এক শুভাকাঙ্ক্ষীর কিছু কথা
এক যাদুঘরের যাদুকর
খান্না সিনেমার পেছন থেকে বেরিয়ে, রাস্তাটি ধরে, উত্তরমুখী শ্যামবাজার পাঁচমাথার দিকে এগিয়ে চলেছেন সদ্য পঁচানব্বুইয়ে পা রাখা এক তরুণ। শিরদাঁড়া খাড়া রেখে, আকাশের দিকে মাথা তুলে তিনি চলেছেন। হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ। ছিপছিপে চেহারা। ধীর পদক্ষেপ। ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছেন মানুষটি। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। সাধারণ বাঙালি পুরুষদের চেয়ে উচ্চতায়ও মানুষটি ঈর্ষণীয়। বাঁ পাশের দোকানগুলো থেকে কেউ কেউ এগিয়ে এসে তাঁকে হাত তুলে প্রণাম জানাচ্ছেন। কেউ বা পা ছুঁয়ে, কেউ আবার হাস্যমুখে মানুষটির কুশল সংবাদ জেনে নিতে বিনীত,— ‘নকুদা কেমন আছেন! ভালো তো?!’
মানুষটির মুখে প্রসন্ন হাসি, সংক্ষিপ্ত উত্তর, হ্যাঁ ভাই’!
উত্তর কলকাতার এই এলাকায় নকুবাবু নামেই ইনি অধিক পরিচিত। শুধু পরিচিতই নয়, এই এলাকার এই মানুষটি একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। কীসের জন্য ওঁর এই জনপ্রিয়তা?
ইনি একজন সংগ্রাহক। পুরোনো পৃথিবীর নানান দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র খুঁজে পেতে নিয়ে তাঁর সংগ্রহশালাটি সাজিয়েছেন। সে আজকের কথা নয়। ছোট্টবেলা থেকেই তাঁকে এই নেশাটি ধরিয়ে দিয়েছিল ছোটো ছোটো নানা আকারের কিছু পাথর, নুড়ি। তারপরে আর এই মানুষটিকে পেছন ফিরে চাইতে হয়নি। চাইতে হয়নি এই কারণে যে, মানুষটির মধ্যে ছিল অনন্ত মনোবল। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে চলেছে সমান্তরালভাবে জীবনসংগ্রাম। সে-কথায় পরে আসছি।
নকুবাবুর ভালো নাম সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায়। বাবা পশুপতি চট্টোপাধ্যায়ের ছিল বাড়িঘর তৈরির ব্যাবসা। কলকাতা শহরে জায়গাজমি কিনে বাড়ি তৈরি করে অন্যকে বিক্রি করে দেওয়া। এই চট্টোপাধ্যায়দের আদি বাড়ি ছিল হুগলি জেলার হরিপাল অঞ্চলে। সেই হরিপাল থেকে সুশীলবাবুর পূর্বপুরুষরা কলকাতার গ্রে স্ট্রিট অঞ্চলে এসে বসবাস করতে থাকেন। সেটা সুশীলবাবুর জন্মের অনেক আগের কথা। এর আগেও, আরও একটা ইতিহাস আছে। সেটা সুশীলবাবুর কথা থেকেই জেনে নেওয়া যাক: ‘আমাদের কুলপঞ্জি অনুযায়ী যতটুকু জানা যায়— তা থেকে বলতে পারি: একাদশ-দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা উত্তর ভারতের কান্যকুব্জ না কনৌজ থেকে পূর্ববঙ্গে আসেন। তখন নাকি গৌরবঙ্গে ব্রাহ্মণদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। অবশ্য, এ নিয়ে অন্য অনেক মতভেদও আছে…!’ সে যাই হোক, এই শ্যাম মিত্র লেনের বাড়িটা ১৯২৪ সালে সুশীলবাবুর বাবা তৈরি করেছিলেন বিক্রি করার জন্যেই। অর্থাৎ ব্যাবসার উদ্দেশ্যেই। কিন্তু সে-সময় সুশীলবাবুদের বাস করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো বাড়ি ছিল না। তাই সুশীলবাবুর মা, ঊষাঙ্গিনী দেবীর জেদাজেদিতেই এই বাড়িটা বসবাসের জন্য রেখে দিতে বাধ্য হন সুশীলবাবুর বাবা।
সুশীলবাবুর সেই স্বপ্নের জাদুঘরটি এখন এই বাড়ির দোতলার একটি ঘর। সারা বিশ্ব যেন এখানে এসে মিলিত হয়েছে। চোখে না দেখলে বিশাস করা যায় না। একটি ঘরের মধ্যেই সুশীলবাবু গোটা বিশ্বটাকে ধরে রেখেছেন। কী নেই ঘরটিতে? প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মুভি ক্যামেরা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মেসেজ রিসিভার। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে যে ইংরেজ দলটি ভারতবর্ষে এসেছিল, তারা যে কলিং বেল ব্যবহার করত, সেটি পর্যন্ত সুশীলবাবুর জাদুঘর আলো করে ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তা ছাড়া নানা যুগের, নানা কালের, নানা বিস্ময়কর দুষ্প্রাপ্য জিনিসপত্র এখানে প্রতিনিধিত্ব করছে। এই জাদুঘরে প্রত্যেকটি বস্তু সুশীলবাবুর কাছে, সুশীলবাবুর মতে ভালোবাসা পেলে জড়পদার্থের মধ্যেও প্রাণের সঞ্চার হতে পারে।
সুশীলবাবুর কথা কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যায় না। তিনি শুধু পুরোনো দিনের জিনিসপত্রেরই সংগ্রাহক নন। শব্দ নিয়ে, শব্দতরঙ্গ নিয়ে, চুম্বক নিয়ে, চুম্বক-তরঙ্গ নিয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু ভাবনাচিন্তা আছে। অনেকে তাঁকে বলে থাকেন, ‘অতীতচারী’। কথাটা মিথ্যে নয়। পুরোনো কলকাতা, পুরোনো কলকাতার সিনেমা-থিয়েটার হল, পুরোনো কলকাতার বাজারদর— কীভাবে তা ভেঙে যাচ্ছে, ভেঙে ফেলা হচ্ছে, বদলাচ্ছে— ইতিহাসের এই মর্মান্তিক বিলুপ্তি তাঁকে বেদনা দেয়। অগ্রগতির নামে যা ধ্বংসাত্মক, যা সমাজকে দূষিত করে তুলেছে, এই মানুষটি সেটাকে মেনে নিতে নারাজ।
১৯২৪ সালে সুশীলবাবুর বাবা যখন বাড়িটি করেন, ঠিক তার দু’বছর পরে, অর্থাৎ ১৯২৬ সালের ১৮ নভেম্বর সুশীলবাবুর জন্ম। স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে— সায়েন্স নিয়ে বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক হন। তারপর শুধু কাজ আর কাজ। অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে দেশভ্রমণ, নিজের দেশকে চেনা, বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে আসা, মানুষকে ভালোবাসা।