৫১
ট্যাক্সিটা সোজাই যাচ্ছিল। ছিটের বাড়ি থেকে একটু এগিয়েই একটা ট্যাক্সি পাওয়া গিয়েছিল। তাতে চড়ে সোজা বাড়ি যাবারই ইচ্ছে ছিল দীপঙ্করের। বাড়িতে কেউ নেই। কাশী একলা কি করছে কে জানে। সন্তোষ-কাকার মেয়েও নতুন। তারা এতদিন কী করছে, কী খাচ্ছে, কেমন করে চালাচ্ছে তাও জানা নেই। হাতে টাকাও নেই তাদের। কোথা দিয়ে সব কী হয়ে গেল। দীপঙ্করের জীবনে সব যেন বেনিয়ম হয়ে গেল রাতারাতি। এরই নাম কি অনুসন্ধান? কাকে সে অনুসন্ধান করছে? কোন সত্যকে? কোন সত্যের অন্বেষণে তাকে এই জীবন-পরিক্রমা করতে হচ্ছে এত পরিশ্রান্ত হয়ে? সে অনুসন্ধান তার কবে শেষ হবে? জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌছিয়েই কি অভীষ্টকে পাওয়া যাবে? অথচ কী-ই বা অভীষ্ট? কোন অভিষ্টকে পেলে সব পাওয়া তার চরম পাওয়া হবে? কাউকেই সে শান্তি দিতে পারেনি, কাউকেই সে সুখ দিতে পারেনি। অন্য কেউ সুখ না- পেলে দীপঙ্কর যে নিজেও সুখী হতে পারে না! কেন এমন করে অনন্যসাধারণ করে তুলেছে তাকে তার সৃষ্টিকর্তা কে জানে! সৃষ্টিকর্তার কোন অভিলাষ সে পূর্ণ করবে এই জীবন দিয়ে? এই জীবন কি তার সৃষ্টিকর্তার কাছে এতই মূল্যবান। দীপঙ্করের হাসি পেল। এত কথাও, এত অদ্ভূত কথাও সে ভাবতে পারে। তবে কী সে উন্মাদ? সে কি উন্মাদ হয়ে যাবে?
হঠাৎ রাস্তার মোড়ের কাছে আসতেই দীপঙ্করের খেয়াল হলো!
যদি এখানে এসে থাকে সতী! যদি শেষ পর্যন্ত কোনও উপায় না-পেয়ে এখানে, এই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডেই এসে থাকে।
দীপঙ্কর বললে—বাঁদিকে চলো, প্রিয়নাথ মল্লিক রোড—
রঘু!
রঘু সেই লক্ষ্মীদির চাকর। লক্ষ্মীদির চাকর এখানে কেন!
দীপঙ্কর বললে—তুই এখানে? তোর নাম রঘু না?
রঘু বললে—আজ্ঞে হ্যাঁ, ছোটদিদিমণি যে এখানে এসেছে, আমাকে বসিয়ে রেখে ভেতরে এই বাড়িতে ঢুকেছে—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—এখানে কখন এসেছে ছোটদিদিমণি?
রঘু বললে—সেই দুপুরবেলা!
—দুপুরবেলা থেকে এখানে বসে আছিস?
রঘু বললে—হ্যাঁ, ছোটদিদিমণি আমাকে যে এখানে বসে থাকতে বলে গেছে, বসে বসে আমার পা ভেরে গেছে—এখনও আসছে না—
দীপঙ্কর আর দাঁড়াল না। তাড়াতাড়ি গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকলো। সন্ধ্যে নেমে এসেছে বাগানে। একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। প্যাসেজের আলোও জ্বলেনি। ব্ল্যাক- আউটের রাতে আলো জ্বলবেও না রাত্রে। তাড়াতাড়ি প্যাসেজটা পেরিয়ে বাঁদিকে রোয়াকের সিঁড়ির কাছে যেতেই হঠাৎ একেবারে সতীর শাশুড়ীর মুখোমুখি হয়ে গেল। সতীর শাশুড়ীর উগ্রমূর্তি। পাশেই আর একজন কে মোটা-সোটা চেহারার মহিলা। দুজন কনস্টেবল একজন পুলিস ইন্সপেক্টরও বসে রয়েছে।
—এই যে!
—হঠাৎ সামনে দীপঙ্করকে দেখেই যেন নয়নরঞ্জিনী দাসীর মূর্তিটা আরো উগ্র হয়ে উঠলো। বললেন—এসে গেছ? তাই ভাবছিলুম, আমি এক মিনিট বাড়ি থেকে বেরিয়েছি আর সঙ্গে সঙ্গে ফাঁক পেয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে—এর পেছনে তো কারো মতলব আছে—মেয়ে মানুষের বুদ্ধিতে তো এতখানি হয় না। তা এসে গেছ ভালোই হয়েছে—
দীপঙ্কর উদ্গ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলে—কী হয়েছে? সতী এখানে এসেছে শুনলুম?
—সতী এসেছে, আর তুমি জানো না? বলি ভেবেছ আমি কিছু শুনিনি? তোমাদের ঘোষাল আমাকে সব বলে গেছে—। ছি ছি ছি, লজ্জার মাথা খেয়ে আবার এখানে এসেছ মুখ দেখাতে?
দীপঙ্কর বললে—আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন?
—তা তো বুঝতেই পারবে না, পরের বাড়ির বউকে নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় জ্ঞান তো বেশ টনটনে থাকে। তখন তো বেশ বুঝতে পেরেছিলে? তা পুলিসে যদি ধরলোই তো ছেড়ে দিলে কেন হারামজাদারা? হাজতে পুরে রাখতে পারলে না?
দারোগা সাহেব কিছুই বুঝতে পারছিলেন না এ-সব কথার। দুজন কনস্টেবলও চুপচাপ দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
ন’দিদি এতক্ষণে কথা বললে। জিজ্ঞেস করলে—এ কে রে নয়ন!
মা-মণি সে-কথার উত্তর না দিয়ে বললে—তা সে সব যা হোক, এখন এসে ভালোই করেছ বাছা। চলো, ওপরে চলো, তোমার সেই তিনি এখন মুর্ছো গেছেন, তাকে নিয়ে যাও তুমি এখান থেকে—অমন বউকে আমার দরকার নেই—চলো চলো—
দীপঙ্কর তখনও বুঝতে পারছিল না। বললে—কিন্তু কী হয়েছে সতীর?
মা-মণি বললেন—সে-সব বাছা তুমি নিজের চোখেই দেখবে চলো না, অত কথা বলতে পারিনে আমি তোমার সঙ্গে—চলো—
বলে মা-মণি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন—এসো, আমার সঙ্গে ওপরে এসো, নবাব-নন্দিনীকে তোমার যেখানে খুশী নিয়ে যাও, সেখানে মূর্ছো যাক, ভিরমি যাক, আমি দেখতে যাচ্ছিনে—এসো—
তারপর ন’দিদির দিকে ফিরে বললেন—এসো ন’দিদি– দীপঙ্করও পেছন-পেছন চলতে লাগলো।