একদা এক পানশালাতে – ৭

৷৷ ৭ ৷৷

অন্যদিন সকাল সাতটার মধ্যেই ঘুম ভাঙে চন্দনের৷ আজ ঘুম থেকে উঠতে প্রায় নটা বেজে গেল৷ আসলে গতরাতে প্রায় দুটো পর্যন্ত পাণ্ডুলিপির প্রুফ দেখে কাজ শেষ করেছে চন্দন৷ তারপর বিছানাতে শোবার পরও বেশ কিছু সময় ঘুম আসেনি তার৷ মাথার মধ্যে খালি ঘুরপাক খাচ্ছিল ধর্ষণ আর তার সঙ্গে বিদিশা বারের নাম জড়িয়ে যাবার খবরটা৷

মুখ ধুয়ে চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দাতে বসল চন্দন৷ সামনেই ছোটো টেবিলের ওপর দৈনিক সংবাদপত্রটা রাখা৷ কাগজটা নিয়ে তার ভাঁজ খুলতেই চোখে পড়ল প্রথম পাতার ওপরের দিকে বড়ো বড়ো করে লেখা—‘বিদেশিনি ধর্ষণ, মুখ পুড়ল কলকাতার৷’

চায়ে চুমুক দিতে দিতে খবরটা পড়তে শুরু করল চন্দন৷ বিদিশা বারের ম্যানেজারের মুখ থেকে চন্দন যা শুনেছে, কাগজে মোটামুটি তাই লেখা হয়েছে৷ তবে তার সঙ্গে সংযোজনও আছে৷ সরকারি তরফে দাবি করা হয়েছে তাঁরা দোষীকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন, এবং ধর্ষিতা বিদেশিনিকে সুস্থ করার চেষ্টা করছেন, যদিও এখনও তার জ্ঞান ফেরেনি৷ বিরোধী রাজনৈতিক দলের বক্তব্যও ছাপা হয়েছে কাগজে৷ তাদের বক্তব্য রাজ্যে কোনো আইন-শৃঙ্খলা নেই৷ ওই বিদিশা পানশালার সঙ্গে শাসকদলের নেতাদের কয়েকজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কারণে অপরাধীকে আড়াল করতে চাচ্ছে সরকার৷ তাই তাঁরা সরকারি আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণে আন্দোলন শুরু করবেন৷

কাগজটা পড়ে চন্দন বুঝতে পারল, ঘটনাটাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই সরকার-বিরোধীদের দু-পক্ষের মধ্যে চাপান-উতোর, রাজনীতির খেলা শুরু হয়ে গেছে৷ কাগজ দেখে, চা খাওয়া শেষ করে ভিতরের ঘরে গিয়ে টিভি চালাল চন্দন৷ বেশ কয়েকটা চ্যানেল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল সে৷ সব চ্যানেলেই লিডিং নিউজ ধর্ষণের খবর৷ কিছু চ্যানেল বিদিশার নাম উল্লেখ না করে বলছে—চাঁদনির একটি পানশালা, আবার কোনো চ্যানেল সরাসরি বলছে—‘বিদিশা বার’৷ এগিয়ে থাকা এক চ্যানেলের সাংবাদিক আবার ‘গ্রাউন্ড জিরো’ অর্থাৎ অকুস্থল থেকে লাইভ করছেন৷ ধর্ষকের বাইকটা ঠিক কোথায় এসে থেমেছিল, ঠিক ক-পা ফেলে সেই ধর্ষক কীভাবে মেয়েটাকে ঝোপের আড়ালে টেনে নিয়ে গেছিল তা সেই সাংবাদিক এমনভাবে দেখাচ্ছেন, বলছেন যে তা দেখে মনে হয় ওই সাংবাদিক নিজেই যেন ওই ধর্ষকের বাইকে চেপে ঘটনার সময় উপস্থিত হয়েছিলেন!

স্নান-খাওয়া সেরে বেলা দশটা নাগাদ বাড়ি থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দিল চন্দন৷ টেলিভিশন আর সংবাদপত্রের দৌলতে ধর্ষণের খবরটা এখন হটকেক৷ ট্রেনেও সহযাত্রীদের টুকরো টুকরো আলোচনার মাধ্যমে ব্যাপারটা বুঝল চন্দন৷ কেউ প্রশাসনিক ব্যর্থতার কথা বলছে, কেউ আবার মেয়েটাকেই দোষ দিচ্ছে৷ এই যেমন চন্দনের সিটের উলটোদিকেই বসে থাকা প্রৌঢ় ভদ্রলোক পান চিবুতে চিবুতে তার সঙ্গীকে বলছিল—‘মেয়েটারই তো দোষ, তুই বাবা রাত্রিবেলা বারে মদ খেতে গেছিলি কেন? অন্যের বাইকেও উঠলি কেন? এমনও হতে পারে এ দেশে এসে ওর টাকা ফুরিয়ে গেছিল, তাই বাইকঅলাকে নিজেই ডেকে নিয়েছিল পয়সার বিনিময় আনন্দ দেবার জন্য৷ তারপর অন্য কোনো গণ্ডগোল হয় তাদের দুজনের মধ্যে৷’

এ দেশে ধর্ষণ হলে অনেকেই ধর্ষিতার চরিত্রের দিকে আঙুল তোলেন, এ ব্যাপারটা চন্দন আগেও খেয়াল করেছে৷ এ এক অদ্ভুত মানসিকতা! তবে চন্দন কারো কথায় অংশগ্রহণ করল না৷ নিজের মনে চুপচাপ বসে সবার কথা শুনল সে৷

সঙ্গে পাণ্ডুলিপির ব্যাগটা বেশ ভারী, তাই শিয়ালদা নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বারোটা নাগাদ কলেজ স্ট্রিট পৌঁছে গেল৷ গতকাল যে প্রকাশকের ঘরে সে গেছিল সেই প্রকাশকের ঘরেই প্রথমে গেল চন্দন৷ প্রবীণ প্রকাশক বিজয়বাবু নিজেও আজ কাউন্টারে উপস্থিত৷ চন্দনকে দেখেই তিনি হেসে বললেন, ‘আপনি কখন আসবেন সে জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম৷

চন্দন মৃদু হেসে বলল, ‘আজ যখন আমি পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে যাব বলেছিলাম, তখন আমি আসবই৷ আপনার চিন্তার কারণ ছিল না৷ কাল রাত দুটো পর্যন্ত প্রুফ দেখে কাজ শেষ করলাম৷’

কথাটা শুনে বিজয়বাবু বললেন, ‘আপনার কথার দাম আছে আমি জানি৷ পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমার কোনো চিন্তা ছিল না৷ আপনার সঙ্গে আমার অন্য একটা আলোচনা আছে৷ ম্যানাস্ক্রিপ্টটা এখানে রেখে আমার চেম্বারে চলুন৷’

তাঁর কথা শুনে চন্দন বুঝতে পারল বিজয়বাবু তার সঙ্গে একটু গোপনীয় আলোচনা করতে চান৷ চন্দন তাঁর কর্মচারীদের কাছে পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে এবং সে সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় কিছু নির্দেশ দিয়ে বিজয়বাবুর সঙ্গে রাস্তায় নামল৷ পাশেই একটা সরু গলি, সেখানেই একটা ঘর বিজয়বাবু তাঁর চেম্বার হিসাবে ব্যবহার করেন৷ চন্দনকে নিয়ে ঘরটাতে ঢুকলেন তিনি৷ একটা টেবিলের দু-পাশে দুটো চেয়ারে মুখোমুখি বসার পর বিজয়বাবু তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘চাঁদনিতে যে পানশালা আছে সেখানে গেছেন আপনি?’

কথাটা শুনে মৃদু চমকে উঠল চন্দন৷ বিদিশার ঘটনা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে চলেছেন নাকি ভদ্রলোক? তিনি কি কোনোভাবে খোঁজ পেয়েছেন যে চন্দনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে বিদিশার?

চন্দন তাঁকে পালটা প্রশ্ন করল, ‘কেন বলুন তো?’

বিজয়বাবু বললেন, ‘অবশ্য না গেলেও কোনো সমস্যা নেই৷ ও ব্যাপারে বাজারে যে সব বই আছে তা আমি জোগাড় করে দেব৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার?’

তিনি বললেন, ‘ও ব্যাপারে আলোচনা করার জন্যই তো আপনাকে এখানে আনলাম৷ পানশালাতে বিদেশিনি ধর্ষণের ব্যাপারটা তো জেনেছেন নিশ্চয়ই?’

তাঁর কথার মধ্যেই চন্দন বলে উঠল, ‘পানশালাতে তো নয়, টিভি, কাগজে যা বলছে তাতে ওই মেয়েটা পানশালাতে গেছিল ঠিকই, কিন্তু ধর্ষণটা হয়েছে বাইপাসের ধারে৷’

বিজয়বাবু বললেন, ‘ওই একই হল৷ এখন ক’দিন ধরে এ নিয়েই আলোচনা চলবে পাবলিকের মধ্যে৷ পানশালার মধ্যে রেপ নিয়ে আপনি একটা হাজার পঞ্চাশ শব্দের উপন্যাস নামিয়ে ফেলুন৷ কাল থেকেই লেখার কাজ শুরু করলে দশ-বারো দিনের মধ্যেই শেষ হবে আশা করি৷ রোজ আপনার বাড়িতে আমার লোক গিয়ে লেখা এনে কম্পোজে দিয়ে দেবে, পনেরো দিনের মধ্যে বইটা বাজারে ছেড়ে দেব আমি৷ একেবারে হটকেকের মতো বইটা বিক্রি হবে৷ একদম হট টপিক৷ আর দিন পনেরো পরেও যদি এ ঘটনার রেশ চলতে থাকে তাহলে তো কোনো কথাই নেই৷ বেস্টসেলার হয়ে যাবে বইটা৷’

বিজয়বাবুর কথা শুনে চুপ করে রইল চন্দন৷ ঝানু পুস্তক ব্যবসায়ী বিজয়বাবু এরপর বললেন, ‘কোনো চিন্তা করবেন না মশাই৷ বাজারে মদ-পানশালা, ক্যাবারে ডান্স নিয়ে যে সব বই আছে তা আজই আমি জোগাড় করে দিচ্ছি৷ ও সব জায়গাতে নিজের যাবার অভিজ্ঞতা যদি নাও থাকে বই থেকে জেনে নেবেন৷ এই যে কত লোক বেশ্যালয় নিয়ে উপন্যাস লেখেন, তাঁরা কয়জন সোনাগাছি বা হাড়কাটা গলিতে গেছেন শুনি? আসলে তথ্য অর্থাৎ রান্নার মশলাই হল আসল৷ তা হাতে পেলে আপনার মতো পাকা রাঁধুনির রান্না করতে কতক্ষণ লাগবে?’

এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘প্লট সাজাবার ব্যাপারে আপনাকে কিছু বলার দুঃসাহস আমার নেই৷ আপনি উপন্যাসে ক্যাবারে ডান্সারের সঙ্গে কারো প্রেম দেখাতে পারেন, এটাকে থ্রিলার স্টোরিও বানাতে পারেন; কিন্তু যাই লিখুন ওই ধর্ষণ আর পানশালার ব্যাপারটা আপনাকে রাখতেই হবে৷ কলেজ স্ট্রিটে বই ছাপতে ছাপতে চুল পাকিয়ে ফেললাম৷ কাস্টমারের কী চাহিদা তা আমি এতদিনে জানি৷ ভারী ভারী প্রবন্ধ, মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে লেখা গম্ভীর উপন্যাসগুলো অনেক সময় পুরস্কার এনে দেয় ঠিকই, কিন্তু দিনের শেষে বই পাড়াকে বাঁচিয়ে রাখে মুচমুচে লগ্ধ উপন্যাসই৷ আর তার বিষয় হিসাবে ধর্ষণ, ক্রাইম এসব অনবদ্য৷’

চন্দন একবার ভাবল বিজয়বাবুকে এখনই জানিয়ে দেয় যে পানশালাতে ধর্ষণ নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা তার নেই৷ কিন্তু সেটা বললে তিনি হয়তো আবার তখনই তাকে আটকে রেখে রাজি করাবার চেষ্টা শুরু করবেন৷ চন্দন তাই এখনই তাঁর মুখের ওপর ‘না’ না বলে বলল, ‘আপনার প্রস্তাব আমি শুনলাম৷ অন্তত একটা দিন আমাকে ভাবার সময় দিন৷ তারপর আমি আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি৷ আমাকে বেরোতে হবে এখন৷ জরুরি কাজ আছে একটা৷’ প্রকাশক বিজয়বাবু বললেন, ‘আপনি তাড়াতাড়ি জানাবেন৷ আমি জানি আপনি পারবেন৷ যত তাড়াতাড়ি মার্কেটে বইটা আসবে তাতে দুজনেরই লাভ৷’

চন্দন এরপর বিজয়বাবুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে পথে নেমে পড়ল৷ বাস ধরার জন্য কলেজ স্ট্রিট বর্ণপরিচয় মোড়ের দিকে এগোতে এগোতে চন্দন ভাবতে লাগল, ‘এই যে রেপের ব্যাপারটা নিয়ে নানা লোকে নানা ভাবে আলোচনা করছে, কিন্তু সত্যিই কি কেউ তেমন ভাবে ভাবছে ওই বিদেশিনি যুবতীর কথা? কেউ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির সুবিধা খুঁজছে, কেউ ব্যবসা খুঁজছে, সংবাদ মাধ্যম টি.আর.পি খুঁজছে৷ কিন্তু সত্যিই কি কেউ উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে মেয়েটার শারীরিক, মানসিক যন্ত্রণার কথা? বহু দূর দেশ থেকে এদেশের ওপর, এ শহরের ওপর ভরসা করে সে এসেছিল এখানে৷ তার মাসুল এমন বীভৎস ভাবে চোকাতে হল তাকে৷ হয়তো বা মেয়েটা একদিন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সুস্থ হয়ে নিজের দেশে ফিরে গেলেও কি সারাজীবনে ভুলতে পারবে তার ওপর ঘটা নারকীয় ঘটনার কথা? হয়তো বা তার জীবনের সব স্বপ্ন শেষ করে দিল ওই ভয়ংকর রাত৷ সারাজীবনটাই জীবন্মৃত হয়ে বাঁচতে হবে মেয়েটাকে৷ মারিয়া নামের সেই অচেনা, অদেখা তরুণীর কথা ভাবতে ভাবতে চন্দনের মনটা কেমন যেন তার প্রতি ভিজে উঠল৷

কলেজ স্ট্রিট থেকে বাস ধরে আধঘণ্টা পর বাস থেকে চাঁদনিতে এসে নামল চন্দন৷ তার সামনে কলকাতার ব্যাস্ত জনজীবন৷ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে দুপুরের রোদে ছুটে যাচ্ছে বাস-ট্যাক্সি, ঝাঁ-চকচকে সব গাড়ি৷ সিগনালে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লে সে সুযোগে রাস্তা পেরোচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ৷ চাঁদনির ইলেকট্রিক গুডসের দোকান, শপিং মলে একই ভাবে মানুষের আনাগোনা৷ যে ধর্ষিতা যুবতী এখন অচেনা কোনো হাসপাতালের বেডে অর্ধমৃত অবস্থায় শুয়ে আছে, তাকে নিয়ে, সে ঘটনা নিয়ে সবাই আলোচনা করলেও তার জন্য তো আর জনজীবন থেমে থাকতে পারে না৷ আর তা থাকার কথাও নয়৷ রাস্তা পেরিয়ে অন্যদিকের ফুটপাতে উঠে বিদিশার দিকে এগোল চন্দন৷

বিদিশার কাছাকাছি পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই সেদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ কানে এল৷ চন্দন সেদিকে আরও এগোতেই ক্রমশ তার চোখের সামনে ফুটে উঠল দৃশ্যটা৷ জনা কুড়ি নারী-পুরুষ সরকারবিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের পতাকা নিয়ে জড়ো হয়েছে বিদিশার গেটের সামনে৷ স্লোগান দিচ্ছে তারা৷ লোকগুলো আর বিদিশার প্রবেশপথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুলিশকর্মী৷ দুটো পুলিশ ভ্যানও দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপর৷ বিদিশার দরজার বাইরের লোহার শাটারটা বাইরে থেকে না নামানো থাকলেও কাচের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ৷ অর্থাৎ বিদিশার ভিতরে লোক আছে৷

যে জায়গাটাতে স্লোগানের ঘটনাটা ঘটছে তার কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে একদল উৎসাহী পথচারী, কৌতূহলী মানুষ ঘটনাটা দেখছে৷ চন্দন সেই জনতার ভিড়ে গিয়ে দাঁড়াল৷ জায়গাটাতে ক্যামেরা আর বুম নিয়ে দাঁড়ানো কয়েকজন টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিককেও দেখতে পেল চন্দন৷

রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থকরা গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিচ্ছে—‘বিদিশা বারের নোংরামো বন্ধ করতে হবে’, ‘বিদিশা বার অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে,’ ‘অপরাধী ধর্ষককে আড়াল করা সরকার নিপাত যাক’, ইত্যাদি৷ স্লোগান চলতে থাকল৷ ইতিমধ্যে আরও একদল পুলিশ এসেও জমা হল সেখানে৷

চন্দন সেখানে উপস্থিত হবার মিনিট দশেক পর স্লোগান থামল৷ আন্দোলনকারীদের মধ্যে যে লোকটা নেতৃত্ব দিচ্ছে তার দিকে এবার ক্যামেরা, বুম-মাইক্রোফোন নিয়ে এগিয়ে গেল সাংবাদিকরা৷ ধুতি-পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা গোলগাল চেহারার লোকটাকে দেখেই চন্দনের মনে হল এ লোকটাকে সে যেন কোথায় দেখেছে! কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লোকটাকে চিনে ফেলল চন্দন৷ আরে এই বিদিশা বারেই তো প্রথম দিন আসার পর লোকটাকে দেখিয়েছিলেন অপূর্ব ঘোষাল৷ লোকটার নামও মনে পড়ে গেল চন্দনের৷ রাতুল ঘোষ, সরকারবিরোধী দলের ট্রেড ইউনিয়ান নেতা! শাসক দলের এক লিডারের সঙ্গে গোপন আন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে, মাল খেতে দুজনে আসে বিদিশা বারে৷ সেই রাতুল ঘোষই আজ নিজের পার্টির হয়ে বিদিশা বার বন্ধ করার জন্য বিক্ষোভ দেখাতে এসেছে!

কিছুটা তফাতে জনতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে রাতুল ঘোষের যে বক্তৃতা চন্দনের কানে এল তার মর্মার্থ হল, দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি দলের মদতে এ তল্লাটের পানশালাগুলোতে নানা ধরনের দুষ্কর্ম চলছে৷ দীর্ঘদিন ধরে রাতুলবাবুদের পার্টি এ সব ঘটনার প্রতিবাদ করছে, কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করেননি৷ আর যার ফলশ্রুতি এই বিদেশিনি ধর্ষণ৷ এর বিরুদ্ধেই আন্দোলন করার জন্য পথে নেমেছেন তাঁরা৷ এ আন্দোলন চলবে৷

সংবাদ মাধ্যমকে বাইট দেওয়া শেষ হবার পর রাতুল ঘোষ তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশে বললেন, ‘বন্ধুগণ৷ আমাদের আন্দোলন এই বিক্ষোভের মধ্যেই থেমে থাকবে না৷ চলুন আমরা ধর্মতলা অবরোধ করব৷ সরকারি ব্যর্থতার বিরুদ্ধে, দোষীদের শাস্তির দাবিতে স্তব্ধ করে দেব কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলাকে৷’

নেতার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠল তাঁর পার্টিকর্মীরা৷ উত্তেজনার আঁচ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে দেখে একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে গেলেন রাতুল ঘোষের দিকে৷ সম্ভবত তিনি রাতুল ঘোষকে তাঁর পরিকল্পনা থেকে নিরস্ত করার জন্য তাঁর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন৷ চারপাশে আবার স্লোগান শুরু হয়েছে রাতুল ঘোষ আর পুলিশকর্মীদের ঘিরে৷ রাতুল ঘোষের কথা চন্দনের কানে এসে না পৌঁছোলেও চন্দন তাঁর হাত-পা ছুড়ে কথা বলার ঢং দেখে অনুমান করল, তিনি পুলিশ অফিসারের কথা মানতে রাজি নন৷ শেষ পর্যন্ত কিন্তু পুলিশ ধর্মতলার দিকে বিক্ষোভকারীদের এগোতে দিল না৷ লোকগুলোকে এক এক করে টেনেহিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে ওঠাতে লাগল পুলিশের লোকরা৷ রাতুল ঘোষ এরপর নিজেই স্লোগান দিতে দিতে পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়লেন৷ সাংবাদিকদের ক্যামেরার ফ্লাশ বাল্ব ঝলসে উঠল তাঁর গাড়িতে ওঠার সময়৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল৷ বিক্ষোভকারীদের নিয়ে পুলিশের গাড়ি চলে যেতেই উপস্থিত সাংবাদিককুল আর কৌতূহলী জনতাও চলে গেল নানা দিকে৷ ঘটনার সাক্ষী হিসাবে শুধু রাস্তাতে পড়ে রইল কয়েকটা পতাকা, প্ল্যাকার্ড এ সব৷

চন্দন এবার কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না৷ বিদিশার ভিতর তার ঢোকা উচিত হবে কি না, ভিতরে কী ঘটছে তা তার জানা নেই৷ সামনেই একটা চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে এক ভাঁড় চা নিল সে৷

চা শেষ করে ভাঁড়টা ছুড়ে ফেলে চন্দন ভাবল সে এখন একবার অপূর্ব ঘোষালকে ফোন করবে৷ ঠিক তখনই বিদিশার দরজা একটু ফাঁক করে বেরোল অর্জুন, আর তার পিছনেই অপূর্ব ঘোষাল৷ তাঁকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে চন্দন এগোল তাঁর দিকে৷ চারপাশে একবার ভালো করে তাকিয়ে নিয়ে অপূর্ব ঘোষাল ইশারা করতেই অর্জুন এরপর কাচের দরজাটা হাট করে দিল৷ সঙ্গে সঙ্গে দুড়দাড় করে চার-পাঁচজন লোক বাইরে বেরিয়ে এদিক-ওদিক ছুটল৷ লোকগুলো যে কাস্টমার, আর এতক্ষণ বিক্ষোভের জন্য ভিতরে আটকা পড়েছিল তা বুঝতে পারল চন্দন৷ তাকে দেখতে পেয়েই বিদিশা বারের ম্যানেজার অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকুন৷ আবার হয়তো একদল এসে উপস্থিত হতে পারে৷’ এ কথা বলে তিনি অর্জুনকে নির্দেশ দিলেন, ‘তুমি শাটার নামিয়ে স্বর্গের সিঁড়ি দিয়ে ভিতরে ঢোকো৷ রমানাথ ওখানে আছে৷’

অপূর্ব ঘোষালের সঙ্গে বারের ভিতরে ঢুকে পড়ল চন্দন৷ কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওয়েটাররা৷ একপাশের একটা টেবিলে আশাবরীও বসে আছে, সবার মুখমণ্ডলেই উত্তেজনা, উৎকণ্ঠার ভাব৷ অপূর্ব ঘোষাল ওয়েটারদের উদ্দেশে বললেন, ‘পুলিশ থেকে আমাকে বলা হয়েছে আজকে বার আর খোলা না রাখতে৷ যার যা কাজ গোছানোর আছে তা শেষ করে একজন একজন করে বেরিয়ে যাও৷ একসঙ্গে বেরোবে না, বলা যায় না আরও একদল এসে ঘিরে ধরতে পারে৷ কাল সকালে আমি সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দেব বার খুলবে কি না? আর পুলিশের থেকে যদি ফোন পাও তবে তাদের সঙ্গে সাবধানে কথা বলবে৷ নইলে আমাদের প্রতি সন্দেহ বাড়তে পারে৷ কোনো সমস্যা হলে ফোন করে জানাবে আমাকে৷’

কর্মচারীদের উদ্দেশে কথাগুলো বলে চন্দনকে ডেকে নিয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে নিজের কেবিনে ঢুকলেন৷ দুজনে খাটটাতে বসার পর অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘এত চাপ আর নেওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু নিতেই হবে৷ আমার ওপরই এখন সব দায়িত্ব৷ গতকাল সন্ধ্যাতে লালবাজারে যাবার পর সেখান থেকে ছাড়া পেতে পেতে রাত এগারোটা বাজল৷ সেখান থেকে আমাকে জানানো হল আজ সকাল দশটা নয়, সকাল আটটার মধ্যে কর্মচারীদের হাজির করতে হবে সেখানে৷ সেই মতো তাদের নিয়ে হাজির হলাম সেখানে৷ ঘণ্টা চারেক সেখানে সবাইকে জেরা ইত্যাদি চলল৷ তারপর ফিরে এসে বার খোলা হল৷ কাস্টমাররাও ঢুকতে শুরু করল৷ আর তার পরই এসে হাজির হল পার্টির লোকগুলো৷ কাস্টমাররা স্বাভাবিকভাবেই ভয় পেয়ে গেছিল৷ দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে কীভাবে পালাল দেখলেন তো৷ ভাগ্যিস পুলিশকে ফোন করাতে তারা এল৷ নইলে কী হত জানি না!’

চন্দন বলল, ‘আপনার বারের কাস্টমার রাহুল ঘোষই তো বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন দেখলাম!’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখেছি৷ স্বাভাবিক নিয়মেই ব্যাপারটা নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে৷ এবং সেটা আরও বাড়বে বলেই মনে হয়৷ এই বিক্ষোভের ঘটনা তারই ইঙ্গিত৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘পুলিশ কী বলল?’

বিদিশা বারের ম্যানেজার বললেন, ‘বিক্ষোভের ঘটনা হওয়াতে পুলিশ না বলা পর্যন্ত আপাতত বার বন্ধ রাখতে বলল৷ কর্মচারীদের জেরা করে প্রাথমিক অবস্থায় তারা আমাদের দিক থেকে তেমন সন্দেহজনক কিছু পায়নি৷ সরকার যে অ্যাসিস্টেন্ট পুলিশ কমিশনার মিস্টার রেড্ডির ওপর এই ধর্ষণ কাণ্ডের তদন্তভার দিয়েছেন, সেই মিস্টার রেড্ডি লোক ভালো বলেই মনে হল৷ শুনেছি সৎ আর দক্ষ পুলিশ অফিসার হিসাবে তাঁর সুনাম আছে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে৷ এটা একটা আশার কথা৷ তিনি কখনও সবাইকে একসঙ্গে বসিয়ে, কখনও বা আলাদা আলাদা ভাবে জেরা করলেন সবাইকে৷ তিনি বললেন, বারের কর্মচারীরা যদি নির্দোষ হয় তবে পুলিশের দিক থেকে ভয়ের কোনো কারণ নেই৷ তবে সব কিছুই নির্ভর করবে পলিটিকাল সিচুয়েশনের ওপর৷’

এরপর একটু থেমে তিনি বললেন, ‘আসলে পুলিশ বা আমাদের মূল সমস্যার জায়গা অন্য৷ আটচল্লিশ ঘণ্টা হতে চলল মেয়েটার এখনও জ্ঞান ফেরেনি৷ ডাক্তাররা বলছেন এমনও হতে পারে মেয়েটা ধীরে ধীরে কোমায় চলে যেতে পারে৷ তার যদি জ্ঞান ফিরত তখন না হয় পুলিশ আমাদের কর্মচারীদের ছবি তাকে দেখিয়ে জানার চেষ্টা করতে পারত যে তাদের মধ্যেই কেউ ওই জঘন্য কাজটা করেছে কি না? কিন্তু মেয়েটা যদি সত্যিই কোমায় চলে যায় অথবা আরও খারাপ কিছু ঘটে তবে আমাদের কপালে দুঃখ আছে!’

চন্দন বলল, ‘অসহায় মেয়েটার কথা ভেবেই আমার সব থেকে বেশি খারাপ লাগছে৷ তার জ্ঞান ফিরুক৷ দ্রুত সে সুস্থ হয়ে উঠুক সেই কামনাই করি৷’

অপূর্ববাবু বললেন, ‘আমিও মনে মনে ওই একই কামনাই করে চলেছি৷ আর তা শুধু বারের কথা ভেবে নয়, মেয়েটার কথা ভেবেও৷ ওর বয়সি আমার ঘরেও তো আছে৷ আমার মেয়ে কোনো দিন আমাকে আমার কাজের ব্যাপারে কিছু বলেনি৷ কিন্তু আজ বলল ‘চাকরিটা তুমি ছেড়ে দাও বাবা৷’

হয়তো তারও মনে হচ্ছে আমার বারের কেউ ওই জঘন্য ঘটনার সঙ্গে যুক্ত৷’

চন্দন বলল, ‘কিছু সংবাদ মাধ্যম এমন ভাবে খবরটা পরিবেশন করছে তাতে এটা ভাবা স্বাভাবিক৷ মালিকের সঙ্গে আর কোনো কথা হয়েছে?’

তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, বার চারেক কথা হয়েছে ফোনে৷ তিনি ওখান থেকেই একে-ওকে ফোন করে ব্যাপারটা সামলাবার, খোঁজখবর নেবার চেষ্টা চালাচ্ছেন৷ কিন্তু অতদূরে বসে এসব কাজ কি করা সম্ভব? তার ওপর তিনি ওখানে তাঁর মাকে হাসপাতালে ভরতি করিয়েছেন৷ পুলিশও তাঁকে আবার ফোন করেছিল, আর প্রকাশ জয়সোয়ালও করেছিল৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘জয়সোয়াল লোকটা কে?’

বিদিশা বারের ম্যানেজার বললেন, ‘একটা শকুন৷ যারা এসব দুর্ঘটনার জন্য ওতপেতে বসে থাকে৷ লোকটা একজন ডেভলপার৷ শপিং মল বানায়৷ বিদিশা বার সহ পাশের প্রপার্টি কিনে নিয়ে সে এখানে একটা শপিং মল বানাতে চায়৷ পাশের অন্য দোকানের মালিক, বারের মালিকরা ব্যাপারটাতে রাজি শুধু এখনও বিদিশার মালিক রাজি হয়নি৷ জয়সোয়ালের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ মহল ও পুলিশ প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ৷ সে মালিককে বলেছে যদি মালিক তার প্রস্তাবে রাজি হন তবে সে সব ঝামেলা সামলে নেবে৷ লোকটার কাছে নাকি খবর আছে বিদিশা বারের ওপর বড় ঝড় আসতে চলেছে৷ বারের লাইসেন্স নাকি বাতিলও হতে পারে৷ আর মেয়েটার যদি খারাপ কিছু হয়ে যায় তবে মালিকের জেলও হতে পারে৷ অর্থাৎ এই দুর্বল অবস্থাতে মালিকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তার কাজ হাসিল করতে চাচ্ছে৷ আসলে এখন আমাদের ভাগ্য নির্ভর করছে৷’

চন্দন জানতে চাইল, ‘এখন আপনি কী করবেন?’

অপূর্ব ঘোষাল বললেন, ‘এখান থেকে বেরিয়ে যাব এখন৷ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করব৷ যাদের প্রশাসনের সঙ্গে, পলিটিকাল লিডারদের সঙ্গে কানেকশন আছে৷ তাদের সঙ্গে আগাম যোগাযোগ করে রাখা ভালো৷ কখন কী ঘটে যায় বলা যায় না৷ লালবাজার থেকেও জানিয়ে রেখেছে যেকোনো সময় ডাক আসতে পারে৷ সে জন্যও নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে৷’

চন্দন বলল, ‘ঠিক আছে, আমি আর এখন আপনার সময় নষ্ট করব না৷ তা ছাড়া আপনার বিশ্রামেরও প্রয়োজন৷ আমি আসলে আজ এখানে এসেছিলাম ব্যাপারটা সম্বন্ধে খোঁজ নেবার জন্য৷ এ পরিস্থিতিতে আপনারা কেমন আছেন তা জানার জন্য৷’

বিদিশা বারের ম্যানেজার বললেন, ‘তার জন্য অনেক কৃতজ্ঞতা আপনাকে৷ আজকাল কে আর কার খোঁজ রাখে? আর বিপদের সময় হলে তো কথাই নেই৷ তখন সে জায়গা থেকে দূরে থাকতে চায় সবাই৷’

চন্দন হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, তা বটে৷ তবে কী জানেন, এখানে আসতে আসতে এ জায়গার প্রতি আমার কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে৷’

অপূর্ব ঘোষাল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, মায়া অতি বিষম বস্তু৷ এই মায়াতে আটকেই আমি এ জায়গা ছেড়ে সরকারি চাকরিতে যেতে পারিনি৷ বহু বড় বড় পানশালা, রেস্তোরাঁ থেকে ডাক এসেছিল, বিদিশাকে ছাড়তে পারিনি৷’

চন্দনরা এরপর কেবিনের বাইরে বেরিয়ে এল৷ অপূর্ব ঘোষাল ভিতরের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলেন, আর চন্দন স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামল৷ রমানাথ সেখানেই দাঁড়িয়েছিল৷ সে দরজাটা একটু ফাঁক করল আর সেই ফাঁক গলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল চন্দন৷ বাসরাস্তার মোড়ে পৌঁছোতেই সে দেখতে পেল আশাবরীও সম্ভবত বাস ধরার জন্যই দাঁড়িয়ে আছে৷ চন্দনকে দেখতে পেয়েই সে এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি মালিকের লোক তা আমি জানতাম না৷ সেদিন মালিকদের সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলে ফেলেছি৷ সেটা তাকে জানাবেন না৷’

চন্দন মৃদু হেসে বলল, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন৷ আসলে আমার এক বন্ধু তার চেনা৷ মালিকের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই৷’

চন্দনের কথা শুনে আশাবরী মৃদু আশ্বস্ত হলেও, তার মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট৷ সে বলল, ‘কোথা থেকে যে কী হল বুঝতেই পারছি না৷ ম্যানেজারবাবু বলেছিলেন সামনের রবিবার বিদিশার জন্মদিন৷ সে জন্য কয়েকটা নতুন গানও তুলেছিলাম৷ এখন কবে বার খুলবে কে জানে? আর যদি সত্যিই বার বন্ধ হয়ে যায় তখন আমি সত্যিই খুব বিপদে পড়ে যাব৷’

চন্দন তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘দেখুন কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো ঝড় থেমে যাবে৷ ওই বিদেশি মেয়েটার জ্ঞান ফিরলেই ব্যাপারটার হয়তো সমাধান হয়ে যাবে৷’

কথাটা শুনে আশাবরী তার গলাতে ঝোলানো কোনো এক দেবতার ছবি দেওয়া ছোটো লকেটটা শাড়ির আড়াল থেকে বার করে মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘তাই যেন হয় ঠাকুর, তাই যেন হয়৷ সুস্থ হয়ে উঠুক মেয়েটা৷’

তাকে দেখে চন্দনের ঠিক এই মুহূর্তের জন্য মনে হল, আশাবরী যেন ঠিক মদের আসরের রাতপরি নয়, অতি পরিচিত সাধারণ কোনো মেয়ে, যে তার পরিবারকে ভালোবাসে, স্বামীকে ভালোবাসে৷ সে শঙ্কিত, বিদিশার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি তার পরিবারে আরও অর্থনৈতিক অনটন নেমে আসে সে জন্য৷

আর এরপরই শিয়ালদা যাবার একটা বাস এসে গেল৷ চন্দন উঠে পড়ল তাতে৷