2 of 3

কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৭৬

৭৬

গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর গেটের ঘন্টা তখনও টিং-টিং করে বেজে চলেছে। ট্যাক্সির ভেতর দীপঙ্কর আবার সনাতনবাবুর দিকে চেয়ে দেখলে। সত্যিই তখনও সে-মুখে কোনও উদ্বেগ নেই, অশান্তি নেই। সত্যিই যেন তিনি হতাশ হতে জানেন না। যত উদ্বেগ সব যেন দীপঙ্করের। যদি সতী আবার সেদিনকার মত অশিষ্ট ব্যবহার করে।

দীপঙ্কর হঠাৎ এতক্ষণে কথা বললে—আপনাকে সতীর কাছে রেখে আমি চলে যাবো সনাতনবাবু —

সনাতনবাবু বললেন—তার কোনও প্রয়োজন নেই দীপঙ্করবাবু, আমি হতাশ হই না, আমি এখনও আশা পোষণ করি—

—কিন্তু আমি কাছে থাকলে সতী হয়ত মন খুলে কথা বলতে পারবে না। আপনারা স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নেবেন, আমি তার মধ্যে নাই বা থাকলাম!

সনাতনবাবু অন্ধকারের মধ্যেই হাসলেন। তারপরে বললেন—আপনি কি ভাবেন অতই সহজ? প্যাসিফিক ওস্যানের রহস্য ভেদ হয়ত মানুষ একদিন করতে পারবে! কিন্তু মানুষের পক্ষে নিজের মনের রহস্য ভেদ করা কি অত সহজ? তাহলে এত সংঘর্ষ কেন? এত জাতি-ভেদ আর প্রথা-ভেদ আর নানারকম ভেদাভেদই বা কেন?

তারপর বললেন—তা ছাড়া রহস্য থাকাটাই তো ভালো! রহস্য আছে বলেই তো সংসারে যেমন এত অমিল, তেমনি এত বৈচিত্র্য, এত সৌন্দর্যও আছে। ফুলের যে সৌন্দর্য, তা কি ব্যাখ্যা করবার জিনিস দীপঙ্করবাবু?

—কিন্তু কোন্ ফুলে বিষ আর কোন্ ফুলে মধু আছে, তা জানলে ভালো হয় না?

সনাতনবাবু বললেন—না। ভালো হয় না। সব জিনিসের সবটুকু জানতে নেই। কিছু অজানা রাখতে হয়। যেমন ভূত, যেমন ভগবান। তার সবটুকু জানরে সংসার অনেকখানি আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়—

দীপঙ্কর বললে—কিন্তু বিষ খেয়ে তো মৃত্যু হতে পারে?

সনাতনবাবু বললেন—সব সময়ে মৃত্যুও তো অবাঞ্ছনীয় নয় দীপঙ্করবাবু!

-–সে কী?

সনাতনবাবু বললেন—এমন মৃত্যুও তো আছে যা দিয়ে কোটি-কোটি মানুষ নবজন্ম পায়!

দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে—সে কী রকম?

তখন থাট্টি-থ্রি আপ সামনে দিয়ে গুম্ গুম্ করে চলেছে। গাড়ির জানালায় আলো নেই। ট্রেন ছাড়বার পর থেকেই আলো নিভিয়ে দেওয়া হয় সব ট্রেনের। নিচের ইস্পাতের চাকাগুলো লাইনের ওপর দিয়ে গড় গড় করে গড়িয়ে চলেছে।

সনাতনবাবু হঠাৎ বললেন—ওই দেখুন, লাইনের ওপর দিয়ে ট্রেনের চাকাগুলো কেমন নির্মমভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে চলেছে

দীপঙ্কর আরো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো সেইদিকে।

—এমন অনেক লোক ছিল যারা ওই চাকার তলাতেই প্রাণ দিয়েছে। এই গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এই হয়ত কত লোক একদিন ওই চাকার তলায় প্রাণ দিয়েছে। দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হয়ত একদিন প্রাণ দেবে!

কথাটা ভাবতেই দীপঙ্কর কেমন যেন শিউরে উঠলো

—সেই প্রাণ দেওয়ার সবটাই কি মৃত্যু? তাদের মধ্যে কারো কারো মৃত্যু হয়ত অমৃত। একজনের মৃত্যুতে হয়ত আর একজন অমৃত পেয়েছে। নিজের মৃত্যু দিয়ে হয়ত আরো দশজনকে নবজন্ম দিয়ে গেছে, এমনও তো হতে পারে!

তবু দীপঙ্কর কথাগুলো বুঝতে পারলে না। থাট্টি-থ্রি আপ তখন অনেক দূরে চলে গেছে। তার পেছনের লাল টেল-ল্যাম্পটা একটা ছোট বিন্দুর মত দেখাচ্ছে। সনাতনবাবুর কথায় হঠাৎ সেই বহুদিনের চেনা জায়গাটা যেন বড় ভয়ানক হয়ে উঠলো দীপঙ্করের চোখে। দীপঙ্করের চোখের সামনে যেন থাট্টি-থ্রি আপের চাকাগুলো সব লাল হয়ে উঠলো। লালে লাল। আর সমস্ত স্লিপারগুলো আর নাইনটি পাউন্ড-এর একজোড়া রেল যেন টাটকা গরম রক্তে স্নান করে উঠলো হঠাৎ।

ভূষণই ডিউটি করছিল তখন। ভূষণেরও যেন-একটা নেশা লেগে গিয়েছিল এই গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর ওপর। এই গেট ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না সে। কত লোক কত জাগয়ায় বদলি হয়ে গেছে। কিন্তু ভূষণ বন্দী হয়ে আছে এই গেট-এর গুমটি ঘরে। দীপঙ্করের মত সেও যেন এই গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর সঙ্গেই নিজের জীবনটাকে জড়িয়ে দিয়েছে। ভূষণ গেটটা খুলে দিলে। আশ্চর্য! দীপঙ্কর অবাক হয়ে গিয়েছিল সনাতনবাবুর কথা শুনে। এমন অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণী সেদিন সনাতনবাবু কেমন করে করতে পেরেছিলেন। তিনি কেমন করে জানতে পেরেছিলেন যে এখানে একদিন এমন হবে।

—আর তা ছাড়া যিশু খ্রিস্টের কথাটাই ভাবুন না দীপঙ্করবাবু, তাঁর একলার মৃত্যু দিয়ে তিনি কত কোটি-কোটি লোকের নবজন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন?

গেটটা খুলতেই ট্যাক্সিটা গিয়ে দাঁড়াল লক্ষ্মীদির বাড়ির সামনে।

রঘু দরজা খুলে দিয়ে বললে-কিন্তু দিদিমণি তো নেই—

—নেই? কোথায় গেছে?

সনাতনবাবু আর দীপঙ্কর ভেতরে এসে বসলো। রঘু বললে—হাইকোর্ট থেকে এক ভদ্রলোক এসে দিদিমণিকে নিয়ে গেছেন —

—হাইকোর্ট থেকে? কখন?

—দুপুরবেলা।

আবার সেই মিস্টার ঘোষালের কেস নাকি! সনাতনবাবুকে বললে—আর একটু বসুন, একটু পরেই হয়ত এসে যাবেন—

আর সত্যিই সতী এল। আধঘন্টার মধ্যেই এসে গেল। বাইরে একটা গাড়ির শব্দ হতেই দীপঙ্কর বললে—ওই সতী এসেছে—

শব্দটা রঘুর কানেও গেছে। সে দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিয়েছে। হয়ত সতীর খুর পরিশ্রম হয়েছে সারাদিন। মিস্টার ঘোষারে মামলার সাক্ষী হয়ে হয়ত সারাদিন উকীলের জেরার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

কিন্তু উঠে দরজার কাছে যেতেই দীপঙ্কর যেন সামনে ভূত দেখে এক পা পিছিয়ে এল!

সতী নয়, লক্ষ্মীদি!

কিন্তু লক্ষ্মীদির এ কী চেহারা হয়েছে! কোথায় গেল সেই লিপস্টিক, কোথায় গেল সেই সিফন, সেই ব্রোকেড আর কোথায় সেই সিগারেট? লক্ষ্মীদিকে প্রথমটা চিনতে কষ্ট হয়। দীপঙ্কর ভূত দেখার মত লক্ষ্মীদিকে একদৃষ্টে দেখতে লাগলো।

ডাকলে—লক্ষ্মীদি—

মুখ তুলে সামনে দীপঙ্করকে দেখেই লক্ষ্মীদি হঠাৎ যেন হাউ-হাউ করে কেঁদে উঠলো।

—কী হলো লক্ষ্মীদি? কী হলো তোমার?

ট্যাক্সিটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। তখনও ভাড়া মিটিয়ে দেওয়া হয়নি তার। রঘু তখন ট্যাক্সি থেকে লক্ষ্মীদির সুটকেস নামিয়ে নিচ্ছে। লক্ষ্মীদির কান্নার সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্করের সমস্ত অন্তরাত্মাও যেন হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠতে চাইলো।

—কী হলো লক্ষ্মীদি? কী হলো তোমার? হঠাৎ তুমি কোত্থেকে?

আর কথাবার্তা নেই। লক্ষ্মীদি সেই সিঁড়ির ওপর উঠেই যেন টলে পড়ে যাচ্ছিল। তারপর দুই হাত বাড়িয়ে দীপঙ্করের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কান্নায় ভেঙে পড়লো লক্ষ্মীদি। বললে—আমার টেলিগ্রাম পাসনি তোরা? আমি যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলুম সতীকে!

—কীসের টেলিগ্রাম? টেলিগ্রামে কী ছিল?

কিন্তু লক্ষ্মীদির তখন আর সে-সব বুঝিয়ে বলবার মত ক্ষমতা নেই। দীপঙ্করের মনে হলো—লক্ষ্মীদি যেন থর থর করে কাঁপছে। লক্ষ্মীদির তখন আর কোনওদিকে জ্ঞান নেই। সেই সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়েই দীপঙ্কর লক্ষ্মীদিকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো।

—চুপ করো লক্ষ্মীদি, চুপ করো, চুপ করো।

তারপর ধরে ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে বললে-চলো লক্ষ্মীদি, ভেতরে চলো, কেঁদো না, কী হয়েছে তোমার বলো?

লক্ষ্মীদি ভেতরে যেতে যেতে বললে—আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে রে দীপু, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে—

—কী সর্বনাশ? সর্বনাশটা কী? চলো, ঘরে গিয়ে বোল সব, এই রাস্তায় কান্নাকাটি কোর না, লোকে কী ভাববে?

ঘরের ভেতরে সনাতনবাবু চুপ করে বসেছিলেন। তিনি শুধু একবার চেয়ে দেখলেন। কিন্তু সে মুখে কোনও কৌতূহল নেই, কোনও জিজ্ঞাসা নেই। তিনি যেমন চুপ করে বসেছিলেন, তেমনি চুপ করে বসে রইলেন। দীপঙ্কর তখনও লক্ষ্মীদিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

—ছিঃ লক্ষ্মীদি, চুপ করো, কেঁদো না, ঘরে গিয়ে তোমার সব কথা শুনবো চলো—

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *