৯২
রামমনোহর দেশাই ক্যাপিট্যালিস্ট লোক। ব্যবসাদার। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট! দেশে কংগ্রেসই আসুক আর হিন্দু মহাসভাই আসুক, তাতে কিছু এসে যায় না তার। দেশাইজী ভেতরে-ভেতরে চাঁদা দিয়েছে কংগ্রেসকে। বেয়াল্লিশ সালে কংগ্রেসীরা এসে তার কাছ থেকে হাজার-হাজার টাকা নিয়ে গেছে। গান্ধী-রাজই হোক আর চার্চিল-রাজই হোক, যে-রাজা হবে তাকেই চাঁদা দিতে হবে মশাই। ব্যবসার এই নিয়ম। তোমাদের বাঙলা- মুলুকে কারবার করতে এসেছি, তোমাদের কাছে নিমকহারামী করতে পারবো না। মুসলিম লীগ রাজা হলে তাকেও চাঁদা দেব! আমি কি তোমার পর? শুধু আমার কারখানায় ধর্মঘাট হলে তোমরা দেখো। তখন যেন আমায় বিদেশী বলে হেলা-ফেলা কোর না।
সেদিন গদীবাদিতে ক্যাশ বাক্সের সামনে বসতেই টেলিফোন বেজে উঠলো।—কে?
ওদিকে থেকে উত্তর এল—ঘোষাল স্পীকিং!
—হুজুর, আপনি?
আর একটু হলেই গদী থেকে লাফিয়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যেত দেশাইজী। খুব সামলে নিয়েছে।
—কবে ছাড়া পেয়েছেন হুজুর?
—লাস্ট্ উইকে। আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে দেশাইজী! আমার প্যালেস্- কোর্টে একবার আসুন এখনি!
—জরুর, জরুর, আমি এখনি যাচ্ছি হুজুর।
—সঙ্গে করে হাজার পাঁচেক টাকা আনবেন আমার জন্যে দেশাইজী!
প্যালেস-কোর্টের সিঁড়িতে মল, যতীন, জগন্নাথ আবার এসে দাঁড়িয়েছে। আজ প্রায় আধ-ফাঁকা হয়ে গেছে প্যালেস-কোর্ট। যে-কজন ইউরোপীয়ান ছিল এখানকার টেনেন্ট, তাদের কয়েকজন ইন্ডিয়া ছেড়ে হোমে চলে গিয়েছে। হোম, সুইট্ হোম। কেউ কেউ গেছে সাউথ আফ্রিকায়, কেউ গেছে কানাডায়, আবার কেউ গেছে হোয়াইট্ অস্ট্রেলিয়ায়। কয়েকজন আবার যাবার তোড়-জোড় করছে। এবার ইন্ডিয়া যাবার দাখিল।
ইন্ডিয়ান এম্পায়ার এবার কোল্যাপ্স করলো বলে। পেথিক্ লরেন্সের কথাবার্তা শুনে তাই মনে হচ্ছে। আবার নতুন কোনও কলোনীতে গিয়ে সেটেল করতে হবে। মিস্টার গান্ধীর সঙ্গে কথা বলবে কি না ইন্ডিয়ার ভাইয়! হোয়াট্ এ ডিস্!ে হোয়াট্ এ শেম্! প্যালেস-কোর্টের বয়-বাবুর্চি-খানসামাদের মুখও চুন হয়ে গিয়েছে। সাহেবরা চলে গেলে খাবো কী? কে এত বখ্শিশ দেবে? কারা এত টিপ্স্ দেবে? মল, যতীন জগন্নাথের মুখও শুকিয়ে গিয়েছে। সাহেবরা চলে গেলে ফ্রী-স্কুল স্ট্রীট যে কানা হয়ে যাবে। ফিটন্ গাড়িতে চড়ে আর মেম-সাহেবরা ঘুরে বেড়াবে না। সুইট্সিটীন বলে আর কাদের তারা পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরিয়ে নিয়ে দালালি করবে? ঘোষাল-সাহেবও ছিল না। বলতে গেলে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল মলের দল। কিন্তু ঘোষাল-সাহেব ছাড়া পেতেই যেন আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। দল বেঁধে এসে হাজির হলো পীরালির কাছে। পীরালি গিয়ে খবরটা দিতেই সাহেব ক্ষেপে উঠেছে একেবারে। ভেতর থেকে সাহেবের চিৎকার শোনা গেল—গেট্ আউট্ গেট্ আউট্, ভাগাও হিঁয়াসে—ভাগাও—
পীরালি সামনে এসে বললে—তুমলোক যাও ভাইয়া, সাহেবের গোসা হয়েছে— মকবুল বললে—গোসা হয়েছে তো কী হয়েছে? কাজ-কাম্ হবে না? আমরা না- খেয়ে মরবো?
পীরালি বললে—সায়েবেরই কাজ-কাম নেই তো তোদের কথা ভাববে কখন? তোরা এখন বাহার যা—
কিন্তু মকবুলরা জানে। তাই অত সহজে তারা ঘাবড়ায় না। তারা জানে সাহেব- লোকদের কাজ-কাম একটা জুটবেই। তামাম দুনিয়াটাই সাহেবদের। একটা টেলিফোন করে দেবে সাহেবদের আপিসে আর কাম জুটে যাবে। সাহেবদের নোরি একটা থাকবেই। তাদের টাকা না-থাকলে তাদের পেটে ভাত জোটে না, কিন্তু সাহেবদের টাকা না থাকলেও হুইস্কি-ব্র্যান্ডি-বীয়ার-এর অভাব হয় না কোনওদিন। সাহেবরা বেঁচে থাকবেই। সাহেবরা আছে বলেই তো মলুরা আছে। সাহেবরা না থাকলে তারাও থাকবে না।
ক’দিন ধরেই আসা-যাওয়া চলছিল। কয়েকদিন ধরেই সাহেব টেলিফোনে বাত- চিত করতে লাগলো। আবার গাড়ি আসতে লাগলো সাহেবের কাছে। আবার সাহেবের বাড়ি ফিরতে রাত হতে লাগলো। আবার সাহেব ফ্রি-স্কুল স্ট্রীটে যাতায়াত করতে লাগলো। যখন বাড়ি ফিরতে লাগলো তখন আবার বেহেড।
রামমনোহর দেশাইজী আবার টাকা নিয়ে আসতে লাগলো। আবার বখশিশ দিতে লাগলো পীরালিকে।
মল যতীন জগন্নাথ আবার এসে দাঁড়াল সিঁড়ির গোড়ায়।
—কী হলো পীরালি? সাহেবের কিছু হলো?
পীরালি বললে—চুপ, চুপ, আর কিছুদিন চুপ করে থাকো তুমলোক, সাহেবের নোকরি হয়েছে—
নোকরি হয়েছে! সাহেবের নোকরি হয়েছে শুনে মল যতীন জগন্নাথের দল আবার চাঙ্গা হয়ে উঠলো। ইয়া আল্লা! জয়-মা-কালী! ব্যোম ভোলানাথ! তার পরদিন থেকেই বিরাট বিরাট গাড়ি এসে দাঁড়ায় প্যালেস-কোর্টের সামনে। উর্দি-পরা নতুন ড্রাইভার। প্যালেস কোর্টের পোর্টিকোতে এসে গাড়িটা দাঁড়ায়। আর গাড়ির খবরটা দিলেই সাহেব তখন ব্রেকফাস্ট খেয়ে তৈরি হয়ে নেয়। কোট-প্যান্ট পরে নিচেয় গাড়িতে গিয়ে বসে। আর গাড়িটা সোঁ সোঁ করে বেরিয়ে যায় রাস্তায়।
সেদিন ড্রাইভারটার সঙ্গে ভাব করলে পীরালি। জিজ্ঞেস করলে—ড্রাইভার সাব, সাহেবকে কোথায় নিয়ে যাও তুমি রোজ?
ড্রাইভার গাড়ির ভেতরে বসে ছিল। বললে — ঘোষাল সাব?
—জী হাঁ! ঘোষাল সাহেব নোকরি করছে?
ড্রাইভার বললে—সাব তো আমাদের কোম্পানীর জানরাল মানেজার!
—কেতনা তলব পায় সাহেব?
—তিন হাজার রূপেয়া।
—কোন্ কোম্পানী?
ড্রাইভার বললে—বজবজকা পেট্রল কোম্পানী! বহুত বড়িয়া কোম্পানী। ওই কোম্পানীকে জানরাল মানেজার ঘোষাল সাব।
সেটা পীরালি আন্দাজ করতে পেরেছিল ক’দিন ধরেই। রেল-কোম্পানীতে সাহেব পেত হাজার টাকা। এখন তিন হাজার। তিন হাজারের কেতা-দুরস্ত সাহেবের চাল- চলনে। সাহেব আরো গম্ভীর হয়ে গেছে আজকাল। আরো দামী-দামী সুট পরে। আরো দামী-দামী বোতল আসে সাহেবের ঘরে। সকালবেলা খবরের কাগজখানা পড়তে পড়তে আরো জোরে চেঁচিয়ে ওঠে। অল্ রট! নেকেড্ ফকিরকে লর্ড ওয়াভেল ডেকেছে। নেহরুকে ছেড়ে দিয়েছে। কংগ্রেসকে ইনভাইট করেছে ভাইসরিগ্যাল লজ-এ! হোয়াট এ ডিসগ্রেস। হোয়াট এ শেম! মিস্টার আমেরী হাউস-অব-কমন্স-এ লেকচার দিয়েছে—
“I understand from published reports that the conversation between Mr. Gandhi and Mr. Jinnah broke down over the issue of Pakistan, but that both gave expression to the hope that this was not the final end of their effort.”
রট! ডাউন উইথ গান্ধী! ডাউন উইথ জিন্না! এদের এত ফ্ল্যাটার করে-করেই ব্রিটিশের প্রেস্টিজ চলে যেতে বসেছে! রাগে মিস্টার ঘোষালের গলার নেকটাইটা টাইট হয়ে ওঠে! এরই নাম রুল ব্রিটানিয়া! তারপর গট গট্ করতে করতে নেমে আসে নিচের পোর্টিকোতে। গাড়ির ভেতর গিয়ে বসে। গাড়িটা চলতে চলতে এসপ্ল্যানেডের মোড়ের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল।
—আই সে, ওদিকে যাবেন না। ওদিকে গন্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। বি কেয়ারফুল! মব্ ভায়োলেন্ট হয়ে উঠেছে!
—হোয়াট? হোয়াটস্ রং? কী হয়েছে?
ওদিক থেকেই একজন ইউরোপীয়ান গাড়ি চালিয়ে আসছিল। সেই বুঝিয়ে বললে সমস্ত। এসপ্ল্যানেডের মোড়ে ব্লাডি নেটিভরা ক্ষেপে গেছে। লাঠি নিয়ে ঢারমটলা স্ট্রীটের আশে-পাশে হাজার-হাজার লোক জড়ো হয়েছে। ইউরোপীয়ান দেখলেই তার হ্যাট খুলে নিচ্ছে, নেকটাই খুলে নিচ্ছে! কোট-প্যান্ট সব ছিঁড়ে দিচ্ছে! সে এক অদ্ভুত দৃশ্য সেদিনকার কলকাতার। পার্ক-স্ট্রীট অঞ্চলের সমস্ত ইউরোপীয়ান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান- কোয়ার্টারের সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। ক্যালকাটা থেকে ইউরোপীয়ানদের সবাইকে নাকি চলে যেতে হবে। নেটিভরা কাউকে এখানে নাকি থাকতে দেবে না। কাউকে হ্যাট- নেকটাই পরতে দেবে না। কাউকে সুট পরতেও দেবে না নেটিভরা। ইংরেজদের হোটেল-দোকান সব বাড়ির কাচের জানলায় ঢিল ছুঁড়ছে। রাতারাতি ইন্ডিয়া যেন ফ্রি হয়ে গেছে। রট! অল রট! রটন টু দি কোর! দিস ইজ গান্ধী! দিস ইজ জিন্না! সারা পৃথিবীতে ভিক্টরির পর এখানে এসে এই ডিফিট!
মিস্টার ঘোষাল বললে—গাড়ি ঘুরাও—
গাড়ি ঘুরলো। সাহেব আবার প্যালেস-কোর্টে ফিরে এল! পীরালি দৌড়ে এসে হাজির। গাড়ি থেকে নেমেই সাহেব বললে—জগন্নাথকো বোলাও —
খানিক পরেই জগন্নাথ এল হাঁফাতে হাঁফাতে। বললে—সেলাম হুজুর!
—গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর খবর কী জগন্নাথ? তালাস করেছিস?
জগন্নাথ বললে—আছে হুজুর। সব ঠিক আছে!
—আচ্ছা যা!
বলে মিস্টার ঘোষাল চুরোটটা ধরালে আবার। তারপর আবার ডাকলে। বললে— শোন—
জগন্নাথ ফিরে আসতেই বললে—তোকে একবার শিলিগুড়ি যেতে হবে, পারবি? খুব শক্ত কাজ!
—খুব পারবো হুজুর, জগন্নাথ কোনওদিন ‘না’ বলেছে হুজুর? যে কাজ দেবেন সেই কাজই পারবো আমি হুজুর!
—আচ্ছা তুই যা। মিস্টার ঘোষাল চুরোটটাকে আবার দাঁতে কামড়ে চিবিয়ে নিলে।