একদা এক পানশালাতে – ৮

৷৷ ৮ ৷৷

পরদিন সকালে চন্দনের ঘুম ভাঙল শীর্ষেন্দুর ফোন পেয়ে৷ তাকে গুড মর্নিং জানিয়ে শীর্ষেন্দু বলল, ‘তোকে আমি বিদিশাতে নিয়ে গেলাম, আর বিদিশাকে জড়িয়ে এ ঘটনা যে ঘটবে তা কে জানত! লেখার জন্য যা যা ইনফরমেশন দরকার তা কালেক্ট করা হয়ে গেছিল তো?’

চন্দন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, তা, অনেকটাই হয়েছে বলা যেতে পারে৷ বারের প্রাথমিক ব্যাপারগুলো জানা হল৷

শীর্ষেন্দু বলল, ‘তবে আর কী? এবার তুই তোর কাজ শুরু কর৷’

চন্দন বলল, ‘লেখা হয়তো শুরু করা যাবে৷ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, খবরের কাগজ আর নিউজ চ্যানেলগুলো গল্প তৈরি করতে গিয়ে বিদিশাকে আরও বেশি জড়িয়ে ফেলছে৷ কাল কলকাতা গেছিলাম৷ বাড়ি ফিরে বেশ রাত পর্যন্ত নানা চ্যানেল দেখেছি টেলিভিশনে৷ একটা চ্যানেল তো এ কথাও বলল যে, ওই ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে বিদিশাই জড়িত৷ যে কারণে ব্যাপারটা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই বিদিশার মালিক দীনেশ খাস্তগীর দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন! অথচ তিনি ওই রাতে ঘটনা ঘটার আগেই তাঁর মাকে নিয়ে দেশ ছেড়েছেন মায়ের চিকিৎসার জন্য৷’

শীর্ষেন্দু কথাটা শুনে বলল, ‘বাঃ তুই তো তবে অনেক খবরই জানিস৷ তবে যা বুঝছি তাতে এবার বারটা না বন্ধ হয়ে যায়৷ আমরা বাইরের মানুষ, বাইরে থেকে আর ভিতরের ঘটনার খবর কতটুকু রাখি৷ আজ একটা সংবাদপত্রে এমনও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে বার-রেস্তরাঁ ব্যবসার আড়ালে বিদিশাতে নাকি মধুচক্র চলে৷ গতকাল একটা পলিটিকাল পার্টি বিদিশা বন্ধ করে দেবার দাবিতে নাকি বিদিশার সামনে বিক্ষোভ দেখিয়েছে বলেও শুনলাম৷ পুরো ব্যাপারটা এখন রাজনীতির দিকে মোড় নিয়েছে৷’

চন্দন বলল, ‘একদমই ঠিক কথা, রাজনীতির খেলোয়াড়রা ঢুকে পড়েছে, এমনকী শপিং মল করবে বলে বিদিশাকে কিনে নিতে চায়, এমন একজন ব্যবসায়ীও৷ কাল অপূর্ব ঘোষালের কাছে খবরটা শুনলাম৷’

‘তুই তাকে ফোন করেছিলি নাকি?’ জানতে চাইল শীর্ষেন্দু৷

চন্দন বলল, ‘আমি কাল বিদিশাতে গেছিলাম ওখানে কী চলছে তা জানার জন্য৷ পলিটিকাল বিক্ষোভটাও আমি নিজের চোখে দেখেছি৷’

চন্দনের কথা শুনে মৃদু আঁতকে উঠে শীর্ষেন্দু বলল, ‘তুই কি পাগল হয়ে গেছিস নাকি? এ অবস্থায় কেউ ওখানে যায়! কোথায়, কী ভাবে জড়িয়ে যাবি তা বুঝতেও পারবি না! ওখন কেলেংকারী হবে৷ আর ওখানে যাস না৷ আর কাউকে বলার দরকার নেই যে ওখানে তোর যাওয়া-আসা ছিল৷ যা খবর জানার তা বাড়িতে বসে টেলিভিশন, খবরের কাগজ দেখে জান৷’—কথাগুলো বলে ফোন রেখে দিল শীর্ষেন্দু৷

চন্দন বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে ভাবল শীর্ষেন্দুর বলা কথাগুলো৷ তাকে সতর্ক করার জন্য শীর্ষেন্দু কথাগুলো ভুল বলেনি৷ বর্তমানে যা পরিস্থিতি তাতে বিদিশা বারে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার৷ সে থানা-পুলিশের চক্করে জড়িয়ে না পড়লেও এমন তো হতেই পারে যে ওত পেতে থাকা সাংবাদিকরা সেখানে ঘিরে ধরল চন্দনকে৷ তখন কেলেংকারী কাণ্ড ঘটতে পারে৷ লেখার জন্য যতটুকু তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন ছিল তা তো মোটামুটি হয়েই গেছে তার৷ যদি আরও কিছু এ বিষয়ে তার জানার প্রয়োজন হয় তবে অন্য কোনো বারেও খদ্দের হয়ে যাওয়া যেতে পারে৷ কলকাতা শহরে তো পানশালার অভাব নেই৷ আসলে এখন চন্দনের কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে তার একটা টান জন্মে গেছে বিদিশার ওপর৷ যে জন্য ঝুঁকির ব্যাপারটা চন্দনের মাথায় আসেনি৷ ধর্ষণের ঘটনায় বিদিশার নাম জড়ানো সত্ত্বেও তাই সে ছুটে গেছে বিদিশাতে৷ তবে আজও একবার চন্দনকে কলেজ স্ট্রিটে যেতে হবে এক প্রকাশকের ঘরে বইয়ের রয়ালটির টাকা নেবার জন্য৷ সেই প্রকাশক আজই তাকে সেখানে যেতে বলেছেন৷ ডেট মিস করলে টাকা আটকে যাবার সম্ভাবনা৷ তবে কলেজ স্ট্রিট যাবার জন্য বেলা বারোটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরোলেই চন্দনের চলবে৷ প্রকাশক তাকে দুপুর দুটো থেকে চারটের মধ্যে তাঁর অফিসে যেতে বলেছেন৷

বেশ অনেক বেলা পর্যন্ত বিছানাতে শুয়ে রইল চন্দন৷ তারপর ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করে নিয়ে টেলিভিশন সেট খুলল যদি মেয়েটার সুস্থতা সম্বন্ধে কোনো আপডেট পাওয়া যায় সে জন্য৷ বেশ কয়েকটা চ্যানেল ঘুরিয়ে দেখল সে৷ সাত সকালেই ইতিমধ্যে বেশ কিছু চ্যানেল বিতর্ক অনুষ্ঠান শুরু করেছে৷ চেনা মুখ সব, ওই যাদের আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট সব বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য, তারাই বসে পড়েছে চ্যানেলগুলোতে৷ কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে মেয়েটিকে নিয়ে এত ঘটনা তার সুস্থতা সম্পর্কে কোনো খবর জানাছে না চ্যানেলগুলো৷ টিভি বন্ধ করে চায়ের কাপ নিয়ে চন্দন খবরের কাগজ নিয়ে বসল৷ যথারীতি কাগজের প্রথম পাতা জুড়ে রয়েছে বিদেশিনি ধর্ষণ সংক্রান্ত নানা খবর৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের চাপান-উতোর, বিশিষ্টজন, সমাজকর্মীদের বক্তব্য এই সবই৷ কয়েকজন শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে এদিন কলেজ স্ট্রিট থেকে একটা প্রতিবাদ মিছিলের আহ্বান করা হয়েছে সংবাদপত্রে৷ সেটাও চোখে পড়ল চন্দনের৷ রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে পরিস্থিতি যে প্রতিদিন আরও জটিল হয়ে উঠছে তা বুঝতে পারল চন্দন৷

স্নান-খাওয়া সেরে বেলা এগারোটা নাগাদ কলকাতা যাবার জন্য রওনা হল চন্দন৷ আজকের কাজটা মিটে গেলে আপাতত আর কলকাতায় যাবার মতো কাজ নেই তার৷ রেল স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই প্রকাশক বিজয়বাবুর ফোন এল৷ চন্দন কলটা রিসিভ করতেই তিনি বললেন ‘আজ কি কলেজ স্ট্রিট আসছেন? আমি কিন্তু ওই মদ-পানশালা এসব নিয়ে বইপত্র জোগাড় করে রেখেছি আপনার জন্য৷ নিয়ে যাবেন তবে৷’

তিনি যেন ধরেই রেখেছেন চন্দন তাঁর কথা মতো উপন্যাসটা লিখবেই৷ চন্দন প্রথমে তাঁকে বলতে যাচ্ছিল, ‘এ ব্যাপারটা নিয়ে ব্যবসা না করলেই কি নয়?’

কিন্তু শেষ মুহূর্তে সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘দাদা আমি এখনও পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারিনি৷ আসলে আমি আমার একটা ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে আছি৷ সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে অন্তত দিন পনেরো সময় লাগবে বলে মনে হয়৷ তার মধ্যে আমার লেখার কাজে হাত দেওয়া হবে না৷’

কথাটা শুনে প্রকাশক বিজয়বাবু মৃদু হতাশভাবে বললেন, ‘কিন্তু অতদিন তো অপেক্ষা করা যাবে না৷ বিপুল সান্যাল আমাকে ফোন করে নিজেই আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এ বিষয় নিয়ে লেখার জন্য৷’

চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, সেই ভালো৷ উনি যথেষ্ট ভালো লেখক৷ আমার ধারণা উনি খুবই ভালো লিখতে পারবেন লেখাটা৷ আমি পরে টেলিফোন করব আপনাকে৷’—এই বলে সে ফোন রেখে দিল৷

দুপুর বারোটা নাগাদ শিয়ালদাতে পৌঁছে গেল চন্দন৷ তারপর সেখান থেকে বাস ধরল৷ কিন্তু কলেজ স্ট্রিট মোড়ে পৌঁছোবার একটু আগেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বাস৷ সামনে যানজট৷ কন্ডাক্টর বাস থেকে নেমে সামনেটা ঘুরে এসে বাসে উঠে হাঁক দিল, ‘কলেজ স্ট্রিট যারা যাবেন নেমে যেতে পারেন৷’

একজন প্যাসেঞ্জার কথাটা শুনে জানতে চাইল, ‘কেন, কী ব্যাপার?’

কন্ডাক্টর বলল, ‘কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে একটা মিছিল শুরু হবে৷ মিছিলটা যতক্ষণ বেরিয়ে না যায় ততক্ষণ গাড়ি এগোবে না৷ ট্রাফিক সার্জেন বলছে, আরও আধঘণ্টা সময় লাগবে মিছিল শুরু হতে৷’

কন্ডাক্টরের কথা শুনে চন্দনের পাশে বসা এক যাত্রী স্বগতোক্তির স্বরে বলল, ‘নিশ্চয়ই ওই রেপ কেসটার ব্যাপারে মিছিল৷ কেনই বা মাঝরাতে বারে মাল খেতে গেলি! আর কেনই বা তুই রেপ হলি কে জানে! মধ্যে থেকে আমাদের মতো পাবলিকের ভোগান্তি! যত্তসব!’

চন্দনের কথাটা শুনে মনে হল—হয়তো বা এ লোকটাই কিছুক্ষণ আগে বাড়িতে বা অন্য কারো সঙ্গে আলোচনা করে এসেছে ধর্ষণের ঘটনাটা বা মেয়েটার দুর্দশা নিয়ে৷ কিন্তু সত্যিই কি এসব ঘটনা আজকাল মানুষের মনের গভীরে দাগ কাটে? নাকি এ সব ঘটনা সময় কাটাবার আলোচনার উপাদান মাত্র? নইলে কি লোকটা এত অবলীলায় মেয়েটার উদ্দেশে কথাগুলো বলতে পারত?

বাস থেকে আরও কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে নেমে পড়ল চন্দন৷ তারপর হাঁটতে শুরু করল কলেজ স্ট্রিট মোড়ের দিকে৷ মোড়ের কাছাকাছি পৌঁছেই জমায়েতটা চন্দনের চোখে পড়ল৷ ফ্ল্যাগ-ফেস্টুন নিয়ে লোকজনের ভিড় জমতে শুরু করেছে৷ হ্যাঁ, ধর্ষণের ঘটনাটা নিয়েই প্রতিবাদ মিছিল৷ বুদ্ধিজীবীদের ডাকে যে মিছিল হবার কথা চন্দন পড়েছে সকালের কাগজে৷ জমায়েতের অনেকের হাতেই ব্যানার, ফেস্টুন রয়েছে, তার কোনোটাতে লেখা—‘ধর্ষকের শাস্তি চাই৷’ কোনোটাতে লেখা, মদ্যপান, পানশালা বন্ধ করো, এ সব নানা স্লোগান৷ প্রকাশকের ঘরে টাকা নিতে যাওয়া ছাড়া চন্দনের আজ আর কোনো কাজ নেই৷ সে মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে টাকাটা নিয়েই সে শিয়ালদার দিকে রওনা হবে বাড়ি ফেরার জন্য৷ কলেজ স্ট্রিট মোড়ে পৌঁছে চন্দন ভিড়টাকে পাশ কাটিয়ে তার প্রকাশকের কাছে যাবার জন্য একটা গলির মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিল৷ ঠিক সেই সময় সে ডাক শুনতে পেল, ‘চন্দন, কোথায় যাচ্ছেন?’

চন্দন থমকে দাঁড়িয়ে দেখল একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আছেন কবি মলয় নন্দী৷ আর তাঁর পাশে বুম-ক্যামেরা হাতে কয়েকজন সাংবাদিক যাঁরা এই মিছিল কভার করতে এসেছেন৷ মলয়, বেশ নিয়মিত বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতে বসেন৷ অর্থাৎ পাবলিক যাঁদের ‘বুদ্ধিজীবী’ বলে তেমনই একজন৷ আজকের এই মিছিলের আহ্বায়ক হিসাবে অন্যদের সঙ্গে খবরের কাগজে তাঁর নামও ছাপা হয়েছে তা দেখেছে চন্দন৷

ডাক শুনে চন্দন সৌজন্যবশত তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘এই এক প্রকাশকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি৷ আপনি ভালো আছেন?’

মিছিলের জন্য পরে আসা নতুন গরদের পাঞ্জাবি গায়ে রোদে দাঁড়িয়ে ঘামছেন মলয় নন্দী৷ চন্দনের কথা শুনে তিনি রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘যা ঘটনা ঘটল এরপর আর ভালো থাকি কী করে বলুন?’

চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা৷’

মলয় এরপর তাঁর পাশে দাঁড়ানো এক সাংবাদিককে, চন্দনকে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনি, চন্দন, এই সময়ের অন্যতম খ্যাতিমান সাহিত্যিক৷ ওনারও একটা বাইট নিয়ে রাখুন৷’

মলয় কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই একজন ক্যামেরাম্যান তার ক্যামেরা তুলে ধরল তার দিকে, আর তার সঙ্গিনী এক মহিলা সাংবাদিক বুম নিয়ে চন্দনের সামনে ধরল৷ চন্দন সাধারণত এসব ব্যাপার এড়িয়ে চলে, কিন্তু এই মুহূর্তে তার আর ‘না’ বলার উপায় নেই৷ সাংবাদিক মহিলা তাকে প্রথম প্রশ্ন করলেন, ‘বিদেশিনি ধর্ষণ সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?’ চন্দন বলল, ‘অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধ৷ দোষী ব্যক্তির শাস্তি দাবি করছি, এবং মেয়েটির দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি৷’

দ্বিতীয় প্রশ্ন এল, ‘আপনি কি মনে করেন, এ রাজ্যে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে?’

চন্দন এ প্রশ্নের যাই জবাব দিক না কেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে৷ তাই এ প্রশ্নর জবাবে চন্দন শুধু বলল, ‘আমি আশা করব সরকার অপরাধীকে শনাক্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করবেন৷’

সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিক তাঁর পেশাদারি দক্ষতাতে তৃতীয় প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘অনেকের মতো আপনিও নিশ্চয়ই দাবি করবেন যে বিদিশা নামের পানশালা বন্ধ করে দেওয়া হোক? কলকাতার পানশালাগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা হোক?’

চন্দন জবাব দেবার আগে মুহূর্তের জন্য থমকে গেল৷ তারপর নিজের অজান্তেই যেন বলে ফেলল—‘না৷’

চন্দনের জবাব শুনে সাংবাদিক ভদ্রমহিলা বিস্মিতভাবে বললেন, ‘না, কেন? আপনি চান না বিদিশা বন্ধ হোক?’

চন্দন বলল, ‘সংবাদ মাধ্যমের খবর থেকে এখনও পর্যন্ত যা জানতে পেরেছি তাতে বিদিশার ভিতরে ঘটনাটা ঘটেনি৷ আর সত্যিই যে ওখানকার কোনো কর্মচারী ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তা প্রমাণিত হয়নি৷ যে কোনো একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বহু মানুষের রুটি-রুজি জড়িয়ে থাকে৷ তাই এভাবে কোনো কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷’

চন্দন কথাগুলো বলে সাংবাদিক ভদ্রমহিলার মুখ দেখেই বুঝতে পারল চন্দনের জবাবটা তাঁর ঠিক মনঃপূত হয়নি৷ হয়তো তিনি আরও কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কাছেই একটা শোরগোল হল৷ একজন খ্যাতনামা অভিনেতা তাঁর গাড়ি থেকে নামছেন মিছিলে যোগদান করার জন্য৷ আর তাঁকে দেখেই চন্দনকে ছেড়ে সাংবাদিক আর তাঁর ক্যামেরাম্যান এগোলেন সেই অভিনেতার কাছে যাবার জন্য৷ আর তাঁদের সঙ্গে এগোলেন মলয় নন্দীও৷ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল চন্দনও৷ সাংবাদিকরা এবার বাইট নেবার জন্য ঘিরে ধরেছে সেই অভিনেতাকে৷ তারা এখন আর চন্দনকে ধরবে না৷ চন্দন সেখানেই দাঁড়িয়ে ভাবল, সাংবাদিকদেরকে তার বলা কথাগুলো কি ঠিক হল?’

আর এর পরই সে পাশ থেকে শুনতে পেল, ‘চন্দনবাবু আমার ওখানেই যাচ্ছেন তো? চলুন তবে৷’

অরিন্দম মুখার্জি, চন্দনের প্রকাশক৷ চন্দন তাঁকে দেখে বলল, ‘হ্যাঁ চলুন, আপনার ওখানেই যাচ্ছিলাম৷ এখানে হঠাৎ আটকে গেলাম৷’

বড় রাস্তা ছেড়ে গলির মধ্যে ঢুকে অরিন্দম বললেন, ‘আমিও বাড়ি থেকে কাউন্টারে আসছি৷ আপনাকে ক্যামেরার সামনে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ একদম ঠিক জবাব দিলেন আপনি৷ ওরা বুঝতে চায় না যে কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বহু মানুষের জীবন, পেট জড়িয়ে থাকে৷ আসলে কোনো মশলাদার খবর পেলেই এরা হামলে পড়ে৷ সেই যে সেবার বইপাড়া যখন ঝড়বৃষ্টিতে ভেসে গেছিল সেবার কত টিভি চ্যানেলকে ফোন করেছিলাম যাতে তারা সে ব্যাপারটা মানুষের সামনে তুলে ধরে সে জন্য, যাতে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ছোটো ছোটো প্রকাশকদের দিকে মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তার জন্য৷ সারা কলেজ স্ট্রিট জুড়ে এক কোমর জলে ভেসে বেড়াচ্ছিল বইয়ের পাতা, প্রকাশকদের ঘরে বইগুলো কাদা হয়ে মাটিতে মিশে যাচ্ছিল৷ কিন্তু সে সব ছবি সেদিন কেউ তুলতে আসেনি তার মধ্যে খুন-ধর্ষণের মতো কোনো মশলা ছিল না বলে৷’

অরিন্দমবাবুর সঙ্গে চন্দন তাঁর বইয়ের দোকানে পৌঁছে গেল৷ চন্দনের আজ অন্য কোথাও যাবার পরিকল্পনা নেই৷ প্রকাশিত অরিন্দমবাবুর থেকে বইয়ের রয়ালটি বাবদ তার প্রাপ্য টাকা বুঝে নেবার পর আরও প্রায় এক ঘণ্টা সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে কাটাল চন্দন৷ কথা প্রসঙ্গে সে একবার অরিন্দমবাবুকে বলল, ‘এই পাড়াতে একজন বলছিলেন বিদেশিনি ধর্ষণের ঘটনাটা তো এখন লোকের মুখে মুখে ফিরছে, আর তার সঙ্গে একটা পানশালার নামও যুক্ত হয়েছে৷ এ সব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে নাকি সেটা হটকেক হতে পারে?’

কথাটা শুনে বইপাড়ার প্রবীণ প্রকাশক অরিন্দমবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তা হয়তো হতে পারে৷ তবে এই বইপাড়াতে তো আমার চল্লিশ বছর হয়ে গেল, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হল, এ ধরনের লেখা হটকেক হয় ঠিকই, বেস্ট সেলারও হয়, কিন্তু তা সবই ওই তিনমাস-ছমাসের জন্য৷ তারপর ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে এ সব বই৷ যে বই নিয়ে বইপাড়াতে, সংবাদপত্রে মাতামাতি হয়েছে একদিন, ভবিষ্যতে সে বইয়ের নামও কেউ মনে রাখে না৷ ধর্ষণ, পানশালা বা বেশ্যালয় নিয়ে বই লেখা যেতেই পারে, কিন্তু তার মধ্যে বিশ্লেষণাত্মক কিছু যদি না থাকে, সামাজিক ব্যবস্থা যদি প্রতিফলিত না হয় তা টিকবে না৷’

অরিন্দমবাবুর সঙ্গে কথা শেষ করে তাঁর কাউন্টার ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়ল চন্দন৷ আর সে সময় বিদিশার কথা মনে হল তার৷ দু-সপ্তাহ ধরে যেদিনই চন্দন কলকাতা বা কলেজ স্ট্রিট এসেছে, সেদিনই সে বিদিশাতে গেছে৷ জায়গাটার প্রতি শুধু অদৃশ্য টান নয়, চন্দনের যেন অভ্যাসেও পরিণত হয়ে গেছিল ব্যাপারটা৷ যদি সব কিছু ঠিক থাকত, বিদিশা খোলা থাকত, চন্দন হয়তো বা আজও যেত সেখানে৷ চন্দনের একবার মনে হল, সে একবার অপূর্ব ঘোষালকে ফোন করে খবর নেয় পরিস্থিতি এখন কেমন সে সম্পর্কে৷ কিন্তু এরপরই চন্দনের মনে হল বিদিশা বারের ম্যানেজার হয়তো এখন লালবাজারে বসে থাকতে পারেন, অথবা বিপদমুক্ত হবার জন্য হয়তো কোথাও ছুটে বেড়াচ্ছেন৷ এ সময় তাঁকে ফোন করা উচিত হবে না৷ বাড়ি ফিরে তাঁকে রাতে ফোন করবে চন্দন৷

অপূর্ব ঘোষালের কথা ভাবতে ভাবতে কলেজ স্ট্রিট মোড়ের দিকে এগোচ্ছিল চন্দন৷ ঠিক এই সময়তেই কাকতালীয় ভাবে বিদিশা বারের ম্যানেজারের ফোন কলটা এল! অপূর্ব কলটা রিসিভ করতেই, ওপাশ থেকে অপূর্ববাবুর কণ্ঠস্বর ভেসে এল—‘চন্দনবাবু আপনি কি কলকাতা এসেছেন?’

চন্দন জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, এই তো, কাজ মিটিয়ে কলেজ স্ট্রিট থেকে বেরোচ্ছি৷ কেন? কী ব্যাপার?’

তিনি বললেন, ‘যদি অসুবিধা বোধ না করেন, তবে আমার এখান থেকে কিছু সময়ের জন্য ঘুরে যাবেন?’

চন্দন মুহূর্তের মধ্যে ভেবে নিয়ে জবাব দিল, ‘আচ্ছা, যাচ্ছি এখন৷ বিদিশা কি খুলে গেছে?’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘না, খোলেনি৷ তবে আমি আছি৷ অর্জুন বাইরে থাকবে, সে আপনাকে ভিতরে নিয়ে আসবে৷ আমি অপেক্ষা করছি আপনার জন্য৷’—এ কথা বলে অপূর্ববাবু লাইনটা ছেড়ে দিলেন৷

অপূর্ব ঘোষালের ডাক শুনে মনের ভিতর একটা চাপা উত্তেজনা অনুভূত হল চন্দনের৷ অপূর্ব ঘোষাল কেন তাকে বিদিশাতে যাবার অনুরোধ করলেন?

কলেজ স্ট্রিট মোড়ের কিছুটা আগেই একটা ট্যাক্সি প্যাসেঞ্জার নামাচ্ছিল৷ চন্দন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে চাঁদনি যাবে বলতেই লোকটা রাজি হয়ে গেল৷

বিদিশার দরজার ঠিক সামনেই ট্যাক্সি থেকে নামল চন্দন৷ বিদিশার সদর দরজার শাটার নামানো৷ বাইরে থেকে তালা দেওয়া৷ বিদিশার সামনে আজ কোনো রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ, পুলিশ বা রিপোর্টারের ভিড় না থাকলেও বিদিশার বন্ধ দরজার ওপর কারা যেন সার সার পোস্টার সেঁটে দিয়ে গেছে৷ তার কোনোটাতে লেখা—সমাজবিরোধীদের আখড়া বন্ধ করো, কোনোটাতে লেখা—ধর্ষকের গ্রেপ্তার চাই বা মদ্যপান বিরোধী স্লোগান৷ চাঁদনিচকের ব্যস্ত দুপুরে পথচলতি জনতা সেই পোস্টারগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে৷ ইতিমধ্যে টেলিভিশন, খবরের কাগজের দৌলতে অনেকেরই আর জানতে বাকি নেই যে, এই সেই বিদিশা বার৷ ধর্ষক সেখানকার কর্মী৷ চন্দন ট্যাক্সি থেকে নেমে বিদিশার সামনের ফুটপাতে উঠল৷ এক মাঝবয়সি দম্পতি ফুটপাত ধরে হেঁটে আসছিলেন৷ বিদিশার সামনে দিয়ে যাবার সময় শাটারের ওপর পোস্টারগুলোর ওপর ভদ্রমহিলার নজর পড়তেই চন্দনের সামনেই ভদ্রমহিলা আঁতকে উঠে তাঁর স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরে বললেন, ‘এ রাস্তা ছাড়া তুমি হাঁটার কোনো পথ পেলে না! এই তো বিদিশা! তাড়াতাড়ি রাস্তার ওপাশে ফুটপাতে চলো৷’

ভদ্রমহিলা এমনভাবে কথাগুলো বললেন, যেন এখনই কেউ বিদিশার বন্ধ দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ভদ্রমহিলাকে ধর্ষণের জন্য তুলে নিয়ে যেতে পারে! স্ত্রীর কথা শুনে ভদ্রলোকও তাড়াতাড়ি রাস্তায় নেমে পড়লেন ফুটপাত বদল করার জন্য৷ তাঁদের দেখে চন্দন বুঝতে পারল যে জনমানসে কী পরিমাণ আতঙ্ক আর উদ্বেগ ছড়িয়েছে ধর্ষণের ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করে! এবং একই সঙ্গে বিদিশার বদনামও!

বিদিশার সদর দরজার কিছুটা তফাতে রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল চন্দন৷ শীর্ষেন্দুর বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল তার৷ হ্যাঁ, যা পরিস্থিতি তাতে চন্দনের পক্ষে এখানে উপস্থিত হওয়াটা ঠিক নিরাপদ নয়৷ কিন্তু চন্দন যেন কিছুতেই এ জায়গাটার প্রতি তার টানকে অগ্রাহ্য করতে পারছে না৷

চন্দন সেখানে মিনিট তিনেক দাঁড়াতেই তার সামনে এসে দাঁড়াল অর্জুন৷ তাকে অনুসরণ করে চন্দন গলির ভিতর প্রবেশ করে উপস্থিত হল স্বর্গের দরজার সামনে৷ সেই দরজার বাইরেও শাটার নামানো ছিল৷ শাটারটা টেনে একটু ওপরে উঠিয়ে অর্জুন বলল, ‘ম্যানেজার সাহেব দোতলার সিংগিং ফ্লোরে আছেন৷ সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উঠবেন৷’

শাটারের তলা দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে চন্দন ভিতরে প্রবেশ করল৷ তার পিছনে অর্জুন আবার বাইরে থেকে শাটার নামিয়ে দিল৷ বাইরের চড়া রোদ থেকে ভিতরে প্রবেশ করার কারণেই হঠাৎই যেন চন্দনের চোখে কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্ধকার নেমে এল৷ সিঁড়িতে ওঠার মুখে প্রথমে দাঁড়িয়ে পড়ল চন্দন৷ তারপর চোখ সইয়ে নিয়ে আধো অন্ধকার স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল৷

দোতলায় উঠে এল চন্দন৷ আধো অন্ধকার করিডোর৷ আলো জ্বলছে না৷ কাচের দরজা খুলে সিংগিং ফ্লোরে ঢুকল চন্দন৷ যে জায়গাটাতে আলোর ঝলকানি আর সাউন্ড সিস্টেমের উন্মত্ত শব্দে বেশিক্ষণ থাকা যায় না, সে জায়গাতে এখন বিরাজ করছে আধো অন্ধকার আর অপরিসীম নিস্তব্ধতা৷ একমাত্র এয়ারকন্ডিশনের ঠান্ডা বাতাস ছাড়া এ জায়গাটাকে আজ যেন কেমন অপরিচিত মনে হল চন্দনের৷ ঘরের এক কোণে মাথার ওপরের সিলিং-এ একটা ছোটো নীল আলো জ্বলছে৷ তার ঠিক নীচে একটা টেবিলে বসে যে ছোটো মঞ্চটাতে দাঁড়িয়ে রাতপরীরা গান করে সেই শূন্য বেদিটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল৷ আর কোনো লোক নেই ঘরে৷ চন্দন সেই টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অপূর্ব ঘোষাল মৃদু হাসলেন তার দিকে তাকিয়ে৷ কিন্তু সে হাসিতে স্পষ্ট জেগে আছে হতাশা-বিষণ্ণতার ছাপ৷ চন্দন তাঁর মুখোমুখি বসতেই তিনি বললেন, ‘আমি জানতাম, আপনি শেষবারের জন্য হলেও আমার ডাকে সাড়া দিয়ে একবার আসবেন৷ অন্য কেউ হলে হয়তো এখানে আসত না এ পরিস্থিতিতে৷ জানেন, এখানের কিছু কাস্টমারের সঙ্গে আমি টেলিফোনে বা নিজে গিয়ে এ দু’দিন যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি এই বিপদের সময় কিছু সাহায্যের প্রয়োজনে৷ পুরোনো কাস্টমার সব, দীর্ঘদিনের আলাপ৷ কিন্তু তাঁরা কেউ টেলিফোনে কথা বলতে চাইলেন না, একজন তো দরজা না খুলে বাড়ির সামনে থেকে তাড়িয়েই দিলেন৷’ এ কথা বলে তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমার মন বলছিল আপনাকে ডাকলে আপনি আসবেন৷ দুটো কারণে আপনাকে এখানে আসতে বললাম আমি৷ প্রথমত, একটা খবর আপনাকে আমার জানাবার আছে, আর দ্বিতীয়ত, আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে৷’

চন্দন বলল, ‘কী খবর?’

সিলিং-এর আলোটার দিকে তাকিয়ে আবারও একটু চুপ করে থেকে বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘এই বিদিশা বার আর কোনোদিন খুলবে না৷’

তাঁর জবাব শুনে চন্দন বিস্মিতভাবে বলে উঠল, ‘আর কোনোদিন খুলবে না কেন? মেয়েটার ব্যাপারে কি কোনো দুঃসংবাদ এসেছে? নাকি সে জ্ঞান ফেরার পর যাকে তার ধর্ষক হিসাবে চিহ্নিত করেছে সে এই পানশালারই কর্মী?’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘না, মেয়েটার এখনও জ্ঞান ফেরেনি৷ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি হতভাগ্য মেয়েটি যেন সুস্থ হয়ে ওঠে, তার নিজের দেশে, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়৷’

চন্দন কথাটা শুনে বলল, ‘অপরাধী তো এখনও শনাক্তই হয়নি৷ পুলিশ তো সাময়িকভাবে বিদিশা বন্ধ রাখতে বলেছে৷ তবে বিদিশা আর খুলবে না কেন?’

বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল হতাশভাবে বললেন, ‘বিদিশা বারের মালিক দীনেশ খাস্তগীর শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন এ জায়গা তিনি ওই প্রকাশ জয়সোয়ালকে বিক্রি করে দেবেন৷ সিদ্ধান্তটা তিনি দু-তিন দিনের মধ্যে লোকটাকে জানিয়ে দেবেন৷ মালিক দিন পনেরো পর কলকাতা ফিরবেন৷ তারপর জয়সোয়ালের সঙ্গে কাগজপত্র সইসাবুদ, টাকাপয়সা লেনদেন হবে৷’

চন্দন কথাটা শুনে বললে, ‘তিনি এত পুরোনো প্রতিষ্ঠানটা বিক্রি করে দেবেন! এত ঐতিহ্যমণ্ডিত একটা প্রতিষ্ঠান! আপনি তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন?’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘যতটা সম্ভব করেছি৷ তবে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন৷ তিনি বলছেন ‘তাঁর পক্ষে আর বারের ঝক্কি-ঝামেলা নেওয়া সম্ভব নয়৷ তাঁর বয়স ষাটের ওপর৷ সুগার-প্রেশার আছে, বৃদ্ধা মায়ের অসুস্থতা, পারিবারিক কিছু সমস্যা, ইত্যাদি নানা কারণে তাঁর পক্ষে মানসিক চাপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না৷ তা ছাড়া জয়সওয়ালও ভালো দাম দেবে বলেছে৷ টাকার কাছে আর ঐতিহ্যের দাম কতটুকু? দেখছেন না, এই কলকাতা শহরেই কত বিখ্যাত মানুষের বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট-শপিং মল হচ্ছে! ওই সব বিখ্যাত মানুষদের উত্তরাধিকারীরাইতো বিক্রি করছেন প্রপার্টিগুলো৷’—কথা শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন অপূর্ব ঘোষাল৷

চন্দন জানতে চাইল, ‘বিদিশাতে যাঁরা কাজ করেন, তবে তাঁদের কী হবে?’

অপূর্ব ঘোষাল উত্তর দিলেন, ‘বিদিশাতে আমরা ম্যানেজার, ক্যাশিয়ার, ওয়েটার, কুক, সিকিওরিটি গার্ড মিলিয়ে ষোলোজন কর্মচারী৷ মালিকের কথায় যা বুঝলাম তাতে পদমর্যাদা অনুসারে কাউকে বিশ, কাউকে চল্লিশ বা পঞ্চাশ হাজার টাকা ধরিয়ে দেওয়া হবে৷ আমি বিদিশা বারের ম্যানেজার হিসাবে হয়তো লাখ দেড়েক টাকা পাব৷ আর আশাবরীর মতো যারা এই সিংগিং ফ্লোরের সঙ্গে যুক্ত, যারা চুক্তিভিত্তিক কর্মী তারা শুধু বকেয়া বেতন পাবে৷’ চন্দনের কথার জবাব দেবার পর অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘মালিকের সঙ্গে কথা বলার পর বেলা দশটা নাগাদ এখানেই এসে ঢুকেছি, তারপর এই চার-পাঁচ ঘণ্টা একলাই ওপরে বা নীচে অন্ধকারে কোথাও বসে থেকেছি বা ঘুরে বেড়িয়েছি৷ আসলে বিদিশা বার বন্ধ হলে আমি হয়তো আজ আর না খেয়ে মরব না, কিন্তু আমার বহু স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই ফ্লোরগুলোর সঙ্গে, এমনকী টেবিল- চেয়ারগুলোর সঙ্গে৷ তা ছাড়া এই বারে বছরের পর বছর থাকতে থাকতে ফিরোজের মতো অনেকের সঙ্গেই তো দাদা-ভাই-বন্ধু-আত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল৷ তারাও কে কোথায় ভেসে যাবে কে জানে? আজ আমি সত্যিই বুঝতে পারছি বিদিশার সঙ্গে আমি কতোটা জড়িয়ে দিলাম! ব্যাপারটা হয়তো আমি আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারব না৷ আজ আমি তালা ঝুলিয়ে চাবি বাড়ি নিয়ে চলে যাবার পর আর কোনোদিন বাইরের মানুষরা আসবে না এখানে৷ আপনারও আর কোনোদিন আসা হবে না বিদিশা বারে৷ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এ জায়গাতে মাথা তুলে দাঁড়াবে ঝা-চকচকে শপিং মল৷’—একটানা কথাগুলো বলে থামলেন বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল৷

চন্দন বলল, ‘আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি৷ আমি এই পানশালার কেউ নই৷ এখানে আমার সামান্য কয়েকদিনের যাওয়া-আসা মাত্র৷ আর তাতেই আমার মনে হয় আমি মানসিকভাবে কেমন যেন জড়িয়ে গেছি বিদিশার সঙ্গে৷ গত কয়েকদিন ধরে আপনাদের ব্যাপারটা নিয়ে প্রবল উৎকণ্ঠার মধ্যে আছি আমি৷ যখনই টেলিভিশন খুলি, সংবাদপত্রর ভাঁজ খুলি, তখনই দেখার চেষ্টা করি, খোঁজার চেষ্টা করি, কোথাও কোনো আশার আলো আছে কি না? ওই অদেখা ধর্ষিতা মেয়েটার জন্য আমার যেমন মন খারাপ লাগছে তেমনই একই ভাবে খারাপ লাগছে এখানকার মানুষগুলোর জন্য৷’

বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল চন্দনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই বললেন, ‘আপনাকে যে অনুরোধটা করতে চলেছি তা কিন্তু এ মানুষগুলোর বিষয়ই৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘কী অনুরোধ?’

একটু চুপ করে থেকে অপূর্ব ঘোষাল তাকে প্রথমে পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘এ ক’দিন এখানে এসে, আমার সঙ্গে, অন্যদের সঙ্গে কথা বলে পানশালা নিয়ে লেখার মতো মোটামুটি একটা ধারণা নিশ্চয়ই তৈরি হয়েছে আপনার? আর কোনোদিন এখানে না এলেও লেখাটা নিশ্চয়ই লিখতে পারবেন আপনি?’

চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, তা পারব৷ লেখাটা আমি লিখতে পারব বলেই আশা৷’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘যদি লেখেন তবে শুধু পানশালা মানেই ফুর্তির জায়গা এটুকুই লিখবেন না৷ তার পাশাপাশি এখানকার যারা কর্মী, যারা এ জায়গার ওপর নির্ভর করে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকে তাদের দুঃখ, বেদনা, অসহায়তার কথাও লিখবেন৷ পানশালা জায়গাটা অনেকেই অচ্ছুৎ, ঘৃণার স্থান বলে মনে করেন৷ কিন্তু এখানকার মানুষরা কিন্তু কেউই অচ্ছুৎ নয়৷ তারা সমাজের আর পাঁচটা মানুষের মতোই সমাজের অংশ৷ তাদের কথাটাও অন্তত একটু লিখবেন আপনার লেখাতে৷—এটুকুই শুধু আপনার কাছে আমার অনুরোধ৷’—এই বলে চন্দনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অপূর্ব ঘোষাল৷

চন্দনের তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই আধো অন্ধকারের মধ্যেও যেন মনে হল, অপূর্ব ঘোষালের চশমার আড়ালে চোখের কোণ যেন চিকচিক করছে৷

চন্দন তাঁর উদ্দেশে বলল, ‘আপনার অনুরোধ আমি নিশ্চয়ই মনে রাখব৷ উপন্যাসটা যদি লিখি তবে নিশ্চয়ই তাতে লেখা থাকবে এখানকার মানুষদের জীবনের কথা৷ তাদের সুখ-দুঃখর কথা৷’

চন্দন আর অপূর্ববাবু এরপর বেশ কিছুটা সময় সেই আধো অন্ধকার ঘরে নিশ্চুপভাবে বসে রইল৷ তারপর একসময় অপূর্ব ঘোষাল তার রিস্টওয়াচটা দেখে নিয়ে বললেন, ‘আপনি যে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে এলেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ৷ বিকাল হয়ে এল৷ এবার আমি বাড়ি ফিরব, খুব ক্লান্ত লাগছে৷ লালবাজার থেকে হয়তো অবার যেকোনো মুহূর্তে ডাকও আসতে পারে৷ তবে যাবার আগে একবার নীচের ফ্লোরটা দেখে আসি৷’

চন্দন বলল, ‘চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে গিয়ে শেষবারের মতো জায়গাটাতে একবার ঘুরে আসি৷’

দোতলার সিংগিং ফ্লোরের চারপাশে একবার তাকিয়ে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে চন্দনকে নিয়ে বাইরে বেরোলেন অপূর্ব ঘোষাল৷ তারপর আধো অন্ধকার করিডোর পেরিয়ে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন নীচের ফ্লোরে৷ গাঢ় অন্ধকার খেলা করছে জায়গাটাতে৷ অপূর্ব ঘোষাল দেওয়াল হাতড়ে একটা সুইচ জ্বালালেন৷ আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরটাতে৷ চারপাশে শুধু সার সার শূন্য টেবিল -চেয়ার৷ টেবিলের ওপরে উলটে রাখা আছে শূন্য পানপাত্রগুলো৷ কাউন্টারের দেওয়ালের গায়ের র‌্যাকে রাখা সার সার পানীয়ের বোতলগুলো যেন বিষণ্ণভাবে চেয়ে আছে শূন্য গ্লাসগুলোর দিকে৷ কোনো টেবিল থেকে আর ভেসে আসছে না গ্লাস, প্লেট, চামচের টুংটাং শব্দ, ভ্রমরের গুঞ্জনের মতো কথাবার্তার শব্দ নেই, বাতাসে ভাসছে না কড়া মদ আর খাবারের গন্ধ মেশানো অদ্ভুত সেই গন্ধ! গন্ধহীন, শব্দহীন, বর্ণহীন এক অদ্ভুত নীরবতা যেন বিরাজ করছে সারা ঘর জুড়ে৷ ওই তো সেই টেবিলটা! যেখানে এসে তাঁর একাকিত্ব কাটাবার জন্য বসতেন বৃদ্ধ পরিমল ভট্টাচার্য তাঁর মৃত বন্ধুর জন্য মদের গ্লাস সাজিয়ে৷ কোনার ওই টেবিলটাতে বসেই তো চন্দনের কাছে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন নাট্যকার অসীম রায়৷ আর চন্দনের সামনের টেবিলটাতে বসেই তো মধুরার ফিরে আসার জন্য প্রতীক্ষা করে সেই আধ পাগল ছেলেটা৷—এরা আর কেউই কোনোদিন এ ঘরে এসে বসবে না৷ বৃদ্ধ ফিরোজ আর কোনোদিন তার মাথার পাগড়ি ঠিক করতে করতে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে খেয়াল রাখবে না কার কী চাই৷ ওই বন্ধ কাচের দরজা খুলে দিয়ে রমানাথ কোনোদিন স্যালুট ঠুকবে না বিদিশার অতিথিদের৷ বিদিশার দরজা এবার থেকে বন্ধ৷ শূন্য নিস্তব্ধ ঘরটার চারপাশে দাঁড়িয়ে চন্দনের এ ক’দিন এখানে আসার স্মৃতিগুলো মনে পড়ে যেতে লাগল, আর একই সঙ্গে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতাও যেন প্রবলভাবে গ্রাস করতে লাগল তাকে৷ অপূর্ব ঘোষালও যতক্ষণ সে ঘরে দাঁড়িয়ে রইলেন ততক্ষণ তাঁর চোখ ছুঁয়ে যেতে লাগল সে ঘরের প্রতিটা টেবিল, সিলিং থেকে শুরু করে মেঝের প্রতিটা কোণ৷ হয়তো বা তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল৷ কিছুক্ষণ সে ঘরে দাঁড়িয়ে থাকার পর অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘চলুন এবার যাই? এখানে বেশিক্ষণ থাকলে আরও মন খারাপ করবে৷’

সে ঘর থেকে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে স্বর্গের সিঁড়ি দিয়ে নেমে অপূর্ব ঘোষালের সঙ্গে বিদিশার বাইরে বেরোল চন্দন৷ অর্জুন দরজা বন্ধ করে বাইরের শাটার নামাবে এখন৷ রাস্তাতে এইরকম রোদ ঝলমল করছে, শুধু বিদিশার ভিতরই জমাটবাঁধা অন্ধকার৷ করমর্দনের জন্য চন্দনের দিকে হাত বাড়ালেন অপূর্ব ঘোষাল৷ তাঁর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো অসহায়, বেদনার হাসি৷ চন্দন তাঁর হাতটা ধরতেই তিনি বললেন, ‘লেখাটা ছাপা হলে আমাকে টেলিফোনে একটু জানিয়ে দেবেন৷ আর বিদিশার মানুষগুলোর কথা মনে রাখবেন৷’

চন্দন বলল, ‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জানাব৷’

বড় রাস্তার দিকে এগোবার জন্য এরপর পা বাড়াল চন্দন৷ সে শুনতে পেল তার পিছনে স্বর্গের সিঁড়ির ঝাঁপ নেমে যাবার ঝনঝন ধাতব শব্দ৷