2 of 3

কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৬৪

৬৪

প্যালেস-কোর্টে তখনও ভালো করে ভোর হয়নি। তবু অত ভোরেও মিস্টার ঘোষালের কফি খাবার প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে ওঠে। অত সকালেও খবরের কাগজের প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে ওঠে। অত সকালেও টেলিফোন ধরার প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে ওঠে। লাইফ ক্রমেই মিজারেব্ল হয়ে উঠছে ভদ্রলোকদের। পিস্ফুল সিটিজেনদের ক্রমেই কলকাতায় থাকা অসহ্য হয়ে উঠছে। হাজত থেকে ছাড়া পাবার পর সোজা প্যালেস- কোর্টে চলে এসেছিল মিস্টার ঘোষাল। এ ক’দিন কী ন্যাস্টি কেটেছে মিস্টার ঘোষালের। হাজতের মধ্যে স্মোক্ করবার আইন নেই, ড্রিঙ্ক করবার আইন নেই। এই টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরিতেও এ-রকম জেলখানা থাকে। এ-দিকে কেউ নজর দেয় না। কতদিকে কত রিফর্ম হচ্ছে, এদিকে কেউ নজর দিচ্ছে না।

— পীরালি—

—হুজুর—বলে দৌড়ে এল পীরালি। পীরালি বহুদিনকার লোক। সে-ও মিস্টার ঘোষালের মামলায় একজন ডিফেন্স উইটনেস ছিল। সে-ও গিয়ে সাক্ষী দিয়ে এসেছে সাহেবের পক্ষে। তারপর সাহেব অনেক রাত্রে বাড়ি আসার পর ডিনার তৈরি করেছে, কফি তৈরি করেছে। সাহেবের সঙ্গে তখন মিস্টার গাঙ্গুলী ছিল। তারাও ড্রিঙ্ক করেছে, ডিনার খেয়েছে। এত বড় একটা মামলায় জিতিয়ে দিয়েছে মিস্টার ঘোষালকে, এর পর ক্লায়েন্টের ঘাড় ভেঙে খাওয়ায় কোনও অন্যায় নেই।

মিস্টার ঘোষাল বলেছিল—কিন্তু স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুনালের কেসটায় কি কোনও ডেঞ্জার আছে মিস্টার গাঙ্গুলী?

মিস্টার গাঙ্গুলী বলেছিল—ও তো হাতের পাঁচ মিস্টার ঘোষাল, আমার উইনেসরা তো সব রেডি, আপনি ব্রাইব্ নিয়েছেন তার কোনও কংক্রিট প্রুফ্ নেই—

না, কোনও কংক্রিট প্রমাণ রাখবার মানুষ নয় মিস্টার ঘোষাল। জীবনে কখনও মিস্টার ঘোষাল নিজের হাতে ঘুষ নেয়নি। কখনও নিয়েছে দ্বিজপদ। তার আপিসের চাপরাসী। বেশির ভাগই মার্চেন্টরা আসতো প্যালেস-কোর্টে। প্যালেস্-কোর্টের পার্লারে বসেই আদান-প্রদান চলতো মার্চেন্টদের সঙ্গে। টাকা হাতে করে নিত পীরালি। এই নিয়ম বহুদিন ধরে চলে আসছিল। মিস্টার ঘোষালের বিশ্বাস ছিল অনেস্টি দিয়ে মর্ডান পৃথিবী চলে না। চলতে পারে না। অন্ততঃ অনেস্টি বলতে ডিক্সনারিতে যে-মানে লেখা আছে, তাই দিয়ে। অনেস্টির নতুন মানে লিখতে হবে। ডিক্সনারিও নতুন করে লিখতে হবে। শুধু অনেস্টি নয়, ট্রুথের মানেও বদলে গেছে। এখন নতুন যুগের সঙ্গে তাল রেখে নতুন রিভ্যালুয়েশন করতে হবে সব জিনিসের। আসলে মিস্টার ঘোষালের কাছে একে ঘুষ বলে না। একে বলে সাইড-ইনকাম। মার্চেন্টরা চায় অফিসাররা ঘুষ নিক্। ঘুষ না দিলে তাদের ব্যবসা চলবে না। মেশিনের পক্ষে যেমন তেল, চাকরির পক্ষে তেমনি ঘুষ। তেল দিলে যেমন মেশিন চালু থাকে তেমনি ঘুষ দিলে কাজও চালু থাকবে। ঘুষ বন্ধ হলে কাজও বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু ক্লার্করা থাকবে নিখুঁত। ক্লার্করা যদি ঘুষ নেয় তো আপিস অচল হয়ে যাবে। তাই প্রায়ই মিস্টার ঘোষাল আপিসের ক্লার্কদের বলতো—আপনাদের বিরুদ্ধে যদি কখনও কোন কমপ্লেন্ আসে, আই শ্যাল্ ফিনিশ উইথ ইউ—

মিস্টার ঘোষাল আরো বলতো—রেলওয়ে আপনাদের খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে, রেলওয়ে আপনাদের প্রোভাইড করছে, আপনারা যে-কাজ করেন তার জন্যে আপনাদের রীতিমত মাইনে দেওয়া হচ্ছে—এখানে এসে গল্প করবার জন্যে, আড্ডা দেবার জন্যে মাইনে দেওয়া হয় না—

তারপর আরো উপদেশ দিত মিস্টার ঘোষাল। বলতো—রেলওয়ের প্রপার্টি দেশের প্রপার্টি, রেলওয়ের কাজ দেশের কাজ, রেলওয়ের প্যাসেঞ্জারদের সুখ-সুবিধে দেখা আমাদের কাজ, আমাদের দায়িত্ব। যতক্ষণ আমরা রেলওয়েতে চাকরি করছি ততক্ষণ দিনরাত আমরা নিজেদের লাভ-লোকসানের কথা ভাববো না, ভাববো রেলের লাভ- লোকসানের কথা! রেলের লাভ হলেই আমাদের লাভ, রেলের লোকসান হলেই আমাদের লোকসান—বুঝলেন? বুঝলেন কিছু আপনারা?

সামনে দাঁড়িয়ে হাবার মত ক্লার্কদের দিনের পর দিন এই সব কক্তৃতা শুনতে হতো। —দেখুন আমি যখন বিলেতে ছিলুম তখন থেকেই ইন্ডিয়ান রেলওয়ের বদনাম শুনেছি। শুনে আমার বড় লজ্জা করতো! এখানে এসেও আমার ফ্রেন্ডরা যখন বলে যে তোমাদের রেলওয়ে স্টাফ্ বড় করাপ্ট, তখন আমার লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। তারা বলে টিকিট-কালেক্টররা নাকি প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়, বুকি—ক্লার্করা নাকি মার্চেন্টদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়—হোয়াট এ শেম্? চি ছি—আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত রিয়ালি, আমি এই রেলওয়ের এই বদনাম মুছে ফেলতে চাই! এই বদনামের জন্যে আপনারা যারা ক্লার্ক তারাই দায়ী, আপনাদের জন্যেই সমস্ত বাঙালী জাত আজ ছোট হয়ে গেছে ফরেনারদের চোখে—আই মাস্ট স্টপ্ ইট্। আমি চাই আমার আন্ডারে যত স্টাফ্ আছে সবাই মাট্ বি ভেরি অনেস্ট! অনেস্টি ইজ্ দি বেস্ট পলিসি! আমি যখন বিলেতে ছিলুম তখন থেকে একটা কথা আমি মুখস্থ করে রেখেছি—কথাটি হচ্ছে—No honest man ever repented of his honesty.

এইরকম দিনের পর দিন আপিসে বক্তৃতা দিয়েছে মিস্টার ঘোষাল আর রামমনোহর দেশাইরা রাত্রে এসে চুপি চুপি দেখা করেছে মিস্টার ঘোষালের সঙ্গে। কখনও দিয়েছে ক্যাশ, কখনও কাইন্ডে। কখনও দিয়েছে টাটকা মেমসাহেব, কখনও দিয়েছে টাটকা বোতল। এমনি অবস্থায় ঘটনাচক্রে প্যালেস-কোর্টে এসে পড়েছিল সতী। তখন থেকে আর কোনও অসুবিধে হয়নি। আপিসে মার্চেন্টরা আসতো ওয়াগন চাইতে। মিস্টার ঘোষাল যখন ফ্রী-স্কুল স্ট্রীটের পাড়ায় আপিসের স্টেশন-ওয়াগন নিয়ে আর্জেন্ট-ওয়ার্কে ব্যস্ত তখন চিট্‌ নিয়ে আসতো মার্চেন্টের দল।

সতী হয়ত নিজের ফ্ল্যাটে চুল বাঁধছে, হঠাৎ পীরালি আসতো হাতে চিট্‌ নিয়ে।

সতী বলতো—কী রে পীরালি, কী?

—হুজুর, একটা আদ্‌মী এসেছে সাহেবের কাছ থেকে।

মিস্টার ঘোষালের হাতের লেখা ছোট চিঠি। চিঠিতে নানা সময়ে নানা রকম লেখা থাকতো। মিস্টার ঘোষাল লিখতো—সতী এই মার্চেন্টকে পাঠাচ্ছি, এ তিন হাজার টাকা দেবে, টাকাটা নিও। আমি ফিরে এসে তোমার কাছ থেকে নিয়ে নেব। টাকাটা গুনে নিতে ভুলো না।

কখনও ক্যাশ টাকা, কখনও রেডিও সেট, কখনও রেফ্রিজারেটার, কখনও রেডিওগ্রাম। সে-সময়ে ঘর ভর্তি হয়ে গিয়েছিল মিস্টার ঘোষালের। শুধু তাই নয়, কখনও শাড়ি, কখনও গয়না, কখনও ফার্নিচার। উপহারের শেষ ছিল না সে-ক’বছর।

প্রত্যেকবার মিস্টার ঘোষাল চিঠি দিয়ে পাঠাতো বাড়িতে, আর প্রত্যেকবার সতী নিত টাকাগুলো।

মিস্টার ঘোষাল বাড়ি এসে টাকাগুলো নিত। আর তারপর পরের দিন আপিসে গিয়ে আবার সেই বক্তৃতা দিত। বলতো-হোয়াট এ শেম্! ছি ছি আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত রিয়্যালি! আমি চাই রেলওয়ের বদনাম ঘুচিয়ে ফেলতে। এই বদনামের জন্যে আপনারা যারা ক্লার্ক তারাই দায়ী, আপনাদের জন্যেই সমস্ত বাঙালী জাত ছোট হয়ে গেছে অন্য সকলের চোখে—

কিন্তু শেষে অন্য পন্থা ধরেছিল মিস্টার ঘোষাল। যখন ঘরে ফার্নিচার ভর্তি হয়ে গেল, রেডিও, রেফ্রিজারেটার, রেডিওগ্রাম রেখে আর জায়গা নেই, তখন ধরেছিল অন্য ছল! যারাই আপিসে আসতো টাকা দিতে, তাদের হাত থেকে টাকা নিত না মিস্টার ঘোষাল। প্রত্যেককেই যেতে হতো মিস্টার ঘোষালের ফ্ল্যাটে। সেখানে ফ্ল্যাটের দরজায় ছিল লেটার বক্স। সেই লেটার বক্সে টাকা ফেলে দিয়ে আসতে হতো মিস্টার ঘোষালের ফ্ল্যাটে। পাঁচশোই হোক আর পাঁচ হাজারই হোক—সমস্ত। তার পরদিন টাকা পেয়েই ওয়াগন সাপ্লাই-ফর্মে সই করে দিতো মিস্টার ঘোষাল হাসিমুখে। আর ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হতো না কাউকে।

এমনি করেই চলছিল মিস্টার ঘোষালের জীবন। একদিকে সতী, সনাতনবাবু আর নয়নরঞ্জিনী দাসীর প্রাণান্তকর জীবন, অন্যদিকে ছিটে-ফোঁটা-প্রাণমথবাবুর উদগ্র সংগ্রাম আর একদিকে কিরণের, ক্ষীরোদার মর্মান্তিক একক যন্ত্রণা। আর কলকাতার আর এক সমাজের শীর্ষে বসে মিস্টার ঘোষালের অশোভন উৎপাত। আর সকলের শেষে দীপঙ্করের বেদনাদায়ক ভূমিকা। এই নিয়েই উনিশ শো বিয়াল্লিশ সালের এক মহা উপন্যাস লেখা হচ্ছিল। এমন সময় সব গোলমাল হয়ে গেল মিস্টার ঘোষালের গ্রেপ্তারে।

শুধু মিস্টার ঘোষালের গ্রেপ্তারই নয়। দীপঙ্কর বুঝতেই পারেনি এমন করে কেনই বা সমস্ত কিছু জটিল হয়ে গেল? সনাতনবাবুর সমস্ত ধ্যান কেন এমন করে ভাঙলো কোন এক নির্মল পালিতের হঠকারিতায়? নয়নরঞ্জিনী দাসীর সব গর্বই বা কেন এমন করে চুরমার হয়ে গেল এক নীলেমের নোটিশে! আর লক্ষ্মীদি?

লক্ষ্মীদির কথা পরে বলবো!

সকাল থেকেই মিস্টার ঘোষালের কাজের শেষ ছিল না। অনেক দিন পর রাত্রে এই প্রথম ভালো ঘুম হয়েছে। আগের রাত্রে মিস্টার গাঙ্গুলীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিন্ত হওয়া গেছে। সেসনস্ কোর্টের সব গোলমাল মিটে গেছে। বাকি আছে স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুন্যাল। সেখানেও সব নথিপত্র তৈরি। প্রথমে প্রসিকিউশন্ হিয়ারিং হয়ে গেলেই ডিফেন্স হিয়ারিং শুরু হবে। ছুটির আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। দ্বিজপদকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে পালিয়ে গেছে। আর এক উইটনেস মিসেস ঘোষ। মিসেস ঘোষের কাছ থেকে কোনও ভয় পাবার নেই। সেদিক থেকেও মিস্টার ঘোষাল নিশ্চিন্ত!

পীরালি যথারীতি কফি নিয়ে হাজির হলো সামনে।

মিস্টার ঘোষাল বললে-দ্যাখ্ পীরালি, যদি কেউ আসে আমাকে খুঁজতে, বলবি আমি নেই—

—হুজুর?

মিস্টার ঘোষাল রেগে গেল। কথার প্রতিবাদ জীবনে কখনও সহ্য করতে পারে না মিস্টার ঘোষাল। বললে—কী?

—জগন্নাথ এসেছিল, আর মল—আর যতীন—

মিস্টার ঘোষাল আগুন হয়ে উঠলো। বললে—স্কাউড্রেলদের এখানে ঢুকতে দিবি না, কাউকেই ঢুকতে দিবি না, কেউ যেন এখানে না আসে, বলবি যে-টাকা আমি দিয়েছি তার বেশি আমি দিতে পারবো না, আমার টাকা ফুরিয়ে গেছে, এর পরের মাস থেকে কেউ মাইনে পাবে না, বলে দিবি তুই—

তারপর বললে—হ্যারে, ড্রাইভার এসেছে?

সকাল হয়েছে। প্যালেস-কোর্টের ভেতরে টেনেন্টরা তখনও ঘুমোচ্ছে, কিন্তু বয়, বাবুর্চি, আয়া, খানসামাদের তখন দুপুর। তারা ভোর তিনটেয় উঠে জল গরম শুরু করে দিয়েছে, ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা আরম্ভ করে দিয়েছে। ক্লিনাররা গাড়ি সাফ্ করতে লেগে গেছে। চিনি দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে রাত থাকতেই। কিন্তু সব কাজ আস্তে করা চাই। শব্দ করতে পারবে না কেউ। নইলে সাহেবদের ঘুম ভেঙে যাবে। সাহেবরা অনেক কাজের লোক। অনেক মাথা-ঘামাবার কাজ করতে হয় তাদের। তোমরা গরীব, তোমরা সাহেবদের জন্যে খাটো, সাহেবদের জন্যে খেটে-খেটে মরো। তোমরা মরলে দেশের ক্ষতি নেই, কিন্তু সাহেবদের বিরক্ত কোর না। ওরা অনেক কাজের লোক। অনেক দামী ওদের লাইফ। ওদের আরাম করে ঘুমোতে দাও।

সামনেই খবরের কাগজটা পড়ে ছিল। সেদিকে নজর পড়তেই মিস্টার ঘোষাল সেটা তুলে নিলে। জাজমেন্টটা বেরিয়েছে। খবরের কাগজওয়ালারা খবরটা শেষ পর্যন্ত ছেপে দিলে? মিস্টার ঘোষাল আগ্রহের সঙ্গে পড়তে লাগলো—

—ড্রাইভার এসেছে হুজুর!

‘যে জঘন্য অপরাধের জন্যে আসামীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তার নিন্দে করবার মত ভাষা আমার জানা নেই। আমি শুধু আশ্চর্য হয়ে যাই এই ভেবে যে, এই সুসভ্য কলকাতা শহরে আসামীর মত এমন ব্যক্তিও সগর্বে মাথা উঁচু করে বিরাজ করছে। এই আসামী শুধু কলকাতার নয়, সমস্ত মানব সমাজের শত্রু। আজ উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আমি আসামীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলাম বটে, কিন্তু আমার ভয় হয়, এই মুক্তি হয়ত আসামীকে আরো দুঃসাহসী, আরো বেপরোয়া করে তুলবে। আর এমন দিন হয়ত আসছে বলে আশঙ্কা করি যখন এই জাতীয় আসামীর সংখ্যা কলকাতার সমাজে আরো বেড়ে যাবে। আর সব চেয়ে আশঙ্কা এইজন্যে যে আসামী নিজেকে সম্ভ্রান্ত সুসভ্য বলে পরিচয় দিয়েছে। অশিক্ষিত দরিদ্র শয়তানের চেয়ে শিক্ষিত ধনী শয়তান সমাজের পক্ষে আরো ভয়াবহ বলে আমি মনে করি……

—ড্রাইভার এসেছে হুজুর!

—চোপরাও হারামজাদ্, ভাগো হিয়াসে, গেট্ আউট্ গেট আউট—

হঠাৎ খবরের কাগজের ঝালটা সমস্ত গিয়ে পড়লো পীরালির ওপর। পীরালির এ- সব সহ্য করা অভ্যেস আছে। চুপ করে রইল সে। মিস্টার ঘোষাল জাজমেন্টটা সমস্তটা আর পড়লে না। দুই হাতে যত শক্তি ছিল, সব শক্তি দিয়ে টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললে কাগজটাকে। ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করলেই যেন খবরের কাগজের লক্ষ-লক্ষ কপি থেকে নিজের কলঙ্ক মুছে ফেলা যাবে! তারপর জামা-সুট বদলে তৈরি হয়ে বেরোল। অনেক কাজ মিস্টার ঘোষালের। সার জন্ হার্বার্টের ফ্রেন্ড, চীফ মিনিস্টার ফজলুল হকের ফ্রেন্ড আজ বিপদে পড়েছে, এতে ভয় পাবার কিছু নেই। এই যে অনারেবল মিস্টার এন আর সরকার। নলিনীরঞ্জন সরকার। দেওয়ান বাহাদুর রামস্বামী মুদালিয়ারের জায়গায় ভাইসরয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের কমার্স মেম্বার হলো আজ। একে নিয়েও তো কত মামলা, কত মকর্দমা হয়েছে কোর্টে। খবরের কাগজে দিনের পর দিন কত কেলেঙ্কারির খবর ছাপা হয়েছে। সব লোক ছি ছি করেছে। কিন্তু কে আজ তা মনে রেখেছে? টাকা দিয়ে সব কেনা যায়। টাকা দিয়ে পাপ যেমন কেনা যায়, পূণ্যও তেমনি কেনা যায়। টাকা দিয়ে রেস্পেক্ট কেনা যায়। ফেম্ কেনা যায়। মিস্টার ঘোষালও টাকা দিয়ে সব কিনে ফেলবে আবাল। যে-জজ্ জাজমেন্ট দিয়েছে, টাকা দিয়ে তাকেও একদিন কিনে ফেলবে মিস্টার ঘোষাল! আসলে money makes a man.

সাহেব বেরিয়ে যাবার পরই পীরালির বেশি কাজ। তখন গেলাস, বোতল, চুরোট, পায়জামা সমস্ত গুছিয়ে ঠিক করে রাখতে হবে। সাহেব যতক্ষণ না-আসে ততক্ষণ সাহেবের লাঞ্চ, সাহেবের কফি, সাহেবের গেলাস, বোতল, চুরোট আবার ঠিকঠাক সব রেডি করে রাখতে হবে। এইটেই নিয়ম এত কালের।

মিস্টার ঘোষাল গাড়িতে উঠেই হুকুম দিলে—গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং—

প্রথমেই মিসেস ঘোষের কাছে যাওয়া ভালো। কালকে কোর্টে মিসেস ঘোষ তার জন্যে যা করেছে, সে-জন্যে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসতে হবে। তারপর? তারপরের কথা তারপরে ভাবা যাবে। স্পেশ্যাল ট্রাইব্যুন্যালের কোর্টের কথাও ভাবতে হবে, পরামর্শ করতে হবে। মিস্টার গাঙ্গুলী অনেক ডকুমেন্ট অনেক উইটনেস-এর লিস্ট করেছে। প্রথমে প্রসিকিউশন হিয়ারিং, তারপর হবে ডিফেন্স। ডিফেন্স হিয়ারিং-এর দিনেই মিসেস ঘোষকে আবার হাজির হতে হবে কোর্টে। আবার সাী হয়ে দাঁড়াতে হবে উইটনেস্ বক্সে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *