2 of 3

কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.৫৬

৫৬

সাকসেশন সার্টিফিকেট্। কাজটা যত সোজা ভেবেছির দীপঙ্কর তত সোজা নয়। লক্ষ্মীদির সই এল দিল্লি থেকে, সতীও সই দিলে। কলকাতার ব্যাঙ্কে প্রায় তিন লক্ষ টাকা ছিল ভুবনেশ্বর মিত্রের। সারা জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রমের টাকা। পৃথিবীর সমস্ত ব্যাঙ্কেই ছিল হয়ত। বাইরের ব্যাঙ্কের টাকা পাওয়া অত সোজা নয়। বর্মার ব্যাঙ্কে কত টাকা ছিল কে জানে! কলকাতার একটা ব্যাঙ্কের হিসেব পাওয়া গেল অনেক কষ্টে।

যে ভদ্রলোক আপিসের বড়বাবু, তিনি শেষকালে বলেছিলেন—আমরাও কিছু পেয়ে থাকি স্যার—

—কী পেয়ে থাকেন?

দীপঙ্কর একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল কথাটা শুনে। ভদ্রলোক আজ কুড়ি বছর এই কোর্টে চাকরি করছেন। দীপঙ্কর কতদিন এসেছে। কতদিন টেলিফোন করেছে। কতদিন নিজে আপিস থেকে এখানে এসে ধর্না দিয়েছে।

—কী মশাই, হলো আমার কেস্‌টা?

প্রথম-প্রথম গা-ই করতেন না। আরাম করে পান খেতেন। সিগারেট খেতেন। বলতেন—অত শিগির কি হয় মশাই? সরকারী টাকা অত শিগগির যদি পাওয়াই যাবে তো এতগুলো লোক এখানে কি ঘাস কাটাতে এসেছে?

—কিন্তু টাকা তো গভর্নমেন্টে পকেট থেকে দিচ্ছে না।

ভদ্রলোক বলতো—দেখুন, এ মুদিখানা নয় যে এক-পয়সার বেনে-মলা চাইলেন, আর ঠোঙায় পুরে বাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। এর নাম কোর্ট! এখানে চাপরাসী থেকে শুরু করে মুহুরি মোক্তার উকিল জজ ম্যাজিস্ট্রেট পার হয়ে তবে মোক্ষলাভ হয়—এখানে দপ্তরে যে-সব লোক কাজ করছে দেখছেন, এরা লোক নয়, সাক্ষী-গোপাল! এই এতগুলো সাক্ষী-গোপালকে তুষ্ট করতে পারলে তবে এখানে কার্যসিদ্ধি হয়—

শেষকালে একদিন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেছিলেন—তা ভদ্রলোকের মাত্র দুই মেয়ে? আর কেউ নেই!

দীপঙ্কর বলেছিল-না—

—তা জামাই না এসে আপনি যে আসেন তাগাদা করতে? আপনি কে?

—আমি কেউ না!

ভদ্রলোক বলেছিলেন—কত লোকের কত সম্পত্তি আর কত টাকা যে এখানে এমনি পড়ে আছে, তার কোনও হিসেব নেই মশাই—

দীপঙ্কর বলেছিল—আপনারা যদি একটু সাহায্য করেন তা হলেই সকলের উপকার হয়—

ভদ্রলোক বলেছিলেন-আমরা কেন উপকার করতে যাবো মশাই! আমরা কত মাইনে পাই তা জানেন? যদি উরির টাকা না থাকতো, তো কোর্টে কোনও শালা চাকরি করতে আসতো? মইনেতে আমাদের কী হয় মশাই? মাইনেতে আমাদের পান- সিগারেটের খরচও ওঠে না—

দীপঙ্কর শেষ দিনে কিছু দিয়েছিল ভদ্রলোককে। ঘুষ নয় ঠিক। ভদ্রলোক শেষকালে ভিক্ষে চেয়েই নিয়েছিল বলতে গেলে। বলেছিল—এ আমরা ভিক্ষে বলেই নিচ্ছি স্যার, মনে করুন দান-খয়রাতই করলেন না-হয়। আপনারা বড়-বড় লোক, কতদিকে কত টাকা খরচ করেন, কিন্তু আমাদের অবস্থার কথাটা একবার বিবেচনা করবেন। এই টাকার ওপর নির্ভর করেই আমাদের ফরসা জামা-কাপড় পরতে হয়, মেয়ের বিয়ের তত্ত্ব করতে হয়, আবার লোক-লৌকিকতাও করতে হয়। ছোটলোক মুচি-মেথর হলে যে বেঁচে যেতুম মশাই, আমরা যে ভদ্দরলোক, ভদ্দরলোকের যে অনেক জ্বালা—

যাক্, শেষ পর্যন্ত সব ঝঞ্ঝাট চুকলো। লক্ষ্মীদি ক’দিন থেকে কেবল চিঠি লিখছিল। টাকার জন্যে সেখান থেকে তাগাদা দিচ্ছিল কেবল। কোর্ট থেকে আপিসে ফিরে দু’ একটা কাজ সেরেই আবার বেরিয়ে পড়লো। এমন সকাল-সকাল আপিস থেকে বেরোন হয় না কখনও।

লালবাজার থানার কাছে আসতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো। পুলিস দু’ হাত বাড়িয়ে রাস্তা আটকিয়েছে। একটা ট্যাক্সি থানার মধ্যেই ঢুকবে। গাড়িতে পুলিস ইন্সপেক্টর বসে ছিল, কনেস্টবল্ বসে ছিল। আর পেছনে…..

দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল সতীর শাশুড়ীকে দেখে। পেছনের সীটে সতীর শাশুড়ী বসে আছেন।

ট্যাক্সিটা গিয়ে থানার উঠোনের মধ্যে দাঁড়াল। ইন্সপেক্টর নামলো, কনস্টেবলরাও নামলো। আর সকলের শেষে মোটা শরীর নিয়ে অতি কষ্টে নামলো সতীর শাশুড়ী! নয়নরঞ্জিনী দাসী।

দীপঙ্কর আর নড়তে পারলে না এক-পা!

নয়নরঞ্জিনী দাসী হঠাৎ থানায় এলেন কেন? দীপঙ্কর ভুল দেখছে নাকি? কিন্তু সেই তো একই রকম চেহারা। সেই থান, সেই সাদা শেমিজ, সেই সাদা মাথার চুল। সেই থপ্ থপ্ করে হাঁটার ভঙ্গি! সেই কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা।

দীপঙ্কর আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে লাগলো। সতীর শাশুড়ী এখানে কেন? এমন সময়ে?

ট্যাক্সি থেকে নেমে কনস্টেবল্ দু’জন দু’পাশে দাঁড়ালো। সতীর শাশুড়ী একবার এদিকে চাইলেন, আর একবার ওদিকে চাইলেন। কোন্‌দিকে যেতে হবে যেন বুঝতে পারলেন না। কনেস্টবল্ দু’জন তাঁকে সামনে একটা দরজার মধ্যে ধরে নিয়ে গেল। পুলিস ইন্সপেক্টর আগে আগে ঢুকে পড়লো।

কেমন হতবাক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর।

গেটে পাহারা দিচ্ছিল একজন কনেস্টবল। দীপঙ্কর গিয়ে জিজ্ঞেস করলে-ট্যাক্সি থেকে কে নামলো?

—কৌন্ বাবুজী? কিধার?

দীপঙ্কর বুঝিয়ে দিলে। বললে—ওই যে বিধবা মেয়েমানুষটিকে কনেস্টবলরা ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে, ও কে?

কনেস্টবল্ চেয়ে দেখলে—বললে—উও আসামী হুজুর, জেনানা আসামী—

—জেনানা আসামী?

দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। বললে—তুমি ঠিক জানো?

কনেস্টবল্‌ল্টা বললে—বাবুজী, জমানা বহুত খারাপ হয়েছে আজকাল। আজকাল দুনিয়া বদলে গিয়েছে। জেনানা আসামী ভি আজকাল হরদম হচ্ছে—যত মর্দানা আসামী, তত জেনানা আসামী হচ্ছে। দুনিয়ামে সভী লোক রাতোরাত আসামী হয়ে গেল!

তারপর হেসে বললে—এবার দেখে নেবেন বাবুজী, পুলিস ভি জেনানা হয়ে যাবে!

.

রাত্রে বাড়ি ফিরে এসে ভাল করে ঘুম হলো না। সকাল বেলাই চলে এল গড়িয়াহাটের বাড়িতে। সারা রাত দীপঙ্কর কেবল ভেবেছে। সত্যিই কি সতীর শাশুড়ীকে শেষ পর্যন্ত আসামী হতে হয়েছে থানায়! পৃথিবীর সমস্ত মানুষ কি একেবারে দাগী হয়ে গেল। কেন এই বিরোধ তাহলে? বিরোধ না থাকলে তো এই সম্মান-অসম্মানের প্রশ্ন ওঠে না। বিরোধ না থাকলে তো এই বিপর্যয়ও থাকে না। কিন্তু কেন বিরোধ থাকবে পৃথিবীতে!

সারা দিন আপিসের অপমান, তারপরে কোর্টে অতক্ষণ হত্যা দেওয়া, তারপর সন্ধ্যে বেলা ক্লান্ত হয়ে খানিকক্ষণের জন্যে সতীর সঙ্গে দেখা করে আবার চলে এসেছিল বাড়িতে। এত ক্লান্তির পর ঘুম হওয়ারই তো কথা ছিল। কিন্তু তবু ঘুম এল না সারা রাত।

অভয়ঙ্কর বলতো—মিস্টার সেন, বাড়ি গিয়েও কি আপনি ফাইলের কথা ভাবেন নাকি?

—ফাইলের কথা!

দীপঙ্কর মনে মনে হেসেছিল। তা ফাইলই বৈকি! জীবনটাও তো একটা ফাইল। একদিন ফাইলের জন্ম হয় একখানা কাগজকে কেন্দ্র করে। সেই কাগজটাকেই ঘিরে গড়ে ওঠে জঞ্জাল। ভাবনা আর সমস্যা জমে জমে মোটা হয় ফাইল। এদিক-ওদিক নানাদিক থেকে তার মাথায় এসে জমা হয় করেসপন্ডেন্স। কত সাহেব কত বড়বাবু তার ওপর নোট্ লেখে। তারপর আবার একদিন লালফিতে বাঁধা হয়ে যায় চিরকালের মত। তখন তার সমাধি হয় রেকর্ড সেকশানের মাচার ওপর। তখন কেউ ছোঁয় না, কেউ দেখেও না আর তাকে। মানুষ ফাইল নয় তো কী!

কাশী ভাত দেবার সময় কাছে বসে ছিল। সারাদিনের সব খরচপত্রের হিসেব দেয় সে। বলে—চালের দাম বেড়ে গেছে দাদাবাবু—

শুধু চাল নয়। প্রত্যেকটি জিনিসের দাম বাড়ার ফিরিস্তি দেয়। তবু দীপঙ্কর কিছু বলে না দেখে অবাক হয়ে যায়। অথচ দোকানে রোজ ঝগড়া করে আসতে হয় তাকে। একটা ঝগড়া করবার লোকও নেই তার বাড়িতে। দীপঙ্কর সব শোনে চুপ করে, আর ক্ষীরোদাও শুধু চুপ করে রান্না করে যায়। কাশী কার সঙ্গে যে কথা বলে ঠিক নেই। তাই সব কথাগুলো বাজারে ফুরিয়ে এসে যেন তৃপ্তি পায়। আবার বাড়িতে এসে ঘুম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ওঠে। একটা বারও লোক নেই তার। সকাল থেকে দুপুর হয়। দুপুর থেকে বিকেল। তারপর বিকেল থেকে রাত। বাড়ি ছেড়ে যে একটু বেরোবে তারও উপায় নেই। দিদিমণি কিছু বলবে না মুখে। কিন্তু দিদিমণি একলা বাড়িতে থাকবেই বা কী করে!

সে দিন একেবারে কিরণের মা’কে জোর করে ধরে নিয়ে এল দীপঙ্কর। বললে—এই আপনার সংসার মাসীমা, এ আপনার ঘাড়েই তুলে দিলুম—

বিধবা মানুষ। সারা জীবন অসীম কষ্টসহিষ্ণুতা আর অপরিমেয় ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে এই সংসারে এসে যেন আরও বোবা হয়ে গিয়েছিল কিরণের মা। এখানে অর্থাভাব নেই, এখানে দুশ্চিন্তা নেই, এখানে জীবিকা অর্জনের হাড়ভাঙা সংগ্রাম নেই। তবু মানুষ বোধহয় কোনও অবস্থাতেই সন্তুষ্ট হতে চায় না। এ-সংসারের মর্মমূলে ঢুকে মাসীমা আর এক অশান্তির সমুদ্রে হাবু-ডুবু খেতে লাগলো। একদিন বললে—এ কী করলে বাবা দীপু, এ তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে?

—কেন মাসীমা, আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে?

—আমি যেখানে ছিলুম, সেখানেই রেখে দিয়ে এস তুমি বাবা, এখানে আমার দম আটকে আসছে—

দুজনেই নির্বিরোধী মানুষ। কিরণের মা আর ক্ষীরোদা। কিরণের মা’ও সংসারের অত্যাচারে কখনও প্রতিবাদ করেনি। ক্ষীরোদাও তাই। সংসারের সমুদ্রে দু’জনেই যেন ভাঙা জাহাজ। পাল তুলে একদিন যাত্রা করেছিল ঠিকই শুভলগ্ন দেখে। কিন্তু ঝড়ে উপড়ে এসে এক নির্জন নির্বান্ধব চরে এসে আটকে গেছে। যেন মেরামত করবার অবস্থাও আর নেই।

একটু আদর করতে গেলেই ক্ষীরোদা কেঁদে ভাসিয়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে আড়ালে লুকিয়ে পড়ে

কাশী বলে—দেখলেন তো মাসীমা, দেখলেন তো কান্ডখানা, আমি বলে তাই এ- সংসারে এতদিন আছি, অন্য কেউ হলে পরনের কাপড় ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতো—

তখন মাসীমা আবার ক্ষীরোদাকে টেনে এনে চুল বেঁধে দেয়। মুখটা ভিজে গামছা দিয়ে মুছিয়ে দেয়। কত সান্ত্বনা দেয়। বলে—বাবা তো চিরকাল থাকে না মা কারো। বাপ-মা আগে যাওয়াই তো ভালো—

ক্ষীরোদা কিছু কথা বলে না। মাসীমা বলে—যাও মা, এবার কলতলায় গিয়ে গা- ধুয়ে এসো—

রাত্রিবেলা মাসীমা ক্ষীরোদাকে কাছে নিয়ে শোয়। ক্ষীরোদাও তেমনি মেয়ে। মাসীমা না বলতেই সরষের তেলের বাটি নিয়ে এসে মাসীমার পায়ে তেল ঘষে দেয়।

মাসীমা বলে—থাক্ মা থাক্—অত সুখ আমার কপালে সইবে না—

ভোর বেলা ঘুম থেকে ওঠবার আগেই মাসীমা দেখে পাশে ক্ষীরোদা নেই। ততক্ষণে ক্ষীরোদা উঠে কাশীকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে। উনুনে কয়লা দিয়ে আগুন ধরিয়েছে। রান্নাঘর পরিষ্কার করে ফেলেছে। মাসীমার মনে হয় কিরণের বদলে এমনি যদি একটা মেয়ে থাকতো তার, এমনি পাশে নিয়ে শুতো। এমনি না-বলতেই সেবা করত। ওইটুকু তো মেয়ে, কিন্তু কোত্থেকে যে খবর পায় কবে একাদশী, কবে ষষ্ঠী, কবে অষ্টমী। সারাদিন নিঃশব্দে কখন সব কাজ সেরে পরের দিনের কাজও এগিয়ে রাখে। দুপুরবেলা ডাল শুকোতে দেয় রোদে। বালিশের ওয়াড়গুলো খুলে নিজেই সাবান দিয়ে কেচে রোদে মেলে দেয়।

—তোমাকে এত কাজ কে শেখালে মা?

বাপ নেই, মা নেই, অথচ সংসারের সমস্ত খুঁটিনাটি এমন নিখুঁত পরিপাটি করে করতে কে শেখালে কে জানে!

দীপঙ্কর বলে—আপনিই একটা উপায় করে দিন না মাসীমা, এই জন্যেই তো আপনাকে এনেছি, আমার মা থাকলে আর এত ভাবতে হোত না—

—তা তোমার মা’র যদি কথা দেওয়াই ছিল তো তুমিই বিয়ে করো না বাবা! এমন বউ তুমি হাজার খুঁজলেও পাবে না, এ-ও বলে রাখছি—

এ-কথার উত্তরে দীপঙ্কর চুপ করে থাকতো। কোনও কথা না বলে খেয়ে উঠে জামা-কাপড় পরে আপিসে চলে যেত। কিন্তু একদিন আর থাকতে পারলে না মাসীমা। বললে—আমাকে তুমি কেন আনলে বাবা এখানে? আমি কী পাপ করেছিলুম?

—কেন মাসীমা, আপনার কি কোন কষ্ট হচ্ছে?

মাসীমা বললে—এর চেয়ে সে-কষ্ট যে অনেক ভাল বাবা, আমি সেখানে খেতে পেতুম না, আমার সেবা করবার লোক ছিল না, হাতে পয়সা ছিল না, তবু এর চেয়ে সে অনেক ভাল! এ যন্ত্রণা তো আর আমার সহ্য হয় না!

দীপঙ্কর অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল—কেন মাসীমা, কী কষ্ট হচ্ছে আপনার?

—ওর বাপ-মা থাকলে আমাকে আর এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হত না। বাড়িতে এত বড় একটা মেয়ে পুষে রেখেছ আর তুমি বলছ যন্ত্রণাটা কীসের? সংসারে সকলকে খেয়ে বুড়ো বয়েসে এ কী পাপে আমাকে জড়িয়ে দিলে বাবা!

যখন কোনও কাজ থাকত না, সেই দুপুর বেলা আর দুপুর রাত্রেই দু’জনে যেন একাত্মা হয়ে যেত। ক্ষীরোদাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরতো মাসীমা। একজন স্বামী- পুত্রকে হারিয়ে, রোগে শোকে শীর্ণ অথর্ব হয়ে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল, আর একজন জীবনের সূচনাতেই সব হারিয়ে নিঃসম্বল হয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। মাসীমা বুঝতে পেরে বুকে জড়িয়ে ধরতো ক্ষীরোদাকে। আর ক্ষীরোদাও যেন একজনের ওপর নির্ভর করতে পেরে প্রাণ ভরে কেঁদে তৃপ্তি পেত। তখন কোনও ভাষা জোগাত না দু’জনের মুখে। সান্ত না দেবার সামর্থ্যটুকু যেন দু’জনেরই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। এ কী পাপ! এ কী যন্ত্রণা! এ কী অভিশাপ নেমে এসেছিল সেই সেদিনকার দুটি মেয়েমানুষের জীবনে।

কিন্তু সেদিন হঠাৎ বড় বিপর্যয় ঘটে গেল আবার। দীপঙ্কর রোজই আপিসে যায়। রোজই আপিস থেকে ফেরে। রোজই দীপঙ্কর খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়ে নিজের ঘরে। আর রোজই দু’টি নিরীহ গলগ্রহ মেয়েমানুষ দুজনের বুকের মধ্যে সান্ত্বনা খোঁজবার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এমনি করেই চলছিল এই ছন্নছাড়া সংসার। কিন্তু একদিন দীপঙ্কর যখন বাড়ি ফিরে এল, তখন তার চেহারার দিকে চেয়ে মাসীমা আঁকে উঠলো। বললে—কী হয়েছে বাবা তোমার?

দীপঙ্কর কিছু বললে না। কিছু খেলেও না। সোজা নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে ছট্‌ফট্ করতে লাগলো। খবর পেয়েই মাসীমা কাছে গেল। কপালে হাত দিয়ে দেখলে। বললে—কী হলো বাবা তোমার?

দীপঙ্কর শুধু বললে—মাসীমা —

আর বেশি কথা বেরোল না দীপঙ্করের মুখ দিয়ে। এপাশ-ওপাশ করতে লাগলো দীপঙ্কর। তার মা বেঁচে থাকলে যেমন করত, মাসীমাও ঠিক তেমনি করতে লাগল। দীপঙ্করের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলে। দু’জনের কারোরই নজরে পড়ল না যে, ক্ষীরোদাও তখন সকলের অলক্ষ্যে দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছে। সেও যেন আকস্মিক বিপর্যয়ে একেবারে বিহ্বল হয়ে গেছে।

কিন্তু এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। সে-ইতিহাসটা না জানলে এ-ঘটনাটা ঠিক বোঝা যাবে না।

অত্যন্ত অস্বস্তির মধ্যে তখন দিন কাটছিল দীপঙ্করের। এ-এক অদ্ভুত অস্বস্তি। এ অস্বস্তির কোনও কারণই কিন্তু থাকতো না অন্য কেউ হলে। অন্য কেউ হলে এত বড় চাকরির মধ্যেই সে সান্ত্বনা পেত। কোথায় কোন্ দীন অবস্থা থেকে সে এত বড় হয়েছে। এত টাকার মালিক হয়েছে। আপিসে তাকে সেলাম করবার লোকের অভাব নেই। আপিসে তার অনুগ্রহ পাবার আকাঙ্ক্ষায় উদ্‌দ্গ্রীব হয়ে থাকে ক্লাক্রা। সংসারে এই-ই তো দুর্লভ। তার মা তো দীপঙ্করের কাছ থেকে এর বেশি কিছু চায়ওনি। কালিঘাটের ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের আবহাওয়া ছেড়েছে। চাকরিতে উন্নতি হয়েছে। সংসারী লোক আর কী চায়? আর কী চাওয়ার আছে?

কিন্তু তবু কোথায় অন্তরের অবচেতনায় যেন একটা বেদনার কাঁটা দিনরাত খচ্ খচ্ করে বিঁধতো! কেন এত অন্যায়, কেন অত অত্যাচার, কেন এত অবিচার। কেন সৎ মানুষের এত কষ্ট! কেন সংসারে সততার কোনও মূল্য নেই। কেন পৃথিবী জুড়ে এত কান্না, এত আৰ্তনাদ! একলা থাকলেই প্রাণমথবাবুর সেই ছোটবেলাকার কথাগুলো মনে পড়ে। কিরণকে মনে পড়ে। অন্ধকার বদ্ধ ফাঁসি-সেলের মধ্যে কেমন করে দিনগুলো কাটছে তার। সতীর কথা মনে পড়ে, লক্ষ্মীদির কথা মনে পড়ে, সনাতনবাবুর কথা মনে পড়ে। সনাতনবাবুর বেদনার কথাটাও একটু-একটু বুঝতে চেষ্টা করে। অপবিত্রতাকে এড়িয়ে গিয়ে নয়, অপবিত্রতার মধ্যেই সনাতনবাবু অপরূপের সন্ধান করছেন।

একদিন সনাতনবাবুর কাছে গিয়েছিল দীপঙ্কর। সেই প্রসন্ন হাসিটা মুখে ঝুলছে।

জিজ্ঞাসা করলেন—সতী কেমন আছে?

দীপঙ্কর বলেছিল—ভালো আছে কেমন করে বলবো বলুন?

—কোথায় আছে সে?

দীপঙ্কর বলেছিল—তার দিদির বাড়িতে—

সনাতনবাবু বলেছিলেন—সতীকে বলবেন, হতাশ যেন না হয়, উত্তেজিত যেন সে না হয়। হতাশ হওয়া পাপ, উত্তেজিত হওয়া পাপ—! আমি আজই সতীকে গিয়ে এখানে নিয়ে আসতে পারি দীপুবাবু, কিংবা আমিও থাকতে পারি তার কাছে

—তাহলে যান না কেন? সতী একটু শান্তি পেত। তার বিবাহিত জীবনটা একটু সুখের হতো তাহলে!

সনাতনবাবু বলেছিলেন—আপনিও কি তাই চান দীপুবাবু?

দীপঙ্কর বলেছিল—আমি চাই সে সুখী হোক, আর শুধু সে একলা নয়, পৃথিবীর সবাই সুখী হোক—

সনাতনবাবু বলেছিলেন—কিন্তু দু’টো কথা তো এক নয় দীপুবাবু! তাহলে আর আজকের এই যুদ্ধটাও বাধতো না। আজ পাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে পাশের বাড়ির লোকের আর মিল হয় না, ভাইতে ভাইতে মিল হয় না, স্বামী-স্ত্রীতে মিল হয় না— মানুষে মানুষে মিল হওয়াটাই উঠে গেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করি না, কেউ কাউকে ভালোও বাসি না—। কালোরা সাদাকে ভয় করে, ধনীরা গরীবদের ভয় করে, অত কথা কী, এ-পাড়ার লোক ও-পাড়ার লোকদের ভয় করে—

দীপঙ্কর বলেছিল—কিন্তু এ-ভয় তো চিরকাল থাকবে! ততদিন সতী বাঁচবে কেমন করে?

সনাতনবাবু বলেছিলেন—ততদিন হয়ত আমিও বাঁচবো না দীপুবাবু। কিন্তু ভয় তো এদের দূর করতেই হবে একদিন।

—কেমন করে সে-ভয় দূর হবে?

সনাতনবাবু বলেছিলেন—জ্ঞানে! স্কুলে কলেজে যে-জ্ঞান হয় সে জ্ঞান নয়। যতদিন সে-জ্ঞান দেবার মত কোনও মানুষের আবির্ভাব না হয়, ততদিন আমাদের দুঃখ সহ্য করতেই হবে। আমি তো সেই কথাই বলছিলুম মা-মণিকে। আমার মা’কে আপনি কতটুকু চিনেছেন জানি না। কিন্তু এমন মা’ও তো কোনও ছেলে পায় না দীপুবাবু!

সনাতনবাবুর মুখের কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল দীপঙ্কর খানিকক্ষণের জন্যে।

–আমাদের এই সংসার তো আপনি দেখছেন, এ চিরকাল এমন ছিল না, দীপুবাবু। আপনি কিছু-কিছু দেখছেন সে-সংসারের। এর শান্তি এর ঐশ্বর্য একদিন এই ভবানীপুরের সমস্ত পরিবারের ঈর্ষার জিনিস ছিল, তা জানেন! আমি যখন ছোট ছিলাম, অল্প বয়েসে আমার বাবা মারা যান, মা না থাকলে এ-সমস্ত যে ভেসে যেত সেদিন। আমার মা শুধু আমার মা-ই নয়, আমার মা-ই যে আমার অস্তিত্ব। মা ছাড়া যে আমি কিছু কল্পনাই করতে পারি না দীপুবাবু। মা’র জন্যেই আমি এই সব কিছু পেয়েছি। এই সব কিছু ভোগ করছি। মা কি সামান্য জিনিস দীপুবাবু! আপনিও তো জানেন দীপুবাবু, আপনার মা আপনার কতখানি ছিলেন? আমি যে আর সব ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু মা’কে? আর আমার কাছে দেশও যা, মা-ও যে তাই। মাতৃভূমি কি আমরা ত্যাগ করি? মাতৃভূমি আমাদের যত দরিদ্রই হোক, তবু কি কেউ আমরা ত্যাগ করেছি তাকে? তাহলে সকলে আমেরিকাতে গিয়ে বাস করলেই তো পারি? বঙ্কিমচন্দ্র যে ‘বন্দে মাতরম্’ লিখেছিলেন, সে তো এই মাতৃভূমিকেই উদ্দেশ্য করে!

তারপর মাতৃরূপের কত ব্যাখ্যাই যে করেছিলেন সেদিন সনাতনবাবু! মাতৃমন্ত্র কী, মাতৃস্বরূপ কী জিনিস, তার অনেক ব্যাখ্যাই দীপঙ্কর সেদিন বুঝতে পারেনি।

—আবার দেখুন, এই মা’র জন্যেই আজকে আমাদের সব ঐশ্বর্য রিক্ত হয়েছে, সব গৌরব অন্তর্হিত হয়েছে, আজকে আমাদের পরিবারের সব কর্মচারী ঠিকমত মাইনেও পায় না। কিন্তু আজকে মায়ের ঐশ্বর্য নেই বলে কি মা’কে আমি পরিত্যাগ করব? মায়ের মূল্য কি ঐশ্বর্য দিয়ে বিচার করে কেউ?

—কিন্তু কোনওদিন যদি আপনার মায়ের সঙ্গে সতীর মিল না হয়, তাহলে?

—মাতৃভূমির কল্যাণের জন্যে রামচন্দ্র সীতাকে ত্যাগ করেছিলেন, তা তো জানেন?

—সতী তো কোনও অপরাধই করেনি সীতার মত?

—কিন্তু সীতাই কি কিছু অপরাধ করেছিলেন?

তারপরেই একটু থেমে বলেছিলেন—না দীপুবাবু, সতীকে ত্যাগের কথা এখানে ওঠেই না, সেই রামচন্দ্রের আমল থেকে হাল-আমল পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ সীতা আর লক্ষ লক্ষ রামচন্দ্র এমনি দুঃখ এমনি ত্যাগ স্বীকার করে আসছেন, এই নিয়ে কত মহাকাব্য কত উপন্যাস, কত গাথা লেখা হয়েছে—তবু পাতাল-প্রবেশ কেউ তো রোধ করতে পারেনি—

—কিন্তু এর কি কোনও সমাধান নেই?

সনাতনবাবু বলেছিলেন—এর সমাধান আমি আমার বইতে খুঁজে পাচ্ছি না দীপুবাবু, কেবল সন্ধান করেই চলেছি। যেদিন সন্ধান পাবো সেদিন আমি নিজে গিয়ে আপনাকে জানাবো।

সেদিন আর বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি দীপঙ্কর। কেবল ভয় হচ্ছিল হয়ত এখনি সতীর শাশুড়ী এসে পড়বে। এসে দেখে ফেলবে তাকে। হয়ত আবার একটা অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটে যাবে। একটু পরেই উঠে পড়েছিল দীপঙ্কর। সনাতনবাবুর চেহারাটাও কেমন যেন শুকনো-শুকনো। সেই লাবণ্য নেই। সেই ঘোষ-বাড়ির ঐশ্বর্যের সঙ্গে সঙ্গে সনাতনবাবুও শুকিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ দীপঙ্কর বললে—আমি তাহলে আসি সনাতনবাবু—

আগে হলে সনাতনবাবু বসতে পীড়াপীড়ি করতেন। সেদিন কেমন যেন ঝিমিয়ে ছিলেন।

দীপঙ্কর বললে—শুনলাম নির্মল পালিত, আপনাদের ব্যারিস্টার, ধরা পড়েছে—

সনাতনবাবু বললেন— হ্যাঁ—

—তাহলে হয়ত টাকাগুলোও পাওয়া যাবে!

সনাতনবাবু ম্লান হাসি হেসে বললেন—টাকা পাওয়া গেলেই কি সব সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে ভেবেছেন? টাকা তো সমস্যা নয় দীপুবাবু, টাকাটা সমস্যা সমাধানের একটা উপায় মাত্র। কিন্তু টাকা দিয়ে তো সব কেনা যায় না—। টাকা ফিরে এলে কি সতী ফিরে আসবে?

দীপঙ্কর নিজের মনেই যেন হঠাৎ চমকে উঠলো। হঠাৎ এতদিন পরে যেন অঘোরদাদুর উল্টো কথা শুনলো সনাতনবাবুর মুখ থেকে। এ-পৃথিবীতে এমন করে এত সহজ ভাবে আর কেউ তো বলেনি এমন কথা।

—টাকা সব নয়?

সনাতনবাবু আর কথা বললেন না। তিনি আবার মাথা নিচু করলেন। তারপর হঠাৎ মাথা উঁচু করে ফ্যাল্ ফ্যাল্ করে চেয়ে রইলেন দীপঙ্করের দিকে। বললেন— টাকা ফিরে এলে কি আমি আমার মাকেও আবার ফিরে পাবো?

দীপঙ্করের বিহ্বল দৃষ্টির ওপর মুখ রেখে সনাতনবাবু আবার বললেন—টাকা গেছে দুঃখ নেই দীপুবাবু, কিন্তু দুঃখ এই যে টাকার জন্যে মাকেও হারিয়েছি, আর মা’র জন্যে সতীকেও হারিয়েছি—

তারপর একটু থেমে দীপঙ্করকে বললেন—আপনি সতীকে বলে দেবেন দীপঙ্করবাবু, যে হতাশ যেন সে না হয়, হতাশ আমি হইনি, হতাশ আমি হই না। জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত আমি হতাশ হবো না, হতাশ হলে আমি থাকবো কী নিয়ে?

বাইরে বেরিয়ে আসছিল দীপঙ্কর। আপন মনে চোখ নিচু করেই আসছিল। পেছন থেকে হঠাৎ শম্ভুর গলা পেতেই মুখ ফিরিয়ে দেখলে।

—তুমি? তুমি কেমন আছো শম্ভু?

শম্ভু বললে–বৌদিমণি কেমন আছে?

দীপঙ্কর বললে—ভালো কি করে থাকে বলো, কিন্তু তোমরা কেমন আছো?

শম্ভু বললে–আপনি শুনেছেন তো কান্ড?

—কী কান্ড?

শম্ভু বললে—এ বাড়ি বিক্রী হয়ে যাচ্ছে!

–সে কি?

শম্ভু বললে—হ্যাঁ, মা-মণি তো সেইজন্যেই উকীলের বাড়ি গেছে। আগেকার ব্যারিস্টারবাবু এ-বাড়ি বাঁধা রেখে দিয়েছিল মারোয়াড়ীদের কাছে, এতদিন কেউ জানত না। দলিল-টলিল তো সব সেই ব্যারিস্টারের কাছে থাকতো! এখন ডিক্রী হয়েছে, বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে আমাদের!

—কই, সনাতনবাবু তো কিছু বললেন না এ-সব কথা!

—উনি আর কী বলবেন! উনি কি কোনও ঝঞ্ঝাটে থাকেন? ন’মাসীমা ক’দিন থেকে আসা-যাওয়া করছে। মা-মণিরও ঘুম নেই, খাওয়া নেই, কেবল এখানে দৌড়োচ্ছে, ওখানে দৌড়োচ্ছে—হুলুস্থুলু কান্ড বেধে গেছে এ-বাড়িতে, অথচ মাইনেও পাইনি আমরা কেউ কত মাস! চাকরিই থাকবে না আর তা মাইনে নিয়ে কী করবো বলুন—

দীপঙ্কর স্তম্ভিত হয়ে গেল সব শুনে! এতক্ষণ ধরে সনাতনবাবুর সঙ্গে বসে বসে কথা বলেছে, কিছুই তো বলেননি। এবার ঘুণাক্ষরেও তো এতবড় ব্যাপারটার এক বর্ণও উচ্চারণ করেন নি!

—তুমি ঠিক বলছো শম্ভু?

—আজ্ঞে ঠিক বলবো না তো কি বেঠিক বলবো আমি! আমাদের অন্ন নিয়ে কথা, আমি বেঠিক কথা বলতে যাবো কেন খামোকা? আর তো দু’এক মাসের মধ্যে এ-বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে! বড়বাজারের মারোয়াড়ীদের কাছে বাঁধা ছিল এতদিন, কেউ টের পায়নি। শুনছি তো এক লাখ টাকায় কিনে নিয়েছে। এ নিয়েই তো যত হুজ্জত হচ্ছে বাড়িতে—

দীপঙ্কর বললে—কিন্তু সেদিন যে তোমার মা-মণিকে লালবাজার থানায় যেতে দেখলুম, পুলিসে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল নাকি?

—কবে?

—এ তো সেদিন, আপিস থেকে বেরিয়ে লালবাজার থানার সামনে দিয়ে আসছিলুম, হঠাৎ দেখলাম দারোগা-পুলিস ঘিরে নিয়ে গিয়ে পুরলো থানার ভেতর! সে কীসের জন্যে? সে-ও কি এই বাড়ির ব্যাপার?

এতক্ষণে যেন মনে পড়লো শম্ভুর। বললে—আজ্ঞে, সে তো সঙ্গে আমিও ছিলুম। ট্যাক্সি করে মা-মণির সঙ্গে আমিও তো গিয়েছিলুম সেখানে! ব্যারিস্টারবাবুকে যে লালবাজার থানায় পুরে রেখেছে—

—কী দেখলে?

শম্ভু সেই ঘটনাটার কথাও সবিস্তারে বললে। ট্যাক্সি থেকে নেমে পুলিস কনস্টেবলরা নয়নরঞ্জিনী দাসীকে নিয়ে গেল ভেতরে। শম্ভুও গিয়েছিল সঙ্গে। একতলা, দোতলা, কত বড় বাড়িটা। কত পুলিস কত দারোগা। সমস্ত পৃথিবী যেন শাসন করা যায় এদের দিয়ে। কত তার আইন-কানুন, কত তার নিয়ম-নিগড়। এ-ঘর দিয়ে ও-ঘরে পৌঁছে কত জায়গায় নাম ধাম লিখতে হয়। নয়নরঞ্জিনী দাসী জীবনে কখনও কল্পনাও করেন নি যে একদিন এখানে তাঁকে আসতে হবে। চারদিকে চেয়ে মোটা-সোটা মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছিলেন।

বলেছিলেন—হ্যাঁ বাবা, আর কতদূর? এ কোথায় নিয়ে এলে বাবা তোমরা আমাকে?

দারোগা-সাহেব সঙ্গেই ছিলেন। বললেন—একটু কষ্ট দিলুম আপনাকে মিসেস ঘোষ!

–একে কি বাবা একটু কষউট বলে! খেয়ে-দেয়ে একটু জিরোতে পাইনি বাড়িতে! বাড়িও যে আমার জেলখানা হয়েছে বাবা!

—আর একটু কষ্ট করুন। সম্পত্তি থাকলেই জ্বালা সইতে হবে মিসেস ঘোষ। যার সম্পত্তি নেই, এ-যুগে তার জ্বালাও নেই!

নয়নরঞ্জিনী দাসী যেন কেঁদে ককিয়ে উঠলেন। বললেন—সম্পত্তিই হয়েছে আমার কাল বাবা, সম্পত্তি না-থাকলে আমি কাশীবাসী হতাম, এখানে আর এমন করে আমাকে দগ্ধে মরতে হতো না, কার পাপে যে সম্পত্তি এমন কাল্ হলো আমার, কে জানে!

দারোগা-সাহেব বললেন—এতে আপনারই সুবিধে! আইডেন্টিফিকেশন্ হয়ে গেলে তখন আপনাকে সোজা বাড়ি পাঠিয়ে দেব।

নয়নরঞ্জিনী বললেন—সোজা বাড়ি যাবার কি আমার উপায় আছে বাবা, এখান থেকে যেতে হবে আবার উকীলের বাড়ি। হারামজাদা ব্যারিস্টার যে ওদিকেও গোলমাল বাধিয়ে বসেছে—

—কী গোলমাল?

নয়নরঞ্জিনী বললেন—বসত বাড়িখানা ছিল, তাও হারামজাদা বাঁধা রেখে দিয়ে গেছে মারোয়াড়ীর কাছে। এখন সেই পাওনাদার কোর্ট থেকে ডিক্রি পেয়ে চেপে ধরেছে। আমি যে কোন্ দিক রাখতে কোন্ দিক সামলাই বুঝতে পারছি না বাবা, আমার পক্ষে যে একটা বলবার লোক পর্যন্ত কেউ নেই—

নয়নরঞ্জিনী দাসীর গলায় কান্না যেন উপ্‌চে পড়লো। দারোগা-সাহেব একটা হল- ঘরের মধ্যে ঢুকলেন। দু’পাশে তারের জাল-আঁটা দরজা। শক্ত লোহার তার। একজন পুলিস-সেপাই দাঁড়িয়ে রয়েছে—কখনও এধার থেকে ওধারে পায়চারি করছে। সেই স্পষ্ট দিনের বেলাতেও তখন সেখানে অন্ধকার। কয়েকটা মিটমিটে ইলেকট্রিক বাল্‌ব জ্বলছে মাথায়।

—ওই দেখুন, চিনতে পারেন?

নয়নরঞ্জিনী দেখলেন। শম্ভু দেখলে। অন্ধকার ঘরটার ভেতরে একজন কোট্‌প্যান্ট পরা লোক তাদের দেখে সেইদিকেই এগিয়ে আসছে। বেশ জুতোর খট্‌খট্ শব্দ করে হেঁটে আসছে। আলোর কাছে আসতেই শম্ভু চিনতে পারলে—ওই তো সেই ব্যারিস্টার বাবু। আলোর কাছে আসতেই নির্মল পালিত চিনতে পেরেছে।

নয়নরঞ্জিনী বললেন—ওমা, এই তো সেই—এ তো সেই চেহারা—তুমি বাছা এমন করে আমায় ঠকালে, এমন করে আমার টাকাগুলো নিয়ে গেলে? এমন হারামজাদা তুমি?

মুখে যত কথা আসছিল, সব বলতে যাচ্ছিলেন নয়নরঞ্জিনী। কিন্তু নির্মল পালিত তার আগেই পকেট থেকে একটা নোটবই বার করেছে। বললে—কী নাম বললে? হোয়াট্ ইজ্ ইয়োর নেম?

—ওমা, দেখ কান্ড, আমায় চিনতেও পারছে না যে গো!

—কী নাম তোমার? সরোজিনী নাইডু? ঠিকানা? ঠিকানা বলো, লিখে নেব! আমি সক্কলকে জেলে পুরবো কাউকে রেহাই দেব না—ভাইয়কে রিপোর্ট করবো—

নয়নরঞ্জিনী কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন, দারোগা সাহেব বললেন—আপনি ওর সঙ্গে কথা বলবেন না, এই লোকটা তো? ঠিক চিনতে পারছেন?

নির্মল পালিত ততক্ষণে ঘস্ ঘস্ করে কী সব লিখে ফেলেছে—। বলছে— গান্ধীকে জেলে পাঠিয়েছি, জহরলাল নেহরুকে জেলে পাঠিয়েছি, এবার তোমাকে জেলে পাঠাবো সরোজিনী নাইডু—

বলে আবার লিখতে লাগলো কী-সব।

নয়নরঞ্জিনী বললেন—তা আমার এতগুলো টাকা তুমি কী করলে বাছা? এমন করে অনাথা-বিধবার সর্বনাশ করতে হয়? এমন করে যথাসর্বস্ব কেড়ে নিতে হয়?

দারোগা-সাহেব থামতে বললেন। কিন্তু নির্মল লিখতে লিখতে বললে—টাকা? কীসের টাকা?

—ওমা, বলে কী গো, টাকার কথা বেমালুম ভুলে গেলে?

—ওঃ, ইউ নো, আমি বলেছিলুম তোমাকে–beauty is potent but money is omnipotent. টাকা যে গডের চেয়েও বড়। টাকা দেখালেও আমি ছাড়বো না তোমাকে, গান্ধীকে জেলে পাঠিয়েছি, জহরলাল নেহরুকে জেলে পাঠিয়েছি, এবার তুমি সরোজিনী নাইডুই হও আর যে-ই হও, তোমাকেও আমি জেলে পাঠাবো এবার—a fool makes money and it takes a wise man to spend it—ইউ আর এ ফুল—

দারোগা-সাহেব নয়নরঞ্জিনী দাসীকে আর দাঁড়াতে দিলেন না। বললেন—চলে আসুন মিসেস ঘোষ—চলে আসুন-—

তখনও থরথর করে কাঁপছিলেন নয়নরঞ্জিনী। পেছনে তখনও চিৎকার করছে নিৰ্মল পালিত। ইংরিজী, বাংলা, আবোল-তাবোল—কত কী বলে চলেছে—

নয়নরঞ্জিনী বললেন—হ্যাঁ বাবা, টাকাগুলো তাহলে পাওয়া যাবে না? ওগুলো সত্যি- সত্যিই জলে গেল?

দারোগা-সাহেব বললেন—দেখলেন তো সব, আমরা তো আপনার টাকা আদায় করবার জন্যেই চেষ্টা করছি, কিন্তু পাগলের তো আর কোনও বিচার হয় না—

—কিন্তু ও যে স্যায়ানা পাগল বাবা! দেখলে না পেটে পেটে কত বুদ্ধি! এখন কী হবে?

দারোগাবাবু বললেন—আপনি কিছু ভাববেন না, সে যা করবার আমরা করবো। আপনি এখন বাড়ি যান।

নয়নরঞ্জিনী কেঁদে আকুল হলেন। বললেন—একটু দেখো বাবা, আমি জীবনে কারো কোনও ক্ষতি করিনি, বিধবার টাকাগুলো যেন নয়-ছয় না হয়ে যায়, আমার অনেক কষ্টের টাকা বাবা, আমর বাড়িটা পর্যন্ত বাঁধা রেখে দিয়েছে, এমন হারামজাদা—

দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—তারপর?

শম্ভু বললে—তারপর আর কী করবে মা-মণি। মা-মণি চলে এল। আমি ট্যাক্সি ডেকে দিলুম, সেই ট্যাক্সিতে করে মা-মণিকে উকীলের বাড়ি নিয়ে গেলুম। সেখানেই রাত্তির হয়ে গেল। আজকাল এই সবই হচ্ছে দিনরাত। মা-মণির খাওয়া নেই দাওয়া নেই, দিনরাত কেবল উকীল আর উকীল—টাকা আর টাকা—

—আর সেই বিয়ে? দাদাবাবুর সেই বিয়ে দেবার চেষ্টা হচ্ছিল, তার কী হলো?

শম্ভু বললে—সেও তো পাকা হয়ে উঠেছিল, ন’মাসীমা রোজই তো আসতো, সেই মিত্তির-গিন্নী আর তার মেয়েকে নিয়ে, কিন্তু এখন এই বাড়ির হিড়িকে সব ধামা চাপা পড়ে আছে—

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *