৷৷ ৯ ৷৷
এদিন বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙল চন্দনের৷ তারপর অনেক্ষণ সে চুপচাপ বিছানাতে শুয়ে রইল৷ আসলে গতকাল বিকালে চন্দন একটা অবসাদ নিয়ে বিদিশা থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিল৷ সেই অবসাদ যেন তাকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে৷ একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা, কিন্তু তার জন্য সবাই তো দায়ী নয়, তবে তার জন্য হঠাৎই এতগুলো মানুষের জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে কেন? মানুষগুলোর ছোটো ছোটো আশাগুলোতে ছেদ পড়বে কেন? ওই যারা বিদিশা পানশালার ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করছিল তারা তো কেউই সমাজের কাছে, পৃথিবীর কাছে খুব বেশি কিছু দাবি করেনি৷ কেউ শুধু চেয়েছে তার ছেলেটার ভবিষ্যতে একটা চাকরি, কেউ স্বামীর সুস্থতা, কারো শুধু দাবি ছিল, তার পিতৃপুরুষের কবরের পাশে ঘুমিয়ে থাকার জন্য একখণ্ড মাটি৷ একটা দমকা ঝড় হঠাৎই যেন এসে এক লহমায় তাদের স্বপ্নগুলোকে তছনছ করে দিল৷
গতকাল বাড়ি ফিরে সন্ধ্যাবেলাতে লেখার টেবিলে এসে বসেছিল চন্দন৷ কিন্তু চার ঘণ্টা বসেও আধ পাতাও লিখতে পারেনি সে৷ কখনও নিশ্চুপভাবে বসে ভেবেছে বিদিশার কথা, আবার কখনও বা উঠে গিয়ে টেলিভিশন সেট চালু করে, একই খবর দেখে বিরক্ত হয়ে আবার ফিরে এসেছে তার লেখার টেবিলে৷ কোনো কিছুতেই আর মনোসংযোগ করতে পারছে না চন্দন৷ খালি ঘুরেফিরে তার মনে আসছে বিদিশার কথাই৷
বেলা দশটা নাগাদ টেবিলের ওপর রাখা তার মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায় বিছানা থেকে উঠল চন্দন৷
অঞ্জনদা, লেখক অঞ্জন বসাকের ফোন৷ চন্দন কলটা রিসিভ করতেই অঞ্জনদা তাকে সুপ্রভাত জানিয়ে বললেন, ‘তোমার সঙ্গে সেদিন দেখা হল ঠিকই, কিন্তু কথায় কথায় একটা ব্যাপার বলতে ভুলে গেছি৷’
‘কী কথা দাদা বলুন?’—চন্দন বলল৷
তিনি বললেন, ‘আমার পরিচিত এক ছোটো প্রকাশক একটা প্রেমের গল্প সংকলন প্রকাশ করতে চলেছেন৷ সম্পাদনার দায়িত্ব আমার৷ তুমি যদি বইটার জন্য একটা নতুন গল্প লিখে দিতে পারো ভালো হয়৷ পাঁচশো টাকা দেবে ওরা৷ আসলে তোমার মতো জনপ্রিয় লেখকরা যদি লেখা দাও তবে সেই প্রকাশক একটু লাভের মুখ দেখতে পারেন৷ ছোটো প্রকাশক, তোমার প্রাপ্য দেবার ক্ষমতা ওঁদের নেই৷’
চন্দন জবাব দিল, ‘আপনি যেখানে বলছেন সেখানে টাকাটা বড় কথা নয়৷ দেব৷ কবের মধ্যে দেব?’
অঞ্জনদা বললেন, ‘খুব তাড়া নেই, একমাসের মধ্যে দিলেই হবে৷’
এ কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘তোমার গলাটা এত ভারী শোনাচ্ছে কেন? রাত জেগে লিখে এইমাত্র উঠলে নাকি?
চন্দন জবাব দিল, ‘এইমাত্র ঘুম থেকে উঠলাম ঠিকই, কিন্তু রাত জেগে লিখিনি৷ কাল কলকাতা থেকে ফিরে লেখার টেবিলে অনেকক্ষণ বসেছিলাম ঠিকই৷ কিন্তু লিখতে পারিনি, কিছুতেই মনোসংযোগ করতে পারছি না৷’
চন্দনের কথাটা শুনে একটু চুপ করে থেকে অঞ্জনদা জানতে চাইলেন, ‘মনোসংযোগ করতে না পারার মতো কোনো কারণ ঘটেছে কি? তেমন কিছু ঘটে থাকলে তোমার যদি সমস্যা না হয় তবে আমাকে বলতে পারো৷ যদি আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করে উঠতে পারি তাই জানতে চাচ্ছি৷’
চন্দন বলল, ‘আপনাকে বলতে আমার কোনো সমস্যা নেই৷ আর মনোসংযোগ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আপনার পরামর্শ পেলে তো আমার ভালোই হয়৷’
এ কথা বলার পর চন্দন বলল ‘চাঁদনি চকের বিদিশা বারের নাম তো নিশ্চয়ই আপনি জেনেই গেছেন ওই বিদেশিনি যুবতী ধর্ষণ কাণ্ডের সঙ্গে এই পানশালার নাম যুক্ত হওয়ায়? যদিও এখনও প্রমাণিত হয়নি যে ওই বারেরই কেউ ব্যাপারটা ঘটিয়েছে৷’
অঞ্জন বসাক বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই পানশালার কথা তো এখন বিদেশিনি ধর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে লোকের চর্চার বিষয়৷ যদিও আমি নিজে কখনও সেখানে যাইনি৷’
চন্দন বলল, ‘আপনি আমাকে সেদিন ওই বিদিশাতেই ঢুকতে দেখেছিলেন৷ পানশালা নিয়ে লেখাটা লিখবার জন্য আমি বিদিশা বারেই কিছুদিন হল যাওয়া- আসা করছিলাম৷ ওর ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষালের সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্কও তৈরি হয়েছে৷ নানা তথ্য দিয়ে, নানা লোকের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে অনেক সাহায্যও করেছেন তিনি৷ আমার নিজের অজান্তেই ওই পানশালার সঙ্গে, ওখানকার কর্মীদের সঙ্গে কেমন যেন একটা মানসিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল৷ ধর্ষণ কাণ্ডে ওই পানশালার নাম জড়িয়ে যাওয়াতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক চাপের কারণে পুলিশের নির্দেশে সাময়িকভাবে ক’দিন ধরে বন্ধ রাখা হয়েছিল৷ এখন ওই বারের মালিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওই বার আর খুলবে না৷ তিনি তাঁর জায়গা অন্য একজনকে বিক্রি করে দিচ্ছেন শপিং মল তৈরি হবে বলে৷ হঠাৎই ওই বারের কর্মচারীদের জীবনে অনিশ্চয়তা নেমে এল! তারা খুবই সাধারণ মানুষ৷ ওই পানশালার ওপরে নির্ভর করেই এতদিন বেঁচে ছিলেন৷ আমি কিছুতেই ব্যাপারটাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না৷’
চন্দন তার কথা শেষ করতেই অঞ্জন বসাক বললেন, ‘আমাদের লেখকদের অনেকেরই অনেক সময় এ সমস্যা হয়৷ বিশেষত যারা একটু অনুভূতিপ্রবণ বা সংবেদনশীল৷ লেখার কাজের জন্য বা অন্য কাজের জন্য আমরা কখন যে কোন ঘটনা বা মানুষের সঙ্গে নিজের মনকে জড়িয়ে ফেলি তা বোঝাই যায় না৷ আমার নিজের জীবনেও কয়েকবার এ ঘটনা ঘটেছে৷ একবার পথশিশুদের নিয়ে একটা লেখা লিখতে অদ্ভুতভাবে এক ফুটপাতবাসী পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে গেছিলাম৷ আর সে জন্য পরবর্তীতে আমাকে বেশ কিছু বিড়ম্বনা ও মানসিক সমস্যার মধ্যেও পড়তে হয়েছিল৷ আমার মনে হয় তোমার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা এমনই৷’
চন্দন বলল, ‘একদম ঠিক তাই দাদা৷ ওই পানশালার সঙ্গে মানসিক ভাবে কদিনের মধ্যেই যে এতখানি ইনভলবড হয়ে গেছি তা বুঝতে পারিনি৷’
অঞ্জন বসাক বললেন, ‘কিন্তু এই মানসিক অস্থিরতা তোমাকে কাটিয়ে উঠতে হবে৷ নইলে তোমার লেখার ক্ষতি হবে৷ তোমাকে একটা কথা বলি, দুটো-তিনটে দিন তুমি টেলিভিশন, খবরের কাগজ এসব দেখো না৷ কারণ, যত তুমি ওসব জায়গাতে ওই পানশালার নাম দেখবে, শুনবে ততই তোমার মনে পড়ে যাবে ও জায়গার কথা৷ বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে সময় কাটাও৷ কোথাও ঘুরেও আসতে পারো৷ আশা করি এভাবে চললে কয়েকদিনের মধ্যেই মনের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে৷ তবে একটা কথা ভবিষ্যতে মনে রাখবে৷ হাঁসের মতো পাত্রের ভিতর থেকে জলের থেকে দুধটা আলাদা করে তুলে নেওয়া, অর্থাৎ লেখার জন্য প্রয়োজনীয় রসদটুকু সংগ্রহ করাই আমাদের কাজ৷ জলের গভীরে নামলে বা পাত্রের ভিতর প্রবেশ করলে সেখানে আটকে যাবার সম্ভাবনা থাকে৷’
চন্দন বলল, ‘আপনার এ কথাটা আমি ভবিষ্যতে মনে রাখব দাদা৷’
সাহিত্যিক অঞ্জন বসাক এরপর চন্দনের সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে আরও কয়েকটা কথা বলার পর ফোন ছেড়ে দিলেন৷
ফোন রাখার পর চন্দন মনে মনে ভাবল, বরাবরের মতো এবারও তাকে সৎ পরামর্শই দিলেন অঞ্জনদা৷ হ্যাঁ, এ ক’টা দিন সে টেলিভিশন, খবরের কাগজ থেকে নিজেকে দূরে রাখবে৷ বই পড়ে বা অন্য কোনো ভাবে নিজের মনকে ব্যাপারটা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবে৷
সেই মতো কলঘরে গিয়ে প্রাত্যহিক কাজ সেরে চা আর প্রাতরাশ সাঙ্গ করে একটা প্রিয় গল্প সংকলন নিয়ে বারান্দাতে গিয়ে বসল চন্দন৷ ছোট টেবিলটার ওপর দৈনিক সংবাদপত্রটা রাখা৷ কাগজটা দেখে চন্দনের মুহূর্তের জন্য একবার মনে হল, কাগজটা খুলে একবার সে দেখে যে মেয়েটার সুস্থতা সম্পর্কে বা বিদিশা বারের সম্বন্ধে কাগজে কোনো খবর ছাপা হয়েছে কি না? কিন্তু এর পরমুহূর্তেই চন্দন অঞ্জনদার পরামর্শ স্মরণ করে কাগজটা না খুলে একপাশে সরিয়ে রাখল৷ তারপর বইটা খুলে বসল৷ চন্দনের বাড়ির এই ছোটো বাগান আর প্রাচীর ঘেরা দক্ষিণের বারান্দাটা বেশ নিরিবিলি৷ বইটা খুলে বসল চন্দন৷ প্রথমে বইটাতে মন বসাতে চন্দনের যে মৃদু সমস্যা হল না তা নয়৷ বেশ কয়েকবার তার মনে পড়ল বিদিশার কথা, ভেসে উঠল অপূর্ব ঘোষালের মুখ৷ কিন্তু কয়েক পাতা ওলটাবার পরই ধীরে ধীরে সে ডুবে যেতে লাগল বইয়ের গল্পগুলোর মধ্যে৷ লেখকের কলমের জাদু যদি শক্তিশালী হয় তবে সে পাঠককে সব ভুলিয়ে দিতে পারে৷ চন্দন লেখক হলেও সে একজন পাঠক তো বটেই৷ ভালো লেখক হতে হলে আগে একজন ভালো পাঠক হওয়া প্রয়োজন৷
বইটার মধ্যে চন্দন এত মজে গিয়েছিল যে ঘণ্টা তিনেক সময় কীভাবে কেটে গেল তা বুঝতেই পারল না৷ চন্দনের হুঁশ ফিরল তার মায়ের ডাকে৷ বেলা দেড়টা বাজে, এবার স্নান-খাওয়ার জন্য তাকে উঠতে হবে৷
বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকতেই আবারও চন্দনের মোবাইল বেজে উঠল৷ এবার শীর্ষেন্দুর ফোন৷ চন্দন ফোন কলটা নিতেই শীর্ষেন্দু জানতে চাইল, ‘বাড়িতেই আছিস, নাকি কলেজ স্ট্রিটে চক্কর কাটছিস? আজ বিকালে ফ্রি আছিস?’
চন্দন বলল, ‘বাড়িতেই৷ তেমন কোথাও বেরোনোর নেই৷ কেন?’
শীর্ষেন্দু বলল, ‘ক-দিন ধরে কাজের মারাত্মক চাপ চলছিল৷ একটু রিল্যাক্স করা দরকার৷ অর্থাৎ সোজা কথায় বলতে হলে আজ একটু মাল খাব৷ তুই ‘ফ্রাইডে ক্লাবের’ নাম শুনেছিস? তাহলে তোকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যেতাম৷’
চন্দন কথাটা শুনে বলল, ‘হ্যাঁ, নাম শুনেছি৷ কলকাতার বড়লোকদের ক্লাব৷ তুই ওখানকার মেম্বার নাকি?’
শীর্ষেন্দু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, অনেক পুরোনো ক্লাব৷ একসময় শুধু কলকাতার অভিজাত মহলের পয়সাঅলা মানুষরাই ওখানকার মেম্বার হতে পারত৷ বর্তমানে অবশ্য নিয়মকানুন অনেকটা শিথিল হয়েছে৷ নিজস্ব গাড়ি থাকলেই ওই ক্লাবের মেম্বার হওয়া যায়৷ আর সেই নিয়মের ফাঁক গলে আমি ফ্রাইডে ক্লাবের মেম্বার হয়েছি৷ মানে, আমাদের ফার্মের এক ক্লায়েন্ট আমাকে ওখানকার মেম্বার বানিয়েছে৷ যাবি? ওখানেও তো মদ্যপানের আসর বসে৷ হয়তো লেখার কিছু খোরাকও মিলে যেতে পারে৷ আফটার অল ফ্রাইডে ক্লাবটাও একটা শুঁড়িঘর৷’
বাইরে বেরোলে মনের অবসাদটা হয়তো কেটে যেতে পারে৷ তাই চন্দন বলল, ‘ঠিক আছে, যাওয়া যেতে পারে৷’
শীর্ষেন্দু বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তোকে পাঁচটা নাগাদ বাড়ি থেকে তুলে নেব৷ বাড়িতে বলে দিস ফিরতে রাত হতে পারে৷ হ্যাঁ, ক্লাবের কিছু নিয়ম আছে, ফুলস্লিভ শার্ট আর শুট পরে যেতে হবে৷’
চন্দন হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, তাই হবে৷’
ফোন ছেড়ে দিল শীর্ষেন্দু৷
স্নান, খাওয়া সেরে ঘণ্টা দুই ঘুম দিল চন্দন৷ সাড়ে চারটেতে মোবাইলে অ্যালার্ম দেওয়া ছিল৷ সে শব্দেই বিছানা ছেড়ে উঠল সে৷ রাতে ভালো ঘুম হয়নি চন্দনের৷ বিকালে ঘুম থেকে ওঠার পর শরীর আর মন দুটোই বেশ ঝরঝরে মনে হল তার৷ ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে, চা খেয়ে পোশাক পরতে শুরু করল চন্দন৷ ঠিক পাঁচটাতে বাড়ির বাইরে শীর্ষেন্দুর গাড়ির হর্নের শব্দ শোনা গেল৷ ড্রাইভার সমেত গাড়ি নিয়ে ঠিক সময় হাজির হয়ে গেছে সে৷ ইছাপুরে শীর্ষেন্দুর বাড়ি, সেখান থেকে চন্দনের বাড়ি আসতে তার কুড়ি মিনিট মতো সময় লাগে৷
চন্দন তৈরি হয়েই ছিল৷ বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে৷ শীর্ষেন্দু আর চন্দনকে নিয়ে গাড়ি রওনা হল কলকাতার দিকে৷ তাদের যেতে হবে দক্ষিণ কলকাতা৷
গাড়ি চলতে শুরু করার পর দু-একটা কথা বলার পর শীর্ষেন্দু বলল, ‘বিদিশার ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই কেলো হয়ে গেল! দীনেশ খাস্তগীর আমাদের ক্লায়েন্ট৷ আমি নিজেও তো বেশ কয়েকবার ওখানে গেছিলাম৷ টেলিভিশনে খবরটা শুনেই বেশ খারাপ লেগেছিল৷ তুই তো ওখানে পর পর বেশ ক-দিন গেছিলি৷ ঘটনা ঘটার পরও গেছিস৷ বিদিশার লোকজনের সঙ্গে তোর কথা বলে কী মনে হয়েছে?’
চন্দন বলল, ‘বিদিশার কোনো কর্মচারী যে ঘটনাটা ঘটিয়েছে তা প্রমাণিত হয়নি৷ এমনও হতে পারে ওই ধর্ষক মেয়েটার কাছে নিজের মিথ্যা পরিচয় দিয়েছিল৷ আসলে এখন সব ঘটনাকেই নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি আর মিডিয়া৷ সে সব চক্করেই কিছু প্রমাণিত হবার আগেই ফেঁসে গেল বিদিশা৷ আমার কিন্তু বিদিশার লোকগুলোকে খারাপ মনে হয়নি৷ বিশেষত অপূর্ব ঘোষালের ব্যবহার, আচরণ তুলনাহীন৷’
চন্দনের কথা শুনে এ প্রসঙ্গে শীর্ষেন্দু হয়তো তাকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু চন্দন বিদিশার আলোচনা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়৷ তাই সে এরপর আলোচনার বিষয় অন্য দিকে ঘোরাবার জন্য বলল, ‘এই ফ্রাইডে ক্লাবের চক্করটা কী বলতো? আগে তো তোর মুখে কোনোদিন ও জায়গার নাম শুনিনি!’
শীর্ষেন্দু হেসে বলল, ‘শুনবি কী করে? আমি তো সবে মাস ছয় হল ওই ক্লাবের মেম্বার হয়েছি৷ এর আগে শুধু তিনদিন গেছি ওখানে৷ সাধন বক্সী আমাদের ক্লায়েন্ট৷ জলপাইগুড়িতে ওর একটা টি-এস্টেট ছাড়াও সিকিমে একটা ওষুধের কারখানা আছে৷ সাধন বক্সী ফ্রাইডে ক্লাবের পুরোনো মেম্বার৷ ওই আমাকে মেম্বার বানাল৷’
চন্দন বলল, ‘ও সব ক্লাবে তো শুনেছি অনেক টাকা মেম্বারশিপ দিতে হয়?’
চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, সিলভার মেম্বার অর্থাৎ সাধারণ মেম্বারশিপ ফি ইয়ারলি থারটি থাউজেন্ড আর গোল্ডেন মেম্বার, অর্থাৎ ভবিষ্যতে যদি কর্মকর্তা হতে চাও তবে ইয়ারলি ওয়ান ল্যাক৷’
শীর্ষেন্দুর জবাব শুনে চন্দন বিস্মিতভাবে বলল, ‘তুই এত টাকা দিয়ে ক্লাব মেম্বার হলি!’
শীর্ষেন্দু হেসে বলল, ‘না, টাকাটা আমাকে দিতে হয়নি৷ ওটা আসলে আমার নামে জমা করেছে সাধন বক্সী৷ সামনে ক্লাবের ইলেকশন৷ সাধন বক্সী প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে দাঁড়াতে চান৷ আমাকে মেম্বার করে নিজের পক্ষে একটা ভোট বাড়ালেন তিনি৷ আরও কয়েকজনকেও তিনি একই কারণে ফ্রাইডে ক্লাবের মেম্বার করেছেন৷ ভোট মিটে গেলে সামনের বছর তিনি আমার চাঁদা না ভরলে আমি আর মেম্বার থাকব না৷ যতদিন আছি ততদিন সুবিধাটাকে কাজে লাগিয়ে মাল আর খাবার খেয়ে নিই৷ একজন করে কম্পেনিয়নও নিয়ে যেতে পারেন ক্লাব মেম্বাররা৷’
সমাজের ওপরতলার এসব ক্লাবের ব্যাপারে তেমন কিছু জানা নেই চন্দনের৷ সে বলল, ‘বুঝলাম না হয় ফ্রাইডে ক্লাবের মতো নামি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বা কর্মকর্তা হওয়া জন্য এত টাকা খরচ করেন!’
শীর্ষেন্দু হেসে জবাব দিল, ‘এমন একটা ক্লাবের কর্মকর্তা হলে হাই সোসাইটিতে প্রেসটিজ বাড়েই কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়৷ ওখানে বসে নানা ধরনের বড় বড় বিজনেস ডিল হয়, এমনকি পলিটিকাল ডিলও৷ এই যে কিছুদিন আগে গুণধর সান্যাল এক পার্টি ছেড়ে অন্য পার্টিতে গিয়ে পার্লামেন্টের টিকিট পেলেন, সেই ডিলটাও নাকি ওখানে বসেই হয়েছিল বলে সাধন বক্সীর মুখ থেকে শুনেছি৷ এসব বড় বড় ক্লাবকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সাধন বক্সীর মতো লোকেরা নিজেদের ব্যবসা ও অন্যান্য নানা ব্যাপারে নানা সুবিধা লাভ করেন৷ সেটাই আসল কথা৷’
চন্দনের এবার ব্যাপারটা কিছুটা বোধগম্য হল৷ শীর্ষেন্দু বলল, ‘ক্লাবে তোর সঙ্গে সাধন বক্সীর পরিচয় হবে৷ ব্যবসায়িক প্রয়োজনে লোকটা দেশ-বিদেশের নানা জায়গাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন৷ নানা বড় বড় ক্লাব, পানশালাতেও গেছেন৷ হয়তো বা ওঁর বলা কোনো কথা তোর লেখার কাজে লেগে যেতে পারে৷’
শীর্ষেন্দু তার আলোচনাতে এরপর আর বিদিশার প্রসঙ্গ ওঠাল না৷ অন্য নানা ধরনের গল্প, আলোচনা শুরু হল তাদের দুজনের মধ্যে৷ কলকাতাতে ঢোকার পর বেশ কয়েকবার জ্যামে দাঁড়াতে হল চন্দনদের৷ খানিকটা সময় নষ্ট হল তাতে৷ অবশেষে দক্ষিণ কলকাতার প্রাচীন অভিজাত ফ্রাইডে ক্লাবের সামনে চন্দনরা যখন গাড়ি থেকে নামল, তখন কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা সাতটা৷ ক্লাবের বাইরের রাস্তাতে পার্ক করা আছে বেশ কয়েকটা দামি গাড়ি৷ প্রাচীরের ওপর নিবিড় কাঠের ফেনসিং-ঘেরা অভিজাত ফ্রাইডে ক্লাব৷ গেটে দাঁড়ানো উর্দিপরা দারোয়ান সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল৷ শীর্ষেন্দুর সঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করল চন্দন৷ চারপাশে সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো লনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মাঝারি আকৃতির একটা ধবধবে সাদা রঙের বাড়ি—ফ্রাইডে ক্লাব৷ বাড়িটার মাথার ওপরের গম্বুজ আর সামনের বারান্দার থামগুলো দেখে চন্দনের মনে হল এ বাড়িটা সম্ভবত ব্রিটিশ আমলের তৈরি৷ মোরাম বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটে ফ্রাইডে ক্লাবের সদর দরজার সামনে হাজির হল চন্দনরা৷ এখানেও একজন উর্দিপরা কর্মচারী দাঁড়িয়ে ছিল৷ এবার শীর্ষেন্দুকে পকেট থেকে তার মেম্বারশিপ কার্ড বার করে লোকটাকে দেখাতে হল৷ ভারী ওক কাঠের প্যানেল বসানো দরজাটা খুলে দিল লোকটা৷ ফ্রাইডে ক্লাবের ভিতর শীর্ষেন্দুর সঙ্গে পা রাখতেই এয়ারকন্ডিশনের শীতল বাতাস ঘিরে ধরল তাদের৷ মুহূর্তের জন্য চন্দনের মনে পড়ে গেল বিদিশার কথা৷ রমানাথ যখন কাচের দরজাটা টেনে খুলে দিত, তখন ঠিক একই রকম ঠান্ডা বাতাস এসে লাগত গায়ে৷ তবে এখানে ঢোকার পর মদ, সিগারেট আর খাবারের পাঁচমিশালি গন্ধটা চন্দনের নাকে লাগল না৷ তার বদলে এখনে ছড়িয়ে আছে রুম ফ্রেশনারের আভিজাত্যের গন্ধ৷ শীর্ষেন্দু চন্দনকে নিয়ে ঝকঝকে পালিশ করা কাঠের মেঝে বসানো করিডোর পেরিয়ে সোজা প্রবেশ করল বলরুমে৷ ধবধবে সাদা শ্বেতপাথর বসানো বেশ বড় গোলাকৃতি ঘরটার মাথায় ঝুলছে বিশালাকৃতির একটা ঝাড়বাতি৷ ঘরের চারপাশে দেওয়াল ঘিরে রাখা আছে চামড়ায় মোড়া সোফা৷ বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ বসে আছে সেখানে৷ অনুচ্চস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে তারা৷ কারো হাতে ধরা পানীয়র গ্লাস৷ যাঁরা ঘরটাতে বসে আছেন তাঁদের পোশাক আর চেহারার জৌলুস দেখলেই বোঝা যায় তাঁরা ঠিক ‘আম আদমি’ নন, সমাজের ওপরতলার মানুষ সব৷ মহিলাদের সবার পরনেই শাড়ি৷ চন্দনের মনে হল সম্ভবত এটাও এখানকার ড্রেস কোড৷
ঘরটার একপাশে ওয়াইন ডেস্ক আর ফুড কাউন্টার৷ ইলেকট্রিক হিটারের ওপর বসানো আছে সুদৃশ্য মুখঢাকা খাবারপূর্ণ পাত্র৷ সাদা জামা আর লাল বো-টাই পরা পরিবেশকরা দাঁড়িয়ে আছে জায়গাটার সামনে৷
চন্দনকে নিয়ে সেদিকে এগোতে এগোতে শীর্ষেন্দু চাপাস্বরে বলল, ‘বিনা পয়সাতেই যখন খাব তখন স্কচ হুইস্কি নিই৷ তুই অবশ্য ভোদকা বা ওয়াইন নিতে পারিস৷ তবে রামটা এখানে পাবি না৷ দামি ব্র্যান্ডের মাল সব৷’
স্কচই নিল চন্দনরা৷ তার সঙ্গে স্ন্যাক্সের প্লেট৷ সেগুলো নিয়ে অন্য লোকজনের থেকে কিছুটা তফাতে একটা সোফায় বসল তারা৷
ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন ঘরটাতে ঢুকলেন৷ যাঁরা ঘরে ঢুকছেন, যাঁরা সোফাতে বসে আছেন তাঁদের হাঁটাচলা, বসা, তাকানোর ভঙ্গি, এ সব কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে নিখুত আভিজাতের, পয়সাঅলা উচ্চকোটির মানুষের ছাপ৷ চন্দন এমন জায়গাতে কোনোদিন আসেনি৷ চারপাশে তাকিয়ে মৃদু আড়ষ্ট বোধ করল সে৷ ব্যাপারটা সম্ভবত অনুমান করে শীর্ষেন্দু তাকে বলল, ‘চাপ নিস না, রিল্যাক্সড মুডে থাক৷ যাদের চারপাশে দেখছিস তাদের অনেক পয়সা থাকলেও এদের থেকে তুই কম নস৷ এখানে ক’জন লিখতে পারবে তোর মতো?’
চন্দন জানতে চাইল, ‘এদের তুই চিনিস?’
শীর্ষেন্দু বলল, ‘কয়েকজনের সঙ্গে সাধন বক্সী আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তাদের চিনি৷ ওই যে কালো শিফনের শাড়ি পরা ফর্সা ভদ্রমহিলা একলা বসে আছেন, ওঁর নাম রঞ্জনা দত্ত৷ কলকাতার এক নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের মালকিন৷ আর আমাদের বাঁদিকের সোফায় যে দুজন বসে কথা বলছেন তাঁরা হলেন মিস্টার বাসু আর মিস্টার সমাদ্দার৷ বাসুর বড় লেদার ফ্যাক্টরি আছে ট্যাংরাতে, আর সমাদ্দারের এক্সপোর্ট বিজনেস৷ মিস্টার বাসু বিয়ে করেননি৷ বক্সীদা বলছিলেন সমাদ্দারের ওয়াইফের সঙ্গে বাসুর নাকি রিলেশন আছে৷ বার্থডে পার্টিতে বাসু, সমাদ্দারের বউকে হিরের আংটি গিফ্ট করেছে৷’
কথাটা শুনে গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে চন্দন হেসে বলল, ‘এখানেও এসব চলে!’
শীর্ষেন্দু বলল, ‘হ্যাঁ, চলে৷ এখানে কেউ মদ খেয়ে খিস্তি করে না ঠিকই তবে নানা ঘোঁটালা আছে৷ যত বড় জায়গা তত বড় ঘোঁটালা৷ আমি বক্সীদার মুখ থেকে কথা প্রসঙ্গে কিছু শুনেছি৷ তবে সফিসটিকেটেড ব্যাপার সব৷ এদের বাইরে থেকে দেখে বুঝতেই পারবি না ভিতরে ভিতরে কী চলছে! বছর কুড়ি আগে গাড়ির চাবি নিয়ে একটা স্ক্যান্ডেল বেশ রসালো ভাবে লিক হয়েছিল খবরের কাগজে৷ সেটা তো এ ক্লাবেরই ঘটনা ছিল৷’
‘গাড়ির চাবি নিয়ে স্ক্যান্ডেল! সেটা কী?’—জানতে চাইল চন্দন৷
শীর্ষেন্দু তার হাতের গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে উঠে গিয়ে কাউন্টার থেকে আর একটা পেগ এনে, সোফায় বসে বেশ আয়েশ করে বসে বলল, ‘সাধন বক্সীর মুখ থেকে ওই গাড়ির চাবি স্ক্যান্ডেলের ঘটনাটা যা শুনেছি, তা হল, ওই কুড়ি-বাইশ বছর আগে নাকি এ ক্লাবে মাঝবয়সি প্রৌঢ় লোকেদের আট-দশজনের একটা গ্রুপ ছিল৷ তখন তাঁরাই ছিলেন এ ক্লাবের হর্তাকর্তা— গোল্ডেন মেম্বার৷ সাধারণ ক্লাব মেম্বাররা রাত দশটা পর্যন্ত এখানে থাকার সুযোগ পায় আর গোল্ডেন মেম্বাররা রাত বারোটা পর্যন্ত৷ প্রতি মাসের শেষ শুক্রবার ওই মাঝবয়সি, প্রৌঢ় গোল্ডেন মেম্বাররা তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে হাজির হতেন এখানে৷ সন্ধ্যা থেকে খানা-পিনা-হাসি-আড্ডা চলত এখানে৷ তারপর রাত দশটাতে সাধারণ মেম্বাররা ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলে গাড়ির চাবি দিয়ে এক অদ্ভুত লটারি করা হত৷ আইস কিউব ক্যানটা খালি করে তার মধ্যে ওই গোল্ডেন মেম্বাররা তাঁদের গাড়ির চাবিগুলো ফেলতেন৷ তারপর সেই ক্যান ঝাঁকিয়ে নিয়ে রুমালে চোখ বাঁধা একজন এক একটা চাবি তুলে নিয়ে অন্যদের হাতে ধরিয়ে দিতেন৷ অর্থাৎ রামের চাবি চলে যেত যদু বা মধুর হাতে৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির মালিকের স্ত্রীরাও৷ অর্থাৎ মধুর গাড়ির চাবি যদি যদুর হাতে যায় তাহলে মধুর স্ত্রীও একরাতের জন্য যদুর৷ বক্সীদার মুখে যা জেনেছি তাতে এ খেলাতে ওই সব গোল্ডেন মেম্বারদের স্ত্রীদেরও উৎসাহ কম ছিল না৷ কারণ, মাঝবয়সে স্বামী-স্ত্রীর শরীরের সম্পর্কে ভাটা পড়ে৷ স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের সম্মতিতেই এই শরীর বদলের খেলাটা ছিল৷ শেষে এক এদেরই কারও একজন গাড়ির ড্রাইভার যেন কী গণ্ডগোল হওয়াতে ব্যাপারটা সাংবাদিকদের জানিয়ে দেয়৷’
শীর্ষেন্দুর বলা এই অদ্ভুত গল্পটা শুনে চন্দনেরও যেন মনে হল বহুদিন আগে সেও যেন এ ঘটনার কথা কোথাও শুনেছিল বা পড়েছিল!
চন্দন কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল, ‘সে ঘটনা কাগজে ফ্ল্যাশ হবার পর কিছু ঘটেনি?’
শীর্ষেন্দু গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘সে সময় এক সংস্কৃতিপ্রেমী মন্ত্রী একটু চ্যাঁচামেচি করবার চেষ্টা করেছিলেন এই ব্যভিচারী বুর্জোয়া ক্লাব বন্ধর দাবিতে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কিছু করে উঠতে পারেননি৷ কারণ, তাঁর পার্টি থেকেই তাঁকে চাপিয়ে দেওয়া হয়৷ তা ছাড়া তেমন প্রমাণও কিছু ছিল না৷ খেলার অংশীদাররা কেউ স্বীকারও করেননি ব্যাপারটা৷ সে সময় মোবাইল ক্যামও ছিল না যে আড়াল থেকে কেউ ঘটনাটা তুলে রাখবে৷’
এ কথা বলে কাঠি দিয়ে একটা চিকেন বল মুখে ফেলে শীর্ষেন্দু বলল, ‘এখানে মদ্যপানের আসর বসলেও এটা তো আর ওই তোর বিদিশা বার নয়, এখানের মেম্বাররা সবাই ইনফ্লুয়েনশিয়াল পার্সেন৷ এসব জায়গাতে যাই ঘটুক না কেন, কেউ কিছু ছিঁড়তে পারবে না৷’
আবার শীর্ষেন্দুর কথায় বিদিশার প্রসঙ্গ উঠে আসাতে চন্দন তাড়াতাড়ি হাতের গ্লাসটা শেষ করে নতুন পেগ আনার জন্য উঠে গেল৷ সে যখন নতুন গ্লাসটা নিয়ে শীর্ষেন্দুর পাশে বসল তখন অবশ্য আর বিদিশার কথা তুলল না শীর্ষেন্দু৷ আরও ক্লাব মেম্বারদের আসা শুরু হয়েছে, ধীরে ধীরে ভরে উঠছে ঘরের সোফাগুলো৷ মাঝে মাঝে দু-একজনের গলার শব্দ বা মহিলা কণ্ঠের হাসির শব্দও কানে আসছে৷ কিন্তু সে সব শব্দ যেন নিক্তিমাপা, পরিশীলিত৷ শীর্ষেন্দুর সঙ্গে গল্প করতে করতে চারপাশের অচেনা পরিবেশ দেখতে লাগল চন্দন৷
একঘণ্টা কেটে যাবার পর শীর্ষেন্দু হঠাৎ একজন ভদ্রলোককে দেখিয়ে চন্দনকে বলল, ‘আরে ওই তো বক্সীদা এসে গেছেন!’
যে ভদ্রলোককে শীর্ষেন্দু দেখাল তাঁর আনুমানিক বয়স বছর ষাটেক হবে৷ পরনে ধবধবে সাদা শার্ট-প্যান্ট, লম্বা, ফর্সা চেহারা, চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা৷ মসৃণ মুখমণ্ডল বেয়ে ঝাড়বাতির আলো যেন চুঁইয়ে পড়ছে৷ একঝলক লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায় পয়সাওলা লোকের জৌলুস আছে ওই সাধন বক্সীর মধ্যে৷ একটা সোফার সামনে দাঁড়িয়ে সোফাতে বসা এক দম্পতির সঙ্গে কথা বলছেন বক্সীদা৷
সে সোফার সামনে ছেড়ে এরপর অন্য একটা সোফাতে গিয়ে সেখানে বসা তিনজন ভদ্রলোকের সঙ্গেও হাসিমুখে কিছুক্ষণ কথা বললেন সাধন বক্সী৷ আর এরপরই তিনি শীর্ষেন্দুকে দেখতে পেয়ে সোজা এগিয়ে এসে বসে পড়লেন শীর্ষেন্দুর পাশে৷ দামি বিদেশি পারফিউমের গন্ধ নাকে লাগল চন্দনের৷
শীর্ষেন্দু তাঁকে বলল, ‘আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম বক্সীদা৷ আজ আসতে এত দেরি হল?’
প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক মৃদু উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, ‘আর বলবেন না! ঠিক সময়ই চলে আসতাম৷ কিন্তু হাজরা মোড়ে পলিটিকাল পার্টির বিক্ষোভ চলছিল৷ পাক্কা চল্লিশ মিনিট জ্যামে আটকে রইলাম৷’
ভদ্রলোকের মুখ থেকে বিক্ষোভের কথাটা শুনে মৃদু চমকে উঠল চন্দন৷ আবার সেই ধর্ষণের ব্যাপার আর বিদিশার নাম নিয়ে আলোচনা শুরু হতে চলেছে নাকি? ওই ধর্ষিতা মেয়েটার ব্যাপারে আরও কোনো খারাপ খবর নেই তো? শীর্ষেন্দু জানতে চাইল, ‘হাজরা মোড়ে কী কারণে বিক্ষোভ?’
সাধন বক্সী জবাব দিলেন, ‘এক মন্ত্রী পেট্রোল পাম্পের লাইসেন্স পাইয়ে দেবার জন্য এক বাক্স টাকা ঘুষ নিয়েছেন৷ স্টিং অপরেশন ক্যামেরাতে ধরা পড়েছে সে ছবি৷ বিকাল থেকে টেলিভিশন চ্যানেলে দেখাচ্ছে খবরটা৷ তার বিরুদ্ধে পলেটিকাল পার্টির বিক্ষোভ৷’
সাধন বক্সীর কথা শুনে চন্দনের শঙ্কা কেটে গেল৷ শীর্ষেন্দু এরপর সাধন বক্সীর সঙ্গে চন্দনের পরিচয় করিয়ে দিল৷ চন্দনের লেখক পরিচয় পেয়ে সাধন বক্সী শীর্ষেন্দুকে বললেন, ‘ডিসেম্বর মাসে ক্লাবের জন্মদিনে আমরা সমাজের বিশিষ্ট কয়েকজন ফেলিসিটেট করি৷ বহু বছর আগে আমরা একবার লেখক ধূর্যটী মিত্রকে ফেলিসিটেট করেছিলাম৷ চন্দনবাবুর নামটা কিন্তু এ ব্যাপারের জন্য আমাকে মনে করিয়ে দেবেন৷’
চন্দন কথাটা শুনে ঈষৎ লজ্জিত ভাবে বলল, ‘লেখালেখির জগতে কিন্তু আমার থেকে অনেক গুণী মানুষ আছেন৷’ বক্সী বললেন, ‘তা থাকতে পারেন৷ প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তো একাধিক গুণী মানুষ থাকেন, কিন্তু পুরস্কৃত হন একজন৷ তা এখন আপনি কী বিষয় নিয়ে লিখছেন? যদিও সত্যি কথা বলতে কী, ব্যবসার চাপে আজকাল খবরের কাগজের হেডলাইন আর শেয়ার মার্কেটের খবর ছাড়া তেমন বিশেষ কিছু পড়া হয় না৷’
‘কী লিখছেন?’—এ প্রশ্নটায় চন্দন বরাবরই কেমন যেন একটা অস্বস্তিবোধ করে৷ কারণ, সে জবাব দেবার পরই নানারকম প্রশ্ন আসতে শুরু করে যার জবাব দেওয়া অনেক সময় মুশকিল হয়ে যায় তার পক্ষে৷ তবে চন্দন কিছু জবাব দেবার আগেই শীর্ষেন্দু বলল, ‘বুঝলেন বক্সীদা, উনি এখন পানশালা, মদ্যপান এসব নিয়ে রিসার্চ করছেন একটা উপন্যাস লেখার জন্য৷ আপনি তো দেশ-বিদেশের নানা ক্লাব, বার, হোটেলে ঘুরেছেন৷ এ ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতার কথা বললে আমার এই লেখক বন্ধুর কাজে লাগতে পারে৷’
কথাটা শুনে বক্সীদা মৃদু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, ব্যবসার প্রয়োজনে বিদেশেরও নানা বড় বড় পানশালা রেস্তোরাঁ, হোটেলে আমি গেছি৷ যদিও সুরাপানে আমার তেমন আসক্তি নেই, তবুও প্রথমবার লন্ডনে গিয়ে যখন মাস তিনেক ছিলাম তখন প্রতি সপ্তাহে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে হত আমাকে৷ লন্ডনের কিছু অভিজাত মানুষের থেকে এ ব্যাপারে কিছু জ্ঞান লাভ করেছিলাম আমি৷ মদ্যপানের কিছু ম্যানারিজিম আছে, যে ব্যাপারটাতে সম্ভ্রান্ত ব্রিটিশরা রীতিমতো চর্চা করেন৷ এই যেমন ভালো স্কচ হুইস্কি বা ওয়াইন খাবার পদ্ধতিটা হল প্রথমে গ্লাসে একটু স্কচ নিয়ে সেটা ঝাঁকিয়ে ফেলে দিতে হয়৷ তারপর গ্লাসে পানীয় ঢালতে হয়৷ তবে আমরা যেমন যে কোনো মদের মতো স্কচেও জল মিশিয়ে খাই, ওঁরা কিন্তু তা করেন না৷ জল মেশালেও খুব সামান্য জল মেশান৷ এক পেগ হুইস্কিতে হয়তো দু-চা-চামচ জল৷ দামি হুইস্কি ওঁরা নিটই খান সময় নিয়ে গ্লাসটা ঠোঁটে ছুঁইয়ে রেখে৷ স্কচের ফ্লেভারটাই আসল৷ ওভাবে পান করলে ফ্লেভার পাওয়া যায়৷ তা ছাড়া আপনারা যে গ্লাসে স্কচ খাচ্ছেন, এটা কিন্তু স্কচের গ্লাস নয়৷ স্কচ বা ওয়াইন সব সময় পান করতে হয় ‘টিউলিপ গ্লাসে’৷ অর্থাৎ যে গ্লাসের নীচে সরু কাচের দণ্ড থাকে৷ ওই সরু দণ্ডটা আঙুল দিয়ে এমনভাবে ধরতে হয় যাতে আপনার আঙুল পানীয় ভর্তি কাচের আধার স্পর্শ না করে৷ কারণ আপনার হাতের উত্তাপেই নাকি ভালো স্কচ হুইস্কির ফ্লেভার নষ্ট হয়ে যেতে পারে৷ লন্ডনের অনেক জায়গাতে মদ্যপানের ম্যানারিজিম লোকে পয়সা দিয়ে শেখে৷’
শীর্ষেন্দু বক্সীদার কথা শুনে হেসে বলল, ‘তাহলে এর পরের পেগটা ‘টিউলিপ গ্লাসেই’ নিচ্ছি৷ ওই তো কাউন্টারে টিউলিপ গ্লাস রাখা আছে৷’
সাধন বক্সী ঘরের নানাদিকের সোফাগুলোর দিকে লক্ষ করতে করতে বললেন, ‘এক এক দেশে মদ্যপানের নানান রীতি, নানা নিয়ম৷ আবার মস্কোর পানশালাগুলোতে দেখেছি ওরা এমনভাবে ভোদকার গ্লাসগুলো ধরে যাতে হাতের উত্তাপ পানীয়র মধ্যে ছড়িয়ে যায়৷ অনেকে তো আবার সেই উত্তাপ বাড়াবার জন্য দু-হাতের তালু দিয়ে গ্লাস ধরে চুমুক দেন৷ আর ভোদকা পানের সঙ্গে সঙ্গে খাবারের ব্যাপারটা বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখে৷ খাবার অর্থাৎ চাট৷ রুশ ভাষায় তাকে বলে ‘জাকুস্কি’৷ হুইস্কির সঙ্গে ব্রিটিশরা যেমন ডার্ক চকোলেট, শেডার চিজ, স্মোকড চিকেন ব্রেস্ট খান, তেমনই জাকুস্কি হল—আচার, পেঁয়াজ, রোস্টেড পটেটো বা স্মোকড ফিশ৷ তবে মদ্যপানের সময় যারা আমাদেরই মতো ম্যানারিজিমের খুব একটা তোয়াক্কা করে না, আমাদেরই মতো যা পায় তাই দিয়ে ঢকঢক করে মদ্যপান করে তারা হল মার্কিনিরা৷ মদ্যপানটাই তাদের কাছে আসল ব্যাপার৷ আনুষঙ্গিক ব্যাপারে তারা খুব একটা তোয়াক্কা করে না৷’
এ কথা বলার পর সাধন বক্সী হয়তো বা তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে শীর্ষেন্দু আর চন্দনকে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঘরের এক কোণে দৃষ্টি পড়াতে হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন৷ চার-পাঁচজন লোক সেখানে অন্যদের থেকে কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে জটলা করছেন৷ সেদিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পর সাধন বক্সী শীর্ষেন্দুকে বললেন, ‘ওই লোকগুলোর মধ্যে ওয়াকিং স্টিক হাতে সাদা চুলওলা লোকটাকে চিনে রাখুন৷ ওর নাম সুশীল দত্তগুপ্ত৷ ওই গাড়ির চাবি স্ক্যান্ডেলের একজন পার্টনার৷ এখন এই পঁচাত্তর বছর বয়সেও ক্লাব ইলেকশনে আমাদের এগেনস্ট প্যানেলে ক্যান্ডিডেট হবে বলে শুনছি! তাই মনে হয় ওখানে ক্যাম্পেন করছে৷’
এ কথা বলার পর তিনি চন্দনের উদ্দেশে বললেন, ‘সরি, আমাকে এবার উঠতে হবে৷ আসলে সামনে ক্লাব ইলেকশন, তাই মেম্বারদের সবার সঙ্গে একটু যোগাযোগ রেখে চলতে হচ্ছে, তাদের পিছনে সময় দিতে হচ্ছে৷ এ সব ব্যাপার মিটে গেলে শীর্ষেন্দুবাবুর সঙ্গে আবারও একদিন চলে আসবেন৷ জমিয়ে আড্ডা হবে৷’
শীর্ষেন্দু আর চন্দনের থেকে সাধন বক্সী এরপর চলে গেলেন ঘরের অন্যদিকে৷ শীর্ষেন্দু চন্দনকে বলল, ‘কিরে, বক্সীদা হুইস্কি খাবার ব্যাপারে যে কথাগুলো বললেন, সে কথাগুলো আগে জানতিস?’
চন্দন জবাব দিল, ‘না, জানতাম না, জানার কথাও নয়৷ আমার লেখাতে কাজে লাগবে৷’
শীর্ষেন্দু আর চন্দন এরপর কাউন্টারে গিয়ে শেষ পেগ স্কচ হুইস্কি নিয়ে এল৷ এবং অবশ্যই তা আনল সাধন বক্সীর মুখ থেকে সদ্য শোনা কাচের টিউলিপ গ্লাসে৷
তিন পেগ করে মদ্যপান করার পর খাওয়া সেরে চন্দনরা যখন ফ্রাইডে ক্লাবের বাইরে বেরিয়ে এল তখন রাত নটা বাজে৷ সন্ধ্যাটা বেশ উপভোগ করেছে চন্দন৷ বিদিশার কথা চন্দনের আর তখন মনে নেই৷