একি অপূর্ব প্রেম
জন্মভূমির টানে দেশে গিয়েছিলাম।
সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে দেশছাড়া। গ্রামছাড়া।
ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করব, বড় করব এই চিন্তা করেই বাবা দেশের বিশাল জায়গা জমি, ঘরবাড়ী সব অল্পদামে বিক্রী করে চলে আসেন শহরে।
তারপর আর কি। দেখতে দেখতে যুদ্ধ থেমেছে, ভারত স্বাধীন হয়েছে। বছরগুলো ঝরা পাতার মত খসে খসে পড়েছে।
আমি শহরে থেকে বড় হয়েছি, লেখাপড়া শিখেছি। কলকাতার বড় সরকারী অফিসে চাকরী করেছি। আর এখন রিটায়ার করার পর কেবল ঘুরে বেড়ানোর কাজ নিয়েছি।
ভবঘুরে জীবন।
কেবল প্রকৃতির কোলে বসে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে বেড়ান। উপভোগ করা শ্যামলী মায়ের অবদান, আর ক্যামেরা বন্দী করে রাখা প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য।
নিজের খামখেয়ালির এই ঝক্কি বাড়ীর কাউকে পোয়াতে হয় না। মাসকাবারি পেনশনের টাকাটা সবটাই তুলে দিই বাড়ীর হাতে। ফলে বাড়ীর সবাই খুশী। আর আমি হাত খরচের জন্য, এই ঘুরে বেড়ানোর জন্য সামান্য কিছু নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কখনও রাজস্থানের উদয়পুরে, কখনও মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহ, কখনও সিমলা, কখনও জম্মু কাশ্মীর বা হরিদ্বার হৃষিকেশ ইত্যাদি।
তা রিটায়ারের পর বারোটা বছরে কত না দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ালাম। কত ছবি তুললাম। কত নিঝরিনীর ঝরে যাওয়া জলের ছবি, পাহাড় পর্বতে সূৰ্য্য ওঠার বা সূর্য ডোবার দৃশ্য। মন্দির বা দেবস্থানের পুরোনো সেই সব টেরাকোটার ছবি তুললাম। কিন্তু তবু যেন মন আর ভরে না। রাতে ঘুম হয় না। কেবলই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ট্রেনে চেপে কোথায় যেন চলে যাই। কোথায় নামি জানি না। কোন কোন দিন কলকাতা বা দিল্লীর ফাইন আর্টস একাডেমীতে নিজের তোলা ছবি খুঁজে বেড়াই।
দিল্লী থেকে ফিরতি পথে সত্যি একদিন একটা নির্জন ছোট্ট স্টেশনে নেমে পড়লাম। কর্ড লাইনের পোড়াবাজার।
তারপর আর কি। লেভেল ক্রসিংয়ের ওধারে গিয়ে বাঁয়ের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে থাকলাম গ্রামের দিকে।
সামনেই একটা ছোট্ট কাঠের পুল। সাঁকো।
কাঠের পুলটা পেরিয়ে সামনে সরু রাস্তা। ধানক্ষেত।
ধানক্ষেতের আল ধরে এগোলে মেঠো বড় রাস্তা। এবার হাঁটতে থাকি উত্তরমুখ করে।
ওই ত দূরে মাঠ পেরিয়ে শ্যামল বনানী ঘিরে গ্রামটা দেখা যাচ্ছে–যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
পথ চলতে চলতে দেখি কোন চাষী এই সাত সকালে কেমন করে ডোঙ্গায় পা দিয়ে জল হেঁচছে। আলু ক্ষেতে জল দিচ্ছে। কোথাওবা কোনো চাষী মাঠে লাঙ্গল দিচ্ছে আর গরুর পিঠে ছড়ি মারছে আর মুখে আউরিয়ে যাচ্ছে হ্যাট হ্যাট হ্যাট।
ও দিককার ওই গ্রামটার নাম যেন কি–হ্যাঁ ধেমুয়া। লোকে ধেমো বলেই ডাকে। একটু এগোলেই একটা উঁচুমত ঢিবি রাস্তার ধারে। ঢিবিটার ওপর ক’টা লোক উনুনে খেজুর পাতা পুরে দিয়ে বড় বড় হাঁড়িতে জাল দিচ্ছে। হ্যাঁ, খেজুর রস জাল দিয়ে ওরা গুড় তৈরী করছে।–ঝোলা গুড়, পাটালি গুড়।
ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে কতবারই না ওই ঢিবিতে উঠে-ওদের গুড় তৈরী করা দেখেছি। তখন ওদের উনুনের পাশে আমরা ২/৫ জন যারাই বসে থাকতাম তাদের হাতে ওরা ওই গরম গুড় ধরিয়ে চাখতে বলত। কি রে ধোঁ গন্ধ হয়নি তো?
আমরা গুড় চেখে বলতাম না চাচা, ধোঁ গন্ধ হয়নি। খুব ভাল টেস্ট হয়েছে।
রহিম চাচার মুখটা জ্বল জ্বল করে উঠত। যাক এত পরিশ্রম তাহলে সার্থক। এবার তবে কলসীতে ভরে ফেলা যাক। এসব স্মৃতি কথা আজও যেন চোখের সামনে ভাসছে।
ঢিবিটায় উঠতে ইচ্ছা করছিল।
কিন্তু ওখানে গেলে এই ৫০ সাল বাদে ওদের কেউ কি আমাকে চিনতে পারবে! হয়ত সে রহিম চাচাই নেই, মরে গেছে। যাকগে আর খানিকটা হাঁটলেই নিজের গ্রামে পৌঁছে যাব। ওই ত দূরে দেখা যাচ্ছে সেই ছায়া সুনিবিড় তাল, সুপুরি, আম গাছে ঘেরা সেই আমার গ্রাম, আমার জন্মভূমি মাকালপুর। টিনের ছাউনী দেওয়া ঘরটা এখান থেকে ভালই দেখা যাচ্ছে।
বাবা শঙ্কর প্রসাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, স্বাধীনতার ২/৫ বছর আগে দেশের সব বাড়ী জমি গোবর্ধন রায়কে বিক্রী কোবলা করে দিয়ে শহরে চলে আসেন। আমার তখন কতই বা বয়স দশ বার বছর হবে।
বাবা মায়ের মুখেই শুনেছি দেশের বাড়ী ঘর বিক্রী করলেও মা কালীর মন্দির আর মা মনসার ঢিবিটা বিক্রী করেননি। সেই স্মৃতি ঘেরা রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে এলাম কতটা পথ।
দু পাশে ধানের জমি। সবুজ হলদে গাছে সোনালী ধানের শীষ ধরেছে। হাওয়ায় দুলছে শীষগুলো। আগে এই সব মাঠে একবারই ধান চাষ হোত। কেবল মাত্র বর্ষার জলে। আর এখন পাম্পের দৌলতে জল তুলে সেচ লাগিয়ে বছরে ধান তুলছে তিনবার। তবু ধান চালের আকাল আর গেল না। বাজারে আলুর দাম দশ, চাল দশ, বার, পনের টাকা কেজি।
গরীব চাষীদের যে দুরবস্থা আগেও ছিল এখনও তাই রয়ে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়লাম বারাসাতের মাঠে।
ছোট্ট বেলায় এখানেই সবাই মিলে ফুটবল খেলতাম, ঘুড়ি ওড়াতাম, হাডু-ডু প্রতিযোগিতায় নাম দিতাম।
বাঁ পাশে নতুন পুকুর।
পুকুরের পাড়টা বড় উঁচু। পাড়ে তখনও যেমন কুল, বাবলা, বেল গাছ, রাম তুলসী, আশ শ্যাওড়া ভেরান্ডা গাছে ভৰ্ত্তি থাকত আজও তেমনি আছে।
ছোটবেলায় নতুন পুকুরের পাড়ে উঠতে বেশ মজা লাগত। যেন পাহাড়ে উঠছি। তখন নতুন পুকুরের পাড়ে একটা বিশাল কদবেলের গাছ ছিল। এখন আর নেই।
এক সাধুবাবার মাথায় ছিল বিরাট জটা জুটো।হিমালয়েসিদ্ধিলাভ করে এই কদবেল তলায় এসে নিশ্চিন্তে আস্তানা গেড়ে ছিলেন। পরে উঠে যান ত্রিবেণীতে। সেখানে কালীনাথ আশ্রম স্থাপন করেন।
সাধুবাবা এখানে এসে মাটিতে একটা চৌকো গৰ্ত্তকরে যজ্ঞ করতে শুরু করেন। হোম যজ্ঞ শেষ হলে পরে সন্ধ্যার প্রাক্কালে একবারই অন্ন গ্রহণ করতেন। অন্ন গ্রহণের পূর্বে সাধুবাবা একটা খাম্বাজি হাঁক ছেড়ে ডাকতেন–আয় আয় শিবা আয়। আয় শিবা আয় আয়। তারপর কোথা থেকে দলে দলে সব শেয়ালেরা বন থেকে বেরিয়ে একটা সাড়া দিত–হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া। পরে সবাই এসে সাধুবাবার যজ্ঞবেদী ঘিরে জড় হয়ে দাঁড়াত।
গ্রামের জমিদারবাবু সাধুবাবার অলৌকিক ক্রিয়া কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে সাধুবাবার জন্য একটা পাকা যজ্ঞবেদী বানিয়ে দেন। সেই যজ্ঞবেদীটা এখনও রয়েছে।
শিয়ালেরা এসে দাঁড়ালে পর সাধুবাবা গাওয়া ঘিয়ে তৈরী করা লুচি আর হালুয়া দিয়ে শিবদের সেবা করতেন। পরে ওরা চলে গেলে সাধুবাবা স্বপাকে রান্না করে অনুগ্রহণ করতেন।
উঁকি দিয়ে দেখতে ইচ্ছা করল বেদীটা। কিন্তু যা জঙ্গল ঢুকতেই ভয় করতে লাগল। যজ্ঞবেদীর চারপাশে বাবলা আর রামতুলসীর বন, ঝোপঝাড়।।
নতুন পুকুরের সেই নিথর সবুজ জলটা দেখা যাচ্ছে ওপর থেকে। আজও তেমনি চক চক করছে। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিরে কেমন আছিস। বড় রোদুর উঠছে। আয় আমার জলে ডুব দিয়ে স্নান করে একটু শীতল হয়ে যা।
পাড়ের ওদিকটা দিয়ে নেমে জলের কিনারায় পৌঁছালাম। জুতো খুলে পুকুরের জলে নেমে হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। আঃ কি ঠাণ্ডা জল! পায়ের নীচে সাদা, হলুদ বালি। একটুকুও কাদা নেই। পুকুরের এদিক ওদিকে শ্যাপলা শালুক পদ্মে ভর্তি। আর আছে কলমী লতা। তাতে নীল রঙের ফুল ফুটেছে।
পাড়ের উত্তর-পূর্ব কোণে দেখা যাচ্ছে একটা টালির ঘর। আগে তো এটা ছিল না। কেউ বা হয়তো জবর দখল করে কুঁড়েবানিয়েছে।
মাঝ পুকুরে একটা বড় রাজহাঁস চরে বেড়াচ্ছে।
একটা মেয়েকে দেখা গেল। সাদা থান পরা। মেয়েটা ডাকছে আয় আয় চই চই। দেখলাম মেয়েটার ডাকে সাড়া দিয়ে প্যাক প্যাক শব্দ করতে করতে মাঝ পুকুর থেকে ডাঙায় উঠে গেল রাজহাঁসটা।
হাতে বায়নাকুলার। সেটাকে চোখে লাগিয়ে দেখতে লাগলাম। রাজহাঁসটা জল থেকে উঠতেই মেয়েটা ওর গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে কত না আদর করল। নিজের শাড়ীর আঁচল দিয়ে হাঁসের পিঠ ও পেটটা মুছিয়ে দিল। হাঁসটা গলা লম্বা করে মেয়েটার মুখে মুখ দিয়ে আদর করতে লাগল। মেয়েটার হাতে একটা থালা। থালায় করে হাঁসটার জন্য কি যেন নিয়ে এসেছিল। হাঁসটা তার হলুদ ঠোঁট দিয়ে মহানন্দে সেগুলো সব খেয়ে নিল। খাওয়া শেষ হতে মেয়েটা হাঁসটাকে কোলে করে টালির ঘরে ঢুকে গেল।
দৃশ্যটা অপূর্ব লাগল। যাতে ভুলতে না পারি তার জন্য টেলিলেন্স দিয়ে সবটাই ক্যামেরায় বন্দী করলাম। ..
এবার পাড় থেকে নেমে ওদিককার রাস্তা ধরে গ্রামের সেই বিক্রী করে দেওয়া বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
ওইতো দেখা যাচ্ছে সেই পটুল গাছটা।
একটা মিষ্টি আমের গাছ। মা নাম দিয়েছিল পটুল। ছোট্ট ছোট্ট হলুদ রঙের পেয়ারাফুলির মত আম অসংখ্য ঝুলত আমের সময়। এখনও হয় কি না জানি না। কি মিষ্টি সেই আম!
কিন্তু ওদিককার সেই আম বাগানটা তো দেখছি না।
বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। হায় ভগবান একি জন্মভূমি দেখতে এলাম! শৈশবের স্মৃতি ঘেরা সে সব ঘরবাড়ী আমবাগান এ সব কই। আমবাগানের বদলে ওখানে হাল চালাচ্ছে ক’জন চাষী। মনে পড়ে শৈশবের কত স্মৃতি। ছোট্টবেলায় ঝড় উঠলেই ওই আমবাগানে ছুটতাম আম কুড়াতে। টিপ টপ করে পাকা আম পড়ত এ গাছ ও গাছ থেকে। গ্রামের কত ছেলে মেয়েই না এসে কোঁচড় ভৰ্ত্তি করে আম কুড়োত, বাড়ী নিয়ে যেত। তখন কেউ বারণ করত না।
তারপর গ্রামে তো এলাম।
কিন্তু কে আর আমায় চিনবে। আর আমিই বা কাকে খুঁজে পাব যার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলব।
পটুলের আম তলাতেই ছিল মা মনসার ঢিবি। ঢিবিটা আজও আছে। একটা বিশাল মনসাগাছ হয়ে রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর সেই প্রাচীনতম গাছের বংশধরের একটা এই ঢিবিতে আজও বিদ্যমান।
একটু দাঁড়িয়ে মা মনসাকে স্মরণ করে প্রণাম করলাম।
এবার সামনের আলুক্ষেতটা পেরোলেই টিনের সেই ঘরটা। যেটা দূরে রেললাইন থেকে নজরে আসছিল। ওটাই আমাদের পৈতৃক বসত বাটি। এত বছর পরেও ও ঘরটার কোন পরিবর্তন হয়নি কেন কে জানে।
ওপাশে দাঁড়িয়ে মা কালীর মন্দির।।
শিব কালী একই ঘরে প্রতিষ্ঠিত। কি জানি এখনও পূজো হয় কি। মন্দিরের মাথার চুড়োতে গজিয়ে উঠেছে বিশাল বটবৃক্ষ। গাছের শেকড় বাকড় দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে মন্দিরটাকে জাপটে ধরে আছে।
মন্দিরে একটা দরজার পাল্লা নেই।
দেখলাম মায়ের মূৰ্ত্তিটা, আর পাশে শিবলিঙ্গ এখনও বিরাজিত। দু’চারটে জবা ফুলও চড়ান রয়েছে মায়ের পায়ে।
মাকে স্মরণ করে প্রণাম করে উঠতেই দেখি এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা বলছেন কে বাবা তুমি। তোমাকে তো চিনলাম না।
বললাম আমার নাম অজিত। ডাক নাম রেণু। বাবা মার কাছে শুনেছি এটাই নাকি আমার জন্মস্থান। কতদিন আগে বাবা এ সব বিক্রীবাটা করে চলে যান। তা জন্মভূমি দেখার সময় পাইনি এতদিন। তাই একবার দেখতে এলাম। তা মা আপনি?
ও মা! তুমিই রেণু। এস বাবা এস। ঘরে এস। আমি তোমার বড় জেঠিমা হই। বড় কর্তা ছোট কর্তা দুজনেই গত হয়েছে। পড়ে আছি আমরা দুই বুড়ী আর নাতি নাতনীরা। এসো বসো।
প্রণাম করলাম জেঠিমাকে। বুঝলাম ইনিই গোবর্ধন জেঠার স্ত্রী। এনাদের হাতেই বাবা সব তুলে দিয়ে গেছেন শুধু ঠাকুর থান দুটি ছাড়া।
বাড়িতে বসে জলযোগ করতে করতে দেখলাম ছোটবেলার দেখা সেই সব ঘর বাড়ীর কোনটার চিহ্ন নেই। কোথায় সেই বিশাল উঠোন। কোথায় সেই কলতলা, টিউবওয়েল। সেই খড়ের চালের বড় ঘর। কোথায়ই বা সেই সব মরাই, চেঁকিশাল, পায়রা ঘর। উঠোনের সেই বিরাট ক্রোটনগাছটাও আর নেই। এ সবের বদলে ছোট্ট এক চিলতে উঠোনের এপাশে ওপাশে খুপরি খুপরি ঘর বাড়ী, রান্নাঘর বাথরুম।
বড় জেঠিমা, ছোট জেঠিমা দুজনেই এসে বলল তা এ বেলা খেয়ে যাচ্ছ তো? দুটি শাক ভাত খেয়ে যাও। এসেছ যখন দুদিন থেকে গেলেও কোন অসুবিধা হবে না।।
জেঠিমাদের প্রথম অনুরোধে জলযোগটা সারলাম। আর বললাম জেঠিমা থাকা, খাওয়ার জন্য চিন্তা করবেন না। এই তো বেশ, মিষ্টি খেলাম। এবার উঠব। গ্রামটা একটু ঘুরে দেখব। কেউ আমাকে চিনতে পারে কিনা। পরে একদিন ফের আসব। আচ্ছা জেঠিমা বাবার মুখে শুনেছি যোগিন কাকা বলে একজন আমাদের সব জমিজমা দেখা শোনা করত। তার দেখা পাব কোথায় বলতে পারেন?
ও তুমি যোগিনের কথা বলছ। হ্যাঁ ও তো এখনও বেঁচেই আছে। তবে খুবই বুড়ো হয়ে গেছে। ওর। দুই বাপ বেটিতে এখন নতুন পুকুরের ওই পাড়ে একটা ঘর বেঁধে বাস করছে। তা যাও না, গেলেই দেখা পাবে যোগিনের।
তোমার বাবার ডান হাত ছিল ওই যযাগিন। ক্ষেত খামার চাষবাস একাই সামলাত বয়েসকালে। এখন আর কিছুই পারে না। তারপর ওর মেয়েটা বিধবা হবার পর আরও ভেঙে পড়েছে। একটা ছেলে থাকলে বরং বাপকে দেখত।
ঠিক আছে আজ আসি জেঠিমা। দেখি যোগিন কাকার সঙ্গে দেখা হয় কিনা।
দুঃখ বেদনা আর হতাশা নিয়ে জন্মভূমি দেখার সখ মিটিয়ে গেলাম আবার নতুন পুকুরের পাড়ে।
পুকুরের স্বচ্ছ জলে যোগিন কাকার টালির ঘরের ছায়া পড়েছে। জল তরঙ্গে কুঁড়ে ঘরের ছায়া তরঙ্গায়িত হচ্ছে। আর দুলছে আমার মন। আবার কি দেখব শুভ্র বসনা থান পরা সেই যুবতী কন্যাকে। আর সেই লম্বা গ্রীবাধারী রাজহংসটাকে।
ডাকলাম দূর থেকে।
যোগিন কাকা বাড়ী আছো? যোগিন কাকা।
–কে? কে ডাকে বাইরে। দেখত মা শ্যামলী। শ্যামলী এল। শ্যামলীর কোলে সেই বড় রাজহাঁসটা। বলল কাকে চান?.
বললাম যোগিন কাকাকে। বলো শঙ্কর বাবুর ছেলে রেণু এসেছে উত্তরপাড়া থেকে। তোমায় ডাকছে।
আর কিছু বলতে হলো না। দড়ির একটা খাঁটিয়ায় শুয়ে ছিল যোগিন কাকা। পাশে রেডিও বাজছিল।
আমার কথা শুনতে পেয়ে নিজেই উঠে এসে বলল কে এসেছিস? রেণু এসেছিস? আয় বাবা ভেতরে আয়। তারপর খবর কি বল। কেমন আছিস তোরা সব। বাপরে কত বড় হয়েছিস। তারপর বাবা মা সব কে কেমন আছে বল। আমার কথা তোদের এখনও মনে আছে। দেখছি।
বসলাম দড়ির খাটিয়াতে।
বললাম কি করছিলে যোগিন কাকা?
যোগিন কাকা বলল–কি আর করব খবর শুনছিলাম আর কি।
আমি বললাম–তুমি কেমন আছো বলো। কিন্তু তুমি তো ওদিককার তেঁতুল তলায় মনসা টিবির কাছে থাকতো তা এখানে উঠে এলে কি করে?
যোগিন কাকা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল সে অনেক কথা। তোরা চলে যাবার পর গোবর্ধন বাবুরা আমার ওই বসত ভিটেটুকুও কেড়ে নিল। জোর করে ঘর বাড়ী ভেঙ্গে দিল। ওই ভিটেতে ওরা আলুক্ষেত করেছে। আর তোদের সেই সখের আমবাগানটা, সেটা বিক্রী করে দিয়ে গাছ কাটিয়ে চাষবাস করছে অন্য লোক। গ্রাম পঞ্চায়েত ওদের হাতে। অনেক কষ্টে গ্রামের আর দশজনার সুপারিশে নতুন পুকুরের পাড়ে মাথা গোঁজবার এই জমিটুকু পেয়েছি।
তারপর জিজ্ঞাসা করলাম তা এটা কে হয়, তোমার মেয়ে?
–হাঁ, ওটা আমার শ্যামলী মা। বড় দুঃখী।
ছেলেবেলাতেই ওর মা মারা যায়। তারপর একটু ডাগর হতেই একটা ভাল পাত্র দেখে ওর বিয়ে দিয়েছিলাম। ঘরজামাই করেছিলাম ছেলেটাকে। দুটিতে কি ভাবইনা ছিল। কি মিল মিশ। সব সময় আনন্দে আর স্ফূৰ্ত্তিতে ডগমগ থাকত দুজনে।
যোগিন কাকা বলতে লাগল–সারাদিন ক্ষেতে খামারে, মাঠে কত কাজই না করত। ধান বোনা, ধান কাটা, ধান ঝাড়া এ সবই করত। সখ করে ওরা দুটো রাজহাঁস পুষেছিল। কিন্তু অতসুখ সইল না অভাগীর কপালে। ক্ষেতে কাজ করতে করতে কালকেউটেতে কাটল জামাইটাকে। বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটা। জামাইকে বাঁচাতে রোজা, হাসপাতাল সবই করেছিলাম। কিন্তু বাঁচলো না। যোগিন কাকা কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখের জল মুছল।
এর অল্প ক’দিন পরেই শ্যামলীর রাজহাঁসটাও মারা গেল।শ্যামলী আরও ভেঙে পড়ল। তারপর কত বার বলেছি ওকে। ওসব থান পরা ছাড়। রঙীন পর। মনটাকে শক্ত কর। বললে আমি তোর আবার বিয়ের চেষ্টা করব।–তা মেয়ে আমার মোটেই রাজী নয়।
একবার মেলা দেখতে গিয়ে দুজনে একটা ছবি উঠিয়েছিল। মেয়ের আমার, ওই জামাইয়ের ছবিটাই সম্বল। এই সবই খবর। তা রেণু বাবু এতদিন পরে জন্মভিটে দেখার কথা মনে পড়ল। দেরী করে ফেলেছিস বাবা, বড় দেরী করে ফেলেছিস। এ সব জমি জায়গা বিক্রী বাটা না করে যদি এখানে থেকেই লেখাপড়া করতিস তবে দেশের বাড়ীর এই জমির এ হাল হোতনা। এখন এখানকার জমির দাম কত হয়েছে জানিস। পাঁচ হাজার টাকা করে কাঠা। আর তোর বাবা সব কিছু ঘুচিয়ে অকারণ চলে গেল।
বললাম যোগিন কাকা এবার তুমি থামো। আমি আর কিছু শুনতে চাই না। আমি আমার স্বপ্নের, শৈশবের সেই জন্মভিটেটুকু দেখতে এসেছিলাম এই শেষ বয়সে। তা যা দেখলাম তাতে আমার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। এখন বুঝছি না এলেই ভাল করতাম।
শ্যামলী এল চা নিয়ে। বলল আপনার চা।
চায়ের প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম–শ্যামলী তোমার সঙ্গী সাথীটি কোথায় গেল?
শ্যামলী বুঝতে পারল না।
যোগিন কাকা বুঝিয়ে দিল। রেণু বলছে তোর রাজহাঁসের কথা। তাই তো বাবাজী?
ঠিক তাই।
শ্যামলী বলল–ওই যে আমার বিছানায় শুয়ে ঘুম মারছে। শ্যামলী গিয়ে রাজহাঁসটাকে কোলে তুনে নিল। হাঁসটা শ্যামলীর কোল থেকে নেমে ওর গলায় মুখে বুকে ঠোঁট ঠেকিয়ে চুম্ দিল।
ইত্যবসরে আমি স্বভাবসুলভ চরিত্রে শ্যামলীকে আর তার সঙ্গী সাথীকে ধরে রাখলাম আমার ক্যামেরায়। শ্যামলী আপত্তি কবেনি ছবি তোলাতে। হ্যাঁ সেই আলোকচিত্র গুলোরই বিশেষ একখানা ছবি এবার স্থিরচিত্র প্রদর্শনীতে প্রথম স্থান পেয়েছে। পেয়েছে আন্তর্জাতিক সম্মানও। What a mysterious love it is? সত্যি এ কি অপূর্ব প্রেম।
যোগিন কাকা বলেছিল শ্যামলী মা তার নিজের মানুষকে হারিয়ে শ্যামলকেনিয়ে (ওই রাজহাঁসকেনিয়ে) দিনরাত পড়ে আছে।কি বিচিত্র ওদের প্রেম।