তবে মনে হয়।, তেমন কিছু ঘটবে। ওটা যে ফাঁদ, কিশোর বোধহয় বুঝতে পারবে। ঘটলও তা-ই, ওদিকে তাকালই না পাজিটা।

বরং মন্ত্রী এগিয়ে নিয়ে এল ওর, ঠুটো জগন্নাথ রাজার দিকে। আরও কোণঠাসা করে ফেলল। মনে মনে জিভ কাটল মুসা। কিশোরের জন্য ফাঁদ পাতার আগে বরং একটা কিছু এনে রাজাকে আড়াল দেয়া দরকার ছিল। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই। অন্য পথ দেখতে হবে। মাথা চুলকাতে লাগল মুসা।

তোমার আগের ঘরটা বড় ছিল, বলল কিশোর। এত ছোট ঘরে থাকছ কী করে? দম বন্ধ হয়ে আসে না?

চোখ তুলে বন্ধুর দিকে তাকাল মুসা। তারপর নজর বোলাল পিচ্চি রুমের উপর। ঘরের ব্যাপারে মিথ্যে বলেনি কিশোর। সত্যিই ঘরটা খুবই ছোট। দশ বাই দশ। একটা সিঙ্গেল খাট, পড়ার টেবিল, চেয়ার ও ক্লজিট–এতেই ভরে গেছে। নড়াচড়া করার জায়গা নেই। একটু বেখেয়াল হলে এটা-ওটার সঙ্গে ঠোকর খেতে হয়। কয়েকবার পেটে গুঁতো লেগে খুব ব্যথা পেয়েছে ও। কখনও দম বন্ধ হয়ে আসে।

আমি যেমন, আমার রুমও তেমন, এমনই তো হবে, গম্ভীর চেহারা করে হাতি দিয়ে ওর একটা সৈন্য খেয়ে নিল মুসা। অসুবিধে হয় না। গত কয়েকদিনে অভ্যেস হয়ে গেছে। মা বলেছে পরে কোনও বড় রুম দেয়া হবে আমাকে। কিশোরের দিকে ঝুঁকে এল মুসা। ভাল করে দেখো তো, গোঁফের রেখা ফুটেছে আমার?

কিশোর ওর দিকে তাকাল। ঠোঁট মুড়ে হাসল কেবল, কিছু বলল না। তারপর খেলায় ডুবে গেল আবার। কয়েক মুহূর্ত পর নৌকো দিয়ে মুসার একমাত্র ঘোড়াটা খেয়ে বলল, চেক, এবার সামাল দাও দেখি।

এই ভয়টাই করছিল মুসা। হার হলো আজও। তিন গোয়েন্দা প্রধানের। সঙ্গে দাবায় কখনোই এটে উঠতে পারে না ও। সত্যিই খেলতে পারে কিশোর! গেল বার সাব-জুনিয়র জাতীয় প্রতিযোগিতায় এক পয়েন্টের জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।

কিশোর উঠে দাঁড়াল। আজ নিয়ে কবার হারলে, মনে আছে?

কাল এসো, কথাটা পাত্তা না দিয়ে বলল মুসা। ঠিকই তোমাকে হারাব।

আসব, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কিশোর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজায় উদয় হলো আরেকটা মুখ।

মুসার মামাত বোন, তানজিয়া। হ্যালো, মিস্টার মুসা, দাবা-জগতের ভবিষ্যৎ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, কেমন আছ?

রাগিয়ে না তানজিয়া, একটু রেগেই গেল মুসা। একদিন ঠিকই তা-ই হব আমি, নিশ্চিত থাকতে পারো।

বেশ-বেশ, আমরাও চাই তুমি তা-ই হয়ে বিশ্বে হইচই ফেলে দাও।

তানজিয়ার পাশে এসে দাঁড়াল শাওনি, ওর ফুপাত ভাই। প্রায় তানজিয়ারই সমবয়সী।

মুসার এই খালাত ভাই ও মামাত বোন এবছরটা থাকবে ওদের বাড়িতে। বড়রা আলাপ করছেন, ওদের রকি বিচ স্কুলেই ভর্তি করা হতে পারে। হয়তো, সেজন্যই তানজিয়া পেয়েছে ওর আগের ঘরটা। বাড়তি ঘর দুটোর একটায় উঠেছে শাওনি। তাতেই মুসার মনে দাগা লেগে গেছে। নিজে ও বাধ্য হয়ে থাকছে ইঁদুরের এই গর্তে।

মুসা সাহেবের দাবা প্র্যাকটিস কেমন চলছে? হাসতে হাসতে বলল শাওনি।

ভাল না, মুসা বলল। আজও হেরে গেলাম কিশোরের কাছে।

হতাশ হওয়ার মত কিছু হয়নি, শাওনি মাথা ঝাঁকাল। হারতে হারতে একদিন দেখবে জিতে গেছ।

তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ক, শাওনি ভাই।

এই ঘরে কী করে থাকো তুমি, মুসা? ভ্রূ কুঁচকে বলল তানজিয়া।

এখানে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। এই শাওনি, চলো, পালাই খাঁচা

মাথা দুলিয়ে সায় দিল শাওনি। তানজিয়াকে অনুসরণ করে বেরিয়ে গেল।

রবিনের দেয়া একটা বই নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল মুসা।

বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘরটা সত্যি এখন ওর। এমন কী ওদের গেস্ট রুমটাও এটার চেয়ে ঢের বড়।

সত্যি গত কয়েকদিনে দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। খাঁচায় বন্দি পাখির মত মনে হচ্ছে নিজেকে। এত ছোট ঘরে মানুষ থাকতে পারে? অবশ্য মন খিঁচড়ে থাকলে এসব মনে হয় ওর, অন্য সময় নয়।

বইটা মেলে ধরে পড়তে শুরু করল মুসা। জাস্টিন কেস নামের এক মহাকাশচারীকে বন্দি করেছে শয়তান পিঁপড়ে সম্রাট। এগিয়ে আসছে সে… এগিয়ে আসছে…

পড়তে পড়তে তন্দা এসে গেল মুসার। একমহর্তের জন্য ঘুমিয়েই পড়ল নাকি? আচমকা মুখের উপর পিঁপড়ে সম্রাটের গরম শ্বাস অনুভব করল!

ওয়াক! কেমন যেন বিশ্রী গন্ধ, ঠিক কুকুরের খাবারের মত।

এমন সময় একটা আওয়াজ কানে এল ওর।

চোখ মেলে তাকাল।

যতটুকু ভেবেছিল, তার থেকেও ভয়াবহ একটা মূর্তি দেখা গেল। কাল্পনিক পিঁপড়ে সম্রাটের চেয়েও ভয়াবহ।

ওটা বাঘের মাসী, তানজিয়ার প্রিয় পুশি! মুসার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত।

পুশি! বিরক্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠল ও। সরে যা! ভাগ!

চেঁচানিতে কাজ হলো না কোনও। ঝাঁপ দিল পুশি।

ডজ দিয়ে সরে গেল মুসা। একইসঙ্গে থাবা দিয়ে বিছানা থেকে ফেলে দিল ওটাকে।

দাঁতের ওপর থেকে ঠোঁট সরে গেছে পুশির। আবার ঝাঁপ দিল মুসাকে লক্ষ্য করে। কিন্তু বিছানার নাগাল পেল না। বিছানায় উঠতে হলে জোরে লাফ দিতে হবে।

বিছানার এক কোণে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চেঁচাল মুসা। যা, ভাগ!

এমন সময় দরজায় তানজিয়া ও শাওনিকে দেখা গেল। হাসছে।

মুসার উপর নজর স্থির রেখে পেটে শুয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল পুশি। এবার আর মিস হবে না বুঝতে বাকি নেই মুসার।

নাও না ওকে, তানজিয়া! কাতর স্বরে বলল মুসা, অসহায় চোখে বোনের দিকে তাকাল।

হাসির বেগ বেড়ে গেল ওদের দুজনের। আমার বেড়ালকে তোমার, এত অপছন্দ কেন বুঝি না! বলল তানজিয়া।

তানজিয়ার বেড়াল পুশিকে দেখলে সত্যি খুব বিরক্ত হয় মুসা। পুশিও ওকে পছন্দ করে না।

প্লিজ, তানজিয়া, ওটাকে সরিয়ে নাও।

লাফিয়ে বিছানায় উঠল পুশি।

নেমে পড়ল মুসা। ড্রইং রুমে গিয়ে সোফায় বসল। সুস্থির হয়ে টিভি অন করল।

মিঁয়াও মিঁয়াও মিহি ডাক ছাড়তে ছাড়তে কিচেনের দিকে দৌড়ে গেল। খুদে শয়তানটা।

শয়তান বিড়াল! ভাবল মুসা টিভি দেখতে দেখতে। বাগে পেয়ে নিই, এমন ঠ্যাঙানি লাগাব, বাপের নাম ভুলিয়ে দেব একদিন।

দরজায় এসে দাঁড়ালেন মা। হাতে ব্যাগ। উনি ফেরার পথে বাসার সামনের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে প্রায়ই বাজার করে আনেন।

ছেলেকে এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি। কিচেনের দিকে এগোবার ফাঁকে বললেন, তানজিয়া, আজ তুমি রাধবে। শরীর খুব ম্যাজম্যাজ করছে আমার। মেয়েদের রান্নাটান্না শিখতে হয়, তাই ভাই-ঝিকে প্রথম থেকেই শেখাচ্ছেন উনি।

তানজিয়ার জবাব শোনা গেল, আচ্ছা, ফুপু।

.

মাংসটা মোটেই সেদ্ধ হয়নি, খেতে বসে মুসা বলল। চিবাতে চিবাতে দাঁত খসে পড়ল! জানটাও বেরিয়ে যাবে এরপর।

থামবে তুমি? চোখ রাঙাল তানজিয়া। আর কেউ তো কিছু বলছে না! তুমি বললেই তো চলবে না!

খাওয়ার ফাঁকে নীরবে হাসলেন মা। বাবাও। কেউ কিছু বলছেন না।

খাওয়ায় মন দিল মুসা। একটু পর তানজিয়া বলল, ফুপু, আমি গেস্ট রুমের ক্লজিটে কিছু কাপড় রাখি? আমারটা একদম ভরে গেছে। আর জায়গা নেই।

রেখো, অনুমতি দিলেন তিনি। এর

অসম্ভব! আপত্তি করল মুসা। তানজিয়ার ক্লজিট আমার গোটা ঘরের চেয়েও বড়।

তাতে কী? ভ্রূ কুঁচকে উঠল তানজিয়ার।

আমারটা এ বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘর! প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল মুসা। নড়াচড়া করা যায় না ভালমত। মুসার মনে হলো, মামাত বোন আর খালাত ভাই এসে সব দখল করে নিল, ওর জন্য কিছুই আর থাকল না।

তুমি একটা বাঁদর, বেশি নড়াচড়া করো! বললেন মা। তাই ওই ঘরে অমন মনে হয় তোমার।

মায়ের কথা শুনে দমে গেল মুসা। মনের কষ্ট লুকিয়ে নরম স্বরে বলল, মা, আমার একটা বড় ঘর দরকার। আমি গেস্ট রুমে চলে যাই?

ডানে-বাঁয়ে মাথা দোলাতে দোলাতে মা সরাসরি বললেন, না।

কেন, মা?

ওটা গেস্ট রুম, গেস্টদের জন্যে।

গেস্ট? কাঁদো কাঁদো গলায় বলল মুসা। তানজিয়া তো আমার আগের ঘরটা ছেড়ে গেস্ট রুমে থাকতে পারে?

তোমার নানা-নানি…

ওঁরা তো বছরে বড়জোর একবার আসেন, তা-ও দুতিন দিনের জন্যে। আমার এখনকার ঘরে দুতিন দিন ঘুমাতে তাঁদের কোনও অসুবিধে হবে না। শুধু রাতটুকু, বাকি সময় তো সারাবাড়ি ঘুরে বেড়ান ওঁরা।

দুজন মানুষ ঘুমানোর ঘর নয় ওটা, শান্ত স্বরে বললেন মিসেস রাফাত।

কিন্তু, মা…

কোথায় ঘুমাও, এ নিয়ে এত মাথা-ব্যথা কেন তোমার? বললেন উনি। কুম্ভকর্ণের মত ঘুমাও তুমি, ঘুমে বোধহয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। টর্নেডোর মধ্যে খোলা মাঠে ঘুমাতেও তোমার কোনও অসুবিধে হবে না। তা হলে ঘর নিয়ে এত চিন্তা কীসের?

মা, সত্যি! আমার একটা বড় ঘর দরকার। শুধু কী ঘুমাই? ওটায় আমি বাসও করি। অতটুকু ঘরে মানুষ বাস করতে পারে না।

বেশ, ঠিক আছে, বললেন মিসেস রাফাত। আগে ওই ঘরের জিনিসপত্র সরাতে হবে। আগামী শনিবার…

শনিবার? বিষম খেল মুসা। আজই আমি…

বাড়াবাড়ি কোরো না, মুসা, এবার রেগে উঠলেন মা। এখন তোমার ঘরে যাও।

আমার ঘর! এই বাড়িতে আমার কোনও ঘর আছে নাকি? মনে মনে চেঁচিয়ে বলল মুসা। চেহারা থমথম করছে ওর।

এবার যাও, মুসা! বললেন মিস্টার রাফাত।

চেয়ার পিছনে ঠেলে উঠে পড়ল মুসা। রাগে-অপমানে কাঁপতে কাঁপতে ছুটল নিজের ঘরের দিকে।

দরজা বন্ধ করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল ও। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকল, পড়েই থাকল।

.

কাজটা ঠিক করল না, মা, বিড়বিড় করে নিজেকে শোনাল মুসা। তুমি বলেছ শনিবার দিন, কিন্তু তানজিয়া চোখের ইশারা করেছে, তুমি আমাকে ফাঁকি দিচ্ছ। ফারিহার সব কথা শোনো তোমরা, এমন কী শাওনিরও। যা চায়, তাই দাও ওদেরকে। আর আমাকে… গলা বুজে এল ওর। মন শান্ত। হতে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিল।

গেস্ট রুমটা কেউ ব্যবহার করছে না, ভাবল ও। কাজেই মার কথা শুনব না আমি। আজ থেকে ওই ঘরেই ঘুমাব।

সবাই কখন ঘুমিয়ে পড়বে সে অপেক্ষায় থাকল মুসা। যখন নিশ্চিত হওয়া গেল, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, ধীরে ধীরে উঠে বসল। ঘর থেকে বেরিয়ে বেড়াল-পায়ে এগোল গেস্ট রুমের দিকে।

আজ রাতে ওখানেই ঘুমাবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। দুনিয়ার কোনও শক্তি ওকে বাধা দিতে পারবে না। ২। এ নিয়ে বাসায় হয়তো তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবে, ভাবছে মুসা হাঁটতে হাঁটতে। ও অবাধ্য হলে মা ভীষণ রেগে যান, ওকে হয়তো চড় লাগাবেন ধরে। তাতে কী! মুসা মরতে রাজি, তবু আজ থেকে গেস্ট রুমেই ঘুমাবে ও।

সকালে ঘুম ভাঙার পর কী ঘটবে, বুঝতে পারছে না। তবে কপালে যে খারাবি আছে, এটুকু বুঝতে পারছে। হয়তো ওর জীবনটাই বদলে যাবে কাল থেকে।

সকালে ঘুম ভাঙতে মুসার মনে হলো পা দুটো ঠাণ্ডা হয়ে আছে।

কম্বলের তলা দিয়ে বেরিয়ে থাকার কারণে হয়তো, ধারণা করল ও। উঠে বসে কম্বল ঠিক করতে গিয়ে পায়ের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠল।

কার পা ও-দুটো? ওর?

তা হলে এত বড় লাগছে কেন? দানবের মত বিশালু না হলেও, যথেষ্ট বড়। গতকাল সাইজ যা ছিল, তার চাইতে অনেক বড়। তার মানে কি সে লম্বা হয়ে গেছে?

এক রাতের মধ্যে?

ছোটরা নির্দিষ্ট একটা বয়স পর্যন্ত বড় হয়, জানে মুসা। তারপর আর দেহ বাড়ে না, বয়স বাড়তে থাকে কেবল। আর সে বেড়ে ওঠার গতি এত ধীর যে চট করে কারও নজরে পড়ে না।

কিন্তু একরাতের মধ্যে ও এত বড় হলে কী করে?

কী ঘটেছে ওর বেলায়?

পা টিপে টিপে গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে এল মুসা। কিচেন থেকে সবার গলা ভেসে আসছে। নাস্তা-পর্ব চলছে।

ভয়-ভয় লেগে উঠল মুসার। আজ খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার ইচ্ছে ছিল, যাতে কেউ টের না পায় ও গেস্ট রুমে রাত কাটিয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দেরি হয়ে গেছে। সবাই জেগে গেছে। ব্যাপারটা মা জানতে পারলে কী ঘটবে বুঝতে পারছে না ও। কাল খুব বাহাদুরি ফলিয়ে গেস্ট রুমে ঘুমাতে গেলেও, এখন ভয় করছে। ব্যাপারটা মা জানতে পেরেছেন কি না কে, জানে!

সবার অগোচরে বাথরুমের সামনে এসে দাঁড়াল ও। সবকিছু কেমন যেন ছোট ছোট লাগছে।

বাথরুমের দরজার হাতলটা যখন ধরল, কেন যেন মনে হলো ওটা জায়গা বদল করেছে। রাতে কেউ এসে ওটাকে নীচে লাগিয়ে দিয়েছে।

ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল মুসা। মনে হলো, সিলিঙ অনেক নীচে নেমে এসেছে। লাইট জ্বেলে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল।

কে ওটা! ও?!! নাকি আর কেউ!!!

নিজের প্রতিবিম্বের উপর থেকে চোখ সরাতে পারল না। চেহারাটা ওরই, কিন্তু তারপরও কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। গালদুটো একটু ফোলা

ফোলা লাগছে। কালও নাকের নীচের গোঁফের রেখাটা এত স্পষ্ট ছিল না। ঠোঁট দুটোও এক রাতের মধ্যে পুরু হয়ে উঠেছে। এবং কালকের চেয়ে কম করে হলেও ছয় ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে ও।

আমি… আমি বড় হয়ে গেছি? ভাবল ও কাঁপতে কাঁপতে। একরাতের মধ্যে কম করে হলেও কয়েক বছর বয়স বেড়ে গেছে আমার! তার মানে… কাল ওর বয়স ছিল তেরো, আজ হয়েছে সতেরো-আঠারো! এ কী আজব কাণ্ড!

না, না… একশো মাইল বেগে চিন্তার ঝড় বইছে ওর মাথায়। এ হতে পারে না। নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছি আমি। বাস্তবে এসব ঘটতে পারে না।

একমিনিট চোখ বুজে থাকব আমি, ভাবল ও। যখন খুলব, নিশ্চয়ই আবার আগের মুসা হয়ে যাব।

চোখ বুজল মুসা। এক হাজার এক, এক হাজার দুই করে ষাট পর্যন্ত গুনল।

তারপর ধীরে ধীরে তাকাল।

নাহ, কিছুই তো স্বাভাবিক হয়নি। সব আগের মতই আছে।

ও আসলেই এখন সতেরো-আঠারো বছরের তরুণ!

বুকের মধ্যে হৃত্যন্ত্রের লাফালাফি চলছে। রিপ ভ্যান উইঙ্কলের গল্প জানা আছে ওর। একশো বছর ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল সে। ঘুম ভাঙার পর দেখল সব বদলে গেছে।

ওর বেলায়ও তা-ই ঘটেছে নাকি? ভাবল মুসা। টানা কয়েক বছর ঘুমিয়ে কাটিয়েছে ও?

হাত-মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে কিচেনের দিকে ছুটল মুসা। অস্বাভাবিক কিছু ঘটে থাকলে মা-বাবা, ফারিহা-শাওনি-তানজিয়া নিশ্চয়ই দেখতে পাবে।

কয়েক পা এগিয়েছে, এমনসময় হোঁচট খেল মুসা। পা দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হলো, মস্তিষ্কের নির্দেশ মানছে না ওরা।

কিচেনের সামনে এসে আবারও হোঁচট খেল।

মা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা গলা ছেড়ে। বাবা! ভাল করে দেখো তো আমাকে!

তাঁরা দুজন ওর দিকে ঘুরে তাকালেন।

এ কী! এখনও তৈরি হওনি দেখছি, খাওয়া থামিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন মা।

কিন্তু মা! মার কথা খেয়াল না করে বলল ও মরিয়া হয়ে। আমি বড় হয়ে গেছি! একরাতের মধ্যে কম সে কম চার-পাঁচ বছর বড় হয়ে গেছি!

তা-ই নাকি! হাসলেন মা। বাবার উপর দিয়ে নজর ঘুরিয়ে এনে ওর উপর স্থির করলেন। আচ্ছা, এখন জলদি খেয়ে নাও, তারপর কলেজের পোশাক পরে এসো। পনেরো মিনিটের মধ্যে বেরোব আমরা।

হ্যাঁ, জলদি যাও, আদেশের সুরে বলল তানজিয়া। তোমার জন্যে আজ আমাদের সবার দেরি হয়ে যাবে।

বাঘের চোখে মামাত বোনের দিকে তাকাল ও। কিছু বলতে গিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেলল।

পাশাপাশি বসেছে তানজিয়া ও শাওনি। হাঁ করে দুজনকে পালা করে দেখল মুসা। ওর বয়স যদি আঠারোই হয়, তো তানজিয়া আপুর হবে অন্তত উনিশ। শাওনি মুসার দুই-তিন বছরের বড়। তার মানে এখন শাওনির অন্তত বিশ বছর হওয়ার কথা।

কিন্তু ওদের তা হয়নি।

যেমন ছিল, চোদ্দো আর পনেরো বছর বয়স ওদের। ফারিহাও যেমন ছিল তেমনি আছে!

ওরা সবাই ছোট রয়ে গেছে! অসম্ভব! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এ হতে পারে না, কিছুতেই?

এমন করে হেসে উঠল তানজিয়া, যেন মজা পেয়েছে।

বাবা! মরিয়া কণ্ঠে বলল মুসা। অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটে গেছে। আমার মধ্যে। কাল আমার বয়স ছিল তেরো–আজ আঠারো হয়ে গেছে!

পাগল হয়ে গেল নাকি ও? হেসে উঠল শাওনি। ওর গলা শুনে বিস্মিত হলো মুসা।

মা-বাবা দুজনই তাড়াতাড়ি নাস্তা সারায় ব্যস্ত। ছেলের কথা কানে ঢুকছে না।

কাছে গিয়ে মার হাত ধরে ঝাঁকাতে লাগল মুসা। মা! তানজিয়া আমার চেয়ে এক বছরের বড়, শাওনি দুই-আড়াই বছরের। ফারিহা আমার তিন-চার বছর ছোট। কিন্তু আজ আমি এত বড় হই কী করে? বাবার দিকে ঘুরে তাকাল। তোমরা আমাকে দেখে কিছু বুঝতে পারছ না? আমি যে বড় হয়ে গেছি বুঝছ না?

কী শুরু করলে তুমি সাত সকালে? একটু বিরক্ত হলেন মা। কী আবোল তাবোল বকছ? তুমি যা ছিলে, তা-ই আছ। জলদি খেয়ে নাও।

খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন মা। আজ আমার শপিং করতে হবে। তোমরা তৈরি হয়ে নাও। আমরা যাওয়ার পথে তোমাদের নামিয়ে দিয়ে যাব।

কিন্তু, মা…

আবার! জলদি টেবিলে বোসো।

কী করার আছে মুসার? বাবা-মা ওর কথায় কান দিচ্ছেন না। তাদের আচরণে মনে হচ্ছে সবকিছু আগের মত স্বাভাবিকই আছে।

অথচ…

নাস্তা নাকে-মুখে গুঁজে কিচেন থেকে বেরিয়ে এল মুসা। ক্লজিট থেকে স্কুলের পোশাক বের করতে গিয়ে আহাম্মক বনে গেল। ওর আগের ড্রেস সব উধাও হয়ে গেছে। যেসব আছে, আগে কখনও চোখে দেখেনি। সব যেন ওর গায়ের মাপেই তৈরি।

অদ্ভুত কাণ্ড!

এসব তানজিয়া বা শাওনির কোনও ফিচলামি নয়তো? ওর সাথে ইয়ার্কি করছে না তো? ফারিহাটাও ওদের সঙ্গে মিশে…

শুধু ড্রেস নয়, জুতো-স্যাণ্ডেলও ওর বর্তমান সাইজের উপযোগী।

নিশ্চয়ই ওরা আমাকে বোকা বানাতে চাইছে, ভাবল মুসা।

কিন্তু তা-ই বা হয় কী করে? এসব না হয় ওদের কাজ, কিন্তু ওর বড় হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা কী? ওদের পক্ষে এমন কাজ কি সম্ভব?

এমনসময় ঘরে ঢুকল পুশি।

ওহ, না! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। যা ভাগ, বেরিয়ে যা বলছি!

তানজিয়ার বেড়ালটা ওর কথা শোনার কোনও গরজ দেখাল না। এগিয়ে এসে মুসার পায়ের কাছে দাঁড়াল। আজ কোনও ত্যাড়ামির লক্ষণ নেই ওটার মধ্যে। কোনও বদ মতলব নেই। যেন দুনিয়াতে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য ওর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে লেজ দোলানো।

অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে এই বাড়িতে, কাপড় পরার ফাঁকে ভাবল মুসা। ও নিশ্চিত, কোথাও কোনও গড়বড় ঘটে গেছে। বাসার প্রতিটি প্রাণী বদলে গেছে। এমন কী পুশি পর্যন্ত।  

কী হলো, মুসা, জলদি এসো! মা তাড়া দিলেন।

বেরিয়ে এল মুসা। বাবা এর মধ্যে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করে তৈরি। অন্যরাও উঠে পড়েছে। মুসাও উঠল।

কিছুক্ষণের মধ্যে মুসার স্কুলের সামনে এসে পৌঁছল গাড়ি। দরজা খুলে নেমে হাঁটা ধরেছিল ও, কিন্তু থামতে বাধ্য হলো।

মুসা! মাথা দোলালেন মা। কোথায় যাচ্ছ তুমি?

কেন, স্কুলে! বিস্মিত হলো ও।

চলি, ফুপু, বলে তানজিয়া নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। শাওনি ও ফারিহাও।

মুসার স্কুলের দিকে এগিয়ে গেল ওরা।

হাঁ করে ওদের দিকে চেয়ে রইল মুসা। বিস্ময়ের যে ধাক্কাটা খেয়েছে, সেটা এত বড় যে সামলে নিতে পারছে না।

দুষ্টুমি রেখে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো, বাবা ঝঝের সঙ্গে বললেন। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ফিরে এসে গাড়িতে উঠল হতভম্ব মুসা। আসল ঘটনা কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে চেয়ে থাকল বাবার দিকে। কখন যে গাড়ি রকি বিচ কলেজের সামনে থেমে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই করেনি।

কী হলো, মার ডাকে সংবিৎ ফিরে পেল ও। কী চিন্তায় পড়লে আবার!

নামছ না কেন? বাবা তাড়া লাগালেন।

ও যখন বুঝল গাড়িটা কোথায় দাঁড়িয়েছে, সশব্দে ঢোক গিলল।

কলেজ! ভয়ে আতা উড়ে গেল ওর। কলেজে গিয়ে আমি কী করব?

মুসা! মা বললেন চরম বিরক্তির সঙ্গে। তোমার কী হয়েছে বলো তো! আজ এমন করছ কেন? জলদি নামো!

রোবটের মত গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল ও। এ ছাড়া আর কী করার আছে!

যাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাবা বললেন। ছেড়ে দিলেন গাড়ি। ওর। চোখের সামনে দিয়ে ধুলো উড়িয়ে সাঁ করে চলে গেলেন বাবা-মা।

ঘুরে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে বিশাল কলেজ বিল্ডিংটার দিকে তাকাল ও। গলা-বুক শুকিয়ে সাহারা মরুভূমি।

কপালে আজ কী আছে আল্লা মালুম।

ঘণ্টার আওয়াজ কানে আসতেচমকে উঠল ও। বড় বড় ছেলে-মেয়েরা দ্রুত ক্লাসরুমে ঢুকে যাচ্ছে।

অ্যাই ছেলে, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? পিছন থেকে এক টিচারের ডাকে আতঙ্কে লাফিয়ে উঠল মুসা। ক্লাসে যাও! ঘণ্টা পড়ে গেছে শুনতে পাও না? বলতে বলতে সামনে এগিয়ে গেলেন উনি।

স্কুলের প্রথম দিনটার কথা মনে পড়ে গেল ওর। সেই দিন আর আজকের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আজও সেদিনের মতই নিজেকে অসহায়-এতিম মনে হলো।

চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো, কিন্তু লজ্জায়, তা-ও পারছে না। এতবড় ধাড়ি ছেলে কলেজের ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে চেঁচালে মান-ইজ্জত থাকবে নাকি?

এইটুথ গ্রেডের ছাত্র মুসা। স্কুল পাস করতে এখনও বেশ কয়েকবছর বাকি। তারপর না কলেজ!

অথচ…

এখন কী করব আমি? ভাবল মুসা। কী করা উচিত আমার? কোথায় যাব? কোন ক্লাসে ঢুকব? ফার্স্ট ইয়ারে নাকি সেকেণ্ড–কোন ক্লাসের ছাত্র আমি, সেটাও তো জানি না।

বিশাল দেহের একটা ছেলে গটগট করে ওর দিকে এগিয়ে এল। সামনে এসে ঝুঁকে ওর মুখের দিকে তাকাল।

জোর করে হাসার চেষ্টা করল মুসা। তিন গোয়েন্দার অন্য দুই সদস্য যদি দেখত সে-হাসি, সারা জীবন ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত।

নড়ল না ছেলেটা। কটমট করে তাকিয়ে আছে, পারলে চিবিয়ে খায়। মুখে কোনও কথা নেই। ওর নাকের সামনে মুখ এনে কড়া চোখে চেয়ে আছে।

এক পা পিছাল মুসা। শুকিয়ে ওঠা ঠোঁট জিভ দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করল। কোনওমতে বলল, ইয়ে, মানে আমি কোন ক্লাসের ছাত্র জানি না। মানে… আমি…আমার বয়সী ছেলেমেয়েদের ক্লাসরুম কোনটা জানা আছে তোমার?

পরমুহূর্তে বুঝতে পারল প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। কারণ এটা কোনও প্রশ্নই হয়নি।

বাঁদর! রাগে ফেটে পড়ল ছেলেটা। বহুত জ্বালাতন করেছ, এবার পেয়েছি! পালাবে কোথায়! চলো আমার সঙ্গে!

কোথায়! বিস্ময়ে দম আটকে এল মুসার। বলে কী গুণ্ডা ছেলেটা?

আমি তোমার কী করলাম! তোমার সঙ্গে যাব কেন? আমি তো তোমাকে চিনিই না!

বিশাল থাবা দিয়ে ওর কাঁধ খাবলে ধরল ছেলেটা। আঁকাতে লাগল।

চেনো না, না? ন্যাকামি হচ্ছে? ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে। চলো বলছি!

উহ! গুঙিয়ে উঠল মুসা। আরে! কী করছো! ব্যথা লাগছে তো! ছটফট করে উঠল মুসা।

ঠিক এমনি সময়ে বই-খাতা হাতে গেট দিয়ে ঢুকলেন টাক-মাথা একজন বয়স্ক টিচার। চেহারা দেখলেই মনে হয় সবসময় ধমকের মুডে আছেন।

আজ ছুটির পর! মুসার কাঁধ ছেড়ে দিয়ে বলল ধেড়েটা। টেরটি পাবে তুমি, বাছাধন! আমার সঙ্গে চালাকি? বলেই সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। ধীর পায়ে চলে গেল নিজের পথে।

হাঁপ ছেড়ে দ্রুতপায়ে সামনে এগোল মুসা।

সামনে যে-ক্লাস রুম পড়ল, ঢুকে গেল সেটাতেই। একেবারে পিছনের সীটে বসে পড়ল গিয়ে। অচেনা ছেলেটার রক্তচক্ষুর কথা মনে হতে এখনও কেমন যেন লাগছে। কী দোষ করেছে ও?

কয়েক মুহূর্ত পর এক মহিলা টিচার ঢুকলেন ক্লাসে। চুপ হয়ে গেল ক্লাস। ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

এসো তা হলে আজকের কাজ শুরু করা যাক, বললেন উনি। তোমাদের বইয়ের সাতান্ন পৃষ্ঠা খোলো দেখি।

এটা কীসের ক্লাস? ভাবল মুসা। পাশের ছেলেটার সামনের খোলা বইটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল।

হায় খোদা! এ যে দেখছি যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়!

এ হতে পারে না।

ওটা অঙ্ক বই!

অঙ্কে সে রীতিমত কাঁচা-ক্লাস এইটের অঙ্কই ঠিকমত মাথায় ঢোকে। কলেজের অঙ্ক করবে কীভাবে?

হঠাৎ খেয়াল করল, টিচার ওরই দিকে চেয়ে আছেন।

মুসা! তোমার কী এখন এই ক্লাসে থাকার কথা?

না! উঠে দাঁড়াল ও। ভুল হয়ে গেছে, ম্যাডাম। যাচ্ছি।

ইচ্ছে করলে থাকতে পারো, অসুবিধে নেই।

না, না, ঠিক আছে! বলেই দৌড়ে বেরিয়ে গেল ও।

এখন?

এখন কী করব আমি? ভাবল ও করিডরে দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সময় পার করে দিল।

একসময় ঘণ্টা পড়ল। হলের ও-মাথা থেকে এগিয়ে এলেন একজন টিচার। খাটো, সাদা-কালো একমাথা কোঁকড়া চুল। সামনের ক্লাস রুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন মুসাকে দেখে।

আজও তুমি দেরিতে এসেছ? ভ্রূ কুঁচকে বললেন তিনি। এসো এসো, জলদি ঢোকো ক্লাসে।

গোবেচারার মত ক্লাসে ঢুকল ও। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ছে, যেন ক্লাসটা কোনওমতে ম্যানেজ করে নিতে পারে।

কিন্তু আসলেই ফাটা কপাল ওর।

এটা ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাস।

এখানে পড়ানো হচ্ছে আনা কারেনিনা। একে ওটা বিরাট বই, তারওপর ক্লাসের প্রত্যেককে ওটা থেকে একটু একটু করে পড়তে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, পড়তে পারলেও মুসা আগের কাহিনি জানে না।

তুমি সবার শেষে এসেছ, মুসা, সার বললেন। তাই আজ তোমাকে দিয়েই শুরু করতে চাই। শুরু করো, সাতচল্লিশ পৃষ্ঠা থেকে।

উঠে দাঁড়াল মুসা। উসখুস করতে লাগল। ইয়ে… মানে… সার, আজ আমি ইংরেজি বইটা আনতে ভুলে গিয়েছি।

বেশ করেছ, হাসির ভঙ্গি করলেন উনি। ওর পাশের ছেলেকে বললেন, রয়, তোমার বইটা ওকে একটু ধার দাও দেখি।

রয় মার্টিন এগিয়ে দিল বইটা।

ধন্যবাদ, বিড়বিড় করে বলল মুসা। পা কাঁপছে ঠক্ঠক্ করে। ঘাম ছুটে যাওয়ার অবস্থা।

পৃষ্ঠা সাতচল্লিশ, আবারও বললেন সার।

বই খুলল ও। নির্দিষ্ট পৃষ্ঠা বের করল। অজান্তে একটা লম্বা শ্বাস বেরিয়ে এল। পৃষ্ঠাটা বিশাল, কঠিন কঠিন সব শব্দ দিয়ে ভরা। ওগুলো পড়ে বোঝার চেয়ে সাঁতার কেটে সাগর পাড়ি দেয়াও অনেক সহজ হবে।

দাঁতভাঙা রাশান নাম-কীভাবে উচ্চারণ করবে মুসা? এক ক্লাস ছাত্র ছাত্রীর সামনে বেইজ্জত হতে চলেছে বুঝতে বাকি নেই ওর।

ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম বাক্যটা দেখে নড়াচড়া দূরে থাক, শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। হৃৎপিণ্ডের গতি থেমে পড়ার অবস্থা।

বিরাট বাক্য। শুধু বিশাল বললে কমই বলা হবে, বি-শা-ল। যেন লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে শুরু হয়ে টেক্সাসে গিয়ে থেমেছে ওটা। এক বাক্যেই পুরো পৃষ্ঠা কাবার!

ওদিকে নীরবতার সাগরে ডুবে গেছে পুরো ক্লাস। একটা পিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে।

ছাত্র-ছাত্রীরা হাঁ করে চেয়ে আছে মুসার দিকে। যেন চিড়িয়াখানার আজব কোনও জন্তু ও, খাঁচা ভেঙে পালিয়ে এসেছে। চোখেমুখে ওদের নীরব কৌতূহল।

চিন্তিত ভঙ্গিতে নীচের ঠোঁট মুখে পুরে চুষতে লাগল মুসা। কী করবে দিশে পাচ্ছে না। সারের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না লজ্জায়। পৃষ্ঠার শুরুতেই একটা বিরাট নাম আছে, ওটা উচ্চারণের সাধ্য ওর নেই!

মাথা নীচু করে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বইয়ের দিকে।

কী হলো! নড়েচড়ে বসলেন সার। চুপ করে আছ কেন, পড়ো!

লম্বা একটা দম নিয়ে শুরু করল মুসা, দ্য ইয়াং প্রিন্সেস কিটি শেরব্‌… শেরবা… শেরবি…

দাঁত ভাঙার অবস্থা হতে থেমে পড়ল বাধ্য হয়ে।

শেরবেট স্কায়া, শুদ্ধ করে দিলেন সার। হাসলেন। শেরবি নয়। নামটা আগের প্রত্যেকটা ক্লাসে বহুবার উচ্চারণ করা হয়েছে, মুসা। এতদিনে তোমার মুখস্থ হয়ে যাওয়ার কথা।

কী কায়া? কি বললেন সার? উনি বলে দেয়ার পরও ওর দ্বারা বিদঘুঁটে শব্দটা উচ্চারণ করা সম্ভব হলো না। দেহটা আঠারো বছরের হলে কি হবে, ওর আসল বয়স তো তেরো। তেরো বছরের একটা ছেলের পক্ষে কি এত বিচ্ছিরি শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব? মোটেই না।

রয় মার্টিন, বইটা ওর কাছ থেকে নিয়ে তুমি পড়ো দেখি, মেজাজ খাট্টা করে আদেশ দিলেন সার।

 তা-ই করল ছেলেটা, উঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে পড়তে শুরু করল। গল্পটা বোঝার চেষ্টা করল মুসা। কিন্তু একটা শব্দও মাথায় ঢুকল না, এ ধরনের শব্দ জীবনে শোনেইনি, বুঝবে কী করে?

ভীষণ ক্লান্ত লাগছে ওর। অজান্তে হাই তুলল একটা।

বিরক্ত লাগছে নাকি, মুসা? প্রশ্ন করলেন সার। ব্যাপারটা দূর করে দিচ্ছি, দাঁড়াও। রয় মার্টিন, থামো। থামল ও। মুসা, ও যেটুকু পড়ল, এবার তুমি তার অর্থ বলো।

অর্থ! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল, মুসা। একি অনর্থ কাণ্ড! অর্থাৎ ঘটনা খুলে বলতে হবে?

হ্যাঁ, উপর-নীচে মাথা দোলালেন সার।

নীরবে কয়েকটা মুহূর্ত কাটিয়ে দিল মুসা।

কখন ক্লাস শেষ হবে? ভাবছে মনে মনে।

অর্থ? এবার বিড়বিড় করে নিজেকে শোনাল। কুঁচকে উঠল, এমন ভঙ্গি করল, যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে। ইয়ে… মানে…সার…

ক্লাসের সবগুলো চোখ মুসার উপর স্থির। গিলছে ওকে। কয়েকটা ছেলে মজা পেয়ে হাসছে নীরবে।

অধৈর্য হয়ে উঠলেন সার। কী হলো, বলো! খালি বল খেলে বেড়ালেই চলবে? পড়াশোনা করতে হবে না?

কী করা উচিত মুসার? কী-ই বা করার আছে। একটা বর্ণও তো বুঝতে পারেনি, কী ঘোড়ার ডিম বলবে? ক্লাস থেকে পালানোর ফিকিরে আছে। চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

ইয়ে… সার, আমার খুব বাথরুম পেয়েছে।

চাপা হাসির রোল পড়ল। সারের ঠোঁটে এক টুকরো হাসির আভাস ফুটে উঠতে না উঠতে মিলিয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে উঠলেন।

যাও, বললেন উনি। তাড়াতাড়ি এসো।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

আপাতত এই বিপদ থেকে তো উদ্ধার পাওয়া গেছে, ভেবে ও খুশি।

ত্রস্ত পায়ে করিডর ধরে এগিয়ে চলল মুসা। একশো মাইল বেগে দুইশো রকমের চিন্তা বয়ে যাচ্ছে মাথায়। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে সামনে এগোচ্ছে ও। একটা দরজার সামনে এসে ব্রেক কষল। উপরে লেখা: রিচার্ড স্যালন, প্রিন্সিপাল।

কী মনে করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভেতরে ঢুকব? ভাবল মুসা। প্রিন্সিপাল সারকে খুলে বলব সব?

 কিন্তু ভিতরে যাওয়া কি উচিত হবে? নতুন কোনও সমস্যা যদি তৈরি হয়? তখন কী হবে!

নাহ্, ঢুকব না। ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল ও, এমন সময় ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল কেউ তেড়ে আসছে ওর দিকে। এমন কেউ, যাকে মোটেই আশা করেনি ও।

ও… তুমি তা হলে এখানে? সেই বিশালদেহী ছেলেটার গলা শুনে আঁতকে উঠল মুসা। আর দেরি করতে পারছি না। চলো! ওইদিকটায় চলো! হাত বাড়াল কলার চেপে ধরবে বলে।

হঠাৎ করে প্রিন্সিপালের অফিসটাকে এ-মুহূর্তে নিরাপদ জায়গা বলে মনে হলো মুসার। এই ধেড়ে ছোঁড়া যে-ই হোক না কেন, প্রিন্সিপালের অফিসে ঢুকে ওকে ধোলাই দেয়ার সাহস পাবে না।

আমার কাজ শেষ হওয়ার পর, মারফতি হাসি ফুটল ছেলেটার মুখে, তোমাকে আর চেনা যাবে না। হাঃ হাঃ হাঃ।

চট করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল মুসা। ডেস্কের পিছনে হ্যাংলা পাতলা এক লোককে বসে থাকতে দেখা গেল। মাথা জুড়ে চকচকে টাক। নাকের নীচে বাহারি গোঁফ। ঘরে আর কেউ নেই। কুতকুতে চোখ তুলে ওর দিকে তাকালেন প্রিন্সিপাল।

কে? ও তুমি? বললেন গমগমে কণ্ঠে। এত শুকনো লোকের গলা এমন মোটা হতে পারে, ভাবাই যায় না। কোন ইয়ারের ছাত্র যেন?

কয়েকবার জোরে জোরে দম নিল মুসা। উজবুকের মত চেয়ে আছে সারের দিকে। কেন এসেছে, ভয়ে, উত্তেজনায় সব গুলে খেয়ে হজমও করে ফেলেছে।

ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ফার্স্ট ইয়ার।

ইয়ে… সার… আমতা আমতা করতে লাগল মুসা। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

বসো, মুসা, সামনের চেয়ার দেখিয়ে শান্ত স্বরে বললেন সার। ভয় একটু একটু করে কেটে যাচ্ছে। প্রিন্সিপালকে যতটা কড়া ভেবেছিল, দেখা যাচ্ছে ততটা নন। এখন বলো কী হয়েছে।

কোথাও বড় ধরনের কোনও গণ্ডগোল হয়ে গেছে, সার, শুরু করল মুসা। তারপর হড়বড় করে বলে ফেলল, এই মুহূর্তে এখানে আমার থাকার কথা নয়। আমি কলেজের ছাত্র নই, সার।

একটু একটু করে ভ্রূ কুঁচকে উঠল প্রিন্সিপালের। মানে! তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না আমি, মুসা।

সার, আমি স্কুলের ছাত্র, গলা দিয়ে আপনাআপনি কান্নার মত একটা আওয়াজ ঠেলে বেরিয়ে এল মুসার। আমি ক্লাস এইটে পড়ি। কলেজের ছাত্র নই।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ওর দিকে চেয়ে রইলেন প্রিন্সিপাল। চেহারায় অস্বস্তি। উঠে হাত বাড়িয়ে মুসার কপাল ছুঁয়ে দেখলেন তিনি।

মুসা বুঝতে পারল ওর জ্বর উঠেছে কি না তাই চেক করছেন সার। ওর কথা নিশ্চয় পাগলের প্রলাপ ভাবছেন উনি।

তাই হবে। নইলে কপাল ছুঁয়ে দেখবেন কেন?

হাসির ভঙ্গি করলেন প্রিন্সিপাল। শান্ত, নরম স্বরে ধীরে ধীরে বললেন, মুসা, এই কলেজেরই ছাত্র তুমি। আমার কথা বোঝা গেছে? কে বলল তুমি ক্লাস এইটে পড়ো?

আমি… আমি জানি আমাকে দেখে কলেজের ছাত্র বলেই মনে হয়, আমতা আমতা করে বলল ও। কিন্তু আসলে আমি স্কুলের ছাত্র। একটু আগে ইংলিশ ক্লাসে সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে। প্রথম শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে আমার দাঁত ভাঙার জোগাড় হয়েছিল। আমি সত্যি…

শান্ত হও, মুসা, ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন প্রিন্সিপাল। তুমি ভুল করছ। একটা ফাইল বের করে খুলে ধরলেন। ঝুঁকে তীক্ষ্ণ চোখে ওটা দেখল মুসা। ছাত্র-ছাত্রীদের নামের তালিকা ওটা। দেখো, চেয়ে দেখো।

সবার উপরে নিজের নামটা দেখে চোখ আলু হয়ে উঠল মুসার। এ কী করে সম্ভব! ও স্বপ্ন দেখছে না তো?

চোখ বুজল। লম্বা করে দম নিয়ে তাকাল।

নাহ্, স্বপ্ন নয়। যা ঘটছে সব সত্যি। কঠোর বাস্তব।

দেখলে? হাসলেন প্রিন্সিপাল। কলেজেরই ছাত্র তুমি, মুসা। ফাঁকিবাজও নও, তোমার রেজাল্ট অন্তত তা-ই বলে। এখন বলল, কেন তুমি পড়া দেখে ভয় পাচ্ছ?

কিন্তু… কিন্তু… আগে আমি কখনও কলেজের পড়া… প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল মুসা।

কী ঘটছে এসব? এসবের মানে কী?

একলাফে কয়েকটা বছর বয়স বেড়ে গেল কীভাবে? মাঝখানের বছরগুলো কোথায় গেল? কেন মনে করতে পারছে না ও?

আপনি বুঝতে পারছেন না, সার, মরিয়া হয়ে বলল মুসা। কাল আমার বয়স ছিল তেরো। আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর দেখি আমার বয়স অনেক! আমার দেহ বড় হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনের বয়স বাড়েনি, তেরোই রয়ে গেছে!

আমি জানি, জবাব দিলেন প্রিন্সিপাল।

আমি জানি তুমি গোয়েন্দাগিরি করতে ভালবাসো, বলে চলেছেন উনি। কিন্তু তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে সেটা আমাকে বিশ্বাস করতে বলো তুমি?

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সার। মুসার বুঝতে বাকি রইল না বিরক্ত হচ্ছেন উনি। একটু একটু করে রেগেও উঠছেন।

পদার্থবিদ্যার ক্লাস শুরু হবে, বললেন সার। এখন ক্লাসে যাও।

জ্বি?

ফিজিক্সের ক্লাস শুরু হবে, আবারও বললেন সার, এখানে বসে থেকে সময় নষ্ট কোরো না, যাও!

কিন্তু, সার, আমি কিছুই বানিয়ে বলিনি, যা বলেছি, সত্যি বলেছি।

আর একটা কথাও নয়, উঠে দাঁড়ালেন প্রিন্সিপাল। থমথমে গলা। যাও, ক্লাসে যাও।

নিরুপায় হয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। ধীর পায়ে বেরিয়ে এল প্রিন্সিপালের অফিস থেকে। সেই বিশাল ছেলেটার খোঁজে চারদিকে তাকাল ভয়ে ভয়ে।

নেই। আশপাশে কোথাও নেই ও। করিডর ফাঁকা।

এই নরক থেকে পালাতে হবে, ভাবল মুসা। যেভাবে হোক পালাতে হবে। ক্লাসের দিকে না গিয়ে হনহন করে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করল ও।

গেটের কাছাকাছি এসে কেউ ওকে ফলো করছে কি না বুঝবার জন্য পিছনে তাকাল। নাহ্, কেউ নেই।

কিন্তু গেট দিয়ে বেরোতেই কারও সাথে ধাক্কা খেল জোরে।

আরেকটু হলে মাটি শোকার ব্যবস্থা হয়েছিল আর কী! পড়তে পড়তে কোনও মতে সামলে নিল নিজেকে।

উহ্! নীরবে চেঁচিয়ে উঠল ওর অন্তরাত্মা।

পাশেই একটা মেয়েকে রাস্তায় বসে থাকতে দেখা গেল। চারদিকে বই খাতা ছড়িয়ে আছে। মেয়েটার সাথেই ধাক্কা খেয়েছে ও, বুঝতে অসুবিধে হলো না।

লজ্জিত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল মুসা। তুমি ব্যথা পাওনি তো? মিমি করে বলল। আমি… আমি দুঃখিত।

নীরবে মাথা দোলাল মেয়েটা। না, ঠিক আছে। ভুল তো আমারও হয়েছে।

দুঃখিত, আবারও বলল মুসা। তোমাকে দেখতে পাইনি। দিনটা আমার ভীষণ বাজে যাচ্ছে আজ।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, হাসল মেয়েটা। আমি ব্যথা পাইনি।

মেয়েটার বয়স বারো-তেরোই হবে। মিষ্টি চেহারা। মাঝ পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে বেণী করে বাঁধা ঘন চুল। ধূসর চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা।

বই-খাতা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।

দাঁড়াও, আমি হেল্প করছি, বলে মেয়েটার পাশে বসে পড়ল মুসা। ঝুঁকতেই মাথার সাথে মাথা ঠুকে গেল দুজনের।

উহ! গুঙিয়ে উঠল মুসা। এই দেখো, আবার তোমাকে ব্যথা দিলাম। আসলে নিজেই ব্যথা পেয়েছে।

আমি কিছু মনে করিনি, বলল মেয়েটা হাসতে হাসতে। বই-খাতা তুলে উঠে দাঁড়াল ওরা।

আমার নাম সানজানা।

আমি মুসা।

তোমার কী হয়েছে, মুসা? ওকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করতে করতে বলল সানজানা। তাড়া আছে বুঝি খুব?

কী বলার আছে মুসার! এর মধ্যে ওর উপর দিয়ে কত ধকল গেছে, কীভাবে বোঝাবে ওকে?

আমাকে তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়তে হবে, জবাব দিল ও। তারপর শুধরে নিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। পরে আবার দেখা হবে।

হন-হন করে হাঁটতে শুরু করল মুসা। প্রিন্সিপাল সার যদি জানতে পারেন ও কলেজ থেকে ভেগেছে, তা হলে সাড়ে সর্বনাশ। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়া উচিত।

বাসায় ফিরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। আপাতত ঝামেলার হাত থেকে বাঁচা গেছে ভেবে খুশি।

ড্রইং রুমে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল সোফার উপর।

ওহ, কী একটা দিন গেল রে বাবা! ভাবল মনে মনে। এমন দিন যেন কারও জীবনে কখনও না আসে।

কলেজের ওই বিশালদেহী রহস্যময় ছেলেটার কথা মনে হতেই আতঙ্কিত হয়ে উঠল মুসা। বিশাল থাবা ছেলেটার, একটা ঘুসি যদি মুখের উপর পড়ত, দ্বিতীয়টা পড়ার জায়গা থাকত না।

আজ মোটামুটি নিরাপদেই বাসায় ফেরা গেছে।

কিন্তু কাল?

কাল কী হবে?

.

তানজিয়া আর শাওনি স্কুল থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত টিভি দেখে কাটাল মুসা।

ওরা এখন পিচ্চি। মুসাকে দেখাশোনা করবে কী, উল্টে মুসারই ওদেরকে দেখেশুনে রাখতে হবে।

আনা কারেনিনায় একটু নজর বোলাতে হয়। কারণ ক্লাস ভর্তি ছাত্র ছাত্রীর সামনে আর বেইজ্জত হতে চায় না ও। কিন্তু যে সমস্ত খটমটে নাম, বাবা! পড়তে গেলে মাথা ব-বন্ করে। উচ্চারণ করতে গেলে দাঁত খসে পড়ার অবস্থা হয়।

কলেজের কথা মনে হতেই চোখের সামনে বিশালদেহী ছেলেটার চেহারা, ভেসে উঠল। কাল ওকে কীভাবে সামাল দেবে ও?

সাহায্যের জন্য কিশোরের কাছে যাবে কি না ভাবল একবার। পর মুহূর্তে চিন্তাটা বাতিল করে দিল। বিপদটা ওর, অযথা আরেকজনকে জড়াতে যাওয়া কেন? একাই এ বিপদের মোকাবিলা করবে ও, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল মুসা।

.

রাত হলো। ঘুমাতে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এল। নিজের রুমে এসে দেখল তানজিয়া ঘুমাচ্ছে ওর বিছানায়।

সুতরাং ধীর পায়ে গেস্ট রুমের দিকে এগিয়ে চলল মুসা। নিঃশব্দে ঢুকে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ল।

এই বিপদ থেকে কীভাবে উদ্ধার পাব আমি? ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করল ও। এসব কী ঘটছে জানা নেই। কেন ঘটছে, জানে না।

কী করা উচিত, বুঝতে পারছে না।

কীভাবে আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে ও?

চোখ মেলল মুসা। খোলা জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে মুখের উপর। সকাল হয়ে গেছে।

সবার আগে কলেজের কথা মনে পড়ল ওর। সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা শুকিয়ে উঠল। আবার চোখ বুজল। মরে গেলেও আর কলেজে যাচ্ছি না ভাবল মনে মনে। কিছুতেই না। কেন যেন বিছানায় শুয়ে থাকাই সবচেয়ে : নিরাপদ বলে মনে হলো। যেন তাতেই সব সমস্যার হিল্লে হয়ে যাবে।

মুসা! মার ডাক ভেসে এল। জলদি ওঠো! এত বেলা পর্যন্ত ঘুমায় নাকি কেউ!

উঠতে ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুক্ষণ পড়ে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।

মুসা!

এবার মার কণ্ঠ কেমন যেন অন্যরকম ঠেকল ওর কানে। এত জোরে চেঁচান না কখনও উনি। ব্যাপার কী?

লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল মুসা। পা ঝুলিয়ে দিল।

দাঁড়াও, দাঁড়াও।

এ কী!

তীক্ষ্ণ চোখে পায়ের দিকে তাকাল মুসা। অন্যরকম লাগছে না? আগের মত মনে হচ্ছে না?

হ্যাঁ, তাই তো! আগের পা ফিরে পেয়েছে মুসা!

তার মানে… তার মানে আমি আবার আগের দেহ ফিরে পেয়েছি, ভাবল ও। তেরো বছর বয়সে ফিরে গেছি!

চোখের সামনে দুহাত তুলে ধরল। ছোট হাত। আর যাই হোক, এ হাত ষোলো বছরের কোনও ছেলের হাত হতে পারে না।

মুসা আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছে। কোনও ভুল নেই তাতে।

গেস্ট রুম থেকে বেরিয়ে বাথরুমে ঢুকল ও। আয়নার সামনে দাঁড়াল।

জলদি এসে নাস্তা সেরে নাও! তাড়া লাগালেন মা।

কানে ঢুকল না। নিজেকে দেখায় মগ্ন।

হ্যাঁ, ওই তো সেই মুসা, দাঁড়িয়ে আছে আয়নার সামনে। তেরো বছরের মুসা।

ইয়াহ্ হু! চাপা আনন্দে ফেটে পড়ল ও। খুশিতে এমন এক লাফ দিল যে আরেকটু হলে বাথরুমের ছাদে ঠুকে যেত মাথা।

সব সমস্যার হিল্লে হয়ে গেছে। ওকে আর কলেজে যেতে হবে না আজ! ওই ব্যাটা নচ্ছার ভালুকের মুখোমুখিও হতে হবে না। কী মজা!

দুঃস্বপ্নের পালা শেষ হয়েছে তা হলে। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে। এসেছে ও। সব ঠিক হয়ে গেছে।

মুসা, দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু, মার ডাকে সংবিৎ ফিরল ওর।

কিন্তু তার কণ্ঠ অন্যরকম লাগছে কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে? ভাবল ও। ঘরে এসে স্কুল ড্রেস পরে তাড়াতাড়ি কিচেনের দিকে এগোল মুসা।

ঝড়ের বেগে কিচেনে ঢুকল। মা, আজ কিন্তু আমি…

সামনের দৃশ্য দেখে গলায় কথা আটকে গেল ওর। কিচেন টেবিলে বসে আছেন দুই অপরিচিত মানুষ। একজন মহিলা, একজন পুরুষ। জীবনে কখনও দেখেনি মুসা ওঁদের।

হাঁ করে কী দেখছ? বললেন মহিলা। তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে নাও। স্কুলে যেতে হবে না?

আমার মা-বাবা কোথায়? অনিশ্চিত গলায় বলল মুসা। চোখদুটো। এখনও রসগোল্লার মত হয়ে আছে। ফারিহা, শাওনি ভাই, তানজিয়া?

দৃষ্টি বিনিময় করলেন দুজন।

শরীর খারাপ করেছে নাকি, সান? বললেন পুরুষ লোকটা।

সান? মানে ছেলে? মুসা কেন তাঁর ছেলে হতে যাবে?

মহিলা উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে মুসার কপালে হাত রেখে বললেন, কই, জ্বর-টর তো নেই দেখছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও দেখি। আজ তোমার বাবা তোমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসবেন।

কে আমার বাবা! বলল হতভম্ব মুসা। আমার বাবা-মাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন আপনারা?

কী আবোল-তাবোল বকছ? বিরক্ত গলায় বললেন ভদ্রলোক। লুকিয়ে রেখেছি মানে?

আপনাদের তো চিনি না আমি! আপনারা..

চুপ করো! ধমক লাগালেন এবার মহিলা। এ সব কী বলছ তুমি? দেরি করে স্কুলে গেলে বকা খেতে হবে, সে খেয়াল আছে?

এমন সময় একটা বেড়াল ঢুকল রান্নাঘরে। জীবনে ওটাকে এই প্রথম দেখল মুসা। এগিয়ে এসে আহ্লাদী ভঙ্গিতে ওর পায়ের সঙ্গে গা ঘষতে লাগল বেড়ালটা।

ছোটখাট এক লাফ দিয়ে সরে গেল মুসা। এটা আবার কোত্থেকে আমদানী হলো? পুশি কোথায়, পুশি?

পুশি? অবাক হলেন মহিলা। পুশি কে? দেখো মুসা, বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!

ভয় পেয়ে গেল মুসা। এসব কী ঘটছে ওদের বাড়িতে? মাথার মধ্যে কেমন যেন করছে। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। দুপা অবশ হয়ে আসছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে ওর।

ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল ও। কোনওমতে বলল, আপনারাই আমার বাবা-মা, এ কথা বলতে চান? শেষদিকে গলা কাঁদো কাঁদো হয়ে উঠল ওর।

ঝুঁকে ওর মাথায় একটা চুমু খেলেন ভদ্রমহিলা। বলতে চাওয়ার দরকার কী? তাই তো সত্যি। আমি তোমার মা, ইনি বাবা। ওটা তোমার বেড়াল-মাস্টার।

আমার কোনও বোন নেই? মামাত?

না, বললেন বাবা। তুমি আমাদের একমাত্র ছেলে।

তোমার যদি বোন থাকত, প্রশ্রয়ের সুরে বললেন মা। তোমার সবকিছুতে ভাগ বসাত। সেটা কী ভাল হত?

খেপে উঠল মুসা। থা-থা-থামুন! উত্তেজনায় খানিক তোতলাল।

অনেক মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনিয়েছেন আপনারা আমাকে। আর নয়। এবার বলুন আমার আসল বাবা-মা কোথায়? এসব কী ঘটছে? আমাদের বাড়িতে আপনারা কেন?

ওর মা-বাবা নজর বিনিময় করলেন। তারপর একযোগে তাকালেন ওর দিকে। হতবিহ্বল চাউনি।

মা বলছেন না কেন আপনারা কারা! ধৈর্য হারিয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

আমার আসল পরিবারের অন্য সবাই কোথায়?

বাবা উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত চেপে ধরলেন। শার্ট ভেদ করে তার নখ মাংসে গেঁথে যাওয়ার জোগাড় হলো। জলদি চলো। আর সময় নেই। চড়া। গলায় আদেশ দিলেন।

না! কাতরে উঠল মুসা। ব্যথা পেয়েছে। যাব না আমি!

সকাল হতে না হতে অনেক উঁচড়ে পাকামো করে ফেলেছ। চলো এখন!

কিছু করার নেই মুসার। বাবার টান খেয়ে এগোতে হলো। গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল। দেখল ওদের পুরানো মডেলের টয়োটা করোলার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঝঝকে নতুন একটা ফিয়াট। ১. ধমক খেয়ে গাড়িতে উঠে বসল মুসা। এমনসময় বেরিয়ে এলেন মহিলা। ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে এলেন গাড়ির দিকে। আজ তোমার হয়েছে কী, মুসা, বলো তো! বই-টিফিন, পানি ছাড়াই স্কুলে যাচ্ছ যে বড়, খোলা জানালা দিয়ে ওগুলো এগিয়ে দিলেন। ধরো এগুলো। তারপর আদর করে ওর নাক টিপে দিলেন।

ধ্যাৎ! বিরক্ত হলো ও। কী করছেন! ওর মা কখনও এই কাজ করেন না। কাজেই এসবে অভ্যস্ত নয় মুসা।

গাড়ি স্টার্ট দিলেন নকল বাবা। মাথা দুলিয়ে দ্বিতীয় মা বললেন, দেখো, স্কুলে কারও সাথে মারামারি বাধিয়ে বোসো না যেন কালকের মত।

ওঁরা সিরিয়াস, বুঝতে পেরে অদ্ভুত অনুভূতি হলো মুসার। অভিনয় করছেন না তারা। সত্যি সত্যি ভাবছেন যে তারাই মুসার মা-বাবা। ওঁদের। আসল ছেলেটা গেল কোথায়? তার নামও মুসা?

কিন্তু তা কী করে সম্ভব?

কী আশ্চর্য!

সারা শরীরে কাপ ধরে গেল মুসার।

এসবের মানে কী?

১০

পরশু ও ছিল তেরো বছরের কিশোর। গতকাল হঠাৎ করে বয়স বেড়ে হয়ে গেল।

তারপর আজ… আজ আবার বয়স তেরোয় নেমে এসেছে, তবে পরিবার বদলে গেছে। অন্য এক পরিবারের সদস্য আজ মুসা। ও কি স্বপ্ন দেখছে আসলে?

গাড়ি চালাচ্ছেন সেই পরিবারের প্রধান, ওর নতুন বাবা। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে মুসা।

আমরা কোথায় যাচ্ছি? দুর্বল গলায় জানতে চাইল।

তোমার স্কুলে, জবাব দিলেন তিনি। মুহূর্তের জন্য পাশে তাকালেন। কেন, তোমার কী মনে হয় আমরা হাওয়া খেতে বেরিয়েছি?

কিন্তু এটা তো আমার স্কুলের রাস্তা নয়।

চরম বিরক্তি নিয়ে মাথা এপাশ-ওপাশ করলেন মানুষটা। বোঝাই যায়। মুসার উপর ক্রমে চটে উঠছেন। পরিস্থিতি অসহ্য করে তুলেছে ও।

একটা স্কুলের সামনে থেমে দাঁড়াল গাড়ি। কিন্তু ওটা মুসার স্কুল নয়। এটা ওদের স্কুলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রকি বিচ কুইন্স হাইস্কুল। ওর সম্পূর্ণ অচেনা।

এসে গেছি। নেমে পড়ো এবার, হাত বাড়িয়ে দরজা খুলে দিলেন তিনি।

আস্তে করে নেমে পড়ল মুসা। কী করবে মাথায় খেলছে না।

যাও, স্কুলে যাও। আমি চললাম।

চলে গেলেন বাবা।

এখন? ভাবল ও। এখন কী করব?

বয়স নিয়ে আপাতত কোনও সমস্যা না থাকলেও অন্য এক পরিবারের ছেলে হয়ে গেছে ও। সম্পূর্ণ ভিন্ন স্কুলের ছাত্র।

এমন আজগুবি কথা কেউ শুনেছে কখনও?

ও কি জেগে আছে, না ঘুমিয়ে? দুঃস্বপ্ন দেখছে?

কানের লতিতে চিমটি কাটল জোরে। কই, না, ব্যথা লাগে তো! সামনে বড় এক পাথরের টুকরো পড়ে থাকতে দেখে আরও নিশ্চিত হতে লাথি ঝেড়ে বসল। উফ! ব্যথা লেগেছে।

তার মানে ও জেগে আছে। এসব দুঃস্বপ্ন নয়, সত্যি।

গেট পেরিয়ে স্কুল কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ল মুসা–এ ছাড়া আর কোথায়। যাবে? আর কী করার আছে? ছেলেমেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে স্কুল ভবনের দিকে। তাদের দেখাদেখি মুসাও এগোল। এই স্কুলের নিয়ম-কানুন কিছুই জানা নেই। এমন কী কোন্ ক্লাসে পড়ে ও, তাও না। সামনে এক মেয়েকে দেখল মুসাওরই বয়সী হবে।

হাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে পেণ্ডুলামের মত দুলছে ওর বেণী, মাঝ পিঠ পর্যন্ত চুল মেয়েটার। কুচকুচে কালো।

কী মনে হতে ঘুরে তাকাল মেয়েটা। মিষ্টি করে হাসল ওর দিকে ফিরে।

ওকে চেনা চেনা লাগছে না? ভাবল মুসা। কোথায় যেন দেখেছে আগে।

কোথায়?

জবাবে মুসাও হাসল। নার্ভাস হাসি।

তোমার নাম কী? মেয়েটাকে কোথায় দেখেছে মনে করার চেষ্টার ফাঁকে বলল ও।

সানজানা।

সানজানা!

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে এখন। কাল কলেজ থেকে পালানোর সময় এই মেয়ের সাথেই ধাক্কা খেয়েছিল ও।

আমার নাম মুসা, কাল তোমার সাথে দেখা… কথা শেষ না করে থেমে গেল।

মেয়েটা কি ওকে চিনতে পেরেছে? বুঝতে পারছে না মুসা। চেনার কথা নয় অবশ্য। কাল আর আজকের মুসার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সানজানার পক্ষে কি কল্পনা করা সম্ভব এই মুহূর্তে যে-ছেলেটার সাথে সে কথা বলছে, গতকাল তার বয়স বেশি ছিল? কলেজের ছাত্র ছিল সে?

ক্লাস শুরু হতে এখনও দেরি আছে, নীরবতা ভাঙল সানজানা। ওই গাছটার নীচে বসি গিয়ে, চলো।

চলো, যন্ত্রচালিতের মত ওকে অনুসরণ করল মুসা।

মেয়েটা যে খুব মিশুক, বুঝতে বাকি রইল না ওর। চমৎকার মিষ্টি ব্যবহার। জীবনটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হওয়ার পর যতজনের সাথে দেখা হয়েছে মুসার, তাদের মধ্যে একেই ওর সবচেয়ে ভাল লেগেছে।

বড় একা লাগছে মুসার। অদ্ভুত ঘটনাগুলো কাউকে বলা দরকার, বুঝতে পারছে। এমন কাউকে, যে ওর সব কথা শুনবে, বিশ্বাস করবে এবং সমস্যাটা বুঝতে পারবে।

এই মেয়ে হয়তো বুঝবে, ভাবল মুসা। অন্তত ওকে দেখে সেরকমই মনে হয়। ভরসা করা যায়।

বসে পড়ল ওরা গাছের ছায়ায়।

কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল মুসা। সানজানা! ভাল করে দেখো তো আমাকে চেনা চেনা লাগছে কি না!

কপাল কুঁচকে তাকাল ও। কিছুক্ষণ দেখল মুসাকে।

হ্যাঁ, লাগে, বলল ও। তোমাকে নিশ্চয়ই স্কুলের আশপাশে কোথাও দেখেছি।

মেয়েটাকে সবকিছু খুলে বলার সিদ্ধান্ত নিল মুসা। এসব আজগুবী কথা ও বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। তবু বলবে। কাউকে না কাউকে না বলা। পর্যন্ত স্বস্তি পাবে না ও। আমি তা বলছি না। বলতে চাইছি…

কী? বলো!

তুমি কাল রকি বিচ কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলে না?

হ্যাঁ। ওই কলেজের সামনে দিয়েই বাসায় ফিরি আমি।

গতকাল কারও সাথে তোমার ধাক্কা লেগেছিল? আমার চেয়ে বড়। এই ধরো মোলো-সতেরো বছর বয়স, এমন কারও সাথে? ঠিক কলেজের সামনে?

মুখ খুলতে যাচ্ছিল মেয়েটা, কিন্তু কিছু একটা চোখে পড়তে বন্ধ করে ফেলল। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল মুসা।

দুই ছেলেকে এদিকে আসতে দেখা গেল। বয়সে তরুণ, তাগড়া গড়ন। একজন লম্বা, অন্যজন খাটো। কালো জিন্স ও কালো টি-শার্ট পরনে। একজনের মাথায় নীল স্কার্ফ বাধা। হাতের মজবুত পেশি দেখানোর জন্যই যেন হাতা গুটিয়ে রেখেছে অন্যজন।

কারা ওরা? দেখে ষোলো-সতেরোর মত বয়স মনে হয়। নিশ্চয়ই স্কুলের ছাত্র নয়। তা হলে এখানে কী করছে ওরা?

সোজা মুসাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের লাফালাফি নতুন উদ্যমে শুরু হয়ে গেছে মুসার। ছেলেদুটো যে বিপজ্জনক বুঝে ফেলল চট করে।

আগুন চোখে মুসাকেই দেখছে।

ও-ও-ওরা কারা? ভয়তাড়িত কণ্ঠে বলল মুসা।

জবাব দিল না সানজানা। সময় নেই।

হঠাৎ মুসাকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল এক ছেলে, ওই তো ব্যাটা!

সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার ছাড়ল অন্যজন, ধ ব্যাটাকে!

১১

পরমুহূর্তে একশো মাইল বেগে তেড়ে এল ওরা।

ওরা কারা, মুসা জানে না। এখন কিছু জানার সময়ও নেই। জান। বাঁচানো ফরজ। লাফ দিয়ে উঠেই দে ভোঁ দৌড়।

প্রাণপণে দৌড়ের ফাঁকে পিছন ফিরে তাকাল। সত্যি সত্যি তাড়া করেছে নাকি বদমাশ দুটো?

ধর ব্যাটাকে! তখনই আবার চেঁচিয়ে উঠল ওদের একজন।

ওদের বাধা দিল সানজানা। দাঁড় করিয়ে কী যেন বোঝাতে লাগল।

ধন্যবাদ, সানজানা, দৌড়ের ফাঁকে বিড়বিড় করে বলল মুসা। এক দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে স্কুলের সীমানার বাইরে চলে এল।

আরও খানিকটা গিয়ে যখন নিশ্চিত হলো ওরা আর তাড়া করছে না, তখন থামল। হাঁ করে হাঁপাতে লাগল।

সানজানা।

ওর জন্যই এ-যাত্রা বেঁচে গেল মুসা। এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করা। নিরাপদ নয়। হাঁটতে লাগল আবার। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।

চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে। ঘরবাড়ি সব অপরিচিত। বাড়ির ফিরতি পথের দিকে হাঁটতে লাগল মুসা। বুঝতে পারছে, শয়তান দুটো যে-জন্যই হোক, ওকেই পিট্টি লাগাতে আসছিল, সানজানাকে নয়।

কিন্তু কেন?

কাল কলেজেও একটার পাল্লায় পড়েছিল মুসা। বাগে পেলে সত্যি যে মেরে ভর্তা করে দিত ওকে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

আজ ওর নতুন, আজব পৃথিবীতে ওটা নেই অবশ্য, কিন্তু নতুন আপদ ঠিকই জুটেছে।

একটা নয়, দুটো!

নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে মুসার। কারও সাহায্য দরকার। মুসা জানে না এসব কী ঘটছে। এত সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষমতা নেই ওর। এত মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের থাকে?

হাঁটছে তো হাঁটছে মুসা। কিছুক্ষণ পর সামনে একটা বাসা দেখতে পেয়ে। থেমে পড়ল।

আরে, এটাই তো ওদের বাসা! চিনতে পেরে এক দৌড়ে ঢুকে পড়ল মুসা। কিন্তু বাবা-মা বাসায় নেই। আঙিনা পার হয়ে দরজায় থামল ও। দরজায় তালা ঝুলছে।

ঘুরে ওদিকের বাগান পার হয়ে রান্নাঘরের সামনে থামল। ওখানে দরজার ছিটকিনিটা একটু নড়বড়ে। উপরের একটা ফাঁক দিয়ে চেষ্টা করলে খোলা যায়। তা-ই করল ও। কয়েক সেকেণ্ড চেষ্টা করতেই ছিটকিনি খুলে গেল।

ওর সত্যিকারের বাবা-মা গায়েব। ফারিহা, তানজিয়া, শাওনি ভাইও নেই।

কিন্তু এমন কেউ হয়তো থাকতে পারে, ভাবল মুসা, যে ওকে সাহায্য করতে পারে। উদ্ধার করতে পারে এই ম-হা-বি-প-দ থেকে।

হয়তো ওর বাবা-মা কোথাও বেড়াতে গেছেন ফারিহা, তানজিয়া ও শাওনি ভাইকে নিয়ে। কোনও আত্মীয়ের বাসায় গেছেন হয়তো।

একটা বুদ্ধি এল ওর মাথায়। মার এক খালাতো বোন থাকেন শহরের আরেক প্রান্তে। প্রায়ই ওখানে মা বেড়াতে যান। একবার টেলিফোন করে দেখবে ওঁকে, ঠিক করল ও। কপাল ভাল হলে বলা যায় না, ওখানে পেয়েও যেতে পারে মা-বাবাকে।

নির্দিষ্ট নাম্বারে ডায়াল করল ও। জবাবে মহিলা কণ্ঠ ভেসে এল।

লিলি খালা! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল ও। আমি মুসা।

কে? গম্ভীর হয়ে উঠল কণ্ঠটা।

মুসা! রকি বিচ থেকে!

এ নামের কাউকে তো আমি চিনি না, ধীরে ধীরে বললেন মহিলা। মনে হয় ভূল নাম্বারে ফোন করেছ তুমি।

না, লিলি খালা, শুনুন!

আমার নাম লিলি নয়, ঘটাং করে রিসিভার রেখে দেয়ার শব্দ শোনা, গেল।

অনিশ্চিত চোখে টেলিফোন সেটের দিকে চেয়ে রইল মুসা। সঠিক নাম্বারে টেলিফোন করেছে ও, সে ব্যাপারে কোনও ভুল নেই। তবে কণ্ঠটা যে।

ওর লিলি খালার নয়, সেটা বুঝতেও কোনও ভুল হয়নি। তা হলে কে উনি?

তবু আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী? হয়তো রং নাম্বারে গিয়েছিল সেবার কলটা।

হ্যালো? একই কণ্ঠ ভেসে এল ওপাশ থেকে।

অন্যভাবে শুরু করল এবার মুসা। ফারিহা, তানজিয়া বা শাওনি ভাইকে একটু দেয়া যাবে? খুব জরুরী দরকার।

আবার তুমি! এখানে ওসব নামের কেউ থাকে না। রং নাম্বার।

পরমুহূর্তে লাইন কেটে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেল মুসা। প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে ও। কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। যার বুকের মধ্যে ইস্পাতের হৃৎপিণ্ড আছে, সে-ও হয়তো এ পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। মুসা তো একে ছোট্ট, তার ওপর রক্তমাংসের মানুষ।

হাত-পা কাঁপছে ওর ঠঠ করে। ঘেমে গোসল হয়ে গেছে।

চট করে তিন গোয়েন্দাদের অন্য দুজনের কথা মনে পড়ল মুসার। প্রথমে ঠিক করেছিল ওদের কারও সাহায্য ছাড়া নিজের বিপদ নিজে মোকাবিলা করবে। কিন্তু সমস্যা আস্তে আস্তে এত জটিল হয়ে উঠেছে যে ওর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছে ওর একার পক্ষে সমাধান করার মত সমস্যা নয় এটা। অনেক বড়, অনেক কঠিন সমস্যা।

কিশোরদের নাম্বারে ডায়াল করল মুসা। কিন্তু আশ্চর্য! ফল হলো, সেই একই। কিশোর নামের কোনও ছেলে নাকি থাকে না ওই বাসায়।

আশ্চর্য! অদ্ভুত!

রবিনদের বাসায় রবিন নেই!

ওর দুই বন্ধু হাওয়া হয়ে গেছে।

মুসার চেনা পুরো পৃথিবীটাই যেন নেই হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ নতুন, অপরিচিত, আজব এক পৃথিবীর বাসিন্দা সে এখন।

এখানে সবাই ওর অপরিচিত, কাউকে চেনে না মুসা।

না, না, ঠিক হলো না।

একজনকে অন্তত চেনে, সে সানজানা।

কিন্তু ওর টেলিফোন নাম্বার তো মুসা জানে না! কীভাবে যোগাযোগ করবে? মেয়েটার পুরো নাম, বাসা কোথায় কিছুই জানে না। জিজ্ঞেস করতে মনে ছিল না।

এমন সময় সামনের দরজা খুলে গেল। সকালের সেই মহিলা, ওর মা। শপিং ব্যাগ হাতে ঘরে ঢুকলেন।

ছেলেকে দেখে অবাক হলেন তিনি। কী ব্যাপার, মুসা! অসময়ে বাসায় কেন তুমি? স্কুল থেকে চলে এসেছ কেন?

আমি ওই স্কুলের ছাত্র নই, রাগের সাথে বলল ও। তাই।

তার মানে? খেপে উঠলেন মহিলা।

চুপ করে থাকল মুসা। ওর সমস্যা কী করে বোঝাবে ও এই মহিলাকে? ইনি তো ওর মা নন। আসল মা-ই বুঝতে চায় না…

পৃথিবী থেকে গায়েব হয়ে গেছেন ওর আসল মা। কী করে, কখন ব্যাপারটা ঘটল জানা নেই ওর। শুধু জানে, ও অন্য এক জগতে বিচরণ করছে।

অজানা এক শিহরণে কেঁপে উঠল মুসার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। এমন এক পৃথিবী এটা, যেখানে ও একা। একদম একা। যেখানে কাউকে চেনে না। ও। এমন কী ওর বাবা-মাকে পর্যন্ত না।

১২

যাও, শরীর খারাপ লাগলে একটু শুয়ে থাকোগে, বললেন ওর মা।

সারা দুপুর-বিকেল টিভির সামনে বসে কাটাল মুসা। স্ক্রীনে চোখ স্থির থাকলেও মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তার ঝড় বয়ে গেছে।

মনে মনে নিজের উপর বিরক্ত মুসা। কেন সে ওঁদেরকে নিজের মা-বাবা ভাবতে পারছে না? বাবা-মা হিসেবে ওদের যে তুলনা হয় না সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। তারপরও…

হয়তো এঁদের সঙ্গেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হবে ওকে। হয়তো আসল মা-বাবা ভাই-বোনকে কোনওদিন ফিরে পাবে না। তাই যদি হয়, তা হলে বাস্তবকে যত তাড়াতাড়ি মেনে নেয়া যায়, ততই মঙ্গল। তাতে মনের চাপ কমে যাবে। কোনও মতে রাতের খাওয়া সেরে উঠে পড়ল। নিজের রুমের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। দরজায় তালা ঝুলছে। দেখেই বোঝা যায় এই রুম ব্যবহার করা হয় না।

কী আর করা!

বাধ্য হয়ে গেস্ট রুমের দিকে এগোল ও ক্লান্ত পায়ে।

ঘুমাতে যাচ্ছ? পিছন থেকে বলে উঠলেন মা। যাও, সোনা!

বিরক্তি লাগল মুসার। আমি কি কচি খোকা নাকি যে কথায় কথায় সোনা-সোনা করতে হবে?

সকালে তাড়াতাড়ি উঠো, কেমন? বলতে বলতে কিচেনের দিকে এগোলেন উনি।

সকাল!

একেকটা সকাল তো আগের দিনের সকালের তুলনায় অদ্ভুত চেহারা। নিয়ে হাজির হয় মুসার সামনে। অন্তত পরপর দুই সকাল তা-ই ঘটেছে।

কাল সকালে কী হবে কে জানে।

ঘুমিয়ে পড়তে ভয় করছে মুসার। অজানা ভয়ে অবশ হয়ে আসছে হাত পা। জেগে ওঠার পর নতুন কোনও অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না

আর কিছু না হোক, অন্তত একটা ব্যাপার ঘটলে খুশি হবে। সকালে উঠে যদি দেখে এই নকল মা-বাবা নেই হয়ে গেছেন, তা হলে ভীষণ খুশি হবে মুসা। কিন্তু ভাবল ও। আর এদের জায়গায় বড় কোনও আপদ এসে, জুটলে তখন?

হয়তো ঘুম থেকে উঠে দেখা যাবে পুরো পৃথিবীই বদলে গেছে। সূর্য উঠছে দক্ষিণ দিক থেকে।

তখন?

বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল মুসা। দুচোখ বুজে আসছে ঘুমে। চোখ খোলা রাখতে নিজের বিরুদ্ধে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে।

মনে মনে আল্লাকে ডাকল মুসা। বলল, আগের মত যেন সবকিছু স্বাভাবিক দেখতে পাই। বাবা-মা, ফারিহা, তানজিয়া আপু ও শাওনি ভাইকে যেন ফিরে পাই। খোদা, সবকিছু আবার স্বাভাবিক করে দাও তুমি। বাবা-মার অবাধ্য হব না কখনও। প্লিজ…

.

কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না মুসা। চোখ মেলল একেবারে সকালে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে উঠল না। কয়েক মুহূর্ত পড়ে রইল বালিশে মুখ গুঁজে। কিছু পরিবর্তন হয়েছে কি না বোঝার চেষ্টা করল।

ভিতর থেকে হইচই ভেসে আসছে। সারা বাড়ি যে তোক ভর্তি বুঝতে অসুবিধে হলো না কোনও।

অ-নে-ক মানুষ!

একটু একটু করে হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়ছে মুসার।

সারাজীবন নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দ করে এসেছে ও। তাই এ বাড়িতে হঠাৎ এত মানুষের সমাগম দ্বিধায় ফেলে দিয়েছে। কালকের বাবা-মা যে গায়েব হয়ে গেছেন, তাও কীভাবে যেন বুঝে ফেলেছে।

সব চিন্তা মাথা থেকে ঠেলে সরিয়ে দিল মুসা। আগের চিন্তা আগে করা দরকার। প্রথমেই জানা দরকার আজ ওর বয়স কত।

উঠে বসে দুহাত চোখের সামনে মেলে ধরল।

নাহ্‌, ছোটই আছে। বয়স বাড়েনি, বরং মনে হচ্ছে যেন কমেছে।

তাড়াতাড়ি বাথরুমের দিকে এগোল মুসা। ভিতরের উত্তেজনা ঝেড়ে ফেলার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাল।

উত্তেজিত হয়ে কী লাভ? ভাবল ও। অমোঘ নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দেয়া ছাড়া কী করার আছে এই মুহূর্তে? যা ঘটছে সেটাই বাস্তব, এবং একে মেনে নেয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।

বাথরুমে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল মুসা। মনে হলো আজ যেন আয়নাটা একটু উপরে উঠে গেছে। ভাল করে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল।

পরক্ষণে চমকে উঠল–একি! এ যে একটা… একটা প্রায় শিশুর মুখ!

আর যাই হোক, ওর বয়স যে এখন তেরো নয়, তাতে কোনও সন্দেহই। রইল না ওর। খুব বেশি হলে আট বছর হবে আজকের মুসার বয়স।

এ কী আশ্চর্য!

আট! ভাবল ও তটস্থ হয়ে। আট বছর বয়সে ও কোন ক্লাসে ছিল মনে করার চেষ্টা করল। থ্রি! হ্যাঁ, থ্রির ছাত্র ছিল তখন মুসা।

তার মানে, মুসা আবার গ্রির ছাত্র বনে গেছে!

আচমকা পিঠে ব্যথা লেগে উঠল ওর। কেউ অথবা কিছু একটা পিঠে আঁচড় কাটছে বলে মনে হলো। আত্মা উড়ে গেল ওর।

ভিতর থেকে আপনাআপনি ঠেলে বেরিয়ে আসা চিৎকারটা। ঠেকানোর মরিয়া চেষ্টা চালাল। কিন্তু ব্যর্থ হলো শেষ পর্যন্ত।

বাড়ি কেঁপে উঠল ওর তারস্বরের চিৎকারে।

১৩

কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওর পিঠের উপর।

চিকন, রোমশ মুখ দেখা গেল আয়নায়। অদ্ভুত একটা জন্তু বসে আছে কাঁধের উপর।

যা, ভাগ, যা! উদ্বাহু নৃত্য শুরু করে দিল মুসা।

মজা পেয়ে ইইইই! ইইইই! শব্দ করতে লাগল জটা।

প্রচণ্ড ভয় পেয়ে দৌড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল মুসা। ছুটল করিডরের মাঝখান দিয়ে। ইয়া তাগড়া এক লোকের সাথে ধাক্কা খেল।

বাঁচান! মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। এটার হাত থেকে বাঁচান আমাকে!

ওর কাঁধের উপর থেকে জন্তুটাকে তুলে নিলেন মানুষটা। হাসতে হাসতে। ঢলে পড়ার দশা হলো তাঁর।

কী ব্যাপার, মুসা? কোনওমতে বললেন। ক্যাস্টেমকে এত ভয় পাওয়ার কী হলো? জন্তুটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলেন তিনি।

ক্যাস্টেম?

ওটা একটা বানর!

ওর চুল নেড়ে দিলেন ভদ্রলোক। বললেন, জলদি তৈরি হয়ে নাও। রিহার্সালের কথা ভুলে গেছ?

রিহার্সাল? কীসের রিহার্সাল?

আহাম্মকের মত তাঁর দিকে চেয়ে রইল মুসা। পেশিবহুল বিশাল দেহ। কোঁকড়া কালো চুল। মুখে ঘন দাড়ির জঙ্গল।

লোকটার পোশাক দেখে মুসার চোয়াল ঝুলে পড়ার দশা হলো। উজ্জ্বল লাল রঙের কস্টিউম পরে আছেন তিনি। সোনালি, একটা জমকাল বেল্ট কোমরের কাছে বাধা। যাত্রার নায়কের মত দেখাচ্ছে।

হায় আল্লা! মনে মনে আঁতকে উঠল ও। এই লোক কে? ওর আজকের বাবা নাকি? সর্বনাশ!

এ কীসের পাল্লায় পড়ল ও?

রান্নাঘর থেকে এক মহিলার কণ্ঠ ভেসে এল, ওগো, শুনছ?

ওর দিকে একই ধরনের এক সেট পোশাক এগিয়ে দিয়ে লোকটা বললেন, তাড়াতাড়ি এগুলো পরে নাও। তারপর খেতে এসো, জলদি।

মুসা জানে এই লোকটাই ওর বাবা। অন্তত আজকের জন্য। কাল সে ছিল এক পরিবারের সদস্য, আজ জুটেছে আরেক পরিবারের সঙ্গে।

অ্যাই! আবার সেই মহিলার গলা ভেসে এল। খেতে আসছ না কেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো তোমার!

ওই মহিলা এখন নিশ্চয়ই ওর মা–ভাবল মুসা।

অনেকগুলো পিচ্চি হাউকাউ করছে। বাঁদরের মত লাফালাফি করছে সারাবাড়ি। বিভিন্ন বয়সের, মনে হচ্ছে এক ডজনের কম হবে না। না, গুনে দেখা গেল ছয়টা। আধ ডজন। তাই বা কম কীসে?

নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে নিরুপায় মুসা। ওর নিজের বয়স আট। ছয়-ছয়টাবোন ওর এখন, এবং একটা পোষা বানরও আছে এ পরিবারে। অদ্ভুত নাম-ক্যাস্টেম। মাকে অবশ্য এখনও দেখেনি ও–তবে বাবাকে যেটুকু দেখেছে; তাতেই কাজ হয়ে গেছে। ভীষণ হতাশ হয়েছে মুসা। অমন উজবুক মার্কা পোশাক পরা এক লোক ওর বাবা–চিন্তা করা যায়?

এবং ওকে পরার জন্য যে পোশাক দেয়া হয়েছে, সেটাই বা কম যায় কীসে? ব্যায়ামবিদ বা নাচের শিল্পীরা কোমরের কাছে যে জোড়া.দেয়া ওয়ান পীস, আঁটসাঁট পোশাক পরে, ঠিক তেমনি এক টাইট আউটফিট। ওটার বিচ্ছিরি রং চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। নীচের অংশ ক্যাটকেটে নীল, তার উপর সাদা স্ট্রাইপ। উপরের অংশে নীলের ওপর বড় বড় সাদা তারা ফুটে আছে। সব মিলে কী বিচ্ছিরি!

এই জঘন্য পোশাক কেন পরতে হবে ওকে?

কীসের রিহার্সালের কথা বললেন ওর বাবা?

কোনও নাটকে অভিনয় করতে হবে? ভাবতে গিয়ে কলজের পানি শুকিয়ে বরফ হয়ে উঠল। নাটকে অভিনয়ের কথা কল্পনাও করতে চাইছে না মুসা। ওর ধারণা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ ওটা। অভিনেতাদের অতিমানব মনে হয়, তা না হলে কীভাবে ওরকম কঠিন কাজটা করেন তারা?

ভাবতে ভাবতে কস্টিউম পরে নিল মুসা। অবাক হয়ে খেয়াল করল, শরীরে এমনভাবে ফিট হয়েছে ওটা, দেখে মনে হচ্ছে মুসার দ্বিতীয় চামড়া বুঝি। একেবারে জোকারের মত লাগছে ওকে দেখতে।

ধীর পায়ে কিচেনের দিকে এগোল ও।

কিচেন তো নয়, যেন মাছের বাজার। বাঁদরামি করছে হাফ ডজন পিচ্চি। এ ওকে গুতো মারছে, ও তাকে চাটি মারছে। খাবার ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। হাউকাউ, হাসাহাসি

সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড!

লম্বা, একহারা গড়নের এক মহিলা প্লেটে পাউরুটি সাজাচ্ছেন। মাথায় মেঘের মত ঘন, লম্বা চুল। পরনে টকটকে লাল একটা ম্যাক্সি।

আমার নতুন মা, ভাবল মুসা।

একটা প্লেট টেনে নিয়ে খাওয়া শুরু করল।

সুপার হিরোর পোশাকে মুসাকে আজ দারুণ কিউট লাগছে, তাই না? খোঁচা লাগাল এক মেয়ে। ওর বড় বোনদের একজন হবে হয়তো।

একদম বাদরের মত লাগছে, দাঁত বের করে বলল এক ছেলে, ভাই বোধহয়। মুসার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে হয়তো। ক্যাস্টেমের বড় ভাইয়ের মত, বলে হাসিতে ফেটে পড়ল ছেলেটা। ওর চিবুকে এত জোরে এক ঠোকা মেরে বসল যে মাথার ভিতরে খবর হয়ে গেল মুসার। কিউট লিটল মুসা, বলে চলেছে সে, খুদে সার্কাস-তারকা।

সার্কাস!

মুখ থেকে রুটির টুকরো পড়ে গেল মুসার। সর্বনাশ! এ কী শুনছে ও? সার্কাস! কীসের সার্কাস? কয়েকবার সার্কাসে কাজ করেছে ও। তা-ই বলে এখন ও পেশাদারি ভাবে…

মাথা ঘুরতে শুরু করল মুসার।

অদ্ভুত কস্টিউম।

বানর।

হ্যাঁ, এতক্ষণে এসবের কারণ একটু একটু খোলাসা হতে শুরু করেছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরল মুসা। সাহেবুল সুলতান মুসা, সার্কাস বয়! গলা ছেড়ে যদি কিছুক্ষণ ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কাঁদতে পারত, তা হলে বুকটা একটু জুড়াত।

মুসার মনে হলো ওর ভাই ওকে হিংসে করছে। ও নিজে সার্কাস তারকা হতে পারলে খুশি হত যেন। এজন্যই এত খোঁচা মেরে কথা বলছে সে।

এ ছেলে যদি হিরো হতো তা হলে বরং ভালই হত। বাঁচা যেত। আর যা-ই হোক, সার্কাস তারকা হওয়ার কোনও খায়েশ নেই মুসার।

মুসার সাথে অমন করছ কেন তোমরা? মা ধমকে উঠলেন। এমনিতেই ও টেনশনে আছে। শেষ পর্যন্ত তোমাদের খোঁচাখুঁচিতে সব গুবলেট করে। ফেলবে হয়তো, দেখো।

একে একে সবার উপর দিয়ে তীক্ষ্ণ নজর বোলাল মুসা। প্রত্যেকের পরনে উজ্জ্বল রঙের কস্টিউম দেখে ভাবল, পরিবারের সবাই সার্কাসের পাত্র পাত্রী নাকি?

ও আজ সার্কাস-পরিবারের সদস্য!

গলায় রুটি আটকে গেল। সার্কাস পছন্দ করে মুসা, কিন্তু আজ সার্কাসই ওর জীবন! ভাবতে ভাল লাগল না। ও এখন খুদে সার্কাস-তারকা!

ফাটা কপাল আর কাকে বলে!

রিহার্সালের সময় হয়ে এল! তাড়া লাগালেন বাবা। কালো একটা হ্যাট মাথায় চাপালেন। চলো সবাই!

পুরানো, লক্কর-ঝক্কর মার্কা একটা ভ্যানে চেপে বসল ওরা।

বাবা ড্রাইভিঙ সীটে। মা তাঁর পাশে।

পিছনে গাদাগাদি করে বসেছে মুসাসহ তাঁদের অন্য ছয় ছেলে-মেয়ে। ছয় বাঁদরের বাঁদরামি একমুহূর্তের জন্যও থেমে নেই। এত দুষ্টু ছেলেমেয়ে

জীবনে দেখেনি মুসা। একটু পরপর পিচ্চি এক মেয়ে ওকে চিমটি কাটছে। আরেকটা অনবরত মুসার পেটে খোঁচা মারছে।

এক সময় বিরক্ত হয়ে ধমকে উঠল মুসা, অ্যাই, কী হচ্ছে! কেন বিরক্ত করছ?

কেন যে এত বাজে একটা পরিবারের সদস্য হতে গেল মুসা! এর চেয়ে কালকেরটা তো অনেক ভাল ছিল।

বেশ কিছুক্ষণ পর অনেক উঁচু, বিশাল এক তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়াল ভ্যান।

নামো সবাই! হুকুম দিলেন বাবা। নিজেও নেমে পড়লেন।

ভাইবোনদের অনুসরণ করে তাঁবুর ভিতরে চলে এল মুসা। ভিতরটা দারুণ পরিপাটি করে সাজানো। কয়েকজন সার্কাসম্যানকে প্র্যাকটিস করতে দেখা গেল। একেবারে তাঁবুর সিলিঙের কাছে টাঙানো একটা দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা প্র্যাকটিস করছে এক লোক। নীচে নেট বিছানো আছে, পা ফসকে গেলে ওটার উপরেই পড়বে, হাত-পা ভাঙবে না। মাঝখানের গোল করে ঘেরা জায়গায় একটা হাতি পিছনের দুপায়ে খাড়া হয়ে আছে মাহুতের নির্দেশে। নাচের ভঙ্গি করছে। দুতিনজন ভড় দর্শক হাসানোর প্র্যাকটিস করছে।

আমাকে কী করতে হবে? ভাবল মুসা। ওর দুই বোন একটা মই বেয়ে তর তর করে বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেল। তারপর সিলিং থেকে নেমে আসা দুই দড়ির মাথায় ঝুলন্ত আড়া ধরে দুলতে শুরু করল অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে। তাই দেখে আত্মা উড়ে গেল মুসার।

ওই কাজ ওর দ্বারা কোনওদিনই সম্ভব না। হার্টফেল করবে ও নির্ঘাত।

এসো, মুসা, তাড়া লাগালেন বাবা। কাজে চলো।

তাকে মই রেখে সামনে এগিয়ে যেতে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। ওকে তা হলে দড়ি ধরে ঝুলতে হচ্ছে না।

বাঁচলাম! ভাবল সে সামনে এগোতে এগোতে।

না, বাঁচেনি।

ভুলটা একটু পরেই ভাঙল মুসার।

ওকে নিয়ে বাবা তাঁবুর পিছনদিকে চলে এলেন। অনেকগুলো জীব জন্তুর খাঁচা দেখে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল মুসা।

একটা খাঁচার দরজা খুলে দিলেন বাবা।

এসো, মুচকি হেসে বললেন। ঢুকে পড়া।

চোয়াল ঝুলে গেল মুসার। চোখ আলু করে সামনে চেয়ে রইল। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করা যাবে না।

ব-ব-বলেন কী! দুর্বল গলায় ইঁদুরের মত কিচকিচ্ করে উঠল ও। ভে ভেতরে তো সিংহ!

বিশাল এক হাঁ করে এমন এক গর্জন ছাড়ল সিংহটা, সারা তাঁবু কেঁপে উঠল। থরথর করে কেঁপে উঠল মুসাও। কাঁপা পায়ে কোনওমতে দুপা পিছাল।

তাতে কী? ভয় নেই, এসো। ভয় পেয়ে দূরে সরে থাকলে কোনওদিন ওকে বশ করতে পারবে না তুমি। এসো।

নড়তে পারল না মুসা।

শক্তি আছে নাকি যে নড়বে!

বাবা ওকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলেন খাঁচার মধ্যে। এবং পরমুহূর্তে দরজা লেগে গেল দড়াম করে।

১৪

খাঁচার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল মুসা। ঠাণ্ডা স্টীল বারের ছোঁয়ায় দ্বিগুণ বেড়ে গেল কাঁপুনি। ভয়ে চোখ উল্টে যারার দশা। পা এত জোরে কাঁপছে যে ভয় হলো মুখ থুবড়ে পড়েই যাবে যে-কোন মুহূর্তে।

সিংহটা এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে। দৃষ্টিতে আগুন ঝরছে যেন।

ওর বাবা লায়ন টেমার, কখন খাঁচায় ঢুকেছেন খেয়াল করেনি মুসা। ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন উনি, হাতে চাবুক। তাই দেখে কিছুটা ভরসা হলো।

নতুন একটা ট্রিক শিখব আজ আমরা, বললেন উনি হাসতে হাসতে, যেন ব্যাপারটা খুবই মজার। ওটার পিঠে চড়বে তুমি।

ছেলেকে সামনে ঠেলে দিলেন বাবা।

এই মরেছে! তাজ্জব হয়ে ভাবল মুসা। ভদ্রলোক ওর সঙ্গে ঠাট্টা করছেন নাকি? মানুষ চড়বে সিংহের পিঠে? কাঁপাকাপি বেড়ে গেল ওর।

হে খোদা! বাঁচাও আমাকে। এ কীসের মধ্যে এনে ফেললে আমাকে?।

এ কেমন ধরনের বাবা? ভাবল মুসা কাঁপতে কাঁপতে। নিজের ছেলেকে সিংহের খাবার বানাতে চলেছেন!

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পশুরাজ। নড়াচড়ার কোনও লক্ষণ নেই। মুসাও স্থির। এক দৃষ্টিতে ওটার দিকে চেয়ে আছে। দুচোখ আলু হয়ে আছে।

আচমকা এমন এক হাঁক ছাড়ল ওটা, সারা এলাকা থরথর করে কেঁপে উঠল। আরেকটু হলে হার্টফেলই করে বসত হয়তো মুসা।

ওটার গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ল ওর মুখের উপর। আতঙ্কে ঘাড়ের খাটো খাটো চুল সড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেল।

নড়ে উঠল পশুরাজ। মুসার দিকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোতে শুরু করল। হাতের চাবুক দিয়ে মেঝেতে জোর এক বাড়ি লাগালেন বাবা। পরমুহূর্তে গলা ছেড়ে হেঁকে উঠলেন, হেইয়া!

ঠোঁট চাটতে চাটতে পিছাতে শুরু করল পশুরাজ।

সামনে যাও, মুসা, হুকুম দিলেন বাবা। উঠে পড়ো হারকিউলিসের। পিঠে। শক্ত করে কাধ ধরে থাকবে, নড়াচড়া করবে না। আমার চাবুকের বাড়ির তালে তালে দেখো কী সুন্দর খাঁচার চারদিকে ঘুরে বেড়ায় ওটা তোমাকে নিয়ে। এগোও, জলদি।

কথা জোগাল না মুসার মুখে। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে লোকটার দিকে চেয়ে আছে।

উজবুকের মত ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছ কেন আমার দিকে? হারকিউলিসকে তুমি একটুও ভয় পাও না। কী বলো, পাও?

না, মোটেই না। একশো পারসেন্ট সত্যি বলেছেন আপনি, ভাবল মনে মনে। হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। মানুষটার মাথা খারাপ হয়ে গেল না, তো? এসব কী বলছেন? বেশিরভাগ সময় জন্তু-জানোয়াররা ওকে খুব পছন্দই করে, কিন্তু তাই বলে সিংহের মত এরকম হিংস্র একটা প্রাণী…

চাবুক চালালেন উনি। আমি জানি–আমার ছেলে ভীতু হতে পারে না, গম্ভীর গলায় বললেন তিনি। যা বলছি জলদি করো, যাও!

পরমুহূর্তে গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস্ করে বললেন, অযথা ভয় পাচ্ছ তুমি, মুসা। হারকিউলিস খুব ভাল। এখন পর্যন্ত কাউকে একটা আঁচড়ও দেয়নি। তোমাকেও দেবে না।

ঠিক ওর পায়ের কাছে চাবুকের বাড়ি মারলেন আবার। যাও!

কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? সত্যি যদি ও সার্কাস-পরিবারের সদস্য হত, তা হলে না হয় একটা কথা ছিল। কিন্তু এ কেমন কথা? ঘুম থেকে জেগে দেখল। সে এমন একটা পরিবারের ছেলে, আর কথা নেই বার্তা নেই ‘বাবা’ ওকে টেনে-হিঁচড়ে সিংহের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিলেন।

স্বপ্নেও ভাবা যায়?

মুসা যে এখনও ধড়ে প্রাণ নিয়ে দুপায়ে দাঁড়িয়ে আছে, প্যান্ট-ট্যান্ট ভিজিয়ে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়ে বসেনি, তা-ই তো বেশি।

চিন্তার ঝড় বইছে মুসার মাথায়। আর একমুহূর্তও এই খাঁচায় থাকতে ইচ্ছে করছে না। প্রাণে বাঁচতে চাইলে পালাতেই হবে। সিংহের পিঠে ওঠার আগেই হয়তো হার্টফেল করবে ও।

আবার চাবুক হাঁকালেন বাবা। লাফিয়ে পিছিয়ে গেল মুসা।

একটানে দরজা খুলেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। কোনদিক দিয়ে কী ঘটে গেল কিছুই বুঝতে পারলেন না ওর বাবা।

মরিয়া হয়ে খিচে দৌড় লাগাল মুসা! মাথা ঝিমঝিম করছে ওর। ভিতর থেকে কেউ যেন বলছে, জলদি লুকাও, মুসা। বাঁচতে চাইলে শীগগির কোথাও লুকিয়ে পড়ো।

তবু থেকে বেরোতেই সামনে একটা পার্কিং লট দেখতে পেয়ে সেদিকেই এগোল মুসা। অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

একটার আড়ালে পৌঁছে থেমে পড়ল। এবং পরমুহূর্তে সানজানার সাথে ধাক্কা খেল।

তুমি! মেয়েটাকে দেখে বিস্মিত হলো মুসা। পরমুহূর্তে বিস্ময়ের ধাক্কা সামলে সচকিত হয়ে উঠল। বাবা এখনই এসে পড়লেন বলে। আগে জান, বাঁচানো ফরজ।,

আমাকে কোথাও লুকাতে হবে, সানজানা, রুদ্ধশ্বাসে বলল মুসা। মহাবিপদে পড়েছি।

বিপদ! কীসের বিপদ?

সিংহের খাবার হতে চলেছি আমি, কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল ও আমাকে বাঁচাও, সানজানা!

একটা গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করল সানজানা। খুলল না, লক করা।

হায় আল্লা! আচমকা চাপা গলায় গুঙিয়ে উঠল মুসা। সানজানা, ওই দেখো!

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাল মেয়েটা। কালো পোশাক পরা গতকালকের সেই দুই তরুণ ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে অমোঘ নিয়তির মত।

ভুল হলো। ওদের দিকে নয়, মুসার দিকে!

ভাবার সময় নেই। ঝেড়ে দৌড় লাগাল মুসা। কিন্তু কোথায় যাবে? কোথায় লুকাবে?

লুকানোর জায়গা নেই।

না, আছে। তাঁবু। সার্কাসের তাঁবু।

কালো পোশাক পরা ওই দুটো ছেলের চেয়ে এখন সিংহটাকেও অনেক নিরাপদ মনে হচ্ছে ওর। অগত্যা তাঁবুতেই আবার ঢুকে পড়ল মুসা।

তাঁবুর মধ্যে ঢুকে পড়েছে ও! চেঁচিয়ে উঠল লম্বা ছেলেটা।

এবার ব্যাটাকে পালাতে দেয়া যাবে না, বলল খাটোটা। চলো, আমরাও ভেতরে যাই।

ঢুকে পড়ল ওরা।

ওদিকে রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে মুসা। এমন শেয়াল-দৌড় ও জীবনে দৌড়েছে। কিনা সন্দেহ। সোজা সিংহের খাঁচার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। যে-জায়গাটাকে একটু আগেও যমের মত ভয় পাচ্ছিল ও, সেটাকে এখন নিরাপদ মনে হতে ভিতরে ঢুকে পড়ল।

১৫

তারপর আগুপিছু চিন্তা না করেই খাঁচার দরজা লাগিয়ে দিল।

এদিকে দুই কালো পোশাক পরা তরুণ এসে পড়েছে। খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নিল ওরা। নিজেদেরকে সুস্থির হওয়ার সময় দিল। তারপর ক্রুদ্ধ চোখে তাকাল মুসার দিকে।

এবার? কোথায় পালাবে, বাছাধন? কোমরে হাত রেখে মাথা ঝাঁকাল একজন।

চারপাশে দ্রুত নজর বোলাল মুসা। বাবা নেই। খাঁচায় সে একা। হারকিউলিসের সাথে। রাগে গরগর আওয়াজ করছে ওটা।

রাগ করিসনে, বাপ! শান্ত হ… ওটার উদ্দেশে বিড়বিড় করে বলল মুসা। কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। খাঁচার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আগের মতই গজরাচ্ছে পশুরাজ।

রহস্যময় ছেলেদুটো খাঁচার দরজা ধরে মরিয়া হয়ে ঝাঁকাতে শুরু করল। খুলে গেল দরজা। টুক করে ভিতরে ঢুকে পড়ল ওরা।

পালানোর চেষ্টা কোরো না, লম্বু সতর্ক করল।

এত মানুষ দেখে হুঙ্কার দিল সিংহটা। সার্কাসের বুড়ো সিংহ, অন্যজনকে বলতে শুনল মুসা। এ একটু বেঁটে। আমাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই ওর!

কিন্তু মুখে যাই বলুক, ওদের ভিতরের ভয় মুসার চোখে ধরা পড়ে গেল। যতই বাহাদুরি ফলাক, ভিতরের অস্বস্তির ভাবটা চেহারায় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।

আরেক হুঙ্কার ছাড়ল হারকিউলিস–আগের চেয়ে জোরে। সামনে এগোতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা।

মুসা পিছিয়ে গেল।

সিংহটার ওপাশে আড়াল নেয়ার ইচ্ছে আছে। ওর আর বদমাশ দুটোর মাঝখানে যদি সিংহটা থাকে, ওরা এগোতে সাহস করবে না।

লঘু সতর্ক পায়ে সামনে এগোতে শুরু করল। এবার ওর দিকে তাকিয়ে। হুঙ্কার ছাড়ল হারকিউলিস।

ঘাবড়ে গেল ছেলেটা, যতটুকু এগিয়েছিল, তার চেয়েও পিছিয়ে গেল।

ওদের উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে মুসার দিকে তাকাল হারকিউলিস। মনে হয় বোঝার চেষ্টা করছে কার মাংস বেশি সুস্বাদু হবে।

বাঁচতে চাইলে বেরিয়ে যাও তোমরা, গলায় জোর ফোঁটানোর চেষ্টা করল ও। আজ এখনও পর্যন্ত হারকিউলিসকে খেতে দেয়া হয়নি। ওটা কিন্তু ক্ষুধার্ত।

ভয়ে ভয়ে ওটার দিকে তাকাল দুই বদমাশ।

হারকিউলিস আমাকে কিছু করবে না. সির ভঙ্গি করল মুসা। কারণ আমি ওর মাস্টার। আমি হুকুম করলে ও তোমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

নজর বিনিময় করল ওরা। দুর্বল গলায় একজন বলল, মিথ্যে কথা!

অন্যজনের চেহারায় অনিশ্চয়তা।

সত্যি! তোমরা চাইলে প্রমাণ করে দেখাতে পারি।

বাঁটু পিছিয়ে গেল। লম্বু ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এল সামনে। ভয় পাচ্ছ কেন! বিড়বিড় করে বলল। ঘোড়াটা আমাদের বোকা বানাতে চাইছে।

হারকিউলিস! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ধরো ওদের… ওর কথা শেষ হবার আগেই এমন এক হুঙ্কার ছাড়ল পশুরাজ, মাটি থরথর করে কেঁপে উঠল।

না, ঝাঁপিয়ে পড়বার দরকার পড়ল না হারকিউলিসের। তার আগেই লেজ, তুলে দৌড় লাগাল ছেলেদুটো। চোখের পলকে খাঁচা থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে লাগল।

ঠিক আছে, হুমকির সুরে লম্বু বলল। যাচ্ছি। কিন্তু তাই বলে মনে কোরো না তুমি পালাতে পারবে। আবার আসব আমরা! তোমাকে শায়েস্তা করে ছাড়ব।

কি চাও তোমরা আমার কাছে? কণ্ঠ কেঁপে গেল মুসার। আমি কী দোষ করেছি? বলো, কী দোষ করেছি আমি? কেন পিছু লেগেছ আমার?

১৬

আসলে কাউকেই খাওয়ার আগ্রহ ছিল না হারকিউলিসের। কারণ ওটা মানুষখেকো নয়। মাংস খায় ঠিকই, কিন্তু সেসব ওটার প্রতিদিনের রেশনের মাংস, তাজা মানুষের নয়। খাঁচা থেকে বেরোতে চাইছে ওটা আসলে, বন্দিদশা থেকে মুক্তি চায়। এই জন্যই রাগ ঝাড়ছে।

টু করে বেরিয়ে এল মুসা। চেয়ে চেয়ে দেখল কেবল হারকিউলিস।

চুপি চুপি তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল ও। যে ভ্যানে করে এসেছিল, সেটায় উঠে বসে থাকল। আর সবার প্র্যাকটিস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকল। অনেকক্ষণ পর ফিরল ওর নতুন পরিবারের সদস্যরা। ওকে ভালমানুষের মত গাড়িতে বসে থাকতে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন বাবা।

সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি?

জবাব দিল না ও। ভ্যানে উঠে পড়ল সবাই। বাড়ির পথে চলতে শুরু করল লক্কর-ঝক্কর গাড়ি।

সামনে মা-বাবার মাঝখানে বসেছে মুসা। নইলে বোনেরা ওকে খুঁচিয়ে শেষ করে দিত।

আমার খুব খারাপ লাগছে, অভিযোগের সুরে বলল মুসা। ঘুমানো দরকার।

কাল আবার প্র্যাকটিসে আসতে হবে মনে থাকে যেন, গাড়ি চালনার ফাঁকে মাথা দোলালেন বাবা। কাল কিন্তু কোনও ওজর-আপত্তি চলবে না ॥ বলে দিলাম।

জবাব দেয়ার বদলে হাই তুলল মুসা। ও জানে কাল কখনও আসবে না। অন্তত এই সার্কাস-পরিবারের সদস্য আর থাকবে না ও কাল।

কাল নতুন এবং হয়তো আরও ভীতিকর পরিবেশ এসে হাজির হবে ওর সামনে। অথবা ভাল কিছুও ঘটতে পারে। সেই আশাই করছে ও।

খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি বিছানার দিকে এগোল মুসা। আট বছরের ছোট থাকতে একদম ভাল লাগছে না। তার উপর এই সার্কাস-পরিবার একেবারে অসহ্য ঠেকছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পরিবারের হাত থেকে উদ্ধার পেতে চায় ও।

ওর রুমে বাদরামি করছে ভাই-বোনেরা। সুতরাং আবার সেই গেস্ট রুমেই যেতে হলো ওকে বাধ্য হয়ে।

শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে কেবল, ঘুমাতে পারছে না। নানান চিন্তায় মাথা ভারী হয়ে আছে, ঘুরছে।

কাল ওর জন্য নতুন কী চমক আসছে, সে কথা ভাবছে।

পাঠক, তোমরা যদি ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে পড়তে যদি জানতে, আগামীকাল ঘুম থেকে ওঠার পর নতুন কোনও পৃথিবীর বাসিন্দা হবে তুমি, অথচ সেই পৃথিবীটা কেমন হবে তা তোমার জানা নেই, তা হলে তুমি কী ঘুমাতে পারতে?

না মনে হয়।

মুসাও ঘুমাতে পারছে না।

আগামীকাল উঠে যদি দেখি আমি ফুটবল প্লেয়ার হয়ে গেছি, কী যে দারুণ হত! ভাবল ও। যদি পৃথিবীর সেরা ফুটবল প্লেয়ার হতে পারতাম ম্যারাডোনা বা প্লাতিনির মত!

অথবা কোটিপতি কোনও বাবা-মার সন্তান! যা চাইতাম, তাই পেতাম, দারুণ ব্যাপার হত!

অথবা পাঁচশো বছর ভবিষ্যতে যাওয়া যেত যদি! অথবা যদি একজন মহাকাশচারী হতে পারতাম!

মুসা জানে এসব কিছুই ঘটবে না। কারণ ওর কপাল খারাপ। অন্তত এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, তাতে এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

সবকিছুকে ছাপিয়ে আসল পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটা ওর মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

সেদিন কী আসবে আর কখনও?

ওর আসল পরিবারে ফিরে যেতে পারবে মুসা? বাবা, মা, ফারিহা, তানজিয়া, শাওনি ভাইকে ফিরে পাবে? মনে হলো কতযুগ যেন ওদের দেখে না।

খারাপ লেগে উঠল মুসার।

অবশেষে ভোরের দিকে দুচোখ বুজে এল ওর।

.

যখন ঘুম ভাঙল, তখনও আলো ভালমত ফোটেনি। ঘুমজড়ানো চোখে রুমের চারদিকে নজর বোলাল মুসা।

এখন আমি কে? ভাবল। ঘরটা তো স্বাভাবিকই আছে মনে হচ্ছে। বাড়ির ভিতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। সার্কাস-পরিবার গায়েব হয়ে গেছে বুঝতে অসুবিধে হলো না মুসার।

লাফ দিয়ে উঠে বসল। নেমে দাঁড়াল বিছানা থেকে। দুপা ভীষণ দুর্বল লাগছে।

ব্যাপার কী?

ধীর পায়ে বাথরুমের দিকে এগোল মুসা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যা দেখল, তাতে মাথা ঘুরে উঠল বন্ন করে।

হায় আল্লা!

আজকে আগের সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে মুসা।

এ অসম্ভব!

অকল্পনীয়!

অবিশ্বাস্য।

১৭

মুসা এখন থুথুড়ে এক বুড়ো!

না! দুর্বল কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠার চেষ্টা করল ও। এ হতে পারে না!

এ মেনে নেয়া যায় না।

কিছুতেই না।

বুড়ো হয়ে বাঁচতে চায় না মুসা।

এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল।

দুর্বল পায়ে গেস্ট রুমে ফিরে এল ও। মনে হচ্ছে একেকটা পায়ের ওজন কয়েক মণ করে বেড়ে গেছে। সহজে তোলা যায় না।

রুমে এসে বিছানায় বসে কিছুক্ষণ হাঁপিয়ে নিল মুসা, যেন কয়েক মাইল পথ দৌড়ে এসেছে। টপটপ করছে হৃৎপিণ্ড।

শুয়ে চোখ বুজল।

আবার ঘুমাতে হবে। বুড়ো হয়ে বাঁচতে চায় না ও কিছুতেই। ওর বয়স এখন মাত্র তেরো, জানে মুসা। কাজেই এত তাড়াতাড়ি বুড়ো হতে চায় না ও।

এবং ঘুমানো ছাড়া এই বিপদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও পথ নেই। একসময় ঘুমিয়ে পড়লও মুসা। যখন জেগে উঠল, টের পেল বদলে গেছে ও। এখন আর বুড়ো নেই।

আগের মত দুর্বল লাগছে না। বরং ভিতরের শক্তি অনেক বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। হয়তো এখন আমি একজন ফুটবল খেলোয়াড়, আশান্বিত হয়ে ভাবল ও।

উঠে বসে চোখ ডলল কয়েক মুহূর্ত। আচমকা হাতের দিকে নজর যেতেই আঁতকে উঠল।

ওর চামড়া সবুজ হয়ে গেছে!

সবুজ কেন?

আর আঙুলগুলোই বা অমন অদ্ভুত কেন? মানুষের আঙুল অমন হয় নাকি?

জোরে জোরে শ্বাস টানল ও। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপছে। বুকের খাঁচায় বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ড।

এবার কী ঘটেছে ওর পোড়া কপালে?

একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে বাথরুমে চলে এল মুসা। আয়নার সামনে দাঁড়াল। এবং যথারীতি সশব্দে আঁতকে উঠল নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।

দানব হয়ে গেছে মুসা!

কুৎসিত, ভয়ানক এক দানবে পরিণত হয়েছে ও!

১৮

গলা দিয়ে আপনাআপনি একটা গোঙানি ঠেলে বেরিয়ে এল।

এ হতে পারে না, মরিয়া হয়ে বলবার চেষ্টা করল ও। কিছুতেই না।

কিন্তু কথা নয়, কলজে পানি করা হুঙ্কার বের হলো গলা দিয়ে। মনের ভীষণ চাপ সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠল।

না! ভয়ে কাঁটা দিল মুসার সারা গায়ে। ভিনগ্রহের আজব এক জম্ভর মত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে এখন ওকে। এমন কী কথা পর্যন্ত বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে।

বিশাল দেহ পেয়েছে মুসা। উচ্চতা কম করে হলেও সাত ফুট হবে–গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। চামড়ার রং সবুজ, তার মধ্যে কালো স্ট্রাইপ। অনেকটা রাস্তার জেব্রা ক্রসিঙের মত। বাতাসে ভেসে বেড়ানো নানান শব্দ আসছে কানে। ঘ্রাণশক্তিও অনেক বেড়ে গেছে। অনেকটা কুকুরের মত।

ভিনগ্রহের কুৎসিত প্রাণীর মত লাগছে ওকে দেখতে। নাক-মুখ-চোখ কান সবই আছে। চোখদুটোর সাইজ কমলালেবুর সমান। বোচা নাক। জঘন্য! সরু, চোখা কান।

হাতের আঙুল অস্বাভাবিক লম্বা–সেগুলোর আগায় লম্বা নখ। দেখে গা ঘিঘিন করে উঠল মুসার।

এর চেয়ে বুড়ো হয়ে থাকাও অনেক ভাল ছিল। যতবার ও ঘুম থেকে জাগছে, ততবারই অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ কী অসহ্য যন্ত্রণায় পড়ল। মুসা?

এর শেষ কোথায়?

কী করে এর হাত থেকে মুক্তি মিলবে?

সানজানার কথা মনে পড়ল মুসার। ও নিজে যে জগতেই থাকুক, ভোজবাজির মত উদয় হয় মেয়েটা। এবং এ পর্যন্ত প্রতিবারই কালো পোশাক পরা বিপজ্জনক দুই তরুণের হাত থেকে বাঁচানোর ব্যাপারে ওকে সাহায্য করেছে মেয়েটা। সানজানা আসলে ওকে সাহায্য করতে চায়। সেই জন্যই বারবার আসে?

যেভাবে হোক, ওকে খুঁজে বের করতে হবে

সিদ্ধান্ত নিল মুসা। মন বলছে ওকে খুঁজে বের করা সম্ভব। মেয়েটা ওর ধারেকাছেই কোথাও আছে। গত কদিনের কথা ভেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছল মুসাহা, সানজানা ওকে উদ্ধার করতেই চায়। নিশ্চয়ই ও কোনও বিশেষ মেয়ে হবে। কাজেই সানজানাই এখন ওর একমাত্র ভরসা।

বিশাল দানবীয় শরীর নিয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াল মুসা।

ফাঁকা। জনপ্রাণীর সাড়াশব্দ নেই। খাঁ-খাঁ করছে বাড়িটা। ওকে সাহায্য করার কেউ নেই।

মুসা ভেবেছিল এখন ও হয়তো কোনও দানব-পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে। দানব বাবা-মা, ভাই-বোন আছে হয়তো।

কিন্তু না, বাড়িতে ও ছাড়া আর কোনও প্রাণী নেই।

মনে মনে খুশি হয়ে উঠল মুসা। এ বরং ভালই হয়েছে। এখন ও যা খুশি তাই করতে পারবে। বাধা দেয়ার বা শাসন করার মত কেউ নেই।

ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এল মুসা। চেঁচিয়ে ডাকার চেষ্টা করল, সানজানা! সানজানা, তুমি কোথায়?

কিন্তু কোনও কথা বেরোল না মুখ দিয়ে। যা বেরোল তা রক্ত ঠাণ্ডা করা দুর্বোধ্য হুঙ্কার।

আচমকা ওর সামনে ব্রেক কষল একটা গাড়ি। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিল ড্রাইভার। চোখ আলু করে চেয়ে থাকল মুসার দিকে।

ভয় পাবেন না! চেঁচিয়ে উঠল ও। কিন্তু গলা দিয়ে ফুটল অন্য কিছু, কথা নয় আকাশ বাতাস কাঁপানো এক গর্জন।

প্রথমে একটা চিৎকার দিল ড্রাইভার। তারপর গাড়ির গতি দ্রুত তুলল। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না, আরেকটা গাড়ির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটিয়ে বসল। ইস্পাত ও কাঁচ ভাঙচুরের ভয়াবহ আওয়াজ হলো।

কেউ আহত হয়েছে কি না দেখার জন্য এগোল মুসা। অন্য গাড়িতে এক মহিলা আর এক শিশুকে দেখা গেল।

না, আঘাত পায়নি কেউ। তবে গাড়ি দুটোর বেশ ক্ষতি হয়েছে।

চোখের সামনে অদ্ভুত প্রাণীটাকে দেখতে পেয়েই গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল সবাই। চিৎকার করতে করতে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল যে যেদিকে পারে।

এগিয়ে চলেছে মুসা। ওর প্রত্যেক পদক্ষেপে মাটি কেঁপে উঠছে। রাস্তার লোকজন থমকে দাঁড়াচ্ছে, বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকছে কয়েক মুহূর্ত, তারপর রুদ্ধশ্বাসে উল্টোদিকে ছুটছে। দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছে চোখের আড়ালে।

সানজানা, ভাবছে মুসা, সানজানাকে খুঁজে বের করতেই হবে যে-করে হোক।

মাথার মধ্যে কেবল সানজানার চিন্তা ধরে রাখতে চাইছে মুসা। কিন্তু এ পারছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব।

খিদে!

প্রচণ্ড খিদেয় পেটের মধ্যে নাড়িভুড়ি মোচড় মারছে। প্রিয় খাবারগুলো ওর চোখের সামনে ভাসছে। কিন্তু ওগুলো তো কোনও দানবের খাবার হতে পারে না। ওর এখন দরকার শক্ত, কঠিন খাবার।

একটা গাড়ি খেয়ে দেখলে মন্দ হত না–ভাবল মুসা। নিশ্চয়ই খুব মজার, সুস্বাদু হবে।

ওদিকে হুলস্থুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। হই-চই, চেঁচামেচিতে মুসার দানবীয় কানেও তালা লাগার দশা। লোকজন যে-যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। চারদিকে মহা বিশৃঙ্খলা।

যাজকের পোশাক পরা এক লোককে বলতে শোনা গেল, পৃথিবী শেষ! এসব পৃথিবী শেষ হওয়ার লক্ষণ!

বলে আর দাঁড়াল না লোকটা। ঘুরেই দিল দৌড়।

মানুষ যতই ভয় পাক, কাউকে আঘাত করার ইচ্ছে নেই মুসার। সানজানাকে খুঁজছে ও। ভীষণ দরকার এখন মেয়েটাকে।

কিন্তু তার আগে পেট ঠাণ্ডা করতে হবে। খিদেটা ভীষণ চাগিয়ে উঠেছে।

দানবীয় পা ফেলে একটা গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল মুসা। ঝকঝকে নতুন গাড়ি। ওটা দেখেই দ্বিগুণ বেড়ে গেল খিদে। পানি এসে গেল জিভে।

দানবীয় হাত দিয়ে গরিলার যুদ্ধ ঘোষণার মত দমাদম নিজের বুক চাপড়াতে লাগল মুসা।

তাই দেখে গাড়ির ভিতরে বসা ড্রাইভার থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। কী করবে দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। সামনে-পিছনে কোনওদিকেই যাওয়া চলবে না। রাস্তায় অজস্র গাড়ির জ্যাম লেগে গেছে।

একটা ওয়াইপার টান দিয়ে খুলে ফেলল মুসা। স্বাদ পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

উমমমম! দারুণ তো!

ঝটকা মেরে গাড়ির দরজা খুলে ফেলল ড্রাইভার। চোখ কপালে তুলে বেরিয়ে এল। গলার সমস্ত শক্তি এক করে চেঁচিয়ে উঠল। বাঁচাও! বাঁচাও! বলতে বলতে ছুটল যেদিকে দুচোখ যায়। এদিকে চমৎকার একটা খাবার সামনে পেয়ে খুশি হয়ে উঠেছে মুসা।

এক টানে একদিকের দরজা ছুটিয়ে ফেলল। ষ্টার হ্যাঁণ্ডেল খুলে মুখে পুরে দিল।

দারুণ তো! ভাবল মুসা। কোঁৎ করে গিলে ফেলল।

এবার কামড়ে দরজার একটা অংশ মুখে পুরে ফেলল।

চাকুম! চাকুম!! চাকুম!!!

রেজরের মত ধারাল দাঁত দিয়ে কড়মড় করে চিবাল মুসা।

মজা পেয়ে চাকুম চাকুম শব্দ করছে। দেখতে দেখতে পুরো দরজা সাবাড় করে ফেলল মুসা। তারপর একটা সিট খুলে নিল। চামড়াটা দারুণ। সুস্বাদু। ফোম প্যাডিং শুকনো হলেও খেতে মন্দ লাগছে না। মাখনবিহীন টোস্ট বিস্কিটের স্বাদ আছে এতে।

স্টিয়ারিং হুইলটা টান মেরে খুলে ফেলতেই একটা সাইরেনের শব্দ কানে এল ওর।

সেরেছে!

সোজা হয়ে সামনে তাকাতে দেখল একটু দূরত্ব রেখে চারদিক থেকে অসংখ্য মানুষ ওকে ঘিরে ফেলেছে।

প্রত্যেকের চোখে-মুখে বিস্ময়, যেন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য দেখছে। ভয় তাড়িত কণ্ঠে চেঁচামেচি করছে। সামনে এগোতে চায়, কিন্তু সাহস নেই। মুসার দিকে আঙুল নির্দেশ করে কী সব বলাবলি করছে ওরা।

ইয়াল্লা! বাচ্চা ছেলের মত চেঁচিয়ে উঠল এক মাঝবয়সী লোক। কী ওটা! রাক্ষস নাকি, আস্ত গাড়িটা চিবিয়ে খেয়ে নিচ্ছে!

দানব গাড়ি খাবে না তো কাঁচকলা খাবে নাকি? বিরক্ত হয়ে ভাবল মুসা। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে সাইরেনের শব্দ।

এবার দেখল অসংখ্য পুলিশ ওকে দূর দিয়ে ঘিরে ফেলেছে।

রাস্তা পরিষ্কার করুন, লাউড স্পিকারে একটা গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল। পিছিয়ে আসুন সবাই, সরে দাঁড়ান।

এখনই পালাতে হবে, সিদ্ধান্ত নিল মুসা, নইলে খবর আছে। স্টিয়ারিং হুইলটা ছুঁড়ে ফেলেই ছুটতে শুরু করল ও। ভয় পেয়ে লোকজন ফোয়ারার পানির মত চারদিকে ছিটকে পড়ে পথ করে দিল ওকে।

থামাও ওটাকে! দানবটাকে ধরো!

পুলিশের কয়েকটা গাড়ি সম্মিলিত সাইরেন বাজাচ্ছে। সে-শব্দে আকাশ কাঁপছে। মুসার কানে তালা লাগার অবস্থা।

পুলিশের হাতে ধরা পড়লে কপালে খারাবি আছে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। দানব মুসার। নির্ঘাত ওকে মেরে ফেলবে তারা।

পালাতে হবে।

এক্ষুণি পালাতে হবে।

ছুটছে মুসা। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। দৌড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুহাত সামনে-পিছনে করছে। চিৎকার করতে করতে পিছনে ছুটে আসছে জনতার দঙ্গল, পুলিশ বাহিনী। কিন্তু একটা দানবের সঙ্গে পারা সোজা নয়। লম্বা পায়ে দৌড়ে এদের অনেক পিছনে ফেলে দিল মুসা।

মাঝখানে ব্যবধান বাড়ছে ক্রমে।

আরও বাড়ছে!

আরও বাড়ছে!

এক সময় মুসা বুঝতে পারল ওদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে এসেছে ও। দৌড়াতে দৌড়াতে শহর ছাড়িয়ে নির্জন শহরতলিতে চলে এসেছে। আপনা আপনি দৌড়ের গতি কমে এল।

এবং আচমকা থেমে দাঁড়াল মুসা সামনেই সানজানাকে দেখতে পেল। ওর দিকেই দৌড়ে আসছে মেয়েটা।

মুসার সামনে এসে থেমে দাঁড়াল। ভয় পাওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। মেয়েটার মধ্যে, চিনতে পেরেছে হয়তো।

ব্যস্ত হয়ে মুসা কিছু বলার ব্যর্থ চেষ্টা করল। তাতেই যা বোঝার বুঝে নিল সানজানা। মুসার বাহু ধরে টানতে শুরু করল।

মেয়েটাকে অনুসরণ করল ও।

হাঁটছে।

হাঁটছে।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা গ্রামকে পাশ কাটাল ওরা। মুসার জানতে ইচ্ছে করছে সানজানা ওকে কোথায় নিয়ে চলেছে। কিন্তু জানে কথা বলার ক্ষমতা নেই ওর। কথা বলার চেষ্টা করলে মুখ দিয়ে ভয়ঙ্কর গর্জন বেরিয়ে আসবে। তাতে ভয় পেতে পারে সানজানা। সুতরাং মুখ বুজে ওকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিল মুসা। মেয়েটা নিশ্চয়ই ওর কোনও ক্ষতি করবে না।

হাঁটছে তো হাঁটছেই ওরা।

আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা জঙ্গলের মধ্যে চলে এল ওরা। জঙ্গল ভেদ করে এগিয়ে চলল। যত এগোচ্ছে, তত গম্ভীর হচ্ছে অরণ্য।

সানজানার প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল মুসার অন্তর। যা বোঝার বুঝে নিয়েছে সে। মেয়েটা ওকে লোকচক্ষুর আড়ালে গভীর বনের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে চাইছে হয়তো।

সরু, জংলা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে দুজন। সামনে সানজানা, পিছনে মুসা। একটু পরপর মেয়েটা পিছন ফিরে তাকাচ্ছে। মুসা ওকে অনুসরণ করছে কি না দেখে নিচ্ছে।

অবশেষে ছোট, পাকা একটা পুরানো বাড়ির সামনে শেষ হলো ওদের দীর্ঘ পথচলা। গাছপালা বাড়িটাকে ঢেকে রেখেছে প্রায়। দূর থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই।

লুকানোর চমৎকার জায়গা এটা, ভাবতে গিয়ে খুশি হয়ে উঠল মুসা। কিন্তু সানজানা এটার খবর কীভাবে জানল ভেবে অবাকও হচ্ছে যথেষ্ট। হয়তো এই গ্রামে ওদের আসা-যাওয়া আছে। হয়তো কোন আত্মীয় থাকেন।

সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বাড়িতে দিব্যি মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু খাবার? খাবার কোথায় পাবে মুসা?

খাওয়ার কথা মনে হতেই পেটের ভিতরে নতুন করে মোচড় দিয়ে উঠল। তবে ব্যাপারটাকে পাত্তা দিল না মুসা।

এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল সানজানা। মুসাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল।

তখনই ওদের সামনে এসে দাঁড়াল দুটো ছায়া।

প্রথমে ছায়াই মনে করেছিল মুসা।

পরমুহূর্তে ভুল ভাঙল।

ছায়া কোথায়, মানুষ!

কালো পোশাক পরা!

ওদের দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল মুসা।

এ কী করে হয়?

 কালো পোশাক পরা সেই দুই ছেলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে মুসা।

ওদের মধ্যে একজন কথা বলে উঠল। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, সানজানা। ব্যাটাকে আমাদের কাছে ধরে আনার জন্যে ধন্যবাদ। দারুণ তোমার কর্তব্যজ্ঞান। ধন্যবাদ।

১৯

হা-আ-আ-আ-আ-উ-উ-উ-উ-ম-ম-ম-ম!

দুহাত শূন্যে ছুঁড়ল মুসা পাগলের মত। হিংস্র হয়ে উঠেছে।

সানজানা বিশ্বাসঘাতিনী! বিশ্বাসঘাতকতা করেছে!

পালাতে হবে–ভাবল বিশাল দানবীয় মস্তিষ্কের মধ্যে আটকে পড়া মুসার কচি মন। বাঁচতে চাইলে পালাতে হবে এই নরক থেকে। নইলে…

আর ভাবার সময় নেই।

দরজার দিকে এগোতে গিয়েছিল মুসা। কিন্তু পারল না।

শক্ত একটা জালের মধ্যে ওকে বন্দি করে ফেলল ওরা।

প্রচণ্ড শক্তিতে চার হাত-পা ছুঁড়তে লাগল মুসা। জাল ছেঁড়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল। হলো না। উল্টে আরও পেঁচিয়ে গেল জাল। বেরোবার পথ নেই।

শক্ত নেটের মধ্যে বন্দি হলো মুসা!

দেহের সমস্ত শক্তি এক করে বুক চাপড়াতে লাগল চাপা ক্ষোভে। বন জঙ্গল কাঁপিয়ে হুঙ্কার ছাড়তে লাগল একের পর এক। কিন্তু লাভ হলো না, এরই মধ্যে শক্ত করে নেটের মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে ওকে।

আমাকে ছেড়ে দাও! বলার চেষ্টা করল ও। তীক্ষ্ণ নখর, দাঁত দিয়ে নেট ছেঁড়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাল আবারও। জালটা অদ্ভুত কোনও জিনিসের তৈরি। ভীষণ মজবুত। ছেঁড়া গেল না কিছুতেই।

তারপরও অনেকক্ষণ পা ছুঁড়ল মুসা। কাজের কাজ কিছু হলো না। মাঝখান থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। মেঝের উপর শুয়ে পড়ল।

এক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে সানজানা এবং কালো পোশাক পরা ছেলেদুটো। চেহারায় স্বস্তি, বিজয়ের আনন্দ।

জানে কাজটা হবে না, তারপরও কেন যেন মুসার মনে হলো ওর পক্ষে কথা বলা সম্ভব। তা-ই মুখ খুলল।

কীভাবে আমাকে এমন বিপদে ফেলতে পারলে তুমি? সানজানাকে বলার চেষ্টা করল। তোমাকে আমি বন্ধু ভেবেছিলাম।

তর্জন-গর্জন ছাড়া কিছুই বেরোল না গলা দিয়ে। মেয়েটা মুখ নীচু করে চেয়ে আছে ওর দিকে। মুসার বক্তব্য বুঝতে পারছে না।

বুকের উপর হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দুই ছেলে। কেমন জব্দ! জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে খাটো ছেলেটা। কথাটা সে-ই বলল।

তোমরা কারা? বলতে চাইল মুসা। কী চাও তোমরা? এসব কী ঘটছে?

জবাব দিল না কেউ।

লম্বা ছেলেটা বলল, অল রাইট। পেছনের রুমে ওকে বন্দি করে রাখি, চলো।

দুর্বল গলায় আবার গর্জন ছাড়ল মুসা। পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে এল ওরা তিনজন। কাজে হাত লাগাল। জালের তিন প্রান্ত ধরে ছ্যাচড়াতে হ্যাঁচড়াতে মুসাকে নিয়ে চলল আরেক ঘরে।

ছোট্ট, অন্ধকার একটা ঘরে নিয়ে এল ওরা মুসাকে। তারপর বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল।

অসহ্য নীরবতা চেপে বসেছে পরিবেশে। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। পাখিরাও ডাকতে ভুলে গেছে।

ঘরের চারদিকে নজর বোলাল মুসা। আবছা আঁধারে দেখা গেল রুমে ও ছাড়া আর কেউ নেই, কিছু নেই। লোহার গরাদওয়ালা একটা জানালা আছে শুধু অনেক উঁচুতে, সিলিঙের কাছাকাছি। জেলখানার মত।

গরাদগুলো দেখে পেটের খিদেটা চাগিয়ে উঠল। জালের মধ্যে বন্দি না থাকলে এখনই ওগুলো দিয়ে ভোজ সারা যেত। কিন্তু কপাল মন্দ। নেট এত শক্ত হয়ে শরীরে এঁটে আছে যে একচুল নড়তে পারল না মুসা।

বাধ্য হয়ে চুপ করে শুয়ে থাকল ও অসহায়ের মত। কিছু একটা ঘটবার অপেক্ষায় আছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাবার পরও ওরা ফিরে এল না। হয়তো পাশের ঘরেই আছে ওরা, ধারণা করল মুসা। কিন্তু কী করছে বোঝার উপায় নেই।

জানালা দিয়ে দেখা গেল দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে।

সন্ধে নামছে।

মুসা বুঝতে পারছে ঘুমানো ছাড়া এখন কিছু করার নেই ওর। ঘুম থেকে জাগার পর আবার যেন নিজেকে মানুষ হিসেবে ফিরে পায়, এই আশা নিয়ে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ও।

২০

ঘুম ভাঙতেই মুসা টের পেল ব্যথায় জান বেরিয়ে যাবার দশা ওর।

ইয়াল্লা! ভাবল ও। কাল কী খেয়েছিলাম আমি? মনে হচ্ছে ওর পাকস্থলীতে লোহা-লক্কড় নাচানাচি শুরু করেছে।

এমন সময় সব মনে পড়ে গেল।

গাড়ি!

গাড়ি খেয়েছিল ও কাল। ওর পাকস্থলী এখন সত্যিই লোহার টুকরোয় ভর্তি!

ওয়াক! বহু কষ্টে ভিতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা বমির বেগ ঠেকাল মুসা। উঠে বসল। নিজের হাত-পা দেখল।

হ্যাঁ, আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছে মুসা, মানুষ হয়ে গেছে।

স্বস্তির শ্বাস ফেলল শব্দ করে।

শক্ত জালটা একপাশে পড়ে আছে। কাটা। কী করে ঘটল ব্যাপারটা?

মুসা ঘুমিয়ে থাকতে কেউ এসে কেটে দিয়েছে। কে সে?

কিন্তু আমি এখন কে? ভাবল ও।

সরু সরু হাত-পা, পায়ের পাতা পায়ের তুলনায় বড়ই মনে হচ্ছে। তবে দানবের পাতার মত অত বড় নয়। ও এখন আবার একটা কিশোরে পরিণত হয়েছে। তেরোর আশপাশেই হবে বয়স। একটু বেশিও হতে পারে–চোদ্দ বা পনেরো।

তাতে কিছুই যায়-আসে না। ও এখন আর দানব নেই, সেটাই আসল।

সেটাই একমাত্র স্বস্তির কথা।

কিন্তু এখনও গভীর বনের সেই রহস্যময় বাড়ির মধ্যে ও বন্দি, বুঝতে পারল মুসা। এখনও বন্দি।

অবশেষে সফল হয়েছে রহস্যময় ছেলেদুটো। ওকে ধরতে পেরেছে। তবে সানজানার সাহায্য ছাড়া কাজটা সম্ভব হত কি না সন্দেহ। মেয়েটাকে বন্ধু ভেবেছিল মুসা, সে-ই কিনা…

মুসার কাছে কী চায় ওরা? ওকে নিয়ে কী করতে চলেছে?

উঠে দাঁড়াল ও। হাই তুলতে তুলতে আড়মোড়া ভাঙল। জানালার ওপাশে গাছের ডালে বসে একটা দাঁড়কাক ডাকছে কর্কশ কা-কা শব্দে।

দরজা খোলার চেষ্টা করল মুসা। ওপাশ থেকে বন্ধ। মুখ তুলে জানালার দিকে তাকাল। গরাদের সরু ফাঁকের মধ্য দিয়ে বেরোনো ওর পক্ষে সম্ভব নয়।

তার মানে পালানোর পথ নেই।

এমন সময় বাইরে থেকে তালা খোলার শব্দ উঠল।

ওরা আসছে!

ঘরের এক কোণে সরে দাঁড়াল মুসা। ভয় লাগছে। ঠোঁট চাটল কয়েকবার।

খুলে গেল দরজা। দুই সঙ্গীকে নিয়ে ভিতরে ঢুকল সানজানা নামের মেয়েটা।

মুসা? আবছা আঁধারে ওকে দেখতে না পেয়ে অনিশ্চিত গলায় ডাকল ও। কোথায়… এক কোণে ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেল সে।

আমাকে কেন এখানে ধরে এনেছ তোমরা? স্লান স্বরে বলল মুসা।

ও আবার কথা বলতে পারছে বুঝতে পেরে এই পরিস্থিতিতেও খুশি হয়ে উঠল মুসা। আর যা-ই হোক, অন্তত বিশ্রী গর্জন তো বেরোচ্ছে না গলা দিয়ে।

আমাকে যেতে দাও!

ছেলেদুটো আপনমনে মাথা দোলাল। যেন ওর আবদার শুনে মজা পেয়েছে।

সে কী! কথা বলে উঠল খাটো জন। যেতে দেব বলে এতদূর ধরে আনা হয়েছে নাকি তোমাকে!

একযোগে এগিয়ে এল দুজন। হাত একবার মুঠো পাকাচ্ছে, একবার খুলছে।

আমাকে যেতে দাও, প্লিজ!

ঝট করে দরজা লাগিয়ে দিল সানজানা।

ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওর দিকে এগোতে লাগল দুই মৃত্যুদূত!

২১

মরিয়া হয়ে ঘরের চারদিকে নজর বোলাতে লাগল মুসা। পালানোর পথ নেই জেনেও পথ খুঁজছে।

দরজার দিকে ছুটতে গেল। কিন্তু হলো না। দরজা আর.ওর মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লম্বু আর বাটকু।

আমরা তোমাকে মারব না, মুসা, শান্ত স্বরে বলল সানজানা। আমরা তোমাকে সাহায্য করতে চাই, সত্যি।

আরেক পা এগিয়ে এল ওই দুই তরুণ। সঙ্গে সঙ্গে দুপা পিছিয়ে মাঝখানের দূরত্ব বাড়াল মুসা। সানজানার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। অন্তত ছেলেদুটোর ভঙ্গি দেখে কোনওমতেই মেনে নেয়া সম্ভব নয় যে, ওরা ওকে সাহায্য করতে চায়।

ভয় পেয়ো না, মুসা, সানজানা বলল। তোমার সাথে আমাদের জরুরী কিছু কথা আছে।

হঠাৎ মুসার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মেয়েটা। মুসাকে শান্ত করার আন্তরিক চেষ্টা করছে। মুসাও ব্যাপারটা বুঝতে পারল।

কিন্তু ছেলেদুটোর মধ্যে আন্তরিকতার ছিটেফোঁটাও নেই। আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সানজানার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।

এসব কী ঘটছে খুলে বলো, প্লিজ, নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টার ফকে বলল মুসা।

কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল সানজানা। রিয়্যালিটি ওয়ার্প বা বাস্তব ঘূর্ণির মধ্যে আটকা পড়েছ তুমি, তাই তোমার এই অবস্থা।

ওর বলার ভঙ্গি দেখে অবাক হলো মুসা। এমনভাবে বলছে, যেন ব্যাপারটা সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান রাখে মুসা।

ঠাট্টা করতে ছাড়ল না ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ, রিয়্যালিটি ওয়ার্প, হাসির ভঙ্গি করল। আমি জানি এই কারণেই অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে।

ইয়ার্কি রাখো! ধমক লাগাল লম্বু। এটা কোনও ঠাট্টার বিষয় নয়। আমাদের অনেক ভুগিয়েছ তুমি।

শান্ত হও, ব্যাবলা, ডান হাত তুলল সানজানা। আমি বোঝাচ্ছি ওকে।

মুসার দিকে ঘুরল সে। নরম সুরে বলল, রিয়্যালিটি ওয়ার্ল্ড কী তা তুমি নিশ্চয়ই জানো না, তাই না?

হ্যাঁ, জবাব দিল ও। জানি না। তবে জিনিসটা যে ফালতু কিছু, তা বেশ বুঝতে পারছি।

প্রথম যে রাতে তুমি তোমাদের গেস্ট রুমে ঘুমালে, সে রাতে রিয়্যালিটির একটা গর্তে গিয়েছিলে তুমি।

কিছু বুঝতে না পেরে দুপাশে মাথা দোলাল মুসা।

রিয়্যালিটির গর্ত! আমাদের গেস্ট রুমে!

মাথা ঝাঁকাল সানজানা। এক বাস্তবে ঘুমাও তুমি, জেগে ওঠো আরেক বাস্তবে। অর্থাৎ ব্যাপারটা এরকম

এক হয়ে ঘুমাও, জেগে ওঠো অন্য কিছু হয়ে। এখনও ওই গর্তের মধ্যে আটকে আছ তুমি। এখন তুমি যতবার ঘুমাবে, ততবার বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকবে। বাস্তব হয়ে। যাবে অবাস্তব আর অবাস্তব হবে বাস্তব।

ব্যাপারটা থামিয়ে দাও, তা হলেই তো হয়ে যায়, বলল মুসা।

থামিয়ে দেব! চেঁচিয়ে উঠল বাটু।

আহ্, মিজু, থামো তো! বলল সানজানা।

কিন্তু… কিন্তু… তোমরা… কথা খুঁজে না পেয়ে থেমে গেল মুসা। মাথা ঘুরছে।

তুমি আইন ভঙ্গ করছ, মুসা, বলল সানজানা। যতবার তুমি বদলে যাচ্ছ, ততবারই রিয়্যালিটির আইন ভঙ্গ করছ।

আমি কী ইচ্ছে করে বদলাচ্ছি! প্রতিবাদ করল ও। আর তোমাদের রিয়্যালিটির আইন সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি। কাজেই ভাঙার প্রশ্নই আসে না। কী জিনিস সেটা?

আমি জানি তুমি ইচ্ছে করে করছ না, গলা খাঁকারি দিল সানজানা। কিন্তু সেটা দেখার বিষয় নয়। আইন ভাঙা হচ্ছে, সেটাই আসল। তোমার একেক পরিবর্তনের সাথে সাথে তুমি অনেক মানুষের বাস্তব আর অবাস্তব বোধের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছ। কোনটা বাস্তব আর কোনটা অবাস্তব, সেটা তারা বুঝতে পারছে না তোমার কারণে।

তোমরা বুঝতে পারছ না কেন! উত্তেজনায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা।

আমি চাই ব্যাপারটা বন্ধ হোক! এজন্যে যা করার দরকার, করব। আমি আবার স্বাভাবিক জগতে ফিরে যেতে চাই।

চিন্তা কোরো না, দাঁত খিচাল ব্যাবলা। আমরা সব ঠিক করে দেব।

আমরা রিয়্যালিটি পুলিশ, বলল সানজানা। বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের দায়িত্ব। তাই প্রথম থেকেই তোমার ওপর নজর ছিল আমাদের। রিয়্যালিটির গোড়ায় কুড়াল মেরে আইনের চোখে বিরাট বড় অপরাধ করেছ তুমি। তোমাকে ধরতেও আমাদের কম বেগ পেতে হয়নি।

কেন! কেন তোমরা আমাকে ধরেছ?

আমাদের চোখের সামনে বারবার তুমি আইন ভাঙবে, হাত মুঠো করে ঘুসি দেখাল মিজু। আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখব, কীভাবে ভাবতে পারলে তুমি?

চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল মুসা। তর্জনীর ডগা কপালে ঠুকল। কিন্তু আমাদের গেস্ট রুমে রিয়্যালিটির গর্ত এল কোত্থেকে?

প্রাকৃতিক নিয়মে, জবাব দিল সানজানা। আরও কিছুদিন হয়তো থাকবে ওটা। তারপর আবার প্রাকৃতিক নিয়মে সরে যাবে। ওই ঘরে সেই রাতে কারও থাকার কথা ছিল না। তুমি বেয়াড়া ছেলে, কারও কথা না মেনে ওই ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছ!

আচ্ছা, তা হলে ওই গেস্ট রুমই সব অনর্থের মূল, তা-ই না? ওই অপয়া ঘরে ঘুমিয়েছিলাম বলেই তোমাদের, আমার সবার এত দুর্ভোগ পোহাতে হলো?

হ্যাঁ।

আর কখনও ওই রুমে আমি ঘুমাব না! শপথ করার ভঙ্গিতে বলল মুসা। এখন যেমন আছি, তেমন বেঁচে থাকতে আমার কোন আপত্তি নেই। আগের জীবনে ফিরে না-ই বা গেলাম।

মাথা দোলাল সানজানা। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে, মুসা। তুমি গর্তের এত গভীরে চলে গেছ যে সেখান থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। এখন তুমি যেখানেই ঘুমাও, বদলে যাবে, রিয়্যালিটি আইন বারবার লঙ্ঘিত হবে।

তার মানে… তার মানে আমাকে তা হলে তোমরা আর কখনও ঘুমাতে দেবে না?

আসলে ঠিক তা নয়, বলে দুই সঙ্গীকে পালা করে দেখল সানজানা। তারপর গভীর চোখ মেলে তাকাল ওর দিকে।

আমি দুঃখিত, মুসা। সত্যি সত্যি খুব দুঃখিত। ছেলে হিসেবে তুমি চমৎকার। তোমাকে ভীষণ ভাল লেগেছিল আমার। কিন্তু এখন করার কিছু নেই। আইনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না আমি।

মা-মানে… কী-কী বলতে চাও তুমি! সাদা কাগজের মত ফ্যাকাসে হয়ে উঠল মুসার চেহারা।

মুসার একটা হাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল সানজানা। সত্যি আমরা নিরুপায়। তোমাকে আমরা ঘুম পাড়িয়ে দেব। চিরতরে।

২২

ঝাঁকির উপর ঝাঁকি খেল মুসা। এত মানসিক চাপ সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ল।

সা-সানজানা, এ-এ কী বলছ তুমি? তোতলাতে লাগল।

ও ঠিকই বলেছে, জোর দিয়ে বলল ব্যাবলা।

এ হতে পারে না! ফিসফিস করে বলল মুসা। পড়িমরি করে দরজার দিকে ছুটতে চাইল। কিন্তু মিজু আর ব্যাবলা তৈরি হয়েই ছিল। দুদিক থেকে ওর দুবাহু জাপটে ধরল ওরা।

পালাতে পারবে না, হাসল মিজু। শুধু শুধু চেষ্টা কোরো না।

ছেড়ে দাও আমাকে! চোখের কোণে পানি চিকচিক করে উঠল মুসার। মেরে ফেলো না, প্লিজ!

ওদের শক্ত থাবা থেকে ছোটার প্রাণপণ চেষ্টা করল ও। কিন্তু লাভ হলো না। জন্মের মত শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে মুঠো। ছুটছে না। বলিষ্ঠ দুই যুবকের সঙ্গে ওর পেরে ওঠার কথা নয়। ভয়, উত্তেজনা আর ঘটনার আকস্মিকতায় মুসা এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে শক্তিতে এখন সানজানার সঙ্গেও পারবে বলে ভরসা হলো না।

দেয়ালের সঙ্গে ওকে ঠেসে ধরে থাকল দুই যুবক।

প্লিজ, সানজানা! আমার কথা শোনো, আবেদন ঝরল ওর কণ্ঠে। আগের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার কোনোই উপায় নেই?

আছে, কাশল মেয়েটা। যে ঘরে তুমি সবসময় ঘুমাও, অর্থাৎ তোমার অপ্রিয় ওই ছোট্ট রুমটায় একবার ঘুমাতে পারলেই তুমি স্বাভাবিক জীবন…

এত সহজ উপায় থাকতে তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছ কেন? ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠল মুসা।

সহজ মনে হলেও আসলে সহজ নয়, কঠিন হাসি ফুটল সানজানার মুখে। তার প্রমাণ এর মধ্যেই তুমি বেশ কয়েকবার পেয়েছ। প্রতিবার তুমি প্রথমে তোমার ঘরেই ঘুমাতে গিয়েছিলে, কিন্তু পরিস্থিতি তোমাকে বাধ্য করেছে গেস্ট রুমে গিয়ে ঘুমাতে। সুতরাং ওই রুমে তুমি কখনও ঘুমাতে পারবে না। এবং স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরেও যেতে পারবে না।

কিন্তু কিন্তু আর একবার চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?

সমস্যা তাতে আরও বাড়বে। বহু কষ্ট করে তোমাকে আটকানো গেছে। কাজেই এখন ছেড়ে দেয়ার ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়।

আর কিছু বলার নেই ভেবে চুপ করে থাকল মুসা। মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

আমরা ফিরে আসব, বলল সানজানা। হাসির ভঙ্গি করল। অযথা তুমি ভয় পাচ্ছ। কোনদিক দিয়ে কী ঘটে যাবে, কিছুই টের পাবে না তুমি, দেখো। কোনও ব্যথা লাগবে না।

দরজা বন্ধ করে চলে গেল ওরা। বাইরে থেকে তালা লাগানোর আওয়াজ শোনা গেল।

হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘরের চারদিকে নজর বোলাল মুসা। পালানোর পথ খুঁজছে। চারদিকে দেয়াল। উপরে সিলিং। নীচে মেঝে। ছোট্ট একটা জানালা আছে, কিন্তু ওটার গরাদের ফাঁক দিয়ে বের হওয়া যাবে না। তা ছাড়া। জানালাটাও অনেক উপরে, নাগাল পাবে না ও।

আসলে এটা একটা জেলখানা, বুঝল ও। রিয়্যালিটি পুলিশের জেলখানা।

পাশের ঘর থেকে ওদের অস্পষ্ট কথাবার্তা কানে আসতেই দরজার কাছে। ছুটে গেল মুসা। কান পেতে শুনতে চেষ্টা করল।

ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে ওকে, মিজুর গলা শোনা গেল। পুরো এক গ্লাস খাওয়াতে হবে নইলে ব্যাটা আবার জেগে উঠবে।

কিন্তু যদি বেঁকে বসে? সানজানাকে বলতে শোনা গেল। যদি খেতে না চায়, তখন?

নিশ্চয়ই খাবে! জোর দিয়ে বলল ব্যাবলা। ও খাবে না ওর ঘাড়ে। খাবে। এই দায়িত্বটা আমাকে দাও।

কাঁপতে কাঁপতে দরজার কাছ থেকে সরে এল মুসা। আর শুনতে চায় না। পাগলের মত পায়চারি শুরু করল।

ওরা ওকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেবে! তা হলে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়বে ও! কোনওদিন আর ভাঙবে না সে ঘুম!

কালঘুম!

রিয়্যালিটির গর্তে পড়ার পর থেকে একের পর এক বিপদে পড়েই চলেছে ও। কিন্তু এই বিপদের কোনও তুলনা হয় না। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর বিপদ আর কী হতে পারে?

মৃত্যুর ঘণ্টা বাজছে ওর!

অসহায়ভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা ছাড়া আর কিছু করার নেই!

কিন্তু তারপরও মনের কোণে এক চিলতে আশার আলো দেখতে পেল ও। কেন, কীসের আলো, তা নিজেও জানে না।

ওর অবচেতন মন বলছে, এ যাত্রা তুমি বেঁচে যেতেও পারো, মুসা!

আচমকা একটা ব্যাপার মনে পড়ল। এর আগের একেক বিপদ থেকে কীভাবে উদ্ধার পেয়েছে ও?

মুসা ঘুমিয়েছে, ঘুম থেকে ওঠার পর আরও কঠিন বিপদে পড়েছে ঠিক, তবে আগেরটা কেটে গেছে।

ঘুম ভাঙার পর মহাবিপদে পড়েছে সত্যি, কিন্তু এখনকারটার চেয়ে বড় বিপদ আর কী হতে পারে?

ভাবতে গিয়ে ওর মনের আশার আলোটা একটু উজ্জ্বল হলো।

এখন যদি ও আবার ঘুমিয়ে পড়ে, তা হলে নতুন আরেক রিয়্যালিটিতে জেগে উঠবে। এবং বদলে যাবে। দানব যখন হয়েছে, তখন পাখি হওয়াও অসম্ভব নয়, কিংবা বেড়াল।

তার মানে…তার মানে… এই বন্দিদশা থেকে…

কিন্তু সমস্যা হলো এই মুহূর্তে কীভাবে ঘুমানো সম্ভব? মাথা চরকির মত চক্কর খাচ্ছে। একশো মাইল বেগে দুইশো রকমের চিন্তার টর্নেডো বয়ে চলেছে।

কিন্তু তবু চেষ্টা করতে হবে, ভাবল ও। চট করে শক্ত মেঝেতে শুয়ে পড়ল। হাতে সময় খুব কম। ওরা ফিরে আসার আগেই ঘুমিয়ে পড়তে হবে।

বিছানা নেই।

বালিশ নেই।

কম্বল নেই।

দিনের আবছা আলো আসছে জানালা দিয়ে।

তা ছাড়া মাথার উপরে মৃত্যু ঝুলছে জেনে ঘুম দেয়া বড় কঠিন কাজ কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

তবু তোমাকে পারতেই হবে, মুসা, নিজেকে মনে মনে শোনল ও। তোমার খালাতো-মামাতো ভাই-বোনরা তোমাকে সবসময় বলত, তুমি ঘুমে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, টর্নেডোর মধ্যে খোলা মাঠে ঘুমাতেও অসুবিধে হবে না। তোমার। কাজেই তোমার পারা উচিত, মুসা, তোমাকে পারতেই হবে।

মা-বাবার কথা মনে পড়ল। মনে হলো দীর্ঘ কয়েক যুগ ওঁদের দেখে না ও। ফারিহা, তানজিয়া আপু, শাওনি ভাই

ওদেরকেও দেখে না কত যুগ।

আবার ওদের সবাইকে ফিরে পেতে চায় মুসা। ফিরে পেতে চায় প্রিয়। বন্ধু কিশোর-রবিন-রেমন-জিনা-শ্যারনকে।

ভাবতে ভাবতে চোখ বুজল মুসা। ছোট বেলায় মা সুর করে ছড়া কেটে ঘুম পাড়াতেন। তার একটা ছিল:

ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি
মোদের বাড়ি এসো,
খাট নেই পালঙ্ক নেই
খোকার চোখে বোসা…

ছড়াটা মনে করার চেষ্টা করল মুসা। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। নিজেই নিজেকে সেটা সুর করে শোনাতে লাগল ও।

তারপর… তারপর একসময় তলিয়ে গেল ঘুমের অতলে।

২৩

চোখ মেলে তাকাল মুসা। চোখ ডলল। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম? নিজেকে প্রশ্ন করল।

হ্যাঁ, তা-ই তো!

এখন কোথায় ও?

উপরে তাকাল, সিলিঙ চোখে পড়ল।

চারদিকে তাকাল। দেয়াল।

একটা দরজা।

অনেক উপরে একটা জানালা-জেলখানার মত। লোহার গরাদ রয়েছে। ওটায়।

না! ফিসফিস করে বলল ও। আমি এখনও সেই বাড়িতেই?

হ্যাঁ, তা-ই। এখনও বনের মধ্যে সেই বাড়িতে বন্দি ও।

বন্দি।

ভেস্তে গেছে ওর পরিকল্পনা।

এখন কী করবে?

নাআআআআ!

রাগে, হতাশায়, মত্যভয়ে মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো মুসার। কাজ হয়নি ওর পরিকল্পনায়। আর কোনও বুদ্ধি মাথায় আসছে না। মাথার মধ্যে মগজ বিস্ফোরিত হতে পারে যে-কোন মুহূর্তে। এখন কী করবে ও? জানে না। কিছু খেলছে না মাথায়। উদ্ধার পাওয়ার যে ক্ষীণ আশার আলো দেখা দিয়েছিল, তা বিলীন হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে। বাঁচার আর কোনও উপায় নেই!

পাশের ঘর থেকে ওদের গলা ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই ওকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর প্রস্তুতি চলছে। নাকি প্রস্তুতি শেষ? এখনই আসবে ওরা?

একটু পরেই ওকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হবে? বাবা-মা-ভাই বোনের সঙ্গে, বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হবে না!

রিয়্যালিটি পুলিশ এত নির্দয় কেন? কেন এত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ওরা? কাজটা কি ঠিক হলো?

কোনও অন্যায় তো করিনি আমি, ভারত মুসা। অন্তত নিজের ইচ্ছেয় নয়। যা করেছে, না জেনে, ভুলে করে বসেছে। ওরা কি এটাকে ক্ষমা করে দিতে পারত না?

যত ভাবছে, তত রাগ বাড়ছে ওর। সহ্য করতে না পেরে আবার চেঁচিয়ে উঠল, নাআআআআআ!

কিন্তু, এবার কণ্ঠস্বর কেমন যেন অন্যরকম শোনাল।

নাআআ!

না বলছে মুসা। কিন্তু শুনতে পেয়েছে অন্যকিছু।

নিশ্চিত হতে আবারও বলল, না!

আওয়াজ হলো, ইইই!

গলাটা ওরই। কিন্তু আওয়াজটা মানুষের গলার মত শোনাল না।

শোনাল অন্য কিছুর মত।

সে আবার কী! তাজ্জব হয়ে ভাবল মুসা।

মুখ নিচু করে নিজের দিকে নজর দিল মুসা।

এতক্ষণ মনে ছিল না। উত্তেজনায় এতই বেহাল দশা, ঘুম থেকে জাগার পর ওর যে বদলে যাবার কথা, তা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল।

হ্যাঁ, বদলে গেছে মুসা।

ইয়াল্লা! একী!

এতটুকুন হয়ে গেছে ও। এখন খুব বেশি হলে আট ইঞ্চি হবে ও লম্বায়।

ছোট, সরু দুই থাবায় পরিণত হয়েছে হাতদুটো। গায়ে ধূসর পশম। পিছনে লম্বা, মোটা লেজও আছে।

কাঠবিড়ালী! আঁতকে উঠল মুসা।

ও এখন একটা কাঠবিড়ালী!

চট করে জানালাটার দিকে নজর গেল ওর। এখন গরাদের সরু ফাঁক দিয়ে ওর পক্ষে বের হওয়া কোনও সমস্যাই নয়। একেবারে জলবৎ তরলং।

আর একমূহুর্ত সময়ও নষ্ট করল না মুসা। চোখের পলকে দেয়াল বেয়ে অনায়াসে উঠে পড়ল। বেরিয়ে এল ফাঁক গলে।

মুক্তির আনন্দে ধেই-ধেই করে খানিক নেচে নিল।

ইয়াহহু!

তারপর যত দ্রুত সম্ভব বন-বাদাড় ভেঙে বাড়ির খোঁজে ছুটল। কিছুক্ষণ পর শহরে ফেরার রাস্তা পেয়ে গেল ও, ওটা ধরে ছুটতে শুরু করল তুফান বেগে।

শহরে পৌঁছে দেখা গেল সব আগের মতই স্বাভাবিক। দানবকে নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছিল, তার চিহ্নই নেই।

আসলে আগের রিয়্যালিটিতে নেই ও, বুঝতে পারল মুসা। আরেক বাস্তবে আছে এখন। ও এখন কাঠবিড়ালী।

বাতাসে নাক টানল মুসা। নানান রকমের সুগন্ধে ম ম করছে চারপাশ। নিজের ঘ্রাণশক্তির প্রশংসা না করে পারল না। এখন গন্ধ শুঁকে শুঁকে সহজেই নিজের বাসা খুঁজে বের করতে পারবে।

লাফাতে লাফাতে ছুটল মুসা। কিন্তু রাস্তা পেরোতে গিয়ে ঝামেলা ঘটিয়ে বসল। উত্তেজনার চোটে মার সতর্কবাণীর কথা ভুলেই বসেছিল।

উনি সবসময় বলতেন দুদিকে ভাল করে দেখে নিয়ে তবে রাস্তা পার হবে।

ওর অসতর্কতার সুযোগে বাঁ দিক থেকে ছুটে এল যন্ত্র-দানব একটা ট্রাক ড্রাইভার ওকে দেখতেই পায়নি। মানুষই চোখে পড়ে না ওদের, ও তো ছোট্ট একটা কাঠবিড়ালী!

ভাবার সময় পেল না মুসা। আচমকা চোখের সামনে পাহাড় সমান উঁচু চাকা দেখে আঁতকে ওঠারও সময় পেল না। কেবল প্রাণের সহজাত তাগিদে সরে যাওয়ার দুর্বল চেষ্টা করল একবার।

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

সভয়ে চোখ বুজল মুসা।

ভাবল, এভাবেই মরণ লেখা ছিল কপালে?

গাড়ির চাকার নীচে ভর্তা হয়ে মরব?

২৪

রাস্তার সঙ্গে চাকার তীব্র ঘর্ষণের আওয়াজ উঠল।

দাতমুখ খিঁচিয়ে কড়া ব্রেক কষেছে ড্রাইভার। প্রায় জায়গায় দাঁড় করিয়েছে গাড়ি। তারপর আচমকা নীরব হয়ে গেল চারদিক।

ধীরে ধীরে, ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল মুসা। একটা চাকা ওর ছোট্ট মাথাটার মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে থেমেছে। খুব সামান্যর জন্য এ যাত্রা প্রাণটা রক্ষা পেয়েছে ওর।

গাড়িটার নীচ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল মুসা, রাস্তা পেরোল। আবার চলতে শুরু করল ট্রাক।

রাস্তার কিনারা দিয়ে বাড়ির পথ ধরল মুসা। একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে তেড়ে এল ওর দিকে। উপায় নেই দেখে চট করে পাশের একটা গাছে উঠে পড়ল ও। নইলে বাঁচতে পারত না ওটার হাত থেকে

গাছটার নীচে সামনের দুপা তুলে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দাঁত খিঁচাল কুকুরটা। গাছের গা আঁচড়াল তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে। ভয় দেখাল মুসাকে।

কিন্তু ওর তরফ থেকে কোনওরকম উৎসাহ না পেয়ে এক সময় আগ্রহে ভাটা পড়ল ওটার। চলে গেল।

গাছ থেকে নেমে আবার চলতে শুরু করল মুসা।

গাড়ি, মোটরসাইকেল, সাইকেল, মানুষ, কুকুর, বেড়াল ইত্যাদির বাধা পেরিয়ে অবশেষে ওদের বাসার সামনে এসে দাঁড়াল।

চিরচেনা বাসা চোখে পড়তে মন আনন্দে নেচে উঠল। ওটা দেখে জীবনে কখনও এত খুশি হয়নি ও।

সানজানা বলেছে, ওর ছোট্ট ঘরে যেখানে ঘুমাত, সেখানে একবার ঘুমাতে পারলেই আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে ও। রিয়্যালিটির গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

কীভাবে কাজটা সম্ভব, সেই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ওর। একটা কাঠবিড়ালীর পক্ষে কাজটা যে কঠিন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

সমস্যা আরও আছে।

বাসায় এখন ওর আসল বাবা-মা থাকেন কি না জানা নেই। ও এখন যে বাস্তবে আছে, সেখানে এই বাসার অধিবাসী কারা কে জানে!

মুসা মনেপ্রাণে আশা করছে ওর পরিবারকেই যেন পাওয়া যায় বাসায়। তা হলে কাজটা ওর জন্য হয়তো সহজ হবে কিছুটা।

নইলে…

ওর ঘরের জানালার গা ঘেঁষে বেড়ে ওঠা মস্ত ওক গাছটায় উঠে পড়ল মুসা। যে-ডালটা একেবারে জানালার কাছ দিয়ে গেছে, সাবধানে ওটার মাথায় চলে এল।

জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে নিজের ঘরে উঁকি দিল।

নিজের সেই অপছন্দের ঘরটাকে আজ এত ভাল লাগল, যা বলে বোঝানো সম্ভব নয় ওর।

ওই তো ওর বিছানা!

সেই চেয়ার!

সেই টেবিল!

সেই বইপত্র!

সব জায়গামতই আছে।

কিন্তু ভিতরে ঢোকার উপায় নেই। জানালা বন্ধ। ছোট্ট থাবা দিয়ে কাঁচের পাল্লা খোলার চেষ্টা করল মুসা। কাজ হলো না। খুলল না পাল্লা।

গাছের এ-ডাল ও-ডাল করে অন্য জানালাগুলোও পরখ করে দেখল মুসা। সবগুলো বন্ধ।

নাহ, জানালা দিয়ে ঢোকা সম্ভব নয়। দরজা দিয়ে ঢোকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কাজটায় ঝুঁকি আছে। কেউ দেখে ফেললে নিশ্চয়ই দূর! দূর! করে তাড়িয়ে দেবে ওকে। তবু চেষ্টা করতে হবে। তীরে এসে তরী ডুবলে আফসোসের সীমা থাকবে না।

বাসায় কেউ আছে? সামনের জানালার ওপাশে ড্রইং রুম। ভিতরটা ভাল করে দেখার চেষ্টা করল মুসা। পরক্ষণে আনন্দে মন নেচে উঠল।

ওই তো মা! ওর আসল মা! ফারিহা, তানজিয়া আপু, শাওনি ভাই!

সবাই আছে দেখছি! ফিরে এসেছে! আপনজনদের পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ল মুসা। উত্তেজিত হয়ে উঠল। এ ডাল থেকে ও ডাল করল কিছুক্ষণ।

এমন সময় হঠাৎ পুশির মিয়াও ডাক কানে আসতে জমে গেল।

ওহ, হ্যাঁ। ওই ব্যাটার কথা দিব্যি ভুলে বসেছিল মুসা। ওটাকে দেখে মনের খুশি খুশি ভাবটা মারাত্মক এক হোঁচট খেল।

ইঁদুর জাতীয় যে-কোনও প্রাণীকে তাড়া করা বেড়ালদের প্রিয় খেলা

জানা আছে মুসার। এরইমধ্যে জানালা দিয়ে ওকে দেখতে পেয়ে খেপে উঠেছে বাঘের মাসি। কী যন্ত্রণা!

ফারিহা হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল। মুসার দিকে আঙুল তুলে কী যেন বলল মাকে।

হা! ভাবল মুসা। ফারিহা, এসো। এসে আমাকে নিয়ে যাও। জানালা খোলো, প্লিজ! আমাকে ভেতরে নিয়ে যাও। আমি কাঠবিড়ালী নই, তোমার ভাই, মুসা।

উঠে এসে জানালাটা খুলল ফারিহা। ওমা! ওকে বলতে শোনা গেল। কী সুন্দর কাঠবিড়ালী! জলদি দেখে যাও।

ইতস্তত করতে লাগল মুসা। একলাফে ভিতরে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পুশির কথা মনে হতে দমে গেল।

সাহস হচ্ছে না।

অ্যাই শাওনি ভাই! ফারিহা ডেকে উঠল। পুশিকে সরাও তো! দেখছ না, ওকে ভয় পাচ্ছে কাঠবিড়ালীটা?

সামান্য একটা কাঠবিড়ালীর উপর তোর কত টান, ফারিহা! মনে মনে ভাবল মুসা। নাহ, ওসব সেন্টিমেন্টকে এখন পাত্তা দেয়া ঠিক হবে না। চিন্তাটাকে মাথা থেকে দূর করে দিল ও।

দেখল, শাওনি ভাই পুশিকে কোলে নিয়ে ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফারিহার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তানজিয়া।

অ্যাই, কাঠবিড়ালী! আহ্লাদী ভঙ্গিতে ডাকল তানজিয়া।

আয়, আর কোনও ভয় নেই।

লাফিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল মুসা।

দেখলে, ফুপু! খুশিতে চিচিক্ করে উঠল তানজিয়ার দুচোখ।

ডাকতেই কী সুন্দর ভেতরে চলে এল! আমাকে পছন্দ হয়েছে মনে হয়। ভাবছি এটাকে পুষব, আমি।

উঁহু! বাধা দিলেন মা। সেটি হবে না। কাঠবিড়ালী রোগজীবাণু ছড়ায়।

শুনেও শুনল না মুসা। কথাটা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ মনে করে তা-ই করল ও। কথাটা যে কোনও ছেলের জন্য অপমানজনক, কিন্তু মা তো জেনেশুনে বলেননি। কাজেই ভুলে যাওয়াই উচিত।

ভিতরে ছুটল মুসা। মাথায় একটাই চিন্তা–নিজের ঘরে গিয়ে লুকিয়ে থাকা। এবং ঘুমিয়ে পড়া। তা হলেই..

আরে আরে! ধরো ধরো! চেঁচিয়ে উঠলেন মা। ঢুকে পড়ল তো ভেতরে!

ওকে ধরতে ছুটে এল তানজিয়া ও ফারিহা।

পিছন থেকে মার চেঁচামেচি শুনতে পেল মুসা। তানজিয়া, ফারিহা, শীগগির তাড়িয়ে দাও ওটাকে।

কিন্তু কী করে তাড়াব!

আগে ওটাকে ধরতে হবে তো।

সামনে কিচেন পেয়ে সুড়ৎ করে ঢুকে পড়ল মুসা। তানজিয়া ও ফারিহা পিছন পিছন এসে আস্তে করে দরজা বন্ধ করে দিল। আটকা পড়ে গেল মুসা। ফাঁদে পড়ে গেছে।

আয়, ডাকল তানজিয়া। ভয় নেই, আমার কাছে আয়।

পাগলের মত লেজ দোলাতে লাগল মুসা। পালানোর পথ খুঁজছে। ওর মিষ্টি কথায় মন ভুলছে না।

ইঞ্চি ইঞ্চি করে ওর দিকে এগোতে থাকল তানজিয়া। ও যাতে ভয় না পায়, সেদিকে খেয়াল রাখছে।

চট করে টেবিলের নীচে ঢুকে পড়ল মুসা। ঝাঁপ দিয়েও ধরতে ব্যর্থ হলো তানজিয়া। শিকার হাতের তলা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আরও কিছুক্ষণ ধরে ছুটোছুটি চলল দুই বোনের। এ-মাথা থেকে ও মাথা, চেয়ারের তলা থেকে টেবিলের তলা–এই চলল।

এক সময় মুসা ক্লান্ত হয়ে পড়ল।

পিছাতে পিছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল।

বাঁয়ে তাকাল, ওদিকে সাইডবোর্ড।

ডানে, ফ্রিজ।

পিছনে দেয়াল।

সামনে তানজিয়া আর ফারিহা।

ধরা পড়ে গেল মুসা। সৎ করে ছুটে এল একটা হাত। মুঠো করে ধরল। ওর ঘাড়। আরেকটা হাত ছুটে এসে ওর পিঠ জাপটে ধরল।

ধরেছি! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল তানজিয়া, যেন বিশ্ব জয় করেছে। ফুপু, ধরেছি ওটাকে!

দরজা খুলে শাওনি ঢুকল আগে, পিছনে মা। জলদি ওটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে এসো, যাও! বললেন তিনি।

কেন, ফুপু! আবেদন ফুটল তানজিয়ার কণ্ঠে। কাঠবিড়ালীটা কী। সুন্দর!

রাগে মুসার ছোট্ট দেহ কেঁপে গেল। তানজিয়া ওকে পুষতে চাইছে! ওর পোষা জন্তু হয়ে কিছুতেই বাঁচতে চায় না মুসা।

কিন্তু এ ছাড়া উপায় কী? নইলে তো নিজের ঘরে ঢোকার সুযোগ পাবে না। ঘুমানো তো অনেক পরের কথা।

না! কড়া গলায় বললেন মা। ওসব কিছুতেই ঘরে রাখা যাবে না। ফেলে দিয়ে এসো, যাও!

আচ্ছা, হতাশা ফুটল তানজিয়ার কণ্ঠে। যাচ্ছি।

কিচেন থেকে বেরিয়ে এগোনোর ফাঁকে বিড়বিড় করে বলল ফারিহা, খালার আদেশ।

একটা কাঠবিড়ালী পুষলে কী এমন পৃথিবী উল্টে যেত? বলল তানজিয়া, কেউ কী পোষে না?

পোষে, হতাশ হয়ে ভাবল মুসা। অনেকেই পোষে।

সামনের দরজা খুলল তানজিয়া। ওর গায়ে আদরের পরশ বুলিয়ে বলল, বিদায়, বন্ধু। তোকে পোষার খুব ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু ফুপুর জন্যে পারলাম না। কিছু মনে করিস না।

বলল বটে, কিন্তু ছাড়ল না মুসাকে। কী মনে করে দরজা বন্ধ করে দিল আবার। শক্ত করে ধরে আছে মুসাকে।

পা টিপে টিপে নিজের রুমে চলে এল তানজিয়া। পিছনে ফারিহাও।

ঘাবড়াস না, ছোট্ট বন্ধু, ফিসফিস করে বলল। আপাতত রেখে দিচ্ছি। তোকে। কিন্তু বেশিক্ষণ রাখা সম্ভব হবে না বোধহয়।

বিছানার তলা থেকে একটা খাঁচা বের করল ও। দরজা খুলে ওকে ভিতরে ঠেলে দিল।

না! প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল মুসা। আমাকে খাঁচায় পুরো না, প্লিজ! ছেড়ে দাও!

কিন্তু কাঠবিড়ালীর গলায় তো আর কথা ফোটে না! তাই কিছুই বুঝল না তানজিয়া-ফারিহা। আবার বন্দি হলো মুসা।

ফাটা কপাল আর কাকে বলে!

২৫

এখন কী হবে? ভয়ে দিশেহারা হয়ে ভাবল মুসা। খাঁচায় বন্দি ও। কথা বলার ক্ষমতাও নেই। তার মানে…

আরেকটা ভীতিকর চিন্তা পাগল করে তুলল ওকে। এই পিচ্চি খাঁচার মধ্যে যদি ও ঘুমিয়ে পড়ে?

কী ঘটবে?

পরেরবার কী হয়ে জাগবে ও?

সানজানা মিথ্যে বলেনি

ওর ঘরে গিয়ে ঘুমানোর আশা এই জনমে বোধহয় পূরণ হবে না!

চোখের সামনে বোনের বিরাট মুখটা দেখতে পেল মুসা। খিদে পেয়েছে? বলল তানজিয়া। দাঁড়া, খাবার নিয়ে আসছি।

তানজিয়া আর ফারিহা চলে গেল।

দুজন ফিরল কিছুক্ষণ পর।

এই যে, নিয়ে এসেছি, বলল তানজিয়া।

ছোট একটা বাটিতে করে কিছু ছোলা নিয়ে এসেছে ওরা। দরজা খুলে। বাটিটা ভিতরে ঠেলে দিল।

ছোলা মোটেই পছন্দ নয় মুসার। কিন্তু খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। তা-ই বাধ্য হয়ে খেতে হলো।

এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। এক মুহূর্ত পর শাওনি ভাইয়ের গলা শোনা গেল, তানজিয়া, তোমার টেলিফোন।

ফারিহা, এসো তো একটু, ডাক দিলেন মা।

আসছি, উঠে দাঁড়াল তানজিয়া ও ফারিহা। দৌড়ে বেরিয়ে গেল ওরা।

হতাশ ভঙ্গিতে বসে কুটকুট করে ছোলা খাচ্ছিল মুসা। তানজিয়া যে খাঁচার দরজা বন্ধ না করেই চলে গেছে, বুঝতে বেশ সময় লাগল।

ইয়াহ্ হু! ব্যাপারটা চোখে পড়া মাত্র কাঠবিড়ালীর ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বোনের বোকামির প্রমাণ পেয়ে আনন্দ আর ধরে না।

সামনের থাবা দিয়ে ধাক্কা মেরে দরজা খুলে ফেলল ও। খাঁচা থেকে বেরিয়ে সতর্ক পায়ে দরজার দিকে এগোল। কান খাড়া।

উঁকি দিয়ে দেখল করিডর খালি। কারও পায়ের শব্দ পাওয়া গেল না। এই তো সুযোগ!

দ্রুত ওর ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।

দরজা বন্ধ। কাঠবিড়ালীর ছোট্ট থাবা দিয়ে মরিয়া হয়ে ওটা ঠেলল কিছুক্ষণ, লাভ হলো না। খুলল না দরজা।

আর কী করার আছে ওর?

কপাল খারাপ।

পায়ের শব্দ কানে আসতে সচকিত হলো মুসা। তানজিয়া ফিরে আসছে।

মুসা জানে তানজিয়া ওকে দেখে ফেলার আগেই পালাতে হবে এখান থেকে। নইলে আবার খাঁচায় বন্দি হতে হবে।

এক ছুটে ড্রইং রুমে চলে এল ও। জানালা, কি খোলা? হ্যাঁ, ভোলাই

দৌড়ে সোফার পিছনে, চেয়ারের তলায় চলে এল মুসা। দেয়াল বেয়ে উঠে জানালা দিয়ে বেরিয়ে এল সুড়ৎ করে। লাফিয়ে পড়ল উঠনে। পরক্ষণে পাশের একটা গাছে উঠে পড়ল দ্রুত। একটা ডালে বসে নিজেকে সুস্থির। হওয়ার সময় দিল।

নিজের ঘরে ঢুকতে পারেনি মুসা। ব্যর্থ হয়েছে। এখন ওর একটা কাজই কেবল করার আছে।

ঘুমাতে হবে। বলা যায় না, হয়তো আবার মানুষ হয়ে জেগে উঠতে পারে। সেটাই একমাত্র ওর ভরসা। সে ক্ষেত্রে বাঁচার একটা উপায় হবে হয়তো। নইলে….

যে করে হোক ওর ঘরে ঢুকতেই হবে। ঘুমাতে হবে। নইলে…

আর ভাবতে পারছে না।

রিয়্যালিটি পুলিশ ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এবং ওরা যে মুসাকে খুঁজে বের। করবেই, তাতে কোনও ভুল নেই। ওদের চোখ ফাঁকি দেয়া যায় না।

আর একবার ধরা পড়লে ওকে বাঁচাতে পারবে না কেউ।

২৬

পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে জেগে উঠল মুসা। দেখল গাছের নীচে চিত হয়ে পড়ে আছে। ব্যাপার বুঝতে কয়েক সেকেণ্ড লাগল। চিন্তা করতে করতে গাছের উপর ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভাগ্যিস নিচু ডালে বসেছিল। নইলে হাড়গোড় একটাও আস্ত থাকত না। পাউডার হয়ে যেত।

ঘুম তো ভাঙল, কিন্তু এখন ও কে? কী?

পরমুহূর্তে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। আবার তেরো বছরের কিশোরে পরিণত হয়েছে ও। তবে নিজেকে ফিরে পায়নি, অর্থাৎ তেরো বছরের এক কিশোর ও হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মুসা হতে পারেনি।

নিজেকে দেখে হাসি পেল মুসার। কুমড়োপটাশ মার্কা স্থূল দেহ। এই জন্যই গাছের ডাল ওর ভার সইতে পারেনি। দেহের এখানে সেখানে চর্বি থলথল করছে।

কিন্তু এটা কোনও সমস্যা নয়। আবার ও মানুষ হতে পেরেছে, সেটাই। বড়। এখন ও কথা অন্তত বলতে পারবে।

এবং এখন নিজের ঘরে ঢোকার একটা সুযোগ পেয়েও যেতে পারে ও।

বুক চিতিয়ে সামনের দরজার দিকে এগোল মুসা। দরজা বন্ধ। কলিং বেলে চাপ দিল। একটু একটু করে উত্তেজিত হয়ে উঠছে।

কে দরজা খুলবে বুঝতে পারছে না মুসা। মনে মনে আশা করছে সেই মানুষটি ওর পরিবারের কেউ যেন হয়।

খুলে গেল দরজা।

মা! খুশিতে আত্মহারা হয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। মা! আমি ফিরে এসেছি! আমি মুসা!

চোখ কুঁচকে উঠল মার।

কে? কণ্ঠে সন্দেহ ফুটল। মুসা! মুসা কে? এই নামের কাউকে চিনি বলে তো মনে পড়ছে না।

সে কী, মা! আকাশ থেকে আছড়ে পড়ল ও। অবশ্যই চেনো! আমি তোমার ছেলে, মুসা!

অনিশ্চিত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।

ফারিহা, তানজিয়া ও শাওনি এসে দাঁড়াল মার পিছনে। ছেলেটা কে, ফুপু? জিজ্ঞেস করল তানজিয়া।

ফারিহা! চেঁচিয়ে উঠল ও। শাওনি ভাই! আমি মুসা, আমি ফিরে এসেছি!

এ কে, শাওনি? জানতে চাইল তানজিয়া।

চিনি না তো! কপাল কুঁচকে দেখছে ওকে শাওনি।

হায় খোদা! ভাবল মুসা। এসব কী হচ্ছে! মুখ ঘুরিয়ে আর বসে থেকো না তুমি। আমার দিকে তাকাও। বিপদ থেকে উদ্ধারের এত কাছাকাছি এসেও কী…

আবেদন ফুটল ওর কণ্ঠে। প্লিজ, মা। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দাও, আমাকে ঘুমাতে হবে। আমার ঘরে ঘুমাতে দাও। এ আমার জীবন-মরণ সমস্যা।

কিন্তু আমরা তো চিনতে পারছি না, তোমাকে, বললেন মা। মুসা নামের কাউকে চিনি না আমরা। মনে হয় ভুল বাসায় এসে পড়েছ তুমি।

পাগল না তো? শাওনি বলে উঠল।

অথবা ধান্দাবাজ, বলল তানজিয়া।

না, আমি ওসব কিছু নই,ব্যস্ত হয়ে বলতে চাইল ও। মা…

মুখের উপর ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন মা।

হতাশায় অন্তর ছেয়ে গেল মুসার। ঘুরে রাস্তার দিকে তাকাল।

এখন? কী করবে ও?

সামনের দৃশ্য দেখে আত্মা উড়ে গেল মুসার।

তীর বেগে ওর দিকে ছুটে আসছে সেই তিনজন।

সানজানা, মিজু আর ব্যাবলা।

রিয়্যালিটি পুলিশ!

আবার ধরা পড়ে গেছে মুসা!

২৭

ওই তো! আঙুল তুলে চেঁচিয়ে বলল সানজানা। ওই তো! জলদি চলো! তিনজন সোজা দৌড়ে এল ওর দিকে।

ধরো, ধরো!

ঘুরেই দৌড় দিল মুসা। কিন্তু কাজটা যে এ মুহূর্তে ওর জন্য কত কঠিন, টের পেতে দেরি হলো না। মোটাদের জন্য দৌড়ানো সত্যিই কঠিন।

চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল মুসার। পাশের বাড়ি ঘুরে ছুটে চলে এল ওদের বাড়ির পিছন দিকে। এদিকটা ঝোপ জঙ্গলে ভর্তি। ছোট একটা ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে পড়ল।

কয়েক মিনিট পর পায়ের শব্দ উঠল। হাঁপাচ্ছে ওরা তিনজনই।

কোথায় গেল? সানজানার গলা শোনা গেল।

ওদিকে গেছে মনে হয়, সামনে আঙুল তুলে দেখাল ব্যাবলা। জলদি চলো।

চলে গেল ওরা।

এতক্ষণ দম নেয়ার কথা মনে ছিল না মুসার, নড়াচড়া দূরে থাক্। অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা দম ছাড়ল এবার আস্তে আস্তে।

এ যাত্রা বাঁচা গেছে। কিন্তু জানা আছে ওদের হাতে ধরা পড়তেই হবে। ওকে।

যে কাজ করলে এদের হাত থেকে বাঁচা যায়, তা কীভাবে করা সম্ভব ভেবে অস্থির হয়ে উঠল মুসা। মা পর্যন্ত ওকে চিনতে পারলেন না। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কী হতে পারে? কিছুতেই ওকে বাসায় ঢুকতে দেবেন না মা। এবং ভিতরে যেতে না পারা পর্যন্ত ওর কোনও আশাও নেই।

এখন একটাই পথ খোলা আছে ওর সামনে, চুপি চুপি ঢোকা। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে ওকে। সবার ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষায় থাকতে হবে। তারপর চোরের মত…

অপেক্ষার পালা শুরু হলো। ঝোপের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকল ও। বসে থাকতে থাকতে ব্যথা হয়ে গেল হাত-পা। বাধ্য হয়ে ওখানেই ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। রিয়্যালিটি পুলিশের ভয়ে ঝোপের আড়াল থেকে বেরোতে পারছে না। ওদের চোখে পড়া চলবে না।

ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। জেগে থাকতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবু ঘুমানো চলবে না। নতুন আর কোনও সমস্যায় পড়তে রাজি নয় মুসা।

ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলেছে সময়। অবশেষে এক যুগ পর রাত নামল। একটু একটু করে গম্ভীর হলো, নীরব হয়ে এল চারদিক।

সময় হয়েছে মনে হতে উঠে দাঁড়াল মুসা। আড়মোড়া ভেঙে জড়তা কাটাল।

বাসার দিকে তাকাল। মা-বাবা জেগে আছেন এখনও। বাতি জ্বলছে। ফারিহা, তানজিয়া আর শাওনি ভাই মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের ঘরে বাতি নেভানো।

মা-বাবার ঘরের বাতিও নিভে গেল একসময়। আঁধার হয়ে গেল পুরো বাড়ি। তবু আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল মুসা। সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর ধীর পায়ে বাসার সামনের দিকে চলে এল। ওদের ড্রইং রুমের একটা জানালায় গরাদ নেই। ওটার সামনে এসে দাঁড়াল।

যা ভেবেছিল তা-ই।

বন্ধ।

আবার চলে এল পিছন দিকে। কিচেনের দরজা খুলে ফেলল কায়দা। করে, নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল।

যাক্, হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। সবুরে মেওয়া ফলেছে তা হলে। অবশেষে বাঁচার উপায় জুটল।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সমস্ত দরজা-জানালা ঠিকমত লাগানো। আছে কি না পরখ করে দেখেন বাবা। আজও নিশ্চয়ই করেছেন। কিন্তু তাতে কী? এই দরজাটা যে বিশেষ কায়দায় খোলা যায়, তা তো উনি জানেন না।

একটু একটু করে মুসার নিভু নিভু আশার আলোটা উজ্জ্বল হচ্ছে আবার। এখন সামনে আর একটাই বাধা ওর ঘরের দরজা। ওটা খোলা থাকলে হয়।

বেড়াল-পায়ে এগোল ও করিডর ধরে। নিজের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ, খোলা! জীবনে কখনও এত খুশি হয়েছে কি না মনে করতে পারল না মুসা। এবার ভিতরে ঢুকে একটা ঘুম দেবে ও, ব্যস, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার আগের মুসা হয়ে যাবে ও।

খুশিতে ধেই-ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে। চেঁচিয়ে ঘুমিয়ে পড়া শহরকে জাগাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেসব কিছুই করল না ও। টুক করে ঢুকে পড়ল ঘরে। ওই তো ওর বিছানা। শূন্য! শুয়ে পড়লেই হলো।

এগিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে বিছানা ঝাড়ল ও। তারপর জুতো খুলে উঠে। পড়ল। নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

আবার নিজের বিছানায় ঘুমাতে যাচ্ছে মুসা, সেই আনন্দে দিশেহারা। গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে।

এখন যদি কেউ দেখে ফেলে ওকে, কী ভাববে? চোর? নিশ্চয়ই তা-ই। মা-ই যখন চিনতে পারলেন না…

সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে দূর করে সকালের কথা ভাবল মুসা। কী ঘটবে কাল? নিজেকে সত্যি কি ফিরে পাবে ও? সানজানার কথা সত্যি হলে তা-ই তো হওয়া উচিত।

ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এল মুসার। ভারী হয়ে উঠল শ্বাস-প্রশ্বাস।

মেয়েটা সত্যি বলেছে কি না আর কয়েক ঘণ্টা পরই প্রমাণ হয়ে যাবে।

একসময় ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল মুসা।

২৮

নাকেমুখে গরম লেগে উঠতে ঘুম ভাঙল মুসার। সূর্যের আলো।

চোখ মেলে তাকাল। কোথায় আছে ও এখন? দ্রুত চারদিকে নজর বোলাল। ছোট্ট একটা ঘরের মধ্যে আছে ও। এই বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘর। ওরই ঘর!

হার্টবিট বেড়ে গেল মুসার। সানজানা কি সত্যি বলেছিল? স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছে ও?

দেরি সহ্য হলো না। তড়াক করে উঠে পড়ল মুসা। দরজার সাথে লাগানো ছোট্ট আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল।

হ্যা!!!

ও আবারও মূসা হয়ে গেছে। নিজেকে ফিরে পেয়েছে ও!

ইয়াহ্হু! আনন্দে অস্থির হয়ে দুহাত শূন্যে ছুঁড়ল মুসা। এমন সময় দরজাটা একটু ফাঁক হলো। নাক ঢুকিয়ে দিল পুশি। ভিতরে ঢুকে ডাক ছাড়তে শুরু করল। অন্য সময় হলে বিরক্ত হতো মুসা, কিন্তু আজ হলো না।

বরং ওটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। ছাড়া পাওয়ার জন্যে উল্টে পুশিই মরিয়া হয়ে লাফালাফি শুরু করে দিল। মুসাকে একদম পছন্দ করে না ওটা।

মুসা! কিচেন থেকে মা ডেকে উঠলেন।

ওর আসল মা!

মুসা! পুশিকে ব্যথা দিচ্ছ কেন? ছেড়ে দাও।

ব্যথা দিচ্ছি না; মা! জবাব দিল ও। আদর করছি।

পুশিকে ছেড়ে কিচেনের দিকে ছুটল ও। ডাইনিং টেবিলে সবাইকে দেখে খুশিতে ঝম করে উঠল ওর চেহারা। বাবা, মা, ফারিহা, তানজিয়া, শাওনি ভাই–সবাই আছে।

সবাইকে ফিরে পেয়ে খুশিতে দম আটকে এল ওর। ধেই-ধেই করে নাচার ইচ্ছেটা দমন করল বহু কষ্টে।

বোনের গলা জড়িয়ে ধরল আহ্লাদী ভঙ্গিতে। বলল, ফারিহা! আমার ছোট্ট ফারিহা!

অ্যাই! বিস্মিত কণ্ঠে বলল ফারিহা। ছাড়ো, ছাড়ো তো আমাকে!

বোনকে ছেড়ে ছুটে গেল ও শাওনির দিকে। একইভঙ্গিতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, শাওনি ভাই, তুমি ভাল আছ তো?

কী হয়েছে তোমার, মুসা? কপাল কুঁচকে উঠল তানজিয়ার। আমি জানি কাল রাতে ভূতেরা তোমাকে কিডন্যাপ করেছিল। ওরা তোমার ব্রেন ওয়াশ করে দিয়েছে।

খেয়াল করল না মুসা। এগিয়ে এসে বোনের বেণী ধরে টান দিল।

উহ! চেঁচিয়ে উঠল তানজিয়া। ব্যথা পাচ্ছি তো!

এবার, মার দিকে এগোল মুসা। জড়িয়ে ধরে তার গালের সঙ্গে গাল ঘষতে লাগল।

দুষ্ট ছেলে কোথাকার! হেসে বললেন উনি। আদর করার ভঙ্গিতে চাপড় মারলেন পিঠে। বোসো, নাস্তা খেয়ে নাও।

বাবা বাদ থাকেন কেন?

বাবা, বলে হাত বাড়াল মুসা।

অবাক হলেও আপত্তি করলেন না তিনি। হ্যাণ্ডশেক সেরে বললেন, লক্ষ্মী ছেলের মত জলদি খেয়ে নাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের।

বসে পড়ল মুসা। খাওয়ায় মন দিল। সব আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। ও যে হারিয়ে গিয়েছিল, কেউ খেয়াল করেনি।

আর কখনও ওই গেস্ট রুমে ঘুমাচ্ছি না আমি, মনে মনে শপথ করল ও। কক্ষনো না। নিজের ছোট্ট ঘর নিয়ে আর কোনও অভিযোগ নেই, ক্ষোভও নেই। সারাজীবন ওই ঘরে থাকতেও আর আপত্তি নেই।

.

স্কুল জীবনের সবচেয়ে সুন্দর একটা দিন কেটেছে আজ মসার। প্রতিটি ক্লাসে পড়া পেরেছে। কোন এক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় কঠিন বিষয়গুলোও সহজ মনে হয়েছে আজ। অন্তত কলেজের আনা কারেনিনার চেয়ে অনেক সহজ ছিল।

রবিন আর কিশোরকে সব খুলে বলেছে মুসা। রবিন বিশ্বাস করেনি। কিশোর বিশ্বাস করবে কি করবে না ভাবছে এখনও। যাদের নিজেদের অদ্ভুত

সব অভিজ্ঞতা আছে, সেই তিন গোয়েন্দা সদস্যরা কেন বিশ্বাস করবে না। ভেবে ওদের উপর খেপে আছে মুসা।

টিফিন পিরিয়ডে ফুটবল খেলতে নেমে মুসা দেখল, আজ দারুণ খেলছে ও। গোলও করতে পেরেছে একটা।

ছুটির পর ক্লাস থেকে বেরোতেই থমকে দাঁড়াল মুসা কিছু একটা চোখে পড়তে।

একটা মেয়ে! এদিকেই আসছে। ওরই বয়সী হবে বোধ হয়। মাঝ পিঠ পর্যন্ত ঘন চুল বেণী করে বাঁধা। ধূসর চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা।

কে ও?

সানজানা!

জায়গায় জমে গেল মুসা। হাত-পা হিম হয়ে এল। ভাগবে না দাঁড়িয়ে থাকবে, বুঝে উঠতে পারছে না।

তার মানে রিয়্যালিটি পুলিশ এখনও আমার পেছনে লেগে আছে? ভাবল ও। নিজের চেষ্টায় স্বাভাবিক জগতে ফিরে এসেছে মুসা। ওকে চিরতরে ঘুম পাড়ানোর আর কোনও অধিকার নেই ওদের। তারপরও..

পালাতে হবে, ভাবল মুসা। ঝেড়ে দৌড় দেবে বলে রেডি হলো।

এরমধ্যে একেবারে কাছে চলে এসেছে মেয়েটা। হাসছে ওকে দেখে।

নাহ! সানজানা নয় ও। ওদের ক্লাসেরই মেয়ে, অন্য সেকশনে পড়ে অবশ্য। কী যেন নাম! মনে পড়ছে না।

যাক বাবা! তা-ও ভাল। হাঁপ ছাড়তে ছাড়তে ভাবল ও। বাঁচা গেল! ও যে-ই হোক, সানজানা যে নয়, তাতেই মুসা মহাখুশি।

কিশোর আর রবিন কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়াল করেনি মুসা।

কী হলো, মুসা! ওর কাঁধে হাত রাখল রবিন।

কিশোর ভারিক্কি.ঢঙে পকেট থেকে একটা গাম বের করে মুখে পুরল। অমন হাঁ করে ওই মেয়েটাকে গিলছিলে যে, ব্যাপারটা কী!

হেসে ফেলল মুসা। দুই বন্ধুর কাঁধে হাত রাখল। চলো, যে যার বাসায় যাই।

.

ড্রইং রুমে ঢুকে মাকে দেখতে পেয়ে অবাক হলো মুসা। টিভি দেখছেন একা একা। এসময় তার বাসায় থাকার কথা না। ব্যাপার কী?

মা, তুমি তো বলেছিলে বিকেলে বাজারে যাবে!

হাসলেন উনি। আজ যাব না। বাসায় বিশেষ একটা কাজ আছে।

বিশেষ কাজ!

জানতে ইচ্ছে করছে, তা-ই না? টিভির সুইচ অফ করলেন মা।

হ্যাঁ, তা…

ঘরের চারদিকে নজর বোলাল মুসা। সবকিছু স্বাভাবিকই আছে মনে হচ্ছে। ওদেরই ড্রইং রুম এটা।

বিশেষ কাজটা কী, মা?

আবার হাসলেন উনি। উত্তেজিত মনে হচ্ছে।

ভুলে গেলে? আর তিনদিন পর না তোমার জন্মদিন!

আসলেই ভুলে গিয়েছিল মুসা। এতবড় বিপদে পড়লে মানুষ বাবার নাম। পর্যন্ত ভুলে যায়, জন্মদিন তো কোন ছার।

তোমার জন্যে বিশেষ একটা সারপ্রাইজ আছে, মুসা, রহস্য ঝরল মার কণ্ঠে। এসো আমার সাথে।

মার পিছন পিছন ওর ঘরের বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল মুসা। কীসের সারপ্রাইজ? ভাবছে মনে মনে।

সারপ্রাইজটা কি আমার রুমে? জিজ্ঞেস করল ও।

জবাব দিলেন না মা। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে বললেন, দেখো।

ভিতরে উঁকি দিল মুসা। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত অনেকগুলো কার্টন দেখে কোঁচকাল। ওদের স্টোর রুমে ছিল এগুলো।

দারুণ!

এগুলোর মধ্যে কী মা, আমার জন্যে গিফট? খুশি হয়ে উঠল ও।

গিফট? এত গিফট কেউ পায় নাকি?

ঠিক বলেছেন মা। তবু যা আশা করেছিল মুসা, সেটাই যদি হতো, দারুণ হতো! দেখে শেষ করা যেত না।

তা হলে… কীসের সারপ্রাইজ? অনিশ্চয়তা ফুটল মুসার চেহারায়।

মুসা, শুরু করলেন মা। বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভেবে দেখেছি। আসলে তুমিই ঠিক। তোমার ঘরটা সত্যিই খুব ছোট। তা-ই এটাকে স্টোর। রুম বানানো হয়েছে।

কী বললে? বিস্ময়ের এতবড় এক ধাক্কা খেল মুসা, আরেকটু হলে মাথা ঘুরে পড়েই যেত।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ তুমি।

ওকে সঙ্গে নিয়ে গেস্ট রুমের সামনে এসে দাঁড়ালেন মা। দরজা খুলে দিয়ে বললেন, কী, খুব খুশি লাগছে, না?

ইয়াল্লা! মনে মনে আঁতকে উঠল মুসা।

এ হতে পারে না! কিছুতেই না!

অসম্ভব!

মাথা ঝাঁকালেন মা হাসতে হাসতে।

তোমার নতুন ঘরে তোমাকে স্বাগতম, মুসা।

মা… মা… এর চেয়ে বেশি কিছু বলা সম্ভব হলো না মুসার পক্ষে।

ওর বিছানা, চেয়ার, টেবিল, বইপত্র সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে গেস্ট রুমে। হা করে তা-ই দেখছে ও। চেহারা আস্ত আহাম্মকের মত।

খুশি হওনি তুমি, মুসা? মার চেহারায় বিস্ময় ফুটল। এই ঘরে থাকবে বলে অন্তত নয়শো নিরানব্বইবার আমার কাছে বলেছ তুমি, বলোনি?

হ্যাঁ, তা… ইয়ে, মা… শেষ করতে পারল না মুসা। হাঁ হয়ে গেল মুখ। ভিতর থেকে চাপা এক দুর্বোধ্য গোঙানি বেরিয়ে এল।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *