৫৪
মনে আছে সেদিন সনাতনবাবুর সেই নিস্তব্ধ মূর্তিটার দিকে চেয়ে দীপঙ্করের মাথা নিচু হয়ে আসতে চেয়েছিল। এই মানুষটাকে যেন কেউই বুঝলে না। বুঝতে চাইলে না। সংসারে যত কথা না বলতে পারা মানুষগুলোর যেন নির্বাক প্রতিনিধি এই সনাতনবাবু। দুঃখ তো সকলেই পায়। দুঃখের কত না ব্যাখ্যাই করে গেছেন কত মহাপুরুষ। কিন্তু প্রতিবাদহীন সহনশীলতার মধ্য দিয়ে সনাতনবাবুর মত আর কে দুঃখকে এমন অপরূপ মর্যাদায় মণ্ডিত করতে পেরেছে! একটি দিনের একটি ঘটনার মধ্যে দিয়েই যেন দীপঙ্কর অনেক কিছু শিখে ফেললে। এ সংসারে এমন ঘটনা তো নিত্য-নৈমিত্তিক। এখানে প্রতিদিনই প্রবল দুর্বলকে আঘাত করছে। ব্যাধি-বিচ্ছেদ-মৃত্যু এখানকার প্রতিদিনকার ঘটনা। বিপর্যয় এখানে অদৃশ্য থেকে প্রতিপদে সহস্রশীর্ষ ভয়ের করাল ছায়া বিস্তার করছে। তবু সনাতনবাবুর মত কে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে সেই অপরিহার্য অপবিত্রতার মধ্যে অপরূপের সন্ধান করতে পেরেছে!
অন্ধকার ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে সতীকে গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর বাড়িতে রেখে আসার পরও বার বার সনাতনবাবুর উদ্দেশে প্রণাম করলে দীপঙ্কর
রঘু ছিল সঙ্গে। ট্যাক্সিতে সামনের সিটে বসে ছিল।
দীপঙ্কর বললে—তোমার কাছে টাকা আছে রঘু?
—আজ্ঞে, না তো!
দীপঙ্কর পকেট খুঁজে দেখলে। কয়েকটা মাত্র টাকা তখনও পড়ে ছিল। বললে— এগুলো রাখো তুমি কালকে আরো কিছু দিয়ে আসবো—
সতী সারা রাস্তা দীপঙ্করের কোলের ওপরেই শুয়ে পড়েছিল। তার যেন নড়বার ক্ষমতাও নেই। দুই হাতে তাকে ধরে নিয়ে যেতে হয়েছে সারা রাস্তা। তারপর দুজনে মিলে ধরে তার ঘরের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসেছে।
রঘু বলেছিল—দাদাবাবু, আপনি এখানে থাকবেন না?
দীপঙ্কর বলেছিল— আজ রাতটা দিদিমণি এমনি করেই থাক, আমি ভোর বেলাই চলে আসবো—কিছু ভেবো না তুমি—একেবারে ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসবো—
চলে আসবার আগে বললে—এই ক’দিন আর কেউ এসেছিল এখানে?
রঘু বললে—এসেছিল, দু’তিনজন—
—কী করতে?
রঘু তা জানে না। দীপঙ্কর আবার বললে—কোনও চিঠি এসেছে?
তাও আসেনি। তবু লেটার-বক্সের ভেতরে একটা চিঠি পড়ে ছিল। চাবি খুলে চিঠিটা বার করতেই বোঝা গেল লক্ষ্মীদির চিঠি। হোক সতীর নামে। তবু চিঠির খামটার মুখ ছিঁড়ে ফেললে। লক্ষ্মীদি লিখেছে—
ভাই সতী,
কেমন আছিস? এখানে এসে ভালোই আছি আমরা। দীপুকে বলিস বাবার নামে সেই টাকাগুলোর যেন একটা ব্যবস্থা করে। অতগুলো টাকা ব্যাঙ্কে উইথআউট্ ইন্টারেস্টে পড়ে থাকা ভাল নয়। তাড়াতাড়ি যেন একটা সাক্সেশন সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা সে করে। যেমন-যেমন ব্যবস্থা হয়, আমাকে লিখবি। দরকার হলে আমি নিজেও চলে যেতে পারি এক-দিনের জন্যে। ইতি—
তাড়াতাড়ি চিঠিটা পড়ে ভাঁজ করে সতীর টেবিলে রেখে দিয়ে এল। তারপর আবার সেই ট্যাক্সিতে চড়েই বাড়ি ফিরে এসেছে। এতদিন বাড়ি ছাড়া। যেন এক যুগ! অন্ধকারে স্টেশন রোডের ভেতরে গাড়িটা ঢুকতেই সব কথা আবার মনে পড়ে গেল। কাশী, ক্ষীরোদা। এইখান থেকেই কিরণকে ধরে নিয়ে গিয়েছে তারা। বলতে গেলে এইখানেই কিরণের মৃত্যু হয়েছে। দীপঙ্করই যেন কিরণকে হত্যা করেছে নিজের হাতে। কিরণকে যেন ফাঁসির কাঠগড়ায় তুলে দিয়ে সে নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে এল।
—কাশী, কাশী।
অনেকক্ষণ ডাকার পর ভেতর থেকে দরজা খোলার ক্ষীণ শব্দ এল। কাশী দরজা খুলতে এত দেরি করছে!
কিন্তু দরজাটা খুলেই যে নিঃশব্দে এক পাশে সরে গেল সে কাশী নয়—সন্তোষ- কাকার মেয়ে! হঠাৎ সেই অন্ধকারেই বিদ্যুৎ-চমকের মত যেন এক পলক দেখে নিয়ে দীপঙ্কর কেমন বিমূঢ় হয়ে গেল। ক্ষীরোদা হয়ত রোজই জেগে থাকে তাকে দরজা খুলে দেবার জন্যে! কাশী ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ে-দেয়ে। দীপঙ্কর দরজাটা নিজেই বন্ধ করে দিয়ে আস্তে আস্তে ভেতরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। কিছু যেন বলবার ছিল কাউকে। কিন্তু না বলেই আবার আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলো। ওপরের ঘরটায় তালা লাগানো ছিল।
ক্ষীরোদা এসে আস্তে আস্তে পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল চাবি নিয়ে।
দীপঙ্কর বললে—দাও, আমাকে দাও চাবিটা, আমি খুলছি—
কিন্তু চাবিটা দিতে গিয়ে হঠাৎ হাত ফসকে ঝন্ ঝন্ শব্দে সেটা পড়ে গেল সিমেন্টের মেঝের ওপর।
আর দীপঙ্করের মনে হলো যেন সেই সঙ্গে ক্ষীরোদার কুমারী-জীবনের সমস্ত লজ্জা, সমস্ত সম্ভ্রম, সব যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল এক মুহূর্তে।
ক্ষীরোদা আর দাঁড়াল না সেখানে। তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে সেই অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করেই যেন বাঁচলো। তখনও তার বুকটা ঢিপ্ ঢিপ্ করছে।