৬৩
মানুষের জীবনে এমন দিন কখনও কখনও আসে যখন নিজেকে নিয়ে যন্ত্রণার আর অবধি থাকে না। জন্মের গোড়া থেকে যে যন্ত্রণার সূত্রপাত, তার একমাত্র অব্যাহতি তো মৃত্যুতে। কিন্তু যন্ত্রণারও তো তারতম্য আছে! ছোট যন্ত্রণা যেমন আছে, তেমনি বড় যন্ত্রণাও তো আছে। সেই বড় বড় যন্ত্রণার যেন আর উপশম নেই। দিনের মধ্যে যখন হঠাৎ এক এক সময়ে অকারণে সেই যন্ত্রণার আবেগ তীব্র থেকে তীব্রতর, তীব্রতর থেকে তীব্রতম হয়ে ওঠে, তখন সমস্ত জীবনের শিক্ষা, সমীক্ষা, জ্ঞান, তপস্যা সব কিছু যেন বন্যায় ভেসে যায়। তখন মনে হয় এর থেকে যেন আর মুক্তি নেই, এর থেকে যেন আর অব্যাহতি নেই!
ছোটবেলা থেকে ধাপে ধাপে মৃত্যু, জীবন, জন্ম, অন্যায়, অবিচার, আনন্দ, বেদনা, সব কিছু অতিক্রম করে এসে এসে দীপঙ্করে ধারণা হয়েছিল আঘাত সে এখন সহ্য করতে পারবে হাসিমুখে, অন্যায় সে এখন অতিক্রম করতে পারবে ক্ষমা দিয়ে। কিন্তু নিজেকে যে এমন করে সে জড়িয়ে ফেলবে সেই জালে তা সে বুঝতে পারেনি। জালই তো! যন্ত্রণার জাল! জীবনের সব কুটিল প্রশ্নের সমাধান করতে গিয়ে একদিন সে নিজেই যে যন্ত্রণার জালে আটকে পড়বে তা সে ভাবতেও পারেনি! দীপঙ্কর চেয়েছিল নিজের আত্মা দিয়ে একদিন বিশ্বের আত্মার মধ্যে সে প্রবেশ করবে। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের ছোট ছেলেটি প্রতিদিনের চেষ্টায় অঘোরদাদু থেকে শুরু করে তার মা, কিরণ, সতী, লক্ষ্মীদি, মিস্ মাইকেল, প্রাণমথবাবু, সকলের মধ্যে এককার হতে চেয়েছিল। শুধু তারাই নয়। এ-সংসারের ভালো-মন্দ সকলের যোগে সে এক অমৃতযোগে প্রতিষ্ঠা পেতে চেয়েছিল। প্রতিদিনই সে নিজের চেতনার অধিকার পরিব্যাপ্ত করতে চেয়েছিল সকলের মধ্যে। তার আমিত্ব বলে যে দুর্ভেদ্য আবরণ তাকে ছোটবেলায় সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছির, সে আবরণ যেন দিনের পর দিন তখন সরে যাচ্ছিল। সহজ হতে চেয়েছিল সে ছোটবেলা থেকে। এতদিনের চেষ্টায় তাই সহজও হতে পেরেছিল সে। ভেবেছিল তার সহজ হওয়ার শিক্ষা যেন শেষ হয়ে গিয়েছে। অন্যের মধ্যে সে এবং তার মধ্যে অন্যের বাধা যেন চিরদিনের মত দূর হয়ে গেছে। তাই সে আপিসে যেত, বাড়িতে আসতো, সংসারের কাজ করতো, দৈনন্দিন পৃথিবীর খবর রাখতো, কিরণের জন্যে দুশ্চিন্তা করতো, সতীর কাছে এসে বসতো—সবই যেন তার সহজ হবার সাধনা। ভেবেছিল-সেই সহজিয়া সাধনার মধ্যে দিয়েই একদিন তার সব প্রশ্নের সমাধান সে পেয়ে যাবে। তার মত সমস্ত পৃথিবীর মানুষই একদিন সহজ হয়ে আসবে। সবাই সবাইকে ভালবাসবে, সবাই সকলের সহযোগিতা করবে, সবাই মিলে সকলের সব বিরোধের একদিন অবসান করে দেবে।
কিন্তু আবার একদিন দুর্ঘটনা ঘটলো অপ্রত্যাশিতভাবে!
হয়ত মিস্টার ঘোষালই এর মূলে।
আশ্চর্য! মিস্টার ঘোষাল কি এই বিংশ শতাব্দীর একমাত্র সৃষ্টি! তা তো নয়। যুগ যুগ ধরে এরাই কখনও চেঙ্গিস খাঁ হয়, কখনও কালাপাহাড় হয়, কখনও তৈমুর লং হয়ে উদয় হয়। কিন্তু কেন হয়? কেন এদের সৃষ্টি? পৃথিবী যদি সার্থকতার দিকেই এগিয়ে চলেছে, তবে কেন এরা মাঝে মাঝে উদয় হয়ে মহাপুরুষদের সব সাধনা সব তিতিক্ষা এমনি করে বানচাল করে দেয়? রামায়ণের যুগেও একজন রাবণের উদয় হয়েছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি রাবণের কেন উদয় হলো? দীপঙ্করদের সহজ হবার সব প্রচেষ্টাকে কেন এরা এমন করে বিপর্যস্ত করে দিলে?
সেসনস্ কোর্টের জাজমেন্টে সেই কথাটাই প্রকারান্তরে বলেছিলেন সেদিনকার জজসাহেব!
যেদিন মিস্টার ঘোষালের কেস-এর জাজমেন্ট বেরিয়েছিল, দীপঙ্কর মন দিয়ে পড়েছিল সবটা। সতীকেও পড়িয়েছিল। তাতে শেষকালে মন্তব্য লেখা ছিল— “মিস্টার ঘোষাল নামে যে-আসামীর বিচারের ভার এই কোর্টের ওপর পড়েছিল, তাঁর সম্বন্ধে আমি সুবিচার করতে পারলাম না বলে আমি দুঃখিত। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই আজ আসামীকে মুক্তি দিচ্ছি—কারণ আমার সামনে বিবাদীপক্ষ যে এভিডেন্স হাজির করেছেন, তা অকাট্য! মিস্ মাইকেল নামে যে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নারী অত্যন্ত মর্মান্তিক ভাবে জীবন ত্যাগ করেছে, সেই নারীর হত্যার জন্যে মিস্টার ঘোষালেরই মত কোনও ভদ্রবেশী তথাকথিত শিক্ষিত অর্থশালী ব্যক্তি দায়ী, এ-কথা আমি বিশ্বাস করি। আমার পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে স্বর্গতঃ নারীর মৃত্যুতে—কিন্তু আমি নিরুপায়। মিস্টার ঘোষালরা এমনই চতুর, এমনই কুটিল ব্যক্তি যে এঁদের অভিযুক্ত করার মত সুচতুর পুলিসবিভাগ আজো দেশে সৃষ্টি হয়নি। মিস্টার ঘোষাল মুক্তি পাবার পর হয়ত আবার তাঁর পূর্ব- কার্যকলাপ অব্যাহত রাখবেন, আবার দ্বিগুণ চাতুর্য আর দ্বিগুণ কৌশলের সঙ্গে তাঁর নৃশংস অভ্যাস চালিয়ে যাবেন। দেশের এই দুর্দিনে যখন প্রত্যেক মানুষ কায়ক্লেশে জীবনধারণ আর জীবিকা-অর্জনের চেষ্টায় বিব্রত, তখন কল্পনা করতেও ভয় হয় যে এই কলকাতা শহরেই এমন মানুষ তার বিপুল অর্থ এবং প্রতিষ্ঠা-প্রতিপত্তির সাহায্যে সশরীরে বিভীষিকারূপে বিরাজ করবে। আর শুধু মিস্ মাইকেলই নয়, এমন একদিন আসাও বিচিত্র নয়, যেদিন আরো অনেক নিরপরাধ নারীই এই মিস্ মাইকেলের মত মর্মান্তিকভাবে প্রাণ বিসর্জন দিতে বাধ্য হবে। মিস্টার ঘোষাক্ষকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত এবং চরম দন্ড দিতে পারলে আমিই সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হাতে পারতাম। কিন্তু আমি যে-আসনে বসে আছি, সে আসন আইনের কূট-ধারার দ্বারা শৃঙ্খলিত। আমি সেই আইনের দ্বারা বিড়ম্বিত বলেই আজ মিস্টার ঘোষালকে নারী-হত্যার অপরাধ থেকে বাধ্য হয়ে মুক্তি দিচ্ছি।
যে আইন মিস্টার ঘোষালকে মুক্তি দিতে সাহায্য করেছিল, সেই আইনই যে আবার একদিন মিস্টার ঘোষালকে শৃঙ্খলিত করবে, তা হয়ত সেদিনকার সেসন জজ্ বুঝতে পারেন নি। তাই বার-বার আইনের দোহাই দিয়ে নিজের বিবেকের দংশনকে সংযত করেছিলেন তিনি।
কিন্তু সে-কথা এখন থাক্। সে-কাহিনী যথাস্থানে বলবো।
সেদিন সতী জানতো না, দীপঙ্করও জানতো না কী বিপর্যয় তাদের জন্যে আত্মগোপন করে আছে ভবিষ্যতের গর্ভে। দীপঙ্কর চুপ করে বসেছিল তখনও। তখনও সতী আসছে না। প্রতিদিন এমনি করেই এখানে আসে, প্রতিদিনই এমনি পাশের চেয়ারে বসে থাকে সতী! কিন্তু সেদিনই প্রথম ব্যতিক্রম।
রঘু আবার ফিরে এল। জানালা দিয়ে একবার বাইরের দিকে চেয়ে দেখলে। বললে—দিদিমণি তো এখনও আসছে না দাদাবাবু—
দীপঙ্কর কোনও উত্তর দিলে না। ঘরের আলোয় ঠুলি পরানো। জানালার বাইরে আলো পড়ে না। কিন্তু বাইরের আকাশের তখন আলোয় আলো। পূর্ণিমার চাঁদ যেন আরো বড় হয়েছে। যত রাত বাড়ছে, চাঁদ যেন আরো বেড়ে উঠেছে। বড় স্থির বড় শান্ত রাত। ভেতরের সব অশান্তি যেন শান্তির ছদ্মবেশ ধরে বাইরের প্রকৃতিতে বিরাজ করছে। অথচ কোথায় শান্তি? সেই বিসমার্ক যেন আবার জার্মান অস্পায়ার তৈরি করতে নতুন নামে এসে পৃথিবীতে জন্মেছে। এদিকে নর্থ আফ্রিকা আর ওদিকে অ্যালান্টিক কোস্ট থেকে ইজিসিয়ান বর্ডার পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চলে টিউটন জাতের আধিপত্য ছড়িয়ে পড়েছে। ব্ল্যাক্ সী ঘিরে ফেলেছে জার্মান আর্মি। মেডিটারেনিয়ান এরিয়াও গ্রাস করে ফেলতে চলেছে। ককেশাস আর সুয়েজ ক্যানালে পৌঁছুতে আর বেশি দেরি নেই। এমন সময়…..
—ওই দিদিমণি এসে গেছে!
কথাটা যেন স্বপ্নের মত কানে এসে লাগলো। বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামার শব্দ হলো। তারপর রঘু এসে দরজা খুলে দিয়েছে! সতী এসে ঘরে ঢুকলো। দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে। যেন অনেক ঝড় অনেক তুফান পেরিয়ে জেটিতে এসে পৌঁছুলো একটা পাল-তোলা নৌকো।
—কখন এলে তুমি?
এ-সব প্রশ্নের উত্তর সাধারণতঃ দিতে হয় না। যে প্রশ্ন করে সেও এর উত্তর চায় না।
—আমি আসছি, একটু বোস!
তারপর তাড়াতাড়ি শাড়িটা বদলে মুখে-হাতে জল দিয়ে এসে যথারীতি পাশের চেয়ারটায় বসলো সতী; বললে—আমি রঘুকে রেখে গিয়েছিলাম তোমার জন্যে। তুমি বুঝি অনেকক্ষণ বসে আছো?
দীপঙ্কর তবু কিছু কথা বললে না।
—রাগ করলে নাকি? কথা বলছো না যে? হঠাৎ মিস্টার ঘোষালের কেসের জন্যে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল ওদের এটর্নী। তারপর—
দীপঙ্কর বললে—আমি জানি সব!
—তুমি জানো! কী করে জানলে! তোমাকে তো আমি বলিনি! আমার মনে ছিল না, আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম! তুমি কী করে জানতে পারলে?
দীপঙ্কর বললে—অভয়ঙ্কর আমাকে সব বলেছে। তার কাছে সব শুনে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, তাই সকাল-সকাল চলে এসেছিলাম আপিস থেকে! কিন্তু অনেক রাত হলো…..
বলে দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠলো। তারপর যথারীতি প্রত্যেক দিনের মত দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
সতী বললে—এ কি, তুমি চলে যাচ্ছো নাকি?
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ—
সতী বললে—আশ্চর্য, তুমি তো আমাকে বকলে না, কিংবা কোনও উপদেশও দিলে না—
তারপর সতী গিয়ে দীপঙ্করের হাতটা ধরলে। বললে—এসো, আর একটু বোস, রাগ করো না আমার ওপর, না-গিয়ে উপায় ছিল না বলেই গিয়েছি। কিন্তু এখন ভাবছি না-গেলেই হয়ত ভালো হতো।
—কেন?
সতী বললে—শুনলাম, যার জন্যে আমি এত করলুম সে নাকি প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে গিয়ে আমার শাশুড়ীর কাছে তোমার-আমার নামে প্রচুর নিন্দে করে এসেছে, শুনে ভাবলাম কার জন্যে আমি এত কষ্ট করলুম! জানো, কোর্টে জেরার উত্তর দিতে দিতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলুম—
দীপঙ্কর বললে—আমি সবই জানতাম, তুমি জানতে না এইটেই আশ্চর্য—
—কিন্তু একটা মানুষের প্রাণের চেয়ে কি আমার বদনামটাই বড়? তুমিই বলো?
দীপঙ্কর বললে—তাহলে তাকে বাঁচিয়ে ভাল করেছ বলো? তাহলে আর অনুতাপ করছো কেন?
সতী হাত ধরে টানলে। বললে—তুমি রাগ কোর না দীপু। আর একটু বোস— আরো অনেক খবর আছে—
দীপঙ্কর বসলো। সতী বললে–আসবার সময় একটু নেমেছিলাম হাজরা রোডে—
—কেন?
সতী চেয়ে দেখলে দীপঙ্করে মুখের দিকে। বললে—তুমি আবার জিজ্ঞেস করছো, কেন?
দীপঙ্কর বললে—তারা আবার তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে তো?
—না, কিন্তু অন্য একটা সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে সেখানে। কৈলাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে বললে আমার শাশুড়ীর নামে নাকি কোর্ট থেকে নীলেমের নোটিশ এসেছে, ও-বাড়ি নীলেম হয়ে যাবে। আমি দেখলুম, আমার শাশুড়ী উকীলের বাড়ি থেকে এলেন ট্যাক্সি করে—
—তারপর?
সতী বললে—আচ্ছা, যদি সত্যিই ও-বাড়ি চলে যায় ওদের তো ওরা যাবে কোথায়? ওদের তো আর কোনও যাবার জায়গাও নেই, আর কোনও শেল্টারও নেই ওদের, কী হবে? শেষকালে কি ও-বাড়ি ছাড়তে হবে ওদের? বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হবে? সারা রাস্তা কেবল এই কথা ভাবতে ভাবতেই এসেছি আমি—
দীপঙ্কর বললে—আমি এর কী জবাব দেব—এ-সব কথার উত্তর উকীলই একমাত্ৰ দিতে পারে—
সতী বললে—না, আমি মনে মনে তাই ভাবছিলুম, কোথা থেকে কী হলো সব? জন্ম থেকে এতদিন ধরে যা কিছু দেখছি, যা কিছু শুনছি সব যেন কেমন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে, মানুষ তবু কেন এত অহঙ্কার করে, তবু কেন মানুষ এত বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে ঝগড়া- বিবাদ করে। কার জন্যে করে, কীসের জন্যে করে?
কথাগুলো বলতে বলতে সতী যেন কেমন উদাস হয়ে উঠেছিল। আজকে সতীর আশ্রয় জুটেছে, অর্থ জুটেছে, নিজের ওপর নির্ভর করবার সামর্থ্যও জুটেছে। এমনি এই মুহূর্তে পৃথিবীর কত দিকে কত লোক তার শাশুড়ীর মত তার স্বামীর মতই নিরাশ্রয় হয়ে যাচ্ছে, কেউ তার হিসেব রাখছে না। এই কলকাতা শহর খুঁজলেও এমন কত উদাহরণ পাওয়া যাবে। প্রতিদিন কোর্টে গেলে হাসপাতালে গেলে কেবল নতুন করে মানুষের দৃষ্টি খুলে যায়। কিন্তু পৃথিবীর তো সময় নেই। পৃথিবী নিজের আবেগে ঘুরেই চলে দিনরাত, কে মরলো কে বাঁচলো তা দেখবার প্রয়োজন তার নেই।
হঠাৎ সতী বললে—কই, কথা বলছো না যে?
দীপঙ্কর বললে—কী কথা বলবো বলো?
সতী বললে—কিন্তু একলাই কি আমি কেবল কথা বলে যাবো? তুমি কিছু বলবে না? ওদের এত বড় সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে আর তুমি শুধু চুপ করে থাকবে? তোমার কিছু বলবার নেই?
দীপঙ্কর বললে—কিন্তু আমি কী কথা বলবো? কে আমার কথা শুনবে?
সতী বললে—কেন, আমি তোমার কথা শুনি না? আমি তোমার কথা কখনও শুনিনি?
দীপঙ্কর বললে—আমার কথা শুনলে আজকে সমস্তই অন্যরকম হতো সতী, আমার কথা শুনলে পৃথিবীও অন্যরকম হয়ে যেত আজ!
—তাহলে কেন তুমি আসো এখানে? না এলেই পারো! আমি তো মাথার দিব্যি দিয়ে তোমাকে আসতে বলিনি—
দীপঙ্কর বললে—না এসে পারি না যে!
—কিন্তু আমার এখানে তোমার কীসের এত আকর্ষণ শুনি? আমার কাছ থেকে তুমি কী চাও সত্যি করে বলো তো?
দীপঙ্কর চমকে উঠলো। চমকে উঠেই সতীর দিকে মুখ ফেরাল একবার। দীপঙ্করের মনে হলো—তার পিঠে যেন চাবুক মারলে সতী! মুখ দিয়ে শুধু বললে— ছিঃ—
বলেই দীপঙ্কর দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
সতী উঠে দাঁড়াল। বললে—যেও না, দীপু শোন, শুনে যাও—
দীপঙ্কর পেছনে ফিরলো না। যেমন যাচ্ছিল তেমনিই চলতে লাগলো।
সতী তবু থামলো না। বললে—নিজের দুর্বলতা ধরা পড়ে গেছে বলে বুঝি পালিয়ে গিয়ে মুখ রক্ষা করছো? কিন্তু আমার চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারো নি দীপু, তোমার সমস্ত ভন্ডামি আমি ধরে ফেলেছি, পালিয়ে গিয়েও তুমি পার পাবে না, ঘুরে ফিরে তোমাকে আবার আমার কাছে আসতেই হবে—
দীপঙ্কর দরজাটা খুলে সোজা বাইরে রাস্তায় গিয়ে পড়লো।
সতী তখন যেন নির্দয় নির্মম হয়ে উঠেছে একেবারে। বললে—জানি খুব বাহাদুরি দেখানো হলো আমার কাছে, খুব ভালো ছেলে সেজে রইলে, কিন্তু এও বলে দিচ্ছি আর কখনও যেন এ-বাড়িতে এসো না, আর কখনও ঢুকতেও পাবে না এখানে—
বলে দড়াম করে সশব্দে সদর দরজাটা বন্ধ করে দিলে সতী! তখনও সতীর বুকটা ঢিপ্ ঢিপ্ করছে উত্তেজনায়!
.
সতীর কথাগুলো তখনও তীরের মত ঝাঁকে ঝাঁকে এসে বিঁধছিল দীপঙ্করের কানে। দীপঙ্কর দুই হাতে নিজের দু’টো কান বন্ধ করে দিলে। তারপর জোরে জোরে পা চালিয়ে চলতে লাগলো অন্ধকার মাড়িয়ে মাড়িয়ে। সমস্ত রাস্তাটা জনহীন! দীপঙ্করের মনে হলো সেই পূর্ণিমার রাত্রেও যেন তার জীবনের আকাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এল। সামনের অনন্ত পথ যেন তার দিকে চেয়ে নিঃশব্দে অট্টহাসি হেসে উঠলো একবার! দীপঙ্কর আর সহ্য করতে পারলে না। সারা জীবন নিজে যে যন্ত্রণার জাল সৃষ্টি করেছে, তারই অক্টোপাশে যেন সে আটকে গিয়েছিল। এর থেকে মুক্তি পাবার জন্যেই যেন ছিটকে বেরিয়ে পড়বার আপ্রাণ চেষ্টা করছে হাত-পা ছুঁড়ে। সঙ্গে সঙ্গে দীপঙ্কর সেই রাত দশটার সমুদ্রে আকন্ঠ ঝাঁপ দিয়ে যেন পরিত্রাণ পেল!
কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে বিকট শব্দ করে আকাশ-বাতাস অন্তরীক্ষ কাঁপিয়ে সাইরেন বেজে উঠলো! আশে-পাশে কোথাও কোনও আশ্রয় নেই। দীপঙ্কর ডাইনে-বাঁয়ে উত্তরে দক্ষিণে চারদিকে চেয়ে দেখলে। সামনেই গড়িয়াহাট লেভেলক্রসিং-এর গেটটা। গেটটা খোলা। কোনও ট্রেন আসবার কথা নেই এখন। ওখানেই ভূষণ মালী গুটি ঘরের মধ্যে ডিউটি দিচ্ছে। ওখানেই গিয়ে দাঁড়াবে নাকি সে? ওখানেই আশ্রয় নেবে নাকি সেন- সাহেব! সাইরেনের শব্দটা ঢেউ-এর মতন কেঁপে কেঁপে উঠছে নামছে—আর বাতাসকে কেটে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। সমস্ত আবহাওয়াটা যেন হঠাৎ এক মুহূর্তে বিষাক্ত হয়ে উঠলো!
—দীপু-উ-উ-উ—
দীপঙ্কর থমকে দাঁড়াল। একবার। কী যেন সন্দেহ হলো। পূর্ণিমার চাঁদের আলোর নিচে সতীর রুদ্ধশ্বাস অস্পষ্ট চেহারাটা নজরে পড়লো। যেন তার দিকেই আসছে সতী। দীপঙ্কর কী করবে বুঝতে পারলে না।
—দীপু—
সামনে এসে সতী দীপঙ্করের হাত দু’টো চেপে ধরলে। তখনও হাঁফাচ্ছে সতী। বললে-চলো দীপু, ফিরে চলো—
দীপঙ্কর একবার ক্ষীণ চেষ্টা করলে। যেন প্রতিবাদ করতে চাইলে। যেন সতীর হাত দু’টো ছাড়িয়ে দিতে চাইলে। কিন্তু সতী তখন জোরে আঁকড়ে ধরেছে। একেবারে আষ্টে- পৃষ্টে আকর্ষণ করে রেখেছে তাকে। বললে—ফিরে চলো দীপু, এয়ার-রেড় হবে, শিগির চলো—
—কিন্তু তুমি কেন বেরোলে এখন? এই সময়ে?
সতী বললে-আমি যা কিছু বলেছি সব মিথ্যে দীপু, তুমি ফিরে চলো—লক্ষ্মীটি—
—কিন্তু তুমি তো অন্যায় কিছু বলো নি!
—ন্যায়-অন্যায় আমি জানি না, তোমার পায়ে পড়ি দীপু, তুমি আর কথা বাড়িও না, এয়ার-রেডের পরে তোমায় ছেড়ে দেব আমি, এখন চলো তুমি, চলো—
সেই ঝাপসা আলো আর অবধারিত মৃত্যুর নিচে দাঁড়িয়ে দুজনে যেন দুজনকে নতুন করে চিনতে পারলে। সতী তাকে দুই হাতে আকর্ষণ করছে তখনও। মৃত্যু থেকে সে নিজে বাঁচবে। শুধু নিজে তাই নয়, দীপঙ্করকেও সে বাঁচাবে। দরকার হলে নিজের মৃত্যু দিয়েও সে দীপঙ্করকে বাঁচাবে! মৃত্যুর চোরাবালি থেকে তুলে জীবনের তীর্থে প্রতিষ্ঠা করে তার দীপঙ্করকে সে পরিত্রাণ দেবে।