৮৪
হোসেনভাই কাশেমভাই-এর পার্টনার মিস্টার হোসেনভাই অবাক হয়ে গেছে সেন- সাহেবকে দেখে। কোথায় বসাবে, কী খাওয়াবে, কেমন করে অভ্যর্থনা করবে ভেবে পেলে না। সেন-সাহেব একবারে সশরীরে এসে গেছে তার আপিসে। এ যে অভাবনীয় সৌভাগ্য।
দীপঙ্কর বললে—আমি বসতে আসিনি মিস্টার হোসেনভাই, আমি ট্র্যানস্ফার হয়ে যাচ্ছি, শুনেছেন তো?
—হ্যাঁ, সে তো জানি।
দীপঙ্কর বললে— আমি মাসে-মাসে আপনার ধার শোধ করবো বলেছিলুম। এই নিন্ এ-মাসের টাকা। আমি মাইনে পেয়েই আপনাকে দিতে এসেছি। আট শো দিয়ে গেলাম গুনে নিন্—
হোসেনভাই বললে-এর জন্যে আপনি অত ব্যস্ত হচ্ছে কেন? আমি তো কিছু বলিনি তার জন্যে?
—না বলুন, কিন্তু আমার তো দায়িত্ব আছে। এর পর আমি শিলিগুড়ি থেকে টাকা পাঠাবো।
—সে আপনার যেমন খুশি দেবেন। আমি কত ওয়াগন পেয়েছি আপনার কাছ থেকে। আমি তো দশ-বিশ লাখ কামিয়েছি সেই ওয়াগন নিয়ে!
দীপঙ্কর বললে—তা হোক, আমি তো ধার নিয়েছি আপনার কাছ থেকে। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি শোধ দিতে চাই, আমি দেনা রাখতে চাই না।
হোসেনভাই বললে—কিন্তু, আপনি পরে দিলেও তো হ’ত, আমি তো মারা যাচ্ছি না, আমার তো ফার্ম রইল।
—আপনি না মারা যেতে পারেন, কিন্তু আমি মারা যেতে পারি, তখন কে আপনার ধার শোধ করবে?
এর পর দাঁড়ায়নি দীপঙ্কর। আপিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল। যাবার আগে সব কিছু গুছিয়ে রেখে যেতে হবে। কলকাতা থেকে চলে যাওয়া মানে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। তার নাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর। এত সহজে কি ছাড়া যায়? এই কলকাতা, এই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, এই ফ্রী-স্কুল স্ট্রীট, এই স্টেশন রোড, এই গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং। এর প্রত্যেকটি ধূলিকণার সঙ্গে সে যে মিলে-মিশে ছিল এতদিন এখানকার খুঁটিনাটি, এই কলকাতার পাপ-পুণ্যের সঙ্গে একাত্মা হয়ে গিয়েছিল সে। একে ছেড়ে যেতে হবে। যত দিন এগিয়ে আসতে লাগলো ততই যেন টান পড়তে লাগলো তার মনে। দাতারবাবুকেও টেলিগ্রাম করে দিয়েছিল তাঁর করলবাগের নতুন ঠিকানায়। দাতারবাবু উত্তর দিয়েছিল—আমি দু দিনের জন্যে কলকাতায় যাবো। কিন্তু বেশী দিনের জন্যে থাকতে পারবো না। আমার মামলার তদবির করতে হবে। তোমরা তোমাদের লক্ষ্মীদিকে দেখো।
ফেরার পথে শেষবারের মত প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়ির সামনে নামলো। শেষবারের মতই বটে। আর কি কখনও এ-বাড়িতে আসা হবে! শেষবারের মতন সতীর শাশুড়ীকে একবার অনুরোধ করে আসবে। সনাতনবাবুকেও একবার বলে আসবে।
শম্ভুর সঙ্গে দেখা হলো বাইরেই। বললে—আসুন, দাদাবাবু —
শম্ভুরও যেন মুখের ভাব বদলে গিয়েছে। ওরাও যেন টের পেয়ে গিয়েছে এ-বাড়ি ছেড়ে আর রাস্তায় দাঁড়াতে হবে না তাদের। ওরাও যেন টের পেয়ে গিয়েছে টাকা জমা দেওয়ার কথা। ওরাও জানে ওদের বউদিমণি এক লাখ টাকা দিয়ে এ-যাত্রা ওদের রক্ষা করেছে।
শম্ভু জিজ্ঞেস করলে—এবার বউদিমণি আসবে, জানেন বোধ হয়?
—কেন? কে বললে?
—জানেন না? বউদিদিমণি যে মা-মণিকে মকদ্দমার টাকা দিয়েছে, দাদাবাবু যে আনতে গেছে বউদিমণিকে—
—সে কী? কে বললে তোমায়?
শম্ভু বললে—আমরা সব শুনেছি, বাতাসীর-মা, ভূতির-মা সবাই জানে—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-তোমার মা-মণি বাড়িতে আছেন?
—আছেন, যান না, ওপরে আছেন। বলেই নিজেও সামনে সামনে চলতে লাগলো।
নয়নরঞ্জিনী সবে ঘুম থেকে উঠেছেন তখন। একটু যেন ভালো হয়েছে চেহারাটা আবার। আবার যেন সেই আগেকার মত খুশী-খুশী মেজাজ।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—সতীকে আপনি আনতে পাঠিয়েছেন? শুনলাম সনাতনবাবু নাকি গেছেন সতীকে আনতে? সত্যি?
নয়নরঞ্জিনী মুখ বেঁকালেন। বললেন—আরে তুমিও যেমন ভালোমানুষ বাবা! কে বললে তোমায়?
—শম্ভু বলছিল।
নয়নরঞ্জিনী শম্ভুর উদ্দেশে এ-দিক ও-দিক চাইলেন। সামনে থাকলে হয়ত বকুনি খেয়ে মরতো। কিন্তু সে তখন কোথায় সরে গেছে চট্ করে।
দীপঙ্কর আবার জিজ্ঞেস করলে—সত্যি বলুন না, আপনি রাজী হয়েছেন?
নয়নরঞ্জিনী আবার মুখ বেঁকালেন। বললেন—কী যে বলো তুমি বাবা, আমি রাজী-আরাজী হবার কে? কে আমার কথার ধার ধেরেছে? বউমা টাকা দিয়েছে আমাকে, এখন বউমার খুশি! আমি রাজীও হইনি, অরাজীও হইনি! তুমি তো এতদিন দেখছো বাবা আমাকে! আমি কোনওদিন বউমার কোনও কথায় হাঁ-না-রাম-গঙ্গা কিছু বলেছি? আমি কি সেই কথা বলার মানুষ! আমি তো কোনওদিন ছেলে-বউয়ের কোনও কথাতেই থাকিনি বাবা! তাদের কথায় আমার থাকা কিসের দায়? এই দেখ না, এই যে মামলা চালাচ্ছি, এ কার জন্যে? এ বাড়ি যদি বাঁচে তো কে ভোগ করবে এ-সব? আমি?
এ-সব পুরোনো কথা শোনবার জন্যে দীপঙ্কর আসেনি। বললে—সে তো আমি জানি, কিন্তু আপনি বউমাকে নেবেন কি না বলুন?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—আচ্ছা, তুমি যে কী বলো! আমি কি বউমাকে তাড়িয়েছি বাড়ি থেকে যে, আমি ডেকে আনতে যাবো? বউমার খুশি হয় আসবে, না-হয় না-আসবে! আমি কী করতে পারি বলো? আমি এই বুড়ো বয়েসে কি বউয়ের পায়ে হাত দিয়ে সাধবো বলতে চাও?
দীপঙ্কর বললে—আমি সে-সব কিছুই শুনতে চাই না আপনার কাছে, আমি যাবার আগে শুধু জেনে যেতে চাই যে, আপনি তাকে গ্রহণ করেছেন।
—তুমি চলে যাবে? কোথায় যাবে তুমি?
দীপঙ্কর বললে—আমি বলি হয়ে বিদেশে চলে যাবো! হয়ত আর আসা হবে না কখনও। কিন্তু আপনার বউকে আপনি ঘরে নিয়েছেন এইটে জানতে পারলেই আমি নরকে গিয়েও শান্তি পেতে পারি—আপনি বলুন, আপনি তাকে নেবেন। আপনি আপনার টাকা পেলেন, এখনও আপনার কিসের আপত্তি? আপনি জানেন সতীর মত মেয়ে হয় না—সতী আপনার সত্যিই সতী-লক্ষ্মী বউ, আমার কথায় আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, অনেক তপস্যা করলে তবে সতীর মত বউ পাওয়া যায়—
—তা আমি কি বলছি বাবা যা, পাওয়া যায় না? এ তো দেখছি মহা জ্বালা হলো তোমাকে নিয়ে…….
দীপঙ্করের আর তখন এ-সব বাজে কথা শোনবার সময় ছিল না। বললে—আপনি জানেন সনাতনবাবু সতীর কাছেই গেছেন?
—হ্যাঁ বাবা, তা গেছে। জোয়ান ছেলে যখন বায়না ধরেছে তখন আর আমি তাকে না বলতে পারিনি! কেন? তুমি ও-কথা জিজ্ঞেস করছো কেন?
কিন্তু দীপঙ্কর তখন আর দাঁড়ায়নি সেখানে। আর বেশী কথা শোনবার সময়ও ছিল না তার। কলকাতা ছেড়ে চলে যাবার আগে দীপঙ্কর দেখে যাবে। দেখে যাবে সতী এখানে এসেছে। সতীকে সনাতনবাবু আবার সম্মান দিয়েছেন, আবার স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছেন। আর তারপর শিলিগুড়ি কেন, পৃথিবীর যে কোনও কোণে গিয়ে থাকতেও তার কোনও আপত্তি নেই।