কারাগারে মোহন – শশধর দত্ত
সহৃদয়, চরিত্রবান, অভিজ্ঞ, সুপ্রসিদ্ধ ডিটেকটিভ- ঔপন্যাসিক
মান্যবর
শ্রীযুক্ত রাধারমণ দাস মহাশয়ের
করকমলে আমার
‘কারাগারে মোহন’ উপন্যাসখানি
পরম সাদরে উৎসর্গ করিলাম।
১
জাহাজের নোঙ্গর না তোলা পর্যন্ত কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হ’তে লাগল। সমুদ্রযাত্রা যদিও এই আমার প্রথম নয়, ইতিপূর্বে কয়েকবার ব্রহ্মদেশ ভ্রমণ কোরে এসেছিলাম, তা’ হ’লেও মন-চাঞ্চল্যের হেতুটা যে আসলে কি বোঝাবার চেষ্টা করবার পূর্বেই জাহাজ ছাড়বার শেষ ঘণ্টা পোড়ে গেল। ইলেকট্রিক শক্তি প্রয়োগ কোরে হাজার মুনি নঙ্গর দেখতে না দেখতে গঙ্গার তলদেশ হ’তে উঠে এসে জাহাজের বোলের এক পার্শ্বে আশ্রয় গ্রহণ করলে।
যে সব ভাগ্যবান নর-নারীকে বিদায় অভিনন্দন জানাবার জন্য আউটরাম ঘাটের দ্বিতল জেটিতে শত শত নর-নারীর সমাবেশ হয়েছিল, জাহাজ ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গে, জাহাজের রেলিংয়ের ধারে এসে তাঁরা ভিড় কোরে দাঁড়ালেন। শত শত রুমাল আকাশের বুকে পত্পত শব্দে আঘাত করতে লাগল, শত শত কণ্ঠে নানারূপ বিদায় অভিনন্দন বাণী ধ্বনিত হ’য়ে শূন্যে মিলিয়ে যেতে লাগল।
আমার আত্মীয়-স্বজন বলতে ত্রিকুলে কেউ নেই। বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা তখন পর্যন্ত শূন্যের ঘরে সীমাবদ্ধ ছিল, সুতরাং আমাকে বিদায় দেবার জন্য কোন প্রাণীর শুভাগমন হয় নি জেনেও আমি অন্যান্য নর-নারীর সঙ্গে একত্রে দাঁড়িয়ে, তাঁদের অভিনন্দনের কল্পিত অংশ দাবি কোরে নিজের মন সুখী করবার প্রেরণায় রত রইলুম।
ধীরে ধীরে জাহাজ মাঝ গঙ্গায় এসে গতিবেগ বর্ধিত করলে। ধীরে ধীরে জেঠী ও লোকজন আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। তখন আমরা আমাদের যে যা’র কেবিনের দিকে চলে গেলুম। এতক্ষণ যে অস্বস্তির ভাব আমার মনের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল, সহসা কোথায় যে তা’ অন্তর্হিত হ’য়ে গেল, বুঝতে পারলাম না।
বৃহৎ জাহাজ। প্রথম শ্রেণীর যাত্রী আমি। জাহাজের প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সকল কেবিনগুলিই ভর্তি চলেছে। আমি একটা সম্পূর্ণ কেবিন রিজার্ভ করেছি। কারণ আমার স্বভাবের বিশেষত্ব আমাকে অন্য লোকের সঙ্গে বাস করাকে একান্ত ভাবে প্রতিরোধ করে। একমাত্র এই কারণের জন্যই আজ পর্যন্ত জীবন-সঙ্গিনী লওয়া সম্ভব হয় নি।
কেবিনে একা একা ভাল লাগল না। আমি প্রথম শ্রেণীর ডেকে এসে দেখলুম কয়েকজন তরুণ ও তরুণী ইতিমধ্যেই কয়েকখানি ডেক্ চেয়ার অধিকার কোরে বসেছেন।
ভগবান আমাকে ঐশ্বর্য আহরণের প্রচুর সুযোগ দিয়েছেন বোলে আমি তাঁর কাছে যতটা কৃতজ্ঞ, আমার দেহও সাধারণ মানব-দুর্লভ সৌন্দর্যে মণ্ডিত করেছিলেন বোলে, তার অপেক্ষা বহুগুণে বেশী কৃতজ্ঞ।
আমার ভবঘুরে জীবনে বহু তরুণ-তরুণীর সান্নিধ্য উপভোগ করেছি। ট্রেনে পথে যে সব বন্ধুত্ব হয় তার একটা অবশ্যম্ভাবী ফল এই হয় যে, যতক্ষণ একই ট্রেনে বা পথে একসঙ্গে থাকা যায়, ততক্ষণ পরস্পরের মধ্যে একান্ত ঘনিষ্ঠতা জন্মে, একে অপরের উপর নির্ভরশীল হ’য়ে ওঠে, পরস্পরের মধ্যে দূরত্বের ব্যবধান আশ্চর্যজনক রূপে অন্তর্হিত হয় কিন্তু পরে যখন ছাড়াছাড়ি হয়
তখন আর একের কথা অপরের মনে থাকে না, কেহ মনে রাখতে চায় না, শুধু একটা স্মৃতিতে, তা’ও সর্বক্ষেত্রে নয়, পর্যবসিত হয়। তেমনি জাহাজের আকর্ষণও সমভাবে কাজ করে।
আমি বলেছি, ইতিপূর্বে কয়েকবার সমুদ্র যাত্রা করতে হ’য়েছে আমাকে। কিন্তু প্রত্যেকবারেই যে-সব বন্ধুত্ব করেছি, যে-সব তরুণীর একান্ত সন্নিকটে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধোরে আলাপ কোরেছি, কত দুর্বল মুহূর্তে, কত তরুণীর মনের অকপট ইতিহাস শ্রবণ কোরে, আমার চিত্ত দ্রবীভূত হ’য়েছে, আজ আর তা’ আমার মনে নেই। মনে রাখবার কোন প্রচেষ্টাই করি নি। এইরূপ সকল ক্ষেত্রেই হয়, ইহাই স্বাভাবিক, ইহাই মানুষের মন-ধৰ্ম।
সুতরাং যখন দেখলাম, কয়েকটী তরুণ-তরুণী একত্র হ’য়ে পরস্পরের সহিত পরিচিত হবার জন্য আগ্রহ চোখে মুখে ফুটিয়ে তুলেছে, তখন আমি মনে মনে হাস্য কোরে ভাবলুম, এমনিই হয়। হওয়াই স্বাভাবিক।
আমাকে একখানা চেয়ারে উপবেশন করতে দেখে একটি তরুণ একবার আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে পার্শ্বের তরুণীর সঙ্গে আলাপে রত হ’লেন। আমি গঙ্গার দুই পার্শ্বের দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া তীরের দিকে চেয়ে অন্যমনস্ক হ’য়ে উঠলুম।
যে মানুষের কোন অবলম্বন নেই, যে মানুষকে পিছনে টেনে রাখবার কোন আকর্ষণ নেই, সেই মানুষের মন যে কি বিপজ্জনক বস্তু, তা’ আমি বিশেষরূপেই বুঝি। আমার মন কখন যে কি- চিন্তা করে, কি চাচ্ছে, তা’ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে ঠিকভাবে জাতে দেয় ন।। হঠাৎ দাবি আসে, আবার দেখা যায় দাবি পূরণের পূর্বেই দাবি ছেড়ে বসে আছে। এমন অবস্থায় জীবনে কতবার যে পড়েছি, তার আর সংখ্যা নেই।
“মশায় শুনছেন?” চমকিত হ’য়ে চেয়ে দেখি একটি জীবন্ত হাতে আঁকা প্রতিমা দু’টী ভ্রমর-কৃষ্ণ চক্ষু-তারকা আমার মুখের উপর ন্যস্ত কোরে নিশ্চল হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কি রূপ! জীবনে অগ্নি-রূপা নারী বহু দেখেছি, কিন্তু এমন রূপ কদাচিৎ চোখে পড়ে। আমি বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলুম।
আমার অবস্থা বোধ হয় তরুণী বুঝতে পারলেন। মৃদু হেসে বললেন, “আমার একটা রুমাল এই চেয়ারে বোধ হয় ফেলে গেছি। একটু কষ্ট কোরে উঠতে হবে যে?”
ভাবলুম, একটু কষ্ট! ও মুখের আদেশ পেলে আমার জীবন পর্যন্ত দিতে কুণ্ঠিত হই না। আমি ব্যস্তভাবে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালুম। কিন্তু রুমাল কোথায়?
তরুণী মৃদু হেসে বললেন, “ধন্যবাদ। তা হলে অন্য কোথাও ফেলেছি বোধ হয়।” তরুণী নির্লিপ্ত, নির্বিকার ভাবে রেলিংয়ের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন।
আমি সবিস্ময়ে চেয়ে রইলুম। আমার মনে হ’ল, আকাশে সমস্ত বিদ্যুৎ একত্রীভূত হ’য়ে জাহাজের রেলিংএর পাশে বাঁধা পড়েছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমি চেয়ে রইলাম।
অপরাহ্ণে জাহাজ সমুদ্রে উপস্থিত হল। চারিদিকে অনন্ত উদার জলরাশি। উত্তাল তরঙ্গমালা-বিক্ষোভিত অকূল সমুদ্রের অসীম রূপ, অনন্ত শক্তির রূপ চক্ষুর উপর যেরূপ ভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে, এমন ভাবে শক্তি সমাবেশের ধারণা আর কিছুতেই হয় না।
জাহাজের নর-নারীর মুখে উচ্ছৃঙ্খল আনন্দদীপ্তি! মাত্ৰ তিনটি দিন ও রাত্রির জন্য সকল প্রকার কর্ম ও দায়িত্ব হ’তে মুক্তি পেয়ে মানুষের নিয়ম-শৃঙ্খলে বাঁধা মন ক্ষিপ্ত ঘোড়ার মত উচ্ছ্বসিত বেগে নৃত্য সুরু করেছে। এই কয়টি নর-নারীকে দেখে জগতে দুঃখ আছে, নিরানন্দ আছে, শোক, ব্যথা, হতাশ বোলে কোন বস্তু আছে, তা’ ধারণা করা শক্ত।
মধ্যাহ্ন-আহারের সময় জাহাজের ডাইনিং হলে দলে দলে নর-নারীর একত্রে আহারের দৃশ্য যে না দেখেছে, আহারকালীন অর্কেস্ট্রার মধুর বাদ্যধ্বনি যে না শুনেছে, তা’কে বোঝান যাবে না, খাওয়াতেও এত আনন্দ আছে, জীবন-ধারণেও এত পূৰ্ণানুভূতি আছে!
যে তরুণীকে প্রভাতে দেখে তাঁর বিদ্যুৎরূপে মুগ্ধ হয়ে- ছিলাম, আহারের টেবিলে ভাগ্যগুণে তাঁর সঙ্গে একত্রে বসতে পেয়ে ধন্য হয়ে গিয়েছিলাম। আলাপ হ’ল তাঁর সঙ্গে। তিনি রেঙ্গুনের এক অতি প্রভাবশালী বিখ্যাত বাঙ্গালী ধনী ব্যবসায়ীর কন্যা। তিনি পিতার সংগে দু’বার ইয়োরোপ ভ্রমণ কোরে এসেছেন। তরুণী কলকাতায় এক বান্ধবীর বিবাহে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলেন। সংগে গভর্নেসরূপে একজন বৃদ্ধা মহিলা রক্ষীরূপে এসেছিলেন, এখন রেঙ্গুনে ফিরে চলেছেন তরুণীর নাম, মিস রমা সোম। রমা গ্রাজুয়েট। রমা সুন্দরী, অপরূপা সুন্দরী, অসামান্যা মেয়ে!
আহারের সময় রমা হাসিমুখে বললেন, “ধন্যবাদ মিঃ চন্দ। আমার রুমাল পেয়েছি।”
একটা তুচ্ছ রুমালের জন্য লক্ষপতির একমাত্র সন্তানের এই উদ্বেগে, আমার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।
রমা দু’টি ভ্রূ কুঞ্চিত কোরে বললেন, “হাসছেন যে?” আমি হেসে বললাম, “আপনার সৌভাগ্য দেখে।”
রমার মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। তিনি মুখ নত কোরে বললেন, “হাজার তুচ্ছ হোক, এমন অনেক জিনিস আছে, যার মূল্য সোনা রূপার ওজনে হয় না, মিঃ চন্দ!”
আমি আহত হলাম সম্পূর্ণ অহেতুক হেতুতে। তবু মৃদু হাস্যমুখে বললাম, “আমারও এতটুকু দ্বিমত নেই, মিস সোম, কারণ আপনার প্রীতি ও অপ্রাতির মূল্য যে সোনারূপায় ক্রয় করা যায় না, তাতে আমার বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।”
রমার নতমুখ লালব হ’য়ে আরো নত হয়ে পড়ল। রামার সেই সলজ্জ আরক্ত মুখখানিতে যে ভাব ফুটে উঠল, আহারে না বসলে, এখনি আমার ছোট্ট কোডাক ক্যামেরায় এই অপূর্ব ভাবটা চিরতরে স্থায়ী করে রাখতুম।
আহারের পর বিশ্রাম। কোন কাজ নেই, কর্তব্য নেই, দায়িত্ব নেই, অফুরন্ত অবসর ও নিদ্রা।
সন্ধ্যার ঘণ্টাধ্বনি হ’ল। জাহাজ তখন সমুদ্রের বক্ষ মথিত কোরে পূর্ণবেগে ছুটেছে। আকাশে নির্মল চন্দ্র কিরণ দিচ্ছে, নিম্নে সুনীল জলধির বুকে মায়াপুরী সৃষ্টি করেছে। দলে দলে নর-নারী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ডেকে ছুটে এসেছে। নানাবিধ উদ্ভট গল্পে আকাশ-বাতাস মুখরিত হ’য়ে উঠেছে। আমি, মিস রমা ও তিনচারটী তরুণ একত্র হ’য়ে নানা গল্পে মত্ত হয়েছি। আমার জীবনে এমন একটি দিনের কথাও স্মরণ করতে পারি না, যে-দিন এমন সহজ স্বচ্ছন্দভরা মধুময় স্মৃতিতে পূর্ণ। মিস সোমের সঙ্গে পরিচয় হ’য়ে আমার জীবন যেন সহসা নূতন আলোক দেখতে পেয়েছে।
চিরজীবন নারীকে ঘৃণা কোরে এসেছি। এতদিন ভেবেছি, ‘নারী নরকস্য দ্বার’ বোলে একটা যে প্রবাদ বাক্য আছে, তা বর্ণে বর্ণে সত্য। কিন্তু জীবনব্যাপী ঘৃণা যে এমন সুধায় পরিণত হবে, কে তা জানত?
সহসা চারিদিকের অস্ফুট গুঞ্জন-ধ্বনি স্তব্ধ হ’য়ে উঠল। মুখে মুখে একটা ভীষণ বার্তা প্রচারিত হয়ে গেল যে, জাহাজের ক্যাপ্টেন অয়ারলেস্ পেয়েছে, বিখ্যাত দস্যু মোহন ছদ্মনামে আমাদের জাহাজে রেঙ্গুন চলেছে। রঙ অতি ফরসা। মাথার চুলের ভিতর নূতন কাটা দাগ আছে। ঘা শুকোয়নি এখনও। সে ছদ্মনামে চলেছে। তার প্রথম অক্ষর ‘P’ অবধি অয়ারলেস যন্ত্রে উঠে যন্ত্র সহসা বিকল হ’য়ে পড়ায় বাকী নামটুকু জানতে পাৱা যায় নি।
দস্যু মোহন! যে ভয়াবহ প্রকৃতির দস্যু কত ধনীর সর্বনাশ করেছে, কত পুলিস অফিসারের চোখের জলে নাকের জলে একশেষ করেছে, যে দস্যুর শত নাম শত ছদ্মবেশের আবরণে, আসল রূপ আজ পর্যন্তও কেউ প্রত্যক্ষ করেনি, যে দশ্যু পত্র দিয়ে পূর্বাহ্ণে সংবাদ পাঠিয়ে দস্যুতা করে, কেউ তার গতি রোধ করতে পারে না, যার ভয়াবহ প্রতিহিংসার কবলে কত নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, যে নিয়তির মত দুর্বার, বজ্রের মত কঠোর, মৃত্যু অপেক্ষা ভয়াবহ সেই দস্যু মোহন আমাদের জাহাজের প্রথম শ্রেণীর যাত্রী হ’য়ে চলেছে!
সকলের মুখে আসন্ন বিপদের ছায়াপাত হ’ল। সকলের মুখ রক্তশূন্য হ’য়ে গেল।
২
মিস রমা সোমের মুখ ভয়ে এতটুকু হ’য়ে গেল। সহসা সকল আনন্দ-প্রবাহ নিঃশেষে রুদ্ধ হ’য়ে গেল।
এক সময়ে রমা বললেন, “কি হবে, মিঃ চন্দ?”
আমি রমাকে সাহস দেবার জন্যে বল্লাম, “ভয় কি ক্যাপ্টেন যখন পূর্বাহ্ণে খবর পেয়েছেন, তখন গ্রেপ্তার করতে তিনি বিলম্ব করবেন না। “
একটি সুশ্রী যুবক তার নাম প্রফুল্ল মিত্র, সে মিস সোমের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্য নানারূপে চেষ্টা করে আমার উদ্বেগের সৃষ্টি করেছিল। সে বললে, “প্রথম শ্রেণীর আরোহীদের মধ্যে যখন মোহন আছে, তখন তাকে খুঁজে বার করা আদৌ কষ্টসাধ্য হবে না।”
অন্য একজন যুবক বললে, “দস্যু মোহনকে আপনি চেনেন না বোলেই ও-কথা বলতে সাহসী হয়েছেন, নইলে মোহনের অসাধ্য কর্ম কিছু আছে বোলে তার জন্ম-শত্রু প্রসিদ্ধ চীফ ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টার মিঃ বেকার পর্যন্ত অস্বীকার করেন না। সেবারে যখন মহারাজের বাড়ীতে চুরি করলে তখন পুলিস রক্ষ! করতে পারলে কী?”
অন্য একটি ভদ্রলোক বললেন, “অয়ারলেসে বলছে, প্ৰথম শ্রেণীতে মোহন চলেছে, নামের আদ্যাক্ষর যা পাওয়া গেছে, ‘P’ তাতে ঐ নামের আদ্যক্ষরে যে কয়টা নাম আছে সেগুলোতে চোখ বুলুলেই ধরা যাবে বোলে আমার বিশ্বাস।”
একজন যুবক বললে, “মোহন একা চলেচে।”
আমি মৃদু হেসে বললুম, “ও-কথাটা অবান্তর। কারণ মোহনের মত নারী-দ্বেষী পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর নেই বলেও চলে।”
মিস সোম সবিস্ময়ে বললেন, “নারী-দ্বেষী? কেন নারী- দ্বেষী, মিঃ চন্দ?”
আমি হেসে জবাব দিলুম, “আমার ঠিক কারণ জানা নেই, মিস সোম।” তারপর গলার স্বর নীচু কোরে বললুম, “নিশ্চয়ই সে আপনার মত নারী-রত্নের সন্ধান পায়নি বোলে!”
দেখলাম, মিস সোমের মুখ গোলাপের মত টক্টকে লাল হ’য়ে উঠল এবং সংগে সংগে মুখখানি নত হ’য়ে গেল।
একটি ভদ্রলোক আতঙ্কে অভিভূত হ’য়ে বলেন, “সর্বনাশ হ’লো এবার। ধনেপ্রাণে মারা যেতে এ জাহাজে উঠেছিলাম দেখচি।”
ভদ্রলোকের কি হ’ল বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলুম, “আপনার কি হ’ল মশায়?”
“আরে মশায়, আপনাদের কি। আমার ওপর ঐ হত-ভাগাটার যে জাত-ক্রোধ, আর যার জন্য মগের মুলুকে পালাচ্ছি, সেই ভয়ই আমার ঘাড়ে চেপে বল! এই সব মানবতার শত্রুকে ফাঁসি দেওয়া দরকার।”
শঙ্কিত আবহাওয়া সত্ত্বেও অনেকে হেসে উঠলেন। একজন
যুবক বললে, “চুপ করুন মশায়। কে বলতে পারে, যাকে আপনি বারবার ফাঁসি লাগাবার হুকুম দিচ্ছেন, সেই মোহন আমাদের মধ্যেই নেই?”
যুবকের কথা শুনে আমাদের সকলের মুখের হাসি চ’লে গেল। ভদ্রলোক অভিভূত হ’য়ে বললেন “না, না, আমি কি গালাগালি করতে পারি তাঁর মত মহাপুরুষকে? আমরা গরীব লোক, যা দু’এক লাখ জমিয়েছি, তা’ আর কত টাকা? ছেলে- পুলে রয়েছে, ভবিষ্যৎ রয়েছে, তাই বলছি—যাদের বিশ, পঞ্চাশ, শ’ লাখ আছে তা’দের যেন তিনি দয়া করেন, তবে দেখতে শুনতে এবং ধর্মেও ভাল হয়। নমস্কার! নমস্কার! “
যুবকটি হেসে বলে, “কাকে নমস্কার করছেন মশায়?”
ভদ্রলোক কোন জবাব না দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে গেলেন।
আমি বললুম, “শুনুন আপনারা। মোহন যখন প্রথম শ্রেণীতে চলেছে, আর সে দেখতে অতি ফরসা এবং একা চলেছে, আর তার নামের আদ্যাক্ষর ‘P’, তখন আমার কাছে প্যাসেঞ্জারদের লিস্ট আছে, আসুন না, তা’র জন্মশত্রু মিঃ বেকারের জন্য অপেক্ষা না কোরে, আমরাই অনুসন্ধান করি?”
সকলেই আমার কথায় সায় দিল। শুধু প্রফুল্ল মিত্তিরের মুখখানি শুকাইয়া উঠিল।
মিস সোম তার ডেক চেয়ারখানা আমার খুব নিকটে টেনে এনে বসলেন।
আমি পকেট থেকে লিস্ট বার কোরে বললুম, “এই দেখুন, ‘P’ আদ্যাক্ষরের ২৮ জন লোক প্রথম শ্রেণীতে চলেছেন। তার মধ্যে ৮জন ইয়োরোপিয়ান। ১৫ জন পরিবারবর্গ নিয়ে চলেছেন। বাকী থাকে পাঁচ জন, যাঁরা একা চলেছেন। এঁদের মধ্যে এক জনের নাম হচ্ছে, প্রমথ মল্লিক।“
মিস সোম উচ্চ কণ্ঠে বললেন, “ওঁকে আমি চিনি। বাবার বন্ধু উনি। রেঙ্গুন হাইকোর্টে চাকরি করেন।”
আমি বললাম, “দুই—প্রেমময় ব্যানার্জি।”
একজন বলে, “আমার মাসতুতো ভাই।”
“তিন, প্যারীচরণ ঘোষ।”
একজন চিৎকার কোরে বললে, “আমার ভগ্নীপতি। আমার বোন লুটীদি’কে রেঙ্গুন থেকে আনতে চলেছেন।”
আমি বললুম, “চার— প্রীতিরঞ্জন বটব্যাল।”
“এখানে আছি।” বোলে দীর্ঘ দাড়ী ও গুল্ফে ভূষিত ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন।
মিস্ সোম হেসে লুটোপুটি খেতে খেতে বললেন, “ওঁকে কি খুব ফরসা বলা চলে?”
সবাই হেসে উঠলেন। আমি বললুম, “বাকী থাকে পাঁচ, আমাদের নূতন বন্ধু প্রফুল্ল মিত্তির। ওঁর দুর্ভাগ্যক্রমে ওঁর রঙও অতি ফরসা। সুতরাং ওঁর বক্তব্য শোনা আমাদের উচিত।”
প্রফুল্ল মিত্রের মুখ আস্বাবিকরূপে বিবর্ণ হ’য়ে উঠল। সে কয়েকবার আমাদের সকলের দিকে পর্যায়ক্রমে চেয়ে বললে, “আমারও ঠিক ঐ সন্দেহ এতক্ষণ হচ্ছিল! কারণ আমার রঙও,” আমার দিকে চেয়ে বললে, “দুর্ভাগ্যক্রমে অতি ফরসা। একাও চলেছি। নামের আদ্যাক্ষর “প” দিয়ে। সুতরাং আমাকেই গ্রেপ্তার করা উচিত।” প্রফুল্লর মুখ গম্ভীর ও চক্ষু রক্তবর্ণ হ’য়ে উঠল।
সকলে হাসতে চেষ্টা করেও হাসতে পারলেন না। প্রফুল্লর মুখের দিকে সকলে সভয়ে চাইতে লাগলাম। বলতে কী আমারও সন্দেহ হচ্ছিল যে, ভদ্রলোকের “আমাকেই গ্রেপ্তার করা উচিত” এই কথা সত্য হ’য়ে না দাঁড়ায়!
সহসা মিস সোম বললেন, “ওঁর মাথায় কাটা ঘা আছে তো।”
প্রফুল্ল বিষণ্ন মুখে বললে, “ঐটিরই অভাব মনে হচ্ছে। এই দেখুন আমার মাথা, যদি খুঁজে বার করতে পারেন।”
আমি তাঁর মাথা পরীক্ষা করতে যাবো, এমন সময়ে লেডী সান্ন্যাল ছুটতে ছুটতে এসে হাউ মাউ কোরে কেঁদে উঠলেন। অতিকষ্টে তাঁকে শান্ত কোরে যা শুনতে পেলাম তা’ এই যে তাঁর কেবিনে ঢুকে চোরে তাঁর ধনরাশি, জড়োয়া গয়না, হীরার দুল, ও হীরার নেকলেস সব চুরি কোরে নিয়েছে।
দস্যু মোহন যে আমাদের মধ্যে রয়েছে এই শঙ্কা আর একবার সকলের মনে গভীরভাবে আলোড়ন তুললে। সকলের মুখে অনাগত বিপদের ছায়াপাত হ’ল।
৩
আমরা দ্রুতপদে লেডী সান্ন্যালের কেবিনে গিয়ে দেখলুম তাঁর যথাসর্বস্ব চুরি হয়ে যায় নি। অসমসাহসিক দস্যু, তাঁর মহামূল্য নেকলেস থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ হীরকগুলি এবং জড়োয়া গহনার মূল্যবান পাথরগুলি মাত্র চুরি করেছে, সোনার গহনায় হাত পর্যন্ত দেয় নি, বা কয়েকশত মুদ্রার নোটও চুরি করেনি। এমন ভাবে বেছে বেছে হীরকগুলো তুলে নিয়েছে, তাতে দস্যু যে একজন মণিকারও তাতে কারও সন্দেহ রইল না।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে দস্যু এমন ভাবে পরীক্ষা কোরে চুরি করতে সক্ষম হল কি প্রকারে? লেডী সান্ন্যাল চা’ খেতে স্টেরুমে গমন করেছিলেন, বিশ কি পঁচিশ মিনিট সময় মাত্র তিনি বাইরে ছিলেন, ইতিমধ্যে কেবিনের দ্বার ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ কোরে নিশ্চিন্ত মনে দস্যু মোহন বেছে বেছে শ্রেষ্ঠ পাথরগুলি চুরি কোরে বেরিয়ে গেছে।
সারা জাহাজের আনন্দ-কোলাহল নিঃশেষে রুদ্ধ হ’য়ে গেল। এখনও দু’ দিন ও দু’ রাত্রি একই জাহাজে এমন ভীষণ দস্যুর সঙ্গে বাস করতে হবে জেনে আমাদের অস্বস্তির আর সীমা রইল না।
পরদিন প্রাতঃকালে ক্যাপ্টেন প্রফুল্ল ক্যাপ্টেন প্রফুল্ল মিত্রকে ডেকে পাঠালেন। আমাদের মন হতে যেন একটা পাষাণ-ভার হঠাৎ নেমে গেল। আমাদের মধ্যে কারও সন্দেহ রইল না যে, প্রফুল্ল মিত্রই ছদ্মবেশে দস্যু মোহন।
প্রফুল্ল মিত্রকে ডেকে পাঠানোর অর্থ ই যে, তাকে গ্রেপ্তার করা হল, এ বিষয়ে আমাদের সন্দেহ ছিল না।
লেডী সান্ন্যালের বাছাই করা হীরক অপহরণ দেখে, তা’ যে দস্যু মোহনের চির-পরিচিত ধারায় চুরি, তা আমাদের মধ্যে অনেকেই নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করেছিলাম। প্রথমতঃ জাহাজের মধ্যে চুরি কোরে চোরাই জিনিস গোপনে রাখা এক দুরূহ ব্যাপার। কারণ জাহাজের প্রত্যেকটী স্থান ক্যাপ্টেনের ও কর্ম- চারীদের পরিচিত। সুতরাং অল্পপরিসর স্থানে বহু টাকা মূল্যের দ্রব্য লুণ্ঠন কোরে গোপন রাখা সম্ভব হবে, এই ভেবেই, লেডী সান্ন্যালের মাত্র মূল্যবান পাথরগুলি যে চুরি করা হয়েছে, তা’তে অনেকেরই সন্দেহ ছিল না।
যা হোক, একটা বিষয়ে আমি লাভবান হলুম। প্রফুল্ল মিত্রের সুশ্রী, সুন্দর চেহারা মিস সোমের যে প্রশংস-দৃষ্টি আকর্ষণ করদিল, তার গ্রেপ্তারে সে সম্ভাবনা চিরতরে রহিত হ’য়ে গেল। এখন আমি একা একান্তভাবে রমাকে কাছে পাবো, এই চিন্তায় আমি অন্তরের অন্তর হতে দস্যু মোহনকে আশীর্বাদ করতে লাগলুম। যদি তার আগমন প্রচারিত না হ’তো, তাহ’লে এমন মধুময় সৌন্দর্যরাশিতে অংশীদার নিয়ে আমার জীবনের প্রথম ও নব-বসন্তের সমারোহে অপূর্ণতা রয়ে যেতে৷।
মিস সোম আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “আমার মন ঠিক বুঝতে পেরেছিল মিঃ চন্দ।”
আমি বুঝতে না পেরে বললাম, “কি বুঝতে পেরেছিল, মিস সেমি?”
“এমনি কিছু একটা যে ঘটবে তা আমি প্রথম থেকেই আশঙ্কা করছিলাম। কাল প্রথম যখন আমার সঙ্গে মিঃ মিত্রের দেখা হ’ল, তখন আমার মন এমন ভীত হ’য়ে পড়েছিল যে কি বলব!” মিস সোম ধীরে ধীরে বললেন।
এতখানি নির্দোষ সরলতা! মুগ্ধ হ’য়ে আমি রমার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। জীবনে অন্য কোন নারীর মুখের দিকে এমন দৃষ্টিতে চেয়ে দেখবার সুযোগ বা অবসর হয়নি আমার। চিরদিন নানা উদ্ভট কর্তব্যে পাগল হয়ে ঘুরে বেরিয়েছি। আমি এই মুহূর্তটুকু অক্ষয় করে রাখবার জন্য বললুম, “আপনি— একটু মুখটা তুলে বসুন দেখি? আপনার বর্তমান ভাবের এক- খানা ফটো তুলে নেবার জন্য অত্যন্ত লুব্ধ হয়েছি, মিস সোম।”
রমা দেবী লজ্জিত স্বরে বলেন, “কাল থেকে তিনখানা ছবি তুলেছেন আপনি। লোকে দেখলে কি বলবে বলুন তো?”
লোকে অনেক কিছুই বলে, মিস সোম। লোকের কথা আমি শুনিনে।” মিস সোমের চতুর্থ ছবি তুলে নিলুম।
এমন সময়ে কয়েকজন সহযাত্রী এসে উপস্থিত হলেন। সকলের মুখেই এক কথা, কখন দস্যু মোহন আবার কা’র সর্বনাশ করবে!
এক ভদ্রলোক বললেন, “যাক বাঁচা গেছে। দস্যুকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়েচে, তখন আর ভয়ের কি আছে? আপনি ও ত তাই বলেন, মিঃ চন্দ?”
আমি বললাম, “তা’তে আর সন্দেহ আছে, বটব্যাল মশাই?” অপরে বললেন, “কিন্তু চোরাই মাল তো পাওয়া যাচ্ছে না, মশাই? প্রফুল্ল মিত্তির যদি দস্যু মোহনই হবে, তবে চোরাই মাল সে কোথায় রাখলে? তা’ ছাড়া তার মাথার কাটা দাগ বা যা’ই কোথায় গেল—বলুন তো?”
আমরা সবিস্ময়ে বক্তার মুখের দিকে চাইলুম। আমি বললুম “মাথার যে কাটা দাগ নেই, সে কথা আপনাকে কে বললে?”
ভদ্রলোক বললেন, “সবাই বল্চে, মশায়। ক্যাপ্টেন উত্তম- রূপে পরীক্ষা ক’রেও কাটা দাগ বা কোন ঘা খুঁজে পায় নি। তা’ ছাড়া, সে না-কি বলেছে যে রেঙ্গুনের এক ধনী চাল-ব্যাপারীর পুত্র সে। কে জানে মশায়, কোনটা সত্যি, কোন্টা মিথ্যে! “
মিস সোমের মুখ ভয়ে বিবর্ণ হ’য়ে উঠল। আমার দিকে চেয়ে বলেন, “আপনি তো ক্যাপ্টেনের বিশেষ বন্ধু, মিঃ চন্দ। আপনিও কি সঠিক খবর কিছু পান নি?”
আমি মনে মনে বললুম, যদি পাওয়া সম্ভব হ’ত, তা’হলে আমার মত খুশি আর কে হ’ত! প্রকাশ্যে বললুম, “যদি প্রফুল্ল দস্যু মোহন না হবে, তবে তা’কে ক্যাপ্টেন গ্রেপ্তার করতে পারত না। সে যে মোহন—তা’তে আমার বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই।”
মিস সোমের মুখে আবার নির্ভরতার চিহ্ন পরিস্ফুট হ’য়ে উঠল।
গতকল্য মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় মনে যে অপূর্ব আনন্দানুভূতি জেগে উঠেছিল, আজ আর তা’র কোন স্পর্শ ই পাওয়া গেল না। আমরা কোনও রকমে আহার শেষ করতে আরন্ধ করলুম।
এক সময়ে মিস সোম বলেন, “রেঙ্গুনে আপনি কোথায় উঠবেন, মিঃ চন্দ?”
আমি বললুম, “খুব সম্ভবতঃ একটা হোটেলেই থাকতে সক্ষম হব মিস সোম।”
মিস সোম ক্ষণকাল দ্বিধা কোরে বলেন, “আমার বাবা আপনার কথা শুনবেন যখন, তখন দেখবেন আপনি কিছুতেই সক্ষম হবেন না।”
মিস সোম মৃদু শব্দে হেসে উঠলেন।
আমি বললুম, “হাসলেন যে?”
মিস সোম বললেন, “হাসলুম— এমনিই!” একটু পরে পুনরায় বলেন, “সক্ষম হবেন কথার অর্থ কি, মিঃ চন্দ?”
আমি হাসতে হাসতে বললুম, “হোটেলে থাকা আমি কোন সময়েই পছন্দ করিনে। যখন নিতান্ত বাধ্য হ’তে হয়, তখন সক্ষম হব অর্থাৎ মনের সব আপত্তি দূর করতে বাধ্য হ’বো। বুঝেছেন?”
এমন সময়ে একটা গুঞ্জনধ্বনি ‘ডাইনিংহলের চারিদিকে উত্থিত হ’ল। দেখি, প্রফুল্ল মিত্র শির উঁচু কোরে খাবারের ঘরে প্রবেশ করছেন। তাঁকে দেখে মিস সোমের মুখ কালো হ’য়ে উঠল। ভয়-চরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে তিনি যেন কি বলতে গেলেন, পারলেন না।
অবশেষে প্রফুল্ল মিত্তিরকেও ছেড়ে দিলে! তবে দস্যু কে? এই শঙ্কায় সকলের মন ভারাক্রান্ত হ’য়ে উঠল! আমাদের আহার শেষ হয়েছিল। প্রফুল্ল সকলের সঙ্গে দু’ একটা কথা ক’য়ে যেমন আমাদের টেবিলের নিকট আসবার উপক্রম করলে, অমনি মিস সোম, তাঁর গভর্নেসের সঙ্গে দ্রুতপদে কক্ষ ছেড়ে বা’র হয়ে গেলেন।
প্রফুল্ল মিত্রের প্রফুল্ল মুখ মলিন হ’য়ে উঠল। এক হিংস্র উল্লাসে আমি উৎফুল্ল হ’য়ে ভাবলুম, “যাক বাঁচা গেল! প্রফুল্ল মিত্রের জন্য রমার সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হ’বার, আমার আর কোন কারণ নেই।” আমি বললুম, “কি হ’ল, মিঃ মিত্ৰ?”
প্রফুল্ল আমার মুখের দিকে একবার তীব্রদৃষ্টিতে চেয়ে বলে, “হবে আর কী?”
পিছন থেকে এক ভদ্রলোক বললেন, “বেশ মশায়, হবে আর কী, কি রকম? আপনাকে কি জন্য গ্রেপ্তার করেছিল শুনি?”
প্রফুল্ল গম্ভীর মুখে বলে, “ভুল কোরে মশায়, ভুল কোরে।”
কিন্তু আমরা কেউই তা’র কথা সমর্থন করতে পারলাম না।
আমরা অন্তরের অন্তরে প্রার্থনা করছিম, যেন ভুল না হয়ে থাকে। এমন সময়ে প্রফুল্ল পুনরায় বলে, “আমার কাছে কাগজ- পত্র দেখে ক্যাপ্টেন নিঃসন্দেহ হ’য়ে আমাকে ছেড়ে দিয়েছেন। এইবার আমি দেখচি, হতভাগা মোহন কেমন কোরে আত্মগোপন করতে সক্ষম হয়!”
প্রফুল্ল কারও নিকট কোন সমর্থন না পেয়ে হল্ হ’তে বেরিয়ে গেল।
একজন বললেন, “ক্যাপ্টেনের ছেড়ে দেওয়া ভুল হয়েছে, আমি জোর গলায় বলতে পারি। অমন কাগজ-পত্র দস্য মোহন হাজারে হাজারে তৈরী করতে পারে। না, দেখচি সকলের সর্বনাশ না কোরে আর ও নিশ্চিন্ত হবে না।”
আমি চিন্তিত হয়ে পড়লুম। এইবার কার ওপর সন্দেহ হবে, কাকে গ্রেপ্তার করা হবে, কিছুই বুঝতে পারলম না। প্রফুল্ল মিত্রের নামের আদ্যাক্ষর মিলে গেল, অত্যন্ত ফরসাও সে, একাও চলেছে, প্রথম শ্রেণীতেও চলেছে সে, অথচ তা’কে ছেড়ে দেওয়া হ’ল, এর অর্থ কী বুঝতে পারলুম না।
অপরাহ্ণে আমরা যখন ডেকে জমায়েৎ হলম, মিস সোম আমার অতি সন্নিকটে এসে উপবেশন করলেন! আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলুম যে, তিনি অত্যন্ত ভীত হয়েছেন। বললাম, “কি এত ভাবছেন, বলুন তো?”
রমা দেবী মুখ তুলে বললেন, “আমার অত্যন্ত ভয় করচে। আমার সমস্ত হীরা-গহনা যাক আমার দুঃখ নেই, কিন্তু……”
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, “আপনার পর পীড়ন করবে এমন অমানুষ বোধ হয় দস্যু মোহনও হ’তে পারবে না।”
মিস সোম সবিস্ময়ে মুখ তুলে চেয়ে বললেন, “দস্যুর আবার মনুষত্ব আছে না-কী? “
আমি মনে মনে রমার প্রশংসা কোরে বললাম, “তা’ বটে! তা’ হলেও আমি যখন আপনার কাছে রয়েছি, তখনও কি আপ- নার এমন ভয় পাওয়া উচিত, মিস সোম? “
আমার অর্থহীন প্রবোধ বাক্য শুনে, মিস সোমের মুখে সলজ্জ হাসি ফুটে উঠল।
বললেন, “ভয় পাওয়া কি উচিত অনুচিত ভাবেন, মিঃ চন্দ?
তা ছাড়া আমাকেই যে সে রেহাই দেবে, এমন ভরস| কি কোরে করি বলুন তো?”
এমন সময়ে লেডী সান্ন্যাল বিষণ্ন মুখে এসে বললেন, “এই- বার আমি কি করি বলুন আপনারা? ক্যাপ্টেন ছেড়ে দিয়েছে?”
শুনলাম, দশাকে নাকি লেডী সান্ন্যালের মুখের দিকে সবাই চাইলাম। সত্যই এ আমদের অন্যায় দোষারোপ! যদি সত্য সত্যই প্রফুল্ল মিত্র নির্দোষী হন, তবে তাঁ’র মুক্তি পাওয়ায় আমাদের এতখানি বিরোধিতা করা, এতে কি হীনতা প্রকাশ পাচ্ছে না?
কারও নিকট কোন সহানুভূতি না পেয়ে লেডী সান্ন্যাল পুনরায় বললেন, “যদি একটুও ঘুণাক্ষরে শুনতে পেতাম, তা’হলে আমি কিছুতেই এই হতভাগা জাহাজে উঠতাম না।”
একজন ভদ্রলোক বললেন, “এখন সমস্যা দাঁড়াচ্ছে, সত্যিকার দস্যু কে? তবু ও-ছোকরাকে গ্রেপ্তার করায় আমাদের মানসিক শঙ্কা বহুল পরিমাণে কমেছিল, কিন্তু কে যে দস্যু মোহন আর কে যে নয়, এ-তো আমার মাথায় আসছে না। আপনি কি বলেন, মিঃ চন্দ?”
আমি বললাম, “সমস্যা যে গুরুতর তা’তে আমার কোন সন্দেহই নেই। আপনিও হ’তে পারেন, আমিও হ’তে পারি, উনিও হ’তে পারেন। প্রকৃতপক্ষে সকলেই হ’তে পারেন। কিন্তু সত্য সত্যই যে কে, এ সমস্যার সমাধান কি কোরে হয় বলুন দেখি?”
একজন যুবক মিস সোমের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার উদ্দেশ্যে অপেক্ষাকৃত উচ্চৈস্বরে বললে, “আপনারা আমার একটা মন্তব্য শুনবেন?”
সকলের দৃষ্টি একসঙ্গে তার মুখের উপর পড়ল। মিস সোমের দৃষ্টিও একান্তভাবে যুবকের মুখের উপর ন্যস্ত হ’ল। যুবকের মনোবাসনা সিদ্ধ হ’লে, মৃদু হেসে বিজ্ঞের স্বরে বললে, “আমার মনে হয়, ক্যাপ্টেনের ভুল হয়েচে।”
আমি ব্যঙ্গস্বরে বললাম, “এ আর নতুন কি আবিষ্কার করলেন?”
যুবকটি বললে, “আগে আমার কথাই শুনুন, মশায়। আমি বলছি ক্যাপ্টেনের ছেড়ে দেওয়া ভুল হয়েচে।
কারণ ঐ একটি ব্যক্তি ছাড়া আর কারুকেই সন্দেহ করবার মত আমাদের জাহাজে আর কেউ নেই।”
এরূপ তর্ক বাড়তে দেবার ইচ্ছা আমার আদৌ ছিল না। কারণ যুবকের আসল উদ্দেশ্য মিস সোমের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, তা আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম। সুতরাং আমি রমার দিকে চেয়ে বললাম, “চলুন আমরা একটু বেড়িয়ে আসি। যাবেন, মিস সোম?”
মিস সোমের মুখ উজ্জ্বল হ’য়ে উঠল; কিন্তু পরক্ষণেই নিষ্প্রভ হ’য়ে গেল। বললেন, “যদি মোহনের সঙ্গে দেখা হ’য়ে যায়?”
আমি হেসে বললাম, “ভালই হয়। আলাপ করা যাবে। আপনি উঠুন।”
মিস সোম উঠে দাঁড়ালেন। এমন সময়ে ছোট এক টুকরা টাইপ করা কাগজ, জাহাজের একজন কর্মচারী সকল যাত্রীদের হাতে হাতে বিতরণ কোরে গেল। আশ্চর্য হ’য়ে পড়লুম, “মিঃ প্রফুল্ল মিত্র স্বতঃপ্রবৃত্ত হ’য়ে পাঁচহাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, যে-কেহ দস্যু মোহনকে গ্রেপ্তার করিয়ে দেবে তা’কেই তৎক্ষণাৎ দেওয়া হবে।”
একজন হাসিমুখে মন্তব্য করলেন, “দশু। মোহন, দস্যু মোহনকে পুরস্কৃত করবেন!”
মিস সোম মৃদু হাস্যমুখে বললেন, “আসুন, মিঃ চন্দ।”
৪
অবিরাম গতিতে জাহাজ চলেছে। চারিদিকে জল আর জল। আকাশ চারিদিকে গোল হ’য়ে সমুদ্রের বক্ষের উপর নেমে এসেছে। মিস সোম সমুদ্রের দিকে চেয়ে উচ্ছ্বসিত স্বরে বললেন, “যতবারই দেখি না কেন, এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য কখনও পুরাতন হয় না। নয়-কি মিঃ চন্দ?”
আমি মিস্ সোমের পাশে দাঁড়িয়েছিলুম। কোমল-স্বরে বললুম, “যথার্থ বলেছেন আপনি।”
মিস সোম বললেন, “এমন আনন্দময় ভ্রমণ এক দস্যুর জন্য এমন ভাবে নষ্ট হ’ল, ভাবতেও আমার কষ্ট হয়।”
আমি পুলকিত হ’য়ে চিন্তা করলুম, আমার সঙ্গ কি তবে রমাকে আনন্দ দিতে সক্ষম হ’য়েছে? প্রকাশ্যে বললাম, “আমার সৌভাগ্যের আর অন্ত নেই, মিস সোম।”
মিস সোম চমকিত হ’য়ে আরক্ত হ’য়ে উঠলেন। এমন সময়ে স্বয়ং ক্যাপ্টেন আমাদের সম্মুখে এসে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, “বড়ই দুঃখের বিষয় মিঃ চন্দ যে, আমরা প্রাণপণ চেষ্টা ক’রেও না দস্যু, না অপহৃত অলঙ্কার আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। এক্ষেত্রে আমরা কি করি বলুন তো।”
আমি মৃদু হেসে বললুম, “দশ্যুর পূর্ণ নামের জন্য অয়ারলেস পাঠিয়েছেন?”
ক্যাপ্টেন বিষণ্ণ মুখে বললেন, “সেও এক “সেও এক বিপদ। অয়ারলেস যন্ত্র এমন খারাপ হ’য়ে গেছে যে, এখন পর্যন্ত তা’ ঠিক হচ্ছে না। নইলে কোন্ কালে দস্যু মোহনকে গ্রেপ্তার করতে পারতাম।
মিস সোম বললেন, “সমস্ত জাহাজ অনুসন্ধান করেছেন?”
“প্রত্যেকটি স্থান, মিস সোম। সত্য কথা বলতে কী এই অসমসাহসিক যাদুকর-দস্যুর কথা কাগজে-পত্রে অনেক পড়িছি, তা হ’লেও পূর্বে সব কথা বিশ্বাস করতাম না; কিন্তু এখন লাকটার ওপর আমার শ্রদ্ধা সহস্র গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভাবচি এমন একটা লোক যদি বিপথে না গিয়ে সুপথে থাকতো, তা’ হ’লে জগতের মহোপকার হ’তে পারতো।”
আমি মৃদু হেসে তাঁর কথা সমর্থন করলুম। বললুম, “তা’ হ’লে আমাদের দস্যু মোহনের দয়ার ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর রইল না?” i
আমাদের যথাসাধ্য করছি, মিঃ চন্দ। আপনারা সকলে যে বিশেষ সাবধানে থাকবেন, এ আশা নিশ্চয়ই করতে পারি আমি।” ক্যাপ্টেন সেখান হ’তে চলে গেলেন।
মিস সোম অস্থির কণ্ঠে বললেন, “চলন, আমরা ডেকে যাই, মিঃ চন্দ। আমার অত্যন্ত ভয় করচে।”
আমরা ডেকে ফিরে এসে দেখলুম সেখানে তুমুল তর্ক, যুক্তি, আলোচনা সুরু হ’য়েচে। সকলেই আছেন, কিন্তু প্রফুল্ল মিত্র ছাড়া। শুনলুম তিনি নিজে অনুসন্ধানের কার্যে নিযুক্ত হয়েছেন। একজন বললেন, তিনি মিত্রকে ক্রু ও খালাসীদের সঙ্গে আলাপ করতে দেখে এসেছেন।
মিস সোম বললেন, “আমার মনে হয়, মিঃ মিত্র যদি নির্দোষীই হ’বেন, তবে এমন দূরে দূরে রয়েছেন কেন?“
আমার হাসি পেল রমার কথা শুনে। কারণ বেচারাকে দেখে আহারের টেবিল থেকে রমা ও তার গভর্নেস যে ভাবে উঠে চলে গিয়েছিল, তা স্বচক্ষে দেখেও কোন যুবক কোন তরুণীকে আপ্যায়িত করতে আসতে পারে, আমার কল্পনাতীত ব্যাপার। তা ছাড়া আর কি উপায় আছে? আমাকে নীরব থাকতে দেখে, মিস সোম উৎকণ্ঠিত স্বরে বললেন, “আপনি কি ভয় পেলেন, মিঃ চন্দ?”
আমি হেসে বললুম, “না, মিস সোম। আমি ভাবচি মিত্রের আসল উদ্দেশ্যটি কী? এদিকে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে, স্বয়ং অনুসন্ধানে লেগেছে, অন্য দিকে ক্যাপ্টেনের মুখে যা’শুনলেন, তা’তে কে যে দস্যু মোহন আর কে যে নয়, আমি তো আর ভাবতে পারি নে।”
মিস সোম আয়ত দু’টি চক্ষু তুলে বললেন, “তবে কি হবে, মিঃ চন্দ?”
আমি এই ভয়াতুর কপোতীকে অভয় দেবার জন্য বললুম, “আপনার ভাববার বিশেষ কোন কারণই নেই, মিস সোম।”
একজন ভদ্রলোক চিৎকার করে বললেন, “ভরসাই বা কোথায়, মশায়? মোহন কারুকেই রেহাই দেয় না। শুনেছি নারীর উপর তার বিজাতীয় ঘৃণা আছে, তা’ তিনি পরমা সুন্দরীই হোন, আর কুৎসিতাই হোন।”
আমার হাসি পেল। ভাবলুম, হতভাগ্য মোহন! যার নামে এমন সব কাহিনী প্রচারিত হয়, মানুষ নামের অযোগ্য সে। আমার মন এই ভেবে সান্ত্বনা পেলে যে, মিস সোমের মত একটি অসামান্যা মেয়ের দেখা যদি তা’র ভাগ্যে ইতিপূর্বে সম্ভব হ’ত, তা’ হ’লে তা’র নিন্দাবাদে আকাশ-বাতাস এমন এমন মুখরিত হতো না।
আমাকে নীরব থাকতে দেখে মিস সোমের ভয় বৃদ্ধি পেলো। তিনি বললেন, “আচ্ছা দস্যুটার সম্বন্ধে আর কিছু জানেন আপনি, মিঃ চন্দ?”
আমি কিছু বলবার পূর্বেই একজন যুবক বললে, “লোকটার একটু বিশেষত্ব আছে, মিস সোম। শুনি, ধনীলোকের ওপর তার বিজাতীয় ঘৃণা। কিন্তু কেন, তা আমি সবিশেষ অবগত নই। সে যত ধন ধনীদের মাথায় হাত বুলিয়ে অপহরণ করে, শুনেছি না কী তার শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত গরীবদের কাজে বিলিয়ে দেয়।”
মিস সোমের মুখে সশ্রদ্ধ ভাব ফুটে উঠল। আমার দিকে চেয়ে বললেন, “সত্যি, মিঃ চন্দ?”
আমি বললুম, “শুনি তো এমনি সব অনেক কথা। দস্যুটার পিছনে না-কি একটা খুব বড় সমিতি আছে। সে সেই সমিতির মধ্য দিয়ে দেশের যতগুলি সাধারণ প্রতিষ্ঠান আছে, যেমন হাসপাতাল, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, অনাথ আশ্রম, অন্ধ বিদ্যালয়, সব তাতেই নিয়মিতভাবে একটা নির্ধারিত অঙ্কের টাকা দান করে। যেখানে দুর্ভিক্ষ, যেখানে মড়ক, মহামারী – সেইখানেই সে কোন না কোন মূর্তিতে দীন-দরিদ্রের সেবার জন্য অর্থ নিয়ে উপস্থিত হয়। জানেন ত আমাদের দেশ, গরীব দেশ? তাই দরিদ্ররা তাদের বিপদের সময় সাহায্যকে ভগবানের কৃপা বলে মনে নেয়।”
লেডী সান্ন্যাল শুনছিলেন; সহসা ভীষণ ক্রোধে চিৎকার করে বললেন, “শয়তান, বর্বর, পিশাচ, দস্যু, তস্কর আবার পরের ধনে পোদ্দারী করে দরিদ্রকে দান করতে যান! আমরা দান করিনে? দান করতে যেন জানিনে! এই সেদিন এক বড় সাহেবের জন্য বাগান পার্টিতে দশ হাজার টাকা খরচ করলুম | তাঁকে ‘স্যার’ উপাধি পাবার আগে কম টাকাটা কি ওই সব দুর্ভিক্ষ মহামারিতে ঢালতে হয়েছে? তারপর সে সব কথা সংবাদ- পত্রে তুলতেই কি কম বেগ পেতে হয়েছে? দান করতে আমরাও যেন জানিনে!”
অনেকেই মুখ টিপে হাসতে লাগলেন। সহসা জাহাজের একজন কর্মচারী এসে সকলকে উদ্দেশ কোরে বললে, “ক্যাপ্টেনের অনুরোধ, আপনারা সকলে আপন আপন ধনরত্ন খুব সাবধানে রাখবেন। আজ সন্ধ্যার পর ঝড় উঠবে, সাইক্লোন ও হ’তে পারে। তবে ক্যাপ্টেনের আদেশ যে, আপনারা বিপদ- জ্ঞাপক ঘণ্টাধ্বনি আরম্ভ হ’বা মাত্র যে যার কেবিনে ঢুকে হ্যামকে আশ্রয় নেবেন।” এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ কোরে কর্ম- চারী অস্তহিত হ’ল।
বিপদের উপর বিপদ। সাইক্লোন! যে না দেখেছে, যে সাইক্লোনের মধ্যে না পড়েছে, তা’কে কিছুতেই বোঝানো যাবে না, সে কি বস্তু! দস্যু মোহন হীরক-হারের মধ্যে বাছাই কোরে শ্রেষ্ঠ পাথরগুলি নেয়, কিন্তু সাইক্লোনরূপী ভীষণ জীব কোন কিছুই পরিত্যাগ কোরে যায় না। এমন কি, বৃহৎ জাহাজকেও গ্রাস করতে এতটুকু বেগ পায়না, এমনিই বস্তু সাইক্লোন!
একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল। মিস সোম একেই তো দস্যু মোহনের চিন্তায় অস্থির, তার ওপর সাইক্লোনের কথা শুনে একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন। আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, এইবার সর্বরকমে ষোলকলা পূৰ্ণ হ’তে চললো, মিঃ চন্দ।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনি তো বহুবার সমুদ্রে অভি- যান করেছেন, কখনও কি সাইক্লোনের মুখে পড়েন নি?”
মিস সোমের মুখে একটু ম্লান হাসি ভেসে উঠল। বললেন, “পড়িনি আবার! আজও সে দিনের কথা মনে পড়লে আমার কান্না পায়। তাই তো ভাবছি, দশ্যু যা’ করতে এখন পর্যন্ত সক্ষম হয় নি, সাইক্লোন তা’ পরিপূর্ণ ভাবেই সমাপ্ত ক’রে যাবে।”
একজন যুবক আমাদের দিকে চেয়ে বললে, “সাইক্লোন আসবে, তাতে আবার ভয়ের কারণ কি আছে মশায়? সাইক্লোন মানে তো ঝড়? আমি বহু দেখচি। আমাদের ও সবে ভয় করে না।”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, “বহু দেখেছেন? আপনি কি এর আগে সমুদ্রে এসেছিলেন?
যুবকের মুখে বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল। বললে, “আরে মশায়, ঝড় দেখতে সমুদ্রে আসতে হয় না। বাঙলা দেশের ছেলে আমি, কাল-বৈশাখী দেখে দেখে চোখ পচে গেছে। আপনাদের সাইক্লোন কি তার চেয়েও ভীষণ?”
মিস সোম সহসা মৃদু শব্দে হেসে উঠলেন, “আমার এসপ্, ফেবেলের কুয়োর ব্যাঙের গল্প মনে পড়ে গেল।” মিস সোম মৃদুস্বরে বললেন, “প্রতিবাদ কোরে ওদের দর্প আহত করবেন না, মিঃ চন্দ। নিজের মূর্খতা ও অহঙ্কার নিয়েই ওঁরা সন্তুষ্ট থাকুন।”
এদিকে সন্ধ্যা সমাগতপ্রায়। রাত্রির আহার আটটার সময় নির্ধারিত থাকলেও, সেদিন সাইক্লোন-সম্ভাবনায় সন্ধ্যার সময়ই আহারের ঘণ্টা বেজে উঠল। আমরা সকলে ডাইনিং হলে নেমে গেলুম।
৫
সকলের মুখেই একটা অনাগত বিপদের আতঙ্ক-চিহ্ন। দস্যু মোহনের সান্নিধ্য-চিন্তা অতিক্রম কোরেও সাইক্লোন-আতঙ্ক সকলের মুখে অধিক পরিমাণে দেদীপ্যমান।
আহারে বসে দেখলুম, প্রফুল্ল মিত্র একখানা ছোট টেবিলে একা খেতে বসেছে। আমার মন সহানুভূতিতে ভরে গেল। ভাবলুম, যদিই বেচারা নির্দোষী হয়, তবে তার ওপর আমাদের সকলের এই অসঙ্গত আচরণ সত্যই একটু অধিক পরিমাণে লজ্জাজনক। কিন্তু আমার আনন্দও কম হচ্ছিল না। কারণ তা’র মত অতি সুশী যুবকের মোহ ত্যাগ কোরে যদি আমার মত যুবকের প্রতি মিস সোম এতখানি অনুরক্ত হ’য়ে না উঠতেন, তা’ হলে? কল্পনাতেও বেদনা অনুভব করি।
তাড়াতাড়ি আহার শেষ কোরে, আমরা ডেকে উপস্থিত হলুম। সবে মাত্র সন্ধ্যা। অসহ্য গরম। সমুদ্র তরঙ্গশূন্য। চারিদিকে একটা থমথমে ভাব। আকাশের রঙ পাণ্ডুর। এতটুকু বাতাসের চিহ্ন কোন স্থানেই নেই। জাহাজের গতি শ্লথ হ’য়েচে। সাইক্লোন আসবার পূর্বে প্রকৃতির যে-ভাব জীবনে আর একবার প্রত্যক্ষ করবার দুর্ভাগ্য আমার হ’য়েছিল, ঠিক সেই রকম ভাবের পুনরাবৃত্তি দেখে আমার মন একটু উদ্বিগ্ন হ’য়ে উঠল। কিন্তু সে উদ্বেগ আমার নিজের জন্যে নয়, মিস সোমের মত ক্ষণাঙ্গী তন্বী তরুণী যে সাইক্লোনের মত বর্বর জন্তুর আক্রমণ সহ্য করতে পারবেন, ভাবতেও আমার ভরসা হচ্ছিল না।
সাইক্লোনের ভয়ে, বিপদজ্ঞাপক ঘণ্টাধ্বনির পূর্বে ই অধিকাংশ যাত্রীই স্ব স্ব কেবিনে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। আমি একা রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছিলুম, এমন সময়ে সুমধুর স্বরে মিস সোম ডাকলেন, “মিঃ চন্দ?”
আমি চমকিত হ’য়ে পিছন ফিরতেই দেখলুম, চোখে-মুখে আতঙ্ক পরিস্ফুট কোরে মিস সোম একখানা ডেক চেয়ারে উপবেশন কোরে আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন।
আমি দ্রুতপদে তাঁ’র নিকটে গেলুম ও অন্য চেয়ার দখল কোরে বসলুম। বললুম, “কি হয়েছে, মিস সোম?”
মিস সোম মুখ নত কোরে বললেন, “আমার অত্যন্ত ভয় করছে, মিঃ চন্দ।”
আমি কি বলে সান্ত্বনা দেব ভেবে পেলুম না। কারণ জীবনে নারী সম্বন্ধে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারি নি আমি। সুযোগেরও অভাব প্রচুর পরিমাণে অন্তরায় হয়েছিল। বললুম, “আপনার ভীত হওয়া ত উচিত নয়, মিস সোম। আপনি দু’বার ইয়োরোপ ঘুরে এসেছেন, সুতরাং বে-অব-বেঙ্গলের মত ছোট্ট সমুদ্রের সাইক্লোনে ওঁরা সব অস্থির হতে পারেন, কিন্তু আপনি?”
মিস সোমের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, ক্ষণকাল নীরব থেকে বললেন, “সাইক্লোনের ভয় নয়, মিঃ চন্দ।”
“তবে কিসের ভয়, মিস সোম? দস্যু মোহনের?” আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলুম।
মিস সোম মুখ নত করে বললেন, “না।”
আমার বিস্ময়ের আর অবধি রইল না। বলল ম, “তবে?
বহুক্ষণ নীরবে আপনার মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে মিস সোম বললেন, “এ-যাত্রা যদি রক্ষা পাই, তবে আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবার সম্ভাবনা আছে ত, মিঃ চন্দ?”
আনন্দে আমি আত্মহারা এবং বাক্যহারা হয়ে উঠলুম। বহুক্ষণ অপলক চোখে চেয়ে থেকে অতি কষ্টে বললুম, “আপনার মনে থাকবার মত পরম সৌভাগ্য যদি এমন করেই সম্ভব হয়, তবে জগতে এমন কে দুঃখী আছে যে সে-সম্পদ পরম-পাওয়া বলে মেনে না নেবে, মিস সোম?”
শিক্ষিতা-নারী রমার দু’টী পেলব কোমল কপোল আরক্ত হয়ে উঠল। তার দু’টি রক্ত-রাঙা অধরে ভীরু আবেগ কম্পিত হয়ে উঠল। এমন সময়ে ভীষণ শব্দে জাহাজের বিপদ-জ্ঞাপক ঘণ্টাধ্বনি শুরু হ’ল। আমার দুর্ভাগা অদৃষ্টে মিস সোমের হৃদয়ের কথা অশ্রুত রয়ে গেল। আমি তাকে ব্যগ্রকণ্ঠে কেবিনে যাবার জন্য অনুরোধ জানালাম।
ডেকে যে দু’একজন নর-নারী দূরে দূরে বসে কথা বলছিলেন সকলে ত্রস্ত চরণে, ভীত অস্ফুট চিৎকারে যে যাঁর কেবিনে চলে গেলেন।
মিস সোম কম্পিতপদে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি চলতে পারচি না, আমাকে দয়া কোরে কেবিনে দিয়ে আসুন।”
মিস সোম একটি হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি পরম- সৌভাগ্যে ভাগ্যবান হয়ে মিস সোমকে ধীরে ধীরে তাঁর কেবিনে দিয়ে এলুম এবং বারবার কোরে অনুরোধ জানিয়ে এলুম, তিনি ও তাঁর গভর্নেস যেন এখনি হ্যামকে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
বাইরে এসে একবার স্তব্ধ প্রকৃতির দিকে চাইলাম। কে জানে এই নিস্তব্ধ প্রকৃতির বক্ষ চিরে কোন্ সেই মহাদানব হুঙ্কার ছেড়ে ছুটে আসছে? কে বলতে পারে, আর অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের সংদ্রের তলদেশে চির-বিশ্রাম গ্রহণ করতে হবে না? হয়তো জীবনের আর শেষ কয়টি মুহূর্ত বাকী আছে। তারপর সীমাহীন অখণ্ড অবসর, বিশ্রাম, নিদ্রা! কে জানে, মৃত্যুর পর মানুষের গতি কি হয়?
জাহাজের অবিরাম ঘণ্টার শব্দ আসন্ন মৃতু্যু-দূতের আগমন সংবাদ ঘোষণা করছিল, আমি কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে কেবিন অভিমুখে চলতে সুরু করলাম।
৬
কেবিনে প্রবেশ কোরে হ্যামকে আশ্রয় নিলুম। মন হতে কিছু সময়ের জন্য দস্যু মোহন অন্তর্হিত হ’য়ে গেল। পরিবর্তে মিস সোম, রমার ভয়ার্ত, আকুল উদ্বেগে ভরা মুখখানি আমার মন ও সত্তাকে পূর্ণ কোরে ফেললে।
আমার মন এই ভেবে সান্ত্বনা পেলো, যদিও সাইক্লোন তার সকল ভয়াবহতা নিয়ে আমাদের ওপর ভেঙ্গে পড়ে, তা’ হলেও যে নারী প্রশান্ত মহাসাগর দু’বার অতিক্রম করেছে, একবার সাইক্লোনের মুখে পড়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে, সে নারী সাধারণ বালিকার মত একেবারে অসহ যাতনায় ভেঙ্গে পড়বে না।
কিন্তু সে কথা যা’ক। এখন আমি কেন এই পথে চলতে সুরু করেছি, কেন আমি অসম্ভবকে সম্ভব করবার দুরাশায় মত্ত হয়েছি, তার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণই খুঁজে পেলাম না। আমার ভাগ্যে ওরূপ নারী-রত্ন লাভ কি কখনও সম্ভব হবে? রমার পিতা কি স্বেচ্ছায় তাঁর রূপে-গুণে দুর্লভ কন্যা রত্নকে আমার হাতে সমর্পন করবেন? যদি না করেন, তবে আমি এরূপে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি কোন্ হেতুতে? চিরদিনের জন্য অনুশোচনা ও দুঃখ স্বেচ্ছায় বরণ কোরে নেওয়ার মধ্যে সার্থকতা কোথায়?
কে যেন আমার কানে বললে, জগতের সব বস্তুই দুই আর দুইয়ে চারের নীতিতে বিচার করা চললেও, প্রেমের বিচার করা, চলে না। প্ৰেম পাত্র অপাত্র বিচার করে না, যুক্তি-তর্কের ধার ধারে না, সম্ভব-অসম্ভব চিন্তা করে না, সে আপন গতিতে আপনি আত্মহারা হ’য়ে চলে।
আমি ভাবলুম, আমার ফেরবার পথ আর নেই। যে-বস্তু মানুষ বিচার কোরে গ্রহণ করে না, যে-বস্তু আপনা হ’তে, আপন স্বেচ্ছা-দুর্দম গতিতে অন্যের মন জয় করে, তা’কে ইচ্ছা থাকলেও আর তাড়ানো যায় না। উপায় থাকলেও নিরুপায় হতে হয়।
নেই থাক্ উপায়। আমি চাই রমাকে। রমাহীন জীবন যাপন করা আমার পক্ষে অসম্ভব। যেমন কোরেই হোক রমাকে জীবন-সঙ্গিনী করতে হবে। নইলে এ-জীবনের কোন প্রয়োজন নেই, কোন অর্থ নেই।
সহসা আমার চিন্তা ব্যাহত হ’ল। মনে হ’ল সহস্ৰ দানব একসঙ্গে তাণ্ডব চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে। জাহাজের ঘণ্টাধ্বনি তীব্রতর হ’য়েছে। সেই দানবীয় চিৎকার শুনে বুঝলুম সাইক্লোন দৈত্য এসে পড়েছে। আর কয়েক মুহূর্ত, তারপর সেই ভীষণ দানবীয় শক্তির সঙ্গে আমাদের ক্ষুদ্র জাহাজের জীবন-মরণ যুদ্ধ শুরু হবে।
কর্ণবধিরকারী চিৎকার সহসা নিকট হ’তে নিকটতর হ’তে লাগল। চক্ষুর পলক পড়তে না পড়তে সহস্র দানবের বীভৎস হুঙ্কার আকাশ-সমুদ্র কম্পিত কোরে জাহাজের ওপর ভেঙ্গে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমার হ্যামক ভীষণবেগে কাত হ’য়ে পড়ল। মনে হ’ল জাহাজ ডুবে গেছে। সমুদ্রের তলদেশে ছুটেছে।
মাত্র এক সেকেণ্ড! তারপর জাহাজ অন্য পাশে কাত হ’য়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে আমার হ্যামক অন্য পাশে ঝুলে পড়ল। তারপর কর্ণবধিরকারী অট্ট চিৎকার-তাণ্ডবের মধ্যে আমি একবার এদিক,
একবার ওদিক ভীষণ বেগে দুলতে লাগলুম। জাহাজের সমস্ত বাঁশীর মিলিত তীব্র চিৎকার; ঘণ্টাধ্বনি, সাইক্লোনের অপার্থিব আরাব, একত্রে মিলে যে-ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করলো, মনে হ’ল এই মৃত্যু উল্লাসের মাঝে মানুষের সাধ্য কী নিজেকে রক্ষা করে? মৃত্যু নিশ্চিত, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, মৃত্যু আগত ভেবেও আমার মন এতটুকু ভীত হ’ল না, শুধু শ্রীমতী রমার উদ্বেগ, কষ্ট, যাতনার কথা ভেবে অস্থির হ’য়ে উঠল। যদি সাধ্য থাকতো, সম্ভব হতো তা’ হ’লে আমি ছুটে গিয়ে তাঁকে অভয় দিতাম, রক্ষা করতাম। কিন্তু মানুষের শক্তি সীমাহীন নয়। জাহাজের এই তাণ্ডৰ দোলানীর মাঝে স্থির হ’য়ে দাঁড়াবার কোন ক্ষমতা, কোন মানুষেরই নেই।
একই ভাবে তাণ্ডব-লীলা চলেছে। কখন কাবে, কি কখনও থামবে না, কে জানে! মানুষের শক্তি কত তুচ্ছ, মানুষ কত ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষমতা কিরূপ সীমাবদ্ধ, এরূপ অবস্থায় পতিত হ’য়ে যেরূপ অনুভব করা যায়, তেমন আর কিছুতেই হয় না।
আমি দুই চক্ষু মুদিত কোরে পড়ে রইলাম।
মানুষ যে-দুঃখকে নিরবছিন্ন ভাবে, যে দুঃখের অন্ত নেই বলে দৃঢ় বিশ্বাস করে, কালের স্রোতে, সে ভাবনার, সে বিশ্বাসেরও ব্যতিক্রম হয়। তেমনি যে-সাইক্লোন অনেকেই কখনও শান্ত হবে না বোলে ভেবেছিল, তারাই মনে মনে ইষ্ট-দেবতাকে ধন্যবাদ দিয়ে যখন বলল, “ধন্যবাদ, প্রভু ধন্যবাদ! তোমার কৃপায় এ-যাত্রায়ও রক্ষা পেলুম।” তখন রাত্রি দুইটা।
আমার দেহ চূর্ণ হ’য়ে গেলেও, আমার প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হ’ল, মিস সোমের খবর নেওয়া।
আমি কোনরকমে পোশাক পরিবর্তন কোরে, মিস সোমের কেবিনের দ্বারে আঘাত কোরে ডাকলুম, “মিস সোম! মিস সোম!”
মিস সোম ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, “ধন্যবাদ! বেঁচে আছি এখনও। আমার গভর্নেসের অবস্থা শোচনীয়। দয়া কোরে আধ ঘণ্টা পরে একবার খবর নেবেন।”
যাক্ বাঁচা গেল! আমি ধীরে ধীরে ডেকে এসে উপস্থিত হলুম। ডেক-চেয়ারগুলি কর্মচারীরা সব তুলে রেখে দিয়েছিল, আবার পাতে শুরু করেছে।
আমি রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে উন্মুক্ত, শান্ত সমুদ্রের দিকে চেয়ে দেখলুম, আকাশের চন্দ্র-কিরণ আবার মায়াপুরী স্বজনের কাজে রত হয়েছে। কিছু পূর্বে যে তাণ্ডব-লীলা আরম্ভ হয়েছিল; তা’র কোন চিহ্নই কোন স্থানে নেই। শান্ত, প্রশান্ত সমুদ্রের বুকে শিহরণ তুলে দখিন হাওয়া অপূর্ব গন্ধময় হ’য়ে ভেসে আসছিল। আমি মনে মনে ভাবলুম, প্রকৃতির লীলার আর অন্ত নেই!
৭
যে ভীষণ রাত্রিকে অফুরন্ত বোলে মনে হয়েছিল, তা’রও অবসান হ’ল। প্রভাতে প্রথম তপন-কিরণে সমুদ্রের বক্ষ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। গতরাত্রে যে বিভীষিকার রাজত্ব শুরু হয়েছিল, কোন স্থানেই তা’র কোন চিহ্ন আর দেখা গেল না।
কিন্তু নতুন বিপদ-সংবাদে আমাদের ডেকের সাধারণ সভায়, আবার নতুন কোরে দস্যু মোহন-বিভীষিকা জ্বলন্ত বাস্তবমূর্তি পরিগ্রহ করল। গতরাত্রে সাইক্লোন অতিবাহিত হ’য়ে গেলে আমাদের বিখ্যাত প্রফুল্ল মিত্র, যিনি দস্যু মোহনের গ্রেপ্তারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, তাঁকে জাহাজের সম্মুখের দিকে দস্যু মোহন আক্রমণ কোরে, তাঁর মাফলারেই তাঁর মুখ ও হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে, পকেট থেকে একশ টাকার পঞ্চাশ খানা নোট বার কোরে নিয়ে একখানা পত্ৰ লিখে রেখে গেছে।
পত্রে লেখা আছে :
“আপনি যে-দস্যুকে গ্রেপ্তারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, আমি সে কাজ সমাপ্ত কোরে পুরস্কার গ্রহণ করলুম। ইতি—
আপনারই বন্ধু
মোহন”
এমন ভীষণ সংবাদ শ্রবণ কোরে সকলেই সন্ত্ৰস্ত হ’য়ে উঠলুম। সর্বনাশ! তবে দস্যু কে? প্রফুল্ল মিত্রই কি তবে নিজেকে বেঁধে রেখে নতুন খেলা খেলে জানাচ্ছে যে, সে নিজে দস্যু নয়? আমাদের মধ্যে অনেকের দৃঢ় বিশ্বাস হ’ল যে, প্রফুল্ল মিত্রেরই কারসাজি এটা।
কিন্তু গোঙানী শুনে জাহাজের যে একজন অফিসার তা’কে বন্ধন-মুক্ত করেছিলেন, তিনি বলেছেন যে, কোন মানুষ আপনাকে আপনি তেমন ভাবে কিছুতেই বাঁধতে পারে না। তবে? তবে দস্যু কে?
এই প্রশ্নই আমাদের মনে অবিরত উঠতে লাগল। ফলে সকলেই পরস্পর পরস্পরকে দস্যু ব’লে ভাবতে লাগল। কে দস্যু? আমার পাশে যে ভদ্রলোক শঙ্কিত বিহ্বল চোখে চেয়ে রয়েছেন উনি? না একটু দূরে যে যুবক ভীত বিহ্বল হয়ে আপন সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি? না ওঁর সঙ্গী? তা নয় ত কে?
অবশেষে ব্যাপার এরূপ দাঁড়াল যে, বিশেষ পরিচিত সন্দেহা- তীত ব্যক্তি ব্যতীত কেউ কারও সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত করতে সাহসী হ’ল না।
এখনও একটা দিন একটা রাত্রি জাহাজে থাকতে হবে। ইতোমধ্যে কি যে হবে, আর কি যে হবে না, তার কোন নিশ্চয়তাই আমাদের মধ্যে রইল না।
একজন বললেন, “মোহন যে শুধু ঐ ক’টা টাকা বা কয়েকটা হীরার টুকরা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে, তা বিশ্বাস হয় না। এবার নিশ্চয়ই রক্ত-স্রোতে জাহাজ ভাসিয়ে দেবে। কারণ মোহন দস্যু যে কি রকম ভয়ঙ্কর নীচ, তা আমার জানা আছে।”
ভদ্রলোকের কথা শুনে সকলের মুখে আতঙ্ক চিহ্ন পরিস্ফুট হ’য়ে উঠল।
জাহাজের ক্যাপ্টেন ক্ষিপ্ত হ’য়ে উঠলেন। তিনি হুকুম দিলেন যে, যেমন কোরেই হোক এই দস্যুকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তিনি ও তাঁর সমস্ত কর্মচারী মিলে জাহাজের সমস্ত গুপ্ত স্থান, এমন কি জাহাজের তক্তা পর্যন্ত তুলে তুলে অনুসন্ধান শুরু করলেন।
কিন্তু কোথায় দস্যু মোহন?
আবার নতুন সংবাদ এল, গত রাত্রে ক্যাপ্টেনের সোনার ঘড়ি চুরি হ’য়ে গেছে।
একে তো ক্যাপ্টেন ক্ষিপ্ত হ’য়ে উঠেছিলেন, তা’র উপর স্বয়ং ঘড়ি খুইয়ে উন্মাদেরও অধম হ’য়ে উঠলেন। তাঁ’র চিৎকারে, তাঁর হুকুমের পর হুকুমে কর্মচারীদের জীবন দুর্বহ হ’য়ে উঠলেও, তাঁরা প্রাণপণে দস্যুর অনুসন্ধানে রত হ’লেন।
মোহনের নতুন নতুন কীর্তিতে আমার পক্ষে এই সুবিধা হ’ল যে, আমি রমাকে একান্ত নিকটে পেলুম। তিনি লতার মত আমাকে অবলম্বন কোরে একান্ত নির্ভয়ে আপনাকে ছেড়ে দিলে। আমি নানা রকমে তাঁ’কে সান্ত্বনা দেবার জন্য আমার মনের কথা, মনের আবেদন, নানা ছলে নানা ভাবে তাঁর কানের মধ্যে গুঞ্জন- ধ্বনিতে ঢালতে লাগলুম। ভীতা কপোতীর মত দুই পক্ষ অবশ কোরে রমা আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।
এক সময়ে রমা বললেন, “আশ্চর্য শক্তি এই মোহনের। লোটার জন্য এত ভয় ও ঘৃণা হ’লেও, সময়ে সময়ে শ্রদ্ধার ভারে অবনত হ’য়ে পড়তে হয়।”
আমি সবিস্ময়ে বললুম, “কেন, মিস্ সোম? “
বড় বড় দু’টি চক্ষু মেলে রমা বললেন, “কেন, জিজ্ঞাসা করছেন? জাহাজের এই স্বল্প পরিসর জায়গার মধ্যে উপরি উপরি এতগুলো কাণ্ড কোরেও যে লোক অলক্ষ্যে অদৃশ্য হ’য়ে থাকতে পারে, তা’র মত ক্ষমতাশালী শক্তিবাকে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা যায় না? সব চেয়ে আমার বেশী ক’রে জানতে ইচ্ছে করে, এই সব জিনিস চুরি ক’রে কোথায় সে লুকিয়ে রেখেচে! ক্যাপ্টেন তো বললেন, তিনি তক্তা তুলে তুলে খোঁজ করেও কিছুই দেখতে পান নি; তবে?”
আমি বললুম, “এর মধ্যে বিস্মিত হবার কি আছে, মিস সোম? আমরা তো দেখেছি যে, সে বেছে বেছে মহামূল্য ও আকারে ছোট হীরাগুলিই নিয়েছে? আমার হাতের ছোট কোডাক ক্যামেরার এই ফোল্ডে বহু সহস্র টাকার হীরা যদি লুকিয়ে রাখি, তবে কে তার সন্ধান পাবে, মিস সোম? এও তেমনি। যে দস্যু এতগুলি বুদ্ধিমান লোককে বোকা বানিয়ে এখন পর্যন্ত নিজেকে স্বাধীন রাখতে পেরেছে, তার পক্ষে এ -সব চিন্তা করা খুবই স্বাভাবিক নয় কি?”
মিস সোম চিন্তিত মুখে বললেন, “তা’ হবে। কিন্তু কে সেই দস্যু, মিঃ চন্দ?”
আমার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। আমি বললুম, “আমিও ঠিক ওই প্রশ্নই করছি, মিস সোম। বর্তমানে যা’ অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে কে যে দস্যু মোহন নয়, তাই এক সমস্যা হ’য়ে দাঁড়িয়েছে।”
এমন সময়ে একজন বাঙালী ভদ্রলোক ডেকে এসে উচ্চ- স্বরে বললেন, “ক্যাপ্টেনের ঘড়ি পাওয়া গেছে।”
আমরা সকলে উৎসাহভরে জিজ্ঞাসা করলুম, “কোথায়? কা’র কাছে?”
“কারুর কাছে নয়, মশায়। সেকেণ্ড অফিসারের প্যান্টলুনের পকেটের মধ্যে।
সেকেণ্ড অফিসার হঠাৎ পকেটে হাত দিয়ে দেখে কি একটা ভারী বস্তু রয়েছে। সে বিস্মিত হ’য়ে সেটা বা’র কোরে দেখে, বস্তুটি ক্যাপ্টেনের অপহৃত ঘড়ি। তখনি সে ক্যাপ্টেনের কাছে ছুটে গিয়ে, এই আশ্চর্য কাহিনী জানায়।” ভদ্রলোক বিবৃত করলেন।
একজন যুবক বললেন, “তা’ হ’লে সেকেণ্ড অফিসারেরই কাজ এটা।
ভদ্রলোক চটে গিয়ে বললেন, “কখনও না। আর সে যদি চুরি করেই থাকবে, তবে আবার আপনা হ’তে জানাতে যাবে কেন মশায়? এই বুদ্ধি নিয়ে সংসার করচেন কি কোরে? এ সেই দস্যু-মহারাজ মোহনের একটু তামাসা আর কি!”
“তা’ হলে মোহনের রসবোধও আছে?” আমি মিস সোমের দিকে চেয়ে বললুম।
মিস সোম শুধু বললেন, “আশ্চর্য!”
মিস সোমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে একজন যুবক, যে ইতিপূর্বে বহুবার মিস সোমের দৃষ্টি আকর্ষণের কার্যে নিজেকে নিযুক্ত করেছিল, বললে, “আশ্চর্যই বটে, মিস সোম। আমার এমন আনন্দ হচ্ছে।”
আমি সবিস্ময়ে বললুম, “আনন্দ?”
“হাঁ মশাই, হাঁ। আনন্দ করবো না তো কাঁদবো না-কী? এমন কটা বীর-পুরুষ বাঙালীর ঘরে জন্মায়? যদিও সে ভুলপথে চলেছে, তবুও তার কথা ভেবে গর্ব বোধ করেন না, এমন যদি কেউ থাকেন, তবে তাঁর না থাকাই উচিত।” যুবকটী উচ্ছ্বসিত স্বরে বললে।
লেডী সান্ন্যাল বিষণ্ন মুখে বসে আমাদের আলাপ-আলোচনা শুন্ছিলেন; সহসা বোমার মত ফেটে পোড়ে বললেন, “আনন্দ আর গর্ব দুই হ’তে৷ কেমন বুঝতাম, যদি আমার মত সম্পদ হারিয়ে গলাবাজি করতে বাছা।”
যুবক একবার তাঁর মুখের দিকে চেয়ে সেখান থেকে উঠে গেল।
একজন বললে, “এ লোকটাকেও আমার সন্দেহ হয়।”
পাশের অন্য যুবক ক্রুদ্ধ হ’য়ে বললে, “আমার বন্ধুকে যে সন্দেহ করে, তা’র মুখদর্শন করলেও পাপ আছে।”
যুবকটি পিছন ফিরে বলো।
রমা বললেন, “আসুন, আমরা একটু ঘুরে বেড়াই।”
‘আমি সানন্দে রমার সঙ্গে জাহাজের সম্মুখ দিকে অগ্রসর হ’তে লাগলুম। এক সময়ে ক্যাপ্টেন আমাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “মোহনের নতুন কীর্তি সব শুনেছেন, মিঃ চন্দ?”
আমি মৃদু হেসে বললুম, “হাঁ শুনেছি। শুনলুম আপনার ঘড়ি পাওয়া গেছে, সত্য?”
ক্যাপ্টেনের মুখে অপ্রতিভ হাসি ফুটে উঠল বললেন, “হাঁ। লোকটার রসবোধও পুরো মাত্রায় আছে। আমি ভেবে পাই না, সে কি কোরে আমার ড্রয়ার থেকে চুরি করে? সব চেয়ে বিস্ময়- জনক ব্যাপার, সেকেণ্ড অফিসারের প্যান্টের পকেটে কি করে রেখে গেল? লোকটা কি অদৃশ্য হবার ক্ষমতা রাখে, মিঃ চন্দ?”
আমি বিস্মিত হ’য়ে বললুম, “আশ্চর্য শক্তি আছে স্বীকার করতেই হবে। ভাল কথা, আপনার অয়ারলেস্ মেসিন সারা হয়েছে তো?”
“না, সম্পূর্ণ অচল হ’য়ে পড়েছে।” ক্যাপ্টেন হতাশম্বরে বললেন।
আমি বললুম, “তবে আর কোন সংবাদই দস্যু সম্বন্ধ পান নি?”
“কি কোরে আর পাবো, মিঃ চন্দ। এখন আজকের দিন ও রাত্রিটা কেটে গেলে আমি নিশ্চিন্ত হই।” ক্যাপ্টেন আমাদের অভিবাদন কোরে চলে গেলেন।
আমরা জাহাজের সম্মুখে দু’টি লৌহ-স্তম্ভের উপর উপবেশন করলুম।
জাহাজ পূর্ণ গতিতে চলেছে। সমুদ্র শান্ত। রৌদ্র কিরণ গাঢ় নীল জলের ওপর অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা করছিল। রমা স্নিগ্ধ-বৃষ্টিতে চেয়ে বসেছিলেন। এক সময়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “আপনার কিন্তু বিশেষ কোন পরিচয় দেন নি আমাকে!”
আমি মৃদু হেসে বললুম, “আমার নাম শুনেছেন। আমার বাপ-মা, আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। ভবঘুরে জীবন বলাই চলে। ভগবান অর্থাভাব দেন নি আমাকে। আমার এখন একান্ত কামনা, মিস সোম, আমি যেন পাঁচজনের মত ঘর বাঁধি, সংসার করি। পাঁচজনের মত পাঁচজনকে নিয়ে যেন বেঁচে থাকি আমি। শিশু-কলরবে আমার শান্তি-নীড় যেন মুখরিত হ’য়ে পড়ে।”
রমা সলজ্জ দৃষ্টিতে চেয়ে বলেন, “আপনার বাড়ী তো কলকাতাতেই, মিঃ চন্দ?”
আমি বললুম, “হাঁ। তবে অন্যান্য স্থানেও আমার কয়েকটা বাড়ী আছে, মিস সোম। আমার সব আছে, আবার আমার কিছুই নেই।”
মিস সোম চকিতে একবার মুখ তুলে চেয়ে বলেন, “আপনি তে৷ ইচ্ছা করলেই নিজের বাসনা পূর্ণ করতে পারেন, মিঃ চন্দ?”
“পারি?” আমার কণ্ঠে উল্লাস ব্যক্ত হ’ল। আমি নিজেকে যেন আর ধ’রে রাখতে পারছিলাম না। পুনরায় আবেগ ভরা স্বরে বললুম, “আপনি বলছেন, আপনি অভয় দিচ্ছেন, মিস সোম?” আমার অসংলগ্ন কথা গুনে মিস সোমের মুখে যে- সবিস্ময় ভাবটি ফুটে উঠল, তা’ আমি জীবনে ভুলবো না। রমা কি বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময়ে তাঁর গভর্নেস ছুটতে ছুটতে এসে বলেন, “রমা, বুড়ী, বেবী, আমাদের পাশের কেবিনে গত রাত্রে হীরার কুন্ঠি চুরি হ’য়ে গেছে। তুমি দেখবে এসো, তোমার কিছু গেছে কি না!”
মিস সোম উদ্বেগে পূর্ণ হ’য়ে দাঁড়ালেন। আমি পুনরায় আপন অদৃস্টকে ধিক্কার দিলুম। দু’-দুবার সুযোগ ব্যর্থ হয়ে গেল। যে দস্যু মোহনকে আমি অন্তরের অন্তরে আশীর্বাদ করেছিলুম, তা’র ওপর ক্রুদ্ধ হ’য়ে উঠলুম।
আমরা দ্রুতপদে কেবিন অভিমুখে ধাবিত হলুম।
৮
একই ধরণের চুরি। বেছে বেছে হীরক সংগ্রহ! দস্যু মোহনের কর্মক্ষমতা দেখে আমাদের মধ্যে ভীষণ ভীতির ভাব দেখা গেলেও, সবিস্ময় শ্রদ্ধার ভাবেরও অভাব ছিল না।
ক্যাপ্টেনের অবিরাম প্রচেষ্টা, প্রথম শ্রেণীর কেবিন থেকে বৃহৎ জাহাজের এমন কোন স্থান বা যাত্রীদের এমন কোন জিনিস রইল না, যা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে অনুসন্ধান করা না হয়েছে; অবশেষে সন্ধ্যার পর অনুসন্ধান-পর্ব শেষ এই ভেবে করা হ’ল রাত্রি প্রভাতেই জাহাজ রেঙ্গুন-বন্দরে পৌঁছাবে এবং সেখানে নিঃসন্দেহরূপে যে পুলিসের বন্দোবস্ত হ’য়েছে, তারাই দস্যু মোহনকে গ্রেপ্তার করবে এবং চোরাই মাল উদ্ধারে সক্ষম হবে
সন্ধ্যা থেকে রাত্রি ১২টা পর্যন্ত এই সময়টুকু আমার জীবনে অক্ষয় হ’য়ে রইল। এই সময়টুকু রমার সাহচর্যে, রমার মধুর কথায়, তাঁর আত্মদানের স্বীকৃতিতে পূর্ণ। সময় যে এমন করে কাটে অথবা ঘণ্টাকে যে কয়েক মিনিট ব’লে মনে হয়, এমন অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম। আমি ভূত-ভবিষ্যৎ ভুলে বর্তমানের আনন্দে, মোহে আত্মহারা হ’য়ে পড়লুম। আমার যে কোন বিষয়ে কিছু করবার আছে বা কিছু ভাববার আছে, আমার মন থেকে সে চিন্তা নিঃশেষে অন্তহিত হ’য়ে গেল। আমি আমাকে ভুলে আমাকে নিয়েই আমাকে হারালুম।
অবশেষে প্রভাত হ’ল। প্রত্যেকটি নর ও নারী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দেখলে, তারা ইরাবতী নদীতে প্রবেশ করেছে। অদূরে রেঙ্গুনের জেটি দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক দিনের পর স্থলভূমি দেখতে পেয়ে আমাদের মন অকথিত আনন্দে পূৰ্ণ হ’য়ে উঠল। প্রভাতেই একজন অফিসার এসে জানিয়ে গেলেন, রেঙ্গুন-পুলিস দস্যু-মোহনকে ধরবার জন্য অপেক্ষা করছে, অতএব প্রত্যেক আরোহীকে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
উত্তম! মিস সোম—মিস সোম আর বলি কেন—রমা ও আমি রেংলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলুম। রমা বলে, “তোমার হাতের কাজ মিলেই আমার কাছে যাবে তো, কিশোর? আমাকে কথা দাও, প্রয়োজনের বেশী একটি দিনও আমাকে তুমি ভাবাবে না?”
আমি রমার একখানি হাত চেপে ধরে বললুম, “তুমিও আমাকে কথা দাও, আমার যদি, ফিরতে কিছু বিলম্বও হয়, আমার জন্য অপেক্ষা করবে, রমা!”
রমার মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠল। সে বললে, “শুধু শুধু দেরীই বা হ’বে কেন, কিশোর?”
আমার বুকের মাঝে একটা ব্যথা অনুভব করলুম। হয়তো আনন্দের উত্তেজনা। কখনও-তো এমন পরিস্থিতিতে পড়ি নি, আমি! আমি ডাকলুম “রমা, রাণি!”
রমা আয়ত চক্ষু মেলে বললে, “বলো!”
“চিরদিন আমাকে এমনি ভালবাসবে তো? কোন কারণেই আমাকে ঘৃণা করবে না তো, রাণি?” আমার স্বর রুদ্ধ হয়ে এলো।
রমা বললে, “তোমাকে ঘৃণা করবো আমি? তোমাকে?” রমার মুখে হাসি ফুটে উঠল। পুনরায় বললে, “নারী যাকে একবার মন দেয় কিশোর, সে মরে যায়, তবু সে মন আর ফিরিয়ে নিতে পারে না।”
এমন সময়ে জাহাজ এসে জেটির সম্মুখে লাগ্ল। ধীরে ধীরে জাহাজের সিঁড়ি নামানো হ’ল। কিন্তু ও কি? আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ডিটেকটিভ মিঃ বেকার এখানে? কৈ তা’ তো জানতাম না।
রমা আমার বিস্মিত ভাব দেখে বললে, “কি হয়েচে, কিশোর?”
আমি মৃদু হেসে বললুম, “ঐ যে মধ্যবয়স্ক দীর্ঘ-চেহারা একজন সাহেব সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন দেখতে পাচ্ছ, রমা? উনি একজন বিখ্যাত গোয়েন্দা। দস্যু মোহনের ভয়ানক শত্ৰু। এবার যে মোহনের আর রক্ষা নেই, তা’ আমার মন বলচে।”
সহসা রমা আনন্দে উত্তেজিত হ’য়ে নিষ্ঠুর স্বরে বললে, “যদি উনি দস্যুকে ধরতে পারেন, তবে আমার চেয়ে বেশী খুশি আর কেউ হবে না। তা হলে আমরা একটু অপেক্ষা করি এসো, কিশোর। দস্যু ধরা পড়লে, তাকে দেখে তবে যাবো আমরা। সত্যি, দস্যু-মোহনকে দেখতে এত ইচ্ছে হচ্ছে আমার!”
আমি বললুম, “বেশ তাই হবে। কিন্তু আমার বিশ্বাস, মোহন আগে কিছুতেই নামতে চাইবে না। যখন চেয়ে চেয়ে মিঃ বেকার বিরক্ত হয়ে উঠবেন, দৃষ্টি ক্লান্ত হয়ে পড়বে, তখনই সে নামতে ভরসা পাবে।”
রমা বললে, “এমনও তো হতে পারে, দশ্যু বহু পূর্বেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে পালিয়েছে।”
আমি বললুম, “না, তা সম্ভব ছিল না। কারণ ক্যাপ্টেন দিনে ও রাত্রে জাহাজের পাশে বন্দুক হাতে কয়েক জন প্রহরী নিযুক্ত করেছিলেন। তাদের ওপর হুকুম ছিল, কাউকে পালাতে দেখলেই নির্বিচারে গুলি চালাতে। ও-সব কথা থাক! ঐ দেখ যাত্রীরা নামতে শুরু করেছে।”
চেয়ে দেখলুম বেকার সাহেব, নির্বিকার ভাবে যাত্রীদের অবতরণ লক্ষ্য করছেন, আর জাহাজের একজন অফিসার তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে কানে কানে মাঝে মাঝে বোধ হয় যাত্রীদের পরিচয় দিচ্ছেন
একে একে বহু যাত্রী নেমে যাবার পর আমাদের প্রফুল্ল মিত্র যাচ্ছে দেখে রমা বললে, “ঐ দস্যু-মোহন যাচ্ছে। এখনি ওকে গ্রেপ্তার করবে : দেখো!”
প্রফুল্ল সিঁড়ির মুখে যা’বার পূর্ব মুহূর্তে আমি রমাকে বললুম, “রমা, আমার ইচ্ছা যায়, প্রফুল্ল ও বেকার সাহেবের একসঙ্গে একটা ছবি তুলি, কিন্তু আমার হাত ঘোড়া, তুমি যদি পারো তো ভাল হয়।”
রমা ব্যস্তভাবে আমার হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলবার চেষ্টা করলে – কিন্তু পারলে না। ওদিকে যে-মুহূর্তে প্রফুল্ল মিত্র সিঁড়ির মুখে পা বাড়িয়েছে, অমনি জাহাজের অফিসার মিঃ বেকারকে কিছু বললেন, কিন্তু বেকার সাহেব নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রফুল্ল মিত্র নেমে গেল।
‘আমি দেখলুম, পাঁচ-সাতজন ছাড়া আর কোন যাত্রীই নেই। বললুম, “এস রমা, এবার আমরা যাই।”
আমার পিছনে ক্যামেরা হাতে রমা অগ্রসর হ’ল। আমরা যেমন সিঁড়ির মুখে এসেছি, অমনি বেকার সাহেব আমার দিকে চেয়ে বললেন, “দয়৷ ক’রে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন।”
আমি তপ্ত হয়ে বললুম, “কেন? আমার সময় নেই। পথ ছাড়ুন।”
“আহা! এত তাড়া কিসের বলুন তো আপনার?” বেকার সাহেব পথ রোধ ক’রে আমার মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে চাইলেন।
আমি ক্রোধে উত্তেজিত হ’য়ে বললুম, “এর মানে? ঢাকার পুলিস-ম্যাজিস্ট্রেট্ কিশোর চন্দকে আটক করবার সাহস আপনার আছে?”
মিঃ বেকার শান্তস্বরে বললেন, “ঢাকার ম্যাজিস্টেট্ মিঃ চন্দ আজ তিন বছর হ’ল মারা গেছেন।” আবার বললেন, “মোহন না?” বলেই হঠাৎ আমার মাথার উপর আনন্দচ্ছলে একটা আঘাত করলেন।
আমি যাতনায় চিৎকার কোরে উঠলুম। সেদিন মাদ্রাজে এক ধনীর সর্বস্ব লুট করে পালাবার সময়, তিনতলার ছাদ থেকে লাফাতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিলুম, সে ঘা তখনও সারে নি।
বেকার সাহেব অদূরে অপেক্ষমাণ দু’জন পুলিস-অফিসারকে ইঙ্গিত করলেন, তা’রা আমার দু পাশে এসে দু’জনে দাঁড়ালো। আমি অবশেষে গ্রেপ্তার হলুম!
আর রমা! সে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল ও দেখছিল। তা’র মুখের দিকে চেয়ে আমার মনে হ’ল, সে এখনি বুঝি মূর্ছা যাবে। কিন্তু অতিকষ্টে সে আত্মসম্বরণ কোরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। আমি একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। রমার হাতে আমার ক্যামেরা ছিল। প্রথমে আমার ভয় হ’য়েছিল, রমা ঐ ক্যামেরা আমাকে ফেরত দিতে চাইবে। কিন্তু বুদ্ধিমতী শিক্ষিতা মেয়ে আমার মুখের দিকে একবার চেয়ে আমার মনের কথা বুঝেছিল। সে ক্যামেরা হাতে কোরে সিঁড়ির অর্ধপথ নেমে সহসা টাল খেয়েছে, এমন ভাব দেখিয়ে ক্যামেরাটি হাত থেকে নদীর জলে ফেলে দিল। ক্যামেরার ভিতর কয়েক সহস্ৰ টাকার হীরা ও নোট ছিল। যাক্, আমার বিরুদ্ধে জ্বলন্ত প্রমাণ আপাততঃ ইরাবতী গর্ভে আশ্রয় নিলে! বেকারের সন্দেহ পর্যন্ত হ’ল না।
জেটিতে নেমে রমা দ্রুতপদে চলে গেল, একবারও পিছু ফিরে চাইল না। যখন সে অদৃশ্য হ’য়ে গেল, তখন আমার মুখ থেকে আমার অজ্ঞাতে বার হ’ল, “দুঃখ এই, আমি একটা হীন দস্যু, তা’ই অমন নারী-রত্নে বঞ্চিত হলুম!”
আমার পুরাতন বন্ধু বেকার সাহেব সবিস্ময়ে আমার মুখের দিকে একবার চাইলেন, পরে অফিসারদের দিকে চেয়ে আমাকে জেলে দিয়ে যাবার হুকুম দিয়ে বললেন, “এতদিন পরে তোমার অদৃষ্ট তোমাকে প্রতারিত করলে, মোহন। লক্ষ্মী ছেলের মত চলে এসো।”
* * *
শ্রীমতী রমার সহিত প্রথম পরিচয়ের এবং স্বীয় প্রথম কারা- বরণের কাহিনী, মোহন তাহার কোন বন্ধুর নিকট গল্প করিয়া- ছিল। আমরা তাহা অবিকল উদ্ধৃত করিয়া দিলাম।
৯
রেঙ্গুন হইতে মোহনকে সশস্ত্র পুলিস-পাহারায় মাদ্রাজে আনিয়া ভারতের সর্বাপেক্ষা সুরক্ষিত জেলে রাখা হইয়াছে। তাহার সর্বশেষ কীর্তি মাদ্রাজের কোন ধনীর সম্পদ-লুণ্ঠন। সুতরাং ঐ অপরাধের বিচার মাদ্রাজে হইবে বলিয়াই তাহাকে বিচারাধীন ভাবে সেখানে রাখা হইয়াছে। তাহার উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখিবার জন্য সুপ্রসিদ্ধ ডিটেকটিভ, এবং দস্যু মোহনের একমাত্র যোগ্য-শত্ৰু মিঃ বেকারকেও সাময়িক ভাবে মাদ্রাজের আই, বি, তে বদলী করা হইয়াছে।
দস্যু মোহনের বিস্ময়কর গ্রেপ্তারের ইতিহাস উপর্যুপরি কয়েকদিন ধরিয়া ভারতের বিভিন্ন সংবাদ-পত্রে প্রকাশিত হইতে- ছিল। মোহনের গ্রেপ্তারে দেশের অভিজাত ধনী-সম্প্রদায়, রাজা, মহারাজাগণ পুলিস বিভাগ সকলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিয়াছেন। যাহাতে দস্যুকে চরম শাস্তি দেওয়া হয়, তাহা দাবী করিয়া দিনের পর দিন কয়েকটি কাগজে নানা ভাবে প্রবন্ধ বাহির হইতেছিল।
কিন্তু সত্য কথা বলিতে কি, দেশের বহু দরিদ্র, অনাথ-আতুর সম্প্রদায় এই সংবাদে মর্মাহত হইয়া গোপনে চক্ষুর জল ফেলিয়া ভগবানের নিকট দিবারাত্র প্রার্থনা করিতেছে, যেন মোহনের কোন শাস্তি না হয়।
যাহা হউক, মোহন গ্রেপ্তার হইয়াছে এবং এক অতি- সুরক্ষিত জেলে সশস্ত্র পাহারার অধীনে তাহাকে রাখা হইয়াছে। মোহনের বিরুদ্ধে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পুলিস ছয় মাসের সময় গ্রহণ করিয়াছে। সুতরাং সংবাদ- পত্রের উত্তেজনামূলক আলাপ-আলোচনা, সাধারণের জল্পনা- কল্পন৷ একমাস অতীত হইতে না হইতে ধীরে ধীরে নিঃশেষে রুদ্ধ হইয়া গেল। দস্যু মোহন তাহার বিচারের অপেক্ষায় জেলের এক দুর্ভেদ্য সেলে পড়িয়া রহিল। সংসার ও বৃহত্তর জগৎ তাহাকে ভুলিয়া দৈনন্দিন বাঁধা ধরা গতিতে চলিতে আরম্ভ করিল।
১০
বাঙলার মুসলমান রাজত্বের অবসানে যে-সব স্বাধীন বাঙালী- রাজা ইংরাজের বশ্যতা স্বীকার করিয়া কয়েক পুরুষ শান্তিতে বাস করিয়া অবশেষে লয় পাইয়া যাইতেছিলেন, তাঁহাদের মধ্যেই এক অতিশয় ধনবান রাজার বংশধর, অতীতের ধনসম্পদ লইয়া, পুরীর স্বর্গদ্বারের পিছনে এক দুর্গ তুল্য প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া বাস করিতেছিলেন। রাজকুমারের সংসারে স্ত্রী, পুত্র পরিজন কেহ ছিল না। তাঁহার বয়স প্রায় ৬৪ বৎসর। তিনি স্বাধীন রাজার যুগযুগ ধরিয়া সঞ্চিত ঐশ্বর্যসমূহ পুরুষানুক্রমে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। যে সব মহামূল্য হীরক, মণি-মুক্তা ও প্রস্তর- রাজির অধিকারী তিনি হইয়াছিলেন, এতাবৎ তাহার কণামাত্রও অপব্যয় করেন নাই। উপরন্তু তিনি সেই সমস্ত ধন-সম্পদ অতি সাবধানতার সহিত বৃহৎ লৌহ সিন্দুক সমূহে পূর্ণ করিয়া, দুর্গ প্রাসাদের অভ্যন্তরে গুপ্ত-কক্ষ নির্মাণ করিয়া, তাহার মধ্যে রাখিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহার সম্বন্ধে এই ইতিহাস সাধারণ্যে প্রচারিত হইয়াছিল যে, তিনি অত্যন্ত কৃপণ, ভিখারীকে ভিক্ষা দেন না, প্রার্থীকে দান করেন না। অত বড়ো দুর্গ-প্রাসাদ যেন মাত্র কয়েকজন ভৃত্য লইয়া বাস করেন।
তিনি অপব্যয়ের মধ্যে নানা ভাষায় প্রচারিত নানা সংবাদ-পত্ৰ পাঠ করিতেন। প্রতিদিন প্রাতঃকালে তাঁহার ড্রইংরুমের টেবিলের উপর আট দশখানা সংবাদ-পত্রের সমাবেশ হইত। তিনি সমস্ত দিন ধরিয়া সংবাদ-পত্রের মধ্য দিয়া জগতের সঙ্গে পরিচিত হইতেন।
সেদিন প্রভাতে অন্যান্য দিনের মত যে-পোষ্ট-পিয়ন গত পঞ্চদশ বৎসর ধরিয়া তাঁহাকে সংবাদ-পত্র সরবরাহ করিতে- ছিল, সে আসিয়া ড্রইং-রুমের দ্বারে নিয়মিত মৃদু আঘাত করিল।
বৃদ্ধ রাজকুমার নিত্যবিক্রম দ্বার খুলিবার পূর্বে নিয়মিত সতর্ক দৃষ্টিপাতে পিয়নকে উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া অর্গলমুক্ত করিলে, পিয়ন হাসিয়া কহিল, “ভয় নেই হুজুর, আমি সেই গঙ্গাধরই এসেছি। ছদ্মবেশে অন্য কেউ আসে নি।”
নিত্যবিক্রম কহিলেন, “কিছু বলা যায় না হে, যে দিনকাল পড়েছে।”
পিয়নের হাত হইতে সংবাদ-পত্রের তাড়াটি লইয়া রাজকুমার দ্বার বন্ধ করিবার উপক্রম করিলে, পিয়ন কহিল, “আজ একটা নতুন বস্তু আছে, হুজুর।”
“নতুন বস্তু!” রাজকুমার বিস্মিত দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন। পিয়ন হাসিতে হাসিতে কহিল, “আপনার নামে একখানা রেজেষ্ট্রী-পত্র এসেছে, হুজুর। এই নিন্—রসিদে সই কোরে দিন।”
বৃদ্ধের বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। গত পঞ্চদশ বৎসর ধরিয়া তিনি পুরীর প্রাসাদে বাস করিতেছেন। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব-শূন্য বলিয়া কাহারও নিকট হইতে কখনও কোন পত্র পান নাই। তাঁহাকে কে আবার পত্র লিখিল?
যাহা হউক, রাজকুমার অসন্তুষ্ট ও সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া রসিদখানি সহি করিয়া দিলেন এবং পিয়ন যে পর্যন্ত না দৃষ্টির বাহির হইয়া গেল, তিনি দ্বার ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন এবং পরে দ্বার উত্তমরূপে বন্ধ করিয়া দিয়া একখানি চেয়ারে উপবেশন করিয়া রেজেঙ্গী-পত্রখানি কম্পিত হস্তে খুলিয়া ফেলিলেন। |
“মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি” নিম্নে দেখিলেন, “দস্যু মোহন” নাম সহি করিয়াছে।
বৃদ্ধের হাত হইতে পত্রখানি কাঁপিতে কাঁপিতে পড়িয়া গেল। তিনি বহুক্ষণ নিশ্চেষ্ট ভাবে বসিয়া রহিলেন; পরে পত্রখানি হস্তে তুলিয়া লইয়া পাঠ করিতে লাগিলেন।
পত্রখানি আমরা নিম্নে অবিকল উদ্ধৃত করিলাম।
“মহাসম্মানিত প্রিয় রাজকুমার নিত্যবিক্রম!
আপনার দুর্গ-প্রাসাদের হলের নিম্নে যে লৌহনির্মিত গুপ্ত প্রকোষ্ঠ আছে, তাহার মধ্যে উত্তর-দিকের সিন্দুকে আপনার পিতৃ-পুরুষদের নানা প্রদেশ হইতে লুন্ঠিত বহুমূল্য হীরক, মণি- মুক্তা প্রভৃতি আছে—তা’র সবগুলি এবং পূর্বদিকে যে হস্তী-দন্ত নির্মিত, অধুনা-দুষ্প্রাপ্য লিখিবার একখানা টেবিল, চারখানা অপরূপ ধরণের ও আকৃতি বিশিষ্ট বসিবার কেদারা আছে—সে- গুলি এবং রৌপ্য ও স্বর্ণ-নির্মিত ছোট আলমারি [যাহা খুলিয়া টুকরা টুকরা করা যায়] সেইটি, সবগুলিকে ভিন্ন ভিন্ন বাক্সে উত্তম রূপে বন্ধ করিয়া আমার নামে মাদ্রাজের ঠিকানায়, পত্র প্রাপ্ত হইবার এক সপ্তাহ মধ্যে রেলওয়ে পার্শেলে পাঠাইয়া দিবেন।
বলা বাহুল্য, আপনি যদি আমার অনুরোধ মত কার্য না করেন, তবে আমি আগামী ১২ই বৈশাখ শুক্রবার (আপনার পত্র প্রাপ্তির ঠিক এক সপ্তাহ পরে) রাত্রি ঠিক ১১টার সময় স্বয়ং উপস্থিত হইব এবং আমার ইচ্ছা কার্যে পরিণত করিব। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমি যে কেবল ঐ বস্তুগুলি লইয়াই সন্তুষ্ট হইব, তাহা শপথ করিয়া বলিতে পারি না। অধিক লেখা বাহুল্য মাত্ৰ।
আপনারই বশম্বদ
মোহন”
পুনশ্চঃ
“দেখিবেন, যেন হস্তীদন্ত-নির্মিত বড় চেয়ারগুলি পাঠাইবেন না। কারণ আমি জানি সেগুলি আসল হাতীর দাঁতে তৈরী নয়। আর শুধু স্বর্ণে নির্মিত বড় আলমারিটাও আমাকে পাঠাইবেন না যেন, কারণ তাহা যে বাজে পান-মরা সোনায় তৈরী তা’ও আমি বিশেষ ভবে জানি। স্মরণ রাখিবেন, উত্তর দিকের ছোট সিন্দুক- টার সব হীরাগুলোই যেন পাঠানো হয়। একটা পিস কম হইলেও আমি জানিতে পারিব।”
পত্রখানি মহারাজকুমার নিত্যবিক্রমের মনে মহা ঝড় প্রবাহিত করিল। যদি পত্রখানি বস্থ্য মোহনের নিকট হইতে না আসিত তাহা হইলেও তিনি অস্থির হইতেন, কিন্তু এতটা পরিমাণে নহে।
তিনি নিত্য সংবাদ-পত্র অধ্যয়ন করেন। ভারতে, এমন কি সারা পৃথিবীতে যখন যেখানে কোন প্রসিদ্ধ চুরি-ডাকাতির খবর বাহির হইয়াছে, তিনি পাঠ করিয়াছেন। সে সকল বিষয় তাঁহার কণ্ঠস্থ বলিলেই চলে। তিনি উত্তমরূপেই জানিতেন, দস্যু মোহন ধরা পড়িয়াছে। সশস্ত্র পাহারায় তাহাকে মাদ্রাজে আনিয়া সুরক্ষিত জেলে আবদ্ধ রাখা হইয়াছে। তিনি আরও জানিতেন, তাহার উপর লক্ষ্য রাখিবার জন্য বিশেষ-পুলিসের বিশেষ বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। মোহন তাহার শত্রু বেকার সাহেবের দ্বারা যে-ভাবে গ্রেপ্তার হইয়াছে, সে খবরও তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে রাখিতেন। কিন্তু দস্যুর তাঁহার প্রাসাদ সম্বন্ধে এরূপ নিখুঁত জ্ঞান কি করিয়া সম্ভব হইল ভাবিয়া, তাঁহার বিস্ময় ও ভয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল।
তাহা ছাড়া গুপ্ত ভূগর্ভস্থ কক্ষে কোথায় কোন সিন্দুকে তিনি কি রাখিয়াছেন, সে সম্বন্ধে এরূপ নির্ভুল জ্ঞান পরম বিস্ময়ের বস্তু নহে কি? রাজকুমার আপনাকে আপনি প্রশ্ন করিল।
সবার উপর—দস্যু মোহন কখন কাহাকেও যে মিথ্যা ভয় দেখাইয়াছে, তাহ। রাজকুমারের মনে পড়িল না। রাজকুমার নিত্যবিক্রমের স্মরণ হইল, মোহন কামরূপের মহারাজার প্রাসাদে পত্র লিখিয়া দিন স্থির করিয়া, এমন কি যে সময়ে সে উপস্থিত হইবে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সেই সময়ে উপস্থিত হইয়া, তাহার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিয়াছিল। কেহই মহারাজাকে রক্ষা করিতে পারে নাই। মহারাজা মোহনের পত্রকে একটা বিরাট ঠাট্টা ভাবিয়া নিশ্চিন্তমনে নিদ্রা দিয়াছিলেন, তাই তাঁহাকে লুণ্ঠিত হইতে হইয়াছে।
কিন্তু যে-সব রত্নরাজি, মহামূল্য দ্রব্যসমূহ কখনও লোকচক্ষুর বাহিরে আসে নাই, সে-সব অতি গোপনীয় বস্তুর খবর দস্যু মোহনকে কে সরবরাহ করিল? তাঁহার ভৃত্যেরা? মহারাজার মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি মনে মনে বলিলেন, “দীর্ঘ পনেরো বছরের মধ্যে একদিনের জন্যও কোন ভৃত্য কোন সন্দেহের অবকাশ রাখে নাই। তাহা ছাড়া তিনি কোন ভৃত্যকে ভূগর্ভস্থ কক্ষে কখন লইয়াও যান নাই। তবে?”
মহারাজকুমার বহুক্ষণ চিন্তামগ্ন রহিলেন। তাঁহার অতি প্রিয়তম বিলাস সংবাদ-পত্রও অধ্যয়ন করা হইল না। তিনি অস্থির চিত্তে পদচারণা করিতে আরম্ভ করিলেন।
এখন কি করিবেন তিনি? কামরূপের মহারাজার মত নিশ্চয়ই তিনি মোহনের পত্রকে উপেক্ষা করিবেন না।
দস্যু মোহন জেলে আবদ্ধ। অথচ সে তাঁহাকে পত্র লিখিয়া বহুলক্ষ টাকা মূল্যের রত্নরাজি দাবি করিল, ইহা কিরূপে সম্ভব হইতে পারে? কুমার নিত্যবিক্রমের শ্লথ শিরাসমূহ ফুলিয়া উঠিল। তিনি মনে মনে কহিলেন, “দস্যু মোহনের পক্ষে অসম্ভব বলিয়া কোন বিষয় আছে কী? নাই। তবে সে যে তাহার ইচ্ছা পূর্ণ করিবে না, এমন কথা কে জোর করিয়া বলিতে পারে? আমি পারি না।”
বৃদ্ধ রাজকুমার ড্রইংরুমের দ্বার চাবিবদ্ধ করিলেন এবং প্রায় দুই বৎসরের মধ্যে এই প্রথম তাঁহার মোটর বাহির করিতে আদেশ দিলেন।
তিনি সর্বরকমে নিশ্চিন্ত হইয়া, যাহা চাবী-বদ্ধ করিবার করিয়া, মোটরে আরোহণ করিয়া স্বয়ং পুরীর পুলিস সুপারের অফিসে উপস্থিত হইলেন।
পুলিস-সুপার মাননীয় অতিথির আগমনের হেতু অবগত হইয়া হাসিয়া ফেলিলেন এবং পত্রখানি বারবার পাঠ করিয়া, হাস্যমুখে কহিলেন, “কুমার নিত্যবিক্রমের সঙ্গে কেউ বিদ্রূপ করেছে।”
রাজকুমারের মুখ পুলিস সাহেবের কথায় অধিক পরিমাণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইল। তিনি কহিলেন, “দস্যু মোহনের পক্ষে অসম্ভব কিছু নেই। আর সে তথ্য আমার অপেক্ষা আপনার বেশী জানা উচিত ছিল।”
মহারাজার তীব্র শ্লেষে পুলিশ সুপার গম্ভীরমুখে কহিলেন, “আপনি ভুলে যাচ্ছেন, মোহন মাদ্রাজ-জেলে বিচারের অপেক্ষা করছে।”
কুমার কহিলেন, “তা”র পক্ষে অমন একটা দেশী-জেল ভেঙ্গে বা’র হ’য়ে আসা এতটু অসম্ভব হবে না।”
পুলিস সুপার কিছু সময় চিন্তা করিয়া কহিলেন, “এই দস্যুটার ওপর এত বেশী অলৌকিকত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সী-জেলের মত অতি সুরক্ষিত কারাগার সম্বন্ধেও আপনাদের মত বিশিষ্ট ব্যক্তির অশ্রদ্ধার ভাব মনে উদয় হ’বার সম্ভাবনা হয়। সে যা’ই হোক, আমি এখনি টেলিগ্রাফ কোরে দস্থা মোহনের খবর আনিয়ে নিচ্ছি।”
তখন টেলিফোনের এরূপ বিস্তৃতি ছিল না। পুলিস সুপার জরুরী তার পাঠাইয়া দিলেন এবং রাজকুমারকে কহিলেন, “তারের জবাব এলেই আমি আপনার প্রাসাদে দেখা করবো।”
মৌখিক ধন্যবাদ দিয়া কুমার নিত্যবিক্রম আপন প্রাসাদে ফিরিয়া আসিলেন।
১১
মহারাজা কুমারের সকল শান্তি মন হইতে নির্বাসিত হইল। তিনি প্রাসাদে ফিরিয়া গুপ্ত সুড়ঙ্গ-পথে ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করিলেন। মাতা যেরূপ পীড়িত শিশুর দিকে সস্নেহ-কাতর দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকে, ঠিক সেই রকম দৃষ্টিতে কুমার বহু পুরুষ ধরিয়া সঞ্চিত ধনরাজির দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন।
তিনি উত্তর দিকের ছোট সিন্দুকটা চাবী-মুক্ত করিয়া উন্মুক্ত করিলেন। রত্ন রাজি ঝলমল করিয়া জ্বলিয়া উঠিয়া তাঁহার চক্ষু অশ্রুসিক্ত করিয়া দিল। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া চিন্তা করিলেন, এই সব বক্ষ-ৱক্ত অপেক্ষা প্রিয় বস্তু সমূহকে হারাইতে হইবে! এরূপ চিন্তা কুমারের পক্ষে অসম্ভব। তিনি দ্রুতহস্তে সিন্দুক তালা বন্ধ করিয়া কক্ষময় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া মনে হয়, যেন একটা জীবন্ত যক ধনরাজি আগুলিয়া অতৃপ্তিতে অস্থির হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে! কিছু সময় এইরূপে ঘুরিয়া বেড়াইয়া কুমার ভূগর্ভস্থ কক্ষে সুবৃহৎ তালা বন্ধ করিয়া উপরে উঠিয়া আসিলেন।
সে দিন তাঁহার আহারে তৃপ্তি রহিল না। তিনি কোন রকমে সামান্য কিছু আহরে করিয়া ড্রইংরুমে পুলিস সুপারের অপেক্ষায় বসিয়া রহিলেন।
তিনি ভাবিতে লাগিলেন, “আজ হইতে এক সপ্তাহ পরে শুক্রবার রাত্রিতে দস্যু মোহন তাঁহার বহু পবিত্র স্মৃতি-মণ্ডিত, বহু পুরুষানুক্রমে সঞ্চিত অমূল্য ধনরাজি লুণ্ঠন করিবে।” এই চিন্তা তাঁহাকে উন্মাদ করিয়া তুলিল।
অপরাহ্ন ৪টার সময় পুলিস-সুপার মিঃ ব্রাইট আগমন করিলেন। তিনি ড্রইংরুমে প্রবেশ করিয়া বসিবার পূর্বেই কুমারের হাতে একখানি টেলিগ্রাফের ফরম দিয়া কহিলেন, “এই দেখুন, আমি যা বলেছিলাম, তা সত্য কিনা?”
কুমার নিত্যবিক্রম আগ্রহ সহকারে তারটি পাঠ করিয়া দেখিলেন, লেখা আছে, “দস্যু মোহন বিশেষ পাহারাধীনে জেলে আবদ্ধ আছে—বাহিরে পত্র লিখিবার বা পাঠাইবার কোন অধিকার তাহার নাই। “
পুলিস সুপারের হাস্যময় মুখের দিকে চাহিয়া কুমার কহিলেন, “তবে এই পত্র কে লিখেছে? এই হস্তাক্ষর কি দশ্য মোহনের নয়?”
পুলিস সুপার পুনরায় পত্রখানি পরীক্ষা করিয়া কহিলেন, “যদিও এই লেখা মোহনের বোলেই আমার মনে হ’চ্ছে, তা হ’লেও নকল করা চলে না কী? এমনও হ’তে পারে, অন্য কোন বদমাশ আপনাকে ভয় দেখাবার জন্য হস্তাক্ষর নকল কোরে পত্র দিয়েছে। সে যাই হোক, আমি পত্রখানা হস্তাক্ষর-বিশেষজ্ঞের নিকট পাঠিয়ে দেখি, সত্যই এটা আসল কি নকল!”
পুলিস সুপার নানারূপে কুমারকে আশ্বাস দিয়া মোহনের পত্রখানি লইয়া চলিয়া গেলেন।
পরদিন হস্তাক্ষর-বিশেষজ্ঞের নিকট হইতে জবাব আসিল, “যদিও পত্রের লেখা অনেকটা দস্যু মোহনের মত, তাহা হইলেও এ-পত্র তাহার দ্বারা লিখিত হয় নাই।”
পুলিস-সুপারের যেটুকু সন্দেহ ছিল, তাহাও নিঃশেষে দূর হইয়া গেল। তিনি ম্লান মুখে সম্মুখে উপবিষ্ট কুমার নিত্য- বিক্রমের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আপনাকে কোন দুষ্ট লোক মিছামিছি ভয় দেখিয়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে নিয়ে আর মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। কারণ দস্যু মোহন কারাগারে যেরূপ প্রহরী-বেষ্টিত হ’য়ে গাছে, তা’র পক্ষে এ রকম যাদুকর হওয়া অসম্ভব ব্যাপার তো নিশ্চয়ই, উপরন্তু এই ব্যাপার নিয়ে কোন প্রতিরোধ-ব্যবস্থা করা একেবারে বাতুলের কাজ হবে। আপনি নিশ্চিন্ত মনে নিদ্ৰা যা’ন! কিছুই ঘটবে না, দেখবেন!”
পুলিস সুপারের অফিস হইতে নিরাশ হইয়া প্রত্যাবর্তন করিয়া কুমার নানারকমে মনকে প্রবোধ দিতে লাগিলেন। তিনি ভাবিলেন, যে-লোক ইংরাজের সুরক্ষিত কারাগারে আছে সে- লোকের পক্ষে এতটা পথ আসিয়া চুরি করিয়া যাওয়া ‘অসম্ভব বলিয়াই বোধ হয়। যে-ব্যক্তি অদ্য পর্যন্ত সুরক্ষিত-জেলে পাহারাধীনে আবদ্ধ রহিয়াছে, তাহার পক্ষে এই দীর্ঘ পথ অতি- ক্রম করা অসম্ভব নহে কী?
এইরূপ সম্ভব অসম্ভব চিন্তা করিয়াও কুমার মনের শান্তি ফিরিয়া পাইলেন না। চতুর্থ দিবসে তিনি যখন সংবাদ-পত্র পাঠ করিতেছিলেন, তখন একটি সংবাদ দেখিয়া আনন্দে উত্তেজনায় লাফাইয়া উঠিলেন।
‘ভুবনেশ্বর গেজেট’ পত্রিকায় নিম্নলিখিত সংবাদটি বাহির হইয়াছিল :—
“সুপ্রসিদ্ধ চীফ ডিটেকটিভ মিঃ বেকার তিন সপ্তাহের ছুটি উপভোগ করিবার জন্য ভুবনেশ্বরে আসিয়াছেন। তিনি মৎস্য শিকারে উৎসাহী বলিয়া, ভুবনেশ্বরের ঝিল ও হ্রদের আকর্ষণে আমাদের পুরাতন শহরকে সম্মানিত করিয়াছেন। আমরা তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করিতেছি।
মিঃ বেকার সুপ্রসিদ্ধ দস্যু মোহনকে রেঙ্গুনে গ্রেপ্তার করিয়া যে-প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, তেমন সম্মান অনেকের পক্ষেই হিংসার বস্তু। তাঁহার অবসর আনন্দময় হউক, এই আমরা প্রার্থনা করিতেছি।”
বৃদ্ধ কুমারের মুখ আলোকিত হইয়া উঠিল। তিনি সম্মুখের টেবিলের উপর চপেটাঘাত করিয়া কহিলেন, ‘যাঁহাকে মনে প্রাণে কামনা করছিলাম, ভগবান তাঁহাকেই আনিয়া দিয়াছেন। জয় ভগবান! আর আমার মোহনের জন্য চিন্তা নাই?’
কুমার সে দিন নিয়মিত সময়ের পূর্বেই আহার সমাধা করিয়া আপন মোটরে ভুবনেশ্বর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। ভুবনেশ্বরে উপস্থিত হইয়া তিনি প্রথমে ‘ভুবনেশ্বর গেজেট’ পত্রিক৷ অফিসে গমন করিয়া, যে রিপোর্টার মিঃ বেকারের সংবাদ ছাপিয়াছিলেন, তাঁহার সহিত দেখা করিয়া, মিঃ বেকারের ঠিকানা জানিতে চাহিলেন। রিপোর্টার কহিলেন, “মিঃ বেকারের কথা জিজ্ঞাসা করছেন? সোজা চলে যান। প্রথমেই যে ‘বুড়ী হ্রদ’ পাবেন, তা’র তীরে একটা গাছের তলায় হাফ খাকী-প্যান্ট ও টুপি মাথায় বুড়ো বেকার মাছ ধরচেন।”
কুমার সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “আপনারা তাঁর খবর পেলেন কি কোরে?”
রিপোর্টার বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিলেন, “আরে মশায়, কাগজের রিপোর্টারদের অসাধ্য কর্ম কিছু আছে না-কী? কাল যখন ঐ হ্রদের ধার দিয়ে আসছিলুম, দেখি একজন সাহেব মাছ ধরছেন। আমি নিঃশব্দে তাঁর পিছনে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি, ছিপের বাঁটের ওপর পরিষ্কার অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘ডিটেকটিভ ইস্পেক্টার বেকার।’ আর যায় কোথায়! আলাপ করতে চাইলুম, কিন্তু বুড়ো বড়ো কম কথা বলেন, মশায়। বলেন, ‘আমি এখানে মাত্র তিন সপ্তাহের ছুটিতে অবসর বিনোদনে এসেছি, এ সময়ে অফিস সংক্রান্ত কিম্বা দস্যু মোহন সংক্রান্ত কোন প্রশ্নে সময় নষ্ট করবার ইচ্ছা আমার নেই। আপনার পথ দেখুন আপনি!’ ভারী বদ মেজাজী লোক মশায়!”
কুমার নিত্যবিক্রম ভাবিলেন, ‘তার মত বিখ্যাত লোক এই রূপ একটী কাগজের একজন নগণ্য রিপোর্টারের সঙ্গে আলাপ করলেই আশ্চর্যের বিষয় হ’তো। তিনি মৌখিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিয়া, রিপোর্টার-নির্দেশিত পথে মোটর চালাইবার আদেশ দিলেন এবং অল্প সময় পরে ‘বুড়ী হ্রদের’ ধারে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, সতা সত্যই মিঃ বেকার একটা গাছের তলায় উপবেশন করিয়া ফাৎনার দিকে চাহিয়া, ছিপ ফেলিয়া বসিয়া আছেন।
কুমার মোটর হইতে অবতরণ করিয়া ধীরে ধীরে মিঃ বেকারের নিকট গমন করিলেন এবং নিজের পরিচয় দিয়া আপন আগমন উদ্দেশ্য সবিস্তারে ব্যক্ত করিলেন।
মিঃ বেকার নিঃশব্দে শ্রবণ করিলেন। যতক্ষণ কুমার কথা কহিতেছিলেন, তিনি জলের উপর ভাসমান ফানার দিকে এক- দৃষ্টে চাহিয়া বসিয়াছিলেন। কুমারের বক্তব্য শেষ হইলে তিনি গম্ভীর মুখে আগন্তুকের পা হইতে মাথা পর্যন্ত একবার চক্ষু বুলাইয়া লইয়া বিরক্তস্বরে কহিলেন, “দস্যুরা কখনও পূর্বাহ্ণে পত্র লিখে চুরি করতে আসে না, মশায়। তা ছাড়া দশ্যু মোহনকে আমি যতদূর জানি, সে এমন ভাবে সময় নষ্ট করতে ঘৃণা বোধ করে।”
কুমার আগ্রহভরে কহিলেন, “তবুও তো বলা যায় না, মিঃ বেকার?”
মিঃ বেকার কহিলেন, “আমার যদি বিন্দুমাত্রও সন্দেহ থাকতো যে আমার পুরাতন বন্ধু দস্যু মোহনের আগমন সম্ভব হ’বে, তবে আমি সানন্দ চিত্তে তা’কে আর একবার গ্রেপ্তার করবার দায়িত্ব গ্রহণ করতাম। আপনি মিথ্যে সময় নষ্ট করছেন, কুমার। দস্যু মোহন ভারতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সুরক্ষিত কারাগারে আবদ্ধ আছে।”
কুমার বিষণ্ন মুখে কহিলেন, “সে যদি জেল হইতে পালায়?”
“মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী-জেল থেকে মানুষ পলাতে পারে না কুমার।” মিঃ বেকার নীরস স্বরে কহিলেন।
“অন্য মানুষ না পারুক, দস্যু মোহন পারে না এমন কাজ কি আছে, মিঃ বেকার?” কুমার আগ্রহভরে প্রশ্ন করিলেন।
মিঃ বেকার কহিলেন, “দস্যু মোহনও মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নয়।”
কুমার কথার উপর জোর দিয়া কহিলেন, “কিন্তু ‘যদি’র কথা তো বলা যায় না! যদিই সে সক্ষম হয়, মিঃ বেকার?”
“উত্তম! যদি সে পলায়ন করতে সক্ষম হয়, তা’ হ’লে আমি তা’কে আবার গ্রেপ্তার করবো। কিন্তু দোহাই আপনার, মিথ্যে মিথ্যে নিজেকে অস্থির করবেন না। বাড়ী গিয়ে সুনিদ্রা দিন। আর মাছ ধরতে বিঘ্ন উৎপাদন করবেন না, এই অনুরোধ আমার রক্ষা করুন।” মিঃ বেকার গম্ভীর মুখে কহিলেন।
কুমার বুঝিলেন, মিঃ বেকার কিছুতেই বিশ্বাস করিবেন না বা আর এ বিষয়ে আলাপ করিবেন না। তিনি ক্ষুণ্ন মনে আপন প্রাসাদে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি মনে মনে এই ভাবিয়া শান্তি পাইলেন যে, মিঃ বেকার বলিয়াছেন, দস্যুরা পত্র দিয়া পূর্বাহ্ণে জানাইয়া চুরি করতে আসে না। সবার উপর মিঃ বেকারের নির্বিকার ভাব দেখিয়া তাঁহার ধারণা হইল, যদি মোহনের জেল হইতে পলায়নের বিন্দুমাত্রও সম্ভাবনা থাকিত, তাহা হইলে মিঃ বেকারের মত দায়িত্ব-সম্পন্ন অফিসার কখনও এমন নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিতেন না।
কমার বিশেষরূপেই জানিতেন, মিঃ বেকারের মত দস্য মোহনের যোগ্য জাত-শত্রু আর কেহ নাই। সুতরাং মিঃ বেকার যখন তাঁহার কথা বিন্দুমাত্র সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিলেন না, তখন নিশ্চয়ই কোন দুষ্ট লোকে তাঁহাকে ভয় দেখাইবার জন্য এইরূপ করিয়াছে, বলিয়া তাঁহার ধারণা হইল।
তাঁহার মন অপেক্ষাকৃত শান্ত হইল। তিনি ক্রমশঃ ভাবিতে আরম্ভ করিলেন, নিশ্চয়ই ইহা কোন দুষ্টলোকের চক্রান্ত। তাহা হইলেও, তিনি কক্ষের দ্বার ও অর্গলগুলি নূতন করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন। তালাগুলি পরীক্ষা করিলেন। কোন ভৃত্যের ব্যবহার সন্দেহাতীত কি-না, বার বার নানা ছলে তাহাদের পরীক্ষা করিতে লাগিলেন, অবশেষে তাঁহার মন দস্যু-মোহন-ভীতি হইতে প্রায় মুক্ত হইল।
১২
ক্রমশঃ দস্যু-মোহন-লিখিত-তারিখ নিকটবর্তী হইতে লাগিল। ১১ই বৈশাখ বৃহস্পতিবারের প্রভাতও নিরাপদে কাটিয়া গেল, কিন্তু অপরাহ্ণে এক টেলিগ্রাফ-পিয়ন আসিয়া উপস্থিত হইল। কহিল, “তার হ্যায় মহারাজ!’
কুমারের মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল। তিনি কম্পিত হস্তে তারটী খুলিয়া ফেলিলেন এবং তাহা পাঠ করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে একটী সোফার উপর উপবেশন করিলেন। তারটী নিম্নে উল্লিখিত হইল :—
“কোন মাল মাদ্রাজে পৌঁছায় নি। অতএব আগামী-কল্য রাত্রের জন্য প্রস্তুত থাকিবেন।
“মোহন”
বহুক্ষণ পরে কুমার প্রকৃতিস্থ হইলেন। তাঁহার প্রথম চিন্তা হইল, যেমন করিয়াই হউক মিঃ বেকারকে আনিতেই হইবে। তিনি দ্রুত মোটর বাহির করিতে আদেশ দিলেন এবং অল্প সময় পরে প্রস্তুত হইয়া মোটরে আরোহণ করিলেন ও ভুবনেশ্বর যাইবার জন্য আদেশ দিলেন।
মোটর ছুটিল। তাঁহার সারা মন ব্যাপিয়া আতঙ্ক ও দুর্ভাবনা রাজত্ব করিতে লাগিল। তিনি একবার ভাবিতে লাগিলেন, “দূর হৌক, মোহন যাহা চায় পাঠাইয়া দিই। তাহা হইলে অনেক ধনরত্ন রক্ষা পাইবে। কিন্তু সে যদি স্বয়ং আসিয়া আমার সর্বস্ব লুট করিয়া লইয়া যায়, তা’ হইলে কি হইবে? আমাকে কি শেষে আত্মহত্যা করিয়া মরিতে হইবে?”
পুনরায় ভাবিলেন, “না, না, প্রাণ ধরিয়া আমি স্বেচ্ছায় নিজ- হাতে আমার পিতৃ-পুরুষের সঞ্চিত ধন অন্যের হাতে তুলিয়া দিতে পারিব না। আমাকে যমালয়ে না পাঠাইয়া মোহন এক টুকরা হীরাও লইতে পারিবে না। আমি যেমন করিয়া পারি মিঃ বেকারকে লইয়া যাইবই যাইব। তিনিই একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি। তিনি ব্যতীত আর কাহারও সাধ্য নাই, আমাকে এই সর্বনাশের আগুন হইতে রক্ষা করে।”
কুমার মোটরের গতি দ্রুত করিবার জন্য আদেশ দিলেন। অবশেষে হ্রদের ধারে উপস্থিত হইয়া মোটর থামিলে, কুমার নিত্যবিক্রম দ্রুত অথচ নিঃশব্দ গতিতে অগ্রসর হইয়া দেখিলেন, মিঃ বেকার ঠিক পূর্বেকার মত একই স্থানে বসিয়া মৎস্য ধরিতেছেন।
কুমার তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইয়া বিনা বাক্যব্যয়ে টেলিগ্রামখানি মিঃ বেকারের হাতে তুলিয়া দিলেন।
মিঃ বেকার একবার তারের কাগজখানির উপর চক্ষু বুলাইয়া লইয়া কহিলেন, “তারপর?”
“তার পর? দেখতেই পাচ্ছেন।” কুমার কহিলেন।
“কি দেখতে পাচ্ছি?” মিঃ বেকার জিজ্ঞাসা করিলেন।
কুমার অধৈর্য কণ্ঠে কহিলেন, “সর্বস্ব লুট করবে, আমার সবনাশ হয়ে যাবে।”
মিঃ বেকার কুমারের দিকে ফিরিয়া তীব্রকণ্ঠে কহিলেন, “আপনি নিশ্চয়ই এই আশা করেন না যে, আমি এই সব গাঁজাখুরী কাজে সময় নষ্ট করবে|?”
কুমার নিত্যবিক্রম স্থির-দৃষ্টিতে চাহিয়া কহিলেন, “আগামী- কালের রাত্রি আমার প্রাসাদে অতিবাহিত করতে আপনি কত টাকা চান, মিঃ বেকার? আমি ধনী ব্যক্তি, অত্যন্ত ধনীলোক আমি। আপনি যা চাইবেন, তাই দোবো আমি। বলুন, আপনি কত চান?”
“আমি এক পেনিও চাই না। আমাকে বিরক্ত করবেন না আপনি। আপনি যা’ন এখান থেকে।” মিঃ বেকার নীরস স্বরে কহিলেন।
কুমারের নড়িবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। তিনি কহিলেন, “আমি আপনাকে দশ হাজার টাকা দেবো, মিঃ বেকার। আপনি রাজী?”
এরূপ অসম্ভব প্রস্তাবে মিঃ বেকার ক্ষণকাল বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাহিয়া কহিলেন, “আপনি কি ক্ষেপেছেন? কেন মিছে অর্থব্যয় করবেন আপনি? দেখবেন কিছুই ঘটবে না, মাঝখান থেকে আপনার অর্থব্যয় হবে। তা ছাড়া আমি ছুটিতে রয়েছি, আমার কোন অধিকারই নেই এমন ভাবে কোন টাকা রোজগার করবার।”
কুমার আগ্রহভরে কহিলেন, “দ্বিতীয় প্রাণী এসব কথা জানবে না, মিঃ বেকার। আপনি আমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করুন। তা’ হ’লে রাজী হ’লেন তো?”
মিঃ বেকার ধীরে ধীরে কহিলেন, “অগত্যা! কিন্তু আবার বল্ছি, ও-সব কিছুই ঘটবে না। কারণ দস্যু মোহন এক কারাগারে আছে—” এই অবধি বলিয়া সহস| আপন মনে অস্ফুট কণ্ঠে কহিলেন, “শয়তান মোহনকে বিশ্বাসও নেই। সে যে কি পারে, আর পারে না, তা’ আজ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারলুম না! উত্তম আমি কাল রাত্রি ৯টার সময় আপনার প্রাসাদে উপস্থিত হবো।”
কুমার আনন্দিত স্বরে কহিলেন, “ধন্যবাদ, মিঃ বেকার, অশেষ ধন্যবাদ! আমি আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকবো।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “যদি সত্য সত্যই দস্যু মোহন কথা রাখতে আসে, তা’ হ’লে তাকে গ্রেপ্তারের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবো না ভেবে, সত্যই আমি আনন্দিত হলুম, কুমার সাহেব। হাঁ, ভাল কথা, আপনার চাকরদের বিশ্বাস করা চলে তো?”
কুমার কহিলেন, “হাঁ, চলে। তবে……”
“তবেতে কাজ নেই। আমি কলকাতায় তার কোরে দু’জন ফোর্সের লোক আনিয়ে নিচ্ছি। কারণ মোহনকে যে চেনে, সে বোঝে তাকে আয়ত্বে আনা কতখানি শক্তির কাজ। আচ্ছা, আপনি এখন আসুন! কাল রাত্রি ৯টায় আবার দেখা হবে।”
বৃদ্ধ কুমার বিদায় লইয়া অপেক্ষাকৃত সুস্থ মনে প্রাসাদে প্রত্যাবর্তন করিলেন।
১৩
পরদিন প্রাতঃকালে শয্যা ত্যাগ করিয়া কুমার বহুদিনের অব্যবহৃত মরিচাধরা তলোয়ার ও বন্দুকগুলি বাহিয়া করিয়া পরিষ্কারের কার্যে ভৃত্যগণকে নিযুক্ত করিলেন। আবার নূতন করিয়া ভূগর্ভস্থ কক্ষ পরীক্ষা করিলেন। ড্রইংরুমের দ্বার, ফটক, খিড়কির দ্বার প্রভৃতি সতর্কতা সহকারে পরীক্ষা করিয়া কুমার অপেক্ষাকৃত সুস্থ মনে সংবাদ-পত্র পাঠে মনোনিবেশ করিলেন।
অপরাহ্ণে ভৃত্যগণকে কহিলেন, “আজ আটটার মধ্যে সব কাজ সেরে ফেলতে হবে। কারণ আমি একটু বিশেষ কাজে ব্যস্ত থাকবো।”
তোমাদের রাত্রি রাত্রি আটটার মধ্যে কুমার আহার সম্পন্ন করিয়া ভৃত্যদের ছুটি দিলেন। তাহারা প্রাসাদের পশ্চিমাংশে দুইখানি দীর্ঘ হলে শয়ন করে। তাহারা নিজেরা সেখানে রান্না-বান্না করিয়া আহার করে। ভৃত্যগণ সকাল সকাল ছুটি পাইয়া আপনাদের মহলে চলিয়া গেল।
কুমার সাহেব ঘন ঘন ঘড়ির দিকে চাহিয়া মিঃ বেকারের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। তিনি সম্মুখস্থ টেবিলের উপর লাইসেন্স লওয়া একটি বন্দুক, একটি সাতঘরা অটোম্যাটিক রিভলভার ও একখানি তীক্ষ্ণধার তরবারি রক্ষিত করিয়া বার বার সেগুলির দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। কত অতীত- স্মৃতি যে ওই অস্ত্রগুলির সহিত অচ্ছেদ্য সূত্রে আবদ্ধ আছে, উহা একে একে তাঁহার মনাকাশে উদয় হইতে লাগিল।
তিনি চমকিত হইয়া ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিলেন, মাত্ৰ আটটা বাজিয়া পঁচিশ মিনিট হইয়াছে। তিনি অধৈর্য চিত্তে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।
দস্যু মোহন লিখিয়াছে, “রাত্রি এগারোটার সময় আসিবে, তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন।” কুমার সাহেবের মুখে এক টুকরা ক্রুর হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি মনে মনে কহিলেন, তিনি যে এরূপ ভাবে প্রস্তুত থাকিতে সক্ষম হইবেন অর্থাৎ মিঃ বেকারকে দৈবক্রমে সহায়করূপে পাইবেন, একথা ঘুণাক্ষরেও দস্যু মোহন যদি পূর্বাহ্ণে জানিতে পারিত, তবে এরূপ সাংঘাতিক পত্র লিখিবার পূর্বে, সে বার বার চিন্তা করিয়া দেখিত।
এক সময় অন্যমনস্ক হইয়া কুমার রিভলভারটা হাতে তুলিয়া লইলেন। তাহার মানস নয়নে অতীতের একটি চিত্র ভাসিয়া আসিল I তখন তাঁহার পূর্ণ যৌবন। বয়স মাত্র ২৫ বৎসর। প্রিয়তম অসামান্য তরুণীকে পত্নীরূপে পাইয়া তিনি আনন্দে, প্রেমে আত্মহারা! তাঁহার মত ভালবাসিতে জগতের অন্য কোন পুরুষ সক্ষম কি না, সে সময়ে তাঁহার মনে বিলক্ষণ সন্দেহ ছিল। তিনি পত্নীকে এক মিনিটের জন্যও আড়াল করিতে বেদনা বোধ করিতেন।
একদিন শিকার হইতে ফিরিয়া আসিতে রাত্রি হইয়া গেল। তিনি অন্দর মহলে নিঃশব্দে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, তাঁহার প্রিয়তমা পত্নী কাহারও সহিত অতি নিম্নস্বরে কথা কহিতেছেন। তিনি বিস্মিত হইয়া এক ধাক্কায় দ্বার মুক্ত করিতেই, একটী অপরূপ সুন্দর যুবক ঘর হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেল। তারপর তিনি কিরূপ ভাবে আত্মবিস্মৃত হইয়া প্রিয়তমা নারীকে হস্ত-ধৃত রিভলভারটি দিয়া গুলি করিয়া কুকুরের মত হত্যা করিয়াছিলেন, সহসা তাঁহার মনে পড়ায় দুই চক্ষু অশ্রুজলে ভরিয়া উঠিল। পত্নী-হত্যার পরদিন যখন তিনি জানিতে পারিলেন, যে-যুবক তাঁহার পত্নীর কক্ষ হইতে পলাইয়া গিয়াছিল সে আর ‘অন্য কেহ নহে, তাঁহারই সহোদর, কুমারের সহিত মনান্তর থাকায় এরূপভাবে চলিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিল, তখন তাঁহার বুকে যে বেদনা বাজিয়াছিল, আজ পর্যন্ত তাহা ভুলিতে পারেন নাই। তিনি আর বিবাহ করেন নাই। প্রিরতমা পত্নীর মুখে মৃত্যুকালীন যে-বিস্ময় ফুটিয়া উঠিয়াছিল, যেন বলিতে চাহিয়াছিলেন, ‘কি কারণে তুমি আমাকে হত্যা করিলে? আমি কি করিয়াছি?’ সেই পবিত্র স্মৃতিটুকুর ধ্যানে আজ পর্যন্ত অতিবাহিত জীবন যাপন করিতেছেন।
এমন সময়ে দ্বারে মৃদু করাঘাতের শব্দ হইল। তিনি দ্রুত- বেগে মুখের অশ্রু নিশ্চিহ্ন করিতে করিতে কহিলেন, “কে?”
“মিঃ বেকার!” উত্তর আসিল।
কুমার নিত্যবিক্রম দ্রুতপদে উঠিয়া দ্বার মুক্ত করিয়া দিলেন। দুইজন বিভীষণ আকৃতি লোকের সহিত মিঃ বেকার প্রবেশ করিলেন। অভিবাদন ও প্রত্যভিবাদনের পালা শেষ হইলে, লোক দুই জনের দিকে হাত বাড়াইয়া মিঃ বেকার কহিলেন, “দস্যু মোহনের মত লোকের সঙ্গে পাল্লা দিতে হ’লে, আমার এই দু’জন বিশ্বস্ত অনুচর অত্যাবশ্যক। আসুন, প্রথমে এদের উপযুক্ত স্থানে ডিউটিতে বসিয়ে দিই।”
কুমার লোক দুইজনের আকৃতি ও গম্ভীর মুখের দিকে সভয় দৃষ্টিতে চাহিয়া ভাবিলেন, এদের মত দুর্দান্ত লোকেরই আমার প্রয়োজন। প্রকাশ্যে কহিলেন, “আসুন মিঃ বেকার, আপনাকে গুপ্ত-কক্ষের ভিতর নিয়ে যাই। কারণ আপনাকে আমার পূরা- পূরি বিশ্বাস করা প্রয়োজন। “
মিঃ বেকারের মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল। কহিলেন, “আমাকে যিনি সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস না করতে পারেন আমি তাঁর ছায়া মাড়াতেও ঘৃণা বোধ করি, তাঁ’র কোন কাজের দায়িত্ব নেওয়া তো পরের কথা!
কুমার নিত্যবিক্রমের পিছনে মিঃ বেকার দুইজন অনুচর সহ ভূগর্ভস্থ কক্ষে উপস্থিত হইয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহার সর্বপ্রচেষ্টা সত্ত্বেও সবিস্ময় অত্যাশ্চর্য ভাবটি মুখে দেদীপ্যমান হইয়া উঠিল। তিনি গম্ভীর মুখে চারিদিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। কক্ষের চারিদিকে চারিটী অতি বৃহৎ ও মজবুত লৌহ-সিন্দুক। কক্ষের একাংশে গজদন্ত-নির্মিত এক সেট্ চেয়ার, টেবিল ও সোফা। মধ্যস্থলে নানাবর্ণের শ্বেত- পাথরের ও হস্তীদন্ত-নির্মিত বহুমূল্য তৈজসপত্র। কত লক্ষ টাকার জিনিস যে এই ছোট্ট ভূগর্ভ কক্ষটিতে আবদ্ধ রহিয়াছে, তাহা ভাবিয়া মিঃ বেকার ক্ষণকালের জন্য বাকশক্তি-রহিত হইয়া গেলেন।
কক্ষের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া কুমার নিত্যবিক্রম কহিলেন, “উত্তর দিকে ঐ যে ছোট্ট সিন্দুকটি দেখছেন, ওর মধ্যের সমস্ত সম্পদ মোহন দাবি করেছে। ঐ হাতীর দাঁতের সেট, এই রোপ্য স্বর্ণ নির্মিত আলমারি, এই সব জিনিসগুলিই সে চেয়েছে।”
কথা বলিবার সময় কুমারের কণ্ঠস্বর কম্পিত হইয়া উঠিল।
মিঃ বেকার ভূগর্ভস্থ দ্বার ও হাওয়া ও আলো আসিবার পাইপগুলি পরীক্ষা করিলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “এই পাইপের ভিতর দিয়ে, একমাত্র অশরীরি জীবেরাই প্রবেশ করতে পারে! কারণ প্রত্যেকটি তিন ইঞ্চি স্কোয়ার। বাকী থাকে লৌহ-দ্বার। এই দ্বার ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করা, আমার মতে, কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, কিন্তু মোহন মানুষ নয়- দানব; সুতরাং আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি আমার সহকারী দু’জনের একজনকে এই কক্ষে, আর অন্য জনকে কক্ষের বাইরে সিঁড়ির মুখে রাখতে চাই। আপনি কি বলেন, কুমার?”
কুমার কহিলেন, “আমি একান্তরূপে আপনার ওপরই নির্ভর করেছি। আপনি বিবেচনা কোরে আপনার কর্তব্য সম্পন্ন করুন।”
মিঃ বেকার কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করিয়া কহিলেন, “ভূগর্ভে আসার এই দ্বার ছাড়া—কোন সুড়ঙ্গ পথ আছে?”
কুমার কহিলেন, “আমার জানা নেই। আমি এই বাড়ী ক্রয় করি, পরে নিজের মনোমত কোরে অদল-বদল করিয়েছি। কিন্তু কোন সুড়ঙ্গ পথ আছে কি নেই এমন কোন কথা, বাড়ীর পূর্ব মালিকও আমার নিকট বলেন নি।”
“তবেই একজন পুলিস-প্রহরীর ভিতরে থাকা একান্ত প্রয়োজন।” মিঃ বেকার একজন প্রহরীকে বলিলেন, “হুদা, তুমি থাকবে ভিতরে, কিন্তু খুব সাবধান। একদম ঘুমুতে পাবে না, সারাক্ষণ জেগে থেকে পাহারা দেবে। বুঝেচ?”
প্রহরী ঘোঁৎ করিয়া উঠিল। মিঃ বেকার তাহাকে ভিতরে একটা টুলের উপর বসাইয়া পুনরায় বসিলেন, “খুব সাবধানে! দস্যু মোহন যে-সে ব্যক্তি নয়! যে-কোন লোককে দেখবে অমনি গুলি করবে। আর বাঁশী বাজিয়ে আমাকে জানাবে।“
প্রহরী সেলাম করিয়া ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল।
মিঃ বেকার, কুমার অন্য বৃষস্কন্ধ প্রহরীর সহিত বাহিরে আসিয়া লৌহদ্বারে চাবি লাগাইয়া দিলেন ও চাবি কুমারের হাতে অর্পণ করিয়া দ্বিতীয় প্রহরীকে পূর্বরূপ উপদেশ দিয়া দ্বারের বাহিরে বসাইয়া কহিলেন, “এইবার চলুন। আমাদের থাকবার উপযুক্ত স্থান পছন্দ করি।
মিঃ বেকার ড্রইংরুমের বাহিরে বড় ফটকের পার্শ্বে একটি ছোট্ট ঘর দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ ঘরে কে থাকে?”
কুমার কহিলেন, “আমার প্রহরী থাকে। কিন্তু আজ তা’দের আপনার আদেশ মত ছুটি দিয়েছি। তারা বাড়ীর পশ্চিমদিকের ভৃত্য-মহলে আছে।”
মিঃ বেকার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে কক্ষটি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, কক্ষের প্রায় অর্ধেক স্থান কতকগুলি অব্যবহৃত চেয়ারে পরিপূর্ণ তিনি কয়েকটা চেয়ার দুই সারিতে সাজাইয়া মৃদু হাস্যমুখে কহিলেন, “আসুন, আপনি আজ এই শয্যায় শুয়ে পড়ুন। কিছু ভয় নেই আপনার। যদিও আমি জানি কিছুই ঘটবে না, মাঝ- খান থেকে আপনার কতকগুলো টাকা জলে গেল।”
কুমার সাহেব উত্তেজনা ও শঙ্কায় ক্লান্ত হইয়াছিলেন; তবু শয়ন না করিয়া চেয়ারের উপর সোজাভাবে উপবেশন করিয়া কহিলেন, “দস্যুকে বিশ্বাস নেই, মিঃ বেকার।“
“না, নেই। বিশেষ কোরে দস্যু মোহনের মত অসাধারণ দস্যুকে।” মিঃ বেকার দ্বিতীয় সারিতে লম্বা হইয়া শয়ন করিয়া কহিলেন, “আমি এখন সময়ে সময়ে ভাবি, রেঙ্গুনে সে আমাকে নিজ ইচ্ছায় ধরা দিয়েছিল কি-না! আপনি বসে রইলেন কেন। মিছে রাত জেগে কষ্ট পাবেন, শুয়ে পড়ুন।”
কুমার কহিলেন, “ঘুম আজ আর আমার কাছে আসবে না, মিঃ বেকার। তা’র চেয়ে সে চেষ্টা না কোরে, আমরা গল্প কোরে রাতটুক কাটিয়ে দিই আসুন। তাতে লাভ ভিন্ন লোকসান হবে না।”
“না, হবে না। কিন্তু আমি একটু ঘুমিয়ে নিই, কুমার সাহেব। আমার এই কাজে বৃদ্ধ দশা হ’ল। আমি বুঝি, কি ঘটবে আর কি ঘটবে না! এক্ষেত্রে আপনাকে আমি এইটুকু আশ্বাস দিচ্ছি যে, কিছুই ঘটবে না!” মিঃ বেকার মৃদু হাসা করিলেন।
কুমার সাহেব নীরবে, কান খাড়া করিয়া প্রহরীদের পাহারা দিবার ক্ষুদ্র ছিদ্রের মধ্য দিয়া বাড়ীর বাহিরের ঘন অন্ধকারের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
১৪
রাত্রি এগারোটা বাজিল। কুমার সাহেব সচকিত হইয়া উঠিলেন, তিনি দেখিলেন, মিস্টার বেকারের চক্ষু ঘুমে ভারী হইয়া আসিতেছে। সহসা তিনি মিঃ বেকারের একটা হাত নাড়িয়া দিয়া ডাকিলেন, “মিঃ বেকার?”
মিঃ বেকার চক্ষু চাহিয়া দেখিলেন, মুখে তীব্র উত্তেজনা লইয়া কুমার তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়! আছেন। কহিলেন, “কি খবর কুমার সাহেব?”
সতর্ক নিম্ন-কণ্ঠে কুমার কহিলেন, “রাত্রি ১১টা বাল।”
“তা” বাজবে। আবার ১২টাও বাজবে। তারপর একটা, দু’টো, কোরে রাত্রিও শেষ হ’য়ে যাবে। তবে সেজন্য আপনার উদ্বেগ কিসের?” মিঃ বেকার ব্যঙ্গস্বরে কহিলেন।
কুমার কহিলেন, “এগারোটার সময় সে আসবে বলেছিল।”
“কে আসবে বলেছিল?” মিঃ বেকার সবিস্ময় কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন।
কুমার সাহেব আপন ভুল বুঝিতে পারিয়া কহিলেন, “বলেছিল নয়, লিখেছিল। দস্যু মোহন লিখেছিল।”
“তা’ আমি জানি। মিছে আপনি উদ্বেগে অস্থির হচ্ছেন। যদি মোহন তা’র প্রতিজ্ঞা পালন করতে সাহসী হ’তো, এতক্ষণ আপনার প্রাসাদ রিভলভারের শব্দে আর দস্যু মোহনের মরণ আর্তনাদে পূর্ণ হ’য়ে উঠতো। বুঝেছেন কুমার?” মিঃ বেকারের মুখে মৃদু হাসি দেখা দিল।
কুমার নীরব হইলেন। তিনি তাঁহার সমগ্র মনোযোগ একাগ্র করিয়া ছিদ্রের ভিতর দিয়া চাহিয়া রহিলেন। দেখিতে দেখিতে রাত্রি ১২টা বাজিল—একটা বাজিল, কুমার সাহেব বসিয়া রহিলেন। মিঃ বেকারের রীতিমত উচ্চ নাসিকা গর্জন চলিতেছিল। তিনি উদ্বেগশূন্য মনে নিদ্রা যাইতেছিলেন।
শান্ত, গভীর রাত্রি! বৃহৎ প্রাসাদের কোন স্থানেই কোন শব্দ নাই। সমস্ত প্রকৃতি যেন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। শুধু দূর হইতে অশ্রান্ত সমুদ্র-গর্জন নীরব প্রকৃতির বক্ষে রহস্যময় জাগরণের ভীতি জাগাইতেছিল। সহসা সমুদ্র-গর্জন রূপান্তরিত হইয়া কুমারের কর্ণে শত শত মোহনের অবোধ্য গুঞ্জনধ্বনিতে পরিণত হইল। তাঁহার মনে হইতে লাগিল, যেন সমস্ত প্রকৃতি মোহনে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। তাহারা যেন অবোধ্য ভাষায় কুমার সাহেবকে বিদ্রূপ করিতেছে।
কুমার সাহেবের মানস-নয়ন দেখিতে পাইল, তাঁহার পূর্ব-পুরুষের সঞ্চিত অমূল্য সম্পদ যেন শত শত মোহনের হাতে হাতে অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে। ধীরে ধীরে প্রাসাদ পার হইয়া সমুদ্র- তীরে, তারপর সমুদ্রের কল্লোলিত ঢেউএর মাথায় মাথায় তাঁহার সম্পদ-গোষ্ঠি নাচিতে নাচিতে চলিয়া যাইতেছে, দূরে—বহুদূরে— দৃষ্টির বাহিরে!
চারিদিকে অস্ফুট গুঞ্জন-ধ্বনি। সকলের পূর্বে অস্ফুট ব্যঙ্গোক্তি! অপদার্থ কুমারের গৃহলক্ষ্মী বিতাড়িত হইয়া গেল, রাখিতে পারিল না। অক্ষম, অপদার্থ, কাপুরুষ নিজ প্রিয়তম সাধ্বী পত্নীকে বিনাদোষে, বিনা অপরাধে হত্যা করিয়া যে মহাপাপ করিয়াছিল, তাহার প্রতিশোধ গ্রহণ করিতে রাজলক্ষ্মী পুরী হইতে কাঁদিতে কাঁদিতে চলিয়া গেলেন।
কুমার সাহেবের কর্ণে অস্ফুট অবোধ্য ক্রন্দন-ধ্বনি প্রবেশ করিতে লাগিল। তিনি হাঁপাইতে লাগিলেন। ঘামে তাঁহার সমস্ত শরীর ভিজিয়া উঠিল। কণ্ঠ শুষ্ক হইল। এমন সময় নিস্তব্ধ প্রকৃতিবক্ষ কম্পিত করিয়া একটা মোটরের বাঁশীর শব্দ উত্থিত হইল।
কুমার সাহেব অতি-পরিমাণে চকিত হইয়া, মিঃ বেকারের মাথা ধরিয়া সজোরে নাড়িয়া দিয়া কহিলেন, “মিঃ বেকার! বেকার!”
আচমকা ধাক্কা খাইয়া মিঃ বেকার ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন। তিনি বিহ্বল দৃষ্টিতে চাহিয়া কহিলেন, “কি ব্যাপার? কি হয়েছে?”
“ঐ যে শব্দ হ’ল?” কুমার উত্তেজিত স্বরে কহিলেন।
মিঃ বেকার হতাশ স্বরে কহিলেন, “কোথায় শব্দ? আমার নাক ডাকছিল।”
কুমার সাহেব প্রতিবাদ করিয়া কহিলেন, “না না, ঐ শুনুন!”
মিঃ বেকার শুনিলেন, একটা মোটরের বংশী-ধ্বনি দূরে মিলাইয়া গেল। তিনি বিচলিত কুমার সাহেবের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “ওটা মোটরের হর্নের শব্দ।”
কুমার চোখমুখ কপালে তুলিয়া কহিলেন, “তবে?”
মিঃ বেকার অধৈর্য স্বরে কহিলেন, “কুমার সাহেব, আপনি যে প্রকৃতিস্থ নন্, তা’ আমার উত্তমরূপে ধারণা হয়েছে। আপনি কি মনে ভাবেন, দস্যু মোহন মোটরের হর্ন বাজিয়ে, শহর তোলপাড় কোরে চুরি করতে আসবে? আর আপনার প্রাসাদের ওপর কামান দেগে মণি-রত্ন লুট কোরে যাবে? মিছে অস্থির হ’চ্ছেন কেন? তা’র চেয়ে আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন। আপনি না ঘুমুতে পারেন, তবে দয়া কোরে আমার ঘুমের ব্যাঘাৎ ঘটাবেন না। কারণ মিথ্যে পণ্ড শ্রম করা আমার ধাতুতে সহ্য হয়না।”
মিঃ বেকার পুনরায় শয়ন করিলেন এবং অবিলম্বে তাঁহার উচ্চ নাসিকাধ্বনি শ্রুত হইতে লাগিল। কিন্তু কুমার সাহেব শয়ন করিলেন না; তিনি কান খাড়া করিয়া বসিয়া রহিলেন। মাত্র একটিবার হর্নের শব্দ ছাড়া আর তিনি কিছুই শুনিতে পাইলেন না। ধীরে ধীরে প্রভাত হইল। চারিদিকে পরিপূর্ণ শান্তি বিরাজ করিতে লাগিল। সমুদ্রের ভয়ার্ত গর্জনধ্বনি প্রভাতালোকে হ্রাস পাইল।
মিঃ বেকার গাত্রোত্থান করিলেন। হাসি মুখে কহিলেন, “যা’ক ভালয় ভালয় রাত্রি কেটে গেছে! আমি আপনাকে কি বলেছিলাম, কুমার সাহেব? মিছামিছি আপনার অতগুলো টাকা জলে যাবে। বলতে কি, আমার লজ্জা হচ্ছে ও টাকা আপনাকে কাছ থেকে নিতে। আসুন, দেখিগে আমার সহচরেরা কি বলে!”
১৫
কুমার সাহেবের মন প্রভাতের শান্ত বাতাসে গ্লানি-শূন্য হইয়া উঠিল। রাত্রিতে যে কিছু ঘটিল না, এই চিন্তায় তাঁহার মন আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। তিনি মিঃ বেকারের সহিত হলঘরে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, বাহিরে রক্ষী-প্রহরী একটা টুলের উপর বসিয়া দেওয়ালে ঠেস দিয়া নিদ্রা যাইতেছে।
প্রহরীকে নিদ্রা যাইতে দেখিয়া, মিঃ বেকার হুঙ্কার ছাড়িয়া কহিলেন, “বাঃ! বেশ কর্তব্য-জ্ঞান তো তোমার? ঘুমানো বার করছি আমি! বার বার নিষেধ কোরে গেলাম যা না করতে, এত বড় সাহস—নেই কাজ করতে একটু দ্বিধা পর্যন্ত হ’ল না!” কুমারের দিকে হাত বাড়াইয়া কহিলেন, “কৈ চাবি দিন? ভিতরে যাই চলুন।”
কুমার সাহেব পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া মিঃ বেকারের হাতে দিলেন। তিনি দ্রুত হস্তে চাবি খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন, ভিতরের প্রহরীও অকাতরে নিদ্রা যাইতেছে। তিনি পুনরায় গর্জন করিয়া উঠিলেন, “অপদার্থের দল! তোমায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করবো আমি।”
এমন সময়ে কুমার সাহেব আর্তকণ্ঠে চিৎকার করিয়া উত্তর দিকের ছোট সিন্দুকটার মুক্ত ডালা ধরিয়া টান দিলেন। সিন্দুক শূন্য, ভিতরে এক টুকরা বস্তুও নাই! তিনি হায় হায় শব্দ, করিয়া উঠিলেন; কহিলেন, “গেছে, সব গেছে! আমার সর্বনাশ হ’য়ে গেছে। ঐ দেখুন মিঃ বেকার, গজদন্তের বহুমূল্য সেও গেছে। রৌপ্য ও স্বর্ণ নির্মিত আলমারিও গেছে। হায়! হায়! হায়! আমার সর্বনাশ হ’য়ে গেল! ওরে বাবা! কে আমার এমন সর্বনাশ করলে? হায়! হায়! হায়! মোহন আমার বুকে ছুরি মেরে গেল না কেন? এ শোক আমি সহ্য করবো কি কোরে? হায়, হায়, হায়, আমার সর্বস্ব গেল, আমার সবনাশ হ’য়ে গেল।”
কুমার সাহেব ক্ষিপ্ত ক করের মত চারিদিকে ছুটাছুটি করিয়া নানা স্বরে চিৎকার করিতে লাগিলেন। কর্ত টাকা মূল্যের সম্পদ গেছে, মুখে মুখে হিসাব করিয়া বুক চাপড়াইতে লাগিলেন ও মোহনের উদ্দেশে অভিশাপ ছড়াইতে লাগিলেন।
এদিকে কুমার সাহেব যখন ভূগর্ভ কক্ষটী কাঁপাইয়া তুলিলেন, মিঃ বেকার তখন বাক্যহারা হইয়া গেলেন।
তিনি বিহ্বল দৃষ্টিতে চাহিয়া চাহিয়া চারিদিক দেখিতেছিলেন। তাঁহার কথা কহিবার শক্তি যেন সম্পূর্ণরূপে অন্তর্হিত হইয়াছিল।
সহসা কুমার সাহেব মিঃ বেকারের নিশ্চল অবয়ব ও নির্বাক মুখের দিকে চাহিয়া চিৎকার করিয়া কহিলেন, “একটা অথাও বলো, সাহেব! আমাকে বলো তুমি কেমন চমৎকার রক্ষণা করছে আমাকে!”
মিঃ বেকার অস্ফুট কণ্ঠে কহিলেন, “দস্যু মোহন! দস্যু মোহন! “
পাগলের মত চিৎকার করিয়া কমার কহিলেন, “হাঁ হাঁ, দস্যু মোহন! দস্যু মোহন!“
সহসা মিঃ বেকার ক্রোধে যেন ফাটিয়া পড়িলেন; ভিতরের প্রহরী তখনও নিদ্র| যাইতেহে দেখিয়া, তিনি তাহার লম্বা চুলের গুচ্ছ দুইহাতে চাপিয়া ধরিয়া চিৎকার করিয়া তাহার নাম ধরিয়া ডাকিতে লাগিলেন। কিন্তু প্রহরীর নিদ্রাভঙ্গ হইল না।
অবশেষে হতাশ হইয়া মিঃ বেকার কহিলেন, “না, এতো স্বাভাবিক নিদ্ৰা নয়! নিশ্চয়ই ক্লোরোফরম করেছে।” তিনি প্রহরীর অঙ্গ-বস্ত্র শুকিয়া দেখিতে লাগিলেন।
কুমার সাহেব কহিলেন, “কে ক্লোরোফরম করেছে?”
“আবার কে! মোহন ভিন্ন এ ক্ষমতা কার?” মিঃ বেকার কহিলেন।
কুমার সাহেব সেইখানে বসিয়া পড়িয়া কহিলেন, “তা’ হ’লেই আমাকে সেরেছে। আমার আর কোন উপায়ই নেই।“
“না, নেই।” মিঃ বেকার ধীরে ধীরে কহিলেন।
কুমার চিৎকার করিয়া কহিলেন, “এত বড়ে৷ অত্যাচার, এমন শয়তানী, সাজা পাবে না?”
মিঃ বেকার নির্বিকার স্বরে কহিলেন, “পুলিসে খবর দিন।”
কুমার কহিলেন, “তা’তে আর কি ফল ফলবে?”
মিঃ বেকার কহিলেন, “পুলিসের অনেক কিছু সুযোগ আছে। তা’রা চেষ্টা করলে হয়তো বা কৃতকার্যও হ’তে পারে।”
“পুলিস! পুলিসে যা করবে তা’ আপনার কাজেই বুঝতে পারছি। কিন্তু কিছু প্রমাণ আছে কি-না, কোন ক্লু দস্যু ফেলে গেছে কি না, কোথায় আপনি তা’ অনুসন্ধান করবেন, না পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন, এক পাও নড়ছেন না।” কুমার সাহেব অনুযোগ করিলেন।
মিঃ বেকারের মুখে ক্লান্ত হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি কহিলেন, “প্রিয় কুমার সাহেব! দস্যু মোহন পিছনে এমন কিছু প্রমাণ ফেলে যাবে, যা’র বলে আমি তা’কে ধরব বা সাজা দেবার কাজে লাগাবো, আপনি যদি তা’ আশা কোরে থাকেন, তবে ভুলে যান। কারণ দস্যু মোহনের বিশেষত্বই ওই খানে। সে যা ক’রে, ত|’র কোন চিহ্নই পিছনে রেখে যায় না।”
কুমার সাহেব হতাশ স্বরে কহিলেন, “তবে আমার কোন মণি-মুক্তাই আর ফিরে পাবো না? কোন আশাই নেই ওসবের? আমি পাঁচ লক্ষ টাকা দস্যু মোহনকে দিতে পারি, যদি সে সিন্দুকের রত্নগুলো আমাকে ফেরত দেয় ও-গুলো আমার কাছে অমূল্য মিঃ বেকার, অমূল্য। আমার আদি-পুরুষের পরি- জনেরা ওই সব হীরে-মুক্তো গলায় পরতো, বিশেষ কোরে আমার স্ত্রীর সব অলঙ্কারও তার মধ্যে ছিল। আমি পাঁচ লক্ষ টাকা দেবো—যদি দস্যু ওগুলো আমাকে ফেরৎ দেয়।”
মিঃ বেকার ভ্রূ-কুঞ্চিত করিয়া কহিলেন, “আপনি কি সত্য সত্যই ঐ প্রস্তাব করছেন?”
“হাঁ, হাঁ, হাঁ! কিন্তু আপনি কেন জিজ্ঞাসা করছেন?” কুমার সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন।
মিঃ বেকার কহিলেন, “আমি একটা উপায়ের কথা ভাবছি।”
“কি উপায়?”
“আগে আমাকে কাজ করতে দিন। যদি না সক্ষম হই, তখন এসব কথা বলবো।” মিঃ বেকার কহিলেন, “আর একটা কথা, আপনি পুলিসের কাছে আমার এখানে থাকার কথা বলতে পারবেন না। কারণ, যা’ হ’য়ে গেল, তা’তে আমার সুনাম তো আর বাড়বে না। বরং বদনামই হ’বে প্রচুর। তাছাড়া আপনি যদি ছোট সিন্দুকের মণিমুক্তাগুলো| ফিরিয়ে পেতে চান, তবে আমার সম্বন্ধে আপনাকে নীরব থাকতে হবে। রাজী?”
কুমার সাহেব কহিলেন, “রাজী। কিন্তু কত দিন লাগবে?”
“তা’ কিছু বলা যায় না। আমি মাদ্রাজে না যাওয়া পর্যন্ত……”
কুমার সাহেব বাধা দিয়া কহিলেন, “প্রহরীদের ঘুম ভেঙ্গেছে
এবার।”
মিঃ বেকার দেখিলেন, প্রহরীরা বিস্মিত ভীতি-বিহ্বল দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিয়াছে। তাহাদের একজনকে প্রশ্ন করিতে সে কহিল, “আমি কিছুই স্মরণ করিতে পারছি না।”
“তুমি নিশ্চয়ই কোন লোককে দেখেছ?”
প্রহরী কহিল, “না হুজুর, কোন লোককেই দেখিনি।”
“চিন্তা কোরে দেখো।”
“না, কোন লোককেই দেখি নি।”
“রাত্রে কি মদ খেয়েছিলে?”
“না হুজুর, আমি মদ ছুই না।”
প্রহরীর চোখ ও মুখের অবস্থা দেখিয়া, মিঃ বেকার নিঃসন্দেহ হইয়া কহিলেন, “নিশ্চয়ই ওর অলক্ষ্যে ওকে ক্লোরোফরম করা হয়েছিল। কারণ ক্লোরোফরমের সব কিছু চিহ্নই ওর চোখে-মুখে প্রকটিত রয়েছে।” কুমারের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আসুন, আমাদের আর সময় নষ্ট করলে চলবে না। আমি দেখি যদি আপনার রত্নগুলো ফিরিয়ে আনতে পারি।”
দ্বিতীয় প্রহরীও প্রথমের মত সব কিছু প্রশ্ন অস্বীকার করিল; তাহারা একবাক্যে কহিল, তাহারা কিছুই দেখে নাই।
সেই দিন প্রাতঃকালে পুরীর পুলিস-অফিসে দস্যু মোহনের নামে, যে মাদ্রাজ-জেলে বিচারাধীন কয়েদী অবস্থায় রহিয়াছে, চুরির অভিযোগ পেশ করা হইল।
১৬
দেশময় হৈ চৈ পড়িয়া গেল। দস্যু যাদুকর মোহনের অলৌকিক শক্তি-বর্ণনায় প্রতিটি সংবাদ-পত্রের সম্মুখ পৃষ্ঠা পূর্ণ হইতে লাগিল। কুমারের নিভৃত জীবন পুলিস-অফিসারেরা, কাগজের রিপোর্টারের দল, শখের গোয়ান্দারা অতিষ্ঠ করিয়া তুলিল। তিনি কেন মিঃ বেকারের কথা শুনিয়া পুলিসে ডায়েরী করিলেন? না করিলে এত ঝঞ্ঝাট পোহাইতে হইত না ভাবিয়া, কুমার নিজের উপর ক্রুদ্ধ হইয়া পড়িলেন।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ঘটিল যে, দস্যু-মোহন যে- পত্র কুমারকে লিখিয়াছিল এবং যে-পত্রের বিষয় পুলিস-সুপার, তিনি ও মিস্টার বেকার ব্যতীত অন্য কেহই জানিতেন না, সেই পত্রের অবিকল অনুবাদ কি করিয়া ‘বাঙলার ডাক’ সংবাদ-পত্রে প্রকাশিত হইল বা কে ঐ পত্রের বিষয় কাগজকে জানাইল, তাহাও কুমারের নিকট সমস্যা হইয়া দাঁড়াইল।
দস্যু মোহন জেলে থাকিয়া চুরি করিতেছে, কেহ তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না, সে রাত্রে জেল হইতে অদৃশ্যভাবে- বাহির হইয়া যায়, মোহন ডাকিনী মন্ত্র জানে, এই সব নানা উদ্ভট কাহিনীর আলোচনায় দেশ সরগরম হইয়া উঠিল
পুরাতন প্রাসাদের ভিতর সুড়ঙ্গ আছে, এই কথাও চারিদিকে রাষ্ট্র হইল। কাগজে কাগজে সুড়ঙ্গের কাহিনী, এমন কি কল্পিত মানচিত্র পর্যন্ত প্রকাশিত হইতে লাগিল। পুলিস- অফিসারগণ সুড়ঙ্গ আবিষ্কারের চেষ্টায় বৃহৎ প্রাসাদের চতুঃ- পার্শ্বের ইট তুলিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিলেন, কুমারকে জেরার উপর জেরা করিয়া ক্ষিপ্ত করিয়া তুলিলেন। নানা জল্পনা-কল্পনায় সারা ভারতবর্ষ মুখরিত হইয়া উঠিল। দস্যু মোহনের অলৌকিক- শক্তির কাহিনী পড়িয়া সকলে শিহরিয়া উঠিতে লাগিল।
যখন সুড়ঙ্গের কোন অস্তিত্ব খুঁজিয়া বাহির করা গেল না, তখন এই প্রশ্ন উদয় হইল যে, তাহা হইলে বৃহৎ তালা-বদ্ধ কক্ষের ভিতর হইতে আলমারি, চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি বড় বড় বস্তুগুলি কি করিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল? তাহারা ভূতের মত নিরাকার বস্তু নহে, সুতরাং সে-ভাবে অদৃশ্য হইতে পারে না। সুতরাং কোন লোক প্রবেশ করিয়াছিল। যদি প্রবেশ করিয়া- ছিল, তবে দ্বার বন্ধ দেখা গেল কেন? তবে কোন্ পথে তাহারা প্রবেশ করিয়াছিল, বা কোন্ পথে তাহারা বাহির হইয়া গেল?
স্থানীয় পুলিস এই কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হইয়া হাল ছাড়িয়া দিল এবং ফটকের হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট পাঠাইল। কিন্তু কটকের পুলিস সমস্ত ব্যাপার কাগজ-পত্রে ও পুরীর রিপোর্টে অবগত হইয়া নিজেদের মধ্যে আলোচনা করিয়া কর্তব্য স্থির করিলেন। তাঁহারা কলিকাতা পুলিস-কমিশনারকে একজন বিশিষ্ট অফিসার পাঠাইবার জন্য অনুরোধ করিয়া পত্র পাঠাইলেন এবং লিখিলেন, যদি দস্যু মোহনের চির-শত্রু—যিনি রেঙ্গুনে দস্যুকে অসাধারণ বুদ্ধি-কৌশলে গ্রেপ্তার করিয়াছিলেন, সেই স্বনামধন্য চীফ, ইন্সপেক্টার মিঃ বেকারকে পাঠাইতে পারেন, তবে তাঁহারা অতিশয় বাধিত হইবেন।
কলিকাতার পুলিস-কমিশনার পত্র পাইয়া সেই পত্রখানির নকল ও তাঁহার আদেশ একত্রে মিঃ বেকারের নিকট মাদ্রাজের পুলিশ-কমিশনারের কেয়ার অফে পাঠাইয়া দিলেন এবং পৃথক পত্রে মাদ্রাজের কমিশনারকে অনুরোধ জানাইলেন, তিনি যেন মিঃ বেকারকে পুরীতে পাঠাইতে সাহায্য করেন।
মাদ্রাজের কমিশনার পত্র পাইয়া মিঃ বেকারকে ডাকিয়া পাঠাইলেন, ও তিনি আসিলে পত্রখানি তাঁহার হাতে দিলেন।
মিঃ বেকার পত্রপাঠ করিয়া কহিলেন, “আমার মনে হয়, পুরীতে ছুটে গিয়ে কুমারের প্রাসাদের ইট তুলে সুড়ঙ্গ খোঁজায় সময় নষ্ট করাই হবে। আর কিছু হবে না স্থানে আছে ব’লে আমার ধারণা।“
এর মূল অন্য
পুলিস-কমিশনার হাসিয়া কহিলেন, “দস্যু মোহনের কাছে, আপনি বলতে চান? যদি আপনার এই ধারণা হয়, তবে কি বলতে চান, দস্যু-মোহন ডাকাতিতে অংশ গ্রহণ করেছিল?”
“আমার মনে হয়, তাই। তা ছাড়া আমি আরও বলতে চাই, এই কাজ দস্যু-মোহন ছাড়া আর কারুরই নয়।” মিঃ বেকার দৃঢ়কণ্ঠে কহিলেন।
পুলিস কমিশনার তাচ্ছিল্যস্বরে কহিলেন, “বাজে কথা বলবেন না আপনি। দস্যু মোহন কারাগারে রয়েছে, সুতরাং…
মিঃ বেকার বাধা দিয়া কহিলেন, “দস্যু মোহন জেলে আছে আমি জানি, তার ওপর কড়া দৃষ্টি রাখা হ’য়েচে, তা’ও আমার অজ্ঞাত নয়। কিন্তু তার হাতে হাত-কড়া, পায়ে বেড়ী দিয়ে রাখা হ’লেও, আমি ঠিক এই মতই প্রকাশ করতাম যে, এ কাজ দস্যু মোহন ছাড়া আর কারও নয়।”
“আপনার এমন দৃঢ় ধারণার হেতু কী?” কমিশনার জিজ্ঞাসা করিলেন।
“কারণ, আমি আর দ্বিতীয় ব্যক্তিকে জানি না, যে এমন ব্যাপকভাবে জাল ফেলে, এমন বৃহৎ শিকার করতে এবং কৃতকার্য হ’তে পারে। এরকম পারে, মাত্র এক ব্যক্তি, আর সে হচ্ছে– দস্যু মোহন।” বেকার কহিলেন।
“বাজে কথা, মিঃ বেকার।” তাচ্ছিল্যস্বরে কমিশনার কহিলেন।
মিঃ বেকার গম্ভীর স্বরে কহিলেন, “কিন্তু সত্য কথা, স্যর। আমাদের বন্ধু মোহন অমন পুরাতন পদ্ধতিতে চুরি করতে ঘৃণা বোধ করে। সে আধুনিক যুগের বৈজ্ঞানিক দস্যু। এমন কি পরবর্তী যুগের মানবও বলা চলে।”
“তা’ হ’লে আপনি কি করতে চান?”
“আমি আপনার কাছে এই প্রার্থনা করছি, আমাকে এক ঘণ্টার জন্য দস্যু মোহনের সঙ্গে আলাপ করতে দিন।” মিঃ বেকার অনুরোধ করিলেন।
“কোথায়? তা’র সেলে?”
“হাঁ। গতবার আমি যখন তাকে রেঙ্গুন থেকে মাদ্রাজে আনি, পথে আমাদের মধ্যে বিশেষ বন্ধুত্ব হ’য়েছিল। আমার নিশ্চিত ধারণা আছে, যদি মোহন নিজেকে বাঁচিয়ে এই চুরি সম্বন্ধে কোন সংবাদ দিতে সক্ষম থাকে, তবে নিশ্চয়ই দিতে অস্বীকার করবে না। তা হ’লে এখান থেকে পুরী ছোটার অনাবশ্যক কষ্ট থেকেও আমি রেহাই পাবে৷।” মিঃ বেকার কহিলেন।
১৭
সেদিন বেলা ১২টার সময় মিঃ বেকার প্রেসিডেন্সী-জেলে দস্যু মোহনের সেলে উপস্থিত হইলেন। মোহন তাহার জেলের বিছানার উপর শয়ন করিয়াছিল; বেকার সাহেবকে দেখিয়া মাথা তুলিয়া বিস্মিত কণ্ঠে হাসিয়া কহিল, “এ-কী? এ-যে কল্পনার অতীত ব্যাপার। প্রিয় বন্ধু বেকার যে এখানে?”
মিঃ বেকার মৃদু হাস্যমুখে কহিলেন, “হাঁ, স্বয়ং।”
মোহন হাস্য করিয়া কহিল, “আমি এখানে নিজের ইচ্ছায় এসে অনেক কিছুই প্রত্যাশা করি, কিন্তু আপনাকে আবাহন করতে পারবো, এর চেয়ে কল্পনাতীত ও আনন্দের বিষয় আর কিছু নেই আমার।”
“তুমি অত্যন্ত বিনয়ী।” মিঃ বেকার হাসিয়া কহিলেন।
মোহন বাধা দিয়া কহিল, “না, না, বন্ধু না। আদৌ না। আপনাকে আমি বিশেষ শ্রদ্ধা করি, মিঃ বেকার।”
“তোমার কথা শুনে আমার গর্ব হচ্ছে মোহন।” মিঃ বেকার কহিলেন।
মোহন মৃদু হাসিয়া কহিল, “আমি শত সহস্রবার বলেছি, আমাদের মিঃ বেকারের মত সুযোগ্য ডিটেকটিভ ভারতে আর দু’টী নেই। ওঁর সঙ্গে তুলনা করতে পারা যায়, একমাত্র বিলাতের সারলক হোমসকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় মিঃ বেকার, আমি আপনাকে এই টুলটা ছাড়া কিছুই বসবার জন্য দিতে পারি না। একটু কষ্ট কোরে এটাতেই বসুন।”
মিঃ বেকার মৃদু হাসিয়া টুলে উপর উপবেশন করিলেন। মোহন বলিতে লাগিল, “আমি জেলের ওয়ার্ডার আর প্রহরীদের গম্ভীর মুখ দেখে দেখে বিতৃষ্ণায় ভরে উঠেছি। আজ কার মুখ দেখে উঠেছিলাম জানি না যে, আপনার মুখ দর্শনের সৌভাগ্য আমার হ’ল। আমি তো ঐ সব ছুঁচো স্পাইদের জ্বালায় উত্যক্ত হ’য়ে উঠেছি। তারা দিনে দশবার আমার ঘরে ঢুকে চারদিক অনুসন্ধান করে, পকেট হাতড়ায়, বিছানা তুলে দেখে; সদাই ভয়, যেন আমি পালাবার মতলব আটছি। আচ্ছা, আপনি বলতে পারেন, গভর্নমেন্ট আমার ওপর এতটা নেক্-নজর রেখেছেন কেন?”
মিঃ বেকার মৃদু হাসিয়া কহিলেন, “গভর্নমেন্ট ঠিক কাজই করেছেন।”
মোহন মাথা নাড়িয়া কহিল, “না, না, ঠিক কাজ নয় এটা। আমাকে নিরালা, নিভৃত জীবন যাপন করতে দেওয়াই আপনার গভর্নমেন্টের উচিত কাজ, মিঃ বেকার।”
মিঃ বেকার হাসিতে হাসিতে কহিলেন, “পরের পয়সার ওপর নবাবী করতে দেওয়া মোহন?”
মোহন পুলকিত স্বরে কহিল, “ঠিক বলেছেন। পরের পয়সায় নবাবী করায় এত আনন্দ আছে, আর এত সহজ ব্যাপার যে কি বলবো! যাক্ ও-সব কথা। আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনার তাড়া আছে। কিন্তু কি-জন্য আপনার শুভাগমন হ’য়েছে, মিঃ বেকার?”
মিঃ বেকার কহিলেন, “কুমার নিত্যবিক্রমের ঘটনা সম্বন্ধে জানতে এসেছি, মোহন।“
মোহন ভ্রূ-কুঞ্চিত করিয়া চিন্তা করিতে করিতে কহিল, “নিত্যবিক্রম! নিত্যবিক্রম! হাঁ হয়েচে। বাঙলার এক স্বাধীন রাজ-বংশের পরাধীন শেষ প্ৰদীপ! লৌহ-সিন্দুকের মণি-মুক্তা, গজদন্ত, ড্রইংরুম সেট, সোনা ও রৌপ্য নির্মিত ছোট আলমারি। হাঁ হাঁ মনে পড়েছে। এই সব তুচ্ছ জিনিস মনেও থাকে না ছাই! আমার মাথা এর চেয়ে বড় বড় জিনিস নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে।”
মিঃ বেকার চক্ষু কপালে তুলিয়া কহিলেন, “তুচ্ছ জিনিষ?”
“তা’ ছাড়া আর কি বলবো, মিঃ বেকার? যা’ই হোক আপনি যখন এই কেস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, তখন বলুন আর কি জানতে চান আপনি?”
মিঃ বেকার কহিলেন, “আমরা কতদূর অগ্রসর হ’য়েছি এই কেসে, বলবার কি প্রয়োজন আছে, মোহন?”
“না না, আপনার কষ্ট করবার প্রয়োজন নেই। আজকার সংবাদ-পত্রে আমি সব পাঠ করেছি। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, কেসের কিনারা আপনারা কিছুই আজ পর্যন্ত করতে পারেন নি।” মৃদু হাসিয়া মোহন কহিল।
মিঃ বেকার কহিলেন, “আর সেই জন্যই তোমার দয়ার ওপর নির্ভর কোরে আমি এখানে এসেছি, মোহন?”
“আমি আপনার অনুগত ভৃত্য।” মোহন সবিনয়ে কহিল।
“প্রথমেই জানতে চাই, এই ব্যাপার কি তোমার দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে, মোহন?” বেকার প্রশ্ন করিলেন।
“গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত।” হাসিতে হাসিতে মোহন কহিল।
মিঃ বেকার সবিস্ময়ে কহিলেন, “রেজিস্ট্রি চিঠি থেকে টেলিগ্রাম পর্যন্ত?”
“হাঁ, ও-সব আপনার এই অনুগত ভৃত্যের দ্বারাই প্রেরিত হ’য়েছিল। ভাল কথা মনে পড়েছে, রসিদগুলো বোধ হয় এখানেই কোথাও আছে।” বলিয়া মোহন তাহার বিছানার তলদেশ হইতে দুইখানি পোস্ট অফিসের রসিদ বাহির করিয়া মিঃ বেকারের হাতে দিল
মিঃ বেকার বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া কহিলেন, এ কী ব্যাপার? আমার ধারণা ছিল, তোমাকে প্রত্যেক ঘণ্টায় সার্চ কোরে দেখা হয়। একটু সন্দেহ হলেই তোমার ঘর তন্ন তন্ন কোরে সার্চ করা হয়। তবে এ-সব কি কোরে সম্ভব হ’য়েছে, মোহন? স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, তুমি সংবাদ-পত্র পড়ো, রেজিস্ট্রি পত্র পাঠাও, এসব কি কোরে হয় মোহন?”
মোহন কপালে করাঘাত করিয়া ব্যঙ্গস্বরে কহিল, “হায় অদৃষ্ট! আপনার অনুচরেরা আমার জামার সেলাই খুলে দেখে, জুতোর সোল খুলে দেখে— আমি কিছু লুকিয়ে রেখেছি কি-না! কিন্তু ওরা এমন নির্বোধ, একবারও ভাবে না যে, মোহন এত কাঁচা ছেলে নয় যে ঐ সব পুরোনো পদ্ধতি অবলম্বন কোরে এখানে বাস করচে!”
মিঃ বেকার সবিস্ময়ে কহিলেন, “কি অদ্ভুত লোক তুমি, মোহন? এখন তোমার গল্প বলো, শুনি।”
মোহন গম্ভীর মুখে কহিল, “ধীরে বন্ধু, ধীরে। আমি আমার সব গোপন কথা ব’লে ফেলি, আর আপনি আমার সব পথ বন্ধ কোরে দিন, তা’ কি আমার কাছে প্রত্যাশা করেন আপনি?”
মিঃ বেকার সশ্রদ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “তোমার ওপর বিশ্বাস স্থাপন কোরে আমি কি ভুল করেছি, মোহন?”
“না, মিঃ বেকার না। আচ্ছা, আপনি যখন একান্তই শুতে চাইছেন, তখন শুনুন।” বলিয়া মোহন ছোট্ট ঘরটিতে দু’এক পা পায়চারি করিয়া ফিরিতে লাগিল। পরে আসিয়া কহিল, “আপনি নিত্যবিক্রমের চিঠিতে কি ধারণা করেছেন?”
“আমার ধারণা, তুমি বুড়োকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছিলে।
কেমন তাই না?” মিঃ বেকার জিজ্ঞাসা করিলেন। মোহন কহিল, “ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম বটে! আপনি কি ভাবেন, মোহনের এত প্রচুর সময় আছে; যে সে ঐ সব বাজে কাজে হাত দিয়ে নষ্ট করবে? আমি আপনার কাছ থেকে আরও বুদ্ধিমানের মত কথা আশা করেছিলাম। কিন্তু যাক্ সে কথা।
এখন শুনুন, ঐ চিঠিখানাই আমার সফলতার পথে একমাত্র বৈতরণীর কাজ করেছিল। ঐ চিঠিখানাই আমাকে কৃতকার্য হ’তে সাহায্য করেছিল। আচ্ছা, একে একে সব কথাই বলছি।”
“ধন্যবাদ।” মিঃ বেকার কহিলেন।
“আচ্ছা শুনুন। আমি প্রথমে ভেবে দেখলুম, আমাকে এক দুর্ভেদ্য প্রাসাদের মধ্যে দুর্ভেদ্য লৌহ-কক্ষ থেকে কাজ উদ্ধার করতে হবে। সুতরাং আপনি কি ভাবেন, কাজ দুরূহ বোলে আমি পিছিয়ে আসতে পারি?”
“নিশ্চয়ই না।” মিঃ বেকার উৎসাহ দিলেন।
“তবে কি একদল ডাকাত নিয়ে ঢেঁকি ঘুরিয়ে তলোয়ার ভেজে, দুম ফট্কা ফুটিয়ে যেমন আগের যুগে করতে! তেমন ভাবে সফল হতে হবে?” মোহন জিজ্ঞাসা করিল।
মিঃ বেকার কহিলেন, “তা’ ছেলেমানুষের কাজ হ’তো।”
“যেখানে সুড়ঙ্গ নেই, সেখানে কি সুড়ঙ্গ কেটে যাওয়া সম্ভব?” মোহন পুনরার প্রশ্ন করিল।
“অসম্ভব!” মিঃ বেকার কহিলেন।
“তবেই আমার পক্ষে একমাত্র পথ খোলা রইল। তা’ এই যে, প্রাসাদের মালিক-কর্তৃক নিমন্ত্রিত হ’য়ে যাওয়া। কেমন তাই না?” মোহন মৃদু হাসিয়া কহিল।
“একেবারে নূতন মতলব।” মিঃ বেকার মন্তব্য করিলেন।
মোহন আনন্দে দীপ্ত হইয়া কহিল, “আর তা এত সহজে ঘটেছিল যে, কী বলবো! কুমার নিত্যবিক্রম বিখ্যাত দস্যু মোহনের নিকট থেকে যদি একটা পত্র পায় যে, দস্যু তার ধন-রত্ন লুঠ করতে আসবে, তা’ হ’লে সে প্রথমেই কি করবে ভাবেন?”
মিঃ বেকার কহিলেন, “সোজা পুলিসকে জানাবে?”
“আর পুলিস হাসবে এই ভেবে যে, মোহন মাদ্রাজের প্রেসি- ডেন্সী জেলে আবদ্ধ আছে, সে কখনও পত্র পাঠাতে পারে? নিশ্চয়ই কোন দুষ্ট লোকে ঠাট্টা কোরে ভয় দেখিয়েছে। সুতরাং তারা কোন প্রকার সাহায্য করতে অস্বীকার করবে। সে ক্ষেত্রে কুমার কি অন্য কোন সাহায্যের জন্য চেষ্টা করবে না?”
“নিশ্চয়ই করবে।” মিঃ বেকার কহিলেন।
“আর এমন যদি হয়, ঘটনাচক্রে একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ সে সময়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন, এ খবর যদি স্থানীয় কাগজে পড়েন, ত’হলে তিনি কি করেন?”
মিঃ বেকার কহিলেন, “সেই ডিটেকটিভকে নিশ্চয়ই নিযুক্ত করেন।”
“ঠিক তাই ঘটেচে!” মোহন হাসিয়া কহিল। ” এখন আসুন আমরা কল্পনা করি, দস্যু-মোহন জেল থেকে তার কোন অতি নিপুণ সহচরকে পুরীর কাছাকাছি কোন শহরে বাসা কোরে থাকতে বললেন, আর স্থানীয় কাগজে সে সহচর কোনও রকমে এই প্যারাটুক বা’র করালে যে অমুখ বিখ্যাত ডিটেকটিভ ছুটি উপলক্ষে তিন সপ্তাহের জন্য বিশ্রাম করতে আর মাছ ধরতে সেখানে এসেছেন, আর সেই সহচর ডিটেকটিভের পার্ট অভিনয় করে, তা’হ’লে কি হয়, মিঃ বেকার?”
মিঃ বেকার রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কহিলেন, “তারপর?”
মোহন বলিতে লাগিল, “হ্যাঁ, যদি কুমার কাগজে ঐ সংবাদ পাঠ কোরে কোন কিছু না কোরে নিশ্চিন্ত হ’য়ে ব সে থাকতেন, তাহ’লে কিছুই ঘটতো না। কিন্তু তা হয়নি। তিনি সংবাদ পড়বামাত্র আমারই বন্ধুর কাছে এসে আমারই বিরুদ্ধে সাহায্য প্রার্থনা করলেন।”
মিঃ বেকার সবিস্ময়ে কহিলেন, “অদ্ভুত নতুন ফন্দী।’
“তাই বটে!” মোহন হাসিল, “জাল ডিটেকটিভ প্রথমে ক মারের প্রস্তাবে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ভাব দেখিয়ে অস্বীকৃতি জানালে। তারপর মোহনের কাছ থেকে তার্ গেল। তার্ পাবার পর হ’তেই সত্যিকার কাজ সুরু হ’ল। আমার বন্ধু জাল ডিটেকটিভরূপে যত কুমারকে অস্বীকৃতি জানাতে লাগল, ততই কুমার বেপরোয়াভাবে তাকে খোসামোদ করতে লাগলেন। অবশেষে একটা মোটা টাকা পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে, তাঁর সম্পদকে নিরাপদ রাখার জন্য তাকে নিয়ে গেলেন। জাল- ডিটেকটিভ, মোহনের অলৌকিক ক্ষমতার অজুহাতে তারই দু’জন বলিষ্ঠ সহচরকে সঙ্গে নিয়ে গেল। একটা মোটর লড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল, তা’তে কোরেই সব জিনিস ধীরে সুস্থে কুমারের ভূগর্ভ কক্ষ থেকে বার কোরে চালান দেওয়া হ’ল। এদিকে যখন লরি ভরা হচ্ছিল, তখন অন্য দিকে জাল-ডিটেকটিভ অর্থাৎ আমার বন্ধু কুমারকে সদর গেটের কাছে প্রহরীর ঘরে মিথ্যা অভিনয়ে আটক কোরে দিয়েছিল।”
মিঃ বেকার আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া বলিলেন, “চমৎকার! আমার ভাষা নেই যে তোমার এই বুদ্ধির প্রশংসা করি, মোহন। কিন্তু দু’একটা বিষয়ে আলোকপাত করে দেখি। প্রথমতঃ, ঘর তালাবদ্ধ ছিল, চাবি ছিল কুমারের কাছে, তবে দ্বার খোলা সহজ হ’ল কি প্রকারে?”
মোহন হাসিয়া কহিল, “খুব সহজেই। আমাদের কাছে চাবি খোলবার আর লাগাবার বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি :আছে, তাও কি আপনি অবগত নন?”
মিঃ বেকার মৃদু হাসিয়া কহিলেন, “তা-বটে! আর কে তিনি এমন বিখ্যাত ডিটেকটিভ, যার নাম শুনেই কুমারের মত বিশিষ্ট লোক এমন আগ্রহ দেখাতে পারেন, মোহন?”
মোহনের সারা মুখে হাসি উপছাইয়া উঠিল। সে কহিল, “অতি প্রসিদ্ধ, অতি যশস্বী, অতি নিপুণ, দস্যু মোহনের একমাত্র উপযুক্ত শত্রু চীফ ইন্সপেক্টার মিঃ বেকার।“
মিঃ বেকার চক্ষু কপালে তুলিয়া কহিলেন, “কী? আমি স্বয়ং?”
“হাঁ বেকার, আপনি স্বয়ং এবং আমার নাটকের অভিনয়ের “এই অংশটুকুই সব চেয়ে বিস্ময়কর। এখন আপনি যদি পুরীতে যান, আর কুমারের সঙ্গে আলাপ করেন, তা’হলেই আপনার সব কিছু পরিষ্কার হ’য়ে যাবে। আর এ কর্তব্যবোধও আপনার জাগবে যে আপনার জন্যই কুমারের অধিকাংশ সম্পদ লুন্ঠিত হ’য়েচে। আপনার কর্তব্য হবে, আপনাকে গ্রেপ্তার করা, তা হলে আমার পক্ষে সেটা খুব আনন্দদায়ক প্রতিহিংসা নেওয়া হ’বে। মিঃ বেকার গ্রেপ্তার করেছেন মিঃ বেকারকে!”
মোহন অট্টহাস্যে ভাঙ্গিয়া পড়িতে লাগিল। সে হাসির যেন আর বিরাম নাই, অন্ত নাই। মিঃ বেকার ক্ষুব্ধ মনে দাঁত দিয়া ঠোঁট কামড়াইতে লাগিলেন। ভাবিয়া পাইলেন না, মোহনের ইহাতে হাসিবার কি আছে।
এমন সময়ে একজন ওয়ার্ডার ও একটি লোক মোহনের মধ্যাহ্ন ভোজনের আহার্য লইয়া উপস্থিত হইল। বিশেষ অনুগ্রহ করিয়া জেলের কর্তৃপক্ষগণ মোহনের জন্য বাহির হইতে খাবার দেওয়ার অনুমতি দিয়াছিলেন। লোকটি টেবিলের উপর পাত্রগুলি রাখিয়া ওয়ার্ডারের সহিত বাহির হইয়া গেল। মোহন আহারে বসিয়া দু’ এক গ্রাস আহার করিয়া কহিল, “অধৈর্য হবেন না, মিঃ বেকার। আপনাকে পুরী যাবার কষ্ট আর পেতে হবে না। আমি আপনাকে এমন একটা সংবাদ দিচ্ছি, যা শুনে আপনার চক্ষু স্থির হ’য়ে যাবে। মোহনের বিরুদ্ধে যে কে কুমার করেছিলেন, তা তিনি তুলে নিচ্ছেন!”
মিঃ বেকার বিস্ময়ে চিৎকার করিয়া কহিলেন, “কী?”
মোহন শান্তকণ্ঠে কহিল, “মোকদম৷ তুলে নেওয়া হচ্ছে।”
মিঃ বেকার বিদ্রূপ হাস্যে কহিলেন, “বাজে বোকো না। আমাকে এই মাত্র চীফ চিঠি পাঠিয়েছেন।
৯৭
মোহন কহিল, “তাতে কি হ’ল? আপনার চীফ কি মোহনের ব্যাপার সম্বন্ধে মোহন অপেক্ষা বেশী খবর রাখেন?
তবে শুনুন আপনাকে খুলেই বলি। কিন্তু আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, মিঃ বেকার। হাঁ, সেই জাল মিঃ বেকার অর্থাৎ আমার সহচর সেখানে কুমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব পাতিয়ে বসেছেন। ফলে কুমার তাঁর সিন্দুকের মধ্যস্থিত বহুশতাব্দীর, বর্তমানে অকেজো মূল্যহীন স্মৃতি সম্পদগুলির জন্য জাল বেকারের মধ্য দিয়ে মোহনের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন। তিনি পাঁচলক্ষ টাকা নগদ দিতে প্রস্তুত হয়েছেন। ঐ জিনিসগুলি ফেরত দেওয়া হ’লেই, তিনি মোহনের নামে মোকর্দমা তুলে নিতেও স্বীকৃত হ’য়েছেন। সুতরাং চুরির কোন কথাই ওঠে না। ফলে পুলিসকেও হতাশ হ’তে হবে।”
মিঃ বেকার শুধু বিস্ময়ে চাহিয়া কহিলেন, “কিন্তু এ সব খবর তোমার কাছে এলো কি কোরে?”
“আমি যে টেলিগ্রামের প্রতীক্ষা করছিলাম এই মাত্র তা’ পেয়েছি।” মোহন হাসিতে হাসিতে কহিল।
“তুমি এই মাত্র টেলিগ্রাম পেয়েছে?” মিঃ বেকার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন।
“প্রিয় বন্ধু, এই মুহূর্তে! আচ্ছা আপনার সম্মুখে আমি পড়ছি—কিন্তু আপনি যদি অনুমতি দেন।” মোহন কহিল।
মিঃ বেকার অসন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “তুমি আমার সঙ্গে বিদ্রূপ করছ, মোহন!“
“না বন্ধু, না।” মোহন মৃদু হাস্যে কহিল, “আচ্ছা এক কাজ করুন। আমার জন্য ঐ যে সিদ্ধ ডিমটা দিয়েছে, ওর মাথাটা খুব আস্তে ভেঙ্গে ফেলুন দেখি? তা হ’লেই আপনি বুঝতে পারবেন যে, মোহন গুরুতর বিষয় নিয়ে মিথ্যে দত্ত করে না বা ঠাট্টা-বিদ্রূপও করে না!”
মিঃ বেকার বিস্মিত হইয়া মোহনের নির্দেশ মত ডিমের মাথাটা ছুরি দিয়া কাটিয়া ফেলিলেন। তিনি সবিস্ময়ে দেখিলেন, ডিমের ভিতর একেবারে খালি; ডিমের মধ্যে একটা খুব পাতলা নীলবর্ণ কাগজ গুটানো রহিয়াছে। তিনি কাগজখানি টানিয়া বাহির করিয়া পড়িলেন, তাহাতে ছোট অক্ষরে লেখা আছে—
“বন্দোবস্ত মত কাজ হয়েচে। কুমার পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়েছেন, মোকর্দমা তুলে নিয়েছেন এবং তাঁর মণি-মুক্তা ফেরত হয়েছে।”
মিঃ বেকার স্তম্ভিতস্বরে কহিলেন, “পাঁচলক্ষ টাকা!”
মোহন মৃদু হাসিয়া কহিল, “হাঁ বন্ধু, পাঁচলক্ষ টাকাই বটে! কিন্তু কেমন দুঃসময় চলেছে এখন? তা ছাড়া আমার খরচ-পত্র অত্যন্ত বেশী। যদি আপনি আমার খরচের হিসাব ঠিক মত জানতেন, তা’হ’লে বুঝতেন একটা বড়ো শহরের জন্য গভর্ন- মেণ্টের যে টাকা খরচ হয়, আমার খরচও প্ৰায় ততো।”
মিঃ বেকার উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার মনের শান্তি চলিয়া গিয়াছিল। মোহনের বিবৃতিতে কোন গলদ আছে কি না তিনি ক্ষণকাল মনে মনে চিন্তা করিয়া কহিলেন, “ভগবানকে ধন্যবাদ যে ভারতবর্ষে দশ বিশটা মোহন নেই, তা’ হ’লে আমাদের কারবার বন্ধ কোরে দিয়ে চলে যেতে হ’তো।”
মোহন কহিল, “না, না, এমন আর আমি আর বেশী কি করতে পারি? তবে অবসর সময় কাটাবার জন্য মাঝে মাঝে কিছু করতে হয় বৈ কি! তা’ ছাড়া যে সময়ে আমি জেলে থাকি, সে সময়েই কাজ করবার সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া যায়।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “তার মানে? তোমার আসন্ন বিচার সাক্ষী-সাবুদ, জেরা, এত সব বিষয়েও চিন্তা কোরে তোমার অবসর সময় কাটে না?”
মোহন ধীরে ধীরে কহিল, “না। কারণ আমি স্থির করেছি বিচারের সময় আদালতে উপস্থিত হবো না। “
মিঃ বেকার বিদ্রূপ-হাস্যে কহিলেন, “আহা, তাই না কি?”
মোহন পুনরায় কহিল, “না, আমি আদালতে হাজির হবো না।”
“সত্যি?” মিঃ বেকার জিজ্ঞাসা করিলেন।
মোহন ভ্রূ-কুঞ্চিত করিয়া কহিল, “আপনি কি সত্য সত্যই ভাবেন যে, জেলে পচবার জন্য মোহনের সৃষ্টি হয়েছে? এমন ধারণাও আমার পক্ষে অপমানজনক। মোহন যে কয়দিন স্ব- ইচ্ছায় জেলে থাকবে, মাত্র সেই কয় দিন, নইলে জগতে কা’র ও সাধ্য নেই, তাকে একটা মিনিটও বেশী জেলে রাখতে পারে।”
মিঃ বেকার বিদ্রূপস্বরে কহিলেন, “এতই যদি ক্ষমতা, তা’ হ’লে জেলে না আসাই তোমার উচিত ছিল, মোহন!”
মোহন উত্তেজিত স্বরে কহিল, “ও, আপনি সেই অহঙ্কারেই ফুলে আছেন—না? তবে শুনুন মিঃ বেকার, আমার সম্মানিত বন্ধু, মিঃ বেকার! মোহনের অঙ্গে হাত দেবার সাধ্য কা’রও পক্ষেই সম্ভব হ’তো না, যদি সে সে-সময়ে অপর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত না থাকতো।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “তুমি উদ্ভট কথা বল্ছ, মোহন! “
মোহন কহিল, “আপনার কি মনে পড়ে মিঃ বেকার, আমার সঙ্গে একটি তরুণীর কথা? আমাকে সে মুগ্ধ করেছিল, বলতে আমার লজ্জা নেই, আমি তাকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি। আর একমাত্র এই জন্যই আমি সে সময়ে অত্যন্ত অন্যমনস্ক হয়েছিলাম, সেজন্য তোমার উপস্থিতি সেখানে দেখেও নিজের সম্বন্ধে সাবধান হইনি। তাই আজ আমি এখানে, নইলে……”
মোহন কথা শেষ করিল না।
মিঃ বেকার বিদ্রূপম্বরে কহিলেন, “তা’ হ’লেও তোমার এখানে বহুদিন কেটে গেছে।”
মোহন কহিল, “আমি দস্যু। আমি সেই নিরীহ, অপাপ-বিদ্ধ, অতুলনীয় তরুণীর সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। তাই আমি তাকে ভুলে যেতে চাই। আমার মন আরোগ্য করতে চাই। আজ পর্যন্ত আমার মনে সেই কয়টি দিনের মধুর স্মৃতি তেমনি রূপেই জেগে রয়েছে। এর জন্যই মাঝে দিন কতক অসুখে ভুগেছি। আর জেলের মত এমন বিশ্রামের জায়গা আর কোথাও নেই। আমি এখানে বিশ্রাম করছি, মিঃ বেকার। এখানকার নিয়ম-কানুন আমাকে আশাতীত ভাবে আরোগ্য হবার সাহায্য করেছে! তাই আমি এখনও এখানে আছি।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “তুমি আমার চোখে ধূলো দিতে চাইছ, মোহন।”
“শুনুন, মিঃ বেকার” মোহন কহিল, “আজ শনিবার। আগামী বুধবারে আমি আপনার সঙ্গে ব্রডওয়ে হোটেলে একসঙ্গে আহার করবো। অর্থাৎ ঐ দিন আমি এখান থেকে চলে যাবো। বুঝেছেন?”
মিঃ বেকার অবজ্ঞা হাস্যে কহিলেন’ “উত্তম! আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।”
ইহার পর উভয়ে বন্ধুর মত করমর্দন করিবার পর মিঃ বেকার যাইবার জন্য পা বাড়াইলে, মোহন ডাকিল, “মিঃ বেকার?”
মিঃ বেকার মুখ ঘুরাইয়া কহিলেন, “আবার কি বল্ছ, মোহন?”
“আপনি ঘড়ি ফেলে যাচ্ছেন।” মোহন কহিল।
“আমার ঘড়ি?” সবিস্ময়ে মিঃ বেকার কহিলেন।
“হ্যাঁ, আপনার ঘড়ি। এই মাত্র আমার পকেটে কুড়িয়ে পেলাম।” বলিয়া মোহন ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া ঘড়ি ফেরৎ দিল। পুনরায় কহিল, “ক্ষমা করবেন, মিঃ বেকার। এ একটা বদ অভ্যাস জন্মে গেছে আমার। তা’ ছাড়া আমার ঘড়ি আপনারা রেখে দিয়েছেন, কিন্তু সে অপরাধের জন্য আপনার ঘড়ি চুরি করবার আমার কোনও অধিকার যে নেই, তা সত্য। তা’ছাড়া আমার এখানে একটা সোনার ঘড়ি আছে, তা’তেই আমার সময় দেখার কাজ সুন্দর ভাবে চলে যায়।“
বিছানার তলদেশ হইতে মোহন স্বর্ণচেন সমেত একটি সুন্দর সোনার ঘড়ি বাহির করিয়া দেখাইল।
মিঃ বেকার আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “ও ঘড়িটি কার পকেট থেকে মেরেছ, মোহন?”
মোহন ঘড়ির চেনের কলেটের ওপর খোদাই নামটি পড়িয়া কহিল, “গোপাল আচারিয়া লিঙ্গম। ওহো যে, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে পরীক্ষা করেছিলেন এটা তাঁরই ঘড়ি। অত্যন্ত ‘চমৎকার লোক তিনি।”
মিঃ বেকারের বিস্ময় এত বৃদ্ধি পাইল যে, তিনি একটিও কথা৷ বলিতে পারিলেন না। তিনি মোহনের হাত হইতে ম্যাজিস্ট্রেটের ঘড়িটি লইয়া বাহির হইয়া গেলেন।
১৮
একদিন মোহন জেলে মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ করিয়া, সবেমাত্র একটি বৃহৎ সিগার ড্রয়ার হইতে বাহির করিয়া, সিগারের মধ্য- স্থলের টিকিটের ব্যাণ্ডটি পাঠ করিতেছিল, এমন সময়ে সেলের দ্বার মুক্ত হইলে, সে অতি ব্যস্ততার সহিত হাতের সিগারটী পুনরায় ড্রয়ার মধ্যে রাখিয়া দিল। অল্পের জন্য তাহার কার্য ধরা পড়িল না।
ওয়ার্ডার কহিল, “তোমার এক্সারসাইজের সময় হ’য়েছে, এস।”
মোহন হাস্যমুখে কহিল, “চল বন্ধু, আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
প্রহরী-বেষ্টিত হইয়া মোহন জেলের ওয়ার্ডারের সহিত বাহির হইয়া গেল।
মোহন বাহির হইয়া যাইবামাত্র দুইজন ডিটেকটিভ, তাহার সেলের মধ্যে প্রবেশ করিল ও তাহার কক্ষটী পুঙ্খাপুঙ্খরূপে সার্চ করিতে লাগিল। তাহারা প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছিল যে, আজ মোহনের সমস্ত চালাকি তাহারা ফাঁস করিবে। কারণ ইহা প্রমাণিত সত্য যে, মোহন বাহিরে চিঠিপত্র লিখিতেছিল, তার পাঠাইতেছিল এবং চিঠিপত্র পাইতেছিল, কিন্তু কি উপায়ে, আজ তাহা আবিষ্কার করিবার জন্য তাহারা দৃঢ়সঙ্কল্প হইয়া আসিয়াছিল। সেদিন মাদ্রাজের হিন্দু-কাগজে মোহনের লিখিত একখানি পত্র প্রকাশিত হইয়াছিল। তাহাতে লেখা ছিল,
হিন্দু সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,
মহাশয়,
আপনি আপনার কাগজে আমাকে অযথা গালাগালি করিয়া- ছেন, সুতরাং তাহার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য আমার মোকর্দমার যে দিন স্থির হইয়াছে তাহার দুইদিন পূর্বে আপনার সহিত দেখা করিব এবং যথোপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ করিব।
আপনার বিশ্বস্ত
মোহন
পত্রের লেখা যে মোহনের স্বহস্তের, তাহা পরীক্ষায় নির্ধারিত হইয়াছিল। ইহা নিঃসন্দেহে আশা করা যায় যে, মোহন জেল হইতে পলায়ন করিবার জন্য আয়োজন করিতেছে। সুতরাং তাহার সকল মতলব ধ্বংস করিবার জন্য গভর্নমেন্ট উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেলেন।
যে কোন গভর্নমেন্টের পক্ষে এরূপ অবস্থা অসহনীয়। যে ম্যাজিস্ট্রেট মোহনকে পরীক্ষা করিয়াছিলেন, তাঁহার সহিত বন্দো- বস্তু করিয়া পুলিস-কমিশনার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের বড় সাহেবকে সঙ্গে লইয়া একদিন জেল পরিদর্শন করিতে গেলেন। জেলে উপস্থিত হইয়া তিনি দুইজন ডিটেকটিভকে মোহনের কক্ষ বিশেষরূপে সার্চ করিবার জন্য পাঠাইয়া দিলেন।
ডিটেকটিভ দুইজন সেলের বিছানাপত্রের সেলাই খুলিয়া, ভাঙ্গা টেবিলের তক্তা খুলিয়া, পায়া খুলিয়া, কক্ষের মেঝের পাথর তুলিয়া, চতুর্দিক পরীক্ষা করিতে লাগিল; কিন্তু কোন স্থানেই কোন কিছু না পাইয়া হতাশ হইয়া চলিয়া যাইবার জন্য উপক্রম করিতেছিল, এমন সময়ে একজন ওয়ার্ডার আসিয়া কহিল, “ড্রয়ার দেখেছেন? আমার মনে হ’ল মোহন ড্রয়ারের মধ্যে যেন কিছু রাখলে।”
অর্ধমুক্ত ড্রয়ারে যে কিছু থাকিতে পারে না, এই বিশ্বাসে ডিটেকটিভ, দুইজন তাহ! উপেক্ষা করিয়াছিল, ওয়ার্ডারের কথায় পরীক্ষা করিতেই পূর্বোক্ত সিগারটী পাইয়া তাহারা আনন্দে চিৎকার করিয়া কহিল, “জয় ভগবান, পেয়েছি।”
একজন ডিটেকটিভ কহিল, “না, না, সিগার এখানে ভেঙ্গো না, চল, কমিশনার সাহেবকে প্রথমে বলি। তিনিই পরীক্ষা করবেন।”
অন্য ডিটেকটিভ কহিল, “কিন্তু চুরুটের মধ্যে কিছু পাওয়া যাবে কি?”
কমিশনার চুরুটটি পাইয়া, কয়েক মিনিট পরে তাহা ধীরে ধীরে খুলিতে লাগিলেন। ইতোমধ্যে ডিটেকটিভ দুইজন অপর ড্রয়ার হইতে কতকগুলি সংবাদ-পত্রের কাটিং, একটা পাইপ, কিছু তামাক ও দুইখানি পুস্তক বাহির করিলেন।
কমিশনার আনন্দিত স্বরে কহিলেন, “এখন প্রত্যেকটী জিনিস পরীক্ষা করে দেখা যাক, আমরা কতদূর মোহনের সম্বন্ধে জানতে পারি।” তিনি সিগারটী পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, “মোহন দেখচি খুব দামী সিগারের ধূম পান করে।” পরে দেখি- লেন, তাহাতে মেয়েলী হাতে লেখা রহিয়াছে;-
“৩৫৭৮ অন্যের স্থান স্থান গ্রহণ করছে। দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে ধাক্কা দিলেই মুক্ত হবে। এম, সি, অপেক্ষায় থাকবে। ২টা থেকে ৬টা প্রত্যহ। ৬টা প্রত্যহ। জবাব দিন। ভয় পাবেন না। আপনার বন্ধুরা সর্বদাই পথ চেয়ে আছে।”
কমিশনার ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “অর্থ বোঝা খুবই সহজ। ৩৫৭৮ হচ্ছে খুব সম্ভবতঃ প্রিজন ভ্যানের নম্বর। নয় কী?”
জেলের সুপার নিকটেই ছিলেন কহিলেন, “হাঁ।”
“তা’ হ’লেই দেখা যাচ্ছে, প্রিজন ভ্যানের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে দস্যুর সঙ্গীরা কিছু শয়তানী করেছে। তারপর সব পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এম, সি, কি? ও বুঝেছি, মোটর কার।” বলিয়া কমিশনার উঠিয়া দাঁড়াইলেন; কহিলেন, “মোহনের মধ্যাহ্ন ভোজন শেষ হ’য়েছে?”
ওয়ার্ডার কহিল, “হাঁ, স্যার।”
“তবেই দেখা যাচ্ছে, মোহন এখনও এই সিগারের সংবাদ পায় নি। আরও বোঝা যাচ্ছে যে, সে সবেমাত্র এই সিগার পেয়েছিল, পড়বার সুযোগ পায় নি এখনও।”
সুপার বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “কিন্তু সিগার এলো কোন্ পথে? কোন্ উপায়ে?”
কমিশনার কহিলেন, “আমি তা’ কি কোরে বলবো? এমন ও হ’তে পারে, তার খবরের সঙ্গে কিম্বা সিদ্ধ আলুর তালের মধ্যে। “
সুপার কহিলেন, “অসম্ভব। আমরা এই ভেবে মোহনকে বাইরের খাবার খেতে অনুমতি দিয়েছিলাম যে, ওর সম্বন্ধে অনেক নতুন খবর শুনতে পাবো। কিন্তু ওর খাবার পরীক্ষা কোরে আমরা কিছুই পাই নি।”
কমিশনার কহিলেন, “এক কাজ করুন, যাতে আমরা এই সিগার-পত্রের উত্তরে মোহনের জবাব সন্ধ্যার মধ্যেই পেতে পারি, তার বন্দোবস্ত করুন। আমি এই পত্র এখনি মিঃ গোপাল আচারিয়া লিঙ্গমের কাছে নিয়ে যাচ্ছি, তিনি যদি বলেন, তা’হলে এর ফটোগ্রাফ তুলে নেব। পরে অবিকল এই ব্রাণ্ডের অন্য সিগারের মধ্যে পত্রখানা রেখে মোহনের ড্রয়ারে রেখে দেবো। এমন ভাবে কাজ করতে হবে, যেন ওর সন্দেহ না হয় যে, আমরা এ বিষয়ে কিছু অবগত হয়েছি। ইতিমধ্যে মোহনকে সেলের বাইরে রাখবার বন্দোবস্ত যেন হয়।”
সুপার কহিলেন, “আপনার আদেশ মতই কার্য হবে।”
১৯
পুলিস কমিশনারের আদেশ মত মোহনের সেদিনের রাত্রের উচ্ছিষ্ট খাবার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের ল্যাবরেটরীতে আনীত হ’ল।
দুইজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডিটেকটিভকে দিয়া অবশিষ্ট উচ্ছিষ্ট খাবার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করাইলেন কিন্তু কিছুই সন্দেহজনক পাওয়া গেল না। বাসন-কোসনও পরীক্ষা করা হইল, কিছুই পাওয়া গেল না। অবশেষে একটি ছুরির তলদেশের ফাঁপা অংশের মধ্য হইতে পাতলা কাগজে লেখা একখানি পত্ৰ বাহির হইল। পুলিস কমিশনার আনন্দে অস্ফুট চিৎকার করিয়া উঠিলেন। কহিলেন, “মোহনের মত দস্যুর পক্ষে এরূপ ভাবে পত্র পাঠানো ছেলেমানুষি হয়েচে। যাই হোক কি লিখেছে দেখা যাক।” তিনি পত্রখানি পাঠ করিলেন। তাহাতে লেখা ছিল :–
“আমি তোমার উপর নির্ভর করচি। এম, সি, প্রত্যহই যেন একটু দূরে দূরে থাকে। আমি সম্মুখের দিকে অগ্রসর হবো। শীঘ্র সাক্ষাৎ হবে।“
তোমার প্রিয়তম বন্ধু
মোহন”
“অবশেষে তোমাকে ধরেছি মোহন!” পুলিস কমিশনার মহানন্দে চিৎকার করিয়া উঠিলেন।
“যাই হোক এতদিনে আমরা ওর বিষয় জানতে সক্ষম হয়েচি, আমাদের পক্ষে আশাতীত সাফল্য বলতে হবে।”
একজন ডিটেকটিভ কহিল, “এবার ওকে পালাবার একটু সুযোগ দিতে পারলেই, ওর দলবল সবাইকে আমরা গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবো, স্যর।”
কমিশনার কহিলেন, “কিন্তু ও যা’ চালাক, আমাদের চোখে যদি ধুলো দিয়ে সরে পড়ে, তা’ হ’লে?”
ডিটেকটিভ কহিল, “সে জন্য আমাদের বহু লোকের বন্দো- বস্ত করতে হবে ওর ওপর নজর রাখবার জন্য। তা’তেও যদি বেশী চালাকি কোরে পালাবার মতলব করে, তা’ হ’লে ওকে নিজের কর্মের ফল ভোগ করতে হবে। “
কমিশনার কহিলেন, “সে ক্ষেত্রে ওকে গুলি করতেও যা’তে দ্বিধা না করে, তেমন হুকুম দিয়ে রাখবো। তা’ ছাড়া ওকে আমরা কিছুতেই কোন বিষয় স্বীকার করাতে পারিনি, ওর সহকারীদের ধরতে পারলে আমাদের কাজ সহজ হ’য়ে আসবে। “
মোহন আদৌ বেশী কথা কহে না। ম্যাজিস্ট্রেট তাহাকে নানা ভাবে জেরা করিয়াছিলেন, কিন্তু কিছুই জানিতে পারেন নাই। উপরন্তু তিনি আদালতের একজন বিখ্যাত উকীলকে পর্যন্ত সঙ্গে লইয়া মোহনকে জেরা করিয়াছিলেন, কিন্তু কোনও ফলই ফলে নাই। এক এক সময়ে জেরার উত্তরে মোহন নম্র- স্বরে বলিত, “আপনাদের কথাই সত্য, স্যার। আমি স্বীকার করছি, পলাশডাঙ্গা রাজবাড়ীতে চুরি আমিই করেছিলাম, গভর্নরের এডিকংয়ের স্ত্রীর মুক্তা-নেকলেস আমিই নিয়েছিলাম। জাল নোট আমিই ছেপেছিলাম, তারপর হীরাপুরের জমিদার-বাড়ীতে, কলিকাতার ধনকুবের দত্তদের প্রাসাদে, স্বনামধন্য মিত্র-প্রাসাদে, বর্ধমান রাজবাড়ীতে আমিই চুরি করেছিলাম। আমি স্বীকার করছি, যেখানে যত নাম করা চুরি, ডাকাতি, সিঁদকাটা হ’য়েচে, আমিই সমস্ত সম্পন্ন করেছিলাম।”
ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, তা’ হ’লে কি করেছিলে, বলো শুনি?”
“তার কোন আবশ্যকই নেই, স্যার। আমি স্বীকার করছি, আমিই করেছিলাম। যা বল্লুম, তা’র দশগুণ, বিশগুণ বেশী অকর্ম আমি করেছি, স্যর।” মোহন বলিল।
প্রতিদিনই পুলিস-ভ্যানে করিয়া মোহনকে অন্যান্য বন্দীদের সহিত পুলিস অফিসে লইয়া যাওয়া হইত এবং প্রতিদিনই ম্যাজিস্ট্রেট তাহাকে জেরা করিতে চেষ্টা করিতেন এবং প্রতিদিনই ক্লান্ত হইয়া হাল ছাড়িয়া দিতেন। অবশেষে বেলা ৪টার সময় আবার তাহাকে জেলে আনিয়া রাখা হইত।
একদিন অপরাহ্ণে তখনও অন্যান্য অপরাধীদের পরীক্ষা শেষ হয় নাই, বিশেষ কারণ বশতঃ একা মোহনকে লইয়া জেলের গাড়ী জেলে ফিরিবার মনস্থ করিল।
গাড়ী আদালত হইতে. ছাড়িলে, মোহন দেখিল, সে মাত্র একা গাড়ীর মধ্যে রহিয়াছে। তাহার মুখে এক জাতের হাসি ফুটিয়া উঠিল।
প্রিজন-ভ্যান সব দেশেই প্রায় একই ধরণের। দুই দিকে কয়েদীদের বসিবার স্থান থাকে, মধ্যে সরু খালি স্থান থাকে। পশ্চাতে পুলিস-প্রহরী থাকে, সে মধ্যে মধ্যে খালি স্থানের দিকে দৃষ্টি রাখে। কারণ কোন কয়েদী যদি পলাইবার চেষ্টা করে তবে তাহাকে সিট্ হইতে উঠিয়া মধ্যের সরু পথ দিয়া তবে দ্বার অভিমুখে যাইতে হইবে এবং সেরূপ করিলে প্রহরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে।
মোহন সচকিত হইয়া উঠিল। প্রিজন ভ্যান যখন কোর্ট হইতে বাহির হইয়া প্রায় মধ্য-পথে পৌঁছাইল, সে একবার আড়- চোখে পশ্চাতে চাহিয়া দেখিল, প্রহরী নীচু হইয়া মধ্য-পথের দিকে অনন্যমনা হইয়া দৃষ্টি ফেলিয়া বসিয়া আছে।
মোহন ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে পা দিয়া চাপ দিল। সে বিস্মিত হইয়া দেখিল, দেওয়ালের নিম্নভাগ ধীরে ধীরে বাহিরের দিকে ফাঁক হইয়া গেল। আর একটু চাপ দিলেই একজনের বাহির হইবার যথেষ্ট স্থান হইবে। মোহনের বক্ষের ভিতরকার হৃৎপিণ্ড উদ্দাম নৃত্য করিয়া উঠিল। সে নিঃশব্দে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল।
প্রিজন-ভ্যান্ জর্জ টাউন পার হইয়া অগ্রসর হইয়া সহসা পথের মধ্যে দাঁড়াইয়া পড়িল। মোহন বিস্মিত হইয়া চাহিয়া দেখিল, পথের মাঝে একখানা ঘোড়ার গাড়ী ঘোড়া-সমেত পড়িয়া রহিয়াছে, পথ বন্ধ হইয়া গিয়াছে এবং পথের অপর পার্শ্বে আর একটি প্রিজন ভ্যান দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। মোহন সকল পরিস্থিতি এক দৃষ্টিতে দেখিয়া লইল। চারিদিকে লোক- জন জমায়েত-হইয়াছে। মোহন এ সুযোগ আর উপেক্ষা করিতে পারিল না। চারিদিকে হট্টগোল, চিৎকার হইতেছিল, মোহন নিঃশব্দে পায়ের চাপ দিয়া ঝুপ করিয়া নীচে লাফাইয়া পড়িল। তাহাকে প্রিজন ভ্যান হইতে লাফাইয়া পড়িতে দেখিয়া নিকটেই দণ্ডায়মান একটি ট্যাক্সি ড্রাইভার হাসিয়া উঠিল এবং চিৎকার করিয়া প্রহরীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে গেল, কিন্তু পথের গোলমালে প্রহরীর কর্ণে তাহা পৌছিল না।
মোহন লাফাইয়া পড়িয়াই এক দৌড়ে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া গিয়া বাম ফুটপাত দিয়া চলিতে লাগিল। সহসা একবার দাঁড়াইয়া পিছন ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল, তাহার পর দুই পকেটে হাত প্রবেশ করাইয়া ভদ্রলোকে যেরূপ ভাবে ভ্রমণ করেন, সেইভাবে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল।
কিছুদূর অগ্রসর হইয়া রাস্তার দক্ষিণ দিকে একটি চা-এর হোটেল দেখিয়া প্রবেশ করিল ও এক পিস্ কেক ও এক কাপ চা লইয়া পান করিল এবং এক প্যাকেট সিগারেট লইল।
হোটেলের খানসামা বিল লইয়া আসিলে, মোহন কহিল, “তোমার ম্যানেজারকে ডাকো।”
বয় ম্যানেজারকে ডাকিয়া আনিলে, মোহন উচ্চকণ্ঠে সকলকে শুনাইয়া কহিল, “আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, মনিব্যাগ সঙ্গে কোরে আনি নি। আশা করি আপনি আমার নাম শুনেছেন। অতএব আমাকে দু’ এক দিনের জন্য ক্ষমা করলে বাধিত হবো। আমি দস্যু মোহন।”
ম্যানেজার মনে করিলেন, ভদ্রলোক ঠাট্টা করিতেছেন তিনি উচ্চশব্দে, হাসিয়া উঠিলেন।
মোহন পুনরায় কহিল, “আমি দস্যু মোহন। আমি আপনার সঙ্গে বিদ্রূপ করছি না। আমি এইমাত্র প্রেসিডেন্সী জেল থেকে পালিয়ে এসেছি। আশা করি, আমার নামের ওপর আপনার শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আছে। বিদায়!”
মোহন এমন অতর্কিতে হোটেল হইতে বাহির হইয়া পড়িল যে, অন্যান্য খরিদ্দাররা উচ্চশব্দে হাস্য করিয়া উঠিল এবং ম্যানে- জার কোন বাধা দিবার সুযোগ পর্যন্ত পাইলেন না।
মোহন পথে নামিয়া ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল। রাস্তার পার্শ্বে সজ্জিত দোকান গুলির নানাবিধ দ্রব্যসম্ভার দেখিতে দেখিতে সে অগ্রসর হইতে লাগিল। তাহাকে দেখিয়া মনে হওয়া এতটুকু অস্বাভাবিক নহে, যেন সে ভ্রমণে বাহির হইয়াছে, হাতে কোন কাজ নাই, তাড়া নাই।
পথের কথা দুই একজনকে জিজ্ঞাসা করিতে করিতে মোহন অবশেষে প্রেসিডেন্সী জেলের গগণচুম্বী পাঁচীল ও তাহার সম্মুখ- ফটকের নিকট আসিয়া ফটকের সেণ্টীকে অভিবাদন করিয়া কহিল, “এটা কি প্রেসিডেন্সী জেল?”
সেণ্টী গম্ভীর মুখে কহিল, “হাঁ।”
মোহন কহিল, “আমি আমার সেলে ফিরে যেতে চাই। প্রিজন-ভ্যান ভুল কোরে আমাকে পথের মাঝে ফেলে এসেছিল। কিন্তু আমি কোন অন্যায় সুযোগ নিতে চাই না!”
সেন্ট্রী গজগজ করিয়া উঠিল, কহিল, “দেখ বাপু, লক্ষ্মীছেলের মত সরে পড়ো। এখানে মাতলামো কোরো না। যাও, পথ দেখো।”
মোহন নম্রস্বরে কহিল, “কিন্তু ভাই, আমার পথ এই ফটকের মধ্যে। তুমি যদি দস্যু মোহনকে ভিতরে যেতে না দাও, তার হ’লে তোমার বিপদ ঘটতে পারে, বন্ধু।”
প্রহরী চক্ষু কপালে তুলিয়া কহিল, “দস্যু মোহন? এ সব তুমি কি বলছ?”
মোহন দুঃখিতস্বরে কহিল, “আমি দুঃখিত যে, আমার কাছে কোন কার্ড নেই তোমাকে দেখাতে পারি।”
মোহন পকেটে খুঁজিবার ভান করিয়া পুনরায় কহিল, “না দাদা, কোন কার্ড নেই। কিন্তু ভদ্রলোকের কথা বিশ্বাস করো আমি দস্যু মোহন।”
প্রহরী স্তম্ভিত দৃষ্টিতে কিছু সময় চাহিয়া রহিল। সে মোহনের আপাদমস্তক চক্ষু বুলাইয়া পরীক্ষা করিল এবং একটিও কথা না বলিয়া ফটকের ঘণ্টা বাজাইল।
সঙ্গে সঙ্গে লৌহ- ফটক উন্মুক্ত হইয়া গেল। মোহন ভিতরে প্রবেশ করিল এবং বরাবর জেল অফিসে উপস্থিত হইল।
কয়েক মিনিট জেলের সুপার কৃত্রিম ক্রোধে চিৎকার করিতে করিতে প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “এ সব কি চালাকি, মোহন?”
মোহন মৃদু হাসিয়া কহিল, “থামুন স্যার, ওসব মিথ্যে রাগ আমার কাছে দেখাতে হবে না আপনাকে। আমি সব জানি। বেশ সুন্দর ফাঁদ পেতেছিলেন যা হোক! আপনাদের বুদ্ধি আছে তা’ আমায় স্বীকার করতেই হবে। প্রথমতঃ আদালত থেকে আমাকে একা আনা, দ্বিতীয়তঃ পথের মাঝে গাড়ী ফেলে গোলমাল সৃষ্টি করা, এ-সব আমার কি দৃষ্টি এড়াতে পারে ভাবেন? তারপর কুড়িজন ডিটেকটিভ, যে আমার পিছনে পাগলা কুকুরের মত, কেউ বা হেঁটে, কেউ বা সাইকেলে, মোটরে যাওয়া করছিল, তাও কি আমি দেখিনি ভাবেন? তারা ভেবেছিল, আমি এমনি নির্বোধ যে পালাতে চেষ্টা করবো, আর তারা গুলি চালিয়ে আমার দফা রফা কোরে দেবে! বাঃ গভর্নমেন্টের এই সব উচ্চ বেতনের কর্মচারীদের কি সুন্দর বুদ্ধি!” সুপার অতিকষ্টে হাস্য সম্বরণ করিয়া গম্ভীর মুখে চাহিয়া রহিলেন।
মোহন পুনরায় কহিল, “শুনুন স্যার, আপনার শিকারী কুকুরদের কোলে দেবেন, এমন কোরে যেন আমাকে তারা আর বিরক্ত না করে। আমি যখন পালাবার ইচ্ছে করবো, তখন কা’রও সাহায্য আমার প্রয়োজন হবে না।”
২০
দুই দিবস পরে মাদ্রাজের ও কলিকাতার সমস্ত সংবাদ-পত্রে দস্যু মোহনের পলায়ন-কাহিনী সবিস্তারে প্রকাশিত হইতে লাগিল। মোহনের নারী-বন্ধুর পত্র সিগারের ভিতর দিয়া প্রেরিত হওয়ার কাহিনী, তাহার পর আদালত হইতে তাহাকে একাকী লইয়া আশা, পথে ঘোড়া ও গাড়ী পড়িয়া পথ রোধ, মোহনের হোটেলে চা খাওয়া, অবশেষে জেলে ফেরত আসার কাহিনী সবিস্তারে দিনের পর দিন প্রকাশিত হইতে লাগিল।
মোহনের সহকারীদের দ্বারা জেলের ভ্যানের দ্বার কাটিয়া রাখা ইত্যাদি ঘটনা পাঠ করিয়া ভারতের নর-নারীর মনে দস্যু-মোহনের অদ্ভুত, অলৌকিক শক্তির পরিচয় আবার নূতন করিয়া দাগ কাটিতে লাগিল।
ইহার ফল এই হইল যে, অদূর ভবিষ্যতে মোহন যে জেল হইতে পলায়ন করিবে, সে বিষয়ে কাহারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ রহিল না। মোহনের তথাকথিত পলায়নের পরদিন আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ লিঙ্গম যখন জিজ্ঞাসা করিলেন, “মোহন, তোমার গতকল্যকার কাজের কৈফিয়ৎ আমাকে দাও।” তখন মোহন দীপ্তমুখে বলিয়াছিল, “দেখুন স্যর, গতকল্যকার অভিনয়ে আমার ভবিষ্যৎ পলায়নের রিহার্সাল দেওয়া হ’ল, এই ভাবেই সমস্যা সমাধান করতে পারেন।”
ম্যাজিস্ট্রেট বলিলেন, “আমি তোমার কথা এক বর্ণও বুঝতে পারলুম না।”
মোহন কহিল, “তার কোনও প্রয়োজন নেই।”
তারপর সংবাদ-পত্রে পূর্ণ ইতিহাস প্রকাশিত হইলে, তখন ম্যাজিস্ট্রেট ঐ একই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন; তখন মোহন বিরক্ত হইয়া উত্তর দিল, “ও ডিয়ার, ও ডিয়ার, ও ডিয়ার! সবের প্রয়োজন কোথায়? এ সব প্রশ্নের এতটুকু গুরুত্ব নেই।
ম্যাজিস্ট্রেট কহিলেন, “গুরুত্ব নেই, তুমি কি কোরে জানলে?”
মোহন কহিল, “নিশ্চয়ই নেই, কারণ আমি বিচারের দিন আদালতে হাজির হবো না।”
“আদালতে হাজির হবো না?” ম্যাজিস্ট্রেট সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন।
মোহন কহিল, “না, নিশ্চয়ই না, আমি সিদ্ধান্ত করেছি— আদালতে আমি হাজির হবো না। আমাকে এই সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুত করবে, এমন শক্তি আমার জানা নেই।
মোহনের এই উদ্ধত ঘোষণা ‘বাঙলার ডাক’ পত্রিকায় ও অন্যান্য কাগজে বড় বড় অক্ষরে ছাপা হইতে লাগিল। সাধারণ পাঠকেরা প্রতিদিন প্রাতঃকালে সংবাদ-পত্র খুলিয়া দস্যু মোহনের পলায়ন কাহিনী পড়িবার জন্য আগ্রহের সহিত সংবাদ খুঁজিতে লাগিল। দোকানে, বাজারে, অফিসে, বাসে, ট্রামে সকলের মুখে একই প্রশ্ন, মোহন কি পলাইয়াছে? কাহারও মনে বিন্দু- মাত্র সন্দেহ ছিল না যে, মোহন অতি সহজে পলায়ন করিতে সক্ষম হইবে মাত্র যে দিন তাহার ইচ্ছা হইবে, সেই দিনই সে পলায়ন করিবে—গভর্নমেন্টের এমন কোন শক্তি নাই যে তাহাকে বাধা দিতে পারে।
এমন যখন জনসাধারণের অভিমত, তখন কর্তৃপক্ষ যে নিশ্চিত হইয়া বসিয়া থাকিবে, তাহা আদৌ সম্ভবপর নহে। তাঁহারা সমস্যার পর সমস্যায় অভিভূত হইতে লাগিলেন।
প্রথমতঃ মোহন যখন পলাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছে, তখন সে তাহা প্রকাশ্যে ঘোষণা করিয়া এমন ভাবে সকলকে জানাইয়া তাহার পথে বিঘ্ন উৎপাদন করিবার সুযোগ দান করিল কেন? সবার উপর, মোহনের যে-পত্র ‘বাঙলার ডাক’ সংবাদ-পত্রে প্রকাশিত হইল, তাহাই বা কে ওই সংবাদ পত্রে প্রেরণ করিল? কর্তৃপক্ষ পলায়নের কথা জানিতে পারিয়া যে-কৌশলে জাল বিস্তার করিয়াছিলেন, সেই সংবাদ সবিস্তারে কি করিয়া সংবাদ- পত্রে প্রকাশিত হইল, তাহাও এক সমস্যার বস্তু। যে লোক জেল হইতে পলায়ন করিবে বলিয়া জগতের সম্মুখে ঢাক পিটাইতে পারে, সে লোককে দিবা-রাত্র দৃষ্টির মধ্যে রাখা হইলেও, মন সর্বদা উদ্বেগে পরিপূর্ণ হইয়া থাকে।
জেল-কর্তৃপক্ষ মোহনকে উপরের সেল হইতে নিম্নে আরও সঙ্কুচিত সেলে বন্দী করিলেন। তাহার উপর দৃষ্টি রাখিবার জন্য ওয়ার্ডারের সংখ্যাও বৃদ্ধি করিলেন।
ইহার পর দীর্ঘ দুইমাস অতিবাহিত হইয়া গেল। গত দুই মাস মোহন বিছানার উপর শয়ন করিয়া কাটাইয়া দিল। সে সর্বদা দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া শয়ন করিয়া থাকিত। কাহারও সহিত কথা কহিত না। তাহার উকীল বারবার দেখা করিতে চাহিয়৷ বিফল হইলেন। মোহন কাহারও সহিত দেখা করিল না। সে ওয়ার্ডারদের সহিত কথা বলা একদম বন্ধ করিল।
অন্যদিকে মোহনের পলায়নের কথা সকল সংবাদ-পত্রে প্রকাশিত হইতে লাগিল; ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ লিঙ্গম তাহাকে পুলিস- অফিসে লইয়া আসা বন্ধ করিলেন এবং এত দিন জেরা করিয়া ও যখন বিশেষ কিছুই জানিতে পারিলেন না, তখন জেরা করা একেবারে বন্ধ করিয়া দিলেন।
বিচারের একপক্ষ কাল পূর্বে সহসা মোহন সজাগ হইয়া উঠিল। সে কর্তৃপক্ষের নিকট কক্ষের বাতাসের অপ্রতুলতা সম্বন্ধে অভিযোগ জানাইল। তাহাকে জেলের উঠানে ব্যায়াম করিবার অনুমতি দেওয়া হইল। কিন্তু সর্বসময়ে তাহার দুই দিকে দুই প্রহরী মোতায়েন থাকিত।
ইতোমধ্যে জনসাধারণের উৎসাহ বিন্দুমাত্রও হ্রাস পায় নাই। তাহারা প্রতিদিনই মোহনের পলায়নের বার্তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছিল। সাধারণের দৃঢ় ধারণা জন্মিয়াছিল যে, মোহন নিশ্চয়ই পলায়ন করিবে। মোহন সাধারণের মনে তাহার জন্য যে সম্ভ্রম, যে আশা, যে উদ্দীপনা, যে শ্রদ্ধার ভাব উপ্ত করিতে সক্ষম হইয়াছিল, তাহা পরম বিস্ময়কর বলিলেও অত্যুক্তি করা হয় না। তাহাদের ধারণা জন্মিয়াছিল, মোহন পলায়ন করিবেই। ইহা অনিবার্য। এমন কি জনসাধারণ এই ভাবিয়া বিস্মিত হইতেছিল যে মোহন ইচ্ছা করিয়া প্রত্যহ দিন পিছাইয়া দিতেছে কেন?
প্রত্যহ প্রাতঃকালে পুলিস-কমিশনার তাঁহার সেক্রেটারীকে জিজ্ঞাসা করেন, “মোহন এখনও যায় নি?”
সেক্রেটারী বলেন, “না, স্যর।”
“যাক, বিপদ কেটে যাচ্ছে!” কমিশনার হাসিয়া কহিতেন।
বিচারের একদিন পূর্বে একজন ভদ্রলোক “হিন্দু” কাগজের সম্পাদকের সহিত দেখা করিতে চাহিলেন। তাঁহাকে সম্পাদকের নিকট লইয়া যাওয়া হইলে, তিনি একখানা কার্ড সম্পাদকের টেবিলের উপর ছুঁড়িয়া দিয়া, দ্রুতপদে কক্ষ হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
কার্ডে লেখা ছিল, “মোহন সর্বদা তাহার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে।”
পর দিন প্রভাতে হিন্দু কাগজে ঐ কার্ডের ইতিহাস বর্ধিত হইল।
২১
অদ্য মোহনের বিচারের দিন। চারিদিকে উত্তেজনা, উদ্বেগ শঙ্কার ভিতর দিয়া ইতিহাস প্রসিদ্ধ বিচারের দিন উপস্থিত হইল। আদালত-কক্ষ লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল। অবশেষে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় কোর্ট-পুলিস বিচার কক্ষের দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। আদালত-প্রাঙ্গণে, আদালতের বাহিরে জন-সমুদ্রের সমাবেশ হইল। সকলেরই প্রাণে আশা, একবার তাহারা মোহনকে দেখিবে। সকলেই আশা করিতেছিল, মোহন তাহার কথা নিশ্চয়ই রাখিবে, বিচারের জন্য আদালতে সে নিশ্চয়ই উপস্থিত হইবে না। আদালতের বাহিরে সমবেত মহতী জনতার কথা, তর্ক, আলোচনা একত্রে মিশ্রিত হইয়া সমুদ্র-কল্লোলের মত একটা শব্দতরঙ্গ আকাশে উত্থিত হইল।
সাধারণের উত্তেজনা লক্ষ্য করিয়া পুলিস এক ঢাকা ভ্যানে করিয়া মোহনকে লইয়া জেলের ওয়ার্ডারগণসহ আদালত-কক্ষের পশ্চাৎ দ্বার দিয়া প্রবেশ করিয়া, মোহনকে আসামীর ডকে প্রবেশ করাইয়া দিল।
তখন বৃষ্টি পড়িতেছিল; আকাশে আলো অপ্রচুর থাকায়, আদালত-কক্ষে মোহনকে বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যাইতেছিল না।
যে উকীল-ভদ্রলোক সস্তায় নাম কিনিবার জন্য স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া মোহনের পক্ষ সমর্থন করিবেন বলিয়া অনুমতি লইয়াছিলেন, তিনি ডকের নিকট গমন করিয়া নিম্নস্বরে মোহনকে বার বার প্রশ্ন করিয়াও একটা প্রশ্নেরও উত্তর পাইলেন না। মোহনকে দেখিয়া মনে হইতেছিল, সে যেন অত্যন্ত অসুস্থ। সে সোজা হইয়া বসিতে পারিতেছিল না, তাহার মস্তক অবিরত বক্ষের উপর ঝুলিয়া ঝুলিয়া পড়িতেছিল।
উকীল মহাশয় অবশেষে বিরক্ত হইয়া হাল ছাড়িয়া দিলেন ও বিচারককে কহিলেন, “হুজুর আমার মক্কেলকে অত্যন্ত অসুস্থ বোলে মনে হচ্ছে। আমি বহু চেষ্টা করেও একটা প্রশ্নের জবাবও পেলাম না। সুতরাং আমার প্রার্থনা যে, আমার মক্কেলকে ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করা হোক। “
বিচারক উকীলের এই প্রার্থনায় কর্ণপাত করিলেন না। তিনি মৃদু হাসিয়া কহিলেন, “আপনার মক্কেল যে এখানে বর্তমানে সবার চেয়ে সুস্থকায় ব্যক্তি, তা’ এখনি দেখতে পাবেন।”
উকীল প্রতিবাদ করিয়া কহিল, “হুজুর, আমি আজ পর্যন্ত আমার মক্কেলের নিকট হ’তে কোন উপদেশ পাই নি। সে ক্ষেত্রে আমার পক্ষে…”
বিচারক মৃদু হাস্যে বাধা দিয়া কহিলেন, “আসামীর পক্ষ গ্রহণ করা অসম্ভব। উত্তম, আপনি উপবেশন করুন। আমি এ কেস আর পাঁচটা মিনিটের জন্যও স্থগিত রাখতে দেবো না।”
উকীল মহাশয় আর একবার বৃথা প্রতিবাদ জ্ঞাপন করিয়া হতাশ হইয়া বসিয়া পড়িলেন।
জনতায় পরিপূর্ণ আদালত-কক্ষ রুদ্ধনিঃশ্বাসে মেঘ-ঘন স্বল্পা- লোকে আসামী মোহনকে উত্তমরূপে দেখিবার জন্য বৃথা চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু মোহন নতমুখে অবিন্যস্তভাবে উপবেশন করিয়া থাকায় তাহাদের বাসনা পূর্ণ হইতেছিল না। মোহন তাহার প্রতিজ্ঞা রাখিতে পারে নাই বলিয়া, তাহাদের বিফল – প্রত্যাশা- ক্ষুব্ধ মন স্বতঃই সম্পুর্ণ অজ্ঞাত কারণে বিচারকের বিরুদ্ধে, জেল- কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রভাবিত হইয়াছিল এবং যখন বিচারক মোহনের উকীলের আবেদন অগ্রাহ্য করিয়া মামলা স্থগিত রাখিতে অস্বীকৃত হইলেন, তখন একটা অশান্ত গুঞ্জনধ্বনি সারা কক্ষে উত্থিত হইল।
বিচারক কঠিন দৃষ্টিতে জনতার দিকে চাহিয়া, তাহাদের নীরব থাকিতে আদেশ দান করিলেন। জনতা ও আইনজীবি- গণের গুঞ্জনধ্বনি অকস্মাৎ স্তব্ধ হইয়া গেল।
বিচারক আসামীর দিকে চাহিয়া গম্ভীর স্বরে কহিলেন, “বন্দি, উঠে দাঁড়াও। তোমার নাম, বয়স, আর পেশা বলো।”
কিন্তু বিচারকের আদেশে আসামী কোনও সাড়া দিল না।
বিচারক পুনরায় কহিলেন, “তোমার নাম কী?“
একটা শ্রান্ত ও জড়িত স্বর আসামীর কাঠগড়া হইতে বাহির হইল, “নীলকমল দে।“
সঙ্গে সঙ্গে আদালত গৃহ জনতার গুঞ্জনধ্বনিতে পূর্ণ হইয়া উঠিল এবং বিচারক মুখ তুলিয়া -চাহিতেই মুহূর্ত মধ্যে নীরব হইয়া গেল।
“নীলকমল দে? নামটা তোমার নতুন আবিষ্কার? আমরা অবগত আছি, অন্ততঃ তোমার দশটা ছদ্ম-নাম আছে। এ নামটায় আর একটা সংখ্যা বাড়লো। সে যাই হোক্ তোমাকে আমরা তোমার সবচেয়ে বিখ্যাত নাম, মোহন ব’লেই ডাকবো আশা করি তা’তে তোমার কোন আপত্তি হবে না।” বিচারক শ্লেষ মিশ্রিত স্বরে কহিলেন।
বিচারক তাঁহার কাগজ-পত্রে চক্ষু বুলাইয়া পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “বন্দি, যথাসাধ্য চেষ্টা ক’রেও তুমি কে, আজ পর্যন্ত আমরা জানতে পারি নি। তুমি এমন একজন লোক, আর আমি এমন এক ব্যক্তির বিচার করতে বসেছি, যার অতীত ইতিহাস নেই। আমরা কিছুই জানি না, তুমি কে, কোথা থেকে তুমি এসেছ, তোমার বাপ-মা-ই বা কে, আর কোথায়ই বা তোমার শিশুকাল অতিবাহিত হ’য়েছিল। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে হ’লে, আমরা তোমার সম্বন্ধে প্রকৃতপক্ষে কিছুই জানি না। তুমি যেন হঠাৎ আকাশ থেকে নেমে এসেছ। মাত্র তিন বৎসর পূর্বে আমরা জানতে পারলুম যে, দস্যু-মোহন নামে অতি বুদ্ধিমান, নিপুণ বৈজ্ঞানিক, অতিশয় দানশীল এবং ভীষণ চরিত্রের একজন ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েচে। এই সময়ের পূর্বে তোমার যে আনুমানিক ইতিহাস আমরা জ্ঞাত হয়েছি, তার উপর সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করা না গেলেও, আমরা জেনেছি, তুমি ছয় বৎসর পূর্বে জহর নামে যাদুকর প্রোফেসার বিশ্বাসের শিষ্য হ’য়ে যাদু-বিদ্যা শিক্ষা করেছিলে। তারপর বিনয়কুমার নাম নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্থার ঘোষের ল্যাবরেটরীতে মানুষের দৈহিক গঠন নিয়ে অনুশীলন করেছিলে। সে সময়ে তোমার গুরু স্যর ঘোষ তোমার অসামান্য মেধা ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং বুঝবার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হ’য়ে গিয়েছিলেন। তারপরেই কলকাতায় এক জাপানীর কাছে দেবেন্দ্র নাম গ্রহণ কোরে জুজুৎসু ও অন্যান্য কৌশল শিক্ষা করেছিলে, তারপরে তুমি মোটরসাইকেল চালনায়, মোটর চালনায়, এরোপ্লেন চালনায়, অশ্বারোহণে অশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলে, তারপর এক মোটর রেসে জিনে দশহাজার টাকা পুরস্কার পেয়ে, সেই যে কোথায় অদৃশ্য হ’য়ে গেলে, আর কোন ঠিকানাই পাওয়া গেল না। পরে তুমি বহু লোককে বহু অর্থ দান করেছ, বহু সাধারণ প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য অর্থ নিয়মিত ভাবে দিয়ে আছ, অগ্নিদাহ, মহামারী প্রভৃতি রোগে বিপন্ন বহুজীবন রক্ষা করেছ এবং বহু ধনীর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছ।”
বিচারক এক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “এই গেল তোমার আনুমানিক ইতিবৃত্ত। এর পরই আমরা তোমাকে দেখতে পেলুম তুমি সমাজের শীর্ষস্থানীয়, ধনী, রাজা, মহারাজা প্রভৃতি নামকরা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছ। যে সব ব্যক্তির ওপর তোমার নজর পড়েছে, তাকেই কেউ রক্ষা করতে পারে নি। তোমার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, অসাধারণ মেধা, সুনিপুণ কৌশল, অপরিমিত লোকবল প্রতিপদে পুলিস বিভাগকে অপদস্থ করেছে। আমি স্বীকার করতে লজ্জিত হচ্ছি না যে, তোমার মত অসাধারণ মেধাবী অমানুষিক বুদ্ধিশালী ব্যক্তি আমি জীবনে আর অপর একটি দেখিনি। বন্দি! তুমি কি এই অভিযোগগুলি মেনে নিচ্ছে?”
বিচারক যখন বক্তৃতা করিতেছিলেন, তখন আসামী ন্যুব্জদেহে ঠেস দিয়া কাঠগড়া অবলম্বন করিয়া দাড়াইয়াছিল। তাহার হাত দু’টি শ্লথভাবে দুই পার্শ্বে ঝুলিতেছে। ইতিমধ্যে মেঘ কাটিয়া যাওয়ায়, আদালত কক্ষ আলোকিত হইয়া উঠিলে, সমগ্র জনতা চাহিয়া দেখিল আসামীর গণ্ড বসিয়া গিয়াছে, চক্ষু কোটরে প্রবেশ করিয়াছে। চক্ষু রক্তবর্ণ, গাত্রবর্ণ বিবর্ণ হইয়াছে। দেখা গেল জেলে মোহনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। মোহনের যে সুন্দর যৌবনসুলভ, মনোমুগ্ধকর প্রতিকৃতি গত কয়েক মাস ধরিয়া সংবাদ-পত্রে ছাপা হইতেছিল, তাহার সহিত আসামীর আদৌ সাদৃশ্য নাই। দর্শকগণের মন মোহনকে দেখিয়া বিষণ্ণ হইয়া উঠিল
বিচারক প্রশ্ন করিয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। কিন্তু বন্দীর কোন জবাব না পাইয়া, তিনি পুনরায় তাঁহার প্রশ্ন আবৃত্তি করিলেন। আসামী অতি কষ্টে দুইবার চেষ্টা করিয়া জড়িত- কণ্ঠে কহিল, “নীলকমল দে।”
বিচারক হাসিয়া উঠিলেন কহিলেন, “তোমার এই নতুন এবং অদ্ভূত উপায়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের অর্থ আমি বুঝতে অক্ষম, মোহন। যদি তুমি ভেবে থাকে৷ এই রকম নির্লিপ্ত ব্যবহার কোরে তুমি লাভবান হবে, তবে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি কোনও দিকে দৃকপাত না কোরে তোমার বিচার শেষ করবো, তুমি যত খুশি, ন্যাকামি করতে পারো।”
অতঃপর বিচারক দস্যু মোহন কর্তৃক সমাধিত চুরি ও ডাকাতির ইতিহাস বর্ণনা করিয়া, তাহার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধারায় চার্জ গঠন করিবার পূর্বে সাক্ষ্য গ্রহণ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। একে একে বহু সাক্ষী আসিয়া সাক্ষ্য দিয়া যাইতে লাগিল।
এক সাক্ষীর সাক্ষ্য অন্য সাক্ষ্যের সহিত মিলিল না। বহু সাক্ষী বহু রকমের আজগুবি সাক্ষ্য দিতে লাগিল। কিন্তু একটা বিষয়ে সকল সাক্ষীর মিল দেখা গেল যে, কোন সাক্ষীই দস্যু-মোহনকে চেনে না। সুতরাং সে যে সত্যই মোহন এবং তাহাকে যে পূর্বের এই বেশে কখনও কেহ দেখিয়াছে, তাহা হলফ করিয়া কেহই বলিতে পারিল না।
নানা সাক্ষীর নানা সাক্ষ্যবস্তু অবগত হইয়া আদালত গৃহের জনতা গুঞ্জন করিতে লাগিল। অবশেষে মোহনের একমাত্র যোগ্য শত্রু ও বন্ধু প্রধান সাক্ষী ডিটেকটিভ, ইন্সপেক্টার মিঃ বেকার সাক্ষীর কাঠগড়ায় প্রবেশ করিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আদালত-গৃহ স্তব্ধ হইয়া উঠিল। তিনি কি বলেন শুনিবার জন্য সকল ব্যক্তিই উৎকর্ণ হইয়া রহিল।
কিন্তু সুবিখ্যাত ডিটেকটিভের আচরণ সকলের মনে প্রথমেই বিস্ময় উদ্রেক করিল। যখন মিঃ বেকার আসামীর কাঠগড়ার দিকে চাহিলেন, তখন তাঁহার মুখ হঠাৎ ম্লান ও বিরক্তিতে পূর্ণ হইয়া উঠিল। যাহা হউক, তিনি কাঠগড়ার উপর দুই বাহু রাখিয়া, কি করিয়া দস্যু মোহনকে রেঙ্গুন বন্দরে গ্রেপ্তার করিয়া- ছিলেন, তাহার বিশদ ইতিহাস একে একে বর্ণনা করিলেন। কেমন করিয়া তিনি কলিকাতা হইতে মোহনের অনুসন্ধানে রেঙ্গুন গিয়াছিবেন, কেমন করিয়া তিনি মোহনকে চিনিতে পারিয়াছিলেন, পরে রেঙ্গুন হইতে তাহাকে পাইয়া বরাবর মাদ্রাজে উপস্থিত হইয়াছিলেন, তাহাও বিবৃত করিলেন। আদালত-গৃহের জনতা মিঃ বেকারের বর্ণনা রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শ্রবণ করিতে লাগিল। তাহারা যেন অতিশয় বিস্ময়কর কোন রূপ- কথা শুনিতেছে; বিস্ময়, হতাশা, শ্রদ্ধা, উত্তেজনার ভাব ক্ষণে ক্ষণে বৃহৎ জনতার মুখে চোখে পর্যায়ক্রমে প্রতিফলিত হইতেছিল।
অবশেষে মিঃ বেকার মোহনের সহিত তাঁহার জেলে আলাপের কাহিনী, যথা মোহনের গর্ব যে সে বিচারের দিনে আদালতে হাজির হইবে না, কুমার নিত্যবিক্রমের মণি-মুক্তা প্রভৃতি মূল্যবান্ দ্রব্যসমূহ অপহরণের অদ্ভুত কাহিনী, পরিশেষে তাঁহার পকেট করিয়৷ ঘড়ি লইবার কৌতূহলোদ্দীপক ইতিহাস বিবৃত করিলে জনতা হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল।
বিচারক জনতাকে নীরব থাকিবার জন্য কড়া আদেশ দিলেন। মিঃ বেকারকে দেখিয়া অত্যন্ত অসুস্থ বোধ হইতে- ছিল; কারণ তিনি সাক্ষ্য-কাহিনী বিবৃত করিবার সময় বারবার ক্লান্ত হইয়| নীরব হইতেছিলেন। বিচারক তাহা লক্ষ্য করিয়া আদেশ দিলেন, “আপনি যদি অসুস্থ হ’য়ে থাকেন, তবে আপনি একটু বিশ্রাম গ্রহণ করুন পরে আপনার বাকী সাক্ষ্য গ্রহণ করবো।”
মিঃ বেকার প্রতিবাদ করিয়া কহিলেন, “না, না, স্মার্; শুধু সামান্য একটু……” এই অবধি বলিয়া তিনি সহসা থামিয়া গেলেন এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আসামীর দিকে চাহিয়া রহিলেন। বহুক্ষণ পরে কহিলেন, “স্যর, আসামীকে নিকটে গিয়ে দেখবার অনুমতি কি আমাকে দেবেন? নিশ্চয়ই কিছু গোলোযোগ ঘটেছে এবং সেটা কি, তা’ আমি পরিষ্কারভাবে দেখতে চাই।”
বিচারক অনুমতি দিলেন। মিঃ বেকার আসামীর কাঠগড়ার নিকটে গিয়া একদৃষ্টে আসামীর দিকে বহুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন, পরে সাক্ষীর কাঠগড়ায় ফিরিয়া গম্ভীরস্বরে বিচারকের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “আমি শপথ কোরে হুজুরের নিকট নিবেদন করছি, যে লোক আসামীর কাঠগড়ায় আছে, সে দস্যু মোহন নয়!”
সহসা আদালত-কক্ষ মৃত্যুর মত নিস্তব্ধ হইয়া গেল।
বিচারক উত্তেজিত কণ্ঠে কহিলেন, “আপনি কি বলছেন? আপনার কথার অর্থ কী? আপনি পাগল হ’য়ে গেলেন?”
ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টার শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “ঐ ব্যক্তির সঙ্গে মোহনের চেহারার এতটা সাদৃশ্য আছে যে, প্রথম দৃষ্টিতে ধরা সহজ নয়। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই উভয়ের মধ্যে পার্থক্য ধরা পড়ে। এর নাক, কান, মুখ, মাথার চুল, গায়ের রঙ মোহনের আদৌ মত নয়! ওর চোখের দিকে চেয়ে দেখুন, এমন মাতালের চোখ মোহনের যে হ’তেই পারে না তা’ আমার অপেক্ষা আর কে বেশী জানে, সার?”
বিচারক অপ্রকৃতিস্থ স্বরে কহিলেন, “দাঁড়ান, দাঁড়ান, অপেক্ষা করুন। আমাকে ভাবতে দিন। আপনার এসব কথার অর্থ কী? আমি আপনার একথার কৈফিয়ৎ শুনতে চাই। আপনি কি বলছেন? এ লোকটা দস্যু মোহন নয়? তবে এ কে?”
মিঃ বেকার হতাশ স্বরে কহিলেন, “তা’ আমি জানি না। খুব সম্ভব মোহন এই লোকটাকে তার বদলে চালিয়ে দিয়েছে। মোহনের চেহারার সঙ্গে এ লোকটার অদ্ভুত সাদৃশ্য অস্বীকার করা যায় না। খুব সম্ভবতঃ এ একজন তার দুষ্কর্মের সহায়ক।
অপ্রত্যাশিত ঘটনায় আদালত-গৃহে উত্তেজনা পরিলক্ষিত• হইল। আনন্দ-চিৎকার, হর্ষধ্বনি, উত্তেজিত কথোপকথনে আদালত সরগরম হইয়া উঠিল।
বিচারক পরীক্ষাকারী ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ গোপাল আচারি লিঙ্গমকে, জেলের সুপারকে ও ওয়ার্ডারদিগকে জরুরী তলব করিয়া পাঠাইলেন এবং আদালতের বিচার কার্য স্থগিত রাখিয়া দিলেন।
বিচারকের জরুরী আহ্বানে সকলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মিঃ লিঙ্গম ও সুপার বন্দীকে অতি নিপুণভাবে পরীক্ষা করিয়া উভয়ে একবাক্যে কহিলেন, “বন্দীর সঙ্গে মোহনের আশ্চর্য রকম সাদৃশ্য থাকলেও, বন্দী মোহন নয়।”
বিচারক বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। পরে চিৎকার করিয়া কহিলেন, “তবে এ লোকটা কে? কোথা থেকে এ এলো? জেলের মধ্যে মোহনের স্থান দখলই বা করলে কী প্রকারে?”
অবশেষে জেলের দুইজন ওয়ার্ডার বন্দীকে পরীক্ষা করিয়া আদালত-কক্ষের সকলকে বিস্মিত করিয়া কহিল, “বন্দী দস্যু মোহনই বটে!”
কিন্তু তাহাদের মধ্যে একজন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুনরায় কহিল, “আমার মনে হয়, এই বন্দীই মোহন!“
বিচারক ক্রোধে ফাটিয়া পড়িয়া কহিলেন, “তোমার মনে হয়, এ কথার অর্থ কী?”
ওয়ার্ডার কহিল, “প্রায় দু’মাস আগে বন্দীকে উপরের সেল থেকে নীচের সেলে এক রাত্রিতে বদলি করা হয়। প্রকৃতপক্ষে আমি বন্দীকে ভাল কোরে কখনও দেখিনি। গত দু’মাস কাল বন্দী দ্বারের দিকে পিছন ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ কোরে শুয়ে শুয়ে সময় কাটিয়েছিল।”
বিচারক হতাশস্বরে কহিলেন, “কিন্তু এই দু’মাসের পূর্বে বন্দী কোথায় ছিল “
“আজ্ঞে, তার আগে ওপরের ৫ নং সেলে ছিল!” ওয়ার্ডার নিবেদন করিল।
জেলের সুপার কহিলেন, “মোহন তার পলায়ন করবার ইচ্ছে ঘোষণা করার পর আমরা সাবধান হবার জন্য তার সেল বদল কোরেছিলাম।”
বিচারক কঠিন মুখে কহিলেন, “আপনি জেলের সুপার, সুতরাং আপনার কর্তব্য ছিল, শেষের দু’মাস বন্দীর ওপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখা।”
স্তূপার নতমুখে কহিলেন, “বন্দী এমন শান্তভাবে ছিল যে, আমার উপস্থিতির কোনও কারণই ঘটে নি।”
বিচারক কহিলেন, “আর এই লোকটা কি সেই লোক নয়, যাকে আপনার জিহ্মায় রাখা হয়েছিল? অর্থাৎ এই লোকটাই কি দস্যু মোহন নয়?”
সুপার কহিলেন, “না স্যর।”
“তবে কে এ?” বিচারক ফাটিয়া পড়িলেন।
জেলের সুপার নতমুখে কহিলেন, “তা’ জানি না, হুজুর!”
বিচারক ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া কহিলেন, “তা” হ’লে এই দাঁড়ায় যে, দু’মাস আগে এই লোকটাকে পরিবর্তন করে মোহন পালিয়েছে। কিন্তু তেমন ব্যাপার সম্ভব হ’ল কি প্রকারে–আপনি বলতে পারেন?”
সুপার বিষণ্ন মুখে কহিলেন, “না, আমি পারি না, হুজুর।
বিচারক ক্ষুব্ধ ও হতাশ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল জেলের কর্মচারীদের মুখের উপর চাহিয়া বন্দীকে কহিলেন, “বান্দ, কবে থেকে তুমি জেলের মধ্যে রয়েছ, আমাদের কি বলতে পারো না?”
বিচারকের কণ্ঠে হতাশ স্বরের কোমল স্পর্শ বন্দীকে যেন সচেতন করিয়া তুলিল তাহার তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা যেন ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হইতে লাগিল। কিছু সময় প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া বন্দী ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে, প্রশ্নের পর প্রশ্নের উত্তরে যাহা কহিল, তাহা সংক্ষেপে এই যে, প্রায় দুইমাস পূর্বে পাঁচ আইন ভঙ্গ করার জন্য পুলিস তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া কোয়ার্টারে লইয়া যায়। তারপর তাহার আট আনা জরিমানা করা হয়। সে জরিমানা দিয়া যখন পুলিস-অফিস হইতে চলিয়া আসিবার জন্য উঠানে পা দিয়াছে, তখন দু’জন পুলিস-অফিসার কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া, হিড় হিড় করিয়া টানিতে টানিতে তাহাকে জেলের ভ্যানে তুলিয়া দেয় এবং জেলে আনিয়া একটা ঘরে বন্ধ করিয়া রাখে। সেইদিন হইতে সে ভাল খাবার খাইতে পাইতেছিল, ঘুমাইবার অফুরন্ত সময় পাইতেছিল; সুতরাং সে কাহারও কাছে তাহাকে কি জন্য বন্দী করিয়া রাখা হইয়াছিল, জিজ্ঞাসা করে নাই বা কোন অভি- যোগও করে নাই। সে বেশ সুখেই ছিল সেখানে।
এই অবধি বলিয়া বন্দী পুনরায় ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হইয়া উঠিল এবং জড়িতস্বরে ঢুলু ঢুলু চক্ষে বিচারকের দিকে চাহিয়া বলিল, সে অনেকক্ষণ ঘুমাইতে পায় নাই, আজ যেন তাহাকে শীঘ্র শীঘ্র জেলে পাঠাইয়া দেওয়া হয়, এই তাহার সনির্বন্ধ অনুরোধ।
আদালত গৃহের জনতা উচ্চহাস্থাধ্বনিতে ভাঙ্গিয়া পড়িল এবং বিচারক শুনানী অন্য দিনের জন্য স্থগিত রাখিয়া আদালত বন্ধ করিয়া দিলেন।
জনতা দস্যু মোহনের জয়ধ্বনি করিতে করিতে বাহির হইয়া পড়িল।
২২
দস্যু মোহনের প্রত্যাশিত পলায়ন-কাহিনীতে সারা ভারতবর্ষে উচ্চ প্রশংসা-কলরব উত্থিত হইল। সংবাদ-পত্রসমূহে এই অত্যাশ্চর্য কাহিনী অবলম্বন করিয়া সত্য, অর্ধ-সত্য, কল্পিত লোমহর্ষণকারী বিবরণসমূহ প্রকাশিত হইতে লাগিল। সর্ব সময়ে, সর্ব স্থানে, সর্ব লোকের মুখে দস্যু মোহনের অলৌকিক অপরূপ কাহিনী নানা শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত হইয়া বৃহৎ মহীরুহে পরিণত হইল।
জনসাধারণ যখন দস্যু মোহনের বীরত্ব কাহিনীর স্বপ্নে মশগুল, তখন মাদ্রাজের জেল-কর্তৃপক্ষ এবং পুলিস কর্তৃপক্ষ তাঁহাদের সমস্ত শক্তি লইয়৷ এই অভিনব ব্যাপারের সমাধানে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। অনুসন্ধানে প্ৰকাশ পাইল, দুইমাস আগে নীলকমল দে নামে একটা লোককে পুলিস কোর্টের পাঁচ আইন ভঙ্গ করার জন্য আট আনা জরিমানা করা হইয়াছিল। লোকটা প্রথম দিনে জরিমানা না দিয়া একরাত্রি পুলিস হাজতে বাস করে। কিন্তু পরদিন অপরাহ্ণে জরিমানা প্রদান করায় বেলা দুই ঘটিকার সময় তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। এই বিবরণী পুলিস অফিসের রেকর্ড হইতে পাওয়া গেল।
আরও প্রকাশ পাইল যে, ঐদিন বেলা দুই ঘটিকার অব্যবহিত পরেই মোহনকে শেষবারের মত পরীক্ষা করিয়া জেল-ভ্যানে করিয়া পুলিস অফিস হইতে আনয়ন করা হয় এবং সেই অবধি সে নিম্ন সেলে স্থানান্তরিত হইয়াছে।
কিন্তু ইহা কি সম্ভব যে উক্ত দিনে পুলিস অফিসে যে ওয়ার্ডাররা মোহনের সহিত গমন করিয়াছিল, তাহারা নীলকমলের সহিত মোহনের সাদৃশ্যের জন্য এই নিদারুণ ভুল করিয়াছে? তাহারা কি প্রতারিত হইয়াছে? ইহাও কি সম্ভব হইতে পারে? ওয়ার্ডারগণের দীর্ঘ বৎসরের আনুগত্যে এরূপ ভুল কখনও সম্ভব হইতে পারে কি? এই সব চিন্তা কর্তৃপক্ষের মন আলোড়িত করিয়া তুলিল।
কর্তৃপক্ষ নানা পথে অনুসন্ধান করিতে লাগিল। মোহনের ভীষণ শত্রু মিঃ বেকার দিবারাত্র নানা সমস্যার ভিতর দিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। তিনি হিন্দু পত্রিকার সম্পাদকের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া একজন লোক যে তাঁহাকে একখানি কার্ড দিয়া গিয়াছিল, সেই কার্ডটি দেখিতে চাহিলেন।
সম্পাদক মহাশয় মিঃ বেকারকে সমাদরে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইয়া, টেবিলের ড্রয়ার হইতে কার্ডখানি বাহির করিয়া, তাঁহার হাতে দিলেন।
মিঃ বেকার দেখিলেন, কার্ডে লেখা আছে, “দস্যু মোহন তাহার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে।” মিঃ বেকারের মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি অস্ফুট কণ্ঠে কহিলেন, “আমি স্বীকার করছি, তাত করে।”
সম্পাদক মহাশয় কহিলেন, “কি কুক্ষণেই আপনাদের পরামর্শে দস্যু মোহনের নামে অমন প্রবন্ধ লিখেছিলাম, মিঃ বেকার, যে আমার দিনের আহার, রাত্রের ঘুম দুই-ই অন্তর্হিত হয়েচে। যে ব্যক্তি আপনাদের দুর্গ থেকে এমন অবহেলায় বেরিয়ে আসতে পারে, সে ব্যক্তি আমার মত একজন নিরীহ
লোককে যে হাসতে হাসতে খুন করতেও পারে, তা’তেও আমার সন্দেহ নেই।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “আপনি পুলিস-পাহারার বন্দোবস্ত করেছেন তো?”
সম্পাদকের মুখে করুণ মু হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি কহিলেন, “আপনার মুখে ব্যঙ্গ শোভা পায় না, মিঃ বেকার। যে সমস্ত পুলিস-ফোর্সকে তুচ্ছ জ্ঞান কোরে, প্রেসিডেন্সী জেল থেকে পূর্বে ঘোষণা কোরে বার হ’য়ে আসে, তার হাত থেকে আমাকে রক্ষ| করবার জন্য দু’চার জন পুলিস-পাহারার কি মূল্য আছে, মিঃ বেকার? তার চেয়ে মোহনের দয়ার ওপর নিজেকে ফেলে রাখা শতগুণে ভালো। আমি তাই-ই করেছি।”
মিঃ বেকারের মুখে সলজ্জ হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি কহিলেন, “সেই ভাল। আমি যতদূর জানি, মোহনের নিকট যে বশ্যতা স্বীকার করে, তার কোন অনিষ্ট সে করে না। তা’ করতে সে ঘৃণা প্রকাশ করে।”
সম্পাদক মহাশয়ের মুখে আশার আলো ফুটিয়া উঠিল। তিনি কহিলেন, “এমন একটা লোক যে কেন অমন একটা পথে গেল, কে জানে!“
মিঃ বেকারের উচ্চাঙ্গের তত্ত্বালোচনা শুনিবার মত পর্যাপ্ত সময় ছিল না তিনি সম্পাদকের নিকট হইতে বিদায় লইলেন এবং যাইবার সময় মোহন লিখিত কার্ডখানি লইয়া গেলেন।
পরে কার্ডে লিখিত হস্তাক্ষর পরীক্ষা করিয়া জানা গেল, তাহা মোহনের স্বহস্তে লিখিত অক্ষর। সুতরাং সমস্যায় আরও একটি জটিল গ্রন্থি লাগিয়া গেল, সমস্যা সমাধানের পথে অগ্রসর হইল না।
কমিশনারের কক্ষে জেল সুপার, মিঃ বেকার এবং ম্যাজিস্ট্রেট লিঙ্গম একদিন সমবেত হইয়, আলোচনা করিতেছিলেন। কমিশনার কহিলেন, “আমি বুঝতে পারছি না, এটা কি মোহনের পূর্ব আয়োজিত প্ল্যান, না আকস্মিক ঘটনার যোগাযোগ? আপনার কি ধারণা, মিঃ বেকার?”
মিঃ বেকার কহিলেন, “আমি যেমন ঘনিষ্ঠ ভাবে মোহনকে জানি, তা’তে অন্ততঃ একটা লোক আকস্মিক, দৈব, কি অদৃষ্টের ওপর নির্ভর কোরে কোন কাজ করে না। আর সেই লোক হচ্ছে মোহন। আপনারা কুমার নিত্যবিক্রমের প্রাসাদের চুরির কথা চিন্তা করুন। এমন কোন দৈব নেই, যা’ কুমারের ভূগর্ভস্থ লৌহ-কক্ষ হ’তে অমূল্য মূল্যের সম্পদ হরণ করবার সুযোগ দিতে পারতো। বহু চিন্তা কোরে মোহন যে অভিনব আয়োজন করেছিল, তা একমাত্র মোহনের পক্ষেই সম্ভব। তা ছাড়া এক্ষেত্রেও যদি একটু গভীরভাবে চিন্তা কোরে দেখেন, দেখতে পাবেন, কোন দৈব বা আকস্মিকতার কোন চিহ্নই কোন স্থানে নেই।
পুলিস ম্যাজিস্টেট মিঃ লিঙ্গম কহিলেন, “আপনি বুঝিয়ে দিন মিঃ বেকার।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “প্রথমত নীলকমলের কথা ধরুন। মোহনের নিজের মত সাদৃশ্য আছে, এমন একটা লোককে খুঁজে বার করতে, তা’কে অর্থাৎ তার আদেশে তার সহচরদের যে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছে, তা আমরা সম্যকরূপে জ্ঞাত না হ’লেও অনুমান করতে পারি। তারপর প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি বিষয়ে বিবেচনা করা হয়েছে। মোহন পূর্বাহ্ণে নিশ্চয়ই জানতে পেরেছিল, হয়তো আপনি…” ম্যাজিস্টেটের দিকে চাহিয়া মিঃ বেকার বলিতে লাগিলেন, “হয়তো আপনি কোন বিরক্তিকর মুহূর্তে এমন কথা মোহনের সাক্ষাতে আপনার নিম্নপদস্থ কর্ম চারীদের বলেছিলেন যে, আগামী শনিবার দিন জেরা শেষ কোরে সোমবার রিপোর্ট দাখিল করবেন। হয়তো তা’ শুনে, শুক্রবার দিন নীলকমলকে দিয়ে এমন একটা তুচ্ছ অপরাধ সংগঠন করায় যা’র দরুণ সামান্য কিছু জরিমানা হ’তে পারে।“
মিঃ বেকার একটু দম লইয়া বলিতে লাগিলেন, “এখানে লক্ষ্য করবার বিষয় যে, নীলকমলের আট আনা জরিমানা হয়। জরিমানা দেবার অর্থ তার কাছে থাকা সত্বেও সে শেষ পর্যন্ত হাজত-বাস বেছে নেয় এবং অপরাহ্ণে জরিমানা প্রদান কোরে সে মুক্তি গ্রহণ করে। এই সব আলোচনা কালে আমি মোহনের তীক্ষ্ণ-দূরদৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হ’য়ে যাই। ওর কাজের একটুকু বিশেষত্ব এই যে, যদি ওর আয়োজনমত কোন কিছু একটা কাজ কেউ না করে, তবে সমস্ত কিছু পণ্ড হয়ে যাবে। আর প্রত্যেকটি পার্ট প্রত্যেকে ঠিকভাবে অভিনয় করলে, ঠিক ঘড়ির মত কাঁটায় কাঁটায় সফলতা নিয়ে আসবে।”
কমিশনারের মুখ দিয়া সহসা বাহির হইল, “এমন একটা লোক যদি সৎপথে চলতো, তাহ’লে জগতের অনেক উপকার হতো। এখন নীলকমলকে নিয়ে কি করা যায় বলুন, মিঃ বেকার!”
মিঃ বেকার কহিলেন, “নীলকমলের অতীত ইতিহাস যেটুকু পাওয়া গেছে, তা’তে আমরা শুধু এইটুকু জানতে পারি যে, ও বাঙলার বর্ধমান জেলার একটা গণ্ডগ্রামের লোক। অল্প বয়সে আত্মীয়-স্বজন-হারা হ’য়ে ভবঘুরে জীবন যাপন কোরে, ভারতের নানাস্থানে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন কোরে ঘুরে বেড়িয়েছে। গত তিন বৎসরের মধ্যে নীলকমল যে কোথায় ছিল, কি কোরে জীবিকা অর্জন করেছে, কিছুই জানা যায় নি।”
মিঃ লিঙ্গম কহিলেন, “স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, সে মোহনের আশ্রয় পেয়েছিল। আর তা’ যদি সত্য হয়, তবে নীলকমল যে মোহনের একজন সহকারী, তা’তে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ থাকে না।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “তা আনুমানিক সত্য। কিন্তু অনু- মানের উপর নির্ভর কোরে আমরা তা’কে সাজাও দিতে পারি না বা অনির্দিষ্টকাল জেলের মধ্যে আটক রাখতে পারি না। পারি কি, স্যার?”
কমিশনার চিন্তিতমুখে কহিলেন, “না পারি না। কিন্তু আমাদের সমস্যা অমীমাংসিত রয়েই যায়। অসম্ভব ক্ষমতাশালী দস্যু মোহন এমন কোন কিছু রেখে যায় নি, যা’ অনুসরণ কোরে আমরা তার সন্ধান করতে পারি।”
মিঃ। বেকারের মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়া উঠিল। তিনি কহিলেন, “মোহনের বিশেষত্ব এইটুকু, স্যার। আর একমাত্র ঐ কারণেই তাঁকে খুঁজে বার করবার প্রচেষ্টা আমি ছেড়ে দিয়েছি।”
ম্যাজিস্ট্রেট লিঙ্গম সবিস্ময়ে কহিলেন, “ছেড়ে দিয়েছেন?”
মিঃ বেকার কহিলেন, “তাছা’ড়া সময় বাঁচাবার পন্থা আমার জানা নেই। ‘হিন্দু’র সম্পাদককে দেওয়া কার্ডখানার তারিখ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, মোহন মাত্র চারদিন পূর্বেও এই শহরে ছিল। একমাত্র ভগবানই বলতে পারেন, এখনও সে এই মাদ্রাজ শহরে আছে কি না! খুব সম্ভবতঃ আছে। কিন্তু কোথায় আছে, কি বেশে আছে তা’ অনুমান করা একেবারে অসম্ভব। এমন হওয়াও এতটুকু বিচিত্র হবে না, যদি পরে প্রকাশ পায় যে, কমিশনার সাহেবের একজন চাপরাশীর ছদ্মবেশে সে এই অফিসেই কয়েক দিন কাটিয়ে গেছে। “
শ্রোতা কয়টির মুখে উদ্বেগের ছায়াপাত হইল। জেল-সুপার কহিলেন, “মোহন যে যাদুকর, তা’তে কোন সন্দেহ নেই।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “গতবার যখন জেলের কুমার নিত্য- বিক্রমের চুরি কেসের জন্য মোহনের সঙ্গে দেখা করি, সে গর্ব কোরে সেদিন ঘোষণা করেছিল যে, ‘আমি আগামী বুধবারে আপনার সঙ্গে ব্রডওয়ে হোটেলে বসে আহার করবো।’ যদিও আমি তার সেই দত্ত বিশ্বাস করি নি, তবুও আমি নির্ধারিত দিনে যে ব্রডওয়ে হোটেলে গিয়েছিলুম, তা স্বীকার করতে আমার লজ্জা নেই। আর এই দন্তটুকু সে বিশেষ বিবেচনা কোরেই যে করেছিল, তা-যে একান্ত অর্থহীন নয়, আমি এখন বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারছি।”
কমিশনার কহিলেন, “বুঝিয়ে বলুন, মিঃ বেকার!”
মিঃ বেকার মৃদুহাস্যে কহিলেন, “ওটা তার একটা ভীষণ চাল্, স্যর। কারণ আমি যখন দেখলুম যে, মোহন বৃথা দন্ত করেছিল, তা’র প্রতিজ্ঞা রাখতে পারে নি, তখন আমার মনে স্বতঃই এই চিন্তা উদয় হ’য়েছিল যে, মোহনের দ্বিতীয় দত্তপূর্ণ ঘোষণা যে, সে বিচারের সময় আদালতে উপস্থিত হবে না, তা’ও একটা মিথ্যা দত্ত। ফলে তার কথা আমি বিশেষ গুরুতরভাবে নিতে পারিনি। সত্য কথা বলতে কি, আমি তাঁকে উপেক্ষা করেছিলাম, এবং আমি তার ভ্যানে পূর্বের মত পুলিস অফিসে প্রত্যহ যাতায়াত বন্ধ কোরে, অন্য ডিটেকটিভের হাতে সে ভার অর্পণ করেছিলাম।
মিঃ বেকারের এই স্বীকারোক্তি কাহারও মনে তাঁহার সম্বন্ধে হীন ধারণা অঙ্কিত করিল না। উপরন্তু দস্যু মোহনের অসীম- সাহসিক কার্য-কলাপের চিন্তায় সকলের মন ভারাক্রান্ত হইয়া উঠিল।
পুলিস কমিশনার বিষণ্নস্বরে কহিলেন, “এখন আমাদের কর্তব্য কী? জনসাধারণ যে উন্মত্ত হ’য়ে উঠেছে। দস্যু তস্করের বিরুদ্ধে যে স্বাভাবিক ঘৃণা মানুষের মনে সঞ্জাত হয়, দস্যু মোহনের ক্ষেত্রে তার বিপরীত কার্য করছে। এও এক বিষম বিপদ।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “তার একমাত্র কারণ মোহন দারিদ্র্যের বন্ধু, যেখানে অভাব, শোক, দারিদ্র্য, সেখানেই দস্যু মোহনের মঙ্গল হস্তের আবির্ভাব দেখা যায়। মোহনের বিদ্রোহ ধনী সম্প্রদায়ের, রাজা-মহারাজা-সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। এক কথায় সে অভিজাত সমাজের ভীষণ শত্রু। এমন একটা ঘটনাও আমাদের দৃষ্টিতে আসেনি, যে-ক্ষেত্রে মোহন কোন দরিদ্রের কোন অনিষ্ট করেছে। অবিবাহিত, অতি সুঠাম আকৃতি-সম্পন্ন যুবক দেশের জনসাধারণের চিত্ত জয় করেছে এবং অন্যান্য কারণের মধ্যে এটাও একটা শ্রেষ্ঠ কারণ যে, কেন আমরা মোহনের কোন ঠিকানা পাই না। আমার সন্দেহ হয় যে, অনেকে তা’কে বাড়ীতে আশ্রয় দেয়, দিনের পর দিন তার সেবা কোরে নিজেকে কৃতার্থ ভাবে, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন কোরেছে। আর এরূপ সন্দেহভাজন ব্যক্তি আমার নজরে এসেছে।”
কমিশনারের মন মোহনের প্রশংসায় তিক্ত হইয়া উঠিল। তিনি ঘড়ির দিকে চাহিয়৷ উঠিয়া দাড়াইলেন, কহিলেন, “আজ সন্ধ্যার পর আপনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন, তখন নীলকমলের সম্বন্ধে আদেশ জানাবো।”
সভা ভঙ্গ হইল। সকলেই চিন্তিত মুখে বাহির হইয়া গেলেন।
২৩
দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ করিয়া একটি মাস অতিবাহিত হইয়া গেল, তবু দস্যু মোহন সম্বন্ধে কিছুই অবগত হওয়া গেল না। তাহার দন্তপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী “আমি বিচারের সময় আদালতে উপস্থিত থাকি না,” উহা সম্পূর্ণরূপে সত্য বলিয়া প্রমাণিত হইল।
নীলকমলকে নানারূপ জেরা করিয়া, ভয় দেখাইয়া, কোন কিছু বাহির করা দূরে থাকুক, তাহার চক্ষু হইতে নিদ্রার আমেজ পর্যন্ত দূর হইল না। মানুষ যে এরূপভাবে আহার ও দু’ একটা কাজের সময় ব্যতীত সারাক্ষণ নিদ্রা যাইতে পারে, ইহাও কল্পনাতীত ঘটনা। তাহাকে সাজা দিবার মত কোন প্ৰমাণই যখন নাই, তখন তাহাকে আর কত দিন এমন ভাবে আটক করিয়া রাখা যাইতে পারে? সুতরাং ম্যাজিস্ট্রেট একদিন তাহাকে মুক্তি দিবার আদেশ দিলেন।
মিঃ বেকার ও তাহার দুইজন সহকারী পূর্ব হইতে প্রস্তুত হইয়াছিলেন; যে মুহূর্তে একদিন শীতের কুয়াসাচ্ছন্ন প্রভাতে নীলকমলকে জেল হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হইল, তাঁহারা সেই মুহূর্তে তাহার পিছু লইলেন।
মিঃ বেকারের দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছিল যে, নীলকমল দস্যু মোইনের হাতের তাস। সুতরাং তাহার পিছু লওয়া হইলে তাঁহারা দস্যু মোহনের আড্ডার খবর না জানিতেও পারেন, কিন্তু মোহনের কোন সহচরের সংবাদ পাওয়া এতটুকু বিচিত্র হইবে না তাঁহারা মোহনের নিকট হইতে বা নীলকমলের মত একটা নির্বোধ নীরেট লোকের কাছ হইতে কোন কথা বাহির করিতে না পারিলেও, তাহার অন্য সহচর বা সহচরদের নিকট হইতে তাহা পারিবেন না, তাহা কে বলিতে পারে? সুতরাং মিঃ বেকার এখ শেষ পন্থা গ্রহণ করিলেন।
মিঃ বেকারের এই যুক্তি পুলিশ কমিশনার সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং অন্য দুইজন বিখ্যাত ডিটেকটিভকে তাঁহার সহিত পাঠাইয়া দিলেন।
নীলকমল জেল হইতে ছাড়া পাইয়া ফটকের বাহিরে আসিয়া পা ঘসিতে লাগিল। তাহার মুখভাব দেখিয়া স্পষ্টই ধারণা হইল, সে যেন মুক্তি পাইয়া সুখী হয় নাই। সে বার বার সতৃষ্ণ নয়নে জেল-ফটকের ভিতর দিয়া চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিল, অবশেষে যখন বুঝিল যে, বন্ধ ফটক আর তাহার জন্য মুক্ত হইবে না, তখন সে ধীরে ধীরে শহরের দিকে চলিতে লাগিল।
নীলকমলের চলন-ভঙ্গী দেখিয়| ধারণা করা কিছুমাত্র কঠিন ছিল না যে, সে কি করিয়া সময় কাটাইবে বা কি করিবে, কোথায় যাইবে, কোন নিশ্চিত ধারণা তাহার ছিল না।
সে ধীরে ধীরে চলিতে চলিতে একটা চীনা বন্ধকী দোকানের ( Pawn Shop) নিকট আসিয়া কয়েক মুহূর্ত ইতঃস্তত করিল, পরে সোজা ভিতরে প্রবেশ করিয়া গায়ের কোটটা খুলিয়া কয়েক আনা পয়সার বিনিময়ে বন্ধক করিল এবং বাহিরে আসিয়া ধীরে ধীরে চলিতে আরম্ভ করিল।
নীলকমল বহু পথ ঘুরিয়৷ অবশেষে বাস স্ট্যাণ্ডের নিকট উপস্থিত হইল। একটা লোকারণ্য বাসে দৌড়াইয়া উঠিতে গেলে, বাস কণ্ডাক্টর “এ গাড়ীতে আর জায়গা নেই, পরের গাড়ী পাঁচ মিনিট পরে তাতে আসুন।” বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল ও বাস ছাড়িয়া দিল।
সম্মুখেই একটা চা’য়ের দোকান। নীলকমল দু’ এক মিনিট একটা বাস-ইন্সপেক্টারের সঙ্গে কথা কহিয়া, চা’এর দোকানে প্রবেশ করিল।
মিঃ বেকার উক্ত বাস-ইস্পেক্টারের নিকট গিয়া বিনা- ভূমিকায় আপন পরিচয়-বস্তুটি দেখাইলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “ও লোকটা তোমায় কি জিজ্ঞাসা করলো?”
বাস-ইন্সপেক্টার কহিল, “জর্জ টাউনের বাস ক’ মিনিট পরে ছাড়বে এবং এক কাপ চা খাবার সময় আছে কি না, জানতে চাইলো।”
“ধন্যবাদ!” বলিয়া মিঃ বেকার তাঁহার সহকারী দুইজনকে নিকটে আসিতে আহ্বান করিলেন এবং বলিলেন, “শীঘ্র দু’খানা ট্যাক্সি ভাড়া করো। আমার সঙ্গে তোমাদের মধ্যে একজন একটা ট্যাক্সিতে, আর একজন অন্য ট্যাক্সিতে এর পিছু ধাওয়া করতে হবে। যাও শীগির বন্দোবস্ত করো।”
যথা আদেশ বন্দোবস্ত হইল। কিন্তু দশ মিনিট অতিবাহিত হইয়া গেল, তবু ফিরিল নীলকমল না দেখিয়া, মিঃ বেকার সন্দিহান হইয়া চা’এর দোকানে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, নীলকমল নাই এবং দোকানের অন্যদিকেও একটা দরজা আছে দেখিরা তিনি ক্রোধে বিস্ময়ে আত্মহারা হইলেন ও দ্রুতপদে অন্য দ্বার দিয়া বাহির হইয়া চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন। কিন্তু নীল- কমলকে দেখিতে পাইলেন না। তাঁহার নিজের উপর অত্যন্ত রাগ হইল। এমন সময়ে সহসা দেখিলেন, নীলকমল একটি দ্বিতল বাসের উপর চড়িয়া উত্তর মুখে যাইতেছে।
মিঃ বেকার ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া ধাবমান বাসে লাফাইয়া উঠিলেন এবং দ্বিতলে উঠিয়া নীলকমলের পিছনের আসনে উপবেশন করিলেন। তখন তাঁহার মনে হইতে লাগিল দুই হাতে টানিয়া হতভাগার মাথা ছিঁড়িয়া ফেলেন। তিনি তাঁহার সহকারী দুইজন হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িলেন। যাহা হউক, তিনি যে অবশেষে নীলকমলকে পাইয়াছেন ইহাতেই তিনি সন্তুষ্ট হইয়া নীরবে পশ্চাতে বসিয়া রহিলেন।
বাস নানা স্থানে বাঁধিয়া নানা আরোহীকে নামাইয়া এবং নূতন আরোহীকে তুলিয়া ছুটিতেছিল। মিঃ বেকার দেখিলেন নীলকমল তাহার অভ্যাসমত ঢুলিতেছে। তাহার মস্তক নিদ্রার আমেজে বুকের উপর ক্ষণে ক্ষণে নামিয়া পড়িতেছিল। এমন একট| নির্বোধ নীরেট হতভাগাও যে বুদ্ধির দৌড়ে তাঁহাকে প্রায় পরাভূত করিতে সক্ষম হইয়াছিল এবং সহকারী দুইজন হইতে তাঁহাকে পৃথক করিতে সক্ষম হইল ইহা কী নীলকমলের বুদ্ধির খেলা না আকস্মিক ঘটনা মিঃ বেকার ভাবিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
নীলকমলের মুখ-বিবর অর্ধ উন্মুক্ত তাহার মুখে বোকামির সকল চিহ্ন বিদ্যমান, এমন একটা লোক কি কখনো দস্যু মোহনের সহকারী হইতে পারে? না, ইহা কখনও সম্ভব হইতে পারে না। তাছাড়া এই গোবেচারা লোকটা যে তাঁহাকে বুদ্ধির খেলায় পরাভূত করিবে, ইহাও সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ব্যাপার। শ্রেফ দৈব নীলকমলের প্রতি প্রসন্ন হইয়া, এইরূপ পরিস্থিতি সম্ভব করিয়াছে।
রেলওয়ে স্টেশনের নিকট আসিয়া নীলকমল বাস হইতে অবতরণ করিল। বলা বাহুল্য মিঃ বেকারও তাহার পিছু পিছু অবতরণ করিলেন। কিন্তু জর্জটাউন যাইবে বলিয়া, এখানে নীলকমল নামিল কেন, এই চিন্তায় মিঃ বেকারের মন বিস্ময়ে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। যাহা হউক তিনি অতি সাবধানে তাঁহার পিছু লইলেন।
নীলকমল ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল। সে অবিরত এক রাস্তা হইতে অপর রাস্তায়, দক্ষিণ হইতে বামে—এলোমেলো- ভাবে চলিতে চলিতে অগ্রসর হইতে লাগিল মাঝে মাঝে সে মুখ তুলিয়া কাহাকেও যেন অনুসন্ধান করিতে লাগিল। তবে কি সে কাহাকেও প্রত্যাশা করিতেছে?
সফলতা নিকটবর্তী ভাবিয়া, মিঃ বেকারের মন উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। তিনি দ্বিগুণ উৎসাহে নীলকমলকে অনুধাবন করিতে লাগিলেন।
এমনি করিয়া পথ চলিয়া প্রায় একঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া গেল। অবশেষে নীলকমল সমুদ্রের ধারে উপস্থিত হইল এবং শ্রান্ত ও ক্লান্ত কলেবরে একটা বেঞ্চির উপর উপবেশন করিল।
মিঃ বেকার নীলকমলের অদূরে একটা গাছের আড়ালে দণ্ডায়মান থাকিয়া তাহাকে লক্ষ্য করিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে অর্ধ ঘণ্টা উত্তীর্ণ হইয়া গেল। নীলকমল উঠিবার নামমাত্র করিল না। মিঃ বেকার চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, সে সময়ে সমুদ্রের ধার একেবারে জনমানব শূন্য। তিনি অধৈর্য হইয়া উঠিলেন এবং নীলকমলের সহিত আলাপ করিবার উদ্দেশে পার্শ্বে গিয়া উপবেশন করিলেন।
মিঃ বেকার তাঁহার হাতের ছড়ি দিয়া বালুর উপর দাগ কাটিতে কাটিতে সমুদ্রের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “চমৎকার দৃশ্য।”
নীলকমল কোন উত্তর দিল না—নীরবে রহিল। সহসা নীলকমল উচ্চহাস্য বেগে ফাটিয়া পড়িতে লাগিল। শিশুরা যেমন অকারণে হাসিতে হাসিতে লুটাইয়া পড়ে, সেইরূপ অফুরন্ত হাস্যধারা আকাশ, বাতাস, সমুদ্রের কল্লোলের ভিতর আছাড় খাইয়া পড়িতে লাগিল—যেন সে হাস্যপ্রবাহ কখনও থামিবে না। অন্তহীন হাস্যধারা অবিরাম উচ্চ কল্লোলে প্রবাহিত হইতে লাগিল।
মিঃ বেকার চকিত হইয়া উঠিলেন। তাঁহার কর্ণে এই হাস্যধারা অপরিচিত নহে। তীব্র উত্তেজনায় তাঁহার মাথার চুল খাড়া হইয়া উঠিল। তিনি দুই হাতে সমস্ত শক্তি দিয়া নীলকমলের সার্ট চাপিয়া ধরিয়া, তাহার মুখের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন। তিনি আদালতে যেমন ভাবে তাহাকে পরীক্ষা করিয়াছিলেন, তাহার অপেক্ষা আরো ভাল করিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। সহসা তিনি বিস্ময়ে হতবাক হইলেন। তিনি দেখিলেন, তিনি যাহাকে দেখিতেছেন, সে নীলকমল নহে, আদালতে দৃষ্ট সেই নির্বোধ, নীরেট লোকটা নহে, তিনি দেখিতেছেন, দস্যু মোহনকে!
তিনি সবিস্ময়ে দেখিলেন, যে-চক্ষু কোটরগত বলিয়া পূর্বে বোধ হইয়াছিল, এখন আর তাহা নাই, দস্যু মোহনের হাস্যময় উজ্জ্বল চোখ দু’টী চাহিয়া রহিয়াছে। যে মুখের চামড়া লোল ও বিবর্ণ বোধ হইয়াছিল, সেই মুখ অত্যাশ্চর্য যাদু মহিমায় পরিবর্তিত হইয়া দস্যু মোহনের যৌবন-সুলভ কান্তিভরা সুন্দর মুখ প্রকাশিত হইয়াছে। মুখে এতটুকু পার্থক্য নাই। তিনি সহসা ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিয়া, চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “দস্যু মোহন! দস্যু মোহন!”
মিঃ বেকার সুতীব্র ক্রোধে ফাটিয়া পড়িয়া মোহনের উপর লাফাইয়া পড়িয়া তাহার গলা চাপিয়া ধরিলেন। তাঁহার বয়স পঞ্চাশ বৎসর হইলেও, শক্তি-সামর্থ্যে দস্যু মোহনের অপেক্ষা দশগুণ বেশী শক্তিমান। তিনি চকিতে ভাবিলেন, দশ্য মোহনকে গ্রেপ্তার করিতে পারিলে, তিনি কিরূপ অসামান্য সুযশে আমোদিত হইবেন। কিন্তু তাঁহাদের ধস্তাধস্তি শীঘ্রই শেষ হইয়া গেল। দস্যু মোহন মিঃ বেকারের এই সবেগ আক্রমণে এতটুকু বিচলিত না হইয়া স্থিরভাবে বসিয়া রহিল; সহসা মিঃ বেকার একটা তীব্র আর্তনাদ করিয়া উঠিলেন : তাঁহার দক্ষিণ হস্ত অবশ হইয়া ঝুলিতে লাগিল।
“আপনি যদি কলকাতায় আমার কাছে ‘জিউ জিৎ- শেখবার সুযোগ পেতেন, তা’হলে আপনি জানতেন, আমার এই সামান্য কৌশলকে জাপানী ভাষায় কি বলে! জাপানীরা এই কৌশলকে বলে, ‘উদি-সি-ঘি’। এক মুহূর্ত বেশী যদি আমি এই কৌশল আপনার হাতের ওপর চালাতুম, তা’হলে এতক্ষণে আপনার হাতটা ভেঙ্গে যেতো, মিঃ বেকার ঢ’’বং তা’ হলেই আপনার উপযুক্ত শাস্তি হতো। কি আশ্চর্য! আপনার মত একজন পুরাতন বন্ধু যাঁকে আমি ভক্তি করি, সম্মান দেই, সাঁর সম্মুখে আমি নিজের ছদ্মবেশ খুলতে সাহস পাই, তাঁর এমন ব্যবহার। সত্যই দুঃখের বিষয়, বেকার।” মোহন সহস৷ বিস্মিত কণ্ঠে কহিল, “এ-কী, এ-কী ব্যাপার, বন্ধু বেকার?”
মিঃ বেকার নীরবে বসিয়াছিলেন। তাঁহার সারা মন আলোড়িত করিয়া এই চিন্তা উদিত হইতেছিল যে, তাঁহার সাক্ষেই দস্যু মোহন এমন ভাবে মুক্তি পাইয়াছে। একমাত্র তাঁহারই ভুলের সুযোগে তাঁহাকেই প্রতারিত করিয়া মোহন কৃতকার্য হইয়াছে। এই পলায়নের কাহিনী তাঁহার সকল সুনাম নষ্ট করিবে। হয়তো তাঁহার এতদিনের চাকরিও তাঁহাকে হারাইতে হইবে। মিঃ বেকারের দুই চক্ষু উথলিয়া অশ্রুধারা গণ্ড বহিয়া ঝরিয়া পড়িতে লাগিল।
মিঃ বেকারের দিকে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া মোহন কহিল, “মাই গড়। আপনি যদি এই ব্যাপারকে এমন দৃষ্টিতে দেখবেন বুঝতে পারতাম, তা’হলে আমি আপনার সঙ্গে কথাই বলতাম না। তা’ ছাড়া, নীলকমলকে সাজা দেবার কোন সঙ্গত কারণই তো আপনাদের ছিল না, মিঃ বেকার?”
“তা’হলে আদালতে তুমিই নীলকমল, আর এখানে তুমিই মোহন? দু’জনেই একলোক?” মিঃ বেকার জিজ্ঞাসা করিলেন।
“হ্যাঁ আমি, আমি। আর কেউ নয়, সেখানেও আমি, এখানেও আমি।” মোহন মৃদু হাসিয়া কহিল।
মিঃ বেকার সবিস্ময়ে কহিলেন, “তা’ও কি সম্ভব?”
মোহন তাচ্ছিল্য স্বরে কহিল, “সেজন্য কারুর যাদুকর হবার প্রয়োজন নেই। সুপণ্ডিত বিচারক কি বলেছিলেন শোনেন নি? যে কোন লোক যদি বছর দশ-বারো ধোরে নানা বিদ্যায় সুশিক্ষিত হ’তে পারে, তবে তার পক্ষে কোন কিছু সাধন করা এতটুকু অসম্ভব ব্যাপার নয়।”
“কিন্তু তোমার চোখ, তোমার মুখ?” সবিস্ময়ে মিঃ বেকার জিজ্ঞাসা করিলেন।
“আপনি কেন ভুলে যাচ্ছেন যে, দু’বছর আমি বৈজ্ঞানিক স্থার ঘোষের ল্যাবরেটরীতে যে শিক্ষানবিশী কোরেছিলাম, সে শুধু ছেলেখেলার জন্য নয়। যে লোক একদিন জগদ্বিখ্যাত নাম অর্জন করবে, তা’র পক্ষে নিজের চেহারা একটু বদল করা কিছুমাত্র আশ্চর্যের বিষয় নয়, মিঃ বেকার। আমাদের ভারতবর্ষে এমন সব গাছ গাছড়া আছে, আমাদের শ্রেষ্ঠ আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ- বেদের এক অংশে যে সব অত্যাশ্চর্য, অব্যর্থ, সুপরিক্ষিত নির্দেশ আছে, তা’ যদি আপনি জানতেন, তা’হলে আমার মুখের ও চোখের পরিবর্তন করা কত কত সহজ তা’ ভেবেই শুধু আশ্চর্য হ’তেন, আমাকে দেখে হ’তেন না। গত দু’মাস ধোরে নির্জন সেলে বদ্ধ থেকে আমি ধীরে ধীরে নিজেকে রূপান্তরিত করে- ছিলাম, আমার এই পরিবর্তনের গতি এত ধীরে ধীরে হয়েছিল যে, ওয়ার্ডারদের নজরে পড়ে নি এবার বুঝেছেন, মিঃ বেকার?”
মিঃ বেকারের সন্দেহ গেল না। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিন্তু নীলকমল দে’র কাহিনী?”
“ওঃ, নীলকমল দে? সত্যই একজন নীলকমল আছে। সে অত্যন্ত দরিদ্র, ভিক্ষাবৃত্তিই তার জীবন-ধারণের একমাত্র পেশা। বছর তিন আগে, অর্থাৎ আমার আবির্ভাবের পূর্বক্ষণে তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তার চেহারার আমার চেহারার সঙ্গে এমন সাদৃশ্য আছে যে, পাছে আমি বার বার গ্রেপ্তার হই অর্থাৎ ভ্রম বশতঃ তাকেই আপনারা গ্রেপ্তার করেন এবং শাস্তি দেন, এই ভয়ে তাকে আমি এমন এক নিরাপদ আশ্রয়ে রাখতে বাধ্য হই যে, সেখান থেকে সে আর কারুর নজরেই আসবে না এবং আমি ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যের সাদৃশ্যটুকু আমার দেহ হ’তে লোপ করি। সেই নীলকমলকে আমার বন্ধুরা যোগাযোগ কোরে আপনাদের ৫ আইন ভঙ্গ করায় ও কৌশলে একরাত্রি হাজতবাস করায় এবং হিসাব কোরে তা’কে হাজত থেকে এমন এক সময়ে মুক্ত করে, যে সময়ে আমিও পুলিস অফিস থেকে বার হ’য়ে জেলের গাড়ীতে উঠি। এসবের প্রয়োজন হয় এই জন্য যে, চরম প্রয়োজন সময় আপনাদের এমন বিশ্বাস জন্মানো, যা’তে আপনারা ভাবতে বাধ্য হন, হয়তো সেই সময়েই আমি পলায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। আর হয়েছিলও তাই, না মিঃ বেকার?”
মিঃ বেকার ঘাড় নাড়িয়া কহিলেন, “ঠিক তাই।”
মোহন কহিতে লাগিল, “নীলকমলকে এই প্ল্যানের মধ্যে আনা সব চেয়ে বড়ো প্রয়োজন হয়েছিল যদি তা না হ’তো, আমি কে, আপনারা জানতে চাইতেন। তা’ হলেই আমার সব মতলব ফাঁস হ’য়ে যেতো। আপনারা অনুসন্ধানের মুখে দেখতে পেলেন, এক নীলকমল ভিখারী, সে ঠিক ওই সময়েই পুলিস হাজত থেকে বার হয়েছিল, আর আমিও নিজেকে নীলকমল বোলে পরিচয় দিলুম, সুতরাং এই বদল কার্য সুচারু- রূপে সুসম্পন্ন হ’ল। কেমন, তাই না, মিঃ বেকার?”
মিঃ বেকার মাথা দোলাইয়া কহিলেন, “হাঁ, হাঁ, তোমার কথাই ঠিক।”
মোহন দৃপ্ত মুখে কহিল, “আগের কথা মনে করুন। আমি যখন দম্ভ কোরে ঘোষণা করলুম যে, আমি বিচারের সময় আদালতে হাজির হবো না, তখন আপনারা ব্যতীত ভারতের সমস্ত নর-নারী বিশ্বাস করেছিল, আমি নিশ্চয়ই পলায়ন করবো। কিন্তু আপনারা ভাবলেন, আমি বৃথা দম্ভ প্রকাশ করছি। আপনারা আরো ভাবলেন, কুমার নিত্যবিক্রমের কেসে সফল হ’য়েছি বোলে আমি শক্তিগর্বে আত্মহারা হ’য়ে পড়েছি। কিন্তু আপনারা একবারও চিন্তা করলেন না যে, দস্যু মোহন এমন মিথ্যা অহঙ্কার করে না! যখন সে বলে, সে পালাবে, তখন নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে, এমন কোন সুযোগ আছে, যার বলেই সে এমন প্রকাশ্য দম্ভ করে। আপনারা কি ভাবলেন, না ভাবলেন, আমার কিছুই এসে গেল না, কিন্তু ভারতের নর-নারীর মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে, আমি পলায়ন করবো। একেই বলে বিশ্বাসের শক্তি! দ্বিধাহীন, সন্দেহহীন নির্মল বিশ্বাস। মোহন পলায়ন করবে, সে বিচারের সময় হাজির হবে না, এই বিশ্বাস সকলের মনে অঙ্কিত হ’য়ে গেল। আর সেই সঙ্গে আপনার মনও দ্বিধাজড়িত হ’য়ে উঠল। তারপর আপনি যখন আদালতে আমাকে পরীক্ষ৷ কোরে বললেন যে, আমি দস্যু মোহন নই, আমি অন্য লোক, তখন আদালত-গৃহের সমগ্র জনতা একমনে বিশ্বাস করলো যে, আমি মোহন নই, আমি মোহন হ’তে পারি না মোহন পালিয়েছে, আমি অন্য বক্তি। কিন্তু একটা লোক ও যদি বিন্দু মাত্র সন্দেহ প্রকাশ করতো, একটা লোকও যদি একবার বলতো, যদি এই লোকটাই সত্য সত্যই দস্যু মোহন হয় এবং আমার কাছে এমন দ্বিধা-জড়িত মন নিয়ে এসে আমার দিকে চেয়ে দেখতো, তা’ হ’লেই আমার সব চালাকি পণ্ড হয়ে যেতো আমি কিছুতেই দস্যু মোহন হ’তে পারি না, দস্যু মোহন পালিয়েছে, নিশ্চয়ই পালিয়েছে, না পালিয়ে পারে না। সুতরাং সকলের দৃষ্টি ও মনের অটল বিশ্বাস প্রতারিত হ’তে এতটুকু দ্বিধা করলো না। সঙ্গে সঙ্গে আপনিও প্রতারিত হ’লেন।”
মোহন সহসা মিঃ বেকারের একটা হাত চাপিয়া কহিল, “এখন স্বীকার করুন বন্ধু, আপনি সেদিন ঠিক সময়ে ব্রড্ওয়ে হোটেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন কি না!”
মিঃ বেকার মোহনের প্রশ্ন এড়াইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বন্ধুদের জেলের গাড়ীতে দ্বার কেটে রাখা বিষয়ে তুমি কি বলতে চাও?”
মোহন হাসিয়া কহিল, “শ্রেফ ধাপ্পা, আর ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয়। তারা জেলের পুরাতন গাড়ীখানার বিনিময়ে অন্য একখানি সেইরকম গাড়ীতে দ্বার কেটে রেখে একটা পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। আমি বুঝেছিলাম যে, অমন একটা বিপদ সঙ্কুল প্ল্যান এক দৈব ভিন্ন কোন অবস্থাতেই সফল হ’তে পারে না। অথচ জনসাধারণের মধ্যে একটা আগ্রহ জাগিয়ে রাখবার জন্য ইচ্ছা না থাকলেও একবার চেষ্টা করেছিলাম। তার ফলে আমার সত্যিকার প্ল্যান আশাতীত সাফল্য লাভ করেছে।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “সিগারের মধ্যের পত্রও কি আমাদের ধাঁধাঁ লাগাবার জন্য ইচ্ছা কোরে রেখেছিলে?
মোহন হাসিতে হাসিতে কহিল, “হাঁ। আর ছুরির মধ্যে আমার জবাবও।”
“আর চিঠিগুলো?” মিঃ বেকার প্রশ্ন করিলেন।
“হাঁ, আমিই লিখেছিলাম।” মোহন কহিল।
“আর ঐ নারী যে তোমাকে পত্র লিখতো, সে কে?”
“আমি, আমি, সবই আমি। আমি ইচ্ছা করলে যে কোন রকম হস্তাক্ষর লিখতে পারি।” হাসিতে হাসিতে মোহন কহিল।
মিঃ বেকার একমুহূর্ত চিন্তা করিয়া কহিলেন, “বেশ, সবই যেন তুমিই করেছ, কিন্তু যখন নীলকমলের দেহের মাপ নেওয়া হ’ল, তখন তোমার মাপের সঙ্গে মিল না কেন?”
হাসিতে হাসিতে মোহন কহিল, “মোহনের দেহের সঠিক মাপ কারুর কাছেই নেই।“
মিঃ বেকার কহিলেন, “রাবিশ্! বাজে বোকো না মোহন।” মোহন কহিল, “অন্ততঃ সঠিক মাপ নেই। আর এই বিষয়ে অর্থাৎ দেহতত্ত্ব নিয়ে আমি বহুদিন আলোচনা করেছিলাম তা কি এমনি বৃথা যাবে বোলে, মিঃ বেকার? অবশ্য আমি স্বীকার করছি, কানের মাপ, নাকের মাপ এবং মাথার মাপের তারতম্য আদৌ হয় না না। কিন্তু কি জানেন?”
মিঃ বেকার কহিলেম, “বলো…”
“গতবারে যখন আমি আপনার সঙ্গে রেঙ্গুন থেকে আসি, তখন সেখানের পুলিস অফিসের একজন কেরানীকে মোটা রকম বকশিশ দিয়ে রেকর্ডে আমার মাপের গোলমাল কোরে রাখি। আর এই নিয়েই আপনারা আমার রেকর্ড তৈরী করেছেন। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, নীলকমলের মাপের সঙ্গে আমার মাপ কেন মেলেনি।”
মিঃ বেকার ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া কহিলেন, “বেশ এখন তুমি কি করবে?”
মোহন কহিল, “এখন? আমি এখন বিশ্রাম গ্রহণ করবো। আমাকে এখন কিছু দিন কোন স্বাস্থ্যকর স্থানে থেকে আমার স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে হবে। তা’ছাড়া আমি নানা মানুষের রূপ ধারণ কোরে নিজে যে কি, তা প্রায় ভুলে গেছি। তার ফলে এই হয়েছে যে, আমি এখন আমাকেই অনেক সময়ে হারিয়ে ফেলি। তারপর আপনার মনে আছে কী, মিঃ বেকার, মিস সোমের কথা? এতদিন জেলে থেকেও তাকে আমি ভুলতে পারিনি। সত্য বলতে কি, রমাকে ভোলা দূরে থাকুক, সে আমার মনে আরও জোর কোরে চেপে বসছে। এমন হবে জানলে, বহুদিন পূর্বে ই আমি জেল থেকে চলে আসতাম। মিথ্যে সময় অপব্যয় করতাম না।”
মোহনের স্বরে হতাশার সুর ফুটিয়া উঠিল।
মিঃ বেকার কহিলেন, “তা” হ’লে এখন প্রিয়তমা সন্দর্শনে যাত্রা করবে। কি বলো, মোহন?”
মোহন হাসিয়া কহিল, “আপনার কথাই সত্য হোক, মিঃ বেকার। আমি যেন রমাকে প্রিয়তমা বোলেই ভাবতে সক্ষম হই
সহসা মোহন বেঞ্চির সম্মুখে পায়চারি করিয়া ঘুরিতে লাগিল। তাহার মুখে এক অভিনব আলো ফুটিয়া উঠিল। এক সময়ে মিঃ বেকারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া কহিল, “আশা করি আমাদের মধ্যে সব কথা বলা-কওয়া শেষ হ’য়ে গেছে, মিঃ বেকার?”
“না।” মিঃ বেকার কহিলেন,, “আমি জানতে চাই, তুমি তোমার পলায়নের সত্য কাহিনী কাগজে প্রকাশ করবে কি না; আর আমি যে ভুল করেছি, তা’ও লিখবে কি না?”
মোহন মৃদু হাস্য মুখে কহিল, “না, না, না। জগতের আর তৃতীয় ব্যক্তি আমাদের এ সব বিষয়ের একটী বর্ণও জানতে পারবে না। আপনি নিশ্চিন্ত হোন্, মিঃ বেকার। তা’ ছাড়া, মোহনের এই সব ‘গুপ্ত-তথ্য সে জনসাধারণকে জানিয়ে নিজেকে হাল্কা করবে, এমন বিশ্বাস আপনার হ’ল কি কোরে? না বন্ধু, আপনার কোন চিন্তা নেই। আজ আমাকে একটা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে, আর আমি দেরী করতে পারছি না, বন্ধু। বিদায়! বিদায়!”
মোহন ও মিঃ বেকার উভয়ে সহর্ষে করমর্দন করিলেন মিঃ বেকার জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় নিমন্ত্রণ, মোহন? আমি ভেবেছিলাম, তুমি বিশ্রাম করবার জন্য উতলা হয়েছ। তবে?”
মোহন হাসিয়া কহিল, “হায়! সামাজিক লোক হ’তে হ’লে দায়িত্ব এড়িয়ে চলা যায় না। আমার বিশ্রামের দিন, আগামী কাল থেকে সুরু হবে।”
মিঃ বেকার কহিলেন, “কোথায় নিমন্ত্রণ মোহন?”
“লাটসাহেবের বার্গান বাড়ীতে।” বলিয়া মোহন ধীরে ধীরেদৃষ্টির বাহিরে চলিয়া গেল।
সমাপ্ত