৯৫. উপসংহার
একদিন যে-জীবন শুরু হয়েছিল ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের একটা অখ্যাত বাড়িতে, অনেক পথ-পরিক্রমার পর তারই উপসংহারে এসে পৌঁছেছি এখন। জীবনের উপসংহার, সংগ্রামের উপসংহারও বটে। দীপঙ্করের জীবনের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার ইতিহাসেরও উপসংহার। একদিন তার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ১৯১২ সালে। সেদিন জীবন ছিল শান্ত, সংগ্রাম ছিল মৃদু। তারপর আনন্দের প্রাচুর্যে, দুঃখের মহিমায় কখন যে মহাজীবনের সিংহাসনে তার রাজ্যাভিষেক হয়ে গিয়েছিল—তা সে নিজেই জানতো না। দীপঙ্করের এই মহাজীবন তো নদী নয়। নদীর মত পাহাড়-প্রান্তর-মরু-অরণ্য-নগর- গ্রামের তরঙ্গাভিঘাতে ধৌত করে অন্তরের অমূল্য-সঞ্চয়কে মহাসমুদ্রে উৎসর্গ করাও নয়। দীপঙ্করের জীবন যে আকাশ-মহাকাশ! মহাকাশের অনন্ত বিস্তার- বৈচিত্র্যের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করা। সেই বিস্তার-বৈচিত্র্যের সমুদ্রে অবগাহন করেই নিজেকে প্রকাশ করা। সে-প্রকাশ যেন অসীমের কাছে আত্মাসমর্পণ। সে আত্মসমর্পণে যত ভীতি, তত আনন্দ। যত উদ্বেগ, তত নির্ভরতা। যত সংগ্রাম, তত জয়। কিন্তু বেদনা? সংসারে কোথায় বেদনা নেই? দীপঙ্কর তো ছোট নয়। দীপঙ্কর যদি ছোট হতো তো সংগ্রামে সে কাতর হতো, দুঃখ তাকে নিঃশেষ করে দিত। কিন্তু বেদনা আছে বলেই তো সংসারে ছোটর স্থান নেই। যে-বেদনা আঘাতে অটল, যে-বেদনা দুঃখে স্থির-সেই বেদনা যে অনির্বচনীয়। সেই বেদনার অনির্বচনীয়তা দীপঙ্করকে যেন মহীয়ান করে তুলেছিল শেষকালে। এই মহত্ত্বই তার কাছে প্রমাণ করেছিল যে সোক্রেটিস যা বলেছিলেন তা ঠিক—And this one thing hold fast. That to a good man, whether alive or dead, no evil can happen, nor are the gode indiff-erent to his well- being.
আমরা জিজ্ঞেস করতাম—কিন্তু আপনি এত কষ্ট করে আছেন কেন স্যার? দীপঙ্করবাবু তখন আমাদের স্কুলের টীচার। আর আমরা ছাত্র। আমাদের কথা শুনে তিনি হাসতেন। আমরা অনেক টীচার দেখেছি। অনেক টীচার আমাদের অনেক উপদেশ দিয়েছেন, অনেক শাসন করেছেন। কিন্তু এর আগে এমন করে কেউ আকর্ষণ করেন নি। আমরা ছুটির পর তাঁর সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর বাড়িতেও যেতাম। তাঁর তক্তপোশের ওপর বসতাম। এক-একদিন সবাই মিলে তাঁর খাবার ভাগাভাগি করে খেতাম। আর তাঁর মুখ থেকে গল্প শুনতাম। আর তাঁর বাড়িতে থাকতো কাশী। কাশীই ছিল তাঁর সব। কাশীকে কখনও মনে হতো তাঁর চাকর, কখনও মনে হতো তাঁর বন্ধু, কখনও বা আবার মনে হতো তাঁর মনিব। দীপঙ্করবাবু কাশীকে হাসতে হাসতে ডাকতেন—কাশীবাবু—
স্কুলে আমাদের এক-একদিন প্রশ্ন করতেন—বড় হয়ে তোমরা কে কী হবে বলো তো?
আমরা কেউ বলতাম—ডাক্তার হবো। কেউ বলতাম—ইঞ্জিনীয়ার হবো। কেউ কেউ বলতো—সাহিত্যিক হবে, কবি হবে। কত সব অদ্ভূত সাধ থাকে মানুষের। উকীল, ব্যারিস্টার, জজ, মিনিস্টার পর্যন্ত হবার আকাঙ্ক্ষা ছিল আমাদের। আমরা সে-সব দিন দেখিনি। কেমন করে গোপীনাথ সাহা টেগার্ট সাহেবকে গুলী করতে গিয়ে ফাঁসির দড়িতে প্রাণ দিলে, কেমন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জেলখানার ভেতর গুলী চালানোর পর কলকাতার ময়দানে মনুমেন্টের তলায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিলেন। কেমন করে কিরণের মত ছেলেরা স্বার্থের কথা ভুলে ইন্ডিয়ার স্বাধীনতা আনলে, কেমন করে প্রাণমথবাবুর মত মহাপ্রাণ-মানুষ কংগ্রেসের জন্যে আত্মোৎসর্গ করলেন, কেমন করে ছিটে-ফোঁটার দল সুবিধে-বাদীর মত ঠিক সময়ে কংগ্রেসের মধ্যে এসে ঢুকলো – সে-সব কথা আমাদের মতন বয়েসের ছেলেদের জানবার কথা নয়। কেমন করে মিস্টার ঘোষালরা সংখ্যায়, প্রতিষ্ঠায়, প্রতিপত্তিতে সমাজের মাথায় উঠে বসলো আবার—তাও আমরা জানতাম না। কেমন করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের, স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শকে আমরা ভুলে গেলাম স্বাধীনতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে—তাও আমরা জানবার চেষ্টা করিনি। আমরা জানতাম এই বোধহয় নিয়ম। এই স্বার্থপরতা, এই নীচতা, হীনতা, এই ঘৃণ্যতাই বুঝি আদর্শ। আমরা জানতাম পরকে ঠকিয়ে, সমাজকে ধাপ্পা দিয়ে সকলের ওপরে ওঠার নামই মনুষ্যত্ব। আমরা জানতাম জীবনে উন্নতি করতে গেলে ছিটে-ফোঁটার মত হওয়াই উচিত। আমরা জানতাম—অর্থই একমাত্র পরমার্থ। আমরাও অঘোরদাদুর মত জানতাম—কড়ি দিয়ে বুঝি সবই কেনা যায়। কিন্তু দীপঙ্করবাবু এসেই আমাদের সব ভুল ভাঙ্গিয়ে দিলেন।
তিনি আমাদের আকাঙ্ক্ষার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন—সে কি? তোমাদের মধ্যে একজনও কেউ মানুষ হতে চাও না?
তিনি যেন হতাশ হয়ে গেলেন আমাদের মুখের দিকে চেয়ে। কিন্তু আমরা সত্যিই বুঝতে পারতাম না। জীবনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়ে কী হবে? স্বামী বিবেকানন্দ হয়েই বা কী হবে? আমরা হবো হেনরী ফোর্ড। আমরা হবো রকফেলার, আমরা হবো এন্ড্রু কার্নেগী। কিংবা হবো জি ডি বিড়লা, হবো গোয়েঙ্কা, হবো মাহীন্দ্র। তাও যদি না পারি তো হবো মিনিস্টার। কিছু কাজ করতে হবে না—শুধু বক্তৃতা দিয়েই বেড়াতে হবে, আর সরকারী গাড়ি করে উৎসবে-অনুষ্ঠানে সভাপতি হবো। তা-হলেই আমরা মাসে- মাসে ঠিক মাইনে পেয়ে যাবো। শুধু আমরা নয়, আমাদের গার্জেনরাও এই কথাই শেখাতো আমাদের। আমাদের স্কুলে আমরা লেখা-পড়া করতাম ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে ওই একই ধারাতে আমরা লেখাপড়া শিখছিলাম। হঠাৎ দীপঙ্করবাবু এসেই আমাদের সব ধ্যান-ধারণা বদলে দিলেন।
কিন্তু গন্ডগোল বাধলো কিছুদিন পর থেকেই। হেডমাস্টারের কানে কথাটা গেল। গার্জেনদের কানেও কথাটা গেল। নতুন ইংরেজীর টীচার ছেলেদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। হেডমাস্টারমশাই একদিন তাঁকে ডেকে সাবধান করে দিলেন। বললেন—আপনি স্কুলের টেক্সট বুকের বাইরে আর কিছু শেখাবেন না ছেলেদের—
দীপঙ্করবাবু বললেন—কিন্তু টেক্সট বুকে যে সমস্ত ভুল লেখা রয়েছে—
হেডমাস্টার মশাই বললেন-থাক্ ভুল। সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড এ-বই এ্যাপ্রুভ করেছে, আপনি কেন তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন? আপনি জানেন না এ-বই একজন ডক্টরেটের লেখা?
আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে সব দেখতে পাচ্ছিলাম, শুনতে পাচ্ছিলাম।
দীপঙ্করবাবু বললেন—যিনি ডক্টরেট তাঁর ডক্টরেট কেড়ে নেওয়া উচিত, যাঁরা এই অথরকে ডক্টরেট দিয়েছেন তাঁদেরও ডক্টরেট কেড়ে নেওয়া উচিত—
—তার মানে?
দীপঙ্করবাবু বললেন—তার মানে এই বই তাঁর নিজের লেখা নয়, তিনি নাম ধার দিয়েছেন, লিখেছে অন্য লোকে, আর তিনি নিজের নাম দিয়েছেন অথর হিসেবে অনেক টাকা পেয়ে—
—আপনি এ-কথা বলতে পারছেন?
দীপঙ্করবাবু বললেন—আপনি নিজেই জানেন সে-কথা, সুতরাং আমার বলাতে কিছু দোষ হয়নি—
কিন্তু আশ্চর্য! আমরাও পরে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। যে-সব বিখ্যাত লেখকের বই আমরা পড়ছি সে-সব তাঁদের নিজের লেখা নাকি নয়। যিনি আসলে বইটা লেখেন তাঁর নাম থাকে না। তিনি যদি পান আড়াই শো টাকা, যাঁর নাম ছাপা হয় লেখক হিসেবে তিনি পান হাজার টাকা। এ-সব আমরা জানতাম না। জানতাম না এই সব বই স্কুলে ধরাবার জন্যে দালাল থাকে। তারা হেডমাস্টারের বউকে শাড়ি কিনে দেয়, স্কুলের সেক্রেটারিকে দামী-দামী জিনিষ ঘুষ দেয়। তবে বুক-লিস্টে সেই বই-এর নাম ওঠে দীপঙ্করবাবুর ঘটনা না ঘটলে আমাদের এসব জানবার উপায়ও ছিল না। কী জানি কেন, সেই দীপঙ্করবাবুকেই একদিন চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার নোটিশ এল। ছেলেদের তিনি মাথা খাচ্ছেন। ছাত্রদের মনে নাকি বিষ ঢোকাচ্ছেন—এই অভিযোগ! আমরা স্কুলের সব ছেলেরা মিলে প্রতিবাদ করলাম। দরখাস্ত করলাম। কিছুতেই যখন কিছু হলো না তখন স্ট্রাইক শুরু হলো আমাদের। আমরা স্কুলের গেটের সামনে শুয়ে পড়ে রইলাম। কেউ ঢুকতে পারবে না স্কুলের ভেতর। দীপঙ্করবাবুর ওপর বরখাস্তের নোটিশ প্রত্যাহার না করলে এমনি ধর্মঘট চলবে দিনের পর দিন। রাত্রে পোস্টার লিখে দেওয়ালে-দেওয়ালে এঁটে দিই। তুমুল আন্দোলন চলতে লাগলো। একদিকে সমস্ত স্কুল, সমস্ত গার্জেনরা, আর একদিকে আমরা সবাই ছাত্র। আমাদের দীপঙ্করবাবুকে আমরা চাই। তাঁকে অন্যায়ভাবে ছাড়ানো চলবে না।
আমরা রোজ ভোর বেলা উঠে গিয়ে স্কুলের সামনে গিয়ে চিৎকার করি— সেক্রেটারির বিচার চাই—
সবাই এক সুরে চেঁচিয়ে ওঠে—বিচার চাই—
শেষকলে পুলিস এল লাঠি নিয়ে। সেক্রেটারিই পুলিস ডেকে আনিয়ে-ছিলেন। পুলিসে-ছাত্রে লড়াই শুরু হলো। আমাদের মধ্যে কয়েকজন ধরা পড়লো। আর কয়েকজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। খবর পেয়ে দৌড়ে এলেন দীপঙ্করবাবু। তাঁকে দেখেই আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। তিনি এসে বললেন—তোমরা চুপ করো ভাই। আমাকে নিয়েই যখন এত গন্ডগোল তখন আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। তোমরা মনে কোর না এই এত বড় পৃথিবীতে আমার কোনও আশ্রয় মিলবে না। পৃথিবী অনেক বড়। তোমরা যত বড় কল্পনা করো তার চেয়েও বড়। আমি আর একদিন আর এ জায়গা থেকে এখানে চলে এসেছিলাম। এখান থেকেও আবার আর এক জায়গায় চলে যাবো। প্রয়োজন হলে পৃথিবীর সব জায়গায় আমি খুঁজবো—দেখবো কোথায় মানুষ পাই। আমি হতাশ হই না, হতাশ হবো না। সনাতনবাবু আমাকে শিখিয়েছেন হতাশ হতে নেই। আমি আশা নিয়ে সারা পৃথিবী খুঁজবো—কোথাও-না-কোথাও মানুষ পাবোই।
.
এই-ই হলো সূত্রপাত। আমাদের বারাসত স্কুলের টীচার দীপঙ্করবাবুর সঙ্গে এই- ই হলো শেষ-সাক্ষাৎ। এর পর মাত্র কয়েকদিন ছিলেন। সেই ক’দিনের মধ্যেই তাঁর সব পরিচয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ধর্মঘট আমাদের শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁরই কথায়। তিনিই আমাদের ধর্মঘট বন্ধ করতে অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন—আজকে এক মিনিটে তোমাদের সব অভিযোগের প্রতিকার হবে না। ইতিহাস পড়ে দেখো। সোক্রেটিসকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। গান্ধীজীকেও প্রাণ দিতে হয়েছে। আমি এতদিনের পর বুঝেছি To a goodman, whether alive or dead, no evil can happen. আমি তোমাদের আশীর্বাদ করে যাচ্ছি। তোমরা ডাক্তার হয়ো, তোমরা ইঞ্জিনীয়ার হয়ো, তোমরা সব কিছু হয়ো, কিন্তু সকলের আগে মানুষ হয়ো—পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দরকার আজ মানুষের, মানুষের কমে যাচ্ছে—
দীপঙ্করবাবুর ছোট ঘরের ভেতর ছোট তক্তপোশটার ওপর বসে আমরা ক’জন ছাত্র তাঁর কথা শুনছিলাম। আমরা জিজ্ঞেস করলাম—মানুষ মানে কী স্যার?
দীপঙ্করবাবু বললেন—ওই দেখ—
আমরা চেয়ে দেখলাম। তিনি দেয়ালের গায়ে ঝোলানো একটা ফ্রেমে-বাঁধানো ছবির দিকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ছবিতে কিছুই নেই, শুধু একজোড়া পায়ের ছাপ। দু’পায়ের পাতায় আলতা মাখিয়ে ছাপ নেওয়া হয়েছে। ওটা আমরা প্রায়ই দেখতাম। প্রায়ই কৌতূহল হতো। জিজ্ঞেস করলাম—ও কা’র পায়ের ছাপ স্যার?
দীপঙ্করবাবু বললেন—প্রাণমথবাবুর!
আমরা প্রাণমথবাবুর কথা আগেই শুনেছিলাম। বললাম—কেন স্যার? ওঁর পায়ের ছাপ রেখেছেন কেন?
দীপঙ্করবাবু যেন হঠাৎ বড় অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, বললেন—তবে শোন—
আজ দীপঙ্করবাবু কোথায় কতদূরে আছেন জানি না। তিনি তাঁর মানুষ খুঁজে পেয়েছেন কিনা তাও জানি না। আমাদের স্কুল আজো তেমনি চলেছে। টেক্সট্ বুকের ভুল আজো পড়ানো হচ্ছে আমাদের স্কুলে। সেই ভুল শিখেই ছাত্ররা ডাক্তার হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, উকীল হচ্ছে, ব্যারিস্টার হচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো বিড়লা, গোয়েঙ্কা, মাহীন্দ্রও হচ্ছে। দূর ভবিষ্যতে কেউ-কেউ ফোর্ড, রকফেলার, কার্নেগীও হয়ত হবে। তারপর কলেজে ঢুকেছি। সংসারে ঢুকেছি। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের পর আরো চোদ্দ পনেরো বছর কেটে গেল। দীপঙ্করবাবুর মত আর কেউ প্রতিকার করবার নেই, প্রতিবাদ করবার নেই। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের অঘোরদাদুর মত আমরা সবাই কড়ি দিয়ে সব কিনছি। পাপ কিনছি, পুণ্য কিনছি, ধর্ম কিনছি, অধর্ম কিনছি! গাড়ি বাড়ি রেফ্রিজারেটারের মত সম্মান প্রতিষ্ঠা প্রতিপত্তি কিনছি। অঘোরদাদুর সব কথাই আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। অঘোরদাদু ভবিষ্যদ্রষ্টা। আজ এই ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর কাহিনী লিখতে লিখতে সেই সব দিনের শোনা কাহিনীগুলোই মনে পড়ছে বার বার।
—তবে শোন!
১৮৭৭ সালের ১লা জানুয়ারী তারিখে দিল্লিতে একদিন মহা-সমারোহে দরবার বসলো। ভারত-সাম্রাজ্যেশ্বরী কুইন-ভিক্টোরিয়া বললেন—’আমার আশা ও বিশ্বাস যে বর্তমান উপলক্ষ হইতে আমি ও আমার ভারতীয় প্রজাবৃন্দ ক্রমশঃ দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর স্নেহের বন্ধনে পরস্পর মিলিত হইতে পারিব। এবং তাঁহাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদস্থ ব্যক্তি হইয়ে নিম্নতর স্তরের লোকরা পর্যন্ত সকলেই প্রাণে অনুভব করিতে পারিবেন যে আমার শাসনতন্ত্রে তাঁহাদের সকলের জন্যে স্বাধীনতা সাম্য ও ন্যায়বিচার মৌলিক নীতিগুলি সম্যক রক্ষিত হইয়াছে এবং তাঁহাদের সুখ-শান্তি বিধান, তাঁহাদের সৌভাগ্য-সমৃদ্ধি বর্ধন ও তাঁহাদের কল্যাণসাধনই আমার সাম্রাজ্য পালনের চিরন্তন উদ্দেশ্য ও চরম লক্ষ্য।’
সেইদিন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সাম্য ও ন্যায়-বিচারের সাক্ষ্য ভুরি-ভুরি ছড়ানো ছিল ১৯৪৭-এর ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত। সেই ১৫ই আগস্ট তারিখেই সেই একই দিল্লিতে মহা-সমারোহে আর এক দরবার বসলো রাত বারোটার সময়। সেই কুইন ভিক্টোরিয়ার সেই একই আসন থেকেই জওহরলাল নেহরু বেতারে বক্তৃতা দিলেন—Long years ago we made a tryst with destiny, and now the time comes when we shall re-deem iyr pledge. The service of India means the service of the millions who suffer. It means the ending of poverty and ignoranc and disease and inequality of opportunity. The ambition of the greatest man of our generation has been to wipe out every tear from every eye.
ইন্ডিয়ার কোটি কোটি লোক রাত জেগে সেই বক্তৃতা শুনছিল। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের অঘোর-সৌধের বাড়িতে রেডিও খুলে দিয়ে শুনছিল ছিটে, শুনছিল ফোঁটা, শুনছিল লক্কা, শুনছিল লোটন। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িতে শুনছিলেন সনাতনবাবু, শুনছিলেন নয়নরঞ্জিনী দাসী। উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ভাড়াটে বাড়িতে শুনছিল লক্ষ্মণ সরকার আর ক্ষীরোদা। আর লেক হাসপাতালের ছোট্ট কেবিনটাতে শুয়ে শুয়ে শুনছিল দীপঙ্কর। আর আরো একটা বাড়ির ছোট ঘরের মধ্যে বসে-বসে শুনছিল কিরণ আর মাসীমা। আর গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর বাড়িতে শুনছিল……
কিন্তু সে-কথা এখন থাক।
মধুসূদনদের রোয়াকেও সেদিন রাত্রে ভিড় কম নয়। সারা কলকাতার রাস্তাতেই ভিড়। কেউ কাজ করবে না। অনেক কষ্টের পর স্বরাজ এসেছে। অনেক কষ্ট স্বীকার, অনেক জেল-খাটা, অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে পরম সম্পদ পাওয়া গিয়েছে। পার্টিশান হয়ে গেছে ইন্ডিয়ার। নতুন এক রাষ্ট্রের আবির্ভাব হয়েছে পৃথিবীতে। তার নাম পাকিস্তান। সেদিন সেই কলকাতার বুকের ওপর দিয়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে কাতারে কাতারে। সে-দৃশ্য সবাই দেখেছে। বাড়ির দরজা বন্ধ করে রুদ্ধ-শ্বাসে মুহূর্ত গুনেছে। রাস্তায় কখনও চিৎকার হয়েছে—বন্দে মাতরম্। কখনও-আল্লা হো আকবর। গান্ধীজীর সঙ্গে মহম্মদ আলি জিন্না সাহেবের কথাবার্তায় কোন ফল ফলেনি। ওয়ার্ধা থেকে হাসি- মুখে ফিরেছিলেন প্রাণমথবাবু। হাতে তাঁর ফাইল। তাঁর সব উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। লর্ড ওয়াভেলও রাজী হয়েছেন গান্ধীজীর কথায়। সবাইকে মুক্তি দিতে হবে। আর যারা অপরাধী তাদের বিচার হবে। বিচারও হলো, দোষী প্রমাণিত হলো। কিন্তু তবু ছাড়া পেলে সবাই। শা নওয়াজ খাঁ, কর্নেল ধীলন, লক্ষ্মী মেনন, সর্দার জীবন সিং। আর ছাড়া পেল কিরণ।
কিরণ ছাড়া পেয়েই সোজা চলে এসেছে একেবারে স্টেশন রোডে। দীপু আছে এ- বাড়িতে? দীপঙ্কর সেন?
অচেনা মুখ। সামনের ঘরের জানালায় পর্দা টাঙানো। ভেতরের ঘর থেকে ছোট ছেলেমেয়ের গলা শোনা গেল। মহিলাদের আওয়াজ। বেশ জমিয়ে সংসার পেতেছে নাকি দীপু?
—না মশাই, এখানে তো দীপঙ্কর বলে কেউ থাকেন না। অন্য কোথাও দেখুন।
—আপনারা কতদিন এসেছেন এ-বাড়িতে?
—তা একবছর আগে, সেই হিন্দু-মুসলিম রায়টেরও আগে—
সে-সব কথা কিরণ জানতো না। তখন সে জেলের ভেতর। তাহলে কোথায় গেল সে? হয়ত ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের বাড়িতে গেলে খোঁজ পাওয়া যেতে পারে!
কিরণ আবার ট্রামে উঠল। আবার এসে দাঁড়াল সেই পুরোন পাড়ায়। যেখানে বয়েজ ওন্ লাইব্রেরী করেছিল। ঠিক যেন চেনা গেল না। সব বদলে গিয়েছে। অঘোরদাদুদের বাড়িটাও আর চেনা যায় না। মাথার ওপরে বড় বড় করে সিমেন্টের কংক্রিটে লেখা রয়েছে ‘অঘোর সৌধ’। গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটো সামনের উঠোনে। গেটে দারোয়ান। দারোয়ানের গায়ে খদ্দরের ইউনিফর্ম। কিরণের চোখে যেন আরব্য- উপন্যাসের মত মনে হলো সব। বাড়ির মাথার লম্বা বাঁশের আড়ায় পত্-পত্ করে কংগ্রেসের ফ্ল্যাগ উড়ছে। এরা কংগ্রেসের মেম্বার হয়েছে নাকি? অঘোরদাদুর সেই বখাটে নাতি দুটো?
—কিরণ না?
কিরণ পেছন ফিরলো। ফটিক। ফটিকের মা মুড়ি ভাজতো পাথর-পটিতে। বললে—তুমি তো জেলে ছিলে শুনেছি—কবে ছাড়া পেলে?
কিরণ জিজ্ঞেস করলে—তোমার কী খবর?
—আমি তো ভাই একটা ফ্যাক্টরীতে কাজ করছি। তোমার খবর কী? কোথায় আছো এখন?
সে-কথার উত্তর না দিয়ে কিরণ জিজ্ঞেস করলে—দীপু কোথায় আছে জানো তুমি? দীপুকে খুঁজছি—
ফটিক বললে—আমি তো ঠিক জানি না ভাই, একদিন একটা বিয়েতে নেমন্তন্ন করতে এসেছিল, তারপর সেইদিনই শিলিগুড়ি চলে গিয়েছিল বদলি হয়ে, আর দেখা হয়নি—
—এ-বাড়িটাতে এখন কারা থাকে?
ফটিক বললে—বিয়েটা তো এই বাড়িতেই হলো। লক্ষ্মণ সরকারের বিয়ে হলো কিনা! লক্ষ্মণ সরকারকে মনে আছে তো?
—আর প্রাণমথবাবু? প্রাণমথবাবুর কাছে গেলে হয়ত দীপুর খোঁজ পাওয়া যেতে পারে, কী বলো?
—তিনি তো মারা গেছেন! তুমি শোন নি?
প্রাণমথবাবুর মৃত্যুর খবর কিরণ জানতো না। ফটিক বললে—সে বড় প্যাথেটিক ভাই। বলতে গেলে ইলেক্শন করতে গিয়েই মারা গেলেন।
—কীসের ইলেক্শন?
—কংগ্রেসের। ফোঁটাদাকে চেন তো? সেই ফোঁটাদাই তো এখন এখানকার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। প্রাণমথবাবু অত দিনকার প্রেসিডেন্ট, সকলকে ঘুষ দিয়ে ভোট ভাঙিয়ে প্রাণমথবাবুকে হারিয়ে দিলে।
সত্যিই সে এ মর্মান্তিক দৃশ্য। নিজের জীবনে কখনও প্রতিষ্ঠা চাননি প্রাণমথবাবু। শুধু চেয়েছিলেন ইন্ডিয়া স্বাধীন হোক। ওয়ার্ধা আশ্রম থেকে ফিরে এসেছেন তখন। হঠাৎ ঠিক হলো ইলেকশন হবে। কংগ্রেসের নতুন মেম্বাররা চায় ফটিক ভট্টাচার্য হবে প্রেসিডেন্ট। প্রাণমথবাবু বললেন—তা তুমিই প্রেসিডেন্ট হও না, আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি, আমার দ্বারা আর কাজ চলছে না—
কিন্তু ফোঁটা বললে—না, তা হতে পারে না, ভোট হবে—
সেই ভোটই হলো শেষ পর্যন্ত। প্রাণমথবাবুর ইচ্ছের বিরুদ্ধেই ভোট হলো। ফটিক ভট্টাচার্য মেম্বারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়ে বেড়াতে লাগলো। দেশের যুবশক্তিকে সামনে এগিয়ে আসতে হবে। ক’দিন ধরে কালিঘাটের পার্কে দাঁড়িয়ে খুব বক্তৃতা দিলে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হতে হবে। ইন্ডিয়াকে পার্টিশন করা চলবে না। গরম-গরম বক্তৃতায় অনেক হাততালি কুড়োল ক’দিন ধরে। সেই মিটিং-এ প্রাণমথবাবুকেও বলতে বলা হলো। তিনি বলতে চাননি। বলবার ইচ্ছেও তাঁর ছিল না। তিনি বুঝেছিলেন তাঁকে এবার সরতে হবে। এবার থেকে কংগ্রেসের ভেতরে ঢুকতে আরম্ভ করেছে লোভ আর স্বার্থপরতা। ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে যে যেখানে ছিল সবাই এসে জুটেছে কংগ্রেসের ফ্ল্যাগের তলায়। এবার থেকে তাঁদের চিহ্ন মুছে যাবে। তবু তিনি দাঁড়ালেন। কিন্তু দাঁড়াতে গিয়ে কেমন যেন মাথাটা ঘুরে গেল। তিনি টলে পড়ে গেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল একটা শতাব্দী। সেই ১৮৮৫ সালে যে-প্রতিষ্ঠানের একদিন পত্তন হয়েছিল ত্যাগ আর সহিষ্ণুতার ভিতের ওপর, তার শেষ স্তম্ভটি এতদিনে ধূলিসাৎ হয়ে গেল কালিঘাট-পার্কের মীটিং-এ।
দীপঙ্কর যখন খবর পেয়েছিল তখন সবে ছাড়া পেয়েছে হাসপাতাল থেকে। কালি লেনের বাড়িতে যখন পৌঁছলো দীপঙ্কর তখন প্রাণমথবাবুকে নিয়ে আসা হয়েছে বাড়িতে। তিনি শুয়ে আছেন। অসংখ্য লোকের জটলা চারিদিকে। মাসীমা নিঃশব্দে বসে আছেন। দীপঙ্কর তারই এক ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। তার চোখের সামনে থেকে যেন সব মুছে গেল। মুছে গেল সব ভিড়, সব কোলাহল, সব পৃথিবী। একদৃষ্টে চেয়ে আছেন প্ৰাণমথবাবু। চোখ পলকহীন! সেই ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল স্কুলের হেডমাস্টার যেন দীপঙ্করের দিকে চেয়ে-চেয়েই বলছেন—সারা জীবন সত্য কথা বলবে দীপু—সত্য কথার মার নেই সংসারে, সত্যেরই জয় সর্বকালে—
আরো অনেক কথা মনে পড়তে লাগলো। চোখের সামনে সমস্ত অতীতটা যেন একের পর এক স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠতে লাগলো। এতগুলো মৃত্যু দেখেছে দীপঙ্কর, কিন্তু প্রাণমথবাবুর মৃত্যুকে যেন প্রণাম করতে ইচ্ছে করলো সেদিন। মনে হলো মৃত্যু যে এমন মহিমময় হতে পারে তা যেন এর আগে তার জানা ছিল না!
মাসীমা তারপর প্রাণমথবাবুর দু’পায়ের ছাপ তুলে নিলেন একটা সাদা কাগজে। পায়ের ওপর আলতা লাগিয়ে তারই ছাপ ওঠানো হলো। দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি মাসীমার কাছে গিয়ে বললে—ওটা আমাকে দিন মাসীমা, আমি ওটা পূজো করবো—
—ওই দেখ সেই পায়ের ছাপ্! যেখানেই সেখানেই ওটা আমার সঙ্গে থাকে!
—আর তারপর সেই আপনার বন্ধু কিরণ?
—কিরণ এখনও বেঁচে আছে। এখনও ইন্ডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে মাথা ঘামায়। ইন্ডিয়ার মানুষের দুর্ভাগ্য নিয়ে দুর্ভাবনা করে! রাত জাগে, বই পড়ে, চেঁচায়, মিছিল করে, চাষী-মজুর নিয়ে দল বাঁধে। সে বলে-এ স্বাধীনতা নয়। সে বলে—এ বড়লোকদের স্বাধীনতা, এ কোটিপতিদের স্বাধীনতা। মানুষের স্বাধীনতার জন্যে তাকে আরো লড়াই করতে হবে। সেই স্বাধীনতার জন্যেই সে এখনও যুদ্ধ করছে, বই লিখছে, প্যালেট্ লিখছে। দরকার হলে মাঝে মাঝে জেল খাটে—
—তারপর?
—তারপর কিরণ উনিশের একের বি’র বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়তে লাগলো-লক্ষ্মণ!
যে দরজা খুলে দিলে সে লক্ষ্মণ নয়, সে ক্ষীরোদাও নয়, সে কিরণের মা। কিরণের মা’র তখন চোখে ছানি পড়তে শুরু করেছে। ভালো করে দেখতে পায়নি। বললে—কাকে খুঁজছো বাবা? কাকে চাই?
কিরণ সেইখানে দাঁড়িয়ে মাকে দেখেই কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেল। তারপর বোধ হয় অনেক দেখার অনেক শেখার অনেক কষ্ট পাওয়ার ফলে মুখ থেকে বেরিয়ে এল— আমি কিরণ!
কিরণের মা আর থাকতে পারলো না। সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে ধরলো ছেলেকে। বললে—তুই এসেছিল বাবা? তুই বেঁচে আছিস?
তারপর কান্নায়-হাসিতে-আনন্দে-আবেগে মাসীমার সব কথা যেন ডুবে গেল। বললে—তুই আমাকে এমনি করে ফেলে গেলি বাবা! পরের ছেলে দীপু, দীপুই আমাকে বাঁচালে, দীপু না থাকলে তোকে চোখে দেখাও আমার কপালে থাকতো না বাবা—
বলে অঝোর-ধারে কাঁদতে লাগলো মাসীমা। কিন্তু কিরণের সেদিকে খেয়াল নেই। সে দীপঙ্করকে খুঁজতে এসেছিল। বললে—দীপু কোথায় তুমি জানো?
মাসীমা বললে—সে তো হাসপাতালে রে। রেলগাড়িতে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিল—
কোন্ হাসপাতালে?
মাসীমা বললে–লেকের হাসপাতালে—
কিরণ আর দাঁড়াল না। মা’র হাত ছাড়িয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। পেছনে থেকে মাসীমা জিজ্ঞেস করলে—কোথায় যাচ্ছিস তুই?
কিন্তু যে উত্তর দেবার সে তখন আর চোখের সামনে নেই। রাস্তায় বেরিয়ে একেবারে চোখের আড়ালে চলে গেছে—