৬৭
বহুদিন আগে একদিন নয়নরঞ্জিনী দাসী অনুতাপ করেছিলেন ছেলের বিয়েতে যথেষ্ট অর্থ আদায় করতে পারেননি বলে। তখন তাঁর অর্থ ছিল। কিন্তু অর্থের তেমন প্রয়োজনও ছিল না। সে অর্থ চেয়েছিলেন তিনি প্রয়োজন মেটাবার জন্যে নয়— চেয়েছিলেন নিজের গৌরব বৃদ্ধির জন্যে। অর্থ শুধু প্রয়োজনই মেটায় না, গৌরব বৃদ্ধিও করে। তোমার টাকা আছে জানলেই আমি তোমার শ্রদ্ধা করবো। আমাকে টাকা ধার দিতে হবে না, আমাকে টাকা দান করতেও হবে না। তোমার টাকা তোমারই থাকবে, শুধু আমাকে তোমার পূজো করতে দিও। শুধু তুমি নও, সংসারে যারই টাকা আছে, তারই ক্ষমতা আছে। আমি সেই টাকার অংশ চাই না, কিন্তু আমাকে ক্ষমতার ভক্ত হতে দিও। এইটুকু শুধু আমি চাই।
নয়নরঞ্জিনী দাসী নিজের শ্বশুর নিজের স্বামী হারিয়ে যখন নিঃস্ব, তখনও যে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাননি তার একমাত্র কারণ অগাধ টাকা। অগাধ টাকার ছাদের তলায় তিনি তখন নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়েছেন। শুধু আশ্রয়ই নয়, আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পেয়েছেন শ্রদ্ধা, ভক্তি, গৌরব। তার দাম টাকার চেয়েও বেশী। তিনি সব হারিয়ে তাই টাকাকেই তখন আঁকড়ে ধরলেন। তিনি ভাবলেন- চাঁদির জুতো মেরে সকলের কাছ থেকে ভক্তি আদায় করবেন। তিনি চাকর-ঝিদের বলতেন—খুব যে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস, কেন, মাস গেলে মাইনে নিস না?
সতীকে বলতেন—এত দেরি করে ঘুম থেকে কেন ওঠো বৌমা, সকালে উঠতে পারো না?
এসব ঘটনা কেবল প্রতিপত্তিরই নামান্তর। টাকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিপত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে অন্য সমস্ত বৃত্তিকে অন্ধ করে দেয়। তখন স্নেহ-ভালবাসা-মায়া-মমতা সব কিছু পণ্য হয়ে আগাম-শোধ দাবী করে। নয়নরঞ্জিনী দাসীও সেই আগাম-শোধই দাবী করতেন সকলের কাছ থেকে। সেই দাবী সতী শোধ করেনি বলেই তার সঙ্গে তাঁর বিরোধ বেধেছে। যে কড়ায় গন্ডায় তা শোধ করেছে সে নির্মল পালিত। নির্মল পালিত তাঁর দাবী শোধ করে প্রকারান্তরে তাঁর প্রতিপত্তিও হরণ করেছিল। যখন নয়নরঞ্জিনী দাসীর চোখ ফুটলো তখন তিনি দেখলেন এতদিন যার জন্যে তাঁর প্রভাব, এতদিন যে- জন্যে তাঁর প্রতিপত্তি, সেই টাকাই তিনি হারিয়ে বসে আছেন। আর তারপর থেকেই তিনি কেমন অন্যরকম হয়ে গেলেন।
সকাল বেলাই সেদিন উঠেছিলেন তিনি। আগের রাত্রে অনেক পরামর্শ করে ছেলেকে বউ-এর সন্ধানে পাঠাচ্ছিলেন। কিন্তু বাধা পড়েছিল। সাইরেন বাজবার সময়ে একতলার সোনার লাইব্রেরী ঘরে দুজনে কাটিয়েছিলেন। তারপর অনেক রাত হয়ে গেল।
সনাতনবাবু বলেছিলেন—এখন যাবো মা-মণি?
মা-মণি বলেছিলেন—না, কাল সকালে গেলেই চলবে!
সারা রাত্রি ঘুম না-হওয়ারই কথা। না-ঘুম না-জাগা অবস্থাতেই কাটলো সমস্ত রাত। শ্বশুরের মৃত্যু হয়েছিল তাঁরই সামনে। তখন তিনি শিরদাঁড়া সোজা রাখতে পেরেছিলেন। স্বামীরও মৃত্যু হয়েছিল তাঁর চোখের ওপর—তবুও তিনি ভেঙে পড়েননি। সোনাকে বুকে নিয়ে তিনি মাথা উঁচু করে ছিলেন। কিন্তু টাকা এমনই জিনিস! স্বামী- শ্বশুরের অন্তর্ধান তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি বটে, কিন্তু টাকার অন্তর্ধান তাঁর মর্মমূলে গিয়ে নাড়া দিয়ে দিলে।
সকালবেলা বিছানা থেকে উঠেই তিনি সোনাকে গিয়ে ডাকলেন। বললেন— সোনা, এবার তৈরি হয়ে নাও, তোমাকে যেতে হবে এখনি—
সনাতনবাবু যাবার জন্যেই প্রস্তুত। তাঁর যেতে আপত্তি ছিল না। তখনও আপত্তি করলেন না। কিন্তু নয়নরঞ্জিনী তবু ছেলেকে একলা পাঠিয়ে বিশ্বাস করতে পারলেন না পুরোপুরি।
সনাতনবাবু তখন জামা-কাপড় পড়ে তৈরি, ট্যাক্সী এসে গেছে, শম্ভুও হাজির। সনাতনবাবু গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ নয়নরঞ্জিনী বললেন—খোকা, দাঁড়াও—
নিজের ছেলেকেও যেন হঠাৎ আর বিশ্বাস করতে পারলেন না তিনি। জোয়ান বয়েস। হয়ত বউ-এর মুখ দেখেই সব ভুলে যাবে। রাক্ষুসীর কথাতেই হয়ত শেষ পর্যন্ত ঢলে পড়বে। শুধু ছেলে নয়, কাউকেই আর বিশ্বাস করবেন না তিনি। টাকার ব্যাপারে কাউকেই বিশ্বাস করা উচিত নয়।
তাড়াতাড়ি কাপড়টা বদলে নিলেন। ফর্সা সেমিজ পরলেন একটা। তারপর তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসে গাড়িতে উঠলেন। বললেন-এবার গাড়ি ছাড়ো—
সনাতনবাবু বললেন—তুমি যাবে?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—আমি না গেলে কি কোনও কাজ তোমার দ্বারা হবে? তুমি যদি সমস্ত বুঝতে তাহলে আজ আমাকে এই কষ্ট করতে হয়? এখন চলো, এখন তার দেখা পাওয়া গেলে হয়—
সনাতনবাবু বললেন—তুমি যা-যা বলতে বলেছিলে আমি তো তাই-ই গিয়ে বলতাম—
–তোমার ওপর আমার আর বিশ্বাস নেই, শেষকালে কী বলতে কী বলবে, বউ তো সুবিধের মানুষ নয়! সে তোমাকে এক হাটে কিনে আর এক হাটে বেচতে পারে!
এর পরে আর সনাতনবাবু কোনও প্রতিবাদ করেননি। গাড়ি গিয়ে সোজা একেবারে হাজির হলো স্টেশন রোডে। কাশীই দরজা খুলে দিয়েছিল। তারপর তাঁদের সেখানে দাঁড় করিয়ে রেখে ওপরে দীপঙ্করকে গিয়ে খবর দিয়েছিল। মনে আছে দীপঙ্কর সেদিন তাঁদের দেখে শুধু অবাকই হয়ে যায়নি, জীবনের আর এক নতুন সত্যেরও পরিচয় পেয়েছিল। সনাতনবাবু সদাশিব মানুষ। ঘরে ঢুকেই আসল কথাটা পাড়তে ভুলে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন—তাহলে তো এ-সময়ে আপনাকে বিরক্ত করতে আসা উচিত হয়নি দীপঙ্করবাবু, আপনি শুয়ে থাকুন, আমরা বরং চলি এখন নয়—
নয়নরঞ্জিনী বললেন—ইনি কে?
দীপঙ্কর বললেন—ইনি আমার মাসিমা!
—নিচে যে সোমত্ত মেয়েটিকে দেখলাম, ও কে?
মাসিমাই উত্তর দিলে দীপঙ্করের হয়ে। বললে-ও আমার মেয়ে—
সনাতনবাবু বললেন—চলো মা, এখন দীপঙ্করবাবুর অসুখ, এখন বিরক্ত করা উচিত নয়–
বলে নয়নরঞ্জিনী হঠাৎ এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে বললেন—কিন্তু আমার বৌমাকে তো দেখলাম না বাড়িতে! সে কোথায়?
দীপঙ্কর বললে—আপনার বৌমা আমার এখানে তো থাকে না!
—তোমার এখানে থাকে না তো কোথায় থাকে?
দীপঙ্কর বললে—সতী তো তার দিদির বাড়িতে থাকে! গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং- এর কাছে—
নয়নরঞ্জিনী বললেন—কোন্ দিদি? যে-দিদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল অজাত-কুজাতকে?
দীপঙ্কর পাল্টা প্রশ্ন করলে—আপনি কি সতীকে খুঁজতেই এসেছেন আমার কাছে? তাহলে আপনি ভুল ধারণা করেছেন তার সম্বন্ধে! আপনারা সতীর সম্বন্ধে যে ধারণা করেছেন, তা সত্যিই সে নয়! কেন যে এমন ধারণা হলো আপনাদের তাই বুঝতে পারছি না।
নয়নরঞ্জিনী বললেন—না হলেই তো ভালো বাবা, অমন বংশের বউ হয়ে এমন কান্ড কররে পাড়ার লোকের কাছে যে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়। সবাই বলে আমার ছেলের বউ নাকি বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে! এটা কি আমাদেরই শুনতে ভালো লাগে বাবা? তাই তো সোনাকে সকালে উঠেই বললাম—চল বৌমাকে দেখে আসি গিয়ে—
সনাতনবাবু বললেন—আমাদের সে-বাড়ির ঠিকানাটা একবার দিতে পারেন দীপুবাবু?
নয়নরঞ্জিনী বললেন—শুধু ঠিকানা দিলে কি আমরা যেতে পারবো? তুমি যদি সঙ্গে যেতে তো খুব ভালো হতো বাবা!
দীপঙ্কর হঠাৎ এই আগ্রহের কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। বললে—হঠাৎ তার কাছে যাবার ইচ্ছেই বা হলো কেন এতদিন পরে? এত কান্ডর পরে তার কাছে গেলে সতীও তো অবাক হয়ে যাবে?
সনাতনবাবু বললেন—তা তো যাবেই, যে কান্ড তাকে নিয়ে করেছি আমরা—
নয়নরঞ্জিনী কথার মাঝখানে ছেলেকে থামিয়ে দিলেন। বললেন—তুমি থামো, আমি বলছি—
বলে বলতে লাগলেন—আসলে কী হয়েছে জানো বাবা, কাল রাত্তিরে একটা স্বপ্ন দেখিচি, ভোর রাত্তিরে হঠাৎ স্বপ্ন দেখলাম, বৌমার যেন খুব অসুখ হয়েছে, বৌমা আমাকে ডেকে যেন বলছে—মা আমি চললুম! আমি তাড়াতাড়ি বৌমার কপালে যেন হাত দিতে গিয়েছি, হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল, আমি বিছানায় উঠে বসলুম। তারপর সোনাকে গিয়ে ডাকলুম, বললুম—চলো বৌমাকে গিয়ে দেখে আসি, বৌমাকে না দেখলে মনে শান্তি পাচ্ছি না—
মাসিমা এতক্ষণ সব শুনছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বললে—কিন্তু দীপুর যে শরীর খারাপ কাল থেকে, কাল রাত্তিরে কিছু খায়নি বাবা আমার—
সনাতনবাবু বললেন—তাহলে থাক, আমরা বরং অন্য একদিন আসবো—
নয়নরঞ্জিনী বললেন—তুমি তাহলে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে না বাবা সেখানে? আমি বড় বিপদে পড়েই এসেছি তোমার কাছে। বড় আশা করেই মায়ে-পোয়ে এসেছিলাম বাবা। ভেবেছিলুম বৌমাকে এখানেই পাবো! কিন্তু আজই বৌমাকে একবার না দেখতে পারলে আমি বাড়িতে গিয়েও শান্তি পাবো না যে—
দীপঙ্কর উঠে দাঁড়ালো। বললে—চলুন, আমি যাবো—
—আহা, বেঁচে থাকো বাবা তুমি! তুমি যে আমার কী উপকার করলে বাবা, কী বলবো! জানো বাবা, আমার বয়েস হয়েছে, আমি আর ক’দিন! আমি তো গঙ্গামুখো পা বাড়িয়েই আছি। এখন ছেলে-বৌএর হাতে সংসার তুলে দিয়ে যেতে পারলেই হয়। যাবার আগে ছেলে-বউকে সুখী দেখে যেতে পারলে প্রাণটা তবু ঠান্ডা হয়! তুমি তো জানো, বড় অভিমানী বৌমা আমার—শুনলুম নাকি আবার বৌমার বাবাও মারা গেছেন! আহা, বেয়াই আমার বড় ভালো মানুষ ছিলেন! তা তিনি পুণ্যত্মা মানুষ, বেশ গট গট্ করে চলে গেলেন, আমারই মরণ—
দীপঙ্করকে উঠতে দেখে মাসিমা কাছে এগিয়ে গেল। বললে—এই শরীর নিয়ে তুমি যেতে পারবে দীপু?
দীপঙ্কর বললে—আপনি ভাববেন না মাসিমা, এখানে না-গেলেই নয়, আমাকে যেতেই হবে!
হঠাৎ দীপঙ্করের এই দৃঢ়তা দেখে মাসিমাও যেন কেমন হতবুদ্ধি হয়ে গেল। যে মানুষ কাল থেকে খায়নি, ঘুমোয়নি, সেই লোক এখন বাইরে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। সনাতনবাবু বললেন—হ্যাঁ দীপুবাবু, আপনি না-হয় কিছু খেয়ে নিন, আমরা বসছি—
নয়নরঞ্জিনী বললেন-তোমার যদি খিদে পেয়ে থাকে তো বাবা, তাহলে দোকানেই তোমাকে কিছু খাইয়ে দেব খন, আমাদের আবার ট্যাক্সী দাঁড়িয়ে আছে ওদিকে—। আর এ-কাজটা হয়ে গেলে তোমার খাবার অনেক সময় পাবে তখন—
পাশের ঘরে দীপঙ্কর জামা পরছিল। মাসিমা গিয়ে জিজ্ঞেস করলে—ওরা কারা দীপু? কী করতে এসেছেন?
দীপঙ্কর বললে—আপনাকে পরে সব বলবো মাসিমা—এখন এত তাড়াতাড়ি সব বলা যাবে না—
—কিন্তু ওঁর বৌমার কী হয়েছে?
দীপঙ্কর বললে—ওঁর বৌমার যা হয়েছে, তেমন সর্বনাশ যেন কোনও মেয়েমানুষের না হয়!
তারপর তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বাইরে এসে বললে—চলুন—
দীপঙ্কররা চলে যাবার পরে মাসিমা বাইরের ঘর পর্যন্ত এসেছিল। ট্যাক্সীটা চলে যেতেই সদর দরজাটা বন্ধ করে দিলে। তারপর পেছন ফিরতেই দেখলে দূরে রোয়াকের কোণে ক্ষীরোদাও সেই দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাসিমাকে দেখেই ক্ষীরোদা চোখ ফিরিয়ে নিল। কাছে এসে মাসিমা বললে—হ্যাঁরে, তুই কিছু জানিস মা? ওরা কারা? ওদের বৌ-এর কী হয়েছে?
সমস্ত জিনিসটাই যেন কেমন রহস্যের মত মনে হলো মাসিমার কাছে। কিন্তু কাকেই বা জিজ্ঞেস করা যায়? ক্ষীরোদাও মাসিমার দিকে পাথরের চোখ দুটো তুলে রইল অপলক। জীবনের মানে যার হারিয়ে গেছে, তারই বা মুখের ভাষা থাকে কী করে? মুখের ভাষা তার বেরোবে কোন্ সুখে?