2 of 3

কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৭

৫৭

শীতকালের দুপুরবেলাও রোদ ঝাঁ-ঝাঁ করতো। সেই সময়টাতেই সতী নিজের ঘরটার মধ্যে নিজেকে বন্ধ করে রাখতো। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই দীপঙ্কর আসতো একবার। আপিসে যাবার আগে এসে রোজ দেখা করতো তখনোও সতী ঘুম থেকে ওঠেনি। দীপঙ্কর চুপ করে বসে থাকতো বাইরের ঘরের চেয়ারটার ওপর। প্রথমে ছ’টা বাজতো, তারপর সাড়ে ছ’টা, তারপর সাতটা। তখন হঠাৎ সতী এসে দাঁড়াতো। পাশের চেয়ারটাতেই এসে নিঃশব্দে বসে পড়তো। শুধু বলতো–তুমি এসেছো?

দীপঙ্কর বলতো—রোজই তো আসি—

সতী বলতো—কেন আসো তুমি?

দীপঙ্কর বলতো—না এসে যে পারি না—

তারপর খানিকক্ষণ আর কোনও কথা হতো না দু’জনের মধ্যে। মুহূর্তের চাকাগুলো নিঃশব্দে গড়িয়ে যেত মহাকালের সীমানায়। যেন দীপঙ্করও অনন্তকাল বসে থাকতে পারতো। তার ক্লান্তি নেই, তার শ্রান্তি নেই। এমনি করে সমস্তটা জীবন ভরে মুহূর্তের পদধ্বনি শুনতে পারতো সতীর পাশে বসে। সতী চা খেত, আর দীপঙ্কর চুপ করে বসে থাকতো। রাস্তার ওপর দিয়ে মিলিটারি লরীগুলো সার বেঁধে ধুলো উড়িয়ে চলে যেত একে একে। দুজনে তাই দেখতো বসে বসে। একটা চিল আকাশে অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে উড়তো। কাদের বাড়ির কোন্ ছেলে ঘুড়ি ওড়াতো আনাড়ীর মত। ঘুড়িটা বারে বারে আটকে যেত রেল-লাইনের টেলিগ্রাফের তারে। তারপর একসময় টানাটানিতে সুতোটা ছিঁড়ে যেত। তখন ঘুড়িটা ঝুলতো তারের মাথায়। বাতাসে দুলতো আর তারপর একদিন ছিঁড়ে যেত ঘুড়িটা। কয়েকটা কাঠি শুধু কঙ্কালের মত আটকে থাকতো সেখানে। পৃথিবীতে কি দেখবার জিনিসের অভাব আছে? কত বৈচিত্র্য, কত রোমাঞ্চ, কত আনন্দ, চোখ খুলে দেখলে বুঝি তার অভাব হয় না। তারপর হঠাৎ দীপঙ্কর বলতো—আমি আসি—

বলে উঠে দাঁড়াত। আর তারপর সোজা সদর দরজাটা খুলে বেরিয়ে যেত। এ- বাড়িতে তাকে আসতেও কেউ বলতো না, এ-বাড়ি থেকে তাকে যেতেও কেউ বলতো না। এ-বাড়ির দরজা দীপঙ্করের আসা-যাওয়ার জন্যে খোলা থাকতো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। তারপর আবার যখন সন্ধ্যে হতো, আবার আসতো দীপঙ্কর। সতী তখন একলা এসে বসেছে চেয়ারটায়। দীপঙ্করও সারাদিনের আপিসের ক্লান্তির পর পাশের চেয়ারটায় এসে বসে পড়তো।

সতী বলতো—তুমি এলে?

দীপঙ্কর বলতো—হ্যাঁ, —

সতী বলতো—আর কেন আসো তুমি?

দীপঙ্কর সেই একই জবাব দিত। বলতো—না এসে যে পারি না—

এইটুকুতেই কথা শেষ হয়ে যেত দু’জনের। আর যেন কথা বলবার কিছু ছিলও না। কিংবা হয়ত কথার শেষও ছিল না কারো। যেন দু’জনের মনে অনেক কথা জমে-জমে পাথর হয়ে উঠেছিল। কবে একদিন ভূগোলের দুটি প্রান্ত থেকে দুটি মানুষ কোন্ গ্রহ চক্রের ষড়যন্ত্রে একজায়গায় এসে জুটেছিল। তারপর কত বিপর্যয়, কত দুর্বিপাক গেল, তবু তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারলো না। সন্ধ্যেবেলা এ-দিকটা নির্জন হয়ে আসে তাড়াতাড়ি। রঘু রান্না শেষ করে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে কখন অজ্ঞাতে ঘুমিয়ে পড়ে অঘোরে। কখন সাতটা বাজে, আটটা বাজে, সাড়ে আটটা বাজে, ন’টা বাজে, সাড়ে ন’টা বাজে—

তখন হঠাৎ দীপঙ্কর উঠে দাঁড়িয়ে বলে—আমি আসি—

বলে সোজা সদর দরজাটা খুলে নিঃশব্দে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। এমনি করেই দিন চলতো। এমনি করেই দীপঙ্কর জীবনের প্রত্যেকটি দিনের পরিক্রমা করতো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দীপঙ্করের অন্তরাত্মা যেন এখানেই পড়ে থাকে। বাইরের আবর্জনাটা নিয়ে কখনও সে আপিসের কামরায় ডি-টি-এস, কখনও সে মাসীমার কাছে একেবারে শিশু। আবার কখনও সে যেন সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের অনাথ ছেলেটা! তখন আবার তার মনে পড়ে যেত কিরণের কথা! এ-যুদ্ধের ব্যাপারে কত লোকের কত সর্বনাশ হচ্ছে, কত লোক হাসপাতালে পঙ্গু হয়ে আর্তনাদ করছে, খবরের কাগজে তার কোনও হিসেব থাকতো না। হয়ত হিসেব থাকবেও না। এখান থেকে ব্ল্যাক-আউটের অন্ধকারে সোজা বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন নিজের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছত দীপঙ্কর তখন সকলের শুয়ে পড়ার কথা! কিন্তু একমাত্র কাশী ছাড়া আর কেউ শুয়ে পড়ে না। ঠিক মা’র মত মাসীমাও জেগে থাকে। দীপঙ্করকে দেখে বলে—কী বাবা, আপিসে তোমার এত কী কাজ?

দীপঙ্কর বলে—আপিসে নয় মাসীমা, অন্য জায়গায়—

—কিন্তু এই ডামোডোলের সময়ে এত রাত পর্যন্ত কি বাইরে থাকা ভাল বাবা? শুনছি নাকি জাপানীরা বোমা ফেলবে কলকাতায়?

তারপর খেতে বসে দীপঙ্কর। খেতে খেতে বলে—আপনি কেন জেগে বসে থাকেন মাসীমা, আপনি খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়লেই পারেন?

মাসীমা বলে—আমাকে খাবার কথা বোল না বাবা, আমার উপোস করার অভ্যেস আছে, এই মেয়েকে একটু বুঝিয়ে বলো তো তুমি, ওই মেয়ে যে তুমি না-খেলে মুখে কুটোটি দেবে না, ওকে একটু বুঝিয়ে বলে দাও না—

দীপঙ্কর বলে—আপনি একটু বুঝিয়ে বলতে পারেন না ওকে, আপনাদের না-খেয়ে থাকতে দেখলে আমার যে বড় কষ্ট হয়—

—তা সেই কথাটা তুমি ওই মেয়েকে একবার বোঝাও না। আমি ডেকে আনছি— বলে মাসীমা জোর করে টানতে টানতে একেবারে দীপঙ্করের সামনে এনে হাজির করে। বলে—মুখপুড়ীকে আমি পই পই করে বলি যে তুই খেয়ে নে, তুই খেয়ে নে, কিন্তু তুমি না-খেলে ও কিছুতেই খাবে না, কিছুতেই খাওয়াতে পারি নে ওকে—কী যে মেয়ের গোঁ—

ক্ষীরোদার তখন ভয়ঙ্কর অবস্থা! লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে মাসীমার বুকের মধ্যে কুঁকড়ে রয়েছে। আঁচলে মুখ ঢেকে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের লজ্জা ঢাকছে।

—এখন বলো একে, বলো!

দীপঙ্কর মুখ তুলে চাইল। কেমন যেন দয়া হলো ক্ষীরোদার ওপর। বললে— আপনি বললেই যথেষ্ট, আপনি বললেই শুনবে—

ক্ষীরোদা যেন আর থাকতে পারলো না। মাসীমা হঠাৎ জোর করে চিবুকটা ধরে তুলতেই অবাক হয়ে গেল। বললে-ওমা, এ মেয়ে যে কেঁদে ভাসাচ্ছে রে—কী রে, কী হলো তোর? কাঁদছিস কেন? এই দেখ, এতে কান্নার কী হলো?

বলে হাতটা একটু শিথিল করতেই ক্ষীরোদা দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *