আমি তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে নূতন যোগ দিয়েছি। একদিন বিকেলে আমার বিভাগের একজন ছাত্র আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ছাত্রটির উদভ্রান্তের মতো চেহারা, শূন্য দৃষ্টি। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যার, আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে!’’
ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কেন?”
ছাত্রটি কোনো সদুত্তর দিতে পারল না; শুধু বুঝতে পারলাম কোনো একটা দুর্বোধ্য কারণে সে তীব্রভাবে হতাশাগ্রস্ত, মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত। কীভাবে মানসিকভাবে বির্পযস্ত বা হতাশাগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের হতাশা থেকে টেনে বের করে আনতে হয়, আমার জানা নেই। শুধুমাত্র কমন সেন্স ব্যবহার করে আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি, তাকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করেছি, শক্তি দেবার চেষ্টা করেছি।
সে যখন চলে যাচ্ছে, আমি তখন তাকে বলেছি, ‘‘তোমার যদি আবার কখনও আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে, করে আমার কাছে চলে এস।”
ছেলেটি মাঝে মাঝেই আসত। শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলত, “স্যার, আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে।”
আমি তখন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম, সাহস দিতাম। ছাত্রটি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেনি, পাশ করে বের হয়েছে। কিন্তু আমার একটি ছাত্রী আত্মহত্যা করেছিল। এতদিন হয়ে গেছে, তবু সেই ঘটনাটির কথা ভুলতে পারি না। এখনও যখন কোনো একটি ছাত্র বা ছাত্রী আমার অফিসে ঢুকে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে– স্যার, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে– আমার বুক কেঁপে উঠে।
আমি জানি, সাহস করে কিংবা মরিয়া হয়ে যে এক বা দুজন ছাত্রছাত্রী আমার কাছে আসে, তার বাইরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী আছে যারা কোনো কারণ ছাড়াই হতাশাগ্রস্ত, নিঃসঙ্গ, কিংবা আত্মহত্যাপ্রবণ। তারা কী করবে বুঝতে পারে না, কোথায় সাহায্য পাবে জানে না। আমাদের সবার অজান্তে তারা বিচিত্র এক ধরনের যন্ত্রণায় ছটফট করে। একজন শারীরিকভাবে অসুস্থ হলে তাকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার কথা আমরা সবাই জানি। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও তাকে যে একটু সেবা করে স্বাভাবিক করে তুলতে হয় সেটা কিন্তু আমরা এখনও জানি না।
আজকে আমার এই লেখাটি লিখতে খুব আনন্দ হচ্ছে। কারণ কিছু তরুণ-তরুণী মিলে এই দেশে মানসিক সেবা দেওয়ার জন্যে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘কান পেতে রই’ এবং এই সপ্তাহে একই প্রতিষ্ঠানটির এক বছর পূর্তি হবে। এই এক বছর তারা অসংখ্য হতাশাগ্রস্ত নিঃসঙ্গ বিপর্যস্ত মানুষকে টেলিফোনে মানসিক সেবা দিয়েছে। আত্মহত্যা করতে উদ্যত মানুষকে শান্ত করে নূতন জীবন উপহার দিয়েছে। আজকে আমি এই প্রতিষ্ঠানটিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে লিখতে বসেছি।
টেলিফোনে মানসিক সেবা দেওয়ার ব্যাপারটি যখন প্রথম শুনেছিলাম তখন আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। এটি কীভাবে কাজ করে আমি বুঝতে পারছিলাম না। এর পেছনের কাহিনিটি খুবই চমকপ্রদ। সেটা জানার পর আমি প্রথমবার বুঝতে পেরেছি এটা কীভাবে কাজ করে।
যুক্তরাজ্যের একজন ধর্মযাজকের কোনো একজন কাছের মানুষ হঠাৎ আত্মহত্যা করেছিল। ধর্মযাজক মানুষটি কোনোভাবে এটা মেনে নিতে পারলেন না। তখন তিনি ঠিক করলেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্ত মানুষদের তিনি বোঝাবেন, সাহস দেবেন, শক্তি দেবেন, সান্ত্বনা দেবেন। সত্যি সত্যি তিনি একদিন কাজটি শুরু করে দিলেন এবং দেখতে দেখতে অনেক মানুষ তাঁর কাছে সাহস, সান্ত্বনা, উপদেশ আর শক্তি পেতে আসতে শুরু করল।
কিছুদিনের ভেতরে ধর্মযাজক আবিস্কার করলেন, এত মানুষ তার কাছে আসতে শুরু করেছে যে, তিনি আর কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্যে ওয়েটিং রুমে অসংখ্য মানুষ বসে থাকে। ধর্মযাজক মানুষটি তখন কিছু ভলান্টিয়ারকে ডেকে নিয়ে এলেন, যারা ওয়েটিংরুমে অপেক্ষা করা মানুষদের একটু চা-কফি খেতে দেবে, তাদের সঙ্গে একটু কথা বলে অপেক্ষার সময়টুকু কাটানোর জন্যে সাহায্য করবে।
ক’দিনের ভেতরে ধর্মযাজক অত্যন্ত বিচিত্র একটি বিষয় আবিস্কার করলেন। ধর্মযাজক দেখলেন, যারা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আসছিল, হঠাৎ করে তাদের আর তাঁর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন হচ্ছে না। ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে কথা বলেই তারা খুশি হয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে।
ধর্মযাজক হঠাৎ করে বুঝতে পারলেন, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই মানুষগুলো কোনো উপদেশ শুনতে আসে না, তার আসলে তাদের বুকের ভেতর আটকে থাকা অবরুদ্ধ যন্ত্রণার কথা বলেই ভারমুক্ত হতে চায়। কোনো একজন মানুষ যদি গভীর মমতা দিয়ে একজন হতাশাগ্রস্ত বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের কষ্টের কথাটি শুনে, তাহলে তাদের অনেকেই মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে যায়।
ধর্মযাজক এই অবিশ্বাস্য চমৎকার তথ্যটি আবিস্কার করে ১৯৫২ সালে লন্ডনে টেলিফোনে মানসিক সেবা দেওয়ার একটি হেলপ লাইন বসিয়েছিলেন। সেখানে কিছু ভলান্টিয়ার হতাশাগ্রস্ত, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিংবা আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষের মনের কথা শুনত। তারা নিজে থেকে কোনো উপদেশ দিত না। যারা তাদের যন্ত্রণার কথা, কষ্টের কথা বলত– সেই মানুষজন কথা বলতে বলতে আবিস্কার করত তাদের যন্ত্রণা কমে আসছে– একজন মানুষ গভীর মমতা দিয়ে তার দুঃখের কথা শুনছে– সেখান থেকেই তারা সান্ত্বনা খুঁজে পেত।
পদ্ধতিটি এত সহজ, এত সুন্দর এবং এত সফল যে, পৃথিবীর চল্লিশটি দেশে এ রকম মানসিক সেবা দেওয়ার হেলপ লাইন রয়েছে। ‘কান পেতে রই’ দিয়ে বাংলাদেশ হচ্ছে একচল্লিশতম দেশের একচল্লিশতম প্রতিষ্ঠান।
অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চল্লিশটিরও বেশি দেশে এই হেলপ লাইনগুলো কাজ করে যাচ্ছে। তাই কীভাবে এটা দিয়ে কাজ করানো যায় সেটি অজানা কিছু নয়। যারা ‘কান পেতে রই’ দাঁড় করিয়েছে তাদের একজন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মানসিক সেবা দেওয়ার হেলপ লাইনে প্রায় তিন বছর কাজ করে এসেছে।
সারা পৃথিবীতেই যে পদ্ধতিটা ব্যবহার করা হয়, এখানেও তাই। এই কাজটি করে ভলান্টিয়াররা, কিন্তু এরা কেউ সাধারণ ভলান্টিয়ার নয়। অনেক যাচাই-বাছাই করে তাদেরকে নেওয়া হয়। তারপর সবাইকে একটা দীর্ঘ প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যারা সফলভাবে পুরো প্রক্রিয়াটার ভেতর দিয়ে যেতে পারে, তারাই এই হেলপ লাইনে টেলিফোনের সামনে বসতে পারে। যে ফোন করে সাহায্য নিতে চায় তাকে তার নিজের পরিচয় দিতে হয় না। সে যে সমস্যার কথাটি বলে সেটি পুরোপুরি গোপন রাখা হয়, পৃথিবীর আর কেউ সেটি জানে না।
আমার কাছে যেটি সবচেয়ে চমকপ্রদ মনে হয়েছে সেটি হচ্ছে, ‘কান পেতে রই’ প্রতিষ্ঠানটিতে যে ভলান্টিয়াররা কাজ করে তাদের পরিচয়ও বাইরের কাউকে জানানো হয় না! একশ দিন পূর্তি হওয়ার পর তারা একটি অনুষ্ঠান করেছিল। সেখানে কয়েকজন ভলান্টিয়ার উপস্থিত দর্শকদের সামনে কথা বলেছিল। কিন্তু তারা কথা বলেছিল পর্দার আড়াল থেকে। সাদা স্ক্রিনে শুধু তাদের ছায়া দেখা গেছে।
আমাকে অবশ্যি এই ভলান্টিয়ারদের পর্দার আড়াল থেকে দেখতে হয় না, আমি তাদের অনেককেই চিনি। আমি নিজেও ভাবছি, কোনো এক সময় ভলান্টিয়ার হওয়ার প্রশিক্ষণটুকু নিয়ে নেব।
হেলপ লাইনের টেলিফোনের সামনে বসার মতো সাহস আমার নেই। যখন কোনো একজন ছাদে রেলিংয়ের উপর দাঁড়িয়ে লাফ দেওয়ার পূর্বমুহূর্তে ফোন করবে কিংবা একগাদা ঘুমের ওষুধ হাতে নিয়ে টেলিফোন ডায়াল করবে কিংবা ধারালো ব্লেড হাতে নিয়ে শরীরের কোনো একটা ধমনী কেটে ফেলার হুমকি দেবে, তখন তাদের সঙ্গে কথা বলে বলে শান্ত করার মতো আত্মবিশ্বাস আমার নেই। কিন্তু অন্তত আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কেউ যদি উদভ্রান্তের মতো আমার কাছে সাহায্যের জন্যে ছুটে আসবে, তখন কীভাবে তার সঙ্গে কথা বলতে হবে, সেটুকু হয়তো আরেকটু ভালো করে জানব।
‘কান পেতে রই’ সম্পর্কে জানার পর এর মাঝেই আমার একটা বড় লাভ হয়েছে– আগে যখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কেউ আসত, আমার ভেতরে একটা ধারণা কাজ করত যে, তাকে বুঝি কিছু উপদেশ দিতে হবে। এখন আমি জানি, কোনো উপদেশ না দিয়ে শুধু যদি তাদের কথা একটু মমতা দিয়ে শুনি, তাহলেই তাদের অনেক বড় উপকার হয়। আমি সেটা ঘটতে দেখেছি।
‘কান পেতে রই’ প্রতিষ্ঠানটির ভলান্টিয়াররা যেহেতু ঘোষণা দিয়েছে তারা কখনওই সাহায্যপ্রার্থীর পরিচয় বা সমস্যার কথা কাউকে বলবে না, তাই বাইরের কেউ সেটি জানতে পাবে না। বড়জোর একটা পরিসংখ্যান পেতে পারে। এই পরিসংখ্যানগুলো গবেষণার বিশাল একটা উপাত্ত হতে পারে।
তাদের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আমি পুরো প্রক্রিয়াটির রুদ্ধশ্বাস এবং নাটকীয় অংশটুকু অনুভব করতে পেরেছি। আত্মহত্যা করতে উদ্যত কোনো একজন মানুষের সঙ্গে যখন কোনো ভলান্টিয়ার দীর্ঘ সময় কথা বলে, তার উত্তেজিত স্নায়ু শীতল করে আনে, তার আশাহীন অন্ধকার জগতের মাঝে ছোট একটা প্রদীপশিখা জ্বালিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত টেলিফোনটি নামিয়ে রাখে, তখন অনেক সময়েই ভলান্টিয়াররা নিজেরাই হতচকিত, বিচলিত, ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত হয়ে যায়। অন্য ভলান্টিয়াররা তখন তাকে ঘিরে রাখে, তাকে এক কাপ চা তৈরি করে খাওয়ায়, পিঠে থাবা দেয়!
আমি সবিস্ময়ে এই ভলান্টিয়ারদের দেখি; তার কারণ এদের মাঝে এক-দুজন চাকুরিজীবী থাকলেও সবাই কমবয়সী তরুণ-তরুণী। বেশিরভাগ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। আমি আমার জীবনে একটা সত্য আবিস্কার করেছি; সেটি হচ্ছে, বড় কিছু করতে হলে সেটি ভলান্টিয়ারদের দিয়ে করাতে হয়, যে ভলান্টিয়াররা সেই কারণটুকু হৃদয় দিয়ে বিশ্বাস করে। কাজেই মানসিক সেবা দেওয়ার এই কাজটুকুও আসলে ভলান্টিয়াররা করে।
অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের ভলান্টিয়ারদের থেকে ‘কান পেতে রই’-এর ভলান্টিয়াররা একটু ভিন্ন; কারণ তাদের পরিচয় কেউ কখনও জানতে পারবে না। তারা কাজ করে সবার চোখের আড়ালে। আত্মহত্যা করতে উদ্যত যে মানুষটি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা না করে নিজের জীবনে ফিরে গিয়েছে সেও কোনোদিন জানতে পারবে না কোন মানুষটির কারণে সে বেঁচে আছে। কোনোদিন তার হাত স্পর্শ করে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারবে না।
এটি একটি অসাধারণ ব্যাপার! আমি মুগ্ধ হয়ে তাদেরকে দেখি। তাদের দেখে আমি এই দেশের তরুণ-তরুণীদের নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহস পাই।
পৃথিবীর যেসব দেশে মানসিক হেলপ লাইন পুরোপুরি চালু আছে সেখানে এটি সপ্তাহের সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। ‘কান পেতে রই’ সে রকম পর্যায়ে যেতে পারেনি। এটি সপ্তাহের পাঁচদিন একটা নির্দিষ্ট সময় চালু থাকে। ধীরে ধীরে তারা তাদের সময় বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে তাদের ভলান্টিয়ারের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। চব্বিশ ঘণ্টা চালু রাখতে হলে ভলান্টিয়ারের সংখ্যা আরও অনেক বাড়াতে হবে। তারা ধীরে ধীরে সেই কাজ করে যাচ্ছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলে তারা হয়তো সেটা আরও দ্রুত করতে পারত।
সপ্তাহের সাতদিন পুরো চব্বিশ ঘন্টা ভলান্টিয়াররা হয়তো থাকতে পারে না, কিন্তু যখন তাদের থাকার কথা তখন কিন্তু তারা সবাই থাকে। এই দেশটি যখন হরতাল আর সন্ত্রাসে বিপর্যস্ত হয়েছিল তখনও তারা হাজির ছিল। তারা ঈদের দিনও হাজির ছিল, পূজার ছুটিতেও হাজির ছিল। মানসিক সেবা দিতে আসার সময় তারা ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছে, সাইকেলে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, কোনো যানবাহন না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে হেঁটে এসেছে, কিন্তু কখনও কেউ অভিযোগ করেনি।
কোনো পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হবে না, কোনো টেলিভিশনে তাদের দেখা যাবে না– কিন্তু কখনও তাদের মুখের হাসিটি বন্ধ হয়নি। এই মুহূর্তে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষজনকে সাহায্য করে যাচ্ছে। একসময় তারা বড় হবে। জীবনের নানা ক্ষেত্রে তারা দায়িত্ব নেবে। তখনও তারা নিশ্চয়ই সেখানে অন্য সবার থেকে ভিন্ন হবে। আমি সেটা দেখার জন্যেও অপেক্ষা করে আছি।
‘কান পেতে রই’ সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানি। কারণ আমার পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য এদের সঙ্গে যুক্ত। তারা যখন তাদের কাজ শুরু করে তখন খুব বড় গলায় আমাদের বলেছিল, “আমরা তোমাদের মতো বড় বড় মানুষের কোনো সাহায্য না নিয়ে এটা দাঁড় করাব।”
প্রথমেই তারা আটকে পড়েছিল। রিকশা করে ঘুরছে দুটি কমবয়সী মেয়ে, তাদেরকে ঢাকা শহরের কোনো বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দিতে রাজি হওয়া দূরে থাকুক, কথা বলতেই রাজি হয়নি। কাজেই বাসা ভাড়া করার জন্যে আমাদের মতো বড় মানুষদের একটি-দুটি টেলিফোন করতে হয়েছিল। এরপর তারা আর কখনও আমাদের সাহায্য নেয়নি। কোনো এক সন্ধেবেলা একটা কেক বা সদ্যপ্রকাশিত একটা বইয়ের বান্ডিল নিয়ে গেলে ভিন্ন কথা– সেগুলো নিয়ে তাদের উচ্ছাসের কোনো অভাব নেই।
আমি পত্রপত্রিকায় লিখি। সবসময় খারাপ খারাপ বিষয় নিয়ে লিখতে ভালো লাগে না, সুন্দর কিছু নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে। আমি ‘কান পেতে রই’-এর এই উদ্যোগ নিয়ে লিখতে চেয়েছিলাম। একই পরিবারের সদস্য রয়েছে বলে তারা অনুমতি দেয়নি। এখন আমার পরিবারের সদস্য এখানে নেই, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি আছে। শুধু তাই নয়, পুরো এক বৎসর তারা সফলভাবে কাজ করে গেছে। তাই এবারে যখন ‘কান পেতে রই’-কে নিয়ে লিখতে চেয়েছি, তারা আনন্দ এবং আগ্রহ নিয়ে রাজি হয়েছে।
আমি তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাদের প্রতিষ্ঠানের বিশেষ কিছু কী তারা সবাইকে জানাতে চায়। তারা বলেছে শুধুমাত্র তাদের সেবা দেওয়ার সময় এবং তাদের টেলিফোন নম্বরগুলো জানালেই হবে। এই মুহূর্তে তাদের প্রচারের পুরো কাজটুকু হয় সামাজিক নেটওয়ার্ক কিংবা লিফলেট বিতরণ করে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার তাদের বাজেট নেই। বয়স কম বলে তারা এখনও আপোস করতে শেখেনি। তাই আদর্শের মিল নেই বলে গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় তাদের উপর ফিচার করতে চাইলেও তারা রাজি হয় না।
কাজেই যারা কম্পিউটারের নেটওয়ার্কে নেই, তাদের বেশিরভাগই এই চমৎকার উদ্যোগটার কথা জানে না। যারা খবরের কাগজ পড়ে, তাদের মাঝে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কেউ যদি থাকে তাহলে হয়তো তারা একটুখানি সাহায্যের খোঁজ পেতে পারবে। কাজেই আমি ‘কান পেতে রই’-এর সময়সূচি আর টেলিফোন নম্বরটুকু দিয়ে দিচ্ছি:
রবিবার থেকে বুধবার, দুপুর ৩টা থেকে রাত ৯টা। বৃহস্পতিবার দুপুর ৩টা থেকে ভোর ৩টা।
টেলিফোন নম্বরগুলো হচ্ছে–
০১৭৭৯৫৫৪৩৯১, ০১৭৭৯৫৫৪৩৯২, ০১৬৮৮৭০৯৯৬৫, ০১৬৮৮৭০৯৯৬৬, ০১৯৮৫২৭৫২৮৬ এবং ০১৮৫২০৩৫৬৩৪।
গত বই মেলায় আমি এই প্রতিষ্ঠানের ভলান্টিয়ারদের একটা বই উৎসর্গ করেছিলাম। উৎসর্গপত্রে লিখেছিলাম–
“তোমরা কিছু তরুণ-তরুণী মিলে নিঃসঙ্গ, বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্তদের মানসিক সেবা দেবার জন্যে একটা হেলপ লাইন খুলেছ। এমনকি আত্মহত্যা করতে উদ্যত কেউ কেউ শেষ মূহূর্তে তোমাদের ফোন করেছিল বলে তোমরা তাদের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছ। আমি আমার সুদীর্ঘ জীবনে কখনও কারও জীবন বাচাঁতে পারিনি, কিন্তু তোমরা এই বয়সেই মানুষের জীবন বাচাঁতে পার– কী আশ্চর্য!’’
আসলেই– “কী আশ্চর্য!”