৭০
সোজা আপিস যাবার আগেই দীপঙ্কর আবার ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ‘অঘোর-সৌধ’তে গিয়ে নামলো। আপিস যাবার জন্যেই তৈরি হয়ে বেরিয়েছিল সেদিন। মনোহরদের রোয়াকের আড্ডা তার আগেই হয়ত শেষ হয়ে গেছে। সেই পুরোন রাস্তা দিয়ে চলতে- চলতেই যেন দীপঙ্কর আবার তার নিজের মধ্যে নিজেকে ফিরে পেলে। যেন সেই ছোটবেলার দীপু সে। সেই রাস্তার কোণে তেলেভাজার দোকানটা তখনও রয়েছে। সেই গলিটারও তেমনি চেহারা। শুধু পিচ্ ঢালা হয়েছে রাস্তায়। ফটিকদের পাথুরেপটির ভেতরে টিনের চালাটাও তেমনি আছে আসলে বাইরে বোধহয় সবটাই সেইরকম আছে, শুধু ভেতরটাই বদলেছে। আজ কেউ আর চিনতে পারলে না তাকে। কিংবা হয়ত কাউকে অত চিনে রাখবার কারো সময়ও নেই। সবাই যেন ব্যস্ত! রাস্তার লোকগুলো ব্যস্ত হয়ে হেঁটে চলেছে। হাঁটছে না তারা, যেন ছুটছে। যেন আর সময় নেই কারো। ছোট ছোট ছেলেরাও আর আগের দিনের মত পাড়ার গলিতে গুলি খেলছে না, খেলা করছে না। সময় নেই কারো। ছুটে গিয়ে সকলকে সকলে পেছনে ফেলে রাখবে। অর্থাৎ আরো যেন টাকা চাই। এক মিনিট দেরি হলে যেন অনেক টাকা ফসকে যাবে। সকলের হাতে এক নতুন জিনিস। সকলেই হাতে নিয়ে চলেছে থলি। চটের থলি। ছোটবেলায় তো এত থলি দেখেনি দীপঙ্কর কারোর হাতে!
—ছিটেবাবু আছেন?
‘অঘোর-সৌধ’র সামনের গেটে একটা দরোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল। একটা গাড়ি বেরিয়ে গেল গেট দিয়ে। ভেতরে বউরা বসে। হয়ত সেই লক্কা কিংবা লোটন। সেদিনের সেই কালিঘাটের বস্তির মেয়েদের চেনবারও আর উপায় নেই। তারা ভদ্র-গৃহস্থবাড়ির সঙ্গে নিখুঁত খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেদের। লাল চওড়া পাড় শাড়ি। গরদের শাড়ি। হয়ত কালিঘাটের মন্দিরেই পূজো দিতে যাচ্ছে। হেঁটে যাওয়া হয়ত আর সম্ভব নয় তাদের পক্ষে। সম্ভ্রম, মর্যাদা, শালীনতা—অনেক কিছুরই বাধা হয়ত তাদের পায়ে হাঁটা আজ বন্ধ করে দিয়েছে।
আজ যেন ছিটেও অনেক মর্যাদার মানুষ হয়ে উঠছে। সেই খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি আরো ফরসা হয়েছে। আরো মোটা হয়েছে যেন সে। ঘরময় লোক। অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী, অনেক আশ্রিত, অভ্যাগত জুটেছে তাদের। আত্মীয় বন্ধু বান্ধব প্রতিবেশী—কিছুরই অভাব নেই তাদের আজ। দীপঙ্করকে দেখেই একটু অবাক হবার ভান করলে। অথচ মনে মনে যেন ধারণা শুধু দীপঙ্কর কেন, সবাইকেই এই ‘অঘোর-সৌধ’তে একদিন আসতেই হবে। কলকাতার হোমরা-চোমরা মানুষরা তার কাছে যখন আসে তখন দীপঙ্কর তো কোন্ ছার! দীপঙ্কর চারদিকে চেয়ে দেখলে। এই বাড়ির উঠোনের ভেতর কোন্ ঘরে সে থাকতো, কোন্ ঘরে শুতো, কোথায় সে খেত, কোথায় সেই আমড়া গাছটা ছিল—তা যেন আর চেষ্টা করলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না!
অনেক লোকের মধ্যে কীভাবে কথাটা পাড়বে বুঝতে পারলে না দীপঙ্কর।
—তারপর এদিকে কী মনে করে ভাই দীপু?
দীপঙ্কর বললে—তুমি খুব ব্যস্ত আছো?
ছিটে হাসলো। বললে—আর যে দিনকাল পড়েছে, এ-যুগে ব্যস্ত না-থেকে উপায় আছে? খেটে খেতে হয় তো! কী বলেন বদ্রীদাসজী?
ওপাশ থেকে কে একজন মারোয়াড়ী হেঁ হেঁ করে হেসে উঠে তাল দিলে।
—না, তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল, পার্সোন্যাল কথা একটু—
ছিটে বললে—তা তোমার যদি আপত্তি না থাকে তো আমার আপত্তি কিছু নেই, আমি ভাই সেই প্লেন্ য়্যান্ড সিম্পল ছিটেই আছি এখনও! সিম্পল্ থাকার অনেক গুণ, জানো? তা আফিসে যাচ্ছো বুঝি?
—হ্যাঁ একটু তাড়াতাড়ি আছে আমারও। সাড়ে আটটা বেজে গেছে কি না? ছিটে বললে—তাহলে এই পাশের ঘরে চলো, পাশের ঘরটা তো পার্সোন্যাল কথা বলবার জন্যেই তৈরি করেছি—
পাশের ঘরটাও সাজানো-গোছানো। টেবল-চেয়ার ফরাস তাকিয়া—সব কিছুই আছে। ছিটে-ফোঁটা নিজেদের দুই ভাইএর ছবি টাঙানো রয়েছে ঘরে। জেলে ধরে নিয়ে যাবার আগে ফোঁটাকে ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছিল গুণ-গ্রাহীরা। সেই অবস্থার ফোটো। দেশসেবক, কর্মী, ত্যাগী ফোঁটা, ফটিক ভট্টাচার্য।
ছিটে বলে—এটাতে ফোঁটা বসতো, ফোঁটার ঘর—কী, বল এবার, কী তোমার পার্সোন্যাল টক্?
দীপঙ্কর বললে—আমি এসেছিলাম তোমার কাছে, একটা বিশেষ কাজে। খুব বিপদে পড়ে। একমাত্র তুমিই আমাকে উদ্ধার করতে পারো!
—বিপদ? তোমার চাকরি নিয়ে কিছু বিপদ?
দীপঙ্কর বললে—না, তা নয়, কিছু টাকা আমার দরকার— ছিটে যেন এটা ভাবতেই পারেনি। বললে—টাকা?
—হ্যাঁ, আমি অনেক ভেবে তোমার কাছে এসেছি। তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে এ-বিপদ থেকে বাঁচাতে পারবে না। আমার আপিস থেকে লোন্ নেবার কথা ভেবেছিলাম কিন্তু তাতে আমার কুলোবে না। বড় জোর আমার প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে পনেরো কুড়ি হাজার টাকা আমি ধার নিতে পারি—কিন্তু তার অনেক বেশি আমার দরকার—
ছিটে কী ভাবলে। বললে—ব্যবসা করবার মতলব? কীসের ব্যবসা করবে?
দীপঙ্কর বললে—না, ব্যবসা নয়, অন্য কারণে
—তাহলে আর কী হতে পারে? মিলিটারি কন্ট্রাক্ট? কত অর্ডার পেয়েছো তুমি? কত পার্সেন্ট থাকবে? ক্যাশ পেমেন্ট না ক্রেডিট? গ্রেন সাপ্লাই?
দীপঙ্কর বললে—না, ও-সব কিছুই না। টাকাটা তুমি দিতে পারবে কি না বলো না। আমি ইন্টারেস্ট দেব, বাজারে যে-ইন্টারেস্ট তুমি পাও আমি সেই ইন্টারেস্ট দেব। কিংবা মাসে-মাসে পাঁচশো টাকা করে আমি দিতে পারি। মোটকথা একসঙ্গে আমার অনেক টাকা থোক্ দরকার, আমার নিজের হাতে কিছু নেই এখন
ছিটে বললে—কত টাকা চাই তোমার তাই-ই বলো না!
দীপঙ্কর বললে—ধরো এক লাখ!
—এক লাখ? এক লাখ টাকার জন্যে এত ভাবনা? আজকাল ক্যাপিট্যালের তো ছড়াছড়ি। মানি-লেন্ডাররা টাকা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে ক্যাপিট্যাল ইনভেস্ট করবে বলে!
—কিন্তু তাদের কাছে আমি যেতে চাই না। তোমাকে চিনি, তাই তোমার কাছে এসেছি। তুমি যদি দাও তাহলে সবচেয়ে ভালো হয়। আমি অবশ্য শুধু হাতে টাকা নেব না। আমি রীতিমত স্ট্যাম্পড-পেপারে এগ্রিমেন্ট করে নেব। তা ছাড়া তুমি তো জানো আমি কী চাকরি করি, কত টাকা মাইনে পাই। তোমার টাকা অন্ততঃ মারা যাবে না, এইটুকু গ্যারান্টি দিতে পারি—
ছিটে হো হো করে হেসে উঠলো। বললে—তুমি দেখছি রীতিমত ওয়ার্লডলি লোক হয়ে পড়েছ। টাকা তো চাইছো, টাকা আমার কাছেও। কিন্তু টাকা তো আর লিকুইড ফেলে রাখি না আমরা। আমাদের টাকা তো আর ব্যাঙ্কে থাকে না।
—ব্যাঙ্কে থাকে না?
দীপঙ্কর যেন সেদিন অবাক হয়ে গিয়েছিল ছিটের কথা শুনে! এত টাকার মালিক এরা, ব্যাঙ্কে টাকা রাখে না?
—না, ব্যাঙ্কের সঙ্গে আমাদের কারবার নেই। সেকালের লোকরা টাকা ব্যাঙ্কে রাখতো, এখনও যা মাসকাবারি মাইনে পায়, তারা ব্যাঙ্কে টাকা রাখে। বিজনেসম্যানরা টাকা কখনও ব্যাঙ্কে রাখে না। তা ছাড়া ওয়ারের সময় এত টাকা ব্যাঙ্কে রাখাও তো রিস্ক! কুড়ি পঁচিশ মেরে কেটে পশ্চাশ পর্যন্ত ব্যাঙ্কে রাখি আর বাকিটা—
—বাকিটা?
ছিটে বললে—বাকিটা সবই ইনভেস্টমেন্ট। কিছু ল্যান্ড কিনেছি, কিছু চাল স্টক্ করেছি। চালের দর তো এবার বাড়বে, চার টাকা মণ ছিল বাজারে, এখন ছ’টাকা হয়েছে। আমি তিনটাকা দরে কিনেছিলুম, যখন চল্লিশটাকা মণ দর হবে, তখন ছেড়ে দেব। তিনশ টন মাত্র কিনেছি, টাকা থাকলে আরো কয়েকশ টন কিনে ফেলতাম।
আরো অনেক কথা বলে গেল ছিটে। অদ্ভুত সব কথা। টাকা নাকি কেউ ব্যাঙ্কে রাখে না। সবাই অঘোরদাদুর মত নাকি টাকা লুকিয়ে রাখে। সাদা টাকা হলে ব্যাঙ্কে রাখা যায়, কিন্তু এ যে কালো টাকা। ব্ল্যাক মানি। এর হিসেব তো কাউকে দিতে হবে না। ব্যাঙ্কের টাকা হিসেব দিতে হবে ইনকাম ট্যাক্স আপিসকে। কিন্তু ব্ল্যাক-টাকার হিসেব কাউকেই দিতে হবে না। তুমি পাঁচ টাকার মেডিসিন কিনে পঞ্চাশ টাকায় বেচো, কেউ কৈফিয়ৎ চাইতে আসবে না তোমার কাছে। এখানে চেকের কারবার নেই, সব ক্যাশ্। নগদে কেনা বেচা। তিনশ টন চাল কিনে স্টক্ করেছে ছিটে, টাকা থাকলে আরো তিনশ টন স্টক করতো, সমস্ত উঠোনটা গোডাউন হয়ে গেছে চালের, আর মেডিসিনের আর নানা জিনিসের। শুধু কাঁটা পেরেক বেচেই কত লোক লক্ষপতি হয়ে গেছে। কেউ তাদের ফাঁসি দেয় নি, কেউ তাদের গালাগালিটাও দেয়নি সেদিন। ফোঁটা কংগ্রেসের ভাইস্ প্রেসিডেন্ট। জেলে যাবার সময় পাড়ার লোকেরাই তার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিয়েছে। তাকে আর প্রাণমথবাবুকে পুলিসে যখন ধরে নিয়ে গেছে তখন সবাই চিৎকার করে অভিনন্দন জানিয়েছে। ‘বন্দে মাতরম’ বলে পাড়া মাত্ করেছে। প্রাণমথবাবুর সঙ্গে এক ব্র্যাকেট এক লেভেলে উঠে গেছে সে। আবার যখন সে ছাড়া পাবে জেল থেকে, তখন আবার ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দেবে তারা। সবাই আবার বন্দে মাতরম্ বলে পাড়া মাত্ করবে। দরকার হলে আবার জেলে যাবে সে, আবার ব্রিটিশ-আইন ভাঙবে। মাথায় তার লাঠি পড়বে, মাথা ফেটে রক্ত পড়বে। কিন্তু কেউ জানে না ব্যাঙ্কে তার কত টাকা আছে, কেউ জানবে না তার ভাই তিনশ টন চাল স্টক্ করে কত প্রফিট করলে। কত ক্যাপিটাল ইনভেস্ট্ করে কত পার্সেন্ট ডিভিডেন্ড পেলে তার দৌলতে!
ছিটের অনেক কাজ ছিল। বললে—তুমি কিছু মনে কোর না ভাই দীপু, তোমাকে নিজের লোক মনে করি বলেই এত কথা বললুম—অন্য কেউ হলে আর এত কথা বলতুম না।
সেদিন ছিটের কাছ থেকে খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল দীপঙ্করকে। ফিরতে হয়েছিল অনেক জ্ঞান নিয়ে। টাকা সম্বন্ধে এক নতুন জ্ঞান দিয়েছিল ছিটে। টাকা যদি উপায় করতেই হয় তো সোজা সৎ পথে থেকে তা করা যাবে না। টাকা বড় বজ্জাত জিনিস। টাকাকে ভালোবাসো সে-ও তোমাকে ভাল-বাসবে। কিন্তু টাকাকে ভালবাসতে ক’জন জানে? টাকাকে যারা পর মনে করে ব্যাঙ্কে রাখে, টাকাও তাদের পর মনে করে দূরে সরিয়ে দেয়। টাকাকে আরাম দিতে নেই। আরাম দিলেই টাকা আলসে হয়ে যাবে। তার বাহ্ হবে। টাকাকে ঘোড়ার মত খাটাতে হয়। খাটিয়ে খাটিয়ে টাকার মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। তবেই টাকার স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, তবেই টাকার মেজাজ ভাল থাকবে। তবেই টাকা আরো জমবে। টাকা আরো বাচ্চা পাড়বে। যারা ভাবে বাঁচার জন্যে টাকা, তারাই আসলে মরে। কিন্তু যারা মনে করে টাকার জন্যেই বাঁচা, তারাই আসলে বাঁচে।
টাকা সম্বন্ধে এত বক্তৃতা দেবার কোনও দরকার ছিল না ছিটের। এত বক্ততা শোনবার সময়ও ছিল না তখন দীপঙ্করের। কিন্তু উনিশ শো বিয়াল্লিশ সালের শেষ পর্যায়ে এসে মানুষ কোথায় পৌঁছিয়েছে, দীপঙ্কর তারই যেন একটা হদিশ পেল সেদিন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, সক্রেটিস্, মিল্, বেথাম—পৃথিবীর বড় বড় মহাপুরুষ যা যা বলে এসেছেন এতদিন, সব যেন সেই সেদিনকার কলকাতা শহরের মানুষের কাছে মিথ্যে হয়ে গেল। সব মানুষ যেন নতুন করে নতুন এক সভ্যতার সূচনা করলে।
আপিসে দু’চার জন মার্চেন্ট আসতো। নানা কাজে তাদের রেলওয়ে আপিসে আসতে হয়ই। সেদিন দীপঙ্করের কী মনে হলো, একজন মার্চেন্টকে এ অদ্ভূত কথা জিজ্ঞেস করে বসলো। প্রথমটায় একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল মিস্টার হোসেন ভাই। হোসেনভাই বোম্বের মার্চেন্ট। কলকাতায় তাদের ব্র্যাঞ্চ আছে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—আচ্ছা মিস্টার হোসেনভাই, একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপনাকে, আপনার তো অনেক টাকা, এত লাখ-লাখ টাকা নিয়ে আপনি কী করেন?
হোসেনভাই হঠাৎ এই প্রশ্নে একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে কিছু উত্তর দিতে পারে নি। দীপঙ্কর বলেছিল—আপনি কিছু মনে করবেন না মিস্টার হোসেনভাই, কথাটা এমনি জিজ্ঞেস করলাম! আমার বড় জানতে ইচ্ছে করে, যাদের অনেক টাকা তাদের জীবন কী-রকম? তারা কি আমাদেরই মত মানুষ? তারা কি আমাদেরই মত সংসারের ভাবনা ভাবে? তাদের কি আমাদেরই মত সুখ দুঃখ আছে? আমাদের যেমন হয়, তাদেরও কি তেমনি মাথা ধরে, ঘুম পায়, ক্ষিদে পায়, হাসে, কাঁদে? সবই কি আমাদের এই গরীব লোকদের মতন?
লোকটা প্রথমে বলতে চায় নি। সেন-সাহেবের সঙ্গে এ-সম্পর্কও তার নয়। বিরাট গাড়ি চড়ে আপিসে আসে। ওয়াগনের জন্যে দরখাস্ত করে। তারপর কাজ শেষ হলে থ্যাঙ্কস্ দিয়ে চলে যায়। এমনিই বরাবর হয়ে আসছে। কিন্তু সেদিন কাজ শেষ হবার পর হঠাৎ এই অপ্রাসঙ্গিক কথায় হোসেনভাই একটু বিচলিত হলো। বললে-এ-কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন সেন-সাহেব। আমরাও তো মানুষ, আমাদেরও তো বাল-বাচ্চা আছে, আমাদেরও তো হাজারো তলিফ আছে—টাকার তক্লিফ নেই, জীবনে কোনও দিন টাকার তলিফ থাকবেও না। কিন্তু টাকাই তো দুনিয়ায় সব কুছ্ নয় সেন-সাহেব!
—কিন্তু কেন তা হলে আরো টাকা চান? টাকা উপায়ের জন্যে কেন আরো ওয়াগন চান?
লোকটা কিছু উত্তর দিতে পারলে না। খানিক পরে একটু ভেবে বললে—আসলে কারবার তো চালু রাখতে হবে?
—কিন্তু কারবার চালু রাখবার দরকার কী? যে-টাকা আছে তাতে তো ছ’ পুরুষ বসে খেতে পারবেন?
হোসেনভাই বললে—কিন্তু আমার আপিসে আড়াই হাজার স্টাফ আছে, তারা কী করবে? তারা যে আন-এমপ্লয়েড হয়ে যাবে।
দীপঙ্কর বললে—তাদের জন্যেই আপনি টাকা উপায় করছেন? তা হলে তাদের কারো অসুখ হয়ে মরে গেলে তার ফ্যামিলির কথা আপনি ভাবেন? তাদের ছেলের চাকরি, মেয়ের বিয়ে, সব আপনি দেখেন? তাদের সব বিপদে আপনি মাথা ঘামান? তাদের জন্যে যদি এতই আপনার মাথা-ব্যথা তা হলে তারা এক মাস অসুখে পড়ে থাকলে তাদের ছাঁটাই করেন না?
হঠাৎ এতগুলো কথা একসঙ্গে বলে ফেলে দীপঙ্কর নিজেই অনুতপ্ত হলো। এত কথা অকারণে কাকে শোনাচ্ছে সে? আসলে টাকাও তো একটা নেশা। এই নেশার জন্যেই হয়ত গাঙ্গুলীবাবুকে প্রাণ দিতে হলো অসময়ে, অঘোরদাদুকে অপঘাতে মৃত্যু বরণ করতে হলো! তবু তো সেই টাকাকেই নেশা করেছে ছিটে-ফোঁটা, সেই টাকাকেই নেশা করেছিল নির্মল পালিত! অথচ এই লোকটা ইচ্ছে করলেই আজ এক লাখ টাকা ধার দিতে পারে। এক লাখ টাকা ধার দিয়ে নয়নরঞ্জিনী দাসীকে বাঁচাতে পারে। আবার সব গোলমাল মিটে যায়। এখন যখন নয়নরঞ্জিনী আবার তাঁর পুত্রবধূকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, তখন সতীও সুখী হতো। সতী সুখী হলেই দীপঙ্করের জীবনের অর্ধেক কাজ যেন শেষ হয়ে যায়। তখন দীপঙ্কর আবার পরম নিশ্চিন্তে তার জীবন কাটাতে পারে।
আশ্চর্য! হোসেনভাই জানেও না কেন সে এত টাকা উপায় করছে। কার জন্যে করছে! সে বোধটুকুও তার নিঃশেষ হয়েছে। ছিটে-ফোঁটা, নির্মল পালিত, অঘোরদাদু, লক্ষ্মীদি এরা কেউই জানতো না কেন তারা টাকা চায়। হয়ত বাঁচার জন্যে তারা টাকা চায় না, টাকার জন্যেই তারা বাঁচে! কে জানে!
শেষ পর্যন্ত কথা বলতে বলতে টাকা ধার চাওয়া আর হলো না।
আপিসের ছুটির পর সেদিন গড়িয়াহাট লেভেল ক্রসিং-এ না গিয়ে দীপঙ্কর সোজা প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িতে গেল। দরজা ভেজানো ছিল। সেটা ঠেলে দীপঙ্কর সামনে রাস্তা দিয়ে বাগানের দিকে এগিয়ে গেল। বাগান আর বলা যায় না তাকে। আরো জঙ্গল হয়েছে সেখানে। সমস্ত বাড়িটা যেন কেমন বিষণ্ণ। কাছাকাছি চাকর-বাকর কেউ নেই। এমন অবস্থায় চোর-ডাকাত যে-কেউ ঢুকে পড়তে পারে ভেতরে। এই বাড়িরই একদিন কী চেহারা ছিল। একদিন সতীর বিয়ের সময় এই বাড়িতেই ঢোকবার অধিকারটুকু পর্যন্ত তার ছিল না। একদিন এখানে এই বাগানের সামনেই চাকর-ঝি- ঠাকুর-দরোয়ান-ড্রাইভার সকলের চোখের সামনে সতী মর্মান্তিক অপমান মাথায় তুলে নিয়েছিল। একদিন এই বাড়িরই তেতলার একটা ঘরে গরম লুচি মুখে দিতে গিয়ে দীপঙ্করে মনে হয়েছিল সে যেন বিষ খাচ্ছে। আজ এ-বাড়ির দিকে তাকালে যেন আর সে-কথা কল্পনা করাও যায় না!
হঠাৎ একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটে গেল। হঠাৎ ওপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে তর্-তর্ করে যেন কার নেমে আসার পায়ের শব্দ কানে এল। অন্ধকার বারান্দাটার সামনে দাঁড়িয়ে আর এগোবে কি না ভাবছে। কে নামছে এমন করে? এ-বাড়িতে এমন তর্-তর্ করে হাঁটার মানুষ তো কেউ নেই। নয়নরঞ্জিনী দাসী তো মোটাসোটা মানুষ, তিনি ধীরে- সুস্থে চলাফেরা করেন। সনাতনবাবুও তো এত চট্পটে নন। তবে কে নামছে?
শব্দটা তেতলা থেকে দোতলায় নেমে এল। তারপর দোতলা থেকে একতলায়।
এবার একেবারে মুখোমুখি পড়ে যাবে!
দীপঙ্কর বারান্দার এক পাশে সরে দাঁড়াল।
—ও মা, কে ওখানে? কে দাঁড়িয়ে?
স্পষ্ট মেয়েলি গলা! দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি বললে—আমি—
—ও মা, দীপু, তুমি?
আশ্চর্য! সতী! সতী একটা ঝল মল জরি-পাড় শাড়ি পরেছে অনেক দিন পরে। কাছে আসতেই আরো স্পষ্ট হলো চেহারাটা। এত হাসিখুশী যেন কখনও আগে দেখেনি সতীকে। যেন দশ বছর বয়েস কমে গেছে সতীর।
সতী বললে—তুমি এখানে একলা দাঁড়িয়ে কেন? এসো, ভেতরে এসো। খুব চমকে গেছ তো?
দীপঙ্কর যেন আকাশ থেকে পড়েছে তখন। বললে—কিন্তু তুমি? তুমি হঠাৎ এখানে?
—তুমি জানো না বুঝি? আমি যে কাল এখানে চলে এসেছি। উনি কাল নিজে আমাকে আনতে গিয়েছিলেন। আমার আর কোনও রাগ নেই মনে, জানো। আমার আর কোনও কষ্ট নেই। সব যে মিটমাট হয়ে গেছে আমাদের দুজনের—
দীপঙ্কর যেন তবু বিশ্বাস করতে পারলে না কথাগুলো। একদিনের মধ্যে এমন করে সব মিটমাট হয়ে গেল, সব গোলমাল চুকে গেল, অথচ দীপঙ্কর কিছু জানলোই না!
—কী করে মিটমাট হলো?
সতী খিল্ খিল্ করে হাসতে লাগলো। বললে-বা রে বা, মিটমাট না হয়, এইটেই তুমি চাও নাকি?
দীপঙ্কর বলে—না, না, তা বলছি না, কিন্তু আগে আমি অত করে বলেছি, তুমি তো শোন নি!
—বা রে, উনি যে নিজে গিয়েছিলেন কাল! ওঁর কথা কি আমি ফেলতে পারি? ও আর তুমি কি এক?
তা বটে! দীপঙ্করের তখনও যেন বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি! তবে কি সতী শেষ পর্যন্ত টাকা দিতে রাজী হয়েছে শাশুড়ীকে! ঘুষ দিয়ে শাশুড়ীর স্নেহ, শ্বশুরবাড়ির আশ্রয়, স্বামীর ভালবাসা, সমস্ত কিছু কিনে নিয়েছে!
—কী ভাবছো? এসো, ভেতরে এসো?
দীপঙ্কর ভেতরে যাবে কিনা ভাবছে, এমন সময় হঠাৎ পেছনে একটা শব্দ হলো। একটা গাড়ির শব্দ। একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো বাগানের সামনে। গাড়ির দরজা খুলে নামলেন সতীর শাশুড়ী। আর সামনের সীট থেকে নামলো শম্ভু। ভাড়া মিটিয়ে নিয়ে ট্যাক্সিটা বেরিয়ে চলে গেল।
–কে ওখানে? কে ওখানে দাঁড়িয়ে?
দীপঙ্কর পেছন ফিরে সতীর দিকে চাইতেই যেন আবার সব অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কোথায় গেল সতী! এই তো এখানে দাঁড়িয়ে ছিল স্পষ্ট। এই তো এতক্ষণ তার সঙ্গে কথা কইছিল। এই তো জরি-পাড় শাড়ি পরে খিল্-খিল করে হাসছিল এতক্ষণ!
—এ কি? তুমি দীপঙ্কর না? কী বাবা, কী মনে করে? বৌমার কিছু খবর আছে?
কী আশ্চর্য! এমন ভুলও হয়! এই বয়েসে জেগে-জেগেও মানুষে এমন স্বপ্নও দেখে! কিন্তু স্বপ্নটা যদি সত্যি হতো? যদি সত্যিই সব মিটমাট হয়ে যেত সতীর। টাকা দিয়ে হোক, কিংবা টাকা না-দিয়েই হোক, সতী যদি সত্যিই এ-বাড়িতে এসে স্ত্রীর মর্যাদা পেত! শুধু সতী নয়, যদি পৃথিবীর সব মানুষই সুখী হতো। সকলের কল্যাণ হতো। সকলের মঙ্গল হতো! যদি পৃথিবী থেকে যুদ্ধ, মহামারী, রোগ, শোক সব কিছু দূর হতো! যদি সত্যিই পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসতো!
শম্ভু তাড়াতাড়ি আলোর সুইচটা জ্বেলে দিয়েছিল। এবার সমস্ত স্পষ্ট দেখা গেল। নয়নরঞ্জিনী যেন বড় ক্লান্ত, বড় শ্রান্ত। সারাদিন যেন ভীষণ পরিশ্রম করেছেন। মাথায় মুখে চুলে সর্বত্র ধুলোয় ভর্তি।
—চলো বাবা, শুনি তোমার কথা, ভেতরে চলো। সমস্ত দুপুর আজ কোর্টের ভেতরে কেটেছে। সম্পত্তি নিয়ে যে কী-ঝঞ্ঝাটেই পড়েছি, কী বলবো। সম্পত্তি যেন পরম শত্তুরেরও না থাকে কখনও—সম্পত্তি না তো বিষ! সম্পত্তি আমার বিষের মত ঠেকছে বাবা— চলো—চলো—
নয়নরঞ্জিনীর পেছন-পেছন দীপঙ্করও চলতে লাগলো। কিন্তু তখনও যেন তার মন থেকে স্বপ্নের ঘোরটা কাটেনি!